মগধের সাহিত্য
১০০ বছর আগে, ১৯২০ সালের ডিসেম্বর থেকে ১৯২১এর এপ্রিল অব্দি
মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছ’টি বক্তৃতা দিয়েছিলেন এবং ১৯২৩ সালে পাটনা বিশ্ববিদ্যালয় সেই
বক্তৃতা ক’টি পুস্তকাকারে প্রকাশ করেছিল।
‘মগধের সাহিত্য’ শীর্ষক এই বক্তৃতামালায়
বক্তৃতা সংখ্যা ১ ছিল ‘মগধের মূল
অধিবাসী’, বক্তৃতা সংখ্যা ২ ছিল ‘পাটলিপুত্র – ভারতের মেধাজগতের রাজধানী’, বক্তৃতা সংখ্যা ৩ ছিল
‘কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের ঐতিহাসিক শিক্ষা’, বক্তৃতা সংখ্যা ৪ ছিল ‘বাৎস্যায়নের কামসূত্র’, বক্তৃতা সঙ্খ্যা ৫ ছিল ‘বাৎস্যায়ন ভাষ্য’ এবং বক্তৃতা সংখ্যা ৬ ছিল ‘বাণভট্ট এবং আর্য্যভট্ট’।
বক্তৃতা সংখ্যা ৬
বাণভট্ট এবং আর্য্যভট্ট
খ্রিষ্টযুগের পঞ্চম
শতকে যখন গুপ্তরা প্রায় পুরো ভারতের অধিপতি ছিল, বাৎস্যায়ন পরিবারে কুবের নামে সুবিখ্যাত
এবং সুগভীর জ্ঞানসম্পন্ন একজন বৈদিক পণ্ডিত ছিলেন। তিনি নিজের সময়ের সব রকম বিজ্ঞানে
বিশারদ ছিলেন এবং সব ধরণের বলিদানে বিশেষজ্ঞ ছিলেন। তাঁর চার পুত্র ছিলেন যাদের মধ্যে
কনিষ্ঠতম ছিলেন পশুপতি। পশুপতির পুত্র ছিলেন অর্থপতি যিনি অসংখ্য বলিদান সম্পন্ন করেছিলেন
এবং অর্থপতির পুত্র ছিলেন চিত্রভানু যিনি বিদ্যার্জনে ও ধর্মানুরাগে পিতৃপুরুষদের সুনাম
বজায় রেখেছিলেন।১ চিত্রভানুর পুত্র ছিলেন বাণ। বাণ নিজের মাতাকে শৈশবেই
হারান২ এবং চোদ্দ বছর বয়স হতে হতে পিতাদের হারান।৩ নিজের পরিবারেই
বাণ শিক্ষা গ্রহণ করেন, কিন্তু কালে কালে অবাধ্য হয়ে ওঠেন, অরাজক জীবন কাটাতে শুরু
করেন। যাত্রায় বেরোন; উত্তর ভারতে সফরের সময় নর্ত্তক, অভিনেতা, সঙ্গীতজ্ঞ, প্রব্রাজিকা
সম্বলিত তাঁর বড় সড় এক অনুগামীবৃন্দ জোটে। যদিও লোকেরা তাঁর পাণ্ডিত্যের প্রশংসা করত,
নিজের দিনযাপনের ধরণধারণে তিনি ব্রাহ্মণ্য শুদ্ধতা বজায় রেখে চলতেন এমন সুনাম তাঁর
ছিল না।৪ যাহোক, কিছু বছর বন্য জীবন কাটিয়ে নানা স্থানে ঘোরার পর তিনি সংযত
হয়ে ওঠেন। বাড়ি ফিরে তিনি বাৎস্যায়ন পরিবারের প্রধানের স্থান গ্রহণ করেন। সে পরিবারে
তখন অনেক বিদ্বান এবং সুসংস্কৃত ব্রাহ্মণ ছিলেন। বাণ শ্রৌত এবং স্মার্ত বৈদিক বলিদান
অনুষ্ঠানে এবং নানা রকম চারুকলায় দারুণ আনন্দ পেতেন।৬ এক অপরাহ্নে, যখন
সারাদিনের কাজের পর তিনি শোণ নদীর শীতল বাতাস উপভোগ করছিলেন, এক অশ্বারোহী সেখানে পৌঁছোয়।
ঘোড়ার পিঠ থেকে নামার পর বাণের নিচু-জাতের ভাই চন্দ্রসেন ওই অশ্বারোহীকে বাণের কাছে
নিয়ে আসে। সে লোকটি নিজের পাগড়ি৭ খুলে বাণের হাতে একটা চিঠি দেয়। বাণ একান্ত
মনোযোগে চিঠিটা পড়েন, কেননা সেটি লিখেছিলেন কৃষ্ণগুপ্ত, থানেশ্বরের হর্ষবর্দ্ধনের প্রধানমন্ত্রী।
কৃষ্ণগুপ্ত চিঠিতে বাণকে ইঙ্গিত করেন যে মহান সম্রাটের সঙ্গে দেখা করতে চেয়ে আর্জি
করার এটাই প্রশস্ত সময়।৮ পরের সকালে বাণ যাত্রার জন্য প্রস্তুত হন এবং কয়েক
দিনে সেখানে পৌঁছোন যেখানে সম্রাট শিবিরে ছিলেন।৯ অনেকখানি জায়গা নিয়ে ছিল
সেই শিবির এবং বাণ তার যেমন প্রাণবন্ত ও পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা করেছেন তেমন বর্ণনার
জন্য যে কোনো যুগের যে কোনো দেশের কবি সম্মানিত হতে বাধ্য।
সম্রাটের দরবারে
পৌঁছে বাণ দেখেন কৃষ্ণগুপ্ত সম্রাটের সঙ্গে সরকারি বিষয়ে কথা বলছেন। বাণকে ইশারায় তিনি
কাছাকাছি শান্ত ভাবে বসে থাকতে বলেন। সম্রাট আর কৃষ্ণগুপ্তর আলোচনা লম্বা চলল এবং সবটাই
ফিসফিসিয়ে। বাণ খুবই বিরক্ত হচ্ছিলেন। যাহোক, আলোচনার পর কৃষ্ণগুপ্ত সম্রাটের সঙ্গে
বাণের পরিচয় করিয়ে দেন। সম্রাট সংক্ষিপ্ত মন্তব্য করেন, “মহানয়ং ভুজঙ্গঃ।”১০ সে মন্তব্য বাণকে সবচেয়ে বেশি খেপিয়ে দেয়।
শব্দটার মানে শুধু সাপ নয়, ‘ফুলবাবু’ বা ‘নারীদের প্রিয়’। বাণ ভাবছিলেন যে তাঁর যাত্রাকালের আচার-আচরণের জন্য রাজা তাঁকে
খিস্তি করছেন। কিন্তু কৃষ্ণগুপ্ত শিগগিরই বাণের রাগ কমানোর সুযোগ পেয়ে গেলেন এবং কিছুক্ষণের
মধ্যেই হর্ষ এবং বাণ বন্ধু হয়ে গেলেন। সম্রাটের দরবারে বাণ উচ্চস্থানে নিয়োজিত হলেন
এবং তিনি বেশ প্রসন্ন হলেন।১১
শিবিরে সম্রাটের
সঙ্গে অনেকদিন কাটিয়ে বাণ নিজের পরিবারে ফেরার জন্য চিন্তিত হয়ে উঠলেন এবং জন্মস্থানে
ঘুরে আসার অনুমতি আদায় করলেন।১২ বাড়িতে এসে দেখলেন পুরো পরিবার প্রতি সন্ধ্যায়
প্রভমান-প্রোক্ত পুরাণ ১৩-এর আবৃত্তি শুনতে ব্যস্ত। পুরাণের আবৃত্তিকার
প্রতি সন্ধ্যায় আসেন, খেজুরপাতার একটি পাণ্ডুলিপি খোলেন, তা থেকে দীর্ঘ কিছু অংশ পড়েন
এবং গোধুলির আগে নিজের সান্ধ্য প্রার্থনা বলতে চলে যান। মনোযোগী শ্রোতাদের মধ্যে বাণের
চারজন খুড়তুতো ভাইবোন ছিল। তাদের একজন, পুরাণে প্রাচীন রাজাদের ইতিহাস শোনার পর মন্তব্য
করল, “প্রাচীন এই রাজাদের রাজত্ব কত ছোট, তবুও পুরাণ
তাদের কৃতিত্ব ও গুণাবলীর এত বিশদে লিপিবদ্ধ করে। আমাদের সম্রাট হর্ষর রাজত্ব তো বিরাট!
এবং তিনি এত গুণবান আর জনপ্রিয়! বাণ! তুই তাঁর কাজের বর্ণনা করে একটা পুরাণ লিখিস না
কেন?” বাণ সম্মতিতে মাথা নাড়লেন আর হর্ষচরিত লিখতে
শুরু করলেন।১৪
এভাবেই সপ্তম শতকের
প্রথম দিকের বছরগুলোয় ভারতে ঐতিহাসিক সাহিত্য রচনা শুরু হল। শুরুতে খুব ফলপ্রসূ না
হলেও এখন সে সাহিত্যের সর্বোত্তম ফসল ফলতে শুরু করেছে। শুরুতে ফলপ্রসূ না হওয়ার একটা
কারণ এই দুর্ভাগ্যজনক তথ্য যে বাণ তাঁর কাজ শেষ হওয়ার আগেই গত হলেন। যদি তিনি তাঁর
সতেজ ও অননুকরণীয় শৈলীতে রচনাটি শেষ করতে পারতেন, অন্যান্যরা নিশ্চয়ই তাঁকে অনুসরণ
করত। বাণ যেহেতু শেষ করতে পারলেন না, লোকে ভাবল ইতিহাস একটি অশুভ বিষয়; সবরকম ভাবে
এড়িয়ে চলল। একই ঘটনা ঘটল ‘কথা’ সাহিত্যের ব্যাপারে। বাণ ‘কাদম্বরী’ শুরু করলেন কিন্তু শেষ করতে পারলেন না। যদিও তাঁর যোগ্য পুত্র ভুষণ
সেটা শেষ করলেন, কিন্তু ‘কথা’ সাহিত্য তাই উন্নতি লাভ করল না।
বাণ-এর হর্ষচরিত
সংস্কৃতে লিখিত প্রথম ঐতিহাসিক রচনা। প্রাচীন ভারতে ইতিহাস ছিল এবং আমি আগেই আপনাদের
বলেছি যে ইতিহাস পঞ্চম বেদ পরিগণিত হত। কিন্তু সে সময়ের কোনো ঐতিহাসিক রচনা আমরা পাই
না। একটাই জিনিষ পাই – ভারতে যারা শাসন
করেছিল সেসব বিভিন্ন রাজবংশের রাজাদের নামের সূচী। শুধু মগধে আমরা নামের সঙ্গে রাজত্বকালেরও
হিসাব পাই। মি. পারগিটার যিনি বিষয়টি নিয়ে যত্নের সঙ্গে অন্বেষণ চালিয়েছেন, বলেন যে
সূচীগুলো প্রাকৃতে সংরক্ষিত ছিল। সে যাই হোক, যাঁরা বাণকে হর্ষচরিত লিখতে উৎসাহিত করেছিলেন,
নিঃসন্দেহে ভেবেছিলেন যে তাঁরা নতুন কিছু করতে বলছেন। তাঁরা বাণকে এক আধুনিক রাজার
জন্য সেই কাজ করতে বলেছিলেন যে কাজ পুরাণসমূহ প্রাচীন রাজাদের জন্য করেছিল আর বাণ,
উনিশ বা বিশ শতকের ইতিহাসবিদের মেজাজ ও মনন নিয়ে কাজটা করলেন। তিনি নিজের গোত্রের ইতিহাস
দেন, তারপর পঞ্চম প্রজন্ম অব্দি তাঁর পূর্বপুরুষদের ইতিহাস এবং নিজের আত্মজীবনী। এটাও
বলেন যে কী তাঁকে সেই রাজার ইতিহাস লিখতে প্ররোচিত করল যাঁর তিনি সেবক। নিজের জীবনকাহিনী
লিখতে গিয়ে তিনি নিজেকে নিষ্কলঙ্ক ব্যক্তি হিসেবে পেশ করেন না। তিনি যা ছিলেন, নিজের
কোনো দোষ না লুকিয়ে তাই তিনি লেখেন। তিনি তাঁর রাজার অনুরক্ত প্রশংসক ছিলেন কিন্তু
তাঁর দোষ তিনি লিখতে ছাড়েন না। প্রকৃত ইতিহাসবিদের মানসিকতা নিয়ে তিনি রাজার বংশের
ইতিহাস লেখেন। প্রভাকরবর্দ্ধন, রাজ্যবর্দ্ধন এবং হর্ষবর্দ্ধনের বিষয়ে তিনি যা বলেন
সেগুলো আধুনিককালে রচিত ভারতবর্ষের ইতিহাসের অতিপরিচিত তথ্য কেননা সেসব তাঁরই দেওয়া
ঐতিহাসিক খোঁজখবর থেকে নেওয়া। খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতকের শুরুতে ভারতীয় জীবনের ওপর প্রভূত
আলোকপাত করে গ্রন্থটি।
বাণ-এর কাদম্বরী
একটি আখ্যায়িকা, কিন্তু বিস্ময়কর আখ্যায়িকা। কাহিনীর কাল তার বেশ কয়েকটি পাত্রের তিন
জন্মে বিস্তৃত; কাহিনীতে এমন শব্দ আছে যা তিন চার পংক্তি দীর্ঘ এবং এমন বাক্য আছে যা
চার পাঁচ পৃষ্ঠা দীর্ঘ। আমার একজন শিক্ষক গ্রন্থটির পুরোনো আর ছোটো টাইপে ছাপা এক সংস্করণের
একটি বাক্য সুতো দিয়ে মেপেছিলেন। সুতোটা ৩৬ ফুট লম্বা ছিল। কাদম্বরী লৌকিক এবং অলৌকিকের
অদ্ভুত মিশ্রণ। চাঁদ এক জন্মে তারাপীড়, উজ্জয়িনীর রাজপুত্র হয়ে যায়, অন্য জন্মে শূদ্রক,
বিদিশার রাজা। পুণ্ডরীক, লক্ষীর পুত্র এক জন্মে বৈশম্পায়ন আবার অন্য জন্মে টিয়াপাখি
হয়ে যায়। অনেক দিক থেকে আখ্যানটির মিল পাওয়া যায় পালি বৌদ্ধ কাহিনী শ্যামাবতীর সঙ্গে;
তিরিশ বছর আগে চট্টগ্রাম থেকে দ্বিতীয় গ্রন্থটির বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। এই
কাহিনীও আত্মার অনেকগুলো দেহান্তর ধরে চলে। কাদম্বরীর গল্প, গল্পের অফুরান উৎস গুণাঢ্য-এর
বৃহৎকথা থেকে নেওয়া। বৃহৎকথা এখন অপ্রাপ্য কিন্তু তার প্রতিনিধিত্ব করে সোমেশ্বর-এর
কথা-সরিত-সাগর। বাণ-এর আর একটিমাত্র রচনা জ্ঞাত – চণ্ডীশতক১৫ যাতে দেবী দুর্গার ওপর একশটি পদ্য আছে। সে
সময় তিনটি শতক লেখা হয়েছিল। বাণ-এর এই একটি, তাঁর শ্বশুর ময়ূর রচিত সূর্য্যশতক এবং
মানতুঙ্গ রচিত ভক্তামরস্ত্রোত্র – তিনটি শতক হর্ষের
রাজধানীতে পাশাপাশি চলা তিনটি মহান ধর্মের প্রতিনিধিত্ব করে।
বাৎস্যায়ন, চিকিৎসক
পঞ্চতন্ত্রে দুজন
চিকিৎসকের নাম আছে, (১) শালিহোত্র এবং (২) বাৎস্যায়ন।১৬ অশ্বশাস্ত্রের রচয়িতা
শালিহোত্র পশ্চিম পাঞ্জাবের বাসিন্দা ছিলেন। কিন্তু বাৎস্যায়ন নিশ্চিতভাবেই শোণ নদীর
তীরে বাসরত প্রীতিকূট-এর পরিবারের একজন ছিলেন। মধুসূদন সরস্বতী তাঁর প্রস্থানভেদ-এ
বলেন যে কামসূত্র আয়ুর্বেদের অংশ। এ থেকে ওয়েবার মনে হয় ভাবেন যে পঞ্চতন্ত্র-এ উল্লিখিত
চিকিৎসক বাৎস্যায়ন এবং কামশাস্ত্রের লেখক একই ব্যক্তি। শুধুমাত্র নামোল্লেখ থেকে কোনো
অনুমান করা যায় না। কিন্তু আমি ভাবতে প্রবৃত্ত হই যে বাৎস্যায়নের পরিবারে একজন চিকিৎসক
থেকে থাকতে পারেন, কেননা গোত্রটি বিদ্বানে পরিপূর্ণ এবং বিস্তৃত ছিল, এবং মগধে অনেক
শতক যাবত তাদের প্রভাব ছিল। খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতকে খুসরু নৌসেরবনের আদেশে পঞ্চতন্ত্র
পহলবি ভাষায় অনুদিত হয়েছিল। বিশ শতকে আমরা যা জানি বা এমনকি সপ্তম শতকে বাণ যা জানতেন,
বাৎস্যায়ন পরিবারের বিষয়ে তা থেকে অনেক বেশি জানতেন পঞ্চতন্ত্রের লেখক। মধুসূদন সরস্বতী
কর্তৃক কামশাস্ত্রের আয়ুর্বেদে অন্তর্ভুক্তি, শাস্ত্রটির অধ্যয়নে আধুনিক অবজ্ঞার প্রতিফল।
আধুনিক সময়ে কামশাস্ত্রের অর্থ শুধুমাত্র আসঙ্গ-এর এবং কামোদ্দীপক ঔষধির শাস্ত্র।
কিন্তু প্রাচীন কালে এর ব্যাপকতর অর্থ ছিল। এর অর্থ ছিল পাঁচশো আঠেরোটি চারুকলা, বস্তুতঃ
সে সমস্ত কিছু, মানবজীবনকে সহনীয় ও সুখকর করতে যার অবদান ছিল। সবচেয়ে ভালো ধরণের গার্হস্থ্য
এবং সামাজিক বিধিবিধানও ওই শাস্ত্রের অন্তর্ভুক্ত ছিল।
প্রাচীন কামশাস্ত্র
শাস্ত্রের চারটি স্বীকৃত বিভাগের একটি এবং ধর্মশাস্ত্র, অর্থশাস্ত্র ও মোক্ষশাস্ত্র-এর
সমগোত্রীয় ছিল। মধুসূদন সরস্বতী যেভাবে এটিকে আয়ুর্বেদের শাখা বলে দিলেন, প্রাচীন কালে
পঞ্চতন্ত্রের লেখক সেভাবে বলার ঝুঁকি নিতে পারতেন না। যখন নাকি খোদ আয়ুর্বেদ অথর্ববেদের
উপবেদ আর অথর্ববেদ ধর্মশাস্ত্রের অন্তর্গত।
সুবন্ধু
আমি মনে করি সুবন্ধু
গুপ্ত সম্রাটদের শাসনাধীন মগধের বাসিন্দা ছিলেন। তাঁর জীবনকাল নিয়ে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের
ফিটজেওয়ার্ড হল এবং মি. গ্রে যা কিছু জল্পনা করেছেন সেগুলো বিশেষ কাজে দেয় না। এশিয়াটিক
সোসাইটি অফ বেঙ্গলের জার্নাল এ্যান্ড প্রসিডিংসএর নতুন সিরিজের ভলিউম ১এর ২৫৩ সংখ্যক
পৃষ্ঠায় আমি লিখেছিলাম –
শৈলীর শ্রেষ্ঠত্ব
নিয়ে আলোচনায় বামন, খ্রিষ্টীয় নবম শতকে রচিত তাঁর কাব্যালঙ্কারসূত্রবৃত্তিতে, শ্রেষ্ঠত্বের
উদাহরণ হিসেবে ‘সাভিপ্রায়ত্ব’ নামে একটি পদ্য উদ্ধৃত করেন।
পদ্যটি বা শ্লোকার্থটি
এরকম –
সোয়ম সম্প্রতি চন্দ্রগুপ্ততনয়শ
চন্দ্রপ্রকাশোযুবা
জাতো ভূপতিরাশ্রয়ঃ
কৃতধিয়াম দিষ্ট্যা কৃতার্থশ্রমঃ
(চন্দ্রগুপ্তের পুত্র,
তরুণ রাজা চন্দ্রপ্রকাশ এখন বিদ্বান মানুষদের আশ্রয় হয়ে উঠেছে এবং সৌভাগ্যবশতঃ তার
প্রচেষ্টা সফল হয়েছে।)
এর ওপর টিপ্পনী করতে
গিয়ে লেখক বলেন যে “বিদ্বান মানুষদের আশ্রয়” শব্দগুলো গুরুত্বপূর্ণ কেননা ওগুলো মনে করায় যে চন্দ্রপ্রকাশের
একজন মন্ত্রী সুবন্ধু। গুপ্ত রাজবংশে দুজন চন্দ্রগুপ্ত ছিলেন। দুজনকেই বিক্রমাদিত্য
বলা হত। প্রথমজন সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন এবং দ্বিতীয়জন তাঁর পৌত্র। দ্বিতীয়
চন্দ্রগুপ্ত বিদ্বান মানুষদের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। এটাই কি সম্ভাব্য নয় যে সুবন্ধু তাঁরই
এক পুত্র চন্দ্রপ্রকাশের সেবায় ছিলেন?
ভারতীয় পুরাতত্ত্বে
এদিকের বছরগুলোয় একটা বিবাদ উঠেছিল যাতে “চ সুবন্ধু” শব্দদুটোকে “বিশ্ববন্ধু” করার চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু মি. নরসিংহ চেরিয়ার অনেক পাণ্ডুলিপি
ঘেঁটে দেখিয়েছিলেন যে কথাটা চ সুবন্ধু, বিশ্ববন্ধু নয়। কাজেই আমার তত্ত্বটা
প্রমাণিত হয় যে সুবন্ধু দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত এবং তার পরবর্তী রাজত্বে ছিলেন। একটাই
যুক্তি এই তত্ত্বের বিরুদ্ধে খাড়া করা যেতে পারে যে সুবন্ধু এক জায়গায় লেখেন ন্যায়স্থিতিরিব
উদ্যোতকরসবস্ব ১৭ এবং তার অর্থ সুবন্ধু, ন্যায়বার্ত্তিকের লেখক উদ্যোতকরকে
জানতেন, যে উদ্যোতকর, বাচস্পতি মিশ্র বলেন, দিঙনাগের১৮ আক্রমণের বিরুদ্ধে
বাৎস্যায়নকে সমর্থন করেছিলেন। কিন্তু এখন অব্দি জ্ঞাত তথ্য অনুযায়ী দিঙনাগ এবং উদ্যোতকরের
সময় চন্দ্রগুপ্ত ২এর পর। কিন্তু আমার মনে হয় এই প্রশ্নগুলোকে খোলা রাখা উচিৎ। এই তথ্যটা
অস্বীকার করা যায় না যে সুবন্ধু চন্দ্রগুপ্ত ২এর পুত্র চন্দ্রপ্রকাশের অধীনে কাজ করেছিলেন
এবং নিজের রচনা বাসবদত্তার মুখবন্ধে সুবন্ধু পরিতাপ করেন যে বিক্রমাদিত্যের১৯
(চন্দ্রগুপ্ত ২) মৃত্যুর পর দুনিয়া উচ্ছন্নে যাবে। খল অথবা ঈর্ষান্বিত মানুষদের
প্রতি তিনি তিক্ত২০, এবং আমার মনে হয় তারাই তাঁর পৃষ্ঠপোষক চন্দ্রপ্রকাশ
এবং তাঁর বিনাশের কারণ হয়েছিল।
তাঁর রচনার পটভূমি
একেবারেই নিরস এবং লেখক মনে হয় সেটা ভ্রুক্ষেপ করেন না। তিনি শুধু তাঁর শ্লেষগুলোর
খেয়াল রাখেন এবং শ্লেষালঙ্কার প্রয়োগে তিনি যে দক্ষতা দেখিয়েছেন তা এখনো অতুলনীয়। তিনি
নিজের শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে সচেতন ছিলেন এবং যেহেতু মুখবন্ধ সেই রচনার পর লেখা হয় যে
রচনার সেটি মুখবন্ধ, তাই মুখবন্ধে তিনি নিজের রচনার সমালোচনা করেন। সেই সমালোচনা পরবর্তী
সব সমালোচকেরাও অনুমোদন করেছে –
সরস্বতীদত্তবরপ্রসাদঃ
চক্রে সুবন্ধুঃ সুজনৈকবন্ধুঃ
প্রত্যক্ষরশ্লেষময়প্রবন্ধ
বিনয়াসবৈদগ্ধ্যনিধির্নিবন্ধম।২১
যেমন তিনি বলেন,
প্রতিটি অক্ষরে একটি শ্লেষ আছে। গল্প খুব সহজে বলা।
চিন্তামণির পুত্র
কন্দর্পকেতু, এক রাজা, সকালে স্বপ্নে এক অনন্য সুন্দরী কন্যাকে দেখে তাকে খুঁজতে বেরিয়ে
যায়। বিন্ধ্য পর্বতে সে এক বিশাল বৃক্ষের প্রসারিত শাখার নিচে ঘুমিয়ে পড়ে। মাঝরাতে
ঘুম ভাঙলে সে একটি টিয়া এবং তার সঙ্গীর ঝগড়া শোনে। স্ত্রী টিয়াটি পুরুষ টিয়া দেরি করে
এসেছে বলে ক্রুদ্ধ এবং পুরুষ টিয়া কৈফিয়ত দিতে আমতা আমতা করে – “আমি পাটলিপুত্রে
গিয়েছিলাম। সেখানে রাজার কন্যা বাসবদত্তার স্বয়ম্বর ছিল। কিন্তু রাজকন্যা সেখানে আসা
সব রাজপুত্রদেরকে খারিজ করে দিল। সে স্বপ্নে দারুণ সুন্দর এক যুবককে দেখেছিল তাই নিজের
সখীকে তার সন্ধানে পাঠালো। আমি সেই সখীকে নিয়ে এসেছি।” অসীম কৌতূহলে কন্দর্পকেতু উঠে তরুণীটিকে দেখতে পেল। তরুণীটি কন্দর্পকেতুকে
বাসবদত্তার কাছে নিয়ে গেল। সেখানে তারা জানতে পারল যে রাজা পরের দিনই অন্য কারোর সঙ্গে
বাসবদত্তার বিয়ে দেবেন। তাই তারা পালিয়ে গেল এবং বিন্ধ্য পর্বতে একটি লতাকুঞ্জে লুকিয়ে
পড়ল। কিন্তু রাজপুত্র যখন সকালে জাগল, দেখল বাসবদত্তা নেই। সে বহু জায়গায় ঘুরল এবং
অবশেষে একটি পাথরের মুর্তি পেল – তার আকৃতি ঠিক তার
প্রিয়তমার মত। সে মুর্তিটা স্পর্শ করল আর ঐ তো! বাসবদত্তা! সে নিজের বিপজ্জনক অভিজ্ঞতা
রাজপুত্রকে শোনালো। রাজপুত্র যাতে সকালে উঠে কিছু খেতে পায় সেই চিন্তায় সে শিকড় আর
ফলের খোঁজে জঙ্গলে গিয়েছিল। সেখানে তাকে বন্যগোষ্ঠির একটা দল আক্রমণ করে। সৌভাগ্যবশতঃ
পাশেই আরেকটি বন্যগোষ্ঠির দল ছিল। দুই দল নিজেদের মধ্যে তাকে পাওয়ার জন্য লড়াই করে।
দুই দলেরই বিনাশ হয়, কিন্তু তখনই এক ঋষি আসেন যাঁর আশ্রম ঐ বন্যগোষ্ঠির দল নিজেদের
লড়াইয়ে ধ্বংস ছিল। ঋষি ভাবেন যে মেয়েটিই ধ্বংসের কারণ, তাই তিনি তাকে পাথর হয়ে যাওয়ার
অভিশাপ দেন। বাসবদত্তা ঋষিকে মিনতি করে যে তিনি যেন রাগ না করেন, যে সে নির্দোষ। ঋষি
বলেন, অভিশাপ তখনই যাবে যখন সেই রাজপুত্র তাকে স্পর্শ করবে যাকে সে ভালোবাসে। এখানেই
গল্প শেষ হয় এবং দুজনে রাজপুত্রের পিতার রাজধানীতে ফিরে আসে। সেখানে তারা সুখে সমৃদ্ধিতে
জীবন অতিবাহিত করে।
আর্য্যভট
পাটলিপুত্র আরেকজন
মহান মানুষের জন্মস্থান ছিল। তিনি আর্য্যভট, হিন্দুদের বৈজ্ঞানিক জ্যোতির্বিদ্যা এবং
গণিতের পিতা। খ্রিষ্টাব্দ ৪৭৬এ তাঁর জন্ম হয় এবং এখানেই তিনি ২৩ বছর বয়সে, অর্থাৎ খ্রিষ্টাব্দ
৪৯৯এ নিজের কৃতি, কালক্রিয়াপাদ রচনা করেন।২২ তিনি গ্রীসীয় জ্যোতির্বিদ্যার
ছাত্র ছিলেন। যে অদ্বিতীয় অঙ্কপাতন তাঁর নামে চলে এবং যেটি তিনি তাঁর দশগীতিকায় দেন,
গ্রীসীয় প্রণালীর একটি অভিযোজন মনে হয়। ক থেকে ম অব্দি ব্যঞ্জনবর্ণের মূল্য ১ থেকে
২৫ ধার্য হয় এবং আটটি স্বরবর্ণের – ই, উ, ঋ,
এ, ৯, ঐ, ও, ঔ – প্রত্যেকটি ১০০র গুণিতকের রূপ নেয়। ফলে ক
হয় ১, কি হয় ১০০, কু হয় ১০,০০০, কৃ হয় ১০,০০,০০০, ক্লি হয় ১০,০০,০০,০০০, কে হয় ১০,০০,০০,০০,০০০,
কৈ হয় ১০,০০,০০,০০,০০,০০০। এটি গ্রীসীয় প্রণালীর পরিবর্তিত রূপ।
আর্য্যভটের একটি
রচনাকে দশগীতিকা বলা হয়। কেননা এতে
গীতিকা ছন্দে দশটি পদ্য আছে; গীতিকা ছন্দটি আর্য্য ছন্দের পরিবর্তিত রূপ। তাঁর অন্য
রচনা আর্য্যসিদ্ধান্তিকে ১০৮টি পদ্য আছে এবং সেটি তিন ভাগে বিভক্ত – কালক্রিয়াপাদ, গোলপাদ এবং গণিতপাদ। এই দুই রচনায়, যার মোট আয়তন
১১৮টি পদ্যের বেশি নয়, আর্য্যভট হিন্দু জ্যোতির্বিদ্যার পুরো প্রণালীটার ব্যাখ্যা করেছেন।
তিনি এমনকি দার্শনিক সূত্রগুলো থেকেও বেশি সংক্ষিপ্ত, এবং গদ্যে লিখিত, অত্যন্ত শব্দবহুল
জ্যোতির্বিদ্যা-সংক্রান্ত সিদ্ধান্তগুলো থেকে অদ্ভুতভাবে, একেবারেই বিপরীত।
আর্য্যভটের যুগ নিয়ে
একটা বিবাদ আছে মনে হয়। পশ্চিম মালবে মালব যুগ ছিল, গুপ্ত সাম্রাজ্যে গুপ্ত যুগ ছিল,
সে ছাড়া শক যুগ, কলচুরি যুগ ইত্যাদি … সব স্থানীয়
এবং জনগোষ্ঠিগত যুগ ছিল। হিন্দুদের মধ্যে তাঁর রচনাগুলোর উপযোগিতা সর্বজনীন। কোন যুগের
সঙ্গে সেগুলোকে সম্পর্কিত করবেন সেটা একটা সমস্যা। তাই তিনি সবার পরিচিত কলিযুগের নাম
নিলেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে ভারতের সব জ্যোতির্বিদেরাই সে যুগের নাম শক যুগ স্বীকার
করে নিয়েছে। কারণটা খুব দূরের নয়। ভারতে শকদ্বীপী ব্রাহ্মণ বা সিথিয়ান যাজকশ্রেণীই
– প্রাচীন ম্যাগি-প্রসঙ্গ (পূর্বদেশের তিন জ্ঞানী
যাঁরা সদ্যজাত শিশু যীশুর জন্য নৈবেদ্য এনেছিলেন) – একচেটিয়া না হোক, সাধারণভাবে জ্যোতির্বিদ্যা এবং জ্যোতিষশাস্ত্র
অধ্যয়ন এবং অধ্যাপনা করত। তারা ভারতবর্ষে বহুকাল ধরে বসবাস করছিল। ব্রাহ্মণ বা বৌদ্ধ,
কেউই জ্যোতিষীদের সমর্থন করত না। বুদ্ধ স্পষ্টভাবে সম্যক আজীব বা প্রকৃত জীবিকা থেকে
জ্যোতিষশাস্ত্রকে বহিষ্কৃত করেছিলেন।
বলা হয় যে আর্য্যভট
পৃথিবীর দৈনিক গতি২৩ আবিষ্কার করেছিলেন। তাঁর ধারণা ছিল পৃথিবী বর্তুল।
এসব বৈজ্ঞানিক বিষয়ের ব্যাখ্যা আমরা তাঁদের ওপর ছেড়ে দিই যাঁরা হিন্দু জ্যোতির্বিদ্যা
নিয়ে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানে ব্যাপৃত আছেন। কিন্তু একটা ব্যাপার নিশ্চিত যে প্রায় এই
সময়েই নক্ষত্র-অনুধাবনের পুরোনো কৃত্তিকা শৃংখলা পরিত্যক্ত হয়েছিল এবং অশ্বিনীর প্রথম
বিন্দু থেকে শুরু হওয়া নতুন শৃংখলা গৃহীত হয়েছিল। অশ্বিনীর প্রথম বিন্দু ৭৩ বছরে এক
ডিগ্রি বা এক দিন অপসৃত হয়, এবং এখন অব্দি কুড়ি দিন অপসৃত হয়েছে। কাজেই মোট সময় হল
২০ x ৭৩, অর্থাৎ ১৪৬০ বছর। বিন্দুটি বিষুবীয় বৃত্তে বৈশাখের প্রথম দিনে ছিল আর এখন
চৈত্রের ১০ তারিখে আছে। অতএব বিন্দুটি সেখানে ১৪৬০ বছর আগে দেখা গিয়েছিল। ১৯২১ থেকে
১৪৬০ বাদ দিলে হয় ৪৬১ খ্রিষ্টাব্দ। এটা নিছক আনুমানিক গণনা। নিখুঁত গণনা করলে সময়টা
আর্য্যভটের জীবনের সক্রিয় বছরগুলোর মধ্যে পড়বে।
আর্য্যভটের অনেক
ছাত্র ছিল। তার ঠিক পরবর্তী উত্তরাধিকারী লল্লও তাঁর ছাত্র ছিলেন। কয়েকজন বলে যে বরাহমিহিরও
তাঁর ছাত্র ছিলেন।২৪
আরেকজন সুপ্রসিদ্ধ
জ্যোতির্বিদ ছিলেন, আর্য্যভটের সমকালীন। বরাহমিহির। তাঁর বৃহজ্জাতকের ২৬তম অধ্যায়ে
তিনি বলেন যে তিনি আদিত্যদাসের পুত্র, একজন আবন্তক, তাঁর জ্ঞান তিনি নিজের পিতার কাছ
থেকে পেয়েছেন এবং কাম্পিল্লক অথবা কপিত্থকে সূর্য-দেবের কাছ থেকে তিনি একটি গ্রন্থ
পেয়েছেন। ভট্টোৎপল বলেন যে বরাহমিহির একজন মাগধ দ্বিজ। কয়েকজন বলে যে তিনি মগদ্বিজ,
অর্থাৎ, বহুকাল ধরে ভারতে বসবাসকারী ম্যাগিদের একজন। এসব কিছু থেকে স্বর্গীয় পণ্ডিত
সুধাকর দ্বিবেদী তাঁর গণকতরঙ্গিনীতে অনুমান করেন (পৃ.১২), অসম্ভব নয় যে বরাহ মাগধ ব্রাহ্মণ
ছিলেন। জীবিকার সন্ধানে তিনি হয়ত উজ্জৈনে গিয়েছিলেন। তিনি মগধে তাঁর নিজের বাড়িতে বাবার
কাছে পড়াশোনা করেছিলেন এবং সেখানে আর্য্যভটের রচনাও অধ্যয়ন করেছিলেন। স্বক্ষেত্রে নিজেকে
পরিচিত করার জন্য তিনি ভ্রমণ করেছিলেন, কাম্পিল্লকে (কালপি) সূর্য্য-দেবতার পুজো করেছিলেন
এবং তাঁর কাছে একটি গ্রন্থ পেয়েছিলেন। আমি তাঁর পুত্রের রচনা পৃথুয়শঃ-শাস্ত্র-এর পাণ্ডুলিপি
পাই নেপাল উপত্যকার উত্তরতম ভাগে, সাঙ্খুতে। তার প্রথম পদ্যটি বলে যে বরাহমিহিরের পুত্র
তার পিতাকে, যখন তারা গঙ্গাতীরে কান্যকুব্জ নামে সুন্দর শহরে ছিল, কিছু প্রশ্ন করে।
হতে পারে গঙ্গার
তীরে থাকার জন্য বৃদ্ধ বয়সে বরাহ কান্যকুব্জে চলে যান, এবং সেখানে নিজের পুত্র পৃথুয়শঃ
তিনি নিজের জ্ঞান প্রদান করেন।
আমরাজ, খণ্ডনখণ্ডখাদ্য-এর
টীকাকার, বলেন যে শকাব্দ ৫০৯, অর্থাৎ খ্রিষ্টাব্দ ৫৮৭তে বরাহমিহিরের মৃত্যু হয়। কিছু
মানুষ ভাবেন যে বরাহ তাঁর পঞ্চ-সিদ্ধান্তিকা ৫০৫ খ্রিষ্টাব্দে, অর্থাৎ ৪২৭ শকাব্দে
লিখেছিলেন। কিন্তু আমরাজকে বিশ্বাস করলে এটা অসম্ভব। বরাহের বয়স তখন হবে মাত্র ১৮ বছর।
সুতরাং, ডঃ থিবট, যত্নসহকারে সমস্যাটার সঙ্গে সম্পর্কিত সব তথ্য বিচার করে ভাবেন যে
শকাব্দ ৪২৭ সেই বছর যখন লল্ল রোমক-সিদ্ধান্ত পরিমার্জন করেছিলেন এবং পঞ্চ-সিদ্ধান্তিকা
৫৫০ খ্রিষ্টাব্দে রচিত হয়েছিল। অতএব বরাহমিহির আর্য্যভটের পরে আসা সমকালীন এবং সম্ভবত
তাঁর ছাত্র।
গণকতরঙ্গিনী বরাহের
রচনার একটি সূচী দেয় এবং মনে করে যে বৃহৎ-সংহিতা তাঁর শেষ রচনা। এটি অতি বিস্তৃত তথ্যপূর্ণ
একটি গ্রন্থ। গ্রন্থটিতে শুধু জ্যোতির্বিদ্যা ও জ্যোতিষশাস্ত্রই নেই, উদ্যানবিদ্যা,
কৃষি, ভাষ্কর্য, স্ত্রীলক্ষণ, পুরুষলক্ষণ ইত্যাদি অনেক কিছু আছে। তাঁর মহান কাজ পঞ্চ-সিদ্ধান্ত
যাতে তিনি সমসাময়িক সব সিদ্ধান্তের সারসংক্ষেপ পেশ করেন। তাদের সংখ্যা পাঁচ – পৌলিশ, রোমক, বাশিষ্ঠ, পৈতামহ, এবং সূর্য্যসিদ্ধান্ত। বরাহ বলেন
যে এই পাঁচটির মধ্যে পৌলিশ এবং রোমকের ব্যাখ্যা করেছেন লাটদেব। পৌলিশ-এর করা সিদ্ধান্ত
নিখুঁত। তার কাছাকাছি আসে রোমক কর্তৃক ঘোষিত সিদ্ধান্ত। সাবিত্র (সৌর) আরো নিখুঁত এবং
বাকি দুটো সত্য থেকে দূরে।২৫
এ থেকে স্পষ্ট যে
যবনেশ্বর সংস্কৃতে এমন একটি রচনার অনুবাদ করেছিলেন যেটি তাঁর নিজের ভাষায় বহুকাল যাবৎ
লোকচক্ষুর অন্তরালে ছিল এবং স্ফুজিধ্বজ নামে এক রাজা সংস্কৃত গদ্যটিকে ইন্দ্রবজ্র ছন্দে
৪০০০ পদ্যে পেশ করেন। অনুবাদটা এক অজানা যুগের ৯১তম বছরে করা হয়েছিল এবং সে যুগেরই
১৯১তম বছরে সে অনুবাদ পদ্যে পরিবর্তিত হয়েছিল। এখানে গ্রীসীয় রচনার সংস্কৃত অনুবাদ
হওয়ার একটি স্বতন্ত্র সাক্ষ্য পাওয়া গেল। বরাহমিহির জাতক বা রাশিফল-গণনার ওপর, বৃহজ্জাতক
নামে একটি বই লিখেছিলেন। গণকতরঙ্গিনী অনুসারে সে বইয়ে বরাহ গ্রীসীয়, ময়, যবন এবং মনিত্থ
(মেনেথো)-দের তিনটি রচনা থেকে উদ্ধৃতি দেন। এসবকিছু, ভারতীয় জ্যোতিষের ওপর গ্রীসীয়
জ্যোতির্বিদ্যার প্রভাব দর্শায়। গার্গ্য-এ একটি কথা আছে –
মগধে এবং পাটলিপুত্রে
এর পর যে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থটি লেখা হয়েছিল সেটি হল, সপ্তদশ শতকে রচিত দেশবলিবিবৃতিঃ।
ষষ্ঠে বরাহমিহির থেকে সপ্তদশ শতকে দেশবলি একটা বিরাট লাফ। তবে মগধ এই এক হাজার বছর
আলস্যে দিন কাটায় নি, প্রবলভাবে সক্রিয় ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ আমার ছটি বক্তৃতার
সীমিত পরিসরে আমি সেই প্রবল সক্রিয়তার কালটিকে অন্তর্ভুক্ত করতে পারব না। তাই আমি নিজেকে
বিশুদ্ধরূপে ব্রাহ্মণ্য সাহিত্যে সীমিত করেছি। মাঝখানের ১০০০ বছরের গরিষ্ঠ অংশের সক্রিয়তা
বৌদ্ধ সাহিত্যে সীমিত ছিল। ষষ্ঠ শতকে নালন্দার উত্থান ভারতীয় ইতিহাসে এক বিলক্ষণ ঘটনা।
পাঁচ শতকের বেশি সময় অব্দি নালন্দা বিশ্বের মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল। তারই মধ্যে বাংলায়
পাল রাজাদের আমলে বিক্রমশিলা উঠে দাঁড়ালো, এবং বিক্রমশিলার পর আমরা বাংলার জগদ্দলে
পৌঁছোই। নালন্দা তার বিদ্বান সন্ন্যাসীদের সারা বিশ্বে পাঠাতো এবং বিশ্বের সব দিক,
বিশেষ করে পূর্ব থেকে ছাত্র টেনে আনতো। ইউয়ান চ্বাং এখানেই তাঁর শিক্ষা পেয়েছিলেন।
ফিরে গিয়ে তিনি চীনে বৌদ্ধমতের দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠাতা হলেন এবং তাঁর ছাত্ররা ভারতের বিদ্যা
আর ধর্ম নিয়ে গেল জাপানে, কোরিয়ায়, মঙ্গোলিয়া আর সাইবেরিয়ায়। যখন চীনাদের আসা বন্ধ
হয়ে গেল, তিব্বতীরা এল। নালন্দাতেই তারা সংস্কৃত গ্রন্থগুলোর তিব্বতী ভাষায় অনুবাদ
শুরু করল। তাই দশ হাজারের মত গ্রন্থ ধ্বংস ও বিস্মৃতির হাত থেকে রক্ষা পেল। তারপর তিব্বতী
অনুবাদের কেন্দ্র বিক্রমশিলায় এবং তারও পর জগদ্দলে স্থানান্তরিত হল। নালন্দার সাহিত্য
প্রথম দিকে মহাযানবাদী এবং দার্শনিক ছিল। এখানেই তন্ত্রের প্রারম্ভ হল, পূর্ণ সমৃদ্ধিতে
যার উন্নতি হল বিক্রমশিলায় – বিক্রমশিলায় উন্নত
তন্ত্রের দর্শন নালন্দা থেকে বেশি শিক্ষাগত ছিল। বিক্রমশিলা এবং জগদ্দল উঠে দাঁড়ানো
সত্ত্বেও নালন্দার উন্নতিলাভ বজায় রইল এবং আমাদের কাছে এমনকি একাদশ শতকে সেখানে লেখা
পাণ্ডুলিপি আছে। আমার কাছে, বড়গাঁওয়ে বাংলা অক্ষরে নকল করা পাণ্ডুলিপি আছে, প্রফেসর
বেন্ডাল ভেবেছিলেন যে সেটা চতুর্দশ শতকের, কিন্তু আমার মনে হয় সেটি মুসলিম বিজয়-অভিযানের
আগে নকল করা হয়েছিল। বড়গাঁও যে নালন্দার অবিচ্ছেদ্য অংশ সেটা সর্ববিদিত। এই কালখণ্ডের
বৌদ্ধ সাহিত্য অত্যন্ত কৌতূহলোদ্দীপক এবং শিক্ষাপ্রদকিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ সে সাহিত্য
সংস্কৃততেও নেই, অন্য কোনো ভারতীয় ভাষাতেও নেই। অধিকাংশ রচনা শুধুমাত্র তিব্বতী অথবা
চীনা অনুবাদে প্রাপ্য। কয়েকটি মূল সংস্কৃতে অথবা বাংলায় নেপালে পাওয়া গেছে। পশ্চিম
এবং এমনকি দক্ষিণ ভারতও এই সংস্কৃত রচনাগুলোকে লোকসমক্ষে নিয়ে আসতে নিজেদের অবদান রাখছে।
এই কালখন্ডের সাহিত্যের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করতে জাপান, চীনা অনুবাদগুলোর মাধ্যমে অনেক
কাজ করছে; তিব্বতও সে কাজে সক্রিয়। লন্ডনে, প্যারিসে আর বার্লিনে কেন্দ্র গড়ে কয়েকজন
খুব বিদ্বান মানুষ এই কালখন্ডের ইতিহাসের পুনর্নির্মাণে সক্রিয়তার সঙ্গে ব্যাপৃত আছেন
এবং আমি আশা করি ভারত, বিশেষ করে এই প্রদেশ যে সবচেয়ে বেশি এই কাজে আগ্রহী, এ কাজে
পিছিয়ে থাকবে না।
শেষ রচনা যেটির বিষয়ে
আমি বলতে চাই, হল দেশাবলি-বিবৃতি, পূর্ব ভারতের একটি গেজেটিয়ার, সপ্তদশ শতকে পাটনার
মোগলটুলিতে বিজ্জল ভূপতি নামে চৌহান জমিদারের পৃষ্ঠপোষকতায় তাঁর পণ্ডিত, পণ্ডিত জগমোহন
তৈরি করেছিলেন। কেউ ভাবতে পারে যে সঙ্কলনের কাজটি আইন-ই-আকবরীর দ্বারা অনুপ্রাণিত,
কিন্তু আমি মনে করি অনুপ্রেরণা অন্য জায়গা থেকে এসেছিল এবং সে অনুপ্রেরণা পূর্ণতঃ দেশীয়।
মিথিলার মহান কবি বিদ্যাপতি এক বিরাট মাপের মানুষ ছিলেন, তিনিই প্রথম ভূপরিক্রমা নামে
একটি গেজেটিয়ার লেখেন। তাঁকে অনুসরণ করেন বিক্রম নামে এক জমিদার এবং তাঁর রচনার নাম
বিক্রমসাগর। বিজ্জল ভূপতি, দেখা যায় বিক্রমের এক বংশধর। অর্থাৎ বিজ্জলের অনুপ্রেরণার
দিল্লী থেকে আসার কোনো প্রয়োজন নেই। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ গেজেটিয়ার সাহিত্যের [ভৌগোলিক
অভিধান] ভালো পাণ্ডুলিপি বিশেষ উঠে আসছে না। হোরেস হাইমেন উইলসন এক গাদা টুকরো সংগ্রহ
করেছিলেন এবং সেগুলো এখন কলকাতার সংস্কৃত কলেজ লাইব্রেরিতে জমা আছে। আমি বাঁকুড়ায় কিছু
টুকরো সংগ্রহ করেছিলাম যেগুলো এশিয়াটিক সোসাইটি অফ বেঙ্গলে জমা আছে। এই টুকরোগুলোর
অধ্যয়ন আমাদের, বিহারে, বাংলায় এবং আশেপাশের জেলাগুলোয় বসবাসরত তিনশো বছর আগেকার হিন্দুদের
বিষয়ে অনেক তথ্য দিয়েছে – তাদের মন্দির, তাদের
তীর্থস্থান, তাদের প্রশাসন, তাদের বাণিজ্য, তাদের শিল্পোৎপাদন [ম্যানুফ্যাকচার], তাদের
দুর্গনির্মাণ, তাদের আদব-কায়দা, তাদের দেশাচার, তাদের দুর্বলতা এবং তাদের অভ্যাস। এক্ষেত্রে
বিজ্জলের কৃতির অনুসারী ছিলেন পঞ্চকোটের রাজা যাঁর কবি, রামকবি, পাণ্ডবদিগ্বিজয় নাম
দিয়ে একটি গ্রন্থ রচনা করেন।
এখানেই আমি মগধের
সাহিত্যের ওপর আমার ছটি বক্তৃতার শৃংখলা শেষ করছি। যখন আমি এই বক্তৃতার কাজ হাতে নিয়েছিলাম,
ভেবেছিলাম বেশির ভাগ পৃষ্ঠা মগধের বৌদ্ধ এবং জৈন সাহিত্যের ইতিহাস দিয়ে ভরিয়ে দিতে
হবে। কেননা ভেবেছিলাম যে মগধে এক কৌটিল্যের কাজ ছাড়া, হিন্দু সাহিত্যের অন্য কোনো কাজের
স্থাননির্দেশ করা আমার পক্ষে অসম্ভব হবে। কিন্তু সৌভাগ্যবশতঃ, রাজশেখরের কাব্যমীমাংসা
এবং বাণের হর্ষচরিত আমায় অনেকগুলো কাজকে মগধের বলে সনাক্ত করতে সাহায্য করল। এবং সে
কাজগুলো ধর্মগত গোঁড়ামিতে ভরা না হয়ে এমন কাজ যে সমস্ত ভারতীয় এমনকি পুরো বিশ্বের মানুষ
তার বিষয়ে জানতে আগ্রহী হবে। আমি তাই সম্প্রদায়গুলোকে উপেক্ষা করেছি এবং সেই সমস্ত
কাজ বেছেছি যা সবাইকে কৌতূহলী করে তুলবে।
আমি অত্যন্ত প্রসন্ন হতাম যদি এই বক্তৃতাগুলো স্যার এডোয়ার্ড গেইটের প্রশাসনকালে শেষ করতে পারতাম। স্যার গেইট মগধের সমস্তকিছুর ব্যাপারে অত্যন্ত আগ্রহ দেখাতেন এবং সবসময় আমায় এই প্রদেশের গবেষণায় উৎসাহ দিতেন। কিন্তু যা ঘটনা, তা হল এই যে তিনি এই বক্তৃতাগুলো নিজের অবসরজীবনে পড়বেন এবং জেনে পরিতৃপ্ত হবেন যে তাঁর বিনীত বন্ধু, তার ওপর যে কার্য্যভার ন্যস্ত করা হয়েছিল তা পুরো করেছে, অবহেলা করে নি।
- হরপ্রসাদ শাস্ত্রী
…………………………………………
No comments:
Post a Comment