Monday, October 2, 2023

ব্রহ্মরাক্ষস - গজানন মাধব মুক্তিবোধ

শহরের ওদিকে
ধ্বংসস্তুপ ঘেঁসে
পরিত্যক্ত 
রিক্ত ধাপকুঁয়োটি
ভিতরের শীতল আঁধারে
নীড় বাঁধল জলের গভীরতা ...
অনেক সিঁড়ি ডুবেছে ওই
পুরোনো আবদ্ধ জলে ...
যেন বোঝা না গেলেও
ভিত্তি, তবু
কথা সুগভীর।

ধাপকুঁয়ো ঘিরে
ডালে ডালে জড়িয়ে পাকিয়ে
দাঁড়িয়ে মৌন কিছু যজ্ঞডুমুর।
শাখায় ঝুলছে
ঘুঘুদের বাসা
পরিত্যক্ত, ধুসর, বর্তুল

অতীতের পূণ্যের আভাস
আরণ্য সবুজ কাঁচা গন্ধে বাস করে
হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে
গভীর অনিশ্চয় গড়ে
বিগত কোনো জানা শ্রেষ্ঠতার
বাজতে থাকে বুকে সতত

ধাপকুঁয়োর এই পাগুলোয়
মনোরম সবুজ কনুইয়ে ভর দিয়ে
সাদা-তারা-ফুল নিয়ে
বসে রয়েছে টগর।   

পাশে তার
টকটকে গুচ্ছে লাল ফুল
আমার সেই করবী ...
ডাকছে এক বিপদের মুখে আমায়,
ধাপকুঁয়োর যেদিকে
অন্ধকার খোলা মুখ
শূন্য আকাশে তাকায়।

ধাপকুঁয়োর ওই ঘন গভীরতায়
বাস করছে শূন্য এক ব্রহ্মরাক্ষস,
এবং ভিতর থেকে উপচানো 
                 প্রতিধ্বনিরও প্রতিধ্বনি
পাগলের বিড়বিড়।
গভীর আন্দাজগুলো
দেহের মালিন্য
ঘোচাতে প্রতিপল, পাপ-ছায়া সরাতে
পরিচ্ছন্ন করতে দিন-রাত
                                  ব্রহ্মরাক্ষস
ঘষছে শরীর
করতল অবিরত,
হাত-বুক-মুখ ছপছপ করে,
করেই চলেছে পরিষ্কার,
তবুও কী ময়লা,
কী ময়লা তবুও !!

আর ঠোঁট থেকে
বেরুচ্ছে অদ্ভুত স্তোত্র, ক্রোধিত কোনো মন্ত্রোচ্চারণ
অথবা শুদ্ধ সংস্কৃত গালির জোয়ার,
কপালের রেখাগুলো
বুনছে সমালোচনার দীপ্ত শৃংখলা!!
সেই অখণ্ড স্নানের উন্মত্ত প্রবাহ
প্রাণে সংবেদন, ছায়াময়!!

কিন্তু গভীর ধাপকুঁয়োর ভিতর-দেয়ালে
তেরছা নামা সূর্যালোকের উড়ন্ত পরমাণু যখন
তল অব্দি পৌঁছোয় কখনো,
ঝুঁকে নমস্কার করল সূর্য,
                                মনে করে ব্রহ্মরাক্ষস।
পথ ভুলে যখন জ্যোৎস্নার কিরণ
নামে দেয়ালে কোথাও,
জ্যোৎস্না বন্দনা করল তার,
              জ্ঞানের গুরু মানল তাকে,
                               মনে করে ব্রহ্মরাক্ষস।

অতি প্রফুল্ল কন্টকিত শরীর-মন তার
ভাবতে থাকে যে আকাশও নত হয়ে
মেনে নিয়েছে তার শ্রেষ্ঠতা !!
 
আর তখন দ্বিগুণ ভয়ানক তেজে
পরিচিত মন
সুমের-ব্যবিলনের জনশ্রুতি থেকে
মধুর বৈদিক ঋক অব্দি এবং
তখন থেকে আজ অব্দিকার
সূত্র, ছন্দ, মন্ত্র, থিয়োরেম,  
সমস্ত প্রমেয়
মার্ক্স, এঙ্গেলস, রাসেল, টয়েনবি,
হাইডেগ্‌গার, স্পেঙ্গলার, সার্ত্রে, গান্ধীও
সবার নিষ্পন্ন-অন্তিমের
নতুন ব্যাখ্যা করে সে
শূন্য স্নান করে ব্রহ্মরাক্ষস,  
কালো, প্রাক্তন ধাপকুঁয়োর
সেই সঘন গভীরতায়।
 
এই গর্জনরত, প্রতিধ্বনিত, আন্দোলিত
গভীর থেকে উঠছে ধ্বনি, পরিণামে,
উদভ্রান্ত শব্দের নব আবর্তে
প্রতিটি শব্দ নিজের প্রতিশব্দকেও কেটে,
নিজের প্রতিচ্ছবির সঙ্গেও যুদ্ধ করে সেই আকৃতি,
হচ্ছে কৃতি এক বিকৃত-আকার
ধ্বনি নিজের প্রতিধ্বনির সঙ্গে এখানে লড়ছে 

ধাপকুঁয়োর এই পাড়ের ওপর
মনোরম সবুজ কনুইয়ে ভর দিয়ে
টগরের সাদা তারা-ফুলগুলো
                সেই ধ্বনি শোনে।
শোনে করমচার কোমল ফুল
শোনে প্রাচীন যজ্ঞডুমুর
শুনছি আমিও,
পাগল প্রতীকে কোথাও যেতে থাকা ওই ট্র্যাজেডি
যা, গোঁয়ার্তুমিতে রয়ে গেল ধাপকুঁয়োয়।

X X X X X X X 

খুব উঁচু কালচে একটি সিঁড়ি
               তার অন্ধকার ধাপগুলো
এক নির্জন জগতের আভ্যন্তরীণ।
ওঠা আর নামা,
আবার ওঠা আর গড়িয়ে নামা,
মচকানো পা আর  
বুক ভর্তি ক্ষত।
খারাপ-ভালো-মাঝামাঝির সংগ্রাম থেকেও
উগ্রতর
ভালো এবং তার থেকে ভালোর 
                                          যুদ্ধপ্রস্তুতি।
গভীর কিঞ্চিৎ সফলতা,
অতি মহৎ অসফলতা,
প্রাচুর্য্যবাদী পূর্ণতার
                  এই বেদনাসমূহ খুব প্রিয়
জ্যামিতিক সামঞ্জস্য-গণিতের দৃষ্টি দিয়ে তৈরি
মহৎ নৈতিক মান
আত্মসচেতন সূক্ষ্ম
নৈতিক মান, প্রাচুর্য্যবাদী পূর্ণতার তুষ্টি
              কবেই বা ছিল সহজ বড় মধুর
মানবিক অন্তর্কথাগুলো!!
 
সূর্য ওঠে
লাল চিন্তার রুধির-ধারা
দেয়ালে ছড়িয়ে
ওঠে চাঁদ
ব্রণের ওপর বেঁধে দেয়
সাদা অর্জুনছালের পটি
উদ্বিগ্ন ললাটে।

আকাশীয় প্রান্তে বিস্তীর্ণ নক্ষত্ররাজি
অগণিত দশমিক থেকে দশমিক বিন্দুর সর্বত্র
এলিয়ে জট পাকিয়ে ছড়িয়ে অঙ্কের মাঠে
মৃত্যু হল তার, প্রাণ দিল,
পড়ে আছে প্রসারিত
উন্মুক্ত হাত, বুক এক গবেষকের।
কোমল স্ফটিক প্রাসাদের মত সে ব্যক্তিত্ব
প্রাসাদে সিঁড়ি এবং খুব
                            কঠিন ছিল চড়া
সিঁড়ির নিঃসঙ্গ ধাপগুলো।
ঐ ভাব-সঙ্গত যুক্তি-সঙ্গত কাজ
সামঞ্জস্য-যুক্ত সমীকরণের
অঙ্কের সিঁড়িসমূহ
তার জন্য ছেড়ে দিই।
সেই ভাব যুক্তি আর কাজ
সামঞ্জস্যযুক্ত করার গবেষণায়
সব পণ্ডিত, ভাবুকদের কাছে সে
গুরুর খোঁজে ঘুরলো !! 

কিন্তু যুগ বদলালো আর কীর্তির ব্যবসায়ীরা এল
লাভের কাজ থেকে ধন
                                 ধন থেকে হৃদয়-মন,
এবং ধনে অভিভূত অন্তঃকরণ নিঃসৃত
সত্যের ছুলি
                ঝলসাচ্ছিল অবিরাম।

আত্মসচেতন এই ব্যক্তিত্বে অবশ্য
ছিল বৈসাদৃশ্য প্রাণবন্ত
অপরিণত বিশ্বচেতনা !!
মহত্বের পায়ে ছিল
বিষাদে আকুল মন!
সেসব দিনে যদি আমার
বন্ধুত্ব হত তারই সাথে তবে
নিজে যাপন করে তার বেদনা
তাকে বোঝাতাম তার মূল্য,
                                মর্মার্থ তার কাজের !  
এবং তার উপযোগ
আমাদের মত মানুষের জন্য,
বোঝাতাম তাতপর্য্য সেই আন্তরিকতার !!

নিষ্পেষিত হল ভিতরের
আর বাইরের দুই কঠোর পাটায়,
এমনই নিকৃষ্ট ট্র্যাজেডি !!
ধাপকুঁয়োর ভিতরে সে স্বয়ং
উন্মাদ প্রতীকে অবিরাম বলতে থাকল
কুঠুরিতে কিভাবে নিজের
অঙ্ক কষতে থাকল
আর মরে গেল
সঘন ঝোপের কাঁটাদার তামস-বিবরে
মৃত পাখির মতন
বিদায় নিল সে
চিরনিদ্রিত হল অজানা সেই জ্যোতি
কেন হল এমন !
কেন এমন হল !!
আমি ব্রহ্মরাক্ষসের
                      শিষ্য হতে চাই সজল-হৃদয়
যাতে তার সেই আধকরা কাজ
তার বেদনার স্রোত
সুসঙ্গত পূর্ণ নিষ্পত্তিতে
পৌঁছে দিতে পারি।

[সম্ভাবিত রচনাকাল ১৯৫৬ থেকে ১৮৬২ অব্দি। শেষ সংশোধন ১৯৬২তে। নাগপুর-রাজনন্দগাঁও। কবি, এপ্রিল ১৯৫৭এ প্রকাশিত। চাঁদ কা মুখ টেঢ়া হ্যয়তে সঙ্কলিত]

[হিন্দি থেকে ভাষান্তরঃ বিদ্যুৎ পাল]  



No comments:

Post a Comment