মগধের সাহিত্য
১০০ বছর আগে, ১৯২০ সালের ডিসেম্বর থেকে ১৯২১এর এপ্রিল অব্দি
মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছ’টি বক্তৃতা দিয়েছিলেন এবং ১৯২৩ সালে পাটনা বিশ্ববিদ্যালয় সেই
বক্তৃতা ক’টি পুস্তকাকারে প্রকাশ করেছিল।
‘মগধের সাহিত্য’ শীর্ষক এই বক্তৃতামালায়
বক্তৃতা সংখ্যা ১ ছিল ‘মগধের মূল
অধিবাসী’, বক্তৃতা সংখ্যা ২ ছিল ‘পাটলিপুত্র – ভারতের মেধাজগতের রাজধানী’, বক্তৃতা সংখ্যা ৩ ছিল
‘কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের ঐতিহাসিক শিক্ষা’, বক্তৃতা সংখ্যা ৪ ছিল ‘বাৎস্যায়নের কামসূত্র’, বক্তৃতা সঙ্খ্যা ৫ ছিল ‘বাৎস্যায়নের
ভাষ্য’ এবং বক্তৃতা সংখ্যা ৬ ছিল ‘বাণভট্ট এবং আর্য্যভট্ট’।
বক্তৃতা সংখ্যা ৪
বাৎস্যায়নের কামসূত্র
বাৎস্যায়নেরা সুদূর
প্রাচীনকাল থেকে মগধে স্থায়ী বসবাস করছিলেন। তাঁরা চ্যবনের বংশধর ছিলেন এবং মগধের পবিত্রতম
স্থান, শোন নদীর পাঁচ মাইল পূর্বে, চ্যবনের আশ্রমে থাকতেন। চ্যবন ভৃগুর ছেলে ছিলেন।
ভৃগু ব্রহ্মার ঔরসে, পুলোমা রাক্ষসের কন্যা পৌলমীর ছেলে ছিলেন। চ্যবন শার্যাতের মেয়েকে
বিয়ে করেছিলেন এবং সে মেয়ের গর্ভে তাঁর একটি ছেলে হয়েছিল, দাধীচ। দাধীচের জন্ম শার্যাতের
রাজধানীতে হয়েছিল এবং সেখানেই তিনি বড় হয়েছিলেন। তিনি শার্যাতের এত প্রিয় ছিলেন যে
শার্যাত তাঁকে কখনও আশ্রমে বাবার কাছে যেতে দেন নি। রাজধানীতেই তাঁর শিক্ষা পূর্ণ
হয়েছিল এবং তাঁকে নিজের সময়ের সবচেয়ে সিদ্ধ ঋষি গণ্য করা হত। শিক্ষা পূর্ণ হওয়ার পর
রাজা তাঁকে পিতার সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার অনুমতি দিলেন। উপযুক্ত সহচর, রক্ষক ইত্যাদি
নিয়ে তিনি শোন বা হিরণ্যবাহ নামে পরিচিত নদীটির পশ্চিম কূলে পৌঁছোলেন। তিনি শুনতে পেলেন
যে দুজন স্বর্গীয় কন্যা কাছাকাছিই কোথাও সন্ন্যাসের অভ্যাস করছেন, এবং ভাবলেন যে তাঁদেরকে
সম্মান জানান তাঁর কর্তব্য। তরূণতর কন্যাটি প্রথম দেখাতেই তাঁর প্রেমে পড়ে গেলেন; যুবক
ঋষিও তাঁকে ভালোবাসলেন। স্বর্গীয় কন্যারা আর কেউ নন, সরস্বতী এবং সাবিত্রী ছিলেন। প্রথমজন
ব্রহ্মার রাজসভায় দুর্বাসা কর্তৃক পৃথিবীতে জীবনযাপন করতে অভিশপ্ত হয়েছিলেন এবং দ্বিতীয়জন
স্নেহপরবশ হয়ে তাঁর সঙ্গ নেন। সরস্বতী যেখানে ছিলেন সেখান থেকে আশ্রমটি মাত্র পাঁচ
মাইল দূরে ছিল, কাজেই প্রেমিকযুগল দিব্যি নিজেদের মত রইল। পরিণামে একটি পুত্রসন্তান
হল তাঁদের। সরস্বতীর কাছে যা জ্ঞান ছিল সব তিনি পুত্রকে দিলেন। কিন্তু যেহেতু পুত্রের
জন্মের সঙ্গে অভিশাপ শেষ হয়ে গিয়েছিল, সরস্বতীকে স্বর্গে ফিরতে হল। পুত্রকে তিনি নিজের
স্বামীর ভ্রাতৃবধু অক্ষমালিকার কাছে রেখে গেলেন। দাধীচ সংসার ত্যাগ করেছিলেন এবং তাঁর
পুত্রও বয়ঃপ্রাপ্ত হলে সে পথেই গেলেন। কিন্তু তার আগে, নিজের মায়ের কাছ থেকে পাওয়া
সমস্ত জ্ঞান খুড়তুতো ভাই বৎসকে দিয়ে গেলেন। এবং বৎস থেকেই বাৎস্যায়নদের, পান্ডিত্যের
জন্য পরিচিত বিশিষ্ট পরিবার শুরু হল। তাঁরা আশ্রমের সীমার ভিতরেই প্রীতিকুটে স্থায়ী
হলেন।
বাণভট্ট, নিজে একজন
বাৎস্যায়ন, সপ্তম খ্রিষ্টাব্দে রচিত হর্ষচরিত-এর প্রথম অধ্যায়ে নিজেদের গোত্র
ও পরিবারের এই উদ্ভব কাহিনী বয়ান করেন। কাহিনীটা যে খুবই প্রাচীন সেটা দুই দিক
থেকে বোঝা যায়ঃ – (১) দুজন স্বর্গীয় সত্তার স্বর্গীয় রূপে পৃথিবীতে
আসা এবং এক সন্তান রেখে যাওয়ার গল্পটা পুরুরবা ও উর্বশী, শকুন্তলা এবং নহুষের রাজত্বকালে
স্বর্গীয় পরীদের পৃথিবীতে আসার গল্পগুলোর অনুরূপ। আরেকটু আধুনিক কালে তারা আর স্বর্গীয়
রূপে আসে না, মনুষ্যরূপে জন্ম নেয় এবং অভিশাপ শেষ হওয়া অব্দি থাকে। (২) কাহিনীটি গোত্র-এর
উদ্ভব লিপিবদ্ধ করে। এর আগে অব্দি কোথাও গোত্রের স্থানীয় উদ্ভবের কোনো গল্প পাওয়া যায়
নি। তাই, বাৎস্যায়ন গোত্রের স্থানীয় উদ্ভবের বর্ণনা সর্বাধিক মূল্যবান একটি তথ্য। বাৎস্যায়নরা
যে চ্যবনের আশ্রমে সুদূর প্রাচীনকাল থেকে ছিল সেটা প্রমাণ করেন পাতঞ্জলি। মহাভাষ্য
রচনার সময় তিনি যে সুমহান প্রাচীন নগরীটির খুব কাছে থাকতেন, তাঁর রচনা যেমন সেই পাটলিপুত্রের
উল্লেখে ভরা তেমনই বাৎস্যায়নদের উল্লেখে ভরা।
এটা অদ্ভুত লাগতে
পারে যে বৈদিক আর্য্যরা যে মগধকে এত বিদ্বেষের চোখে দেখত সেই মগধ চ্যবন, দাধীচ এবং
বৎসের মত ঋষিদের জন্মভূমি ও নিবাস। কারণটা বোঝা কঠিন নয়। এই ঋষিরা খুব সম্ভবত সেই রূপান্তরিত
ব্রাত্যদের একজন ছিলেন, বৈদিক যুগের পরবর্তী পর্বের মগধের প্রতি যাদের বিশেষ আকর্ষণ
ছিল।
তর্কের খাতিরে বলা
যেতে পারে যে বাৎস্যায়ন নামে দুটি গোত্র ছিল। একটির উল্লেখ আছে ভৃগু, চ্যবন, আপ্নাবত,
ঔর্ব এবং জামদগ্ন্যের বংশধর বলে, বৌধায়ন রচিত মহাপ্রবরাধ্যায়-এ। অন্যটির উল্লেখ
আছে কশ্যপের বংশধর বলে মৎস্য পুরাণে। কিন্তু মিস্টার পি.চেন্টসাল রাও, সি.আই.ই., নিজের
গোত্রপ্রবর-এর তালিকায় বলেন যে অন্যান্য ঋষিদের অনেক বংশধর ভৃগুর পরিবারের সঙ্গে সম্বদ্ধ
ছিল, কাজেই ভৃগু থেকে অবতীর্ণ বাৎস্যায়ন এবং কশ্যপ থেকে অবতীর্ণ বংশধরেরা এক ও অভিন্ন
পরিবার হতে পারে।
ওই মৎস্য পুরাণেই
আবার আছে যে বাৎস্যায়নেরা কৌশিতকের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। তাণ্ড্য মহাব্রাহ্মণ থেকে পাওয়া
তথ্যানুসারে কৌশিতকরা নিঃসন্দেহে ব্রাত্য ছিল। কথাটির সাক্ষ্য দেয় এ তথ্যও যে মহাপ্রবরাধ্যায়
বাৎস্যায়নদের সেই গোত্র-তালিকাভুক্ত করে যাদেরকে কেবল-ভৃগু গণ্য করা হয়।
অর্থাৎ জমদগ্নি, ভারদ্বাজ, বিশ্বামিত্র, অত্রি, গোতম, কশ্যপ, বশিষ্ঠ এবং অগস্ত্য প্রভৃতি
আটজন গোত্র-প্রবর্তক-এর সঙ্গে তারা যুক্ত নয়। এঁদের মধ্যে জমদগ্নি ভৃগুর বংশধর।
অন্য বংশধরেরা কেবল-ভৃগু বলে পরিচিত। অন্যান্য ব্রাহ্মণদের সঙ্গে তাদের তফাৎ
যে তারা সেই গোত্রগুলো বাদে যে কোনো গোত্রে বিয়ে করতে পারে, যে গোত্রগুলোর প্রবরদের
সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ তাদের গোত্রের সঙ্গে সম্মত। যখন নাকি অন্যান্য ব্রাহ্মণেরা, যদি একজনও
প্রবর ঋষি দুপক্ষেরই হয়। তাই আমার যুক্তি যে এই কেবলরা ব্রাত্য আর্য্যদের মধ্যে থেকে
বৈদিক যুগের শেষভাগে বৈদিক আর্য্যদের দলে এসেছে। এ বিষয়ে আমি আমার প্রথম বক্তৃতায় অনেক
কিছু বলেছি।
বাৎস্যায়নদের একেবারে
প্রথম দিকের কাজ বোধহয় কামসূত্র। টীকাকার বলেন যে লেখকের ব্যক্তিগত নাম ছিল
মল্লনাগ এবং তার গোত্র-নাম ছিল বাৎস্যায়ন। গ্রন্থটি অর্থশাস্ত্রের লেখক কৌটিল্যের অনুকরণ
করে। এতে সাতটি অধিকরণ বা পুস্তক আছে, ৩৬টি অধ্যায় এবং ৬৪টি প্রকরণ অথবা বিষয়। শ্লোকের
সংখ্যা সোয়া হাজার। কিন্তু কৌটিল্য থেকে আলাদা, এই গ্রন্থ শাস্ত্রের পরম্পরা আগে দেয়,
তারপর দেয় বিষয়বস্তু। কৌটিল্য পরম্পরা দেনই না। সেগুলো তাঁর উদ্ধৃতি থেকে অনুমান করতে
হয়।
কামসূত্রের পরম্পরা
অত্যন্ত কৌতূহলোদ্দীপক। তাতে বলা হয় যে সৃষ্টির পর প্রজাপতি, মানবজীবনের তিনটি উদ্দেশ্যের
ওপর এক লক্ষ অধ্যায় সম্বলিত একটি গ্রন্থ রচনা করেন। এই তিন উদ্দেশ্য হলঃ – ধর্ম, অর্থ এবং কাম (আইন, অর্থনীতি এবং প্রেমবিদ্যা)। মনু আইন-সম্পর্কিত
অংশ “আলাদা” করেছেন,
এবং বৃহস্পতি অর্থনীতি-সম্পর্কিত অংশ। মহাদেবের শিষ্য নন্দী এক হাজার অধ্যায়ে প্রেমবিদ্যাকে
“আলাদা” করেছেন।
ঔদ্দালকি শ্বেতকেতু প্রেমবিদ্যাকে পাঁচ শ’ অধ্যায়ে
সংক্ষিপ্ত রূপ প্রদান করেন। পাঞ্চাল বভ্রভ্য শ্বেতকেতুর কাজটিকে সংক্ষেপ করে সাতটি
অধিকরণে অথবা পুস্তকে বিভক্ত একশ পঞ্চাশ অধ্যায়ে নামিয়ে আনেন। সে সাতটি অধিকরণ হলঃ
– (১) সাধারণ (প্রারম্ভিক), (২) সাম্প্রযোগিক
(মিলন), (৩) কন্যাসম্প্রযুক্তক (মেয়েদের প্রবৃত্তকরণ), (৪) ভার্যাধিকরণিক (পত্নী বিষয়ে
একটি ভাগ), (৫) পারদারিক (ব্যাভিচার), (৬) বৈশিক (গণিকা বিষয়ক), (৭) ঔপনিশদিক (গুপ্তকথা)।
পরে, পাটলিপুত্রের
গণিকাদের অনুরোধে দত্তক, ষষ্ঠ, ‘বৈশিক’ বিষয়ে, অর্থাৎ গণিকাদের ওপর একটি স্বতন্ত্র এবং সম্যক গবেষণাগ্রন্থ
রচনা করেন। টীকাকার লেখক দত্তকের বিষয়ে নিম্নরূপ কাহিনী-পরম্পরা জানিয়ে রাখেন। মথুরা
থেকে একজন ব্রাহ্মণ দেশান্তরে পাটলিপুত্রে পৌঁছেছিল। বৃদ্ধ বয়সে তার একটি পুত্র জন্ম
নেয়। পুত্রটির মা প্রসূতি শয্যায় মারা যায় এবং পিতা শিশুটিকে এক ব্রাহ্মণীর হাতে দিয়ে
দেয়। সে ব্রাহ্মণী শিশুটির নাম রাখে দত্তক (কেননা শিশুটি তাকে দেওয়া হয়েছিল)। ছেলেটি
বড় হয়, সমস্ত শাস্ত্র এবং শিল্পকলার জ্ঞান অর্জন করে। শাস্ত্রের ব্যাখ্যায় তার অসাধারণ
দক্ষতার কারণে সে দত্তকাচার্য্য নামে খ্যাত হয়। বয়ঃপ্রাপ্ত হলে সে জগতের আচারব্যবহার
জানতে উদ্গ্রীব হয় এবং তার মনে হয় যে গণিকাদের কাছেই সেসব সবচেয়ে ভালোভাবে জানা যেতে
পারে। তাই সে তাদের পল্লীতে প্রতিদিন যাওয়া শুরু করে এবং তাদের আচারব্যবহার শেখে। এত
গভীরভাবে সে শেখে যে শেষে গণিকারাই তার কাছে প্রেমবিষয়ে পরামর্শ নিতে আসতে শুরু করে।
তখন বীরসেনা এবং পাটলিপুত্রের অন্যান্য বিশিষ্ট বারাঙ্গনারা তাকে, প্রেমিকদের হৃদয়
জয় করার শিল্প নিয়ে একটি গবেষণাগ্রন্থ লিখতে অনুরোধ করে।
দত্তকের উদাহরণটা
মানুষের মনে ধরে। বিদ্বান মানুষেরা প্রেমবিদ্যার অন্য ছয়টি বিষয়ে নিজেদের দক্ষতা কাজে
লাগাতে চাইছিল না। তাই চারায়ণ প্রারম্ভিক বিষয়ের ওপর, সুবর্ণনাভ মিলনের ওপর, ঘোটকমুখ
কন্যাদের ওপর, গোনার্দীয় পত্নীদের ওপর, গনিকপুত্র ব্যাভিচারের ওপর এবং কুচুমার বিজ্ঞানটির
গুপ্তকথার ওপর গ্রন্থ রচনা করে। এভাবে অনেক লেখক প্রেমবিদ্যার বিভিন্ন বিষয়ের ওপর স্বতন্ত্র
গ্রন্থ রচনা করে। সেগুলো যোগাড় করা এবং পড়া কঠিন। অন্যদিকে বাভ্রব্যর কাজটা এত ব্যাপক
যে পড়ে আয়ত্ত করা কঠিন। তাই বাৎস্যায়ন বাভ্রব্যের গ্রন্থটিকে সংক্ষিপ্ত করলেন। এভাবেই
বর্তমান কাজটি অস্তিত্বে এল।
মহাভাষ্যের রচনাকার
পতঞ্জলি গনিকার পুত্র ছিলেন এবং তাঁর জন্ম গোনার্দায় হয়েছিল। কিন্তু তাঁকে ভার্যাধিকরণিক
এবং পারদারিক অংশের লেখকের সাথে এক করা যায় না কেননা, স্পষ্টত তাঁরা দুজন ভিন্ন ব্যক্তি
ছিলেন। ঘোটকমুখের উল্লেখ শুধু কামসূত্রে নেই, অর্থশাস্ত্রেও আছে। সে দুজন এক ব্যক্তি
মনে হয় না। কেননা ঘোটমুখ ব্যক্তি-নাম নয়, গোত্র-নাম। একই ব্যাপার চারায়ণ নিয়েও, সেটিও
গোত্র-নাম।
প্রমাণ করার চেষ্টা
হয়েছে যে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের, বাৎস্যায়নের কামসূত্রের এবং পালি সাহিত্যের চারায়ণ
এবং ঘোটকমুখ অভিন্ন। কিন্তু সেটা অসম্ভব মনে হয়। কেননা দত্তকের পিতা মথুরা থেকে পাটলিপুত্রে
এসেছিলেন। তিনি এবং তাঁর পুত্র দত্তক কৌটিল্যের সমসাময়িক হবেন। কেননা, উদয়ীর চতুর্থ
বর্ষে পাটলিপুত্র রাজধানী হয়েছিল, এবং যে ব্রাহ্মণে সেখানে এসেছিল তার আকর্ষণের কারণই
ছিল যে পাটলিপুত্র এক বড় রাজতন্ত্রের রাজধানী। রাজগৃহ থেকে রাজধানী পাটলিপুত্রে অপসারিত
হয়েছে ৪৪০ খ্রিষ্টপূর্বে এবং কৌটিল্য সেখানে ৩২৫ খ্রিষ্টপূর্বে ছিলেন ধরে নিলে ব্রাহ্মণ
এবং তাঁর ছেলে দত্তক, কৌটিল্যের বেশি বয়সে সমসাময়িক হয়ে হবেন। দীঘ-চারায়ণ এবং ঘোটমুখ
দত্তকের পর প্রেমবিদ্যা বিষয়ে লেখেন। কাজেই কৌটিল্য তাদের লেখা থেকে উদ্ধৃতি দিতে পারেন
না। তাই কৌটিল্য উদ্ধৃত আর বাৎস্যায়ন উদ্ধৃত চারায়ণ এবং ঘোটমুখ এক ও অভিন্ন হতে পারেন
না। কৌটিল্য যাঁদের উদ্ধৃত করেন তাঁরা গল্প-বলিয়ে ছিলেন। পালি সাহিত্যে যাঁরা আছেন
তাঁরা ধার্মিক মানুষ এবং রাজনীতিবিদ। বাৎস্যায়ন যাঁদের উদ্ধৃত করেন তাঁরা প্রেমবিদ্যার
লেখক। এদেরকে এক ও অভিন্ন দেখান ধৃষ্টতা হবে। রাজশেখর তাঁর কাব্য-মীমাংসা-য়
কাব্যতত্ত্বের লেখক হিসেবে একজন সুবর্ণনাভ-এর উল্লেখ করেন। তাঁকে আমাদের সুবর্ণনাভ-এর
সঙ্গে এক করা দুঃসাহসিক হবে কেননা কাব্যতত্ত্ব অনেক পরের বিজ্ঞান।
বৈদিক সাহিত্যে শ্বেতকেতু
বেশ পরিচিত চরিত্র। তিনি প্রবহন জৈবল এবং বিদেহের জনকের সমসাময়িক। তিনি বৈদিক যুগের
শেষ দিকের। কিন্তু তিনি সেই ঋষি হিসেবে বেশি পরিচিত যিনি বিবাহ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন
এবং সম্ভবত প্রেমবিদ্যার ওপর বিস্তারিত গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তাঁর কিছু ভাবনা খুব
আদিম এবং স্থুল। কিন্তু অনুমান হয় যে তিনি ঐতিহাসিক ব্যক্তি ছিলেন এবং আমাদের ভাবতে
কোনো বাধা নেই যে তিনিই এই বিজ্ঞানের আদি প্রতিপাদক ছিলেন, কেননা তিনিই বিবাহ প্রণালীর
সংস্থাপক ছিলেন।
দ্বিতীয় লেখক হলেন
পাঞ্চাল বাভ্রব্য। তাঁর বই বাৎস্যায়ন পড়েছিলেন। কেননা বাৎস্যায়ন স্পষ্টভাবে লেখেনঃ
–
বাভ্রব্যীয়াংশ্চ
সূত্রার্থান আগম্য বিমৃষ্য চ
বাৎস্যায়নশ্চকারেদং
কামসূত্রং যথাবিধি ।।
অর্থাৎ বাৎস্যায়ন
তাঁর গুরুর সঙ্গে বাভ্রব্যের বইটি অধ্যয়ন করেছিলেন। জয়সওয়াল সাহেব ভাবেন যে যত্ন নিয়ে
খোঁজ করলে সে বই পাওয়া যেতে পারে, কেননা পঞ্চশায়ক-এর মত এত এদিককার কাজে বইটি থেকে
উদ্ধৃতি নেওয়া হয়েছে। ঔদ্দালকির কাজে ৫০০ অধ্যায়ের বিন্যাস জানা যায় না। এ কাজ সাতটি
অধিকরণে বিভাজিত ছিল না। কেননা সেই বিভাজন করার কৃতিত্ব বাৎস্যায়ন বাভ্রব্য পাঞ্চালকে
দিয়েছেন। খুব সম্ভবত ঔদ্দালকি অন্যান্য বিষয়ের তুলনায় মিলন অথবা সম্প্রযোগের ওপর বেশি
লিখেছেন। তিনি সে বিষয়কে দশটি প্রধান শীর্ষকে ভাগ করেছিলেন। তাই তাঁর কাজকে দশাতয়ী
বলা হয়। বিবাহ প্রণালীর প্রবর্তনের সময় এটাই স্বাভাবিক তিনি সতী স্ত্রী, বালিকাবধু
এবং গণিকাদের কর্তব্য বিষয়ে, এবং ব্যভিচার বিষয়ে কিছু লেখা থেকে বিরত থাকবেন, কেননা
তাঁর সময়ে বা তার আগে বিবাহ বলে কিছু ছিল না। বস্তুতঃ সেই সমাজে যেখানে বিবাহকে একটি
প্রাচীন এবং পবিত্র সংস্থা গণ্য করা হয়, সাত অধিকরণ সম্বলিত বাভ্রব্যের গ্রন্থ সম্ভব।
বাভ্রব্য মিলনের দশটি প্রধান শীর্ষককে চৌষট্টি অংশে বা কলায় ভাগ করেন। প্রত্যেকটি শীর্ষককে
আটভাগেই ভাগ করেছেন এমন নয়, কিন্তু উপ-বিভক্তির মোট সংখ্যা চৌষট্টি।
ঋগ্বেদ প্রথমত দশটি
মণ্ডলে বিভক্ত ছিল। তাই তাকে দশাতয়ী বলা হত। কিন্তু পাঞ্চাল দেশে অষ্টকে বিভক্ত করা
হয় এবং প্রতিটি অষ্টককে আটটি অধ্যায়ে বিভক্ত করা হয়। তাই বলা হতে লাগল চতুঃষষ্টি। শুধু
মিলন সম্বলিত পুরো কামশাস্ত্রও, প্রথমে দশ ভাগে বিভক্ত ছিল। বাভ্রব্য পাঞ্চাল তাকে
চৌষট্টি প্রকরণে অথবা বিষয়ে কমিয়ে আনেন। মিলন বিষয়টিকেও, যেটি দ্বিতীয় অধিকরণে বিবেচিত,
তিনি আটটি আটটি অনুচ্ছেদে এবং চৌষট্টিটি উপচ্ছেদে কমিয়ে আনেন। তাই বাহবৃচ অথবা ঋগ্বেদী
ব্রাহ্মণেরা খেলাচ্ছলে এবং শয়তানি করে কামশাস্ত্রকে বলত ‘চৌষট্টি’। বাৎস্যায়ন বলেন,
কামশাস্ত্র বোঝাতে চৌষট্টি শব্দটির ব্যবহার উপযুক্ত, কেননা ঋগ্বেদের মত এটিরও দশ এবং
চৌষট্টি, দুধরণের ভাগই আছে। এবং দুই ক্ষেত্রেই পরিবর্তনের রচয়িতা ছিলেন একজন পাঞ্চাল
– ‘পাঞ্চাল-সম্বন্ধাচ্চ’ ।
এ কথাটা আরো সংশোধিত
করে টীকাকার বলেন, “পাঞ্চালেন মহর্ষিণা ঋগ্বেদে চতুঃষষ্টির-নিগদিতা
বাভ্রব্যেনাপি পাঞ্চালেন স্বকৃতে সাম্প্রযোগিকে অধিকরণে আলিঙ্গনাদয় উক্তাঃ, ততশ্চ দ্বয়োরেকগোত্রনিমিত্তসমাখ্যেন
পাঞ্চালেন নিগদনাত সম্বন্ধোSস্তেব”।
পাঞ্চাল শব্দটা দেশ
নয়, গোত্র বোঝাতে ব্যবহৃত মনে হয়। এবং কশ্যপের বংশধরদের মধ্যে একটি পাঞ্চাল গোত্র আছে।
হতে পারে গোত্র-নামটি তার মূল নিবাস পাঞ্চাল দেশের নাম থেকেই আহরিত, কিন্তু এমন কোনো
নিশ্চিত লক্ষণ নেই যে রচনাগুলোর পুনর্বিন্যাস পাঞ্চাল দেশে হয়েছিল। অবশ্য এই তথ্যগুলোর
বিরাট গুরুত্ব যে পাঞ্চাল গোত্রের ঋষি ঋগ্বেদকে পুনর্বিন্যস্ত করেছিলেন, গোত্রটি পরবর্তী
বৈদিক যুগের ছিল এবং পাঞ্চাল দেশের সাথে গোত্রটির একটি সম্পর্ক ছিল। এখনো অব্দি মণ্ডল
থেকে অষ্টকে ঋগ্বেদের পুনর্বিন্যাসকর্তা সম্পর্কে সন্দেহাতীত ভাবে কিছু জানা ছিল না।
পাঞ্চাল যে দেশ নয় গোত্র সেটা ওপরে উদ্ধৃত টীকায় স্পষ্টভাবে বলা আছে। কাজেই বাভ্রব্য
এখানে নিছক বংশনাম, গোত্র নয়, যদিও বিশ্বামিত্রের বংশধরদের মধ্যে বাভ্রব্য গোত্র তালিকাভুক্ত
আছে।
শাস্ত্রের শ্রেণীভুক্তকরণ
কৌটিল্য সব বিজ্ঞানকে
চার শিরোনামে শ্রেণীভুক্ত করেন – আন্বীক্ষিকী, ত্রয়ী,
বার্তা এবং[bp1] দণ্ডনীতি অর্থাৎ দর্শন, ধর্ম, অর্থনীতি এবং
রাজনীতি। কিন্তু তিনি শুধু রাজবিদ্যা বা রাজকীয় বিদ্যাভ্যাস নিয়ে চিন্তিত। বস্তুতঃ
ওই শ্রেণীভুক্তকরণ তাঁর সময়ে জ্ঞাত সবকটি বিজ্ঞানের নয়। বাৎস্যায়ন অধিক সুব্যক্ত এবং
সামগ্রিক। তিনি সমস্ত মানব-বিদ্যাভ্যাসকে ত্রিবর্গে শ্রেণীভুক্ত করেন – ধর্ম, অর্থ এবং কাম। নিজের একটি সূত্রে তিনি মোক্ষ-এর উল্লেখ করেন,
কিন্তু তারপর সেটা তিনি একেবারেই বাদ দেন। তিনি বলেন যে ধর্ম হয় শ্রুতি (স্মৃতি অন্তর্ভুক্ত)
থেকে শিখতে হবে নয় বিদ্বানদের কাছে। অর্থ অথবা অর্থনীতি রাজকীয় আধিকারিকদের আচরণ থেকে
অথবা বিশেষজ্ঞদের কাছে শিখতে হবে। কাম-এর পরিভাষা সাধারণভাবে তিনি করেন সবকটি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য
বস্তুর উপভোগ। কিন্তু তারপর তাকে তিনি প্রচলিত অর্থে সীমিত করেন। এটি কামসূত্র থেকে
অথবা নাগরকদের কাছে শিখতে হবে। বাৎস্যায়ন বলেন, অর্থ কামের থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ
এবং ধর্ম অর্থের থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
শাস্ত্রের, কৌটিল্য
এবং বাৎস্যায়ন কৃত বর্গীকরণের তুলনা করলে দেখা যায় যে ধর্ম ত্রয়ীর চেয়ে বেশি সামগ্রিক
শব্দ এবং আন্বীক্ষিকীকেও অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। অর্থ বার্তার চেয়ে বেশি সামগ্রিক। কামশাস্ত্রকে
কৌটিল্য অন্তর্ভুক্তই করেন নি, সাধারণ অর্থেও নয়, সীমিত অর্থেও নয়। তাই বাৎস্যায়ন কৌটিল্য
থেকে বেশি উন্নত চিন্তার প্রতিনিধিত্ব করেন। বাৎস্যায়নের সময় সেসব মানুষেরাও ছিল যারা
এই বিদ্যাভ্যাসের উপযোগিতায় বিশ্বাস করত না এবং তাই কঠোরভাবে বিরোধ করত। বাৎস্যায়ন
তাদের যুক্তিগুলোর দাবি মেটাতে অনেক চেষ্টা করেন। ধর্ম অধ্যয়নের ব্যাপারে তাঁর মুখ্য
বিরোধী ছিল লোকায়তিকেরা। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র একটি দার্শনিক চিন্তাধারা হিসেবে তাদের
উল্লেখ করে। পতঞ্জলি বলেন তাদের প্রধান লেখকদের একজন ছিলেন ভাগুরি। কিন্তু বাৎস্যায়ন
তাদের দর্শন থেকে একটি সূত্র উদ্ধৃত করেন –
(১) বরং সাংশয়িকাত
নীষ্কাত অসাংচায়িকঃ কার্ষাপণঃ ।
এটিই তাদের মূল সূত্রাদি
থেকে পাওয়া প্রথম সন্দেহাতীত উদ্ধৃতি। কিন্তু আমি মনে করি যে কামশাস্ত্রের, ধর্ম-অধ্যয়নের
উপযোগিতার বিরোধকারী, পাঁচ সূত্র সম্বলিত একটি পুরো পরিচ্ছেদ লোকায়তিকদের সূত্রগুলোর
বিরুদ্ধে উদ্দিষ্ট। সেগুলো হলঃ –
(১) ন ধর্মাংশ্চরেত
– এষ্যাতফলত্বাত সাংশায়িকত্বাত চ । (২) কোব্যবালিসো
হস্তগতম পরাগতং কুর্্য্যাত । (৩) বরমদ্য কপোতঃ শ্বো ময়ূরাত ।
এ প্রসঙ্গে বলা যায়
যে বর্তমানে চার্বাক অথবা লোকায়তিক চিন্তাধারার তত্ত্ব সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান দুটো
উদ্ধৃতিতে সীমিত। একটি নৈষধ-চরিতংএর সপ্তদশ সর্গ থেকে আর অন্যটি সর্বদর্শনসংগ্রহ-এর
প্রথম অধ্যায় থেকে। দুটোই পদ্যে, গদ্যে বা সূত্র রূপে নয়। এক জায়গায় সূত্রকারের নাম
বৃহস্পতি দেওয়া আছেঃ –
অগ্নিহোত্রং ত্রয়ো
বেদাঃ ত্রিদণ্ডং ভস্মপুণ্ড্রকং প্রজ্ঞাপৌরুষহীনানাম জিবিকেতি বৃহস্পতিঃ ।
এক জায়গায় চতুর্থ
পাদে আছে ‘জিবিকা ধাতৃনির্মিতা’।
তাদের সূত্রের আরেকটি
উল্লেখ পাওয়া গেছে হরিভদ্রের সদ্দর্শন-সমুচ্চয়-এ, যিনি ৫৮৫ সম্বতে মারা গিয়েছিলেন।
সেখানে লেখক অনেকগুলো কারিকা লোকায়ত তত্ত্বসমূহ স্পষ্ট করতে নিয়োজিত করেন। টীকাকার
গুণরত্ন বাচস্পতি (বৃহস্পতিরই অন্য নাম) থেকে একটি পদ্য উদ্ধৃত করেনঃ –
পৃথিব্যাপ্তেজোবায়ুরিতি
তত্ত্বানি তত সমুদায়ে। ষরীরেন্দ্রিয়সংজ্ঞা তেভ্যশ্চৈতন্যং।
(সদ্দর্শন-সমুচ্চয়,
পৃ. ৩০৭, বিব্লিওথেকা ইন্ডিকা সম্পাদিত)
এটি সম্পূর্ণভাবে
মিলে যায় ‘ইন্ট্রোডাকশন টু দ্য বৈশেষিক ফিলজফি’তে ইউয়াই সাহেব কর্তৃক উদ্ধৃত অজিতকেশকম্বলের মতের সঙ্গে (পৃ. ১৯-২০)।
বইয়ের সেই অংশটাই পুরো এখানে উদ্ধৃত করছি। “অজিতকেশকম্বল
যুক্তি রাখেন যে মানবশরীর চারটি উপাদানে তৈরি (চতুর্মহাভূতিক)। যখন সে মরে তার ভিতরের
পৃথিবী পৃথিবীতে ফিরে যায়, তরলগুলো জলে ফিরে যায়, তাপ আগুনে, বায়ু বাতাসে এবং তার মৌলিক
মানসিক শক্তিগুলো (ইন্দ্রিয়ানি, পাঁচটি অনুভূতি এবং ষষ্ঠ, চিত্ত) দেশে (আকাশ) ফিরে
যায়।” এর ওপর ইউয়াই সাহেব মন্তব্য করেন, “এ অভিমত বাস্তবিক এবং সহজাত বস্তুবাদ। আত্মা নেই, কোনো অন্য মানসিক
কারক নেই শুধু পাঁচ প্রকারের পদার্থ। শরীর পাঁচটি উপাদানের সমষ্টি এবং আত্মা শরীর ছাড়া
আর কিছুই নয়। অজিতকেশকম্বল সম্ভবত একজন চার্বাক।”
কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্রে
বলেন যে বৃহস্পতি এবং তাঁর অনুগামীরা বলত রাজকীয় বিদ্যাভ্যাস অর্থনীতি এবং রাজনীতিতে
সীমিত থাকা উচিৎ, দর্শন এবং বেদ পুরোপুরি বাদ দেওয়া উচিৎ। একটি ভারতীয় পরম্পরা আছে
যে বৃহস্পতি একজন নাস্তিক ছিলেন, এবং চার্বাক চিন্তাধারার বৃহস্পতি সূত্রের সন্ধান
করতে আমাকে বহুবার বলা হয়েছে। এখানে উদ্ধৃত সূত্রগুলো কি বৃহস্পতিরই রচনার অংশ হতে
পারে না?
লোকায়তিকদের সঙ্গে
ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত দুটো আরো চিন্তাধারা থেকে উদ্ধৃতি দেন বাৎস্যায়ন। তাদেরকে বলা
হয় কালকারণিক এবং অর্থচিন্তক। টীকাকার আরেকটি চিন্তাধারার কথা বলেন, ঈশ্বরকারণিক। অর্থচিন্তক
চিন্তাধারা থেকে তিনটে সূত্র উদ্ধৃত আছে। সেগুলো হল –
বহবাশ্চ কামবশগাঃ
সগণা এব বিনষ্টাঃ শ্রুয়ন্তে। তথা দাণ্ডক্যো নাম ভোজঃ কামাত ব্রাহ্মণ-কন্যাং অভিমন্যমানাঃ
সবন্ধুরাষ্ট্রো বিননাশ। দেবরাজশ্চাহল্যামতিবলশ্চ কীচকো দ্রৌপদীং রাবণশ্চ সীতাং অপারে
চান্যে চ বহবো দৃশ্যন্তে কামবশাগা বিনষ্টা ইত্যর্থচিন্তকাঃ।
এই তিনটের মধ্যে
দ্বিতীয় সূত্রটি কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে শব্দে শব্দে এবং অক্ষরে অক্ষরে বসান পাওয়া
যায়। অন্য দুটো সূত্রও সম্ভবত অর্থচিন্তকদের কাছ থেকে এসেছে। কৌটিল্যে আরো অনেক উদাহরণ
রয়েছে, কেননা তাঁর পুরো ছয় ছয়টা ভিন্ন আবেগার্তির কুপরিণতি দেখাবার ছিল। যখন নাকি বর্তমান
লেখকের শুধু কামলালসার পরিণাম দেখাবার আছে।
বাৎস্যায়নের সময়
বাৎস্যায়নের সময়
নির্ধারণ সেই রচয়িতাদের বয়স দিয়ে হতে পারে যাদের তিনি উদ্ধৃত করেন এবং সেই রচয়িতাদের
বয়স দিয়ে হতে পারে যারা তাঁকে উদ্ধৃত করে অথবা তাঁর বইয়ে লিপিভুক্ত ঘটনাবলীর বয়স দিয়ে
হতে পারে। ঔদ্দালকি, বাভ্রব্য-পাঞ্চাল, দত্তক, চারায়ণ, ঘোটমুখ, সুবর্ণনাভ, কুচুমার,
গোনার্দীয় গনিকাপুত্র প্রভৃতি রচয়িতাকে তিনি উদ্ধৃত করেন। কিন্তু এই রচয়িতাদের সঠিক
সালতারিখ আমরা জানিনা তাই বাৎস্যায়নের সালতারিখের কোনো সন্ধানসূত্র এরা দিতে পারবে
না। একটাই ব্যাপার নিশ্চিত জানা আছে যে দত্তক পাটলিপুত্রের বাসিন্দা ছিলেন। তাঁর যুগের
উচ্চসীমায় তিনি কৌটিল্যের সমসাময়িক হতে পারেন। কিন্তু তাঁর যুগের নিম্নসীমা জানা যায়
না। বাৎস্যায়ন একটি ঘটনার উল্লেখ করেন, কুন্তল সাতকর্ণী সাতবাহনের প্রাসাদের একটি মর্মান্তিক
কেলেঙ্কারির কথা। তিনি অন্ধ্র রাজবংশের ত্রয়োদশ রাজা ছিলেন এবং তাঁকে খ্রিষ্টপূর্ব
প্রথম শতকে রাখা যায়। এবং বাৎস্যায়ন সেই সময়টায় উন্নতি লাভ করেন যখন সেই কেলেঙ্কারির
স্মৃতি টাটকা ছিল। কাজেই তাঁকে প্রথম খ্রিষ্টাব্দে রাখা যেতে পারে। কেননা জনতার স্মৃতি
খুব ছোট এবং এক বা দুই প্রজন্মে মানুষ এসব কেলেঙ্কারি ভুলে যায়। কামসূত্রে অন্যান্য
ঘটনাও লিপিবদ্ধ করা আছে। নরদেব, যাকে টীকাকার পাণ্ড্য রাজাদের সেনাপতি বলেন, এক নর্ত্তকীকে
হত্যা করেছিল এবং চোলরাজ চিত্রসেনা নামে এক গণিকাকে হত্যা করেছিল। কিন্তু পাণ্ড্য এবং
চোল রাজাদের নাম দেওয়া নেই এবং তাদের কালপঞ্জি জানার ব্যাপারে আমরা অগাধ সমুদ্রে। বাৎস্যায়ন
আভীর কোট্টরাজের কথা বলেন যাকে এক ধোপা খুন করেছিল। সে ধোপাকে কাজে রেখেছিল রাজার ভাই।
খুনটা হয়েছিল যখন রাজা নিজের ভালোবাসার জনকে খুঁজতে অন্য এক মানুষের বাড়িতে ঢুকেছিল।
কোট্ট যে গুজরাটের একটি জায়গা, এটুকু তথ্য দিয়ে টীকাকার আমাদের আলোকিত করেছেন। কিন্তু
আমরা কোট্টর বিষয়ে কিছুই জানি না, এবং গুজরাট অনেক পরের একটি নাম, বাৎস্যায়নের মত পুরোনো
নয়। গুর্জরদের আগমনের পর সে দেশটির নাম গুজরাট হয়েছিল। টীকাকার আমাদের এটাও বলেন যে
আভীর এক রাজার নাম, জনগোষ্ঠির নয়। বাৎস্যায়ন আরো বলেন যে কাশীর রাজা জয়তসেনাকে তার
অশ্বপাল হত্যা করেছিল। সেটাও আমাদের লেখকের সালতারিখের সন্ধানসূত্র দিতে কোনো সাহায্য
করে না। ভারতীয় ইতিহাসের এখন অব্দি জ্ঞাত যৎসামান্য তথ্যাদি থেকে আমি বাৎস্যায়নের সালতারিখ
আন্দাজ করার দুঃসাহস করব না। এটুকু জোর দিয়ে বলতে পারি যে তিনি কুন্তল সাতকর্ণীর দুই
বা তিন প্রজন্ম পরে এসেছিলেন।
বাৎস্যায়নের সময়
নির্দ্ধারণ করার আরেকটি পথ আছে। তাঁর উল্লেখ করা সবকটি দেশের নাম নিয়ে দেখুন যে কোন
শতকে তারা সামাজিক একক রূপে অস্তিত্বে ছিল। কেননা রাজনৈতিক একক নিয়ে লেখকের কোনো কারবার
নেই। তাঁর কাছে কুন্তল সাতকর্ণী, নরদেব, পাণ্ড্য সেনাপতি, চোল রাজা সব এক স্তরের। তাঁর
উল্লিখিত জনগোষ্ঠি এবং জনগোষ্ঠিগত দেশ হল অন্ধ্র, বৎসগুল্মক, বৈদর্ভ, অপরান্তক, সৌরাষ্ট্রিক,
অভীরক, স্ত্রৈরাজ্যক, গৌড়, সৈন্ধব, হৈমবত, প্রাচ্য, বঙ্গ, অঙ্গ, কলিঙ্গ, নাগরক, মধ্যদেশক,
বালহীক, অবন্তিক, মালব, অভীর, ছয় নদী পরিবেষ্টিত ভূমি (যাতে ষষ্ঠ নদী সিন্ধু), লাট,
কোশল, সাকেত, অহিচ্ছত্র, সৌরসেন মহারাষ্ট্র, দ্রবিড়, বানবাসিক এবং চোল। টীকাকার এই
দেশগুলো অথবা এই জনগোষ্ঠিগুলোর বসতির কিছু নিখুঁত নির্দেশিকা দেন। যেমন তিনি বলেন –
প্রাচ্যা অঙ্গাৎ
পূর্বেণ (বম্বে সংস্করণ পৃ. ১৭১)। সাকেতা অযোধ্যকাঃ (ঐ পৃ. ১৭২)। নগরকাঃ পাটলিপুত্রকাঃ
(পৃ. ১৭২)। শৌরসেনাঃ কৌশাম্ব্যঃ, কালিন্দ্যঃ দক্ষিণতঃ কুলে যে নিবসন্তি (ঐ পৃ. ১৭২)।
স্ত্রীরাজ্যাস-ত্রিপুরী তত্র ভবানাম (ঐ পৃ. ৩২২)। গৌড়াঃ কামরূপকাঃ প্রাচ্যবিশেষাঃ
(ঐ পৃ. ৩০২)। সৈন্ধবানাং সিন্ধুনামা নদস্তস্য পশ্চিমেন সিন্ধুদেষস-তত্র ভবানাং (ঐ পৃ.
৩০২)। হৈমবতানাং হিমবদ-দ্রোনী-ভবানাং (ঐ পৃ. ৩০২)। অঙ্গাঃ রোমরাহিত্যাৎ (?) পূর্বেণ
অঙ্গাঃ (ঐ পৃ. ৩০২)। কলিঙ্গাঃ মহানন্দ্যাঃ পূর্বেণ কলিঙ্গাঃ (ঐ পৃ. ৩০২)। বঙ্গাঃ গৌড়বিষয়াদ্
দক্ষিণেন বঙ্গাঃ (ঐ পৃ. ৩০২)।
অঙ্গ, বঙ্গ আর কলিঙ্গের
বর্ণনা দেওয়া অংশটা অপ্রতিকার্যরূপে বিকৃত। বেনারস সংস্করণ অনুসারে –
বঙ্গাঃ লৌহিত্যাৎ
পূর্বেণ, অঙ্গাঃ মহানন্দ্যাঃ পূর্বেণ, কলিঙ্গাঃ গৌড়বিষয়াদ্দক্ষিণেন (পৃ. ২৯৫ বেনারস
সংস্করণ)
আমি মনে করি না বেনারস
সংস্করণ অবস্থাটা বিশেষ কিছু শোধরায়।
বৎসগুল্মকাঃ দক্ষিণাপথে
সদরয়্যৌ রাজপুত্রৌ বৎসগুল্মৌ তাভ্যামধ্যবাসিতো দেশো বৎসগুল্মক ইতি প্রতীতঃ (পৃ. ২৯৫
বম্বে সংস্করণ)। বৈদর্ভাঃ কালাঞ্জরাদ্দক্ষিণেন বিদর্ভো নাম দেশস-তত্র ভবানাং (পৃ. ২৮৮
বেনারস সংস্করণ)। পশ্চিমসমুদ্র-সমীপে অপরান্তদেশঃ (পৃ. ১৩০ বম্বে সংস্করণ)। লাটঃ অপর-মালবাৎপশ্চিমেন
লাটবিষয়ঃ (পৃ. ১৩০ ঐ)। বজ্রবান্তদেশাৎ পশ্চিমেন স্ত্রীরাজ্যং (পৃ. ১৩০ ঐ)। বেনারস সংস্করণে
বজ্রবন্ত-র বদলে বঙ্গরক্ত লেখা আছে (পৃ. ১২৬
বেনারস সংস্করণ)। অন্ধ্র ইতি নর্মদায়া দক্ষিণেন দেশো দক্ষিণাপথঃ তত্র কর্ণাট-বিষয়াৎ
পূর্বেণ অন্ধ্র বিষয়ঃ (পৃ. ১৩০ বম্বে সংস্করণ)। মহারাষ্ট্রকা ইতি নর্মদা কর্ণাটবিষয়য়োর্মধ্যে
মহারাষ্ট্রবিষয়ঃ (পৃ. ১৩১ ঐ)। নাগরিকা ইতি পাটলিপুত্রকাঃ (পৃ. ১৩১ ঐ)। দ্রবিড় ইতি কর্ণাটিবিষয়াদ্দক্ষিণেন
দ্রবিড়বিষয়ঃ (পৃ. ১৩১ ঐ)। বনবাসঃ কুঙ্কনবিষয়াৎ পূর্বেণ বনবাসবিষয়ঃ (পৃ. ১৩১ ঐ)। আভীরদেশঃ
শ্রীকন্ঠ-কুরুক্ষেত্রাদিভূমিঃ (পৃ. ১৩০ ঐ)। মালব্যা ইতি পূর্বেণ মালবভবাঃ। আবন্তিকাঃ
উজ্জয়িনীদেশভবাঃ তা এব অপর-মালব্যাঃ।
এর মধ্যে অধিকাংশ
দেশ ব্রাহ্মণ, সূত্র, কৌটিল্যর অর্থশাস্ত্র, মহাভারতের মত প্রাচীন রচনায় এবং অশোকের
শিলালিপিতে পরিচিত। বনবাসী বেশ আধুনিক মনে হয়। মৈসুরের শিমোগা জেলার প্রাচীন নাম ছিল
জয়ন্তী বা বৈজয়ন্তী। ত্রিনেত্ররা রাজসিংহাসনে আরূঢ় হওয়ার এক বা দু শতক আগে জায়গাটা
বনবাসী নামে পরিচিত হল। চার বা পাঁচ প্রজন্ম পরে ত্রিনেত্রদের অপসারিত করল কদম্বরা,
যারা ব্রাহ্মণ থেকে ক্ষত্রিয় হয়েছিল এবং যারা, অনুমান হয়, খ্রিষ্টাব্দ তৃতীয় শতকের
শুরুতে ক্ষমতায় এসেছিল। রাজবংশের পঞ্চম রাজা, কাকুৎস্থবর্মা ঘোষণা করে যে সে দক্ষিণের
গুপ্তদের বন্ধু। “মাইসোর অ্যান্ড কুর্গ ফ্রম ইনস্ক্রিপশন্স” বইটিতে লেখক লিউইস রাইস ভাবেন যে কাকুৎস্থবর্মা কর্তৃক উল্লিখিত
গুপ্ত রাজা আর কেউ নন, সমুদ্রগুপ্ত যিনি তাঁর দিগ্বিজয়ে দক্ষিণে এসেছিলেন খ্রিষ্টাব্দ
চতুর্থ শতকে (দেখুন রাইস, কদম্ব সংক্রান্ত অধ্যায়)। অতএব, বৈজয়ন্তী বনবাসী হয়েছে খ্রিষ্ট
অব্দের শুরুতে।
সৌরাষ্ট্র নামে দেশটি
কৌটিল্যের পরিচিত। পুরো সৌরাষ্ট্র অথবা অপর-মালবের পশ্চিম অব্দি তার একটা অংশ লারিয়া
নামে খ্রিষ্টাব্দ দ্বিতীয় শতকের মধ্যবর্তী সময়ে টলেমির পরিচিত। দেশটার লারিয়া নাম হয়েছিল
সম্ভবত টলেমির মোটামুটি এক শতক আগে। লারিয়া সংস্কৃতে হবে লাট, এবং লাট বাৎস্যায়নের
চেনা। অতএব, বাৎস্যায়নকে সহজে খ্রিষ্টাব্দ প্রথম শতকে রাখা যায়।
অহিচ্ছত্রে শিলালিপির
অবশেষগুলো খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক থেকে খ্রিষ্টাব্দ তৃতীয় শতক অব্দিকার। কাজেই খ্রিষ্টাব্দ
প্রথম শতকে অহিচ্ছত্র একটি অতি-পরিচিত স্থান ছিল এবং বাৎস্যায়ন বলেন যে গণিকাদের প্রতি
আচরণে অহিচ্ছত্রের মানুষেরা বেশ গোঁড়া ছিল। এসব বিবেচনা করে, বাৎস্যায়নকে আমি খ্রিষ্টাব্দ
প্রথম শতকে রাখি। যেমন আগে বলেছি, পুরোনো সময়ের কোনো সংস্কৃত গ্রন্থের রচনার সালতারিখ
নিশ্চিত নির্দ্ধারণে ছাত্ররা সক্ষম হবে তেমন উন্নত ভারতীয় কালপঞ্জীর জ্ঞান এখনো হয়
নি। মোটামুটি এক শতকের মধ্যে সময়টাকে আনতে পারলে যথেষ্ট।
যাহোক, ওপরের আলোচনাগুলো
কামশাস্ত্র থেকে বেছে বেছে বার করতে পারা ঐতিহাসিক তথ্যাদির শুকনো এবং ক্লান্তিকর বর্ণনা
মাত্র। গ্রন্থটির আরেকটি দিক আছে যেটি অনেক বেশি আকর্ষক এবং চিত্তগ্রাহী; আমি সে সময়কার
সমাজের ছবিগুলোর কথা বলছি। একটি জীবিত সমাজের ছবি, যেমন লেখক নিজের চারদিকে দেখেছেন
এবং নিজের অভিজ্ঞতায় পেয়েছেন। এখন আমি সে ছবিগুলোর কয়েকটি আপনাদের সামনে মেলে ধরার
চেষ্টা করব। প্রথম বইয়েই বাৎস্যায়ন নাগরকের
ছবি পেশ করেন। আমি বুঝতে পারছি না শব্দটাকে ইংরেজিতে কিভাবে অনুবাদ করব। আক্ষরিকভাবে
শব্দটির অর্থ ‘নাগরিক’। কিন্তু ‘নাগরিক’ নাগরকের সব কটি অর্থ বোঝাবে না। ‘ফুলবাবু’ শব্দটায় খারাপ ধরণের
গন্ধ আছে। ‘নাগর’ আবার নাগরকের
সামাজিক দিকগুলো ব্যক্ত করে না। আমি তাই, আমার ইংরেজির দারিদ্র্যে শব্দটির অনুবাদ করব
‘কেতাদুরস্ত মানুষ’। তার প্রথম বৈশিষ্ট যে তাকে সুপন্ডিত হতে হবে। তার দ্বিতীয় বৈশিষ্ট
যে তাকে বিবাহিত হতে হবে। তার তৃতীয় বৈশিষ্ট যে তার আর্থিক ক্ষমতা থাকবে, সে পূর্বপুরুষদের
সম্পদ উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়ে হোক বা নিজে চেষ্টা করে হোক। সে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়,
বৈশ্য, শূদ্র যা কিছু হতে পারে। সে হয় বড় নগরে থাকবে, নয় ছোটো শহরে, অথবা মফস্বলে বা
ভালো মানুষজন পরিবৃত কোনো জায়গায়। তার একটি বাড়ি থাকতে হবে, তার সামর্থ্য অনুযায়ী বড়
বা ছোট, কিন্তু কেতাদুরস্ত মানুষ হিসেবে তার বাড়ির দুটো অংশ থাকবে, অন্দর এবং সদর,
অন্দর তার পরিবারের জন্য এবং সদর তার বন্ধুদের জন্য। সদরটি জলের পর্দার কাছাকাছি থাকবে
এবং সংলগ্ন একটি বাগান থাকবে। দুই অংশেই অনেক ঘর থাকবে। সদরে বসার ঘরে একটি খাট ও একটি সোফা থাকবে, একটি
শোভন বিছানা থাকবে যাতে দুটো বালিশের একটি মাথার দিকে ও একটি পায়ের দিকে থাকবে। বাঙালিদের
পাশবালিশের ব্যবহার প্রাচীন সময়ে ছিল না। বিছানাটি মাঝে অবতল হবে এবং পরিষ্কার সাদা
চাদর দিয়ে ঢাকা থাকবে। খাটের পাশে আরেকটি খাট থাকবে, একটু নিচু, একই ভাবে সাজান। ঠিক
মাথার ওপর, সম্ভবত একটি কুলুঙ্গিতে একটি চাদর পাতা থাকবে, নাগরকর দেবতার জয় আসন; এবং
একটি উন্নত সমতল স্থান, দেয়াল থেকে বেরিয়ে আসা তাকের মত, যেখানে রাখতে হবে রাত্রে ব্যবহৃত
প্রলেপের অবশেষ, মালা, মোম রাখা এবং সুগন্ধী রাখা দুটো ছোট ডিবে, লেবুর খোসা এবং পান।
মেঝেতে একটি পিকদান থাকবে। দেয়ালে বন্ধনী থেকে একটি বীণা ঝুলে থাকবে, একটি ছবির পট,
রঙের বাক্স, কিছু প্রিয় বই এবং পারিজাতের (ঝিন্টি) মালা। মেঝেতে, খাট থেকে অদূরে চাদর
ও তাকিয়া বেছান থাকবে। দেয়ালে ভর দিয়ে দাবার ছক এবং পাশা রাখা থাকবে। ঘরের বাইরে থাকতে
হবে পাখির খাঁচা। এক কোণায় খেলনা হিসেবে চরকা এবং ছুতোরের যন্ত্রপাতি থাকবে। গাছের
ছায়াদার কুঞ্জে একটি সাধারণ দোলনা থাকবে এবং একটি বৃত্তাকার দোলনা, ফুলে ঢাকা বসার
আসন।
নাগরকের প্রাত্যহিক কর্তব্য
সে সকালে উঠবে, প্রাতঃকৃত্য
সারবে, দাঁত মাজবে, সারা শরীরে মিহি করে প্রলেপ লাগাবে, ধুপ জ্বালিয়ে তাকে সুগন্ধিত
করবে, মালা পরবে, মোম এবং লাল রঙ দিয়ে ঠোঁট রাঙাবে, সুগন্ধিত পান চিবোবে, আয়নার সামনে
দাঁড়াবে, তারপর নিজের কাজে যাবে।
তার অন্যান্য কর্তব্য
হল, প্রতিদিন চান করা, প্রতি দ্বিতীয় দিন সুগন্ধী দিয়ে নিজের শরীরকে পরিষ্কার করা,
ফেনক (সাবানের মত কিছু) দিয়ে পা দুটোকে নরম করা, প্রত্যেক চতুর্থ দিন শরীরের উপরিভাগ
কামান এবং প্রত্যেক পঞ্চম বা দশম দিন নিম্নভাগ। এসব প্রতিটি কাজ নিপুণভাবে করতে হবে।
সে এমন আচরণ করবে যাতে তার বগল না ঘামে। সে দুবার ভোজন করবে, একবার পূর্বাহ্নে এবং
একবার অপরাহ্নে। কিন্তু ‘সামান্যাধিকরণ’এর লেখক চারায়ণ বলেন, অপরাহ্নে নয়, একটি ভোজন সে রাত্রে করবে। ;মৃচ্ছকটিক’এ আমরা দেখি যে সাতসকালে একটি উপাহার হয়, কল্যবর্ত। এটা চারায়ণও
লেখেন নি, বাৎস্যায়নও লেখেন নি। এবং চারায়ণ শুধু একটি সামান্যাধিকরণ লিখেছেন। একটা
যুক্তি হতে পারে যে মৃচ্ছকটিক চারায়ণেরও লেখার আগে রচিত হয়েছে। আহারের পর সে নিজের
টিয়েগুলোকে কথা বলাবে। তারপর সে মোরগের লড়াই দেখে, ভেড়াদের ঢুঁ-মারা খেলা দেখে এবং
চারুকলার সূচিতে বর্ণিত অন্যান্য আমোদপ্রমোদে নিজেকে ব্যস্ত রাখে। তারপর আসে তার প্রণয়-দূতেরা
[কোটনা] এবং তার অভিসারের সাঙ্গোপাঙ্গরা। তাদেরকে বিদায় জানিয়ে সে একটা ছোট্ট ঘুম দেয়।
ঘুমিয়ে উঠে জামাকাপড় পরে এবং সঙ্গীদের কাছে যায়। তারপর গোধূলিতে আসে সঙ্গীত। একটু পরে
সে নিজের সুসজ্জিত, জ্বলন্ত ধূপের সুগন্ধে ভরা ঘরে নিজের প্রণয়িনীদের প্রতীক্ষা করে
অথবা তাদের ডেকে আনতে বার্তাবাহকদের পাঠায়; অথবা নিজেই তাদের সঙ্গে দেখা করতে যায়।
যখন রমণীরা আসেন, হাসিখুশি এবং খোশামুদে কথা বলে সে তাদের আপ্যায়ন করে। যদি তাদের পোষাক
বৃষ্টিতে ভিজে গিয়ে থাকে, সে নিজের হাতে তাদের পোষাক বদলে দেয়।
অনিয়মিত কর্তব্য
নাগরক সারা বছর সবকটি
বিভিন্ন ঋতুতে সবধরণের উৎসব সংগঠিত করে। হিন্দু নির্ঘন্টে বিশেষ বিশেষ দেবদেবীর জন্য
উৎসবের দিনের ব্যবস্থা আছে। কেতাদুরস্ত মানুষদের কর্তব্য মন্দিরে যাওয়া এবং সেখানে
উৎসব আয়োজিত করা। যদি ভ্রাম্যমান নাট্যদল আসে, তাহলে সে শুধু তাদের আরামের প্রতিই নজর
দেবে না, খেয়াল রাখবে তারা যেন কোনরকম অসুবিধের মধ্যে না পড়ে; তাদের অসুখেবিসুখে সাহায্য
করবে এবং দেখবে তারা যেন নিজেদের শিল্পে দক্ষতার জন্য পুরস্কৃত হয়। সচরাচর শহরের বসতি
এলাকা থেকে সুবিধাজনক দূরত্বে অবস্থিত সরস্বতীর মন্দির, মাঘ মাসের শুক্লপঞ্চমীতে সাধারণত
কেতাদুরস্ত মানুষদের ঠাঁই হত। সেই দিনটি এখনও সারা ভারতে বসন্ত-পঞ্চমী রূপে এবং বঙ্গে
সরস্বতী-পুজা রূপে উদযাপিত হয়। এই সমস্ত এবং অন্যান্য আনন্দ আসরগুলোকে ঘটা বলা হত।
মাঝে মাঝে সাহিত্যসভা
হত যাতে এক বয়সের এবং এক পেশার মানুষেরা কেতাদুরস্ত নারীদের সঙ্গে বসে শিল্প, কবিতা
ইত্যাদি নিয়ে কথা বলতেন। এই সব সাহিত্যসভা তাঁদের নিজেদের বাড়িতে হত, অথবা সভা-গৃহে;
এমনকি সেই কেতাদুরস্ত নারীদের বাড়িতেও হত।
পানভোজনের উৎসব হত
মাঝে মাঝে যাতে সব ধরণের পানীয় এবং সব রকমের ক্ষুধাবর্দ্ধক পরিবেশন করা হত। এই উৎসব
সাধারণতঃ কেতাদুরস্ত পুরুষদের বাড়িগুলোয় ঘুরেফিরে হত, নারীরা পান করত এবং অন্যান্যদের
পান করাত।
বনভোজনঃ অনেক নাগরক
সকালে জমকালো বেশভূষায়, নারীদের সঙ্গে ঘোড়ায় চেপে বাগানে যেত। সেখানে তারা পানভোজনে
মত্ত হত; মোরগের লড়াই, জুয়া, অভিনয় এবং অন্যান্য সুখকর কাজে আনন্দযাপন করত, পারিতোষিক
নিয়ে বাড়ি ফিরত। গরমকালে, বিপজ্জনক জলীয় পশুগুলোকে তাড়িয়ে জলক্রীড়ায় ব্যপৃত হত।
ক্রীড়াঃ প্রতি বছর
তিনটে উপলক্ষ আসত ক্রীড়া অনুষ্ঠিত করার – কার্তিক
অমাবস্যা, কার্তিক পূর্ণিমা, আশ্বিন পূর্ণিমা। বসন্তের আগমনকেও একটি উপলক্ষ মনে করা
হত। এই তিনটে সময়ে লোকে পাগলের মত উৎসবমুখী হয়ে উঠত। মন ভরে নাচত, গাইত, দোলনায় দুলত,
জুয়া খেলত, বাজনা বাজাত, খেলাধুলায় আনন্দমুখর হয়ে উঠত। গ্রামীণ খেলাগুলোও ছিল, আম কিলোনো,
ভুট্টা পুড়িয়ে খাওয়া, পদ্মলতা খাওয়া, বৃষ্টি এলে নরম ঘাসে দৌড়োনো, পাঞ্চাল দেশের ধরণে
মিছিল করা, শিমূল গাছের নিচে ফুল নিয়ে খেলা, বৃষ্টি এলে কদম ফুল ছুঁড়ে লড়াই করা। আরো
অসংখ্য খেলা, গোনানো অসম্ভব।
এটাই খ্রিষ্টীয় প্রথম
শতকে ভারতের সব অংশে কেতাদুরস্ত পুরুষের জীবনের ছবি; বিশেষ করে মগধে, যেখানে বইটা লেখা
হয়েছিল। সময় এখনকার মত কঠিন ছিল না। যার শক্তিসামর্থ্য আছে সে, কয়েক বছর পরিশ্রম করে
ক্ষমতা অর্জন করে, মনের সুখে দুনিয়ার ভালো জিনিষগুলো উপভোগ করতে পারত। তাদের দিন কাটত
সুখকর দৈনন্দিনে আর বছরগুলো কাটত নানা উৎসবে। কাজেই আশ্চর্য্যের কিছু নেই যে তারা শারীরিক
ও মানসিক উপভোগের ওপর, কামসূত্র-এর মত একটি বই লেখার কাজ হাতে নেবে।
আরেকটা ছবি দেব,
যে একজন পত্নীর কেমন হওয়া উচিৎ। চতুর্থ বই থেকে, যাতে বাৎস্যায়ন গোনার্দীয়র বইয়ের সারসংক্ষেপ
করেছেন। পতির প্রতি পত্নীর একনিষ্ঠ ভক্তি থাকবে, পতির গোপন ব্যাপারগুলো নিজের ভিতরে
চাপা রেখে তিনি পতিকে পরমেশ্বর ভেবে তার সেবা করবেন। পতির অনুমত্যানুসারে গৃহস্থালির
ব্যবস্থাপনা নিজের হাতে নেবেন। তিনি ঘরদোর দেখাশোনা করবেন, ঝাঁট দিয়ে পরিষ্কার করে,
ফুল দিয়ে সাজিয়ে, দেখে ভালো লাগে তেমন ঝকঝকে তকতকে করে রাখবেন যাতে দেবতাদের মন্দিরটা
পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকে আর সকাল, দুপুর, সাঁঝের তিনবার বলির নৈবেদ্য থাকে সেখানে।
গোনর্দ বলেন, গৃহস্বামীর জন্য এর চেয়ে বেশি আনন্দদায়ক কিছু নেই। বরিষ্ঠদের সঙ্গে, ভৃত্যদের
সঙ্গে, পতির বোন এবং তাদের পতিদের সঙ্গে তিনি, নিজের এবং তাদের জন্য মানানসই ভাবে ব্যবহার
করবেন। পরিষ্কার মাটিতে তিনি সব্জির বাগান, আখ, জিরে, সর্ষে আর যোয়ান চাষের জায়গা তৈরি
করাবেন। পুজোয় লাগে এমন সমস্ত ফুলগাছ, এমন গাছ যা সারা বছর ফুল দেয় আর সুগন্ধী ঘাস
[উশীর, খসখস] বাগানে লাগাবার ব্যবস্থা করবেন। এদিকে ওদিকে সুন্দর বসার জায়গা তৈরি করাবেন।
কুঁয়ো খোঁড়াবেন, জলাশয় আর পুকুর কাটাবেন। ভিখিরি স্ত্রী, বৌদ্ধ ও জৈন ভিক্ষুণী, উদাসীন
প্রকৃতির স্ত্রী, স্ত্রী বাজীকর, স্ত্রী জ্যোতিষী এবং ডাইনিদের সঙ্গ তিনি এড়িয়ে চলবেন।
তাঁকে জানতে হবে যে কোন আহার্য তাঁর পতির ভালো লাগে এবং কোনটা ভালো লাগেনা; কোনটা তাঁর
স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো এবং কোনটা ভালো না। যখন পতির আসার সময় হবে তখন, বাইরে থেকে
তাঁর কণ্ঠস্বর শুনে তিনি ঘরে, কী কী করার ছিল ভাবতে ভাবতে তৈরি থাকবেন। দাসীকে সরিয়ে
নিজে তিনি পতির পা ধুইয়ে দেবেন। অসংবৃত এবং অনলংকৃত অবস্থায় তিনি কখনো পতির সামনে যাবেন
না। যদি তাঁর পতি মন্দ উদ্দেশ্যে দেদার খরচ
করেন তাহলে গোপনে আপত্তি জানাবেন। যদি বান্ধবীদের সঙ্গে বিয়ের অনুষ্ঠানে, বলিদানে,
বনভোজনে যাওয়ার থাকে বা মন্দিরে যাওয়ার থাকে, পতির অনুমতি নিয়ে যাবেন। সবরকম ক্রীড়া
ও বিনোদনে তিনি পতির প্রবণতা অনুসরণ করবেন। পতির ঘুমিয়ে পড়ার পর তিনি ঘুমোবেন, পতি
ঘুমিয়ে থাকলে তাঁকে জাগাবেন না। রান্নাঘরটাকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন এবং যথেষ্ট সুরক্ষিত
রাখবেন। পতি তাঁকে অপমান করলে তিনি একটু বিচলিত হতে পারেন কিন্তু সরবে প্রতিবাদ করবেন
না। প্রয়োজনে তিনি একান্তে বা ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের মাঝে পতিকে কড়া কথা বলতে পারেন, কিন্তু
কখনই তাঁকে মোহিত করার চেষ্টা করবেন না। কেননা গোনর্দ বলেন, অবিশ্বাসের এর থেকে বড়
কারণ নেই। ক্রুদ্ধ কথা, ক্রুদ্ধ দৃষ্টি এবং কথা বলার সময় মুখ ঘুরিয়ে রাখা তিনি পরিহার
করে চলবেন। তিনি বেশিক্ষণ দরজার কাছে থাকবেন না, বেশীক্ষণ দরজার বাইরে দেখবেনও না।
বাড়ির বাইরের অন্যান্যদের সঙ্গে কথাবার্তা এড়িয়ে চলবেন। কোনো নির্জন জায়গায় বেশিক্ষণ
থাকবেন না। তাঁকে বুঝতে হবে যে ঘাম, নোংরা এবং দুর্গন্ধে বিরক্তি হয়। পতির কাছে যাওয়ার
সময় তিনি সুসজ্জিত, সুগন্ধিতদেহ এবং সুবেশিত হয়ে যাবেন। বাইরে যাওয়ার সময় মাত্র কয়েকটি
গয়না, যৎসামান্য অনুলেপন, সাধারণ অনাড়ম্বর রেশমের পোষাক আর সাদা ফুল ব্যবহার করবেন।
পতির সবকটি উপবাসে এবং ব্রতে তিনি সঙ্গে থাকবেন। যদি বিরত থাকতে বলা হয়, তিনি বলবেন,
“এ ব্যাপারে জোর কোরো না”। মাটির, বেত বা কঞ্চির, কাঠের, চামড়ার এবং ধাতুর তৈরি সব রকম পাত্র
তিনি উপযুক্ত ঋতুতে এবং উপযুক্ত দামে ক্রয় করবেন। যেসব জিনিষ যোগাড় করা কঠিন, যেমন
নুন, তেল, সুগন্ধি, ভালো পাত্র এবং ঔষধি তিনি বাড়িতে লুকিয়ে রাখতে জানবেন। তিনি বীজ
সঞ্চয় করে রাখবেন এবং উপযুক্ত সময়ে রোপণ করবেন। পরিচ্ছেদটা এভাবে লেখা – মূলকা-লুক-পালঙ্কী দমনকাম্রা-তকৈর্বারুকত্রপুস-বার্তাক-কূষ্মাণ্ডালাবু-সূরণ-শুকনাসাঃ
স্বয়ংগুপ্তা তিলপর্ণিকাগ্নিমন্থ-লশুন-পলাণ্ডুপ্রভৃতীনাং সর্বৌষধীনাং চ বীজগ্রহণং কালে
বাপশ্চ।*
তিনি পতির ধনসম্পদ
নিয়ে কথা বলবেন না, পতির গোপন কথাও অন্য কাউকে বলবেন না। তাঁর সমকক্ষদের মাঝে তিনি
চারুকলায়, উন্নত-মানসিকতায়, পতির একান্তপ্রাণ সেবায় এবং রন্ধনে শ্রেষ্ঠ হবেন। তিনি
স্বামীর আয়ের অনুমান রাখবেন এবং সেইমত খরচ করবেন। বেঁচে থাকা দুধ দিয়ে ঘি তৈরি করবেন।
সর্ষে এবং আখ দিয়ে তেল আর গুড় বানাবেন। তাঁকে সুতো কাটা এবং কাপড় বোনা শিখে নিতে হবে।
বিভিন্ন ধরণের দড়ি পাকানোর জন্য তিনি ছাল সংগ্রহ করবেন। তিনি ভুষি ছাড়াতে, পরিষ্কার
করতে এবং কাজের দেখাশোনা করতে জানবেন। মণ্ড, ভুষি, চালের কণা এবং ময়লা আর কাঠকয়লা তিনি
উপযোগে আনবেন। দাসদাসীদের মজুরি জানবেন এবং আহারের কথা মনে রাখবেন। চাষবাস ও গবাদি
পশুর প্রজননের সমস্ত কাজ তিনি জানবেন এবং ঘোড়া ও অন্যান্য পরিবহণের খেয়াল রাখবেন। ভেড়া,
মোরগ, লড়িয়ে-পাখি, মাদি-টিয়ে, বুলবুল, ময়ুর, বাঁদর ও হরিণের পরিচর্যা করবেন। প্রতিদিনকার
আয় ও ব্যয়ের দিকে চোখ রাখবেন। সমস্ত পুরোনো ও নতুন জামাকাপড় একসাথে রাখবেন, বিভিন্ন
রঙে সেগুলোকে রঙ করাবেন এবং দাসদাসীদের, ভালো কাজের পুরস্কার হিসেবে আর অন্যান্যদের
উপহার হিসেবে দেবেন। মদ এবং অন্যান্য পানীয়ের বোতল লুকিয়ে রাখবেন, সময়মত ব্যবহার করবেন,
কেনাবেচার দিকে, আয়ব্যয়ের দিকে নজর রাখবেন।
তিনি তাঁর পতির বন্ধুদের,
তাঁদের সামাজিক পদমর্য্যাদা অনুসারে, পান, মালা এবং অনুলেপ সহকারে সম্মান জানাবেন এবং আপ্যায়ন করবেন।
পতির পিতামাতার যত্ন নেওয়া, তাঁদের ওপর পুরোপুরি ভরসা করা, তাঁদের সঙ্গে তর্ক না করা,
নিচুগলায় এবং খুব কম কথা বলা, জোরে না হাসা, তাদের বন্ধু ও শত্রুদের নিজের বন্ধু ও
শত্রু মনে করে আচরণ করা, সম্পত্তির গর্বে স্ফীত না হওয়া, অধস্তনদের প্রতি উদারমনস্কতা
– এই সব গুণ একজন স্ত্রীকে তার বাড়ির ভূষণ করে
তোলে। পতির অজান্তে তিনি কাউকে কিছু দেবেন না। তিনি ভৃত্যদেরকে তাদের কাজে নিয়োগ করবেন
এবং উৎসবের সময় তাদেরকে পুরস্কৃত করবেন।
____________________
[*পঞ্চানন তর্করত্নকৃত
অনুবাদঃ
মূলক, আলু, পালংশাক,
দোনা {Artemesia Pallens}, আম্রাতক {আমড়া}, এব্বারুক {কাঁকুড়}, ত্রপুষ {শশা}, বার্ত্তাকু,
কুষ্মাণ্ড, অলাবু, সূরণ {ওল}, শুকনাসা {সোণাগাছ}, স্বয়ংগুপ্তা {শকশিম্বী}, তিলপর্ণিকা
{তিল এবং গাছপাণ}, অগ্নিমন্থ {গণিকারিকা}, লশুন, পলাণ্ডু প্রভৃতির বীজ যথাসময়ে সংগ্রহ
করিয়া রাখিবে এবং উপযুক্ত সময়ে বপন করিবে।]
No comments:
Post a Comment