১০০ বছর আগে, ১৯২০ সালের ডিসেম্বর থেকে ১৯২১এর
এপ্রিল অব্দি মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছ’টি বক্তৃতা দিয়েছিলেন এবং ১৯২৩
সালে পাটনা বিশ্ববিদ্যালয় সেই বক্তৃতাক’টি পুস্তকাকারে প্রকাশ করেছিল।
‘মগধের সাহিত্য’ শীর্ষক এই বক্তৃতামালায় বক্তৃতা সংখ্যা ১ ছিল ‘মগধের মূল অধিবাসী’, বক্তৃতা সংখ্যা ২ ছিল
‘পাটলিপুত্র – ভারতের মেধাজগতের রাজধানী’, বক্তৃতা সংখ্যা
৩ ছিল
‘কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের ঐতিহাসিক শিক্ষা’, বক্তৃতা সংখ্যা
৪ ছিল ‘বাৎস্যায়নের কামসূত্র’, বক্তৃতা সঙ্খ্যা ৫ ছিল
‘বাৎস্যায়নের ভাষ্য’ এবং বক্তৃতা সংখ্যা ৬ ছিল ‘বাণভট্ট এবং আর্য্যভট্ট’।
বক্তৃতা
সংখ্যা ১
মগধের
মূল অধিবাসী
পূর্বে মুদ্গগিরি (মুংগের) থেকে পশ্চিমে চরণাদ্রি (চুনার)
অব্দি প্রসারিত, গঙ্গার দক্ষিণ দিক ও বিন্ধ্য পর্বতশ্রেণীর মাঝে অবস্থিত বিশাল ক্ষেত্রটিকে
মগধ নামে জ্ঞাত। যদিও, কর্মনাশা ও চুনারের মধ্যেকার অংশটাকে সাধারণতঃ নদীর বিপরীত
দিকে অবস্থিত কাশীর সাথে যোগ করে দেওয়া হয়।
কীকট শব্দটি একবারই ঋগ্বেদে (তৃতীয়.৫৩.১৪) এসেছে এবং যেহেতু
পরবর্তী সাহিত্যে কীকট অর্থে মগধ বা চুনার থেকে রাজগীর অব্দি তার অংশ
বোঝা হত (বিশ্বকোষ, শক্তিসঙ্গম-তন্ত্র), অনেকেই মনে করেন যে ঋগ্বেদের কীকট বস্তুত
মগধ। পরবর্তি সাহিত্যে কীকট প্রসঙ্গ নিম্নোল্লিখিতঃ
কীকটো নাম দেশোऽনার্যনিবাসঃ। নিরুক্ত ১
বুদ্ধো নামা জিনসুতঃ কীকটেষু ভবিষ্যতি।২
কীকটেষু গয়া পুণ্যা নদী পুণ্যা পুনঃ পুনা।
চ্যবনস্যাশ্রমঃ পুণ্যঃ পুণ্যং রাজগৃহং বনং ।।
এই কীকটপ্রসঙ্গগুলি অবশ্যই মগধ-সম্পর্কিত, কিন্তু ঋগ্বেদের
যে সূক্তে এই শব্দটির উল্লেখ পাওয়া যায় তার পটভূমি সিন্ধু নদের এলাকায়। সিন্ধু থেকে
মগধ অনেক দূর। সম্পূর্ণ ঋগ্বেদে উল্লিখিত পূর্বতম সীমান্ত গঙ্গা আর যমুনা, খুব সম্ভবতঃ
পর্বতরাজি থেকে প্রবাহিত তাদের দক্ষিণমুখি প্রবাহ। সায়ন একবার নাম হিসেবে কীকট শব্দটির
ব্যাখ্যা করেছেন –
অনার্যনিবাসেষু জনপদেষু
এবং একবার নাস্তিক হিসেবে, যাদের ধর্মানুষ্ঠানে কোনো
আস্থা নেই। কীকট-সম্পর্কিত
একটাই উল্লেখ আছে ঋগ্বেদে; স্তোত্ররচয়িতা দুঃখের সাথে বলছেন যে ওদের গবাদি সোম-যজ্ঞে
ব্যবহৃত হয় না। তা সত্ত্বেও সে গবাদি লোভনীয় কেননা তাদের দুধ যজ্ঞে কাজে লাগে। সর্বজনবিদিত
তথ্য যে ভারতে সবচেয়ে ভালো গবাদি পশু পাওয়া যায় সিন্ধু নদের পঞ্চাশ-একশো মাইলের ভিতরে
– হিসার, সিরসা, বহাওলপুর এবং বিকানের জেলায়,
এবং সম্ভবত মগধ নয়, এ জায়গাগুলোকেই কীকট হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এ তত্ত্বটা নিতান্ত
হাস্যকর যে প্রমগন্দ মগধ রাজত্বের সংস্থাপক ছিলেন এবং মগধ শব্দটা, প্রমগন্দের ভিতরে
থাকা এবং ওই একই ঋকে উল্লিখিত মগন্দ’এর ভিন্ন
রূপ।
কৌশিতকী আরণ্যকে১
দেশটাকে মগধ বলা হয়; পরে ব্যাখ্যা করা হবে যে দেশটার সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। অথর্ব
বেদে আছে মগধেরা – বহুবচন, যাতে জাতিগোষ্ঠি২ বোঝায়।
এই জাতিগোষ্ঠিটির সম্পর্ক বৈদিক আর্যদের সাথে বিশেষ বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল না; অথর্ব বেদে
এমন ভাবনার অভিব্যক্তি আছে যে ম্যালেরিয়ার জ্বরটাকে বৈদিক সভ্যতার এলাকার বাইরে মগধদের
দিকে তাড়িয়ে দেওয়া উচিত। বেদের একটি শাখা মগধদের সঙ্গে অঙ্গদের যোগ করে এবং অন্য শাখা
কাশীদের যোগ করে। এই জাতিগোষ্ঠি থেকেই কৌশিতকী আরণ্যকে আমরা ওই দেশের মগধ নামটি পাই।
কেউ কেউ ভাবে ঐতরেয় আরণ্যকে বঙ্গ ও চেরর সঙ্গে উল্লিখিত বগধ, মগধেরই ভিন্ন রূপ।
কিন্তু এ যুক্তি
খাটে না। কেননা বঙ্গ এবং চের অথবা চুটিয়ানাগপুরের দ্রাবিড় জনতার মাঝখানের পুরো দেশটায়
– বর্তমানে বর্দ্ধমান ডিভিশনে – বাগদি নামে এক শক্তিশালী নৃগোষ্ঠি ছিল; বাগদি বগদেরই অন্য রূপ।
স্বতন্ত্র বৈশিষ্টে ও বর্ণে তারা এক সম্পূর্ণ ভিন্ন নৃজাতি। তারা দীর্ঘকায়, মোটাসোটা,
বলিষ্ঠ এবং যুদ্ধপ্রিয়। তাদের নিজেদের সরকার ছিল এবং ভাবার কারণ আছে যে নিজেদের ভাষাও
ছিল। তাই মগধ জাতি থেকে দেশটার নাম হয় মগধ। মাগধ অর্থ মগধবাসী, সে মগধ জাতির নাও হতে
পারে। মাগধেরা ব্রাহ্মণও নয়, শূদ্রও নয় (বাজ. সং ৩০.২২) এবং পুরুষমেধ যজ্ঞে তাদেরকে
অতিক্রুষ্ট (“তীব্র কোলাহল”)৬ দেবের উদ্দেশ্যে বলি দেওয়া হয়। মজার ব্যাপার এটাই
যে মাগধেরা সত্যিই নিজেদের গানে ভীষণ শোরগোল করত। পরে মাগধ শব্দটার অর্থ দাঁড়ায় চারণ,
যারা জোরে জোরে রাজার প্রশস্তি গেয়ে জীবনধারণ করত। এমনকি রাজপুতানা এবং অন্যান্য প্রদেশের
ভাটেরা যারা নিজেদের মাগধ বংশোদ্ভূত বলে তারাও, উপহারাদি দাতাদের প্রশস্তি গাওয়ার সময়
ভীষণ চিৎকার করে। মাঝেমধ্যে অসহ্য হয়ে ওঠে সে চিৎকার।
অথর্ব বেদের৭
ব্রাত্য অধ্যায়ে মাগধের বিষয়ে বলা আছে যে সে বন্ধু এবং উপদেশক, ব্রাত্যের অন্তরঙ্গ
সহচর এবং বজ্র (মিত্র, মন্ত্র, হাস এবং স্তনয়িত্নু); রাজপুতানায় ভাট
এবং চারণেরা এখনও এই চরিত্র বজায় রেখে চলেছে। যখন ব্রাত্য এবং মাগধেরা এত ঘনিষ্ঠ সম্পর্কিত
এবং যখন কোনো কোনো সূত্রে ব্রাত্যরা তাদের সব সম্পত্তি মগধদেশীয় ব্রহ্মবন্ধুদের
দিতে আদিষ্ট, তখন জানা জরুরি হয়ে ওঠে যে ব্রাত্য কারা ছিল। মাঝেমধ্যেই ব্রাত্য শব্দটির
ব্যাখ্যায় বলা হয় সাবিত্রী-পতিতঃ ৮ – তারা যারা গায়ত্রী উচ্চারণ করে না। এভাবে যারা শব্দটির ব্যাখ্যা
করে, মনে হয় তাদের ধারণা শব্দটির উৎপত্তি ব্রত থেকে হয়েছে। কিন্তু ব্রত থেকে
ব্রাত্যের উৎপত্তি হয় নি। তদ্ধিত প্রত্যয় দিয়ে নেতিবাচক উপসর্গ নিষ্পন্ন করার কোনো
নিয়ম নেই। তাই আমার মনে হয়, ব্রাত (বড় দল বা মানুষের পাল) শব্দ থেকে উদ্ভূত
হয়েছে শব্দটি।
ব্রাত শব্দটি ঋগ্বেদে
আটবার দল হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে, তিনবার রয়েছে ঋগ্বেদের সবচেয়ে পুরোনো অংশ, পারিবারিক
মন্ডলে, তিনবার, সবচেয়ে সাম্প্রতিক, দশম মন্ডলে, একবার প্রথম মন্ডলে ও একবার নবম মন্ডলে।
কখনো কখনো শব্দটি রূপক হিসেবে, পাশা(ছক্কা) অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে কিন্তু বেশির ভাগ সময়
অনিশ্চিত সংখ্যক মানুষের পাল হিসেবে। তিন বার শব্দটি, বলতে গেলে, নির্দিষ্ট সংখ্যাসূচক
‘গণ’ এর বিপরীতে৯ ব্যবহৃত হয়েছে এবং সমাবেশসূচক ‘শারধা’র বিপরীতে। ষষ্ঠ
মন্ডলে১০ শব্দটি নিঃসন্দেহে শত্রুভাবাপন্ন দল অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। রথে রাখা অস্ত্রসম্ভারের
বর্ণনায় কবি বলছেন যে অস্ত্রসম্ভার হতে হবে ব্রাতসহা, [শত্রুভাবাপন্ন] দলের
প্রতিরোধ করতে সক্ষম। এবং ষষ্ঠ মন্ডলের স্রষ্টা হিসেবে ঋষি ভরদ্বাজের বংশের নাম উল্লিখিত
হয়। তৃতীয়১১ মন্ডলে (কথিত স্রষ্টা বিশ্বামিত্র) এবং পঞ্চম১২
মন্ডলে (কথিত স্রষ্টা আত্রেয়) ব্যবহৃত শব্দটির অর্থ দল তো নিঃসন্দেহে, শত্রুভাবাপন্ন
দল অর্থও প্রতিভাত হয়। প্রথম মন্ডলে১৩, আছে যে ঘোড়ার অনুসরণ করে রথ, পুরুষ,
নারী এবং ব্রাত – পুরুষ [বা মানুষ]
থেকে ভিন্নকৃত অর্থে। নবম১৪ মন্ডল পাঁচটি দলের কথা বলে। দশম১৫
মন্ডলে দুটো অংশে ব্রাত শব্দটি রূপকার্থে ছক্কা হিসেবে ব্যবহৃত হয় এবং অন্য একটি অংশে
বাক্যে ব্যবহৃত হয় – “আমরা ব্রাতদের
সঙ্গে যোগ দেব।” ১৬ ব্রাত-এর প্রাচীনতম ব্যবহার শত্রুভাবাপন্ন দল অর্থে।
অথর্ববেদেও১৭ একই অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে শব্দটি। বাজসনেয় এবং তৈত্তিরীয় সংহিতায়
রুদ্র-বিষয়ক অধ্যায়ে ব্রাত-এর সাথে ব্রাতপতিও ব্যবহৃত হয়েছে ১৮।
ইয়োরপীয় বিদ্বানেরা মনে করেন যে ওখানে ব্রাতপতি অর্থ দস্যুদলের প্রধান। এভাবেও ব্রাত-এর
সেই একই অর্থ – শত্রুভাবাপন্ন দল। এই ব্রাতদের অস্থায়ী বসত
থাকত, কেননা পঞ্চবিংশ ব্রাহ্মণে আছে যে তারা ব্রাত্যা-য় বেড়িয়ে আসত (ব্রাত্যাম
প্রবসন্তঃ,১৭ যেখানে প্র-বাস অর্থ বেড়ান) এবং তাদের গোষ্ঠিপতি (গৃহপতি)
থাকত। তাদের একজন গৃহপতি বিশুদ্ধিকৃত হওয়ার পর ঋগ্বেদের একটি শাখার সংস্থাপক হয়েছিলেন।
কিন্তু সেসব কথা পরে। তাদের ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতি (ব্রহ্মচর্য) ছিল না, কৃষি ছিল না
এবং বাণিজ্য১৮ ছিল না। এসব কিছুই তাদেরকে যাযাবর দল হিসেবে চিহ্নিত করে।
যারা ব্রাত তৈরি করে, যারা ব্রাত-তে
যোগ দেয় এবং যাদেরকে ব্রাত চুরি করে তারা সবাই ব্রাত্য। মাগধেরা ব্রাত্যদের১৯
বন্ধু, ঘনিষ্ঠ, সহচর এবং সরব প্রশংসক। কাজেই তারা হয় একই দেশে থাকত অথবা খুবই কাছাকাছি
থাকত।
ব্রাত্যদের কুলপরিচয়
কী? পঞ্চবিংশ ব্রাহ্মণে২০ তার উত্তর দেওয়া আছে। তারা ছিল দৈব প্রজা, দেবতাদের
প্রিয়জন ও পূজক। সেই একই দেবতাদের যারা বৈদিক আর্য কর্তৃক পূজিত হত। তাহলে তফাত কী
ছিল? ব্রাত্যদের দেবতারা স্বর্গে গিয়েছিল এবং ব্রাত্যরা নিরুৎসাহ হয়ে পড়েছিল। তারা
নিজেদের সাময়িক প্রবাসে গিয়েছিল। সেই প্রবাসক্রমে তারা সেখানে পৌঁছল যেখান থেকে দেবতারা
স্বর্গে গিয়েছিল। কিন্তু তারা নিজেদের দেবতাদের সাথে মিলিত হওয়ার জপ ও ছন্দ জানত না।
মরুতরা তাদের সেই জপ ও ছন্দ দিল, তবেই তারা নিজেদের দেবতাদের সঙ্গে মিলিত হতে পারল।
এই কাহিনী বলে যে তারা বৈদিক আর্য কর্তৃক পূজিত দেবতাদেরই পূজো করত এবং বিশুদ্ধিকরণের
পর তারা সমান শর্তে বৈদিক সমাজে স্বীকৃত হয়েছিল।
কিন্তু বড় সংখ্যক
ব্রাত্যরা২১ যজমান হিসেবে ব্রাত্যদের বিশুদ্ধিকরণের এই বিচিত্র অনুষ্ঠান
সম্পন্ন করে। তাদের মধ্যে যে মানুষটি যূপ এবং অঞ্জন সরবরাহ করেছিল এবং ঋতুযাজ্যা উচ্চারণ করেছিল,
কথিত যে সে তাদের গৃহপতি অথবা গোষ্ঠিপতি২২ ছিল। বিশুদ্ধিকরণের আগে ব্রাত্যরা
পাপিষ্ঠ২৩ ছিল; আর্যদের স্থায়ী বসতিতে গিয়ে তারা যাজ্ঞিকদের জন্য তৈরি খাবার
বলপূর্বক খেয়ে ফেলত। পরিষ্কৃত বাচনের তারা খুঁত ধরে বেড়াত, নির্দোষ মানুষদের মৃত্যুদন্ড
দিত, যদিও তারা অদীক্ষিত ছিল তবু দীক্ষিতদের মত কথা বলত। এই চারটে পাপ ছিল তাদের এবং
এ চারটেরই, ষোলটা স্তোম চার বার পুনরাবৃত্তি করলে স্খালন হতে পারত। এই স্তোম-গুলোর
মধ্যেকার একটি সাম মরুতদের সম্মানে দ্যৌতান সাম২৫। এটি শুভতম সাম কেননা
দ্যৌতান, মারুতদের পূজক, ব্রাত্যদের গৃহপতি ছিল এবং সে-ই এ সাম-টি দেখেছিল।
পঞ্চবিংশ ব্রাহ্মণ
ব্রাত্যদের আরেকজন গৃহপতির নাম নেয়। সে অন্য কেউ নয়, কৌষিতক২৬, সমস্রবাঃ-র
পুত্র। সে একজন বৃদ্ধ ব্রাত্য যে নিজের পৌরুষ হারিয়ে ফেলেছিল। সে অন্যদের সঙ্গে ব্রাত্যস্তোম
সম্পাদন করেছিল, কিন্তু স্তোমগুলোর বিন্যাসে কিছু ত্রুটি ছিল এবং তাই লুশাকপি, খর্গলের
পুত্র, তাকে অভিশাপ দিয়েছিল যে কৌষিতকিদের উন্নতি হবে না কখনো। সায়ন বলেন যে কৌষিতক
ঋগ্বেদের একটি শাখার দ্রষ্টা। যদি ত্রুটিপূর্ণ ভাবে বিশুদ্ধিকৃত একজন ব্রাত্য ঋগ্বেদের
একটি শাখার সংস্থাপক হতে পারে, বৈদিক আর্য ছাড়া অন্য কোনো কুল থেকে ব্রাত্যদের উদ্ভব
সম্ভবত হতে পারে না।
এবার প্রশ্ন ওঠে,
ব্রাত্যদের কুলপরিচয় কি পূর্ববর্তী কোনো ধারায় নাকি তারা বৈদিক কুলচ্যুত? অবশ্যই কিছু
এমন কুলচ্যুতও ছিল যেমন যাযাবরেরা, কুখ্যাত ছেলেধরা এবং মানুষ-অপহর্তা ছিল। কিন্তু
ব্রাত্যদের কুলপরিচয় সম্ভবত পূর্ববর্তী কোনো ধারায় ছিল, প্রথম অভিবাসনে আগত মানুষজন।
স্যার জর্জ গ্রিয়ার্সন বলতেন – যারা আর্যাবর্তের
বৃহত্তর অংশে ছড়িয়ে পড়েছিল এবং বাংলা ও পশ্চিম পাঞ্জাবের ভাষায় একই রকম প্রভাব ফেলেছিল,
কিন্তু এই বিশাল ভুখন্ডের কেন্দ্রে নয়, কেন্দ্র অধিকার করেছিল দ্বিতীয় এবং পরবর্তী
অভিবাসন।
এর সাক্ষ্য পাওয়া
যায় অথর্ব বেদের পঞ্চদশ অধ্যায়, ব্রাত্য অধ্যায়ে। সেখানে এক অন্তর্দেশ-এর২৭
কথা আছে যেখান থেকে ব্রাত্য পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণদিকে এবং উপরকার অঞ্চলে ও
স্থির অঞ্চলে যায়। সে অন্তর্দেশ-এও যায়। অর্থাৎ সে সর্বত্র বিদ্যমান। অঞ্চলগুলো তাকে
সুরক্ষা প্রদান করে এবং পরিচারক দেয়। পূর্ব তাকে দেয় ভাব, দক্ষিণ সর্ব,
পশ্চিম পশুপতি, উত্তর উগ্র, ধ্রুব (স্থির অঞ্চল) রুদ্র, উপরকার
অঞ্চল মহাদেব এবং ঈশান। সে নিজে ছিল একব্রাত্য, মহাদেব এবং ঈশান।
এখন প্রশ্ন হল এখানে উল্লিখিত সবক’জন দেবতা
প্রতিদিন সব ব্রাহ্মণ কর্তৃক শিব-এর বিভিন্ন রূপ হিসেবে পূজিত হয়। যদি এই একব্রাত্য
আমাদের শিব হয় তাহলে লড়াই না করে তার পক্ষে বৈদিক দেবসমূহে প্রবিষ্ট হওয়া সম্ভব
ছিল না, এবং সে লড়াই তাহলে হবে দক্ষ-যজ্ঞ-এর লড়াই। এর কিছুটা পূর্বাভাস এই অধ্যায়ের
একটি বক্তব্যে পাওয়া যায়, যেমন, যদি ব্রাত্য এক অতিথি হিসেবে ব্রাহ্মণের বাড়িতে সেসময়
যায় যখন ব্রাহ্মণ যজ্ঞে নিযুক্ত আছে, তখনই সে ব্রাহ্মণের উঠে দাঁড়িয়ে ব্রাত্যকে যজ্ঞ
সম্পন্ন করার অনুরোধ জানান উচিত। ব্রাত্য অস্বীকার করলে তার কাছে ব্রাহ্মণের, নিজেই
যজ্ঞ সম্পন্ন করার অনুমতি চাওয়া উচিত। যদি সে অনুমতি দেয় তাহলে যজ্ঞ সম্পূর্ণ করা উচিত,
যদি সে অনুমতি না দেয় তাহলে যজ্ঞে এগোন উচিত নয়, এবং অনুমতি না নিয়ে করলে, পূণ্যের
বদলে পাপ হবে যাজ্ঞিকের। এটা বিষয়ান্তর ছিল, কিন্তু এতটাই চিত্তাকর্ষক যে বিষয়ান্তরে
যাওয়ার প্রলোভন রোধ করতে পারলাম না।
অর্থাৎ, ব্রাত্যরা
সর্বত্র ছিল – অন্তর্দেশ-এর সব দিকে এবং অন্তর্দেশ-এর
ভিতরেও। তবে মনে হয় পূর্বদিকটাই তাদের প্রধান ঠাঁই ছিল। কেননা পঞ্চবিংশ ব্রাহ্মণ-এ
একটি অস্পষ্ট অংশ আছে যেটা সায়নের ব্যাখ্যায় আরো বেশি অস্পষ্ট হয়ে উঠেছে – ককুভং প্রাচীম অনুব্যচলত (“পূর্ব অঞ্চলে গেল”)। অথর্ব
বেদে অঞ্চলের অনুক্রম সব সময় প্রাচী দিয়ে শুরু হয় এবং অঞ্চলগুলোর আপেক্ষিক অবস্থান
অন্তর্দেশ থেকে ধরা হয়।
ব্রাত্যরা অনেক ভাবে
বৈদিক আর্যদের থেকে ভিন্ন ছিল। তাদের মধ্যে বাঁকা ভাবে উষ্ণীষ পরার চলন ছিল২৮,
আর্যদের মধ্যে তা ছিল না। তারা ধনুক রাখত, তাতে ছিলা থাকত না। কাত্যায়ন ব্যাখ্যা কপ্রেন
তারা তীর ছুঁড়তে পারত না। ধনুক হয়ত লাঠির মত ব্যবহৃত হত, এখনও অনেক মানুষ সেভাবে ব্যবহার
করে। অথর্ব বেদে রামধনু একব্রাত্য-এর ছিলা-হীন ধনুক। তার অবতল দিকটা ছিল লাল
এবং উত্তল দিকটা নীল; লাল দিক দিয়ে সে নিজের শত্রুদের আবৃত করত এবং নীল দিক দিয়ে নিজের
প্রতিপক্ষকে বিদীর্ণ করত। কিন্তু বৈদিক আর্যদের ধনুক তেমন ছিল না। তাতে ছিলা ছিল এবং
তা দিয়ে তীর ছোঁড়া হত। ব্রাত্যরা স্থুলভাবে নির্মিত শকট ব্যবহার করত, ঢিলে পাটাতন বেছান;
আকচার সে শকট রাস্তার বাইরে চলে যেত। যখন নাকি বৈদিক আর্যদের রথ ছিল যাতে শক্তিশালী
অস্ত্রসম্ভার থাকত, যথেষ্ট সংখ্যায় তীর রাখার জায়গা থাকত, টানার জন্য পশু থাকত, ঘোড়া
কিম্বা বলদ, তাদেরকে সামলাবার লাগাম থাকত। ব্রাত্যদের রথ টানা ঘোড়া বা খচ্চরেরা হত
কম্প্র, অর্থাৎ ‘নড়বড়ে’, অনিয়ন্ত্রিত। যখন নাকি বৈদিক আর্যরা তাদের ঘোড়াগুলোকে লাগাম দিয়ে
নিয়ন্ত্রণ করত। ব্রাত্যদের পশুগুলো রাস্তা ছেড়ে বাইরে চলে যেত। বৈদিক আর্যদের কাছে
ছিল লাগাম, কিন্তু ব্রাত্যদের ছিল প্রতোড় (চামড়ার দড়ি বাঁধা একটি লাঠি, যেমন
এখনও গরুগাড়ি চালাতে ব্যবহার করা হয়)। ব্রাত্যদের ব্যবহার করা বস্ত্রে কালো পাড় থাকত
আড়াআড়ি, ব্রাহ্মণদের আজও সেরকম পাড় দেওয়া বস্ত্র ব্যবহার করা মানা। পাড়ে সাদা নকশা
তোলা ভেড়ার চামড়া থাকত তাদের দু’টুকরো করে; অন্যান্যদের
ভেড়ার চামড়ায় তেমন কোনো পাড় থাকত না। তাদের গয়না হত রুপোর, যখন নাকি অন্যান্যদের গয়না
হত সোনার।
উপরোক্ত জিনিষগুলো
ব্রাত্যদের মধ্যেকার উচ্চতর শ্রেণীরা, তাদের গৃহপতিরা (গোষ্ঠিপতিরা) ব্যবহার
করত, সাধারণ মানুষেরা ব্যবহার করত এক দিকে লাল পাড় দেওয়া কাপড় যার অন্য দিকে ফিতে থাকত।
কালো চামড়ার এক জোড়া ফিতেওয়ালা চটি আর এক জোড়া ভেড়ার চামড়া ব্যবহার করত তারা। বৈদিক
আর্যদের পরিধান থেকে যথেষ্ট ভিন্ন ছিল এসব।
বিশুদ্ধিকরণের পর
ব্রাত্যদের বিষয়সম্পত্তি সেই ব্রাত্যদের দিয়ে দিতে হত যারা নিজেদের ব্রাত্যা-য়
থাকত অথবা মগধ দেশের তথাকথিত ব্রাহ্মণদের দিয়ে দিতে হত। কাত্যায়ন বলেন যে দ্বিতীয়টাই
শ্রেয়। ঋত্বিকদের দক্ষিণা দেওয়ার পর বিশুদ্ধিকৃত ব্রাত্যরা চাইলে তিন বেদের জ্ঞান লাভ
করতে এবং সমাজে প্রবেশ করতে সক্ষম হত। তার খাবার অন্যেরাও খেতে পারত এবং তাদেরকে পবিত্র
জাতিবিদ্যা শেখান যেতে পারত।
এই দীর্ঘ চর্চা আমাদের
বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত। ব্রাত্যদের বিপথ বা “নড়বড়ে গাড়ি”কে লাত্যায়ন বলেন প্রাচ্যরথ বা “পূর্ব রথ” এবং বলেন যে ব্রাত্যদের সম্পত্তি মগধের ব্রাহ্মণদের দিয়ে দিতে হবে।
তার মানে ব্রাত্যরা অনেকভাবে মগধের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল।
যাযাবরদের পাল হয়ে
দেশান্তরে আসা প্রথম আর্য ছিল তারা। নিজেদের অভ্যাসে এবং জীবনধারণে তারা বেশি সরল এবং
আদিম ছিল এবং ছোট একটি বিশুদ্ধিকরণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাদের পুরোপুরি বৈদিক সমাজে
শামিল করে নেওয়া হত।
অথর্ববেদের স্পষ্ট
কথন অনুসারে এটা নিশ্চিত যে ব্রাত্যরা শুধু পূর্ব দিকে সীমিত ছিল না, সব দিকে ছড়িয়ে
ছিল। কিন্তু উত্তর দিকে তাদের বিস্তারের সীমা হিসেবে ছিল হিমালয়, দক্ষিণে বিন্ধ্য এবং
পশ্চিমে অন্যান্য উপজাতিদের চাপ, যখন নাকি পূর্বে তাদের ছড়িয়ে পড়ার প্রায় অসীমিত সম্ভাবনা
হিল। আদি বাসিন্দা বা
তাদের মধ্যেকার উচ্চতর শ্রেণীর মানুষদের তারা নিজেদের বন্ধু ও উপদেষ্টা বানিয়ে নিত
এবং জঙ্গল পরিষ্কার করে পাওয়া সমতল জায়গাগুলোতে নিজেদের ঘোড়া ও গবাদি পশু নিয়ে অস্থায়ী
বসতে বাস করত। লুন্ঠনবৃত্তি ছাড়াও তাদের দিনচর্যায় থাকত গবাদি পশু ও মানুষ অপহরণ।
আরেক ধরণের জনগণ
ছিল ব্রাতিন, ষ্যেন যাগ-এর নিষ্ঠুর আচারের পুরোহিতগণ। এই ব্রাতিনা শব্দটিও
ব্রাত, আর্যদের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন যাযাবর দল, থেকেই আহরিত হয়েছে। তাদের নিজস্ব
শিক্ষা ছিল এবং নিজেদের যোদ্ধা। যদি যোদ্ধার ছেলে একজন বিদ্বান মানুষ হয় তাহলে এই নিষ্ঠুর
আচারের পুরোহিত হিসেবে তাকেই পছন্দ করা হবে। এখানে টীকাকার একটি প্রশ্ন তোলে; বৈধ প্রশ্ন।
ঋষির পরিবারে জন্ম না নেওয়া একজন মানুষ যজ্ঞ কিভাবে করবে? এবং নিষ্পত্তিতে পৌঁছোয় যে
এই বিশেষ অনুষ্ঠানটির জন্য ঋষির বংশোদ্ভূত হওয়া একান্ত প্রয়োজনীয় নয়। কিন্তু তার শিক্ষা
থাকতে হবে, বৈদিক আর্যের শিক্ষা না হলেও। অনুষ্ঠানের স্থান হয় জঙ্গলের মধ্যেকার সদ্য
পরিষ্কৃত একটি জায়গা। সে উদ্দেশ্যে গাছ ও গুঁড়িগুলো কেটে ফেলা হয়। রস চিপে বার করার
তক্তাগুলোই এই অনুষ্ঠানে মৃত দেহগুলো বয়ে নিয়ে যাওয়ার রুগ্ন ও আহতবাহী শকটে [অ্যাম্বুলেন্স]
তক্তা হিসেবে ব্যবহৃত হওয়া উচিত। পুরোহিত একটি লাল উষ্ণীষ এবং লাল বস্ত্র পরবে, ভয়ঙ্কর
দেখাবে এবং ধনুকে ছিলা পরাবে। একজন লেখক, শাণ্ডিল্য বলেন, এই নিষ্ঠুর আচারে অরহতদের
পুরোহিত করা উচিত। এই ‘অরহত’ শব্দটি গুরুত্বপূর্ণ। প্রাক-বুদ্ধ যুগে এই শব্দটা, সব আদিম সমাজের
মতই, ব্যবহার হত যোগ্য, জ্ঞানী মানুষ, বৈদ্য, যাদুকর ইত্যাদির জন্য। তাই বৌদ্ধ ও জৈনরা
শব্দটা গ্রহণ করেছিল, সেখানে এটি ব্যবহৃত হল তাদের সম্প্রদায়ের সাধুদের জন্য।
অর্থাৎ, ব্রাত্য
এবং ব্রাতিন-এরা ছিল, দুটোই বৈদিক আর্য সমাজের বাইরে থাকা যাযাবরের দল, তারা
ঋষিদের বংশোদ্ভূত হওয়ার দাবি করত না, নিজস্ব পুরোহিত ছিল তাদের, নিজেদের চিন্তাভাবনা
মত তারা আদিম আচার অনুষ্ঠান করত। এদেরকে নিজেদের ভিতরে আনার দুশ্চিন্তায় ছিল বৈদিক
আর্যরা। নানারকম ইঙ্গিত আছে [শাস্ত্রসাহিত্যে] যা দিয়ে বোঝা যায় যে যাযাবরদের সংখ্যাগরিষ্ঠ
অংশ পূর্বদিকে – বেদে কথিত আর্যদেশের পূর্বে ঘুরে বেড়াচ্ছিল।
এমনভাবেই আমরা বৈদিক
সাহিত্যে মগধ নামে এক উপজাতির কথা পাই, মগধ নামে এক দেশের কথা পাই যেখানকার অধিবাসীরা
মগধ আর মাগধদের কথা পাই যারা মগধ দেশের নিবাসী কিন্তু মগধ উপজাতির নয়। বৈদিক জনগণের
মধ্যে দেশটার বিশেষ সুখ্যাতি ছিল না। মগধ দেশে থাকা একজন ব্রাহ্মণকে ব্রহ্মবন্ধু
– তথাকথিত ব্রাহ্মণ – খারাপ ব্রাহ্মণ বলা হত। পুরাণেও, শিশুনাগদের ক্ষত্রবন্ধু অথবা
খারাপ ক্ষত্রিয় বলা হত। একমাত্র কৌশিতকিরা দেশটার প্রতি অনুকূল মনোভাবাপন্ন ছিল। তারা
তাদের আরণ্যকে বলে যে মধ্যমপ্রাতিবোধিপুত্র মগধ দেশে থাকতেন কিন্তু অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় ব্রাহ্মণ
ছিলেন। অর্থাৎ সে দেশটা অনার্য দেশ ছিল। তারপর সেখানে এল ব্রাত্যরা, প্রথম অভিবাসনে
আসা আর্যরা, এবং তারা থাকতে এল। তারা মাগধদের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতাল এবং খুব প্রভাবশালী
হয়ে উঠল। এবং দ্বিতীয় অভিবাসনে আসা আর্যরা, বৈদিক আর্যরা খুব চেষ্টা করল তাদেরকে নিজেদের
ভিতরে টানার। এটুকুই আমরা বৈদিক সাহিত্যে আমাদের জন্য রক্ষিত অপ্রতুল তথ্য ঝাড়াইবাছাই
করে জানতে পারি।
ধ্রুপদী সাহিত্যে
মগধ বেশি পরিচিত। কিন্তু সে সাহিত্যে প্রবেশ করার আগে জানা জরুরি বৈদিক সাহিত্যের যুগ
শেষ হওয়ার পর, ধ্রুপদী সাহিত্য শুরু হওয়া অব্দি কতটা সময় পেরিয়েছিল। ম্যাক্সমুলার ১৮৫৯
সালে লিখিত তাঁর ‘প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যের ইতিহাস’এ সূত্র সাহিত্যকে ৬০০-২০০ খৃ.পু.র মধ্যে সীমায়িত করেন। কিন্তু বুহলার,
এস.বি.ই. শৃংখলায় (১৮৮৬) কৃত তাঁর মানব-ধর্মশাস্ত্র-এর অনুবাদের ভূমিকায়,
xxii সংখ্যক পৃষ্ঠায় বলেন, “সূত্রগুলোর উৎপত্তিকে
৬০০-২০০ খৃ.পু.র মত এত ছোট আর পরের কালখন্ডে সীমায়িত করা মনে হয় আর যুক্তিযুক্ত হবে
না।” কিন্তু নানান কাজ আবিষ্কৃত হয়েছে, তথ্যে আলোকপাত
ঘটেছে এবং পুরোনো সামগ্রী ব্যাখ্যায়িত হয়েছে যা থেকে এ অনুমান ন্যায্য মনে হয় যে বৈদিক
চরণ-এর সূত্র রচনা সম্পর্কিত কাজকর্ম, বুদ্ধ এবং তাঁর সমসাময়িক সংস্কারকদের
আবির্ভাবের আগেই কোনো এক সময় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। অর্থাৎ, ম্যাক্সমুলারের দেওয়া উপর দিকের
সময়সীমা, এই কাজকর্মের নিচের দিকের সময়সীমা হতে পারে। মনে হয়, ম্যাক্সমুলার এই কালখন্ডের
বিশেষ চিন্তা-গোষ্ঠিগুলোর কার্যকলাপ শামিল করে থাকবেন যেগুলোর জন্য বুহলার ওই সময়সীমাকে
ছোটো এবং দেরি করে ধরা বলেছিলেন। মনে হয় বৈদিক গোষ্ঠির সূত্রগুলোর পর এক দীর্ঘ সময়
পেরিয়েছিল যখন বিশেষ চিন্তা-গোষ্ঠিসমূহের বিস্তৃত সূত্রগুলো লেখা হয় প্রভূত সংখ্যায়।
রচনার কারিকাধর্মী রূপ চলতে থাকে, কিন্তু বৈদিক গোষ্ঠির নয়। মনে হয়, বৈদিক সূত্র রচনা
সম্পর্কিত কাজকর্মের বিনাশের কারণ ছিল পারসিকদের হাতে তক্ষশীলার পতন। অন্য দিকে একই
কারণে, ভারতের মেধাজগতের রাজধানী তক্ষশীলা থেকে পাটলিপুত্রে স্থানান্তর, অন্য ধরণের
সূত্র রচনার কাজকর্মকে উদ্দীপিত করে। সূত্র রূপে বোধগম্য রচনার প্রবৃত্তি তক্ষশীলাতে
আগে থেকেই ছিল, কিন্তু পাটলিপুত্রে, যেখানকার শাসকদের লক্ষ্য ছিল সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্য,
সেই প্রবৃত্তিকে উৎসাহিত করা হয়, লালন করা হয় আর বিশেষ যত্ন নেওয়া হয়। পরিণামে ফল হয়
সমৃদ্ধ এবং প্রচুর।
কাজকর্ম শুধু বেদের
ছ’টি অঙ্গে সীমাবদ্ধ ছিল না। জ্ঞানের
অন্যান্য শাখায়, উদাহরণার্থে, ঔষধিবিদ্যা, অর্থনীতি, রাজনীতি, ইতিহাস, দর্শন, বিজ্ঞান,
নাট্যশাস্ত্র এবং এমনকি যৌনবিদ্যা অব্দি বিস্তৃত ছিল। কারিকাধর্মী শৈলীটা শেষে অত্যন্ত
সংক্ষিপ্ত ও হেঁয়ালিমূলক সাব্যস্ত হল এবং কয়েকজন লেখক কারিকাগুলোকে বোঝাতে নিজেদের
টীকা দেওয়া শুরু করল। তারপর তাদের মাথায় এল দীর্ঘ ছন্দোবদ্ধ রচনার পরিকল্পনা, যাতে
বিষয়গুলো আরো চিত্তাকর্ষক হয়ে ওঠে এবং সহজে মুখস্থ রাখা যায়। কেননা মুখস্থ রাখাটাই
সে সময় শিক্ষা দেওয়ার এবং পাওয়ার একমাত্র পদ্ধতি ছিল; জীবনের ব্যবহারিক উদ্দেশ্যে প্রয়োগ
করারও সহজতর পদ্ধতি ছিল। ম্যাক্সমুলার ভাবেন যে শ্লোক ছন্দে দীর্ঘ পদ্যবদ্ধ রচনা সূত্র
যুগের শেষে, আন্দাজ ২০০ খৃ.পু.এ অস্তিত্বে এসেছিল। কিন্তু বুহলার দেখিয়েছেন যে তারা
কয়েক শতাব্দি আগে থেকে অস্তিত্বে ছিল।
এটা বিষয়ান্তর, কিন্তু
এ বিষয়ান্তর কারিকাধর্মী রচনার এবং শ্লোক ছন্দ রচনার ধ্রুপদী যুগে, ভারতের এবং বিশেষ
করে মগধের পরিস্থিতি বোঝার জন্য জরুরি। সে যুগে পশ্চিম ভারত, অথর্ব বেদের অন্তর্দেশ,
ব্রাহ্মণ্য সংস্থাগুলোর রাজত্বে ছিল। সে রাজত্ব ছিল তাদের ছোট ছোট রাজনৈতিক এককগুলোর
মাধ্যমে, তাদের জটিল বলি-সংক্রান্ত আচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে, স্থির ও বহুকাল বিচ্ছিন্ন
সংকীর্ণ চিন্তাধারার মাধ্যমে, তাদের শ্রেণী-স্বার্থ এবং তাদের রক্ষণশীল মতামতের মাধ্যমে।
তারা তখনো নিজেদের পুরোনো ঐতিহ্যে মোহাবিষ্ট ছিল, সেই মোহ ভেঙে বেরুনো তাদের পক্ষে
কঠিন ছিল। কিন্তু পূর্ব দিকে তেমন ছিল না। যদিও সেখানেও ব্রাহ্মণের প্রভাব ছিল সর্বোপরি,
অন্যান্য উপাদানগুলোও ছিল এবং সেগুলো অন্যান্য দিকে বিকশিত হয়েছিল। অন্তর্দেশ-এর
অনুপাতে ব্রাহ্মণের খুবই কম ছিল। সংখ্যাগরিষ্ঠ আর্য জনগণ হয় ব্রাত্য ছিল নয়ত সদ্য ধর্মান্তরিত
ব্রাত্য, মগধ অথবা মাগধ উপজাতি; তাদের মধ্যেকার সবচেয়ে তেজীয়ান ছিল ব্রাত্যদের দুটো
অংশ। বৈদিক যুগে তাদের মধ্যে কোনোরকম ব্রাহ্মণ্য অনুশাসন ছিল না, কৃষিকাজ এবং বাণিজ্য
ছিল না। কিন্তু তাদের ধর্মান্তরণ হওয়ার পর কিছুদিনের ভিতরেই বিস্ময়কর ভাবে তারা নিজেদের
বাণিজ্য এবং জাতীয় সম্পদ বিকশিত করেছিল। তাদের নিজেদের নাগরিক ও সামরিক সংস্থা বিকশিত
করার স্বাধীনতা ছিল এবং সাম্রাজ্যবিস্তারের ভাবনাচিন্তাও তাদের ভিতরে দানা বাঁধতে শুরু
করেছিল। উত্তর ঔধে শাক্য এবং মল্ল-রা, উত্তর বিহারে লিচ্ছবি এবং বিদেহ-রা, পূর্ব দিকে
অঙ্গ-রা, পশ্চিম দিকে কাশি-রা এবং কেন্দ্রে বারহদ্রথ-রা, অর্থাৎ পুরোটা মগধ জুড়ে সবাই
বর্ধিষ্ণু রাজ্য হয়ে উঠেছিল যাদের শহরগুলো ভরে থাকত ব্যস্ত মানুষজনে, গ্রামে থাকত প্রাচুর্য,
পণ্যদ্রব্যে ভরা নৌযান থাকত নদীতে, সভাঘরগুলোয় প্রতিধ্বনিত হত বক্তৃতা, গান, নাটক,
আলোচনা এবং বাদবিবাদ, ঘোড়া আর হাতির প্রাচুর্য দেখা যেত জমকালো মিছিলে এবং চিত্তাকর্ষক
প্রতিযোগিতায়। ব্রাহ্মণরা ছিল তাদের শিক্ষক, তাদের বিবেকের রক্ষক, তাদের মন্দিরে পুরোহিত
এবং তাদের যজ্ঞাদিতে ঋত্বিক। কিন্তু তারুণ্যময় তেজীয়ান জনতা খুব শিগগিরই তাদের
শিক্ষকদের প্রভাব কাটিয়ে নিজেদের মত ভাবতে শুরু করেছিল। খৃষ্টপূর্ব ষষ্ঠ এবং সপ্তম
শতাব্দীতে বৌদ্ধিক, নৈতিক এবং রাজনৈতিক জীবনের এই শক্তিশালী উত্থানের কারণ ছিল ব্রাহ্মণদের
দাসত্ববন্ধন থেকে তুলনামূলক ভাবে কিছুটা মুক্তি, নিজেদের মধ্যে সন্ন্যাস-জীবনে বৃদ্ধি
এবং বৌদ্ধিক রাজধানীর তক্ষশীলা থেকে পাটলিপুত্রে স্থানান্তর। চার জাতের প্রথা এবং তার
অসংখ্য বিধিনিষেধ তাদের মধ্যে শিথিল ছিল। যখন নাকি অন্তর্দেশ-এ এক ভিন্ন দৃশ্য
ছিল। বিভিন্ন বিদেশি জাতির মানুষেরা, আক্রমণকারী দলগুলো থেকে পালিয়ে অন্তর্দেশ-এর
জনগণের মধ্যে আশ্রয় নিচ্ছিল এবং তাদের ভুখন্ডের শান্ত সমৃদ্ধি বিঘ্নিত করছিল। ক্যালডিয়া
থেকে সেমাইটদের তাড়া খেয়ে পালিয়ে সুবের-রা সিন্ধে আশ্রয় নিল। নিজেদের গৃহভূমি
থেকে পারসিক দের তাড়ায় পালিয়ে আসা মীড-রা তাদের দেশে আশ্রয় নিল। এবং শেষ অব্দি পারসিকেরা
এল এবং সবচেয়ে সমৃদ্ধ ভূভাগগুলো অধিকার করে নিল। পুরাণগুলো থেকে জানা যায় যে আভ্যন্তরীণ
অনৈক্যেঅন্তর্দেশ, আগে থেকেই যথেষ্ট দুর্বল হয়ে পড়েছিল এবং সমৃদ্ধ পূর্বের তুলনায়
খুবই খারাপ অবস্থায় ছিল। সেখানেই আবার হৃতসর্বস্ব পশ্চিমারা সুরক্ষিত আশ্রয় খুঁজতে
শুরু করল। এই সবের পরিপ্রেক্ষিতে পূর্ব আরো সমৃদ্ধিশালী হয়ে উঠল।
ঠিক এই মনোজাগতিক
মুহূর্তে, বারহদ্রথদের ক্ষমতাচ্যূত করল একটি নতুন ও তেজীয়ান জাতি, শিশুনাগ, ক্ষত্রবান্ধবঃ
বলে যাদের বৈশিষ্ট প্রকাশ করা হয়েছিল। ক্ষত্রবান্ধবঃ অর্থাৎ ‘তথাকথিত ক্ষত্রিয়’। নিঃসন্দেহে তার মানে তারা ব্রাত্য, ব্রাহ্মণ্য সংস্থাগুলোর নিয়ন্ত্রণাধীন
নয়। কিন্তু যা কিছু ব্রাহ্মণরা বলত, তারা পালন করত। তাদের মধ্যে বেশির ভাগ অংশকে ক্ষত্রিয়ে
পরিবর্তন করা হয়েছিল, যাযাবরী অভ্যাস কিছুটা ছাড়তে হয়েছিল তাদের। শিশুনাগ মুর্ত্তিগুলোর
বস্ত্রাদি অদ্ভুত ভাবে লাত্যায়ন, কাত্যায়ন এবং অন্যান্যদের দ্বারা বর্ণিত যথাযথ ব্রাত্য
বস্ত্রের সঙ্গে মিলে যায়।
এখানে বলা অপ্রাসঙ্গিক
হবে না যে বৈদিক কাল থেকে ব্রাত্যদের সম্পর্কে ধারণা অনেকটা বদলেছে। বৈদিক সাহিত্যে
তারা যাযাবর দল ছিল যাতে ব্রাহ্মণ ছিল না, বর্ণ ব্যবস্থা ছিল না, স্থায়ী নিবাস ছিল
না এবং স্থায়ী সরকার ছিল না। তারা পিতৃতান্ত্রিক জনগণ ছিল, নিজেদের যূথে ঘুরে বেড়াত
এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায়। কিন্তু ধ্রুপদী সাহিত্যে ব্রাত্যদের, প্রথম তিনটে বর্ণে
বিভাজিত এমন ব্রাহ্মণ্য জনগণ মনে করা হত যাদের ব্রাহ্মণ্য সংস্কার হয় নি। আরেকজন বিশেষজ্ঞ
বলেন যে ব্রাহ্মণ্য সংস্কার না হওয়া পুরুষদের নিজের জাতের নারীদের সংসর্গে জন্মান পুত্রেরা
ব্রাত্য ছিল। অর্থাৎ, মনে হয় যে অন্তর্বর্তী সময়ে ব্রাহ্মণেরা তাদের ওপর কিছুটা জাতি
ব্যবস্থা চাপিয়ে দিয়েছিল। বেদে ব্রাত্যরা একটিই শ্রেণী, যখন নাকি ধ্রুপদী যুগে ব্রাহ্মণ
ব্রাত্য, ক্ষত্রিয় ব্রাত্য এবং বৈশ্য ব্রাত্য ছিল। অদ্ভুত ব্যাপার যে ব্রাহ্মণ ব্রাত্যরা
অন্তর্দেশ-এর সব দিকে পাওয়া যেত, কিন্তু পূর্ব দিকে শুধু ক্ষত্রিয় ব্রাত্যরা
থাকত। এটাই হওয়া স্বাভাবিক ছিল। কেননা আগেই দেখিয়েছি যে পূর্বদিকে ব্রাত্যদের সংখ্যা
অনেক অনেক বেশি ছিল। এ বিষয়ে আমি তিনটে গ্রন্থের প্রমাণ যোগ করব। সবচেয়ে পুরোনোটা হল
ললিত বিস্তর। যদিও পরবর্ত্তী শতাব্দীগুলোতে কমে কমে গ্রন্থটি আজকের আকারে পৌঁছেছে,
এখনও এর মধ্যে খৃষ্ট পূর্ব পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতাব্দীর পরম্পরাগুলো বিদ্যমান। তারপর প্রমাণ
দেব অর্থশাস্ত্র থেকে, যেটি চতুর্থ খৃষ্টাব্দে লেখা হয়েছিল এবং মানব-ধর্ম-শাস্ত্র
থেকে, যেটি বর্তমান আকারে, শুঙ্গ রাজবংশের
ব্রাহ্মণদের উত্থানের সময় রচিত হয়েছিল।
বুদ্ধ যখন তাঁর শেষ
জন্মের জন্য তুষিত-ভূবন থেকে বিশ্ব পরিদর্শন করছিলেন, তখন পর্য্যন্ত জ্ঞাত সবক’টি দেশের পর্যালোচনা সারলেন২৯। সীমান্তবর্তী দেশগুলো
তাঁর পক্ষে স্বীকার্য ছিল না। মধ্যমে, ইউয়ান চুয়াঙের মধ্য দেশে, সে সময় ষোলটি রাজ্য
ছিল। তার মধ্যে থেকে আটটি বর্ণিত হল এবং প্রত্যাখ্যাত হল – (১) প্রদ্যোতনপুর (উজ্জৈন), (২) মথুরা, (৩) হস্তিনাপুর,
(৪) বনিস (বোধহয় বৎস), (৫) কোশল, (৬) বিদেহ, (৭) মিথিলা
এবং (৮) বৈশালী। শেষেরটি প্রত্যাখ্যাত হল কেননা সেখানে কোনো রাজা ছিল না
এবং সবাই ভাবত সেই সর্বপ্রধান। হস্তিনাও একই কারণে প্রত্যাখ্যাত হল। অন্য রাজ্যগুলো
অন্য কারণে প্রত্যাখ্যাত হল। শেষে স্থির হল যে তাঁর জন্ম এক ক্ষত্রিয় পরিবারে হওয়া
উচিত, কেননা বিশ্ব আর ব্রাহ্মণরা নয় ক্ষত্রিয়রা পরিচালন করে, এবং শেষ পর্য্যন্ত তাঁর
জন্মের জন্য এক শাক্য পরিবার চয়নিত হল৩০।
কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে৩১
আমরা দেখি যে কাম্বোজ এবং সৌরাষ্ট্রে বসবাস করত ক্ষত্রিয়দের উপজাতিরা (শ্রেণী), যারা
কৃষি, বাণিজ্য এবং অস্ত্র-সম্পর্কিত পেশায় জীবনধারণ করত। লিচ্ছবি, বৃজ্জি, মল্ল, মদ্র,
কুকুর, কুরু এবং পাঞ্চালেরা রাজার পদবিতে জীবনধারণ করত। রাজার পদবিতে জীবনধারণ শুনতে
অদ্ভুত লাগতে পারে। কিন্তু শবরভাষ্যে রাজা শব্দ নিয়ে একটি আলোচনা আছে যা থেকে শব্দটির
অর্থের ওপর আলোকপাত হতে পারে। সেখানে লেখা আছে ‘রাজা’ মানে সে কেউ হতে
পারে যে রাজার, রাজকীয় আধিকারিকের কাজে অথবা সরকারের কাজে নিয়োজিত। এর অর্থ এই নয় যে
তাকে ক্ষত্রিয়ই হতে হবে। ভাষ্য বলে যে অন্ধ্র দেশে রাজারা বা পরিচালনকারী শ্রেণীরা
সব সময় ক্ষত্রিয় হয় না। কাজেই অর্থশাস্ত্রে উল্লিখিত লিচ্ছবি এবং অন্যেরা ক্ষত্রিয়
হতেও পারে আবার না-ও হতে পারে, কেননা বৈজয়ন্তী, একটি বৌদ্ধ পুস্তক স্পষ্ট বলে যে লিচ্ছবিরা
ছিল ব্রাত্য-ক্ষত্রিয়।
অন্য দিকে মানব-ধর্ম-শাস্ত্র
ব্রাত্যদের তিন বর্ণে শ্রেণীভুক্ত করে, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্য। কেননা গ্রন্থটি
বলে যে ব্রাত্য ব্রাহ্মণেরা দক্ষিণ-পশ্চিমে ছিল বসবাসরত আবন্ত্য, উত্তর-পশ্চিমে ছিল
বসবাসরত বাতধান, এবং ছিল ভৃজ্যকান্তক ও পুষ্পশেখর। শেষ দু’টোর বাসস্থান জানা নেই। কিন্তু বুহলার বলেন তারা ছিল গুপ্তচর এবং
জাদুকর। ব্রাত্য ক্ষত্রিয়রা ছিল ঝল্ল, মল্ল, লিচ্ছবি, নট, করণ, খশ এবং দ্রবিড়। এদের
মধ্যে মল্ল এবং লিচ্ছবিরা নিশ্চিতভাবে পূর্বদিকের ছিল। ব্রাত্য বৈশ্যরা ছিল সুধন্বা,
আচার্য্য, কারুশ, বিজন্ম, মৈত্র এবং সতত। ব্রাত্য বৈশ্যদের নিবাস এবং পেশা সম্পর্কে
আমরা কিছুই জানি না।
যদিও মানব-ধর্ম-শাস্ত্রের
টীকাকারেরা বলেন যে জাতের মত কিছু একটা ছিল, কেউ গুপ্তচরবৃত্তি করে দিন চালাত, কেউ
ঈশ্বরের প্রতিমা পূজো করে, কেউ মন্দিরের পুরোহিত হয়ে, কেউ জল টেনে এবং কেউ অন্য অন্যভাবে,
বুহলার ভাবেন যে “বেশিরকম সম্ভাবনা রয়েছে যে মূলতঃ এই সব নামগুলো
জাতিসূচক ছিল [নেশন]” এবং মনে হয় তিনি
সঠিক। কেননা এরা সবাই মনে হয় বৈদিক আর্য সমাজের বাইরে ছিল। আমি জানি যে আচার্যরা এখনও
নেপালে নিচের তলার হিন্দুদের মন্দিরের পুরোহিত। এটা সবাই জানে যে কোশল এবং বিদেহর মাঝখানের
দেশটাকে কারুশরা তাদের নাম দিয়েছে।
এই তিন গুরুত্বপূর্ণ
প্রামাণ্য গ্রন্থের বক্তব্য শোনার পর অনুমান করা যায় যে আর্য ভূভাগের পূর্বদিকের দেশে
ব্রাত্য নামে চিহ্নিত জাতিরা থাকত যাদের ব্রাহ্মণিকরণ ত্রুটিপূর্ণ ছিল। তারা সবাই লড়াকু
জাতি ছিল, অথবা এমন জাতি ছিল যারা আদিম জনগণকে, মগধ, মাগধ এবং অন্যদেরকে নিজেদের অধীনে
এবং নিয়ন্ত্রণে রাখতে ব্যস্ত থাকত; এবং তারা তাদের অধীন মানুষদের চষা জমির উৎপন্ন ভোগ
করে রাজকুমারদের মত থাকত। তারা সবাই রাজা ছিল এবং সেভাবেই তাদের বৈদিক ব্রাহ্মণদের
রচনায় জাতি ব্যবস্থায় স্থান দেওয়া হয়েছিল। তারা সম্ভবতঃ রাজন্য ছিল যাদেরকে ব্রাহ্মণ
লেখকেরা, নিজেদের স্বার্থে কিম্বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে, আধুনিক রাজপুতদের মত ক্ষত্রিয়
বলত।
মহাগোবিন্দ-সুত্র
, বৌদ্ধ পরম্পরায় ভারতের রাজনৈতিক
ভুগোলের ওপর সবচেয়ে প্রাচীন গ্রন্থ তার পালি বয়ানে এবং মিশ্রিত সংস্কৃত বয়ানে (অর্থাৎ
মহাবস্তু) বলে যে মগধ অঙ্গ দেশের পরাধীন, এবং কোশল কাশীর ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু আমরা
দেখি যে বুদ্ধের সময়ে, অঙ্গ মগধের ওপর নির্ভরশীল একটি রাজ্য এবং কাশী কোশলের ওপর নির্ভরশীল।
এই অবস্থান পরিবর্তন খুব সম্ভবত বুদ্ধের জন্মের দু’এক প্রজন্ম আগে শিশুনাগ, ক্ষত্রবান্ধব এবং ব্রাত্য জাতির অভ্যাগমের
কারণে হয়েছিল। কেননা বুদ্ধের জীবনকালে মগধ এবং কোশলের রাজারা পূর্বদিকে আধিপত্য বিস্তারের
জন্য লড়ছিল, শাক্য, মল্ল, লিচ্ছবি, বৃজ্জি, বিদেহ অন্যদের সংঘ অধিকার করেছিল মগধের
উত্তরদিকের এবং কোশলের পূর্বদিকের এলাকা। কুরু, পাঞ্চাল এবং মদ্ররাও এসময়ে সংঘ ছিল।
একটি বইও আছে এবং অর্থশাস্ত্রের একটি পুরো খন্ড এই মৈত্রীচুক্তিবদ্ধ সংঘগুলো নিয়ে আলোচনা
করে; তার শিরোনাম সংঘ-বৃত্তম।
দৃশ্যে বুদ্ধের অবতরণের
কয়েক শতাব্দী আগে বৈদিক সভ্যতার কেন্দ্র ছিল তক্ষশিলা। এখানেই জন্মেজয় তার বিখ্যাত
সর্প-যজ্ঞ করেছিল। এখানেই মহাভারত প্রথম আবৃত্তি করা হয়েছিল, এখানেই ধ্রুপদী সাহিত্যের
সূত্রপাত হয়েছিল। সভ্য ভারতের সব অংশ থেকে এখানেই মানুষ তাদের শিক্ষা শেষ করার জন্য
ভিড় করে আসত, আর এখানেই সব ভারতীয় বিজ্ঞানের উদ্ভব। প্রথম যে চিকিৎসাশাস্ত্রীর কথা
আমরা জানি, জীবক, তিনি তক্ষশিলাতেই থাকতেন। প্রথম জ্ঞাত বৈয়াকরণও সে শহরেই থাকতেন।
মীমাংসার প্রাচীনতম লেখকও সেই একই শহরের ছিলেন। ঘোড়ার ওপর পশুচিকিৎসা-বিজ্ঞানভিত্তিক
রচনার রচনাকার এই শহরের কাছাকাছিই থাকতেন। বস্তুতঃ, ধ্রুপদী সংস্কৃতে সমস্ত কাজগুলোর
– তাদের পরিষদে লিখিত বৈদিক ভাবধারার স্বার্থে
কৃত কাজগুলো ছাড়া – মনে হয় তক্ষশিলাতেই উদ্ভব।
কিন্তু বুদ্ধের জীবনকালে
তক্ষশিলার ওপর বিরাট বিপর্যয় নেমে এল। দারিউস, এক পারসিক রাজা যে সাইরাস প্রতিষ্ঠিত
রাজবংশ ধ্বংস করেছিল, শহরটিকে জয় করল এবং এক শতাব্দী ধরে, উত্তর-পশ্চিম ভারতের একটা
বড় অংশ নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখল। জ্ঞানের কেন্দ্র হিসেবে তক্ষশিলা নিজের উঁচু জায়গাটা
হারিয়ে ফেলল। পাণিনি, বর্ষ এবং উপবর্ষের মত বিশিষ্ট পন্ডিতেরা পূর্বাঞ্চলে গিয়ে নিজেদের
কাজের স্থান খুঁজতে বাধ্য হলেন। পূর্বের সবচেয়ে শক্তিশালী রাজত্ব হিসেবে তখন পাটলিপুত্রের
খ্যাতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছিল। তাঁরা সেখানেই এলেন। সেখানকার রাজা তাঁদেরকে তাঁদের জ্ঞান
ও সামাজিক পদমর্যাদা অনুযায়ী নিজেদের পাঁচসালা সমাবেশে সম্মানিত করলেন। এভাবেই, ব্রাহ্মণদের
ভাষা হিসেবে বৈদিক সংস্কৃতর অবলুপ্তির দীর্ঘকাল পর মগধের সাহিত্য শুরু হল। ভাষা হিসেবে
বৈদিক সংস্কৃত অপ্রচলিত হয়ে গিয়েছিল বটে, কিন্তু পুরোপুরি লুপ্ত হয়ে যায় নি। তক্ষশিলায়
ভারতীয় পান্ডিত্য সেই সংকীর্ণ গতানুগতিকতাটা প্রায় ঝেড়ে ফেলতে পেরেছিল যার অনুসারী
ছিল বৈদিক চিন্তাধারাগুলো, কিন্তু পাটলিপুত্রে এই ঝেড়ে ফেলাটাই হয়ে দাঁড়াল বিশ্বজনীন,
এমনকি সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র।
যখন বৈদিক সাহিত্য
শেষ, এবং লেখনশিল্প হয় আবিষ্কৃত নয় তো প্রবর্তিত, আর্যদের ভাষা তখন এক বিশৃংখলার মধ্যে।
কেউ বৈদিক চিন্তাধারায় ব্যবহৃত বাগ্ধারা এবং অভিধানাদির পক্ষে, কেউ দেশীয় ভাষাগুলোর
ধ্বনিগতভাবে কোমল অভিব্যক্তির পক্ষে। প্রত্যেক অঞ্চলে উপভাষা বদলে যায় – উচ্চশ্রেণীরও বদলে যায়, নিম্নশ্রেণীরও। ফলে, এক অঞ্চলের সঙ্গে আরেক
অঞ্চলের মুক্ত এবং অবাধ কথাবার্তায় বড় রকমের বাধার সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে উচ্চতর শ্রেণীর
জন্য, যাদের প্রচুর ঘোরাঘুরি করতে হয়, এ এক বিরাট প্রতিকূলতা। এই পরিস্থিতি থেকেই জন্ম
নিল ধ্রুপদী সংস্কৃত বা নিছক সংস্কৃত ভাষা – সবরকম দেশীয়
বিকৃতি এবং অনিয়ম থেকে শুদ্ধিকৃত ভাষা। এর ফলে বৈদিক চিন্তাধারার ব্যাকরণ থেকে ভিন্ন
ব্যাকরণ লেখার প্রয়োজন হল। সুসংস্কৃত শ্রেণীগুলোর ভাষার পুরো ক্ষেত্রটার পর্যবেক্ষণ
পাণিনি হাতে নেওয়ার আগে, ধ্রুপদী ভাষার প্রায় পনের বা ষোলটা এধরণের ব্যাকরণ ছিল। এবং
তার দুই উত্তরসূরি, এই কাজটাকে এমন চরিত্র ও স্থায়ীত্ব দিল যে আজকের দিনেও সেটা টিঁকে
আছে। দেশীয় ভাষাগুলোও প্রত্যেকটি নিজের নিজের অঞ্চলে বিকশিত হল। খৃষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর
ধর্মসংস্কারকেরা সেসব ভাষাগুলোর অনেক ক’টিকে আকৃতি
দিল, সাহিত্য দিল। কয়েকজন আবার ধ্রুপদী ভাবনাগুলোকে সাধারণ মানুষের জন্য ব্যাখ্যা করতে
চেয়ে মিশ্রিত ভাষা ব্যবহার করল; সেটি সংস্কৃতও নয় দেশীয়ও নয়, দুটোরই মিশ্রণ। আমার বিশ্বাস
যে নাটকগুলো প্রথমে এই মিশ্রিত ভাষায় লেখা হয়েছিল, যাতে উচ্চ ও নিম্ন শ্রেণী দু’দলই উপভোগ করতে পারে। আমার বিশ্বাসের কারণ দন্ডীর কাব্যাদর্শে,৩২
একটি বক্তব্য যে ভারতে ভাষার চারটে প্রকার রয়েছে, যথা সংস্কৃত, প্রাকৃত, অপভ্রংশ
এবং মিশ্র। মিশ্রর জন্য তিনি উদাহরণ দেন “নাটকের এবং
অন্যান্যর”। আমরা এখনো বিশুদ্ধভাবে মিশ্রভাষায় লিখিত
কোনো নাটক হাতে পাই নি। যে নাটকগুলো পাওয়া যায়, তাতে কিছু মানুষ সংস্কৃত বলে এবং কিছু
মানুষ প্রাকৃত। তাই টীকাকারেরা “নাটকাদি তু মিশ্রকম” বক্তব্যটির ব্যাখ্যা করেন, সংস্কৃতে ও প্রাকৃতে লিখিত নাটক। কিন্তু
তাঁরা ভুলে যান যে দন্ডী ওই বক্তব্যে ভাষার উদাহরণ দিচ্ছেন, সাহিত্যের কোনো রূপের উদাহরণ
নয়। মিশ্র ভাষায় বেশ বড় সাহিত্যসম্ভার এবং বহুসংখ্যক শিলালিপির আবিষ্কার আমাকে আমার
বিশ্বাসে নিশ্চিত করে।
ফলে, মগধের সাহিত্য
নিয়ে আলোচনা করার সময় শুধু সংস্কৃত ধ্রুপদী সাহিত্যের কথা ভাবলে চলবে না, নানা রূপে
প্রাকৃত সাহিত্যের কথাও ভাবতে হবে এবং মিশ্র ভাষার সাহিত্যের কথাও ভাবতে হবে। মগধ সাম্রাজ্যে
ধ্রুপদী সংস্কৃত সাহিত্য পুরোপুরি ব্রাহ্মণ্য, প্রাকৃতে সাহিত্য সংশোধিত চিন্তাধারাগুলোর।
মিশ্র ভাষার সাহিত্য সংশোধিত চিন্তাধারাগুলোর ভাবনা ব্রাহ্মণ্য ধাঁচে প্রকাশিত করার
ফল।
আপনারা দেখতে পাচ্ছেন
কী বিশাল একটা ক্ষেত্র আমি আমার আলোচনায় নিয়ে আসছি। এতে বিপূল সংখ্যায় সংস্কৃত রচনাসমূহ
আছে, সম্পূর্ণ প্রাচীন বৌদ্ধ সাহিত্য এবং সম্পূর্ণ প্রাচীন জৈন সাহিত্য আছে। কিন্তু
আমার সৌভাগ্যবশতঃ, বৌদ্ধ এবং জৈন সাহিত্য এতবার সংশোধিত এবং পুনঃসংশোধিত হয়েছে, এতবার
পরবর্তী শতাব্দীগুলোর ভাষায় অনুদিত এবং পুনঃঅনুদিত হয়েছে যে তাদের মাগধি চরিত্র পুরোটাই
হারিয়ে গেছে বলা যেতে পারে।
_________________
১ – সত্যব্রত খন্ড ৩, পৃষ্ঠা ২৭৩
২ – ভাগবত ১.৩.২৪
৩ – VII ১৩
৪ – V ২২.১৪
৫ – II ১.১
৬ – বাজ. সং XXX. ৫.২২
৭ – XV
৮ – মনু II.৩৯ এবং X.২০
৯ – III. ২৬.৬; V. ৫৩.১১; X ৩৪.১২
১০ – VI. ৭৫.৯
১১ – III. ২৬.৬
১২ – V. ৫৩.১১
১৩ – I. ১৬৩.৮
১৪ – IX. ১৪.২
১৫ – X. ৩৪.৮; X. ৩৪.১২
১৬ – X. ৫৭, ৫
১৭ – II. ৯.২
১৮ – বাজ. XVI.২৫. তৈত্তি. IV. ৫.৪.১
১৯ – XVII. ১.৫.১২
২০ – XVII. ১.২ Av. XV.
XVII.১.
২১ – তান্ড্য VI.৯.২৪ এবং XVII.১.৭. টিকা.
২২ – XVII.১.৭. কম.
২৩ – XVII.১.৯.
২৪ – XVII.১.৭.
২৫ – ৫ XII.১.৭.
২৬ – তান্ড্য ১৭.৪.৩ এবং টিকা
২৭ – এই বক্তৃতা লেখার পর আমি স্যর জর্জ গ্রিয়ার্সনের ভাষা নির্ঘন্ট
পেয়েছি। তাতে পৃ. সংখ্যা ৩৬এ দেখেছি যে ব্রজভাষা কে এখনো অন্তর্দেশী বলা হয়। অন্তর্দেশ-এর
অবস্থান নিয়ে এর পর আর কোনো সন্দেহের অবকাশ থাকে না।
২৮ – লাত্যায়ন VIII ৫
২৯ – ললিতবিস্তর, বিব্লিও.ইন্ড. এড. পৃ ২২ এফএফ
৩০ – ঐ
৩১ -অর্থশাস্ত্র, মৈসোর, এড. ১, পৃ ৩২৬ এফএফ
৩২ – কাব্যাদর্শ I ৩২ এফএফ
মগধের সাহিত্য
পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদত্ত ছয়টি বক্তৃতা
ডিসেম্বর ১৯২০ এবং এপ্রিল ১৯২১
মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, এম এ, সি আই ই
সংস্কৃতের অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
১৯২৩ সালে পাটনা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রকাশিত
সূচীপত্র
বক্তৃতা সংখ্যা ১
মগধের মূল অধিবাসী
বক্তৃতা সংখ্যা ২
পাটলিপুত্র – ভারতের মেধাজগতের রাজধানী
বক্তৃতা সংখ্যা ৩
কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের ঐতিহাসিক শিক্ষা
বক্তৃতা সংখ্যা ৪
বাৎস্যায়নের কামসূত্র
বক্তৃতা সঙ্খ্যা ৫
বাৎস্যায়নের ভাষ্য
বক্তৃতা সংখ্যা ৬
বাণভট্ট এবং আর্য্যভট্ট
No comments:
Post a Comment