মগধের সাহিত্য
১০০ বছর আগে, ১৯২০ সালের ডিসেম্বর থেকে ১৯২১এর এপ্রিল অব্দি
মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছ’টি বক্তৃতা
দিয়েছিলেন এবং ১৯২৩ সালে পাটনা বিশ্ববিদ্যালয় সেই বক্তৃতাক’টি পুস্তকাকারে
প্রকাশ করেছিল।
‘মগধের সাহিত্য’ শীর্ষক এই বক্তৃতামালায় বক্তৃতা সংখ্যা ১ ছিল ‘মগধের মূল
অধিবাসী’, বক্তৃতা সংখ্যা ২ ছিল ‘পাটলিপুত্র – ভারতের মেধাজগতের রাজধানী’, বক্তৃতা
সংখ্যা ৩ ছিল
‘কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের ঐতিহাসিক শিক্ষা’, বক্তৃতা
সংখ্যা ৪ ছিল ‘বাৎস্যায়নের কামসূত্র’, বক্তৃতা সঙ্খ্যা ৫ ছিল ‘বাৎস্যায়নের
ভাষ্য’ এবং বক্তৃতা সংখ্যা ৬ ছিল ‘বাণভট্ট এবং আর্য্যভট্ট’।
বক্তৃতা সংখ্যা ২
সাতজন মহান লেখক
আমার প্রথম বক্তৃতায় কিছুটা ধারণা দেওয়া হয়েছে যে মগধের অধিবাসী কারা ছিল এবং
শিশুনাগদের শাসন শুরু হওয়ার সময় সেখানে কোন কোন ভাষা চলছিল। এবার মগধের সাহিত্য নিয়ে
আলোচনা করা যেতে পারে। মগধ সাম্রাজ্যের সম্পূর্ণ ও সর্বাঙ্গীণ সাহিত্যিক ইতিহাস লেখার
সময় এখনো আসেনি কেননা সাহিত্য নিয়ে গবেষণা এখনো যথেষ্ট এগোয় নি। কিন্তু বিষয়টা এতই
কৌতুহলোদ্দীপক এবং আকর্ষণীয় যে কোনো প্রয়াসকে, তা সে যতই আংশিক এবং অসম্পূর্ণ হোক,
পন্ডিতেরা সম্ভবতঃ স্বাগত জানাবেন। যখন সামগ্রী সর্বজনস্বীকৃতভাবে এত অপর্যাপ্ত, কালানুক্রমিক
বর্ণনার চেষ্টা করা হঠকারিতা হবে। কাজেই পরবর্তী পৃষ্ঠাগুলোয়, এমন কিছু সামগ্রী থেকে
লভ্য তথ্য আহরণ করে একসঙ্গে জোড়া লাগানর চেষ্টা করা হবে যাতে মগধের সাহিত্যিক ইতিহাসের
ওপরও আলোকপাত হয় এবং সাধারণ পাঠকদের জন্যও আকর্ষক হয়ে ওঠে।
বার্হদ্রথ রাজবংশ শেষ হল এবং খৃষ্টপূর্ব সপ্তম শতকের শুরুতে শিশুনাগ মগধের রাজা
হল। শিশুনাগদের বর্ণনায় আছে তারা ক্ষত্রিয়বন্ধু অর্থাৎ, তথাকথিত ক্ষত্রিয়। বুদ্ধের
জন্ম হয়েছিল বিম্বিসারের কালে। তার ছেলে অজাতশত্রু প্রতিষ্ঠা করে পাটলিপুত্র শহর। তার
পৌত্র উদয়ী রাজধানী রাজগৃহ থেকে পাটলিপুত্রে স্থানান্তরিত করে। ঠিক সেই সময় তক্ষশিলা,
ব্রাহ্মণ্য পান্ডিত্যের কেন্দ্র, বিদেশি আধিপত্যে নির্জীব হয়ে পড়েছিল। সেখানকার মহান
পন্ডিতেরা পূর্বের রাজধানীতে আশ্রয় নিতে শুরু করেছিলেন। রাজশেখরের কাব্য মীমাংসায় নিম্নলিখিত
শব্দে আমরা একটি পরম্পরা পাইঃ-
শ্রুয়তে চ পাটলিপুত্রে শাস্ত্রকারপরীক্ষা –
অত্রোপবর্ষবর্ষাবিহ্ন পাণিনিপিঙ্গলাবিহ্ন ব্যাড়িঃ ।
বররুচিপতঞ্জলী ইহ্ন পরীক্ষিতাঃ খ্যাতিমুপজগ্মুঃ ।।১
“পাটলিপুত্রে শাস্ত্র
রচয়িতাদের পরীক্ষার পরম্পরা এভাবে চলে – এখানে উপবর্ষ এবং
বর্ষ, এখানে পাণিনি এবং পিঙ্গল, এখানে ব্যাড়ি এবং এখানে বররুচি এবং পতঞ্জলি পরীক্ষিত
হয়ে খ্যাতিলাভ করলেন।”
এই পরম্পরায় সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য শব্দ শাস্ত্রকার। হিন্দু হোক বা বৌদ্ধ, সমগ্র
প্রাচীন সাহিত্যে সূত্র এবং শাস্ত্রের পার্থক্য, যদিও খুব কঠোরভাবে নয় কিন্তু বজায়
রাখা হয়েছে। তার মানে মগধের সাহিত্য সূত্র দিয়ে শুরু হয় না শাস্ত্র দিয়ে শুরু হয়। এটা
বোঝায় যে তখন পুরোনো সূত্র যুগ শেষ হয়ে গেছে, বৈদিক চিন্তাধারার সূত্রগুলো অচল হয়ে
গেছে, তাদের জায়গা নিয়েছে শাস্ত্র নামধারী বড় ধরণের সর্বাঙ্গীণ কাজ, যদিও তখনও অব্দি
সূত্রের শৈলীতে – সে সময়কার সাহিত্যের প্রচলিত শৈলীতে – রচিত। পন্ডিতদের প্রাগুক্ত সূচীতে উপবর্ষের নাম প্রথম এবং সর্বোপরি। আমার বিশ্বাস,
কালানুক্রমেও তিনি প্রথম হবেন। উপবর্ষ একজন মীমাংসা লেখক ছিলেন২। তাঁর সব
কাজ হারিয়ে গেছে। তাঁকে কখনও সূত্রকার কখনও বৃত্তিকারও বলা হয়। কৃষ্ণদেব তাঁর তন্ত্রচূড়ামণিতে
(মীমাংসা সম্পর্কিত কাজ) বলেন যে মীমাংসা সূত্রের ওপর বৃত্তি রচনা করেছিলেন উপবর্ষ।
অন্যদিকে ক্যাটালগাস ক্যাটালোগোরাম, ভাষ্কর মিশ্রের নাম নিয়ে বলে যে উপবর্ষ নামে এক
সূত্রকার ছিল। তিনি যাই হয়ে থাকুন, সূত্রকার অথবা বৃত্তিকার, তিনি পাটলিপুত্রে এলেন
এবং রাজার দ্বারা সম্মানিত হলেন। ব্রাহ্মণাদিতে প্রাপ্ত এবং কল্পসূত্রে ব্যবহারিক উদ্দেশ্যে
নিয়মাবদ্ধ, বৈদিক অনুজ্ঞাগুলোর ব্যাখ্যার পদ্ধতি হিসেবে মীমাংসা, সুদূর প্রাচীনকাল
থেকেই ছিল। নানারকম নামে পরিচিত ছিল – মীমাংসা, ন্যায়,
নয় ইত্যাদি। ধর্মের ওপর প্রাচীনতম সূত্রের একটি, গৌতম-ধর্ম-শাস্ত্র মীমাংসার কথা বলে।
প্রতিমা-নাটকে রাবণ সীতাকে মেধাতিথির কাছে তার মীমাংসা (ন্যায়-শাস্ত্র) অধ্যয়নের বিষয়ে
বলে।
এখানে প্রশ্ন করা যেতে পারে কেন পাণিনির ব্যাকরণ এবং পিঙ্গলের ছন্দ বিভিন্ন শাখার
পুরোনো ব্যাকরণ ও ছন্দ-সম্পর্কিত রচনাগুলোকে চাপা দিতে পেরেছিল, অথচ মীমাংসা, বৈদিক
চিন্তাধারার পুরোনো কল্পসূত্রগুলোকে চাপা দিতে পারেনি। সূত্রগুলো ব্যবহারিক উদ্দেশ্যে
প্রযুক্ত হত। যজ্ঞের বলি ও অর্ঘ্যাদির খুঁটিনাটির নিষ্পত্তি করত। যখন নাকি মীমাংসা
তার সাধারণ তত্ত্বগুলো এবং ব্যাখ্যার নিয়মাবলি নিয়ে আলোচনা করত। মীমাংসা কল্পসূত্র
এবং তদনুসার ক্রিয়াপদ্ধতিগুলোর সংশোধক হিসেবে প্রযুক্ত হত, ফলে তাদের চাপা দিতে সে
পারত না।
শবর-ভাষ্যের প্রথম পদের প্রথম অধ্যায়ে কৃষ্ণদেব উপবর্ষের নামে, প্রাচীন শৈলীতে
রচিত একটি দীর্ঘ উদ্ধৃতি দিয়েছেন। শবর-ভাষ্য নিশ্চিত মহাযানের উত্থানের পরে রচিত হয়েছিল।
কেননা সেটি স্পষ্ট বলে –
অনেন প্রত্যুক্তো মহাযানিকঃ পন্থাঃ ।
“এ প্রকারে মহাযানবাদীদের
যুক্তি খন্ডিত হল।” পঞ্চাশ বছর আগে, ভাষ্যের সম্পাদক, মহাযানিক শব্দটা না জেনে,
মহাজন থেকে নিষ্পন্ন করে মহাজানিক করে দিয়েছিলেন, যদিও সবকটি পান্ডুলিপিতে মহাযানিক
লেখা আছে। কাহেই শবর যখন লিখছেন তখন উপবর্ষ নিশ্চয়ই প্রাচীন বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচিত
ছিলেন। কিন্তু শবর শুধুই বৃত্তিকার বলেন উপবর্ষ নয়। সিদ্ধান্তে আসা খুব কঠিন যে উপবর্ষ
কী লিখেছিলেন, সূত্ররূপে শাস্ত্র নাকি বৃত্তি? খুব সম্ভব প্রথমটা, কেননা পারম্পরিক
কাব্যে তাঁর সঙ্গীরা সবাই শাস্ত্রকার, মৌলিক লেখক।
একটা কারণ আছে বিশ্বাস করার যে সূচিটা কালানুক্রমিক। কেননা পরে দর্শান হবে যে
মগধের মানুষদের, নিশ্চিত যাদের মধ্যে প্রথম কালানুক্রমের পরম্পরার উদ্ভব হয়েছিল, ভালো
ইতিহাসবোধ এবং সুস্থ কালানুক্রমিক ভাবনাচিন্তা ছিল। সূচিটা যে কালানুক্রমিক তা বিশ্বাস
করার একটা ব্যাকরণগত কারণও আছে। সাধারণভাবে সংযোজিত যুগ্ম শব্দ হওয়া উচিত বর্ষোপবর্ষং,
ছোটো শব্দটা আগে থাকবে। কিন্তু এখানে আছে উপবর্ষবর্ষং। তাত বিশেষ কারণ এটাই যে উপবর্ষ
অভ্যহৃত অথবা বেশি বরণীয়, অর্থাৎ বেশি প্রাচীন। তার ওপর, পরের নামগুলো সব সুস্পষ্ট
কালানুক্রমিক বিন্যাসে রয়েছে। দ্বিতীয় নাম বর্ষ, পাণিনির শিক্ষক। তৃতীয় পাণিনি নিজে।
চতুর্থ পিঙ্গল, চন্দ্রগুপ্ত এবং বিন্দুসারের সমসাময়িক। পঞ্চম ব্যাড়ি, যিনি শব্দ-সংক্রান্ত
সমস্ত বিষয় নিয়ে একটি সর্বাঙ্গীণ রচনা বা সংগ্রহ লিখেছেন। ষষ্ঠ এবং সপ্তম হলেন পাণিনির
ওপর বার্তিক এবং ভাষ্যের লেখক।
বর্ষর বিষয়ে বলা যায় আমরা কিছুই জানি না। শুধুমাত্র কথা-সরিতসাগরে একটি পরম্পরাগত
বয়ান আছে যে উনি পাণিনির গুরু ছিলেন। ফলে আমরা ভাবতে পারি যে পাণিনির মতই উনিও তক্ষশিলা
বা তার পাশের কোন মফস্বল থেকে এসেছিলেন।
পাণিনি তক্ষশিলার মফস্বল শালাতুরার বাসিন্দা ছিলেন। ইউয়ান চোয়াঙের লেখায় তাঁর
প্রতিমার প্রসঙ্গ আছে এবং লেখক বলছেন যে তাঁর সময়ের অনেক আগে থেকেই শালাতুরায় পাণিনির
প্রতিমা প্রতিষ্ঠিত ছিল। গত এক শতক ধরে পাণিনির বয়স তীব্র বিতর্কের বিষয় ছিল। প্রফেসর
গোল্ডস্টুকার তাঁকে ঋক, যজু এবং সামবেদ সংকলিত হওয়ার এবং যাস্ক-এর নিরুক্ত রচিত হওয়ার
ঠিক পরে স্থান দিচ্ছিলেন। বুহলার, কথা-সরিতসাগরের প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে খুব সাবধানে
তাঁকে খৃষ্টপূর্ব ৩৭৫এ রাখছিলেন। পন্ডিত সত্যব্রত সামশ্রমী চাইছিলেন তাঁকে যাস্ক-এর
আগে রাখতে। কিন্তু তাঁদের কেউই মনে হয় কাব্য মীমাংসায় উল্লিখিত পরম্পরার সঙ্গে পরিচিত
ছিলেন না। যদিও এটা একটা অদ্ভুত ব্যাপার, পরে দেখান হবে, যে কৌটিল্য মনে হয় পাণিনিকে
জানতেন না। ব্যাকরণের বিষয়ে বলতে গিয়ে কৌটিল্য ৬৩টি বর্ণ এবং চারটে পদ প্রকরণের কথা
বলেন, যখন নাকি পাণিনির ব্যাকরণে বর্ণের সংখ্যা ৬৪ এবং পদ প্রকরণের সংখ্যা দুই। পাণিনি
ভাষার সমস্ত শব্দকে সুবন্ত এবং তিঙন্ত, দুই শ্রেণীতে ভাগ করেন। দ্বিধাবিভক্তির মাধ্যমে
অধিক্রমণ-হীন সম্পূর্ণ বিভাজন নিয়ে তিনি এতটাই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত যে অব্যয় বা বিভক্তিহীন
উপাদানগুলোকেও, যেগুলো কোনো ব্যাকরণগত পরিসমাপ্তি নেয় না, কারক বিভক্তি সরিয়ে তিনি
সুবন্তে ঢুকিয়ে দেন। কেউ বলতে পারে এ পদ্ধতি অতি-বৈজ্ঞানিক, কিন্তু এটা কঠোরভাবে যুক্তিসঙ্গত,
যদিও অব্যবহারিক এবং শিক্ষানবিসদের বোঝার পক্ষে কঠিন। আগের চিন্তাধারায় শব্দ চার প্রকারে
বিভাজিত ছিল, যথা, নামন (সংজ্ঞা), আখ্যাত (ক্রিয়া), উপসর্গ (উপসর্গ) এবং নিপাত (উপাদান)।
এতেই পরবর্তীকালে, সপ্তম শতকে বোধহয়, ভর্তৃহরির বাক্যপদীয়র টীকাকার হেলারাজ, কারক নিয়ন্ত্রণকারী
পঞ্চম প্রকার যোগ করেন কর্ম-প্রবচনীয় অথবা “অনুসর্গ”। ইংরেজি প্রিপোজিশনের মত। রাজশেখর হেলারাজকে অনুসরণ করেন। তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণের
টীকায় সায়ন বলেন যে চার প্রকারে বিভাজন শ্রৌত, যদিও পাণিনির বিরুদ্ধে, এবং এই তথ্য
যে যাস্ক চার প্রকারের বিভাজন গ্রহণ করেন, সায়নের মত সমর্থন করে। কৌটিল্য যে পাণিনির
প্রণালী গ্রহণ করেন নি, তা প্রতিপন্ন করে যে পাণিনির শিকড় তখনও গভীরে প্রোথিত হয় নি,
এবং তখনও তাঁকে প্রাচীন ও অলঙ্ঘ্য বিশেষজ্ঞ মনে করা হত না।
পাণিনি আটটা বইয়ে বিভক্ত যার প্রতিটির চারটে করে ভাগ আছে এবং সব মিলিয়ে ৩৯৮৩ সূত্র
আছে। ভট্টোজি দীক্ষিত-এর গণনা অনুসারে সূত্রের সংখ্যা ৩৯৭৮, এবং প্রফেসর গোল্ডস্টুকার
অনুযায়ী ৩৯৯৩। ১৮১৫ শকাব্দে বম্বে থেকে কাশীনাথ পরব কর্তৃক প্রকাশিত সিদ্ধান্ত-কৌমুদির
সহজ সংস্করণে পাণিনির একটি সূত্রপাঠ দেওয়া আছে। ওই সংস্করণে প্রতিটি পদের নিচে, ২০
সূত্রের সমষ্টির প্রতীক এবং শেষ সমষ্টির (যাতে পদের সংখ্যা ২০ থেকে কম) প্রতীক দেওয়া
আছে। সেগুলোকে গুনেই আমি ৩৯৮৩তে পৌঁছালাম, এবং সূত্রপাঠের জীবানন্দ-এর সংস্করণের সঙ্গে
আমি সংখ্যাটা মিলিয়ে নিয়েছি। দেখছি যে বার্নেলও একই সংখ্যায় পৌঁছেছেন। তূলনামূলকভাবে
আধুনিক সংস্কৃত ব্যাকরণে সূত্রগুলোর বিন্যাস একটি ব্যবহারিক উদ্দেশ্য সামনে রেখে করা
হয়, যথা, ভাষার রূপ সম্পর্কে শিক্ষাদান, যাতে ছাত্ররা পাঠে এগোতে এগোতে ভাষার কিছুটা
শিখে যায়। কিন্তু পাণিনির বিন্যাস এমন যে সমগ্র সুত্রের অধ্যয়ন পুরো না করে কেউ ভাষায়
তাঁর কাজ প্রয়োগ করতে পারবে না। অন্যান্য ব্যাকরণ, বলতে গেলে স্কুল-পাঠ্য। যখন নাকি
পাণিনি, ভাষাবিদ্যার একটি বৈজ্ঞানিক রচনা যার মূল্য সবার উপরে। তাঁর কাজের ভিত্তি ওই
বিষয়ে পূর্ববর্তী অনেকগুলো কাজ। তিনি যে সব লেখকের কাছে ঋণী তাঁরা হলেন – আপিশালি, কাশ্যপ, গার্গ্য, গালব, চক্রবর্মন, ভারদ্বাজ, শাকটায়ন, শাকল্য, সেনক
এবং স্ফোটায়ন। আরো বৈয়াকরণেরা আছেন যাঁদেরকে উনি উত্তরের এবং পূর্বের বলে উদ্ধৃত করেছেন।
কখনো কখনো তিনি বহুবচনে আচার্যদের উল্লেখ করেছেন, হয়ত সেভাবে তিনি নিজের গুরু বর্ষকে
স্মরণ করেছেন।
পাণিনির যুগ সম্পর্কে গোল্ডস্টুকার বলেন, “আমরা দেখেছি যে আমাদের
জানা পুরো সংস্কৃত সাহিত্যের পরিসরে, ঋক, সাম ও কৃষ্ণ যজুর্বেদের সংহিতাগুলো এবং ব্যক্তিগত
লেখকদের মধ্যে ব্যাখ্যাকার যাস্ক পাণিনির পূর্ববর্তী, বাকি পুরো সাহিত্য ওই আটটা ব্যাকরণ-সংক্রান্ত
বইয়ের পরবর্তী। কাজেই, পাণিনি নিশ্চিতভাবে খুবই প্রাচীন। সম্পূর্ণ ব্রাহ্মণ সাহিত্য
তাঁর পর রচিত হয়েছিল, সবক’টি আরণ্যক, উপনিষদ এবং কল্প-সূত্র উত্তর-পাণিনি।” কিন্তু গোল্ডস্টুকারের পূর্বানুমান সবটা সঠিক নয়। পাণিনি ব্রাহ্মণ সাহিত্যের জন্য
সূত্র রচনা করেন। দ্বিতীয় খন্ড, তৃতীয় ভাগ, সূত্র সংখ্যা ৬০এ তিনি ব্রাহ্মণের জন্য
একটি নিয়ম দেন। তাঁর অনেক নিয়ম ছিল মন্ত্রের জন্য (দ্বিতীয় খন্ড, চতুর্থ ভাগ, সূত্র
সংখ্যা ৮০, তৃতীয় খন্ড, দ্বিতীয় ভাগ, সূত্র সংখ্যা ৭১, ষষ্ঠ খন্ড, প্রথম ভাগ, সূত্র
সংখ্যা ১৫১, ষষ্ঠ খন্ড, চতুর্থ ভাগ, সূত্র সংখ্যা ৫৩), একটি ছিল যজুর জন্য (অষ্টম খন্ড,
তৃতীয় ভাগ, সূত্র সংখ্যা ১০৪) এবং দুটো যজ্ঞের জন্য (অষ্টম খন্ড, দ্বিতীয় ভাগ, পৃঃ
৮৮, ষষ্ঠ খন্ড, চতুর্থ ভাগ, সূত্র সংখ্যা ৫৪)। তাই, সাধারণভাবে দিয়ে দেওয়া বক্তব্য
যে পাণিনি কেবল তিনটে সংহিতা জানতেন, একটাও ব্রাহ্মণ জানতেন না, ধরে রাখা যায় না। তিনি
মন্ত্র এবং যজুর জন্য ছন্দ থেকে পৃথক নিয়ম তৈরি করেন। তাতে এটাও বোঝা যায় তাঁর বৈদিক
নিয়মাবলির বহুলাংশ ব্রাহ্মণ সাহিত্যের সঙ্গেও সম্পর্কিত, কেননা অনেক মন্ত্র ব্রাহ্মণে
পাওয়া যায়, উদাহরণস্বরূপ সামবেদের মন্ত্রব্রাহ্মণচতুর্থ খন্ডের তৃতীয় ভাগে সূত্র সংখ্যা
১০৫ এবং তার বার্তিকা সাখ্য দেয় যে পাণিনির সময় সবচেয়ে প্রাচীন, পবিত্র অথচ আধুনিক
বলে পরিচিত ব্রাহ্মণগুলো ছিল, যেমন যাজ্ঞবল্ক্য ব্রাহ্মণ।
পাণিনির যুগ বৈদিক কালে অত আগে হতে পারে না। তিনি নিজের পূর্বসূরী অনেক বৈয়াকরণ
এবং ভাষাবিদকে উদ্ধৃত করেন। আপিশালী স্বরবিজ্ঞান নিয়ে লিখেছিলেন। আপিশালীর কাজের একটা
ছোট টুকরো ৪০ বছর আগে প্রকাশিত হয়েছিল। গার্গ এবং গালবকে যাস্কও উদ্ধৃত করেন। কিন্তু
তাঁদের বই আমাদের কাছে এসে পৌঁছোয় নি। ১৮৯৩ সালে যাহোক, একটি বই ম্যাড্রাস থেকে প্রকাশিত
হয়েছিল। সেটা শাকটায়ন। আমার বিশ্বাস হালফিল অব্দি দক্ষিণ ভারতের জৈনরা বইটা ব্যবহার
করত। লেখক শাকটায়ন ওদিকে শ্রুতকেবলী-দেশীয়াচার্য্য নামে পরিচিত। শ্রুতকেবলীরা সরাসরি
তীর্থঙ্করের শিষ্য। সোজাসুজি এক তীর্থঙ্করের মুখে মতবাদটা শুনে তারা কেবলী হয়েছে বা
পূর্ণতঃ মুক্ত হয়েছে। অর্থাৎ, শাকটায়ন নিশ্চিত এক তীর্থঙ্করের তরুণতর সমসাময়িক ছিলেন।
এবং পতঞ্জলি বলেন উনি রথের রাস্তায় বসে এতটাই ধ্যানমগ্ন ছিলেন যে সামনে দিয়ে রথের কাফেলা
চলে গেল বুঝতেই পারেন নি। শ্রুতকেবলী ঠিক এমনই হওয়া উচি। জৈনদের ২৪জন তীর্থঙ্করের মধ্যে
শেষ দুজনকে ঐতিহাসিক মনে করা হয়, পার্শ্বনাথ (যাঁর জন্ম বেনারসে এবং মৃত্যু সমেতগিরি,
হাজারিবাগের পরেশনাথ পাহাড়ে) এবং বর্ধমান (যাঁর জন্ম বৈশালীতে এবং মৃত্যু রাজগীরের
কাছে পাবায়)। সাধারণভাবে মনে করা হয় যে দুজনের মাঝে দুই শতকের ফারাক আছে। বর্ধমান সংসার
ত্যাগ করে বৈশালীতে একটি জৈন মঠে যোগদান করেন। শাকটায়ন মনে হয় পার্শ্বনাথের মাধ্যমে
শ্রুতকেবলী হয়েছিলেন। কেননা শুধু পাণিনি নন, যাস্কও তাঁকে উদ্ধৃত করেন। যাস্ক নিশ্চিতভাবে
পাণিনির কয়েক প্রজন্ম আগে ছিলেন, কেননা উপসর্গ সম্পর্কে যাস্কের ভাবনা অপরিণত, পাণিনির
ভাবনা অনেক উন্নত ও পরিষ্কৃত। এটা পাণিনি কর্তৃক আবিষ্কৃত পারিভাষিক শব্দ নয়। তিনি
পূর্বসূরিদের কাছ থেকে গ্রহণ করেন। তাই নিজে তিনি পরিভাষিত করেন না। উপসর্গ সম্পর্কে
যাস্কের ভাবনা নিছক এরকম যে উপসর্গ নানান বোধকে ব্যক্ত করে। কিন্তু পাণিনি বলেন তারা
নিপাত অথবা উপাদান, তারা তখনই উপসর্গ যখন তারা বাচনিক ক্রিয়ার সাথে যুক্ত হয়, যখন ক্রিয়ার
সে ধাতুটি সংজ্ঞায় পরিণত হয় তখন তারা গতি হয়, এবং যখন স্বতন্ত্র হয়ে সংজ্ঞাকে চালন
করে তখন হয় কর্মপ্রবচনীয়। অন্য দিকে শাকটায়ন বলেন যখন তারা সংজ্ঞা বা ক্রিয়াপদ থেকে
স্বতন্ত্র হয় তখন তারা স্পষ্টভাবে বোধকে ব্যক্ত করে না। অর্থাৎ, যাস্ক শাকটায়ন থেকে
এগিয়ে এবং পাণিনি যাস্ক থেকে এগিয়ে, এবং এই অগ্রগতি হতে নিশ্চয়ই কয়েক প্রজন্ম লেগে
থাকবে।
এখন, যদি শাকটায়ন সত্যি বর্ধমানের শ্রুতকেবলী হন এবং পাণিনি, পুরস্কারের জন্য
পাটলিপুত্রে আগত তৃতীয় শাস্ত্রকার হন, তাহলে যাস্কের জন্য অন্তর্বর্তী কোন জায়গা থাকে
না এবং উপসর্গ সম্পর্কে ভাবনা বিকশিত করার জন্য পর্যাপ্ত সময় থাকে না। কাজেই আমি ভাবতে
চাইব যে তিনি পার্শ্বনাথের শ্রুতকেবলী ছিলেন। কেননা এখানে তিনি শুধু শ্রুতকেবলী নয়,
শ্রুতকেবলী-দেশীয়াচার্য্য নামে পরিচিত ছিলেন, অর্থাৎ এমন এক আচার্য্য যে একজন শ্রুতকেবলীর
পার্শ্ববর্তী। তাহলে ব্যাকরণগত ভাবনাগুলো বিকশিত করার পর্যাপ্ত সময় থাকে।
শাকটায়নের ব্যাকরণ যে রূপে আমরা পেয়েছি
তার অকৃত্রিমতা নিয়ে আলোচনায় প্রবেশ করার আমার প্রয়োজন নেই। আমার উদ্দেশ্যের জন্য এটুকু
জানা পর্যাপ্ত যে পাণিনির গ্রন্থে শাকটায়নের উদ্ধৃতিগুলো এ রচনায় পাওয়া যায় কিনা। এমনকি
বার্নেলও, যিনি প্রমাণ করতে চান যে এই ব্যাকরণ একটা জালিয়াতি, তাও আবার আনাড়ি জালিয়াতি,
স্বীকার করতে বাধ্য হন, “এই সমাপতনগুলো প্রমাণ করে যে বর্তমান গ্রন্থটি সত্যিই মূল রচনার
ওপর আধারিত।” এটুকুই আমার এখনকার উদ্দেশ্য সাধনে প্রয়োজন। এগোবার আগে বলতে
পারি যে ব্যাকরণে জালিয়াতি এবং প্রক্ষেপের জায়গা খুব কম।পাণিনি সত্যিই এক প্রতিভাধর মানুষ ছিলেন। তাঁর পূর্বসূরিদের ধারণা ছিল যে সব সংজ্ঞা
ক্রিয়ামূল থেকে নিষ্পন্ন করা যায়। তাঁদের ব্যুৎপত্তিবাদী বলা হত এবং শাকটায়ন এই ব্যুৎপত্তিবাদীদের
সূচিতে শীর্ষস্থানে ছিলেন। কিন্তু পাণিনি এর বিরুদ্ধে ছিলেন। তিনি ব্যুৎপত্তিবাদী ছিলেন
না। তুলনাত্মক ব্যাকরণের আধুনিক প্রণালী যদি কিছু আমাদের শিখিয়ে থাকে, তাহলে সেটা হল
কোনো ভাষার প্রাচীনতর পর্ব থেকে ধার নেওয়া শব্দগুলো সে ভাষার বাস্তবিক ধাতুগুলো থেকে
নিষ্পন্ন করা যায় না। ব্যুৎপত্তিবাদীরা এত দূর গেছে যে নিশ্চিতভাবে বিদেশি ভাষা থেকে
ধার নেওয়া শব্দগুলোও সংস্কৃত ধাতু থেকে নিষ্পন্ন করেছে।
পাণিনির ব্যক্তিগত ইতিহাস আমরা এটুকুই জানি যে তিনি তক্ষশিলার উপনগরী শালাতুরার
নিবাসী ছিলেন। তাঁর মায়ের নাম ছিল দক্ষী, তিনি বর্ষের ছাত্র ছিলেন (এ কথাটা আমরা কথাসরিতসাগর
থেকে জানি তাই সাবধানতা অবলম্বন করে স্বীকার করতে হবে) এবং পাটলিপুত্রে অনুষ্ঠিত এক
পাঁচসালা সমাবেশে তিনি নিজের বিশিষ্টতা প্রমাণ করেছিলেন। পতঞ্জলির দেওয়া আরেকটি তথ্য
আছে যে ছেলেবেলা থেকেই তিনি বিখ্যাত ছিলেন। এ তথ্যটা কথাসরিতসাগরের গল্পটাকে মিথ্যে
করে দেয় যে তিনি প্রথমে একেবারেই নির্বোধ ছিলেন কাত্যায়নের সঙ্গে বাদানুবাদের সময় শিব
তাঁকে বাঁচাতে আসেন। পতঞ্জলি আরও বলেন যে পাণিনির এক ছাত্র ছিল, কৌত্স।
পাণিনির অন্যান্য রচনা সম্পর্কে জানার জন্য একটা পদ্য আছে যেটি সুদূর প্রাচীনকাল
থেকে আমাদের হাতে এসেছে। পদ্যটি এরকম –
অষ্টকং গণপাঠশ্চ ধাতুপাঠস্তথৈব চ।
লিঙ্গানুশাসনং শিক্ষা পাণিনীয়া অমী ক্রমাত্ ।।
অষ্টকং হল অষ্টাধ্যায়ী অর্থাৎ সূত্রপাঠ। অনেক সূত্রে গণের উল্লেখ আছে। গণ অর্থে
একই ধরণের ব্যাকরণগত বদল হয় যে শব্দগুলোর তার একটি সূচী। একটা বই আছে যাতে এই সমস্ত
গণকে এক জায়গায় রাখা হয়েছে এবং সে বইটা পাণিনি রচিত বলা হয়। কিন্তু পরম্পরায় এ কথাও
চলে আসছে যে শাকটায়নেরও একটি গণপাঠ ছিল। গণ একদিনে তৈরি হয় নি। বৈদিক কালের শেষের দিকে
বিভিন্ন শাখার অধ্যাপকেরা নিজের নিজের শাখায় প্রচলিত নানান ধরণের ব্যাকরণগত বৈচিত্রগুলো
খুব যত্ন সহকারে সারণিবদ্ধ করেন। আমাদের কাছে সেসব সারণিগুলোর কয়েকটি আছে যেমন পদগাধ,
চতুর্জ্ঞান, লক্ষণরত্ন ইত্যাদি। এগুলোকে সাধারণ ভাবে লক্ষণগ্রন্থ বলা হয়। বলা নিষ্প্রয়োজন
যে এই সারণিসমূহ, সূত্রগুলো নির্মাণ করতে বড় ভাবে সাহায্য করেছিল কেননা সূত্রগুলো এই
সারণিরই সাধারণীকরণ। এই সারণিগুলো থেকেই গণ নামের সূচিগুলো তৈরি হয়েছিল। প্রত্যেক বৈয়াকরণকে
সূত্ররূপে নিজের গ্রন্থটি সংকলিত করতে আগে নিজের সূচিগুলো তৈরি করতে হত। তাই পাণিনিরও
একটা গণ-সংকলন ছিল।
একই ভাবে প্রত্যেক বৈয়াকরণকে নিজের ক্রিয়ামূল বা ধাতুর সূচি তৈরি করতে হত। পাণিনির
ধাতুপাঠ-এ ১৯৪৪টা ধাতু আছে এবং সে ছাড়া ২০টা সৌত্র ধাতু আছে যেগুলো পাণিনির সূত্র থেকে
তুলে নিতে হবে। তাঁর লিঙ্গানুশাসনে ১৮৩টা সূত্র আছে এবং শব্দের লিঙ্গ নিয়ে আলোচনা আছে।
আধুনিক ভাষাগুলো থেকে ভিন্ন, সংস্কৃতে প্রত্যেকটি সংজ্ঞার লিঙ্গ আছে, আবশ্যক নয় যে
সে লিঙ্গ যৌনতা দিয়ে নির্দ্ধারিত হবে। লিঙ্গানুশাসন সংজ্ঞার লিঙ্গ নির্ণয় করার নিয়মাবলী
দেয়।
পাণিনীয় শিক্ষা-য় আছে বিভিন্ন ছন্দে রচিত ৫৯টি পদ্য। সেগুলো শব্দ উচ্চারণ করার,
বেদ আবৃত্তি করার এবং বক্তৃতাকৌশলের নিয়মসমূহ জানায়। বইটার শুরু পাণিনির বন্দনা দিয়ে
এবং পদ্যগুলোতে মাঝেমধ্যেই পাণিনির উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু প্রাচীন রচনায়, আমরা কৌটিল্যের
উদাহরণে জানি, লেখকেরা আকছার প্রথম পুরুষে কথা বলেন। প্রথমে এবং শেষে বন্দনা পরে যোগ
করা হয়েছে। বর্ণমালায় বর্ণর সংখ্যা এই বইয়ের গুনতি অনুসারে ৬৪। এটি বলে – আত্মা বুদ্ধির সঙ্গে যোগ দেয় এবং বস্তুকে ব্যক্ত করতে চিত্তকে কাজে লাগায়। চিত্ত
শরীরে আগুন জ্বালে এবং আগুন হাওয়াকে গতিমান করে। বুকে বহমান হাওয়া গভীর ধ্বনি উৎপন্ন
করে; সেই হাওয়া কন্ঠে মধ্যম ধ্বনি উৎপন্ন করে; সেই হাওয়া মাথায় তীক্ষ্ণ ধ্বনি উৎপন্ন
করে। হাওয়া মাথায় আঘাত করে মুখে আসে এবং স্পষ্ট বর্ণ উচ্চারণ করে। এই বর্ণ পাঁচ শ্রেণীতে
বিভক্ত – (১) স্বরগ্রাম অনুযায়ী, (২) কাল অনুযায়ী, (৩) কন্ঠ্য-ইন্দ্রিয় অনুযায়ী, (৪) প্রয়াস
অনুযায়ী এবং (৫) স্পর্শ অনুযায়ী। স্বরগ্রাম তিনটে, উচ্চ, নিম্ন আর মধ্য। কালও হ্রষ্ব,
দীর্ঘ এবং দীর্ঘায়িত হতে পারে। কন্ঠ্য-ইন্দ্রিয় আটটা – নাক, বুক, গলা, মাথা, জিভের গোড়া, দাঁত, ঠোঁট আর তালু। প্রয়াস – মুখ খোলা, বন্ধ করা, আদ্ধেক খোলা এবং সামান্য খোলা। স্পর্শ নানা প্রকারের – প, ফ ইত্যাদি উচ্চারণ করার বেলায় ঠোঁটদুটো একে অন্যকে স্পর্শ করে; ত, থ ইত্যাদি
উচ্চারণ করার বেলায় জিভের ডগা দাঁত স্পর্শ করে; ট, ঠ ইত্যাদি উচ্চারণ করার বেলায় জিভের
ডগা শক্ত তালু স্পর্শ করে; চ, ছ ইত্যাদি উচ্চারণ করার বেলায় জিভের মাঝটা নরম তালু স্পর্শ
করে এবং ক, খ ইত্যাদি উচ্চারণ করার বেলায় জিভের গোড়াটা গলা স্পর্শ করে। স্বরবর্ণে কোনো
স্পর্শ নেই। অর্দ্ধ-স্বরবর্ণ সামান্য স্পর্শে উৎপন্ন হয়। শিসধ্বনি অর্দ্ধ-স্পর্শে উৎপন্ন
হয়।
ধ্বনির যে বিশ্লেষণ এই গ্রন্থে দেওয়া আছে তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা করা এখানে
আমার উদ্দেশ্য নয়। স্পষ্ট বলা আছে যে “জগতকে এই বিশ্লেষণ
সম্পর্কে অবহিত করেছে দক্ষীর ছেলে পাণিনি।”
এই প্রসঙ্গে আরো তিনটে কৃতি আমাদের বিবেচনায় আনতে হবে। সেগুলো হল – (১) উণাদি সূত্র, (২) ফিটসূত্র এবং (৩) পরিভাষা সূত্র। নাগোজি ভট্ট শাকটায়নকে
উণাদি সূত্রের লেখক বলেন। কেন না এটা সর্ববিদিত যে শাকটায়ন মানতেন, সব শব্দ ক্রিয়ামূল
থেকে নিষ্পন্ন করা যেতে পারে। রূপমালার রচয়িতা বিমল বররুচি-কাত্যায়নকে উণাদি সূত্রের
রচয়িতা বলেন। কিন্তু গোল্ডস্টুকার বলেন, যদিও উণাদি সূত্রের রচয়িতা পাণিনি নন, উণাদি
প্রত্যয়ের সূচী তাঁরই রচনা।
ফিট্সূত্র – সবাই স্বীকার করেন যে এই সূত্রগুলো শান্তনবাচার্য্যের রচনা।
সূত্রগুলো চার ভাগে বিভক্ত এবং সংখ্যায় ৮৭। ম্যাক্সমুলার এই সূত্রগুলোকে পাণিনির আগে
রাখতে চান এবং এর উৎপত্তি দেখাতে চান পূর্বদিকের চিন্তাধারায়। কিন্তু গোল্ডস্টুকার,
ভারতীয় টীকাকারদের পান্ডিত্যে নির্ভর করে ভাবেন যে এ সূত্রগুলো পাণিনির পরের এবং পূর্বদিকের
চিন্তাধারার সঙ্গে যুক্ত করার মত কোনো তথ্য নেই। একজন ভারতীয় টীকাকার বলেন, “অন্য দিকে পাণিনির প্রসঙ্গে দেখলে এই ফিট্সূত্রগুলোকে আজকের তৈরি মনে হয়।” এবং গোল্ডস্টুকার ভাবেন যে সূত্রগুলো পাণিনির সমালোচনা করার জন্য তৈরি করা হয়েছিল।
ফিট্সূত্রে নিম্নলিখিত ভৌগোলিক নামগুলোর উল্লেখ রয়েছেঃ – সাঙ্কাশ্য, কাম্পিল্য, নাসিক্য, দারু, এবং অঘাট। এর মধ্যে কয়েকটি পাণিনির তূলনায়
আধুনিকতর মনে হয়।
পরিভাষা-পাঠে ১৩৪টি সূত্র রয়েছে। শেষে লেখা আছে যে ব্যাকরণের প্রত্যেক লেখক নিজের
সূত্রটিকে এমনকি আধমাত্রাও আরো ছোটো করা যায় কিনা বিবেচনা করে, যাতে সেটি সন্তানের
জন্মের মত সুখকর হয়। এগুলো স্বতঃসিদ্ধ অথবা ব্যাখ্যার নিয়মাবলী। এই নিয়মসমূহ নিশ্চয়ই
সূত্র সাহিত্যের প্রারম্ভ থেকেই বিদ্যমান ছিল। সূত্র থাকলেই সে সূত্রের ব্যাখ্যার নিয়মাবলীও
থাকতে হবে। বর্তমানে যে পরিভাষা সূত্রটি পাওয়া যায় সেটি পরবর্তী কালে কোনো এক অজানা
লেখক কৃত সংগ্রহ। সংগ্রহটির উপযোগিতা প্রতীয়মান হওয়ায়, তার টীকাও রচিত হয়েছে বারম্বার।
পাণিনির আগেও পরিভাষাদি ছিল। কিছু পরিভাষা পাণিনি নিজের সূত্রসমূহে রূপায়িত করেছিলেন।
কিছু যোগ করেছিলেন কাত্যায়ন, এবং অনেকগুলো যোগ করেছিলেন পতঞ্জলি। কিছু পরিভাষা সূত্রে
প্রদত্ত তথ্যের সম্পূরক – সেগুলোকে বলা হয় জ্ঞাপক। অন্যগুলোকে বলা হয় ন্যায়। সেগুলো ব্যাকরণ
ভিন্ন অন্যান্য রচনায় প্রযোজ্য।
এখানেই পাণিনির অষ্টাধ্যায়ীর সংক্ষিপ্ত নিরীক্ষা আমরা শেষ করছি। বলা হয় যে অষ্টাধ্যায়ী
পাণিনিরই রচনা এবং তাঁরই চিন্তাধারাভুক্ত। ভাবছি যে বেদাঙ্গ নিয়ে আলোচনা করার এখনই
যুক্তিযুক্ত সময়।
বেদাঙ্গ শব্দটা এবং তার ছয় ভাগে বিভাজন কৌটিল্য এবং অন্যান্য পুরোনো লেখকেরা জানতেন।
তত্ত্বটা হল এই যে বেদের প্রতিটি শাখার ছয়টি অঙ্গ ছিল পূর্ণ। কল্পের ব্যাপারে আমরা
পাই যে বেদের বহু শাখা তাদের কল্প কৃতি সংরক্ষিত রেখেছে। কিন্তু ব্যাকরণ বিষয়ে আমরা
বৈদিক কোনো গবেষণামূলক আলোচনা পাই না। সে জায়গাটা পুরোপুরি অধিকার করে রেখেছেন পাণিনি।
আগে দেখিয়েছি যে পাণিনির পূর্বসুরি শাকটায়ন যাঁর ব্যাকরণ আমাদের কাছে এসে পৌঁছেছে,
একজন জৈন ছিলেন। সেই ব্যাকরণের সম্পাদক বলেন যে স্বর-বৈদিকির জন্য কোনো নিয়ম
তাঁর কাছে নেই। কাজেই সে ব্যাকরণকে বেদাঙ্গ বলা যেতে পারে না। আপিশলিকে যক্ষ ও পাণিনি
দুজনেই উদ্ধৃত করেন। এবং তাঁর কাজের বিষয়ে একটাই কথা জানা যায় যে তিনি আটটি গ্রন্থের
রচয়িতা ছিলেন। ‘শিক্ষা’ প্রসঙ্গে জানা যায় যে এ বিষয়ে ছন্দোবদ্ধ কাজ
রয়েছে যার একটা বড় অংশ অত্যন্ত প্রাচীন লেখকদের রচনা। সেসব লেখকেরা বেদের বিভিন্ন শাখায়
ছড়িয়ে ছিলেন। সাধারণ মতে প্রতিশাখ্যগুলি ‘শিক্ষা’ কৃতি এবং অত্যন্ত প্রাচীন। কিন্তু গোল্ডস্টুকার বলেন যে ওগুলো বেদাঙ্গ নয় এবং
পাণিনির পরের, যখন নাকি ম্যাক্সমুলার বলেন, প্রতিশাখ্যগুলি প্রাচীনতর কৃতি, ছন্দোবদ্ধ
‘শিক্ষা’গুলি পরের। কিন্তু পাণিনির মহান কাজ, নিজের আটটি গ্রন্থে ‘শিক্ষা’র সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্বগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করে ছন্দোবদ্ধ
‘শিক্ষা’ আর প্রতিশাখ্যগুলোকে পিছনে করে দিয়েছে। আজকাল এসব কৃতিগুলোর
অধ্যয়ন খুব একটা হয় না।
পিঙ্গল, চতুর্থ শাস্ত্রকার – পাণিনির পর আসেন
পিঙ্গল। পাণিনি ব্যাকরণের জন্য যা করলেন তা তিনি ছন্দশাস্ত্রের জন্য করলেন। তিনি তাঁর
রচনায় ছন্দের সমস্ত নিয়মকে অঙ্গীভূত করলেন, ফলে বিভিন্ন শাখার করা ছন্দ-সম্পর্কিত রচনাগুলো
অচল হয়ে গেল।
দিব্যাবদানমালা অবদান কাহিনীসমূহের একটি সংগ্রহ। অষ্টম বা নবম শতকে এটি প্রস্তুত
করা হয়েছিল। কিন্তু এই সংগ্রহের কয়েকটি অবদান পুরোনো। তার মধ্যে একটি পাংশুপ্রদানাবদান
। কাহিনীটির অর্থ, নিজের এক পূর্বজন্মে অশোক তৎকালীন বুদ্ধকে একমুঠো ধুলো দিয়ে
সাহায্য করেছিলেন এবং বুদ্ধ তাঁকে বর দিয়েছিলেন যে এক ভবিষ্যত জন্মে তিনি বিশ্বের চক্রবর্তী
সম্রাট হবেন। অন্য ভাবে এই কৃতিটিকে অশোকাবদান বলা হয়। এই গল্পটি শুধু অশোক নয় পুরো
মৌর্য রাজবংশের উপকথাসুলভ ইতিহাস। অশোক তাঁর প্রথম যৌবনে খুব দুষ্টু ছিলেন। তাই তাঁর
পিতা বিন্দুসার পিঙ্গল নাগের আশ্রমে পাঠাবার কথা ভাবলেন। পিঙ্গল তাঁকে পূর্ণ শিক্ষা
দিলেন এবং তাঁর আগামী মহানতা সম্পর্কে ভবিষ্যৎবাণী করলেন। অশোকের জীবনের বহু শতক পর
রচিত এই গ্রন্থের প্রামাণ্যতা অত্যন্ত সন্দেহজনক। এটি একমাত্র গ্রন্থ যাতে অশোককে ক্ষত্রিয়
বলা হয়েছে। কোথায় অথবা কারা দিব্যাবদানমালা সংগ্রহ করেছিল বা অশোকাবদান লিখেছিল তা
অজ্ঞাত। কিন্তু কাব্য-মীমাংসায় অঙ্গীভূত পরম্পরা, পাটলিপুত্রয় নিজেদেরকে বিশিষ্ট করে
তোলা শাস্ত্রকারদের মধ্যে চতুর্থ, পিঙ্গলকে, অশোকের গুরু হিসেবে চিনতে প্রলুব্ধ করে।
ব্যাড়ি, পঞ্চম শাস্ত্রকার – পাণিনির মা ছিলেন দক্ষী, দক্ষের কন্যা। দক্ষের পুত্র দক্ষী হবে এবং পৌত্রের পরবর্তী
উত্তরসূরিরা দক্ষায়ণ হবে। ব্যাড়ি একজন দক্ষায়ণ ছিলেন এবং পাণিনির নিকট-সম্পর্কিত ছিলেন
– বোধহয় তাঁর মামার প্রপৌত্র বা প্রপৌত্র-পুত্র। এই ব্যাড়ি ১,০০,০০০ শ্লোক সম্বলিত
একটি সংগ্রহ লিখেছিলেন। কিন্তু জানা যায় না যে তাঁর এই কৃতি গদ্যে রচিত না পদ্যে, কেননা
গদ্যরচনা ৩২ অক্ষর সম্বলিত শ্লোকের মান দিয়ে পরিমাপ করা হয়। পতঞ্জলি এই সংগ্রহের প্রশংসক
ছিলেন। তিনি লিখেছেনঃ –
শোভনা খলু দাক্ষায়ণেন সংগ্রহস্য কৃতিঃ ।
লিখেছেন পাণিনির সূত্র (দ্বিতীয় অধ্যায়, তৃতীয় পাদ, সূত্র সংখ্যা ৬৬, উভয় প্রাপ্তৌ
কর্ম্মণি) র ওপর বার্তিক (দ্বিতীয় অধ্যায়) সম্পর্কে। সূত্রটি এরকমঃ –
অকাকারয়োঃ প্রয়োগে প্রতিষেধো নেতি বক্তব্যং । শেষে বিভাষা।
ঋক-প্রাতিশাখ্যে বহুবার ব্যাড়িকে উদ্ধৃত করা হয়েছে এবং গোল্ডস্টুকার বলেন, তিনি
যে সেই একই ব্যাড়ি যিনি সংগ্রহের লেখক, এ ব্যাপারে যুক্তিপূর্ণ কোনো সন্দেহ নেই। আমি
বেনারসের এক পন্ডিতের কাছে শুনেছিলাম যে পতঞ্জলি সত্যিই ব্যাড়ির সংগ্রহের টীকা রচনা
করেছিলেন। তিনি কারণ দেখিয়েছিলেন যে প্রথম যে সূত্রটির টীকা রচনা করেন পতঞ্জলি সেটি
হল ‘অথ শব্দানুশাসনম্’ । এটি পাণিনির সূত্রপাঠের প্রথম সূত্র নয়; কাত্যায়নের বার্তিক-পাঠেরও প্রথম সূত্র ‘সিদ্ধে শব্দার্থসম্বন্ধে’, এটি নয়। পরবর্তী বৈয়াকরণেরাও ব্যাড়িকে জানতেন। ১৩৯৪ খ্রিষ্টাব্দে মিথিলায় ‘সুপদ্ম-কৌমুদি’ রচনার সময় পদ্মনাভ একটি সূত্র বাঁধেন, ‘যণা ব্যবধানং ব্যাড়িগালোবয়োঃ’। নিজের প্রথম ‘আহ্নিক’এ পতঞ্জলি দু’বার ব্যাড়ির সংগ্রহ
উদ্ধৃত করেন। এই উদ্ধৃতিগুলো থেকে আমরা দেখতে পারি যে পাণিনির মত শুধু ব্যাকরণ-সম্পর্কিত
রচনায় একান্ত আবশ্যক বিষয়াদিতে ব্যাড়ি নিজেকে সীমিত রাখেন নি, আরো অনেক বিষয় নিজের
রচনায় অন্তর্ভুক্ত করেছেন। যেমন, দৃষ্টান্তস্বরূপ, তিনি শব্দের অসীমতা এবং অন-অসীমতা নিয়ে ভাবনাচিন্তা করেছেন। আমরা জানি, সপ্তম খ্রিষ্টাব্দে
রচনারত ভর্তৃহরি বলেন যে সংগ্রহে ১৪০০০টি বিষয়বস্তু আছে, যখন নাকি সংগ্রহ ব্যাকরণশাস্ত্রের
অংশমাত্র।
ষষ্ঠ শাস্ত্রকার হলেন কাত্যায়ন গোত্রের বররুচি। তিনি পাণিনির সূত্রের ওপর ‘বার্তিক’এর রচয়িতা। কিন্তু বার্তিক কী? নাগোজি ভট্ট বলেন, “বার্তিকের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হল কোনো সূত্রে ছেড়ে যাওয়া বা ত্রুটিপূর্ণ ভাবে
অভিব্যক্ত কোনো কিছুর সমালোচনা”। নাগোজি ভট্টের কথায়, “সূত্রে অনুক্তদুরুক্তচিন্তাকরত্বং বার্তিকত্বং”।
সে বার্তিকের সংখ্যা ৫০৩২। কাত্যায়নএর কোনো বার্তিকপাঠ এখনো অব্দি আমাদের কাছে
এসে পৌঁছোয় নি। এই বার্তিকগুলো সব পতঞ্জলির মহাভাষ্য থেকে তোলা হয়েছে। মহাভাষ্যের টীকা
রচনা করতে গিয়ে কৈয়ত ৩৪টি আরো বার্তিক উদ্ধৃত করেন। কাজেই আমরা জানি এমন বার্তিকের
সংখ্যা হল মোট ৫০৬৬। কিন্তু বার্তিকপাঠের কোনো পান্ডুলিপি না থাকায় সুনিশ্চিত ভাবে
বলা অসম্ভব কোনগুলো বার্তিক আর কোনগুলো নয়, বা আরো অন্য কোনো বার্তিক আছে কি নেই। এই
বার্তিকগুলো পাণিনির বিভিন্ন সূত্রের সঙ্গে সম্পর্কিত। কাত্যায়ন পাণিনির একটি সূত্র
ওঠান এবং তার সঙ্গে বার্তিক যোগ করেন – পাণিনি প্রদত্ত
তথ্যে যোগ করার জন্য এবং নিজের দৃষ্টিতে সে তথ্যকে সংশোধিত করার জন্যও। এভাবে তিনি
পাণিনির ১৫০০ সূত্রের সমালোচনা করেন। বাকিগুলো অসমালোচিত থেকে যায়।
তাহলে এবার প্রশ্ন, এতগুলো বার্তিকের প্রয়োজন কেন হয়েছিল। পাণিনি নিজেই খুব সাবধানী
মানুষ ছিলেন। সবকিছু নিজের ক্ষমতার শেষটুকু অব্দি ব্যবহার করে করতেন। তাহলে এত বেশি
সংশোধনের দরকার কেন পড়ল? কারণগুলো হল – (১) পাণিনি পশ্চিমের
ছিলেন আর কাত্যায়ন পূর্বের। কথা-সরিত-সাগর বলে যে বররুচি-কাত্যায়ন কৌশাম্বীতে জন্ম
নিয়েছিলেন। কৌশাম্বী যমুনার দক্ষিণ তীরে এবং গঙ্গা-যমুনার সঙ্গমস্থল থেকে ৩০ মেইল পশ্চিমে।
(২) দুজনের মাঝখানে অনেকগুলো প্রজন্মের ব্যবধান ছিল। পাণিনির কিছু নিয়ম কাত্যায়ণের
সময় অচল হয়ে গিয়েছিল; অভিব্যক্তির নতুন গঠন চলনে এসে গিয়েছিল।
গোল্ডস্টুকার ভাবেন যে বাজসনেয় প্রাতিশাখ্য
সেই একই কাত্যায়নের রচনা যিনি পাণিনির ওপর বার্তিক লিখেছেন এবং তিনি সুনিশ্চিত যে কাত্যায়ন
আগে প্রাতিশাখ্য লিখেছেন তারপর বার্তিক। কেননা তাঁর ধারণা দুটো কৃতিরই উদ্দেশ্য এক,
বলতে গেলে, পাণিনির সমালোচনা, কী অনুক্ত এবং কী দুরুক্ত , তা নিয়ে চিন্তাভাবনা।
বোধহয় সেটাই কারণ যে বার্তিকে পাণিনির অনেক নিয়ম অসমালোচিত থেকে যায়। যেমন আগেই বলেছি,
গোল্ডস্টুকার মনে করেন না যে প্রাতিশাখ্যগুলো বেদাঙ্গের অন্তর্গত। কাত্যায়নেরা পূর্বের শক্তিশালী পরিবার ছিল। সবক’টি বেদের আচার্য ছিল সে পরিবারে। ঋগ্বেদের সর্বানুক্রমণী এক কাত্যায়ন রচিত। এক
কাত্যায়ন রচিত কল্পসূত্র আছে; অন্য এক কাত্যায়ন রচিত গৃহ্যসূত্র আছে – যদিও সে গৃহ্যসূত্রকে পারস্কর-গৃহ্যসূত্র এমনভাবে ঢেকে দিয়েছে যে পন্ডিতদের ঐতিহ্যে
পারস্কর কাত্যায়নেরই আরেক নাম বলা হয়। যদিও এশিয়াটিক সোসাইটির লাইব্রেরিতে কাতীয় গৃহ্যসূত্র
ভিত্তিক কিছু পান্ডুলিপি আছে যেগুলো পারস্কর থেকে ভিন্ন। পন্ডিতদের মাঝে এমনও ঐতিহ্য
আছে যে শেষ সূত্রকার কাত্যায়ন। তাঁরা কাত্যায়নের সূত্রকে সব সূত্রের পরিশিষ্ট মনে করেন।
তাছাড়া, কাত্যায়নের কল্পসূত্রের ১৮টি পরিশিষ্ট আছে, কাত্যায়নকেই সেসবগুলোর রচনাকার
বলা হয়। আরো কিছু পরিশিষ্ট তাঁর নামে চলে, সেগুলোকে ক্ষেপক বলা হয়, অর্থাৎ কাত্যায়নের
পরিশিষ্টে নিক্ষিপ্ত। এগুলো সব যজুর্বেদের বাজসনেয় অংশের অন্তর্ভুক্ত। মাধ্যন্দিন এবং
কান্বদের জন্য সেগুলো প্রামাণিক। সামবেদের ছন্দগ পরিশিষ্টও কাত্যায়ন রচিত বলা হয়।
যদি গোল্ডস্টুকারের কথন সত্য হয়, অর্থাৎ, যদি এটা সত্য হয় যে পাণিনি বাজসনেয় সংহিতার
বিষয়ে জানতেন না, তাহলে কাত্যায়নদের পুরো পরিবার, বোধহয় একমাত্র সর্বানুক্রমণীর লেখক
ছাড়া, এই অধ্যায়ের সমীক্ষাধীন কালে চলে আসত।
কাত্যায়ন ও পাণিনির মধ্যেকার সম্পর্কটাকে ভারতে এবং ইওরোপে প্রায়শই ভুল বোঝা হয়।
ভারতে এই ভুল ধারণা একটি কাহিনী-পরম্পরার জন্ম দিয়েছে যে নন্দের রাজসভায় পাণিনি ও কাত্যায়নের
মধ্যে তর্কযুদ্ধ চলত যাতে সব সময় কাত্যায়ন পাণিনিকে হারিয়ে দিতেন, কিন্তু ভগবান শিবের
মধ্যস্থতায় পাণিনি তাঁর সূত্রকার হন এবং কাত্যায়ন তাঁর বার্তিককার। ইয়োরোপীয় সমালোচকরা
বলেন কাত্যায়ন পরচ্ছিদ্রান্বেষী, শত্রুভাবাপন্ন সমালোচক ছিলেন ইত্যাদি। কিন্তু বাস্তব
তথ্য মনে হয় এটাই যে পাণিনি নিজের সময়কার প্রচলিত ভাষার সমগ্র তথ্যাদি সংগ্রহ করে সেগুলোর
ব্যাখ্যার সূত্র ব্যক্ত করেন। কাত্যায়নও তাই করেন। কিন্তু স্বতন্ত্র একটি রচনার বদলে,
সুবিধের জন্য তিনি পাণিনির নিয়মাবলির সঙ্গে নিজের সমালোচনাগুলো জুড়ে দেন। দুজনেই শ্রেষ্ঠ
চিন্তাশীল ছিলেন এবং নিজেদের সময়কার একটি প্রগতিশীল ভাষার সমস্ত তথ্য সংগ্রহ করে সারা
বিশ্বকে সবিশেষ উপকৃত করেছেন।
পতঞ্জলি। কাব্য-মীমাংসায় উল্লেখিত সপ্তম ও শেষ শাস্ত্রকার হলেন পতঞ্জলি। তাঁর
ব্যক্তিগত ইতিহাস সম্পর্কে এটুকুই আমরা জানি যে তিনি গোণিকার পুত্র ছিলেন এবং গোনার্দা
দেশে ছিল তাঁর নিবাস। বৃহৎ সংহিতা এক জায়গায় এই গোনার্দাকে চেদি এবং কুকুরার সঙ্গে
রাখে আবার অন্য জায়গায় দষপুর এবং কেরলের সঙ্গে রাখে। কিন্তু মনে হয় পতঞ্জলির খুব পরিচিত
জায়গা ছিল উজ্জয়িনী এবং মাহিষ্মতি। এক শহর থেকে সূর্যোদয়ের সময় বেরিয়ে অন্য শহরে সূর্যাস্তের
সময় পৌঁছে যাওয়া যেত। সুবিদিত যে তাঁর সময়ে মেনান্ডারের নেতৃত্বে গ্রীকরা সাকেত শহর
ও মাধ্যমিক দেশটাকে ঘিরে রেখেছিল। মাধ্যমিক অর্থে, যথা প্রস্তাবিত, উদয়পুর এলাকার চারদিকের
ভূখণ্ড হতে পারে। তিনি নিজে ঘটনাটা প্রত্যক্ষ করেন নি, কিন্তু চাইলে করতে পারতেন। এটাও
সুবিদিত যে পাটলিপুত্রে, পুষ্যমিত্র কর্তৃক যে বিরাট যজ্ঞগুলো অনুষ্ঠিত হয়েছিল তার
একটিতে তিনি একজন কার্যনির্বাহক পুরোহিত ছিলেন। পুষ্যমিত্র এক ব্রাহ্মণ সেনাপতি ছিলেন
যিনি খৃষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকের শুরুতে মৌর্য রাজবংশকে সিংহাসনচ্যুত করেন এবং ক্ষমতাসীন
হন। পতঞ্জলি কিছুদিন কাশ্মীরে ছিলেন যেখানে তিনি ভাত খেয়েছিলেন। তাঁর নিয়মিত বাসস্থান
মনে হয় পাটলিপুত্র থেকে কিছুটা দূরে ছিল।
তাঁর জীবনকাল সেই সময়কার যখন অশোকের ব্রাহ্মণবিরোধী পদক্ষেপসমূহের বিপর্যয়কর ফলগুলো
ফলতে শুরু করেছিল। অশোক তাঁর বিশাল সাম্রাজ্যে এমনকি যজ্ঞের প্রয়োজনেও পশুনিধন নিষিদ্ধ
করেছিলেন। এটা ব্রাহ্মণদের জন্য, বিশেষ করে সামবেদ পড়ানো, সোমযাগে বিশেষ পুরোহিত হওয়া
ব্রাহ্মণদের জন্য জ্বালাতন ছিল। শুঙ্গেরা সামবেদের আচার্য ছিল। গোত্র সম্পর্কিত গ্রন্থাদি
বলে যে তারা, ব্রাহ্মণদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সুপরিচিত ভরদ্বাজ ও বিশ্বামিত্র গোত্রের
মধ্যে নিয়োগের উৎপত্তি। কাজেই কোনো সন্দেহ নেই যে শুঙ্গ পুষ্যমিত্র, যে বৃহদ্রথ, মৌর্য
রাজবংশের শেষ রাজাকে হত্যা করে সিংহাসন দখল করেছিল, ব্রাহ্মণ ছিল এবং সামবেদী ব্রাহ্মণ
ছিল। এটা অসম্ভব নয় যে ক্ষমতাসীন হয়ে নিজের আরোহণের স্মারক হিসেবে সে শুধু রাজধানীতে
নয়, একেবারে অশোকের প্রাসাদের ভিতরে যেখান থেকে পশুনিধন নিষিদ্ধ করে প্রথম শিলালেখ
জারি হয়েছিল, লক্ষ লক্ষ অশ্ব হত্যা করে অশ্বমেধ যজ্ঞ অনুষ্ঠিত করবে। কয়েকজন এমন ভাবে
যে ব্রাহ্মণরা পশুনিধনের বিরুদ্ধে কেননা কয়েকটি উপনিষদে “মা হিংস্যাত্ সর্বা ভুতানি”, “অহিংসা পরমো ধর্ম্মঃ” ইত্যাদি কথাগুলো আছে। উপনিষদের ওই ধরণের গুটিকয়েক বিচ্ছিন্ন অভিব্যক্তির বিপক্ষে
ব্রাহ্মণ এবং কল্পসূত্রসমূহের, এমনকি পুষ্যমিত্রের আগের সমগ্র সংস্কৃত সাহিত্যের প্রামাণ্যতা
দাঁড় করানো যায়।
পতঞ্জলির কাজকে বলা হয় মহাভাষ্য বা মহান ভাষ্য। কিন্তু কোন কৃতির ওপর সেই ভাষ্য
, তা বলা কঠিন। তাঁর কাজগুলো শুধু পাণিনির সূত্রের ওপর নয়। যদি বার্তিকগুলো শুধু পাণিনির
সূত্রের সঙ্গে যুক্ত হয়, তাহলে মহাভাষ্যের প্রথম অধ্যায়ের প্রথম পদের প্রথম দুটো আহ্নিকে
যে বার্তিকগুলো দেওয়া আছে, সেগুলো কাত্যায়নের বার্তিকে অন্তর্ভুক্ত করা উচিৎ হয় নি।
তর্ক করা যেতে পারে যে দ্বিতীয় আহ্নিক শিবসূত্র বিষয়ক এবং তাই তারা পাণিনির সূত্রপাঠের
সঙ্গেই যুক্ত এবং তারই অংশ। কিন্তু এ যুক্তি প্রথম আহ্নিকের বেলায় খাটে না যাতে শব্দের
এবং অর্থের দর্শন আলোচিত হয়েছে। এক জায়গায় (আহ্নিক ১) প্রশ্ন তোলা হয়েছে যে শব্দ শাশ্বত,
নাকি কারণজনিত। পতঞ্জলি বলেন, সংগ্রহে প্রধানতঃ এই বিষয়টিকেই পরীক্ষা করা হয়েছে, পক্ষে
এবং বিপক্ষে সব রকম যুক্তি দেওয়া হয়েছে এবং সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া গেছে যে শাশ্বত হোক
বা কারণজনিত, নিয়মগুলো একই ভাবে প্রযোজ্য হবে। অন্য একটি জায়গাতেও (আহ্নিক ১) সিদ্ধ
শব্দটিকে, সংগ্রহের প্রামাণ্যতায় ব্যাখ্যায়িত করা হয়েছে শাশ্বত। আবার অন্য জায়গায়,
একটি বার্তিকের (যথা লৌকিকবৈদিকেষু) মত কোনো কিছুর ব্যাখ্যা করতে গিয়ে পতঞ্জলি একটি
অযাচিত মন্তব্য করছেন … প্রিয়তদ্ধিতাঃ দাক্ষিণাত্যাঃ যথা লোকে বেদে চেতি প্রযোক্তব্যে
যথালোকিকবেদিকেশষ্বিতি প্রয়ুঞ্জতে। (দক্ষিণের মানুষেরা তদ্ধিত খুব পছন্দ করে, তাই ‘লোকে’ আর ‘বেদে’ বলার জায়গায় তারা তদ্ধিতের সঙ্গে বলে ‘লৌকিক’ এবং ‘বৈদিক’)। কার প্রসঙ্গে
দাক্ষিণাত্য বলছেন? পাণিনি হতে পারেন না। তিনি পশ্চিমা, কাত্যায়ন হতে পারেন না, তিনি
পূর্বাইয়া। তাহলে কি ব্যাড়ি? এমন কি হতে পারে না যে প্রথম আহ্নিক পুরোটাই ব্যাড়ির কাজের
প্রথমাংশের ব্যাখ্যা? এবং মহাভাষ্যের পুরোটা, ব্যাড়ি ও কাত্যায়ন সহিত পাণিনির ব্যাখ্যা?
এবং ৫০৬৬টি বার্তিকের অনেকগুলো ব্যাড়ির সূক্ত? তেমন একটি সূক্ত আছে (পাণিনি, তৃতীয়
অধ্যায়, চতুর্থ পাদ, সূত্র সংখ্যা ৩৭এর ওপর বার্তিক সংখ্যা ৩) যাতে একটি বার্তিককে
উদ্ধৃত করা হয়েছে এবং সমালোচনা করা হয়েছে।
প্রথম আহ্নিকে অনেক কিছু আছে যেগুলো পাণিনি এবং কাত্যায়ন বাতিল করে দিতেন যে ওসব
ব্যাকরণের এক্তিয়ারে পড়ে না; ‘শিক্ষা’র অন্তর্ভুক্ত। পাণিনির
সূত্রপাঠে ওগুলো অন্তর্ভুক্ত হয় নি। ওখানে আছে কেননা পাণিনি ওই ‘শিক্ষা’ রূপে ওগুলো ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। ঐন্দ্র চিন্তাধারায়ও, যেটা
প্রাচীনতম এবং সত্যিই শ্রৌত, সর্ববর্মন “সিদ্ধো বর্ণসমাম্নায়ঃ” দিয়ে শুরু করেন। সে সময় মানুষেরা যেমনভাবে বর্ণমালা ব্যবহার করছিল তিনি সেটাকেই
তার নিষ্পাদিত রূপ হিসেবে গ্রহণ করেন। শাকটায়ন বর্ণমালাকে সেরূপে গ্রহণ করেন নি যে
রূপে মানুষেরা বাস্তবে ব্যবহার করছিল, তিনি শিবসূত্র রূপে গ্রহণ করেন। তাঁর শিবসূত্র
ছিল তেরটা। তিনি পাণিনির তুলনায় প্রাচীনতর আর শুধু লৌকিকের জন্য সূত্র রচনা করেন, ‘লৃ’ সম্পূর্ণভাবে বাদ দিয়ে দেন।
দ্বিতীয় আহ্নিকে বার্তিকের শৈলীতে অনেকগুলো সূক্ত রয়েছে যার সঙ্গে পতঞ্জলি বিস্তারিত
ব্যাখ্যা যোগ করেন। সন্দেহ করা হয় যে এই সূক্তগুলোও ব্যাড়ির। আত্মীয় ছিলেন বলে, পাণিনির কাজের জন্য
রূপায়িত শিবসূত্রের ব্যাখ্যায় তিনি কাত্যায়নের চেয়ে যোগ্যতর ছিলেন। এই সূক্তগুলো খুব
শ্রদ্ধাব্যঞ্জক ভাষায় ব্যক্ত করা হয়েছে।
তৃতীয় আহ্নিক থেকে পাণিনির সূত্র এবং কাত্যায়নের বার্তিক (আপাতদৃষ্টিতে ব্যাড়ির
সংগ্রহ থেকে আহরিত সূক্তগুলোর সাথে মিশিয়ে) শুরু হয়। এখানেও আমরা একই সূত্রের পুনরাবৃত্তি
দেখতে পাই – ‘যথা লৌকিকবৈদিকেষু’।
মহাভাষ্যের শৈলী সম্পর্কে আমি ডাঃ কীলহর্নকে উদ্ধৃত করতে চাই … “বলা যেতে পারে যে সংলাপের শৃংখলা রূপে মহাভাষ্য রচিত হয়েছে এবং নিঃসন্দেহে, ব্যাকরণ-বিজ্ঞানে
পারদর্শী পন্ডিতদের মধ্যেকার মৌখিক তর্কবিতর্কের মাধ্যমেই এর অর্থ সর্বাধিক পরিস্ফূট
হয়।”
একই উদাহরণ, একই তত্ত্ব এবং একই ব্যাখ্যা গ্রন্থটিতে বহুবার পুনরাবৃত্ত হয়েছে।
যথাসম্ভব ন্যূন পদাংশে সূত্রকে সীমিত করার, বৈয়াকরণের চেষ্টার যে নীতি, মহাভাষ্যে তার
কোনো স্থান নেই। কিন্তু তা হলেও মহাভাষ্য শব্দবহুল নয়। লেখকের সামনে বহুসংখ্যক বিশেষজ্ঞেরা
ছিলেন, এবং সুব্যবস্থিত ভাবে দেশীয় ভাষাগুলোর পৃষ্ঠপোষণকারী সম্রাট অশোকের সাম্রাজ্যের
পতনের পর, সংস্কৃত ব্যাকরণের একটি সুসম্বদ্ধ গ্রন্থ রচনা করবেন বলে, সেই বিশেষজ্ঞদের
দৃষ্টিভঙ্গিগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সংগতি আনাকে লেখক নিজের উদ্দেশ্য করেছিলেন। পতঞ্জলির
সামনে শুধু পাণিনি, ব্যাড়ি এবং ইয়াস্ক এবং তাদের দ্বারা উদ্ধৃত অন্যান্য বিশেষজ্ঞেরা
ছিলেন না, শৌনাগের মত পরবর্তী এবং তাঁর কাজে প্রায়শই উদ্ধৃত অসংখ্য কারিকার লেখক – তাঁরাও ছিলেন। পতঞ্জলির প্রধান লক্ষ্য ছিল সত্য, এবং সে সত্যের সন্ধানে তিনি
কোনো বিশেষজ্ঞকে ছাড়ান দেন নি, সে যতই প্রাচীন ও শ্রদ্ধেয় হন। এক জায়গায় বলেন, “অতঃপর ভারদ্বাজ রাজসভা থেকে পূর্ণতঃ বহিষ্কৃত হলেন।” ‘পাণিনি সূত্র রচনা করেছিলেন, কাত্যায়ন তার শত্রুতাপূর্ণ সমালোচনা করেছিলেন এবং
পতঞ্জলি প্রথমজনকে সমর্থন করতে চেষ্টা করেছিলেন’এর তত্ত্বটা এত সুষম
যে সত্য হতে পারে না। তাঁরা সবাই সত্যসন্ধানী ছিলেন এবং নিজেদের সাধ্যমত সত্য খুঁজে
বার করেছিলেন। অন্যেরাও ছিলেন, ভাষাতত্ত্ব-সংক্রান্ত সমস্যার সমাধানে তাঁদেরও স্বল্প
স্বল্প পরিমাণ অংশদান ছিল। পাণিনি কঠোরভাবে সমস্ত বাহ্য বস্তু নিজের সূত্রসমূহ থেকে
বহিষ্কৃত করেছিলেন এবং নিজের কৃতিটিকে বিশুদ্ধভাবে ব্যাকরণ-সংক্রান্ত, অর্থাৎ শব্দ-তত্ত্ব-সংক্রান্ত
গ্রন্থের রূপ দিয়েছিলেন।
তাঁর সময়ে একদিকে সেকেলে হয়ে পড়া বা হতে থাকা বৈদিক বাচনরীতি ছিল, অন্যদিকে চলতি
সংস্কৃত বাচনরীতি ছিল যার কয়েকজন প্রবল উদ্গাতা ছিলেন, বিশেষ করে শাকটায়ন, আর ছিল
দেশীয় ভাষা যার উল্লেখ তিনি বাকি দুই বাচনরীতির বিরুদ্ধশক্তি হিসেবে নিজের ‘শিক্ষা’য় করেছেন। কিন্তু পাণিনির সময়কার দেশীয় ভাষায় সাহিত্য অতি অল্পই
ছিল। পাণিনির পরের শতাব্দিগুলোয় যদিও এই ভাষাগুলোর মেজাজে বদল এল। পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতাব্দির
আকস্মিক বিরাট পরিবর্তন এই দেশীয় ভাষাগুলোয় বড় বড় এবং শক্তিশালী সাহিত্যের উৎপত্তি
ঘটাল; ব্রাহ্মণ্য ভাষাকে দেশীয় ভাষার ছোঁয়াচ থেকে বাঁচাতে পতঞ্জলি খুবই চিন্তিত ছিলেন।
বোধ হয় খোদ পুষ্যমিত্রই তাঁকে শুদ্ধিবাদী কাজ করতে অনুরোধ করেছিলেন; পুষ্যমিত্রের সঙ্গে
তিনি ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত ছিলেন। শিশুনাগ, মৌর্য এবং নন্দ রাজবংশদের কাছ থেকে সব শাস্ত্রকারেরাই
উৎসাহ পেতেন কিন্তু পতঞ্জলি মনে হয় ব্রাহ্মণবাদের সম্রাটোচিত পুনরুদ্ধারক পুষ্যমিত্রের
কাছ থেকে বিশেষ পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিলেন।
তাঁর সময়ে পাটলিপুত্র শোন নদীর পাড়ে এক বিশাল শহর ছিল। এর দেয়ালগুলো ছিল অটুট
আর তেমনই ছিল প্রাসাদগুলো। ‘পাটলিপুত্র’ পড়াবার লোক ছিল,
অর্থাৎ পাটলিপুত্রের পথপ্রদর্শক ছিল। পাটলিপুত্র তকে বিভিন্ন দিকে পথ বেরুত, কিছু পথে
এখানে সেখানে কুঁয়ো থাকত। সংকাশ্য থেকে বেশি জমকালো ছিল শহরটা, যদিও মথুরা পাটলিপুত্র
থেকে বেশি জমকালো ছিল।
পতঞ্জলি সাধারণতঃ পাটলিপুত্রে থাকতেন না। কেননা সব সময় তিনি এ জায়গা বা সে জায়গা
থেকে পাটলিপুত্রে যাওয়ার কথা বলেন। কোথাও কোথাও পাটলিপুত্র যাত্রার পথের বিভিন্ন পর্যায়
এবং দূরত্বের উল্লেখ করেন; এক কথায় তিনি পাটলিপুত্রে ভরা। তিনি চন্দ্রগুপ্তসভা এবং
পুষ্যমিত্রসভা-র কথা বলেন। কোনো কোনো পান্ডুলিপিতে চন্দ্রগুপ্তসভা-র
কথা নেই কিন্তু পুষ্যমিত্রসভার-র কথা সব জায়গায় আছে। তিনি সেসব মানুষের কথা
বলেন যাঁরা দেবদেবীর প্রতিমা নিয়ে দিকে দিকে যায় এবং লোকেরা যা কিছু অর্পণ করে তাই
নিয়ে তারা জীবনধারণ করে। একজায়গায় তিনি বলেন যে যখন মৌর্যদের পয়সার দরকার হয় তারা দেবদেবীদের
প্রতিমা স্থাপন করে। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রও এ ব্যাপারে সাক্ষ্য দেয়। যুদ্ধ এবং আর্থিক
অনটনের সময় রাজতহবিলে অর্থ যোগাতে এই উপায়ের কথা বলা আছে। পতঞ্জলি ব্রাহ্মণদের অন্যান্য
গোত্রের তুলনায় গার্গ্যায়ন এবং বাৎস্যায়নদের সঙ্গে বেশি পরিচিত। পরে এটা প্রমাণিত হবে
যে বাৎস্যায়নদের আদি বাসস্থান ছিল মগধে, শোন নদীর তীরে। পতঞ্জলি নিম্নলিখিত শব্দে বৌদ্ধদের
পতন এবং ব্রাহ্মণবাদের পুনরুত্থান ঘটানো বিপ্লবের আভাস দেন –
‘আশ্চর্যং ওদনস্য
নাম পাকঃ। ব্রাহ্মণানাং চ প্রাদুর্ভাবঃ । (অবাক কান্ড যে অন্নের নাম হয়েছে রন্ধন আর
ব্রাহ্মণদের প্রভাব বাড়ছে)। কৌটিল্যের গ্রন্থে বাজারে রান্না করা খাবারের বিক্রি প্রচলিত
ছিল, কিন্তু ব্রাহ্মণদের প্রভাব বাড়তে সবাইকে নিজের অন্ন নিজে রান্না করা শুরু করতে
হল। বিধবা বিবাহকে ভালো চোখে দেখা হত না। কিন্তু যারা বিধবাকে বিবাহ করত তাদেরকে সমাজচ্যুত
করা হত না। মহাভাষ্যে প্রায়শঃ পুনরুক্ত একটি উক্তি আছে –
‘উচ্চানি দেবদত্তস্য
গৃহাণি। আমন্ত্রয়স্বৈনং … দেবদত্তস্য গাবঃ অশ্বাঃ হিরণ্যং। আঢ্যঃ বৈধবেয়ঃ’। (দেবদত্তের বাড়িগুলো সুউচ্চ, আমন্ত্রণ জানাও … গবাদি, অশ্ব এবং সোনা আছে [প্রচুর]। সে ধনী এবং বিধবার সন্তান।) এখানে নেমন্তন্ন
করার জন্য আমন্ত্রয়স্ব ব্যবহার করা হয়েছে নিমন্ত্রয়স্ব নয়। কেননা আমন্ত্রয়স্ব আর নিমন্ত্রয়স্ব
-র তফাত হল – নিমন্ত্রণ স্বীকার করা বাধ্যতামূলক, আমন্ত্রণ-এ
আমন্ত্রিতরা আসতেও পারে নাও আসতে পারে।
মহাভাষ্যে বারম্বার শুদ্ধতার মান হিসেবে শিষ্টদের ব্যবহার করার আবেদন করা হয়েছে।
শিষ্ট কে? “এই আর্যাবর্তে সেই ব্রাহ্মণেরা যারা সংস্থান হিসেবে এক বছরের
শস্য সঞ্চয়ে রাখে, যারা লোভী নয়, যারা নিস্পৃহ, যারা জ্ঞানের কোনো একটি শাখায় কিছুটা
পারদর্শী – সেই শ্রদ্ধেয় মানুষেরাই শিষ্ট।” শিষ্টদের অষ্টাধ্যায়ী, পাণিনির আটটি গ্রন্থ পড়া উচিৎ, কিন্তু এমন কিছু শিষ্ট আছেন
যাঁরা অষ্টাধ্যায়ী না পড়েও, স্বজ্ঞায় অথবা ঈশ্বরের আশীর্বাদে সঠিক বাচনভঙ্গী অর্জন
করেন।
পতঞ্জলির আর্যাবর্ত মনুর আর্যাবর্ত নয়। হিমালয় আর বিন্ধ্যের মাঝের পুরো ভুখন্ডটাকে
অন্তর্ভুক্ত করবে এত ব্যাপ্ত নয়। পতঞ্জলির আর্যাবর্ত সীমিত। এই ভুখন্ডটা আদর্শ-এর
(অর্থে, আমি মানি, সেই জায়গাটা যেখানে সরস্বতী নদী মরুভূমিতে হারিয়ে যায়) পূর্ব থেকে
কালকাবন-এর পশ্চিম অব্দি এবং পারিপাত্র-র (বিন্ধ্যের সঙ্গে আরাবল্লির পাহাড়গুলির সংযোগকারী
পর্বতশ্রেণী) উত্তর থেকে হিমালয়ের দক্ষিণ অব্দি। এই এলাকার বাইরে বসবাসকারী সবাই শূদ্র।
তাই সক এবং যাবব, সৌর্য এবং ক্রৌঞ্চ, কিষ্কিন্ধ্য এবং গান্ধিক, সবাই শূদ্র। তেমনই
চন্ডাল এবং মৃতপ-রা। ছুতোর এবং কামার-রা। ধোপা এবং তাঁতি-রা। এদের মধ্যে তাদেরকে বহিরাগত
মনে করা হয় যারা খাবার খেলে থালা দূষিত হয়, এবং সেই দূষণের শুদ্ধিকরণ (সংস্কার) হয়
না।
মহাভাষ্য থেকে সংগ্রহ করা যায় এমন সমস্ত তথ্য এখানে রাখা আমার বক্তৃতার বিষয়ের
অন্তর্গত নয়। পরের বক্তৃতায় আপনারা শুনবেন যে কৌটিল্যের সময় দর্শনের তিনটেই ধারা ছিল
– সাংখ্য, যোগ এবং লোকায়ত। এর বাইরে কৌটিল্য কোনো তথ্য দেন না। কিন্তু পতঞ্জলি
আমাদের বলেন যে ভাগুরি ছিলেন লোকায়তের জ্যোতি। বোধহয় প্রথমবার আমরা লোকায়ত চিন্তাধারার
লেখকদের মধ্যেকার একটি বাস্তবিক ঐতিহাসিক নাম পাচ্ছি। পতঞ্জলি হিন্দু দর্শনের আরেকটি
ধারার কথা বলেন, মীমাংসা, এবং কাসকৃৎস্নি এই ধারার এক বিশিষ্ট আচার্য ছিলেন; অনেক
শিষ্য ছিল তাঁর। বাদরায়ন তাঁর ব্রহ্মসূত্রে একজন কাসকৃৎস্নকে উদ্ধৃত করেন, এবং ব্যাকরণ
মতে কাসকৃৎস্নি কাসকৃৎস্ন-এর ছেলে। পতঞ্জলি মহাভারতের বহুবার উদ্ধৃত কাব্যপংক্তিটাও
উদ্ধৃত করেন – “কালঃ পচতি ভূতানি …” ইত্যাদি। তিনি যুধিষ্ঠির,
ভীম, অর্জুন, নকুল, সহদেব, বাসুদেব, সত্যভামা, কুরু-গণ এবং উগ্রসেন-এর কথা বলেন। তিনি
বাসবদত্তা, ভৈমারথ, বররুচ-কাব্য-এর মত কিছু কবিতার কথা বলেন।
সংস্কৃত ব্যাকরণে পতঞ্জলির যোগদান সর্বজনস্বীকৃত, কিন্তু সমসাময়িক তথ্য সঠিকভাবে
লিপিবদ্ধ করে ইতিহাসবিদ হিসেবে যে যোগদান তিনি দিয়েছেন তা উপেক্ষণীয় নয়। তাঁর গ্রন্থের
সতর্ক অধ্যয়ন আমাদের আরো গুরুত্বপূর্ণ পরিণামে উপনীত করতে পারে এবং প্রাচীন ভারত সম্পর্কে
নানান তত্ত্বে সংশোধন আনতে পারে। একটা কথা এখানে বলা যায় যে কাব্য-মীমাংসা থেকে উদ্ধৃত
কবিতায় অঙ্গীভূত একটি প্রথা, ম্যাক্সমুলারের সেই তত্ত্বটাকে পুরোপুরি নাকচ করে দেয়
যে বুদ্ধের মৃত্যুর পর থেকে চতুর্থ খ্রিষ্টাব্দে গুপ্ত বংশের উত্থান অব্দি সাত শতাব্দীকাল
সংস্কৃত ঘুমিয়ে পড়েছিল। অবশ্য বলা যায় যে এ প্রথারও ততটুকুই মূল্য, যতটুকু অন্যান্য
ভারতীয় প্রথার মূল্য, তাই এর ওপর খুব বেশি ভরসা করা উচিৎ হবে না। আমি মনে করিনা যে
ভারতীয় প্রথাগুলো ওভাবে পুরোপুরি মূল্যহীন, আর যখন এই প্রথাটির সমর্থনে সুপ্রমাণিত
তথ্য রয়েছে, এর ওপর পুরোপুরি ভরসা করার সব রকম অধিকার আছে ভারতীয়দের।
মগধের শক্তিশালী রাজবংশ যথা শিশুনাগ,
নন্দ, মৌর্য এবং শুঙ্গ কর্তৃক প্রদত্ত উৎসাহ, ব্রাহ্মণদের নিজ ভাষার ব্যাকরণ-প্রণালী
এমন পূর্ণাঙ্গ ও ত্রুটিহীন করতে সক্ষম করেছিল যা সারা বিশ্বের ভাষাবিজ্ঞানীদের প্রশংসা
আদায় করেছে। ব্রাহ্মণেরা এ বিষয়ে প্রজন্মের পর প্রজন্ম, শতাব্দীর পর শতাব্দী কাজ করে
চলেছিল – শেষে পতঞ্জলি তাদের বিজয়-তোরণের মাঝের পাথরটা রাখলেন। সবাই, যারা
সংস্কৃত ব্যাকরণ অধ্যয়ন করেছে, জানে কত ধৈর্যশীল ছিল তাদের গবেষণা, কত ব্যাপক অথচ কত
নিখুঁত। ওইসব রাজবংশ যদি এই ব্রাহ্মণদের উৎসাহপ্রদান ছাড়া আর কিছু নাও করে থাকে, তাদের
সিংহাসনারোহণ ব্যর্থ হয় নি। -------------------------
১ – কাব্যমীমাংসা পৃ ৫৫
২ – হলস কন্ট্রিবিউশন্স মীমাংসা
No comments:
Post a Comment