Thursday, September 18, 2025

আমাদের লাঞ্চরুম

কর্তৃপক্ষ অনেক কিছুকে আইন বলে চালাতে চায়। অনেক কিছুকে জোর করে নিজেদের অধিকারক্ষেত্রে নিয়ে নিতে চায়। কাগজে কলমে তো তার প্রতিরোধ হয়ই না, এমনকি লোকবলেও হয় না। হাঙ্গামার পরিস্থিতি তৈরি করতে হয়। কিষণ সেটা দুবার করে দেখিয়ে ছিল। প্রথমবার, ডিজিএম সাহেবের ভিজিটের সময়।

রোজ বলা হচ্ছিল ব্রাঞ্চের ওই সাকুল্যে একখানা স্নানঘর বা পায়খানা সম্পর্কে। ঢোকার মুখে ডানদিকে দুটো পেচ্ছাপ করার জায়গা আর তার ঠিক আগে একটা আবর্জনার ড্রাম। সেসবে যাহোক করে দিন কেটে যাচ্ছিল। কেউ খেয়ালও করেনি আগে, ব্রাঞ্চে একজন মহিলা কর্মচারি আছেন, চা-জল খাওয়ান, বিধবা, অনুকম্পার ভিত্তিতে চাকরি, দরকার পড়লে তিনি কোথায় যাবেন। তিনিও বুঝতেন অবস্থা। তাই দরকারটাকেই দমিয়ে রাখতেন যতটা পারা যায়। কাজে যাওয়া মহিলার অধিকাংশকে এখনও অনেক জায়গায় তাই করতে হয়। বাড়ির বাইরে জল কম খায়।

সমস্যা এল যখন কর্মচারিদের নতুন প্রজন্ম এল এবং অনুকম্পার চাকরিতে আরো দুজন মহিলা কর্মচারী এলেন। একজন মহিলা আধিকারিকও এলেন স্থানান্তরিত হয়ে। চল্লিশজন কর্মচারি ও আধিকারিক, তার মধ্যে মাত্র চারজন, দশ পার্সেন্ট; এমন কিছু ব্যাপার নয়। কিন্তু, কর্মচারি সংগঠনও নতুন একটা তৈরি হয়েছে। নতুন মোল্লা পেঁয়াজ বেশি খায় বাগ্ধারাটা চরিতার্থ করতেই হোক বা সংগঠনগত প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণেই হোক, তারা বেশি বেশি করে খুঁজে বের করতে শুরু করল ব্যবস্থাপনার ভুলচুকগুলো।

ফলে কর্তৃপক্ষের কাছে, সব শাখাদপ্তর থেকে সদস্যদেরকে দিয়ে স্বাক্ষর করিয়ে জমা দেওয়া দাবিপত্রের মধ্যে একটা ছিল, প্রত্যেক শাখায় মহিলা কর্মচারিদের জন্য যথাযথ টয়লেট সুবিধা। এই শাখায় সেটা মূর্ত রূপ পেলঃ স্নানঘরের ভিতরে ঢুকে পায়খানার জায়গার বাইরে মেয়েদের পেচ্ছাপখানার একটা ব্যবস্থা করতে হবে। অর্থাৎ, পা রাখার দুটো স্ল্যাব, মাঝখানটা অগভীর করে কেটে পাশ দিয়ে যাওয়া জলনিকাশির সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া। আর পুরো জায়গাটা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার নিয়মিত ব্যবস্থা করা।

এমন কোনো বড় কাজ নয়। কিন্তু হচ্ছিলই না। কিষণ ছিল ঐ নতুন সংগঠনের ইউনিটের সম্পাদক।  যেদিন ডিজিএম এলেন, হঠাৎ হইহই। সবাই নিজেদের কাজ ছেড়ে ম্যানেজারের চেম্বারে ঢুকল। দেখল, পেচ্ছাপের জায়গার পাশে রাখা আবর্জনার ছোটো ড্রামটা ম্যানেজারের টেবিলের ওপর রাখা। কিষণ কিছু একটা বলে গম্ভীর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ম্যানেজার, ডিজিএম, তাঁর দুজন সঙ্গী আধিকারিক ভয়ে আঁতকে উঠে বিপরীত দিকে দাঁড়িয়ে আছে। ভিড়ে একজন ফিসফিস করল, ঐ ড্রামটা আনলো কে? থুথু, পানের পিকে ভর্তি!

-       কে আবার! কিষণই!

-       ঘেন্নাপিত্তি নেই? উঁচু ঘরের ছেলে! রাজপুত!

-       কী করবে? কথাই শুনছে না ম্যানেজমেন্ট!

তারই মধ্যে শোনা গেল কিষণের শান্ত, গম্ভীর গলা, বসুন আপনারা স্যার! আপনাদের জন্য চা, জলখাবার আসছে। আপনাদের যখন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার সমস্যা নিয়ে কোনো মাথাব্যথাই নেই, এই ড্রামটার পাশে রেখেই খান চা-জলখাবার!

ম্যানেজার মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, আমি আজই লেডিজ ইউরিন্যালটা তৈরি করার জন্য বলে দিচ্ছি। আর সুইপারকে দিয়ে জায়গাটা নিয়মিত পরিষ্কার করাবার ব্যবস্থা করছি।

-       চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে তৈরি চাই। রামেশ্বর! লে যাও ইসকো!

রামেশ্বর সুইপার, সাফাইকর্মী। একে ওকে সরিয়ে ভিতরে ঢুকে ড্রামটা তুলে নিয়ে গেল।

-       জরা সফাই ভী কর দেনা। পোছা লেকর আও। (ম্যানেজারকে বলল) আশ্বাস নিয়ে যাচ্ছি। আর আসবো না। 

উপরুল্লিখিত দাবিপত্রেই আরেকটি দাবি ছিল, প্রতিটি শাখায় লাঞ্চরুমের ব্যবস্থা। সে ব্যবস্থা এই শাখায় ছিল, কিন্তু বেশির ভাগ শাখায় ছিল না। ওই কাজের টেবিলগুলোর মধ্যে কোনো একটা খালি দেখে সবাই চেয়ার জড়ো করত প্রতিদিন। কিন্তু এখানে ছিল বলেই, সে-দাবিটা নিয়ে তেমন কোনো চিন্তা ছিল না কারোর। চিন্তা শুরু হল এটিএম তৈরি হবে এমন কানাঘুষো শোনার পর। কাল বিকেলে নাকি জোনালের প্রেমিসেস ডিপার্টমেন্টের আধিকারিকেরা এসেছিল, মাপজোক নিয়ে গেছে। তারা বলেছে লাঞ্চরুমটাই সবচেয়ে ভালো জায়গা। আবার একজন নাকি বলেছে, ভালো হবে, ওটাই এদের ইউনিয়নবাজির জায়গা ছিল, হাপিশ হবে।

ব্যাস, ঐ কথাটাতেই আগুন ধরে গেল। তবে, তখনও সবাই বোঝেনি তাদের লাঞ্চরুমটার গুরুত্ব। সবার মুখে একটাই বিষয় নিয়ে চর্চা ছিল, প্রেমিসেস ডিপার্টমেন্ট কত টাকা কমিশন খেয়েছে ঠিকেদারের কাছে। ডিজিএম তার কত প্রতিশত পেয়েছে। ম্যানেজারকে দেখে অবশ্য মনে হচ্ছিল না সে কিছু পেয়েছে বলে।

শেষে একদিন রাজমিস্ত্রির লেবাররা এল। লাঞ্চরুমের ভিতরে জলের বেসিনের নিচে গাঁইতি বসালো। আওয়াজটা হলের ভিতরে বসা কিষণের কানে যাওয়া মাত্র সে দৌড়ে গেল। গাঁইতি-ফাঁইতি কেড়ে নিয়ে লেবারদের ভাগিয়ে দিল। একটু পরেই জোনালের আধিকারিকেরা হাজির। কে করেছে? সিরিয়াস ম্যাটার। শোকজ করুন। হ্যান ত্যান । কিষণ লাঞ্চরুমে পড়ে থাকা একটা গাঁইতি উঠিয়ে আনল। পালাতে গিয়ে লেবারেরা ছেড়ে গিয়েছিল। বা হয়তো ভেবেছিল, ছোটো ঝঞ্ঝাট, কাল খতম হয়ে গেলে আবার তো আসতে হবেই।

ম্যানেজারের চেম্বারে যেখানে আধিকারিকেরা দাঁড়িয়ে ছিল, সেখানে গিয়ে গাঁইতিটা উঠিয়ে বলল, এই তো বেশ জায়গা এটিএম তৈরি করার! ম্যানেজারের এত বড় চেম্বারের দরকার কী? বলে ইচ্ছে করে একজন আধিকারিকের ঘাড়ের পাশ দিয়ে গাঁইতিটা দেয়ালে বসালো। সজোরে চালালেও বসালো আলতো করে, যাতে দেয়ালে দাগ না পড়ে। কিন্তু কাজ যা হবার হয়ে গেল সেদিন। বিকেলে জোনাল অফিস থেকে নতুন প্ল্যান অ্যাপ্রুভ হয়ে এসে গেলঃ লাঞ্চরুম না ছুঁয়ে তার দরজার বাইরে তৈরি হবে এটিএমের অ্যাান্টেরুম, আর সামনের দিকে একটা ঘর তুলে তাতে রাখা হবে মেশিন। খালি একটাই অনুরোধ, লাঞ্চরুমে ঢোকার রাস্তাটা বাইরে দিয়ে হবে।

ওকে, ওকে, এবমস্তু! জয় হো ডিজিএম সাহব কা!

সেদিন টিফিনের সময় সবাই ঢুকতে গিয়ে উপলব্ধি করল লাঞ্চরুমটা কী!

ওদিকে চাপরাশি রানী দেবী নিজের টিফিনটা খুলছেন। তপশীলী জাত। তাঁর মৃত স্বামী এই শাখাতেই সাফাইকর্মী ছিলেন। তাঁর পাশেই এসে বসে পড়লেন সাবিত্রী গুপ্তা। ইনি অনুকম্পায় এসেছেন। ক্যাশ-ক্লার্ক। বানিয়া, অর্থাৎ পশ্চাৎপদ। দেখ না দেখ, নতুন ট্রান্সফারে আসা আধিকারিক নীরা কুমারীও তাঁদের সঙ্গে যোগ দিলেন। আধিকারিকেরা পরে বসে, কিন্তু তখন একা টিফিন খেতে হবে; এখানে অন্ততঃ আরো দুজন নারী আছে।

ওদিকে দপ্তরী নীরজ রজক (জাতে ধোপা) আর বড়বাবু মেহরোত্রাজি তাঁদের টিফিন-ডিবে খুলছেন। পাশ দিয়ে ঢুকল কেরানি বিপিন পোদ্দার। ঠিক তার পরেই মাসুদ টিটকিরি দিতে দিতে ঢুকল, কি রে পোদ্দার, সেই রোজকার লাউ-ফাউয়ের তরকারি নিয়ে এসেছিস? সঙ্গে সঙ্গে পোদ্দারের জবাব, তুই কী আনিস রে শালা কুঁজড়া, নিজেকে নবাব খানদান বলিস? এই দ্যাখ্‌, সেই আলুসেদ্ধ বলে হাতের রুটির টুকরোটা আলুসেদ্ধয় ডোবালো। মাসুদও পোদ্দারের লাউ বা টিন্ডার বড় একটা অংশ সোজা নিজের টিফিনডিবেতে নিয়ে রাখল।

এল শ্রীবাস্তব, টেবিলেই উঠে পড়ে আসন করে বসে পড়ল, যাতে সবার ভাগ পেতে পারে। নিজে কিন্তু কিচ্ছু আনে নি, রোজকার মতই। জিওগ্রাফিতে গোল্ড মেডালিস্ট হলে কি হবে ফোড়ন কাটল পোদ্দার, জাতে লালাজি যে! এমনি ভাবেই এক এক করে সেদিনকার উপস্থিত প্রায় বারো-তের জন হাজির হল।

সব শেষে এলেন হেড ক্যাশিয়ার ঝাজি, ব্রাহ্মণ। হাত ধুলেন অনেকক্ষণ ধরে। তাঁর রোজকার বক্তব্য, নোট ছুঁলে ভালো করে হাত ধুয়ে নিও ভাই। নোটের চেয়ে নোংরা কিচ্ছু হয় না। শুধু ভেবে দেখো যে কোথায় কোথায় লোকে লুকিয়ে রাখে নোটের গাড্ডিগুলো। সে-যা কিছু বলুন, টিফিন-ডিবেটা তিনি কিন্তু আগেই খুলে এগিয়ে দেন টেবিলের ওপর, যাতে অন্যেরা খেতে পারে। তিনি এসে এর ওর তার টিফিন থেকে খাবলা তোলেন।

এমনটাই প্রায় রোজ হত। নারীদের দলটাও বাদ পড়ত না। তারা নিজেরা উঠে আসত না, কিন্তু এদিকের কেউ না কেউ, হয়তো কিষণ বা সঞ্জয়, ওদিক থেকে তরকারি তুলে নিয়ে আসত আর এদিককার ভালো যেগুলো তরকারি, বা আলুর, ছাতুর পরোটা একটু একটু করে ওদিকে দিয়ে আসত। সঞ্জয়ও আবার, টিফিন আনতো না। সদ্য বিয়ে হয়েছে। বৌ সেরকম তাড়াতাড়ি সব রান্না করে উঠতে পারে না। আর মা অসুস্থ। নীরা কুমারীকে দেখিয়ে মেকি দীর্ঘশ্বাস ফেলত, নীরাজির মত শ্বাশুড়ি তো আর পাই নি, যে নিজে সকালে উঠে পুত্রবধুর টিফিন গুছিয়ে দেবে!

তবে মাসে অন্ততঃ একদিন নিজের বৌকে দিয়ে লুচি আর মুরগির মাংস রান্না করাতো। বা হয়তো নিজেই আদ্ধেক কাজ এগিয়ে একটু দেরিতে আসত। আগের দিন সবাইকে বলে যেত, কেউ যেন টিফিন না আনে, দুপুর আড়াইটে নাগাদ তার ছোটো ভাই একটা বড় টিফিন-ক্যারিয়ার পৌঁছে দিত। আর আলাদা করে একটা পনিরের ঝোল, যারা মাংস খায় না তাদের জন্য। মাসুদ দুটোতেই ভাগ বসাতো। আধঘন্টার লাঞ্চ-আওয়ার। বড় জোর পনেরো মিনিট এখানে। তারপর তো বাইরে, মন্ডলজির চায়ের ঠেকে। তারপর সিগরেট, খৈনি বা পান। কিন্তু ঐ পনেরো মিনিট এক অদ্ভুত দৃশ্য তৈরি করত আমাদের লাঞ্চরুম।

সবচেয়ে মজার কথা, প্রতিদ্বন্দী সংগঠনে সাতজন অবশিষ্ট ছিল। তাদের মধ্যেকারও দুজন, রবীন্দ্র শর্মা আর ভোলা মিস্ত্রি  ঢুকে পড়েছিল এই দলে। ওদের একটা স্বার্থ ছিল। একজন বিল কালেক্টার। ক্লিয়ারিং থেকে এসে খিদে পেয়ে যেত। আরেকজন বসত ড্রাফট, বিলস আর হুন্ডির টেবিলে। লাঞ্চের পরেই বেশি চাপ থাকত কাজের। না, সংগঠন ছাড়ল না। এদিককার দলও ওদের সম্মান রাখতে, ওরা ঢুকলেই সাংগঠনিক কোনোরকম কথাবার্তা বন্ধ করে দিত। 

একদিন শিবেব্দ্র প্রসাদ, কেরানি থেকে সদ্য আধিকারিক হয়েছে, জল খেতে ঢুকে দুঃখ করে মিন মিন করেছিল মেহরোত্রাজির কানে, স্‌সালা, মিছিমিছি প্রমোশন নিয়ে নিলাম! কেউ শুনতে পায় নি। শুনল লম্বা ঢ্যাঙা বুড়ো মেহরোত্রাজির তীক্ষ্ণ গলা, তো নে না রে ডিমোশন, মিনমিনাচ্ছিস কেন! কেউ মানা করেছে? ম্যানেজারকে লিখে দে! বল তো, আমিই লিখিয়ে দিচ্ছি! পাছায় দম নেই আর এখানে মিনমিনাচ্ছে!  

১৮.৯.২৫

গোপালদার ইলেকশন ডিউটি

এদিকের রেললাইনগুলোও ইলেক্ট্রিক হয়ে গেছে। মোকামা-পাটনা লোকাল এখন ইএমইউ। তবে সওয়ারিদের মুখে এখনো ডিএম্মা, ডিজেল শব্দটা যায় নি। বাঢ়ে পঞ্চায়েত নির্বাচনের মতগণনায় পর্যবেক্ষকের কাজ সেরে ফিরছেন গোপালদা। ট্রেনের জানলার ধারে বসে হাওয়া খেতে খেতে তিনি বিগত কুড়ি বছরের নির্বাচনী কাজের অভিজ্ঞতা নিয়ে ভাবতে বসলেন। একাজটা তাঁর চাকরি থেকে একেবারেই আলাদা ছিল। চাকরি ছিল একঘেয়ে, ব্যাঙ্কের কেরানির। রোজ একই সময়ে বেরিয়ে একই জায়গায় সময় মত পৌঁছোনো। একই কাজ করা দশটা-পাঁচটা। আর পাঁচ-ছয় দিনের নির্বাচনী কাজগলো আসত ভয় আর রোমাঞ্চ নিয়ে।

সামনের সিটে বসা ধুতি-পাঞ্জাবি পরা এক বয়স্ক ভদ্রলোক অনেকক্ষণ ধরে মনে হয় আলাপ করার জন্য উসখুস করছিলেন। হয়তো করেই নিতেন। পাশের ছেলেটি তখন থেকে চেষ্টা করছিল একটা কলম দিয়ে ওপরের ফ্যানটা চালাতে। কিছুতেই চলল না। শেষে রাগ করে নিজের হাতের কাগজের রোলটা দিয়ে যেই সজোরে আঘাত করল, ফ্যানটার একগাদা ঝুল-ময়লা এসে পড়ল সেই ভদ্রলোকের মাথায়, চোখে আর নাকেমুখে। লোকাল ট্রেনে টয়লেটও নেই, জলের বেসিনও নেই। ভদ্রলোক রাগে ছেলেটিকে বকুনি দিতে দিতে নিজের গা থেকে সেই ময়লা পরিষ্কার করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। গোপালদার ব্যাগে জলের বোতল উঁকি দিচ্ছিল। ভদ্রলোক বললেন, দাদা, এক অঁজুরি পানি দিজিয়েগা? হাতটা একটু ধুতাম। হাঁ, হাঁ, লিজিয়ে না বলে গোপালদা জলের বোতলটা এগিয়ে দিলেন।

-       দুটো হাতই যে নোংরা। আপনি একটু ঢেলে দিন। ব্যাস, ব্যাস। আপনি এদিকেই কোথাও পোস্টেড?

-       না, না, ইলেকশন ডিউটি ছিল।

-       এখন? কিসের?

-       পঞ্চায়েত নির্বাচন। কাউন্টিংএ অবজার্ভারে দিয়েছিল, বাঢ়ে।

-       ও। আর, মানে, করেন কী?

-       ব্যাঙ্কে আছি, পাটনায়।

-       মনেই হচ্ছিল। আমি শিক্ষক ছিলাম, লখিসরাইয়ে। ওখানেই থাকি। এখন পাটনায় মেয়ের কাছে যাচ্ছি। তা, কেমন লাগে, ইলেকশনের কাজ?

-       ভালোই। আপনারা গেলেন না বলে তো আমাদের যাওয়া শুরু হল।

-       মানে? ও হো হো সে কুড়ি বছর আগেকার কথা। ঐ একবার। সে যেতে আপনাদের হতই। আবাদি বাড়ছে, পোলিং বুথ বাড়ছে কেন? ভয় পেতেন?

-       কখনো কখনো পেয়েছি, প্রথম প্রথম

গোপালবাবু আবার স্মৃতিচারণে মগ্ন হলেন। প্রশিক্ষণে পৌঁছোও হাজার মানুষের মাঝে ভিড় ঠেলে। তারপর জিনিষপত্রের প্রাপ্তিস্বীকার করে, ট্রেনে, বাসে, ট্রাকে, ট্র্যাক্টরে পৌঁছোও কোনো অজানা গ্রামের বা শহরের বুথে। নতুন মানুষজনের সঙ্গে আলাপ। একদিনের আলাপ অথচ, ভালোয়-ভালোয়-কাজটা-মিটে-যাক সে চিন্তায় এমন একাত্ম যেন পরিবার! আলাদা কিছু অভিজ্ঞতার শৃঙ্খলা হয়ে তাঁর স্মৃতিতে রয়ে গেছে দিনগুলো। তার ওপর, এতগুলো নির্বাচনের কাজে গেলেন! লোকের চাকরিতে উন্নতি হয়, অথচ একাজে তাঁর ক্রমাগত পদাবনতি ঘটল! প্রেজাইডিং থেকে শুরু করে নিচে নামতে নামতে কুড়ি বছরে পোলিং-ওয়ান, পোলিং-টু, পোলিং-থ্রি, ফটোগ্রাফার, রিজার্ভ, অবজার্ভার !

আজ, এতদিন পর, যখন আর কোনো নির্বাচনে কাজের ডাক পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই, কিছুদিন পর চাকরি থেকে অবসরগ্রহণ করবেন, তখন মনে হচ্ছেঃ পদমর্যাদা আর পারিশ্রমিক বিভিন্ন কারণে কম হতে থাকলেও, সেগুলো কি সত্যিই পদাবনতি ছিল? অসম্মান ছিল? অথচ কখনো প্রাণসংশয় তো হয় নি, শুধু ঐ মোকামা থেকে ফেরার সময় চলতি ট্রাকে লাফিয়ে চড়ার সময়টুকু ছাড়া। বস্তুতঃ তাঁর ভার তো লাঘবই হয়েছে ক্রমাগত! একটু একটু করে কম দায়িত্বের কাজে গেছেন! কোথাও কোনো মারদাঙ্গা, ঝঞ্ঝাট, কিচ্ছু ফেস করতে হয় নি তাঁকে গত কুড়ি বছরে! বরং সব রকমের কাজের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করার সুযোগ পেয়েছেন।

ঈশ্বর কি এভাবেই বলেন না, যে তিনি আছেন?একেই কি ঈশ্বরের আশীর্বাদ বলে না? রোজকার যে কথাটা তিনি সচরাচর অন্যের মুখে শুনে এসেছেন যাক বাবা, ভালো হল, মানপ্রাণ নিয়ে ফিরে আসতে পেরেছ, ঈশ্বরের অশেষ আশীর্বাদ! সে-কথাটাই আজ তাঁর নিজের মাথায় ভর করেছে। সত্যিই কি এটাই প্রমাণ যে ঈশ্বর আছেন? ঈশ্বর এমনকি তাঁর বাড়তে থাকা বয়সের কথা খেয়াল রেখে ধীরে ধীরে কম দায়িত্বের কাজের দিকে সরিয়ে নিয়ে গেছেন? নির্বাচনের কাজ করতে যাওয়ার দিনগুলো একেবারে ছবির মত মনে আছে গোপালদার।

প্রথমবার যে গিয়েছিলেন, যাওয়ার কোনো প্রয়োজনও ছিল না। ইউনিয়নের নেতা রামেশ্বরজি বলেও ছিলেন, কোনো চিন্তা নেই গোপালবাবু। চলুন আমার সঙ্গে কালেক্টারিয়েটে। একটা আবেদন দেবেন, আমি লিখিয়ে দেব। নাম কেটে যাবে। ঐ তো, ভটচাযদারও কাটিয়ে দিয়েছি। অনেকেই সত্যিই নাম কাটিয়ে নিচ্ছিল দিব্যি, কোনো না কোনো পারিবারিক কারণ দেখিয়ে, আর একটু তদ্বির করে। কিন্তু দুটো কাজই গোপালদার জন্য অসহ্য। ধরাধরি, তদ্বির এসব করতে তো তাঁর গা জ্বলেই, পরিবারের কারোর বা নিজের অবস্থা নিয়ে মিথ্যে বলতেও তিনি পারেন না। ভয় যে হয় নি, তা হয়। মাঝে মধ্যেই কোনো না কোনো হাঙ্গামায়, এমনকি বুথে পৌঁছোবার পথে দুর্ঘটনায় কোনো না কোনো নির্বাচনকর্মীর মৃত্যুর খবর তো হামেশাই পড়তে হত খবরের কাগজে। দেখা যাবে। এত ভয় পেলে তো রাস্তায় দুপা চলা কঠিন হয়ে যাবে! বরং নতুন অভিজ্ঞতাটাই সঞ্চয় করা যাক! কিছু তেমন হলে পরিবার তো ক্ষতিপূরণ পাবেই!

অফিসের ম্যানেজারের কাছ থেকে চিঠি নিলেন। প্রেজাইডিং অফিসার। তিনি এবং অফিসের সঙ্গী গুপ্তাবাবু দুজনেই। দুজনেরই বুথের ঠিকানা খগৌল, কোনো একটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এলফিনস্টোন সিনেমা হলটাই প্রশিক্ষণ সভাগার। কত সিনেমা দেখেছেন এই হলে! পাটনার একমাত্র এই হলটাতেই দোতলা নেই। ব্যালকনি, ড্রেস-সার্কেল সব নিচে। পিছন দিকে। যাওয়া শুরু করলেন। কদিন প্রশিক্ষণ সেরে, ক্যাম্প দপ্তরে গিয়ে সেই বড়ো বড়ো চটের বস্তায় বাঁধা ব্যালট বাক্সো, মার্কিনের থানে বাঁধা একগাদা কাগজপত্র, নানা রকমের প্রোফর্মা, কোথাও-পাওয়া-যায়-না এমন দেশলাই, মোমবাতি, ব্লেড, সিলমোহর লাগানোর গালা আরো কত কি সব দেখে দেখে মিলিয়ে প্রাপ্তিস্বীকার করে নিলেন। অতদূরে এতো সব নিয়ে যাবেন কী করে? ভাগ্যিস দানাপুরের তাকিয়াপর মোহল্লায় গুপ্তাবাবুর আত্মীয় থাকতেন, তাঁদের বাড়িতেই সেদিন বিকেলে রেখে দিয়ে এলেন সবকিছু।

পরের দিন সন্ধ্যায় বাড়ি থেকে রাতের খাবার বেঁধে গুপ্তাবাবুর স্কুটারে পৌঁছোলেন তাকিয়াপর। স্কুটার সেখানেই রেখে দিলেন গুপ্তাবাবু। দুজনেরই বুথের ঠিকানায় একই স্কুলের নাম তাই সব মালপত্র রিক্সায় তুলে খগৌল রোড ধরে গেলেন দানাপুর। কোথায় স্কুল? একে-ওকে-তাকে জিজ্ঞেস করে শেষে এক নির্জন মাঠের সামনে দাঁড়ালেন। পাঁচিল, গেট সব হারিয়ে মাঝখানে ভুতের মত দাঁড়িয়ে আছে একটা বিধ্বস্ত একতলা ব্যারাক। সেটাই নাকি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। সাতটা ঘরের মধ্যে মাত্র তিনটেতেই ছাত আছে, আদ্ধেক নোনা ধরা ইঁট আর আদ্ধেক বট-অশ্বত্থের শিকড় দিয়ে গাঁথা। সেই তিনটে ঘরেই তিনটে বুথ। একটার রাজা গোপালদা, আরেকটার রাজা গুপ্তাবাবু। কোনো ঘরে বসার বেঞ্চি বা ডেস্ক কিছুই নেই। আমরা বসব কোথায়? ভোট হবে কোথায়? তৃতীয়টার রাজা তখনো আসেন নি। এলেন একটু পরে। তিনিই বললেন, ভাববেন না। সব হয়ে যাবে কাল। আরে কাজটা তো আমার-আপনার বাড়ির কাজ না, প্রশাসনের কাজ। সব হয়ে যাবে। দেখবেন!

-       বাকি নির্বাচন কর্মীরা?

সদর দপ্তরে জিনিষপত্র দেওয়ার সময় কর্মচারিটিও এরই মত বলেছিল, চিন্তার কিছু নেই। আপনি রিলিভিং না দিলে কেউ ছাড়ান পাবে না, টাকাও পাবে না। কাজেই সব কজন আসবে আগেপিছে।

সেদিন রাতে অবশ্য কেউই এল না। গোপালদা আর গুপ্তাবাবু যেমন করে শেখানো হয়েছে তেমন করে ব্যালট বাক্সোগুলো তৈরি করলেন, পিচবোর্ড থাকতেও ভোট দেওয়ার এনক্লোজার তৈরি হল না কেন না টেবিল-চেয়ার কিছুই নেই। বাকি সব জিনিষপত্র মোমবাতির আলোয় ঘরের ভাঙাচোরা তাকগুলোয় সাজিয়ে রাখলেন। প্রোফর্মাগুলো ওরাই বলেছিল রাতে ভরে রাখবেন বুথসংখ্যা, নাম এই সব। শুধু চুনাও-সম্বন্ধি ব্যোরা পরের দিন বিকেল থেকে ভরতে শুরু করবেন। তাই করলেন দুজনে, যেটা যেই খামে যাবে, সেইখামে ভরে রাখলেন। এক ঘরেই রইল দুই বুথের জিনিষ। সকালে গুপ্তাবাবু তাঁর জিনিষপত্র নিয়ে পাশের ঘরে, মানে পাশের বুথে চলে যাবেন। বাড়ি থেকে আনা খাবার ভাগ করে খেয়ে, মেঝেতে চাদর বিছিয়ে, সিগরেটে সুখটান দিতে দিতে ভাঙা দরজার বাইরে দুজনে তারাভরা আকাশ আর পেট্রলপাম্পের আলো দেখলেন কিছুক্ষণ। তারপর ঘুমিয়ে পড়লেন।

পরের দিন ভোরবেলা থেকেই সাজসাজ রব। পোলিং ওয়ান, টু, থ্রি সবাই এসে গেল, ফোর্স এসে গেল তাই তিনটে বুথের জন্য কিছু চেয়ার আর সতরঞ্চি জোগাড় হয়ে গেল। দুতিনটে পার্টির পোলিং এজেন্টরাও চলে এল। একটা চেয়ারে পিচবোর্ডের এনক্লোজার তৈরি করে ব্যালট বাক্সো রাখা হল। পায়খানাই নেই কাজেই পায়খানা শুধু যাওয়ার নয় পাওয়ারও উপায় নেই। রাস্তার কলে মুখ ধোয়া হল। কাছের দোকান থেকে পুড়ি-সব্জি-জিলেবি পোলিং থ্রিই নিয়ে এল। গোপালদা দেখলেন একমাত্র তিনি আর গুপ্তাবাবুই নতুন। কেননা ব্যাঙ্কের কর্মচারিদেরকে আগে কখনো নির্বাচনের কাজে নেওয়া হয় নি। বাকি সবাই অভিজ্ঞ, পোড়-খাওয়া আর পোলিং টু, থ্রি তো তাঁকে মাথায় তুলে রেখেছে। তৃতীয় বুথের প্রেসাইডিং ভদ্রলোক কানে কানে বলে গেলেন, সব কাজ শেষ হওয়ার আগে রিলিভিং কিছুতেই দেবেন না, যতো তোয়াজ ঐ রিলিভিংটা নিতে হবে বলে।

সারাদিন নির্ঝঞ্ঝাট হল পোলিং, বোধহয় সাতচল্লিশ প্রতিশত। সন্ধ্যে নামতে না নামতে বাক্সো-টাক্সো সিল করে নিলেন। গুপ্তাবাবুও রেডি। কাগজপত্র, প্রোফর্মাগুলো সব যেটা-যেমন ভরে নামছাপা খামে রেখে বস্তাবন্দী করা হল। একটা খাম শুধু হাতে। ভ্যান নিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট এল। বাক্সো রিসিভ করে নিয়ে চলে গেল। তিনি আর গুপ্তাবাবু গেলেন আগে খগৌল। তারপর গুপ্তাবাবুর স্কুটারে এএনকলেজ। রাত দুটোয় লাইনে প্রেজাইডিংএর রিপোর্ট আর বস্তা রিসিভ করিয়ে ছুটি। তাঁর মত আরো হাজার মানুষ তখন রাস্তায় বেরুচ্ছে। তাই অটো পেতেও অসুবিধে হল না।

সবকিছু তো নির্বিঘ্নেই হয়েছিল। পোলিং পার্সেন্টেজ কম ছিল বলে তো আর তিনি দায়ী নন। তবু, কয়েক বছর পর যখন আবার একটা নির্বাচন এল, গোপালদা চিঠি পেলেন, দেখে থতমত খেলেন প্রেজাইডিং থেকে পোলিং ওয়ান হয়ে গেলাম কেন? তবুও বিশেষ কিছু ভাবলেন না। প্রশিক্ষণে শুনেছিলেন প্রেজাইডিং আর পোলিং ওয়ানের প্রায় সমান মর্যাদা। গতবার শিক্ষকেরা হড়তালে ছিল, এবারে নেই। ওরা একাজে অভিজ্ঞ, তাই হয়তো ওদেরকে প্রেজাইডিং দিয়ে আমাদেরকে পোলিং ওয়ান দিয়েছে! তবে এবার জায়গাটা ফার্স্ট ক্লাস। একেবারে বাড়ির কাছে, রেললাইন পেরিয়ে দুই কিলোমিটারের মধ্যে। বালিকা বিদ্যালয়, কঙ্কড়বাগ। জিনিষপত্রও কিছু বওয়ার নেই, সেটা প্রেজাইডিংএর কাজ। সন্ধ্যারাতে গিয়ে দেখলেন ইলেক্ট্রিকের আলো, পরিচ্ছন্ন ঘর, পায়খানা, রাত থেকেই ফোর্স, প্রেজাইডিং আছেনই, বরং একটু বিস্মিত, পোলিং ওয়ান রাতে কেন আর কী চাই। একেবারে রাজধানী শহরের বুকে টেনশনের কোনো আশঙ্কাই নেই। বস্তা জমা দেওয়ারও ঝঞ্ঝাট নেই, সেসব প্রেজাইডিংএর। শুধু হাতে পাওয়া ভোটার তালিকায় নাম মিলিয়ে মিলিয়ে দাগিয়ে যাওয়া। সন্ধ্যে হতে না হতে ছুটি। হাতে গরম সিঙাড়া নিয়ে বাড়ি।

তা, কতোবার গিয়েছেন আজ অব্দি …” ট্রেনের সহযাত্রীটি জিজ্ঞেস করলেন। গোপালবাবু হেসে উঠে বললেন, এই নিয়ে আটবার।

-       কখনো কোথাও ঝামেলায় পড়তে হয় নি তো?

-       না।

-       যাক। শেষ বিচারে সবচেয়ে শান্তির কথা তো সেটাই। বাড়িতে পরিবার রেখে কোথায় কোথায় ছোটা

-       কোথাও অন্ততঃ আমাদের টিমের সঙ্গে তো কোনো ঝামেলা হয়নি, তবে টেনশন থাকতই। বলতে পারেন ঈশ্বরের আশীর্বাদ! প্রতিবার কাজ সেরে অক্ষত অবস্থায় বাড়ি ফিরতে পেরেছি। সেটাই ভাবছিলাম। একবার, মানে, আমার অভিজ্ঞতায় তৃতীয়বার নির্বাচনী কাজ পেলাম মোকামায়। মাফিয়া ডনদের রণক্ষেত্রে। আর মজা দেখুন, প্রথমবারে ছিলাম প্রেজাইডিং, তারপরের বার পোলিং ওয়ান, সেবার আরো ডিমোশন হল, পেলাম পোলিং টু। সেবারে ব্যাংকের অফিসারদেরও প্রচুর সংখ্যায় বহাল করেছিল, তাই। ফলে পারিশ্রমিকও কমেই গেল। আর তারপর টেনশন !

-       খাস মোকামায়?

-       নাঃ, মোর, মোর ইংলিস। আগের দিন বিকেলে ট্রেনে করে মোকামা গিয়ে দেখলাম সব মিলিয়ে গোটা তিরিশজন ঐ ট্রেনে করে পৌঁছেছে। সবার মুখ চিন্তিত। আর পড়বি তো পড়, স্টেশন থেকে বেরুতেই সেই মাফিয়া ডন আর তার দলবলের সামনে। হয়তো ইচ্ছে করেই সে-দেবতা দেখা দিলেন। দুহাত তুলে সবাইকে নমস্কার জানালেন, আইয়ে, আপ হমারে অতিথি হ্যাঁয়! মোকামা মেঁ আপকা স্বাগত হ্যয়। বাকিটুকু তাঁর দলবলের ষন্ডাগুলোর মুখের আর শরীরের হাবভাব বলছিল। বাধ্য হয়ে সবাইকেই হাত তুলে প্রতিনমস্কার জানাতে হল।

-       কে ছিলেন?

-       নাম বাদ দিন! (একবার আড়চোখে ট্রেনের লোকজনকে দেখে নিলেন)

-       আরে দলন সিংই হবে!

-       ছাড়ুন। কথায় কথায় শুনলাম আরেক ডন নাকি জেলে। সেখান থেকেই কলকাঠি নাড়ছে। যে বাইরে, আগে থেকে প্রতিষ্ঠিত, সে সবর্ণ। আর যে জেলে, সে দলিত।

-       ওঃ হো, বুঝে গেছি।

-       জোর টক্কর। আমরা ভাবলাম, কোথাও কিছু বলবনা। যেখানে যার দল ভারি, তারা যা করার করবে। সবাই চেষ্টা করব যেন ভোট শান্তিপূর্ণ হয়।

 

-       স্টেশন থেকে রিক্সা করে রওনা দিলাম মোর-ইংলিসের দিকে।

-       সেটা তো আবার ওরই এলাকা, যে জেলে ছিল, দলিতদের বসতি।

-       হ্যাঁ, সেই ডনের তরফ থেকেই রাতে পুরি-তরকারি যাক সেসব ছাড়ুন (গোপালদার মনে পড়ে গেল ভোর রাতে রাস্তার কলে বোতলে জল ভরে বাঁশবনের পাশ দিয়ে নদীর বুকে ছোটা শুকনো খাতের উঁচুনিচু বালি, হাগতে বসে উল্টে পড়েন আর কি জল কম পড়ায় গামছা প্রায় তুলেই আবার দৌড়ে কলের কাছে আসা, পাশ দিয়ে অন্ধকারে অন্যান্য নারী-পুরুষেরা যাচ্ছে, জল ভরে বাঁশবনে ঢুকে ছুচোনো ) ফেরার সময় ম্যাজিস্ট্রেটের ট্রাকেই পিছনে ফোর্সের সঙ্গে চড়েছিলাম সবাই। পরের বুথ থেকে বাক্স নেওয়ার ছিল। আমি বলে নামলাম যে একটু পেচ্ছাপ করে আসছি। সালা, ট্রাক ছেড়ে দিল!  

-       ওই অবস্থায়, বুঝুন। ট্রাক ছেড়ে যাওয়া মানে আবার মোকামায় গিয়ে ট্রেন ধরা। মোর ইংলিশ হল্ট স্টেশন, রাতে কখন লোকাল পাবো! প্যান্টের চেন টানতে টানতে দৌড়োলাম। চিৎকার করছি, চিৎকার করছি। কে জানে কেউ শুনল কিনা। তবে, গিয়ার বদলাতে গেলে স্পিডটা তো একটু কমে! খপ করে পিছনের ডালার শিকলটা ধরে ফেললাম। আরেক হাতে ডালা ধরে এক লাফে বাফারে পা ঠেকিয়ে ট্রাকে উঠে পড়লাম। ভিতরে সবাই নির্বিকার! যত বলছি, একটু দাঁড়ালেন না? আমি তো বলে নেমেছিলাম! কার কী দায় পড়েছে। ভেবে দেখুন, ওই এক লাফে যদি শিকল বা ডালাটা না ধরতে পারতাম, মুখ থুবড়ে পড়তাম রাস্তায়! একটা আলো নেই, মানুষজন নেই!

-       এমনই হয় ডিউটিগুলো। আমিও তো করেছি। যাক, কিছু হয় নি, বেঁচে গেছেন। তবে অত রিস্ক না নিয়ে সোজা স্টেশনে চলে যেতেন। দেরি হত। তবে, রাতে প্যাসেঞ্জার বা লোকাল তো থাকেই।

গোপালদা স্মৃতিচারণে ডুবে গেলেন অথচ এত ঝক্কি পুহিয়েও পরের বার পেলেন পোলিং থ্রি। কেননা তত দিনে তাঁর নিজেরই ট্রান্সফার হয়ে গিয়েছিল একটা দূরের ব্রাঞ্চে, আধ-শহরি এলাকায়। কত রকমের ভেদাভেদ কাজ করে প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। কেউ কাউকে চেনেও না, অথচ লিস্টে যেহেতু বড় অফিসের কর্মচারিদের নাম আগে, তারা ভালো জায়গা পেয়ে যায়। ছোটো অফিসের লোকেরা পড়ে থাকাগুলো পায়। কোথায় পেলেন এবার? পাটনা জেলা আর নালন্দা জেলার মাঝামাঝি সীমান্তবর্তী একটা গ্রামে। রিপোর্টিং ফতুহা ব্লকে। ইতিমধ্যে ব্যালট বাক্সো বিদায় হয়েছে। ইভিএম এসে গেছে। ফতুহা ব্লক অফিস থেকে পোলিং পার্টির যাওয়ার জন্য বরাদ্দ ট্র্যাক্টর-ট্রেলার। পাটনা-গয়া রোড ধরে গৌরিচক অব্দি গিয়ে বাঁদিকের একটা মাটির রাস্তায়। কিছুক্ষণ পর সে-রাস্তা থেকেও নেমে বাঁপাশের ক্ষেতে। শুকনো ফসল-তোলা ক্ষেত। খুঁটগুলো ট্র্যাক্টরের বিরাট চাকায় মাটিতে মিশে গিয়েও আবার দাঁড়িয়ে পড়ছে। সামনে দেখলেন একটা গ্রাম। কিন্তু না। তার বাঁদিক দিয়ে ক্ষেতে ক্ষেতে ঘুরে পিছনে আরেকটা গ্রাম। সেখানে থামল ট্র্যাক্টর।

পুরো পোলিং পার্টিই ছিল। আলাদা করে আর কে আসবে এতদূরে। একটা গলি ধরে হেঁটে গ্রামের এক মাথা থেকে অন্য মাথায় যাওয়ার সময় ডানদিকে একটা খোলা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল সবাই। চেয়ার পাতা ছিল। সবাই বসে পড়ল। ট্রে-তে করে বাড়ির ভিতর থেকে আনা চায়ের কাপ হাতে হাতে ধরিয়ে দেওয়া হল। সামনে উপবিষ্ট কর্তাব্যক্তিগোছের একজন কেউ গলা খাঁকারি দিয়ে বেশ স্পষ্ট ভাষায় কথা বলতে শুরু করলেন, দেখুন, আগে থেকে কিছু কথা জেনে রাখলে আপনাদের জন্য ভালো হবে। আপনারা শহর থেকে এসেছেন, শান্তিপূর্ণ ভাবে ভোটের কাজ সম্পন্ন করাবেন, তারপর নির্বিঘ্নে ফিরে যাবেন। এটা রাজপুতদের গ্রাম। দুহাজার ভোট আছে এখানে। পাশেই মুখ্যমন্ত্রীর জেলা। সেখানকার রাজপুতরা মুখ্যমন্ত্রীর দলকে ভোট দেবে। এমনিতেও সবর্ণ ভোট সারা বিহারে তাঁর পক্ষে আপনারা জানেন। কিন্তু এই গ্রামের রাজপুতরা একজনও তাঁর দলকে ভোট দেবে না। কেননা কিছু নালিশ আছে। পাশের সব গ্রামে বিদ্যুৎ এসে গেছে। এখানে, হাজার বার বলা সত্বেও আসে নি। এক তরফা ভোট হবে। কিছু নকশাল আছে, হামলা করতে পারে। আপনারা নিশ্চিন্ত থাকবেন। আমরাই সেটা সামলে নেব। ফোর্সের লোকদেরও বলছি, আপনারাও শান্ত থাকবেন। নিন, চা খান।  

রাতে, ক্যাম্পে প্রেজাইডিং গ্রাম থেকে পাঠানো খাবার খেলেন না। বাকি সবাই খেল। গোপালদাও খেলেন। পরের দিন দুপুরের পরেই পোলিং থ্রি-য়ে বসে গোপালদা টের পেয়ে গেলেন বুথ নিঃশব্দে কব্জা হয়ে গেছে। বোগাস চলছে, রিপিট, রিপিট। দরজা বন্ধও করতে হয় নি। দূরে একটা বোমা ফাটল। খুব বোকার মত মনে হল গোপালদার। আরে, বুথ কব্জা রুখতে হলে তো এখানে এসে হাঙ্গামা করতে হবে। অত দূরে বোমা ফাটালে কে ভয় পাবে। সন্ধ্যায় সবাইকে নিয়ে ট্রেলার-ট্র্যাক্টর বেরুল ফতুহা পৌঁছোতে। গোপালদা এবং আরো একজন নেমে পড়লেন বড়ি পহাড়ির মোড়টায়। সেখান থেকে হেঁটে জিরো মাইল। তারপর অটো ধরে বাড়ি।

তার পরপরই এসে গেল পার্লামেন্টারি। আর ডিউটি পেলেন ঠিক উল্টো দিকে। মানে ঐ পাটনা-গয়া রোডেই ডানদিকে একটা গ্রামে। কিন্তু আবার পদাবনতি। একেবারে বুথকর্মীদলের বাইরের লোক ফটোগ্রাফার। নতুন পদ। সদ্য ডিজিট্যাল ক্যামেরা এসেছে। মালপত্র বলতে সেটাই পেলেন বাঁকিপুর গার্লস স্কুলের ট্রেনিং সেন্টারে। এখন যাবেন কী করে? পোলিং পার্টি তো অন্য জায়গা থেকে বেরিয়ে গেছে। কিভাবে কথা এগোলো মনে নেই। মসৌঢ়ির সার্কেল অফিসারের সঙ্গে, সার্কেল? না অন্য কেউ! ছিপছিপে স্মার্ট যুবক।  বলল, বাড়ি থেকে তৈরি হয়ে সন্ধ্যে সাতটায় আসতে। এসে দেখলেন ছেলেটি তৈরি। একটা খোলা মারুতি ভ্যানে বসালো। নিজে বসল ড্রাইভ করতে। গোপালদা ভিতরের জানলাটা দিয়ে পিছনে উঁকি মেরে দেখলেন খোলা অংশটায় স্তূপাকার ইভিএম রাখা আছে। এগুলো অতিরিক্ত। কোথাও কোনোটা অকেজো হলে বদলে দিতে লাগবে।

ছেলেটি বলল, বাড়ি হয়ে যাব স্যার। বাড়ির খাবারটা খেয়েই রওনা দিই। কালকের দিনটা তো বাইরেই কাটাতে হবে।

-       হ্যাঁ, নিশ্চয়ই, খেয়েই তো বেরোবেন।

-       আপনি খেয়ে এসেছেন তো?

ঘাড় নাড়লেন গোপালদা।

ছেলেটির বাড়ি পুনাইচকে, ফ্ল্যাটে। ছেলেটি তাঁকে নিয়ে নিজের ফ্ল্যাটে ঢুকল। ভেতরেই বসতে বলল, কিন্তু সিগরেট খাওয়ার অছিলায় ছেলেটির স্ত্রীকে নমস্কার করে তিনি বাইরে চলে গেলেন। ছেলেটি ভিতরের কামরায় খাচ্ছিল আর গোপালদা বাইরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগরেট খেতে খেতে বার বার স্তূপাকার ইভিএমগুলোকে দেখছিলেন। একটাও চুরি গেলে তাঁর দায় নয় অবশ্য। তবু। ছেলেটা কী বেপরোয়া!

রাত দশটায় পৌঁছোলেন মসৌঢ়ি ব্লক অফিস। বিডিও, অন্যান্য আধিকারিক এবং কর্মচারিরা ইতস্ততঃ কাজ সামলাচ্ছে। এঘর, ওঘর, বাইরের তাঁবু ভরে সব পোলিং পার্টিরা ঘুমিয়ে আছে।

-       এখানেই কোথাও জায়গা করে ঘুমিয়ে নিন। সকালে আপনাকে বুথে পৌঁছে দেব।

তাই রইলেন গোপালদা। সতরঞ্চিতে একটা ফাঁক খুঁজে মাথার নিচে ব্যাগ রেখে ঘুমিয়ে পড়লেন। পরের দিন সকালে ভিতরের সরু সরু মাটির রাস্তাগুলো দিয়ে পিছনের ইভিএমগুলোকে নাচাতে নাচাতে, ঠিক তাঁকে পৌঁছে দিল ছেলেটা। পাটনা-গয়া রোডে উঠে যাওয়া একটা রাস্তায় বট গাছের নিচে মারুতি ভ্যানটা দাঁড় করিয়ে আঙুল দেখিয়ে বলল, ঐ যে আপনার বুথ স্যার! হেঁটে চলে যান।  

-       আপনি?

-       আমার ডিউটি অন্য ক্লাস্টারে। বিকেলে ফিরতে পারবেন তো?

-       হ্যাঁ, হ্যাঁ, অনেক ধন্যবাদ।

এ এক ঝামেলার কাজ। পুরোনো ডিজিট্যালে এক্সপোজার টাইমও একটু লম্বা ছিল। ঘোমটা একটু পিছনে করুন, মুখের পর্দাটা একটু সরান আরেকবার, ছবিটা হয় নি ভয়ও করে, কেউ খেঁকিয়ে না দেয়। যাহোক, নির্বিঘ্নে কাজটা হয়ে গেল। পোলিং শেষ হলে হাঁটতে হাঁটতে উঠলেন পাটনা-গয়া রোডে। কিছু না কিছু তো পাবোই। বাসগুলো বেরিয়ে যাচ্ছিল একের পর এক। বড় ম্যাক্সিগুলোও বেরিয়ে যাচ্ছিল। অনেকক্ষণ পরে একটা ছোটো লোক্যাল টাটা মিনি পেলেন। নামিয়ে দিল বাইপাসে জিরো মাইলে।

কয়েক বছরেই আবার নির্বাচনী কাজ। মনেও নেই, পার্লামেন্ট না এসেম্বলি। বাই-ইলেকশন না রেগুলার? ঠিক ডিমোশন হল না। ঝুলিয়ে রেখে দিল। ওয়েটিং। পোলিং ওয়ান, টু, প্রেজাইডিং যা দরকার করা হবে যদি কেউ অসুস্থ হয়। তবে যাই হোক হেঁটে পৌঁছোনোর অভিজ্ঞতা হল । হরনৌত থেকে বেলছি পৌঁছে দিল বাইক-অটো বা বাইক-ঠেলা, বেলছি থেকে সকসোহরা হেঁটে। সেই বেলছি, যেখানে দলিত নর-সংহারের খবর হেডলাইন হয়েছিল! ইন্দিরা গান্ধী হাতির পিঠে পৌঁছেছিলেন, রাস্তা ছিল না বলে। সকসোহরা ব্লক অফিসে সারারাত সারাদিন বসে তারা গোনো, খাও, ঘুমোও, হাগো, মাঠে বসে থাকো অপেক্ষায়, বাড়ি থেকে খবরের কাগজ নিয়ে এসে থাকলে চোখ দিয়ে চিবোও। সত্যিই তাই করল সবাই পুরো রাত আর পরের দিন। তিনিও তাই করলেন। লাভের মধ্যে চশমাটা হারালেন। যদি ডিউটি করতে হয়, সেই ভেবে গ্রামের রাস্তা থেকে একটা চশমা কিনলেন। সে কি চশমা। ফ্রেমে দুটো কনভেক্স লেন্স বসানো। পাঁচ সেকেন্ড পরে থাকলেই মাথা ঘুরতে শুরু করে। ছোটে সরকার, অনন্ত সিংজির এলাকা। তাঁরই কল্যাণে তৈরি নতুন রাস্তায় সন্ধ্যের লোকাল মিনিবাস ধরে বাঢ় স্টেশনে পৌঁছোলেন। লোকাল ট্রেন ধরে বাড়ি।

সেবারই শহরে পরিচিত অনেক বাঙালি কর্মচারিকে পশ্চিমবঙ্গে ডিউটি দেওয়া হয়েছিল। ভালো আসা-যাওয়ার ব্যবস্থা, খাওয়া-থাকা, নির্ঝঞ্ঝাট বুথ, পারিশ্রমিক পরিচিতরা এসে গল্প করছিল। তাঁর ডাক পড়ল না কেন? ওই যে, শহরের বাইরে পোস্টিং! বরং ডাক পড়ল এখন, যখন তাঁর অবসর নিতে আর কমাস বাকি। তাও কোথায়? শেষ নির্বাচনী কাজ পেলেন, পঞ্চায়েত নির্বাচনের মতগণনায় পর্যবেক্ষক। আবার বাঢ়, তবে যাহোক, শহরেই। কোনো কিছু নেওয়ার ছিল না সরকারের কাছ থেকে। ব্যাগ গুছিয়ে বাঢ়ে নেমে একটা হোটেলে কামরা নিলেন। সন্ধ্যে বেলা বাজারে সিগরেট আর চিপ্স কিনতে গিয়ে অনুভব করলেন থার্মাল প্ল্যান্টটা হওয়ার পর বাঢ়ের জনবিন্যাস পাল্টে গেছে। অনেক নতুন ধরণের মানুষ, শিক্ষিত দক্ষিণী, উড়িয়া, বাঙালি এসে ঢুকে পড়ায় বাঢ়ের স্থানীয় মানুষেরাও আর আগের মত নেই। পরের দিন বড় রাস্তায় ডানদিকে মতগণনা কেন্দ্রে গিয়ে রিপোর্ট করলেন। যেখানে বসতে বলা হল, বসলেন। গণনায় কোনো চ্যালেঞ্জ-ফ্যালেঞ্জ হল না। সন্ধ্যায় ট্রেনে করে এখন দিব্যি বাড়ি ফিরছেন।

ট্রেনটা গুলজারবাগের পর দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। অনেকটা সময় সবাই ট্রেনে বসে এবার নামতে শুরু করেছিল। গোপালদাকে সিট ছেড়ে দাঁড়াতে দেখে সহযাত্রী উদগ্রীব হলেন।

-       উঠছেন যে? এখানে কোথায় নামবেন?

-       ট্রেন তো নড়ছে না। বসে থেকে কী হবে। দুপা হাঁটলেই আগমকুয়াঁ। লেভেলক্রসিংএর কাছে অটো পেয়ে যাবো।

-       সে অটো কি পোস্টাল পার্ক চাঁদমারি রোড হয়ে যাবে?

-       পোস্টাল পার্কে যাবে না। চাঁদমারি রোডের মুখটা ছুঁয়ে বেরিয়ে যাবে।

-       তাহলে চলুন, আমিও নেমে পড়ি। 

অনেক যাত্রী নেমে রেললাইনের ধার দিয়ে হাঁটছে। পিছনের ইঞ্জিনের আলোয় তাদের দীর্ঘ ছায়াগুলো নাচানাচি করছে বাঁদিকে ঝোপঝাড়, জলাভূমি এবং কোথাও কোথাও খাটো দেয়ালের ওপর। অদূরে শুরু হয়েছে আগমকুঁয়া শীতলামন্দিরের দেয়াল। তার ভেতর থেকে মন্দিরের উঁচু চুড়োটা দেখা যাচ্ছে। গোপালদা সহযাত্রীকে প্রশ্ন করলেন,আপনারা তো একেই ঈশ্বরের আশীর্বাদ বলবেন, যে যেমন করে হোক প্রতিবার অক্ষত ফিরে আসতে পেরেছি?

-       কেন, আপনি বলবেন না?

-       সেটাই ভাবছিলাম। আরো ভাবছিলাম, এই যে প্রতিবার একটু একটু করে কম দায়িত্বের কাজে আমাকে বহাল করা হচ্ছিল, পয়সা কম পেলেও টেনশনও তো কম হচ্ছিল! সেটাও তো ঈশ্বরের আশীর্বাদ! নয়? (গোপালদার কথায় ঈষৎ শ্লেষের ছোঁয়া ছিল)

সহযাত্রী ঈষৎ পিছিয়ে গিয়েছিলেন। একজন খৈনি টিপতে টিপতে আসছিল। তার কাছ থেকে একটু চেয়ে নিলেন। তারপর এগিয়ে সঙ্গ নিলেন গোপালদার।

-       এত বড় দেশ, এত বড় নির্বাচন, কোটি কোটি মানুষ ভোট দেয়। লাখে লাখে নির্বাচনকর্মীকে পাঠানো হয় কত দুর্গম জায়গায়, বিপজ্জনক জায়গায়, পাহাড়ে, জঙ্গলে, সমুদ্রের দ্বীপে, নদীর চরে। কটা দুর্ঘটনা ঘটে বলুন তো? শতকরা হিসেবে বোধহয় একেরও কম। পোলিং বুথে হাঙ্গামা হয় ভোট লুট করার জন্য, বুথ কব্জা করার জন্য তারাও কিন্তু সোজাসুজি বাধা না দিলে নির্বাচনকর্মীদেরকে টার্গেট করে না। না, আমি বলছি না, বাধা দেওয়া উচিৎ কি না, সেটা অন্য প্রসঙ্গ, নৈতিকতারও প্রসঙ্গ আর কিছুটা কর্মকুশলতারও প্রসঙ্গ সে যাহোক, আমি বলছি, সরকার, তার এত এত ফোর্স, পুলিস, সিআরপি, বিএসএফ কেউ কিন্তু বিশেষ কিছুই করতে পারে না যখন কোথাও কোনো বুথে সত্যিই কিছু হয়ে যায়। আর রাস্তায় হলে তো কথাই নেই। শুধু ক্ষতিপূরণ দিতে পারে, তাই দেয়। প্রয়োজনে লাঠি-গুলি চালাতে পারে। চালায়। সহানুভূতির বচন দিতে পারে। দেয়!

-       ???

-       আসল ম্যাজিকটা তো থাকে দেশের কোটি কোটি সাধারণ মানুষের হাতে, সেটা ভেবে দেখেছেন?

-       মানে?

-       দেড়-দুহাজার ভোটের গ্রামে বুথে থাকে মোটামুটি দশজন নির্বাচনকর্মী আর ফোর্স। হাঙ্গামা কিছু হলে ধরে নিন লুটেরা দল কুড়ি জন আর খবর পেয়ে ছুটে এল আরো কিছু ফোর্স ঐ কুড়িজন ধরুন! এক হাজার মানুষের গ্রাম হলে পঞ্চাশজন মানে পাঁচ পার্সেন্ট। ফোর্স আর পোলিং পার্টি বাইরের লোক। কিন্তু তারাও কোনো না কোনো গ্রাম বা শহরের। তার মানে দেশের পঁচানব্বই পার্সেন্ট মানুষ ভোটার বা ননভোটার, তারা শান্ত থাকে। ভোট দেয়, অথবা দেয় না, দিতে না পারলে প্রতিবাদ করে, অথবা করে না, সিস্টেমকে সমীহ করে, আপনাদেরকে সমীহ করে, মান্য করে, আর শান্তিতে থাকতে চায়। তো, তাদের যে এই শান্তিপ্রিয়তা, হাজারটা সমস্যার মধ্যেও শান্তিতে থাকার চেষ্টা, আমাদেরকেও শান্তিতে নিজেদের কাজ সম্পন্ন করতে দেওয়ার জন্য জরুরি নির্লিপ্ততা, আমি ইতিবাচক অর্থে বলছি নির্লিপ্ততা সেটাই কি পুরো পরিবেশটাকে নির্বিঘ্ন করে রাখে না? আপনাদের, আমাদের নির্বিঘ্নে কাজ সেরে ফিরে আসা কি তাদের আশীর্বাদ নয়? আর সেটাই কি ঈশ্বরের আশীর্বাদ নয়? ঈশ্বর তো মানুষেই থাকেন!

ঠিক বুঝলেন না গোপালদা। কিন্তু আশ্চর্য হলেন! কখনো ভাবেন নি যে শান্তিপ্রিয়তা, নির্লিপ্ততা, এগুলো ইতিবাচক! প্রতিরোধক শক্তি। সবসময় জেনে এসেছেন এগুলো কাপুরুষতার লক্ষণ আর বস্তুতঃ তিনিও, ছাপোষা গৃহস্থ, একজন কাপুরুষ! গুন্ডা, মাফিয়াদের দখলে চলে যাচ্ছে পুরো পাড়া, এমনকি এই নির্বাচনী বুথেও প্রধান অশান্তি তো বুথ-কব্জা, রাজনৈতিক গুন্ডামির অথচ, আমরা কিছুই করতে পারি না, জনতা কিছুই করতে পারে না। অসহায় বা কাপুরুষ!  এভাবেই ভেবে এসেছেন এত দিন। সবকিছু যে মোটামুটি ঠিকঠাক চলে, সব কিছু মোটামুটি ভালোয় ভালোয় মিটে যায় তার কারণ আমাদের মত সাধারণ জনতার শান্তিপ্রিয়তা?

-       কিন্তু ইতিহাস তো অন্য কথা বলে!

-       হ্যাঁ, সরকারের অন্যায় ক্রিয়াকলাপ অসহ্য হয়ে উঠলে, জুলুম অসহ্য হয়ে উঠলে তখন আর সেই শান্তিপ্রিয়তা, নিষ্পৃহতা থাকে না। আপামর জনসাধারণ অশান্ত হয়ে ওঠে। তোলপাড় হয়ে যায় দেশ, পৃথিবী।

-       বাঃ, কেন? পুরোপুরি শান্ত সময়েও কি জনতার একটা বড় অংশ অসহ্য অন্যায়, জুলুম ভোগ করছে না?

-       হ্যাঁ, করছে। সেটাকে সহ্য না করার বাণীই তো মহামানবদের বাণী! তাই তো মহামানবদের ঈশ্বরের দূত বলা হয়।

-       কিন্তু তাঁরা তো মানুষের শান্তিপ্রিয়তা ভেঙে দেন! তাহলে?

-       তাঁরা মানুষকে উন্নততর শান্তির দিকে নিয়ে যেতে চান! মানুষই কায়েম করে সেই নতুন শান্তি। জীবনে সেই শান্তি বজায় রাখার জন্য মানুষের সমবেত সদিচ্ছা, সদ্ভাবনাই আমার, আপনার মত কর্মীদের জন্য বলুন, ঐ ফোর্স আর ম্যাজিস্ট্রেটের জন্য বলুন, খোদ সরকারের জন্য বলুন, ঈশ্বরের আশীর্বাদ।

শান্তিপ্রিয়তা, এমনকি নিষ্পৃহতা, নির্লিপ্ততা একটা শক্তি? দূর্বলতা নয়? কাপুরুষতা নয়? কথাটা গোপালদার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল। হঠাৎ তাঁর অনেকদিন আগে ট্রেনে বসে শোনা দুই পুলিশের কথা মনে পড়ে গেল। একজন আরেকজনকে বোঝাচ্ছিল, সব মানুষের মধ্যে একজন অপরাধী লুকিয়ে আছে বুঝলি? কিন্তু সেই রূপটা বেরোতে ভয় পায়, কেননা পুলিস আছে। দেশটা সাধারণভাবে শান্তিতে চলছে কেননা পুলিস আছে। বোগাস। এক্কেবারে বোগাস। রাতের ল্যাম্পপোস্টের আলোয় ডানদিকের রেললাইন বাঁচিয়ে, বাঁদিকের পুটুসের ঝোপগুলো দেখতে দেখতে হাঁটছিলেন গোপালদা। ইঞ্জিনের আলো এত দূরে স্তিমিত হয়ে এসেছে। ল্যাম্পপোস্টের জোরালো হলুদ আলোয় পুটুসের ফুলগুলোর রং বদলে গেছে, তবু অজস্র ফুটতে ফুটতে নেমে গেছে নিচের জলা অব্দি দেখা যায়।

একটু জোরেই বলে উঠলেন, বোগাস!

কী বললেন? পাশে হাঁটতে থাকা শিক্ষক ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন।

-       না। কিছু না।

একটা সিগরেট ধরালেন আগমকুঁয়া লেভেলক্রসিংএ রেললাইন ছেড়ে রাস্তায় বেরিয়ে। অটোওয়ালা জক্‌সন জক্‌সন চ্যাঁচাচ্ছিল। শিক্ষক সহযাত্রীটিকে উঠতে বলে নিজেও উঠে পড়লেন।

-       কহাঁ?

-       জক্‌সন। উ পট্টি, মহাবীর মন্দিরকে তরফ জাওগে ন? ইনকো উতার দেনা, চাঁদমারি রোড। (শিক্ষকের দিকে তাকিয়ে বললেন) সোচনেওয়ালি বাত বতা দিয়ে আপ, সর। বাড়ি গিয়ে ভাবতে হবে। ঈশ্বর-মানুষ, মানুষ-ঈশ্বর

-       অত দার্শনিক কথা কিছু নয়, ভাইসাহব। সাধারণ মানুষ নিজেদের প্রাত্যহিক দিনযাপনে শান্তিপ্রিয় তাই দেশের পরিবেশ শান্ত থাকে। তারা শান্ত না থাকলে কারো বাপের সাধ্যি নেই যে কেউ কোথাও পরিবেশকে নির্বিঘ্ন রাখবে। আমরা তো সেটুকুই চাই? নির্বিঘ্নে কাজটুকু করে বাড়ি ফিরে আসা? সেখানে ঐ শান্তিপ্রিয়তাই ঈশ্বরের আশীর্বাদ! আমি কোনো আধ্যাত্মিক বা দার্শনিক প্রসঙ্গ তুলছি না।   

ভদ্রলোককে চাঁদমারি রোডে নামিয়ে দিলেন গোপালদা। মনটা বেশ খুশি খুশি লাগছে যেন কোনো একটা অপরাধবোধ থেকে মুক্ত হয়েছেন। নিজেকে কাপুরুষ ভাবা, গা-বাঁচিয়ে পালানো মানুষ ভাবার চক্র থেকে মুক্তি পেয়েছেন। মানুষই ঈশ্বর, আর তিনিও মানুষ!  একটা দারুণ সত্য যেন উদ্ঘাটিত হচ্ছে ধীরে ধীরে। সত্যিই তো! মানুষ অশান্ত হয়ে উঠলে পোলিং পার্টি, পোলিং বুথ, লুটেরাদের দল, ফোর্স, পুরো সরকার হাওয়ায় উড়ে যাবে। পুরো সিস্টেমটাই হাওয়ায় উড়ে যাবে। মানুষ সাধারণভাবে শান্ত, শান্তি চায়, তাই তারা আছে, করে বা চরে খাচ্ছে। আমি যেমন করে হোক কাজ সেরে নির্বিঘ্নে বাড়ি ফিরে যাচ্ছি। কোথায় পিছনে ছেড়ে গেছে তাঁর বাড়ি! তিনি কি ঐ সফরসঙ্গীকে পথ দেখিয়ে পৌঁছোতে এসেছিলেন এত দূর? নাঃ, রেল-স্টেশন অব্দি যেতেই চেয়েছিলেন। অটো ধরার সময়তেই মাথায় ছিল যে আজ বাড়িতে একটু দেরি করে ফিরলেও চলবে।

জাংশন স্টেশনের ভিড় গোপালদা সবসময় খুব ভালো লাগে। সারারাত খোলা চা-জলখাবারের, এমনকি ভাত-রুটিরও কয়েক ডজন রকমারি দোকান, ঠেলা আলোয় আলো। একটা চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে চা খেলেন এক ভাঁড়। যাঃ, ভদ্রলোকের নামটাও জানা হল না। অবশ্য ভদ্রলোকও তাঁর নাম জানতে চান নি। পকেটে হাত ঢুকিয়ে দেখলেন, কত টাকা আছে। হ্যাঁ, বাড়ির জন্য মহাবীর মন্দিরের নৈবেদ্যম লাড্ডু হয়ে যাবে আধ কিলো। বাড়িতে সবারই ভালো লাগে ঐ লাড্ডু। পুজো দিয়ে না আনলেও একটা প্রসাদ প্রসাদ গন্ধ থাকে।

১৮.৯.২৫