Labels
- Ajker dintar janya (10)
- Alokji's poems in English translation (6)
- Articles (116)
- Behar Herald (2)
- Bhinshohore (55)
- Biography (1)
- Engels (11)
- Hindi (48)
- Housing Question (10)
- Kedarnath Bandopadhyay (1)
- Krishak Sabhar Smriti (2)
- Lok Janwad (4)
- Magadher Sahitya (6)
- Meghsumari (155)
- Phire ese (170)
- Plays (10)
- Poems (462)
- Poems by Robin Datta (5)
- Priyo Pochis (8)
- Sanchita (1)
- Sirir mukhe ghor (20)
- sketches (6)
- Smritiprasanga (2)
- Somudro Dubhabe Dake (29)
- Song (1)
- Songs (7)
- Stories (52)
- Translations (88)
- Video (5)
- कौन थे इश्वरचन्द्र विद्यासागर (200वीं जन्मजयंती पर एक कर्मवीर की कीर्तिगाथा) (19)
Monday, October 30, 2023
প্রশ্ন স্মৃতি-বিস্মৃতির নয়
Wednesday, October 25, 2023
অদ্বিতীয় মাইকেল
Sunday, October 22, 2023
মগধের সাহিত্য - ৬
মগধের সাহিত্য
১০০ বছর আগে, ১৯২০ সালের ডিসেম্বর থেকে ১৯২১এর এপ্রিল অব্দি
মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছ’টি বক্তৃতা দিয়েছিলেন এবং ১৯২৩ সালে পাটনা বিশ্ববিদ্যালয় সেই
বক্তৃতা ক’টি পুস্তকাকারে প্রকাশ করেছিল।
‘মগধের সাহিত্য’ শীর্ষক এই বক্তৃতামালায়
বক্তৃতা সংখ্যা ১ ছিল ‘মগধের মূল
অধিবাসী’, বক্তৃতা সংখ্যা ২ ছিল ‘পাটলিপুত্র – ভারতের মেধাজগতের রাজধানী’, বক্তৃতা সংখ্যা ৩ ছিল
‘কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের ঐতিহাসিক শিক্ষা’, বক্তৃতা সংখ্যা ৪ ছিল ‘বাৎস্যায়নের কামসূত্র’, বক্তৃতা সঙ্খ্যা ৫ ছিল ‘বাৎস্যায়ন ভাষ্য’ এবং বক্তৃতা সংখ্যা ৬ ছিল ‘বাণভট্ট এবং আর্য্যভট্ট’।
বক্তৃতা সংখ্যা ৬
বাণভট্ট এবং আর্য্যভট্ট
খ্রিষ্টযুগের পঞ্চম
শতকে যখন গুপ্তরা প্রায় পুরো ভারতের অধিপতি ছিল, বাৎস্যায়ন পরিবারে কুবের নামে সুবিখ্যাত
এবং সুগভীর জ্ঞানসম্পন্ন একজন বৈদিক পণ্ডিত ছিলেন। তিনি নিজের সময়ের সব রকম বিজ্ঞানে
বিশারদ ছিলেন এবং সব ধরণের বলিদানে বিশেষজ্ঞ ছিলেন। তাঁর চার পুত্র ছিলেন যাদের মধ্যে
কনিষ্ঠতম ছিলেন পশুপতি। পশুপতির পুত্র ছিলেন অর্থপতি যিনি অসংখ্য বলিদান সম্পন্ন করেছিলেন
এবং অর্থপতির পুত্র ছিলেন চিত্রভানু যিনি বিদ্যার্জনে ও ধর্মানুরাগে পিতৃপুরুষদের সুনাম
বজায় রেখেছিলেন।১ চিত্রভানুর পুত্র ছিলেন বাণ। বাণ নিজের মাতাকে শৈশবেই
হারান২ এবং চোদ্দ বছর বয়স হতে হতে পিতাদের হারান।৩ নিজের পরিবারেই
বাণ শিক্ষা গ্রহণ করেন, কিন্তু কালে কালে অবাধ্য হয়ে ওঠেন, অরাজক জীবন কাটাতে শুরু
করেন। যাত্রায় বেরোন; উত্তর ভারতে সফরের সময় নর্ত্তক, অভিনেতা, সঙ্গীতজ্ঞ, প্রব্রাজিকা
সম্বলিত তাঁর বড় সড় এক অনুগামীবৃন্দ জোটে। যদিও লোকেরা তাঁর পাণ্ডিত্যের প্রশংসা করত,
নিজের দিনযাপনের ধরণধারণে তিনি ব্রাহ্মণ্য শুদ্ধতা বজায় রেখে চলতেন এমন সুনাম তাঁর
ছিল না।৪ যাহোক, কিছু বছর বন্য জীবন কাটিয়ে নানা স্থানে ঘোরার পর তিনি সংযত
হয়ে ওঠেন। বাড়ি ফিরে তিনি বাৎস্যায়ন পরিবারের প্রধানের স্থান গ্রহণ করেন। সে পরিবারে
তখন অনেক বিদ্বান এবং সুসংস্কৃত ব্রাহ্মণ ছিলেন। বাণ শ্রৌত এবং স্মার্ত বৈদিক বলিদান
অনুষ্ঠানে এবং নানা রকম চারুকলায় দারুণ আনন্দ পেতেন।৬ এক অপরাহ্নে, যখন
সারাদিনের কাজের পর তিনি শোণ নদীর শীতল বাতাস উপভোগ করছিলেন, এক অশ্বারোহী সেখানে পৌঁছোয়।
ঘোড়ার পিঠ থেকে নামার পর বাণের নিচু-জাতের ভাই চন্দ্রসেন ওই অশ্বারোহীকে বাণের কাছে
নিয়ে আসে। সে লোকটি নিজের পাগড়ি৭ খুলে বাণের হাতে একটা চিঠি দেয়। বাণ একান্ত
মনোযোগে চিঠিটা পড়েন, কেননা সেটি লিখেছিলেন কৃষ্ণগুপ্ত, থানেশ্বরের হর্ষবর্দ্ধনের প্রধানমন্ত্রী।
কৃষ্ণগুপ্ত চিঠিতে বাণকে ইঙ্গিত করেন যে মহান সম্রাটের সঙ্গে দেখা করতে চেয়ে আর্জি
করার এটাই প্রশস্ত সময়।৮ পরের সকালে বাণ যাত্রার জন্য প্রস্তুত হন এবং কয়েক
দিনে সেখানে পৌঁছোন যেখানে সম্রাট শিবিরে ছিলেন।৯ অনেকখানি জায়গা নিয়ে ছিল
সেই শিবির এবং বাণ তার যেমন প্রাণবন্ত ও পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা করেছেন তেমন বর্ণনার
জন্য যে কোনো যুগের যে কোনো দেশের কবি সম্মানিত হতে বাধ্য।
সম্রাটের দরবারে
পৌঁছে বাণ দেখেন কৃষ্ণগুপ্ত সম্রাটের সঙ্গে সরকারি বিষয়ে কথা বলছেন। বাণকে ইশারায় তিনি
কাছাকাছি শান্ত ভাবে বসে থাকতে বলেন। সম্রাট আর কৃষ্ণগুপ্তর আলোচনা লম্বা চলল এবং সবটাই
ফিসফিসিয়ে। বাণ খুবই বিরক্ত হচ্ছিলেন। যাহোক, আলোচনার পর কৃষ্ণগুপ্ত সম্রাটের সঙ্গে
বাণের পরিচয় করিয়ে দেন। সম্রাট সংক্ষিপ্ত মন্তব্য করেন, “মহানয়ং ভুজঙ্গঃ।”১০ সে মন্তব্য বাণকে সবচেয়ে বেশি খেপিয়ে দেয়।
শব্দটার মানে শুধু সাপ নয়, ‘ফুলবাবু’ বা ‘নারীদের প্রিয়’। বাণ ভাবছিলেন যে তাঁর যাত্রাকালের আচার-আচরণের জন্য রাজা তাঁকে
খিস্তি করছেন। কিন্তু কৃষ্ণগুপ্ত শিগগিরই বাণের রাগ কমানোর সুযোগ পেয়ে গেলেন এবং কিছুক্ষণের
মধ্যেই হর্ষ এবং বাণ বন্ধু হয়ে গেলেন। সম্রাটের দরবারে বাণ উচ্চস্থানে নিয়োজিত হলেন
এবং তিনি বেশ প্রসন্ন হলেন।১১
শিবিরে সম্রাটের
সঙ্গে অনেকদিন কাটিয়ে বাণ নিজের পরিবারে ফেরার জন্য চিন্তিত হয়ে উঠলেন এবং জন্মস্থানে
ঘুরে আসার অনুমতি আদায় করলেন।১২ বাড়িতে এসে দেখলেন পুরো পরিবার প্রতি সন্ধ্যায়
প্রভমান-প্রোক্ত পুরাণ ১৩-এর আবৃত্তি শুনতে ব্যস্ত। পুরাণের আবৃত্তিকার
প্রতি সন্ধ্যায় আসেন, খেজুরপাতার একটি পাণ্ডুলিপি খোলেন, তা থেকে দীর্ঘ কিছু অংশ পড়েন
এবং গোধুলির আগে নিজের সান্ধ্য প্রার্থনা বলতে চলে যান। মনোযোগী শ্রোতাদের মধ্যে বাণের
চারজন খুড়তুতো ভাইবোন ছিল। তাদের একজন, পুরাণে প্রাচীন রাজাদের ইতিহাস শোনার পর মন্তব্য
করল, “প্রাচীন এই রাজাদের রাজত্ব কত ছোট, তবুও পুরাণ
তাদের কৃতিত্ব ও গুণাবলীর এত বিশদে লিপিবদ্ধ করে। আমাদের সম্রাট হর্ষর রাজত্ব তো বিরাট!
এবং তিনি এত গুণবান আর জনপ্রিয়! বাণ! তুই তাঁর কাজের বর্ণনা করে একটা পুরাণ লিখিস না
কেন?” বাণ সম্মতিতে মাথা নাড়লেন আর হর্ষচরিত লিখতে
শুরু করলেন।১৪
এভাবেই সপ্তম শতকের
প্রথম দিকের বছরগুলোয় ভারতে ঐতিহাসিক সাহিত্য রচনা শুরু হল। শুরুতে খুব ফলপ্রসূ না
হলেও এখন সে সাহিত্যের সর্বোত্তম ফসল ফলতে শুরু করেছে। শুরুতে ফলপ্রসূ না হওয়ার একটা
কারণ এই দুর্ভাগ্যজনক তথ্য যে বাণ তাঁর কাজ শেষ হওয়ার আগেই গত হলেন। যদি তিনি তাঁর
সতেজ ও অননুকরণীয় শৈলীতে রচনাটি শেষ করতে পারতেন, অন্যান্যরা নিশ্চয়ই তাঁকে অনুসরণ
করত। বাণ যেহেতু শেষ করতে পারলেন না, লোকে ভাবল ইতিহাস একটি অশুভ বিষয়; সবরকম ভাবে
এড়িয়ে চলল। একই ঘটনা ঘটল ‘কথা’ সাহিত্যের ব্যাপারে। বাণ ‘কাদম্বরী’ শুরু করলেন কিন্তু শেষ করতে পারলেন না। যদিও তাঁর যোগ্য পুত্র ভুষণ
সেটা শেষ করলেন, কিন্তু ‘কথা’ সাহিত্য তাই উন্নতি লাভ করল না।
বাণ-এর হর্ষচরিত
সংস্কৃতে লিখিত প্রথম ঐতিহাসিক রচনা। প্রাচীন ভারতে ইতিহাস ছিল এবং আমি আগেই আপনাদের
বলেছি যে ইতিহাস পঞ্চম বেদ পরিগণিত হত। কিন্তু সে সময়ের কোনো ঐতিহাসিক রচনা আমরা পাই
না। একটাই জিনিষ পাই – ভারতে যারা শাসন
করেছিল সেসব বিভিন্ন রাজবংশের রাজাদের নামের সূচী। শুধু মগধে আমরা নামের সঙ্গে রাজত্বকালেরও
হিসাব পাই। মি. পারগিটার যিনি বিষয়টি নিয়ে যত্নের সঙ্গে অন্বেষণ চালিয়েছেন, বলেন যে
সূচীগুলো প্রাকৃতে সংরক্ষিত ছিল। সে যাই হোক, যাঁরা বাণকে হর্ষচরিত লিখতে উৎসাহিত করেছিলেন,
নিঃসন্দেহে ভেবেছিলেন যে তাঁরা নতুন কিছু করতে বলছেন। তাঁরা বাণকে এক আধুনিক রাজার
জন্য সেই কাজ করতে বলেছিলেন যে কাজ পুরাণসমূহ প্রাচীন রাজাদের জন্য করেছিল আর বাণ,
উনিশ বা বিশ শতকের ইতিহাসবিদের মেজাজ ও মনন নিয়ে কাজটা করলেন। তিনি নিজের গোত্রের ইতিহাস
দেন, তারপর পঞ্চম প্রজন্ম অব্দি তাঁর পূর্বপুরুষদের ইতিহাস এবং নিজের আত্মজীবনী। এটাও
বলেন যে কী তাঁকে সেই রাজার ইতিহাস লিখতে প্ররোচিত করল যাঁর তিনি সেবক। নিজের জীবনকাহিনী
লিখতে গিয়ে তিনি নিজেকে নিষ্কলঙ্ক ব্যক্তি হিসেবে পেশ করেন না। তিনি যা ছিলেন, নিজের
কোনো দোষ না লুকিয়ে তাই তিনি লেখেন। তিনি তাঁর রাজার অনুরক্ত প্রশংসক ছিলেন কিন্তু
তাঁর দোষ তিনি লিখতে ছাড়েন না। প্রকৃত ইতিহাসবিদের মানসিকতা নিয়ে তিনি রাজার বংশের
ইতিহাস লেখেন। প্রভাকরবর্দ্ধন, রাজ্যবর্দ্ধন এবং হর্ষবর্দ্ধনের বিষয়ে তিনি যা বলেন
সেগুলো আধুনিককালে রচিত ভারতবর্ষের ইতিহাসের অতিপরিচিত তথ্য কেননা সেসব তাঁরই দেওয়া
ঐতিহাসিক খোঁজখবর থেকে নেওয়া। খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতকের শুরুতে ভারতীয় জীবনের ওপর প্রভূত
আলোকপাত করে গ্রন্থটি।
বাণ-এর কাদম্বরী
একটি আখ্যায়িকা, কিন্তু বিস্ময়কর আখ্যায়িকা। কাহিনীর কাল তার বেশ কয়েকটি পাত্রের তিন
জন্মে বিস্তৃত; কাহিনীতে এমন শব্দ আছে যা তিন চার পংক্তি দীর্ঘ এবং এমন বাক্য আছে যা
চার পাঁচ পৃষ্ঠা দীর্ঘ। আমার একজন শিক্ষক গ্রন্থটির পুরোনো আর ছোটো টাইপে ছাপা এক সংস্করণের
একটি বাক্য সুতো দিয়ে মেপেছিলেন। সুতোটা ৩৬ ফুট লম্বা ছিল। কাদম্বরী লৌকিক এবং অলৌকিকের
অদ্ভুত মিশ্রণ। চাঁদ এক জন্মে তারাপীড়, উজ্জয়িনীর রাজপুত্র হয়ে যায়, অন্য জন্মে শূদ্রক,
বিদিশার রাজা। পুণ্ডরীক, লক্ষীর পুত্র এক জন্মে বৈশম্পায়ন আবার অন্য জন্মে টিয়াপাখি
হয়ে যায়। অনেক দিক থেকে আখ্যানটির মিল পাওয়া যায় পালি বৌদ্ধ কাহিনী শ্যামাবতীর সঙ্গে;
তিরিশ বছর আগে চট্টগ্রাম থেকে দ্বিতীয় গ্রন্থটির বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। এই
কাহিনীও আত্মার অনেকগুলো দেহান্তর ধরে চলে। কাদম্বরীর গল্প, গল্পের অফুরান উৎস গুণাঢ্য-এর
বৃহৎকথা থেকে নেওয়া। বৃহৎকথা এখন অপ্রাপ্য কিন্তু তার প্রতিনিধিত্ব করে সোমেশ্বর-এর
কথা-সরিত-সাগর। বাণ-এর আর একটিমাত্র রচনা জ্ঞাত – চণ্ডীশতক১৫ যাতে দেবী দুর্গার ওপর একশটি পদ্য আছে। সে
সময় তিনটি শতক লেখা হয়েছিল। বাণ-এর এই একটি, তাঁর শ্বশুর ময়ূর রচিত সূর্য্যশতক এবং
মানতুঙ্গ রচিত ভক্তামরস্ত্রোত্র – তিনটি শতক হর্ষের
রাজধানীতে পাশাপাশি চলা তিনটি মহান ধর্মের প্রতিনিধিত্ব করে।
বাৎস্যায়ন, চিকিৎসক
পঞ্চতন্ত্রে দুজন
চিকিৎসকের নাম আছে, (১) শালিহোত্র এবং (২) বাৎস্যায়ন।১৬ অশ্বশাস্ত্রের রচয়িতা
শালিহোত্র পশ্চিম পাঞ্জাবের বাসিন্দা ছিলেন। কিন্তু বাৎস্যায়ন নিশ্চিতভাবেই শোণ নদীর
তীরে বাসরত প্রীতিকূট-এর পরিবারের একজন ছিলেন। মধুসূদন সরস্বতী তাঁর প্রস্থানভেদ-এ
বলেন যে কামসূত্র আয়ুর্বেদের অংশ। এ থেকে ওয়েবার মনে হয় ভাবেন যে পঞ্চতন্ত্র-এ উল্লিখিত
চিকিৎসক বাৎস্যায়ন এবং কামশাস্ত্রের লেখক একই ব্যক্তি। শুধুমাত্র নামোল্লেখ থেকে কোনো
অনুমান করা যায় না। কিন্তু আমি ভাবতে প্রবৃত্ত হই যে বাৎস্যায়নের পরিবারে একজন চিকিৎসক
থেকে থাকতে পারেন, কেননা গোত্রটি বিদ্বানে পরিপূর্ণ এবং বিস্তৃত ছিল, এবং মগধে অনেক
শতক যাবত তাদের প্রভাব ছিল। খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতকে খুসরু নৌসেরবনের আদেশে পঞ্চতন্ত্র
পহলবি ভাষায় অনুদিত হয়েছিল। বিশ শতকে আমরা যা জানি বা এমনকি সপ্তম শতকে বাণ যা জানতেন,
বাৎস্যায়ন পরিবারের বিষয়ে তা থেকে অনেক বেশি জানতেন পঞ্চতন্ত্রের লেখক। মধুসূদন সরস্বতী
কর্তৃক কামশাস্ত্রের আয়ুর্বেদে অন্তর্ভুক্তি, শাস্ত্রটির অধ্যয়নে আধুনিক অবজ্ঞার প্রতিফল।
আধুনিক সময়ে কামশাস্ত্রের অর্থ শুধুমাত্র আসঙ্গ-এর এবং কামোদ্দীপক ঔষধির শাস্ত্র।
কিন্তু প্রাচীন কালে এর ব্যাপকতর অর্থ ছিল। এর অর্থ ছিল পাঁচশো আঠেরোটি চারুকলা, বস্তুতঃ
সে সমস্ত কিছু, মানবজীবনকে সহনীয় ও সুখকর করতে যার অবদান ছিল। সবচেয়ে ভালো ধরণের গার্হস্থ্য
এবং সামাজিক বিধিবিধানও ওই শাস্ত্রের অন্তর্ভুক্ত ছিল।
প্রাচীন কামশাস্ত্র
শাস্ত্রের চারটি স্বীকৃত বিভাগের একটি এবং ধর্মশাস্ত্র, অর্থশাস্ত্র ও মোক্ষশাস্ত্র-এর
সমগোত্রীয় ছিল। মধুসূদন সরস্বতী যেভাবে এটিকে আয়ুর্বেদের শাখা বলে দিলেন, প্রাচীন কালে
পঞ্চতন্ত্রের লেখক সেভাবে বলার ঝুঁকি নিতে পারতেন না। যখন নাকি খোদ আয়ুর্বেদ অথর্ববেদের
উপবেদ আর অথর্ববেদ ধর্মশাস্ত্রের অন্তর্গত।
সুবন্ধু
আমি মনে করি সুবন্ধু
গুপ্ত সম্রাটদের শাসনাধীন মগধের বাসিন্দা ছিলেন। তাঁর জীবনকাল নিয়ে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের
ফিটজেওয়ার্ড হল এবং মি. গ্রে যা কিছু জল্পনা করেছেন সেগুলো বিশেষ কাজে দেয় না। এশিয়াটিক
সোসাইটি অফ বেঙ্গলের জার্নাল এ্যান্ড প্রসিডিংসএর নতুন সিরিজের ভলিউম ১এর ২৫৩ সংখ্যক
পৃষ্ঠায় আমি লিখেছিলাম –
শৈলীর শ্রেষ্ঠত্ব
নিয়ে আলোচনায় বামন, খ্রিষ্টীয় নবম শতকে রচিত তাঁর কাব্যালঙ্কারসূত্রবৃত্তিতে, শ্রেষ্ঠত্বের
উদাহরণ হিসেবে ‘সাভিপ্রায়ত্ব’ নামে একটি পদ্য উদ্ধৃত করেন।
পদ্যটি বা শ্লোকার্থটি
এরকম –
সোয়ম সম্প্রতি চন্দ্রগুপ্ততনয়শ
চন্দ্রপ্রকাশোযুবা
জাতো ভূপতিরাশ্রয়ঃ
কৃতধিয়াম দিষ্ট্যা কৃতার্থশ্রমঃ
(চন্দ্রগুপ্তের পুত্র,
তরুণ রাজা চন্দ্রপ্রকাশ এখন বিদ্বান মানুষদের আশ্রয় হয়ে উঠেছে এবং সৌভাগ্যবশতঃ তার
প্রচেষ্টা সফল হয়েছে।)
এর ওপর টিপ্পনী করতে
গিয়ে লেখক বলেন যে “বিদ্বান মানুষদের আশ্রয়” শব্দগুলো গুরুত্বপূর্ণ কেননা ওগুলো মনে করায় যে চন্দ্রপ্রকাশের
একজন মন্ত্রী সুবন্ধু। গুপ্ত রাজবংশে দুজন চন্দ্রগুপ্ত ছিলেন। দুজনকেই বিক্রমাদিত্য
বলা হত। প্রথমজন সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন এবং দ্বিতীয়জন তাঁর পৌত্র। দ্বিতীয়
চন্দ্রগুপ্ত বিদ্বান মানুষদের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। এটাই কি সম্ভাব্য নয় যে সুবন্ধু তাঁরই
এক পুত্র চন্দ্রপ্রকাশের সেবায় ছিলেন?
ভারতীয় পুরাতত্ত্বে
এদিকের বছরগুলোয় একটা বিবাদ উঠেছিল যাতে “চ সুবন্ধু” শব্দদুটোকে “বিশ্ববন্ধু” করার চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু মি. নরসিংহ চেরিয়ার অনেক পাণ্ডুলিপি
ঘেঁটে দেখিয়েছিলেন যে কথাটা চ সুবন্ধু, বিশ্ববন্ধু নয়। কাজেই আমার তত্ত্বটা
প্রমাণিত হয় যে সুবন্ধু দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত এবং তার পরবর্তী রাজত্বে ছিলেন। একটাই
যুক্তি এই তত্ত্বের বিরুদ্ধে খাড়া করা যেতে পারে যে সুবন্ধু এক জায়গায় লেখেন ন্যায়স্থিতিরিব
উদ্যোতকরসবস্ব ১৭ এবং তার অর্থ সুবন্ধু, ন্যায়বার্ত্তিকের লেখক উদ্যোতকরকে
জানতেন, যে উদ্যোতকর, বাচস্পতি মিশ্র বলেন, দিঙনাগের১৮ আক্রমণের বিরুদ্ধে
বাৎস্যায়নকে সমর্থন করেছিলেন। কিন্তু এখন অব্দি জ্ঞাত তথ্য অনুযায়ী দিঙনাগ এবং উদ্যোতকরের
সময় চন্দ্রগুপ্ত ২এর পর। কিন্তু আমার মনে হয় এই প্রশ্নগুলোকে খোলা রাখা উচিৎ। এই তথ্যটা
অস্বীকার করা যায় না যে সুবন্ধু চন্দ্রগুপ্ত ২এর পুত্র চন্দ্রপ্রকাশের অধীনে কাজ করেছিলেন
এবং নিজের রচনা বাসবদত্তার মুখবন্ধে সুবন্ধু পরিতাপ করেন যে বিক্রমাদিত্যের১৯
(চন্দ্রগুপ্ত ২) মৃত্যুর পর দুনিয়া উচ্ছন্নে যাবে। খল অথবা ঈর্ষান্বিত মানুষদের
প্রতি তিনি তিক্ত২০, এবং আমার মনে হয় তারাই তাঁর পৃষ্ঠপোষক চন্দ্রপ্রকাশ
এবং তাঁর বিনাশের কারণ হয়েছিল।
তাঁর রচনার পটভূমি
একেবারেই নিরস এবং লেখক মনে হয় সেটা ভ্রুক্ষেপ করেন না। তিনি শুধু তাঁর শ্লেষগুলোর
খেয়াল রাখেন এবং শ্লেষালঙ্কার প্রয়োগে তিনি যে দক্ষতা দেখিয়েছেন তা এখনো অতুলনীয়। তিনি
নিজের শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে সচেতন ছিলেন এবং যেহেতু মুখবন্ধ সেই রচনার পর লেখা হয় যে
রচনার সেটি মুখবন্ধ, তাই মুখবন্ধে তিনি নিজের রচনার সমালোচনা করেন। সেই সমালোচনা পরবর্তী
সব সমালোচকেরাও অনুমোদন করেছে –
সরস্বতীদত্তবরপ্রসাদঃ
চক্রে সুবন্ধুঃ সুজনৈকবন্ধুঃ
প্রত্যক্ষরশ্লেষময়প্রবন্ধ
বিনয়াসবৈদগ্ধ্যনিধির্নিবন্ধম।২১
যেমন তিনি বলেন,
প্রতিটি অক্ষরে একটি শ্লেষ আছে। গল্প খুব সহজে বলা।
চিন্তামণির পুত্র
কন্দর্পকেতু, এক রাজা, সকালে স্বপ্নে এক অনন্য সুন্দরী কন্যাকে দেখে তাকে খুঁজতে বেরিয়ে
যায়। বিন্ধ্য পর্বতে সে এক বিশাল বৃক্ষের প্রসারিত শাখার নিচে ঘুমিয়ে পড়ে। মাঝরাতে
ঘুম ভাঙলে সে একটি টিয়া এবং তার সঙ্গীর ঝগড়া শোনে। স্ত্রী টিয়াটি পুরুষ টিয়া দেরি করে
এসেছে বলে ক্রুদ্ধ এবং পুরুষ টিয়া কৈফিয়ত দিতে আমতা আমতা করে – “আমি পাটলিপুত্রে
গিয়েছিলাম। সেখানে রাজার কন্যা বাসবদত্তার স্বয়ম্বর ছিল। কিন্তু রাজকন্যা সেখানে আসা
সব রাজপুত্রদেরকে খারিজ করে দিল। সে স্বপ্নে দারুণ সুন্দর এক যুবককে দেখেছিল তাই নিজের
সখীকে তার সন্ধানে পাঠালো। আমি সেই সখীকে নিয়ে এসেছি।” অসীম কৌতূহলে কন্দর্পকেতু উঠে তরুণীটিকে দেখতে পেল। তরুণীটি কন্দর্পকেতুকে
বাসবদত্তার কাছে নিয়ে গেল। সেখানে তারা জানতে পারল যে রাজা পরের দিনই অন্য কারোর সঙ্গে
বাসবদত্তার বিয়ে দেবেন। তাই তারা পালিয়ে গেল এবং বিন্ধ্য পর্বতে একটি লতাকুঞ্জে লুকিয়ে
পড়ল। কিন্তু রাজপুত্র যখন সকালে জাগল, দেখল বাসবদত্তা নেই। সে বহু জায়গায় ঘুরল এবং
অবশেষে একটি পাথরের মুর্তি পেল – তার আকৃতি ঠিক তার
প্রিয়তমার মত। সে মুর্তিটা স্পর্শ করল আর ঐ তো! বাসবদত্তা! সে নিজের বিপজ্জনক অভিজ্ঞতা
রাজপুত্রকে শোনালো। রাজপুত্র যাতে সকালে উঠে কিছু খেতে পায় সেই চিন্তায় সে শিকড় আর
ফলের খোঁজে জঙ্গলে গিয়েছিল। সেখানে তাকে বন্যগোষ্ঠির একটা দল আক্রমণ করে। সৌভাগ্যবশতঃ
পাশেই আরেকটি বন্যগোষ্ঠির দল ছিল। দুই দল নিজেদের মধ্যে তাকে পাওয়ার জন্য লড়াই করে।
দুই দলেরই বিনাশ হয়, কিন্তু তখনই এক ঋষি আসেন যাঁর আশ্রম ঐ বন্যগোষ্ঠির দল নিজেদের
লড়াইয়ে ধ্বংস ছিল। ঋষি ভাবেন যে মেয়েটিই ধ্বংসের কারণ, তাই তিনি তাকে পাথর হয়ে যাওয়ার
অভিশাপ দেন। বাসবদত্তা ঋষিকে মিনতি করে যে তিনি যেন রাগ না করেন, যে সে নির্দোষ। ঋষি
বলেন, অভিশাপ তখনই যাবে যখন সেই রাজপুত্র তাকে স্পর্শ করবে যাকে সে ভালোবাসে। এখানেই
গল্প শেষ হয় এবং দুজনে রাজপুত্রের পিতার রাজধানীতে ফিরে আসে। সেখানে তারা সুখে সমৃদ্ধিতে
জীবন অতিবাহিত করে।
আর্য্যভট
পাটলিপুত্র আরেকজন
মহান মানুষের জন্মস্থান ছিল। তিনি আর্য্যভট, হিন্দুদের বৈজ্ঞানিক জ্যোতির্বিদ্যা এবং
গণিতের পিতা। খ্রিষ্টাব্দ ৪৭৬এ তাঁর জন্ম হয় এবং এখানেই তিনি ২৩ বছর বয়সে, অর্থাৎ খ্রিষ্টাব্দ
৪৯৯এ নিজের কৃতি, কালক্রিয়াপাদ রচনা করেন।২২ তিনি গ্রীসীয় জ্যোতির্বিদ্যার
ছাত্র ছিলেন। যে অদ্বিতীয় অঙ্কপাতন তাঁর নামে চলে এবং যেটি তিনি তাঁর দশগীতিকায় দেন,
গ্রীসীয় প্রণালীর একটি অভিযোজন মনে হয়। ক থেকে ম অব্দি ব্যঞ্জনবর্ণের মূল্য ১ থেকে
২৫ ধার্য হয় এবং আটটি স্বরবর্ণের – ই, উ, ঋ,
এ, ৯, ঐ, ও, ঔ – প্রত্যেকটি ১০০র গুণিতকের রূপ নেয়। ফলে ক
হয় ১, কি হয় ১০০, কু হয় ১০,০০০, কৃ হয় ১০,০০,০০০, ক্লি হয় ১০,০০,০০,০০০, কে হয় ১০,০০,০০,০০,০০০,
কৈ হয় ১০,০০,০০,০০,০০,০০০। এটি গ্রীসীয় প্রণালীর পরিবর্তিত রূপ।
আর্য্যভটের একটি
রচনাকে দশগীতিকা বলা হয়। কেননা এতে
গীতিকা ছন্দে দশটি পদ্য আছে; গীতিকা ছন্দটি আর্য্য ছন্দের পরিবর্তিত রূপ। তাঁর অন্য
রচনা আর্য্যসিদ্ধান্তিকে ১০৮টি পদ্য আছে এবং সেটি তিন ভাগে বিভক্ত – কালক্রিয়াপাদ, গোলপাদ এবং গণিতপাদ। এই দুই রচনায়, যার মোট আয়তন
১১৮টি পদ্যের বেশি নয়, আর্য্যভট হিন্দু জ্যোতির্বিদ্যার পুরো প্রণালীটার ব্যাখ্যা করেছেন।
তিনি এমনকি দার্শনিক সূত্রগুলো থেকেও বেশি সংক্ষিপ্ত, এবং গদ্যে লিখিত, অত্যন্ত শব্দবহুল
জ্যোতির্বিদ্যা-সংক্রান্ত সিদ্ধান্তগুলো থেকে অদ্ভুতভাবে, একেবারেই বিপরীত।
আর্য্যভটের যুগ নিয়ে
একটা বিবাদ আছে মনে হয়। পশ্চিম মালবে মালব যুগ ছিল, গুপ্ত সাম্রাজ্যে গুপ্ত যুগ ছিল,
সে ছাড়া শক যুগ, কলচুরি যুগ ইত্যাদি … সব স্থানীয়
এবং জনগোষ্ঠিগত যুগ ছিল। হিন্দুদের মধ্যে তাঁর রচনাগুলোর উপযোগিতা সর্বজনীন। কোন যুগের
সঙ্গে সেগুলোকে সম্পর্কিত করবেন সেটা একটা সমস্যা। তাই তিনি সবার পরিচিত কলিযুগের নাম
নিলেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে ভারতের সব জ্যোতির্বিদেরাই সে যুগের নাম শক যুগ স্বীকার
করে নিয়েছে। কারণটা খুব দূরের নয়। ভারতে শকদ্বীপী ব্রাহ্মণ বা সিথিয়ান যাজকশ্রেণীই
– প্রাচীন ম্যাগি-প্রসঙ্গ (পূর্বদেশের তিন জ্ঞানী
যাঁরা সদ্যজাত শিশু যীশুর জন্য নৈবেদ্য এনেছিলেন) – একচেটিয়া না হোক, সাধারণভাবে জ্যোতির্বিদ্যা এবং জ্যোতিষশাস্ত্র
অধ্যয়ন এবং অধ্যাপনা করত। তারা ভারতবর্ষে বহুকাল ধরে বসবাস করছিল। ব্রাহ্মণ বা বৌদ্ধ,
কেউই জ্যোতিষীদের সমর্থন করত না। বুদ্ধ স্পষ্টভাবে সম্যক আজীব বা প্রকৃত জীবিকা থেকে
জ্যোতিষশাস্ত্রকে বহিষ্কৃত করেছিলেন।
বলা হয় যে আর্য্যভট
পৃথিবীর দৈনিক গতি২৩ আবিষ্কার করেছিলেন। তাঁর ধারণা ছিল পৃথিবী বর্তুল।
এসব বৈজ্ঞানিক বিষয়ের ব্যাখ্যা আমরা তাঁদের ওপর ছেড়ে দিই যাঁরা হিন্দু জ্যোতির্বিদ্যা
নিয়ে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানে ব্যাপৃত আছেন। কিন্তু একটা ব্যাপার নিশ্চিত যে প্রায় এই
সময়েই নক্ষত্র-অনুধাবনের পুরোনো কৃত্তিকা শৃংখলা পরিত্যক্ত হয়েছিল এবং অশ্বিনীর প্রথম
বিন্দু থেকে শুরু হওয়া নতুন শৃংখলা গৃহীত হয়েছিল। অশ্বিনীর প্রথম বিন্দু ৭৩ বছরে এক
ডিগ্রি বা এক দিন অপসৃত হয়, এবং এখন অব্দি কুড়ি দিন অপসৃত হয়েছে। কাজেই মোট সময় হল
২০ x ৭৩, অর্থাৎ ১৪৬০ বছর। বিন্দুটি বিষুবীয় বৃত্তে বৈশাখের প্রথম দিনে ছিল আর এখন
চৈত্রের ১০ তারিখে আছে। অতএব বিন্দুটি সেখানে ১৪৬০ বছর আগে দেখা গিয়েছিল। ১৯২১ থেকে
১৪৬০ বাদ দিলে হয় ৪৬১ খ্রিষ্টাব্দ। এটা নিছক আনুমানিক গণনা। নিখুঁত গণনা করলে সময়টা
আর্য্যভটের জীবনের সক্রিয় বছরগুলোর মধ্যে পড়বে।
আর্য্যভটের অনেক
ছাত্র ছিল। তার ঠিক পরবর্তী উত্তরাধিকারী লল্লও তাঁর ছাত্র ছিলেন। কয়েকজন বলে যে বরাহমিহিরও
তাঁর ছাত্র ছিলেন।২৪
আরেকজন সুপ্রসিদ্ধ
জ্যোতির্বিদ ছিলেন, আর্য্যভটের সমকালীন। বরাহমিহির। তাঁর বৃহজ্জাতকের ২৬তম অধ্যায়ে
তিনি বলেন যে তিনি আদিত্যদাসের পুত্র, একজন আবন্তক, তাঁর জ্ঞান তিনি নিজের পিতার কাছ
থেকে পেয়েছেন এবং কাম্পিল্লক অথবা কপিত্থকে সূর্য-দেবের কাছ থেকে তিনি একটি গ্রন্থ
পেয়েছেন। ভট্টোৎপল বলেন যে বরাহমিহির একজন মাগধ দ্বিজ। কয়েকজন বলে যে তিনি মগদ্বিজ,
অর্থাৎ, বহুকাল ধরে ভারতে বসবাসকারী ম্যাগিদের একজন। এসব কিছু থেকে স্বর্গীয় পণ্ডিত
সুধাকর দ্বিবেদী তাঁর গণকতরঙ্গিনীতে অনুমান করেন (পৃ.১২), অসম্ভব নয় যে বরাহ মাগধ ব্রাহ্মণ
ছিলেন। জীবিকার সন্ধানে তিনি হয়ত উজ্জৈনে গিয়েছিলেন। তিনি মগধে তাঁর নিজের বাড়িতে বাবার
কাছে পড়াশোনা করেছিলেন এবং সেখানে আর্য্যভটের রচনাও অধ্যয়ন করেছিলেন। স্বক্ষেত্রে নিজেকে
পরিচিত করার জন্য তিনি ভ্রমণ করেছিলেন, কাম্পিল্লকে (কালপি) সূর্য্য-দেবতার পুজো করেছিলেন
এবং তাঁর কাছে একটি গ্রন্থ পেয়েছিলেন। আমি তাঁর পুত্রের রচনা পৃথুয়শঃ-শাস্ত্র-এর পাণ্ডুলিপি
পাই নেপাল উপত্যকার উত্তরতম ভাগে, সাঙ্খুতে। তার প্রথম পদ্যটি বলে যে বরাহমিহিরের পুত্র
তার পিতাকে, যখন তারা গঙ্গাতীরে কান্যকুব্জ নামে সুন্দর শহরে ছিল, কিছু প্রশ্ন করে।
হতে পারে গঙ্গার
তীরে থাকার জন্য বৃদ্ধ বয়সে বরাহ কান্যকুব্জে চলে যান, এবং সেখানে নিজের পুত্র পৃথুয়শঃ
তিনি নিজের জ্ঞান প্রদান করেন।
আমরাজ, খণ্ডনখণ্ডখাদ্য-এর
টীকাকার, বলেন যে শকাব্দ ৫০৯, অর্থাৎ খ্রিষ্টাব্দ ৫৮৭তে বরাহমিহিরের মৃত্যু হয়। কিছু
মানুষ ভাবেন যে বরাহ তাঁর পঞ্চ-সিদ্ধান্তিকা ৫০৫ খ্রিষ্টাব্দে, অর্থাৎ ৪২৭ শকাব্দে
লিখেছিলেন। কিন্তু আমরাজকে বিশ্বাস করলে এটা অসম্ভব। বরাহের বয়স তখন হবে মাত্র ১৮ বছর।
সুতরাং, ডঃ থিবট, যত্নসহকারে সমস্যাটার সঙ্গে সম্পর্কিত সব তথ্য বিচার করে ভাবেন যে
শকাব্দ ৪২৭ সেই বছর যখন লল্ল রোমক-সিদ্ধান্ত পরিমার্জন করেছিলেন এবং পঞ্চ-সিদ্ধান্তিকা
৫৫০ খ্রিষ্টাব্দে রচিত হয়েছিল। অতএব বরাহমিহির আর্য্যভটের পরে আসা সমকালীন এবং সম্ভবত
তাঁর ছাত্র।
গণকতরঙ্গিনী বরাহের
রচনার একটি সূচী দেয় এবং মনে করে যে বৃহৎ-সংহিতা তাঁর শেষ রচনা। এটি অতি বিস্তৃত তথ্যপূর্ণ
একটি গ্রন্থ। গ্রন্থটিতে শুধু জ্যোতির্বিদ্যা ও জ্যোতিষশাস্ত্রই নেই, উদ্যানবিদ্যা,
কৃষি, ভাষ্কর্য, স্ত্রীলক্ষণ, পুরুষলক্ষণ ইত্যাদি অনেক কিছু আছে। তাঁর মহান কাজ পঞ্চ-সিদ্ধান্ত
যাতে তিনি সমসাময়িক সব সিদ্ধান্তের সারসংক্ষেপ পেশ করেন। তাদের সংখ্যা পাঁচ – পৌলিশ, রোমক, বাশিষ্ঠ, পৈতামহ, এবং সূর্য্যসিদ্ধান্ত। বরাহ বলেন
যে এই পাঁচটির মধ্যে পৌলিশ এবং রোমকের ব্যাখ্যা করেছেন লাটদেব। পৌলিশ-এর করা সিদ্ধান্ত
নিখুঁত। তার কাছাকাছি আসে রোমক কর্তৃক ঘোষিত সিদ্ধান্ত। সাবিত্র (সৌর) আরো নিখুঁত এবং
বাকি দুটো সত্য থেকে দূরে।২৫
এ থেকে স্পষ্ট যে
যবনেশ্বর সংস্কৃতে এমন একটি রচনার অনুবাদ করেছিলেন যেটি তাঁর নিজের ভাষায় বহুকাল যাবৎ
লোকচক্ষুর অন্তরালে ছিল এবং স্ফুজিধ্বজ নামে এক রাজা সংস্কৃত গদ্যটিকে ইন্দ্রবজ্র ছন্দে
৪০০০ পদ্যে পেশ করেন। অনুবাদটা এক অজানা যুগের ৯১তম বছরে করা হয়েছিল এবং সে যুগেরই
১৯১তম বছরে সে অনুবাদ পদ্যে পরিবর্তিত হয়েছিল। এখানে গ্রীসীয় রচনার সংস্কৃত অনুবাদ
হওয়ার একটি স্বতন্ত্র সাক্ষ্য পাওয়া গেল। বরাহমিহির জাতক বা রাশিফল-গণনার ওপর, বৃহজ্জাতক
নামে একটি বই লিখেছিলেন। গণকতরঙ্গিনী অনুসারে সে বইয়ে বরাহ গ্রীসীয়, ময়, যবন এবং মনিত্থ
(মেনেথো)-দের তিনটি রচনা থেকে উদ্ধৃতি দেন। এসবকিছু, ভারতীয় জ্যোতিষের ওপর গ্রীসীয়
জ্যোতির্বিদ্যার প্রভাব দর্শায়। গার্গ্য-এ একটি কথা আছে –
মগধে এবং পাটলিপুত্রে
এর পর যে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থটি লেখা হয়েছিল সেটি হল, সপ্তদশ শতকে রচিত দেশবলিবিবৃতিঃ।
ষষ্ঠে বরাহমিহির থেকে সপ্তদশ শতকে দেশবলি একটা বিরাট লাফ। তবে মগধ এই এক হাজার বছর
আলস্যে দিন কাটায় নি, প্রবলভাবে সক্রিয় ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ আমার ছটি বক্তৃতার
সীমিত পরিসরে আমি সেই প্রবল সক্রিয়তার কালটিকে অন্তর্ভুক্ত করতে পারব না। তাই আমি নিজেকে
বিশুদ্ধরূপে ব্রাহ্মণ্য সাহিত্যে সীমিত করেছি। মাঝখানের ১০০০ বছরের গরিষ্ঠ অংশের সক্রিয়তা
বৌদ্ধ সাহিত্যে সীমিত ছিল। ষষ্ঠ শতকে নালন্দার উত্থান ভারতীয় ইতিহাসে এক বিলক্ষণ ঘটনা।
পাঁচ শতকের বেশি সময় অব্দি নালন্দা বিশ্বের মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল। তারই মধ্যে বাংলায়
পাল রাজাদের আমলে বিক্রমশিলা উঠে দাঁড়ালো, এবং বিক্রমশিলার পর আমরা বাংলার জগদ্দলে
পৌঁছোই। নালন্দা তার বিদ্বান সন্ন্যাসীদের সারা বিশ্বে পাঠাতো এবং বিশ্বের সব দিক,
বিশেষ করে পূর্ব থেকে ছাত্র টেনে আনতো। ইউয়ান চ্বাং এখানেই তাঁর শিক্ষা পেয়েছিলেন।
ফিরে গিয়ে তিনি চীনে বৌদ্ধমতের দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠাতা হলেন এবং তাঁর ছাত্ররা ভারতের বিদ্যা
আর ধর্ম নিয়ে গেল জাপানে, কোরিয়ায়, মঙ্গোলিয়া আর সাইবেরিয়ায়। যখন চীনাদের আসা বন্ধ
হয়ে গেল, তিব্বতীরা এল। নালন্দাতেই তারা সংস্কৃত গ্রন্থগুলোর তিব্বতী ভাষায় অনুবাদ
শুরু করল। তাই দশ হাজারের মত গ্রন্থ ধ্বংস ও বিস্মৃতির হাত থেকে রক্ষা পেল। তারপর তিব্বতী
অনুবাদের কেন্দ্র বিক্রমশিলায় এবং তারও পর জগদ্দলে স্থানান্তরিত হল। নালন্দার সাহিত্য
প্রথম দিকে মহাযানবাদী এবং দার্শনিক ছিল। এখানেই তন্ত্রের প্রারম্ভ হল, পূর্ণ সমৃদ্ধিতে
যার উন্নতি হল বিক্রমশিলায় – বিক্রমশিলায় উন্নত
তন্ত্রের দর্শন নালন্দা থেকে বেশি শিক্ষাগত ছিল। বিক্রমশিলা এবং জগদ্দল উঠে দাঁড়ানো
সত্ত্বেও নালন্দার উন্নতিলাভ বজায় রইল এবং আমাদের কাছে এমনকি একাদশ শতকে সেখানে লেখা
পাণ্ডুলিপি আছে। আমার কাছে, বড়গাঁওয়ে বাংলা অক্ষরে নকল করা পাণ্ডুলিপি আছে, প্রফেসর
বেন্ডাল ভেবেছিলেন যে সেটা চতুর্দশ শতকের, কিন্তু আমার মনে হয় সেটি মুসলিম বিজয়-অভিযানের
আগে নকল করা হয়েছিল। বড়গাঁও যে নালন্দার অবিচ্ছেদ্য অংশ সেটা সর্ববিদিত। এই কালখণ্ডের
বৌদ্ধ সাহিত্য অত্যন্ত কৌতূহলোদ্দীপক এবং শিক্ষাপ্রদকিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ সে সাহিত্য
সংস্কৃততেও নেই, অন্য কোনো ভারতীয় ভাষাতেও নেই। অধিকাংশ রচনা শুধুমাত্র তিব্বতী অথবা
চীনা অনুবাদে প্রাপ্য। কয়েকটি মূল সংস্কৃতে অথবা বাংলায় নেপালে পাওয়া গেছে। পশ্চিম
এবং এমনকি দক্ষিণ ভারতও এই সংস্কৃত রচনাগুলোকে লোকসমক্ষে নিয়ে আসতে নিজেদের অবদান রাখছে।
এই কালখন্ডের সাহিত্যের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করতে জাপান, চীনা অনুবাদগুলোর মাধ্যমে অনেক
কাজ করছে; তিব্বতও সে কাজে সক্রিয়। লন্ডনে, প্যারিসে আর বার্লিনে কেন্দ্র গড়ে কয়েকজন
খুব বিদ্বান মানুষ এই কালখন্ডের ইতিহাসের পুনর্নির্মাণে সক্রিয়তার সঙ্গে ব্যাপৃত আছেন
এবং আমি আশা করি ভারত, বিশেষ করে এই প্রদেশ যে সবচেয়ে বেশি এই কাজে আগ্রহী, এ কাজে
পিছিয়ে থাকবে না।
শেষ রচনা যেটির বিষয়ে
আমি বলতে চাই, হল দেশাবলি-বিবৃতি, পূর্ব ভারতের একটি গেজেটিয়ার, সপ্তদশ শতকে পাটনার
মোগলটুলিতে বিজ্জল ভূপতি নামে চৌহান জমিদারের পৃষ্ঠপোষকতায় তাঁর পণ্ডিত, পণ্ডিত জগমোহন
তৈরি করেছিলেন। কেউ ভাবতে পারে যে সঙ্কলনের কাজটি আইন-ই-আকবরীর দ্বারা অনুপ্রাণিত,
কিন্তু আমি মনে করি অনুপ্রেরণা অন্য জায়গা থেকে এসেছিল এবং সে অনুপ্রেরণা পূর্ণতঃ দেশীয়।
মিথিলার মহান কবি বিদ্যাপতি এক বিরাট মাপের মানুষ ছিলেন, তিনিই প্রথম ভূপরিক্রমা নামে
একটি গেজেটিয়ার লেখেন। তাঁকে অনুসরণ করেন বিক্রম নামে এক জমিদার এবং তাঁর রচনার নাম
বিক্রমসাগর। বিজ্জল ভূপতি, দেখা যায় বিক্রমের এক বংশধর। অর্থাৎ বিজ্জলের অনুপ্রেরণার
দিল্লী থেকে আসার কোনো প্রয়োজন নেই। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ গেজেটিয়ার সাহিত্যের [ভৌগোলিক
অভিধান] ভালো পাণ্ডুলিপি বিশেষ উঠে আসছে না। হোরেস হাইমেন উইলসন এক গাদা টুকরো সংগ্রহ
করেছিলেন এবং সেগুলো এখন কলকাতার সংস্কৃত কলেজ লাইব্রেরিতে জমা আছে। আমি বাঁকুড়ায় কিছু
টুকরো সংগ্রহ করেছিলাম যেগুলো এশিয়াটিক সোসাইটি অফ বেঙ্গলে জমা আছে। এই টুকরোগুলোর
অধ্যয়ন আমাদের, বিহারে, বাংলায় এবং আশেপাশের জেলাগুলোয় বসবাসরত তিনশো বছর আগেকার হিন্দুদের
বিষয়ে অনেক তথ্য দিয়েছে – তাদের মন্দির, তাদের
তীর্থস্থান, তাদের প্রশাসন, তাদের বাণিজ্য, তাদের শিল্পোৎপাদন [ম্যানুফ্যাকচার], তাদের
দুর্গনির্মাণ, তাদের আদব-কায়দা, তাদের দেশাচার, তাদের দুর্বলতা এবং তাদের অভ্যাস। এক্ষেত্রে
বিজ্জলের কৃতির অনুসারী ছিলেন পঞ্চকোটের রাজা যাঁর কবি, রামকবি, পাণ্ডবদিগ্বিজয় নাম
দিয়ে একটি গ্রন্থ রচনা করেন।
এখানেই আমি মগধের
সাহিত্যের ওপর আমার ছটি বক্তৃতার শৃংখলা শেষ করছি। যখন আমি এই বক্তৃতার কাজ হাতে নিয়েছিলাম,
ভেবেছিলাম বেশির ভাগ পৃষ্ঠা মগধের বৌদ্ধ এবং জৈন সাহিত্যের ইতিহাস দিয়ে ভরিয়ে দিতে
হবে। কেননা ভেবেছিলাম যে মগধে এক কৌটিল্যের কাজ ছাড়া, হিন্দু সাহিত্যের অন্য কোনো কাজের
স্থাননির্দেশ করা আমার পক্ষে অসম্ভব হবে। কিন্তু সৌভাগ্যবশতঃ, রাজশেখরের কাব্যমীমাংসা
এবং বাণের হর্ষচরিত আমায় অনেকগুলো কাজকে মগধের বলে সনাক্ত করতে সাহায্য করল। এবং সে
কাজগুলো ধর্মগত গোঁড়ামিতে ভরা না হয়ে এমন কাজ যে সমস্ত ভারতীয় এমনকি পুরো বিশ্বের মানুষ
তার বিষয়ে জানতে আগ্রহী হবে। আমি তাই সম্প্রদায়গুলোকে উপেক্ষা করেছি এবং সেই সমস্ত
কাজ বেছেছি যা সবাইকে কৌতূহলী করে তুলবে।
আমি অত্যন্ত প্রসন্ন হতাম যদি এই বক্তৃতাগুলো স্যার এডোয়ার্ড গেইটের প্রশাসনকালে শেষ করতে পারতাম। স্যার গেইট মগধের সমস্তকিছুর ব্যাপারে অত্যন্ত আগ্রহ দেখাতেন এবং সবসময় আমায় এই প্রদেশের গবেষণায় উৎসাহ দিতেন। কিন্তু যা ঘটনা, তা হল এই যে তিনি এই বক্তৃতাগুলো নিজের অবসরজীবনে পড়বেন এবং জেনে পরিতৃপ্ত হবেন যে তাঁর বিনীত বন্ধু, তার ওপর যে কার্য্যভার ন্যস্ত করা হয়েছিল তা পুরো করেছে, অবহেলা করে নি।
- হরপ্রসাদ শাস্ত্রী
…………………………………………
Monday, October 16, 2023
রুদ্রজী
অনেক বেশি উজ্জীবিত ছিল।
কবিদের বাড়ি ছিল তীর্থের মতন –
এ গলি সে গলি পেরিয়ে,
কাঠচেরাই কিম্বা ট্রেডলের শব্দ চিনে চিনে,
জবাগাছের ডালটা সরিয়ে খোলা দরজার
কড়া নাড়া – আরে এস এস! …
পরে যাঁরা ইতিহাস হলেন সে কবিরা
লেখকেরা কিম্বা অনুবাদকেরা
সেদিন এ শহরের ভাষায় বসন্ত বাঁধছিলেন।
আপনিও তাঁদেরই মধ্যে ছিলেন – সর্বজনশ্রদ্ধেয়;
সবাই ছড়িয়ে পড়ল
সময়ে কিম্বা সত্ত্বায়
আপনি রয়ে গেলেন।
ধীরে ধীরে
কষে বাঁধল আপনাকে পরিবারের
জটিলতা, রোজকার রুটির চাবুক।
লড়ে চললেন;
সূর্যউপাসকের শরীর ছিল আপনার,
সাইকেল চালিয়ে যেতেন, প্রুফ দেখে ফিরতেন
অনেক রাতে …
কবিতার আসরে আপনি বিস্মৃতি হয়ে পড়ছিলেন।
কেন যেন সবসময় মনে হয় আমি দেখতে পাচ্ছি –
বৃষ্টির রাত এগারোটা, ফোঁটাগুলো চিকচিক করছে রাস্তার আলোয়,
ঈষৎ দূরে দীর্ঘদেহী আপনি
ভেজা ঘিয়ে পাঞ্জাবির ভিতরে ন্যুব্জ কাঁধ,
সাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফিরছেন,
হঠাৎ কিছুতে জড়িয়ে পড়ে গেলেন,
দপ করে আগুন জ্বলল এক ঝলক – শেষ!
ক’দিন আগেই তো বেরিয়েছিল প্রায় তিন দশক পর
একটি সংগ্রহ আপনার!
১৯.৩.১৯৯৫
মগধের সাহিত্য - ৫
মগধের সাহিত্য
১০০ বছর আগে, ১৯২০ সালের ডিসেম্বর থেকে ১৯২১এর এপ্রিল অব্দি
মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছ’টি বক্তৃতা দিয়েছিলেন এবং ১৯২৩ সালে পাটনা বিশ্ববিদ্যালয় সেই
বক্তৃতা ক’টি পুস্তকাকারে প্রকাশ করেছিল।
‘মগধের সাহিত্য’ শীর্ষক এই বক্তৃতামালায়
বক্তৃতা সংখ্যা ১ ছিল ‘মগধের মূল
অধিবাসী’, বক্তৃতা সংখ্যা ২ ছিল ‘পাটলিপুত্র – ভারতের মেধাজগতের রাজধানী’, বক্তৃতা সংখ্যা ৩ ছিল
‘কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের ঐতিহাসিক শিক্ষা’, বক্তৃতা সংখ্যা ৪ ছিল ‘বাৎস্যায়নের কামসূত্র’, বক্তৃতা সংখ্যা ৫ ছিল ‘বাৎস্যায়ন ভাষ্য’ এবং বক্তৃতা সংখ্যা ৬ ছিল ‘বাণভট্ট এবং আর্য্যভট্ট’।
বক্তৃতা সংখ্যা ৫
বাৎস্যায়ন ভাষ্য
আরেকজন বাৎস্যায়ন
আছেন যিনি দর্শনসংক্রান্ত কাজের পারিভাষিক শব্দাবলী ও ভাষা নিরূপণ করে ভারতীয় সাহিত্যে
বিশিষ্ট অবদান রেখেছেন। প্রথম যদি তিনি নাও হন, দার্শনিক বিষয়সমূহে তিনি প্রথম দিকের
একজন রচনাকার। তাঁর আগে সমস্ত কিছুই সূত্রে এবং স্মৃতিসংক্রান্ত কাব্যে ছিল। তাঁর সময়
থেকে গদ্য উচ্চতর চিন্তাভাবনার ভাষা হয়ে উঠল। তাঁর কাজ ভাষ্য শ্রেণীতে প্রথম, যাতে
সূত্রগুলোকে সাধারণ ভাষায় নিয়ে এসে, লেখকদের মতের স্পষ্ট ব্যাখ্যা করে তারপর নিজের
সমালোচনা পেশ করা হয়। তাঁর আগে ভাষ্য বলতে ছিল স্বতন্ত্র গ্রন্থ, নিদর্শন হিসেবে নিঘণ্টুর ভাষ্য নিরুক্ত
এবং পাণিনির ওপর পতঞ্জলির মহাভাষ্য দেখুন। কৌটিল্য অর্থশাস্ত্র-এর নিজেরই
রচিত সূত্রগুলোর ওপর একটা ভাষ্য তৈরি করলেন, কাজেই সে ক্ষেত্রে সমালোচনার তত্ত্ব
থাকা অসম্ভব।
বলা হয় যে ন্যায়সূত্র-এর
ওপর বাৎস্যায়নের ভাষ্য বোঝা খুব কঠিন। যে লেখকের ঘোষিত উদ্দেশ্য ছিল দর্শনকে
সাধারণ মানুষের বোঝার মত করে লেখা এবং যার রচনাশৈলী এত সহজ ও সুন্দর, অদ্ভুত মনে হয়
যে তাকে দুর্বোধ্য মনে করা হয়। সমস্যাটা ভাষ্যের নয়, সূত্রের। সূত্রগুলো জোড়াতালি মারা
সংকলন। স্পষ্ট দেখা যায় যে অনেকগুলো হাত সেগুলো সংগ্রহ করছে এবং পরিমার্জন করছে। এই
পরিমার্জন এবং প্রক্ষেপণের উদ্দেশ্য সবসময় বিজ্ঞানের প্রগতি নয়, দলগত স্বার্থ। আর বাৎস্যায়নের
কাজটা ছিল কঠিন। বিভিন্নধর্মী বস্তুসমূহকে সমরূপ একটি প্রণালীর শৃংখলায় নিয়ে আসা। তাই
আকছার তিনি দুর্বোধ্য হয়ে যান এবং জোর গলায় বলা যায় না যে তাঁর ভাষ্যটিকেও দলগত স্বার্থে
বিকৃত করা হয় নি।
কিন্তু তাঁর অসুবিধেগুলো
বুঝতে এবং তাঁর অবদানের সমাদর করতে সাধারণভাবে সূত্রসমূহ এবং বিশেষভাবে ন্যায় সূত্রসমূহ
সঙ্কলিত করার ইতিহাসটা বলা জরুরি। খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে বৈদিক সূত্র, শ্রৌত, গৃহ্য
এবং ধর্মসূত্রের রচনাকাল শেষ হয়ে গিয়েছিল। পাণিনি, পিঙ্গল এবং তাঁদের অনুসারীদের সঙ্গে
শিক্ষা, ব্যাকরণ এবং অঙ্গের অন্যান্য সূত্রের রচনাকাল শেষ হল। বাৎস্যায়নের কামসূত্রের
সঙ্গে বোধহয় মানবজীবনসম্পর্কিত সাধারণ চিন্তাভাবনার বিষয় নিয়ে সূত্র রচনার কালও শেষ
হল। তারপর এল দর্শনসংক্রান্ত সূত্র। তবে সূত্র থাক বা না থাক, দার্শনিক ভাবনাচিন্তা
খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ, সপ্তম বা তারও আগে থেকে চলছিল।
ওই সময়টায়, মানে
খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ, সপ্তম বা তারও আগে, ভারতীয় চিত্তে একটি বিরাট উপপ্লব ঘটেছিল। ভারতের
শান্তি বিঘ্নিত করতে পারে এমন কোনো আভ্যন্তরীণ বা বহির্গত যুদ্ধ হয়েছিল মনে হয় না।
এবং উচ্চতর শ্রেণীসমূহ, বিশেষকরে ব্রাহ্মণেরা, নৈতিক, আধ্যাত্মিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক
ইত্যাদি চিন্তাভাবনার উন্নতিতে তাদের পুরো শক্তি নিয়োজিত করেছিল। বস্তুতঃ একটা সর্বাত্মক
উন্নতির বাতাবরণ ছিল। সবাই নতুন কিছু বলতে চাইছে, কোনো কঠিন সমস্যার সমাধান করতে চাইছে,
মানবজ্ঞানের পরিধিতে নতুন কিছু যোগ করতে চাইছে, কোনো কষ্ট কম করতে এবং দূর করতে চাইছে,
জীবনকে সহনীয় এবং সুখকর করতে কিছু করতে চাইছে। সবাই কিছু নতুন ভাবনা নিয়ে আসছে। ধর্মোপদেশ
আর প্রচারকার্য্যে ভরা সময়। যদি বৈদিক যুগের সর্বশেষ ভাবনিঃসরণ, উপনিষদে, এবং প্রথম
দিকের বৌদ্ধ ও জৈনদের রচনায় দেখি, একটা জিনিষ যা আমাদের চমৎকৃত করে তা হল বিপুল সংখ্যক
লেখক ও শিক্ষকের নাম। সবার কিছু বলার ছিল – নতুন ভাবনা,
ধর্মমত, কর্মবিধি, ধারণা – কিছু একটা যা আমাদের
জ্ঞান বাড়াতে পারে, কিছু একটা যা আরো সুসংবদ্ধ, আরো স্পষ্ট, আরো পরিষ্কৃত হয়েছে। প্রথম
দিকের উপনিষদগুলো (বৈদিক) পড়ে মনে হয়, এমনকি প্রত্যক্ষকরণের পাঁচটি ইন্দ্রিয় এবং কর্মের
পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের কথাও সেসময় সবাই জানে না। কেননা ওই সব অভিব্যক্তিগুলি আমরা তৈত্তিরীয়
এবং অন্যান্য প্রাচীনতর উপনিষদে এভাবে পাই - চক্ষুঃ, শ্রোত্রং, মনঃ, বাক, ত্বক এবং
অন্নং, প্রাণঃ, চক্ষুঃ, শ্রোত্রং।
দার্শনিক সূত্রসমূহের
এই সব আদিম প্রতীতি থেকেই আমরা পরিমার্জিত বর্গীকরণে এবং সূক্ষ্ম পার্থক্যে পৌঁছোই।
প্রক্রিয়াটা দীর্ঘ, ক্লান্তিকর, বাধায় ভরা এবং বহু শতক ধরে চলেছিল। বিদ্বানরা যথার্থই
বলেন যে দার্শনিক সূত্রের বীজগুলো উপপ্লবের সাহিত্যে পাওয়া যাচ্ছিল। কিন্তু কথাটা বিভ্রান্তিকর।
নিখুঁতভাবে বলতে গেলে বলতে হয় যে যে বিষয়গুলো নিয়ে সূত্রের কারবার, সে বিষয়গুলো ওই
সময়কার সাহিত্যে, উন্মেষের প্রথম অবস্থায় আদিম রূপে পাওয়া যায়। এর মধ্যে কিছু বিষয়
জাপানী বিদ্বান মিঃ উই বিলক্ষণ দক্ষতার সঙ্গে, দশপদার্থী সূত্র অনুসারে বৈশেষিক দর্শনের
ভূমিকায় সন্ধান করেছেন। উপনিষদে বর্ণিত চারটি উপাদান ছিল মহাভূত, এবং সে অর্থে আণবিক
নয়। বৌদ্ধদের ছয়জন ধর্মবিরোধী শিক্ষকদের একজন, পকুদ কাচ্চায়ন বলেন পৃথিবী, অগ্নি, জল
এবং বায়ু [সে উপাদান]; আনন্দ, বেদনা এবং আত্মা সৃষ্ট নয়, সৃজন সম্ভব নয় এবং বন্ধ্যা।
তখনও এই ভাবনা আণবিক নয়। তবে তিনি বলেন যে শরীরে এবং বস্তুতে সমপরিমাণ উপাদান রয়েছে
যদিও দৃশ্যতঃ তারা এক নয়; এই নিশ্চিত দ্বন্দ্বের সামঞ্জস্যবিধানে, অন্য কিছুর থেকে
একটি আণবিক সিদ্ধান্ত বেশি কাজে লাগতে পারে এবং সেটাই স্বাভাবিক পরিণতি মনে হয়। জৈনরা
বলেন যে আত্মা এবং শুদ্ধ স্থান ব্যতীত সবকিছু জড় (পুদ্গল) [matter] থেকে উৎপন্ন এবং
সমস্ত জড় অণু অথবাপরমাণু দিয়ে গঠিত। জড় অবশ্য স্থূল এবং সূক্ষ্ম, দুই অবস্থাতেই
হতে পারে; একটি স্থূল অণুর স্থান অসংখ্য সূক্ষ্ম অণুতে পূর্ণ হয়ে থাকে। সারবস্তুর দিক
থেকে অণু চিরন্তন, প্রত্যেকটি অণুর স্বাদ, গন্ধ এবং রং এক, এবং দু ধরণের স্পর্শ। যদিও
বিভিন্ন অণুর গুণাবলী চিরস্থায়ী এবং স্থির নয়, কিন্তু সে গুণাবলী তাদের মধ্যে পরিবর্তিত
ও বিকশিত করা যেতে পারে। অণুর বৈশেষিক প্রণালী এর থেকে বেশি উন্নত। জৈন প্রণালীতে অণুর
একটাই প্রকার, যখন নাকি বৈশেষিকে চারটি উপাদানের অনুরূপ বিভিন্ন প্রকারের অণুর কথা
বলা হয়েছে। মিঃ উই ভারতীয় এবং চীনা গ্রন্থসূত্র থেকে, উপনিষদ থেকে বৈশেষিক সূত্র অব্দি
আণবিক তত্ত্বের অবস্থা এবং পরিবর্তনের বিভিন্ন পর্যায়গুলো যত্নসহকারে সংগ্রহ করেছেন।
খুবই কৌতূহলোদ্দীপক অন্বেষণ তাঁর এবং অধ্যয়ন ফলদায়ী। একই ভাবে সবক’টি তত্ত্বের বিকাশপথ, খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ ও সপ্তম শতকের উদ্ভব থেকে
দার্শনিক সূত্রের যুগ অব্দি সন্ধান করা সম্ভব।
যেমন আগেই বলেছি,
উপপ্লবের যুগে আমরা মিছিমিছিই সূত্রসমূহের উৎস খুঁজব। কিন্তু যদি আমরা সূত্রে আলোচিত
বিভিন্ন বিষয়গুলোর উৎস খুঁজি, আমরা বেশি সফল হব। এইসব নানা বিষয়, শুরু হয়েছিল অনেক
আগে। তারপর সমালোচিত, পুনর্নির্মিত এবং পরিমার্জিত হয়েছিল বার বার। প্রত্যেকটি দার্শনিক
গোষ্ঠি, যেমন ইচ্ছে এবং যেমনরূপে চাইত, সেই বিষয়গুলো ওঠাত। বিভিন্ন দার্শনিক গোষ্ঠি
তৈরি হয়েছিল; তাদের মধ্যে কয়েকটি, যেমন কালকারণিক, ঈশ্বরকারণিক, অর্থচিন্তক স্বল্পস্থায়ী।
বাকিরা কয়েক শতাব্দীকাল ধরে ছিল, মানুষের ভাবনাচিন্তাকে প্রভাবিত করেছিল তারপর অদৃশ্য
হয়ে গিয়েছিল যেমন আজীবক, চেলক, পরিব্রাজক ইত্যাদি। কয়েকটি আমাদের সময় অব্দি এল। পরম্পরা
অনুসারে তাদের সংখ্যা ছয়। কিন্তু সেই ছয় বিভিন্ন ভাবে গোনা হয়ঃ বৌদ্ধ, আর্হত, বৈশেষিক,
সাংখ্য, মীমাংসা এবং ন্যায়, গোনার একটি ধরণ। যদি আপনি লোকায়তকে ঢোকাতে চান, ন্যায়কে
সরিয়ে দিন কেননা সেটা বৈশেষিকের সগোত্র। আধুনিক গণন অন্যভাবে ছয়ের সমষ্টি তৈরি করে,
যথাঃ পূর্ব ও উত্তর মীমাংসা, সাংখ্য এবং যোগ, ন্যায় এবং বৈশেষিক। আরেকটি সমষ্টি আছে
ছয়ের – ব্রহ্ম, ঈশ্বর, বৌদ্ধ, আর্হত, সাংখ্য এবং
লোকায়ত। ফলে বলা যায় যে লেখকদের কাল ও রুচি অনুসারে বিভিন্ন সমষ্টি আছে।
অর্থাৎ, একটা সময়
ছিল যখন এই সব চিন্তাভাবনাগুলো ভারতীয় সমাজে আলোচিত হত। সমালোচিত এবং পরিমার্জিত হত।
দার্শনিক গোষ্ঠি তৈরি করার উদ্দেশ্যে এগুলোর ভিত্তিতে দল তৈরি হত এবং সেখানে চিন্তাসমূহ
সুসম্বদ্ধ করা হত। সূত্র সঙ্কলিত হয়েছিল কিছুকাল অতিবাহিত হওয়ার পর। কাজেই, যদি এই
সূত্রগুলোর উৎস সন্ধান করতে হয়, সেই সব বিভিন্ন অধিকরণ বা একক-বিষয় দিয়ে শুরু
করতে হবে যা সূত্র গঠন করে।
এটাই ভারতে দার্শনিক
চিন্তার বিকাশের সাধারণ ইতিহাস। বাৎস্যায়নের ভাষ্য নিয়ে আলোচনা করতে আমাদের পরস্পর
বিরোধী চিন্তাপ্রণালীগুলোকে সঙ্গে রাখতে হবে। একদিকে বৌদ্ধ, অন্যদিকে জৈন, ওদিকে আবার
শঙ্কর বৈশেষিক প্রণালীকে অর্দ্ধবৈনাশিক বা অর্দ্ধ-নাস্তিবাদী বলে কলঙ্কিত করেন, যখন
নাকি বৌদ্ধরা বিশুদ্ধ এবং সাদাসিধে সার্বিক-নাস্তিবাদী, এবং অনেকে মনে করে এদের কোনো
গোঁড়ামি ছিল না। যে মহাপন্ডিত ব্যক্তি সূত্রসমূহ রচনা করেছেন তিনি সমসাময়িক প্রচলিত
চিন্তাভাবনা থেকে বেশ কয়েকটি অধিকরণ নিয়েছেন, সেগুলো নিজের মত করে ব্যাখ্যা করেছেন,
এবং আহ্নিকে ও অধ্যায়ে সেগুলোকে মালায় গেঁথেছেন। ন্যায় বৈশেষিকদেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করে,
শুধু পদার্থবিজ্ঞান ও অধিবিদ্যা থেকে তর্কশাস্ত্রের দিকে বেশি মনোযোগ দেয়। তাই, বাৎস্যায়নের
কাজ বুঝতে এবং যথাযথ মূল্যায়ন করতে, চিন্তাপ্রণালীগুলোর কিছুটা ইতিহাস কাজে লাগবে।
উপনিষদ যে বেদান্ত
প্রণালীর শিক্ষা দিত, ভারতে সেটিই প্রথম চিন্তাপ্রণালী যার অধ্যয়ন এবং তত্ত্বানুসন্ধান
করা হয়েছিল। কিন্তু উপনিষদসমূহকে দীর্ঘকাল যাবৎ ব্রাহ্মণসমূহের অংশ মনে করা হত এবং
কর্মকান্ডে ব্যবহার করা হত। তাই সে শিক্ষা ব্রাহ্মণদের মধ্যেই সীমিত ছিল। জ্ঞানকান্ড
এবং কর্মকান্ডের মধ্যেকার পার্থক্য অনেক পরে এসেছে। তাই উপনিষদের দর্শন, বলতে গেলে
মুলতুবি অবস্থায় ছিল এবং খ্রিষ্টাব্দ ষষ্ঠ শতকের আগে বিকশিত হয় নি। সপ্তম শতকে আমরা
হর্ষচরিতে ঔপনিষদ১ নামে, অর্থাৎ যারা দর্শনের একটি চিন্তাধারা হিসেবে উপনিষদ
অধ্যয়ন করে, একটি দার্শনিক গোষ্ঠির কথা জানতে পারি। এই গোষ্ঠি থেকেই পরবর্তী শতকগুলোয়
বেদান্তীদের আবির্ভাব হয়। কাজেই ভারতের প্রাচীনতম চিন্তাধারা সবচেয়ে শেষে বিকাশ লাভ
করে।
বেদান্তের পরে আসে
সাংখ্য, গণনামূলক দর্শন, যাতে ভাবকে সংখ্যায় নিরূপিত করার চেষ্টা হয় এবং বস্তুতঃ কপিল
সূত্রে, যার সংখ্যা ২২, প্রায় প্রতিটি সূত্রে একটি সংখ্যা আছে। এটা দর্শায় যে সাংখ্য
শব্দটা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এই ২২টি সূত্রের বয়স নিশ্চিত নয়। এতে অনেক উন্নত ধারণা
আছে, যেমন ত্রিপ্রমাণ, যেটা ন্যায়-এর ধারণাবলীর পরের হতে পারে। বিদ্বানরা সবাই মনে
করেন যে সাংখ্য-এর প্রাচীনতম বিদ্যমান রচনা ঈশ্বরকৃষ্ণ-এর ৭০টি কারিকা। আরো তিনটি কারিকা
আছে যাতে দার্শনিক চিন্তাধারাটি সম্পর্কে অন্যান্য ঐতিহাসিক তথ্য এবং শিক্ষকদের অনুক্রম
দেওয়া আছে। এতে আছে যে ষষ্টিতন্ত্র নামে একটি বই ছিল যার একটি অধ্যায়ে ছিল অন্যান্য
চিন্তাধারার মতসমূহ নিয়ে আলোচনা এবং আরেকটি অধ্যায়ে ছিল কাহিনীসমূহ নিয়ে আলোচনা। এখন
ছয় অধ্যায় সম্বলিত একটি বই আছে ‘সাংখ্য প্রবচন’ যার একটি অধ্যায়ে সাংখ্য দৃষ্টিকোণ থেকে অন্যান্য চিন্তাধারার মতবাদের
খণ্ডন এবং আরেকটি অধ্যায়ে সাংখ্য অনুশীলনে সহজে সিদ্ধি পাওয়া ভক্তদের কাহিনী নিয়ে আলোচনা
আছে। কিন্তু সাংখ্য প্রবচনের সূত্রাদি যে প্রাচীনত্বের দাবী করে তা খারিজ করতে বিদ্বানেরা
একমত। তাঁরা বলেন যে বইটা বেদান্ত চিন্তাভাবনায় ভরা এবং এর সূত্রকার বিজ্ঞান-ভিক্ষু,
যিনি ভাষ্যের লেখক, শঙ্করের অনুযায়ী এবং এগারোশো অথবা বারোশো শতকের মানুষ। আমি গৌড়পদের
ভাষ্যে, ৭০ কারিকার ওপর ষষ্টিতন্ত্রের একটি সূত্র পেয়েছি কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ সাংখ্য
প্রবচন সূত্রসমূহে সেই সূত্রটি নেই। হতে পারে প্রবচন ষষ্টিতন্ত্রকে ভিত্তি করেই রচিত
হয়েছিল কিন্তু পরবর্তী অদলবদলগুলোয় এতটাই বদলে গেছে যে আর চেনা যায় না।
কাজেই সাংখ্যের,
অদ্যাপি বিদ্যমান প্রাচীনতম রচনা, খ্রিষ্টীয় পঞ্চম শতকে অথবা তার আগে ঈশ্বরকৃষ্ণ রচিত
৭০ কারিকা। কিন্তু সূত্রসংগ্রহ কিছু ছিল, যার একটির কথা খোদ কারিকাই বলে – তার নাম ষষ্টিতন্ত্র। ষষ্টিতন্ত্র শব্দটির অর্থ দুর্বোধ্য কিন্তু
একজন আধুনিক টীকাকার নারায়ণ, সাহসের সঙ্গে জটিল ধাঁধাটার জবাবে বলেছেন যে রচনায় ষাটটি
বিষয় ছিল। এবং সেই ষাটটি বিষয়ের নামও বলেছেন। কিন্তু আমরা অন্য একটি সাংখ্য দার্শনিক
গোষ্ঠির কথা জানি যার ব্যাখ্যা করে ভগবত-গীতা এবং কঠোপনিষদ। এই গোষ্ঠি অব্যক্ত এবং
বুদ্ধির মধ্যবর্তী মহাতত্ত্বে বিশ্বাস করে। অশ্বঘোষ তাঁর বুদ্ধচরিতে নির্বাণের বৌদ্ধ
মতের কথা বলতে গিয়ে বলেন যে এটি সাংখ্য মতবাদগুলির অগ্রগতি, এবং তাঁর চিন্তাপ্রণালী
ভগবত-গীতা এবং কঠোপনিষদের অনুরূপ। একটা নিশ্চিত ভিত্তিতে গিয়ে আমরা পাই যে খ্রিষ্টপূর্ব
চতুর্থ শতকে কৌটিল্য সাংখ্যের নাম নিচ্ছেন একটি দার্শনিক গোষ্ঠি হিসেবে। ঈশ্বরকৃষ্ণের
আগে প্রাচীন সাংখ্য সাহিত্য বলতে এটুকুই জানা যায়। ভারতে সবচেয়ে আগের ভ্রমণকারী বা
পর্যটক তপস্বী সম্প্রদায় ছিলেন পরিব্রাজকেরা; তাঁর বৌদ্ধ এবং জৈনদের থেকে অনেক আগের।
হরিভদ্রের সদ্দর্শন সমুচ্চয়ের ভাষ্যে গুণরত্ন বলেন যে এরা সাংখ্যের অনুগামী ছিল।
(P. 95, Bibl. Ind. Edition)
কোনো সন্দেহ নেই
যে সাংখ্য প্রণালী নিজের নাম সংখ্যা থেকে নিয়েছে। এটি বৌদ্ধমত থেকেও প্রাচীন এবং বৌদ্ধমতকে
গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। কয়েকজন মনে করেন যে সাংখ্যের অব্যবহিত পরিণতি বৌদ্ধমত এবং
প্রথম দিকের বৌদ্ধমত সংখ্যায় ভরা – চারটি
মহৎ সত্য, বারোটি আয়তন, পাঁচ স্কন্ধ ইত্যাদি। বৌদ্ধমত দীর্ঘকাল পর্য্যন্ত
গণনায় আটকে ছিল। এমনকি ছোট ছেলেদের তারা ধারণার মাধ্যমে সংখ্যা শেখাতো।
যেমন বলেছি, উচ্চতর
চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করার প্রথম দিকের পদ্ধতি ছিল ধারণাকে সংখ্যা দিয়ে স্থির করা। চিন্তাগুলো
ছিল ক্ষণস্থায়ী, বিলীয়মান, চিত্তে স্থির করা কঠিন, বিদিত করা আরো কঠিন; চিন্তার কারবার
করার সবচেয়ে ভালো উপায় ছিল তাদেরকে সংখ্যায় বাঁধা। কিন্তু যখন চিন্তার সংখ্যা অত্যধিক
হয়ে গেল, চিন্তার জগত ব্যাপ্ত হল তখন ভিন্ন পদ্ধতি আবিষ্কার করার প্রয়োজন হয়ে পড়ল।
সে পদ্ধতি ছিল তুলনা – বর্গীকরণের উদ্দেশ্যে
সংখ্যা দ্বারা স্থিরিকৃত ধারণাসমূহের মিল ও অমিলের তুলনা, এবং সে পদ্ধতি দিল বৈশেষিক
সূত্র যাতে সাধর্ম্য এবং বৈধর্ম্য ছিল প্রধান সূর। পুরো রচনা জুড়ে মিল এবং অমিলের ভাবনা।
প্রণালীটির চারিত্রিক বৈশিষ্ট হল সামান্য আর বিশেষ, সাধারণীকরণ ও বিশেষীকরণ অথবা পৃথকীকরণ।
বৈশেষিক নামটাই পৃথকীকরণ থেকে এসেছে। কিছুসংখ্যক বস্তু নিন, তাদের মধ্যে মিল বা এমন
সাধর্ম্য খুঁজতে থাকুন যেটাকে আপনি সবক’টি বস্তুর
বিধেয় করতে পারেন। সেটা হবে সর্বোচ্চ মিল। তারপর আবার, অমিল খুঁজতে খুঁজতে একেকটি বস্তুর
নিজস্ব স্বাতন্ত্র্যের অন্তিম বিশ্লেষণে, নিম্নতম অমিলে পৌঁছোন। এইভাবে বিশ্বের সমস্ত
স্বজ্ঞা ও ঘটমানের বর্গীকরণ ও বিশ্লেষণ করে কণাদ চূড়ান্ত সাধারণীকরণ পূর-সামান্য অর্থাৎ,
অস্তিত্ব ‘সত্ত্ব’ এবং চূড়ান্ত পৃথকীকরণ বিশেষে পৌঁছোন। এই দুই চূড়ান্তের মাঝে আছে
সমস্ত ঘটমান, মিল এবং অমিল দুইই যার বিধেয় হতে পারে।
বৈশেষিক সূত্রেরও
ইতিহাস উত্থান-পতনে ভরা। লোকপরম্পরা নিশ্চিতভাবে বলে যে এর আঠেরোটি দার্শনিক গোষ্ঠি
ছিল।৩ জানা যায় না এই লোকপরম্পরা কতটা ঠিক। কিন্তু সদ্য চীনে, বৈশেষিকের
একটি দার্শনিক গোষ্ঠির অস্তিত্ব দেখা যাচ্ছে যার দশটি বিভাগ আছে। এটাও ভালোভাবেই সবাই
জানে যে এরা যাকে প্রশস্ত ভাষ্য বলে সেটি একটি স্বতন্ত্র গ্রন্থ। অনেক বস্তুগত লক্ষণে
সূত্র থেকে ভিন্ন। হতে পারে এই গ্রন্থটি পুরোনো ধরণের একটি ভাষ্য, যা মূল রচনাটির বিবর্দ্ধন
ও সমালোচনা করেছিল। প্রশস্তপাদের সম্পাদক দেখান যে সব মিলিয়ে ৫৩টি সূত্র বাদ৪
দিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং ভাষ্যকার বিষয়টির আলোচনায় যে ক্রম গ্রহণ করেছেন সেটি সূত্র থেকে
একেবারেই ভিন্ন। সপ্তপদার্থী নামে আরেকটি দার্শনিক গোষ্ঠি আছে। যদিও তুলনামূলকভাবে
আধুনিক, গোষ্ঠিটির ভিত্তি পুরোনো একটি গোষ্ঠিতে, কেননা পুরোনো কোনো গোষ্ঠিতে ভরসা করতে
না পারলে আধুনিকদের নতুন দার্শনিক গোষ্ঠি শুরু করার সাহস হয় না।
শঙ্করাচার্য্য সাংখ্যকেও
গোঁড়ামিমুক্ত বলেন। নেকনজর সত্ত্বেও সমালোচনা করেন কেননা মনুর মত কিছু গোঁড়া মানুষ
এই দর্শন গ্রহণ করেছিল। সে তূলনায় তাঁর করা বৈশেষিকের আলোচনা কঠোর; তিনি এই দর্শনকে
অর্দ্ধ-বৈনাশিক, অর্থে – অর্দ্ধ-শূন্যবাদী,
বলেন। তিনি জানতেন যে এর উৎস প্রচলিত মতের বিরোধ, যদিও শাস্ত্রবিশ্বাসী মনে করা হয়
কেননা কণাদের সূত্রগুলো আকছার বেদ ও আগমে সমর্থন চায়। চীন থেকে আসা সূত্র সেরকম কোনো
সমর্থন চায় না। কণাদ নিজের রচনায় বেদের ওপর একটি অধ্যায় রেখেছেন এবং বৈদিক আচারপদ্ধতিকে
সমর্থন করেন। এই সব কারণে আধুনিক সময়ে বৈশেষিককে শাস্ত্রবিশ্বাসী মনে করা হয়।
গণনা থেকে তুলনা
অব্দি দার্শনিক পদ্ধতির প্রগতি বিবৃত করে সাংখ্য এবং বৈশেষিক। তারপরে আসে যুক্তিতর্ক
ও আলোচনা, অর্থাৎ ন্যায়। আকছার এর ভুল অনুবাদ হয় তর্কশাস্ত্র। ন্যায়সূত্র শুরু হয় প্রমাণ
দিয়ে এবং শেষ হয় যুক্তিতর্কে বিষয়নির্দিষ্ট পরাজয়সাধনে। সূত্রসমূহে অনেক কিছু আছে যেগুলো
তর্কশাস্ত্রের ক্ষেত্রের বাইরে। আমাদের পিতৃপুরুষেরা ন্যায়সূত্রকে তর্কশাস্ত্র বলতেন।
সেটাই এর সঠিক নাম হওয়া উচিৎ - আলোচনার শিল্প। ন্যায়ের ষোলোটা বিভাগ পরখ করে দেখুন!
সবগুলো আলোচনা সম্পর্কিত। (১) প্রমাণ, সত্যকে বাছাই করার সাধন, (২) প্রমেয়, প্রকৃত
জ্ঞানেই যাকে নিশ্চিত জানা যায়, (৩) সংশয়, সন্দেহ, (৪) প্রযোজন, বিষয়বস্তু, (৫) দৃষ্টান্ত,
উদাহরণ, (৬) সিদ্ধান্ত, মতবাদ, (৭) অবয়ব, অনুমানবাক্য, (৮) তর্ক, যুক্তি দিয়ে অজানা
বিষয়ে সত্য খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা, (৯) নির্ণয়, সত্যের সন্ধান, (১০) বাদ, দু’তরফের শুনে সত্য সন্ধানের সৎ প্রচেষ্টা, (১১) জল্প, প্রতিপক্ষকে
পরাজিত করে নিজের অবস্থান প্রতিষ্ঠা করা, (১২) বিতণ্ডা, নিজের অবস্থান প্রতিষ্ঠা না
করে প্রতিপক্ষকে পরাজিত করা, (১৩) হেত্বাভাস, কুতর্ক [হেতুর ছদ্ম আভাস], (১৪) চল, কথার
মারপ্যাঁচ, (১৫) জাতি, নিষ্ফলতা, (১৬) নিগ্রহস্থান, পরাজয়ের বিন্দু সকল। এসব কিছু একটাই
বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত, আলোচনা। পুরো আর্য্য বিশ্বে, পর্ষদ ছড়িয়ে ছিল। স্থানীয় জ্ঞানী
মানুষেরা পর্ষদ গঠন করতেন। দেওয়ানি এবং ফৌজদারি, সব রকমের মামলায় তাদেরকে মীমাংসায়
আসতে হত। তাদেরকে শাস্ত্রের ব্যাখ্যা করতে হত। বিভিন্ন চিন্তাপদ্ধতির মধ্যে সিদ্ধান্ত
নিতে হত। তর্কশাস্ত্র পর্ষদগুলোর জন্য বস্তুতঃ একটি পথপঞ্জি ছিল। রাজার প্রিভি কাউন্সিলকে
মন্ত্রী পরিষদ বলা হত। কাজেই যখনি মানুষে মানুষে বিবাদে নিষ্পত্তি করতে হত, হয় পরিষদ
বা পর্ষদ বসত এবং কিছু নিয়ম ছিল। কৌটিল্যের শেষ অধ্যায়, তন্ত্রযুক্তি, সেই নিয়মের কয়েকটির
উল্লেখ করে। ন্যায়সূত্র যদি সাদাসিধে, বিশুদ্ধ তর্কশাস্ত্র হত, তাহলে সেখানে পরাজয়ের
বিন্দু, নিগ্রহস্থানের কোনো জায়গা থাকত না। একটি নিয়ম আছে, যদি পরিষদ কর্তৃক তিন বার
আহ্বায়িত হওয়ার পরও পক্ষ নীরব থাকে, তাহলে সে পরাজিত হয়। এটা তর্কশাস্ত্রের অংশ নয়।
কিন্তু আলোচনাকে নির্দেশিত করার কাজে নিয়মটা জরুরি। এই সূত্রগুলো রচিত হওয়ার আগে অন্যান্য
পথপঞ্জি ছিল। কেননা, অশোকের সপ্তদশতম বছরে পাটলিপুত্রে আয়োজিত তৃতীয় বৌদ্ধ পর্ষদে রচিত
কথাবত্থুতে, বিবাদ পরিচালন করার পদ্ধতি পূর্ণতঃ ভিন্ন ছিল। সেই রচনায় – ইংরেজি নামঃ পয়েন্টস অফ ডিফারেন্স – প্রথম বিন্দু পুরো বিস্তারে দেওয়া আছে। কিন্তু বিবাদের ঐ বিস্তারিত
বর্ণনায় অনুমানবাক্যের বিষয়ে একটা শব্দও নেই। বিবাদ পরিচালনের মীমাংসা পদ্ধতিও ভিন্ন
ছিল –
বিষয়ো বিষয়শ্চৈব
পূর্বপক্ষস্তথোত্তরঃ। নির্ণয়শ্চেতি পঞ্চাঙ্গং শাস্ত্রেSধিকরণং স্মৃতং।
জৈনদের সপ্তভঙ্গী
ন্যায় এবং বৌদ্ধদের চতুষ্কোটি – সৎ, অসৎ, সদাসৎ,
এবং নাসৎ-না-সৎ - আলোচনার ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতি। যেমন আগে বলেছি, এই সূত্র পর্ষদগুলোর
পথপঞ্জি ছিল। দর্শনের স্থান এখানে গৌণ। বস্তুতঃ প্রথম সূত্রে যে বিবৃত আছে ওই গ্রন্থে
কোন কোন প্রসঙ্গে আলোচনা হবে, সেখানে আধ্যাত্মিক, বা জ্ঞানতাত্ত্বিক বা নৈতিক গুরুত্বসূচক
একটিও শব্দ নেই। সেগুলোর উপস্থাপন হয়েছে প্রমেয় শীর্ষকে। কিন্তু প্রমেয়, বিচারকদের
পথপ্রদর্শন সম্পর্কিত কোনো বইয়ে একান্ত জরুরি। আধ্যাত্মিক এবং অন্যান্য প্রসঙ্গগুলো
যদি সরিয়ে নেওয়া হয়, তর্কশাস্ত্রের ওপর একটি বই হিসেবে এর মূল্য একটুও কমবে না। বাস্তবে
আমি মনে করি, ওই সব প্রসঙ্গগুলো প্রক্ষেপ, এবং আমি এখন দেখাবার চেষ্টা করব কীভাবে ওই
প্রক্ষেপগুলো রচনায় প্রবেশ করেছিল।
মূলতঃ এই রচনাটিতে
কোনোরকম গোঁড়ামি ছিল না। সব শ্রেণীর মানুষেরা, সে অর্থশাস্ত্রের লেখক হোক বা কামসূত্রের,
বইটা ব্যবহার করতে পারত। কিন্তু খুব ছোটো বই ছিল, প্রথম বই যাতে এখন অন্তর্ভুক্ত
কয়েকটি সুত্র ছিল না। ভাষ্যকারেরা বলেন যে সব দার্শনিক সূত্রের তিনটে অংশ আছে – উদ্দেশ, লক্ষণ, এবং পরীক্ষা – (সংক্ষিপ্ত বর্ণনা, পরিভাষা এবং পরীক্ষা বা সমালোচনা)। প্রসঙ্গগুলোর
সংক্ষিপ্ত বর্ণনা প্রথম সূত্রে দেওয়া হয়, পরিভাষাগুলো প্রথম অধ্যায়ে ছড়িয়ে থাকে। কিন্তু
পরীক্ষা প্রণালীবদ্ধও নয়, সম্পূর্ণও নয়। যদি প্রণালীবদ্ধ হয়, তাহলে প্রত্যাশিত যে সবচেয়ে
আগে প্রমাণের পরীক্ষা হবে, কিন্তু না, প্রথম পরীক্ষিত প্রসঙ্গ সংশয়। তারপরে আসে প্রমাণ,
যাদের সংখ্যা চার, এবং তারপর আসে প্রমেয়। শেষ দুটো শীর্ষক, জাতি এবং নিগ্রহস্থান পুরো
পঞ্চম বইটা জুড়ে জায়গা করে নেয়।
পঞ্চম অধ্যায়ে দুটো
আহ্নিক আছে, একটি জাতি বা যুক্তির অসারতাগুলোর নাম গোনায় এবং দ্বিতীয়টি গোনায় নিগ্রহস্থান,
পরাজয়ের বিন্দু। তবুও মনে হয় না সূত্রগুলো একজন মানুষের লেখা। কেননা প্রথম আহ্নিকে
মতানুজ্ঞা জাতির একটি উপবিভাগ হিসেবে পরিগণিত হয়, আবার সেই একই মতানুজ্ঞা পরাজয়ের একটি
বিন্দু হিসেবেও পরিগণিত হয়। যদি একজনই দুটোই লিখে থাকত, তাহলে একটি দার্শনিক সূত্রে
দুটো, প্রকৃতিতে এত ভিন্ন বিষয়বস্তুকে এক পারিভাষিক নাম দিত না। এই সূচীগুলো মনে হয়
পুরোনো সূচী, প্রজন্মের পর প্রজন্ম উত্তরাধিকারে পেয়েছে এবং তাই পরম্পরাগতভাবে পূজিত
হয়ে থাকে। এগুলো ন্যায়সূত্রের প্রথম অধ্যায়ের পরিশিষ্টের মত, কেননা জাতি ও নিগ্রহস্থান
পরিভাষিত করার সময়, মনে হয় লেখক প্রথম অধ্যায়েই সেটা সেরে নিয়েছেন। কেননা গ্রন্থ-১এ
তিনি হেত্বাভাস এবং চল-এর সবক’টি উপবিভাগ দেন কিন্তু
জাতি এবং নিগ্রহস্থানের বেলায়, অনেক আছে বলে এগিয়ে যান। তার মানে সেগুলো নিয়ে আলোচনা
তিনি আগেই পুরো করেছেন। যদি বলেন যে পঞ্চম অধ্যায়ে, লেখক নিছক ‘বহু’ শব্দটার অর্থবিস্তার
করছেন তাহলে অন্য একটা গুরুতর অসুবিধার সৃষ্টি হবে। প্রকরণসম শব্দটি একটি হেত্বাভাস।
সেই প্রকরণসম আবার জাতিরও একটি। যে লেখক একই দার্শনিক রচনায় দুটো জিনিষের জন্য একটি
পারিভাষিক শব্দ ব্যবহার করে তার প্রশংসা করা যায় না। কিন্তু সে যদি ওই একই কাজ বার
বার করে তাহলে সে আরো বেশি করে প্রশংসার অযোগ্য। তাই ন্যায়সূত্রের লেখকের খ্যাতি বাঁচাতে
বলা ভালো যে পঞ্চম অধ্যায়ের দুটো আহ্নিক পরিশিষ্ট যাতে পুরোনো সূচী মেশানো হয়েছে।
অন্যান্য সব দার্শনিক
সূত্রে আলোচ্য প্রসঙ্গাদির সংক্ষিপ্ত বর্ণনা একটাই সূত্রে দেওয়া থাকে এবং সেখানেই পুরো
রচনার উদ্দেশ্য বিবৃত হয়। কিন্তু ন্যায়-এ আমরা দ্বিতীয় একটি সূত্র পাই। সেখানে, সেই
সূত্রে বর্ণিত প্রসঙ্গগুলোর, তর্কশাস্ত্রের সঙ্গে বা আলোচনার বিধিনিয়মের সঙ্গে কোনো
সম্পর্ক নেই। সেখানের সবকটি প্রসঙ্গ খুব বেশি রকম আধ্যাত্মিক। সেগুলো হল – দৈন্য, অবস্থান্তর, লালসা, দোষ, কৃত্রিম জ্ঞান এবং মুক্তি। তর্কশাস্ত্রের
জন্য জরুরি সবকটি প্রসঙ্গের পূর্ণ গণনা ও সংক্ষিপ্ত বর্ণনার পর আধ্যাত্মিক প্রকৃতির
একটি দ্বিতীয় সূত্র কেন আবশ্যক হবে, সেটা একটা ধাঁধা। আর বাৎস্যায়ন সেই ধাঁধার সমাধান
করতে চান এই বলে যে প্রথম সূত্রে নিঃশ্রেয়স-এর অর্থ আত্ম-মুক্তি এবং দ্বিতীয় সূত্র
সেই মুক্তি প্রাপ্তির ধাপগুলো লিপিবদ্ধ করার জন্য জরুরি। এই ব্যাখ্যা সন্তোষজনক নয়।
তাঁর ভাষ্যকার উদ্যোতকর নিঃশ্রেয়স শব্দটাকে শুধু পারমার্থিক জ্ঞান অর্থে নয়, আরো প্রসারিত
অর্থে গ্রহণ করেন। তিনি বলেন যে মন্ত্রী, সেনাধ্যক্ষ্য, বণিক এবং এমনকি সাধারণ মানুষেরাও
এই তর্ক প্রসঙ্গগুলো পড়ে নিঃশ্রেয়স অর্জন করতে অর্থাৎ, নিজেদের ক্ষেত্রে সমৃদ্ধির সর্বোচ্চ
স্তরে পৌঁছোতে পারেন। কাজেই তিনি নিজেকে পারমার্থিক অভিষ্ট লাভে সীমিত রাখেন না। আমার
সন্দেহ হয় যে দ্বিতীয় সূত্র কেউ একজন, যে তর্ক বা তর্কশাস্ত্রের এই গোঁড়ামিমুক্ত বইটাকে
গোঁড়া বা আধ্যাত্মিক চেহারা দিতে চেয়েছিল, বাৎস্যায়নের আগেই ঐ সূত্রসমূহে ঢোকায়। এবং
সেসব দিনে অনেক সম্প্রদায় ছিল যারা আধ্যাত্মিক বিষয়সমূহে নানা প্রকারের দৃষ্টিভঙ্গি
নিয়ে চলত। যদি বাৎস্যায়ন নিজে সূত্রটা নাও ঢুকিয়ে থাকেন, তিনি সূত্রটি সমর্থন করার
এবং পুরো রচনাটির আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা করার দায় নিজের ওপর নেন। এবং বস্তুতঃ তিনি আধ্যাত্মিক
দর্শনের একটি চিন্তাধারার প্রতিষ্ঠাতা হয়ে ওঠেন; বর্তমানে তা অনেকগুলো সম্প্রদায়ের
জন্ম দিয়েছে।
এখানে উল্লেখ করা
অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে ন্যায়সূত্রের দ্বিতীয় সূত্রে বৌদ্ধ পতিচ্চসমুপ্পাদ-এর প্রভাব
আছে। অবিজ্জাপ্পচ্চয়াসংখারা, সংখারপ্পচ্চয়াবিঞ্যানাঞি, বিঞ্যানপ্পচ্চয়োনামরূপং, নামরূপপ্পচ্চয়া
ষড়ায়তনানি, ষড়ায়তনপ্পচ্চয়া ফংসো, ফংসপ্পচ্চয়া বেদনা, বেদনাপ্পচয়া তনহা, তনহাপ্পচ্চয়োভবো,
ভবপ্পচ্চয়ো জাতি, জাতিপ্পচ্চয়া জরামরণশোক-পরিদেব-দুঃখ-দোমনস্যাপায়াদি ভবন্তি।
এবার আমি বোঝাবো
যে ওই একটা সূত্র প্রবিষ্ট করায় পুরো গ্রন্থটার চেহারা কীভাবে পাল্টে গেছে। ওই সূত্রের
প্রসঙ্গগুলো একমাত্র প্রমেয় ছাড়া প্রথম সূত্রের কোনো প্রসঙ্গের অন্তর্ভুক্ত করা যেতে
পারে না এবং একদম শেষে, প্রমেয়-র লক্ষণে অথবা বর্ণনায় সেগুলো ঢোকানো হয়েছে। নবম সূত্র
দেখুন –
“আত্ম-শরীর-ইন্দ্রিয়-বুদ্ধি-মনঃ-প্রবৃত্তি-দোষ-প্রেত্য-ফল-দুখঃ-পবর্গঃ
প্রমেয়ং।”
প্রথম ছয়টিকে প্রমেয়
বলে প্রায় সবক’টি সম্প্রদায় স্বীকার করে। শেষের ছয়টি দ্বিতীয়
সূত্র থেকে, নামে একটু অদলবদল হয়ে, এসেছে। সূত্র সংখ্যা ১৭, ১৮, ১৯, ২০, ২১ এবং ২২
ওই সূত্রে উল্লিখিত বিষয়বস্তুগুলোকে পরিভাষিত করে।
এবার এই সূত্রগুলোর
পরীক্ষায় আসা যাক। সংশয়, প্রমাণ এবং প্রমেয়-র প্রথম ছয়টি বস্তুর পরীক্ষা করে দ্বিতীয়
এবং তৃতীয় অধ্যায়। বাকি ছয়টি বস্তুর পরীক্ষা হয় চতুর্থ অধ্যায়ের প্রথম আহ্নিকে’; আহ্নিকটি
শেষ হয় আধ্যাত্মিক তত্ত্বজ্ঞানে এবং মুক্তিতে। অন্য আহ্নিক তত্ত্বজ্ঞানকে উন্নত করে।
কাজেই, তর্কশাস্ত্রের বা আলোচনার পথপঞ্জির সঙ্গে এই পুরো অধ্যায়টার কোনো সম্পর্ক নেই।
তবে যদি দ্বিতীয় সূত্র এবং তার আনুসঙ্গিকগুলো সরিয়ে দেওয়া হয়, পুরো গ্রন্থটা হবে আলোচনার
নিয়মাবলী। আমার মনে হয়, তর্কশাস্ত্রের বইটিকে অধ্যাত্মতত্ত্বের বইয়ে বদলে দেওয়ার এই
কর্মটির জন্য আমরা এক বৌদ্ধ জ্ঞানীর কাছে ঋণী। তত্ত্বজ্ঞান একটি পারিভাষিক শব্দ নয়,
ন্যায়ের ষোলটি বিভাগের একটি নয়, তাহলে এর পরীক্ষাই বা কেন হবে আর তাও এত বিস্তারে?
যেমন আগে বলেছি, গোঁড়া, সনাতনপন্থী মানুষেরা তর্কশাস্ত্রের পক্ষে বিশেষ ছিলেন না। মনু
হেতুশাস্ত্র ঘৃণা করেন। হেতুশাস্ত্র তর্কশাস্ত্রেরই আরেক নাম। এই ঘৃণা এক সময় নতুন
ধর্মমতাবলম্বী, বৌদ্ধ এবং অন্যান্যদের বিশেষ গুণ ছিল।
নাগার্জুন চার প্রমাণে
বিশ্বাস করতেন। এই শাস্ত্রও চার প্রমাণে বিশ্বাস করে। চার প্রমাণ চারটি সূত্রে – ৪, ৫, ৬, এবং ৭এ – পরিভাষিত।
তারপর ওপর-পড়া হয়ে আসে আরেকটি সূত্র – ৮। “স(শব্দঃ) দ্বিবিধঃ দৃষ্টদৃষ্টার্থত্বাত। এই সূত্রটি প্রবিষ্ট করার
উদ্দেশ্য, প্রমাণ-এর পরীক্ষায় বিস্তারে দৃষ্ট হয় যেখানে বেদসমূহের প্রামাণ্যতা নিয়ে
দীর্ঘ আলোচনা আছে। কিন্তু এই বিষয়ে প্রক্ষেপক, তিনি যে-ই হোন, মীমাংসকদের বিরোধ করেন
যারা ধ্বনির নিত্যতায় বিশ্বাস করে। কাজেই, প্রক্ষেপের মাধ্যমে গ্রন্থটিকে শুধু আধ্যাত্মিকই
নয়, ব্রাহ্মণ্যবাদী, এবং সে অর্থে সনাতনপন্থী করে তোলা হয়েছিল।
এই বক্তৃতার শুরুতে
ন্যায়সূত্রকে আমি জোড়াতালি দেওয়া কাজ বলেছিলাম। এবং এখন আমি প্রমাণ করেছি যে পঞ্চম
অধ্যায়ের দুটো আহ্নিক, দুজন লিখেছে এবং তারা প্রথম অধ্যায়ের রচয়িতা থেকে ভিন্ন, আর
প্রথম অধ্যায়ে অন্যুন দুটো প্রক্ষেপ দুজন লেখক দুই পৃথক উদ্দেশ্যে এনেছেন। চতুর্থ অধ্যায়েরও
দ্বিতীয় আহ্নিক অদ্ভুত মনে হয়, কেননা এতে তত্ত্বজ্ঞান নিয়ে আলোচনা হয় যখন নাকি তত্ত্বজ্ঞান
পারিভাষিক শব্দ নয়; আরো অদ্ভুত যে আলোচনাটা হয় তত্ত্বজ্ঞানের উন্নতি নিয়ে। আমার মনে
হয়, গ্রন্থটিকে ন্যায্যভাবেই আমি জোড়াতালি বলেছি। কিন্তু যদি সূত্রসমূহ জোড়াতালি হয়,
সেই জোড়াতালিকে সমজাতিক পূর্ণতায় পেশ করা অত্যন্ত কঠিন কাজ। তাই এবার দেখা যাক বাৎস্যায়ন
কীভাবে নিজের কাজটা করেছেন।
কী করতে তিনি প্রবৃত্ত
হয়েছেন সে ব্যাপারে বাৎস্যায়ন সচেতন ছিলেন। তিনি জানছিলেন যে তিনি এমন একটি গ্রন্থের
পারমার্থিক গুরুত্ব দেখাতে চলেছেন যেটি ঠিক পারমার্থিক নয়। কিন্তু তাঁর কোনো দ্বিধা
নেই, কোনো অর্থবৈকল্য নেই, তিনি সোজাসুজি বলেন এটি একটি পারমার্থিক বিজ্ঞান কিন্তু
বিশুদ্ধ পারমার্থিক নয়। তিনি বলেন – সেয়ং আন্বীক্ষিকী
প্রমাণদিভিঃ পদার্থৈর বিভজ্যমানা – প্রদীপঃ
সর্ব্ববিদ্যানামুপায়ঃ সর্বকর্মণাং । আশ্রয়ঃ সর্ব্বধর্মাণাং বিদ্যোদ্দেশে প্রকীর্ত্তিতাঃ
।। তদিদং তত্ত্বজ্ঞানং নিঃশ্রেয়সাধিগমার্থং যথাবিদ্যং বেদিতভ্যং। ইহ ত্বধ্যাত্মবিদ্যায়াং
আত্মাদিতত্ত্বজ্ঞানং নিঃশ্রেয়সাধিগমোপবর্গ-প্রাপ্তিঃ।
“যেমন বিদ্যোদ্দেশ শীর্ষক অধ্যায়ে বলা হয়েছে,
প্রমাণ এবং অন্যান্য পারিভাষিক শব্দে বিভাজিত এই বিজ্ঞান, আন্বীক্ষিকী, সমস্ত বিজ্ঞানের
প্রদীপ হয়, সব আরব্ধ কর্মের সাধন হয়, এবং সমস্ত নিয়মের আশ্রয় হয়”। (অথবা কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে বিদ্যাসমুদ্দেশ)। “সুতরাং, শাস্ত্র (তোমার অধ্যয়ন) অনুযায়ী প্রকৃত জ্ঞানের উদ্দেশ্য
সর্বাধিক মঙ্গল। কিন্তু এই পারমার্থিক বিজ্ঞানে প্রকৃতজ্ঞান আত্মা ইত্যাদি, এবং সর্বাধিক
মঙ্গল মুক্তি।”
তিনি সাহসের সঙ্গে
ঘোষণা করেন যে শাস্ত্রটির একমাত্র উদ্দেশ্য পারমার্থিক শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন, কিন্তু তার
সঙ্গে তিনি এটাও বলেন যে অন্যান্য বিজ্ঞানের আচার্য্যেরাও এর দ্বারা লাভবান হতে পারে
(প্রথম সূত্রের ভাষ্য, শেষের দিকে)। অন্য এক জায়গায় তিনি বলেন, “সন্দেহ প্রভৃতিকে পারিভাষিক শব্দ হিসেবে গ্রহণ করে ন্যায়-বিদ্যা
এক নতুন পথ আবিষ্কার করেছে। যদি আলাদা করে ওই পারিভাষিক শব্দাবলী নিয়ে চর্চা না করা
হত, গ্রন্থটি উপনিষদসমূহের মত নিছক পারমার্থিক বিজ্ঞান হয়ে থেকে যেত” (পৃ. ৪, জীবানন্দের সংস্করণ)। সন্দেহ এবং বাকি পারিভাষিক শব্দগুলোর
স্বতন্ত্র সংক্ষিপ্ত বর্ণনা না থাকলে, – যেমনটা হওয়া
উচিৎ ছিল – দ্বিতীয় পারিভাষিক শব্দ প্রমেয়-র অন্তর্ভুক্ত
হয়ে থাকলে, এই বিজ্ঞানটা নিছক অধ্যাত্ম-বিদ্যা হত।
তত্ত্বজ্ঞান, তিনি
পরিভাষিত করেন – সৎ সৎ ইতি গৃহ্যমাণং যথভূতম অবিপরীতং তত্ত্বং
ভবতি। অসৎ চ অসৎ ইতি গৃহ্যমাণং যথভূতম অবিপরীতং তত্ত্বং ভবতি।
“যখন কোনো সত্তাকে সত্তা রূপে, যেমন আছে তেমন
গ্রহণ করা হয়, বিরোধিতা না করা হয়, সেটা ঐ, তত্ত্ব, এবং যখন অ-সত্তাকে (অবিদ্যমানকে)
অ-সত্তা রূপে, যেমন আছে তেমন গ্রহণ করা হয়, সেটাও তত্ত্ব।” কথাটা এত বেশি রকম বৌদ্ধ তথতা-র মত। দ্বিতীয় উদ্ধৃতিতেও
বৌদ্ধমতের গন্ধ আছে – হেয়ং তস্য নিবর্ত্তকং
হানম আত্যয়িতিকং তস্যোপায়ো ধিগন্তব্যাঃ ইত্যেতানি চত্বারি অর্থপদানি। সম্যক বুদ্ধ্বা
নিঃআরেয়সমধিগচ্ছতি।
এটা কি চার মহৎ সত্যের
অনুরূপ নয়? –
“যে ধর্মা হেতুপ্রভবা হেতুং তেশাং তথাগতোহ্য
বদৎ ; তেসাঞ্চ যো নিরোধো এবম বাদী মহাঞশ্রমণঃ,” এবং মহাযান
এবং পালি বৌদ্ধমতের ‘দুক্খম’, ‘দুক্খ-সমুদয়ো’, ;দুক্খ-নিরোধো’ এবং ‘দুক্খনিরোধগৈমিনি পটিপত’? এমনকি বাৎস্যায়নও,
যিনি ন্যায়শাস্ত্রকে ব্রাহ্মণবাদী এবং সনাতনপন্থী অধ্যাত্মবিদ্যা বানিয়েছেন, বৌদ্ধমতের
কাছাকাছি চলে আসেন। ন্যায়শাস্ত্র প্রমাণ-এর, সাক্ষ্যের মাধ্যমে প্রমেয়-র,
বিষয়ীগত এবং বিষয়গত জ্ঞানের বিষয়বস্তুর প্রতিপাদন চায়। বৌদ্ধরা বলে তোমরা নিজেদের প্রমাণগুলো
প্রতিষ্ঠা করবে কীভাবে? ন্যায়সূত্র বলে বাতির মত, তারা নিজেরাই নিজেকে আলোকিত করে।
নাগার্জুন তাঁর একটি রচনায় বলেন, “না, বাতি
অন্ধকারে অন্যান্যদের আলোকিত করতে পারে, নিজেকে নয়।” (উই, ভূমিকা, পৃ ৫)। এই কথা দর্শায় যে নাগার্জুনের সময় ন্যায়সূত্রের
পর। কিন্তু ন্যায়সূত্র নাগার্জুনের শূন্যবাদকে আক্রমণ করে এবং তাই, মি. উই নিষ্পত্তি
করেন যে সূত্র এবং নাগার্জুন অবশ্যই সমসাময়িক হবেন তাই একে অন্যের খণ্ডন করেন। নিজের
দিক থেকে মি. উই ঠিক। কিন্তু আমি প্রমাণ করেছি যে পুরো সূত্র-গ্রন্থটি একজনের রচনা
নয়, ন্যূনপক্ষে, ভিন্ন ভিন্ন ছয় কালখণ্ডে ছয়জনের রচনা। নাগার্জুন প্রথম দিকের কোনো
রচনার খণ্ডন করতে পারেন – যেমন, যে রচনায়
প্রথম অধ্যায়টা ছিল কিন্তু প্রক্ষেপগুলো ছিল না, দ্বিতীয় ও তৃতীয় অধ্যায়ের অধিকাংশ
ছিল। কিন্তু আমার আশঙ্কা যে চতুর্থ অধ্যায় যাতে শূন্যতা এবং বাহ্যার্থভঙ্গ
নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে, একই লেখকের রচনা নয়। সে অধ্যায়টা নাগার্জুনের পরের হতে পারে,
কেননা ঐ অধ্যায়ে ঈশ্বরকারণিক-এর মত পরবর্তী তত্ত্বেরও খণ্ডন রয়েছে। যেহেতু বিভিন্ন
মানুষের কাজ তাই রচনাটির সালতারিখ স্থির করা নিরর্থক। এটুকু বলা যথেষ্ট যে পুরো গ্রন্থটি
খ্রিষ্টপূর্ব ২০০ থেকে খ্রিষ্টাব্দ ৩০০র মধ্যে সঙ্কলিত।
আর তাই এখন আমি ভারতের
দার্শনিক সাহিত্যে বাৎস্যায়নের অবদানের কথা বলতে চাইব। বিশাল পরিমাণ ভাসমান দার্শনিক
জল্পনা-কল্পনা থেকে আহরিত বিভিন্নধর্মী উপাদানে গঠিত সূত্রসমূহকে তিনি সমধর্মী পূর্ণতায়
বাঁধলেন এবং প্রায় ১৬০০ বছর ধরে স্থায়ী একটা চারিত্রিক বৈশিষ্ট ও সঙ্গতি দিলেন। একদিকে
তিনি প্রণালীটিকে, নাগার্জুন এবং দেব-এর মত চরম ভাববাদী মহাযান বৌদ্ধদের আক্রমণ থেকে
রক্ষা করলেন এবং অন্য দিকে ব্রাহ্মণদের চরম সনাতনপন্থী দার্শনিক চিন্তাধারার প্রবক্তাদের
আক্রমণ থেকে রক্ষা করলেন। শূন্য থেকে বিশ্ব জন্ম নিয়েছে আর যা কিছু আমরা বাইরে দেখি,
চিত্তে থেকে যাওয়া ছাপ ছাড়া তাদের আর কোনো বাস্তবতা নেই, ধ্বনি চিরন্তন, বেদ চিরন্তন,
এবং বিশ্ব চিরন্তনও নয় ক্ষণস্থায়ীও নয় ইত্যাদি – এধরণের তত্ত্বের বিরুদ্ধে তাঁর কান্ডজ্ঞান বিদ্রোহ করল। চরমপন্থীদের
মাঝে তিনি পৌরুষের সঙ্গে দাঁড়ালেন, দুহাতে দু’তরফেরই চরমপন্থীদের
পথ রুদ্ধ করলেন এবং কান্ডজ্ঞানকে প্রতিষ্ঠিত করলেন। তিনি বেদের সত্যতা প্রমাণিত করলেন
– ধ্বনি চিরন্তন ঘোষণা করে নয়, সাধারণভাবে,
কেননা দ্রষ্টা এবং কথকেরা নির্ভরযোগ্য মানুষ ছিল। ঠিক যেমন আপনারা নিজেদের চিকিৎসক
আর ডাক্তারদের ওপর ভরসা করেন তেমনই ঋষিদের ওপর ভরসা করুন। তাঁরা নিয়মনীতি দেখেছেন এবং
কী করনীয় আর কী অকরনীয়, সে বিষয়ে পরামর্শ ও নির্দেশ দিতে তাঁরা সর্বাধিক উপযুক্ত। কিন্তু
বাৎস্যায়নের সবচেয়ে বড় অবদান ব্যক্তিগত ঈশ্বর এবং নৈতিক নিয়ন্তা হিসেবে ঈশ্বরের প্রতিষ্ঠা।
সে ঈশ্বর ক্রোধী নয়, হিতৈষীও নয়, কর্ম অনুসারে সে পুরস্কার দেয় এবং করুণা সহকারে ন্যায়
প্রদান করে। এটা বাৎস্যায়নের নিজের কাজ, কেননা সূত্র ঈশ্বরে বিশ্বাস করে না। যদি আলাদা
করে পুরস্কার-সংক্রান্ত বিভাগটা পড়া হয়, মনে হবে ন্যায়সূত্র নিরীশ্বর, অর্থাৎ ঈশ্বরহীন।
কিন্তু বাৎস্যায়ন সূত্রগুলোর ব্যাখ্যা অন্যভাবে করেন। পারিভাষিক শব্দগুলোতে কোথাও ঈশ্বর
নেই। কিন্তু তিনি বলেন সেখানে আত্মা আছে, এবং এই আত্মাগুলোর একটি ঈশ্বর, আটটি অপার্থিব
শক্তির অধিকারী; তিনি ন্যায়পরায়ণতায় পূর্ণ,
প্রকৃত জ্ঞানে পূর্ণ এবং চিত্তের একাগ্রতায় পূর্ণ। তিনি যা কিছু চান করতে পারেন, মানুষ
এবং প্রকৃতির শক্তিসমূহের নিজস্ব ক্রিয়াকলাপের আভ্যন্তরীণ গঠনপ্রণালীগুলোকে তিনি সক্রিয়
করে তোলেন। তিনি জীবের পিতা, তিনি দ্রষ্টা, সর্বশক্তিমান ও সর্বজ্ঞ। তিনি সমস্ত জীবের
অনুধাবনের অতীত। পরবর্তী সাহিত্যে তিনি শিব এবং তাই হরিভদ্র বলেন –
“অক্ষপাদনায়ে দেবো সৃষ্টি সংহারকৃত শিবঃ
বিভুর্নিতৈকসর্বজ্ঞো
নিত্যবুদ্ধিসমাশ্রয়ঃ।”
এবং নৈয়ায়িকদের জন্য
বর্তমানেও শিব পূজনীয়।
অধ্যাত্মবিদ্যায়
এবং ধর্মে বাৎস্যায়নের অবদান অবশ্যই মহান। কিন্তু আলোচনা বা বিচার-এর নিয়মাবলীকে
নিয়ন্ত্রণ করার ব্যাপারেও তাঁর অবদান কম মূল্যবান নয়। তাঁর ভাষ্যে তিনি যে কার্যধারা
স্থির করে দিয়ে গেছেন তা আজও সমস্ত হিন্দু আদালতে এবং বিবাদে অনুসৃত হয়। পর্ষদের জায়গায়
মধ্যস্থ বসে এবং দুদিকের কথা শোনে, তার ধার্য্য নিয়ম অনুযায়ী দুপক্ষের যুক্তির তুলনা
করে এবং সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। নিয়মগুলোও সেই এক। অনুমান-এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিষ
হল অনুমানবাক্য নির্দ্ধারণ এবং ন্যায়-সূত্র বলে তার দুটো অঙ্গ থাকা উচিৎ। যদিও কিছু
মানুষ দুটো অঙ্গের কথাটা বাদ দিয়ে তিনটে অঙ্গের কথা বলে। ফলে অনেকে ভাবে যে হিন্দুরা
তাদের অনুমানবাক্য নির্ধারণের ছাঁদটা এ্যারিস্টটল থেকে নিয়েছে যিনি খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ
শতকে ছিলেন। কিন্তু এই ধারণা ভুল। কেননা অনুমানবাক্যের অঙ্গ বা অংশের সংখ্যা একসময়
দশ ছিল। সেটা বাৎস্যায়নই বলেন, অবয়ব সূত্রের ওপর তাঁর ভাষ্যে (I, i, ৩২)। তিনি সেগুলোর
নাম ও কাজও বলেন। এটাও বলেন যে পরবর্তীতে সেগুলো অনাবশ্যক প্রতিপন্ন হল। মি. উই তাঁর
মুখবন্ধের পৃ. ৮৩তে একটি নোটে বলেছেন যে ভদ্রবাহু, যিনি খ্রিষ্টপূর্ব ২৯৩এ মারা গেছেন,
এক ধরণের অনুমানবাক্যের কথা বিশদে জানিয়েছিলেন যার দশটি অঙ্গ ছিল। সেই দশটি পরবর্তী
সমালোচনায় কমে পাঁচটি হয়েছিল। কাজেই ভারতীয়রা তাদের অনুমানবাক্য-নির্দ্ধারণ-পদ্ধতি
গ্রীকদের থেকে স্বতন্ত্র বিকশিত করেছিল। বাৎস্যায়নের তীব্র সমালোচনা করেছেন দিঙনাগ,
খ্রিষ্টাব্দ পঞ্চম শতকের মাঝামাঝি, অতএব নিশ্চয়ই তিনি দিঙনাগের কিছু আগে ছিলেন পৃথিবীতে।
তাই, হিন্দুদের তর্কশাস্ত্রে,
অধ্যাত্মবিদ্যায় এবং ধর্মে বাৎস্যায়নের অবদান অমুল্য।
……………………………………