Monday, April 29, 2024

হে মার্কেট স্কোয়্যার – সেদিন আর আজ

‘মে দিবসের ইতিহাস’ বলতেই সবচেয়ে আগে ১৮৮৬ সালে যুক্তরাজ্য আমেরিকার শিকাগোর ঘটনাগুলো চোখের সামনে চলে আসে। আর সে ঘটনাগুলো মোটামুটি অনেকেই জানে। কিছুটা আমিও জানতাম এবং তাই কৌতূহল জেগেছিল জানার যে সেই হে-মার্কেট স্কোয়্যারটা কী হলো? আছে, তেমনই? কোনো স্মারক নিশ্চয়ই তৈরি হয়েছে! কেমন দেখতে সেই স্মারকটা? এই সব ভাবতে ভাবতেই ইন্টারনেট ঘাঁটতে শুরু করেছিলাম আট বছর আগে। যা পেয়েছিলাম সে তথ্যগুলো একটা হিন্দি লেখায় সাজিয়ে ট্রেড ইউনিয়নের বন্ধুদের দিয়েছিলাম। সে লেখা থেকে মে-দিবস এবং আট ঘন্টা কাজের দিনের জন্য লড়াই ইত্যাদি প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে শুধু হে-মার্কেটের কথা যেটুকু জানতে পেরেছি সেটুকু বলছি।

বলার কারণ, স্মৃতি রক্ষা করা আজ অনেক বড় একটা বৈপ্লবিক দায়িত্ব। উত্তর-সোভিয়েত যুগের লুটেরা আন্তর্জাতিক পূঁজি যেমন যেমন সঙ্কটের সম্মুখীন হচ্ছে, মানব সমাজে আরো একটা দিনও অস্তিত্বে থাকার ন্যূনতম বৈধতা হারিয়ে ফেলছে তাদের পূঁজিবাদ, তেমন তেমন তারা প্রত্যেকটি দেশের প্রতিক্রিয়ার সবচেয়ে নিচুতলার শক্তিগুলোকে শাসকশক্তি হিসেবে বসাবার উদ্যোগ নিচ্ছে – আর সেই উদ্দেশ্যে গড়ে তুলছে ইতিহাসহত্যাকারী বিকৃত আখ্যানসমূহ।

মানুষের দেড় শতাব্দীর বৈপ্লবিক ইতিহাসের বহু স্মৃতিচিহ্ন আছে রোজকার চলার পথের আশে পাশে। সেগুলো তাদের বিকৃত আখ্যানকে সত্য বলে প্রচারে বাধা সৃষ্টি করে। তাই সেই স্মৃতিচিহ্নগুলো লোপাট করার ষড়যন্ত্র চলে প্রতিদিন। লেনিনের মূর্তি ভাঙা হয়, আম্বেদকর ও পেরিয়ারের মুর্তি ভাঙা হয়। জালিয়াঁওয়ালাবাগের দেয়ালে গুলির দাগ মুছে ফেলা হয়। রবীন্দ্রচৌককে হঠাৎ একদিন অটলচৌক করার প্রস্তাব নেওয়া হয়। যেটা আমাদের স্মৃতিতে উজ্জ্বল এক চৌমাথা, অনেক ঘটনার সাক্ষী, পথনির্মাণ বিভাগের হঠাৎ নেওয়া প্রস্তাবে তার ওপর দিয়ে উড়ালপুল নিয়ে যাওয়ার সময় চৌমাথাটা নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়। অনেক দিন পরে কারো খেয়াল হয়, আরে ওখানে একটা স্মৃতিফলক ছিলো না? কোথায় গেলো? … অনেক গানের কথা হারিয়ে গেছে, সুর হারিয়ে গেছে, গাইতে জানা মানুষ হারিয়ে গেছে … আন্তর্জালিক তথ্যের ভিড়ে চাপা পড়ে গেছে এমনকি অনেক বোধ, রোমাঞ্চ, বিস্ময়!

আর তাই, স্কুল বইয়ের পাতায় যেমন, আশে পাশের মাটিতেও তেমন, এক একটি স্মৃতি ও স্মৃতিচিহ্ন রক্ষা করা আজ অনেক বড় একটা বৈপ্লবিক দায়িত্ব। হে-মার্কেট স্কোয়্য্যারের স্মৃতি নিয়ে সংগ্রামের কথায় আসার আগে বলে নিই শহীদদের সমাধিতে স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন করারও একটা লড়াই ছিলো।

শহীদদের মৃতদেহ কবরস্থ করা হয় ১৮৮৭তে। তার ছয় বছর পর ১৮৯৩এ তৈরি হয় স্মৃতিস্তম্ভ। তাও সরকারি নয়, শহীদদের পরিবারবর্গকে সাহায্য করার জন্য তৈরি হওয়া এক নাগরিক সংগঠন উদ্যোগ নেয়। শ্রমিক ও সহানুভুতিশীল নাগরিকদের মাঝে চাঁদা তুলে অ্যাালবার্ট ওয়েইনার্ট নামে এক ভাস্করকে দিয়ে তৈরি করানো হয় স্মৃতিস্তম্ভটি, যার নিচে লেখা আছে, কোর্টে স্পাইসের সেই বিখ্যাত উক্তি, “সেদিন আসবে, আজ যে কন্ঠস্বরগুলোকে তোমরা রোধ করছো, তার চেয়ে বেশি শক্তিশালী হবে সে কন্ঠগুলোর নীরবতা” (The day will come when our silence will be more powerful than the voices you are throttling today)।

হে-মার্কেটের ঘটনায় মামলার রায় বেরুবার পর থেকেই সারা আমেরিকায় ও ইয়োরোপে অভিযোগের ঝড় উঠেছিলো যে মামলা সাজানো হয়েছে, অভিযুক্তদের সঙ্গে ন্যায় করা হয় নি। মামলা যে ষড়যন্ত্র ছিলো সে আভাস খোদ ১৮৯৩এর স্মৃতিস্তম্ভের পিছনেই লেখা আছে। পিছনে শহীদ ও জেলে মৃতদের নামের সূচির নিচে তখনকার ইলিনইস (শিকাগো ইলিনইস রাজ্যেরই শহর) গভর্নর জন পিটার আল্টগেল্ডের উক্তি উদ্ধৃতঃ

“এই অভিযোগগুলোর প্রকৃতি ব্যক্তিগত, এবং সেকথাটার আভাস আমার সামনে রাখা কাগজপত্রে আর মামলার বিবরণীতে থাকায় বোঝা যায় সে মামলাটা ন্যায্য ছিলো না। তবুও আমি ঐ মামলার বৈশিষ্টগুলো নিয়ে আর আলোচনা করতে চাই না, কেননা তার প্রয়োজন নেই। আমি নিশ্চিত যে আগে বলা কারণ অনুসারে পদক্ষেপ নেওয়া আমার কর্তব্য। আর তাই স্যামুয়েল ফিল্ডেন, অস্কার নীবে আর মাইকেল শোয়াবকে আজ ২৬শে জুন ১৮৯৩এ আমি সম্পূর্ণ মার্জনা প্রদান করছি।”

মজার কথা, এত সব সত্ত্বেও সরকারের তরফ থেকে সেখানে কোনো ফলক লাগানো হলো না। সেটা লাগাতে পেরিয়ে গেলো প্রায় একশো বছর। ১৯৯৭ সালে এই হে-মার্কেট শহীদ স্মারক ইউএস ন্যাশনাল পার্ক সার্ভিসের হিস্টোরিক ল্যান্ডমার্ক ঘোষিত হলো। তখন সেখানে বসানো হলো সে-সম্পর্কিত ফলক।

কিন্তু কীভাবে হলো?

আসুন, গোরস্তান থেকে বেরিয়ে আগে শহরে হে-মার্কেট স্কোয়্যারে গিয়ে পৌঁছোই।

আপনারা জানেন যে যুক্তরাজ্য আমেরিকার, পূঁজিবাদের আগের কোনো ইতিহাস নেই। আগের যে ইতিহাস, সেটা সাধারণ মানসে এখনো এতদূর অব্দি অস্বীকৃত যে মার্লন ব্রান্ডোর মতো বড়ো মাপের অভিনেতাও তাতে লজ্জিত হন, অস্কার আনতে নিজে না গিয়ে রেড ইন্ডিয়ানদের প্রতিনিধি এক মহিলাকে পাঠিয়ে দেন, আর তার মুখ দিয়ে মঞ্চে পড়ান তাঁর লিখিত ক্ষুব্ধ বয়ান। এবং নানান ভূরাজনৈতিক কারণে আমেরিকার পূঁজিবাদ উনিশ শতকের শেষে একটা বেশ স্বচ্ছন্দ বিকাশের নকশা দিতে থাকে। তাই পূঁজিবাদের মুক্ত দানবশক্তি হে-মার্কেট মামলার রায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোটাকেই একটা নৈতিক অপরাধ সাব্যস্ত করে, ইলিনইসের গভর্নর আল্টগেল্ডের বিরুদ্ধে নির্বাচন প্রচারে কাজে লাগায়। পূঁজিপতিদের সমর্থক প্রশাসনের বক্তব্য প্রথম থেকেই ছিলো যে ১৮৮৬ সালের ৪ঠা মে, হে-মার্কেট স্কোয়্যারে, কয়েকজন ‘নৈরাজ্যবাদী’ জমা হয়েছিলো। তারাই বোমা ফেলেছিলো, তারাই দাঙ্গা করেছিলো যার পরিণামে ‘অসহায়’ এক পুলিসকর্মী শহীদ হয়। তাই হে-মার্কেট স্কোয়্যারের মাঝে, এক পুলিসের ৯ ফুট উঁচু ব্রোঞ্জের প্রতিমা বসিয়ে দেওয়া হলো। প্রতিমা তৈরি করানোর পয়সা দিলো কারখানামালিকদের ইউনিয়ন লীগ ক্লাব,আগামি ৪১ বছর অব্দি ঐ প্রতিমা ওখানেই দাঁড়িয়ে রইলো।

কিন্তু যতোই এ্যাটলান্টিকের ওপারে থাকো, পূঁজিবাদের সঙ্কট তোমায় ধরেই ফেলবে। যতোই গুন্ডা আর পিঙ্কারটন গার্ড লাগিয়ে শ্রমিক আন্দোলনকে বুটের তলায় পিষে ফেলো, কম্যুনিস্ট, সোশ্যালিস্টদের বিরুদ্ধে পূঁজিবাদী ঘুষে পোষা মিডিয়া আর মধ্যশ্রেণীকে লেলিয়ে দাও, শেষ অব্দি পার পাবে না। মানুষের ভিতরের রাগ, ঘেন্না কোনো না কোনো রকম ভাবে বেরুবেই।

১৯২৯এর মহামন্দার দুবছর আগে, ৪ঠা মে ১৯২৭এ (তারিখটা লক্ষ্য করবেন) একটা ট্রামগাড়ি নিজের লাইন থেকে লাফিয়ে নেমে বেরিয়ে পুলিসের প্রতিমাটাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিলো। চালক গ্রেপ্তার হলো। নির্বিকার! একবারও বললো না যে ব্রেক ফেল করেছিলো, বা স্টিয়ারিং পিনে গলদ ছিলো বা ভুল হয়ে গেছে মাপ করবেন হুজুর! কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে নির্বিকার ভাবে বললো, “হাত উঁচিয়ে থাকা পুলিসটাকে দেখতে দেখতে বমি পেতো রোজ।”

১৯২৮ সালে পুলিস বিভাগ প্রতিমাটা আবার তৈরি করালো কিন্তু এবারে আর হে-মার্কেট স্কোয়্যারে বসালো না, ইউনিয়ন পার্কে রেখে দিলো। ১৯৫০এর দশকে এসে গেলো উড়ালপুলের জমানা। পুরোনো হে-মার্কেট স্কোয়্যারের আদ্ধেক অংশে খাম্বা বসিয়ে বেরিয়ে গেলো কেনেডি এক্সপ্রেসওয়ে। সেই সুযোগে ইউনিয়ন পার্ক থেকে পুলিসের মুর্তিটা উঠিয়ে আবার ঐ হে-মার্কেট স্কোয়্যারে (বেঁচে থাকা অংশটায়), এক্সপ্রেসওয়ের লাগোয়া একটা বেদি তৈরি করে বসিয়ে দেওয়া হলো।

১৯৬৮ সালে পুরো যুক্তরাষ্ট্রে ভিয়েতনাম যুদ্ধে সৈন্য-হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ সমাবেশ চলছিলো। সে বছর, ঠিক ঐ ৪ঠা মে-তেই, অর্থাৎ হে-মার্কেটের ঘটনার ৮২তম বাৎসরিকে, পুলিস আর বিক্ষোভকারীদের মধ্যে হাতাহাতির সুযোগে কেউ গিয়ে প্রতিমাটায় কালো রঙ মাখিয়ে দিয়ে এলো। আবার পরের বছর, অর্থাৎ ৬ই অক্টোবর ১৯৬৯ তারিখে কে বা কারা যেন, প্রতিমাটার হাঁটুর মাঝে বোমা ফাঁসিয়ে, প্রতিমাটা উড়িয়ে দিলো। পরে এক বামপন্থী সংগঠন ঘটনাটার দায় নিলো।

এবার আবার ঠিক ঐ ৪ঠা মে-তেই, ১৯৭০ সালে নতুন প্রতিমা বানিয়ে বসানো হলো। কিন্তু দুদিন পর, ৬ই মে-তে, সেই আগের সংগঠনটাই, ঐ একইভাবে বোমা ফাঁসিয়ে প্রতিমা উড়িয়ে দিলো।

প্রতিমা আবার তৈরি হলো। আবার বসানো হলো। স্থানীয় মেয়র সাহেব এবার ২৪ ঘন্টা পুলিশ পাহারা লাগিয়ে দিলো। কিন্তু শেষে ক্লান্ত হয়ে পুলিস কর্তৃপক্ষ প্রতিমাটাকে উঠিয়ে সেন্ট্রাল পুলিস হেডকোয়ার্টার্সের উঠোনে বসিয়ে দিলো, ১৯৭৬এ সেটা চলে গেলো সেন্ট্রাল পুলিস আকাডেমিতে।

১৯৯২ সালে একটা নতুন ব্যাপার হলো। বোধহয় সোভিয়েত ইউনিয়নে ও পূর্ব ইয়োরোপে সমাজবাদকে পরাজিত করতে পারার আনন্দে সরকার শ্রমিকদের কিছু একটা দিয়ে নিজেদের বদান্যতা দেখাতে চাইছিলো। তাই হে-মার্কেট স্কোয়্যারের ঠিক সেই জায়গাটায় যেখানে শ্রমিক নেতারা একটা হাতগাড়ির ওপর দাঁড়িয়ে ভাষণ দিয়েছিলো, একটা কাংস্যফলক লাগানো হলো। তাতে লেখা হলো, “শ্রম আর শিল্পের মাঝে এক দশক ধরে চলতে থাকা কলহের পরিণামে এখানে সাক্ষাৎ যুদ্ধ হয় যাতে শ্রমিক ও পুলিস, দুয়েরই মৃত্যু হয়। ৪ঠা মে ১৮৮৬ সালে ক্রেনের গলির মুখে শ্রমিক সমাবেশে শ্রোতারা একত্রিত হয়েছিলেন। দ্য প্লেইন স্ট্রিট ধরে আসতে থাকা পুলিসবাহিনীর ওপর গলির দক্ষিণ দিক থেকে আক্রমণ করা হয়। পরিণামে আটজন কর্মীর ওপর মামলা চলে। সেই মামলা পুরো বিশ্বের শ্রমিক আন্দোলনের নজর কাড়ে। ফলে অনেক শহরে ‘মে-দিবস’এর শ্রমিক সমাবেশ শুরু হয়।” [২৫শে মার্চ ১৯৯২ সালে মেয়র রিচার্ড এম ড্যালি কর্তৃক সমর্পিত]।

এই কাংস্যফলক বসানোর ১২ বছর পর, ১৪ই ডিসেম্বর ২০০৪এ, সেই মেয়র ড্যালি সাহেব, শিকাগো পুলিস ইউনিয়নের অধ্যক্ষ এবং অন্যান্য সঙ্ঘের নেতাদের হাতে, হে-মার্কেট স্কোয়্যারের ঐতিহাসিক স্থানে ব্রোঞ্জের এক স্মারক প্রতিমার অনাবরণ হলো। সেই স্মারক-প্রতিমা একটা হাতগাড়ি, যার ওপর দাঁড়িয়ে এক শ্রমিক নেতা ভাষণ দিচ্ছে, আরো দুজন পাশে দাঁড়িয়ে। আরেকজন প্রায় হামাগুড়ির অবস্থায়, নিচের ভিড়কে কিছু বোঝাচ্ছে। নিচে, মাটি থেকে আদ্ধেক বেরুনো চারজন, তারা হাতের জোরে হাতগাড়িটাকে সোজা করে রেখেছে কেননা গাড়ির পেছনের চাকাদুটো মাটিতে নেই। – অবশ্যই কিছুটা বিমূর্ত, আমার বিশেষ পছন্দও নয়। আমাদের দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরি থাকতে এসব পছন্দ করতে যাবো কেন? তবুও, মেরী ব্রগারের তৈরি করা এই প্রতিমা স্থাপনের পর, হে-মার্কেট স্কোয়্যার অন্ততঃ তার ইতিহাস ফিরে পেয়েছে।

ওখানে এখন একটা শ্রমিক পার্ক প্রস্তাবিত, যে পার্কের ভিতরে একটি আন্তর্জাতিক স্মৃতি-প্রাচীর গড়ে তোলা হবে, ভিতরের হাঁটাপথের পাশে পাশে ফলক থাকবে, একটা উঁচু সাংস্কৃতিক মিনার থাকবে ইত্যাদি ইত্যাদি। এতো পরিচিত মানুষ শিকাগো যায়, ফেসবুকে ছবি আপলোড করে, কাউকে হে-মার্কেট স্কোয়্যারের কোনো ছবি পোস্ট করতে দেখি নি। যাই হোক, ভালো লাগে ভাবতে, আট ঘন্টা কাজের দিনের লড়াই, মে-দিবসের লড়াইয়ের ঐতিহাসিক স্মৃতিকে শেষ পর্য্যন্ত ধরে রাখতে পেরেছে আমেরিকার শ্রমিক শ্রেণী এবং বিবেকসম্পন্ন মানুষেরা।       

Saturday, April 20, 2024

উত্তরাধিকার

এমনও থাকে কিছু ব্যথা,
কাটিয়ে উঠতে ইচ্ছে করে না
যেন একটু খুঁড়িয়ে চলাই আমার
নায়কোচিত চলন, অন্ধকার ফুঁড়ে ঢুকে
ভীতিসঞ্চার করি খলনায়কের অহমিকায়
দুধাপ সিঁড়ি বেয়ে নেমে
পাশে দাঁড়ানো বাচ্চাটার ঝাঁকড়া চুলে
বুলিয়ে হাত
প্রেয়সীর গলির দিকে উঠে যাই
ক্যামেরা পিছু নেয়
 
অনেক না-পাওয়া না-পারা আমার ব্যথার
উত্তরাধিকার
সে অসহায়তা চলবে
উত্তরাধিকার খোয়াবো না
যেমন লাহোরের পাড়ায় রাতে দশবাড়ির
জোড়াছাতে মায়েদের মজলিস
যেমন গোয়ালন্দের ভেজা জেটিতে কাদায়
পিছন থেকে ডাক
যেমন মৃত্যুর পাহাড়গুলো
 
যেমন সেদিন ওই বীভৎস মৃত্যু আসিফার
যেমন অন্যায়ের জনসভা প্রতিদিন
যেমন লাঞ্ছনার কীর্তিগান আসমুদ্রহিমাচল
 
অবসন্ন নই
বস্তুত এই খুঁড়িয়ে চলা, একটু হাঁপানো
বা হয়তো চোখের কালসিটে, ঘাড়ে কাটা দাগ
এসবকেই নায়কোচিত করে তোলার
অনুশীলন করছি ওদের প্রতিটি চিত্রনাট্যে
 
২০.৪.২৪

 

অবসাদ

অবসাদের যে কতো রূপ!
কয়েক বছর ধরে দেখছি পুরো পাড়াটার অবসাদ
গলির মুদির দোকানে জিনিষের
দাম হয়ে ঢুকছে!
আবার দেখলাম পাড়ার মন্দিরে
আশার উপদেষ্টা হয়ে বসছে অবসাদ।
চল্লিশ বছর আগে পাড়াটায় বিয়ে হয়ে আসা
অনেক বৃদ্ধার চোখে দেখেছি, সকালে,
মেন লাইনের প্যাসেঞ্জার ট্রেন হয়ে অবসাদ
পেরিয়ে যাচ্ছে পুরোনো মসজিদ, যাযাবর বস্তি।
আকাঙ্খাকে দেখেছিলাম সুন্দরী কিশোরী হয়ে
কোনো নতুন ভাড়াটে বাড়িতে ঢুকতে।
আজকাল তার ফেস-ওয়াশ হয়েছে অবসাদ।
কিছু বয়স্ক পুরুষাঙ্গসমষ্টি
নজরে রাখে তাকে। 
অবসাদ ভালোবাসাও হয় জানি।
কিছু রাত আগে সে আমায় 
আধ-কান্না আধ-সমকামী হয়ে টলতে টলতে
ধাক্কা মেরেছিলো।
এখনো খারাপ লাগে তাকে কাছে টানতে পারিনি।
 
১৯.৪.২৪

Wednesday, April 17, 2024

দর

পরিস্থিতি স্বাভাবিক মুনাফার দর!
অস্বাভাবিক বলতে, আরো বেশি দর!
মারি-খরা-বন্যা-যুদ্ধ! শুভ, শুভ, শুভ!
দরে রং ছড়ায়, রাষ্ট্র-মুকুট-কৌস্তুভ!  
জলজঙ্গলজমিতে মুনাফার রথ,
গ্রামসভা ভাঙে, পোষে আইনআদালত!
সংবাদে-সম্প্রচারে সময় স্বাভাবিক
বলার খেলায় ঘোরে বড় জয়স্টিক।

দেশ নাকি মা! ধর্মাতুঁড় করে আলো,
মাতৃধর্ষক করাল প্রজাতি জন্মালো!
নিজেদেরি গণতন্ত্র উলঙ্গ নামিয়ে
খুললো দাসবাজার স্বপ্নে ঠোনা দিয়ে!
আনন্দশিহরণ জাগায় উন্নয়নকথা
ঘেয়ো কোমরে বেড়ির স্বর্ণশীতলতা।
 
৬.৪.২৩

Monday, April 15, 2024

লেনিন আছেন

লেনিন আছেন প্রতিমুহূর্তে আমার তোমার পাশে,
লেনিন আছেন সময়টা নিয়ে সন্দেহে বিশ্বাসে,
মিছিলে এগোতে, মনে রাখি যেন, বুকের আড়ালে তাঁকে
নিয়ে পৌঁছোলে শুরু হবে ক্লাস সন্ধ্যার অবকাশে!
 
প্রথম প্রশ্ন তিনি করবেন, কোত্থেকে শুরু বলো।
মনে আছে তো, সোভিয়েতরাজ, প্রথম কিসে পিছোলো?
কঠিন যুদ্ধে ভুল ক্ষমাহীন! তবু সে বিশ্ব-নজির
নতুন শতকে কাজে চেতনার আঁধার গুঁড়িয়ে চলো!
 
যেমন মায়ের কোলে মুখ রাখা আদর চাওয়ার রীতি,
মানুষের পাশে বসা, দায় নয় মাথার, জীবনগীতি!
পৃথিবীকেই যে ধ্বংস করছে মুনাফাবাজির লোভ,
তার শাসনের শেষ চাই! সেটা বলবে কম্যুনিস্টই!
 
লেনিন আছেন শ্রমজীবীদের ঐক্য গড়ার তাড়ায়,
বিভ্রান্তির প্রত্যহে ভালো বন্ধুর কড়া নাড়ায়।

১৫.৪.২০২৪ 

 

Friday, April 12, 2024

বাবাসাহেব

জানি এটা ঠিক কবিতা নয়। মগজের খিল, তা' খুলবো! 
ব্যক্তিগত আমায় বলে নি কেউ – মগটা ছুঁবি না, হাত পাত্‌!
আম্বেদকরকে এমনকি সহ্য করতে বুক ফাটে ওদের!
ওই যারা পদবী লুকিয়ে বলে স্মার্ট  আমরা মানিনা জাত!
 
সমাজটা সোজা নয়; বিদ্যাসাগরী মাটিতেই, তবু স্বতন্ত্র
বিদ্যালয় খুললেন গুরুচাঁদ!  বুঝেছিলেন রবিঠাকুর!
নবোন্নয়ন কৌলিন্য খোঁজে, কুলগর্ব, বর্ণভেদ আম্বানির
লন্ডনে কেল্লার লোভ; হায়দ্রাবাদে ভেমুলার নিঃশ্বাসে ক্ষুর। 
 
ব্যানারের নিচে দেখে ভিড়, চৌখস মুখের, গুলিয়েছি দেশ।
দেরিতে পৌঁছেছি তার কাছে, মিছিলে যার মুখের প্রয়োজন!  
কাটিয়েছি একঘেয়েমি অনেক, ঐক্যগানে, তবু ঘনিয়েছে
জাত-ধনের মৌরসীপাট্টা ধরে  রামনামে কম্পানি-শাসন!
……
ভেবেছিলো ঢুকতেই দেবে না। যোগেন মন্ডলেরা ঢোকালেন।
মুক্তি না হোক, সংবিধানে তিনি যুদ্ধের কবচ বানালেন।  

১২.৪.২০২৪

আউটপোস্ট

সৈনিক সে!
তাকে ভালোবাসি!
যুদ্ধে এগোতে জানে
নিশ্চয়ই।
তবে তার চেয়ে অনেক
বড় সত্য, সে
শান্তি গড়তে জানে।
 
আটার র‍্যাশন নিয়ে
শিবিরে পৌঁছে
পুরোনো ভাঙা ফিল্ডগানের
গা থেকে খুলে আনে
দুটো স্টিলপ্লেট,
নদির জলে ধুয়ে
আউটপোস্টের পিছনের
পড়ন্ত বেলার দিকে তাকিয়ে
ভাবে,
একটা হল তাওয়া
আরেকটা হল চাকি
ভাঙা পাইপটা হোক
বেলন
দুটো পাথরের ফাঁকে
শুকনো কাঠে-ঘাসে
ধরানো আগুনে
তার রুটিতে ধরে রঙ;
 
ছুটির বেলায়,
\ঝাঁটার দুটো কাঠি দিয়ে
উল বোনে সে!
লড়াইগুলো থামে না;
অনুক্ষণ যোঝার স্পর্ধায়
প্রৌঢ়ত্ব খিলখিলিয়ে ওঠে
রোদে মায়ের ছোঁয়ায়
 
সে জানে, সে একা নয়।
কেউ একা নয়,
কোথাও।
 
ব্যাঙ্গালোর, ২০১৯