“এভাবে দেখো আমায়ঃ পথভোলা
অতিথি, লবণাক্ত ডানা ঝাপটে উড়তে উড়তে তোমার জীবনে এক মুহুর্তের জন্য ঢুকে পড়া এক
বিহঙ্গ – বাঁধা জীবনযাপনের সুখসুবিধেগুলোর অনভ্যাসে রূঢ় এবং ভূল করে চলা, ব্যাপ্ত
হাওয়া আর মহাশূন্যে বেড়ানো বিহঙ্গ।” জ্যাক লন্ডন
তার জীবনের চব্বিশতম বছরে, ওকল্যান্ড
থেকে ২১শে ডিসেম্বর, ১৮৯৯এ পাঠানো এক চিঠিতে সে এই কথাগুলোই আমায় লিখেছিল। শুধু
আমার জীবনের এক ছোট্ট মুহুর্তের নয়, লবণাক্ত ডানা ঝাপটে ওড়া এই বিহঙ্গ শাশ্বত-কালের
জীবনপথের পথিক। কেননা কে বলবে কবে পৃথিবী থেকে শেষ হবে সেই বিস্ময় ও সৌন্দর্য যার
নাম ছিল জ্যাক লন্ডন? কিভাবে ভুলবে কেউ যে তাকে একবার জেনেছে? আর জীবনই বা তাকে
ভুলবে কী করে যে জীবনেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল? সে ছিল যৌবন,
দুঃসাহস, রোমাঞ্চ। সে ছিল এক কবি এবং সমাজবিপ্লবী। বন্ধুত্ব গড়ার অসাধারণ প্রতিভা
ছিল তার। যেমন সে ভালোবাসতে পারতো তেমনই অফুরান পেতো ভালোবাসা। কিন্তু কিভাবে
শব্দে তার ব্যাক্তিত্বের সেই গুণটা ধরব যা তাকে সবার থেকে ভিন্ন করেছিল? কিভাবে
তার চৌম্বক-আকর্ষণ আর তার কবিপ্রকৃতি বোঝাবো কাউকে? পুরোনো দুনিয়ার লড়াই আর
যন্ত্রণায় বিকশিত সে ছিল সেই দুনিয়ার সমস্ত ভয়ানক ও দুর্বৃত্তমূলক কলঙ্ক থেকে
নির্যসিত শক্তি আর নৈতিক উৎকর্ষ। সে সেই গহ্বর থেকে বেরিয়ে এল যে গহ্বরে
তার প্রজন্মের এবং তার আগের প্রজন্মগুলোর লক্ষ লক্ষ মানুষ নৈরাশ্যে হারিয়ে গিয়েছে।
সে উঠল সেই গহ্বর থেকে, পালালো, জাতিসত্ত্বার
মত বড় হয়ে উঠতে আর সেই শক্তিগুলোর সাথে চিহ্নিত হতে যারা মানব-জাতির ভবিষ্যৎ
বদলায়।
তার জীবনের আদর্শ ছিল উঁচু। ধনসম্পদের
নানারকম আরাম আর সুবিধেগুলো, প্রতিভা, সামর্থ্য আর প্রণয়ের সুখ তার নাগালের মধ্যে
ছিল। নেপোলিয়ন আর নীৎশের কিছু অংশ ছিল তার মধ্যে, কিন্ত তার নীৎশেবাদী দর্শন
রূপান্তরিত হল সমাজবাদে – তার সময়ের আন্দোলনে – আর তার নেপোলিয়ন-ধাঁচের মেজাজের
জোর দিয়ে সে গড়ে তুলল এক অবিশ্বাস্য সফলতার ধারণা; তা অর্জন করার ইচ্ছাশক্তিও তার
ছিল। যেহেতু সংবেদনশীল আর আবেগময় ছিল তার প্রকৃতি, তাই লক্ষ্যের দিকে নিয়ে যাওয়ার
পথ থেকে সব রকমের বিচ্যুতি সে পরিহার করল। নিজের জীবনটাকে বিন্যস্ত করল। কী
প্রকান্ড উদ্যম, তবু সে নিজেকে বিশ্বাস করল না! নিয়মের দাস করল নিজেকে। আত্মশাসন, শৃংখলা
আর সংযম হল এই প্রাণবন্ত ও কামনাময় যুবকের ধর্ম। নিজের রোজকার খাটনি বাঁধল এক
হাজার শব্দ, লিখে সংশোধন করে টাইপ করা। বছরের পর বছর নিজের বরাদ্দ করে রাখল সাড়ে
চার ঘন্টা ঘুম; উষাকালে কাজ শুরু হত নিয়মিত। রাতে করত বিজ্ঞান, ইতিহাস আর
সমাজশাস্ত্রের গভীর অধ্যয়ন। এটাকে সে বলত নিজের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি অর্জন। সপ্তাহে
একদিন সে নিজেকে সঁপতো জীবনসংগ্রামে রত এক বন্ধুর কাজে। বিনোদন ছিল মুষ্টিযুদ্ধ,
অসিযুদ্ধ এবং সাঁতার। দারুণ সাঁতারু ছিল সে। অথবা জলযাত্রা – সে ছিল মাস্তুলের
সামনে দাঁড়ানো নাবিক – আবার অনেকটা সময় যেত তার ঘুড়ি ওড়ানোতেও; ঘুড়ির ভালো সংগ্রহ
ছিল তার কাছে। জোলার মত তার প্রথম প্রচেষ্টাগুলো ছিল কবিতা। নিঃসন্দেহে এটাই গোপন
রহস্য ছিল তার গদ্যের মিলটনোচিত সারল্যের, যে কারণে সে নিজের দেশের
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এবং সর্বোনএ শুদ্ধ ইংরেজি আর স্টাইলের স্বীকৃত মডেল হয়ে
উঠেছে। কবিতা লিখতে সে হামেশাই চাইত, কিন্তু প্রবাদানুসারে কবিরা অনাহারে থাকে –
যদিনা ভিন্ন কোনো উৎস থেকে আয় থাকে তাদের – তাই খ্যাতি আর ঐশ্বর্যপ্রাপ্তির দিনটি
অব্দি কাব্যলেখন স্থগিত রইল। খ্যাতি আর ঐশ্বর্য সে পেল এবং তা সে ভোগও করল এক
দশকেরও বেশি সময়, কিন্তু কবিতা লেখা স্থগিত রয়ে গেল, এবং নিজের কাছে করা এই শপথটা
মনে পড়ার আগেই মৃত্যু এসে পড়ল। আরো অনেক কিছু তার মনে পড়ার আগেই এসে পড়ল মৃত্যু।
এত কঠোরভাবে কাজে রত ছিল সে – এত করূণ, এত ট্র্যাজিক ছিল তার কাজে এই কঠোরতা এবং
একটা স্থায়ী অভ্যাস হয়ে পড়েছিল এতদিনে – যে সে নিজের কথাগুলো ভুলে গেল, যে কথাগুলো
আমাকে পাঠানো একটি চিঠিতে সে সেই সময় লিখেছিল যখন আমরা দুজনে বালক-বালিকা থেকে ইষৎ
বড় ছিলামঃ
জানুয়ারি ১৮, ১৮৯২
“স্টিভেনসনের চিঠিগুলো
পড়িনি কেননা – প্রিয় বালিকা! – যেদিন আমি ঠিকঠাক বৈজ্ঞানিক ভিত্তি অর্জন করে নেব
আর ব্যাংকের একাউন্টে এক হাজার ডলার জমা হবে, যখন আমি সারাদিন চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ব,
আর পড়ব, আর পড়ব, আর পড়ব…তখন আমার সাথে থাকার জন্য এস।
“তুমি যদি জানতে কিভাবে
প্রলুব্ধ করে বই! এদিকে আমি স্পেন্সার আর হেকেল হাতুড়ি মেরে মাথায় ঢোকাই আর না-পড়া
জিনিষগুলোর আনন্দ ভুলে থাকার চেষ্টা করি।”
সেই সময়টা এল যখন তার ব্যাংক একাউন্ট হল
১০০০ ডলারের, তাছাড়া বাৎসরিক ৬০,০০০ ডলারের ওপর হল সুনিশ্চিত আয়। কিন্তু কবি আর
ছাত্রের সেই সহজ আর সুন্দর জীবনে ফিরে আসার যে স্বপ্ন ছিল তার সেটা আর হল না। যা
সে পেল তার চরম মূল্য তাকে দিতে হল। তার সফলতাই তার জীবনের ট্র্যাজেডি ছিল।
বাজারের দাবী মেটাতে সে বন্ধক রাখল নিজের মস্তিষ্ক, এবং ক্লান্তি ও অতি-উত্তেজনা
তাকে নিয়ে গেল জন বার্লিকনের পথে আর ফলস্বরূপ সেই যন্ত্রণায় যাকে সে বলত ‘শ্বেত
যুক্তি’। চুয়াল্লিশখানা বই সে লিখেছিল। মাঝেমধ্যে উচ্চতাজনিত ঘুর্ণিরোগ চেপে ধরত
তাকে। কলমের মত এইটুকু ছোট্টো একটা উপকরণের শ্রমে কী করে বাঁচবে একজন বলবান,
স্বাভাবিক মানুষ? পুরুষালী কাজের জন্য সে মুখিয়ে থাকত। নিজের ‘চাঁদের উপত্যকা’ চাষ
করার বাসনা জন্মালো তার মনে। কলমের জোরে রোজগার করা অর্থ সে নিয়োগ করবে এক বিশাল
কৃষি-গবেষণায়; উষর জমিকে সে উর্বর করে তুলবে। ফলাবে ইউক্যালিপ্টাস আর শুরু করবে
অশ্বপালন। এক হিসেবে এগুলো সৃজনী উদ্যম ছিল কেননা যে গল্পগুলো এত বেশি পরিমাণে সে
লিখছিল (বছরে চারটে করে বই) সেগুলোতে আর সেই সৃজনী প্রতিভার ছাপ ছিল না; তার মনে
রাখার সময় ছিল না যে যে কলম এই বাজারে-মালগুলো লিখছে সেই কলমেই লেখা হয়েছিল
‘উত্তরের অভিযান’ আর ‘শ্বেত নৈঃশব্দ’র মত অমর সৌন্দর্যের ছোটোগল্প, ‘মার্টিন এডেন’
আর ‘বন্যের আহ্বান’এর মত মহান বই এবং ‘কেম্পটন-ওয়েস পত্রাবলী’ (যেটা আমরা দুজনে
মিলে লিখেছিলাম) তে প্রকাশিত অতুলনীয় উজ্জ্বল প্রবন্ধগুলো।
তার অর্থরোজগারের ব্যাপারটা কোনো কুৎসিত
লালসার মত ছিল না। ‘খেলা’ নামের বইটাতে সে পুরস্কারী লড়াকুর মানসিকতার ব্যাখ্যা
করেছে যার কাছে ঘেরা (রিং) টা খেলার প্রতীক আর খোদ জীবনেরই উদ্দেশ্য। কলমের
প্রচেষ্টায় অপরিমিত ধনী হওয়া তার কাছে ‘খেলাটা খেলা’র মত ছিল। আই.ডব্লিউ.ডব্লিউ.এর
সদস্যদের, ‘পথ’এর কমরেডদের অথবা মেক্সিকোর বিপ্লবীদের প্রাসাদে আতিথ্য প্রদান তার
পরিহাসবোধ ও নাট্যবোধকে তৃপ্তি দিত। তাদের কাছে সবচেয়ে ভালোটাও অতিরিক্ত ভালো ছিল
না, কারোর জন্যই হয় না। গহ্বর যে তাকে শুধু গিলতে পারেনি
তাই নয়, গহ্বর তার সাথে উপরে উঠে এসেছিল।
১৯০০ সালের ২১শে জানুয়ারি এই চিঠিটা সে
ওকল্যান্ড থেকে লিখলঃ
“তুমি কি জানো, বন্ধু
বানাবার এক মারাত্মক দক্ষতা আছে আমার, আর তাদের সাথে ঝগড়া করতে পারার ইশ্বরপ্রদত্ত
গুণ আমার নেই। এবং প্রতিনিয়ত তারা আসছে। ফিরে আসতে থাকা সমস্ত ক্লন্ডাইক-যাত্রী,
নাবিক অথবা ভাগ্যের সৈনিক, যাদের সাথে জীবনে কখনো হয়ত দেখা হয়নি তাদের সবার জন্য
আমার বাড়িটা হল মক্কা। কোনোদিন আমি একটা প্রতিষ্ঠান তৈরি করব, তাদের সবাইকে
নিমন্ত্রণ করে আনবো আর একে অন্যের বিরুদ্ধে খোলা লেলিয়ে দেব। জাত, ধর্ম আর
চরিত্রের এমন খিচুড়ি দ্বিতীয়টি আর হবে না। বিধ্বংসটাও হবে জবরদস্ত।
“যাই হোক, নিজের
স্বাধীনতায় আমি এত অত্যধিক আনন্দ অনুভব করছি যে মুর্খ হয়ে পড়ছি। যে পথ দিয়ে আমার
সাথে দেখা করতে লোকেরা ঢুকে পড়ে সে পথে আমি গর্ত খুঁড়ে ফাঁস পেতে রাখব, আর আরো
নানা জিনিষের মধ্যে সামনের দরজার ভিতরে একটা ম্যাক্সিম দ্রুত-গুলিছোঁড়া বন্দুক
দাঁড় করাবো। আমার ফায়ারপ্লেসের পবিত্রতা অলঙ্ঘনীয় হবে। অথবা, যদি আমার হৃদয়টাই
মুষড়ে পড়ে, আমি দুনিয়ার অন্য পিঠে পালিয়ে যাব।”
ঠিক এটাই সে ক্যালিফোর্নিয়ার সুন্দর
সোনোমা উপত্যকায় গ্লেন অ্যালেনে করেছিল। পনেরো’শো একড় জমি দিয়ে ঘেরা একটা
অট্টালিকা তৈরি করালো, অবারিত দ্বার, আর যখন হৃদয় মুষড়ে পড়ত, সে দুনিয়ার অন্য পিঠে
ছুটে পালাতো। চলে যেত হাওয়াই এবং দক্ষিণ সমুদ্রের দ্বীপগুলোয়। দুনিয়া থেকে সাত বছর
দূরে থাকার অভিপ্রায়ে হল তার ‘স্নার্ক’এ স্মরণীয় ও অসাধারণ সেই সমুদ্রাভিযান।
তার মত তীব্র অনুভুতিসম্পন্ন যুবকই এত
গভীর ভাবে বুঝতে পারে সময়ের ফুরিয়ে যাওয়া, আর এত ব্যগ্র ভাবে মজুত করতে পারে দিনের
প্রহরগুলো। খুব ছোট্টো ছিল জীবন। অনর্থক আলস্যে সময় নষ্ট করা উচিৎ নয় কারোর। এটাই
ছিল তার বিশ্বাস। জীবনে অনেক কিছু দেখার সুযোগ সে পেয়েছিল। জনতার সন্তান ছিল সে
আশৈশব, কিন্তু শৈশব তার ভাগ্যে জোটেনি। প্রথম থেকেই দেখেছে সংগ্রাম আর বাধ্য হয়েছে
সংগ্রাম করতে। নিজেকে সে মনে করত “রূঢ়, কঠোর আর আপসহীন”। অবশ্যই সে তেমন ছিল না।
শুধু কিছু বিভ্রম ছিল তার মনে, এবং গহ্বরে বা
আরো নীচে সে যা কিছু দেখেছিল সেগুলো তার শৈশব ও যৌবনের সংবেদনশীল প্রকৃতিকে
যন্ত্রণাবিদ্ধ করে রেখেছিল। এই যন্ত্রণা এবং যাকে বলা হয় সংগঠিত সমাজ কিন্তু
বাস্তবে যা একটি বিশৃংখল অরণ্য, সেটির বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া হল তার বিশ্বদর্শনের
বনিয়াদ।
নিচের অংশটি ১৮৯৯ সালের ২১ ডিসেম্বরে
লেখা একটি চিঠি থেকে নেওয়াঃ
“জীবন খুব সংক্ষিপ্ত। বস্তুবাদ
যে মানসিক অবসাদ নিয়ে আসে তার অভিব্যক্তি ফিটজেরাল্ডের ‘জলদি, হে!’ থেকে ভালো কিছু
হতে পারে না। আলস্যে সময় কাটানো কারোরই উচিৎ নয়। আর তারপর, যদি আমাকে তুমি জানো,
এই কথাটা বোঝোঃ আমিও একটি খামারে, না, ক্যালিফোর্নিয়ার এক পশুখামারে একজন
স্বপ্নদর্শী ছিলাম। কিন্তু খুব ছেলেবেলায়, ন’বছর বয়সে, দুনিয়ার কঠিন হাত এসে আমায়
ধরল। তারপর সে হাত আর কখনো ঢিলে হয়নি। সে হাত আমার মধ্যে আবেগটুকু রেখেছে কিন্তু
আবেগপ্রবণতা ধ্বংস করেছে। আমাকে এতটাই প্র্যাক্টিক্যাল করেছে যে আমায় লোকে রূঢ়,
কঠোর আর আপসহীন বলে। দুনিয়ার সে কঠিন হাত আমায় শিখিয়েছে যে কল্পনা থেকে যুক্তি
বেশি শক্তিশালী, বিজ্ঞানধর্মী মানুষ ভাবপ্রবণ মানুষের থেকে উঁচুদরের। আবার জগৎ
সম্পর্কে এক সত্যতর এবং গভীরতর রোমাঞ্চও দিয়েছে সে হাত, যে রোমাঞ্চ এক আদর্শবাদ,
একটি অন্তর্গত আশ্রয় যেটি আমার নিজের লোকেদের সাথে লেনদেনের সময় দৃঢ়ভাবে রুদ্ধ করে
রাখা আবশ্যক, কিন্তু অন্তরের পবিত্রতম স্থানে সেটি রয়েছে। আশ্রয়টি যেন এক দৈববাণী,
লালন করি স্নেহভরে কিন্তু বাজারে গেলেই খুলে দেখাই না, সে বাণী গ্রহণও করি না। যদি
করি, তাহলে আমার ওপর আমার সাথীদের উপহাস বর্ষিত হবে আর আমিও অকৃতকার্য হব। মোদ্দা
কথা, যেখানে যেমন।”
অকৃত্রিমতা তার চরিত্রের সর্বপ্রধান
বৈশিষ্ট ছিল। কখনো সে ছলনা করেনি। নিজের রচনা বা জীবন সে ফাঁকিতে ভরা তর্কের ওপর
গড়েনি, এড়িয়েও যায়নি কোনোকিছু। সাহিত্যের যদি বাজার থাকে এবং তার দাম পাওয়া যায় আর
যদি সে তার মস্তিষ্কের উৎপন্নগুলি বেচার জন্য সাজায়, তাহলে এমন ছল করার মত নীচে সে
কখনো নামবে না যে সে পয়সার জন্য লিখছে না আর সে মানছে যে ‘শিল্পের জন্য শিল্প’। আবার,
সমাজ যদি তাকে তার জিনিষের দাম হিসেবে প্রচুর না দেয় সেটাও তার সেই ‘যেখানে
যেমন’এর সাথে মিলবে না। যদি নিজেকে বাজারের চাহিদা মত করেই থাকো তাহলে তোমায়
অপরিহার্য হয়ে উঠতেই হবে। নিজের বিষয়ে যেমন সে দাবী করত যে সে ‘অর্থতান্ত্রিক
মানুষ’ তেমনই, ঠান্ডা মাথায় সে নিজের লক্ষ্য সাধনে নেমে পড়ল। সে সময় মারী কোরেলি
সম্ভবতঃ ধনার্জনের দিক থেকে সফলতম ঔপন্যাসিক ছিলেন। সে ভয় দেখালো যে সে তাঁর শিল্প
অধ্যয়ন করে সেই গুণগুলো আবিষ্কার করবে যেগুলো তাঁর সাফল্য অনিবার্য করে তুলেছে আর
সেসব সে নিজের মধ্যে গড়ে তুলবে। এসব কথা সে সোজাসুজি বলত এবং নিজের এই সংকল্প আর
লক্ষ্যের কথা জানিয়ে বন্ধুদের চেঁচামেচি আর আক্রমণ ডেকে আনল। তারা অনেকেই তার থেকে
বেশি ভালো করে এই কাজটা করতে লেগে পড়ল যারা বস্তুতঃ তার সংকল্পের দৃঢ়তায়
ঈর্ষান্বিত ছিল।
নীচের চিঠিটা এর সাক্ষ্য বহন করেঃ
৯৬২, ইস্ট সিক্সটিন্থ স্ট্রীট,
ওকল্যান্ড, ক্যালিফোর্নিয়া,
ফেব্রুয়ারী ৩, ১৯০০
প্রিয় আনা,
“শনিবারের রাত, আর আমি
ভালো বোধ করছি। শনিবারের রাত, আর প্রচুর কাজে ভরা একটা সপ্তাহ পুরো হল – ভাড়ার কাজ
অবশ্যই। কেনই বা করব না? কপালের ঘাম পায়ে ফেলছি যে কোনো সৎ কারিগরের মত। এক বন্ধু
আছে আমার যে এ ধরণের কাজকে ঘৃণা করে। সে উত্তরকালের জন্য লেখে, প্রশংসকদের একটা
ছোট্টো দলের জন্য, সমাজের বিস্মৃতির প্রতি সে বিস্মৃত, পয়সা চায়না, পয়সার
ভাবনাটাকেও উপহাস করে, নোংরা মনে করে, যারা পয়সার জন্য লেখে তাদের সবাইকে অভিশাপ
দেয়, ইত্যাদি, ইত্যাদি, -- অর্থাৎ, সে নিজে বলে যে সে এমন। কিন্তু সদ্য তার একটি
চিঠি পেয়েছি। ‘মুনসী’রা তার একটি গল্প কিনবে বলেছে যদি সে শেষটা পালটে দেয়। খুব
যত্নের সাথে সে নিজের গল্পটি বুনেছিল। প্রত্যেকটি ভাবনা অন্তিম দৃশ্যের দিকে
ধাবিত, যখন হিংসাজনিত মৃত্যু ঘটছে প্রধান চরিত্রের। এখন প্রকাশকেরা বলছে প্রধান
চরিত্রটিকে, যে যুক্তিসংগত ভাবে মৃত, বাঁচিয়ে রাখতে। আমার লেখকবন্ধুটি পয়সাকে ঘৃণা
করে। হ্যাঁ; আর সে চরিত্রটিকে বাঁচিয়ে রাখল! ‘আমার পতন হল’, নিজের আচরণের জন্য সে
এটুকুই বলতে সম্মত।”
প্রচন্ড কাজের চাপ আর শিল্পকে পরিশ্রমের
ব্যবসায় বদলে দেওয়ার স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া শুরু হল। একটি অত্যন্ত উদারপ্রকৃতির
মানুষ মাঝে মধ্যেই ডুবে যেতে লাগল শিল্পসংস্কৃতি-সাহিত্য-জগতের প্রতি ঘৃণায় –
সফলতার সাথে ঘিরে ধরা চাটুকারিতায় ক্ষুব্ধ হয়ে উঠল তার সত্তা। এই মানুষগুলো, যারা
আজ তার স্তাবকতা করছে, সে ‘আবিষ্কৃত’ হওয়ার আগে তো কই দেখতে পায়নি কী ছিল তার
ভিতরে! তার একটা গল্পের জন্য সে ওভারল্যান্ড মান্থলি থেকে
পাঁচ ডলার পেয়েছিল আর কেউ সে গল্পটির প্রশংসা করেনি। যখন বই হয়ে বেরুলো, হঠাৎ সে
গল্পটি বিখ্যাত হয়ে উঠল। তাই মানুষের প্রশংসা আর দয়ালুতাকে সে হাল্কা ভাবে নিত। এক
মানসিক অবসাদে তার মনে শুধু এই দুনিয়া নয়, জীবনেরও মূল্য সম্পর্কে প্রশ্ন জাগত। এত
কিছু পাওয়ার পর সে আবিষ্কার করল যে সে সমস্ত মিথ্যে। কোনোকিছুরই অন্তর্নিহিত কোনো
মূল্য নেই। বিষাদরোগে ভুগত সে। আত্মহননের ভাবনায় ডুবে যেত। একটা সময় ছিল যখন
টলস্টয়ের মত সেও টেবিলের ওপর গুলিভরা রিভলবার রাখত – যেকোনো সময় নিজের ওপর ব্যবহার
করতে প্রস্তুত।
জানুয়ারি ৫, ১৯০২
“নিজের স্মৃতিপথে তাকাই, সকাল
একটায়, যে চেহারাগুলো দেখেছিলাম সব পান্ডুর আর সতৃষ্ণ হয়ে ওঠে – তোমার মনে পড়ে?
অথবা, তুমি কি লক্ষ্য করেছ? – এবং আমি অবাক হই কিসের এত আলোড়ন?
“গতকাল ‘ক্যানভাসব্যাক’
হাঁস আর ‘টেরাপিন’ কচ্ছপের মাংসে আহার সেরেছি। হৃদয় ও মস্তিষ্ক উষ্ণ করছিল ঝলমলে
শ্যাম্পেন আর আরো সব বিস্ময়কর পানীয় যার স্বাদ আগে কখনো আমি পাইনি। যৌবনের দিনের সেই
রাতভর মদ্যপান আর নোংরা হুল্লোড় মনে পড়ছিল। ছেঁড়াখোঁড়া জামাকাপড় পরা, ভদ্র আচরণ না
জানা জন্তু ছিলাম আমরা, গলাধঃকরণ করতাম সস্তা, তুচ্ছ আর বমি পাওয়ানো পানীয়। তারপর
আমি স্বপ্ন দেখলাম, আর ওই এঁটেল কাদা থেকে নিজেকে টেনে উপরে তুলে ক্যানভাসব্যাক আর
টেরাপিন আর শ্যাম্পেন অব্দি পৌঁছোলাম, পৌঁছে জানলাম যে গাঁজে যে তফাৎ আনে শিল্প
সেটা শুধু পরিমাণগত।”
ছাব্বিশ বছর বয়স থেকে সে নিজের চিঠির
নীচে “ইতি, বিপ্লবের জন্য তোমার” লিখে সই করতে শুরু করল। এই দেশে এবং সমুদ্রপারে
অন্যান্য দেশগুলোয় হাজার হাজার মানুষ লুফে নিল এই বাক্যাংশ। প্রথম যৌবন থেকে সে
বিপ্লবের সেবায় রত ছিল। পথসভায় সে সমাজবাদের কথা বলত এবং স্থানীয় এলাকায় রবিবার
রাতের বৈঠকগুলোয় বক্তৃতা দিত। মেয়রের জন্য আর বিদ্যালয় পরিচালকের জন্য সে নিজের
নাম সমাজবাদী রাজনৈতিক টিকিটে থাকতে দিয়েছিল। যখন খ্যাতি পেল তখন সে দেশের
পূর্বদিকে এসে সমাজবাদী বিষয়ে ভাষণ দিয়ে বেড়াত।
১২ই ফেব্রুয়ারী, ১৯০৮এ লেখা চিঠিতে সে
লিখছেঃ
“চার মাস বক্তৃতা দিয়ে
ফিরলাম। শুকনো হাড়গুলো একটু বাজালাম। ইয়েল, হার্ভার্ড, কলাম্বিয়া আর শিকাগো
বিশ্ববিদ্যালয়ে বললাম। এছাড়া সোশ্যালিস্ট পার্টির জন্য আরো অনেক বক্তৃতা। (বিপ্লববাদী
ছিল সে) “মাথার ওপর সমাজের যে বিরাট ইমারতখানা আছে তা আমায় বিন্দু মাত্র আনন্দ দেয়
না। ইমারতের ভিতটা আমার বেশি ঔৎসুক্য জাগায়। ওখানেই পরিতৃপ্ত থাকি আমি, শ্রম করি,
হাতে থাকে শাবল, কাঁধে কাঁধ মেলাই বুদ্ধিজীবী, আদর্শবাদী এবং শ্রেণীসচেতন
শ্রমিকদের সাথে, মাঝেমধ্যে চাক্ষুষ দেখি ভিতরের ব্যাপার-স্যাপার আর নাড়িয়ে দিই
পুরো ইমারৎটাকে। কোনো দিন, যেদিন কিছু আরো হাত আর শাবল পাবো কাজে, উল্টে দেব পচা
জীবন আর গোর-না-দেওয়া মড়ায় ভরা ওই ইমারৎ। শেষ করে দেব এই বীভৎস স্বার্থপরতা আর
একঘেয়ে বস্তুবাদ। তারপর আমরা সাফসুথরো করব মাটির নিচের কুঠরিটাকে আর নতুন বাসস্থান
তৈরি করব মানুষের, যার প্রত্যেকটি ঘর হবে আলোবাতাস ভরা, যে হাওয়ায় নিঃশ্বাস নেব
সেটি হবে পরিষ্কার, মহৎ আর জীবন্ত।”
ওদিকে রাশিয়ায় ওরা উল্টে দিয়েছে
ইমারৎখানা, অথচ দুঃখ এটাই যে জ্যাক লন্ডন নীরব, মুক্ত জনতার শীর্ষে আন্দোলিত
রক্তপতাকা সে দেখতে পাবেনা আর, আন্তর্জাতিক গেয়ে ওঠা লক্ষ লক্ষ মানবকন্ঠ তাকে আর
সাথে পাবে না।
ইওরোপে প্রথম যাত্রাকালে লন্ডনের বস্তির
গল্প লিখেছিল সে, “গহ্বরের জনতা”। প্রকাশকদের সাথে দেখা করতেও সে যায় নি। নিজেকে
নিরুদ্দেশ করে হারিয়ে দিয়েছিল মানুষের দুর্দশার গহ্বরে। যার ফলে আমরা পেলাম আমাদের
সময়ের আধুনিক সমাজের বিরুদ্ধে কঠোরতম অভিযোগপত্র, সমাজবৈজ্ঞানিক ধাঁচে লেখা একটি
নতুন “লা মিজারেব্ল”। এটা লিখতে, বস্তিবাসী হিসেবে বসবাস করতে সে নিজেকে বাধ্য
করেছিল। নিজের অর্থসম্পদ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে রাস্তায় ঘুরে বেড়াতো রোজগারের
খোঁজে - ক্ষুধার্ত, গৃহহীন।
লন্ডন, আগস্ট ২৫, ১৯০২
“শনিবার সারারাত আমি
গৃহহারাদের সাথে বাইরে কাটালাম, তিক্ত বর্ষণে হেঁটে বেড়ালাম রাস্তায় রাস্তায়,
গায়ের চামড়া অব্দি ভেজা, ভোর হওয়ার প্রতীক্ষায় রইলাম। রবিবার সারাটা দিন
গৃহহারাদের সাথে কিছু খেতে পাওয়ার নিষ্ঠুর সংগ্রামে কাটালাম। ঘরে ফিরলাম রবিবার
সন্ধ্যায়, ছত্রিশ ঘন্টা লাগাতার কাজ আর একরাতের ছোট্টো ঘুমের পর। আজ ৪০০০ শব্দের
কিছু বেশি লিখলাম, টাইপ করলাম আর সংশোধন করলাম। এক্ষুনি শেষ করেছি। সকাল [আমাদের
হিসেবে রাত – অনু] একটা বাজছে। যা দেখেছি এবং যে যন্ত্রণা ভোগ করেছি তার ফলে আমি
এখন শ্রান্ত, নিঃশেষিত আর আমার স্নায়ুগুলো ভোঁতা হয়ে পড়েছে।”
এবং আবারঃ
“লন্ডন শহর নামে পরিচিত
মানব-নরকের এই গর্ত আমায় অসুস্থ করে তুলেছে।”
সামাজিক প্রজ্ঞা তার ছিল।
শ্রেণীসংগ্রামটা সে বুঝত এবং জনতার আন্তর্জাতিক সংগঠনে তার আস্থা ছিল। সে বুঝত যে
বিবর্তনে আমাদের আজকের আন্তর্জাতিক মানবতার একটিই শত্রু – আন্তর্জাতিক পূঁজিবাদ,
এবং বুঝত যে সমাজের আর্থিক ও সামাজিক শক্তিগুলো জনতার মনে স্পষ্ট করে তুলছে এই
সত্যটা আর তাদের হাতে অস্ত্র যোগাচ্ছে যাতে তারা সফল ভাবে এই শত্রুর মোকাবিলা করতে
পারে। সমাজ একটি যুদ্ধক্ষেত্র যেখানে জনতার শক্তিসমূহ জনতার শোষক ও উৎপীড়কদের
বিরুদ্ধে সংগ্রামরত। তার স্থান ছিল জনতার মাঝে। তার সফলতা এবং তার প্রতিভা তাকে
বিপ্লবী অস্ত্র হাতে তোলা থেকে অব্যাহতি দেয়নি। সেগুলো শুধু প্রমাণ করছে সামাজিক
গণতন্ত্রের মূল সত্য, পরিবেশের শক্তি আর রক্ত ও কুলীনতার সাজানো গল্পটাকে। বিশ্বের
শক্তিশালীদের সামনে দাঁড়িয়ে ভয়ে অভিভূত না হওয়ার মত বিশ্বাস, দৃষ্টি আর সাহস তার
ছিল।
আর.এম.এস. ম্যাজেস্টিক
জুলাই ৩১, ১৯০২
“গতকাল দুপুরে নিউইয়র্ক
থেকে সমুদ্রযাত্রা শুরু করলাম। এক সপ্তাহ পর লন্ডনে পৌঁছব। তারপর দুদিন থাকবে যার
মধ্যে আমায় নিরুদ্দেশে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে যাতে লন্ডনের পশুদের দিক থেকে আমি
দেখতে পারি রাজ্যাভিষেক। তাদের পশু ছাড়া আর কিছু বলা যায়না, যদি নিউইয়র্কের বস্তির
মানুষের সাথে তাদের তুলনা করা যায়, এমন পশু যাদের মধ্যে এখানে ওখানে ইশ্বরত্বের
বিদ্যুৎচমক দেখা যায়।
“দুনিয়াদার মানুষদের আমি
দেখি পুলম্যান রেলকামরায়, নিউইয়র্ক ক্লাবে আর অ্যাটলান্টিক লাইনারের ধুম্রপান-কামরাগুলোয়
এবং সত্যি বলতে, কাজ করতে থাকা শক্তিগুলো সম্পর্কে ওদের অজ্ঞান আর অবুঝপনা দেখে
আমাদের উদ্দেশ্য আমায় আরো আশান্বিত করে। শ্রমিকদের প্রতি তারা তিক্ত, তিক্ততর হয়ে
চলেছে। অন্যদিকে ঘনিয়ে আসতে থাকা বিপ্লব সম্পর্কে তারা পরমসুখে অজ্ঞান। তুমি দেখ,
শ্রমিকদের বাড়তে থাকা সামর্থ্য তাদের আঘাত করছে, তাদেরকে তিক্ত করে তুলছে তবুও চোখ
তাদের খুলছেনা।”
একটা প্রবন্ধ লিখেছিল সে – “আমার জন্য
জীবনের অর্থ কী”। ক্রোপোটকিনের “যুবদের প্রতি আপীল” এবং অস্কার ওয়াইল্ডের “সমাজবাদে
মানুষের আত্মার স্বরূপ”এর সাথে লেখাটির তুলনা করা যেতে পারে। লেখাটির শেষ পংক্তিতে
সাধারণ মানুষের উত্থানের প্রতি বিশ্বাস ধ্বনিত হয়ে ওঠে, “সময়ের সিঁড়ি বেয়ে চিরকাল
কাঠের জুতোর উঠতে থাকা আর পালিশকরা বুটের নামতে থাকা প্রতিধ্বনিত হতে থাকে”।
জ্যাক লন্ডনের মত এত যুবক একজনের যৌবন
সম্পর্কে লিখতে গিয়ে বস্তুতঃ একটা কঠিন অথচ বিস্ময়কর ব্যাপারকে ধরতে চেষ্টা করছি
আমি। তার বিষয়ে বলতে গেলে ভাবনা নয় অনুভুতির দিক থেকে বলতে হয় এবং তার নিজের থেকে
বেশি আর কেউ জানেনা যে সেটা কত কঠিন। আমি তার একটি চিঠি থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছিঃ
৯৬২ ইস্ট সিক্সটিন্থ স্ট্রীট,
ওকল্যান্ড, ক্যালিফোর্নিয়া, ডিসেম্বর ২৭,
১৮৯৯।
“ভাবুকরা অভিব্যক্তির
অভাবে ভোগেনা। তাদের ভাবনাই তাদের অভিব্যক্তি। অনুভুতিওয়ালা মানুষেরা ভোগে। বিশ্বে
সবচেয়ে কঠিন কাজ হল অনুভুতি, গভীর অনুভুতিকে শব্দে ব্যক্ত করা। অভিব্যক্তির দিক
থেকে বলতে গেলে, চার ভল্যুমে ‘দাস ক্যাপিট্যাল’ লেখা অতগুলোই স্তবকের সাদাসিধে
একটি গীতিকবিতা লেখার থেকে সহজ।”
নিজের শরীরের সামর্থ্য নিয়ে সে গর্ব করত।
সে একজন আদর্শবাদী ছিল কিন্তু তার কোনো বিভ্রান্তি ছিল না। সত্য ও ন্যায়ের প্রতি
অতিশয় আগ্রহ ছিল, কিন্তু সেদুটো খুব কম দেখতে পেত চারপাশে। মানবতার উদ্দেশে
উৎসর্গিত এক ব্যক্তিবাদী ছিল সে। যতদিন ছিল তার জীবন, সত্যের আবরণ উন্মোচিত করা
ছিল তার কাজ। সমাজের যাকিছু মন্দ আর অন্যায়, তার বিরুদ্ধে সে ছিল জীবন্ত প্রতিবাদ।
৯৬২ ইস্ট সিক্সটিন্থ স্ট্রীট,
জানুয়ারি ১১, ১৯০০
“আমার ভিতরে যা কিছু
সবচেয়ে মহৎ আর ভালো ছিল সব পিটিয়ে বার করে দেওয়া হয়েছিল। আমার জীবনটা তুমি জানো।
কোনো জাহাজের, তাড়াহুড়োয় আঁকা অগ্রভাগ[ফোরক্যাস্ল]এর ছবির মত। বিচলিত ছিলাম।
ছায়ার পিছনে হাতড়াচ্ছিলাম, ঠাট্টা করছিলাম, অবিশ্বাস করছিলাম, অনেক সময়
মিথ্যেটাকেই চেপে ধরছিলাম বুকে, সবরকম সন্দেহ যেটা বিশ্বাস করার দিকে উন্মুখ করছিল
সেটাকেও সন্দেহ করছিলাম। এবং সবচেয়ে বড় কথা, তৃষ্ণার্ত ছিলাম। ঘাড় শক্ত করে, নিজের
শরীরের সামর্থ্য নিয়ে গর্ব করতাম, আশা থাকত যে পরিষ্কার জল উপচে বেরোবে। কিন্তু
বেরোয়নি, কেননা যা করছিলাম সেটা বর্বরতা ছিল।”
কী ছিল তার এই “শরীরের সামর্থ্য” যা নিয়ে
সেই দিনগুলোয় এত গর্ব করত সে? সে যুদ্ধের পক্ষে থাকত। তার যুক্তি ছিল যে, যে
সমাজের আইন মৃত্যুদন্ড বিধান করে সে সমাজ থেকে যতদিন আমরা পুলিসের সাহায্য আর
রাস্তার আলো স্বীকার করব ততদিন মৃত্যুদন্ডের প্রতিবাদ করার কোনো অধিকার নেই
আমাদের। সে সময় সে বলে বেড়াত যে অ্যাংলোস্যাক্সন মানুষেরা পৃথিবীর নুন আর বিশ্বাস
করত যে কিছু জাতি নিকৃষ্ট। পুরুষের তুলনায় নারীর জৈববৈজ্ঞানিক নিকৃষ্টতায় বিশ্বাস
করার দিকে তার ঝোঁক ছিল, কেননা যদি না পরে সে নারীপুরুষদের একসাথে পীডমন্ট
স্নানাগারে না দেখে থাকত আর সুইমিং পুলের কিনারে নারীদের “ইশ্বরের নীচে সোজা না দাঁড়িয়ে”
কাঁপুনি না দেখে থাকত, সে বিশ্বাস করত যে অধিকার শক্তি দেয়। সে সভ্যতা থেকে দূরে
পালিয়ে বেড়াত এবং নিয়ম করে এড়িয়ে থাকত। মৃত্যুর প্রতি তার মনোভাব ছিল বর্বরোচিত,
অদৃষ্টের প্রতি সম্পূর্ণ উদাসীন, যে কোনো সময় যেতে প্রস্তুত। তার মত ছিল যে প্রেম,
ব্যক্তির জন্য প্রকৃতির পেতে রাখা একটি ফাঁদ। ভালোবাসার জন্য নয়, বিয়ে করা উচিত
বোধনির্ণিত কিছু গুণের জন্য। এই নিয়েই সে তর্ক করেছিল “কেম্পটন-ওয়েস পত্রাবলী”তে।
সেও আবার এত বেশি আবেগের সাথে যে সন্দেহ হবে, যতটা সে দাবী করছে ততটা নিশ্চিত সে
নয়। পরবর্তীকালে, জ্যাক হল সবচেয়ে নরম ভাবুকদের একজন, ঠিক ততটাই আবেগের সাথে নিজের
নতুন ভাবনাগুলো চাউর করতে শুরু করল, যতটা আবেগের সাথে আগে সে ওই সব ভাবনাকে আক্রমণ
করেছিল। সে এখন রোমান্টিক প্রেমে বিশ্বাস করতে শুরু করল, নারীদের ভোটাধিকারের
আন্দোলনকে সাহায্য করল এবং ক্যালিফোর্নিয়ায় এই আন্দোলনের সফলতায় উল্লসিত হয়ে
উঠেছিল। এখন সে হল পুরোপুরি আন্তর্জাতিকতাবাদী এবং সৈন্যবাদ-বিরোধী। সে এখন নিজের
নিয়ে ঠাট্টা করত যে কীভাবে সে রুশ-জাপান যুদ্ধে রুশের দিকে ছিল যখন নাকি পুরো
সমাজবাদী আন্দোলন বিপ্লবী আন্দোলনের স্বার্থে রুশের পরাজয় চাইছিল। কেননা সে সময়
তার নজরে রুশীয়রা সাদামানুষ ছিল, জাপানীরা ছিলনা। একটা আহত রুশীয় পা দেখে সে
“স্বজাতিচেতনা” অনুভব করেছিল কেননা পা’টা তার পায়ের মত সাদা ছিল। মৃত্যুদন্ডের
বিরুদ্ধে তার ঘৃণা হল তার সবচেয়ে উচ্চাকাঙ্খী বই “দ্য স্টার রোভার”এর বিষয়বস্তু,
আর উত্তেজনার জন্য উত্তেজনায় তার বিগত দিনের বিশ্বাসটাকে, যার জন্য সে নিজের ওপর
মদ আর নেশার ওষুধের পরীক্ষা চালিয়েছিল, কালজয়ী “জন বার্লিকন”এ সে খন্ডন করল। সে
অনেক দূরে চলে এসেছিল – যেগুলোর সাথে আগে তার সম্পর্ক ছিল সেই সমস্ত ধারণার বিপরীত
দিকে সে বেরিয়ে এসেছিল, এবং যারা তাকে জানত তাদের সবার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে সে
আসবেই।
আমি তাকে ছবিগুলোয় দেখিঃ এক হাতে নিজের
বাগান থেকে সদ্য তোলা এক গোছা হলদে গোলাপ আর অন্য হাতে সাইকেলের হাতল ধরে আসছে,
গাঢ় বাদামী চুলের ওপর টুপিটা পিছন দিকে হেলান, দুনিয়ার দিকে নক্ষত্রের মত বড় বড়
নীল দুটো চোখ পাতার দীর্ঘ লোমের ভিতর দিয়ে দৃষ্টি মেলে আছে – অবর্ণনীয় সুন্দর আর
পুরুষোচিত একটি ছেলে যার অভিব্যক্তির প্রজ্ঞা আর দয়ালুতা যৌবনকে আড়াল করে রাখে।
আমি তাকে দেখি পপির মধ্যে মুখ ডুবিয়ে
শুয়ে আছে আর দুচোখের দৃষ্টি, তার বড় প্রিয় দৈত্যাকৃতি ইউক্যালিপটাস আর সেকোইয়ার
চুড়োগুলো পেরিয়ে ক্যালিফোর্নিয়ার উঁচু নীল আকাশে উড়তে থাকা নিজের ঘুড়িগুলোকে
অনুসরণ করছে।
আমি তাকে দেখি শান্ত, “দ্য স্প্রে”র ওপর
- চাঁদ আমাদের পিছনে উঠছে - আর শুনি, আগের রাত জেগে পড়া স্পেন্সার আর ডারউইন থেকে
করা তার সাধারনীকরণগুলো সে আওড়াচ্ছে। তার সমস্ত গতিবিধি এবং জীবনের প্রত্যেকটি
খুঁটিনাটিকে এক মুগ্ধকর আকর্ষণে ভরে দিত তার ব্যক্তিত্ব। যখন শুরুর দিনগুলোয়, বিশ্বের
ওপর নিজের ছাপ ফেলতে সে তার অতুলনীয় উদ্যমীশক্তি নিয়ে সংগ্রামে রত ছিল, তখনও সবাই
তার প্রতিভা সহজাত বলে মানত।
আমি তাকে দেখতে পাই, রাত শেষ হওয়ার আগেই
সে নিজের কাজে বসেছে, আর আমার মনে হয় যে ভোর তাকে অভিনন্দন জানিয়ে আলিঙ্গন করছে, এবং
সে প্রকৃতির অন্যান্য, কম শ্রেণীগত পদার্থসমূহ থেকে বেশি মৌল-তত্ত্বগুলোর অংশ। মে
মাসের সকালে আমি তাকে দেখি হানিসাক্ল পুষ্পলতা জড়ানো থামওয়ালা একটা বারান্দার
রেলিং থেকে ঝুঁকে, প্রণয়ের হর্ষমদিরতায় একে অন্যের পিছু পিছু ঘুরতে থাকা দুটো
হামিং পাখির দিকে চেয়ে আছে। সৌন্দর্যের বন্দী ছিল সে – পাখি আর নিকুঞ্জের, সমুদ্র
আর আকাশের আর আর্কটিক জগতের বরফশীতল বিশালতার। রিচার্ড হোভে তাঁর “হিউম্যান ড্রিফ্ট”
শীর্ষক প্রবন্ধে তাঁর বিশ্বদর্শনের সারসংক্ষেপ যে পংক্তিটি দিয়ে শেষ করেছিলেন,
“দেখ, আমি বেঁচেছি!”, জ্যাক ছাড়া অন্য কেউ এত সত্য ভাবে এই কথাটি প্রতিধ্বনিত করতে
পারবে না।
“দেখ, আমি বেঁচেছি!”
সে শুধু পৃথিবীর বিশাল প্রান্তরে,
মকররেখীয় সূর্যালোকে আর শ্বেত হিমায়িত নৈঃশব্দে, পৃথিবীর সুখে আর দুর্দশায় বেঁচে
থাকা শিশুদের সাথে বাঁচেনি, সে সবসময় জীবন ও মৃত্যুর ভাবনায় বেঁচেছে, আন্তর্জাতিক
সমাজবাদের কালজয়ী ও সীমাহীন সংগ্রামে বেঁচেছে।
উৎসঃ দ্য মাসেস, জুলাই ১৯১৭
-------------------------------------------------------------------------------------------------------
আন্না স্ট্রান্সকির জন্ম হয়েছিল ১৮৭৮
সালের ২১শে মার্চ, রাশিয়ার ব্যাবিনোৎজে। তার পিতামাতা ছিলেন পুরোনো রাশিয়ার র্যাডিক্যালপন্থী
মানুষ। আন্না তাঁদের সঙ্গে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রান্সিস্কো শহরে চলে আসে
এবং সেখানেই শিক্ষা লাভ করে। সামাজিক সমস্যাবলী, সাহিত্য এবং শ্রমিক আন্দোলনের
সাথে জীবন্ত যোগসুত্র ছিল।
আন্না এবং তার পরিবার, তার এক ভাই ডঃ
ম্যাক্স স্ট্রান্সকির বাড়িতে থাকত। আন্না এবং তার বোন রোজ, ক্যালিফোর্নিয়ার তরুণ
লেখক ও শিল্পীদের একটি র্যাডিক্যালপন্থী দলের সদস্য ছিল। সেই দলেই ছিলেন জ্যাক
লন্ডন, জিম হোয়াইটেকার, জর্জ স্টার্লিং এবং আর অনেকে। শতাব্দীবদলের সময়
সানফ্রান্সিস্কো শহরে যে বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় বিকশিত হয়েছিল স্ট্রান্সকি বোনেরা
তার নেতৃত্বে ছিল।
জ্যাক এবং আন্না উপসাগর এলাকার
সমাজবাদীদের গতিবিধির নিয়মিত অংশীদার ছিল। খুব ভালো বন্ধু ছিল তারা এবং প্রথম দিকে
একে অন্যকে কখনো রোমান্টিক ভাবে দেখেনি। একই ধরণের ভাবনা এবং স্বপ্নপ্রবণ দুই উচ্চ
মেধাসম্পন্ন চিত্তের সম্পর্ক ছিল তাদের। জ্যাক লন্ডনের জীবনে আন্না স্ট্রান্সকির
শক্তিশালী প্রভাব ছিল। ১৯০২ সালের কিছুটা সময় ছাড়া, যখন জ্যাক আন্নার ভালোবাসায়
পড়েছিল, তারা খুব কাছের বন্ধু ছিল। আন্না নিজে কখনো জ্যাকের প্রেমে পড়েনি, কিন্তু
জ্যাকের জন্য গভীরতম শ্রদ্ধা ছিল তার মনে।
১৯০০ সালের শেষ দিকে, প্রেমের প্রকৃতি
নিয়ে তাদের চিঠিপত্র, “দ্য কেম্পটন-ওয়েস লেটার্স” নামে বইটির জন্ম দিল। বইটিতে
জ্যাক, হার্বার্ট ওয়েস নামে, জীববিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গী থেকে আর আন্না, ডেইন
কেম্পটন নামে, আদর্শগত ও আবেগগত দিক থেকে প্রেম নিয়ে আলোচনা করেছে। ১৯০৩ সালে বইটি
প্রকাশিত হয়েছিল, এবং এখনও সম্পূর্ণ প্রেম-সাহিত্যে সবচেয়ে বেশি কৌতুহলোদ্দীপক এবং
অদ্ভুত বইগুলোর একটি।
উৎসঃ রুস কিংম্যান, এ পিক্টোরিয়াল লাইফ অফ জ্যাক লন্ডন (১৯৭৯)
(বাংলা অনুবাদঃ বিদ্যুৎ পাল)
Source: http://www.jacklondons.net/annastrunskymemoirs
No comments:
Post a Comment