Thursday, October 12, 2017

বিশ্বায়ন, ইংরেজি এবং ‘অন্যান্য’ ভাষা - ইউ· আর· অনন্তমুর্তি

ভাষা আর সাহিত্যে, এবং শুধু ভাষা আর সাহিত্য নয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বাড়তে থাকা প্রভুত্ববাদী প্রবৃত্তির প্রতি আমার যে বিরোধ, তা নিয়েই [আজ এখানে]* বলব বলে ভেবেছি। যেহেতু আমি গল্পলেখক, তাই কী বলতে চাই বোঝাতে বরং কয়েকটি গল্প বলি।

রামায়ণে হনুমান তাঁর বাককুশলতা এবং কূটনীতির জন্য খ্যাত। এক মহান কন্নড় লেখক এবং পুরোনো ঘরানার শিক্ষক মজা করে বলেন যে যখন রাম হনুমানের দারুণ সংস্কৃতের প্রশংসা করেন সেটা একজন ভারতীয় মানুষের ইংরেজীর ইংরেজকৃত প্রশংসার মত শোনায়; যেন উত্তর ভারতীয় রাম দক্ষিণ ভারতীয় হনুমানের প্রশংসা করছেন। মস্করা হিসেবে চলতে পারে কিন্তু সত্যিই তো আর তা নয়! সংস্কৃত তো কোনো বিশেষ এলাকার নয়। সংস্কৃতের গৃহকোণ ছিল সব জায়গায় আর তাই সে গৃহহীনও বটে। যেমন আজকের ইংরেজী। প্রফেসর শেলডন পোলক যে শব্দটাকে খ্যাতি দিয়েছেন সে শব্দটা ব্যবহার করে বলি, বিশ্বনগরের ভাষার গৃহকোণ আছে সবস্থানে এবং তাই সে গৃহহীন। বাংলা, তামিল, তেলেগু, ওড়িয়া, কন্নড় আমাদের সবকটি ভাষার  একটি করে গৃহকোণ আছে। এ ভাষাগুলি আজকের ইংরেজীর বা প্রাচীন কালের সংস্কৃত বা ল্যাটিনের মত ঘুরে বেড়ায় না। কিন্তু ইংরেজী যখন ইংল্যান্ডের ভাষা ছিল এবং নিজের এলাকা ছাড়িয়ে ঘুরে বেড়ানো শুরু করেনি তখন সে একজন মহান শেক্সপিয়রের জন্ম দিয়েছিল। অর্থাৎ বিশ্বনগরের ভাষা হয়ে উঠলেই কোনো ভাষা আপনা থেকে সাহিত্যের মহান ভাষা হয়ে ওঠেনা। শক্তি আর গুণ, সবসময় একসাথে চলবে এমনটা জরুরী নয়। বিবিসি বা সিএনএনএর ইংরেজী হয়ত অডেন বা ইলিয়ট বা ইয়েটসের জন্ম দিতে পারেনা কিন্তু উত্তেজনার জন্ম দিতে পারে, আমাদের ঘুম কেড়ে নিতে পারে। আরো অনেক ইংরেজী আছে, তাদের মধ্যে কয়েকটির কাছে এমন বাস্তব আছে যা বাঁচা হয়েছে, ঘাম আর মাটির গন্ধ আছে এবং এমন মানুষ নিশ্চয়ই আছে যারা সেই ইংরেজীতে স্বপ্ন দেখছে, গালাগাল দিচ্ছে যাতে ভাষাটিতে মানবিক সাহিত্যিক অভিজ্ঞতা বিধৃত হয়।

আবার হনুমানের কাছে ফিরে আসি। কেননা এই মহান সংবাদদাতার সাহায্যে ভাষা নিয়ে আমার আরেকটি কথা আমি বলতে চাই। এবার এমন একটি গল্প যেটি সবাই জানেন। হনুমান লাফ দিয়ে মহাসাগর পার করে লঙ্কায় যান এবং অশোকবনে গভীর শোকে আকুল সীতাকে খুঁজে পান। হনুমান তাঁকে গাছের চুড়ো থেকে দেখেন আর ভাবেন কোন ভাষায় তাঁর সাথে কথা বলবেন। সংস্কৃত, যেটি দরবারের, এমনকি রাবণের দরবারেরও কুলীনদের ভাষা? তাহলে সীতা তাঁকে বিশ্বাস করবেননা; ভাববেন তাঁকে যে হরণ করেছে এ তারই এক দূত। হনুমান ভাবেন (এটি রামায়ণ থেকে উদ্ধৃত) -
যদি দ্বিজের ন্যায় সংস্কৃতে আমি সীতাকে সম্বোধন করি তাহলে তিনি ভাববেন আমি রাবণের দূত আর ভয় পেয়ে যাবেন। বরং মানুষের ভাষায় কথা বলা ভালো, সীতা বুঝবেন।
এই হলেন বাল্মিকি, আর আমাদের বিশ্বাস অনুযায়ী রাবণও এক ব্রাহ্মণ।

আমাদের দেশের একটি ক্ষেত্রীয় ভাষার লেখক হিসেবে নিজের পরিবেশে অনেকগুলো ভাষার আবহমন্ডলের অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন থেকেছি। সবসময় একটি শ্লেষাত্মক মন্তব্য করেছি যে ভারতে যে যত বেশী সাক্ষর সে তত কম ভাষা জানে। বেঙ্গালুরুতে অবস্থিত একটি বহুজাতিক সংস্থার সর্বময় কর্তা হয়ত শুধুই ইংরেজী জানে কিন্তু বাসস্ট্যান্ডের কুলিটি উর্দু, তেলেগু, কন্নড়, তামিল এবং হয়ত কিছুটা ইংরেজীও চালিয়ে যেতে পারে। অনেক ভাষা জীবন্ত আমাদের পরিবেশে এবং আমরা হয়ত সবসময় অচেতনভাবে এক ভাষা থেকে আরেক ভাষায় চলে যাই। বেন্দ্রের উদাহরণ দিই। তিনি বোধহয় আমার ভাষার মহানতম কবিদের একজন ছিলেন। তিনি ঘরে মারাঠি বলতেন, লিখতেন কন্নড়ে। তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কতদিন ধরে এ দুটো ভাষা ব্যবহার করছেন? বারো তেরো বছর বয়স অব্দি তো আমি জানতামই না যে আমি দুটো ভাষা বলছি। তিনি এ কথাটা বলছিলেন তখনই তাঁর পুত্রবধু এসে তাঁর কানে কিছু বললেন। তিনি তার সাথে মারাঠিতে কথা বললেন। ভাবলেনও না যে তিনি তার সাথে মারাঠিতে কথা বলছেন যখন নাকি আমার সাথে কন্নড়ে কথা বলছিলেন। এটাই ভারত এবং ইয়োরোপ এটা বুঝতে পারেনা।

_____________________________________________________________________
*এই লেখাটি সুমিত্রা চিস্তি স্মারক বক্তৃতা ২০০৯এর অংশবিশেষের অনুবাদ। সোশ্যাল সাইন্টিস্ট জুলাই-আগস্ট ২০০৯ সংখ্যায় প্রকাশিত।

বিশ্বনগরের ভাষার অতীতের সংস্কৃত এবং এখনকার ইংরেজী শক্তি সত্ত্বেও তথাকথিত ভার্নাকুলার বা দেশোয়ালী ভাষার  নিজস্ব কিছু সুবিধে এবং ব্যবহারের জায়গা সবসময় আছে। ক্ষেত্রীয় ভাষার মহান লেখকেরা সব সময় জানতেন যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভুত্ব একটি সমস্যা কিন্তু ভিতরের সাহিত্যগুণটি নির্দ্ধারিত করতে পারেননি। আমি জানি আমি সমস্যাটার সরলীকরণ করছি। পরে ফিরবো, শর্তাদি নিয়ে।

আরেকটি গল্প বলি, কালিদাসের কুমারসম্ভব থেকে। আমরা সবাই জানি যে পার্বতী শুধু তাঁর সৌন্দর্য দিয়ে শিবের মন জয় করতে পারেননি আর তাই কঠোর তপস্যা করে শিবকে পেয়েছিলেন। গোটা সৃষ্টির জন্য এটি আনন্দসংবাদ ছিল কেননা তারকাসুর, সে সময়কার এক স্বৈরাচারী রাজা সৃষ্টিকে নিজের কুক্ষিগত করে রেখেছিল এবং একমাত্র শিবের পুত্রই তাকে ধ্বংস করতে পারত। সমস্ত দেবতা এবং ঋষিগণ, যাঁরা এটা জানতেন এবং হরপার্বতীর মিলন ঘটাতে সফল হলেন, এসে আশীর্বাদ করলেন দম্পতিকে। বিদ্যার দেবী সরস্বতীও তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন। কবি কালিদাস সংস্কৃতে লিখছেন, তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী দেবী সরস্বতী কী ভাষায় দম্পতিকে আশীর্বাদ দেখুনঃ (কুমার সম্ভবের ডেভিড স্মিথ কৃত ইংরেজী অনুবাদ থেকে উদ্ধৃত করছি),
এবং দেবী সরস্বতী
আশীর্বাদ করলেন
নবদম্পতিকে, দ্বিবিধ ভাষায়;
চমৎকার বরকে শুদ্ধ মার্জিত সংস্কৃতে,
বধুকে সহজ বোধগম্য বাক্যে
আমি কবিতাটির ডেভিড স্মিথ কৃত চমৎকার অনুবাদ থেকে উদ্ধৃত করছি। শব্দদুটো লক্ষ করুন, দ্বিবিধ ভাষায় দ্বিধ প্রযুক্তেন। এবং শেষ পংক্তিতে জনতার ভাষার বিবরণ, সংস্কৃতের প্রশংসার বিরোধে দেশজ ভাষার ঠিক ততখানিই প্রশংসা দিয়ে করা হচ্ছে, সুখ গ্রাহ্য বন্ধনেন। মূল শব্দগুলি সহজ বোধগম্য বাক্য থেকেও বেশি ইংগিতবহ।
           
সাহিত্যের সব ছাত্র জানেন যে অত্যন্ত মার্জিত ভাষা অসুবিধেরও কারণ হতে পারে। ওয়র্ডসওয়র্থের পক্ষে পোপ এবং ড্রাইডেন কর্ত্তৃক অতিমার্জিত ভাষায় লেখা অসুবিধেজনক ছিল। তাই তাঁকে পিছিয়ে জনতার কাছে যেতে হল। ভাষা যত মার্জিত হবে, মনের অনুভুতিগুলোর অভিব্যক্তি হয়ত এত বেশী পরিচ্ছন্ন, পরিমার্জিত হয়ে পড়বে যে সত্যি বলে মনে হবে না। যেমন অষ্টাদশ শতকে ইংরেজীর নব-ধ্রুপদী কবিদের সাথে হয়ে ছিল। উইলিয়াম ওয়র্ডসওয়র্থকে পিছনে, সাধারণ বাচনভঙ্গীর কাছে পৌঁছোতে হয়েছিল যাতে নিজের কথাগুলো আন্তরিক আবেগের সাথে বলতে পারেন। যদি এমন ঘটনা একটি ভাষার আভ্যন্তরীন ক্ষেত্রে (একটি দেশজ ভাষা, জনতার ভাষার ক্ষেত্রে) হতে পারে তাহলে আপনারা ভাবতে পারেন দুটো ভাষার একটি কুলীন এবং অন্যটি সাধারণ জনতার মধ্যে কী ঘটতে পারে।

অনুমতি দিন, এবার আমি অতীতের সেই, ল্যাটিন থেকে অন্যান্য ইয়োরোপীয় ভাষা এবং সংস্কৃত থেকে ভারতীয় ভাষাগুলোর মহান বিবর্তনের দিকে যাই। বিবর্তনটা সূক্ষ্ম, ধীরগতি এবং অনাটকীয়। হাজার বছর আগে যখন সুমহান কন্নড় কবি পম্পা কন্নড় ভাষায় মহাভারত রচনা করেছিলেন (তাঁর জৈন বিশ্বাস অনুযায়ী অনেক গুরুত্বপূর্ণ বদল ঘটিয়েছিলেন তিনি; বলতে গেলে হস্তক্ষেপ করেছিলেন মহাভারতে) তখন এমন কবিও ছিলেন যাঁরা সংস্কৃতে লিখছিলেন। নিউটন ল্যাটিনে লিখেছিলেন কিন্তু মহান ডারউইন, যাঁর বিরাট সাংস্কৃতিক প্রভাব পড়েছিল তাঁর যুগের ওপর, ইংরেজীতে লিখেছিলেন তাঁর অরিজিন অফ স্পেসিজ। ১৬শ শতকে তো ইংরেজীতে ছিন্নবিচ্ছিন্ন কথা বলাও একটা সমস্যা ছিল।

স্যার ফিলিপ সিডনি বিদেশ থেকে আমদানি করা ল্যাটিনের দুরূহ শব্দগুলো ব্যবহার করার বিরুদ্ধে ছিলেন, তিনি বলতেন যে কোনো খাঁটি ইংরেজের ওই শব্দগুলো অপরিচিত মনে হবে।
তাঁকেই উদ্ধৃত করিঃ
আমি জানি কেউ হয়ত বলবেন যে ইংরেজী একটি খিচুড়ি ভাষা। হবে নাই বা কেন? সেটা হওয়াই তো ভালো, অন্যান্য ভাষার সবচে ভালোটুকু নিয়ে নেওয়া! আবার কেউ বলবেন, এর তো ব্যাকরণই নেই! সত্যিই নেই, প্রশংসার কথা, আসলে এর ব্যাকরণের দরকারই নেই। থাকলে নিজের প্রতি এত সহজ হতে পারত না। কেস, জেন্ডার, মুড, টেন্স ইত্যাদির জটিল ভিন্নতা থেকে একেবারে মুক্ত। ওসব তো মনে হয় ব্যবিলনের টাওয়ারের অভিশাপের অংশ! ওগুলো থাকলেই একটা মানুষকে তার মাতৃভাষা শিখতে স্কুলে যেতে হয়। (স্যার ফিলিপ সিডনির মৃত্যুর পর ১৫৯৫ সালে প্রকাশিত হয়)।

আপনারা নিশ্চয়ই লক্ষ করে থাকবেন যে উদ্ধৃতিটিতে, যাকে আমি দেশজ ভাষা দুশ্চিন্তা বলি (ভার্নাকুলার অ্যাংজাইটি; আমরা সবাই অল্পবিস্তর এর কষ্ট ভোগ করে থাকি) তার চিহ্ন আছে। লোকে আমায় প্রশ্ন করে, আপনি ইংরেজীতে লেখেননা কেন? আপনি ইংরেজী জানেন। অনেক বেশী লোকে আপনাকে জানবে। তখন আমি বলি, হ্যাঁ, অনেক বেশী লোকে আমাকে জানবে কিন্তু তারা এমন লোক যাদের আমি চিনিনা। যখন নাকি কন্নড়ে আমি জানি আমি কাদের জন্য লিখি। এবং তারাও আমাকে জানে। আপনাদের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মত অনুযায়ী আপনারা ভাবতে পারেন যে এর কিছু সুবিধে আছে, কিছু অসুবিধে আছে। (দেশজ ভাষাকে একটি বাচিক সমুদায়ের অপ্রমিত স্থানীয় ভাষা বলে পরিভাষিত করা হয়)। আমি কি বলতে পারি আমাদের মাঝে কয়েকজন যারা আমাদের সন্তানকে ব্যায়বহুল খারাপ ইংরেজী মাধ্যম স্কুলে দিয়ে থাকেন তাঁরা এই দুশ্চিন্তায় কষ্ট পান? এই দুশ্চিন্তা শেষ হয়নি। বেঙ্গালুরুতে ভরা আছে এমন মানুষ। আমাদের নিজেদের নাতিপুতিরা আমাদের সাথে এখন আর আমাদের ভাষায় কথা বলবেনা। নেহরু, বিশ্বায়ন আর ওই সবের এটাই ফলশ্রুতি।

এখানে আমি একটা গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করতে চাই। দেশজ ভাষা শব্দটা যে কোনো ভাষার জন্য অপমানজনক। পরিভাষাগত প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারি, কিন্তু আমাদের কথিত দেশজ ভাষাগুলো পূর্ণরূপে ভাষা। সংক্ষিপ্ত ভাবে ইয়োরোপে আর ভারতে এই দেশজ ভাষাগুলোর পুরোপুরি ভাষা হয়ে ওঠার পথটা আমায় চিহ্নিত করতে হবে।

ইয়োরোপের প্রথম নাম যিনি ল্যাটিনে নয়, আপন জনতার ভাষায় লিখেছিলেন তিনি দান্তে। (তিনি জনতার সাধারণ ভাষায় লেখার পক্ষে যক্তিও দিয়েছিলেন, কিন্তু সেই আত্মপক্ষসমর্থনটা আবার ল্যাটিনে। মিল্টনও কিছু পুস্তিকা, এবং কিছু কবিতাও, ল্যাটিনে লিখেছিলেন; রাজনৈতিক ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ইংরেজী অদৃশ্য হয়ে গেলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যেন তাঁকে ভুলে না যায়)। দেশজভাষাগত দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত হওয়া অত্যন্ত কঠিন, এমনকি যাঁরা নিজেদের কথ্যভাষা, মাতৃভাষাকে ভালোবাসেন তাঁদের পক্ষেও।

এখানে আরো দুটো মন্তব্য করব। দান্তের আগে, কন্নড় ভাষায় প্রথম কন্নড় কাজ এক হাজার বছর আগের একটি নন্দনতাত্ত্বিক গ্রন্থ, নৃপতুঙ্গ/শ্রীবিজয় রচিত কবিরাজমার্গ। কিন্তু তার থেকেও বিষ্ময়কর লাগে আমার খৃষ্টপূর্ব যুগে বলা বুদ্ধের এই কথাগুলো, যাতে উনি সেই দেশজভাষাগত-দুশ্চিন্তায় ভুগতে থাকা কয়েকজন সন্ন্যাসীকে বকছেন। বিনয় পীঠিকা থেকে উদ্ধৃত করছিঃ
দুই সন্ন্যাসী, ব্রাহ্মণজাত, দুশ্চিন্তায় ছিল যে বিভিন্ন জনগোষ্ঠি, উপজাতি ও পরিবারের অন্যান্য সন্ন্যাসীরা নিজের নিজের উপভাষায় পুনরুচ্চারণে বুদ্ধের বাণীকে বিকৃত করে দিচ্ছে। তাঁরা বুদ্ধকে বললেন, আমরা বরং বুদ্ধের বাণীকে বৈদিক সংস্কৃত কাব্যে ধরে রাখি। কিন্তু বুদ্ধ, তথাগত, তাঁদের ভর্ৎসনা করলেন, বিভ্রান্ত মানুষ! তাহলে তারা আর কথোপকথনে আসবেনা যারা এখনও ধর্মান্তর ঘটেনি…” এবং তিনি সমস্ত সন্ন্যাসীদের আদেশ করলেন, তোমরা বুদ্ধের বাণীকে বৈদিক সংস্কৃত কাব্যে ধরবেনা। সেটা করলে জটিলতা বাড়িয়ে তোলা হবে। সন্ন্যাসীগণ, আমি তোমাদের অধিকার প্রদান করছি, বুদ্ধের বাণীকে প্রত্যেকে নিজের উপভাষায় শেখ।
ল্যাটিন এবং অন্য সমস্ত বিবর্তন থেকে আগের এই কাহিনী।

এবার একটি এমন ঘটনা নেব যেটি অতীতে ইয়োরোপে এবং ভারতে দুজায়গাতেই ঘটেছে। আমাদের যুগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বইগুলোর একটি, প্রফেসর শেলডন পোলক রচিত মানুষের দুনিয়ায় দেবতাদের ভাষা (পার্মানেন্ট ব্ল্যাক, ২০০৭)। তাতে উনি এই ঘটনাটি বিবৃত করেছেন। ল্যাটিন ইয়োরোপীয় দেশজভাষাগুলোর জন্য এবং সংস্কৃত ভারতীয় দেশজভাষাগুলোর জন্য জায়গা করে দিচ্ছে। কিন্তু ল্যাটিনের একটা গৃহকোণ ছিল, সংস্কৃতের ছিল না। সংস্কৃত সারা ভারতে ছিল। তাই নিজেকে ক্ষমতাশালী করতে পুরোহিতের ক্ষমতার প্রয়োজন তার ছিল। কিন্তু সংস্কৃতকে সব জায়গায় মান্য করা হত নান্দনিক কারণে, কেননা আপনারা যদি শাসনগুলো দেখেন, শুনতে ভালো লাগে বলে সমস্ত রাজারা প্রশংসিত হতে চাইতেন সংস্কৃতে। অথচ বাস্তব ব্যাবহারগুলো দেখুন কত জমি কাকে দেওয়া হবে মাতৃভাষায় লেখা আছে।
আজকের প্রসঙ্গ অনুযায়ী আমি প্রফেসর পোলকের গবেষণাটি ইষৎ সরলীকৃত ভাবে পেশ করব। উনি প্রথমে গ্রামশিকে উদ্ধৃত করেনঃ আমি মনে করি যদি ভাষাকে সংস্কৃতির উপাদান এবং সে অর্থে সাধারণ ইতিহাসের উপাদান, বুদ্ধিজীবীদের জনপ্রিয়তা এবং জাতীয়তার প্রধান অভিব্যক্তি মনে করা হয়, তাহলে সংস্কৃতির অধ্যয়ন উদেশ্যহীন নয়, শুধু জ্ঞানজাগতিক

প্রথমঃ সাহিত্যিক এবং রাজনৈতিক অভিব্যক্তির সংহিতা হিসেবে সংস্কৃতের পুনরাবিষ্কার করা হয়েছিল তার আগে এটি ধর্মকর্মের পবিত্র ভাষা, মৌখিক ভাবে প্রেরিত বেদাদির ভাষা ছিল। (অলিখিত, মুখে মুখে প্রেরিত বেদকে, মাঝে মাঝে সুমহান কাব্যিক অংশ থাকা সত্ত্বেও, প্রাথমিক ভাবে কখনোই কাব্যের মধ্যে ধরা হত না)। পুরুষসুক্ত নিছক কবিতা নয়, কিন্তু কালিদাসের মেঘসন্দেশ মূলতঃ কবিতা।

দ্বিতীয়ঃ দ্বিতীয় সহস্রাব্দের শুরুতে স্থানীয় বাচিক রূপগুলো নতুন সাহিত্যভাষা হিসেবে সম্মান পেল এবং সংস্কৃতের প্রভুত্বকে চ্যালেঞ্জ করতে শুরু করল। (সাহিত্যের বাচিক রূপগুলো প্রথমে লিখিত অক্ষরে অধিষ্ঠিত হল, তারপর সেগুলোর সাহিত্যিক পরিমার্জন সাধিত হল)। লিখিত অক্ষরে অধিষ্ঠিত হওয়া মানে বর্ণমালা পাওয়া। কন্নড় তামিলের আগে পেয়েছিল। আর তারপর সাহিত্যিক পরিমার্জন, যেমন কবিরাজমার্গে বলা আছে, কবিতা কাকে বলে ইত্যাদি। আপনারা জানেন, কোনো সাহিত্য বা গ্রন্থাংশের বিবেচনা করতে এ দুটো গুরুত্বপূর্ণ। এমন মানুষ আছেন যাঁরা বাইবেল সাহিত্য হিসেবে পড়েন, কিন্তু ইলিয়ট বলেছিলেন, না, আপনি যদি সাহিত্য হিসেবে পড়েন তাহলে এটা আর বাইবেলের মত গুরুত্বপূর্ণ বই থাকেনা, কবিতা হয়ে যায়। তাই ইলিয়ট ওভাবে পড়া স্বীকার করেননা।

তৃতীয়ঃ পশ্চিম ইয়োরোপে একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক লক্ষ করা যায় নব্যল্যাটিন সাহিত্য এবং বিশ্বমুখী রোমান সাম্রাজ্যের একসাথে উত্থান এবং আঞ্চলিক রূপের উদ্ভবে দুয়েরই স্থানচ্যুতি। তার মানে পুরোনো দুনিয়ার ভাষা, অর্থাৎ সাধারণ ভাবে কুলীনদের ব্যবহার করা ভাষাটি যখন পরিত্যক্ত হয়, একটা বিকেন্দ্রীকরণ ঘটেছিল। আমরা একজন টলস্টয়, একজন দস্তয়েভস্কি, একজন দান্তে, একজন শেক্সপিয়র পেয়েছিলাম। ভারতে আমরা পেয়েছিলাম একজন তুলসীদাস, একজন তুকারাম, একজন পম্পা এবং আরো সমস্ত মহান লেখকদের। আর এখন একটা উল্টো প্রক্রিয়া আমরা দেখতে পাচ্ছি। বিশ্বায়নের মাধ্যমে আমরা আবার কেন্দ্রীভূত হচ্ছি। খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এক হাজার বছর ধরে যা সম্পন্ন হচ্ছিল, তার মুখ মনে হয় বিপরীত দিকে ঘুরে যাচ্ছে। একজন জার্মান এখন মনে করে যদি সে ইংরেজী না জানে তাহলে আন্তর্জাতিক হতে পারবেনা। সে সব পুরোনো সুন্দর দিনগুলোয় স্যর সি ভি রমণ সমস্ত পদার্থবিদদের জন্য পাশে জার্মান ডিকশনারি রাখা আর জার্মান জার্নাল পড়া আবশ্যিক করে দিতেন। মাইসোর বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যায় অনার্সের সমস্ত ছাত্রদের জন্য জার্মান আবশ্যিক বিষয় ছিল। এখন দেখতে পাচ্ছি খুব শীগ্‌গির সব ইংরেজীর দিকে চলে যাচ্ছে। ব্রিটিশ ইংরেজী নয়, আমেরিকান ইংরেজী।

কন্নড় ভাষায় প্রথম বই কবিরাজমার্গ এবং সেটি ৮৭৫ সাল নাগাদ প্রকাশিত হয়েছিল। গুরুত্বে এই বইটির সাথে তুলনীয় দান্তের দ্য ভাল্গারি এলোকোয়েনশিয়া (দেশজ ভাষার অলঙ্কারশাস্ত্র বিষয়ক)। সম্ভবতঃ দান্তের নির্বাসনের আগে ১৩০৩ থেকে ১৩০৫ সালের মধ্যে বইটি লেখা হয়েছিল। বইটি অসমাপ্ত এবং কীর্তিউজ্জ্বল একটি দেশজ ভাষার সন্ধানে ল্যাটিনে রচিত বই। বইটিতে সাহিত্যিক রূপ হিসেবে গানের অবয়বের গঠনাদি বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

কবিরাজমার্গ আগের এবং কন্নড়ে লিখিত যখন নাকি দান্তের বইটি ল্যাটিনে লিখিত, যদিও দেশজ ভাষার পক্ষ সমর্থনে। এটা লক্ষ্যণীয়।

কবিরাজমার্গ' যে কথাগুলো বলতে চায় তা আজও আমাদের জন্য মূল্যবান। আমি সংক্ষেপে সেগুলো রাখছি। শেল্ডন পোলক এই বইটার গভীরে গিয়ে দেখেছেন আর প্রখ্যাত কন্নড় ইতিহাসবিদ ডাঃ শেট্টারও গুরুত্বপূর্ণ বই লিখেছেন এর ওপর। আমার কৃত এই সারাংশের জন্য আমি দুজনের কাছেই ঋণী।
কবিরাজমার্গের লেখক বলছেনঃ
সংস্কৃত এবং প্রাকৃত, দুই ভাষাতেই মার্জিত সাহিত্য রচনা করা যেতে পারে, যার যেমন ইচ্ছে, কেননা দুই ভাষাতেই প্রচুর পরিমাণে সাহিত্যের লক্ষ্য এবং লক্ষণ বর্তমান। কিন্তু আমি যে আলোচনাটি এখানে শুরু করতে যাচ্ছি তাকে বোধগম্য করতে গেলে এখানে ওখানে বর্জিত অংশগুলো ভিক্ষে করতে হবে। এবং কারোর পক্ষেই কন্নড় ভাষার জন্য এ কাজটা করা অত্যন্ত কঠিন কেননা সেই লক্ষ্য আর লক্ষণ, যা সংস্কৃত আর পালীর প্রাচীন শিক্ষকেরা দিয়ে গেছেন, কন্নড়ের জন্য একেবারেই নেই। (পোলককৃত অনুবাদ)

গ্রন্থটিতে লেখক পালে-কন্নড় (অর্থাৎ পুরোনো কন্নড়) কে আক্রমণ করেছেন। বলেছেন ভাষাটা সেকেলে আর পুরোনো দিনেরই উপযুক্ত। ও ভাষা ব্যবহার করা মানে, লেখকের ভাষায়, বৃদ্ধার সাথে সম্ভোগ করতে চাওয়া। আমরা অনুমান করতে পারি যে নবম শতাব্দীতে রচিত কবিরাজমার্গের আগেও কন্নড় সাহিত্য ছিল। তামিলও সাহিত্য হিসেবে ছিল কিন্তু আমি জেনেছি যে সেটি মৌখিক/বাচিক সাহিত্য ছিল; কন্নড় সাহিত্য প্রথম লেখা হয়েছিল। এগুলো জেনেছি কন্নড় বিদ্বানদের কাছে এবং বিদ্বজ্জনোচিৎ বিষয়ে ভুল করে থাকলে নিজেকে সবসময় শুধরে নিতে আমি রাজি, কেননা আমি বিদ্বান নই।

কবিরাজমার্গের লেখক তাঁর ভাবনার অনেক কিছু সংস্কৃত সাহিত্যতাত্ত্বিক ভামহ এবং দন্ডি থেকে নিয়েছেন, কিন্তু সেগুলোকে কন্নড়ের প্রয়োজন মত করে নিয়েছেন। কিছু যোগ করেছেন এবং তাঁদের কিছু কিছু সুত্র বদলে নিয়েছেন। আমাদের দিয়েছেন দুটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা মার্গ আর দেসি যেদুটো এখনো কন্নড় লেখকেরা ব্যবহার করতে পারেন। মার্গ হল রাজকীয় প্রধান সড়ক আর দেসি হলও দিশি, আমাদের আপন। সবচেয়ে লক্ষ্যণীয় যে তিনি কন্নড়কে দেবলোক হতে অবতরিত বাণী, সংস্কৃতের মত দেবভাষা মনে করছেন না, বরং ক্ষেত্রানুসারে পরিভাষিত করছেন। বিদ্বানেরা বলেন যে কবিরাজমার্গের লেখকের ভুগোল ভাসা ভাসা এবং অস্পষ্ট। আবার তাঁদের মাঝে কয়েকজন আছেন যাঁরা বলেন যে এটাই তাঁর শক্তিওঃ
পৃথিবীর বৃত্তের মধ্যে, কাবেরী আর গোদাবরী নদীর মধ্যবর্তী স্থানে আছে সেই সংস্কৃতি-ভূমি (নাডু) কন্নড়, সুপরিচিত জনপদ, প্রসিদ্ধ, বিশিষ্ট রাজত্ব (বিষয়)। এবং এরও ভিতরে, কিসুভোলালের মধ্যে আছে একটি সংস্কৃতি-ভূমি, কোপন, পুলিগেরে, বনকোন্ডার বিখ্যাত সুমহান নগরী, ভালো মানুষেরা যার প্রশংসা করে। যদি কেউ জানতে চায় তো জানুক যে সেখানেই আছে কন্নড়ের হৃদয়ভূমি কন্নড় তিরুল।
এবং আমাকে জানানো হয়েছে, লেখক যে তিরুল কন্নড়ের সুপারিশ করছেন সেটা রাজধানীর কন্নড় নয়। রাজধানী থেকে দূরের। তাঁকেই উদ্ধৃত করা উচিৎঃ
কন্নড় ভবিতমদ জনপদম্‌ - যে জনতা নিজেকে কন্নড়ভাষী মানে এবং নিজের পরিচয় কন্নড় ভাষায় পায়।
            তাঁর শব্দে, কন্নড়ড়োল ভবিতমদ জনপদম্‌ - কন্নড়ে কল্পিত দেশ ও জনতা।
একটি ভাষা যেটি যাত্রা করেনা, একটি ক্ষেত্রবিশেষের মানুষকে পরিভাষিত করে। কিন্তু জনতার জীবনে ভাষার প্রয়োজন এখানেই ফুরোয় না। কেননা লেখক অনুসারে, সংস্কৃতের মত বিশ্বজনীন ভাষার বিশেষ যে কাজগুলো, সেগুলো বহির্জগতের সাথে সম্পর্কিত বিভাগবিশেষে প্রতিফলিত হয় বসুধবলয় বিষয় বিশেষমদেশজভাষাগতদুশ্চিন্তার কোনো স্থান নেই এখানে। যখন নাকি দান্তেরও এই দুশ্চিন্তা ছিল, যদিও কবিতায় নয়।

আমাদের প্রথম মহান কবি পম্পা তাঁর বিক্রমার্জুন বিজয়ম এমনই তিরুল কন্নড়ে লিখেছিলেন। তিনি কালিদাসের কৃতির সাথে পরিচিত ছিলেন কিন্তু কখনো ভাবেননি যে একটি এলাকাভিত্তিক ভাষা কালিদাসের কৃতির সামনে দাঁড়ানোর পক্ষে অপর্যাপ্ত হতে পারে। তিনি মার্গ (সংস্কৃতের জগৎ) এবং দেসি (দেশজভাষা ও তার বাগ্‌ধারা) কে মিলিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর কাব্যিক প্রক্রিয়া নিচে বর্ণিতঃ
কল্পনার দিক থেকে কাব্যকে নতুন হতে হবে এবং রচনার বুনট কোমল হতে হবে। এমত গঠিত হওয়ার পর রচনাকে স্থানীয় বাগ্‌ধারা (দেসিওল পুগুবুড়ু) গ্রহণ করতে হবে এবং শাস্ত্রীয় বাগ্‌ধারায় (মার্গডোল তালুবুড়ু) প্রবেশ করতে হবে। এই পথেই কাব্য সত্যই সুন্দর হয়ে উঠবে মঞ্জরী ও নবুঙ্কুরের ভারে নুয়ে পড়া, মৌমাছিতে ঘিরে ধরা, কোকিল এবং শুধুই কোকিলের গানে ভরা, বসন্তে কচি আমগাছের মত সুন্দর। (পোলককৃত অনুবাদ)

মার্গ/দেসি ধারণাটা আজ অব্দি কন্নড়ভাষা ব্যবহারের পথপ্রদর্শক হয়ে আছে। সেই কন্নড় যাকে সমৃদ্ধ হতে হবে ইংরেজী, ফার্সী ও অন্যান্য প্রতিবেশী ভাষা থেকে শব্দ ধার করে এবং তবুও নিজের বিশুদ্ধতা বজায় রাখতে হবে। এক মহান কন্নড় কবি আমায় একবার বলেছিলেন যে কন্নড় এমন এক অপ্সরা যার বহু প্রেমিক থাকা সত্ত্বেও কুমারীত্ব নষ্ট হয়নি।

প্রতিটি ভাষার একটি সামনের উঠোন ও একটি পিছনের উঠোন আছে। গ্রামে নিজের বাড়িটার কথাই ধরি। বড় বাড়ি। একটি চাউড়ি আর একটি সামনের উঠোন ছিল। ভিতরবাড়ি আর পিছনের উঠোন ছিল। সে উঠোনে একটি কুঁয়োও ছিল। সামনের উঠোনে আমার বাবার বন্ধুবান্ধবেরা আসতেন। বাবা হরিজন খবরের কাগজটা হাতে নিতেন, অনুবাদ করে ওদের শোনাতেন, স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং ওই ধরণেরই বিষয়াদি নিয়ে কথা বলতেন। আবার রামায়ণও শোনাতেন। কিন্তু যখন তিনি পিছনের উঠোনে যেতেন, সব জাতের মহিলারা এসে ভীড় করতেন আর তাদের সাথে সব বিষয়ে কথা বলতেন আমার মা। আমি তখন শিশু; এ সমস্ত কিছু শুনতাম। তাই আমি লেখক হলাম। যদি শুধু সামনের উঠোনে থাকতাম তাহলে রাজনীতিবিদ হতাম। প্রায় সবকটি ভারতীয় ভাষার একটি করে পিছনের উঠোন আছে। এবং আছে অতি-শুদ্ররা, যারা আজ সাক্ষর হয়ে উঠেছে এবং নিজেদের সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতা নিয়ে আসছে। লিখিত সাহিত্য থেকে অনেক বেশি আমাদের মৌখিক বা বাচিক সাহিত্য। এ সাহিত্য আছে পিছনের উঠোনে। আমাদের ভাষাগুলোর বিরাট ভবিষ্যৎ আছে কেননা পিছনের উঠোন সারাক্ষণ যোগান দিয়ে চলেছে। ইংরেজী ভাগ্যবান কেননা এর পিছনের উঠোন ছিল; লন্ডনে নয়, ইয়েটসের আয়ারল্যান্ডে, আফ্রিকায় এবং ভারতে। পিছনের উঠোন একটা ছিল আর তাই সেই পিছনের উঠোনের জনতা ইংরেজীকে বাঁচিয়ে রেখেছে।

ইংরেজী ছিল জ্ঞানের প্রবেশপথ। ওয়ারেন হেস্টিংসের অপসারণ আমাকে মুখস্ত করতে হয়েছিল কেননা বাবা বলতেন, দেখ, ব্রিটিশরা এত সত্যনিষ্ঠ যে তারা ওয়ারেন হেস্টিংসকেও সাজা দিয়েছে। ওর বক্তৃতাটা দেখ আর মুখস্ত করে ফেল।

তিনটে করে ভাষা সবাই জানে। আমি তাদের একটিকেও মাতৃভাষা বলিনা। মাতৃভাষা শব্দটা একমাত্র ইয়োরোপেই ব্যবহার করা চলে। কন্নড়ে আমি বলি মনে মথু, বীদি মথু, অত্তড় মথু। মনে মথু হল ঘরের ভাষা। অনেক কন্নড় লেখক বাড়িতে তেলেগুতে কথা বলেন। অগ্রহার কন্নড় ভাষায় লেখেন কিন্তু তাঁর মাতৃভাষা তেলেগু। অনেক লেখক, কবি আছেন যাঁরা কন্নড়ে লেখেন কিন্তু বাড়িতে তামিল বলেন। বেন্দ্রে যেমন, লিখতেন কন্নড়ে কিন্তু বাড়িতে বলতেন মারাঠি। সাংস্কৃতিক দিক থেকে এটা প্রয়োজনীয়। সারা ভারতে কেই নিজের মনে মথু ছেড়ে দেয়না।

বীদি মথু প্রদেশের ভাষা, মানে যে ভাষায় আপনি দুষ্টুমি করে রাস্তায় কোনো ছেলে বা মেয়ের সাথে কথা বলেন। কন্নড় হল বীদি মথুঅত্তড় মথু হল ওপরতলার ভাষা। রামানুজম একটি কবিতায় লিখছেনঃ
যখন খিদে পেত, খাবার পেতে মায়ের সাথে তামিলে কথা বলতাম। যখন মাথায় দুষ্টুমি খেলত, ছেলে মেয়েদের সাথে কন্নড়ে কথা বলতাম। আমার বাবা ছিলেন গণিতের অধ্যাপক। যখন আমায় ডাকতেন, ইংরেজীতে কথা বলতেন।

রামানুজমের বাবা রামানুজমের সাথে ফার্সীতে বা কোনো এককালে সংস্কৃতে কথা বলতেন হয়ত। হয়ত ভবিষ্যতে চীনের অর্থনৈতিক গুরুত্ব বেড়ে গেলে চীনেভাষা হবে আন্তর্জাতিক ভাষা। এবং তাতে কিছু আসে যায়না আমার। কিন্তু একটা অত্তড় মথু আমাদের দরকার, সম্পর্ক ভাষা হিসেবে। শঙ্করের দরকার পড়েছিল, রামানুজমের দরকার পড়েছিল, গান্ধীর দরকার পড়েছিল। আমারও দরকার, নইলে আপনাদের সাথে আমি কথা বলতে পারতাম না। শুধু মাতৃভাষার কথা বলে ব্যপারটাকে আবেগের সাথে জড়িয়ে দেবেননা। এটা ইয়োরোপ নয়। আমাদের দেশের সবকটি অঞ্চলে আমাদের ভাষাগুলো চলে। কর্ণাটকে যদি শুধু কন্নড় ধরণের ব্যাপার-স্যাপার চলে তাহলে তো এটা ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র হয়ে পড়বে! কর্ণাটকে অন্যান্য ভাষার জায়গা অবশ্যই থাকা উচিৎ এবং অন্য ভাষাভাষীদেরও বীদি মথুর বিষয়ে জানা উচিৎ। এটাই ভাষার প্রতি সঠিক দৃষ্টিকোণ।


ভাষা এবং ভারত

পোপের ক্ষমতার সাম্রাজ্য ভেঙে ধুলিসাৎ হওয়ার পর যে অর্থে ইয়োরোপে জাতিরাষ্ট্রের ধারণার আবির্ভাব হল, ভারত সে অর্থে একটি জাতি নয়, সভ্যতা। রবীন্দ্রনাথ এবং গান্ধী দুজনেই, ভারতে স্বাধীনতা সংগ্রাম চলার কালে এটা হৃদয়ঙ্গম করেছিলেন। হিন্দ স্বরাজএ গান্ধী ভেবেছিলেন যে আধুনিক পশ্চিমী সভ্যতা খারাপ এবং ব্রিটিশ শাসন থেকে আমাদের মুক্তির সংগ্রাম ব্রিটেনকেও, আধুনিক সভ্যতা সম্পর্কে তার ভ্রান্ত ধারণার কবল থেকে মুক্ত করবে। সোভিয়েত সঙ্ঘের বিফলতার, আধুনিক চীন ও বিশ্বায়নপথিক ভারতের লোভী সংস্কৃতির আমরা যেটুকু দেখেছি, আমরা হৃদয়ঙ্গম করেছি যে ক্ষমতার কেন্দ্রীভবনের সবকটি রূপই অনিষ্টকর। এবং টলস্টয় ও গান্ধীর মত দ্রষ্টা চিন্তানায়কদের মধ্যে নৈরাজ্যবাদী চিন্তার যে মহান ভাবনাগুলো পাওয়া যায় তার সবটা এক কথায় খারিজ করার দরকার নেই। তাঁরা বিশ্বাস করতেন যে মানবজাতি যদি স্বশাসিত ছোটো ছোটো সমুদায়ে জীবন ধারণ করে তাহলে তারা প্রকৃতির সাথে একাত্ম হবে আর সৃজনশীল হবে। এরই মধ্যে গান্ধী আবার প্রধানতঃ গ্রামীণ সমুদায়ের কথাই বলেছেন।

নেহরু মূলতঃ একজন বিশ্বনাগরিক ভাবুক, গান্ধীর স্বপ্নের প্রতি আকর্ষণটা আবেগের ছিল। অপেক্ষাকৃত ভাবে ছোটো, ভাষা-ভিত্তিক, একটা সীমা অব্দি স্বশাসিত রাজ্য গান্ধীর পঞ্চায়েত-রাজ আদর্শের কাছাকাছি ছিল। তবুও, পশ্চিমা অর্থে শক্তিশালী ভারতের স্বপ্ন দেখা নেহরু ভাষাভিত্তিক রাজ্য সৃজনের বিরুদ্ধে ছিলেন। কিন্তু যেহেতু নেহরু খাঁটি গণতান্ত্রিক ছিলেন তাই ভাষাভিত্তিক রাজ্যের দাবী মানতে বাধ্য হয়েছিলেন। বিশ্বনাগরিক ভারতীয় ইংরেজীশিক্ষিত যে শ্রেণীটা ছিল তারা যেমন সার্বজনীন ভোটাধিকারের বিরুদ্ধে ছিল তেমনই ভাষাভিত্তিক রাজ্যেরও বিরুদ্ধে ছিল। এদের কাছে কয়েকটি তৈরি শব্দ আছে ক্ষুদ্রতর স্বশাসিত সমুদায়ভিত্তিক রাষ্ট্রশক্তির প্রতি আকর্ষণ ও স্বপ্নকে হেয় করার।

ওই শব্দগুলো আমরা জানি সঙ্কীর্ণমনা, উগ্র জাতীয়তাবাদী ইত্যাদি। আমি এখানে স্পষ্ট করে বলতে চাই যে আমার ভাবনায় একজন বিশ্বনাগরিক ভাবুক ইউরোপকেন্দ্রিক, যখন নাকি একজন সমুদায়ভিত্তিক ভাবুক জৈব-বুদ্ধিজীবী এবং বিশ্বমানবতাবাদী।

কয়েক বছর আগে বিবিসি আমায় খুঁজে বার করল। তাদের বিশিষ্ট নির্দোষ হতবুদ্ধিতায় জিজ্ঞেস করল, এটা কি সত্যি যে আমাদের রাজ্য কর্ণাটকে (যার মধ্যে ব্যাঙ্গালোরের মত, তথ্যপ্রযুক্তির বিশ্বায়িত শহর আছে) কন্নড় আবশ্যিক হতে চলেছে? আমিও ততোধিক ছদ্ম-হতবুদ্ধিতায় জবাব দিলাম, এটা কি সত্যি যে ইংল্যান্ডে ইংরেজী আর ফ্রান্সে ফরাসি আবশ্যিক ছিল?

ভারতে আমরা বুঝেছি যে যদি আমরা দেশটাকে অতি-কেন্দ্রীয়তার দিকে নিয়ে যাই তাহলে আমাদের বালকানাইজ হয়ে পড়ার, ছোটো ছোট টুকরোয় ভেঙে যাওয়ার বিপদ ঘনাবে। এক কালে তামিলনাডু এধরণের প্রচার ও উগ্র আন্দোলনের উদাহরণ ছিল। আসাম এখনও আছে। আমাদের সভ্যতা তিনটে তত্ত্বের ওপর দাঁড়িয়ে গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং যুক্তরাষ্ট্রীয়তা। যখন ইন্দিরাজি শাসনে ছিলেন তখন তিনি যুক্তরাষ্ট্রীয়তাকে খর্ব করতে শুরু করলেন, সব রাজ্যে নিজের পোষা লোকগুলোকে বসিয়ে দিলেন আর হাইকমান্ড মানুষের সহ্যসীমা থেকে বেশি হাই অর্থাৎ উঁচু হয়ে গেল। পাঞ্জাবে শুরু হল বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন। ইন্দিরাজী জরুরী অবস্থা ঘোষণা করলেন। ফলে গণতন্ত্রও খর্ব হল আর তার ভয়ানক দাম দিতে হল তাঁকে। হালের বছরগুলোয় ভারতীয় জনতা পার্টি চেষ্টা করল আমাদের রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ প্রকৃতিটা বদলাতে আর ইন্ডিয়া শাইনিংএর স্লোগান সত্ত্বেও তাদের ক্ষমতাচ্যূত হতে হল।

আমরা সংস্কৃতির বহুলতাসম্পন্ন একটি সভ্যতা থাকার পথ খুঁজছি আর সেপথে এক কদম ছিল ভাষাভিত্তিক রাজ্যের গঠন। কিন্তু আমাদের বুঝতে হবে যে কর্ণাটকও একটি ক্ষুদ্র-ভারত এবং কন্নড় ভাষাসংস্কৃতির সামগ্রিক পরিবেশেও যেন কর্ণাটকের অন্যান্য ভাষাসংস্কৃতিগুলি যেমন টুলু, কোঙ্কণী, কোডাভা এবং উর্দু নিজেদের বহিরাগত না মনে করে। প্রায় সবকটি ভারতীয় ভাষাভিত্তিক রাজ্যে এই পরিস্থিতিটাই বাস্তব আর ভাষার এই মেলবন্ধনটাই কাম্য।

বেঙ্গালুরুতে আমাদের সন্তানেরা এক লাখ টাকা খর্চা করে আর বাজে প্রাইভেট স্কুলে ভর্তি হয় যেখানে সবকিছু ইংরেজীতে শেখানো হয়। স্কুল-ঘরে তারা জ্ঞানসৃজন করেনা, জ্ঞান শুধু তাদেরকে হস্তান্তরিত করা হয়। যখন নাকি মাতৃভাষী বিদ্যালয়ে স্কুল-ঘরে জ্ঞান সৃজন সম্পন্ন হয়, তারপর ছাত্রেরা ইংরেজী বা অন্যান্য ভাষায় যেতে পারে। আমি ইংরেজী বিরোধী নই। কিন্তু ছাত্রদের জ্ঞানসৃজন করা জানা উচিৎ। সার্বজনীন বিদ্যালয় তো স্বপ্ন হয়ে গেছে এখন। সরকার আশ্বাসন দিয়ে যায় কিন্তু সার্বজনীন বিদ্যালয় উপেক্ষিত হয় কেননা আমাদের সন্তানেরা সে স্কুলে যায়না। অথচ সরকারি স্কুলশিক্ষকেরা বেশি প্রশিক্ষিত, বেশি মাইনে পান। কেরলে দেখলাম ব্যক্তিগত উদ্যোগে ইংরেজী-মাধ্যম স্কুল খোলা হচ্ছে, তাতে শিক্ষক বহাল করা হচ্ছে খুব কম মাইনে দিয়ে। তাদের ইংরেজী অত্যন্ত খারাপ। কিন্তু গরীব মানুষও মনে করে যে যদি তারা ইংরেজী না জানে তাহলে বেশি দূর এগোতে পারবেনা। কেরল সরকার গঠিত একটি কমিটির তরফ থেকে, ছমাস পরিস্থিতির অধ্যয়ন করার পর যখন আমি আমার রিপোর্ট পেশ করেছিলাম তাতে সুপারিশ করেছিলাম যে সমস্ত সরকারি স্কুলগুলো যেন প্রথম শ্রেণী থেকে মৌখিক ইংরেজী শেখানো শুরু করে, কিন্তু শিক্ষাদানের মাধ্যম থাকবে ছাত্রদের মাতৃভাষা। কমিটির দুজন সদস্য রিপোর্টে স্বাক্ষর করেননি, কেননা বেসরকারি স্কুলমালিকদের জোট অত্যন্ত শক্তিশালী। যদি সরকারি স্কুল, সার্বজনীন বিদ্যালয়ের মান ভালোরকম উন্নত হয়, আমাদের সন্তানেরাও সে স্কুলে যাবে আর বেসরকারি উদ্যোগ মার খাবে। বেঙ্গালুরুতেও এটাই সত্য। সব জায়গায় এটা সত্য।

আমি মনে করি আমাদের কবিরাজমার্গএর যে আদর্শ, মার্গ আর দেসিকে মিলিয়ে এমন একটি ভাষা তৈরি করা যেটি নিজের এলাকার বাইরে হয়ত যাবেনা কিন্তু সমস্ত বিশ্বকে প্রতিবিম্বিত করতে সক্ষম হবে, তেমন ভাষা তৈরি করা সম্ভব যদি আমরা মনে মথু, বীদি মথু আর অত্তড় মথুকে যুক্ত করে নিতে পারি আর কোনো একটাকেও না ছাড়ি।

একটা গল্প দিয়ে শেষ করব। শ্রীকৃষ্ণ পরমাত্মা একটি সার্বজনীন বিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন। সেখানে তাঁর সাথী হলেন কুচেলা বা সুদামা। এক দরিদ্র মানুষ। আমার পৌত্রের সাথে সেটা হবেনা। এই সুপরিচিত গল্পের সুত্রে যা আমি বলতে চাই তা হল যে কুচেলাকে বন্ধু হিসেবে পেয়েছিলেন বলেই কৃষ্ণ ভগবান হতে পেরেছিলেন। সুদামা কৃষ্ণের বন্ধু না হলে এই পুরাকথাটা সম্ভবই হতনা। এবং কুচেলার মনেও কিছু আশা ছিল কেননা কৃষ্ণ তার বিদ্যালয়ের সাথী ছিল। আজ, আমরা আশাও ধ্বংস করেছি, মহিমাও ধ্বংস করেছি। এবং সেটাই বিশ্বায়ন। আমাদের সার্বজনীন বিদ্যালয় প্রণালীতে ফিরে যেতে হবে।       

  [ইংরেজী থেকে ভাষান্তরঃ বিদ্যুৎ পাল]     

     

No comments:

Post a Comment