এই লেখাটা এক বিহারবাসী
বাঙালি কিম্বা বাংলাভাষী বিহারীর দৃষ্টিভঙ্গী, যে নিজের ও নিজের ভাষাগত সমূদায়ের
মাতৃভাষা সংক্রান্ত অধিকারগুলো সরকার ও প্রশাসনের কাছ থেকে আদায় করে নিতে দল বেঁধে
(আমি বিহার বাঙালি সমিতির সদস্য) লড়ছে – পরিস্থিতি মেনে নেওয়ার বা মানিয়ে চলার
প্রবৃত্তিগুলো রুখছে।
বিহার বাঙালি সমিতি মনে
করে বিহারবাসী বাংলাভাষী সমুদায় প্রধানতঃ বিহারেরই অংশ, প্রবাসী নয় (কিছু
চাকরিজীবী, কাজেকর্মে আসা মানুষজন বাদে) এবং বিহারের রাজনৈতিক প্রেক্ষিতেই তাদের
নিজেদের লড়াইটা লড়তে হবে।
দ্বিতীয়তঃ, লেখাটার
নামের পিছনে যে ধারণাটা কাজ করছে সেটাও বলে দিই।
মাতৃভাষা শব্দটায়
বোঝাবার কিছু নেই। মাতৃভাষা মাতৃভাষা। যার পাঠ দিয়ে আমাদের শিক্ষা শুরু হওয়া উচিৎ।
তারপরে আসে, একটি বহুভাষী দেশের জন্য, সম্পর্কভাষা বা লিংগুয়া ফ্রাংকা, যেটা আবার
ভারতসঙ্ঘের সঙ্ঘীয় বা কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রভাষাও। আমি বলছি এই
ভাষাটি প্রকৃত অর্থে মৈত্রীভাষা হওয়া উচিৎ। কিন্তু তা হয়ে উঠতে পারছে না। বৈরিতার
একটা জায়গা গড়ে তুলছে সরকারের শিক্ষানীতি ও আমলাতন্ত্র। যদি বৈরিতার সে জায়গাটা
শেষ করে দেওয়া যায় রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক যুক্ত প্রচেষ্টায় তবেই একসাথে
মিলে এই বাজার-মৌলবাদের যুগে পুনরুজ্জীবন ঘটানো যাবে দেশভাষার যা বস্তুতঃ ভারতীয়
ভাষাসমূহের কলতান – এক মহান কোরাস।
বিষয়ে প্রবেশ করার আগে
আমার মনে হয় ভাষাসম্পর্কিত যে সকল অধিকার ও কর্তব্য – নাগরিকের এবং রাষ্ট্রশক্তির –
এ দেশের সংবিধানে বিধৃত আছে, সেগুলোর একটি সংক্ষিপ্ত চর্চা হয়ে যাওয়া দরকার। কেননা
যে সমস্যাগুলোর প্রেক্ষিত হিসেবে এই লেখাটা তৈরি করছি, তার সবকটির সমাধান
সংবিধানের দৃষ্টিভঙ্গির আলোতেই আমরা এযাবৎ করে এসেছি – মুখ্যমন্ত্রীর জনতা দরবার,
বিধানসভায় প্রশ্ন উত্থাপন, খুঁজে খুঁজে বাঙালি স্বার্থ বুঝবেন এমন বিধায়ককে ধরে
লবিইং, ফের জনস্বার্থ মামলা, জেলায় জেলায় ধর্না, প্যাম্ফলেট বিলি করা, পাটনার
রাস্তায় মিছিল, ভোট বয়কট ইত্যাদি অনেককিছুর মধ্য দিয়ে – এবং কিছু কিছু সুফলও
পেয়েছি।
যখন নাকি বিহার থেকে
ঝাড়খন্ড আলাদা হওয়ার পর বিহারের সরকারী আমলাদের মুখে এই কথাটিই শোনা যেত, “বাঙালি?
বিহারে আর বাঙালি কোথায়? সব তো ঝাড়খন্ডে চলে গেছে!’ এবং সেই দৃষ্টিভঙ্গী থেকে
বাংলা পাঠ্যক্রমএর জন্য সিলেবাস কমিটি গঠন, বাংলা পাঠ্যপুস্তক রচনা ও মুদ্রণ ও
বিতরণ, স্কুলে বাংলা শিক্ষক নিয়োগ, ভাষাগত সংখ্যালঘু স্কুলগুলোর উন্নয়নে অন্ততঃ
কিছুটা অংশীদারী... সমস্ত কিছু বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
সঙ্ঘের রাজভাষা
এ দেশের সংবিধান
অনুসারে “ভারত, অর্থাৎ ইন্ডিয়া, রাজ্যগুলির সঙ্ঘ”১। তাই সংবিধানের
দৃষ্টিতে এ দেশের, হিন্দীতে যাকে বলে ‘রাষ্ট্রভাষা’, বাংলায় ‘জাতিভাষা’ এবং
ইংরেজিতে ‘ন্যাশন্যাল ল্যাংগুএজ’, নেই (হিন্দীতে জাতীয়তাকে বলে ‘রাষ্ট্রীয়তা’)।
হিন্দীও ‘রাষ্ট্রভাষা’ অর্থাৎ জাতিভাষা বা জাতীয়ভাষা নয়।২
ভাষার প্রশ্নে সংবিধান
বলে, “সঙ্ঘের রাজভাষা হবে হিন্দী এবং লিপি হবে দেবনাগরী”৩। রাজভাষা
অর্থাৎ ‘অফিসিয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ অফ দ্য স্টেট’ – ‘স্টেট’ এখানে রাজ্য বা প্রদেশ নয়,
রাজ, সরকার, শাসন ও প্রশাসন।
এর পর, এই ‘রাজভাষা’
সম্পর্কিত সমস্যাগুলোর নিদান বা প্রাসঙ্গিক ব্যাপারগুলোয় সুপারিশ করার জন্য
সংবিধান রাষ্ট্রপতিকে নির্দেশ দিয়েছে যে দেশের সংসদে এই সংবিধান গৃহীত হওয়ার পাঁচ
বছর এবং আবার দশ বছর পর, “নিজ আদেশে একটি কমিশন গঠিত করবেন তথা কমিশনের একজন
অধ্যক্ষ এবং অষ্টম
তপশীলে বিনির্দিষ্ট বিভিন্ন ভাষার প্রতিনিধি নিযুক্ত করবেন; তাঁর আদেশে কমিশন যে প্রক্রিয়া অনুসরণ করবে তা
নির্ধারিত থাকবে”৪। [কিছু শব্দের ওপরে জোর লেখকের]
সংবিধানে, ভবিষ্যতের
জন্য প্রস্তাবিত এই কমিশনকে এ নির্দেশও দেওয়া হয়েছে যে, “নিজের সুপারিশগুলো করার
সময় এই কমিশন ভারতের শিল্পগত, সাংস্কৃতিক এবং বৈজ্ঞানিক উন্নতির প্রতি তথা
অহিন্দীভাষী ক্ষেত্রের মানুষদের লোকসেবা [public services] সম্পর্কিত ন্যায়সংগত দাবী ও
স্বার্থের প্রতি সর্বাঙ্গীণ দৃষ্টি রাখবে”।
সঙ্ঘের সংবিধানে সঙ্ঘের
রাজভাষা নিয়ে সিদ্ধান্ত তো হয়ে গেল। কিন্তু তাৎক্ষণিক প্রভাবে হিন্দীকে সঙ্ঘের
একমাত্র রাজভাষা করার প্রাথমিক প্রস্তাবের বিরুদ্ধে অহিন্দীভাষী, বিশেষকরে
দক্ষিণের রাজ্যগুলিতে ব্যাপক আন্দোলন শুরু হয়ে গেল। তখন ইংরেজীকেও রাজভাষা হিসেবে
বজায় রাখার বিধান দেওয়া হল। সময়সীমা রাখা হল, তখন এবং পরেও, কিন্তু প্রতিবার সেই
সময়সীমা বাড়াতে হল।
প্রশ্ন ওঠে, অষ্টম তপশীলে বিনির্দিষ্ট বিভিন্ন ভাষার যে প্রসঙ্গ
উঠে এল সে ভাষাগুলোকে সংবিধান কোন শ্রেণীতে রাখল। সেটা স্পষ্ট নয়। রাজ্যগুলোকে
অবশ্যই হিন্দীর বদলে কোনো অন্য ভাষাকে (সেই রাজ্যের ভিতরে) রাজভাষা করার অধিকার
দেওয়া হল কিন্তু সে অধিকারকে অষ্টম তপশীলের নিরিখে সীমিত করা হলনা। তপশীলভুক্ত নয়
এমন যে কোনো ভাষাকে রাজ্য প্রথম বা দ্বিতীয় রাজভাষার স্থান দিতে পারে।
এসব দেখে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে সংবিধান রচয়িতাদের মাথায়
ভাষা সম্পর্কিত বিষয়টি শুধু ঔপনিবেশিক ভাষা ইংরেজিকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সরিয়ে,
স্বাধীনতা আন্দোলনপর্বে বিকশিত সম্পর্কভাষা বা লিংগুয়া ফ্রাংকা খড়িবোলী হিন্দীকে
সঙ্ঘের রাজভাষার হিসেবে উন্নীত করা এবং সেই প্রেক্ষিতে (১) রাজ্যগুলির ভাষাগত
অস্মিতাকে (যদিও ভাষাভিত্তিক পুনর্গঠন পরে হল) পরোক্ষ স্বীকৃতি দেওয়া তথা (২)
ভাষাগত সংখ্যালঘুদের ভাষাসম্পর্কিত অধিকারগুলোকে পরিভাষিত ও সংরক্ষিত করাতেই সীমিত
ছিল।
অষ্টম তপশীল তৈরিই হল
সংবিধানের ধারা ৩৪৪(১) এবং ৩৫১ অনুসারে ‘সঙ্ঘের রাজভাষা’ হিসেবে হিন্দীর সত্বর
প্রসার সম্পর্কিত পথনির্দেশের জন্য। যে ভাষাগুলোকে তপশীলভুক্ত করা হল সে
ভাষাগুলোকে জাতীয়ভাষা বা ‘রাষ্ট্রভাষা’ও বলা যাচ্ছিল না আবার রাজ্যে স্বীকৃত ভাষা
হিসেবেও পরিভাষিত করা যাচ্ছিল না। এটুকুই বলা যাচ্ছিল যে এই ভাষাগুলো সংস্কৃত
(যেটি প্রাচীন ও উৎসভাষা) বাদে দেশের আধুনিক ভাষাসমষ্টি। এই ভাষাগুলো যারা বলে সেই
জনতা এই দেশেরই কোনো না কোনো এলাকায় অথবা একসাথে কয়েকটি এলাকায় থাকে এবং, উর্দু
(যার জাতীয়-ভৌগোলিক অস্মিতা হিন্দীরই অংশ) বাদ দিয়ে, স্বাধীনতা আন্দোলনে নিজেদের
বিশিষ্ট জাতীয় অস্মিতা প্রতিষ্ঠিত করেছে।
তাই অষ্টম তপশীল একটি
খোলা তপশীল হয়ে রইল যাতে পরে আরো ভাষা অন্তর্ভুক্ত হতে থাকল। প্রথমে এই তপশীলে
১৪টি ভাষা ছিল। যোগ হতে হতে ২০০৪ সালে সে সংখ্যাটি হল ২২। এখনো, অষ্টম তপশীলে
অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য ৩৮টি ভাষার দাবী কেন্দ্রীয় সরকারের ফাইলে, অনিষ্পাদিত।
ভাষাগত সংখ্যালঘুদের ভাষা ও শিক্ষা
সম্পর্কিত অধিকার
সংবিধানে বিধৃত মৌলিক
অধিকারগুলোর মধ্যে সর্বাধিক পরিচিতঃ “বাকস্বাধীনতা এবং অভিব্যক্তির স্বাধীনতা”৫।
এর প্রয়োগ বিস্তৃত এবং ভাষাকেও শামিল করে। মৌলিক অধিকারসংক্রান্ত অধ্যায়ে পরের
দিকে সংবিধান বলছেঃ-
সংখ্যালঘু শ্রেণীসমূহের স্বার্থসংরক্ষণ৬
(১) ভারতের রাষ্ট্রগত
এলাকা বা তার কোনো অংশের নিবাসী নাগরিকদের যে কোনো উপ-অংশের, যদি নিজেদের বিশিষ্ট
ভাষা, লিপি অথবা সংস্কৃতি থাকে, তা বাঁচিয়ে রাখার অধিকার থাকবে।
(২) রাষ্ট্র কর্তৃক পৃষ্ঠপোষিত
অথবা রাষ্ট্র-তহবিল থেকে সাহায্যপ্রাপ্ত কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রবেশে, কোনো
নাগরিককে ধর্ম, মূলবংশ, জাত, ভাষা অথবা এর মধ্যে কোনো একটিরও ভিত্তিতে বঞ্চিত করা
হবেনা।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনায় এবং প্রশাসনে
সংখ্যালঘু শ্রেণীসমূহের অধিকার৭
(১) ধর্ম অথবা
ভাষাভিত্তিক সমস্ত সংখ্যালঘু শ্রেণীসমূহের আপন রুচি অনুযায়ী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান
স্থাপনার ও পরিচালনার অধিকার থাকবে।
(২) শিক্ষা
প্রতিষ্ঠানগুলোকে সাহায্য দেওয়ার সময় রাষ্ট্র কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে,
সেটি ধর্ম অথবা ভাষাভিত্তিক কোনো সংখ্যালঘু শ্রেণীর পরিচালনায় রয়েছে।
সংবিধান এর পর
অভিব্যক্তির ভাষা সম্পর্কিত একটি মৌলিক অধিকারের ব্যাখ্যা করে যে “প্রত্যেক
ব্যক্তির, কোনো অভিযোগের নিবারণে সঙ্ঘ বা রাজ্যের কোনো আধিকারিক বা প্রাধিকারীকে,
প্রয়োজনানুসারে, সঙ্ঘ বা রাজ্যের কোনো ভাষায় নিবেদন দেওয়ার অধিকার থাকবে”৮।
এবং এর পর ওখানেই পরবর্তী প্যারাগ্রাফে ‘মাতৃভাষা’র উল্লেখ রয়েছে।
“প্রাথমিক স্তরে মাতৃভাষায় শিক্ষার সুযোগ সুবিধা
– প্রত্যেকটি রাজ্য ও রাজ্যের অন্তর্গত প্রত্যেক স্থানীয় প্রাধিকারী সংখ্যালঘু
শ্রেণীর বালকবালিকাদের জন্য, শিক্ষার প্রাথমিক স্তরে মাতৃভাষায় শিক্ষার পর্যাপ্ত
সুযোগসুবিধার ব্যবস্থা করার চেষ্টা করবে এবং রাষ্ট্রপতি কোনো রাজ্যকে এমত ব্যবস্থা
সুনিশ্চিত করার জন্য আবশ্যক ও সমুচিৎ নির্দেশ দিতে পারবেন”৯।
এর পর, ভাষাগত
সংখ্যালঘু সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ আছে।
“ভাষাগত সংখ্যালঘু
শ্রেণীসমূহের জন্য বিশেষ আধিকারিক – (১) ভাষাগত সংখ্যালঘু শ্রেণীসমূহের জন্য এক
বিশেষ আধিকারিক থাকবে যাকে নিযুক্ত করবে রাষ্টপতি। (২) বিশেষ আধিকারিকের কর্তব্য
হবে যে সে এই সংবিধানে ভাষাগত সংখ্যালঘুদের সুরক্ষার যাকিছু ব্যবস্থার বিধান দেওয়া
হয়েছে সে সম্পর্কিত সমস্ত বিষয়ের অন্বেষণ করবে। রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নির্ধারিত
কালান্তরালে সেই বিষয়গুলি সম্পর্কে এই আধিকারিক রাষ্ট্রপতিকে প্রতিবেদন দেবে।
রাষ্ট্রপতি এই সমস্ত প্রতিবেদন সংসদের প্রত্যেকটি সভায় পেশ করার ব্যবস্থা করবে তথা
সম্পর্কিত রাজ্যের সরকারের কাছে পাঠাবে।”
২
বাঁচা গেল।
আইন ও বিধানের অনুবাদ বড় কঠিন কাজ। তবু এতক্ষণ ধরে নিজেই নিজের লেখাটা আইনী
বাক্যাংশে কন্টকিত ও জর্জর করলাম কেননা এসবগুলোই আমাদের লড়াইয়ে, বাদবিবাদে এবং
মাঝে মধ্যে হাইকোর্টে জনস্বার্থ মামলা দায়ের করতে কাজে লাগে। তবু এটাকে সম্পূর্ণ
বলবনা কেননা আমি আইনজ্ঞ নই আর সংবিধানের অনেককিছু খোলসা হয় পরে, কোনো সমস্যার
সমাধানে প্রয়োগ করার সময়, যেটা সুপ্রীম কোর্টের বিভিন্ন রায়ের মাধ্যমে হয়ে থাকে।
যেমন কিছুদিন আগে, কর্ণাটক সরকার কর্তৃক কন্নড় বা নিজের মাতৃভাষার পাঠ আবশ্যিক
করার আদেশ এবং তার বিরুদ্ধে প্রাইভেট স্কুলমালিকদের নালিশের ওপর সুপ্রীম কোর্টের
ডিভিশন বেঞ্চের রায়। কর্ণাটক সরকারের ওই আদেশেরই ভিত্তিতে আজ রায়চুর জেলার রিফিউজী
কলোনীর বাংলাভাষী পরিবারের শিশুরা স্কুলে বাংলা পড়তে পারছে।
বিহারে ১৯৯১
সাল থেকে বলবৎ বিহার রাজ্য সংখ্যালঘু আয়োগ আইনে বিহারের বাংলাভাষীরা ভাষাগত
সংখ্যালঘু এবং সেজন্য আয়োগের একজন উপাধ্যক্ষ পদ একান্তরে বাংলাভাষী অথবা খ্রিশ্চান
হন। এর পিছনে আছে বিহার বাঙালি সমিতির দীর্ঘ, কয়েক দশকব্যাপী কাজের ইতিহাস।
কেননা
দেখুন, সারা দেশের জন্য যে সংখ্যালঘু কমিশন আইন ১৯৯২ সালে বলবৎ হল এবং সে অনুসারে
কমিশনের গঠন হল তার দৃষ্টিতে ভাষাগত সংখ্যালঘুর প্রশ্ন রইলনা। যখন নাকি জাতিসঙ্ঘের
সেই বছরেরই ঘোষণায় ভাষাগত সংখ্যালঘুর উল্লেখ ছিল। কমিশনের দৃষ্টিতে ভাষাগত
সংখ্যালঘুর প্রশ্ন এতটাই রইলনা যে দেশে ১৯৫৬ সাল থেকে যে একটা ন্যাশন্যাল কমিশনার
ফর লিংগুইস্টিক মাইনরিটিজ কাজ করছে, দিল্লীতে লোদী রোডে, পর্যাবরণ ভবনে যার অফিস,
তার উল্লেখটাও রইলনা। আর সত্যি তো, এন∙সি∙এল∙এম∙ যে আদৌ রয়েছে, কী কাজ করছে, কেউ জানেনা।
কোথাও ভাষাগত সংখ্যালঘুরা এই কমিশনারের কোনো সাহায্য পায়না। আগে কী ছিল জানিনা। হ্যাঁ, সারাদেশের রিপোর্ট কিন্তু প্রতি
বছর সরকারের কাছে জমা হয়! কোত্থেকে সেই রিপোর্ট জোটানো হয় তাও জানিনা। সরকার অবশ্য
বলতে পারে যে ১৯৯২ এর আইনে সংখ্যালঘুর আগে ‘ধার্মিক’ কথাটাও তো লেখা নেই!... আর
নোটিফিকেশনে?
সে যা হোক,
আপাততঃ আমি সেই দুঃখজনক পরিস্থিতি বা ঘটনাগুলোর সংক্ষিপ্ত বর্ণনা করব যেগুলোর ফলে
মাতৃভাষার ক্ষতি হল, মৈত্রীভাষা বৈরীভাষার মত দেখতে হয়ে গেল আর দেশভাষা ঠিকমত
তৈরীই হতে পারলনা।
জনতার
ভাষা হিন্দী বনাম রাজভাষা হিন্দী
হিন্দী,
খড়িবোলী, পরিমার্জিত হিন্দুস্তানী কিম্বা হিন্দী-উর্দু ভাষাযুগল উত্তর ভারতের একটা
বড় অংশের শহরগুলোয় প্রধান কথ্য ও লিখিত ভাষা হিসেবে বিকশিত হচ্ছিল। যদিও পরবর্ত্তী
কালে হিন্দী নিজেকে উর্দু থেকে বিযুক্ত করার চেষ্টায় সংস্কৃতে শুধু নিজের উৎস নয়
পুরো বর্তমান রূপটাই খুঁজতে উদ্যোগী হল, বাস্তব এটাই যে উত্তর ভারতের শহরগুলোয় প্রথমে
মোগল ও পরে ইংরেজদের উর্দীধারী হিন্দুস্তানী ফৌজীদের মাধ্যমেই উর্দীর ভাষা উর্দু
বা উর্দু-হিন্দী প্রচারিত ও প্রসারিত হয়েছিল। স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্রগতির ভাষা
হয়ে এটি আধুনিক হিন্দীর (দেবনাগরী লিপিতে) রূপ পরিগ্রহণ করল এবং এই রূপে হিন্দীকে
অনেক অহিন্দীভাষীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভাবে সম্পর্কভাষা হিসেবে স্বীকার করে নিল। উনবিংশ
শতাব্দীতেই ঔপনিবেশিক বেঙ্গল প্রেসিডেন্সীর বিহার অঞ্চলে সরকারী কাজকর্মে হিন্দীকে
স্বীকৃতি দেওয়ার লড়াইটা চালান কলকাতা থেকে আসা এক বাংলাভাষী রাজকর্মচারী ভুদেব
মুখোপাধ্যায়। রাজভাষা কমিশন ১৯৫৫র সদস্য হিসেবে নিজের বিরুদ্ধমত রেকর্ড করানোর
দিনটিতেও সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় বাঙলার হিন্দী প্রচারিণী সভার অধ্যক্ষ ছিলেন।
‘হিন্দী-হিন্দু-হিন্দুস্তান’এর
রাজনৈতিক প্রতিনিধিরা তখনো সংসদে ভালো সংখ্যাতেই ছিল, কিন্তু যতই ঘেউ ঘেউ করুক, সে
সময়কার ভারতও তো অন্যরকম ছিল।
রাজভাষা
রূপে হিন্দী স্বীকৃত হওয়ার পর একটা দেশের ভাষিক পরিস্থিতিতে একটা বিশেষ পরিবর্তন
এল। রাজভাষা নিয়ে সিদ্ধান্ত পরিবর্তনটার কারণ ছিলনা। হিন্দীর ছাড়া অন্য কোনো ভাষা
সঙ্ঘের রাজভাষা হওয়ার জায়গায় ছিলওনা। কিন্তু একদিকে হিন্দীভাষী রাজ্যগুলোতেই
অহিন্দীভাষীবিরোধী চিন্তাভাবনায় নতুন জোয়ার আর অন্যদিকে, সঙ্ঘের নতুন রাজভাষা রূপে
হিন্দীকে উন্নত ও প্রসারিত করার নামে কোটি কোটি টাকার বাজেট বরাদ্দ – সঙ্ঘীয়
বাজেটের মাধ্যমে, হিন্দীভাষী রাজ্যগুলোর বাজেটের মাধ্যমে এবং ১৯৭৬এর পর সবকটি
সরকারী শিল্প/উদ্যোগ/সংস্থা ইত্যাদির রাজভাষা বিভাগের বার্ষিক খরচের মাধ্যমে!
লাখখানেক রাজভাষা আধিকারিকের বেতন, রাজভাষা গ্রন্থাগারগুলোর বার্ষিক খরিদ, বিভিন্ন
ধরণের একাডেমীগুলোর খাতে অনুদান। ২০১৩-১৪ সালে, শুধু সঙ্ঘীয় বা কেন্দ্রীয় বাজেটে
রাজভাষা বিভাগের জন্য বরাদ্দ ছিল ৪৬∙৯৮ কোটি টাকা! এর সাথে যোগ করুন রেলবাজেটের
বরাদ্দ, হিন্দী ‘ক’ ও ‘খ’ শ্রেণীর রাজ্যগুলোর বাজেট বরাদ্দ এবং সরকারী সংস্থাগুলোর
এই খাতে খরচ!
হিন্দী
বইয়ের নামচিন প্রকাশন সংস্থাগুলোর বই কখনো দোকানে গিয়ে হাতে নিয়ে দেখুন। ছাপাই,
বাঁধাই, কাগজ আর বোর্ডএর ওজন, কোয়ালিটি... এবার দামটা দেখুন। দেখবেন সমমানের বাংলা
বইয়ের দ্বিগুণ। কেন? খরচ কি বেশি? একেবারেই না। কিন্তু হিন্দী বইয়ের প্রকাশকেরা
পাঠকের তোয়াক্কা করেনা। তাদের হিসেব থাকে তাদের এজেন্টদের মাধ্যমে সারা দেশে কটা
রাজভাষা গ্রন্থাগারে টাইটেলটা খাওয়ানো যাবে। তার ভিত্তিতেই মুনাফার ভালো মার্জিন
রেখে (যার মধ্যে কিছু রাজভাষা আধিকারিককে দেয় ঘুষটাও ধরা থাকে) তারা দামটা বসায়।
স্বাভাবিকভাবেই,
স্বার্থের একটা বড় জোট তৈরি হল যেটি হিন্দীর উন্নতির নামে হিন্দীর ক্ষতিসাধন
করছিল। হিন্দীকে উর্দু থেকে আলাদা করার থিংক-ট্যাংক বড় বড় বুদ্ধিজীবী হলেও ওই
প্রবণতাটা ভালো সমর্থক পাচ্ছিল এই রাজভাষার জোটগুলো থেকে। অফিসের – সওদাগরী,
ব্যাংক, বীমা ইত্যাদি – কাজেকর্মে যে পারিভাষিক শব্দগুলোর প্রয়োজন হয় তার বেশির
ভাগই কিন্তু ব্রিটিশকালেও ফারসীতে প্রচলিত ছিল, লোকের মুখে মুখেও প্রচলিত ছিল।
কিন্তু সেগুলোকে বাদ দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টায় সংস্কৃত থেকে কিছু উদ্ভট হিন্দী শব্দ
তৈরি হল যেগুলো চলতেই পারেনা। একেবারেই যেখানে সম্ভব ছিলনা সেখানে ফারসী শব্দগুলো
রয়ে গেল।
হিন্দীভাষী
রাজ্যগুলোতে অহিন্দীভাষীদের পরিস্থিতিতে বদল
এই জোটের
জন্য অবশ্য প্রত্যক্ষভাবে হিন্দীভাষী রাজ্যগুলোতে অহিন্দীভাষীদের কোনো ক্ষতি হয়নি।
কিন্তু এই জোট এবং এই সরকারী টাকার বাড়তে থাকা প্রভাবে অহিন্দীভাষীবিরোধী রাজনৈতিক
মতবাদের একটা হেজেমনি তৈরি হল আর সেটাই ক্ষতি করতে শুরু করল নানা ভাবে। সূচীটা
অসম্পূর্ণই থাকবে, তবু ১৯৭৬ থেকে ১৯৯১এর মাঝে অহিন্দীভাষীদের ভাষাস্বার্থ যে
বিরাটভাবে ধাক্কা খেল তার বিভিন্ন দিকগুলো সূচীবদ্ধ করতে চাইব।
১। কেন্দ্রীয়
এবং হিন্দীভাষী রাজ্যগুলোর রাজ্য শিক্ষা বোর্ডের প্রাথমিক স্তরে মাতৃভাষায় পড়ার
অধিকারটা বজায় রাখা তো দূর অস্ত, মাতৃভাষাটুকু পড়ার সুযোগও পাওয়া এত কঠিন হয়ে
দাঁড়ালো যে কিছুদিন পর সেটা কাজেকলমে আর রইলোই না। মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক
স্তরের পাঠ্যক্রমে ত্রিভাষা সুত্রের অন্তর্গত মাতৃভাষা অথবা হিন্দী বাদে কোনো অন্য
আধুনিক ভারতীয় ভাষা পড়ার যে সুযোগ ছিল, সেটা বাধ্যতামূলকভাবে হয়ে দাঁড়ালো ইংরেজী,
হিন্দী আর সংস্কৃত। স্কুলে ভর্তি করার অস্থিরতায় অভিভাবক ও ছাত্র দুজনেই
পরিস্থিতিটা মেনে নিল। প্রাইভেট আর কনভেন্ট স্কুল তো আগে থেকেই এ ব্যাপারে উদগ্রীব
ছিল যে খরচ কমবে। এমনকি ভাষাগত সংখ্যালঘু পরিচালিত স্কুলগুলোতেও, বিশেষ করে যারা
সরকারী সাহায্য পাচ্ছিল, একটা চাপ শুরু হয়ে গেল যা ভাষা বিষয় মানে ইংরেজী, হিন্দী
আর সংস্কৃত।
২।
স্বাভাবিক ভাবে, পরের বছর থেকে এর প্রভাব পড়া শুরু করল। সরকারী মহলে পরিসংখ্যান
রেকর্ড হওয়া শুরু করল যে সব ছাত্র হিন্দীভাষী। এবং সেই পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে
ইংরেজী, সংস্কৃত এবং হিন্দী ছাড়া আর কোনো ভাষার পাঠ্যক্রম, পাঠ্যপুস্তক, শিক্ষক
কোনো কিছুরই ব্যবস্থা করার প্রয়োজন রইল না।
৩।
চিন্তাধারার প্রাধান্য একটা পরিবেশ তৈরি করে। আইনি অর্থে কোনো ষড়যন্ত্র না থাকলেও
ষড়যন্ত্র হয়ে যায়। একটা উদাহরণ দিচ্ছি। জনগণনা। প্রতি দশ বছরে হয়। এখন তো তবু কিছু
আইনি সুযোগ আছে, ইন্টারনেটে সেন্সাস অধিকর্তার ওয়েবসাইট আছে আর কিছু ব্যাপারে
মানুষের গণতান্ত্রিক চেতনাও বেড়েছে। তবু তৃণমূল স্তরে বাস্তবটা কী? আমার আপনার মত
সাধারণ মানুষেরাই হন সেন্সাসের লোক। বিহারে সাধারণতঃ সরকারী শিক্ষকদের মধ্যে থেকে
নেওয়া হয়। ট্রেনিংএর সময় তাঁদেরকে একটি বিধিবহির্ভূত পরামর্শ পান। কখনো সরকারী
ট্রেনার বা কখনো সিনিয়র, যারা আগে একাজ করেছেন তাদের কাছ থেকে। ফর্মের যে বইটা
আপনাদের বিভাগের তরফ থেকে দেওয়া হবে সেগুলো ওখানে বসে ভরবার বা ভরাবার দরকার নেই।
বড়জোর সাইনটা করিয়ে নেবেন, বা, না করালেও ম্যানেজ হয়ে যাবে। ঘরে ঘরে গিয়ে জিজ্ঞেস
করে ভরবেন বা ওদের দিয়ে ভরাবেন – কোথাও ভূল হয়ে গেলে কাটিং হবে, জবাবদিহি করতে হবে
আপনাকে। তার চেয়ে ভালো, যে পয়সা আপনাদের দেওয়া হচ্ছে তা’থেকে দশ-কুড়ি টাকা খর্চা
করে একটা ভালো খাতা কিনে নেবেন। বয়ে বেড়াতেও সুবিধে হবে। সমস্ত তথ্য কলাম বানিয়ে
ওতেই নোট করবেন। সন্ধ্যে বেলায় ফিরে ওগুলো দেখে দেখে ফর্মটা ফিল-আপ করে নেবেন।
কোথাও ভূলও হবেনা, জবাবদিহিও করতে হবেনা!”
কত সহজ!
সুবিধেজনক! কর্মচারীরা চা খেতে খেতে, নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে ব্যাপারটাকে আরো
সহজ করে নেন। বাড়ি বাড়িতে গিয়ে বলেন, “শুধু নাম লেখান সবাইকার, পুরুষ/মহিলা আর
বয়স। হ্যাঁ, আর শিক্ষা। বাকি সব আমরা ভরে নেব”। বাড়ির লোকেরাও ভাবে বাঁচা গেল।
ভরদুপুরে এই উটকো ঝামেলা। কর্মচারীরা যখন রাত্রে বসে ফর্মটা ভরা শুরু করলেন তখন
নাম, পুরুষ/মহিলা, বয়স ভরার পর ধর্ম তো নাম দিয়েই বুঝে নিলেন। আর
ভাষা/কথ্যভাষা/মাতৃভাষার মত গৌণ প্রশ্নে ওপর থেকে নিচে অব্দি একবারে ‘হ’, ‘হ’, ‘হ’
ভরে শেষ করে দিলেন। খেল খতম! হয়ে গেলেন সবাই হিন্দীভাষী। মস্করা করছিনা। এটাই
হয়েছে (যেখানে ষড়যন্ত্রের প্রমাণ পাওয়া গেছে সে কাহিনী তো আরো ভয়ানক) গত পাঁচটি
জনগণনায় বিশেষ করে বিহার, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ অথবা পরবর্তীকালে উত্তরাখন্ডে,
ঝাড়খন্ডে এবং ছত্তিশগড়ে এবং দেশের আরো বেশ কয়েকটি এলাকায়। তাতেই দেখা যায় যে
সাধারণভাবে জনসংখ্যা বৃদ্ধির দর ধনাত্মক হওয়া সত্ত্বেও বাংলাভাষী জনসংখ্যার
বৃদ্ধিদর ঋণাত্মক! আর হিন্দীভাষীর বৃদ্ধিদর, ইংরেজিতে যাকে বলে এক্সপোনেনশিয়াল,
লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। সেন্সাস রিপোর্ট তো নেটেই আছে, খুলে দেখে নিন! স্বাভাবিক
ভাবেই এই পরিসংখ্যানের প্রভাব তো রাজ্যের শিক্ষাগত উন্নয়নের বাজেটেও পড়বে!
হিন্দীর
বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা
রাজভাষার
নামে গড়ে ওঠা নোংরা স্বার্থের পূর্বোক্ত বড় জোটটা বা এখুনি শিক্ষাক্ষেত্রে ও
জনগণনায় যে কারচুপিগুলোর কথা বললাম তার থেকেও বেশী দুঃখজনক হয়ে উঠল প্রগতিশীল,
গণতান্ত্রিক চিন্তাভাবনার হিন্দী বুদ্ধিজীবীদের এ ব্যাপারে নীরবতা। সংখ্যায় ও
শক্তিতে তো তারা খুব কম নয়! এমনও নয় যে তাঁরা আমার অভিযোগগুলোকে অস্বীকার করেন।
পাশে বসে কথা বলে দেখেছি তাঁরা পুরোপুরি আমার সাথে একমত হয়ে যান। কিন্তু
সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলার সময়, দেশের চরিত্র বহুভাষিক বলার সময়ও,
কষ্ট করে এটুকু বলেননা যে এই বহুভাষিকতাকে ধ্বংস করার একটা কুচেষ্টা চলছে তাঁদের
রাজ্যগুলোয়।
১৯৯১এর পর
১৯৯১ সালে এ দেশে নব্য-উদারপন্থার
আর্থিক নীতিগুলো বলবৎ করা হল। বলবৎ হওয়ার পিছনে প্রধান হেতু অবশ্যই পূর্ব ইয়োরোপে
এবং সোভিয়েত সঙ্ঘে সমাজবাদের পতনে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রথমবার
সাম্রাজ্যবাদের অভূতপূর্ব শক্তিবৃদ্ধি এবং এদেশের একচেটিয়া পূঁজিপতি ঘরাণাগুলোর
তার সাথে গাঁটছড়া। কিন্তু এত তীব্র, সত্বর ও অমোঘ ভাবে বলবৎ হতে পারার কারণ ছিল
নতুন প্রযুক্তির অভ্যুদয়। (সাম্রাজ্যবাদের শক্তিবৃদ্ধি ও সমাজবাদের পতনের পিছনেরও একটা
বড় কারক এই নতুন প্রযুক্তি কিন্তু সেটা অন্য প্রসঙ্গ)।
নতুন প্রযুক্তি এবং তার ফলস্বরূপ গজিয়ে ওঠা পরিষেবা এবং
শিল্প দেশের অর্থনীতিতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন নিয়ে এল। মোট আভ্যন্তরীণ
উৎপাদনে পরিষেবা ক্ষেত্রের অংশ ২৫% থেকেও কম ছিল। বেড়ে ৫০%এর বেশি হয়ে গেল। আর
কৃষিপ্রধান দেশ হওয়া সত্ত্বেও কৃষির অংশদান ২০% থেকে কম হয়ে গেল।
এর জবরদস্ত প্রভাব পড়ল
পুরো শিক্ষাব্যবস্থায় এবং বিশেষ করে ভাষা শিক্ষায়। ইংরেজি ছাড়া অন্য যে কোনো ভাষার
শিক্ষা সময়ের অপচয় হয়ে দাঁড়াল। যখন হিন্দীভাষী পরিবারে বাচ্চারা হিন্দীতে কথা বলা
এড়িয়ে যেতে লাগল অথবা অশুদ্ধ, ইংরেজি মেশানো হিন্দী (আজকালকার ‘হিংলিশ’) বলা শুরু
করল তখন বোধহয় বিবেকবান অভিভাবকেরা বুঝতে আরম্ভ করলেন যে বাড়িতে-পরিবারে নতুন
প্রজন্মের কন্ঠ থেকে তাদের মাতৃভাষা হারিয়ে যেতে থাকলে কেমন কষ্ট হয়।
এই কষ্টটাই সাধারণভাবে
অহিন্দীভাষী ও বিশেষকরে বাংলাভাষীরা নিজেদের ভাষা-প্রদেশের বাইরে (যে প্রদেশের
সাথে তাদের সম্পর্ক তিন পুরুষেরও বেশি আগে থেকে নেই) হিন্দীভাষী রাজ্যগুলোতে পেয়ে
আসছিল।
মাতৃভাষা, ভাষাগত আত্মপরিচয় অথবা ভাষিক
সংস্কৃতি বাঁচিয়ে রাখার সংগ্রাম কি ভারতের ঐক্য বাঁচিয়ে রাখার সংগ্রাম থেকে পৃথক?
আমি জানি, এক্ষুনি কেউ
আশ্বাস দেওয়ার ভঙ্গীতে বলতে শুরু করবে, “আরে নারে ভাই, সে কথা নয়। দুদিকই তো দেখতে
হবে! নিজেদের অধিকারের জন্য ন্যায্য সংগ্রাম নিশ্চয়ই করবে কিন্তু সবার আগে তো
দেশের ঐক্য!”
- হ্যাঁ স্যার, সবার আগে তো বটেই? কিন্তু কী যেন
বললেন, দুদিক দেখতে হবে?
- দুদিক নয়? দেশের ঐক্য আর তোমার অধিকার!
- নাঃ, দুদিক তো নয়! আমার অধিকারেই দেশের ঐক্য আর
দেশের ঐক্যেই আমার অধিকার – একটাই তো দিক!... আসলে স্যার, কি জানেন? আমরা ওই দুটো
দিক বানিয়ে কাটকুট খেলা খেলতেই অভ্যস্ত। দেশের ঐক্য, দেশের উন্নয়ন, রাজ্যের উন্নয়ন
ইত্যাদি নিয়ে একটা দিক আর মানুষের অধিকারের লড়াইগুলো আরেকটা দিক। ইংরেজিতে আমরা
খুব গর্ব করে বলিনা, ‘ইউনিটি ইন ডাইভার্সিটি’? কাজের বেলায় ওটা হয়ে যায়, ‘ইউনিটি
ইন স্পাইট অফ ডাইভার্সিটি’। বৈচিত্রের ঐক্যটা হয়ে যায় বৈচিত্র সত্ত্বেও ঐক্য। আর
তখন ফুলগুলোকে ছিঁড়ে, মাটিতে ফেলে গাঁথার সুতোটা খুঁজতে যাই। ভূলে যাই যে ওটা সুতো
নয়। ওটা তো অনেকগুলো সংস্কৃতি, ভাষা, ভাষিক আত্মপরিচয়ের পারস্পরিক ঐক্যমতের মিলনে
জন্ম নেওয়া একটি নতুন রক্তবাহী শিরা! নানারঙের ফুলগুলো থাকবে, গাঁথা হতে চাইবে
একসাথে তবে তো থাকবে শিরা, তার ভিতরে রক্ত!
যা হোক, অতটা দূরে নাই
বা গেলাম। তবে এটুকু তো বুঝতেই হবে যে যতদূর একটা মানুষ তার ভাষিক-সাংস্কৃতিক
অস্মিতায় বাস করবে ততদূর সে ভারতের অস্মিতায় বাস করবে। সারা ভারতে কোথাও নিজের
নাগরিকতার অধিকারে থেকে, রোজগার করতে করতে, লেখাপড়া করতে করতে যত বেশি গুজরাটি হব,
তামিল হব, বাঙালি হব, সাঁওতাল হব, খাসি হব, মণিপুরী হব, তত বেশি আমরা ভারতীয় হব।
সাংস্কৃতিক, ভাষাগত আত্মপরিচয় হারিয়ে ফেলা মানুষ কখনো পুরোটা সার্থকভাবে নিজের
নাগরিকতা পালন করতে পারবেনা। এ সত্যটা ভারতের মত দেশের জন্য আরো বেশি দামী।
জিহবায় নিজের মাতৃভাষা
থাকলে পড়শীর ভাষা মৈত্রীভাষার মত করে পাশে জায়গা পাবে। আর দেশভাষা সব সময় হবে
সবকটি মাতৃভাষার মিলনসংগীত। সেই সংগীতটা না জাগলে সম্পর্কভাষা একটি বাধ্যতা হবে আর
রাজভাষা দাসত্ব।
_____________________________
১ – ভারতের সংবিধান, ভাগ ১∙১ (১)
২ – গুজরাট হাইকোর্টে দায়ের সিভিল এপ্লিকেশন সংখ্যা ২৮৯৬
বছর ২০০৯, সুরেশ ভাই কচোটিয়া বনাম ভারত সঙ্ঘ, ১৩ জানুয়ারি ২০১০এর রায়
৩ – ‘রাজভাষা’ শীর্ষক ভাগ ১৭র অন্তর্গত ‘সঙ্ঘের ভাষা’
শীর্ষক অধ্যায় ১ এ ধারা ৩৪৩(১)
৪ – সংবিধানের ধারা ৩৪৪
৫ – ‘মৌলিক অধিকার’ শীর্ষক ভাগ ৩ এর অনুচ্ছেদ ১৯ (স্বাতন্ত্র্য
সম্পর্কিত অধিকারাদি) এর ১(ক)
৬ - - ওই -
ভাগ ৩ এর অনুচ্ছেদ ২৯
৭ - - ওই - ভাগ ৩ এর অনুচ্ছেদ ৩০
৮ – ‘রাজভাষা’ শীর্ষক ভাগ ১৭ তে ‘বিশেষ নির্দেশ’ শীর্ষক
অধ্যায় ৪ এর অন্তর্গত ধারা ৩৫০
৯ – ধারা ৩৫০ক এবং ৩৫০খ
No comments:
Post a Comment