আমি পরাণের সাথে খেলিব আজিকে মরণখেলা
নিশিথবেলা
।
সঘন
বরষা, গগন আঁধার,
হেরো
বারিধারে কাঁদে চারিধার
ভীষণ
রঙ্গে ভবতরঙ্গে ভাসাই ভেলা;
বাহির
হয়েছি স্বপ্নশয়ন করিয়া হেলা
রাত্রিবেলা
।
ওগো পবনে গগনে সাগরে আজিকে কী কল্লোল !
দে
দোল্ দোল্ ।
পশ্চাৎ
হতে হা হা করে হাসি
মত্ত
ঝটিকা ঠেলা দেয় আসি,
যেন এ
লক্ষ যক্ষশিশুর অট্টরোল ।
আকাশে
পাতালে পাগলে মাতালে হট্টগোল ।
দে
দোল্ দোল্ ।…’
রাত ।
ঘূর্ণিঝড় আর বৃষ্টিতে তোলপাড় আকাশ । টিভি বলছে হাওয়ার গতি সাড়ে তিনশোয় শুরু
হয়েছিল, তবে এখানে পৌঁছোতে পৌঁছোতে ৭০কিমিতে নেমে এসেছে । বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপ
চলছে ।
৭০০
কোটি মানুষের পৃথিবীতে প্রায় পঁচিশ কোটি মানুষ পূর্বভারতে এই মুহুর্তে এই
ঝড়বৃষ্টিতে প্রভাবিত । এমনই ঘূর্ণিঝড় হয়ত আরো কয়েকটি এলাকায় চলছে – চীনে, তাঞ্জানিয়ায়, পেরুতে – আমরা জানিনা ।
এর
আগে পৃথিবীতে আসা এমনই রাতগুলোর মত এরাতও কারো না কারোর জীবনে নিছক রাত নয় । বেশ
কিছু দিন ধরে তার মাথায় নৈরাশ্যের অনির্দেশ দিনরাতের ভেদ আবছা করে দিয়েছে । রাতের
এই ঝড় যেন আরো উস্কে দিয়েছে তার ভিতরের ঝড়টাকে । যে ঝড় তাকে টেনে নিয়ে যেতে চাইছে
নিজেকে শেষ করে দেওয়ার সিদ্ধান্তের দিকে । আর বৃষ্টি ? বৃষ্টি তো নয় যেন
আত্মকরূণার অভিমান; বেঁচে থাকার শেষ ইচ্ছেটুকু কেড়ে নেওয়া অবসন্নতার হিম ।
কেন?
কিসের জেরবার তার দিনযাপনে ? ‘ভালোবাসার
প্রতারণা’, বাসি হয়ে ওঠায় বুঝতে পারার ?
জীবনের বিস্ময়ের মাংস গলে হাড় বেরিয়ে পড়ার ? বিশ্বাসে চিড় ধরে যাওয়ার ? শ্রদ্ধা বা
মমতার ভিত নড়ে যাওয়ার ?
ঠিক
কোন পরিস্থিতিতে আত্মহননের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে মানুষ ? ‘পরাণের সাথে মরণখেলা’র
বদলে নিজের পরাণের রক্তধারা জমাট করে দেয় ধমনীতে ।
সব
প্রেমিক কি নিজের প্রেমিকাকে নিয়ে পালাতে পারে নিরুদ্দেশযাত্রায় ? প্রেমিকাই কি
দুঃসাহসে চেপে ধরতে পারে আত্মভোলা ‘রসায়নবিদ’কে (মনে করুন ঋত্বিকের ‘নাগরিক’) ? খাপ পঞ্চায়েত ত পরের ব্যাপার । মনটাই তো খাপে খাপে বন্দী ।
-
সব মেয়ে কি দিওয়ানি হয়ে দৌড়োয়
জীবনের, জগতের সমরাহ্বান স্বীকার করে নিতে ?
-
কিছু মেয়ে তবু তো দৌড়োয় ।
-
সবাই কি তরে যায় ?
-
অনেকে হারিয়ে যায় গুমনাম । তবু
যারা দৌড়েছে তারাই বদলেছে নিজেদের গল্প, গত একশো বছরে ।
-
কিছুটা ফাইনান্সিয়াল
ব্যাকগ্রাউন্ড চাই ভায়া !
-
ছেঁদো কথা ।
……
চরম
মুহুর্তগুলো জীবনে আসে । আর সে মুহুর্তে একটাই ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিতে পারে
মানুষঃ-
আমি পরাণের সাথে খেলিব আজিকে মরণখেলা…
বাকি
সব সিদ্ধান্ত নেতিবাচক । আত্মহত্যার – একবারে অথবা তিলে তিলে । মৃত্যু কে চায় ? কিন্তু না চাইলে যে পরাণের সাথে
মরণখেলা খেলতে হয় বারবার, এই উপলব্ধিটা হয়না (হতে চায়না – আড়াল করে রাখে আমাদের চেতনার দাসত্ব; কেন, তার বিশেষ কার্যকারণে যাওয়ার
প্রয়োজন নেই এখন) । তাই, কিছু মৃত্যু হয়ত এড়িয়ে যেতে পারি, কিন্তু বড় মৃত্যু,
নিরর্থক দিনযাপনের, সারাটি জীবন যাপনের মৃত্যু এড়াতে পারিনা ।
আবার
পরাণের সাথে মরণখেলাও যে শেষ যুক্তিতে সামাজিক !
* * * * *
একটা
কথা আছে, হুজুগ । হুজুগে যুগ পাল্টায়না । হুজুগ কোনো ঘটনা নয় । হুজুগ মনের একটি
সামাজিক অবস্থা । হুজুগেই মানুষ কিছু একটা ধরে, অবলম্বন হিসেবে । হুজুগের স্তর
ভালোবাসায়ও হয়, এ্যাডভেঞ্চারেও হয়, গবেষণাতেও হয় আবার আন্দোলনেও হয় ।
‘ভীষণ রঙ্গে’ ‘স্বপ্নশয়ন’ হেলা করে বেরিয়ে পড়তে হয়;
পৌঁছে যেতে হয় রামলীলা ময়দানে –
আন্না হাজারের শপথের সাথে শপথ মেলাতে । মোমবাতি হাতে তুলতে হয় ভগৎ সিং চকে – ইরোম শর্মিলার জেদী কন্ঠস্বরের সাথে কন্ঠ মেলাতে । (এর মানে এই নয় যে যারা
যায় তারা সবাই হুজুগেই যায় । কিন্তু হুজুগেও যায় আর আমি আপাততঃ তাদের কথাই বলছি )
।
মিছিলে
বন্ধু জোটে নানারকম, সমাবেশে রাত কাটে । গবেষণাগারে শেষরাতে মাথা কুরে খায়
সিনিয়রদের ক্যরিয়রমুখী লবির কথাগুলো । এ্যাডভেঞ্চার ঘিরে ধরে বরফশীতল নির্জনতা ও
তারপর ?… অন্যরকম, অনেকটা অন্যরকম হয়
পরের দিন সকাল । একটা জেদ ছুটে এসে ঘিরে ধরে শরীর – আমি করব !
ভুখ
হড়তালের পঞ্চম দিন সকালে ঘুম ভাঙে এক অসীম নির্লিপ্তিতে । মৃত্যুও যেন দীর্ঘতর ঘুম
!… পুলিশ কর্ডনের মুখোমুখি, ভয়ে
নিজের চোখে বেইজ্জৎ হয়ে পিছু হটে, আবার যাই, ব্যারিকেড টপকাই; লাঠি খেয়ে কাঁধের
হাড় ফাটে, মাথার আগলটাও খুলে যায় । প্রথম দেখতে পাইঃ-
আজি জাগিয়া উঠিয়া পরাণ আমার বসিয়া আছে
বুকের
কাছে ।
থাকিয়া
থাকিয়া উঠিছে কাঁপিয়া
ধরিছে
আমার বক্ষ চাপিয়া
নিঠুর
নিবিড় বন্ধনসুখে হৃদয় নাচে;
সদ্য
জেগেছে তাই চিনেছি । এই জায়গায় তো আজকাল হাঁটু গেড়ে বসে হাতের ফুলটা বাড়িয়ে
বিবাহের প্রস্তাব দিতে হয় ! ‘আই লাভ ইউ’ বলতে
হয় ! নববধুকে যতনভরে রাখি, সোহাগ করি, সুখের সংসার গড়ে তোলার চেষ্টা করি । নইলে,
অন্ততঃ ভালোবাসাবাসির কথা বলি, সারাজীবন ‘সাথ নিভানে কা’র শপথ করি ।
হুজুগ
যেমন বেশি দিন থাকেনা, যায় অথবা পাল্টায়, ‘নিবিড় বন্ধনসুখে’র স্তরটাও বেশি দিন থাকেনা । বিয়ে করলেও মরে, বিয়ে না
করলেও মরে । সংগঠনের রোজনামচায় দৃষ্টি হারায়, শুধু নিয়মশৃংখলার তন্ত্র থেকে যায় ।
তারপর তন্ত্রও গিয়ে থাকে মন্ত্র – পেট থেকে গজিয়ে ওঠে গোপন দ্বিতীয় মাথা । লাল ফিতের বাঁধন খুলতে খুলতে
হারিয়ে যায় স্বাধীন গবেষণার ইচ্ছে – কোম্পানির গোলামি বেশি লোভনীয় মনে হয় । ছবি-মালা-বরেণ্যস্মরণ চর্বিতচর্বন
হয়ে ওঠে । বন্ধুত্ব, জিন্দাদিল ইয়ারি হারিয়ে যায় ক্যরিয়রের দৌড়ে ।
এমনকি
দেশের জীবনও হারিয়ে যায় স্বাভিমানহীনতায়, উদ্যমহীনতায় । মুমুর্ষু
সমাজব্যবস্থার বিষাক্ত স্ফীতি খেয়ে চলে
স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের লোকায়তিক ।
হায় এতকাল আমি রেখেছিনু তারে যতনভরে
শয়ন-‘পরে ।
দুয়ার
রুধিয়া রেখেছিনু তারে গোপন ঘরে
যতনভরে
।।
……………
শেষে সুখের শয়নে শ্রান্ত পরাণ আলসরসে,
……………
পরশ
করিলে জাগেনা সে আর,
কুসুমের
হার লাগে গুরুভার
ঘুমে
জাগরণে মিশি একাকার নিশিদিবসে ।
বেদনাবিহীন
অসাড় বিরাগ মরমে পশে’
পুরোনো
বাসর নতুন উদ্যমে তবু আবার সাজাই হয়ত দুরাশায়, কোনো একদিন । সুর ফেরেনা । পুরোনো ইয়ারি
ফিরিয়ে আনতে চাই বন্ধুদের ‘দারু’র পার্টিতে ডেকে এনে । শেষরাতে
একে অন্যকে বিষ উগরে ফিরে যাই নিজেদের সেই সুরছেঁড়া বাসি বাসর, অর্থাৎ খোঁড়লে । পুরোনো কাজ ধরতে চাই আবার থেকে – অবসাদ জেঁকে ধরে । সংগঠনে
সাথীদের পুরোনো লড়াকু মনোভাব, একে অন্যের প্রতি মমত্ব বজায় রাখতে বলি – মিটিং করি, ওয়ার্কশপ করি ।
দেখি অনেকের ব্যস্ততা আজকাল আরো সব অন্যান্য দিকে বেড়ে গেছে । দেশ ফিরে তো আসেই
না, আরো হারিয়ে যেতে থাকে ‘ভারতপর্ব’এর
ঝলমলে লেসার শো’য়ে ।
ঢালি মধুরে মধুর বধুরে আমার হারাই বুঝি
একটা
জগৎবিখ্যাত বই আছে । কম্যুনিস্ট ম্যানিফেস্টো । সবাইকার পছন্দ নাও হতে পারে । তবু,
বইটার প্রথম দিকের একটা বিখ্যাত প্যারাগ্রাফ থেকে উদ্ধৃত করছি ।
“আজ অব্দিকার সর্বপ্রকার মানবসমাজের লিখিত ইতিহাস…” কী, আরো লিখতে হবে ? সবাই
জানেন । কিন্তু, তৃতীয় লাইনটার দিকে নজর দেওয়ানোর জন্য পুরোটা আবার উদ্ধৃত করছি । “আজ অব্দিকার সর্বপ্রকার
মানবসমাজের লিখিত ইতিহাস শ্রেণীসংগ্রামের ইতিহাস । মুক্তমানুষ (‘ফ্রীম্যান’ এর গ্রীক অর্থে) ও ক্রীতদাস,
প্যাট্রিসিয়ান ও প্লেবিয়ান, জমিদার ও ভূমিদাস, গিল্ডমাস্টার ও জার্নিম্যান, এককথায়
অত্যাচারী ও অত্যাচারিত একে অন্যের বিরোধে রত থেকেছে আজঅব্দি, কখনো গোপনে কখনো
প্রকাশ্যে লড়াই চালিয়েছে অনবরত । একটা লড়াই যা প্রতিবার, হয় সমাজের বৈপ্লবিক
পুনর্গঠনে শেষ হয়েছে নয়তো…”
‘নয়তো’ …? তারপর কী ?
“নয়তো যুদ্ধরত শ্রেণীগুলির সমূহ ধ্বংসে শেষ হয়েছে ।”
কী
বস্তু ? এই ‘সমূহ ধ্বংস; ?
ভূমিকম্পে,
অগ্ন্যুৎপাতে, জলপ্রলয়ে সব কিছু শেষ হয়ে যাওয়াই কি শুধু সমূহ ধ্বংস ? এমনকি এক
একটি জাতির সম্পূর্ণ অস্তিত্ব, একটি পুরো সভ্যতা হারিয়ে গেছে কালের গহ্বরে, অথবা
গত দু’শো বছরে পূঁজির রথচক্রে পিষ্ট
হয়ে কেননা তারা সমাজের বৈপ্লবিক পুনর্গঠন সময় মত করতে পারেনি ।
কিন্তু
তাছাড়াও, সমাজজীবনের যে অর্থনৈতিক বিপর্যয়, সামাজিক, নৈতিক, সাংস্কৃতিক বিপর্যয়,
সেটা বাড়তে বাড়তে ‘সমূহ
ধ্বংসে’ পৌঁছে যেতে পারে না কি ?
ঢালি মধুরে মধুর বধুরে আমার হারাই বুঝি
পাইনে
খুঁজি ।
…………
অতল
স্বপ্নসাগরে ডুবিয়া মরি যে যুঝি
কাহারে
খুঁজি ।
কর্মভিত্তিহীন
আশাবাদের স্বপ্নসাগরে ডুবে যুঝে মরছি – কাকে খুঁজছি ? যতই মধুর ঢালিনা কেন মধুরে, পরানবঁধুকে আর খুঁজে পাওয়া
যায়না ।
একটা
বই বেরিয়েছে কিছুদিন আগে । ‘অপটিমাল কন্ট্রোল অফ নন-লিনিয়ার প্রসেস, উইথ এ্যাপ্লিকেশন ইন ড্রাগস,
কোরাপশন এ্যান্ড টেরর’ । যদিও
খুবই চমকপ্রদ তার বিচার্য বিষয়, বিচারপদ্ধতি অত্যন্ত জটিল, সাধারণ বোধগম্যতার
বাইরে । বিশুদ্ধভাবে গণিতবিদদের এলাকা । রকেটের বিভিন্ন ইঞ্জিনগুলোর মধ্যে
ভারসাম্য রাখার জন্য যে গাণিতিক প্রক্রিয়া ব্যাবহার করা হয়, সেটি প্রয়োগ করা হয়েছে
সমাজের কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের ওপর । যেমন কোরাপশন, অর্থাৎ দুর্নীতি । বইয়ের
লেখকদের কাছে বিচার্য প্রশ্নটা হল এরকমঃ যদি কোনো সমাজে সাধারণভাবে মানুষ একদিকে ধনসম্পত্তি,
প্রতিপত্তি ইত্যাদি এবং অন্যদিকে দুর্নীতিরোধক শাস্তিবিধানের তুলনার ভিত্তিতে সততা
ও দুর্নীতিগ্রস্ততার মাঝে ঘোরাফেরা করে, তাহলে কি সে সমাজে সৎ ও দুর্নীতিগ্রস্ত
মানুষের অনুপাতে কখনো দীর্ঘস্থায়ী স্থিরতা আসতে পারে ? বা, গাণিতিক ভাষায়, স্থায়ী
ভারসাম্য আসতে পারে কি সে সমাজে ?
বইটার
লেখকদল (পাঁচজন গবেষক) গাণিতিকভাবে প্রমাণ করে দেখিয়েছেন, না, আসতে পারেনা । হয়
কিছুদিনের মধ্যে সবাই দুর্নীতিগ্রস্ত হবে অথবা সবাই সৎ হয়ে যাবে । অর্থাৎ, সেই একই
কথা, হয় বৈপ্লবিক পুনর্গঠন নয় সমূহ ধ্বংস । মাঝামাঝি জায়গায় বেশি দিন থাকা যাবেনা
।
এ তো
গেল বাইরের কথা ।
ঘরের
কথা ?
কতরকম
পরিভাষা ও প্রতীক গড়ে তুলি দাম্পত্যে দুর্নীতির ! এ্যাডজাস্টমেন্ট, কম্প্রোমাইজ ।
সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে স্যাক্রিফাইস ! সব ফাঁপা ! দাম্পত্য ভেঙে যায় !
ইন্ডিপেন্ডেন্স ! সেও ফাঁকা !
ব্যাকুল
নয়নে হেরি চারিপাশে
শুধু
রাশি রাশি শুষ্ক কুসুম হয়েছে পূঁজি;…
* * * * *
তাই ভেবেছি আজিকে খেলিতে হইবে নূতন খেলা
রাত্রিবেলা
।
মরণদোলায়
ধরি রশিগাছি
বসিব
দুজনে বড়ো কাছাকাছি
ঝঞ্ঝা
আসিয়া অট্ট হাসিয়া মারিবে ঠেলা
আমাতে
প্রাণেতে খেলিব দুজনে ঝুলনখেলা
নিশীথবেলা
।
‘ভেবেছি’ । কিন্তু ভাবলেই কি আর হয় ? প্রাণকে নিজের অন্তরে অনুভব করা যদিও বা যায়
মুহূর্তের চৈতন্যে, তাকে ধরে রাখাই হয় কঠিন । কেননা প্রাণ তো আমার ব্যক্তিগত
সম্পত্তি নয় । প্রেয়সীও ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয় । প্রাণ ইতিহাসের সাড়া । প্রেয়সী
আরেকটি প্রাণের ধারক । তাতেও সেই একই ইতিহাসের সাড়া । প্রাণকে কাছে ধরে রাখতে গেলে
ইতিহাসের সাড়া হৃদয়ে বাজিয়ে রাখতে হবে অনুক্ষণ । প্রেয়সীকে কাছে ধরে রাখতে গেলে
তার প্রাণেও যে ইতিহাসের সাড়া তা কান পেতে শুনতে হবে ।
ইতিহাসের
সাড়া প্রাণে বাজিয়ে রাখা, কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে গান শোনাও নয়, ডুগডুগি বাজানোও নয় ।
ইতিহাসের সাড়া প্রাণে অনুক্ষণ বাজিয়ে রাখতে গেলে শামিল হতে হবে ইতিহাস-নির্মাণের
কর্মযজ্ঞে । প্রেয়সীও শামিল হবে তাতে । তবেই প্রেয়সীকেও পাওয়া যাবে ।
এই
কঠোর সত্যটার মুখোমুখি হওয়া বেশ কঠিন । সব কবিতা এখানেই এসে হোঁচট খায় । এখানে
তাকে আবার নতুন করে জায়গা করে দিতে হয় ইতিহাস-নির্মাণে রত কেজুড়ে মানুষটার জন্য, প্রাণশক্তির
সন্ধানে । সাধারণ কবিতা তা করতে গিয়ে ছন্দ হারিয়ে ফেলে, ভেঙে যায় । তাই আগেই, কিছু স্বপ্নবাক্য আউড়িয়ে শেষ করে নিজের যাত্রাপথ । যাতে এখান অব্দি না পৌঁছোতে হয় ।
কিন্তু অনন্যসাধারণ যে কবিতা সে গ্রহণ করে, কেজুড়ে প্রাণশক্তিটাকে প্রবেশ দিয়ে,
নিজের ছন্দ ভেঙে, নতুন ছন্দে নিজেকে আবিষ্কার করার সমরাহ্বান । সে কবিতা বলতে
পারেঃ-
প্রাণেতে
আমাতে মুখোমুখি আজ
চিনি
লব দোঁহে ছাড়ি ভয়লাজ…
‘থ্রী ইডিয়টস’ ফিল্মে শরমন যোশির ক্যারেক্টারটা মনে আছে ? ইন্টারভিউ বোর্ডের সামনে
বলেছিল, “স্যার ! শরীরের সতেরোটা হাড়
ভেঙে আমি এই এ্যাটিচ্যুডটা পেয়েছি । চাকরী আপনারা রাখুন, এই এ্যাটিচ্যুড আমি ছাড়তে
পারবো না ।” হাসপাতালে যেদিন ওর জ্ঞান
ফিরে এসেছিল, ভয়ে ভয়ে বেঁচে থাকার বিরুদ্ধে কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল, তখন
নিশ্চয়ই সেও আউড়ে থাকবে উপরের পংক্তিদুটো, তা সে যা ভাষাতেই হোক । তারপরে অবশ্য
সিনেমা ।
______________
‘স্বপ্ন টুটিয়া বাহিরেছে আজ দুটো পাগল’ । অর্থাৎ স্বপ্ন নয়, কঠোর
বাস্তবের জমিতে ‘ভয়লাজ’ ছেড়ে যদি আমি ও প্রাণ একে
অন্যকে চিনে নিতে পারি, যদি ইতিহাসের সাড়া বাজে দুজনেরই প্রাণে অনুক্ষণ তবেই গাইতে
পারবঃ-
দে
দোল্ দোল্ ।
এ
মহাসাগরে তুফান তোল্ ।
বধুরে
আমার পেয়েছি আবার, ভরেছে কোল ।
……………
বক্ষ
শোণিতে উঠেছে আবার কী হিল্লোল !
ªªªªªª
(২০১৪ সালের কোনো একদিন লেখা)
No comments:
Post a Comment