দুটো উপন্যাস
তেত্রিশ বছর আগে* কিনেছিলাম এলেক্স হ্যালির
‘রূটস’। তার তিন বছর পর কিনেছিলাম নর্মান মেলারের ‘দ্য এক্সিকিউশনার্স সঙ’। তিন
দশক ধরে বই দুটি আলমারিতে অথবা বাক্সে বন্দী হয়ে ছিল। তিন দশকে ন’বার বাসাবদল
করেছি। বই দুটি যতবার বার করেছি প্যাকিং খুলে নতুন বাসায় গুছিয়ে তুলতে, টেনেছে,
যেমন করে সব না-পড়া বই টানে। কিন্তু পড়তে শুরু করার জন্য মন কেন জানিনা, যুগিয়ে
তুলতে পারিনি।
আজ যে পারলাম, তাও জানিনা কেন পারলাম।
ডাইরি দেখছি – ২০শে সেপ্টেম্বর ২০০৯এ শেষ করেছি ‘দ্য এক্সিকিউশনার্স সঙ’। আর ১৩ই
নভেম্বর ২০১০এ পড়ে শেষ করলাম ‘রূটস’। সময় লেগেছে অবশ্যই। এক হাজার পৃষ্ঠার ওপর
প্রথম বইটি। ছ’শো পৃষ্ঠার ওপর দ্বিতীয়টি। কুড়ি পঁচিশ দিন ধরে খেপে খেপে পড়েছি।
প্রথমটি নিয়ে একটি ফিল্ম তৈরি হয়েছিল
বোধহয়; জানিনা কেমন চলেছিল। দ্বিতীয়টি নিয়ে একটি জনপ্রিয় টিভি সিরিয়াল তৈরি
হয়েছিল। দুটো বইয়েরই রচনাকাল সত্তরের দশক। স্থান – যুক্তরাষ্ট্র এমেরিকা। কিন্তু
বিষয়বস্তু, স্থান, কাল সব একেবারে আলাদা। তবু মনে হল দুটোকে পাশাপাশি রেখে জুড়বার
চেষ্টা করে দেখি কী দাঁড়ায়।
যাঁরা উপন্যাসদুটি পড়ে থাকবেন তাঁদের
কাহিনীসার শুনিয়ে সময় নষ্ট করার কোনো অধিকার নেই আমার। তবু এই চিন্তায় এগোতে দুটি
কাহিনীসার পাশাপাশি রাখার প্রয়োজন আছে মনে হয়।
দ্য এক্সিকিউশনার্স সঙ (ঘাতকের গান)
সল্টলেক সিটি উটা রাজ্যের অন্তর্গত।
যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপশ্চিম। যাঁরা গেছেন তাঁরা ভালো জানবেন, আমি অগতির গতি
ইন্টারনেট খুলে মিলিয়ে নিলাম শহরের জনসংখ্যার ৫৮% খ্রীস্টান ধর্মে মর্মন
মতাবলম্বী। মর্মন সম্পর্কে উইকিপিডিয়ায় পেলাম খ্রীস্টান ধর্মের পরবর্তীকালীন
সন্তদের (লেটারডে সেন্টস) অনুযায়ী। এই ধর্মমতের স্থাপনা বোধহয় এমেরিকাতেই উনবিংশ
শতাব্দীর শুরুতে হয়েছিল। তারা গোঁড়া। তৈরি হতে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কোনো
কারণে তাদের বিবাদ ছিল। উপন্যাসেও আছে আর নেটেও পেলাম যে সল্টলেক সিটির মর্মনদের
জন্য ইতিহাসপুরুষ ব্রিহাম ইয়ং। কোনো একসময়ে ব্রিহাম ইয়ং নামে জনৈক ব্যক্তির
নেতৃত্বে অনেক রক্তকর্দ্দমে পথ তৈরি করে মর্মন মতাবলম্বী মানুষেরা এই জনশূন্য
মরুপ্রান্তরে এসে উপনিবেশ গড়ে তুলেছিল। অর্দ্ধশতাব্দীকাল তাদের প্রত্যক্ষ বা
পরোক্ষ যুদ্ধ চলে যুক্তরাষ্ট্রীয় সৈন্যবাহিনীর সাথে। অবশেষে সংযুক্তি। সেই
উপনিবেশই আজ বিশাল সল্টলেক সিটি। আকাশরেখায় দেখা যায় মর্মন মন্দিরের চুড়া, ব্রিহাম
ইয়ং বিশ্ববিদ্যালয়।
কোথা থেকে এসেছিল তারা? পরে জানবো নাহয়। না
জানলেও বিশেষ ক্ষতি নেই। আপাততঃ উপন্যাসের প্রসঙ্গে সেটা খুব বেশি প্রয়োজনীয় নয়।
যা হোক, আগে গল্পের ছকটা বলে নিই।
শৈশব থেকে পারিবারিক নিঃসঙ্গতার ফলে অপরাধমনস্ক হয়ে পড়া
গ্যারি গিলমোর দ্বিতীয়বার দীর্ঘ কারাবাসের পর প্যারোলে ছাড়া পেয়ে সল্টলেক সিটিতে
ঠাঁই নিতে আসে। তখন তার বয়স ছত্রিশ। কিন্তু দুবার জেল খাটার ছাপ শরীরে, মুখে।
কয়েকটা দাঁত নেই। ভদ্র পরিবারে তার পূর্ব পরিচয় নিয়ে সতর্কতা সে তার গোলমেলে
ভাবভঙ্গী দেখিয়ে আরো বাড়িয়ে তোলে। তাকে ভয়ও পায় লোকে। একমাত্র মাস্তুতো বোন
ব্রেন্ডা, তার শৈশবের খেলার সাথী, যার স্পন্সরশিপে সে প্যারোল পেয়েছে, তাকে
যাচ্ছেতাই করে বকবার ক্ষমতা রাখে। ব্রেন্ডাই জানে, হাইস্কুল পাশ করতে না পারা
গ্যারির রুচিবোধ জেলে বসে পড়াশুনো করার ফলে কতটা সমৃদ্ধ। কত সুন্দর আঁকার হাত তার।
আর বালকবয়সের স্বপ্নের রাজকুমার গ্যারি কুপারের মত রাজকীয় মন। কিন্তু সবাই তো আর
ব্রেন্ডা নয়।
একদিকে ঘরের মধ্যে মর্মন সমাজের অতিধার্মিক, গোঁড়া,
নীতিবাদী পরিবেশ আর অন্যদিকে বাইরে হাইওয়ে, পেট্রলপাম্প, পিক-আপ ভ্যান, ট্রাক
অর্থাৎ ছড়াতে থাকা নগরায়ণ ও তার ফসল উচ্ছৃংখল জীবন। সমাজটাই তার নিজের বিকাশক্রমে
এক বিপন্নতার, সঙ্কটের সম্মুখীন। তার মধ্যে গ্যারি আরেক বেখাপ্পা মানুষ। শৈশব
থেকেই জেল খেটে খেটে তার মন আদ্ধেক শিশু, আদ্ধেক বুড়ো। ঠিক সুস্থ যুবকটাই যেন সে
হয়ে উঠতে পারে না – কখনো শিশু হয়ে যায়, কখনো বুড়ো হয়ে যায়। অথচ শরীর তো তার
মধ্যযৌবনে, তার রোজগার চাই, নারী চাই, ঘর চাই বাঁধার! ... ঘরোয়া পরিবেশে গল্প করতে
গিয়ে সে বোঝে তার কাছে গল্পও নেই, জেলের নানান অপরাধকাহিনী ছাড়া। সেসব গল্প
শ্রোতাদের ভয় পাইয়ে দেয়, সতর্ক করে দেয়, ঘৃণামিশ্রিত দূরত্বে ঠেলে দেয়।
তবু সে চেষ্টা করে খাপ খাইয়ে নেওয়ার, বাঁচবার। কাজও
জোটায় – কখনো এটা, কখনো সেটা। থাকার ঘর জোটায়। বদভ্যাসের মধ্যে থেকে যায় এক ক্রেট
বীয়ারের বোতল মাঝরাত অব্দি বসে খালি করা – তাও মাঝে মধ্যে। এমনকি একটি মেয়েবন্ধুও
জোটায়, নিকোল। দুই বাচ্চা কোলে সেও এক উচ্ছন্নে যাওয়া মেয়ে।
নিকোলের শৈশব নষ্ট হয় তার পরিবারে। পাগলা গারদে যেতে হয়।
কত পুরুষ যে তার জীবনে এসেছে তার গুনতি নেই। বস্তুতঃ সে জানে পুরুষসঙ্গ মানেই
ঘন্টাখানেকের মধ্যে কাপড় খোলার জন্য তৈরি থাকা, অথচ সে নিরুপায়। ওঁই সঙ্গটুকুও না
পেলে একা একা পাগল পাগল লাগে। আর মেয়েদের তো কথাই নেই। তারা সঙ্গ দেবে কী? কাছে
গেলেই বেশ্যা ভেবে সতর্ক হয়ে ওঠে। হাঁটু অব্দি জীন্স আর হল্টার লাগানো স্লীভলেস
টপ্স পরে সল্টলেক সিটির রাস্তায় নিজের সেকেন্ড হ্যান্ড মুস্ট্যাঙে সে এক বিষন্ন
বেপরোয়া। কেউ জানেনা, সে কবিতাও লেখে মাঝে মাঝে।
গ্যারি আর নিকোল ঘর বাঁধার চেষ্টা করে। দুজনেই নিঃসঙ্গ।
দুজনেরই মনের অবচেতনে সারাক্ষণ মনে হয় কিন্কিন্ করতে থাকে এক নিয়তিবোধ যে গোড়া
থেকেই সব কিছু ভূল তাদের জীবনে, বোধহয় আর ঠিক হবে না কোনোদিন। তবু কিছুদিন চলে
তাদের সংসার।
কিন্তু একেকটা দিন আসে ভীষণ খারাপ। এদিকে নিকোলের সাথে
ঝগড়া, ওদিকে কাজের জায়গায় ধ্যাঁতানি, সারাক্ষণের অভাব, বাসস্থানে দূরসম্পর্কের
আত্মীয়স্বজনের ঠান্ডা নজর, ব্রেন্ডাও যেন হাল ছেড়ে দিয়েছে... মাথাটা হিমশীতল
অপরাধীর মত হয়ে ওঠে গ্যারির। একরাতে দু’দুটো ডাকাতি আর খুন করে ফেলে।
রাতেই ধরা পড়ে নিজের প্রিয় ভ্যানগাড়িটায় পালাতে গিয়ে।
বিচার হয় কয়েক সপ্তাহ ধরে। শাস্তি হয় – মৃত্যুদন্ড। আপীল করা তার অধিকার। কিন্তু
সে কোর্টকে জানায়, “যদি মৃত্যুদন্ড ঘোষণাটা ঠাট্টা না হয়, তাহলে প্লীজ, যে তারিখ
দিয়েছেন সেই তারিখেই যেন মৃত্যু দেওয়া হয়।”
ব্যাস, আপীল না করা ছোট্টো
কিন্তু রোমাঞ্চকর খবর হয়ে যায় স্থানীয় সংবাদপত্রে।
এই অব্দি প্রথম খন্ড। খন্ডটির
নাম ‘পশ্চিমা কন্ঠস্বর’। এখানে পশ্চিম বলতে যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম। এই পশ্চিম
কতখানি জুড়ে তা আমি জানিনা তবে যে উটার গল্প সে উটা রাজ্যে, কাহিনীর ইঙ্গিতে
স্পষ্ট, গোঁড়া ধর্মাবলম্বী, নীতিবাগীশ সাদা মানুষদের সাংস্কৃতিক প্রভুত্ব। পুরো
কাহিনীতে চরিত্রদের আসা যাওয়ার পথে (একমাত্র গ্যারির জেলের অভিজ্ঞতা ছাড়া) একজন
কালো মানুষ বা একজন লাল মানুষের দেখা নেই। পরিবারে, পথে, শরাবখানায়, প্রশাসনে
মানুষদের কথাবার্তায় যে মানসিক গঠন দেখা যায়, অন্যধরণের মানুষদের উপস্থিতি
সম্পর্কে একটা সহজাত অচেতনতা – এ যেন একশো বছর আগেকার দক্ষিণ এমেরিকা। শুধু তফাৎ
এই যে তাদের ছিল ভীতি এবং অস্বীকৃতি, এদের, অচেতনতা। খুবই উল্লেখযোগ্য যে গ্যারি
নিজেও কালো মানুষদের ঘৃণা করে – ব্ল্যাকহেটার। (আবার নেট ঘাঁটলাম। উটা প্রদেশে
সাদা মানুষের প্রতিশত ৯৫। কালোর প্রতিশত ১এর কিছু বেশি। হিস্প্যানিওল ৪এর
কাছাকাছি।)
দ্বিতীয় খন্ড শুরু হয় স্থানীয় সংবাদপত্রে প্রকাশিত ওঁই
খবরটির সুত্রে। খুব স্বাভাবিক ভাবেই সংবাদমাধ্যমের যোগাযোগে খবরটি পৌঁছে যায়
যুক্তরাষ্ট্রের প্রাণকেন্দ্র নিউইয়র্কের মিডিয়া-তারকাদের কানে। সেদিনই আবার জিমি
কার্টার ভোটে জেতেন। কিন্তু সে শোরগোলেও চাপা পড়েনা উত্তেজক খবরটা – দশ বছরে
এমেরিকায় প্রথম মৃত্যুদন্ড। খোদ উটায় ষোলো বছর পর। তারপর আসামী আবার বলে যে সে
আপীল করবে না। দাবী করে যে নির্ধারিত দিনেই যেন তাকে মৃত্যদন্ড দেওয়া হয়!
ছুট! ছুট! ছুট!
পঙ্গপালের মত যুক্তরাষ্ট্রের পূর্বাঞ্চল মানে কস্মোপলিস থেকে
ধেয়ে আসে সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধি, বৈদ্যুতিন সম্প্রসার-মাধ্যমের প্রতিনিধি আর
মানবাধিকার কর্মীরা। কী বিরাট হইচই। গ্যারি গিলমোরের এক্সক্লুসিভ, গ্যারির
পরিবারের একেকজনকে খুঁজে খুঁজে ইন্টারভিউ, স্টোরি, বাইট, ফুটেজ... । গ্যারির নামে
গেঞ্জি বেরিয়ে গেল, গ্যারির ফ্যানমেল আসতে শুরু করে দিল দিস্তা, দিস্তা। রাতারাতি
গ্যারি হয়ে গেল স্টার।
ওদিকে মানবাধিকার কর্মীদের শুরু হল গ্যারিকে বিরক্ত করা
আর বই ঘাঁটা। কেন সে আপীল করবে না? আসামী না চাইলেও কি মানবাধিকারের তাগিদে কোনো
কোনো সংস্থা বা ব্যক্তি উটা হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে ফেডারেল সুপ্রীম কোর্টে
মামলা দায়ের করতে পারে না?
এরই সাথে শুরু হল এক অন্তঃসলিলা কাব্য। গ্যারির হাতে
ভাষা ও শিল্প তো ছিলই। নিকোলকে প্রেমপত্র লেখা শুরু করল পাতার পর পাতা। নিকোল,
শরীরসর্বস্ব জগতে বড় হয়ে ওঠা নিকোল সেই প্রেমপত্র পড়তে লাগল। একদিকে গ্যারির কাছে
একনিষ্ঠ থাকার চেষ্টা, অন্যদিকে এতদিনকার জীবনের বহুবিধ পুরুষসঙ্গ – নিকোলকে ভর্ত্তি
করতে হল মানসিক চিকিৎসালয়ে। সেখানে নিকোল নিজেকে পুনরাবিষ্কার করল কবি হিসেবে। তার
কবিতাগুলো পেয়ে গ্যারি যত্ন করে রাখতে লাগল বাক্সে। আর গ্যারির চিঠি জমা হতে থাকল
নিকোলের বাক্সে।
বাণিজ্যের কী নজর! খোঁজ পড়ল সেই চিঠি আর কবিতার। হাতে
আসার আগেই স্বত্বাধিকার বিক্রী হতে শুরু করল এক হাত থেকে অন্য হাতে। গ্যারি তো এখন
বড়লোক। কিছু নিকোলের নামে লিখে দিল।
মিডিয়া আর মানবাধিকারের কাজ একে অন্যকে সাহায্য করল।
মিডিয়া চাইছিল গ্যারির মৃত্যুদন্ড বলবৎ হোক। সেদিনটা হবে কার্নিভালের মত। জবরদস্ত
ক্লাইম্যাক্স। কিন্তু একটু দেরি হোক তাতে। তাহলে স্টোরিলাইনগুলো যতদূর সম্ভব
ডেভেলাপ করা যাবে। বাণিজ্য বাড়বে। মানবাধিকারের হস্তক্ষেপ বার বার খেপে খেপে সেই
কাজটাই করে দিচ্ছিল।
অবশেষে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হল গ্যারিকে। জেল ক্যাম্পাস
গাড়িতে, ক্যামেরায়, ফ্ল্যাশে ছয়লাপ। বিমানবন্দরে চার্টার্ড প্লেন দাঁড়িয়ে আছে
ডজনখানেক।
জেল কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ভাড়া করা ঘাতকের দল একটা পর্দার
আড়াল থেকে বন্দুকের একঝাঁক গুলিতে প্রাণ শেষ করে দিল তার।
নিকোল তার দুই বাচ্চাকে নিয়ে চলে গেল দূরে।
মর্মন সমাজে শান্তি নেমে এল।
প্রথম যৌবনে ডাকাতির অপরাধে জেল হওয়ার পর গ্যারি মাকে
বলেছিল, “ওরা আর কী কষ্ট দেবে আমায়? যা কষ্ট আমি নিজেকে দিয়েছি!” তৃতীয় দুনিয়ার
দারিদ্র্যে জীবন কাটানো আমাদের কাছে আপাত-দুর্বোধ্য এই উক্তিটার মধ্যে রয়েছে
গ্যারির পারিবারিক বিশৃংখলা এবং এমেরিকার সমাজে শৈশব ও কৈশোরের নিদারূণ সঙ্কট।
দ্বিতীয়বার জেলে যাওয়ার সময় আদালতে দাঁড়িয়ে গ্যারি একটা
সংক্ষিপ্ত মর্মস্পর্শী বক্তৃতা দিয়েছিল। বিচারকের উদ্দেশ্যে দেওয়া সেই বক্তৃতা
এখানে উদ্ধৃত করছি না। কিন্তু অসাধারণ যুক্তিপূর্ণ কিছু বিশ্লেষণ ছিল তাতে,
অপরাধীর সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়ার জটিলতা সম্পর্কে। বস্তুতঃ গ্যারি সেই
জটিলতারই শিকার হল।
উপন্যাসের শেষে একটি উপসংহার (আফটারওয়র্ড) আছে। তাতে
লেখক নর্মান মেলার, প্রকাশকের অনুরোধে গ্যারি গিলমোরের মৃত্যুদন্ডের সত্য ঘটনা
অবলম্বনে রচিত এই উপন্যাসটি রচনার ইতিহাস বলেছেন। তিনবছর ধরে দুই ডজন গবেষক,
টাইপিস্ট ও আরো কিছু মানুষজনের সাহায্য নিয়ে, ঘটনাবলীর সাথে জড়িত মানুষগুলোর
সাক্ষাৎকার (একশো জনেরও বেশি), নোট্স (যার মোট আয়তন প্রায় পনেরো হাজার পৃষ্ঠা)...
ইত্যাদির বিশ্লেষণ করে এই উপন্যাস রচিত হয়েছে। উপন্যাসকার দাবী করেছেন যে এধরণের
লেখায় তথ্যের সাহায্যে সত্যের যতটা কাছে পৌঁছোনো সম্ভব ততটা পৌঁছোবার তিনি চেষ্টা
করেছেন।
রূট্স (শিকড়)
পশ্চিম আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়া। সেখানেই জুফুরে নামের
একটি গ্রামে বড় হচ্ছিল কিশোর কুন্টা কিন্টে। বাবা ওমোরো। মা বিন্তা। বংশসূত্রে
তারা মালি দেশের কামার এবং মান্ডিঙ্কা উপজাতির বীর কাইরাবা কুন্টা কিন্টের বংশধর।
সেটা ১৭৬৭ সাল। জুলাই মাসের এক ভোরবেলায় কুন্টা গিয়েছিল
গ্রামের অদূরে জঙ্গলে। বহুদিন ধরে ইচ্ছে ভালো দেখে একটা গাছের গুঁড়ি কেটে ঢোল তৈরি
করবে। তারপর যাবে দূর স্বপ্নের দেশ মালি। মায়ের জন্য, ভাইদের জন্য নানারকম উপহার
নিয়ে আসবে। কালো উজ্জ্বল মুখে গুঁড়োকালি মেখে সেজে থাকা গ্রামের তরুণীদের একটিকে
বাছবে নিজের ঘর বাঁধতে।
গাছের গুঁড়িটা বেছে ঝুঁকে যাচাই করার মুহূর্তে সে ধরা
পড়ল ক্রীতদাস পাচারকারী দালালদের হাতে। মুক্ত হওয়ার ব্যর্থ চেষ্টায় রক্তাক্ত হতে
হতে নিজেকে পেল জাহাজের খোলে – উলঙ্গ, আরো দেড়শো উলঙ্গ দেশবাসীর সাথে। শিকলবাঁধা
অবস্থায় চাবুক খেতে খেতে, নিজেদের মল-মুত্র-বীর্যে ঘেয়ো হতে হতে, তিন ভাগের খেপে
খেপে মৃত দু’ভাগ বন্দীকে সমুদ্রে ডুবিয়ে দু’মাস পরে এক ভাগ পৌঁছোলো এমেরিকা
মহাদেশের উপকূলে। দাসবাজারে তারা ক্রীত হল একে একে। কুন্টা কিন্টের নাম হারিয়ে
গেল। মালিকের নামে নামকরণের প্রথায় তার নতুন নাম হল টবি ওয়ালার।
বহুবার পালাবার চেষ্টা করল কুন্টা। শেষ চেষ্টার শাস্তি
হিসেবে তার ডানপায়ের পাতার আদ্ধেক কুড়ুল দিয়ে কেটে ফেলা হল। কবে যেন টের পেল সে –
সতেরো বছরের কিশোরটি এখন বছর তিরিশের মধ্য যৌবনে। তিরিশও পেরিয়ে গেল। সে কি বাবা
হবে না? কাইরাবা কুন্টা কিন্টের বংশ তার, মুক্ত হতে না পারার ব্যর্থতায় হারিয়ে
যাবে? ... মাঝে মধ্যেই খবর আসে নানা জায়গায় গোলাম-ব্যারাক থেকে পালাবার, ছোটো ছোটো
বিদ্রোহের ব্যর্থ চেষ্টার! ফিসফিসিয়ে কথা বলে তারা রাত্তিরবেলায়। ... এর মধ্যে কুন্টার
ভালো লাগে বেল নামে মেয়েটিকে। তার থেকে বড়। মান্ডিঙ্কা পরম্পরায় মেয়ের বয়স পনেরো
হওয়ার কথা। বেলের বয়স পঁয়ত্রিশ, নাকি চল্লিশ। ভারি জবরদস্ত স্বাস্থ্যবতী। তবু এই
তো তার প্রাণ বাঁচিয়েছিল। কাটা পায়ে গ্যাংগ্রীন হওয়া রুখে দিয়েছিল। রাতের পর রাত
জেগে স্নেহে শুশ্রূষায় তাকে সারিয়ে তুলেছিল। ... মালিকের অনুমতি নিয়ে তারা ‘ঝাঁটা
ডিঙোয়’ (বিয়ে করে)।
মেয়ে হয়। বড় জেদি কুন্টা – কিছুতেই ছাড়তে চায় না তার
আফ্রিকীয় পরিচয়, আত্মবিস্মৃত ক্রীতদাসদের দেখে তার রাগ হয়। সদ্যোজাতকে মায়ের কোল
থেকে প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে চলে যায় রাতের আকাশের নির্জনে ... বেল সন্দিগ্ধ স্বরে
প্রশ্ন করে, মানে? আগের দুটো বাচ্চা তো কোল থেকেই বিক্রী করে দেওয়া হয়েছিল! কুন্টা
জবাব দেয়, “তাই এর নাম ‘কিজ্জী’ মানে ‘এখানেই থাকো’।”
কিন্তু কিজ্জী থাকে না। গোপনভাবে লেখাপড়া শিখে নেওয়ার
এবং সেই শিক্ষা কাজে লাগিয়ে নিজের প্রেমিকের জন্য জাল ‘ট্র্যাভেলিং পাস’
(ক্রীতদাসদের লাগত নিজের মালিকের খামারের বাইরে যেতে – না থাকলে পুলিস ও গোলাম-ধরিয়ে
চরেরা বেধরক মার দিয়ে ধরে ফেরত পৌঁছে দিত খামারে) তৈরি করে দেওয়ার গুরুতর অপরাধে
শেরিফ তাকে ধরে। তার মালিকের অনুমতি আদায় করে বিক্রী করে দেয় বাজারে।
ষোলো বছরের কিজ্জী নতুন মালিক কর্তৃক প্রতি রাতে ধর্ষিত
হতে হতে ভাবে কোথাও জেলের কুঠরিতে মরতে থাকা তার হতভাগ্য প্রেমিকের কথা। ধর্ষণের
ফল হয় – একটি সাদাটে সন্তান। ক্রীতদাসের জীবনে সেটা কোনো অপমান নয়, বেঁচে থাকার
বিরাট অবলম্বন। নিজেই কিজ্জী তার সন্তানের কানে দেয় জাতিস্মৃতি – আফ্রিকীয়
পিতামহের, গোলাম-ধরিয়েদের হাতে ধরা পড়ে সমুদ্র পার হয়ে আসার কাহিনী, পালাবার শেষ
চেষ্টায় পায়ের পাতা কাটা যাওয়ার কাহিনী।
কিজ্জীর মালিক ওস্তাদ মোরগ-লড়িয়ে। মোরগ-লড়াইয়ের বাজি
জিতেই সে আজ হতদরিদ্র গোলাম-ধরিয়ে চরদের শ্রেণী থেকে উঠে সদ্য-বড়লোক হয়েছে। পাঁচটা
ক্রীতদাস পোষার ক্ষমতা রাখে। কিজ্জীর ছেলে জর্জের চোখে সে দেখতে পায় মোরগ-খেলার
নেশা। তার নিজস্ব মোরগ-ট্রেনার ক্রীতদাস মিঙ্গোর হাতে সঁপে দেয় জর্জকে।
বড় হতে হতে জর্জ হয়ে ওঠে দশটা খামারে নামডাকওয়ালা
চিকেনজর্জ। মালিকের বশম্বদ, মাথায় ডার্বিটুপি, গলায় সবুজ স্কার্ফ। ওস্তাদ
মোরগ-লড়িয়ে। পুরো গোলাম-ব্যারাক তার আচার-ব্যবহারে ক্ষুব্ধ।
কোথাও জর্জের মধ্যে একটা দ্বিচারিতা থাকে। শৈশবে মায়ের
মুখে শোনা তার আফ্রিকীয় পিতামহের কাহিনী আর কথার ছলে মায়ের মুখ ফস্কে বেরিয়ে যাওয়া
শব্দ থেকে বুঝতে পারা যে সে ধর্ষণের সন্তান – ওই ‘মাস্সা’ (মাস্টার শব্দের মৌখিক
বিকৃতি, মালিকদের প্রতি গোলামদের সাধারণ সম্বোধনসূচক) টম লীই তার পিতা – তার ভিতরে
দ্বিচারিতা গড়ে দেয়। একদিকে মালিকের মোরগটিকে জেতাবার জন্যে জান লড়িয়ে দেয়,
অন্যদিকে পাতি মোরগ-খেলায় বাতিল মোরগগুলো নিয়ে যাওয়ার অনুমতি আদায় করে মোট বাজির
টাকার কিছুটা পুরস্কার হিসেবে পেয়ে জমিয়ে রাখতে, যাতে কোনোদিন সে নিজেকে ও মাকে
মুক্ত করার দাম মালিককে, থুড়ি, পিতাকে দিতে পারে।
সে সময়টা বিদ্রোহের ও বিদ্রোহদমনের গল্প বারবার দক্ষিণ
এমেরিকার এদিক ওদিক থেকে, বিভিন্ন খামার ও রাজ্য থেকে ফিরে ফিরে আসার সময়।
অন্যদিকে দাসপ্রথার বাইরে থাকা উত্তর এমেরিকায় ইংল্যান্ডের বিরূদ্ধে স্বাধীনতা
আন্দোলন গড়ে ওঠার খবর আসার সময়। প্রতিটি খামারে, গোলামঘরগুলোতে ফিসফাস, উত্তেজনা,
উদ্দীপনা ও কিছুদিন পর বিমর্ষতা প্রায় অভ্যাসে পরিণত হওয়ার সময়।
চিকেনজর্জ বিয়ে করে অন্য খামারের ক্রীতদাসী ধর্মভীরু
মাটিল্ডাকে। জর্জের মালিক মাস্সা লী মাটিল্ডাকে কিনেও নেয় যাতে দুজনে একসাথে
থাকতে পারে। সচরাচর ক্ষেতখামারে কাজ করা ক্রীতদাসেরা পায় না এ সুযোগটুকু। জর্জ পায়
চিকেনজর্জ বলে। মাটিল্ডার গর্ভে একে একে সন্তান জন্মায় সাতটি। চার ছেলে, তিন মেয়ে।
ওদিকে নিজের দ্বিচারিতায় জর্জ একদিকে মালিকের চামচা, একনম্বর দারুবাজ ও মাগীবাজ।
অন্যদিকে স্নেহশীল পিতা ও শুধু কিজ্জী নয় পুরো গোলাম-ব্যারাকের মুক্তি কিনে দেওয়ার
ইচ্ছে রাখা সন্তান। নিজের তৃতীয় ছেলে, যার নাম মালিকের নামে ‘টম’, তাকে ওস্তাদ
কামারের শাগরেদী করতে পাঠিয়ে দেয় মালিকের কাছে তদ্বির করে।
টম ফিরে আসে ওস্তাদ কামার হয়ে, মালিকের খামারে জায়গা পায়
দোকান খোলার। মালিকের আয় বাড়ে, টমের কারিগরী শিল্পের সুনাম পুরো এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে।
কিন্তু সুদিন থাকে না। খুব বড় একটা মোরগখেলায় বাজি ধরে সর্বস্বান্ত হয় টম লী।
বাজির পুরো টাকা দিতে না পারার খেসারৎ হিসেবে চিকেনজর্জকে দিয়ে দেয়।
চিকেনজর্জ নতুন মালিকের সাথে কয়েক বছরের জন্য চলে যায়
ইংল্যান্ড। ওদিকে টম লী সব কিছু খোয়াতে খোয়াতে শেষে কিজ্জী ও আরো তিনজন বুড়োবুড়ি
ছাড়া বাকি সব ক্রীতদাসদের বেচে দেয় অন্য খামারমালিকের হাতে।
নতুন খামারে মাটিল্ডার অভিভাবকত্বে ও টমের নেতৃত্বে পুরো
পরিবার আগের থেকে অনেক সুখেই দিন কাটাচ্ছিল। নতুন মালিকেরাও একটু উদারপন্থী।
সময়টাও বদলাচ্ছে। রেললাইন আসছে। টেলিগ্রাফ আসছে। কিছু বছর আগেই হাইতির সফল বিদ্রোহ
তার রক্তাক্ত দমন সত্ত্বেও ছাপ রেখে গেছে হাওয়ায়। ওদিকে উত্তর এমেরিকায় স্বাধীনতা
ঘোষণাও হয়ে গেছে। দক্ষিণ তৈরি হচ্ছে ইয়াঙ্কি উত্তরের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য।
...এমনই আবহাওয়ায় প্রতিশ্রুত সময়ের তিন বছর বেশি লন্ডনে কাটিয়ে ফিরে আসে
চিকেনজর্জ।
নিজের খামারে গিয়ে দেখে কেউ নেই। শুধু স্মৃতিভ্রষ্ট
রাঁধুনী মালিজী মাসী, আর আগের মতই পাজি কিন্তু সর্বস্বান্ত কঙ্কাল টম লী। মা
কিজ্জী অদূরে মাটির নীচে। কবে যেন শায়িতা। মালিককে ঠেসে মদ গিলিয়ে, সিন্দুক ভেঙে নিজের
মুক্তিপত্র মুঠোয় নিয়ে বেরিয়ে যায় চিকেনজর্জ, ঘোড়া টগবগিয়ে নিজের পরিবারের খোঁজে।
নতুন খামারের বেড়ার ধারে দাঁড়িয়ে টমের বৌ,
আধাকালো-আধাইন্ডিয়ান আইরিন সবচেয়ে আগে দেখতে পায় লোকটিকে। ঘোড়ার পিঠে এগিয়ে আসছে –
কালো ডার্বি, সবুজ স্কার্ফ। এত গল্প শুনেছে সে নিজের শ্বশুরের! চেঁচিয়ে ওঠে,
“চিকেনজর্জ! চিকেনজর্জ!”
এতদিন পর নিজের পরিবারের কাছে ফিরেও থাকা আর হয় না তার।
কেননা আইন অনুসারে দক্ষিণের রাজ্যগুলোতে মুক্ত গোলামদের স্থান নেই। পরিবারের
স্বার্থে চিকেনজর্জ হারিয়ে যায় আবার।
ওদিকে যুদ্ধ তীব্রতর। প্রতিদিন মন ভেঙে দেওয়া খবর আসছে
যে দক্ষিণের সঙ্ঘ জিতছে। ক্রীতদাসপ্রথা ঘুচিয়ে নতুন যুক্তরাষ্ট্র গড়তে চাওয়া
উত্তরের সেনা হারছে।
অবশেষে দিন ঘুরতে শুরু করে। দক্ষিণের সঙ্ঘ একের পর এক
যুদ্ধক্ষেত্রে হারতে হারতে শেষে আত্মসমর্পণ করে। যুক্তরাষ্ট্র এমেরিকা গঠিত হয়।
দাস-মালিক ও আরো হরেকরকম সাদা-জিগিরদারদের মুখ চুন করে ক্রীতদাসপ্রথা আইনতল
নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়।
দু’এক রাতের উৎসব। তারপরেই সত্যটা মুখব্যাদান করে সামনে
দাঁড়ায়। মুক্ত হলেই বা কী? কাজও করেই তো খেতে হবে! তা পুরোনো মালিকের খামারে কাজও
করে খাওয়াই তো ভালো!... কিন্তু বুড়ো চিকেনজর্জ ঘোড়ায় চড়ে বীরের মত ফেরে মুক্ত
দক্ষিণে। নতুন স্বপ্ন দেখায়, “চল, নতুন জমি আবাদ করি”। দুই ডজন গাড়ির ক্যারাভানে
মাস্সা মারে’র গোলামপরিবারগুলো সবাই পাড়ি দেয় নতুন আবাদের মুক্ত দিগন্তে।
সেখানেও অবরোধ – কালোদের প্রতি ঘৃণা সেখানেও কম নয়।
কিন্তু তারা আজীবন দাসত্ব করেছে। কঠিনতম পরিস্থিতিতেও জীবনের ফসল বুনতে তারা
অভ্যস্ত। তারাই তো ক্ষেতে, খামারে, রেলপথে, কাঠকলে, কামারশালায় তিলে তিলে গড়ে
তুলেছে এমেরিকা!
তারা বেঁচে থাকে। স্বচ্ছল হয়ে ওঠে। তারা গড়ে তাদের
বাড়িঘর, তাদের সন্তানদের স্কুল, তাদের নিজস্ব গির্জা। এমনকি ধীরে ধীরে ওই অঞ্চলের
স্বনামধন্য পরিবার হয়ে ওঠে তারাই।
টম, যে কামার হয়েছিল, চিকেনজর্জের তৃতীয় ছেলে, আফ্রিকার
জুফুরে গ্রাম থেকে ধরে নিয়ে আসা ক্রীতদাস কুন্টা কিন্টের প্রপৌত্র, তার কনিষ্ঠ
মেয়ে হল সিন্থিয়া। সিন্থিয়া আর উইল পামারের মেয়ে হল বার্থা, বার্থা জর্জ। বার্থা
জর্জ ও সাইমন এ∙ হ্যালির সন্তান হলেন এই উপন্যাসের রচয়িতা এলেক্স
হ্যালি।
উপন্যাসের শেষ অধ্যায়ে লেখক কুড়ি পৃষ্ঠায় বলেছেন তাঁর
বারো বছরের গবেষণার রোমাঞ্চকর কাহিনী। গাম্বিয়ায় সেই জুফুরে গ্রামে গিয়ে মৌখিক
ইতিহাস-কইয়ে পরম্পরাগত ‘গ্রিয়ট’দের কাছে মান্ডিঙ্কা উপজাতি ও কিন্টে বংশের কাহিনী
শোনা, গ্রামের মানুষদের কাছে কিন্টে বংশের বংশধর হিসেবে স্বীকৃত ও অভিষিক্ত হওয়া,
পোর্ট লুইসের নথীপত্র ঘাঁটা, আন্নাপোলিস বন্দরের মালখানার রেকর্ড ঘাঁটা, স্পট
সিল্ভানিয়া কাউন্টির দাস কেনাবেচার রেকর্ড দেখা, শেষে অন্তর্বাস পরে জাহাজের খোলে
বারো রাত এটলান্টিকের দোলায় লোহা আর কাঠের ঘষা খাওয়া। মাথার মধ্যে ছিল সেই
জাতিস্মৃতি যা বাপমাহারা ধর্ষিতা মা কিজ্জী ও তার সন্তান চিকেনজর্জের আদেশ মত
কুন্টা কিন্টের বংশধরেরা পরবর্ত্তী প্রজন্মের কানে দিয়ে গেছে – আদিদেশ আফ্রিকা,
‘ক্যাম্বি-বোলোঙ্গো’ নদী, ভোরের জঙ্গলে ঢোলের জন্য গাছের গুঁড়ির খোঁজ,
ক্রীতদাস-বাহক ‘টোবর’ জাহাজের খোলে ছয় চাঁদের (তিন মাসের) নারকীয় সফর, পালাবার শেষ
চেষ্টায় পায়ের পাতা কাটা পড়া।
ছ’শো অষ্টআশি পৃষ্ঠার এই বই কালো মানুষের চোখ দিয়ে দেখা
এমেরিকা দেশটার গড়ে ওঠার ইতিহাস।
এবং এই কালো মানুষ সত্তরের দশকের ব্ল্যাকপ্যান্থার বা
কোনো উগ্রপন্থী নয়। কালো নেতা ম্যালকম এক্সের আত্মজীবনী লেখক ছিলেন এলেক্স হ্যালি।
‘রূট্স’ তাঁর দ্বিতীয় বই। ঘাতকের হাতে নিহিত ম্যালকম এক্স, কালো ও সাদা মানুষদের
একসঙ্গে মিলে মিশে কাজও করার প্রয়োজনের কথা বলতেন।
বিয়ন্ড
দ্য মেল্টিং পট
‘বিয়ন্ড দ্য মেল্টিং পট’। বাংলা করতে গেলে অর্থের দিক
থেকে ‘পুনর্গঠনের সূচনা’ই করতে হয়, ‘গলনপাত্রের ওপারে’ করার কোনো অবকাশ নেই। তবে
‘মেল্টিং পট’ কথাটার মধ্যে একটা কাব্যিক ভাব আছে। বইটির যুগ্ম রচয়িতা নাথান
গ্লেজার এবং সেই ভারত-পরিচিত ড্যানিয়েল প্যাট্রিক ময়নিহান। বিংশ শতকের সত্তরের
দশকে নিউইয়র্ক মহানগরে বসবাসকারী সংখ্যালঘু যথা নিগ্রো, পুয়ের্তোরিকান, ইহুদি,
ইটালিয়ান এবং আইরিশ জনগোষ্ঠির সমস্যাবলী নিয়ে একটি সমাজশাস্ত্রীয় গবেষণা।
তবে এই বইটির প্রসঙ্গে আসার আগে উপরোক্ত দুটো উপন্যাসকে
পাশাপাশি রেখে দেখি কী কী দুটোতেই সমানভাবে পাওয়া যায়। প্রথমেই দেখা যায় এমেরিকান
শ্রমের প্রকৃতি। জাত চেনা যাকে বলে আর কি। লেখকদ্বয়ের তথ্যনিষ্ঠা শিক্ষণীয়।
দ্বিতীয় বিশেষত্ব হল বাস্তব ঘটনার চিত্রায়ণ। বাস্তব ঘটনার চিত্রায়ণ বলেই
তথ্যনিষ্ঠার প্রয়োজন অতটা বেশি ছিল। কিন্তু জানতে ইচ্ছে করে ১৯৭০এর দশকের এমেরিকায়
বাস্তব ঘটনার ওপর ভিত্তি করে আর কোন কোন উপন্যাস লেখা হয়েছিল এবং এটা কোনো ঝোঁক
ছিল কিনা সেই দশকের। আর, যদি ছিল তবে কেন ছিল। বিংশ শতাব্দীর সত্তরের দশক
আন্তর্জাতিক স্তরে একটি বিশেষ দশক, তাই জানতে চাই। তৃতীয় বিশেষত্ব হল
রাষ্ট্রযুক্তি। যদিও দুটো উপন্যাসের কাল এবং পাত্র ভিন্ন, স্থান কিন্তু একটাই –
এমেরিকা। অথবা ঘুরিয়ে বললে, স্থান আলাদা হলেও কাল কিন্তু একটাই –এমেরিকা। এলেক্স
হ্যালির উপন্যাসের বিষয়টাই এমন যে ইতিহাসের বিশাল প্রবাহে তিনি একটি তন্বী
স্রোতস্বিনীর পরিচয় খুঁজতে খুঁজতে এগিয়েছেন। আবার সেই পরিচয়েই চিহ্নিত করেছেন
ইতিহাসের প্রবাহটিকে। শতাব্দীব্যাপী এক পারিবারিক দিনপঞ্জী। শিকড় থেকে শুরু করে
প্রধান কান্ডটিকে আকাশের দিকে এগিয়ে দিতে গিয়ে নির্মম হাতে বাদ দিয়েছেন গোড়ার
দিকের ডালপালার বিস্তার। কুন্টা বন্দী হওয়ার পর তার বাবা-মা ওমোরো আর বিন্তার কী
হল? উপন্যাসে নেই। মালিক তাদের মেয়ে কিজ্জীকে বিক্রি করে দেওয়ার পর কুন্টা ও বেলের
কী হল? উপন্যাসে নেই। ... কাব্যধর্মী এই উপন্যাসের শেষ একটি গূঢ় নীতিবাক্য বা
বাকধারা দিয়ে – ‘জয়ীরাই ইতিহাস লেখে’।
কাদের জয়? কাদের ওপর? কালোদের জয়? সাদাদের ওপর? আফ্রিকার
জয়? এমেরিকার ওপর? কোনোটাই না। মুক্তিসংগ্রামের জয়? দাসপ্রথার ওপর? অবশ্যই। কিন্তু
আরো কিছু। ভালোবাসার জয়। ঘৃণার ওপর। আর একটি দৃষ্টিভঙ্গীর জয় – এমেরিকা আমাদেরও,
ঠিক ততটাই যতটা তোমাদের। মাটিতে রক্ত ঝরিয়ে, ফসল ফলিয়ে সেই অধিকার আমরা অর্জন
করেছি। এই বহুবর্ণী এমেরিকাকে অস্বীকার করতে চেও না, কুক্ষিগত করতে চেও না,
নিজেরাই শেষ হয়ে যাবে।
নর্মান মেলার স্টাইলের দিক দিয়ে বেশি আধুনিকতাবাদী।
কাব্যধর্মীতা, নীতিবাক্য ইত্যাদি নেই; কাটাকাটা ভাষা। বিষয়টাও অন্যরকম। যেন ১৯৭৬
সালের এমেরিকার সমাজজীবনের অনুপ্রস্থফলক। কিন্তু নামটা লক্ষ্য করেছেন? ঘাতকের গান।
কে ঘাতক? জেলার? ভাড়াটে ঘাতকেরা? প্রোভোর জেল? উটার কোর্ট? পূর্বদিক থেকে উড়ে আসা
মিডিয়াতারকারা, যারা গ্যারির মৃত্যুটাকে লোভনীয় পণ্যসামগ্রী করে তুলছিল? নাকি পুরো
সমাজজীবনটাই – ঘাতক ঔদাসীন্যে, ঘাতক শাসনতন্ত্রে এবং ঘাতক পণ্যমন্ত্রে পর্যবসিত?
সুইডিশ চলচ্চিত্র পরিচালক ইংগমার বার্গম্যানের একটা
ফিল্ম দেখেছিলাম, ‘ফ্যানি অ্যান্ড এলেকজান্ডার’। দুই শিশু ভাইবোন। শৈশব কাটছিল
আমাদের সাধারণ পৌত্তলিক হিন্দু সমাজের মত সবকিছু মানিয়ে হাসিখুশি চলা এক ক্যাথলিক
পরিবেশে। সেখানে মজার খুড়ো জোরদার পাদে মোমবাতি নিভিয়ে দেয়, আবার বাবা-মা যখন তখন
কাপড় নামিয়ে যৌন-আদর শুরু করে দেয়। শুধু হুল্লোড়েই বাচ্চাদুটোর বারোটা বাজছে দেখে
তাদের পাঠিয়ে দেওয়া হল তাদের গভর্নেসের প্রটেস্ট্যান্ট পরিবারে (আমাদের ব্রাহ্ম
পরিবারের মত কী?)। সেখানে কঠোর নিয়মতন্ত্র এবং হিমশীতল আধ্যাত্মিকতা। বাচ্চাদুটো
পাগল হয় বলে এবার। ... শেষ একটা চার্চ থেকে, ক্রিসমাসের প্রার্থনার পর বেরিয়ে আসা
মানুষজনের সঙ্গে তারাও বেরুচ্ছে। নানাজনের মুখে নানারকম সৌজন্যবিনিময়। ওদের
দুজনের, একে অন্যের সঙ্গে ফিসফিসিয়ে আশ্রাব্য অশ্লীল গালিগালাজের বিনিময়। ওদের নীট
শিক্ষাপ্রাপ্তি ওইটুকুই।
নর্মান মেলারের উপন্যাসের মর্মন সমাজ ও উটার শাসনতন্ত্র
যেন ওই প্রটেস্ট্যান্ট পরিবেশ। তথানামিত ‘পশ্চিমা কন্ঠস্বর’। আর নিউইয়র্ক থেকে
ধেয়ে আসা মিডিয়া আর মানবাধিকার যেন ওই ক্যাথলিক পরিবেশ – ‘পূরবিয়া কন্ঠস্বর’।
নীটফল অপরাধ-মনস্কতা, উন্মাদ-অবস্থা, ড্রাগ্স, যৌন-আধিক্য আর হিংসা।
দুটো উপন্যাসের একটিতে জর্জ ওয়াশিংটনের সময় থেকে
আব্রাহাম লিঙ্কনের সময়, আবার সেখান থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময় অব্দি
ইতিহাস প্রসঙ্গ রয়েছে। কালো এলেক্স হ্যালি এমেরিকার কোস্টগার্ডের চাকরী থেকে অবসর
নিচ্ছেন। তাঁর বাবার নামে রাস্তা আছে এমেরিকার মাটিতে। বহুবর্ণী, বহুধর্মী
এমেরিকান জাতি যেন পুরোপুরি প্রস্ফুটিত হয়ে উঠেছে।
যে বই থেকে এই অংশের উপশীর্ষকটা (বিয়ন্ড দ্য মেল্টিং পট)
ধার নিয়েছি সে বইয়ের ৩১৩ সংখ্যক পৃষ্ঠায় একটি উদ্ধৃতি পাচ্ছি। ১৯০৪ সালে প্রকাশিত
‘এক এমেরিকান কৃষকের পত্রাবলী’ নামক বইয়ে জনৈক মিশেল-গিলেম জাঁ দ্য ক্রেভাকুর
স্বপ্ন দেখেছিলেন যে এমেরিকার বিভিন্ন ধার্মিক ও জাতীয় পরিচয়গুলি মিশ্র-প্রতিবেশ ও
বিবাহের মাধ্যমে গলে গিয়ে এক হয়ে যাচ্ছে।
“এই মিশ্র-প্রতিবেশ এক অদ্ভুত ধার্মিক খিচুড়ি দেখাবে যা
না বিশুদ্ধ ক্যাথলিসিজম থাকবে না বিশুদ্ধ ক্যালভিনিজম। এমনকি প্রথম প্রজন্মেই
লক্ষণীয় ঔদাসীন্য দেখা যাবে; এবং হতেই পারে যে এক ক্যাথলিকের মেয়ে অপসৃত [ক্যাথলিক
মত থেকে] একজনের ছেলেকে বিয়ে করবে এবং নিজের বাবামায়েদের থেকে দূরত্ব রেখে বসবাস
করবে। তাদের সন্তানদের তারা কী ধর্মশিক্ষা দেবে? ত্রুটিপূর্ণ কিছু একটা! যদি
আশেপাশে কোনো উপাসনা-স্থান থাকে, আমরা ধরে নেব বন্ধুসভার [কোয়্যাকার] বৈঠক, নিজেদের
ভালো জামাকাপড় না দেখিয়ে তারা বরং ওইখানেই যাবে, কেউ কেউ নিজেকে যুক্তও করবে ওই
সমাজের সাথে। অন্যেরা খাঁটি উদাসীন থাকবে। ...
“এভাবে সব মত ও জাতি মিশ্রিত হচ্ছে, ধার্মিক ঔদাসীন্য
অগোচরে ছড়িয়ে পড়ছে মহাদেশের এক কোণ থেকে আরেক কোণে; আজকের দিনে এটাই এমেরিকানদের
প্রবলতম বৈশিষ্ট।”
এই বৈশিষ্ট ক্রুভাকুরের সময় দৃষ্টিগোচর হলেও বিংশ
শতাব্দীর সত্তরের দশকের এমেরিকায় এর উল্টোটাই ঘটছে। ‘বিয়ন্ড দ্য মেল্টিং পট’ বইটার
লেখক দুজন দেখছেন ধর্মমত ও পন্থাগুলি দানা বেঁধে উঠছে আরো বেশি। দুই মতের পরিবারে
বিয়ে হলে দুটো মতই দুর্বল হবে এই কথাটা মিথ্যা প্রমাণিত করে স্থানপ্রধান মতটির
মানুষ বেড়ে উঠছে।
আর বর্ণের তো কথাই নেই। লেখকদ্বয় বলছেন, “বেশির ভাগ
জাতিগোষ্ঠির [এথনিক গ্রুপ] বিশিষ্ট জাতীয় [ন্যাশন্যাল] দিকগুলোর কোনো গুরুত্বপূর্ণ
চিহ্ন, তৃতীয় প্রজন্ম অব্দি প্রায়শঃ বেঁচে থাকে না। যদি না রঙের প্রশ্ন থাকে। এটাই
সাধারণ নিয়ম।” অর্থাৎ রঙের প্রশ্ন থাকে। আর যদি সমাজটা ‘ঘাতকের গান’এর সমাজ হয়?
১৯৬০-৭০এর এমেরিকায় নাগরিক অধিকারের আন্দোলন,
বর্ণবৈষম্য, দাঙ্গা, প্রতিবাদ, কৃষ্ণাঙ্গচেতনা ইত্যাদির ইতিহাস সর্ববিদিত।
ম্যাককার্থিজম ও কম্যুনিস্ট-শিকারের ইতিহাসও সবাই জানে। কিন্তু, একটা অন্য প্রশ্ন
ভাবায়। শতাব্দীর শুরুতেই আমেরিকান সমাজের উঠতি স্পন্দিত গণতন্ত্র একচেটিয়া পূঁজির
আধিপত্যে ও সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হচ্ছিল। জন দস পাসসের ট্রিলজিতে
সমাজের ভিতরমহলে এই পরিবর্তনের প্রভাবটা ধরা আছে। মিশেল-গিলেম জাঁ দ্য ক্রেভাকুর
যে সমাজের স্বপ্ন দেখেছিলেন, তা থেকে ‘বিয়ন্ড দ্য মেল্টিং পট’এ বিধৃত পরিস্থিতি
অব্দি আমেরিকান সমাজের অধোমুখী যাত্রা কি রাষ্ট্রশক্তির চরিত্রবদল-জনিত? একচেটিয়া
ও পরে বহুরাষ্ট্রিক-পূজির আধিপত্য জনিত?
এখন কী অবস্থায় আছে এমেরিকান জাতির মিলনপ্রক্রিয়া?
এমেরিকার সমাজ সম্পর্কে আমার কোনো প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নেই।
ঔৎসুক্য অবশ্যই আছে। এমেরিকান রাষ্ট্রশক্তির আগ্রাসননীতি, এমেরিকান সাম্রাজ্যবাদের
হামলা ইত্যাদির বিরুদ্ধে পথে নামি মাঝে মধ্যেই। কিন্তু দেশটা তো প্রিয়! ওয়াল্ট
হুইটম্যানের দেশ, জ্যাক লন্ডনের দেশ, ল্যাংস্টন হিউজ ও পল রবসনের দেশ এমেরিকা।
এমেরিকার শ্রমশক্তির ওপর শ্রদ্ধা লেনিনই তৈরি করে দিয়ে গেছেন। তাই একটু আগের
আলোচনার সুত্র ধরে দুটো হাইপথেটিক্যাল মন্তব্য করার দুঃসাহস করে লেখাটা শেষ করতে
চাই।
প্রথমতঃ এমেরিকান গণতন্ত্রে, সমাজে সাম্রাজ্যবাদের
স্বীকৃতি, ‘ন্যায়সঙ্গতি’ (ওই পাসসের ট্রিলজির নাম অনুসারে ‘১৯১৯’এর এমেরিকার
‘ফর্টিসেকেন্ড প্যারালাল’ ধরে ‘বিগ মানি’র আমেরিকা হয়ে ওঠা) ধর্ম, জাতি ও
বর্ণবৈষম্য ঘুচিয়ে এমেরিকান জাতি হয়ে ওঠার মহামিলন প্রক্রিয়া কে স্তিমিত ও অবরূদ্ধ
করে রেখেছে। এমনকি সংকটের দশকগুলোতে বিপরীতমুখীন করে বাড়িয়ে তুলেছে বর্ণ, জাতি ও
ধর্মভিত্তিক গোষ্ঠী ও ‘ভোটব্লক’ নির্মাণপ্রক্রিয়া। বারাক ওবামা আজ রাষ্ট্রপতি।
তবুও মনে হয় আমি ভূল বলছি না। কেননা নতুন অর্থনীতির ‘গ্রেট কন্সেন্সাস’টা যে
সামাজিক ভুগোলে সীমিত, দূর থেকে সব দেশেরই ওই কস্মোপলিটান অংশটাই আগে ফোকাসে আসে।
দ্বিতীয়তঃ, এমেরিকার ‘অতীত’ নেই এটা যেমন ওই দেশটার
শক্তির উৎস, এমেরিকা ‘অতীত’কে যে হত্যা করেছে তার অভিশাপ ভিতরে দুর্বলতাও ছড়িয়ে
রেখেছে। বিপজ্জনক ধাঁধা মনে হচ্ছে কি?
এই যে আমাদের দেশে প্রবণতা আছে অতীতচর্চার, প্রাচীন
যুগের সোনার থালা ধুয়ে জল খাওয়ার... এটা একটা বোঝা। সৃজনী-উদ্ভাবনী চ্যালেঞ্জ
স্বীকার করার গতি শ্লথ করে দেয়। এমেরিকা আড়াইশো বছরের আগে নেই। কিছুই নেই। বিভিন্ন
দেশের মানুষ, বিভিন্ন পরিস্থিতিতে এসে এমেরিকাকে তৈরি করেছে। তাই তাদের
সৃজনী-উদ্ভাবনী চ্যালেঞ্জ নিয়ে খেলা করার প্রবণতা বিস্ময়কর। (হঠাৎই মাথায় খেলে
গেল- বরেন বসুর ‘রঙরূট’ উপন্যাসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন উত্তরবঙ্গে এমেরিকান
সৈন্যের প্রবেশ এবং ব্রিটিশদের থেকে তাদের এ্যাটিচুডের তফাৎ - লেখকের মন্তব্য;
সেটা ওই গণতান্ত্রিক সমাজের প্রতিফলন)
কিন্তু এটা অর্ধসত্য। আরেকটা দিক হল যে ওই মাটির একটা
অতীত ছিল। অত্যন্ত মানবিকসম্পদশালী অতীত। লালমানুষদের অতীত। পরবর্ত্তী এমেরিকা,
ব্রিটিশ উপনিবেশ এমেরিকা, ধনতান্ত্রিক এমেরিকা, সাম্রাজ্যবাদী এমেরিকা সেই অতীতকে
হত্যা করেছে। ধ্বংস করেছে, হাজার হাজার মানুষকে সংহারের লীলা চালিয়েছে শতাব্দীকাল
ধরে।
তার অভিশাপ যেন ‘ঘাতকের গান’এর ছত্রে ছত্রে দেখা যায়। কী
নিদারূণ আত্মিক অবলম্বনহীনতা। কী ভয়াবহ শূণ্যতা। একজন ভালো ধার্মিকও নেই সমাজে।
আবার একজন ভালো অধার্মিকও নেই। দর্শনচিন্তার জায়গায় পৌঁছোলেই মানুষগুলোর কথাবার্তা
কী অদ্ভুত ফাঁপা আর করুণ হয়ে পড়ছে। পণ্যদেবতার অধিষ্ঠানের যেন আদর্শ বেদীমূল!
*২০১১
সাল, অর্থাৎ এই লেখাটার রচনাকাল থেকে ৩৩ বছর আগে।
সংযোজন
যখন লেখাটা তৈরি করেছিলাম তখন
যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি ছিলেন বারাক ওবামা। গত বছর জিতলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম রাষ্ট্রপতি যিনি জনতার ভোটে পরাজিত হলেও নির্বাচক ভোটে
জয়ী ঘোষিত হয়েছেন। যিনি জনতার ভোট বেশি পেয়েছিলেন সেই হিলারি ক্লিন্টনও এমন কিছু
জনপ্রিয় ছিলেন না। কিন্তু এসবের নীচের স্তরে, যে সামাজিক সমীকরণটা ক্রিয়াশীল ছিল
তার ইংগিত দেয় বিবিসির এই পরিসংখ্যানঃ-
সাদা মানুষের ভোট ৫৮% পেয়েছিল রিপাব্লিকান
পার্টি, ৩৭% পেয়েছিল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি। যখন নাকি হিস্প্যানিক ও এশিয়ান ভোট ২৯%
গিয়েছিল রিপাব্লিকানদের দিকে এবং ৬৫% গিয়েছিল ডেমোক্র্যাটদের দিকে। আর কালো
মানুষের ভোট? মাত্র ৮% ছিল রিপাব্লিকানদের দিকে, ৮৮% ডেমোক্র্যাটদের দিকে; যখন
নাকি হিলারিও সাদা। নারীদেরও সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ডেমোক্র্যাটদের ভোট দিয়েছিল।
নানা কারণ আছে এই বিভাজনের। কিন্তু
‘গলনপাত্রে’ ধাতুর রঙ যে মিশ খায়নি, তা তো স্পষ্ট। এই মুহূর্তে রাজ্যগত
পরিসংখ্যানটা হাতে নেই, কিন্তু মনে আছে। যে রাজ্যে কালো মানুষের সংখ্যা কম সেখানে
রিপাব্লিকান সমর্থন, ইংরেজিতে যাকে বলে প্রিডমিনেটিং।
ªªªªª
No comments:
Post a Comment