Sunday, November 19, 2017

ঔপনিবেশিক সংস্কৃতির উচ্ছেদঃ দুর্নীতি, সাম্প্রদায়িকতা এবং জাত-পাত

ঔপনিবেশিক সংস্কৃতির উচ্ছেদ শুরু হয় ঔপনিবেশিক শাসনের অমান্য ও বিরুদ্ধাচরণ দিয়ে। সেটাই ভারতের আধুনিক ইতিহাস এবং আধুনিক হয়ে ওঠার ইতিহাস। যুগটি শেষ হয়নি, চলছে।
দুর্নীতি, সাম্প্রদায়িকতা এবং জাত-পাতের উচ্ছেদ সেই সর্বাত্মক উচ্ছেদ-প্রয়াসেরই অঙ্গ। কিন্তু প্রশ্ন ওঠে, ওই তিনটের জন্ম কি ঔপনিবেশিক যুগে হয়েছে? না, তা হয় নি। আগে থেকে ছিল। শ্রেণী-শাসনের স্বার্থে তিনটেরই জন্ম। ঔপনিবেশিক শাসক তিনটেকেই হাওয়া দিয়েছে, বাড়িয়েছে আর নিজের কাজে লাগিয়েছে। ছিল বলেই কাজে লাগাতে পেরেছে; যত দিন থাকবে কাজে লাগাবে।আবার এটাও এক বিচিত্র পরিহাস যে ঔপনিবেশিক শাসনের অমান্য ও বিরুদ্ধাচরণের একেবারে প্রাথমিক পর্যায়েও, কিছু অমান্য ও কিছু বিরুদ্ধাচরণের মূল কারণ এবং চারিত্রিক বৈশিষ্টই ছিল ওই তিনটি বা ওই তিনটের যে কোনো একটি। আগে থেকেই সামন্তবাদী সংস্কৃতিতে প্রতিপালিত দুর্নীতিগ্রস্ত কেউ, দুর্নীতিজনিত অর্থলাভ সন্তোষজনক না হওয়ায় অসন্তুষ্ট হয়েছে এবং বিরুদ্ধাচরণ করেছে। আগে থেকেই সাম্প্রদায়িকমনস্ক কেউ, ঔপনিবেশিক শাসনের উপস্থিত প্রতিনিধিকুলকে বিধর্মী বলে চিহ্নিত করে সাম্প্রদায়িক বিরুদ্ধাচরণ করেছে। আগে থেকেই জাত-পাত করা মাথা বিষিয়ে উঠেছে ওই একই ভাবে।
খুবই সম্ভব। ইতিহাসের এই ধরণের প্যারাডক্সের সমাধান তাত্ত্বিক বিতর্কে হয়না। হয় ইতিহাসেরই অগ্রগমনে। স্বাধীনতা সংগ্রামের পরবর্তী পর্যায়গুলোয় ওই ধরণের বিরুদ্ধাচরণকারীরা হয় এগিয়ে গেছে, নিজেদের মুক্ত করেছে ওই বৈশিষ্টগুলোর দুষ্প্রভাব থেকে, শামিল হয়েছে যথার্থ বিরুদ্ধাচরণের সামুহিক অভিব্যক্তিতে, নয়তো ফিরে গেছে পিছনে, ঔপনিবেশিক শাসনের সাথে সমঝোতা করে আখের গুছিয়েছে নিজেদের।
এই প্রক্রিয়াটাই অনুধাবনীয়। কেননা, যেমন বললাম - যুগটি শেষ হয়নি, চলছে। এবং, এরই মধ্যে ঔপনিবেশিকতার উচ্ছেদের প্রতর্কে গুরুত্বপূর্ণ ভাবধারাগত জায়গা করে নিয়েছে বামপন্থী শক্তিরা, যারা শ্রেণী-শাসনের উচ্ছেদের সংগ্রাম করে আর তাই, দুর্নীতি, সাম্প্রদায়িকতা ও জাতপাতকে সম্পূর্ণ নির্মূল করার সম্ভাবনাকে শ্রেণী-শাসনের উচ্ছেদ ও সমাজবাদ প্রতিষ্ঠার সাথে যোগ করে।   
কিন্তু এই কথাগুলো বলছি সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ও সমাজবাদী ব্যবস্থার দুর্বল হওয়ার সাতাশ বছর পর। এই মুহূর্তে সারা বিশ্বেই দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক শক্তির বোলবালা। আমাদের দেশেও রাজনৈতিক শাসন সেই সব শক্তিদের হাতে যারা প্রথম থেকেই সর্বাত্মক উচ্ছেদ-প্রয়াসের বিরোধী। আর তাদেরই কাঁধে ভর দিয়ে এসে গেছে পুনঃঔপনিবেশিকরণ বা নবঔপনিবেশিকরণ।

প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে এই তিনটে প্রবৃত্তির অন্তর্সম্পর্কের দিকগুলো নিয়ে আরো একটা কথা না বলে পারছিনা। একজন দুর্নীতিপরায়ণ মানুষকে নিজের ভিতরের বিশ্বাস থেকে না হোক বাইরের পরিচয়ে একজন সাম্প্রদায়িক বা জাতবিচার করে চলা মানুষ হতেই হবে। শাসনে-প্রশাসনে নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে একটা লাইন-আপ তার প্রয়োজন। আবার একজন সাম্প্রদায়িক মানুষ বা জাতবিচার করে চলা মানুষ দুর্নীতিপরায়ণ নাও হতে পারে। কিন্তু ব্যক্তিগত বিশ্বাসের স্তর থেকে বেরিয়ে যেই দুজনে রাজনীতির আঙিনায় প্রবেশ করবে তাদেরকে দুর্নীতিপরায়ণ মানুষের সাথে শুধু সহাবস্থানই নয়, সায় দিয়ে, সংরক্ষণ দিয়ে চলতে হবে। এবং সামাজিক সহাবস্থান এবং পারস্পরিক সংরক্ষণের এই ভিত্তিতে যখন তারা রাজনৈতিক শক্তি বাড়িয়ে তোলার প্রশ্নের মুখোমুখি হবে তখন শুরু হবে মেধাগত দুর্নীতির খেলা। ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নিজেদের দৃষ্টিকে ন্যায়সঙ্গত ঠাউরাতে তারা নিজেদের মত করে পুনর্গঠন করার চেষ্টা করবে অতীত, গুজবে সাজাবে বর্তমান।

১৯৯১এর পর থেকে গত ২৬ বছরে ভারতের অর্থনীতিতে যা কিছু ঘটছে তাতে সবচেয়ে বেশি লাভবান হচ্ছে বিদেশী ও দেশী একচেটিয়া পূঁজি, আর সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শ্রমিক ও কৃষকেরা। এবং কে বেশি লাভবান হচ্ছে বা কে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সে প্রশ্নটা হয়তো মুলতুবিও রাখা যেত যদি প্রমাণিত হত যেঃ-
১। স্বাধীনতার পর ধাপে ধাপে চালু হওয়া আর্থিক নীতিসমূহের সফলতা (তার বিবিধ নামকরণে আমি যাচ্ছিনা) বিশ শতকের নব্বইয়ের দশকের শেষ নাগাদ একটি যুক্তিসঙ্গত পরিণতিতে পৌঁছে গিয়েছিল অথবা তাদের সম্পূর্ণ বিফলতা শেষ বারের মত প্রমাণিত হয়ে গিয়েছিল;
২। ১৯৯১ সালে শুরু করা আর্থিক নীতিগুলি সত্যিই একান্ত প্রয়োজনীয় ছিল কেননা এই পথেই আর্থিক উন্নয়নের পরবর্তী পর্ব সম্ভাবিত ছিল; মানে এই মুহুর্তে কারো লাভ বেশি হলেও বা কারো ক্ষতি বেশি হলেও দীর্ঘসুত্রে প্রস্তাবিত ছিল যে জনগণেরই লাভ হবে এই নীতিগুলো চালু হলে;
৩। অথবা, সোভিয়েত রাশিয়ার বিপর্যয়ের পর যে একমেরুর দুনিয়া তৈরি হল তাতে সরকার নিরুপায় হয়ে পড়েছিল; তাদের সামনে ‘এছাড়া আর কোনো বিকল্প ছিল না’।

তিনটের একটারও সত্যতা প্রমাণ করতে পারেনি ভারতের শাসকশ্রেণী।
প্রথমটির দ্বিতীয় প্রস্তাব অর্থাৎ ‘সম্পূর্ণ বিফলতা’ সম্পর্কে ১৯৯০-৯২ সালেই হঠাৎ জ্ঞানোদয় হয়েছিল কিছু স্বনামধন্য স্বঘোষিত তাত্ত্বিকের । তারা বেশ কিছু বইটইও লিখেছিলো । শেষে দেখলো যাদের মুখ চেয়ে লেখা তারাই বিশেষ পাত্তা দিচ্ছে না আইডিয়াগুলোকে । ইদানিং নরেন্দ্র মোদি আইডিয়াটা ধরেছিলেন । ‘কিচ্ছু হয়নি সাড়ে ছেষট্টি বছরে । যা কিছু করার, তিনিই করেছেন ।’ এখন তিনিও খুব বেশি হাততালি অথবা ‘মোদি-মোদি’ কুড়োতে পারেন না কথাটায়।    
দ্বিতীয় প্রস্তাবটা সরকার বেশ কিছুদিন আউড়ে ছিল, ট্রিক্ল্‌ডাউন তত্ত্ব তারই নির্যাস – মোটামুটি ২০০৪এর পর থেকে, আওড়ানো না ছাড়লেও গুরুগম্ভীর বিষন্ন স্বরে যোগ করছে, ‘শুধু ওতে হবে না, আরো কিছু চাই’, বিশ্বায়নের মানবিক মুখ’। যেমন দেশের বর্তমান রাষ্ট্রপতি সিংহাসনারূঢ় হওয়ার সময় বলেছিলেন । নতুন সরকার আর বলেনা। ১৯শে মে, ২০১৪র বিকেলে ‘টাইমস নাউ’এর তৎকালীন বিখ্যাত গর্জক (যাঁরা বর্তমান সরকারের হয়ে চ্যানেলে সবার সাথে তর্জন-গর্জন করেন) চেঁচিয়ে বলেছিলেন, ‘এন্টাইটেলমেন্টের দিন শেষ হল, এম্পাওয়ারমেন্টের দিন এল’। অর্থাৎ তথাকথিত ‘মানবিক মুখ’ খতম । আর এম্পাওয়ারমেন্ট জনতার কোনো অংশের না হলেও গেরুয়া রেজিমেন্টগুলোর খুব হল এবং এখনও হচ্ছে।
তৃতীয় প্রস্তাবটাই এখন আঁকড়ে ধরার শেষ তাত্ত্বিক খড়কুটো। কিন্তু তত্ত্বটা যে মূলতঃ মিথ্যে সেটার সবচেয়ে বড় প্রমাণ তো সরকারের নিজেরই নীতিসমূহের সেই অংশ যা ২০০৪এ ওই ‘মানবিক মুখ’ হিসেবে চালু হল এবং যার কল্যাণে কিছু নীতি, কিছু ‘ফ্ল্যাগশিপ প্রোজেক্ট’ বিগত কিছু বছর ধরে গ্রামীণ ও শহরী দরিদ্র পরিবারে আয় সৃজনের জন্য এবং জাতীয় আয় পুনর্বিতরণের জন্য চালু করা হচ্ছে! আর ব্যালেন্স অফ পেমেন্টস এর সংকটের সত্যতা যদি তত্ত্ব হিসেবে খাড়া করতেও চায় তারা, তার কারণ তো রাজীব গান্ধী সরকারের সময়কার নীতিবদল -- খোলাবাজার থেকে মহার্ঘ্য বিদেশি ঋণ নিতে বড় দেশি পূঁজিপতিদের হুড়োহুড়ি!

এখন মোটামুটি অনেকেই এটা দেখতে পাচ্ছে যে স্বাধীনতা-পরবর্তী অর্থনীতির ঝালে-ঝোলে-অম্বলে নামে-বেনামে চল্লিশ বছর ঈষৎ লো প্রোফাইলে থেকে ভারতের একচেটিয়া পূঁজি যে ধনশক্তি সংগ্রহ করেছিল (অর্থভেদে, চুরি করেছিল সরকারী উদ্যমগুলো থেকে) সেই ধনশক্তিই তাদের উৎসাহিত করলো এশিয়া-আফ্রিকা-দক্ষিণ আমেরিকার মাটিতে পা বাড়াবার কথা ভাবতে, আর পা বাড়াবার টিকিট পেতে হলে আমেরিকা-ইওরোপ-জাপানের পূঁজিকে ভারতের ধনসম্পদ দখল করার সুযোগ করে দেওয়াই ছিল একমাত্র পথ। সেটি করার শুভলগ্ন এনে দিল সোভিয়েত রাশিয়ার বিপর্যয়। এ ছাড়া আর কোনো কারণ, কোনো যুক্তি নেই ‘নবউদার’ অর্থনীতির পেছনে।

যাহাঁতক সেই রহস্যময় ‘উন্নয়ন’এর বর্মিবাক্স খুলে দেখা যায়, তথ্যপ্রযুক্তি বিপ্লবের ফলশ্রুতি হিসেবে সৃষ্ট শিল্প ও পরিষেবা ক্ষেত্রগুলো এবং এর প্রভাবে বেড়ে ওঠা আরো কিছু পরিষেবা ইত্যাদি বাদ দিলে উন্নয়নএর সেই বিশিষ্ট ‘উ’টারও দেখা পাওয়া যাবেনা, যা সাধারণভাবে বুর্জোয়া গভর্নেন্সের অঙ্গের – আবশ্যক পরিষেবা সৃষ্টি - গতিবেগ থেকে একরত্তিও বেশি! আর তথ্য প্রযুক্তি বিপ্লবের সাড়া ভারতে পৌঁছোনো কোনোভাবেই নব্য-অর্থনীতির অবদান নয়। তথাকথিত ও বহুনিন্দিত ‘লাইসেন্স-কোটা-পারমিট-রাজ’ থাকলেও তা পৌঁছতো । হয়তো ঘুষগুলো নিচে থেকে উপর অব্দি একটু ভাগ-বাঁটোয়ারা হত, সবটাই ওপরে যেত না। বরং তথ্যপ্রযুক্তি বিপ্লব নতুন অর্থনীতির ক্ষেত্রে (বা নতুন রাজনৈতিক-অর্থনীতির ক্ষেত্রে) বাহক-তরঙ্গের (ক্যারিয়ার ওয়েভ) কাজ করেছে।
একটা উদ্ধৃতিঃ-
“For almost all observers, East or West, the political events of the past several years have been stunning.… Observers and participants alike remark that telecommunications and the news media may have facilitated these events and are a new factor to be reckoned with in international political developments. ….increasingly acknowledged role of telecommunications and the information technologies in the transformation of world commerce and international affairs raises the question of whether the awesome power of the information revolution can be deliberately or even more effectively harnessed.”
– A Rand Note, Seizing the Moment: Harnessing the Information Technologies, Steve Bankes, Carl Builder, Rand 1992

ভারতের একচেটিয়া পূঁজির নিজের স্বার্থে ডেকে আনা এই পুনঃঔপনিবেশিকরণের কী প্রভাব তাহলে পড়লো ডিকলোনাইজেশন বা ঔপনিবেশিকতার উচ্ছেদের ঐতিহাসিক প্রকল্পের ওপর? বিশেষ করে, এখানে আলোচ্য সাংস্কৃতিক অসুস্থতার তিনটে প্রবৃত্তি, তিনটে বৈশিষ্ট – দুর্নীতি, সাম্প্রদায়িকতা এবং জাত-পাতের ওপর?

দুর্নীতি ।
দুর্নীতিমুক্ত শাসনব্যবস্থা এদেশে কোনোকালেই ছিলো না । কিন্তু স্বাধীনতাসংগ্রামে এদেশের মানুষ যে স্বপ্নগুলো নিয়ে শামিল হয়েছিলো তার একটি ছিলো স্বাধীনতার পর দেশে ওপরতলা থেকে নীচের তলা অব্দি দুর্নীতিমুক্ত শাসনব্যবস্থা ও প্রশাসন স্থাপিত হবে । অন্য অনেক স্বপ্নের মত এই স্বপ্নটিও পুরণ হলো না, বরং লোকে তাকিয়ে দেখলো, “ও বাবা, কালো সাহেবরা তো গোরাদের বাড়া !”
তবু ১৯৯১ সাল অব্দি দুর্নীতি প্রধানতঃ প্রশাসনের স্তরে ছিল আর শাসনব্যবস্থার নির্ধারিত আর্থিক নীতি অনুসারে কাজ করার ক্ষেত্রে ছিল । কোনো আর্থিক নীতির নির্ধারণটাই মূলতঃ দুর্নীতির ভিত্তিতে হচ্ছে, এই দৃষ্টান্ত খুব বড় মাপে দেখা দিল ১৯৯১এর পর । এবং সেটা বাড়তে লাগলো প্রতি বছর। যেমন একটা আইন ধরুন, কার্যকরী করার ক্ষেত্রে দুর্নীতি হওয়া এক ব্যাপার আর আইনটা বা তার জন্য তৈরি করা খসড়া বিলটাই দুর্নীতির উৎপত্তি হওয়া আরেক ব্যাপার । এই দ্বিতীয় প্রবৃত্তিটারই প্রতিফলন তো স্পেক্ট্রাম কেলেংকারি বা কয়লা কেলেঙ্কারি ! এবং কী বলা যায় – খুচরো ব্যবসায় বিদেশী লগ্নী থেকে শুরু করে নতুন পেনশনে বিদেশী লগ্নী, ব্যাঙ্কে বিদেশী লগ্নী, বীমায় বিদেশী লগ্নী সবই হয়তো তাই ! যে দিচ্ছে সে আমেরিকায় এবং যেখানে জমা হচ্ছে সেটা সুইজারল্যান্ডে ! একটা ভালো কামান কিনতে গিয়ে কিছু কিক-ব্যাক পাওয়া নিঃসন্দেহে ন্যক্কারজনক । কিন্তু প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত একটা এমন ভুল সিদ্ধান্ত করিয়ে নেওয়া যে এই এই বিশেষ স্পেসিফিকেশনের কামানটাই দেশের জন্য জরুরী, শুধু ন্যক্কারজনক নয়, বরফে ভেজা মোজা পরে অক্লান্ত দাঁড়িয়ে থাকা জওয়ানদের পিছন থেকে গুলি করে মারার শামিল । এই ধরণেরই ব্যাপার আজকাল বেশি ঘটছে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রালয়গুলোয়। নরেন্দ্র মোদি সরকার বিগত কংগ্রেস সরকারের অনেক কেলেঙ্কারির বিরুদ্ধে লড়াই দেখিয়ে আর লড়াইটাকে সাম্প্রদায়িক চেহারা দিয়ে ভোট পেয়েছিল। প্রভূত পরিমাণ অর্থ দিয়ে সাহায্য করেছিল একচেটিয়া পূঁজি, কেননা গুজরাতের অভিজ্ঞতায় নরেন্দ্র মোদির ভিতরে তারা নিজেদের সবচেয়ে বিশ্বস্ত দালাল খুঁজে পেয়েছিল। আর সেটাই হল। এসেই নিজের বিশ্বস্ততা প্রমাণ করতে পাইয়ে-দেওয়ার-দরজা খুলে দিল একচেটিয়া ও বড় পূঁজির জন্য, তাও এমন ক্ষেত্রে, প্রতিরক্ষা ও শস্ত্রনির্মাণের ক্ষেত্রে, যার কাল অব্দি বেসরকারি ক্ষেত্রে যাওয়া, বলতে গেলে নৈতিক ভাবে নিষিদ্ধ ছিল। ব্যাসেল কমিটির শংসায় ব্যাংকে শুরু হওয়া এনপি র কনসেপ্ট তো একটা হাতিয়ার হয়ে গেল – কর্জ নাও, এনপি হতে দাও, বাতিল কর্জ হবে, যদি কম্পানির ওপর দেউলিয়া ঘোষণা করার মামলা করতেই হয়, আগেই অন্য কম্পানি খুলে সাইফনিং করে নিও।       
পুরোনো ধরণের প্রশাসনিক দুর্নীতির তো কথাই নেই । আগে নীচের তলায় দিতে হত মালটা, নীচের তলা নিজেরটুকু রেখে বাকিটা সাহেবের দেরাজে রাখতো সন্ধ্যেবেলায় । এখন সাহেব সোজাসুজি নিজেই নেন – একটা ছোটো অংশ ‘মিষ্টি খাওয়ার জন্য’ নীচের তলায় পাঠিয়ে দেন । নীচের তলা যখন মুর্গী পায়, সেও রেট বাড়িয়ে দেয় তিনগুণ, “আগের সময় তো নেই দাদা, জানেনই ভিজিলেন্স ঘুরছে, হিউম্যান রাইট ঘুরছে, আরটিআই ঘুরছে !”
এমনকি জুডিশিয়ারীর ওপরতলা অব্দি আজ দুর্নীতি পৌঁছে গেছে ।
খোলাখুলি সাংসদ, বিধায়ক কেনাবেচাও চলছে। লবিইং এজেন্ট আগে বাইরে ব্রীফ কেস খুলে বসত! এখন দলের সভাপতি নিজেই সে কাজটা করছে।  
এখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন । কিছু দুর্নীতি আছে যা দেশকে নৈতিক ভাবে হয়তো প্রভাবিত করছে কিন্তু জনতার প্রত্যক্ষ ক্ষতিবৃদ্ধি কিছু হচ্ছে না । যেমন তিনটে একই স্তরের কোম্পানির একটি হয়তো একটু বেশি ঘুষের লোভ দেখিয়ে সরকারি স্তরে ক্লিয়ারেন্স পেয়ে যাচ্ছে বিদেশে বা নিজের দেশে কোনো প্রজেক্ট শুরু করার বা হাতে নেওয়ার।
কিন্তু দুর্নীতির একটা নতুন বিরাট ক্ষেত্র খুলে গেছে যা সোজাসুজি জনতাকে প্রভাবিত করছে। যে ক’টি সরকারি স্কীম আছে তার ক্রিয়ান্বয়নে সরকারি আমলা এমনকি পঞ্চায়েত স্তরে দুর্নীতি অব্দি সংবাদ মাধ্যমে বেশ চট করে উঠে আসে। কিন্তু সেই সব এবং আরো কিছু অন্যান্য স্কীমগুলোর ক্রিয়ান্বয়নে সাহায্য করতে যে এনজিওগুলো বহাল করেছে নিজেদের তাদের ভিতরের দুর্নীতির – সরকারি এবং দেশি বিদেশি ফান্ডিংএর টাকার অন্যদিকে চলে যাওয়ার – কোনো হিসেব আমরা পাইনা । আবার এদেরই মাধ্যমে বেশির ভাগ কোম্পানি তাদের তথাকথিত ‘কর্পোরেট সোশ্যাল রেস্পন্সিবিলিটি’র কোটা পুরো করে ।
বামপন্থীরা বলি ‘কোরাপশন বাই ডিফল্ট’ – ভাই, পূঁজিবাদ থাকবে আর দুর্নীতি থাকবেনা তা হতে পারেনা । বিরোধটা পূঁজিবাদের করুন, উন্নয়নের এই গণবিরোধী মডেলের করুন ! আজ শাসকশ্রেণীর বক্তব্যটাও উল্টোভাবে প্রায় একরকম, ‘নিশ্চই! আমরাও তো তাই বলি – উন্নয়ন ! উন্নয়নের এই মডেলটার লাভ বুঝুন, সমর্থন দিন ! দুর্নীতি তো দূর হয়েই যাবে – একটু সময় লাগছে, এই যা !’ আর সত্যিই তো, উন্নয়নের এই মডেলটাকে বেশ ভালোভাবে খাইয়েছে মানুষকে আমাদের মিডিয়া ! আর নাগরিক সমাজের আত্মিক শুদ্ধিকরণের জন্য আন্না হাজারে সাহেব তো আছেনই !

সাম্প্রদায়িকতা।
দাঙ্গা, বিভীষিকাময় ভ্রাতৃসংহারের মধ্যে দিয়েই বিভাজিত হয়ে স্বাধীন হল এই দেশ । দাঙ্গা মাঝে মধ্যেই হয়েছে তারপর। হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার পাশাপাশি ১৯৮৪সালের শিখবিরোধী দাঙ্গাও দেখলো দেশের মানুষ । মন্দির-মসজিদ ভাঙার খেলাও নতুন নয়। স্বাধীনতার পর স্থানীয় স্তরে হয়তো অনেক জায়গায় হয়েছে । কিন্তু ১৯৯২ সালের ছয়ই ডিসেম্বর বাবরি মসজিদের ধ্বংস অনেকগুলো বার্তা বয়ে নিয়ে এল ।
১। যেটি ভাঙা হল সেটি আর্কিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া কর্ত্তৃক ঘোষিত সংরক্ষিত মনুমেন্ট ছিল। অর্থাৎ বার্তা দেওয়া হল যে ইতিহাসের বিকৃতিকরণ শুধু বইয়ে সীমিত থাকবেনা, প্রয়োজনে যে কোনো জাতীয় স্মৃতিসৌধকে গুঁড়িয়ে দেওয়া যাবে ।
২। হিন্দুসমাজের বিরাট সংখ্যক ‘নীচু’জাতের মানুষ যারা এক সময় জাতগত উৎপীড়নে বাধ্য হয়ে ধর্ম পরিবর্তন করেছিল তাদের বার্তা দেওয়া হল, যতই জাত-ভিত্তিক উৎপীড়ন হয়ে থাকুক, ধর্ম যখন পাল্টেছ, তোমাদের আমরা বাবরের সন্তান বলেই অভিহিত করব; আর সেই উদ্দেশেই ঘটনাটি ঘটানো হল ছয়ই ডিসেম্বর, ডঃ আম্বেদকরের প্রয়াণদিবসে ।
৩। ধ্বংসটা করা হল জনসমক্ষে, মিডিয়ার একটা বড় অংশের পরোক্ষ সমর্থনে; দশ দিন আগে দিল্লীতে যে কয়েক লক্ষ শ্রমিকের বিরাট সমাবেশ হয়েছিল তার প্রতি মিডিয়ার ঔদাসিন্যের প্রতিযুক্তি হিসেবে সাজিয়ে ।
৪। প্রধানমন্ত্রী চুপ থাকলেন, দুটো সার্ভেলেন্স হেলিকপ্টারও পাঠালেন না, যেটা এমনকি এমত পরিস্থিতিতে ইংরেজ সরকারও নিয়মমাফিক পাঠাতো – তিনি নিশ্চিত জানতেন যে দুটো সার্ভেলেন্স হেলিকপ্টার ঘটনাস্থলের মাথার ওপর কিছুক্ষণ স্থির হয়ে থাকলেই ৮০ প্রতিশত কারসেবক মসজিদের মাথা থেকে নীচে নেমে পড়তো । অর্থাৎ তিনি জানালেন যে নব্যঅর্থনীতির প্রতি সমর্থন জারি রাখলে পূঁজির স্বার্থের সাথে এই হিংসাত্মক হিন্দুত্ববাদের কোনো বিরোধ নেই ।
লক্ষ্যণীয় যে পরবর্তী বোমা বিস্ফোরণ, দাঙ্গা, মুসলিম উগ্রপন্থী কার্যকলাপ ইত্যাদি নিয়ে মুম্বাইয়ে বেশ কিছু ফিল্ম তৈরি হলেও মসজিদ-ধ্বংস নিয়ে একটাও ফিল্ম তৈরি হয়নি।
আর তারপর তো ২০০২ সালে ভারতে প্রথম সরকার বা স্টেট প্রযোজিত ধর্মভিত্তিক গণসংহার সংঘটিত হলো । যিনি তাতে নেতৃত্ব দিলেন তিনি আজ দেশের প্রধানমন্ত্রী! তাঁর সার্টিফিকেট? না, গণসংহারে তাঁর কোনো হাত ছিলো না, এটা প্রমাণ করা মিডিয়ার মাথাব্যথা নয়। থাকলে থাকতেও পারে, কিন্তু তিনি চলতি ‘উন্নয়নী’ অর্থনীতির সবচেয়ে কঠিনহস্ত প্রয়োগকারী, এটুকুই যথেষ্ট। আর তাই আজ কখনো ‘লাভ-জেহাদ’এর নামে, কখনো গোরক্ষার নামে মুসলমান পীড়ন, মুসলমান নিধন হয়েই চলেছে। এমন প্রধানমন্ত্রী যার মুখে একটু দুঃখের অভিব্যক্তিও নেই। যেমন প্রতিদিন বদলাবার মত দামী জামাকাপড়, চশমা, চটি রাখেন ওয়ার্ডরোবে, তেমনই বিভিন্ন রঙের চোখের-জল রাখেন পকেটে, প্রয়োজন মত মাইকে বা টুইটারে চোঁয়ান। অন্যান্য ধার্মিক সংখ্যালঘুদের ওপরও হামলা চলছে বিশেষ বিশেষ এলাকায়।
এখানেও একটা ব্যাপার দেখার যে গুজরাটে ২০০২ সালের গণসংহারের পর কিন্তু কোনো কর্পোরেট হাউজ কিন্তু এর নিন্দায় এগিয়ে আসেনি । কোনো চেম্বার অফ কমার্স কোনো নিন্দাপ্রস্তাব গ্রহণ করেনি । অর্থাৎ ‘আমাদের দেওয়া উন্নয়নী প্রকল্প যদি শক্ত হাতে ক্রিয়ান্বিত করো তাহলে ওসব দাঙ্গা-টাঙ্গা প্রয়োজনে চালিয়ে যাও, আমরা সামলে নেব !’  

জাতপাত ।
ঔপনিবেশিকতা উচ্ছেদের প্রকল্পে গভীরতম সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রশ্ন !
যদি বাণিজ্যিক হিন্দী সিনেমা দেখার অভ্যেস থাকে, একটু মনে করে দেখুন তো, গত পঞ্চাশ বছরে কটা ফিল্মে নায়কের পদবী ‘উঁচু’ জাতের নয়? উত্তর-নবজাগরণী বাংলায় কটা উপন্যাসে কটা চরিত্র এবং আজকালকার টিভি সিরিয়ালে (হিন্দী বাংলা দুয়েতেই) কটা চরিত্র ‘উঁচু’ জাতের নয়? তাহলে কি সমস্ত লেখক, নির্মাতা, নির্দেশক জাতভেদের সমর্থক? না, তা নয়, কিন্তু বোঝা যায় যে এদেশের, বিশেষ করে মধ্যবিত্ত মানসের (অর্থাৎ বর্তমান সমাজে বুদ্ধিজীবীতার মানসের) কালচারাল কন্সট্রাক্টের এত ভিতর অব্দি আছে ব্যাপারটা যে রিফ্লেক্সের মত কাজ করে ।  
তবে একটা নতুন অধ্যায় সূচিত হল ১৯৯১ সালে । প্রস্তুতিটা আগের বছরেই হয়ে গিয়েছিল। কেন্দ্রে এবং পাঁচটি রাজ্যে অকংগ্রেসী সরকার ও বিশেষ করে উত্তর প্রদেশ এবং বিহারে অনগ্রসর জাতের মেরুকরণে উৎসাহিত হয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রী ভি পি সিং ১৯৯০ সালের আগস্ট মাসে ঘোষণা করলেন চাকরীতে অনগ্রসর জাতের জন্য আসন সংরক্ষণ (সুপারিশটা পনেরো বছরেরও বেশী সময় ধরে ঝুলিয়ে রেখেছিল কংগ্রেস সরকার)। ভীমরুলের চাকে ঢিল পড়ল । সঙ্গে সঙ্গে উত্তর ভারতে আগুন জ্বালালো শাসনে-প্রশাসনে ঘাঁটি গেড়ে বসে থাকা বর্ণহিন্দু সামন্ত-শক্তিরা – ক্ষেপিয়ে তুলল তরুণ প্রজন্মের ছাত্রযুবদের। আর সেই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে তাদের নিজেদের ভোটব্যাঙ্কে শামিল করতে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তির ‘রামরথ যাত্রা’ শুরু হল একমাস পর, সেপ্টেম্বরে । ১৯৯১ এর শেষে সোভিয়েত ইউনয়নের পতন এই ঘুর্ণিঝড়ে শামিল করে নিল শ্রমজীবী জনতার একটা বড় অংশকে । এবং এর পরবর্তী পর্যায়ে শুরু হল অনগ্রসর ও তপশীলী প্রতিটি জাতের জাতভিত্তিক সম্মেলন এবং জাতভিত্তিক সংগঠনগুলোকে নতুন জীবনপ্রদান ।
হিন্দী এলাকায় সম্প্রদায়বাদ বনাম ধর্মনিরপেক্ষতা বিকৃত ভারসাম্য খুঁজে নিল ‘কমন্ডল’ বনাম ‘মন্ডলে’ । আর এসবের খেসারত দিতে হচ্ছে পরবর্তী কুড়ি বছর ধরে, আজ অব্দি। ভিপিসিংএর সেই বিখ্যাত স্লোগান ‘সত্তা মে হিস্‌সেদারী’ (সরকারে অংশীদারী)তে নিজের নিজের জায়গা লোটার জন্য দৌড়োদৌড়ি করছে জাতভিত্তিক ছোটো বড় রাজনৈতিক দল এবং দলের ভিতরকার জোট – ‘উন্নয়ন’এর চলতি মডেলের প্রশ্নে সবার ঘাড় নব্বই ডিগ্রী কাৎ, ‘জী হুজুর! শুধু মন্ত্রীত্ব দিতে হবে!’

          তাহলে ঔপনিবেশিকতার উচ্ছেদের প্রশ্নে ব্যাপারটা কোন জায়গায় দাঁড়াল ? ঠিক যেমন দুর্নীতি, সাম্প্রদায়িকতা এবং জাতপাতের রাজনীতি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের তাঁবেদারীর প্রশ্নে এক হয়েছিল, নব্যসাম্রাজ্যবাদী প্রকল্প এই তথাকথিত ‘উন্নয়ন’এর প্রশ্নে, দেশে পুনঃওউপনিবেশিকরণের জাল বিস্তার করার প্রশ্নে আজকের দুর্নীতি, সাম্প্রদায়িকতা এবং জাতপাতের রাজনীতি এক হয়ে গিয়েছে।
          কাজেই প্রশ্নঃ নব্যসাম্রাজ্যবাদী ‘উন্নয়নী’ প্রকল্পটির বিরুদ্ধে শেষ কথাটি না বলে, ওই প্রকল্পটির উচ্ছেদের দিকে অগ্রসর না হয়ে (বরং অনেক ক্ষেত্রে তাকে সমর্থন করে - বিশেষ করে শহুরে তরুণ প্রজন্ম এবং তথাকথিত ‘সুশীল সমাজ’এর দিকে চোখ রেখে কথাটা বলছি) শুধু দুর্নীতি, সাম্প্রদায়িকতা বা জাতপাতের বিরুদ্ধে কোনো সামাজিক-সাংস্কৃতিক এমনকি রাজনৈতিক আন্দোলন কি আদৌ সফল হবে ? ঔপনিবেশিকতার উচ্ছেদ কি হতে পারবে?

          

No comments:

Post a Comment