Monday, November 20, 2017

বহির্বঙ্গে বাঙালি এবং তার সাহিত্য – বিহার প্রসঙ্গ

বাঙালির মন মননবিশ্বপ্রেক্ষিত
স্বদেশ বা স্বভূমি ছেড়ে বাইরে গিয়ে বিদেশে বিভূঁয়ে থাকার, থেকে যাওয়ার সামাজিক প্রবণতা স্বেচ্ছায় নয়, প্রধানতঃ রুজি- রোজগারের বাধ্যতায় দেড়শো বছরেরও আগে থেকে শুরু হয়েছিল। অবিভক্ত ভারতে শুরু হয়েছিল এই অভিনিষ্ক্রমণ। দেশভাগের পর বাঙালি দুটো দেশের নাগরিক হয়ে যেতে শুরু করল। যেহেতু এ সম্পর্কিত সার্ভেগুলো বেশির ভাগ দেশের নাগরিক হিসেবে; বাঙালি বা বাংলাভাষী হিসেবে নয় তাই সঠিক সংখ্যাগুলো পাওয়া মুশকিল। তবু কিছু হিসেব দিলে বুঝতে পারা যাবে এর প্রকৃতি।
ভারতের একটা হিসেব নিলে যে সময় পশ্চিমবঙ্গে বাঙালি জনসংখ্যা সাত কোটির কিছু বেশি, সে সময় আসামে ৭০ লক্ষ (যেহেতু এই হিসেবে ত্রিপুরার নাম নেই, তাই ধরতে পারি ত্রিপুরার তেইশ লক্ষ বাঙালি এরই মধ্যে আছে) এবং বাকি ভারতে ৭০ লক্ষের বেশি। সেই একই সময়ে বাংলাদেশে বাঙালি ১৪ কোটির বেশি এবং বাকি পৃথিবীতে বাঙালি, ইংলন্ডে সাড়েতিন থেকে চারের মধ্যে আর আমেরিকায় সব মিলিয়ে ২ লক্ষ নিয়ে মোট ১০ লক্ষের বেশি। একটা হিসেব বলছে ১৯৫১ সালে ইউনাইটেড কিংডমে বাংলাদেশী বা পূর্বপাকিস্তানী বাঙালির সংখ্যা ছিল ২০০০। ২০০১ সালে সেই সংখ্যাটা হয়েছে ২,৮৩,০০০। তেমনই আরেকটি সার্ভে বলছে যে এই বাঙালিদের ৮৫% তাদের সঞ্চয় নিজের দেশে পাঠাতো ১৯৬০-৭০এর দশক অব্দি। আজ নানা কারণে মাত্র ২০% এই কাজটা করে বা করতে পারে। এই দুটো প্রবৃত্তিতেই ভারতের বাঙালিদের সংখ্যা জুড়ে নিন। আবার তেমনই গ্রেট ব্রিটেনের সাথে জুড়ে নিন আরো অনেক দেশের নাম – আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, ইওরোপের বিভিন্ন দেশ এবং  সিঙ্গাপুর-হংকং-মালয়েশিয়া সহিত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলি। চল্লিশ ঘর বাঙালি চিনেও আছে। বাঙালি আছে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে। আর ভারতের ক্ষেত্রে আমরা আছি বিভিন্ন রাজ্যে কমবেশি ছড়িয়ে। এসবেরই পরিণতি আজ বাঙালি ডায়াস্পোরা বা বিশ্বব্যাপী বাঙালিয়ানা, বা ভারতবর্ষের মত বহুজাতিক দেশে ভারতব্যাপী বাঙালিয়ানা।
প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় প্রজন্ম পেরিয়ে সেই সব বাঙালিদের অনেকেই, বাকি আরো অনেক জাতির বা ভাষাগোষ্ঠির মত পুরোপুরি সেখানকারই স্থানীয় হয়ে পড়েছেন। আর তাই সেই ডায়াস্পোরা, শুধু বাংলাভাষাভাষীর নয় সব ভাষাভাষীর ক্ষেত্রে, আবার সেই, প্রধানতঃ রুজিরোজগারে টিঁকে থাকার বাধ্যতায় বা সোজাসুজি পেটের দায়ে, নানা সুপথ ও (দায়ে পড়ে) কুপথ পেরিয়ে বহুজাতিক সত্ত্বা বা ট্রান্সন্যাশনাল আইডেন্টিটির জন্ম দিচ্ছে। মিশ্র পরিবার, মিশ্র সংস্কৃতির জন্ম দিচ্ছে।
ক্ষুদ্র পরিসরে এই ঐতিহাসিক গতিপথটিকে বোঝার চেষ্টা করার কথা বলাও বাতুলতা। তবু একটা ব্যাপারে আমরা নিশ্চয়ই আমরা অনেক পশ্চিমা সমাজশাস্ত্রীদের বিরুদ্ধে একমত হব যে ডায়াস্পোরা যেমন নেশন-স্টেটের বিপরীতে কোনো পোস্টমডার্ন ফেনমেনন নয়, পুরোপুরি বুর্জোয়া নেশন-স্টেটেরই কীর্তি – হয় এক দেশের বেকারত্ব অন্য দেশের সস্তাশ্রম – তেমনই আজকের ট্রান্সন্যাশন্যাল আইডেন্টিটিও সেই একই স্টেটের কীর্তি – মানুষটির বা পরিবারটির দিক থেকে, বিধিনিষেধের, আইনকানুনের বেড়াজাল কাটিয়ে রুজিরোজগারে টিঁকে থাকার প্রয়াস। মূলতঃ, মানুষ শেষ পর্য্যন্ত চায় নিজের ভাষা, নিজের সংস্কৃতিকে দাঁতে কামড়ে ধরে রাখতে।

ডায়াস্পোরিক সাহিত্য
এই চাওয়ার ছবিটা বহুবিধ এবং বিচিত্র – সংস্কৃতির শুদ্ধতাবাদী পন্ডিতদের চোখে ‘হাস্যকর’ হতে পারে। কিন্তু তাতে কিচ্ছু আসে যায়না। চেয়ে যেতে হবে। চেষ্টা করতে হবে। এই কথাটিই যথার্থ একটি লেখায় পেলামঃ
Diasporas need not apologize for their alleged lack of authenticity, for the hybridity of diasporan identity, as if it represented mere decline from some purer homeland form. Rather – and there is an inevitable element of utopian self-congratulation here – at its best the diaspora is an example, for both the homeland’s and hostland’s nation-states, of the possibility of living, even thriving in the regimes of multiplicity which are increasingly the global condition, and a proper version of which diasporas may help to construct, given half a chance. The stateless power of diasporas lies in their heightened awareness of both the perils and rewards of multiple belonging, and in their sometimes exemplary grappling with the paradoxes of such belonging, which is increasingly the condition that non-diasporan nationals also face in the transnational era. Tölölyan, Khachig, (Quoted in Two women writers of Bengali diaspora’ by Sumona Das Sur)
ডায়াস্পোরার গতি কেন্দ্রাতিগ। অথচ যে মানুষগুলোকে নিয়ে এই ডায়াস্পোরা তাদের মনের গতি কেন্দ্রাভিগ। এই কেন্দ্রাভিগ মনন ও কেন্দ্রাতিগ জীবনগতি থাকে প্রথম প্রজন্মের মননে। কিন্তু, যেমন যেমন দিন যায়… “immigrants build social fields that link together their societies of origin and settlement.develop and maintain multiple relations—familial, economic, social, organizational, religious, and political that span borders. Transmigrants take actions, make decisions, and feel concerns, and develop identities within social networks that connect them to two or more societies simultaneously.” (Basch, Glick Schiller and Blanc-Szanton, 1992)

সাহিত্যের মনোভূমি
একই সত্য ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে বসবাসকারী বা আমাদের এই বিহারবাসী বাঙালিদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এবং জীবন- যাপনের বিস্তৃতি থেকে যদি দৃষ্টির ক্ষেত্রটা সীমিত করি মন ও মননে বা আরো ছোটো ক্ষেত্রে, সাহিত্যে বীক্ষা ও সত্ত্বার অভিব্যক্তিতে তখনও আমাদের একশ্রেণীর পণ্ডিত ও তাদের স্পন্সর্ড দৃষ্টিভঙ্গীর বিপরীত মেরুতে অবস্থান নিতে হয়।
তাঁরা প্রকাশ্যে বলেন, সাহিত্য একটাই। বাংলা সাহিত্য। তার আবার ‘ভিতর-বাহির’ ভাগ হতে পারে না।
ন্যায্য বলেন! কিন্তু সেই এক ও অখন্ড সাহিত্যের মনোভূমিটা যে বিবিধ! বহুবিধ! প্লুরাল! এমনকি মাল্টিপোলার – মেরুবহুল! এটাও মানুন তাহলে! মানবেন?
কিন্তু না, এটা মানতে তাদের একটা অসুবিধা হয়ে যায়। কেউ খুলে বলেন কেউ বলেন না, কিন্তু তাঁদের অস্বীকৃতিটা স্পষ্ট টের পাওয়া যায়। তাঁরা স্বীকার করেন না যে বাংলা সাহিত্যের সমসাময়িকতা বা কন্টেম্পোরানিইটি কলকাতা বা ঢাকা তো নয়ই এমনকি পশ্চিমবঙ্গ বা বাংলাদেশেও নয়, সারা পৃথিবীতে পরিভাষিত হচ্ছে। ঠিক যেমন ইংরেজি সাহিত্যের। এবং তাঁদের এই রক্তচক্ষুর কারণে এমনকি ‘বাইরে থাকা’ বা ডায়াস্পোরিক লেখকেরাও দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। উপরুল্লিখিত লেখিকা ভাষায়, “One wonders what could be the origin of such a denial of the obvious. Is it a reluctance to stand against the stream, an uncertainty about the medium of self-expression, or a fear that admitting a diasporic status might mean that the country of origin is being viewed as ‘the Other’?” এবং তারপর একটু apologetic ভাবে বলেন, “I think that if we examine and analyze the thinking of such people, as reflected in what they write, we can construct a map of the mental world of diasporic Bengalis from the second half of the twentieth century to the twenty-first century. …It is not an easy task to carry on writing in the mother tongue in a completely different environment and while immersed in the currents of a different language, but for those who do it, the task is an essential part of their sense of identity and self-esteem.” যখন নাকি তাঁর প্রবন্ধটি দুই প্রতিষ্ঠিত ‘ডায়াস্পোরিক’ লেখিকা, কেতকি কুশারি ডাইসন ও দিলারা হাশেমের সৃষ্টিকর্ম নিয়ে। এবং আরো বেশ কয়েকজন ডায়াস্পোরিক লেখক তাঁর চর্চায় উল্লিখিত।

আমরা যারা বিহারে বা সাধারণভাবে ভারতের বহির্বঙ্গে বাস করি, ভাষার অধিকারাদি নিয়ে আন্দোলন করি, মাঝে মধ্যেই একটা বক্তব্যের সম্মুখীন হই, “আগে ভাষা বাঁচলে তবে তো সাহিত্য!” বিহারে তো, আমরা যারা বাঙালি সমিতি ইত্যাদিতে রয়েছি, আমাদের সভায়, আলোচনায় আরো তীব্র ভাবে এই কথাটা উঠে আসে। তার কিছু বিশেষ কারণও আছে।

বিহারে বাঙালি
বিহারে বাঙালীর সাংস্কৃতিক গুরুত্ব ১৯৭৪এর পর থেকেই মোটামুটি কম হতে শুরু করেছিল। কেননা, চুয়াত্তরের আন্দোলনে বাঙালি সমুদায় সংস্কৃতিগত দিক থেকে অনুপস্থিত ছিল। পরে জাতিগত রাজনীতির বাড়বাড়ন্তে সে আরো পিছিয়ে পড়লো। তার পর সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের সাংস্কৃতিক আক্রমণ ত্বরান্বিত করল সমাজের সবকটি ক্ষয়িষ্ণু প্রবৃত্তির বাড়। বিহারবাসী একটি ভাষাগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জীবন তার ব্যতিক্রম নয়। নতুন শতকে বিহার থেকে ঝারখন্ড নামে এক নতুন রাজ্যের সৃজন হওয়ায় সংখ্যাগত অনুপাতে বিহারে বাংলাভাষী হঠাৎ দুর্বল হয়ে পড়লো। আর উপরোক্ত তিনটের ফলশ্রুতি হিসেবে, সামুদায়িক সাংস্কৃতিক জীবনের সমূহ ক্ষয় ও ধ্বংস দেখা দিল।
এভাবে, সম্পূর্ণ অসংগঠিত ও বিচূর্ণ হয়ে পড়া বাঙালী বিহারের জাতভিত্তিক রাজনৈতিক সংখ্যাবিন্যাসে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ল। জাতভিত্তিক পালোয়ানির উত্থান, শহরে জমিজমার ব্যাবসার রমরমা ও আইনশৃংখলার সামগ্রিক অবনতি, এই সব কিছুর কারণে উঠতি প্রমোটার, অপহরণকারী, ছিনতাইবাজ ইত্যাদি সবরকমের দুর্বৃত্তের প্রধান লক্ষ্য (সফ্‌ট টার্গেট), বিশেষ করে বাঙালী-অধ্যুষিত শহরগুলোয় হয়ে দাঁড়ালো বাঙালী মধ্যবিত্ত।
এই রকম পরিস্থিতিতে বিহার বাঙালী সমিতির কুশল নেতৃত্ব ধীরে ধীরে সংগঠনে একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করল। উত্তর বিহারের বিভিন্ন জেলায় গ্রামাঞ্চলে কলোনী গড়ে বসবাসকারী প্রায় পাঁচলক্ষ এককালীন উদ্বাস্তু বাঙালী জনসমুদায় নিজেদের যে আন্দোলন চালাচ্ছিল, তাদেরকে সাদরে আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে এল সমিতির ব্যানারে। পাটনার রাস্তায় বেরুলো মিছিল। জেলায় জেলায় রিলে ধর্না। জমির মালিকানা স্বত্ত্ব, জাতি প্রমাণপত্র, বিপিএল সূচীতে অন্তর্ভুক্তি, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে পাঠ্যক্রমে বাংলা বিষয়ের ও বাংলা মাধ্যমের অন্তর্ভুক্তি, শিক্ষক নিয়োগ, পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ ইত্যাদি দাবীসম্বলিত প্ল্যাকার্ড হাতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে বিহারের বাঙালি টের পেল তার সামুদায়িক পরিচয়ে এক রূপান্তর ঘটছে। তার পর এল ভোট বয়কটের ডাক।… সমিতির সদস্যতার শ্রেণীগঠন, দাবীসমূহ এবং তা আদায় করার ধরণধারণ সব কিছু গেল বদলে। গণআন্দোলন একটা নিয়মিত ব্যাপারে দাঁড়িয়ে গেল।
তাই ‘ভাষা বাঁচলে’ কথাটার গুরুত্ব আমাদের মধ্যে অন্যরকম ও কিছুটা সাহিত্যবিরোধী হয়ে উঠেছে আজকাল। তবু, এটা দেখা দরকার যে কিসের প্রয়োজনে আমাদের মধ্যে বেঁচে আছে ভাষা, মানে বাংলা? অর্থনৈতিক প্রয়োজনে নিশ্চয়ই নয়। অদূর ভবিষ্যতে সে প্রয়োজন আসার সম্ভাবনাও নেই। তাহলে? কী বলে বোঝাই আমরা নিজের সন্তানকে বাংলা পড়ার প্রয়োজনীয়তা? মা-বাবার, দাদু-দিদিমার ভাষা, পরম্পরা ইত্যাদির কথা বলেও যখন বোঝাতে পারি না তখন কি বাংলার অনুপম সাহিত্যেরই উল্লেখ করি না? বলি না যে রবীন্দ্রনাথের মত বিশ্ববরেণ্যই বা সে কোথায় পাবে আর ফেলুদার মত গোয়েন্দাগল্পই বা কোথায় পাবে?… সাহিত্য, ভালো সাহিত্যই ভাষার জায়গা তৈরি করে। বিহারের বাঙালিরা সরকারি মহলে হোক আর বুদ্ধিজীবী মহলে, হুঁকো পান আজও সেই দ্বারভাঙ্গা কে বিভূতিবাবু, ভাগলপুর কে বনফুল আর পুর্ণিয়া কে সতীনাথ ভাদুড়ীর নামে!
কাজেই আমার কথা হল যে সাহিত্যকর্মকে কখনোই হেয় করা উচিৎ নয়। ‘যা হোক, কষ্ট করে বাংলায় লিখছে তো’ কথাটা শুধুমাত্র বালখিল্যদের জন্য প্রয়োগ করা উচিৎ। মনে রাখা উচিৎ যে ‘বাঙালির মন ও মননের সমসাময়িকতা, তার বীক্ষার সমসাময়িকতা বিশ্বব্যাপী ও মেরুবহুল, এই ধারণাটাকে অনুশীলিত সত্যে ও তথ্যে পরিণত করার চ্যালেঞ্জটা আমাদের।  

বাংলা সাহিত্যে বিহার; সাহিত্য ও সাহিত্যিক – নিসর্গ, মানুষ, কালভাবনা
বিগত শতাধিক বছরে বিভিন্ন সমাজ-সংস্কারক ও সাহিত্যিকদের রচনায় ও কর্মে বিহার (এবং ঝাড়খন্ড) তার নিসর্গ, তার মানুষ নিয়ে উপস্থিত থেকেছে। গড়েছে বাংলা ও ভারতের বেশ কয়েকটি যুগসন্ধিক্ষণের কালভাবনা।
আকছার বলা হয় যে ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নিজের শেষ জীবনে নানান কারণে বীতশ্রদ্ধ, ক্লান্ত ও হতাশ হয়ে একটু শান্তির নীড় খুঁজে নিতে এসেছিলেন কর্মাটাঁড়ে! যাঁরা বলেন তাঁরা ভুলে যান যে বিদ্যাসাগর বাংলার নবজাগরণের শ্রেষ্ঠতম সন্তান ছিলেন। রেনেশাঁ-ব্যক্তিত্বের পরিচয় এটাই যে তাঁরা অক্লান্ত কর্মদৈত্য, মনন ও অনুশীলনের ঐক্যের দিকে ধাবিত একেকজন লেভিয়াথান। বাংলার রেনেশাঁর শ্রেণীগত সীমা নিয়ে যত বিতর্কেরই অবতারণা করা হোক, এটা প্রমাণিত তথ্য যে তার শেষ পর্বে একটি ধারা বাঙলা থেকে বেরিয়ে ঔপনিবেশিক অর্থনীতির ও সমাজের প্রত্যন্তে স্থিত মানুষজনের মধ্যে কাজ করতে গিয়েছিল। সেই ধারার সুত্রেই বিদ্যাসাগরের কর্মাটাঁড়ে আসা, বালিকা বিদ্যালয়, হোমিওপ্যাথিক দাতব্য চিকিৎসালয়, বয়স্ক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনার প্রয়াস চালানো এবং আদিবাসি কৃষকদের জন্য উন্নত ধরণের চাষ শেখানো, ফলনশীল বীজের ব্যবস্থা করা, গ্রামীণ শিল্প, কারিগরির মাধ্যমে বৈকল্পিক রোজগারের দিকে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ ইত্যাদি।
বিহারে সরকারি কাজে হিন্দীর প্রচলনে ভুদেব মুখোপাধ্যায়এর অবদান সর্বজনস্বীকৃত। এই কাজটি ‘বাঙালির আত্মপরিচয়ে বিহার D বিহারের আত্মপরিচয়ে বাংলা’র, অর্থাৎ উপরুল্লিখিত ‘multiple belonging’ যথার্থ নজীর।
          বিহার আলাদা হওয়ার আগে অব্দি বেঙ্গল প্রেসিডেন্সীর অন্তর্গত ছিল। ওড়িশাও ছিল। কিন্তু বাংলায় পরিব্রাজক বাদে সাধারণ, মধ্যবিত্ত মানুষের এমনকি ঐশ্বর্যশালী বাবুদেরও যাত্রাপথ রেলের, সমান্তরাল লোহার পাতদুটোর সাথে এগিয়েছে। হাওড়া বেনারস রেলপথ ভায়া লুপলাইন, মানে ভাগলপুর, শুরু হয়েছে ১৮৬৩ সালে। আর হাওড়া থেকে কটক বা পুরী যাওয়ার রেলপথ খুলেছে ১৯০০ সালে। রেলের এই ইতিহাস ঔপনিবেশিক প্রশাসনের হাত শক্ত হওয়ারও ইতিহাস। তারই সাথে জড়িয়ে আছে বাঙালি মধ্যবিত্ত চাকুরে ও বুদ্ধিজীবীদের দেশের বিভিন্ন রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ার ইতিহাস ও পর্যায়ক্রম।
প্রথম দিকের বিহারবাসী, বা বিহারে বেশ কিছু সময়ের জন্য বসবাসকারী বাঙালি লেখকদের লেখায় তাই সাধারণভাবে, বাঙালি চরিত্র বাদে বিহারের মুখ অস্পষ্ট। খুব বেশি হলে দরিদ্র, দুঃস্থ চাষীঘর, চাকর বা ফেরিওয়ালা ইত্যাদির স্টিরিওটাইপ। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরপরই সাহিত্যের নতুন চিন্তাভাবনায়, দেশের সার্বিক মুক্তির স্বার্থেও আবার শহুরে মধ্যবিত্ত জীবনের ও মননের অসারতা প্রমাণেও, প্রত্যন্ত মানুষের মানবিক সৌন্দর্য ও দৃপ্তি প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে। এখানেই মানবিক মূল্যের ব্যাপ্তির প্রেক্ষাপট হিসেবে বিহারের নিসর্গ এবং সেই নিসর্গের সাথে একাত্ম মানুষের চেহারা নিয়ে বিহারের প্রবেশ ঘটে।
আর ওই একই প্রয়োজনীয়তার প্রসারে, অধুনা ঝারখন্ড (কিন্তু তখন বিহার)এর আদিবাসীদের ব্রিটিশশাসন বিরোধী সশস্ত্র সংগ্রামের কাহিনী নিয়ে গবেষণা প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতে থাকে। এমনকি তেমন লেখক, বুদ্ধিজীবীরাও এ নিয়ে ভাবতে শুরু করেন যাঁদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক বিহারের সাথে সেভাবে ছিল না।
উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে হিন্দী সাহিত্যে বিহারের প্রবেশ, বিশেষ করে গ্রামীণ বিহারের প্রবেশ ওই একই সময়ে শুরু হল। আচার্য শিউপূজন সহায়ের ‘দেহাতি দুনিয়া’ প্রকাশিত হয় ১৯২৬ সালে।
স্বাধীনতাপ্রাপ্তির দিনগুলো এগিয়ে আসতে আসতেই সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে শাসনের হস্তান্তরণ বনাম স্বাধীনতা, রাজনৈতিক স্বাধীনতা বনাম সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখ, স্বাধীনতা বনাম শোষণের বিরুদ্ধে অন্তিম মুক্তিসংগ্রাম ইত্যাদি প্রতর্কগুলো।
এই পর্যায়ে বিহারের বাঙালি সাহিত্যিক ও বিহারি চরিত্র দুয়েরই গুরুত্ব অপরিসীম। আলাদা করে নাম নিতে চাই না, তবু উদাহরণ হিসেবে বলছি, ‘জাগরী’ নিজের genreএ প্রথম বাংলা উপন্যাস – বিষয়ভাবনা ও টেকনিক, দুদিক থেকেই। আবার ওই একই লেখকের সৃষ্ট ‘ঢোঁড়ই তাৎমা’ বাংলা ও হিন্দী সাহিত্যের আগামি অনেক চরিত্রের পূর্বসূরী।
অনেকেই বলেন সত্তরের দশক মুক্তির দশক। ৭১এ বাংলাদেশের জন্ম, ৭২এ আলেন্দের নেতৃত্বে চিলিতে নতুন শাসন, ৭৫এ ভিয়েৎনাম, কম্বোডিয়া ও লাওসের মুক্তি এবং ৭৮এ আফগানিস্তানে নুর মুহম্মদ তারাকির নেতৃত্বে দাউদের রাজতন্ত্র উৎখাত। এই বিহারেও, চুয়াত্তরে জয়প্রকাশ নারায়নের নেতৃত্বে গণআন্দোলন যার অভূতপূর্ব সাড়া ছাত্র ও ঘরের মহিলাদের মাঝে। ৭৫এ আপাতকাল ঘোষণা কিন্তু তার জবাবও দিল ভারতের জনতা ওই দশকেরই সাতাত্তরে। ভারতে প্রথম অকংগ্রেসী কেন্দ্রীয় শাসন এল।
নকশাল আন্দোলনও ওই সময়ে ছড়ালো বিহারের ও বর্তমান ঝারখন্ডের বিভিন্ন জেলায়।
এই রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতটা সবার কাছে সমান অর্থে গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে। কিন্তু আমূল পরিবর্ত্তনের একটা হাওয়া যে চলেছিল এবং সেটা বিহারের যুবসমাজকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল এটা তথ্য। যুক্তি-অযুক্তির, স্বপ্ন-বাস্তবের বিতর্ক এখানে টানছি না। সমাজবদলের সংগ্রামের এই নতুন ভাষা নানা ভাবে ছায়া ফেলতে লাগল বাংলা সাহিত্যে যেমন, হিন্দী সাহিত্যেও। ছায়া কথাটা এখানে এতটাই ব্যাপ্ত যে তার ভালোমন্দ ছেড়ে দিচ্ছি, আক্ষরিক অর্থে হিন্দী স্ল্যাং ও নানা ধরণের শব্দ ও শব্দজোট উঠে আসতে লাগল বাংলায়। এই পর্যায়েও আবার, এবং এর পরবর্তী পর্যায়েও এমন লেখকেরা বিহার নিয়ে লিখতে শুরু করলেন যাঁদের জীবনযাপন বিহারে নয়।
নব্বইয়ের দশক। যদিও মহারাষ্ট্র/গুজরাটের দলিত সাহিত্যের অনুবাদ ইত্যাদিরও এই প্রসঙ্গে বড় ভূমিকা রয়েছে, কিন্তু বাংলার সাধারণভাবে অসাম্প্রদায়িক মনন যখন দেখল যে অনগ্রসর জাত আর তপশীলী জাতের রাজনৈতিক ঐক্য রুখে দিচ্ছে আদবানির রথ, আর বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর সাধারণভাবে বজায় রাখছে শান্তি ও শৃংখলা… তখন জাত/বর্ণ ও শ্রেণীর অন্তর্সম্পর্ক নিয়ে পুনর্ভাবনা শুরু হল এবং সাহিত্যের ক্ষেত্রে সেই ভাবনার পটভূমি প্রায় পুরোটাই বিহার। কিছুটা কাজ অবশ্য তখন উঠে আসা বাংলার নিজস্ব ‘দলিত সাহিত্য’ও করেছে। আর, অবশ্যই সোভিয়েত সঙ্ঘে সমাজবাদের পতনও এই ‘ফিরে দেখা’য় একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে।  

শেষমেশ বিহারের বাংলা সাহিত্য নিয়ে কয়েকটি কথা।
১-       সাহিত্যের বিষয়ভাবনায়, বাংলাভাষী-হিন্দীভাষী/মৈথিলীভাষী/ভোজপুরীভাষী পরিবারের অন্তর্সম্পর্কের জায়গাটা এখনো সেভাবে আসেনি। বিশেষকরে পুনর্স্থাপিত উদ্বাস্তুদের কলোনিগুলোতে এ নিয়ে কাজ না করলে সামাজিক প্রেক্ষিতটা স্পষ্ট হবে না।
২-       বিহারের স্থানিক রাজনীতিতে বাঙালি – এ জায়গাটাও অনাবিস্কৃত।
___________________________________________________________________________________________________________

এই প্রবন্ধটি লিখতে ১৬-১৭ মার্চ ২০১৩ পাটনায় বিহার বাংলা আকাডেমি আয়োজিত সর্বভারতীয় আলোচনাচক্রে, আমারই রচিত দুটি বিষয়ভাবনার সাহায্য নেওয়া হয়েছে।

No comments:

Post a Comment