(সন্ধ্যা। মা কাজ করছেন। মেয়ের সঙ্গে বাবা দুহাতে সাইকেল সারাইয়ের
যন্ত্রপাতি নিয়ে ফিরলেন। সঙ্গে সঙ্গে স্কুলের দিদিমণিও ঢুকলেন।)
দিদিমণি - এ্যাই মানসী, ঠিক মত ক্লাস করিস না কেন রে?
মা - হ্যাঁ,
হ্যাঁ, বকুন তো ওকে! বাবা ওকে রোজ সকালে মোবাইলটা দিয়ে যায়, আর শ্রীমতী পনের মিনিট
ছাতে গিয়ে বসেই নেমে আসেন। ছুট দেন বাবাকে মোবাইলটা পৌঁছে আসতে।
দিদিমণি - ছাতে গিয়ে … মানে?
মা - নিচে
নাকি ওই … নেট আসে না। তাই মই বেয়ে ছাতে উঠে পড়ে।
দিদিমণি - এই ঠান্ডায়?
মা - কী
করবে? না হলে আশে পাশে কারোর দোতলায় যেতে হয়।
বাবা - কেন,
সেদিন তো দেখলাম, কোথায় যেন বাবা মেয়েকে সাইকেলে বসিয়ে ছুটছে ক্ষেতের পাশ দিয়ে! দশ
মাইল গেলে তবে নেট আসে – সেখানে ঢিপির ওপর
বসে মেয়ে ক্লাস করে!
দিদিমণি - আচ্ছা। কিছুদিন তো। সব সময় কি এরকম থাকবে? আবার শুরু হবে ক্লাস! কিন্তু
ফাঁকি দিলে তো তখনও চলবে না। কী রে মানসী! স্কুলে তো তুই ক্লাস ফাঁকি দিতিস না!
মা - বন্ধুবান্ধব
থাকত যে! ঘরে বসে তো আর সেটা পায় না।
দিদিমণি - না মানসী, ক্লাসগুলো ছাড়িস না। পিছিয়ে যাবি।
মানসী - বাবার অসুবিধে হয়, মোবাইল ছাড়া।
মা - বাবার
অসুবিধে না কচু। আসলে ওর ওই সাইকেলের যন্ত্রপাতি ঘাঁটতে, তেলকালি মাখতেই ভালো লাগে।
সেই যে যায় সকালে, দুপুরে গিলতে আসে। আবার বেরিয়ে যায়। একটা কাজ দিই না ওকে ঘরের, তারপর
এই অবস্থা।
দিদিমণি - কিরে। মা যা বলছে ঠিক?
মা - ও
আবার কী বলবে? ওর বাপকেই জিজ্ঞেস করুন না! বাপকে তো বলেইছে লেখাপড়া করতে ওর ভালো লাগে
না। তা থেকে সাইকেল সারাই ভালো।
দিদিমণি - সে তো খুব ভালো কথা! বড় হয়ে ইঞ্জিনিয়ার হবি। কিন্তু লেখাপড়াটা তো শিখতেই
হবে! কাল থেকে লক্ষ্য রাখব। আদ্ধেক ক্লাস করে পালাবি না। …
[দিদিমণি বারমুখো হন। মেয়ে দিদিমণিকে এগিয়ে দিতে আসে। মেয়েটির বাবা
ঘরে ঢোকেন। মা বাইরেই কাজ করতে করতে ধিমে গলায় একটা গান গাইতে থাকেন।]
বাঃ, তোর মা এত সুন্দর গান গায়!
মানসী - হ্যাঁ,
ওইরকমই। বললে কিছুতেই গাইবে না। (একটু ভেবে) দিদি, তোমার মোবাইলটা একটু দেবে?
দিদিমণি - কেন?
মানসী - দাও না শিগগির। মায়ের গানটা রেকর্ড করব।
(দিদিমণি মোবাইলটা দিয়ে দেয়। মেয়ে চুপিচুপি গিয়ে রেকর্ড করা শুরু
করে কিন্তু মা বুঝতে পেরে গান থামিয়ে দেন।)
এ কী হল? গাও না মা!
মা- যা ভাগ্!
মানসী - ঠিক
আছে, কথা দিচ্ছি তুমি গানটা গাইলে আমি ক্লাসে ফাঁকি দেব না, পুরোটা করে তবে বেরুব।
গাও!
মা - তুই
ক্লাস কর আর না কর, আমি গাইব না। আবার মোবাইল নিয়ে এসেছে রেকর্ড করতে।
মানসী - (রাগের
ভান করে) তোমাকে কি গ্রুমিং করতে হবে ইন্ডিয়ান আইডলের কম্পিটিশনের জন্য? গাও বলছি!
(আওয়াজ শুনে ভিতর থেকে বাবাও বেরিয়ে এসে মা’কে গাইতে বলেন। মেয়ে কিছুক্ষণ জড়িয়ে টড়িয়ে ধরার পর মা গান ধরেন একটা,
মেয়ে রেকর্ড করে। দিদিমণি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা উপভোগ করেন। গান গাওয়া হয়ে গেলে
মেয়ে ঘর থেকে বাবার মোবাইলটা নিয়ে এসে অডিওটা ট্রান্সফার করে। তারপর দরজার কাছে এসে
মোবাইলটা দিদিমণিকে ফেরায়।)
ওঃ, আপনার মোবাইল থেকে ডিলিট করলাম না।
দিদিমণি - করিস না। দরকার নেই।
(দিদিমণি ঈষৎ দূরে একটা চেয়ারে গিয়ে বসেন। মা উঠোনটা ঝাট দেওয়া শুরু
করেন। বাবা নিজের জিনিষপত্র গুছিয়ে দোকানে যাওয়ার তোড়জোড় করেন। মেয়ে একটা হাইস্টুলে
উঠে মোবাইলটা খুলে বসে, যেন ওটাই ছাত।)
মানসী - (ক্লাসে
জয়েন করেই, অবাক বিস্ময়ে চেঁচিয়ে বলে নিচে উঠোনে কাজ করতে থাকা মাকে) ও মা দেখ! দিদিমণি
তোমার গাওয়া গানটা বাজাচ্ছে ক্লাসে! (তাড়াতাড়ি মেসেজ করতে থাকে দিদিমনিকে)।
মা - (নিচে
থেকে, শুনে) এ মা! ছি ছি! … নিচে আয়! দেখা!
মানসী - যা শেষ হয়ে গেল। (ফোনে দিদিমণির গলার আওয়াজ শোনা যায়
এমন করে শোনে)।
দিদিমণি - তোমরা যারা ক্লাসে জয়েন করেছ সবাইকে বলছি, তোমরাও এটা করো। নিজের নিজের
মা’কে, ঠাকুমা-দিদিমাকে গান গাইতে বলে, কবিতা
আবৃত্তি করতে বলে ছোট্টো ছোট্টো ভিডিও বা অডিও ক্লিপ তৈরি করে আমায় পাঠাও। ক্লাসের
সঙ্গে সঙ্গে এটাও চলবে মাঝে মাঝে। কী? মজা হবে না?
(হঠাত
দিদিমণির পাশে এক মধ্যবয়স্ক মহিলা এসে দাঁড়ান।)
মহিলা - দারুণ
মজা হবে। (দিদিমণি চমকে ঘুরে তাকান।)
দিদিমণি - আপনি! আপনি কে?
মহিলা- ওমা,
আমাকে চিনলে না?
দিদিমণি - আপনি ………
মহিলা - তুমি
যে স্কুলে পড়াও আমি তো সে স্কুলেই থাকি!
দিদিমণি - স্কুলে? কোথায়?
মানসী - (ফোনে)
কার সাথে কথা বলছ দিদি?
দিদিমণি - জানি না। এক ভদ্রমহিলা এসেছেন …
মহিলা - দেখাও
না দেখাও! আমার চেহারাটা দেখাও ওকে! এ তো তোমাদের যুগের যন্ত্রপাতি। মুখ দেখা যায়,
গলা শোনা যায় … আমাদের সময় কি আর এসব ছিল?
দিদিমণি - (একদৃষ্টে তাকিয়ে, ঈষৎ ভয় পেয়ে) আপনাদের সময় মানে?
মহিলা - (মুচকি
হেসে) একশ বছরের বেশি হয়ে গেল ভাই, পৃথিবীতে তোমারই মত ছিলাম।
(মোবাইলে
অনেকগুলো বালিকা কন্ঠস্বর একসাথে কলরব করে ওঠে – ‘দেখান না দিদি, কে?’ দিদিমণি মোবাইল ক্যামেরাটা মহিলার দিকে ঘোরান।)
মানসী - (দেখেই
চমকে উঠে) আরে ইনি তো সেই ছবি!
দিদিমণি - ক্কে কে, কার কথা বলছিস?
মানসী - স্কুলের
অফিসে হেডদিদির চেয়ারের পিছনে যাঁর ছবি টাঙান আছে!
দিদিমণি - (চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠে পিছিয়ে যায়, তারপর সামনে আসে) ভুত! আপনি … আপনি কিভাবে ম্যাডাম? (এগিয়ে আঙুল দিয়ে স্পর্শ করতে যায়।)
মহিলা - উঁহুঁ
হুঁ। কিছু পাবে না। ভুতও বলতে পারো। তোমার ভিতরেই আছি যে! ম্যাডাম নয়, মা, মাসি, পিসি,
দিদি যা খুশি বল। (মোবাইলে পড়ুয়াদের) তোমাদের সঙ্গেই আমি থাকি সব সময়। আর মানসী, তুমি
বলছিলে না তোমার সাইকেল সারাই করতে খুব ভালো লাগে?
মানসী - (বিস্ফারিত
চোখে) হ্যাঁ।
মহিলা - তা
তুমি সাইকেল সারাইও তো শেখাতে পার ক্লাসে। আজকাল তো তোমরা মেয়েরা কী সুন্দর সাইকেল
চালাও – তুমি তোমার ক্লাসের বন্ধুদের শিখিয়ে দাও,
সাইকেলে কী কী সমস্যা আসতে পারে, তার মধ্যে কী কী নিজের হাতে সারান যেতে পারে। সারাতে
গেলে কোন কোন জিনিষ নিজেদের ব্যাগে রাখতে হবে … পারবে না,
শেখাতে?
মানসী - পারব।
মহিলা - (দিদিমণিকে)
এভাবে মেয়েদের মধ্যে যে যা হাতের কাজ জানে সব তারা শেখাবে ক্লাসে। এতেই তো পড়ার আনন্দটা
বাড়বে।
(মহিলা
আস্তে করে বেরিয়ে যান। দিদিমণি অবাক অপলক দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে থাকেন। দূরে মাইকে
ঘোষণা হয় যে, ‘ভাইরাসের প্রকোপে বৃদ্ধি দেখা গেছে বলে স্কুল
আরো তিন মাস বন্ধ থাকবে। সবাই যেন নিয়ম মেনে শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে চলাফেরা করে,
মাস্ক ধারণ করে এবং বার বার সাবান দিয়ে হাত ধোয়।’ মেয়েটি মোবাইল অফ করে লাফিয়ে নামে টুল থেকে, তারপর বেরিয়ে যায়।)
মা - কোথায়
চললি? আজকেও ক্লাস পুরো করলি না তুই!
মানসী - করব।
আগে দোকানে যাই। … শেখাতে হলে ভালো করে শিখতে হবে।
মা - শেখাতে
হবে! কাকে?
মানসী - আমারই
ক্লাসে; ওই যে, ছবি-ম্যাডাম … ওঃ না, ছবি-মা যা
বললেন!
মা - ছবি-মা!
সে কে?
মানসী - ক্লাসে
এসেছিলেন তো! সবচেয়ে বড় ম্যাডাম। যাঁর ছবি টাঙান আছে হেডদিদির মাথার ওপর!
মা - কী?
পাগল হয়ে গেলি নাকি? কী বলছিস?
মানসী - পরে
বোঝাব। (একটা চাদর জড়াতে জড়াতে জবাব দেয়) তুমি জানো, সব সায়েন্স! হ্যান্ডেল সোজা করা,
প্যাডেলের এক্সেল ব্যালেন্স করা, চাকার টিউনিং, ফ্রিহুইলের বেয়ারিং বসান, পাংকচার টিউবে
তাপ্পি লাগান, তার ওই আঠা – সলিউশন …
মা - বুঝি
না, কী বলিস … (বলে মেয়ের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে মাথা নেড়ে
নিজের কাজে মন দেন। … একটু পরে সামনের
দিকে তাকিয়ে হেসে বলেন) মেয়ের জন্য ভেবে ভেবে মরছি এমন নয়। ওরাই বা কী করবে? স্কুলে
যাওয়ার আসল মজাটাই যে নেই আজকাল। এমনিতেও হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে। দিদিমণি বলল নাকি
ইঞ্জিনিয়ার হবে। কী করে হবে? টাকা কোত্থেকে আসবে?
দিদিমণি - (নিজের টেবিলে বসে গুনগুনিয়ে ওঠেন) –
১৭.১.২৩
No comments:
Post a Comment