সঙ্গীতে যুক্তিবাদ – কিছু ব্যক্তিগত ভাবনাচিন্তা
সঙ্গীত১ সম্পর্কে আমাদের মত সাধারণ মানুষের মধ্যে
প্রচলিত ধারণাগুলি আজও এক কিম্ভূত-মহলে বন্দি। সঙ্গীতের উদ্গম বা উদ্ভবের কিছু কল্পকাহিনী
মহাদেবের জটার জটিলতায় ঘুরপাক খেতে থাকে। এ থেকেই বোঝা যায় আজ থেকে সোয়া শো, দেড় শো
বছর আগে কী বিষম পরিস্থিতি ছিল। রাগরাগিণীর কথা উঠলে ‘অযুত/অসংখ্য’, ব্যাকরণের কথা
উঠলে ‘ঘরানার রহস্যময় বৈশিষ্ট’, সমধর্মিতার কথা উঠলে ‘শ্রুতির সূক্ষ্ম ভেদ’, সময়সীমার
কথা উঠলে ‘অনহদনাদ’এর ‘ব্রহ্ম-বিস্তৃতির’ গল্প … অথচ মোদ্দা কথাটা ছিল যে যুগের সঙ্গে
তাল মেলাতে না পেরে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত গতিহীন২ হয়ে পড়েছিল।
কে কবে কোথায় প্রথম শুরু করেছিলেন দেশের সঙ্গীতকে নতুন শতাব্দীর
আলোয় যাচাই করার প্রয়াস, প্রথম ধাপে কতখানি ঘটেছিল অগ্রগতি – জানা নেই। কিন্তু সাংস্কৃতিক
পরম্পরার সব ক্ষেত্রেই যে একটা জাতীয়তাবাদী-যুক্তিবাদী৩ পুনরাবিষ্কার প্রক্রিয়া
শুরু হয়েছিল উনিশ শতকে, সঙ্গীতের ক্ষেত্রেও সেটা একই সময়ে শুরু হয়ে থাকবে।
কিছু বড় নাম এবং কিছু বড় কাজ (অবশ্যই আমি যেগুলোকে বড় মনে করি)
ধরে আমি নিম্নলিখিত শৃংখলাটি তৈরি করেছি – একে সঙ্গীতের যুক্তিবাদী পুনরাবিষ্কার এবং
পুনর্নির্মাণকে বোঝার একটি ঐতিহাসিক-যৌক্তিক (হিস্টোরিকো-লজিকাল) পদ্ধতি বলতে পারেন।
যদিও সে দৃষ্টিতে, কাজ এবং নামের দিক থেকে ভারতীয় বা বিশেষভাবে উত্তর-ভারতীয় সঙ্গীতের
দুই মহাপুরুষ, পন্ডিত বিষ্ণুদিগম্বর পালুস্কর এবং পন্ডিত বিষ্ণুনারায়ণ ভাতখন্ডের মধ্যে
পালুস্করের নাম প্রথমে আসা উচিৎ। তাঁর বৈপ্লবিক পদক্ষেপ, সঙ্গীত বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা
এবং সম্পর্কিত কাজকর্ম ১৯০১ সালেই শুরু হয়েছিল যখন নাকি ভাতখন্ডের কালজয়ী গ্রন্থ ‘হিন্দুস্তানি
সঙ্গীত-পদ্ধতি’র প্রথম খন্ড ১৯০৯ সালে এসেছিল। তা সত্ত্বেও, ঐতিহাসিক মুহূর্তগুলোকে
শৃংখলায় আনার জন্য তাঁর কাজের উল্লেখ ভাতখন্ডের পরে করেছি।
১ – রাগরাগিণীর প্রামাণিক ঠাট নির্দ্ধারণ
বাংলায় রবীন্দ্রনাথের জন্মের এক বছর আগে ১৮৬০
সালে মহারাষ্ট্রের কোল্হাপুরে জন্মেছিলেন বিষ্ণু নারায়ণ ভাতখন্ডে। আলটপকা রবিঠাকুরের
নামটা এইজন্য আনলাম যে ভারতে সঙ্গীতে যুক্তিবাদের যে কোনো অধ্যয়নে তাঁর প্রসঙ্গ অপরিহার্য।
ভাতখন্ডে পেশায় উকিল ছিলেন। পেশায় সফল ছিলেন। ভারতের শাস্ত্রীয় সঙ্গীত (উত্তর ভারতীয়
এবং কর্ণাটকি, দুটোই) বা মার্গসঙ্গীতের অধ্যয়ন প্রথম থেকেই তাঁর নেশা ছিল। স্ত্রী এবং
কন্যার অসাময়িক মৃত্যুর পর বেরিয়ে পড়লেন ভারত ভ্রমণে। এতদিন ওকালতিতে যে টাকা উপার্জন
করেছিলেন তা কাজে লাগল। এক একটি ঘরানার জীবিত বিশারদদের কাছে গিয়ে দেখা করলেন। সে দেখা
সহজ ছিল না। অধিকাংশ ওস্তাদ, গুরু বা বিশারদ নিজেদের অহঙ্কারে মজে ছিলেন। দেখা করতে
আসা লোকটির উদ্দেশ্যের কথা জেনে, তার বিরুদ্ধে নিজেদের ক্রোধ ও উপেক্ষা জাহির করতে
তাঁরা কিছু বাকি রাখেন নি। যেন লোকটি কোনো গর্হিত কাজ করতে বেরিয়েছে। দর্জির ফিতে দিয়ে
অসীমকে মাপতে বেরিয়েছে! এত বড় স্পর্ধা? সঙ্গীতকে মাপবে? এখনি শিবের তৃতীয় নেত্র খুলবে
আর পাপিষ্ঠ লোকটি তাঁর রোষানলে ভস্ম হয়ে যাবে! … তবুও ভাতখন্ডে জারি রাখলেন তাঁর ভ্রমণ।
কেউ কিছু বলতেই চায় না! তবু কাজে লেগে রইলেন তিনি। যেখানে যেটুকু পাওয়া যায়। ছোটো ছোটো
নোটে ডাইরি ভরে গেল। তারপর ফিরলেন আবার কোলহাপুরে, নিজের বাড়িতে। প্রথমে একটা ছোটো
বই লিখলেন রাগের পরিচিতি নিয়ে – ‘স্বরমালিকা’। তারপর বন্ধুদের কথায় মারাঠিতে লিখলেন
তাঁর ম্যাগনাম ওপাস, ‘হিন্দুস্তানি সঙ্গীত-পদ্ধতি’। এই গ্রন্থের চতুর্থখন্ডের মুখবন্ধে
উনি লিখেছেন –
“সঙ্গীত বিষয়ে আমার অভিজ্ঞতা মোটামুটি পঞ্চাশ
বছরের। এই পঞ্চাশ বছরে দেশের অনেক সুপ্রসিদ্ধ গায়ক-বাদকের সম্পর্কে আমি এসেছি। যে সব
নামকরা গুণী শিল্পীদের আমি শুনেছি, তাঁদের অধিকাংশের নাম এই গ্রন্থে দেওয়া হয়েছে। গ্রন্থটি
লেখা শুরু করার আগে এক নেপাল বাদ দিয়ে অন্য সমস্ত প্রদেশে গিয়ে থেকে, সেখানকার গায়ক-বাদকদের
সঙ্গে সঙ্গীতচর্চা করে এবং প্রবাসে যা কিছু উপযোগী গ্রন্থ দেখতে পেয়েছি, সেগুলো সম্পাদিত
করে, ভালোভাবে অধ্যয়ন করেছি। শুধু তাই নয়, অনেক প্রখ্যাত গায়কদের সামনে নিজে বসে তাঁদের
কাছ থেকে খেয়াল-ধ্রুপদের হাজার, দেড় হাজার গান শিখেছি এবং নোটেশনও তৈরি করেছি। তার
অধিকাংশ তো আমি আমার বিশিষ্ট শিষ্যদের শিখিয়েও দিয়েছি। সার কথা এই যে এতটা পূর্ব প্রস্তুতি
নেওয়ার পরই আমি এই গ্রন্থ রচনার কাজে হাত দিয়েছি।
সবচে’ আগে আমি সমাজে বর্তমানে প্রচলিত সবক’টি
রাগকে সূক্ষ্মভাবে নিরীক্ষণ করেছি। তাতে দেখতে পেয়েছি যে আজকাল সমাজে একশো-দেড়শোর বেশি
রাগ গাওয়া হয় না। এটাও লক্ষ্য করেছি যে স্থূল দৃষ্টিতে এ সমস্ত রাগকে মূলতঃ নিচের তিনটে
শ্রেণিতে ভাগ করা যায়ঃ–
১ – যে রাগে রে, ধা এবং গা স্বর তীব্র হয়।
২ – যে রাগে রে কোমল এবং গা আর নি তীব্র হয়।
৩ – যে রাগে গা এবং নি কোমল হয়।
এটাও লক্ষ্য করলাম যে গাওয়ার সময় কয়েকটি রাগে
দ্বিরূপ স্বর প্রকট হয়, কিন্তু সব মিলিয়ে সে রাগগুলোর চলন এবং রচনা দেখে বলতে পারি,
তাদের শ্রেণি পৃথক করার প্রয়োজন নেই। এভাবে, শ্রেণি নির্দ্ধারিত হয়ে যাওয়ার পর, সমস্ত
রাগকে শ্রেণিভুক্ত করার জন্য নিম্নলিখিত দশটি মেল বা ঠাটকে আমি হিন্দুস্তানি সঙ্গীতের
ভিত মনে করলামঃ–
১ – ইমন ২
– বিলাওয়ল ৩ – খামাজ ৪
– ভৈরব ৫ – পূর্বী
৬ – মাড়োয়া ৭ – কাফি ৮
– আশাবরি ৯ – ভৈরবী ১০ – টোড়ি
টোড়ি ঠাটে গা কোমল এবং টোড়ির কয়েকটি ধরণে গা,
নি কোমল। তাই ঠাটটাকে গা, নি প্রযুক্ত শ্রেণিতে নেওয়া হয়েছে। এভাবে, সমস্ত রাগকে এই
দশটি ঠাটে শ্রেণিভুক্ত করে … “ [মারাঠি সংস্করণের মুখবন্ধ, হিন্দুস্তানি সঙ্গীত পদ্ধতি,
চতুর্থখন্ড, সঙ্গীত কার্যালয়, হাথরস]
বোঝা যায় যে কত বড় বৈপ্লবিক ছিল ভাতখন্ডের
এই কাজ।
কর্ণাটকি সঙ্গীতে বোধহয় লক্ষণ-গীতির একটি পরম্পরা
ছিল। রাগের লক্ষণ বোঝাবার জন্য। ঠাটের ধারণা অব্দি পৌঁছোনোর আগে ভাতখন্ডে সেই লক্ষণ-গীতির
প্রেরণায় মারাঠিতে নির্ভেজাল সুরগুলোর ‘বিহার’ রচনা করলেন। সে বইটি লিখতে গিয়ে তাঁকে
আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে হল। নিজের ধরণে স্বরলিপি রচনা করার পদ্ধতি বিকশিত করলেন।
পরে, ধীরে ধীরে সমস্ত দেশের জন্য এক মানের লিপি, চিহ্ন এবং রচনা-পদ্ধতি স্বীকৃত হয়েছে।
এমন নয় যে রাগরাগিণীকে শ্রেণিভুক্ত করার চেষ্টা
এর আগে হয়নি। আরোহ-অবরোহের চক্রাকার বিন্যাস, ভাব এবং আরো অন্যান্য ধরণে শ্রেণিভুক্ত
করার চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু একটিই সপ্তকে আরোহের ন্যুনতম যে ক’টি রূপকে চিহ্নিত করা
যেতে পারে, তাদেরকে ঠাট বলে, সেই ভিত্তিতে রাগরাগিণীর শ্রেণিকরণ প্রথমবার ভাতখন্ডেই
করেছিলেন। এখনো অনেকেই এ কাজটাকে হাওয়ায় উড়িয়ে দেয়। সেদিনই ইন্টারনেটে দেখলাম একজন
বলছেন, ঠাট দিয়ে রাগরূপের তল পাওয়া সম্ভব নয়। কে বলছে ভাই, যে সম্ভব? ভাতখন্ডে সাহেব
কি বলেছেন? ভাবের তল, প্রাণের মাপ সত্যিই পাওয়া যায় না কিন্তু হাড়ের মাপ তো পাওয়া যায়!
আর সে সময় এটাই সবচেয়ে বৈপ্লবিক কাজ ছিল। সাত স্বরের সপ্তকে সা আর পা স্থির রেখে, বাকি
পাঁচটি স্বরের মধ্যে মাএর কড়ি ও শুদ্ধ এবং রে, গা, ধা, নির কোমল এবং শুদ্ধ – দশটি স্বর,
দশটি রূপ। যতই হোক রাগ এবং রাগিণী, তার দশটি বিমূর্ত বর্গ বা শ্রেণিনির্মাণ।
বেঁধে দিলেন উনি। এমন বাঁধলেন যে পুরো ভারত
মানল সে বাঁধন। আপনি গায়ক? বাদক? জৌনপুরি সাধছেন ওস্তাদ? সাধুন! বোধহয় আপনার মনে ছবি
ফুটে উঠছে … শরতকালে ছোট্ট কসবার রাস্তাটার, যখন আপনি স্কুলে যাওয়ার জন্য সেটা পার
করতেন, রামতিরথের দোকানের জিলিপির গন্ধ ভুলিয়ে দিত সংস্কৃত স্যারের পেটাই … দু’পয়সার
জিলিপি কিনে বসে যেতেন আমবাগানে … রোদ চড়ত ধীরে ধীরে, পাতার ফাঁক দিয়ে মুখে, ঘাসে এসে
পড়ত তার আলো … গেয়ে চলুন, বাজিয়ে চলুন, প্রাণ ভরে মনে আনুন সেই সকালের আনন্দবেদনা!
একদম মনে রাখার দরকার নেই যে জৌনপুরির ঠাটটা কি। কিন্তু ভাবের বিস্তারে কখনো যদি আশাবরির
কোনো অঙ্গ ছুঁয়ে যেতে ইচ্ছে হয় তখন ভাববেন যে এই ইচ্ছের গতিপথের সুত্রটা কে আবিষ্কার
করেছিল!
ঠাটের ধারণা কি সঙ্গীতের স্বাভাবিক গতিকে রুদ্ধ
করে? পদ্মফুলের ফুলসুদ্ধু মৃণালগুলোকে নারকেলের দড়ি দিয়ে বাঁধতে যায়? এটা কি সেরকমই
হাস্যকর কোনো চেষ্টা, ভক্ত হনুমানের নামে প্রচলিত গল্পে যেমনটা আছে যে তিনি নাকি সীতামায়ের
দেওয়া মুক্তোর মালা থেকে মুক্তো ছিঁড়ে চিবিয়ে দেখছিলেন যে সেটা খাওয়া যায় কিনা? অথবা
যুক্তির পথে একটি বিরাট মুক্তিকে সম্ভাবিত করা হল! আধুনিক যুগের সাথে এবং ভারতের জাতীয়
অভ্যুদয়ের সাথে ভারতের সাংস্কৃতিক পরম্পরাকে যোগ করার একটি পথের সিদ্ধান্ত ছিল ভাতখন্ডের
কাজে। সারা দেশের জন্য এক মান নির্দ্ধারণ এবং প্রমিতকরণ। এটা ছিল প্রথম যুক্তিবাদি
পদক্ষেপ।
মাদুরাইয়ের মীনাক্ষী মন্দিরের ভিতরে একটি স্তম্ভ
আছে যেটি বস্তুতঃ বাইশটি শীর্ণ স্তম্ভের গুচ্ছ। শীর্ণ স্তম্ভগুলোর মাঝে খালি জায়গা
আছে। কোনো একটা পাতলা কাঠি দিয়ে আলাদা আলাদা বাজালে বাইশটি বিভিন্ন স্বর উৎপন্ন হয়।
সেগুলি নাকি বাইশ শ্রুতি। অদ্ভুত, না? এত জটিল একটা ট্যুনিং ফর্ক, বিরাট পাথরে তৈরি
এবং তাও এক সপ্তকের বাইশটি স্বরের জন্য। কত শতাব্দি আগেকার!
ভারতের শাস্ত্রীয় সঙ্গীত পরম্পরার যে বিপুল বৈভব, কত শতাব্দিকাল ধরে সে ঐতিহ্যকে জিইয়ে রাখার যে অনন্য ফল – রাগরাগিণীর প্রতিষ্ঠিত সামাজিক সম্পর্ক (দিন-রাতের প্রহর অনুসারে, মনের ভাবানুসারে সুর ও ভাবের সূক্ষ্ম প্রভেদ প্রায় সামাজিক অবচেতনের অঙ্গীভূত হয়ে গেছে – এক একটি রাগ বা রাগিণী এখন কয়েকটি মেজাজের ভান্ডার, রিপোজিটরি অফ মুডস), অনহদ নাদের কল্পনার প্রতিধ্বনি এত বছর ধরে প্রাচ্যের বিশ্বদৃষ্টিকে যে এক বিশেষ বর্ণ দিয়েছে, এই সবকিছুকে ছোটো করে দেখার অভিযোগ যদি কেউ করে তাহলে সেটাই বরং পাগলের প্রলাপ হবে।
২ – সঙ্গীত সম্মেলনের আয়োজন
ঠাটের ভিত্তিতে রাগরাগিণীর প্রমিতকরণের পর
স্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজ বা বলা যায় দ্বিতীয় ঐতিহাসিক মুহূর্ত ছিল সঙ্গীত সম্মেলনের
আয়োজন। তথাকথিত রহস্যময় ঘরানাকেন্দ্রিকতা থেকে মার্গ সঙ্গীতকে বাইরে আনল এই আয়োজন।
মানুষের কাছে পৌঁছোল সঙ্গীত, মানুষের কাছে পৌঁছোতে ধীরে ধীরে লঘু করতে এমনকি ভাঙতেও
হল অনেক অর্থহীন হয়ে পড়া রীতি। হয়ত বিরাট মাপের বিখ্যাত কিছু বিশারদ ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান
করলেন সম্মেলনে গাইবার বা বাজাবার ডাক, তবু একসাথে পরিবেশন, একে অন্যকে শোনা এবং ক্রমবর্দ্ধমান
শ্রোতৃবর্গের কাছে নিজের শিল্প পৌঁছোনোর মত করে তোলা শুরু হল।
এ কাজেও ভাতখন্ডে পথ দেখালেন। যদিও জলন্ধরের
হরিবল্লভ সঙ্গীত সম্মেলন দাবি করে যে ওদের সম্মেলন সবচেয়ে পুরোনো – ১৮৭৫এ শুরু হয়েছে,
এবং সেটা হতেও পারে – কিন্তু যে উদ্দেশ্যের কথা বলছি সে উদ্দেশ্যের সাথে সম্মেলন বিশের
শতকের দ্বিতীয় দশকে শুরু হল। কেননা ভাতখন্ডে এ কাজে ততক্ষণ সফল হতে পারতেন না যতক্ষণ
নিজে, সঙ্গীত নিয়ে তাঁর ঐতিহাসিক গবেষণার ফলে সঙ্গীত-সমাজে প্রতিষ্ঠিত না হতে পারতেন।
ঘটনাটা এমন হল যে বরোদার মহারাজা, যিনি ভারতীয় শিল্পকলা, শিক্ষা, গ্রন্থালয় ইত্যাদির
আধুনিকীকরণের জন্য প্রসিদ্ধ, বরোদায় সঙ্গীত বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার জন্য ডেকে পাঠালেন
ভাতখন্ডেকে, এবং বোধহয় বিষ্ণুদিগম্বর পালুস্করকেও। সেটা ছিল ১৯১৬ সাল। বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার
প্রস্তুতিক্রমে ভাতখন্ডে মহারাজাকে সঙ্গীত সম্মেলনের প্রস্তাব দিলেন। ফলে বরোদায় ঐতিহাসিক
সর্বভারতীয় সঙ্গীত সম্মেলনের আয়োজন হল। সারা দেশ থেকে চারশোরও বেশি সঙ্গীতজ্ঞেরা অংশগ্রহণ
করেছিলেন। আয়োজনের প্রারম্ভে ভাতখন্ডে একটি দীর্ঘ সারগর্ভ ভাষণ দিলেন যেটি পরে A
short historical survey of the music of upper India নামে প্রকাশিত হয়েছিল। এই ভাষণের
প্রথমদিকের একটি প্যারাগ্রাফ, ঈষৎ দীর্ঘ হওয়া সত্ত্বেও উদ্ধৃত করতে চাই কেননা যে জাতীয়তাবাদি-যুক্তিবাদি
পুনরাবিষ্কারের কথা এই প্রবন্ধের শুরুতে বলেছি তার স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে উদ্ধৃতিতেঃ
A satisfactory feature of the
Renaissance of Indian culture and Indian ideals, which characterises the intellectual
activity of India of the present day, is the attention that is paid to the
revival of our ancient music. The keen interest evinced by the present
generation in the preservation and further progress of this national heirloom
has materialised itself broadly speaking, in two different aspects. On the one
hand, one notices the movement of learned scholars from all parts of India
meeting in national conferences with a view to focus attention on and
co-ordinate the results of research grappling with the technical side of the
question such as for instance, the working out of a system of uniform and
adequate notation, the systematising of the ragas at present sung in the
northern part of the country, so as to make the same easy of instruction ad
assimilation and so forth. On the other hand one welcomes the growth of numerous
music clubs and schools of music, – and with it the facilities offered for
serious and thorough-going study of the art, – and its gradual introduction
into our homesteads. Both these aspects are complimentary of each other,
neither is complete without the other. The learned but dry-as-dust
disquisitions of our theorists would be fruitless waste of time if they did not
succeed in evoking some interest on the part of the public in the art; while
the Gyan Samaj would be a deplorably shaky superstructure without the firm
foundation of the science.
একদিকে রাগরাগিণীর গভীরে বিবিধ পথগামী অনুসন্ধানের
পরিণামগুলো একজায়গায় এনে তার একরূপ নোটেশন তৈরি করে প্রণালিবদ্ধকরণ (সিস্টেমেটাইজেশন)
এবং অন্যদিকে জনগণের হৃদয়ে পৌঁছোনোর সংগঠিত প্রয়াস। এবং এই দুটোকে একসাথে যোগ করতে
পারে বিজ্ঞানের মজবুত ভিত্তি।
পরে তো দেশের বিভিন্ন শহরে এ ধরণের সঙ্গীত
সম্মেলন অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠল। স্বাধীনতার পর অল ইন্ডিয়া রেডিও বা আকাশবাণী আয়োজিত
সঙ্গীত সম্মেলনের বিশেষ গুরুত্ব কায়েম হল সঙ্গীতমহলে। দেশের অন্যান্য শহরে তো বড় বড়
সঙ্গীত সম্মেলনে টিকিট, গেটপাস ইত্যাদির ব্যবস্থা হত, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে
পারি পাটনার কথা। দুর্গাপুজো থেকে কালীপুজো অব্দি ডজন খানেক সাঙ্গীতিক আয়োজন – চিল্ড্রেন্স
পার্ক, পাটনা কলেজিয়েট, গোবিন্দ মিত্র রোড, সব্জিবাগ, নালা রোড, গান্ধী ময়দান, সেক্রেটারিয়েট,
বীণা সিনেমা, স্টেট ব্যাঙ্ক … ঠিক সঙ্গীত সম্মেলন না হলেও তার থেকে খুব কম কিছু হত
না। গেটপাস কিছু থাকত, কিন্তু তা বহাল থাকত শেষ রাত অব্দি। শাস্ত্রীয় নৃত্যের সমঝদার
হোন বা না হোন, নাচ দেখার সামন্ততান্ত্রিক ঐতিহ্যে কায়েম থেকে বড়লোক শ্রোতারা চেয়ারে
থাকতেন ওই সিতারা দেবী বা যামিনী কৃষ্ণমুর্তি বা উর্মিলা নাগর বা অন্য কোনো শিল্পীর
নাচ অব্দি। সামিয়ানায় ভোরের হাওয়া লাগার আগেই চেয়ারগুলো খালি হয়ে যেত আর বাঁশের বেড়ার
ফাঁকফোকর দিয়ে ঢুকে পড়ত গেটপাসহীন সাধারণ মানুষেরা। গ্রাম থেকে গরুর গাড়ীতে করে শাস্ত্রীয়
সঙ্গীত শুনতে আসছে লোকে, ভাবা যায়? ভাবা যায়, বৃষ্টি নামল, আয়োজকেরা গিরিজা দেবীর গান
থামিয়ে ভিতরে নিয়ে যেতে ব্যতিব্যস্ত আর গিরিজা দেবী? দূরের শ্রোতাদের আওয়াজ “গেয়ে চলুন
গিরিজা দেবী, আমরা আছি” শুনে আয়োজকদের বললেন পাঁচটে ছাতার ব্যবস্থা করতে। একটা তাঁর
মাথায়, একটা তানপুরার মাথায়, একটা তবলচির মাথায় … এবং গেয়ে চললেন অঝোর বৃষ্টির মধ্যে
খেয়াল শেষ করে একের পর এক ঠুমরি, কাজরি! এই ছিল ভাতখন্ডে, পালুস্কর এবং অন্যান্যদের
কাজের জোর! জাতীয়তাবাদী-যুক্তিবাদী অভিযানের জোর! … শিশুদের লেখাপড়া শুরু হয় হাতে-খড়ি
দিয়ে। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে দেশের সাধারণ মানুষের কানে-খড়ি হতে পেরেছিল এই সব সঙ্গীত সম্মেলনের
জন্য।
[ক্রমশঃ]