Thursday, October 12, 2017

জ্যাক লন্ডনঃ স্মৃতিচারণ - আন্না স্ট্রান্সকি ওয়লিং

“এভাবে দেখো আমায়ঃ পথভোলা অতিথি, লবণাক্ত ডানা ঝাপটে উড়তে উড়তে তোমার জীবনে এক মুহুর্তের জন্য ঢুকে পড়া এক বিহঙ্গ – বাঁধা জীবনযাপনের সুখসুবিধেগুলোর অনভ্যাসে রূঢ় এবং ভূল করে চলা, ব্যাপ্ত হাওয়া আর মহাশূন্যে বেড়ানো বিহঙ্গ।” জ্যাক লন্ডন

তার জীবনের চব্বিশতম বছরে, ওকল্যান্ড থেকে ২১শে ডিসেম্বর, ১৮৯৯এ পাঠানো এক চিঠিতে সে এই কথাগুলোই আমায় লিখেছিল। শুধু আমার জীবনের এক ছোট্ট মুহুর্তের নয়, লবণাক্ত ডানা ঝাপটে ওড়া এই বিহঙ্গ শাশ্বত-কালের জীবনপথের পথিক। কেননা কে বলবে কবে পৃথিবী থেকে শেষ হবে সেই বিস্ময় ও সৌন্দর্য যার নাম ছিল জ্যাক লন্ডন? কিভাবে ভুলবে কেউ যে তাকে একবার জেনেছে? আর জীবনই বা তাকে ভুলবে কী করে যে জীবনেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল? সে ছিল যৌবন, দুঃসাহস, রোমাঞ্চ। সে ছিল এক কবি এবং সমাজবিপ্লবী। বন্ধুত্ব গড়ার অসাধারণ প্রতিভা ছিল তার। যেমন সে ভালোবাসতে পারতো তেমনই অফুরান পেতো ভালোবাসা। কিন্তু কিভাবে শব্দে তার ব্যাক্তিত্বের সেই গুণটা ধরব যা তাকে সবার থেকে ভিন্ন করেছিল? কিভাবে তার চৌম্বক-আকর্ষণ আর তার কবিপ্রকৃতি বোঝাবো কাউকে? পুরোনো দুনিয়ার লড়াই আর যন্ত্রণায় বিকশিত সে ছিল সেই দুনিয়ার সমস্ত ভয়ানক ও দুর্বৃত্তমূলক কলঙ্ক থেকে নির্যসিত শক্তি আর নৈতিক উৎকর্ষ। সে সেই গহ্বর থেকে বেরিয়ে এল যে গহ্বরে তার প্রজন্মের এবং তার আগের প্রজন্মগুলোর লক্ষ লক্ষ মানুষ নৈরাশ্যে হারিয়ে গিয়েছে। সে উঠল সেই গহ্বর থেকে, পালালো, জাতিসত্ত্বার মত বড় হয়ে উঠতে আর সেই শক্তিগুলোর সাথে চিহ্নিত হতে যারা মানব-জাতির ভবিষ্যৎ বদলায়।

তার জীবনের আদর্শ ছিল উঁচু। ধনসম্পদের নানারকম আরাম আর সুবিধেগুলো, প্রতিভা, সামর্থ্য আর প্রণয়ের সুখ তার নাগালের মধ্যে ছিল। নেপোলিয়ন আর নীৎশের কিছু অংশ ছিল তার মধ্যে, কিন্ত তার নীৎশেবাদী দর্শন রূপান্তরিত হল সমাজবাদে – তার সময়ের আন্দোলনে – আর তার নেপোলিয়ন-ধাঁচের মেজাজের জোর দিয়ে সে গড়ে তুলল এক অবিশ্বাস্য সফলতার ধারণা; তা অর্জন করার ইচ্ছাশক্তিও তার ছিল। যেহেতু সংবেদনশীল আর আবেগময় ছিল তার প্রকৃতি, তাই লক্ষ্যের দিকে নিয়ে যাওয়ার পথ থেকে সব রকমের বিচ্যুতি সে পরিহার করল। নিজের জীবনটাকে বিন্যস্ত করল। কী প্রকান্ড উদ্যম, তবু সে নিজেকে বিশ্বাস করল না! নিয়মের দাস করল নিজেকে। আত্মশাসন, শৃংখলা আর সংযম হল এই প্রাণবন্ত ও কামনাময় যুবকের ধর্ম। নিজের রোজকার খাটনি বাঁধল এক হাজার শব্দ, লিখে সংশোধন করে টাইপ করা। বছরের পর বছর নিজের বরাদ্দ করে রাখল সাড়ে চার ঘন্টা ঘুম; উষাকালে কাজ শুরু হত নিয়মিত। রাতে করত বিজ্ঞান, ইতিহাস আর সমাজশাস্ত্রের গভীর অধ্যয়ন। এটাকে সে বলত নিজের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি অর্জন। সপ্তাহে একদিন সে নিজেকে সঁপতো জীবনসংগ্রামে রত এক বন্ধুর কাজে। বিনোদন ছিল মুষ্টিযুদ্ধ, অসিযুদ্ধ এবং সাঁতার। দারুণ সাঁতারু ছিল সে। অথবা জলযাত্রা – সে ছিল মাস্তুলের সামনে দাঁড়ানো নাবিক – আবার অনেকটা সময় যেত তার ঘুড়ি ওড়ানোতেও; ঘুড়ির ভালো সংগ্রহ ছিল তার কাছে। জোলার মত তার প্রথম প্রচেষ্টাগুলো ছিল কবিতা। নিঃসন্দেহে এটাই গোপন রহস্য ছিল তার গদ্যের মিলটনোচিত সারল্যের, যে কারণে সে নিজের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এবং সর্বোনএ শুদ্ধ ইংরেজি আর স্টাইলের স্বীকৃত মডেল হয়ে উঠেছে। কবিতা লিখতে সে হামেশাই চাইত, কিন্তু প্রবাদানুসারে কবিরা অনাহারে থাকে – যদিনা ভিন্ন কোনো উৎস থেকে আয় থাকে তাদের – তাই খ্যাতি আর ঐশ্বর্যপ্রাপ্তির দিনটি অব্দি কাব্যলেখন স্থগিত রইল। খ্যাতি আর ঐশ্বর্য সে পেল এবং তা সে ভোগও করল এক দশকেরও বেশি সময়, কিন্তু কবিতা লেখা স্থগিত রয়ে গেল, এবং নিজের কাছে করা এই শপথটা মনে পড়ার আগেই মৃত্যু এসে পড়ল। আরো অনেক কিছু তার মনে পড়ার আগেই এসে পড়ল মৃত্যু। এত কঠোরভাবে কাজে রত ছিল সে – এত করূণ, এত ট্র্যাজিক ছিল তার কাজে এই কঠোরতা এবং একটা স্থায়ী অভ্যাস হয়ে পড়েছিল এতদিনে – যে সে নিজের কথাগুলো ভুলে গেল, যে কথাগুলো আমাকে পাঠানো একটি চিঠিতে সে সেই সময় লিখেছিল যখন আমরা দুজনে বালক-বালিকা থেকে ইষৎ বড় ছিলামঃ

জানুয়ারি ১৮, ১৮৯২

“স্টিভেনসনের চিঠিগুলো পড়িনি কেননা – প্রিয় বালিকা! – যেদিন আমি ঠিকঠাক বৈজ্ঞানিক ভিত্তি অর্জন করে নেব আর ব্যাংকের একাউন্টে এক হাজার ডলার জমা হবে, যখন আমি সারাদিন চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ব, আর পড়ব, আর পড়ব, আর পড়ব…তখন আমার সাথে থাকার জন্য এস।
“তুমি যদি জানতে কিভাবে প্রলুব্ধ করে বই! এদিকে আমি স্পেন্সার আর হেকেল হাতুড়ি মেরে মাথায় ঢোকাই আর না-পড়া জিনিষগুলোর আনন্দ ভুলে থাকার চেষ্টা করি।”

সেই সময়টা এল যখন তার ব্যাংক একাউন্ট হল ১০০০ ডলারের, তাছাড়া বাৎসরিক ৬০,০০০ ডলারের ওপর হল সুনিশ্চিত আয়। কিন্তু কবি আর ছাত্রের সেই সহজ আর সুন্দর জীবনে ফিরে আসার যে স্বপ্ন ছিল তার সেটা আর হল না। যা সে পেল তার চরম মূল্য তাকে দিতে হল। তার সফলতাই তার জীবনের ট্র্যাজেডি ছিল। বাজারের দাবী মেটাতে সে বন্ধক রাখল নিজের মস্তিষ্ক, এবং ক্লান্তি ও অতি-উত্তেজনা তাকে নিয়ে গেল জন বার্লিকনের পথে আর ফলস্বরূপ সেই যন্ত্রণায় যাকে সে বলত ‘শ্বেত যুক্তি’। চুয়াল্লিশখানা বই সে লিখেছিল। মাঝেমধ্যে উচ্চতাজনিত ঘুর্ণিরোগ চেপে ধরত তাকে। কলমের মত এইটুকু ছোট্টো একটা উপকরণের শ্রমে কী করে বাঁচবে একজন বলবান, স্বাভাবিক মানুষ? পুরুষালী কাজের জন্য সে মুখিয়ে থাকত। নিজের ‘চাঁদের উপত্যকা’ চাষ করার বাসনা জন্মালো তার মনে। কলমের জোরে রোজগার করা অর্থ সে নিয়োগ করবে এক বিশাল কৃষি-গবেষণায়; উষর জমিকে সে উর্বর করে তুলবে। ফলাবে ইউক্যালিপ্টাস আর শুরু করবে অশ্বপালন। এক হিসেবে এগুলো সৃজনী উদ্যম ছিল কেননা যে গল্পগুলো এত বেশি পরিমাণে সে লিখছিল (বছরে চারটে করে বই) সেগুলোতে আর সেই সৃজনী প্রতিভার ছাপ ছিল না; তার মনে রাখার সময় ছিল না যে যে কলম এই বাজারে-মালগুলো লিখছে সেই কলমেই লেখা হয়েছিল ‘উত্তরের অভিযান’ আর ‘শ্বেত নৈঃশব্দ’র মত অমর সৌন্দর্যের ছোটোগল্প, ‘মার্টিন এডেন’ আর ‘বন্যের আহ্বান’এর মত মহান বই এবং ‘কেম্পটন-ওয়েস পত্রাবলী’ (যেটা আমরা দুজনে মিলে লিখেছিলাম) তে প্রকাশিত অতুলনীয় উজ্জ্বল প্রবন্ধগুলো।

তার অর্থরোজগারের ব্যাপারটা কোনো কুৎসিত লালসার মত ছিল না। ‘খেলা’ নামের বইটাতে সে পুরস্কারী লড়াকুর মানসিকতার ব্যাখ্যা করেছে যার কাছে ঘেরা (রিং) টা খেলার প্রতীক আর খোদ জীবনেরই উদ্দেশ্য। কলমের প্রচেষ্টায় অপরিমিত ধনী হওয়া তার কাছে ‘খেলাটা খেলা’র মত ছিল। আই.ডব্লিউ.ডব্লিউ.এর সদস্যদের, ‘পথ’এর কমরেডদের অথবা মেক্সিকোর বিপ্লবীদের প্রাসাদে আতিথ্য প্রদান তার পরিহাসবোধ ও নাট্যবোধকে তৃপ্তি দিত। তাদের কাছে সবচেয়ে ভালোটাও অতিরিক্ত ভালো ছিল না, কারোর জন্যই হয় না। গহ্বর যে তাকে শুধু গিলতে পারেনি তাই নয়, গহ্বর তার সাথে উপরে উঠে এসেছিল।

১৯০০ সালের ২১শে জানুয়ারি এই চিঠিটা সে ওকল্যান্ড থেকে লিখলঃ

“তুমি কি জানো, বন্ধু বানাবার এক মারাত্মক দক্ষতা আছে আমার, আর তাদের সাথে ঝগড়া করতে পারার ইশ্বরপ্রদত্ত গুণ আমার নেই। এবং প্রতিনিয়ত তারা আসছে। ফিরে আসতে থাকা সমস্ত ক্লন্ডাইক-যাত্রী, নাবিক অথবা ভাগ্যের সৈনিক, যাদের সাথে জীবনে কখনো হয়ত দেখা হয়নি তাদের সবার জন্য আমার বাড়িটা হল মক্কা। কোনোদিন আমি একটা প্রতিষ্ঠান তৈরি করব, তাদের সবাইকে নিমন্ত্রণ করে আনবো আর একে অন্যের বিরুদ্ধে খোলা লেলিয়ে দেব। জাত, ধর্ম আর চরিত্রের এমন খিচুড়ি দ্বিতীয়টি আর হবে না। বিধ্বংসটাও হবে জবরদস্ত।
“যাই হোক, নিজের স্বাধীনতায় আমি এত অত্যধিক আনন্দ অনুভব করছি যে মুর্খ হয়ে পড়ছি। যে পথ দিয়ে আমার সাথে দেখা করতে লোকেরা ঢুকে পড়ে সে পথে আমি গর্ত খুঁড়ে ফাঁস পেতে রাখব, আর আরো নানা জিনিষের মধ্যে সামনের দরজার ভিতরে একটা ম্যাক্সিম দ্রুত-গুলিছোঁড়া বন্দুক দাঁড় করাবো। আমার ফায়ারপ্লেসের পবিত্রতা অলঙ্ঘনীয় হবে। অথবা, যদি আমার হৃদয়টাই মুষড়ে পড়ে, আমি দুনিয়ার অন্য পিঠে পালিয়ে যাব।”

ঠিক এটাই সে ক্যালিফোর্নিয়ার সুন্দর সোনোমা উপত্যকায় গ্লেন অ্যালেনে করেছিল। পনেরো’শো একড় জমি দিয়ে ঘেরা একটা অট্টালিকা তৈরি করালো, অবারিত দ্বার, আর যখন হৃদয় মুষড়ে পড়ত, সে দুনিয়ার অন্য পিঠে ছুটে পালাতো। চলে যেত হাওয়াই এবং দক্ষিণ সমুদ্রের দ্বীপগুলোয়। দুনিয়া থেকে সাত বছর দূরে থাকার অভিপ্রায়ে হল তার ‘স্নার্ক’এ স্মরণীয় ও অসাধারণ সেই সমুদ্রাভিযান।

তার মত তীব্র অনুভুতিসম্পন্ন যুবকই এত গভীর ভাবে বুঝতে পারে সময়ের ফুরিয়ে যাওয়া, আর এত ব্যগ্র ভাবে মজুত করতে পারে দিনের প্রহরগুলো। খুব ছোট্টো ছিল জীবন। অনর্থক আলস্যে সময় নষ্ট করা উচিৎ নয় কারোর। এটাই ছিল তার বিশ্বাস। জীবনে অনেক কিছু দেখার সুযোগ সে পেয়েছিল। জনতার সন্তান ছিল সে আশৈশব, কিন্তু শৈশব তার ভাগ্যে জোটেনি। প্রথম থেকেই দেখেছে সংগ্রাম আর বাধ্য হয়েছে সংগ্রাম করতে। নিজেকে সে মনে করত “রূঢ়, কঠোর আর আপসহীন”। অবশ্যই সে তেমন ছিল না। শুধু কিছু বিভ্রম ছিল তার মনে, এবং গহ্বরে বা আরো নীচে সে যা কিছু দেখেছিল সেগুলো তার শৈশব ও যৌবনের সংবেদনশীল প্রকৃতিকে যন্ত্রণাবিদ্ধ করে রেখেছিল। এই যন্ত্রণা এবং যাকে বলা হয় সংগঠিত সমাজ কিন্তু বাস্তবে যা একটি বিশৃংখল অরণ্য, সেটির বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া হল তার বিশ্বদর্শনের বনিয়াদ।

নিচের অংশটি ১৮৯৯ সালের ২১ ডিসেম্বরে লেখা একটি চিঠি থেকে নেওয়াঃ

“জীবন খুব সংক্ষিপ্ত। বস্তুবাদ যে মানসিক অবসাদ নিয়ে আসে তার অভিব্যক্তি ফিটজেরাল্ডের ‘জলদি, হে!’ থেকে ভালো কিছু হতে পারে না। আলস্যে সময় কাটানো কারোরই উচিৎ নয়। আর তারপর, যদি আমাকে তুমি জানো, এই কথাটা বোঝোঃ আমিও একটি খামারে, না, ক্যালিফোর্নিয়ার এক পশুখামারে একজন স্বপ্নদর্শী ছিলাম। কিন্তু খুব ছেলেবেলায়, ন’বছর বয়সে, দুনিয়ার কঠিন হাত এসে আমায় ধরল। তারপর সে হাত আর কখনো ঢিলে হয়নি। সে হাত আমার মধ্যে আবেগটুকু রেখেছে কিন্তু আবেগপ্রবণতা ধ্বংস করেছে। আমাকে এতটাই প্র্যাক্টিক্যাল করেছে যে আমায় লোকে রূঢ়, কঠোর আর আপসহীন বলে। দুনিয়ার সে কঠিন হাত আমায় শিখিয়েছে যে কল্পনা থেকে যুক্তি বেশি শক্তিশালী, বিজ্ঞানধর্মী মানুষ ভাবপ্রবণ মানুষের থেকে উঁচুদরের। আবার জগৎ সম্পর্কে এক সত্যতর এবং গভীরতর রোমাঞ্চও দিয়েছে সে হাত, যে রোমাঞ্চ এক আদর্শবাদ, একটি অন্তর্গত আশ্রয় যেটি আমার নিজের লোকেদের সাথে লেনদেনের সময় দৃঢ়ভাবে রুদ্ধ করে রাখা আবশ্যক, কিন্তু অন্তরের পবিত্রতম স্থানে সেটি রয়েছে। আশ্রয়টি যেন এক দৈববাণী, লালন করি স্নেহভরে কিন্তু বাজারে গেলেই খুলে দেখাই না, সে বাণী গ্রহণও করি না। যদি করি, তাহলে আমার ওপর আমার সাথীদের উপহাস বর্ষিত হবে আর আমিও অকৃতকার্য হব। মোদ্দা কথা, যেখানে যেমন।”

অকৃত্রিমতা তার চরিত্রের সর্বপ্রধান বৈশিষ্ট ছিল। কখনো সে ছলনা করেনি। নিজের রচনা বা জীবন সে ফাঁকিতে ভরা তর্কের ওপর গড়েনি, এড়িয়েও যায়নি কোনোকিছু। সাহিত্যের যদি বাজার থাকে এবং তার দাম পাওয়া যায় আর যদি সে তার মস্তিষ্কের উৎপন্নগুলি বেচার জন্য সাজায়, তাহলে এমন ছল করার মত নীচে সে কখনো নামবে না যে সে পয়সার জন্য লিখছে না আর সে মানছে যে ‘শিল্পের জন্য শিল্প’। আবার, সমাজ যদি তাকে তার জিনিষের দাম হিসেবে প্রচুর না দেয় সেটাও তার সেই ‘যেখানে যেমন’এর সাথে মিলবে না। যদি নিজেকে বাজারের চাহিদা মত করেই থাকো তাহলে তোমায় অপরিহার্য হয়ে উঠতেই হবে। নিজের বিষয়ে যেমন সে দাবী করত যে সে ‘অর্থতান্ত্রিক মানুষ’ তেমনই, ঠান্ডা মাথায় সে নিজের লক্ষ্য সাধনে নেমে পড়ল। সে সময় মারী কোরেলি সম্ভবতঃ ধনার্জনের দিক থেকে সফলতম ঔপন্যাসিক ছিলেন। সে ভয় দেখালো যে সে তাঁর শিল্প অধ্যয়ন করে সেই গুণগুলো আবিষ্কার করবে যেগুলো তাঁর সাফল্য অনিবার্য করে তুলেছে আর সেসব সে নিজের মধ্যে গড়ে তুলবে। এসব কথা সে সোজাসুজি বলত এবং নিজের এই সংকল্প আর লক্ষ্যের কথা জানিয়ে বন্ধুদের চেঁচামেচি আর আক্রমণ ডেকে আনল। তারা অনেকেই তার থেকে বেশি ভালো করে এই কাজটা করতে লেগে পড়ল যারা বস্তুতঃ তার সংকল্পের দৃঢ়তায় ঈর্ষান্বিত ছিল।

নীচের চিঠিটা এর সাক্ষ্য বহন করেঃ

৯৬২, ইস্ট সিক্সটিন্থ স্ট্রীট,
ওকল্যান্ড, ক্যালিফোর্নিয়া,
ফেব্রুয়ারী ৩, ১৯০০

প্রিয় আনা,

“শনিবারের রাত, আর আমি ভালো বোধ করছি। শনিবারের রাত, আর প্রচুর কাজে ভরা একটা সপ্তাহ পুরো হল – ভাড়ার কাজ অবশ্যই। কেনই বা করব না? কপালের ঘাম পায়ে ফেলছি যে কোনো সৎ কারিগরের মত। এক বন্ধু আছে আমার যে এ ধরণের কাজকে ঘৃণা করে। সে উত্তরকালের জন্য লেখে, প্রশংসকদের একটা ছোট্টো দলের জন্য, সমাজের বিস্মৃতির প্রতি সে বিস্মৃত, পয়সা চায়না, পয়সার ভাবনাটাকেও উপহাস করে, নোংরা মনে করে, যারা পয়সার জন্য লেখে তাদের সবাইকে অভিশাপ দেয়, ইত্যাদি, ইত্যাদি, -- অর্থাৎ, সে নিজে বলে যে সে এমন। কিন্তু সদ্য তার একটি চিঠি পেয়েছি। ‘মুনসী’রা তার একটি গল্প কিনবে বলেছে যদি সে শেষটা পালটে দেয়। খুব যত্নের সাথে সে নিজের গল্পটি বুনেছিল। প্রত্যেকটি ভাবনা অন্তিম দৃশ্যের দিকে ধাবিত, যখন হিংসাজনিত মৃত্যু ঘটছে প্রধান চরিত্রের। এখন প্রকাশকেরা বলছে প্রধান চরিত্রটিকে, যে যুক্তিসংগত ভাবে মৃত, বাঁচিয়ে রাখতে। আমার লেখকবন্ধুটি পয়সাকে ঘৃণা করে। হ্যাঁ; আর সে চরিত্রটিকে বাঁচিয়ে রাখল! ‘আমার পতন হল’, নিজের আচরণের জন্য সে এটুকুই বলতে সম্মত।”

প্রচন্ড কাজের চাপ আর শিল্পকে পরিশ্রমের ব্যবসায় বদলে দেওয়ার স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া শুরু হল। একটি অত্যন্ত উদারপ্রকৃতির মানুষ মাঝে মধ্যেই ডুবে যেতে লাগল শিল্পসংস্কৃতি-সাহিত্য-জগতের প্রতি ঘৃণায় – সফলতার সাথে ঘিরে ধরা চাটুকারিতায় ক্ষুব্ধ হয়ে উঠল তার সত্তা। এই মানুষগুলো, যারা আজ তার স্তাবকতা করছে, সে ‘আবিষ্কৃত’ হওয়ার আগে তো কই দেখতে পায়নি কী ছিল তার ভিতরে! তার একটা গল্পের জন্য সে ওভারল্যান্ড মান্থলি  থেকে পাঁচ ডলার পেয়েছিল আর কেউ সে গল্পটির প্রশংসা করেনি। যখন বই হয়ে বেরুলো, হঠাৎ সে গল্পটি বিখ্যাত হয়ে উঠল। তাই মানুষের প্রশংসা আর দয়ালুতাকে সে হাল্কা ভাবে নিত। এক মানসিক অবসাদে তার মনে শুধু এই দুনিয়া নয়, জীবনেরও মূল্য সম্পর্কে প্রশ্ন জাগত। এত কিছু পাওয়ার পর সে আবিষ্কার করল যে সে সমস্ত মিথ্যে। কোনোকিছুরই অন্তর্নিহিত কোনো মূল্য নেই। বিষাদরোগে ভুগত সে। আত্মহননের ভাবনায় ডুবে যেত। একটা সময় ছিল যখন টলস্টয়ের মত সেও টেবিলের ওপর গুলিভরা রিভলবার রাখত – যেকোনো সময় নিজের ওপর ব্যবহার করতে প্রস্তুত।

জানুয়ারি ৫, ১৯০২

“নিজের স্মৃতিপথে তাকাই, সকাল একটায়, যে চেহারাগুলো দেখেছিলাম সব পান্ডুর আর সতৃষ্ণ হয়ে ওঠে – তোমার মনে পড়ে? অথবা, তুমি কি লক্ষ্য করেছ? – এবং আমি অবাক হই কিসের এত আলোড়ন?

“গতকাল ‘ক্যানভাসব্যাক’ হাঁস আর ‘টেরাপিন’ কচ্ছপের মাংসে আহার সেরেছি। হৃদয় ও মস্তিষ্ক উষ্ণ করছিল ঝলমলে শ্যাম্পেন আর আরো সব বিস্ময়কর পানীয় যার স্বাদ আগে কখনো আমি পাইনি। যৌবনের দিনের সেই রাতভর মদ্যপান আর নোংরা হুল্লোড় মনে পড়ছিল। ছেঁড়াখোঁড়া জামাকাপড় পরা, ভদ্র আচরণ না জানা জন্তু ছিলাম আমরা, গলাধঃকরণ করতাম সস্তা, তুচ্ছ আর বমি পাওয়ানো পানীয়। তারপর আমি স্বপ্ন দেখলাম, আর ওই এঁটেল কাদা থেকে নিজেকে টেনে উপরে তুলে ক্যানভাসব্যাক আর টেরাপিন আর শ্যাম্পেন অব্দি পৌঁছোলাম, পৌঁছে জানলাম যে গাঁজে যে তফাৎ আনে শিল্প সেটা শুধু পরিমাণগত।”

ছাব্বিশ বছর বয়স থেকে সে নিজের চিঠির নীচে “ইতি, বিপ্লবের জন্য তোমার” লিখে সই করতে শুরু করল। এই দেশে এবং সমুদ্রপারে অন্যান্য দেশগুলোয় হাজার হাজার মানুষ লুফে নিল এই বাক্যাংশ। প্রথম যৌবন থেকে সে বিপ্লবের সেবায় রত ছিল। পথসভায় সে সমাজবাদের কথা বলত এবং স্থানীয় এলাকায় রবিবার রাতের বৈঠকগুলোয় বক্তৃতা দিত। মেয়রের জন্য আর বিদ্যালয় পরিচালকের জন্য সে নিজের নাম সমাজবাদী রাজনৈতিক টিকিটে থাকতে দিয়েছিল। যখন খ্যাতি পেল তখন সে দেশের পূর্বদিকে এসে সমাজবাদী বিষয়ে ভাষণ দিয়ে বেড়াত।

১২ই ফেব্রুয়ারী, ১৯০৮এ লেখা চিঠিতে সে লিখছেঃ

“চার মাস বক্তৃতা দিয়ে ফিরলাম। শুকনো হাড়গুলো একটু বাজালাম। ইয়েল, হার্ভার্ড, কলাম্বিয়া আর শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে বললাম। এছাড়া সোশ্যালিস্ট পার্টির জন্য আরো অনেক বক্তৃতা। (বিপ্লববাদী ছিল সে) “মাথার ওপর সমাজের যে বিরাট ইমারতখানা আছে তা আমায় বিন্দু মাত্র আনন্দ দেয় না। ইমারতের ভিতটা আমার বেশি ঔৎসুক্য জাগায়। ওখানেই পরিতৃপ্ত থাকি আমি, শ্রম করি, হাতে থাকে শাবল, কাঁধে কাঁধ মেলাই বুদ্ধিজীবী, আদর্শবাদী এবং শ্রেণীসচেতন শ্রমিকদের সাথে, মাঝেমধ্যে চাক্ষুষ দেখি ভিতরের ব্যাপার-স্যাপার আর নাড়িয়ে দিই পুরো ইমারৎটাকে। কোনো দিন, যেদিন কিছু আরো হাত আর শাবল পাবো কাজে, উল্টে দেব পচা জীবন আর গোর-না-দেওয়া মড়ায় ভরা ওই ইমারৎ। শেষ করে দেব এই বীভৎস স্বার্থপরতা আর একঘেয়ে বস্তুবাদ। তারপর আমরা সাফসুথরো করব মাটির নিচের কুঠরিটাকে আর নতুন বাসস্থান তৈরি করব মানুষের, যার প্রত্যেকটি ঘর হবে আলোবাতাস ভরা, যে হাওয়ায় নিঃশ্বাস নেব সেটি হবে পরিষ্কার, মহৎ আর জীবন্ত।”

ওদিকে রাশিয়ায় ওরা উল্টে দিয়েছে ইমারৎখানা, অথচ দুঃখ এটাই যে জ্যাক লন্ডন নীরব, মুক্ত জনতার শীর্ষে আন্দোলিত রক্তপতাকা সে দেখতে পাবেনা আর, আন্তর্জাতিক গেয়ে ওঠা লক্ষ লক্ষ মানবকন্ঠ তাকে আর সাথে পাবে না।

ইওরোপে প্রথম যাত্রাকালে লন্ডনের বস্তির গল্প লিখেছিল সে, “গহ্বরের জনতা”। প্রকাশকদের সাথে দেখা করতেও সে যায় নি। নিজেকে নিরুদ্দেশ করে হারিয়ে দিয়েছিল মানুষের দুর্দশার গহ্বরে। যার ফলে আমরা পেলাম আমাদের সময়ের আধুনিক সমাজের বিরুদ্ধে কঠোরতম অভিযোগপত্র, সমাজবৈজ্ঞানিক ধাঁচে লেখা একটি নতুন “লা মিজারেব্‌ল”। এটা লিখতে, বস্তিবাসী হিসেবে বসবাস করতে সে নিজেকে বাধ্য করেছিল। নিজের অর্থসম্পদ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে রাস্তায় ঘুরে বেড়াতো রোজগারের খোঁজে - ক্ষুধার্ত, গৃহহীন।

লন্ডন, আগস্ট ২৫, ১৯০২

“শনিবার সারারাত আমি গৃহহারাদের সাথে বাইরে কাটালাম, তিক্ত বর্ষণে হেঁটে বেড়ালাম রাস্তায় রাস্তায়, গায়ের চামড়া অব্দি ভেজা, ভোর হওয়ার প্রতীক্ষায় রইলাম। রবিবার সারাটা দিন গৃহহারাদের সাথে কিছু খেতে পাওয়ার নিষ্ঠুর সংগ্রামে কাটালাম। ঘরে ফিরলাম রবিবার সন্ধ্যায়, ছত্রিশ ঘন্টা লাগাতার কাজ আর একরাতের ছোট্টো ঘুমের পর। আজ ৪০০০ শব্দের কিছু বেশি লিখলাম, টাইপ করলাম আর সংশোধন করলাম। এক্ষুনি শেষ করেছি। সকাল [আমাদের হিসেবে রাত – অনু] একটা বাজছে। যা দেখেছি এবং যে যন্ত্রণা ভোগ করেছি তার ফলে আমি এখন শ্রান্ত, নিঃশেষিত আর আমার স্নায়ুগুলো ভোঁতা হয়ে পড়েছে।”

এবং আবারঃ
“লন্ডন শহর নামে পরিচিত মানব-নরকের এই গর্ত আমায় অসুস্থ করে তুলেছে।”

সামাজিক প্রজ্ঞা তার ছিল। শ্রেণীসংগ্রামটা সে বুঝত এবং জনতার আন্তর্জাতিক সংগঠনে তার আস্থা ছিল। সে বুঝত যে বিবর্তনে আমাদের আজকের আন্তর্জাতিক মানবতার একটিই শত্রু – আন্তর্জাতিক পূঁজিবাদ, এবং বুঝত যে সমাজের আর্থিক ও সামাজিক শক্তিগুলো জনতার মনে স্পষ্ট করে তুলছে এই সত্যটা আর তাদের হাতে অস্ত্র যোগাচ্ছে যাতে তারা সফল ভাবে এই শত্রুর মোকাবিলা করতে পারে। সমাজ একটি যুদ্ধক্ষেত্র যেখানে জনতার শক্তিসমূহ জনতার শোষক ও উৎপীড়কদের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত। তার স্থান ছিল জনতার মাঝে। তার সফলতা এবং তার প্রতিভা তাকে বিপ্লবী অস্ত্র হাতে তোলা থেকে অব্যাহতি দেয়নি। সেগুলো শুধু প্রমাণ করছে সামাজিক গণতন্ত্রের মূল সত্য, পরিবেশের শক্তি আর রক্ত ও কুলীনতার সাজানো গল্পটাকে। বিশ্বের শক্তিশালীদের সামনে দাঁড়িয়ে ভয়ে অভিভূত না হওয়ার মত বিশ্বাস, দৃষ্টি আর সাহস তার ছিল।

আর.এম.এস. ম্যাজেস্টিক   
জুলাই ৩১, ১৯০২

“গতকাল দুপুরে নিউইয়র্ক থেকে সমুদ্রযাত্রা শুরু করলাম। এক সপ্তাহ পর লন্ডনে পৌঁছব। তারপর দুদিন থাকবে যার মধ্যে আমায় নিরুদ্দেশে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে যাতে লন্ডনের পশুদের দিক থেকে আমি দেখতে পারি রাজ্যাভিষেক। তাদের পশু ছাড়া আর কিছু বলা যায়না, যদি নিউইয়র্কের বস্তির মানুষের সাথে তাদের তুলনা করা যায়, এমন পশু যাদের মধ্যে এখানে ওখানে ইশ্বরত্বের বিদ্যুৎচমক দেখা যায়।
“দুনিয়াদার মানুষদের আমি দেখি পুলম্যান রেলকামরায়, নিউইয়র্ক ক্লাবে আর অ্যাটলান্টিক লাইনারের ধুম্রপান-কামরাগুলোয় এবং সত্যি বলতে, কাজ করতে থাকা শক্তিগুলো সম্পর্কে ওদের অজ্ঞান আর অবুঝপনা দেখে আমাদের উদ্দেশ্য আমায় আরো আশান্বিত করে। শ্রমিকদের প্রতি তারা তিক্ত, তিক্ততর হয়ে চলেছে। অন্যদিকে ঘনিয়ে আসতে থাকা বিপ্লব সম্পর্কে তারা পরমসুখে অজ্ঞান। তুমি দেখ, শ্রমিকদের বাড়তে থাকা সামর্থ্য তাদের আঘাত করছে, তাদেরকে তিক্ত করে তুলছে তবুও চোখ তাদের খুলছেনা।”

একটা প্রবন্ধ লিখেছিল সে – “আমার জন্য জীবনের অর্থ কী”। ক্রোপোটকিনের “যুবদের প্রতি আপীল” এবং অস্কার ওয়াইল্ডের “সমাজবাদে মানুষের আত্মার স্বরূপ”এর সাথে লেখাটির তুলনা করা যেতে পারে। লেখাটির শেষ পংক্তিতে সাধারণ মানুষের উত্থানের প্রতি বিশ্বাস ধ্বনিত হয়ে ওঠে, “সময়ের সিঁড়ি বেয়ে চিরকাল কাঠের জুতোর উঠতে থাকা আর পালিশকরা বুটের নামতে থাকা প্রতিধ্বনিত হতে থাকে”।

জ্যাক লন্ডনের মত এত যুবক একজনের যৌবন সম্পর্কে লিখতে গিয়ে বস্তুতঃ একটা কঠিন অথচ বিস্ময়কর ব্যাপারকে ধরতে চেষ্টা করছি আমি। তার বিষয়ে বলতে গেলে ভাবনা নয় অনুভুতির দিক থেকে বলতে হয় এবং তার নিজের থেকে বেশি আর কেউ জানেনা যে সেটা কত কঠিন। আমি তার একটি চিঠি থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছিঃ

৯৬২ ইস্ট সিক্সটিন্থ স্ট্রীট,
ওকল্যান্ড, ক্যালিফোর্নিয়া, ডিসেম্বর ২৭, ১৮৯৯।

“ভাবুকরা অভিব্যক্তির অভাবে ভোগেনা। তাদের ভাবনাই তাদের অভিব্যক্তি। অনুভুতিওয়ালা মানুষেরা ভোগে। বিশ্বে সবচেয়ে কঠিন কাজ হল অনুভুতি, গভীর অনুভুতিকে শব্দে ব্যক্ত করা। অভিব্যক্তির দিক থেকে বলতে গেলে, চার ভল্যুমে ‘দাস ক্যাপিট্যাল’ লেখা অতগুলোই স্তবকের সাদাসিধে একটি গীতিকবিতা লেখার থেকে সহজ।”

নিজের শরীরের সামর্থ্য নিয়ে সে গর্ব করত। সে একজন আদর্শবাদী ছিল কিন্তু তার কোনো বিভ্রান্তি ছিল না। সত্য ও ন্যায়ের প্রতি অতিশয় আগ্রহ ছিল, কিন্তু সেদুটো খুব কম দেখতে পেত চারপাশে। মানবতার উদ্দেশে উৎসর্গিত এক ব্যক্তিবাদী ছিল সে। যতদিন ছিল তার জীবন, সত্যের আবরণ উন্মোচিত করা ছিল তার কাজ। সমাজের যাকিছু মন্দ আর অন্যায়, তার বিরুদ্ধে সে ছিল জীবন্ত প্রতিবাদ।

৯৬২ ইস্ট সিক্সটিন্থ স্ট্রীট,
জানুয়ারি ১১, ১৯০০

“আমার ভিতরে যা কিছু সবচেয়ে মহৎ আর ভালো ছিল সব পিটিয়ে বার করে দেওয়া হয়েছিল। আমার জীবনটা তুমি জানো। কোনো জাহাজের, তাড়াহুড়োয় আঁকা অগ্রভাগ[ফোরক্যাস্‌ল]এর ছবির মত। বিচলিত ছিলাম। ছায়ার পিছনে হাতড়াচ্ছিলাম, ঠাট্টা করছিলাম, অবিশ্বাস করছিলাম, অনেক সময় মিথ্যেটাকেই চেপে ধরছিলাম বুকে, সবরকম সন্দেহ যেটা বিশ্বাস করার দিকে উন্মুখ করছিল সেটাকেও সন্দেহ করছিলাম। এবং সবচেয়ে বড় কথা, তৃষ্ণার্ত ছিলাম। ঘাড় শক্ত করে, নিজের শরীরের সামর্থ্য নিয়ে গর্ব করতাম, আশা থাকত যে পরিষ্কার জল উপচে বেরোবে। কিন্তু বেরোয়নি, কেননা যা করছিলাম সেটা বর্বরতা ছিল।”   

কী ছিল তার এই “শরীরের সামর্থ্য” যা নিয়ে সেই দিনগুলোয় এত গর্ব করত সে? সে যুদ্ধের পক্ষে থাকত। তার যুক্তি ছিল যে, যে সমাজের আইন মৃত্যুদন্ড বিধান করে সে সমাজ থেকে যতদিন আমরা পুলিসের সাহায্য আর রাস্তার আলো স্বীকার করব ততদিন মৃত্যুদন্ডের প্রতিবাদ করার কোনো অধিকার নেই আমাদের। সে সময় সে বলে বেড়াত যে অ্যাংলোস্যাক্সন মানুষেরা পৃথিবীর নুন আর বিশ্বাস করত যে কিছু জাতি নিকৃষ্ট। পুরুষের তুলনায় নারীর জৈববৈজ্ঞানিক নিকৃষ্টতায় বিশ্বাস করার দিকে তার ঝোঁক ছিল, কেননা যদি না পরে সে নারীপুরুষদের একসাথে পীডমন্ট স্নানাগারে না দেখে থাকত আর সুইমিং পুলের কিনারে নারীদের “ইশ্বরের নীচে সোজা না দাঁড়িয়ে” কাঁপুনি না দেখে থাকত, সে বিশ্বাস করত যে অধিকার শক্তি দেয়। সে সভ্যতা থেকে দূরে পালিয়ে বেড়াত এবং নিয়ম করে এড়িয়ে থাকত। মৃত্যুর প্রতি তার মনোভাব ছিল বর্বরোচিত, অদৃষ্টের প্রতি সম্পূর্ণ উদাসীন, যে কোনো সময় যেতে প্রস্তুত। তার মত ছিল যে প্রেম, ব্যক্তির জন্য প্রকৃতির পেতে রাখা একটি ফাঁদ। ভালোবাসার জন্য নয়, বিয়ে করা উচিত বোধনির্ণিত কিছু গুণের জন্য। এই নিয়েই সে তর্ক করেছিল “কেম্পটন-ওয়েস পত্রাবলী”তে। সেও আবার এত বেশি আবেগের সাথে যে সন্দেহ হবে, যতটা সে দাবী করছে ততটা নিশ্চিত সে নয়। পরবর্তীকালে, জ্যাক হল সবচেয়ে নরম ভাবুকদের একজন, ঠিক ততটাই আবেগের সাথে নিজের নতুন ভাবনাগুলো চাউর করতে শুরু করল, যতটা আবেগের সাথে আগে সে ওই সব ভাবনাকে আক্রমণ করেছিল। সে এখন রোমান্টিক প্রেমে বিশ্বাস করতে শুরু করল, নারীদের ভোটাধিকারের আন্দোলনকে সাহায্য করল এবং ক্যালিফোর্নিয়ায় এই আন্দোলনের সফলতায় উল্লসিত হয়ে উঠেছিল। এখন সে হল পুরোপুরি আন্তর্জাতিকতাবাদী এবং সৈন্যবাদ-বিরোধী। সে এখন নিজের নিয়ে ঠাট্টা করত যে কীভাবে সে রুশ-জাপান যুদ্ধে রুশের দিকে ছিল যখন নাকি পুরো সমাজবাদী আন্দোলন বিপ্লবী আন্দোলনের স্বার্থে রুশের পরাজয় চাইছিল। কেননা সে সময় তার নজরে রুশীয়রা সাদামানুষ ছিল, জাপানীরা ছিলনা। একটা আহত রুশীয় পা দেখে সে “স্বজাতিচেতনা” অনুভব করেছিল কেননা পা’টা তার পায়ের মত সাদা ছিল। মৃত্যুদন্ডের বিরুদ্ধে তার ঘৃণা হল তার সবচেয়ে উচ্চাকাঙ্খী বই “দ্য স্টার রোভার”এর বিষয়বস্তু, আর উত্তেজনার জন্য উত্তেজনায় তার বিগত দিনের বিশ্বাসটাকে, যার জন্য সে নিজের ওপর মদ আর নেশার ওষুধের পরীক্ষা চালিয়েছিল, কালজয়ী “জন বার্লিকন”এ সে খন্ডন করল। সে অনেক দূরে চলে এসেছিল – যেগুলোর সাথে আগে তার সম্পর্ক ছিল সেই সমস্ত ধারণার বিপরীত দিকে সে বেরিয়ে এসেছিল, এবং যারা তাকে জানত তাদের সবার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে সে আসবেই।

আমি তাকে ছবিগুলোয় দেখিঃ এক হাতে নিজের বাগান থেকে সদ্য তোলা এক গোছা হলদে গোলাপ আর অন্য হাতে সাইকেলের হাতল ধরে আসছে, গাঢ় বাদামী চুলের ওপর টুপিটা পিছন দিকে হেলান, দুনিয়ার দিকে নক্ষত্রের মত বড় বড় নীল দুটো চোখ পাতার দীর্ঘ লোমের ভিতর দিয়ে দৃষ্টি মেলে আছে – অবর্ণনীয় সুন্দর আর পুরুষোচিত একটি ছেলে যার অভিব্যক্তির প্রজ্ঞা আর দয়ালুতা যৌবনকে আড়াল করে রাখে।

আমি তাকে দেখি পপির মধ্যে মুখ ডুবিয়ে শুয়ে আছে আর দুচোখের দৃষ্টি, তার বড় প্রিয় দৈত্যাকৃতি ইউক্যালিপটাস আর সেকোইয়ার চুড়োগুলো পেরিয়ে ক্যালিফোর্নিয়ার উঁচু নীল আকাশে উড়তে থাকা নিজের ঘুড়িগুলোকে অনুসরণ করছে।

আমি তাকে দেখি শান্ত, “দ্য স্প্রে”র ওপর - চাঁদ আমাদের পিছনে উঠছে - আর শুনি, আগের রাত জেগে পড়া স্পেন্সার আর ডারউইন থেকে করা তার সাধারনীকরণগুলো সে আওড়াচ্ছে। তার সমস্ত গতিবিধি এবং জীবনের প্রত্যেকটি খুঁটিনাটিকে এক মুগ্ধকর আকর্ষণে ভরে দিত তার ব্যক্তিত্ব। যখন শুরুর দিনগুলোয়, বিশ্বের ওপর নিজের ছাপ ফেলতে সে তার অতুলনীয় উদ্যমীশক্তি নিয়ে সংগ্রামে রত ছিল, তখনও সবাই তার প্রতিভা সহজাত বলে মানত।

আমি তাকে দেখতে পাই, রাত শেষ হওয়ার আগেই সে নিজের কাজে বসেছে, আর আমার মনে হয় যে ভোর তাকে অভিনন্দন জানিয়ে আলিঙ্গন করছে, এবং সে প্রকৃতির অন্যান্য, কম শ্রেণীগত পদার্থসমূহ থেকে বেশি মৌল-তত্ত্বগুলোর অংশ। মে মাসের সকালে আমি তাকে দেখি হানিসাক্‌ল পুষ্পলতা জড়ানো থামওয়ালা একটা বারান্দার রেলিং থেকে ঝুঁকে, প্রণয়ের হর্ষমদিরতায় একে অন্যের পিছু পিছু ঘুরতে থাকা দুটো হামিং পাখির দিকে চেয়ে আছে। সৌন্দর্যের বন্দী ছিল সে – পাখি আর নিকুঞ্জের, সমুদ্র আর আকাশের আর আর্কটিক জগতের বরফশীতল বিশালতার। রিচার্ড হোভে তাঁর “হিউম্যান ড্রিফ্‌ট” শীর্ষক প্রবন্ধে তাঁর বিশ্বদর্শনের সারসংক্ষেপ যে পংক্তিটি দিয়ে শেষ করেছিলেন, “দেখ, আমি বেঁচেছি!”, জ্যাক ছাড়া অন্য কেউ এত সত্য ভাবে এই কথাটি প্রতিধ্বনিত করতে পারবে না।
“দেখ, আমি বেঁচেছি!”

সে শুধু পৃথিবীর বিশাল প্রান্তরে, মকররেখীয় সূর্যালোকে আর শ্বেত হিমায়িত নৈঃশব্দে, পৃথিবীর সুখে আর দুর্দশায় বেঁচে থাকা শিশুদের সাথে বাঁচেনি, সে সবসময় জীবন ও মৃত্যুর ভাবনায় বেঁচেছে, আন্তর্জাতিক সমাজবাদের কালজয়ী ও সীমাহীন সংগ্রামে বেঁচেছে।
উৎসঃ দ্য মাসেস, জুলাই ১৯১৭ 
-------------------------------------------------------------------------------------------------------
আন্না স্ট্রান্সকির জন্ম হয়েছিল ১৮৭৮ সালের ২১শে মার্চ, রাশিয়ার ব্যাবিনোৎজে। তার পিতামাতা ছিলেন পুরোনো রাশিয়ার র‍্যাডিক্যালপন্থী মানুষ। আন্না তাঁদের সঙ্গে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রান্সিস্কো শহরে চলে আসে এবং সেখানেই শিক্ষা লাভ করে। সামাজিক সমস্যাবলী, সাহিত্য এবং শ্রমিক আন্দোলনের সাথে জীবন্ত যোগসুত্র ছিল।
 আন্না এবং তার পরিবার, তার এক ভাই ডঃ ম্যাক্স স্ট্রান্সকির বাড়িতে থাকত। আন্না এবং তার বোন রোজ, ক্যালিফোর্নিয়ার তরুণ লেখক ও শিল্পীদের একটি র‍্যাডিক্যালপন্থী দলের সদস্য ছিল। সেই দলেই ছিলেন জ্যাক লন্ডন, জিম হোয়াইটেকার, জর্জ স্টার্লিং এবং আর অনেকে। শতাব্দীবদলের সময় সানফ্রান্সিস্কো শহরে যে বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় বিকশিত হয়েছিল স্ট্রান্সকি বোনেরা তার নেতৃত্বে ছিল।

জ্যাক এবং আন্না উপসাগর এলাকার সমাজবাদীদের গতিবিধির নিয়মিত অংশীদার ছিল। খুব ভালো বন্ধু ছিল তারা এবং প্রথম দিকে একে অন্যকে কখনো রোমান্টিক ভাবে দেখেনি। একই ধরণের ভাবনা এবং স্বপ্নপ্রবণ দুই উচ্চ মেধাসম্পন্ন চিত্তের সম্পর্ক ছিল তাদের। জ্যাক লন্ডনের জীবনে আন্না স্ট্রান্সকির শক্তিশালী প্রভাব ছিল। ১৯০২ সালের কিছুটা সময় ছাড়া, যখন জ্যাক আন্নার ভালোবাসায় পড়েছিল, তারা খুব কাছের বন্ধু ছিল। আন্না নিজে কখনো জ্যাকের প্রেমে পড়েনি, কিন্তু জ্যাকের জন্য গভীরতম শ্রদ্ধা ছিল তার মনে।

১৯০০ সালের শেষ দিকে, প্রেমের প্রকৃতি নিয়ে তাদের চিঠিপত্র, “দ্য কেম্পটন-ওয়েস লেটার্স” নামে বইটির জন্ম দিল। বইটিতে জ্যাক, হার্বার্ট ওয়েস নামে, জীববিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গী থেকে আর আন্না, ডেইন কেম্পটন নামে, আদর্শগত ও আবেগগত দিক থেকে প্রেম নিয়ে আলোচনা করেছে। ১৯০৩ সালে বইটি প্রকাশিত হয়েছিল, এবং এখনও সম্পূর্ণ প্রেম-সাহিত্যে সবচেয়ে বেশি কৌতুহলোদ্দীপক এবং অদ্ভুত বইগুলোর একটি।

                                                     উৎসঃ রুস কিংম্যান, পিক্টোরিয়াল লাইফ অফ জ্যাক লন্ডন (১৯৭৯)
(বাংলা অনুবাদঃ বিদ্যুৎ পাল)      
Source: http://www.jacklondons.net/annastrunskymemoirs

समाजवादी आदर्शबोध का कोई विकल्प नहीं - विनय कोनार

पुराने युग के श्रेष्ठ जिन सन्तानों ने पूंजीवादी व्यवस्था की नि:सारता को समझते हुये देश में समाजवाद के बीज बोये थे, लगभग वे सभी शासकवर्ग के हमलों के फलस्वरूप या प्रकृति के नियम के अनुसार धरती से गुजर चुके हैं । पिछली सदी के तीसरे एवं चौथे दशक के पूर्वार्द्ध में आंधी-तूफानों के बीच अपने वक्ष में आदर्शवाद का दीप जलाये जिन लोगों ने यात्रा शुरू की थी उनमें से जो आज भी हमारे वक्त में जीवित हैं स्वाभाविक तौर पर वे बुढ़ापे से पीड़ित हैं, गति धीमी हो चुकी है । चौथे दशक के उत्तरार्द्ध में एवं उसके बाद दूसरी पीढ़ी के जो कॉमरेड नेतृत्व में आये थे उनमें से भी कई लोग विदा ले चुके हैं या विदाई की घन्टी सुनने लगे हैं । छठे दशक या सातवें दशक के पूर्वार्द्ध के जो कॉमरेड हत्यारों के वार से बच निकले और ज़िन्दा हैं उनके ही एक बड़े हिस्से से राज्य एवं जिला नेतृत्व के सूनेपन की भरपाई हो पाई है । लेकिन सूनापन बढ़ रहा है; उपर के स्तर पर प्रकट न भी हुआ हो अभी पर जोन एवं स्थानीय स्तर पर दिखने लगा है ।  पिछले पचीस वर्षों में पार्टी की सदस्यता में कई गुणा वृद्धि हुई है । लेकिन हमारी यह व्यर्थता है कि नई पीढ़ी के इन सहकर्मियों के गुणात्मक दर्जे को हम आशा के अनुरूप विकसित नहीं कर पाये हैं । गुणात्मक दर्जे का फर्क मेधा की कसौटी पर नहीं, लेकिन आदर्शबोध की कसौटी पर कमी रह जा रही है ।    
कुछेक अपवादों के बावजूद अगली पीढ़ी के कॉमरेड शायद पूर्वजों की उँचाई को नहीं छू पायेंगे, लेकिन वह कोई विस्मय या चिंता का कारण नहीं होगा । इतिहास के क्रांतिकारी शिविर में प्रतिभायें समय के साथ एक ही लय में नहीं आते हैं – आते हैं युगसन्धिकाल में, झोंकों में । किसी भी सिद्धांत की तरह क्रांतिकारी सिद्धांत भी सोच-विचार का फसल है, बुद्धिजीवियों का दान है । पुरानी व्यवस्था जब समाज को जर्जर कर देती है, नियमों का अनुशासन एवं लय जब टुटने लगता है, निरन्तर अनिश्चयता एवं उद्विग्नता जब समाज को भीतर से कुरेदती रहती है तब समाज में चेतना के हलकों में अनेकों प्रश्न, अनेकों जिज्ञासायें एवं नये रास्ते के लिये अकुलाहट उभरने लगते हैं । इसके कारण चेतना की दुनिया आलोड़ित होती है, जन्म लेती हैं नई प्रतिभायें, नये सिद्धांत । यह कहने की जरूरत नहीं कि ये बुद्धिजीवी आ पाते हैं मुख्यत: शारीरिक श्रम से मुक्त सम्पत्तिवान वर्ग के घरों से ही । योरप के नवजागरणकाल में एवं भारत में खास कर बंगाल में ऐसे लोग उस युग की मांग के अनुसार आये थे । इतिहास की अन्धी ताकत के तौर पर अंग्रेज सरकार ने अपनी जरूरत से जिस रौशन-खयाल मध्यवर्ग का जन्म दिया था उन्ही में से, राष्ट्रीय अपमान से मुक्ति की आकांक्षा में आतुर मुट्ठीभर ऊँचे दर्जे के बुद्धिजीवी मज़दूरवर्ग के आदर्शों के द्वारा निर्देशित साम्राज्यवाद-विरोधी संग्राम की लौ के स्पर्श से प्रेरित होकर कम्युनिस्ट पार्टी के गठन के कार्य में खुद को समर्पित किये । देश की स्वतंत्रताप्राप्ति के उपरांत जब पूंजीपतिवर्ग सत्ता में आया तो नये उभर कर आये वुद्धिजीवियों के एक अच्छे-खासे हिस्से के सामने नई परिस्थितियों में खुद को उन्नत करने की सम्भावनायें पसरीं । आज साम्राज्यवादी वैश्वीकरण के जमाने में भले ही देश संकट में हो, साम्राज्यवादी देशों की तूलना में फटेहाल हमारी मेधाशक्ति का उपरी हिस्सा खुद को बेचने के लिये बाजार पाने के स्वप्न में मशगूल हैं; बिकने की कीमत उन साम्राज्यवादी देशों की तूलना में काफी कम होते हुये भारत के हिसाब से अच्छी है । फिर, असीमित ताकत से लैस आत्मकेन्द्रिक विकृत भोगवाद का अश्लील प्रभाव भी है । लेकिन हर बीमारी की एक सीमा है जिसके बाद उसके निदान का रास्ता उजागर होता है । मार्क्सवादी विश्लेषण की यही सिखाता है कि आत्मकेन्द्रिक विलासिता का यह रंगीन स्वप्न लम्बे समय तक नहीं रहेगा । आत्मघाती आत्मकेन्द्रिक प्रतिस्पर्धा में विश्वपूंजी के आगे घुटने टेकने बजाय एकजुट होकर खड़ा होगा आदमी, क्रांतिकारी खेमें में शामिल होगी नई मेधाशक्ति । लेकिन प्रतिभा बड़ा सवाल नहीं है, व्यक्तिप्रतिभा की कमी को मिलेजुले प्रयासों के द्वारा लांघा जा सकता है । समस्या तब होती है जब कमी आदर्शबोध की होती है ।
कभी कभी इस किस्म का खयाल दिमाग में आता है कि पार्टी के सामने कोई पर्सपेक्टिव यानि बुनियादी लक्ष्य की ओर चलने के पथ पर आशु संभावनामय कोई कालखंड नहीं है । देश में विभिन्न जगहों पर हमारी इच्छा के अनुरूप पार्टी का विस्तार नहीं हो पा रहा है, एक ही जगह पर अटकी हुई पश्चिम बंगाल में वही एक ही वाममोर्चे को बचाये के कार्यभार की पुनरावृत्ति1 कॉमरेडों को क्लांत कर रहा है और यही वाधक बन रहा है कार्यकर्त्ताओं के लिये । वाधक बन रहा है आत्म-अनुशासन से खुद को उन्नत करने में, एकाग्रचित्त एवं निष्ठावान बनने में और इसी से गैर-कम्युनिस्ट रुझानें पैदा हो रही हैं । आशु सम्भावना का गाजर लटका कर उन्नत कम्युनिस्ट का निर्माण हो सकता है ऐसा सोचना भ्रांत और खतरनाक होगा; समस्या को हलका दिखाने की कुचेष्टा मात्र होगी । विश्व के महानतम प्रतिभाओं में प्रमुख कार्ल मार्क्स जब जीवन के गहरे दुख-तकलीफों के बीच भी दोस्त व सहकर्मी कॉमरेड एंगेल्स के सहयोग से प्रकृतिविज्ञान की अद्यतन अग्रगति एवं मानवसमाज के वर्त्तमान व अतीत अन्तर्विरोध व विकास के इतिहास का विश्लेषण कर द्वन्दात्मक एवं ऐतिहासिक भौतिकवाद के सिद्धांतों को विकसित कर रहे थे तब उनके सामने सुदूर लक्ष्य के अलावे कोई आशु सम्भावना नहीं थी । उन्नीसवीं सदी के मध्य भाग या सातवें दशक की शुरूआत में किसी स्पष्ट आदर्शों वाले नेतृत्व के बिना मज़दूरवर्ग के जो संग्राम योरप में उबलने लगे उन में भी कोई आशु सम्भावना नहीं थी । इन संग्रामों में पराजय निश्चित है जान कर भी मार्क्स और एंगेल्स उन संग्रामों के साथ खड़े हुये, उनसे शिक्षा ग्रहण कर अपने सिद्धांत को समृद्ध बनाये, अन्तिम लक्ष्य के प्रति आस्था को सुदृढ़ बनाते रहे । सन 1905 में रूस में मज़दूर-क्रांति असफल होने के बाद जब अकल्पनीय दमनात्मक कार्रवाइयों के साथ स्टॉलिपिन प्रतिक्रिया का काल शुरू हुआ तब क्या कोई आशु सम्भावना थी लेनिन के सामने ? क्या वे जानते थे उस समय कि सन 1912 में, लेना में सोने के खदानों के मज़दूरों की हड़ताल के साथ क्रांतिकारी आन्दोलन का युग शुरू हो जायेगा ? 
हमारे देश में भी, प्राणों को न्योछावर करने वाले जिन क्रांतिकारियों ने अंधेरे में थाह लगाते, असहनीय कष्ट स्वीकारते साम्यवाद के आदर्शों को प्रसारित करने क उद्यम लिया, पेशावर-कानपुर-मेरठ षड़यंत्र मुकदमों में पीसे गये,... जेल में कैदी के सुनिश्चित मृत्यु की जिम्मेदारी से खुद को बचाने के लिये साम्राज्यवाद यक्ष्मारोग से पीड़ित जिस काकाबाबु2 को रिहा कर दिया वह काकाबाबु जब भोजन के पैसे बचा कर किताब की कम्पनी से मार्क्सवाद की किताब की किताब खरीद कर खुशी से डगमग हुये थे क्या उस समय उनके सामने इशारा था आशु सम्भावनाओं का ? सन 1946 में भी क्या कुछ सामने था ? सन 1948 की अति-वामपंथ की भ्रांतियाँ – बुर्जुवा के हाथों में सत्ता का हस्तांतरण झूठा है, बुर्जुवा नेतृत्व की नि:सारता प्रमाणित है, साम्राज्यवाद-विरोधी जनवादी क्रांति के लिये जनता तैयार है, एक चिनगारी पूरे जंगल को आग लगा सकता है – माओ की सुक्तियाँ तब तक प्रचलित न होने पर भी उसी किस्म की धारणायेँ ! लेकिन क्रांति आसन्न है यह सम्भावना सन 1950 आते आते अदृश्य हो गई । लेकिन हमलोग, जो उसी युग में आवेग से चालित होकर आन्दोलन में आये, भाग तो नहीं गये स्वप्नभंग की वेदना के साथ ?  फिर आई सन 1962 में ‘देशप्रेम की बाढ़’ । पार्टी दफ्तरों पर हमले होने लगे, जेल में भीड़, जेल के सिपाहियों में भी ‘देशप्रेम’ का असर । 1962 के पहले मैं जेल नहीं गया था, लेकिन श्रद्धेय नेताओं से सुना था कि राजनैतिक बन्दी का सम्मान मिले न मिले, सरकार का मनोभाव जो भी हो, सिपाही कम्युनिस्ट बन्दियों का आदर करते थे, सम्मान करते थे । उनकी समझ में नहीं आती थी हमारी बातें पर उन्हे प्रतीत होता था कि ये स्वदेशीबाबुलोग दूसरे किस्म के लोग हैं, देश के बारे में, गरीबों के बारे में सोचते हैं । लेकिन 1962 में कुछ दिनों तक हमें वह सम्मान भी नहीं मिला । मालूम हुआ कि हमलोग देशद्रोही-गद्दार हैं; अनुशासन के साथ गिनती देनी पड़ती थी शुरू के दिनों में । इसके उपर था अन्तरराष्ट्रीय कम्युनिस्ट आन्दोलन में मतभेद, पार्टी के अन्दर उसका प्रभाव । उस पल, क्या संभावना थी हमारे सामने ? कितने भयावह थे 1970-77 के दिन ! सैंकड़ों कॉमरेडों के साथ जेल में । काँटातार से घेर, गाँवों से छान कर उठा रहा है पुलिस-प्रशासन, कम्युनिस्टों को । जेल के बाहर प्रति दिन प्रिय नेता या कार्यकर्त्ता की हत्या हो रही है, प्रति दिन जेल में शहीद-दिवस मनाना पड़ रहा है । मिसा के मुकदमें से रिहा हुये जिन कॉमरेडों को उत्साह के साथ जेल गेट तक पहुँचा कर आ रहे हैं कुछ ही दिनों के बाद उसके, खूनसने लाश में तब्दील हो जाने की खबर मिली है । दिल टूटता रहा है । गाँवों में हजारों हजार कार्यकर्त्ता और नेता घरों से बाहर हैं । पूरावक्ती कार्यकर्त्ताओं में से कोई शियालदह के रास्ते पर आलू बेच कर, दुकानों में बहीखाते लिख कर, थोड़े से वेतन पर पारचून की दुकान में नौकरी कर मंसुर हबीबुल्लाह के घर के छत की कोठरी में रात बिता रहा है, कोई ट्युशनी कर रहा है, कोई लेदमशीन के कारखाने में काम कर रहा है, कोई पुरुलिया में तो कोई बाँकुड़ा में है, कोई बाहर से जमीन बेच कर घर में रुपये भेज रहा है । कलकत्ता के मियाँबगान, कसबा, जादवपुर इलाके में लड़ते हुये पीछे हटना पड़ रहा है । हम ही लोग तब जेल में नेता हैं । हर तरह से कॉमरेडों को जिन्दादिल रखने की कोशिश की जा रही है... फिर भी जब कॉमरेडलोग आकर अफसोस के साथ बोलते थे, “कॉमरेड, खत्म हो गया सब कुछ, 50 साल पीछे चले गये हम लोग”, तब हस कर परिस्थिति को हलका करने की कोशिश के अलावे और कोई जबाब मालूम नहीं था । उसके बाद आया आपतकाल । पार्टी नेतृत्व ने कहा, “पुराना पूंजीवादी जनतंत्र अब लौट कर नहीं आयेगा” । लेकिन, मौके रहने के बावजूद कॉमरेडलोग भाग तो नहीं गये पार्टी छोड़ कर ।
किस जादु मंत्र के स्पर्श से कॉमरेड नहीं भागे ? कोई पर्सपेक्टिव या आशु संभावना के खिँचाव से नहीं, बल्कि मार्क्सवादी इतिहासबोध पर दृढ़ आस्था के कारण हम डटे रहे । आज जो हमलोग नेतृत्व में हैं, जिनकी उम्र हुई है, क्या हमने सोचा था अपनी जवानी में कि 2/10 साल या अपने जीवनकाल में हमारे स्वप्न सार्थक हो उठेंगे ? काकाबाबु की पीढ़ी के लोग क्या ऐसा सोचे थे ? या क्या न सोच पाने के कारण अपने जीवनसंध्या में हताशा के साथ विदा हुये थे ? नहीं ।
एक सवाल उठ सकता है कि उस समय समाजवादी खेमा एवं सोवियत संघ, समाजवादी क्रांति पर आस्था का एक दृढ़ स्तंभ, व्यवहारिक मार्क्सवाद के दृढ़ प्रत्यय के रूप में था । नि:सन्देह सोवियत का पतन और समाजवाद का विघटन जबर्दस्त चोट किया है समाजवादपरस्त क्रांति की शक्ति पर, पूंजीवाद की हमलावर ताकत को और अधिक आक्रामक बनाया है । साम्राज्यवादी वैश्वीकरण का पंजा पूरी दुनिया का, खास कर 90% देशों के मज़दूर, किसान, मध्यवर्ग, छोटी पूंजी का गला दबाये बैठा है, दुनिया में संग्रामी मनुष्यों को आत्मरक्षा की लड़ाई लड़नी पड़ रही है । लेकिन पराजय, व्यर्थता, पीछे हटने की स्थितियों के बिना कभी कोई सत्य धरती पर चिरस्थायी रूप से प्रतिष्ठित हो पाई है ? कूपमंडुक राजतंत्र के विरुद्ध संग्राम में पूरी दुनिया घूमने वाले बुर्जुवावर्ग को क्या बार बार पराजित होना नहीं पड़ा ? सामन्तवादी विचार व आदर्शों के विरुद्ध क्या उन्हे तीन शताब्दियों तक संग्राम नहीं करना पड़ा ? पूंजीवाद को स्थापित करने में प्रांसिसी क्रांति के बाद क्या सौ साल नहीं लगे ? इंग्लैन्ड में क्रॉमवेल की क्रांति के 18 वर्षों के बाद क्या कब्रगाह से उसी क्रॉमवेल का मृत शरीर निकाल कर फाँसी पर लटकाया नहीं गया ? जबकि ये सारे क्रांति एक किस्म के शोषण के बदले दूसरे किस्म के शोषण चालु किये जाने के लिये थे एवं पुराने शोषकों के नये शोषकों में रूपान्तरण की सम्भावनायें भी यथार्थ थीं । इन सबों की तूलना में समाजवाद की स्थापना के लिये संग्राम बहुत अधिक कठिन, दीर्घकाल तक चलने वाला है क्योंकि इसका लक्ष्य है सभी किस्म के शोषणों की समाप्ति । शोषण पर आधारित हजारों वर्षों के दार्शनिक परम्परा का मोह तोड़ कर नया इन्सान तैयार करने का संग्राम है यह ।
राजसत्ता हाथ में लेने के 74 साल बाद भी समाजवाद का विघटन हमें हतप्रभ किया था । लेकिन आज पीछे की ओर देखते हुये आसानी से समझ में आती है कि बहुत पहले से ही समाजवाद में क्षय के लक्षण प्रकट हुये थे लेकिन हम निर्विकार थे क्योंकि हम, दुनिया के कम्युनिस्ट लेनिन की शिक्षा, हमें सतर्क रहने को कहती हुई उनकी वाणी भूल गये थे । पूंजीवादी जनवादी क्रांति से समाजवादपरस्त क्रांति का बुनियादी फर्क है । सामन्तवाद के गर्भ में ही पूंजीवादी उत्पादन प्रणाली प्रसारित होती रहती है, मुद्रा का आधिपत्य एवं पूंजीपतियों की आर्थिक ताकत बढ़ती रहती है, राजनीतिक स्तर पर पूंजीपति वर्ग के द्वारा सत्ता पर कब्जा किये जाने से क्रांति का अंत होता है । लेकिन समाजवादी क्रांति में राजसत्ता पर कब्जा किये जाने से ही क्रांति की शुरूआत होती है । सत्ता पर कब्जा किये जाने के बाद आर्थिक, राजनैतिक एवं विचारधारा के क्षेत्र में लम्बे समय तक तीव्र वर्गसंघर्ष चलाये बिना क्रांति का विजय संभव नहीं – क्या यह बात हम भूल नहीं गये थे ? समाजवाद गरीबी का बँटवारा नहीं, प्रचुरता का बँटवारा है, प्रचुरता का दर्शन है । पिछड़े हुये देश में उत्पादन शक्ति के त्वरित विकास के बिना समाजवाद सफल नहीं हो पाता है । विश्वव्यापी पूंजीवादी घेरे के भीतर, उत्पादन शक्ति के त्वरित विकास के लिये कुछ पीछे हट कर लेनिन ने नई आर्थिक नीति या ‘नेप’ लागू किया । उस दौरान वर्गसंघर्ष को सभी क्षेत्र में आगे नहीं बढ़ा पाने पर, मज़दूर-किसानों को शोषण पर आधारित दर्शन की परम्परा के बन्धन से मुक्त नहीं कर पाने पर पूंजीपतिवर्ग द्वारा राजसत्ता दोबारा हथिया लेने के खतरों से क्या लेनिन ने हमें आगाह नहीं किया था ? कई गलतियों के कारण रूसी क्रांति की सफलता को अन्तत: आगे नहीं बढ़ाया जा सका, लेकिन उसके चलते क्या रुसी क्रांति का यथार्थ एवं थोड़े से समय में विस्मित करने वाली अग्रगति के किरणों की दीप्ति झूठी या भ्रामक हो जायेगी ? परिवर्त्तन के यथार्थ पर आस्था रखते हुये ही हमें अपने भूल-गलतियों का विश्लेषण करना होगा । बार बार पराजय या व्यर्थता के बिना क्या किसी नये सत्य की प्रतिष्ठा हो पाई है ? ‘सूर्य केन्द्र में है’ इस सिद्धांत को प्रतिष्ठित करने में क्या लम्बा समय नहीं लगा ? क्या उसके के लिये आत्मत्याग नहीं करना पड़ा ? सोलहवीं सदी के मध्य में प्रख्यात वैज्ञानिक एवं चित्रकार लिओनार्दो द विंची ने हवाई जहाज का मॉडल तैयार किया, आसमान में उड़ पाने की सम्भावना का यथार्थ सामने आया । बार बार के असफलताओं को पार कर उसे सफल करने में क्या साढ़े तीन शताब्दी का वक्त नहीं लगा ? हजारों वर्ष के वर्गसमाज के बाद मार्क्सवाद की उम्र तो ज़रा सी है !
मार्क्सवाद जड़सूत्र नहीं, कर्म का मार्गदर्शक है । किसी भी विज्ञान की तरह मार्क्सवाद भी विकासशील है । विज्ञान अंधा धर्मविश्वास नहीं, यथार्थ तथ्य एवं तर्क पर स्थापित है । मार्क्सवाद को त्यागने वाले ऐसे लोग जिन्हे सीधी तौर पर ‘मार्क्सवाद अब चलने लायक नहीं’ बोलने की हिम्मत नहीं होती, मार्क्सवाद को विकसित करने के बहाने उसके सारवस्तु को खत्म कर देते हैं । इतिहास में बार बार ऐसा हुआ है । मार्क्सवाद की बुनियादी बात क्या है ? समाज परिवर्तनशील है, उत्पादन करने की क्षमता के साथ सामंजस्य रखते हुये उत्पादन सम्बन्धों का परिवर्तन होता है, अर्थनीति के क्षेत्र में उत्पादन शक्ति एवं उत्पादन सम्बन्ध का अन्तर्विरोध एवं राजनीति व दर्शन के क्षेत्र में वर्गसंघर्ष ही समाज परिवर्तन की प्रेरकशक्ति है । क्या इस बुनियादी सत्य में कोई बदलाव आया है ? अवश्य ही यह सच है कि मार्क्स के समय पूंजीवाद जहाँ खड़ा था, लेनिन के समय जहाँ था आज वहाँ नहीं है । मार्क्स की भविष्यवाणी के अनुसार विश्व के आखरी कोने तक को पूंजीवाद ने अपनी जंजीरों में बाँध लिया है – यह आज विश्वव्यवस्था है । उत्पादन शक्ति का निरन्तर क्रांतिकारी रूपान्तरण बिना किये पूंजीवाद नहीं रह सकता है यह सत्य आज जाहिर है । विज्ञान व प्रौद्योगिकी का अचंभित करने वाला विकास मानवसमाज की सृजनक्षमता के नये दिगन्त का द्वार खोल दिया है । सूचना प्रौद्योगिकी एवं संचार व्यवस्था का विस्फोट दुनिया के व्यवहारिक दायरे को अत्यंत संकुचित कर दिया है । विज्ञान व प्रौद्योगिकी के कारण उद्योग एवं कृषि में विपुल मात्रा में अतिरिक्त का सृजन सेवा क्षेत्र को प्रसारित किया है – सफेद पोषाक वाले यानि ‘बाबु’ श्रमिकों की संख्या कई गुणा बढ़ गई है । विज्ञान व प्रौद्योगिकी के कारण ही कई क्षेत्रों में श्रम का पुराना चरित्र बदल गया है, श्रमजीवी लोगों में अलग अलग स्तर बने हैं । मेधाशक्ति का माल में तब्दील होने की प्रक्रिया तेजी से फैल रही है, भविष्य में यह मेधा सम्भावनामय शक्ति में रूपान्तरित होगी । पूरी तरह से सैन्य-शक्ति पर निर्भर करने वाला पुराना साम्राज्यवाद अब नहीं है, उसकी जगह पर आया है जरूरत पड़ते ही इस्तेमाल किये जाने लायक विशाल सैन्यशक्ति की धमकी के साथ पूरी दुनिया को आर्थिक गुलामी में जकड़ना । आज लेनिन के जमाने का कार्टेल और सिन्डिकेट पुराने हो गये हैं, विश्व के कुल उत्पादन का सिंहभाग पर अधिकार जमाई हुई बहुराष्ट्रीय संस्थायें राष्ट्रीय राजसत्ताओं को अपने प्रबंधक बना रही हैं । साम्राज्यवादी पूंजी आज पलक झपकते यहाँ वहाँ चले जाने को सक्षम और चंचल है, किसी भी कमजोर देश की अर्थनीति को ध्वस्त कर दे सकती है । आर्थिक निर्देशन जितना केन्द्रिकृत हो रहा है उत्पादन उतना ही विकेन्द्रित हो रहा है । समाजवाद के विघटन के बाद एकध्रुवीय दुनिया के डंके बजाये जाने के बावजूद विकसित पूंजीवादी देशों के बीच एवं उनके साथ तीसरी दुनिया के देशों का अन्तर्विरोध लगातार तीव्र हो रहा है ।
नि:सन्देह ये सारी विशिष्टतायें नई हैं । लेकिन ये मार्क्स के द्वन्दात्मकता के सिद्धांत को खारिज नहीं बल्कि और अधिक स्थापित कर रही हैं । देशों के बीच एवं देश के अन्दर वर्गीय अन्तर्विरोध के तत्व बढ़ रहे हैं या घट रहे हैं ? संयुक्त राष्ट्र संगठन का मानव विकास प्रतिवेदन क्या कह रहा है उसकी पुनरावृत्ति आवश्यक नहीं है । रोजगारहीन विकास तो उन्ही की अवधारणा है । सेवा क्षेत्र का विस्तार हो रहा है पर उसमें रोजगार के अवसर संकुचित हो रहे हैं । जनता के बड़े हिस्से की क्रयक्षमता शून्य है, मुट्ठीभर लोगों के भोगविलास के बाजार की मांग उन्नत प्रौद्योगिकी के कारण कमतर श्रम से ही पूरी हो जाती है, करोड़ों लोग गैरजरूरी हैं आज,  विपुल पैमाने पर श्रमशक्ति की बर्बादी है । कलकारखानों में, कृषि में, सेवा क्षेत्र में काम कर रहे लोगों में स्तरों का फर्क है लेकिन उनके बीच एकता के तत्व क्या बढ़ नहीं रहे हैं ? करोड़पतियों के भोज में व्यंजनों के जूठन के प्रत्याशी भीखमंगों की तरह, मेधापण्य के बाजार में थोड़ी सी जगह पाने के लिये मेधाशक्ति के बीच जो भयावह चूहों की दौड़ चल रही है, क्या कोई सन्देह है कि इसके फलस्वरूप मेधाशक्ति का बड़ा हिस्सा बाहर छिटक जायगा ? इतने बड़े पैमाने पर मेधाशक्ति क्या खामोशी से मौत को गले लगायेगी ? या संग्राम के मार्ग पर आयेगी ? दूसरे श्रमजीवी लोगों के साथ क्या वे अपनी आत्मीयता नहीं कायम करेंगे ? विभिन्न देशों में पूंजीपतिवर्ग का कमजोर हिस्सा क्या डूबने से बचने की कोशिश नहीं करेंगे ? सीमाविहीन अनैतिकता, अपराध, पाशविकता, नीचता, क्रुरता, हिंसा क्या पूंजीपतिवर्ग के ही बड़े हिस्से में अनिश्चयता के उद्वेग पैदा नहीं करेंगे ?
आसानी से समझ में आती है यह बात कि मार्क्स या लेनिन के युग में जो अन्तर्विरोध थे उनकी मात्रा कम नहीं हुई है बल्कि कई गुणा बढ़ गई है । निश्चय ही, पहले की तूलना में इन अन्तर्विरोधों में विविधता आई है, इन्ही विविधताओं में एकता के माध्यम से बुनियादी अन्तर्विरोध सफलता की ओर बढ़ेगा । इतिहास में, बदलाव का कोई खाका पहले से खींचा नहीं जा सकता है । इक्कीसवीं सदी इस अन्तर्विरोध को किस तरह विकसित करेगा हम नहीं जानते । लेकिन मानवसमाज का बड़ा हिस्सा गरीबी, वंचना, बेरोजगारी, विषमता एवं यंत्रणा के बदले मुट्ठीभर लोगों की भोगलालसा और कोड़ों की फटकार को हमेशा के लिये मान लेगा, ऐसा सोचना मनुष्य के प्रति आस्था खोने जैसा पाप तो होगा ही, आज तक के मानव इतिहास की दिशा को भी अस्वीकार करने जैसा होगा । समय को घंटा-मिनट या वर्ष से नापा जा सकता है, लेकिन उतने छोटे नापों से इतिहास को नापना संभव नहीं । उन्नत विज्ञान एव प्रौद्योगिकी समाजतंत्र के यथार्थ को खारिज नहीं कर रहा है बल्कि और अधिक स्थापित कर रहा है । इस कुत्सित शोषण की व्यवस्था के प्रति घृणा, दबे-कुचले वंचित जनता के साथ हमदर्दी एवं इतिहास की यथार्थवादी समझ के प्रति आस्था ही उस आदर्श के बोध का आधार है जो कम्युनिस्टों को, व्यक्तिजीवन की सीमा को पार कर मृत्यु का सामना करने लायक बना सकता है ।
कम्युनिस्ट भी इन्सान है और पूंजीवादी समाज के नियमों के अनुसार ही उसे जीवित रहना पड़ता है । उनका भी एक व्यक्तिजीवन है, दूसरों की तरह उनकी भी समस्यायेँ हैं, यंत्रणायें हैं । अभी भी है और अतीत में भी था । लेकिन अतीत में हम सरकार3 में नहीं थे, प्रति दिन अधिकारहीनता की वेदना के पहाड़ों को दूसरों की तूलना में और अधिक ठेल कर हमें आगे बढ़ना पड़ता था । इसे टालने के लिये मौकें या सुविधायें हमारे पास नहीं थे, भीतर से आदर्शवाद को चोट पहुँचा सके ऐसे तत्व नहीं थे । लेकिन आज हम एक राज्य सरकार में हैं । अधिकांश नगरपालिकाओं एवं त्रिस्तरीय पंचायतों में हैं । कितने ही लोगों के बलिदान के फलस्वरूप आज हम प्रशासन में आये हैं और कायम हैं । राजसत्ता पर कायम पूंजीपति-जमींदार और हम एक राज्य के प्रशासन में, एक विचित्र स्थिति है, कोई मिसाल नहीं है दुनिया में । जो भी अवसर उपलब्ध हैं उन्हे जनता के लिये इस्तेमाल भी करना होगा और उन्हे समझाना भी होगा कि सरकार में रहने के बावजूद सत्ता उनकी नहीं है । कठिन काम है यह, पर इससे भी अधिक कठिन काम है आदर्शबोध को सही रखना । पारिवारिक एवं सामाजिक जीवन के बीच अन्तर्विरोध, व्यक्तिगत हित एवं आदर्शबोध के बीच अन्तर्विरोध । पारिवारिक जीवन में पूंजीवादी समाज के प्रतिस्पर्धा के नियमों को मान कर ही हमें जीवित रहना पड़ेगा लेकिन उस प्रतिस्पर्धा में प्रशासनिक एवं सामाजिक ताकत को पक्षपात के साथ इस्तेमाल नहीं करना होगा । भयानक कठिन काम है । भोजन के अभाव के कारण मृत्यु कठिन है लेकिन दूसरे भूखे का भोजन नहीं छीनकर मरना उससे कहीं अधिक कठिन है । आदर्शबोध का कठिन कवच ही इस कठिन काम के लिये हमें सक्षम बना सकता है । हममे से कुछ लोगों के आदर्शबोध में कमी आ रही है, पैर लड़खड़ा रहे हैं, फिर भी हमारे अधिकांश कार्यकर्ताओं के आदर्शबोध को लेकर हम गर्वित हैं । उसी के चलते छठी बार वाममोर्चा को विजय प्राप्त हुआ है । कुछ लोग वाम मोर्चा के विजय को एक ही स्तर पर आवर्तन मानते हैं । वे भ्रम में हैं । थोड़ा सोचने पर ही समझ में आ जायेगा  कि 1977 का चुनाव एवं 2001 का चुनाव एक ही जैसा नहीं है, लोगों की चेतना के एक ही स्तर का परावर्तन नहीं है । लेकिन वह एक अलग प्रसंग है । अभी विषय है आदर्शबोध । उस आदर्शबोध पर भीतर से हमले की कोशिश चल रही है, विकृत-अश्लील भोगवाद एवं सिद्धांतहीनता का व्यापक प्रचार उस हमले के लिये अनुकूल परिस्थिति तैयार कर रहे हैं । इसके खिलाफ हम में से हर एक साथी को अपने साथ लड़ाई लड़नी पड़ेगी तथा पार्टी के अन्दर संग्राम करना पड़ेगा । इसका कोऐ विकल्प नहीं है । इसी आदर्शबोध को सीने में लेकर हमारे पूर्वज अनजाने रास्ते पर अमृत की खोज में यात्रा शुरू किये थे, हमें भी उसी आदर्शबोध को सुदृढ़ कर खुद को उन्नत करना होगा । पुराने लोगों के चले जाने से आया सूनेपन को भरना होगा; देर करने की गुंजाइश नहीं है, जल्द करना होगा ।


1यह लेख वर्ष 2001 में लिखा गया एवं ‘देशहितैषी’ में प्रकाशित हुआ था ।   
2कॉ मुज़फ्फर अहमद प्रेम और आदर से ‘काकाबाबु’ कहे जाते हैं ।
3वर्ष 2001 में वाममोर्चे की सरकार सत्तासीन थी ।  

[देशहितैषी शारद-2001 में प्रकाशित लेख का मूल बांग्ला से अनुवाद]


বিশ্বায়ন, ইংরেজি এবং ‘অন্যান্য’ ভাষা - ইউ· আর· অনন্তমুর্তি

ভাষা আর সাহিত্যে, এবং শুধু ভাষা আর সাহিত্য নয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বাড়তে থাকা প্রভুত্ববাদী প্রবৃত্তির প্রতি আমার যে বিরোধ, তা নিয়েই [আজ এখানে]* বলব বলে ভেবেছি। যেহেতু আমি গল্পলেখক, তাই কী বলতে চাই বোঝাতে বরং কয়েকটি গল্প বলি।

রামায়ণে হনুমান তাঁর বাককুশলতা এবং কূটনীতির জন্য খ্যাত। এক মহান কন্নড় লেখক এবং পুরোনো ঘরানার শিক্ষক মজা করে বলেন যে যখন রাম হনুমানের দারুণ সংস্কৃতের প্রশংসা করেন সেটা একজন ভারতীয় মানুষের ইংরেজীর ইংরেজকৃত প্রশংসার মত শোনায়; যেন উত্তর ভারতীয় রাম দক্ষিণ ভারতীয় হনুমানের প্রশংসা করছেন। মস্করা হিসেবে চলতে পারে কিন্তু সত্যিই তো আর তা নয়! সংস্কৃত তো কোনো বিশেষ এলাকার নয়। সংস্কৃতের গৃহকোণ ছিল সব জায়গায় আর তাই সে গৃহহীনও বটে। যেমন আজকের ইংরেজী। প্রফেসর শেলডন পোলক যে শব্দটাকে খ্যাতি দিয়েছেন সে শব্দটা ব্যবহার করে বলি, বিশ্বনগরের ভাষার গৃহকোণ আছে সবস্থানে এবং তাই সে গৃহহীন। বাংলা, তামিল, তেলেগু, ওড়িয়া, কন্নড় আমাদের সবকটি ভাষার  একটি করে গৃহকোণ আছে। এ ভাষাগুলি আজকের ইংরেজীর বা প্রাচীন কালের সংস্কৃত বা ল্যাটিনের মত ঘুরে বেড়ায় না। কিন্তু ইংরেজী যখন ইংল্যান্ডের ভাষা ছিল এবং নিজের এলাকা ছাড়িয়ে ঘুরে বেড়ানো শুরু করেনি তখন সে একজন মহান শেক্সপিয়রের জন্ম দিয়েছিল। অর্থাৎ বিশ্বনগরের ভাষা হয়ে উঠলেই কোনো ভাষা আপনা থেকে সাহিত্যের মহান ভাষা হয়ে ওঠেনা। শক্তি আর গুণ, সবসময় একসাথে চলবে এমনটা জরুরী নয়। বিবিসি বা সিএনএনএর ইংরেজী হয়ত অডেন বা ইলিয়ট বা ইয়েটসের জন্ম দিতে পারেনা কিন্তু উত্তেজনার জন্ম দিতে পারে, আমাদের ঘুম কেড়ে নিতে পারে। আরো অনেক ইংরেজী আছে, তাদের মধ্যে কয়েকটির কাছে এমন বাস্তব আছে যা বাঁচা হয়েছে, ঘাম আর মাটির গন্ধ আছে এবং এমন মানুষ নিশ্চয়ই আছে যারা সেই ইংরেজীতে স্বপ্ন দেখছে, গালাগাল দিচ্ছে যাতে ভাষাটিতে মানবিক সাহিত্যিক অভিজ্ঞতা বিধৃত হয়।

আবার হনুমানের কাছে ফিরে আসি। কেননা এই মহান সংবাদদাতার সাহায্যে ভাষা নিয়ে আমার আরেকটি কথা আমি বলতে চাই। এবার এমন একটি গল্প যেটি সবাই জানেন। হনুমান লাফ দিয়ে মহাসাগর পার করে লঙ্কায় যান এবং অশোকবনে গভীর শোকে আকুল সীতাকে খুঁজে পান। হনুমান তাঁকে গাছের চুড়ো থেকে দেখেন আর ভাবেন কোন ভাষায় তাঁর সাথে কথা বলবেন। সংস্কৃত, যেটি দরবারের, এমনকি রাবণের দরবারেরও কুলীনদের ভাষা? তাহলে সীতা তাঁকে বিশ্বাস করবেননা; ভাববেন তাঁকে যে হরণ করেছে এ তারই এক দূত। হনুমান ভাবেন (এটি রামায়ণ থেকে উদ্ধৃত) -
যদি দ্বিজের ন্যায় সংস্কৃতে আমি সীতাকে সম্বোধন করি তাহলে তিনি ভাববেন আমি রাবণের দূত আর ভয় পেয়ে যাবেন। বরং মানুষের ভাষায় কথা বলা ভালো, সীতা বুঝবেন।
এই হলেন বাল্মিকি, আর আমাদের বিশ্বাস অনুযায়ী রাবণও এক ব্রাহ্মণ।

আমাদের দেশের একটি ক্ষেত্রীয় ভাষার লেখক হিসেবে নিজের পরিবেশে অনেকগুলো ভাষার আবহমন্ডলের অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন থেকেছি। সবসময় একটি শ্লেষাত্মক মন্তব্য করেছি যে ভারতে যে যত বেশী সাক্ষর সে তত কম ভাষা জানে। বেঙ্গালুরুতে অবস্থিত একটি বহুজাতিক সংস্থার সর্বময় কর্তা হয়ত শুধুই ইংরেজী জানে কিন্তু বাসস্ট্যান্ডের কুলিটি উর্দু, তেলেগু, কন্নড়, তামিল এবং হয়ত কিছুটা ইংরেজীও চালিয়ে যেতে পারে। অনেক ভাষা জীবন্ত আমাদের পরিবেশে এবং আমরা হয়ত সবসময় অচেতনভাবে এক ভাষা থেকে আরেক ভাষায় চলে যাই। বেন্দ্রের উদাহরণ দিই। তিনি বোধহয় আমার ভাষার মহানতম কবিদের একজন ছিলেন। তিনি ঘরে মারাঠি বলতেন, লিখতেন কন্নড়ে। তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কতদিন ধরে এ দুটো ভাষা ব্যবহার করছেন? বারো তেরো বছর বয়স অব্দি তো আমি জানতামই না যে আমি দুটো ভাষা বলছি। তিনি এ কথাটা বলছিলেন তখনই তাঁর পুত্রবধু এসে তাঁর কানে কিছু বললেন। তিনি তার সাথে মারাঠিতে কথা বললেন। ভাবলেনও না যে তিনি তার সাথে মারাঠিতে কথা বলছেন যখন নাকি আমার সাথে কন্নড়ে কথা বলছিলেন। এটাই ভারত এবং ইয়োরোপ এটা বুঝতে পারেনা।

_____________________________________________________________________
*এই লেখাটি সুমিত্রা চিস্তি স্মারক বক্তৃতা ২০০৯এর অংশবিশেষের অনুবাদ। সোশ্যাল সাইন্টিস্ট জুলাই-আগস্ট ২০০৯ সংখ্যায় প্রকাশিত।

বিশ্বনগরের ভাষার অতীতের সংস্কৃত এবং এখনকার ইংরেজী শক্তি সত্ত্বেও তথাকথিত ভার্নাকুলার বা দেশোয়ালী ভাষার  নিজস্ব কিছু সুবিধে এবং ব্যবহারের জায়গা সবসময় আছে। ক্ষেত্রীয় ভাষার মহান লেখকেরা সব সময় জানতেন যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভুত্ব একটি সমস্যা কিন্তু ভিতরের সাহিত্যগুণটি নির্দ্ধারিত করতে পারেননি। আমি জানি আমি সমস্যাটার সরলীকরণ করছি। পরে ফিরবো, শর্তাদি নিয়ে।

আরেকটি গল্প বলি, কালিদাসের কুমারসম্ভব থেকে। আমরা সবাই জানি যে পার্বতী শুধু তাঁর সৌন্দর্য দিয়ে শিবের মন জয় করতে পারেননি আর তাই কঠোর তপস্যা করে শিবকে পেয়েছিলেন। গোটা সৃষ্টির জন্য এটি আনন্দসংবাদ ছিল কেননা তারকাসুর, সে সময়কার এক স্বৈরাচারী রাজা সৃষ্টিকে নিজের কুক্ষিগত করে রেখেছিল এবং একমাত্র শিবের পুত্রই তাকে ধ্বংস করতে পারত। সমস্ত দেবতা এবং ঋষিগণ, যাঁরা এটা জানতেন এবং হরপার্বতীর মিলন ঘটাতে সফল হলেন, এসে আশীর্বাদ করলেন দম্পতিকে। বিদ্যার দেবী সরস্বতীও তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন। কবি কালিদাস সংস্কৃতে লিখছেন, তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী দেবী সরস্বতী কী ভাষায় দম্পতিকে আশীর্বাদ দেখুনঃ (কুমার সম্ভবের ডেভিড স্মিথ কৃত ইংরেজী অনুবাদ থেকে উদ্ধৃত করছি),
এবং দেবী সরস্বতী
আশীর্বাদ করলেন
নবদম্পতিকে, দ্বিবিধ ভাষায়;
চমৎকার বরকে শুদ্ধ মার্জিত সংস্কৃতে,
বধুকে সহজ বোধগম্য বাক্যে
আমি কবিতাটির ডেভিড স্মিথ কৃত চমৎকার অনুবাদ থেকে উদ্ধৃত করছি। শব্দদুটো লক্ষ করুন, দ্বিবিধ ভাষায় দ্বিধ প্রযুক্তেন। এবং শেষ পংক্তিতে জনতার ভাষার বিবরণ, সংস্কৃতের প্রশংসার বিরোধে দেশজ ভাষার ঠিক ততখানিই প্রশংসা দিয়ে করা হচ্ছে, সুখ গ্রাহ্য বন্ধনেন। মূল শব্দগুলি সহজ বোধগম্য বাক্য থেকেও বেশি ইংগিতবহ।
           
সাহিত্যের সব ছাত্র জানেন যে অত্যন্ত মার্জিত ভাষা অসুবিধেরও কারণ হতে পারে। ওয়র্ডসওয়র্থের পক্ষে পোপ এবং ড্রাইডেন কর্ত্তৃক অতিমার্জিত ভাষায় লেখা অসুবিধেজনক ছিল। তাই তাঁকে পিছিয়ে জনতার কাছে যেতে হল। ভাষা যত মার্জিত হবে, মনের অনুভুতিগুলোর অভিব্যক্তি হয়ত এত বেশী পরিচ্ছন্ন, পরিমার্জিত হয়ে পড়বে যে সত্যি বলে মনে হবে না। যেমন অষ্টাদশ শতকে ইংরেজীর নব-ধ্রুপদী কবিদের সাথে হয়ে ছিল। উইলিয়াম ওয়র্ডসওয়র্থকে পিছনে, সাধারণ বাচনভঙ্গীর কাছে পৌঁছোতে হয়েছিল যাতে নিজের কথাগুলো আন্তরিক আবেগের সাথে বলতে পারেন। যদি এমন ঘটনা একটি ভাষার আভ্যন্তরীন ক্ষেত্রে (একটি দেশজ ভাষা, জনতার ভাষার ক্ষেত্রে) হতে পারে তাহলে আপনারা ভাবতে পারেন দুটো ভাষার একটি কুলীন এবং অন্যটি সাধারণ জনতার মধ্যে কী ঘটতে পারে।

অনুমতি দিন, এবার আমি অতীতের সেই, ল্যাটিন থেকে অন্যান্য ইয়োরোপীয় ভাষা এবং সংস্কৃত থেকে ভারতীয় ভাষাগুলোর মহান বিবর্তনের দিকে যাই। বিবর্তনটা সূক্ষ্ম, ধীরগতি এবং অনাটকীয়। হাজার বছর আগে যখন সুমহান কন্নড় কবি পম্পা কন্নড় ভাষায় মহাভারত রচনা করেছিলেন (তাঁর জৈন বিশ্বাস অনুযায়ী অনেক গুরুত্বপূর্ণ বদল ঘটিয়েছিলেন তিনি; বলতে গেলে হস্তক্ষেপ করেছিলেন মহাভারতে) তখন এমন কবিও ছিলেন যাঁরা সংস্কৃতে লিখছিলেন। নিউটন ল্যাটিনে লিখেছিলেন কিন্তু মহান ডারউইন, যাঁর বিরাট সাংস্কৃতিক প্রভাব পড়েছিল তাঁর যুগের ওপর, ইংরেজীতে লিখেছিলেন তাঁর অরিজিন অফ স্পেসিজ। ১৬শ শতকে তো ইংরেজীতে ছিন্নবিচ্ছিন্ন কথা বলাও একটা সমস্যা ছিল।

স্যার ফিলিপ সিডনি বিদেশ থেকে আমদানি করা ল্যাটিনের দুরূহ শব্দগুলো ব্যবহার করার বিরুদ্ধে ছিলেন, তিনি বলতেন যে কোনো খাঁটি ইংরেজের ওই শব্দগুলো অপরিচিত মনে হবে।
তাঁকেই উদ্ধৃত করিঃ
আমি জানি কেউ হয়ত বলবেন যে ইংরেজী একটি খিচুড়ি ভাষা। হবে নাই বা কেন? সেটা হওয়াই তো ভালো, অন্যান্য ভাষার সবচে ভালোটুকু নিয়ে নেওয়া! আবার কেউ বলবেন, এর তো ব্যাকরণই নেই! সত্যিই নেই, প্রশংসার কথা, আসলে এর ব্যাকরণের দরকারই নেই। থাকলে নিজের প্রতি এত সহজ হতে পারত না। কেস, জেন্ডার, মুড, টেন্স ইত্যাদির জটিল ভিন্নতা থেকে একেবারে মুক্ত। ওসব তো মনে হয় ব্যবিলনের টাওয়ারের অভিশাপের অংশ! ওগুলো থাকলেই একটা মানুষকে তার মাতৃভাষা শিখতে স্কুলে যেতে হয়। (স্যার ফিলিপ সিডনির মৃত্যুর পর ১৫৯৫ সালে প্রকাশিত হয়)।

আপনারা নিশ্চয়ই লক্ষ করে থাকবেন যে উদ্ধৃতিটিতে, যাকে আমি দেশজ ভাষা দুশ্চিন্তা বলি (ভার্নাকুলার অ্যাংজাইটি; আমরা সবাই অল্পবিস্তর এর কষ্ট ভোগ করে থাকি) তার চিহ্ন আছে। লোকে আমায় প্রশ্ন করে, আপনি ইংরেজীতে লেখেননা কেন? আপনি ইংরেজী জানেন। অনেক বেশী লোকে আপনাকে জানবে। তখন আমি বলি, হ্যাঁ, অনেক বেশী লোকে আমাকে জানবে কিন্তু তারা এমন লোক যাদের আমি চিনিনা। যখন নাকি কন্নড়ে আমি জানি আমি কাদের জন্য লিখি। এবং তারাও আমাকে জানে। আপনাদের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মত অনুযায়ী আপনারা ভাবতে পারেন যে এর কিছু সুবিধে আছে, কিছু অসুবিধে আছে। (দেশজ ভাষাকে একটি বাচিক সমুদায়ের অপ্রমিত স্থানীয় ভাষা বলে পরিভাষিত করা হয়)। আমি কি বলতে পারি আমাদের মাঝে কয়েকজন যারা আমাদের সন্তানকে ব্যায়বহুল খারাপ ইংরেজী মাধ্যম স্কুলে দিয়ে থাকেন তাঁরা এই দুশ্চিন্তায় কষ্ট পান? এই দুশ্চিন্তা শেষ হয়নি। বেঙ্গালুরুতে ভরা আছে এমন মানুষ। আমাদের নিজেদের নাতিপুতিরা আমাদের সাথে এখন আর আমাদের ভাষায় কথা বলবেনা। নেহরু, বিশ্বায়ন আর ওই সবের এটাই ফলশ্রুতি।

এখানে আমি একটা গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করতে চাই। দেশজ ভাষা শব্দটা যে কোনো ভাষার জন্য অপমানজনক। পরিভাষাগত প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারি, কিন্তু আমাদের কথিত দেশজ ভাষাগুলো পূর্ণরূপে ভাষা। সংক্ষিপ্ত ভাবে ইয়োরোপে আর ভারতে এই দেশজ ভাষাগুলোর পুরোপুরি ভাষা হয়ে ওঠার পথটা আমায় চিহ্নিত করতে হবে।

ইয়োরোপের প্রথম নাম যিনি ল্যাটিনে নয়, আপন জনতার ভাষায় লিখেছিলেন তিনি দান্তে। (তিনি জনতার সাধারণ ভাষায় লেখার পক্ষে যক্তিও দিয়েছিলেন, কিন্তু সেই আত্মপক্ষসমর্থনটা আবার ল্যাটিনে। মিল্টনও কিছু পুস্তিকা, এবং কিছু কবিতাও, ল্যাটিনে লিখেছিলেন; রাজনৈতিক ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ইংরেজী অদৃশ্য হয়ে গেলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যেন তাঁকে ভুলে না যায়)। দেশজভাষাগত দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত হওয়া অত্যন্ত কঠিন, এমনকি যাঁরা নিজেদের কথ্যভাষা, মাতৃভাষাকে ভালোবাসেন তাঁদের পক্ষেও।

এখানে আরো দুটো মন্তব্য করব। দান্তের আগে, কন্নড় ভাষায় প্রথম কন্নড় কাজ এক হাজার বছর আগের একটি নন্দনতাত্ত্বিক গ্রন্থ, নৃপতুঙ্গ/শ্রীবিজয় রচিত কবিরাজমার্গ। কিন্তু তার থেকেও বিষ্ময়কর লাগে আমার খৃষ্টপূর্ব যুগে বলা বুদ্ধের এই কথাগুলো, যাতে উনি সেই দেশজভাষাগত-দুশ্চিন্তায় ভুগতে থাকা কয়েকজন সন্ন্যাসীকে বকছেন। বিনয় পীঠিকা থেকে উদ্ধৃত করছিঃ
দুই সন্ন্যাসী, ব্রাহ্মণজাত, দুশ্চিন্তায় ছিল যে বিভিন্ন জনগোষ্ঠি, উপজাতি ও পরিবারের অন্যান্য সন্ন্যাসীরা নিজের নিজের উপভাষায় পুনরুচ্চারণে বুদ্ধের বাণীকে বিকৃত করে দিচ্ছে। তাঁরা বুদ্ধকে বললেন, আমরা বরং বুদ্ধের বাণীকে বৈদিক সংস্কৃত কাব্যে ধরে রাখি। কিন্তু বুদ্ধ, তথাগত, তাঁদের ভর্ৎসনা করলেন, বিভ্রান্ত মানুষ! তাহলে তারা আর কথোপকথনে আসবেনা যারা এখনও ধর্মান্তর ঘটেনি…” এবং তিনি সমস্ত সন্ন্যাসীদের আদেশ করলেন, তোমরা বুদ্ধের বাণীকে বৈদিক সংস্কৃত কাব্যে ধরবেনা। সেটা করলে জটিলতা বাড়িয়ে তোলা হবে। সন্ন্যাসীগণ, আমি তোমাদের অধিকার প্রদান করছি, বুদ্ধের বাণীকে প্রত্যেকে নিজের উপভাষায় শেখ।
ল্যাটিন এবং অন্য সমস্ত বিবর্তন থেকে আগের এই কাহিনী।

এবার একটি এমন ঘটনা নেব যেটি অতীতে ইয়োরোপে এবং ভারতে দুজায়গাতেই ঘটেছে। আমাদের যুগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বইগুলোর একটি, প্রফেসর শেলডন পোলক রচিত মানুষের দুনিয়ায় দেবতাদের ভাষা (পার্মানেন্ট ব্ল্যাক, ২০০৭)। তাতে উনি এই ঘটনাটি বিবৃত করেছেন। ল্যাটিন ইয়োরোপীয় দেশজভাষাগুলোর জন্য এবং সংস্কৃত ভারতীয় দেশজভাষাগুলোর জন্য জায়গা করে দিচ্ছে। কিন্তু ল্যাটিনের একটা গৃহকোণ ছিল, সংস্কৃতের ছিল না। সংস্কৃত সারা ভারতে ছিল। তাই নিজেকে ক্ষমতাশালী করতে পুরোহিতের ক্ষমতার প্রয়োজন তার ছিল। কিন্তু সংস্কৃতকে সব জায়গায় মান্য করা হত নান্দনিক কারণে, কেননা আপনারা যদি শাসনগুলো দেখেন, শুনতে ভালো লাগে বলে সমস্ত রাজারা প্রশংসিত হতে চাইতেন সংস্কৃতে। অথচ বাস্তব ব্যাবহারগুলো দেখুন কত জমি কাকে দেওয়া হবে মাতৃভাষায় লেখা আছে।
আজকের প্রসঙ্গ অনুযায়ী আমি প্রফেসর পোলকের গবেষণাটি ইষৎ সরলীকৃত ভাবে পেশ করব। উনি প্রথমে গ্রামশিকে উদ্ধৃত করেনঃ আমি মনে করি যদি ভাষাকে সংস্কৃতির উপাদান এবং সে অর্থে সাধারণ ইতিহাসের উপাদান, বুদ্ধিজীবীদের জনপ্রিয়তা এবং জাতীয়তার প্রধান অভিব্যক্তি মনে করা হয়, তাহলে সংস্কৃতির অধ্যয়ন উদেশ্যহীন নয়, শুধু জ্ঞানজাগতিক

প্রথমঃ সাহিত্যিক এবং রাজনৈতিক অভিব্যক্তির সংহিতা হিসেবে সংস্কৃতের পুনরাবিষ্কার করা হয়েছিল তার আগে এটি ধর্মকর্মের পবিত্র ভাষা, মৌখিক ভাবে প্রেরিত বেদাদির ভাষা ছিল। (অলিখিত, মুখে মুখে প্রেরিত বেদকে, মাঝে মাঝে সুমহান কাব্যিক অংশ থাকা সত্ত্বেও, প্রাথমিক ভাবে কখনোই কাব্যের মধ্যে ধরা হত না)। পুরুষসুক্ত নিছক কবিতা নয়, কিন্তু কালিদাসের মেঘসন্দেশ মূলতঃ কবিতা।

দ্বিতীয়ঃ দ্বিতীয় সহস্রাব্দের শুরুতে স্থানীয় বাচিক রূপগুলো নতুন সাহিত্যভাষা হিসেবে সম্মান পেল এবং সংস্কৃতের প্রভুত্বকে চ্যালেঞ্জ করতে শুরু করল। (সাহিত্যের বাচিক রূপগুলো প্রথমে লিখিত অক্ষরে অধিষ্ঠিত হল, তারপর সেগুলোর সাহিত্যিক পরিমার্জন সাধিত হল)। লিখিত অক্ষরে অধিষ্ঠিত হওয়া মানে বর্ণমালা পাওয়া। কন্নড় তামিলের আগে পেয়েছিল। আর তারপর সাহিত্যিক পরিমার্জন, যেমন কবিরাজমার্গে বলা আছে, কবিতা কাকে বলে ইত্যাদি। আপনারা জানেন, কোনো সাহিত্য বা গ্রন্থাংশের বিবেচনা করতে এ দুটো গুরুত্বপূর্ণ। এমন মানুষ আছেন যাঁরা বাইবেল সাহিত্য হিসেবে পড়েন, কিন্তু ইলিয়ট বলেছিলেন, না, আপনি যদি সাহিত্য হিসেবে পড়েন তাহলে এটা আর বাইবেলের মত গুরুত্বপূর্ণ বই থাকেনা, কবিতা হয়ে যায়। তাই ইলিয়ট ওভাবে পড়া স্বীকার করেননা।

তৃতীয়ঃ পশ্চিম ইয়োরোপে একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক লক্ষ করা যায় নব্যল্যাটিন সাহিত্য এবং বিশ্বমুখী রোমান সাম্রাজ্যের একসাথে উত্থান এবং আঞ্চলিক রূপের উদ্ভবে দুয়েরই স্থানচ্যুতি। তার মানে পুরোনো দুনিয়ার ভাষা, অর্থাৎ সাধারণ ভাবে কুলীনদের ব্যবহার করা ভাষাটি যখন পরিত্যক্ত হয়, একটা বিকেন্দ্রীকরণ ঘটেছিল। আমরা একজন টলস্টয়, একজন দস্তয়েভস্কি, একজন দান্তে, একজন শেক্সপিয়র পেয়েছিলাম। ভারতে আমরা পেয়েছিলাম একজন তুলসীদাস, একজন তুকারাম, একজন পম্পা এবং আরো সমস্ত মহান লেখকদের। আর এখন একটা উল্টো প্রক্রিয়া আমরা দেখতে পাচ্ছি। বিশ্বায়নের মাধ্যমে আমরা আবার কেন্দ্রীভূত হচ্ছি। খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এক হাজার বছর ধরে যা সম্পন্ন হচ্ছিল, তার মুখ মনে হয় বিপরীত দিকে ঘুরে যাচ্ছে। একজন জার্মান এখন মনে করে যদি সে ইংরেজী না জানে তাহলে আন্তর্জাতিক হতে পারবেনা। সে সব পুরোনো সুন্দর দিনগুলোয় স্যর সি ভি রমণ সমস্ত পদার্থবিদদের জন্য পাশে জার্মান ডিকশনারি রাখা আর জার্মান জার্নাল পড়া আবশ্যিক করে দিতেন। মাইসোর বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যায় অনার্সের সমস্ত ছাত্রদের জন্য জার্মান আবশ্যিক বিষয় ছিল। এখন দেখতে পাচ্ছি খুব শীগ্‌গির সব ইংরেজীর দিকে চলে যাচ্ছে। ব্রিটিশ ইংরেজী নয়, আমেরিকান ইংরেজী।

কন্নড় ভাষায় প্রথম বই কবিরাজমার্গ এবং সেটি ৮৭৫ সাল নাগাদ প্রকাশিত হয়েছিল। গুরুত্বে এই বইটির সাথে তুলনীয় দান্তের দ্য ভাল্গারি এলোকোয়েনশিয়া (দেশজ ভাষার অলঙ্কারশাস্ত্র বিষয়ক)। সম্ভবতঃ দান্তের নির্বাসনের আগে ১৩০৩ থেকে ১৩০৫ সালের মধ্যে বইটি লেখা হয়েছিল। বইটি অসমাপ্ত এবং কীর্তিউজ্জ্বল একটি দেশজ ভাষার সন্ধানে ল্যাটিনে রচিত বই। বইটিতে সাহিত্যিক রূপ হিসেবে গানের অবয়বের গঠনাদি বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

কবিরাজমার্গ আগের এবং কন্নড়ে লিখিত যখন নাকি দান্তের বইটি ল্যাটিনে লিখিত, যদিও দেশজ ভাষার পক্ষ সমর্থনে। এটা লক্ষ্যণীয়।

কবিরাজমার্গ' যে কথাগুলো বলতে চায় তা আজও আমাদের জন্য মূল্যবান। আমি সংক্ষেপে সেগুলো রাখছি। শেল্ডন পোলক এই বইটার গভীরে গিয়ে দেখেছেন আর প্রখ্যাত কন্নড় ইতিহাসবিদ ডাঃ শেট্টারও গুরুত্বপূর্ণ বই লিখেছেন এর ওপর। আমার কৃত এই সারাংশের জন্য আমি দুজনের কাছেই ঋণী।
কবিরাজমার্গের লেখক বলছেনঃ
সংস্কৃত এবং প্রাকৃত, দুই ভাষাতেই মার্জিত সাহিত্য রচনা করা যেতে পারে, যার যেমন ইচ্ছে, কেননা দুই ভাষাতেই প্রচুর পরিমাণে সাহিত্যের লক্ষ্য এবং লক্ষণ বর্তমান। কিন্তু আমি যে আলোচনাটি এখানে শুরু করতে যাচ্ছি তাকে বোধগম্য করতে গেলে এখানে ওখানে বর্জিত অংশগুলো ভিক্ষে করতে হবে। এবং কারোর পক্ষেই কন্নড় ভাষার জন্য এ কাজটা করা অত্যন্ত কঠিন কেননা সেই লক্ষ্য আর লক্ষণ, যা সংস্কৃত আর পালীর প্রাচীন শিক্ষকেরা দিয়ে গেছেন, কন্নড়ের জন্য একেবারেই নেই। (পোলককৃত অনুবাদ)

গ্রন্থটিতে লেখক পালে-কন্নড় (অর্থাৎ পুরোনো কন্নড়) কে আক্রমণ করেছেন। বলেছেন ভাষাটা সেকেলে আর পুরোনো দিনেরই উপযুক্ত। ও ভাষা ব্যবহার করা মানে, লেখকের ভাষায়, বৃদ্ধার সাথে সম্ভোগ করতে চাওয়া। আমরা অনুমান করতে পারি যে নবম শতাব্দীতে রচিত কবিরাজমার্গের আগেও কন্নড় সাহিত্য ছিল। তামিলও সাহিত্য হিসেবে ছিল কিন্তু আমি জেনেছি যে সেটি মৌখিক/বাচিক সাহিত্য ছিল; কন্নড় সাহিত্য প্রথম লেখা হয়েছিল। এগুলো জেনেছি কন্নড় বিদ্বানদের কাছে এবং বিদ্বজ্জনোচিৎ বিষয়ে ভুল করে থাকলে নিজেকে সবসময় শুধরে নিতে আমি রাজি, কেননা আমি বিদ্বান নই।

কবিরাজমার্গের লেখক তাঁর ভাবনার অনেক কিছু সংস্কৃত সাহিত্যতাত্ত্বিক ভামহ এবং দন্ডি থেকে নিয়েছেন, কিন্তু সেগুলোকে কন্নড়ের প্রয়োজন মত করে নিয়েছেন। কিছু যোগ করেছেন এবং তাঁদের কিছু কিছু সুত্র বদলে নিয়েছেন। আমাদের দিয়েছেন দুটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা মার্গ আর দেসি যেদুটো এখনো কন্নড় লেখকেরা ব্যবহার করতে পারেন। মার্গ হল রাজকীয় প্রধান সড়ক আর দেসি হলও দিশি, আমাদের আপন। সবচেয়ে লক্ষ্যণীয় যে তিনি কন্নড়কে দেবলোক হতে অবতরিত বাণী, সংস্কৃতের মত দেবভাষা মনে করছেন না, বরং ক্ষেত্রানুসারে পরিভাষিত করছেন। বিদ্বানেরা বলেন যে কবিরাজমার্গের লেখকের ভুগোল ভাসা ভাসা এবং অস্পষ্ট। আবার তাঁদের মাঝে কয়েকজন আছেন যাঁরা বলেন যে এটাই তাঁর শক্তিওঃ
পৃথিবীর বৃত্তের মধ্যে, কাবেরী আর গোদাবরী নদীর মধ্যবর্তী স্থানে আছে সেই সংস্কৃতি-ভূমি (নাডু) কন্নড়, সুপরিচিত জনপদ, প্রসিদ্ধ, বিশিষ্ট রাজত্ব (বিষয়)। এবং এরও ভিতরে, কিসুভোলালের মধ্যে আছে একটি সংস্কৃতি-ভূমি, কোপন, পুলিগেরে, বনকোন্ডার বিখ্যাত সুমহান নগরী, ভালো মানুষেরা যার প্রশংসা করে। যদি কেউ জানতে চায় তো জানুক যে সেখানেই আছে কন্নড়ের হৃদয়ভূমি কন্নড় তিরুল।
এবং আমাকে জানানো হয়েছে, লেখক যে তিরুল কন্নড়ের সুপারিশ করছেন সেটা রাজধানীর কন্নড় নয়। রাজধানী থেকে দূরের। তাঁকেই উদ্ধৃত করা উচিৎঃ
কন্নড় ভবিতমদ জনপদম্‌ - যে জনতা নিজেকে কন্নড়ভাষী মানে এবং নিজের পরিচয় কন্নড় ভাষায় পায়।
            তাঁর শব্দে, কন্নড়ড়োল ভবিতমদ জনপদম্‌ - কন্নড়ে কল্পিত দেশ ও জনতা।
একটি ভাষা যেটি যাত্রা করেনা, একটি ক্ষেত্রবিশেষের মানুষকে পরিভাষিত করে। কিন্তু জনতার জীবনে ভাষার প্রয়োজন এখানেই ফুরোয় না। কেননা লেখক অনুসারে, সংস্কৃতের মত বিশ্বজনীন ভাষার বিশেষ যে কাজগুলো, সেগুলো বহির্জগতের সাথে সম্পর্কিত বিভাগবিশেষে প্রতিফলিত হয় বসুধবলয় বিষয় বিশেষমদেশজভাষাগতদুশ্চিন্তার কোনো স্থান নেই এখানে। যখন নাকি দান্তেরও এই দুশ্চিন্তা ছিল, যদিও কবিতায় নয়।

আমাদের প্রথম মহান কবি পম্পা তাঁর বিক্রমার্জুন বিজয়ম এমনই তিরুল কন্নড়ে লিখেছিলেন। তিনি কালিদাসের কৃতির সাথে পরিচিত ছিলেন কিন্তু কখনো ভাবেননি যে একটি এলাকাভিত্তিক ভাষা কালিদাসের কৃতির সামনে দাঁড়ানোর পক্ষে অপর্যাপ্ত হতে পারে। তিনি মার্গ (সংস্কৃতের জগৎ) এবং দেসি (দেশজভাষা ও তার বাগ্‌ধারা) কে মিলিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর কাব্যিক প্রক্রিয়া নিচে বর্ণিতঃ
কল্পনার দিক থেকে কাব্যকে নতুন হতে হবে এবং রচনার বুনট কোমল হতে হবে। এমত গঠিত হওয়ার পর রচনাকে স্থানীয় বাগ্‌ধারা (দেসিওল পুগুবুড়ু) গ্রহণ করতে হবে এবং শাস্ত্রীয় বাগ্‌ধারায় (মার্গডোল তালুবুড়ু) প্রবেশ করতে হবে। এই পথেই কাব্য সত্যই সুন্দর হয়ে উঠবে মঞ্জরী ও নবুঙ্কুরের ভারে নুয়ে পড়া, মৌমাছিতে ঘিরে ধরা, কোকিল এবং শুধুই কোকিলের গানে ভরা, বসন্তে কচি আমগাছের মত সুন্দর। (পোলককৃত অনুবাদ)

মার্গ/দেসি ধারণাটা আজ অব্দি কন্নড়ভাষা ব্যবহারের পথপ্রদর্শক হয়ে আছে। সেই কন্নড় যাকে সমৃদ্ধ হতে হবে ইংরেজী, ফার্সী ও অন্যান্য প্রতিবেশী ভাষা থেকে শব্দ ধার করে এবং তবুও নিজের বিশুদ্ধতা বজায় রাখতে হবে। এক মহান কন্নড় কবি আমায় একবার বলেছিলেন যে কন্নড় এমন এক অপ্সরা যার বহু প্রেমিক থাকা সত্ত্বেও কুমারীত্ব নষ্ট হয়নি।

প্রতিটি ভাষার একটি সামনের উঠোন ও একটি পিছনের উঠোন আছে। গ্রামে নিজের বাড়িটার কথাই ধরি। বড় বাড়ি। একটি চাউড়ি আর একটি সামনের উঠোন ছিল। ভিতরবাড়ি আর পিছনের উঠোন ছিল। সে উঠোনে একটি কুঁয়োও ছিল। সামনের উঠোনে আমার বাবার বন্ধুবান্ধবেরা আসতেন। বাবা হরিজন খবরের কাগজটা হাতে নিতেন, অনুবাদ করে ওদের শোনাতেন, স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং ওই ধরণেরই বিষয়াদি নিয়ে কথা বলতেন। আবার রামায়ণও শোনাতেন। কিন্তু যখন তিনি পিছনের উঠোনে যেতেন, সব জাতের মহিলারা এসে ভীড় করতেন আর তাদের সাথে সব বিষয়ে কথা বলতেন আমার মা। আমি তখন শিশু; এ সমস্ত কিছু শুনতাম। তাই আমি লেখক হলাম। যদি শুধু সামনের উঠোনে থাকতাম তাহলে রাজনীতিবিদ হতাম। প্রায় সবকটি ভারতীয় ভাষার একটি করে পিছনের উঠোন আছে। এবং আছে অতি-শুদ্ররা, যারা আজ সাক্ষর হয়ে উঠেছে এবং নিজেদের সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতা নিয়ে আসছে। লিখিত সাহিত্য থেকে অনেক বেশি আমাদের মৌখিক বা বাচিক সাহিত্য। এ সাহিত্য আছে পিছনের উঠোনে। আমাদের ভাষাগুলোর বিরাট ভবিষ্যৎ আছে কেননা পিছনের উঠোন সারাক্ষণ যোগান দিয়ে চলেছে। ইংরেজী ভাগ্যবান কেননা এর পিছনের উঠোন ছিল; লন্ডনে নয়, ইয়েটসের আয়ারল্যান্ডে, আফ্রিকায় এবং ভারতে। পিছনের উঠোন একটা ছিল আর তাই সেই পিছনের উঠোনের জনতা ইংরেজীকে বাঁচিয়ে রেখেছে।

ইংরেজী ছিল জ্ঞানের প্রবেশপথ। ওয়ারেন হেস্টিংসের অপসারণ আমাকে মুখস্ত করতে হয়েছিল কেননা বাবা বলতেন, দেখ, ব্রিটিশরা এত সত্যনিষ্ঠ যে তারা ওয়ারেন হেস্টিংসকেও সাজা দিয়েছে। ওর বক্তৃতাটা দেখ আর মুখস্ত করে ফেল।

তিনটে করে ভাষা সবাই জানে। আমি তাদের একটিকেও মাতৃভাষা বলিনা। মাতৃভাষা শব্দটা একমাত্র ইয়োরোপেই ব্যবহার করা চলে। কন্নড়ে আমি বলি মনে মথু, বীদি মথু, অত্তড় মথু। মনে মথু হল ঘরের ভাষা। অনেক কন্নড় লেখক বাড়িতে তেলেগুতে কথা বলেন। অগ্রহার কন্নড় ভাষায় লেখেন কিন্তু তাঁর মাতৃভাষা তেলেগু। অনেক লেখক, কবি আছেন যাঁরা কন্নড়ে লেখেন কিন্তু বাড়িতে তামিল বলেন। বেন্দ্রে যেমন, লিখতেন কন্নড়ে কিন্তু বাড়িতে বলতেন মারাঠি। সাংস্কৃতিক দিক থেকে এটা প্রয়োজনীয়। সারা ভারতে কেই নিজের মনে মথু ছেড়ে দেয়না।

বীদি মথু প্রদেশের ভাষা, মানে যে ভাষায় আপনি দুষ্টুমি করে রাস্তায় কোনো ছেলে বা মেয়ের সাথে কথা বলেন। কন্নড় হল বীদি মথুঅত্তড় মথু হল ওপরতলার ভাষা। রামানুজম একটি কবিতায় লিখছেনঃ
যখন খিদে পেত, খাবার পেতে মায়ের সাথে তামিলে কথা বলতাম। যখন মাথায় দুষ্টুমি খেলত, ছেলে মেয়েদের সাথে কন্নড়ে কথা বলতাম। আমার বাবা ছিলেন গণিতের অধ্যাপক। যখন আমায় ডাকতেন, ইংরেজীতে কথা বলতেন।

রামানুজমের বাবা রামানুজমের সাথে ফার্সীতে বা কোনো এককালে সংস্কৃতে কথা বলতেন হয়ত। হয়ত ভবিষ্যতে চীনের অর্থনৈতিক গুরুত্ব বেড়ে গেলে চীনেভাষা হবে আন্তর্জাতিক ভাষা। এবং তাতে কিছু আসে যায়না আমার। কিন্তু একটা অত্তড় মথু আমাদের দরকার, সম্পর্ক ভাষা হিসেবে। শঙ্করের দরকার পড়েছিল, রামানুজমের দরকার পড়েছিল, গান্ধীর দরকার পড়েছিল। আমারও দরকার, নইলে আপনাদের সাথে আমি কথা বলতে পারতাম না। শুধু মাতৃভাষার কথা বলে ব্যপারটাকে আবেগের সাথে জড়িয়ে দেবেননা। এটা ইয়োরোপ নয়। আমাদের দেশের সবকটি অঞ্চলে আমাদের ভাষাগুলো চলে। কর্ণাটকে যদি শুধু কন্নড় ধরণের ব্যাপার-স্যাপার চলে তাহলে তো এটা ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র হয়ে পড়বে! কর্ণাটকে অন্যান্য ভাষার জায়গা অবশ্যই থাকা উচিৎ এবং অন্য ভাষাভাষীদেরও বীদি মথুর বিষয়ে জানা উচিৎ। এটাই ভাষার প্রতি সঠিক দৃষ্টিকোণ।


ভাষা এবং ভারত

পোপের ক্ষমতার সাম্রাজ্য ভেঙে ধুলিসাৎ হওয়ার পর যে অর্থে ইয়োরোপে জাতিরাষ্ট্রের ধারণার আবির্ভাব হল, ভারত সে অর্থে একটি জাতি নয়, সভ্যতা। রবীন্দ্রনাথ এবং গান্ধী দুজনেই, ভারতে স্বাধীনতা সংগ্রাম চলার কালে এটা হৃদয়ঙ্গম করেছিলেন। হিন্দ স্বরাজএ গান্ধী ভেবেছিলেন যে আধুনিক পশ্চিমী সভ্যতা খারাপ এবং ব্রিটিশ শাসন থেকে আমাদের মুক্তির সংগ্রাম ব্রিটেনকেও, আধুনিক সভ্যতা সম্পর্কে তার ভ্রান্ত ধারণার কবল থেকে মুক্ত করবে। সোভিয়েত সঙ্ঘের বিফলতার, আধুনিক চীন ও বিশ্বায়নপথিক ভারতের লোভী সংস্কৃতির আমরা যেটুকু দেখেছি, আমরা হৃদয়ঙ্গম করেছি যে ক্ষমতার কেন্দ্রীভবনের সবকটি রূপই অনিষ্টকর। এবং টলস্টয় ও গান্ধীর মত দ্রষ্টা চিন্তানায়কদের মধ্যে নৈরাজ্যবাদী চিন্তার যে মহান ভাবনাগুলো পাওয়া যায় তার সবটা এক কথায় খারিজ করার দরকার নেই। তাঁরা বিশ্বাস করতেন যে মানবজাতি যদি স্বশাসিত ছোটো ছোটো সমুদায়ে জীবন ধারণ করে তাহলে তারা প্রকৃতির সাথে একাত্ম হবে আর সৃজনশীল হবে। এরই মধ্যে গান্ধী আবার প্রধানতঃ গ্রামীণ সমুদায়ের কথাই বলেছেন।

নেহরু মূলতঃ একজন বিশ্বনাগরিক ভাবুক, গান্ধীর স্বপ্নের প্রতি আকর্ষণটা আবেগের ছিল। অপেক্ষাকৃত ভাবে ছোটো, ভাষা-ভিত্তিক, একটা সীমা অব্দি স্বশাসিত রাজ্য গান্ধীর পঞ্চায়েত-রাজ আদর্শের কাছাকাছি ছিল। তবুও, পশ্চিমা অর্থে শক্তিশালী ভারতের স্বপ্ন দেখা নেহরু ভাষাভিত্তিক রাজ্য সৃজনের বিরুদ্ধে ছিলেন। কিন্তু যেহেতু নেহরু খাঁটি গণতান্ত্রিক ছিলেন তাই ভাষাভিত্তিক রাজ্যের দাবী মানতে বাধ্য হয়েছিলেন। বিশ্বনাগরিক ভারতীয় ইংরেজীশিক্ষিত যে শ্রেণীটা ছিল তারা যেমন সার্বজনীন ভোটাধিকারের বিরুদ্ধে ছিল তেমনই ভাষাভিত্তিক রাজ্যেরও বিরুদ্ধে ছিল। এদের কাছে কয়েকটি তৈরি শব্দ আছে ক্ষুদ্রতর স্বশাসিত সমুদায়ভিত্তিক রাষ্ট্রশক্তির প্রতি আকর্ষণ ও স্বপ্নকে হেয় করার।

ওই শব্দগুলো আমরা জানি সঙ্কীর্ণমনা, উগ্র জাতীয়তাবাদী ইত্যাদি। আমি এখানে স্পষ্ট করে বলতে চাই যে আমার ভাবনায় একজন বিশ্বনাগরিক ভাবুক ইউরোপকেন্দ্রিক, যখন নাকি একজন সমুদায়ভিত্তিক ভাবুক জৈব-বুদ্ধিজীবী এবং বিশ্বমানবতাবাদী।

কয়েক বছর আগে বিবিসি আমায় খুঁজে বার করল। তাদের বিশিষ্ট নির্দোষ হতবুদ্ধিতায় জিজ্ঞেস করল, এটা কি সত্যি যে আমাদের রাজ্য কর্ণাটকে (যার মধ্যে ব্যাঙ্গালোরের মত, তথ্যপ্রযুক্তির বিশ্বায়িত শহর আছে) কন্নড় আবশ্যিক হতে চলেছে? আমিও ততোধিক ছদ্ম-হতবুদ্ধিতায় জবাব দিলাম, এটা কি সত্যি যে ইংল্যান্ডে ইংরেজী আর ফ্রান্সে ফরাসি আবশ্যিক ছিল?

ভারতে আমরা বুঝেছি যে যদি আমরা দেশটাকে অতি-কেন্দ্রীয়তার দিকে নিয়ে যাই তাহলে আমাদের বালকানাইজ হয়ে পড়ার, ছোটো ছোট টুকরোয় ভেঙে যাওয়ার বিপদ ঘনাবে। এক কালে তামিলনাডু এধরণের প্রচার ও উগ্র আন্দোলনের উদাহরণ ছিল। আসাম এখনও আছে। আমাদের সভ্যতা তিনটে তত্ত্বের ওপর দাঁড়িয়ে গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং যুক্তরাষ্ট্রীয়তা। যখন ইন্দিরাজি শাসনে ছিলেন তখন তিনি যুক্তরাষ্ট্রীয়তাকে খর্ব করতে শুরু করলেন, সব রাজ্যে নিজের পোষা লোকগুলোকে বসিয়ে দিলেন আর হাইকমান্ড মানুষের সহ্যসীমা থেকে বেশি হাই অর্থাৎ উঁচু হয়ে গেল। পাঞ্জাবে শুরু হল বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন। ইন্দিরাজী জরুরী অবস্থা ঘোষণা করলেন। ফলে গণতন্ত্রও খর্ব হল আর তার ভয়ানক দাম দিতে হল তাঁকে। হালের বছরগুলোয় ভারতীয় জনতা পার্টি চেষ্টা করল আমাদের রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ প্রকৃতিটা বদলাতে আর ইন্ডিয়া শাইনিংএর স্লোগান সত্ত্বেও তাদের ক্ষমতাচ্যূত হতে হল।

আমরা সংস্কৃতির বহুলতাসম্পন্ন একটি সভ্যতা থাকার পথ খুঁজছি আর সেপথে এক কদম ছিল ভাষাভিত্তিক রাজ্যের গঠন। কিন্তু আমাদের বুঝতে হবে যে কর্ণাটকও একটি ক্ষুদ্র-ভারত এবং কন্নড় ভাষাসংস্কৃতির সামগ্রিক পরিবেশেও যেন কর্ণাটকের অন্যান্য ভাষাসংস্কৃতিগুলি যেমন টুলু, কোঙ্কণী, কোডাভা এবং উর্দু নিজেদের বহিরাগত না মনে করে। প্রায় সবকটি ভারতীয় ভাষাভিত্তিক রাজ্যে এই পরিস্থিতিটাই বাস্তব আর ভাষার এই মেলবন্ধনটাই কাম্য।

বেঙ্গালুরুতে আমাদের সন্তানেরা এক লাখ টাকা খর্চা করে আর বাজে প্রাইভেট স্কুলে ভর্তি হয় যেখানে সবকিছু ইংরেজীতে শেখানো হয়। স্কুল-ঘরে তারা জ্ঞানসৃজন করেনা, জ্ঞান শুধু তাদেরকে হস্তান্তরিত করা হয়। যখন নাকি মাতৃভাষী বিদ্যালয়ে স্কুল-ঘরে জ্ঞান সৃজন সম্পন্ন হয়, তারপর ছাত্রেরা ইংরেজী বা অন্যান্য ভাষায় যেতে পারে। আমি ইংরেজী বিরোধী নই। কিন্তু ছাত্রদের জ্ঞানসৃজন করা জানা উচিৎ। সার্বজনীন বিদ্যালয় তো স্বপ্ন হয়ে গেছে এখন। সরকার আশ্বাসন দিয়ে যায় কিন্তু সার্বজনীন বিদ্যালয় উপেক্ষিত হয় কেননা আমাদের সন্তানেরা সে স্কুলে যায়না। অথচ সরকারি স্কুলশিক্ষকেরা বেশি প্রশিক্ষিত, বেশি মাইনে পান। কেরলে দেখলাম ব্যক্তিগত উদ্যোগে ইংরেজী-মাধ্যম স্কুল খোলা হচ্ছে, তাতে শিক্ষক বহাল করা হচ্ছে খুব কম মাইনে দিয়ে। তাদের ইংরেজী অত্যন্ত খারাপ। কিন্তু গরীব মানুষও মনে করে যে যদি তারা ইংরেজী না জানে তাহলে বেশি দূর এগোতে পারবেনা। কেরল সরকার গঠিত একটি কমিটির তরফ থেকে, ছমাস পরিস্থিতির অধ্যয়ন করার পর যখন আমি আমার রিপোর্ট পেশ করেছিলাম তাতে সুপারিশ করেছিলাম যে সমস্ত সরকারি স্কুলগুলো যেন প্রথম শ্রেণী থেকে মৌখিক ইংরেজী শেখানো শুরু করে, কিন্তু শিক্ষাদানের মাধ্যম থাকবে ছাত্রদের মাতৃভাষা। কমিটির দুজন সদস্য রিপোর্টে স্বাক্ষর করেননি, কেননা বেসরকারি স্কুলমালিকদের জোট অত্যন্ত শক্তিশালী। যদি সরকারি স্কুল, সার্বজনীন বিদ্যালয়ের মান ভালোরকম উন্নত হয়, আমাদের সন্তানেরাও সে স্কুলে যাবে আর বেসরকারি উদ্যোগ মার খাবে। বেঙ্গালুরুতেও এটাই সত্য। সব জায়গায় এটা সত্য।

আমি মনে করি আমাদের কবিরাজমার্গএর যে আদর্শ, মার্গ আর দেসিকে মিলিয়ে এমন একটি ভাষা তৈরি করা যেটি নিজের এলাকার বাইরে হয়ত যাবেনা কিন্তু সমস্ত বিশ্বকে প্রতিবিম্বিত করতে সক্ষম হবে, তেমন ভাষা তৈরি করা সম্ভব যদি আমরা মনে মথু, বীদি মথু আর অত্তড় মথুকে যুক্ত করে নিতে পারি আর কোনো একটাকেও না ছাড়ি।

একটা গল্প দিয়ে শেষ করব। শ্রীকৃষ্ণ পরমাত্মা একটি সার্বজনীন বিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন। সেখানে তাঁর সাথী হলেন কুচেলা বা সুদামা। এক দরিদ্র মানুষ। আমার পৌত্রের সাথে সেটা হবেনা। এই সুপরিচিত গল্পের সুত্রে যা আমি বলতে চাই তা হল যে কুচেলাকে বন্ধু হিসেবে পেয়েছিলেন বলেই কৃষ্ণ ভগবান হতে পেরেছিলেন। সুদামা কৃষ্ণের বন্ধু না হলে এই পুরাকথাটা সম্ভবই হতনা। এবং কুচেলার মনেও কিছু আশা ছিল কেননা কৃষ্ণ তার বিদ্যালয়ের সাথী ছিল। আজ, আমরা আশাও ধ্বংস করেছি, মহিমাও ধ্বংস করেছি। এবং সেটাই বিশ্বায়ন। আমাদের সার্বজনীন বিদ্যালয় প্রণালীতে ফিরে যেতে হবে।       

  [ইংরেজী থেকে ভাষান্তরঃ বিদ্যুৎ পাল]