শুধু তাহাই নয় আনুসঙ্গিক যে আনন্দ, তাহার হ্রাসও তো দেশেরই ক্ষতি! বিশ্ব হ্যাপিনেস ইন্ডেক্সে দেশের গড়পড়তা আনন্দ বাড়াইতে হইলে আনন্দের এই উচ্চ শিখরগুলিকে উচ্চতর করিতে হইবে, তাহার নিমিত্তে যদি তলদেশের নিরানন্দ প্রসারিত হয়, তাহার হ্রাসেও তথা উদ্বেগের বৃদ্ধিই একমাত্র পথ। আপনারা কি অবহিত নহেন যে ধনত্রয়োদশী অথবা ধনতেরসে হিন্দিভাষী অঞ্চলে কোটি কোট দরিদ্র মানুষ, গৃহে সম্মার্জনী থাকিলেও আরো একটি সম্মার্জনী এবং/অথবা ঘরে কিছু কাটিয়া খাইবার না থাকিলেও চামচ কিনিয়া থাকে?
আজিকালকার সময় আধুনিক সময়। আন্তর্জাল গৃহীর শক্তি, গৃহিণীরও শক্তি; সন্তানাদির শক্তি তো অবশ্যই। সন্তানেরা যখন দূরদেশে কর্মক্ষেত্রে দূদিন-তিনদিনব্যাপী যাত্রায় ট্রেনে চাপিয়া যায়, প্রহরে প্রহরে উদ্বিগ্ন ফোন আসে, “খোকা, কদ্দুর পৌঁছোলি? খুকি, কোথায় তুই এখন? সকালের জলখাবার খেয়েছিস?” ইত্যাদি। ইতিবাচক প্রত্যুত্তরের সমর্থনে টাওয়ার দৃশ্যমান হইলেই হোয়াটস্যাপে ভিডিও খুলিয়া যায়, “এই দ্যাখো, আমার জলখাবার, এই দ্যাখো, চিলকা পেরুচ্ছি, এই দ্যাখো, আমাদের ক্যাম্পাস, এই দ্যাখো আমার ফ্ল্যাট, আমার পিজি, আমার ছাত, সামনের মন্দির …” উদ্বেগনিরসনের সুবিধা বৃদ্ধির সহিত উদ্বেগের অভিব্যক্তিবৃদ্ধি ও নিরসনশিল্পের উন্নতিতে আন্তর্জাল কম্পানিগুলির যে লাভ, তাহাও তো দেশেরই লাভ! বস্তুতঃ, বিমানযাত্রায় যে আন্তর্জাল বন্ধ রাখিবার ব্যবস্থা থাকে তাহা খুলিয়া দেওয়া উচিৎ। তাহা হইলে ভিডিও কলে উদ্বিগ্ন গুরুজনদিগকে বিমানসেবিকার স্মিতমুখ, গবাক্ষের বাহিরে মেঘপুঞ্জে সূর্যাস্ত, সমুদ্র ও পর্বতরাজি দেখাইবারও সুযোগ থাকিবে।
তাই বলি, উদ্বেগ লইয়া অযথা ঘাঁটাঘাঁটি করিবেন না। উদ্বেগ থাকিলে, তবে তো উদ্বেগ প্রশমিত করিবার ঔষধাদিও বিক্রয় হইবে? অমঙ্গলবিনাশী সত্যনারায়ণের পূজা অথবা যজ্ঞ-হোমাদি হইবে? পূজাসামগ্রী বিক্রয় হইবে, মহাদরিদ্র পুরোহিতসমাজের উপার্জন বাড়িবে; বিদেশের কথা ছাড়িলেও, মুম্বই, পুণে, ব্যাঙ্গালোর ইত্যাদি শহরে সে উপার্জন আইফোন ও রোলেক্স ঘড়িরও বিক্রয় বৃদ্ধি করে।
যদি আমি অমঙ্গলের আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন হইতে না পারি, খাওয়াদাওয়ায় কোনো ব্যাঘাত যদি না ঘটে, বার বার গৃহের বাহিরে-ভিতরে আসাযাওয়া না করি, প্রয়োজনীয় ঔষধাদি গ্রহণ বিস্মৃত না হই, তাহা হইলে কেমন আমার ভালোবাসা, কেমন আমার অপত্য স্নেহ, কেমন আমার শ্রদ্ধা? আমরা তো গর্ব করিয়া বলিতে পারি যে, যে ভগবান আমাদিগের চিত্তের বিকার নাশ করেন, বিশ্বের ও জীবের মঙ্গলে ও কল্যাণে আশ্বস্ত করেন, সব উদ্বেগ প্রশমিত করেন, আমরা আজিকার দিনে তাঁহাকেই লইয়া সর্বাধিক উদ্বিগ্ন! ভগবান আজি একটি জাতীয় উদ্বেগ!
যদিচ শেষ সত্য ইহাই যে উদ্বেগ, মানবসম্পর্কেরই পরিচায়ক ও অভিব্যক্তি। এবং তাহা আদিম। মানুষ মানুষের সহিত সম্পর্ক স্থাপিত করিয়াছে, উদ্বেগের জন্ম হইয়াছে। মানবী মানবকে ভালোবাসিয়াছে, উদ্বেগের জন্ম হইয়াছে। শিশুর জন্ম – মাতা ও পিতার হৃদয়ে উদ্বেগের জন্ম। বংশ, গণ, পরিবার ও বৃহত্তর সমাজনির্মাণের সহিত উদ্বেগের প্রসার ঘটিয়াছে। সেদিক দিয়া আধুনিক কালে আমরা আজ কম উদ্বিগ্ন হই। পাড়ার ছেলেটি বা মেয়েটি রাতে বাড়ি ফিরিল না কেন, তাহা শুধু মাতা, পিতা, ভ্রাতা, ভগ্নী বাদে কাহাকেও উদ্বিগ্ন করে না। গ্রামের সন্তানটি দূর দেশে গিয়াছে কর্মসংস্থানের সন্ধানে, পূজায় বাড়ি ফিরিবে না, সে শুধু তাহার পরিবারের উদ্বেগ। কোনো এক সময় গ্রামে বরযাত্রী আসিলে তাহাদের যত্ন ও গ্রামের কন্যাটির নির্বিঘ্নে বিবাহ পুরো গ্রামটির উদ্বেগের কারণ হইত, আজ? দেশের মানুষেরা তাহাদের ইতিহাসযাত্রায় বিগত শতাব্দীর প্রাক্কালে আসমুদ্রহিমাচল এই ভুখন্ডের শৃংখলমুক্তির উদ্বেগে এক হইতে পারিয়াছিল। আজি সে উদ্বেগ কোথা?
দেশের অর্থনৈতিক
ও অগ্রগতি ও বিকাশক্রমে আজি উদ্বেগও একটি শিল্প। বস্তুতঃ তাহা বিনোদন শিল্পের অংশ।
উদ্বেগ নির্মিত হইতেছে। কোটি কোটি টাকায় প্রস্তুত, অত্যাধুনিক যন্ত্রসমন্বিত তাহার
বৃহৎ কর্মশালায় সময়ানুসারে, বাজারের নেতৃবৃন্দের যেমত চাহিদা, বিজ্ঞাপনের বিনিময়ে সেমত
উদ্বেগ স্থান অথবা গণসমূহ বিশেষে উৎপন্ন করা হইতেছে, দেশের নেতৃবৃন্দের যেমত চাহিদা, বিজ্ঞাপন ও দাক্ষিণ্যের বিনিময়ে সেমত
উদ্বেগ স্থান অথবা গণসমূহ বিশেষে উৎপন্ন করা হইতেছে। দেশের অনুন্নতি গ্রাস করিতে করিতে
বিকাশ ক্রমশঃ সর্বগ্রাসী হইয়া উঠিতেছে।
No comments:
Post a Comment