Sunday, September 3, 2023

ছবি-মা

                                                 

[মা, বাবা, মানসী, দিদিমণি, মহিলা]

  

[সন্ধ্যা। মা কাজ করছেন। মেয়ের সঙ্গে বাবা দুহাতে সাইকেল সারাইয়ের যন্ত্রপাতি নিয়ে ফিরলেন। সঙ্গে সঙ্গে স্কুলের দিদিমণিও ঢুকলেন।]

দিদিমণি -      এ্যাই মানসী, ঠিক মত ক্লাস করিস না কেন রে?

মা -              হ্যাঁ, হ্যাঁ, বকুন তো ওকে! বাবা ওকে রোজ সকালে মোবাইলটা দিয়ে যায়, আর শ্রীমতী পনের মিনিট ছাতে গিয়ে বসেই নেমে আসেন। ছুট দেন বাবাকে মোবাইলটা পৌঁছে আসতে।

দিদিমণি -      ছাতে গিয়ে মানে?

মা -              নিচে নাকি ওই নেট আসে না। তাই মই বেয়ে ছাতে উঠে পড়ে।

দিদিমণি -      এই ঠান্ডায়?

মা -              কী করবে? না হলে আশে পাশে কারোর দোতলায় যেতে হয়।

বাবা -           কেন, সেদিন তো দেখলাম, কোথায় যেন বাবা মেয়েকে সাইকেলে বসিয়ে ছুটছে ক্ষেতের পাশ দিয়ে! দশ মাইল গেলে তবে নেট আসে সেখানে ঢিপির ওপর বসে মেয়ে ক্লাস করে!

দিদিমণি -      আচ্ছা। কিছুদিন তো। সব সময় কি এরকম থাকবে? আবার শুরু হবে ক্লাস! কিন্তু ফাঁকি দিলে তো তখনও চলবে না। কী রে মানসী! স্কুলে তো তুই ক্লাস ফাঁকি দিতিস না!

মা -              বন্ধুবান্ধব থাকত যে! ঘরে বসে তো আর সেটা পায় না।

দিদিমণি -      না মানসী, ক্লাসগুলো ছাড়িস না। পিছিয়ে যাবি।

মানসী -         বাবার অসুবিধে হয়, মোবাইল ছাড়া।

মা -              বাবার অসুবিধে না কচু। আসলে ওর ওই সাইকেলের যন্ত্রপাতি ঘাঁটতে, তেলকালি মাখতেই ভালো লাগে। সেই যে যায় সকালে, দুপুরে গিলতে আসে। আবার বেরিয়ে যায়। একটা কাজ দিই না ওকে ঘরের, তারপর এই অবস্থা।

দিদিমণি -      কিরে। মা যা বলছে ঠিক?

মা -              ও আবার কী বলবে? ওর বাপকেই জিজ্ঞেস করুন না! বাপকে তো বলেইছে লেখাপড়া করতে ওর ভালো লাগে না। তা থেকে সাইকেল সারাই ভালো।

দিদিমণি -      সে তো খুব ভালো কথা! বড় হয়ে ইঞ্জিনিয়ার হবি। কিন্তু লেখাপড়াটা তো শিখতেই হবে! কাল থেকে লক্ষ্য রাখব। আদ্ধেক ক্লাস করে পালাবি না।  

[দিদিমণি বারমুখো হন। মেয়ে দিদিমণিকে এগিয়ে দিতে আসে। মেয়েটির বাবা ঘরে ঢোকেন। মা বাইরেই কাজ করতে করতে ধিমে গলায় একটা গান গাইতে থাকেন।]

বাঃ, তোর মা এত সুন্দর গান গায়!

মানসী -         হ্যাঁ, ওইরকমই। বললে কিছুতেই গাইবে না। (একটু ভেবে) দিদি, তোমার মোবাইলটা একটু দেবে?

দিদিমণি -      কেন?

মানসী -         দাও না শিগগির। মায়ের গানটা রেকর্ড করব।

[দিদিমণি মোবাইলটা দিয়ে দেয়। মেয়ে চুপিচুপি গিয়ে রেকর্ড করা শুরু করে কিন্তু মা বুঝতে পেরে গান থামিয়ে দেন।]

                   এ কী হল? গাও না মা!

মা-               যা ভাগ্‌!

মানসী -         ঠিক আছে, কথা দিচ্ছি তুমি গানটা গাইলে আমি ক্লাসে ফাঁকি দেব না, পুরোটা করে তবে বেরুব। গাও!

মা -              তুই ক্লাস কর আর না কর, আমি গাইব না। আবার মোবাইল নিয়ে এসেছে রেকর্ড করতে।

মানসী -         (রাগের ভান করে) তোমাকে কি গ্রুমিং করতে হবে ইন্ডিয়ান আইডলের কম্পিটিশনের জন্য? গাও বলছি!

[আওয়াজ শুনে ভিতর থেকে বাবাও বেরিয়ে এসে মাকে গাইতে বলেন। মেয়ে কিছুক্ষণ জড়িয়ে টড়িয়ে ধরার পর মা গান ধরেন একটা, মেয়ে রেকর্ড করে। দিদিমণি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা উপভোগ করেন। গান গাওয়া হয়ে গেলে মেয়ে ঘর থেকে বাবার মোবাইলটা নিয়ে এসে অডিওটা ট্রান্সফার করে। তারপর দরজার কাছে এসে মোবাইলটা দিদিমণিকে ফেরায়।]

ওঃ, আপনার মোবাইল থেকে ডিলিট করলাম না।

দিদিমণি -      করিস না। দরকার নেই। একটু পরে জুমে ক্লাস নেব বিজ্ঞানের। হোয়াটস্যাপে মেসেজ করে দিয়েছিলাম, দেখেছিস তো?

মানসী -         দেখেছি।

[দিদিমণি ঈষৎ দূরে, যেন নিজের বাড়িতে গিয়ে একটা টেবিলের সামনে চেয়ার নিয়ে বসে, টেবিল থেকে বই টেনে বার করে পড়তে শুরু করেন। তারপর মোবাইল খুলে জুম অন করেন।]

দিদিমণি -      হ্যাঁ, সবাই নিজেদের ভিডিও, অডিও অন কোরো না। যখন যার কিছু প্রশ্ন করার হবে, অন করবে। মন দিয়ে দেখ, আমি একটা মডেল দেখাচ্ছি

[মা উঠোনটা ঝাঁট দেওয়া শুরু করেন। বাবা নিজের জিনিষপত্র গুছিয়ে দোকানে যাওয়ার তোড়জোড় করেন। মানসী একটা হাইস্টুলে উঠে মোবাইলটা খুলে বসে, যেন ওটাই ছাত। ক্লাসে জয়েন করে, মন দিয়ে মডেলটা দেখে আর দিদিমণির বোঝানো শুনে ঘাড় নাড়ে। তারপর অডিও, ভিডিও অন করে]

মানসী -         দিদি, একটা প্রশ্ন। সৌরমন্ডলে বুধ, শুক্র, পৃথিবী, মঙ্গল, বৃহস্পতি, শনি এই ছটা আমাদের এখানকার নামে জানি

দিদিমণি -      হ্যাঁ, সূর্য বা রবি নিয়ে আমাদের সপ্তাহের সাতটা দিনের নাম

মানসী -         তাহলে ইউরেনাস, নেপচুন আর প্লুটোকে ইংরিজি নামে জানি কেন? অথচ বলার সময় তো নবগ্রহ বলি!

দিদিমণি -      নবগ্রহ বলি ভারতীয় জ্যোতিষ অনুযায়ী, যাতে সূর্যও একটা গ্রহ আর রাহু, কেতু দুই ছায়াগ্রহ। আজকাল ইউরেনাস, নেপচুন আর প্লুটোরও কিছু নামকরণ হয়েছে, কিন্তু তিনটে গ্রহই এদিককার আবিষ্কার।

                   [কিছুক্ষণ মূকাভিনয়েই ক্লাস চলতে থাকে। দিদিমণি নিজের চেয়ারে বসে বলে যান আর মানসী হাইস্টুলে বসে শোনে।]

মানসী -         [হঠাৎ মানসী অবাক বিস্ময়ে চেঁচিয়ে ডাকে নিচে উঠোনে কাজ করতে থাকা মাকে] ও মা দেখ! দিদিমণি তোমার গাওয়া গানটা বাজাচ্ছে ক্লাসে! (তাড়াতাড়ি মেসেজ করতে থাকে দিদিমনিকে)।

মা -              (নিচে থেকে, শুনে) এ মা! ছি ছি! নিচে আয়! দেখা!

মানসী -         যা  শেষ হয়ে গেল।

[দিদিমণির কণ্ঠস্বর এবার শোনা যায়।]

দিদিমণি -      তোমরা যারা ক্লাসে জয়েন করেছ সবাইকে বলছি, তোমরাও এটা করো। নিজের নিজের মাকে, ঠাকুমা-দিদিমাকে গান গাইতে বলে, কবিতা আবৃত্তি করতে বলে ছোট্টো ছোট্টো ভিডিও বা অডিও ক্লিপ তৈরি করে আমায় পাঠাও। ক্লাসের সঙ্গে সঙ্গে এটাও চলবে মাঝে মাঝে। কী? মজা হবে না?

                   [হঠাত দিদিমণির পাশে নিঃশব্দে এক মধ্যবয়স্ক মহিলা এসে দাঁড়ান। মানসীও দেখতে পায় নিজের মোবাইলে।]

মহিলা -         দারুণ মজা হবে। (দিদিমণি চমকে ঘুরে তাকান।)

দিদিমণি -      আপনি! আপনি কে?

মহিলা-          ওমা, আমাকে চিনলে না?

দিদিমণি -      আপনি ………

মহিলা -         তুমি যে স্কুলে পড়াও আমি তো সে স্কুলেই থাকি!

দিদিমণি -      স্কুলে? কোথায়?

মানসী -         (ফোনে) কার সাথে কথা বলছ দিদি?

দিদিমণি -      জানি না। এক ভদ্রমহিলা এসেছেন

মহিলা -         দেখাও না দেখাও! আমার চেহারাটা দেখাও ওকে! এ তো তোমাদের যুগের যন্ত্রপাতি। মুখ দেখা যায়, গলা শোনা যায় আমাদের সময় কি আর এসব ছিল?

দিদিমণি -      (একদৃষ্টে তাকিয়ে, ঈষৎ ভয় পেয়ে) আপনাদের সময় মানে?

মহিলা -         (মুচকি হেসে) একশ বছরের বেশি হয়ে গেল ভাই, পৃথিবীতে তোমারই মত ছিলাম।

                   (মোবাইলে অনেকগুলো বালিকা কন্ঠস্বর একসাথে কলরব করে ওঠে দেখান না দিদি, কে? দিদিমণি মোবাইল ক্যামেরাটা মহিলার দিকে ঘোরান।)

মানসী -         (দেখেই চমকে উঠে) আরে ইনি তো সেই ছবি!

দিদিমণি -      ক্কে কে, কার কথা বলছিস?

মানসী -         স্কুলের অফিসে হেডদিদির চেয়ারের পিছনে যাঁর ছবি টাঙান আছে!

দিদিমণি -      (চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠে পিছিয়ে যায়, তারপর সামনে আসে) ভুত! আপনি আপনি কিভাবে ম্যাডাম? (এগিয়ে আঙুল দিয়ে স্পর্শ করতে যায়।)

মহিলা -         উঁহুঁ হুঁ। কিছু পাবে না। ভুতও বলতে পারো। তোমার ভিতরেই আছি যে! ম্যাডাম নয়, মা, মাসি, পিসি, দিদি যা খুশি বল। (মোবাইলে পড়ুয়াদের) তোমাদের সঙ্গেই আমি থাকি সব সময়। আর মানসী, তুমি বলছিলে না তোমার সাইকেল সারাই করতে খুব ভালো লাগে?

মানসী -         (বিস্ফারিত চোখে) হ্যাঁ।

মহিলা -         তা তুমি সাইকেল সারাইও তো শেখাতে পার ক্লাসে। আজকাল তো তোমরা মেয়েরা কী সুন্দর সাইকেল চালাও তুমি তোমার ক্লাসের বন্ধুদের শিখিয়ে দাও, সাইকেলে কী কী সমস্যা আসতে পারে, তার মধ্যে কী কী নিজের হাতে সারান যেতে পারে। সারাতে গেলে কোন কোন জিনিষ নিজেদের ব্যাগে রাখতে হবে পারবে না, শেখাতে?

মানসী -         পারব।

মহিলা -         (দিদিমণিকে) এভাবে মেয়েদের মধ্যে যে যা হাতের কাজ জানে সব তারা শেখাবে ক্লাসে। এতেই তো পড়ার আনন্দটা বাড়বে।

                   [মহিলা আস্তে করে বেরিয়ে যান। দিদিমণি অবাক অপলক দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে থাকেন। দূরে মাইকে ঘোষণা হয় যে, ভাইরাসের প্রকোপে বৃদ্ধি দেখা গেছে বলে স্কুল আরো তিন মাস বন্ধ থাকবে। সবাই যেন নিয়ম মেনে শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে চলাফেরা করে, মাস্ক ধারণ করে এবং বার বার সাবান দিয়ে হাত ধোয়। মেয়েটি মোবাইল অফ করে লাফিয়ে নামে টুল থেকে, তারপর বেরিয়ে যায়।]

মা -              কোথায় চললি? আজকেও ক্লাস পুরো করলি না তুই!

মানসী -         করব। আগে দোকানে যাই। শেখাতে হলে ভালো করে শিখতে হবে।

মা -              শেখাতে হবে! কাকে?

মানসী -         আমারই ক্লাসে; ওই যে, ছবি-ম্যাডাম ওঃ না, ছবি-মা যা বললেন!

মা -              ছবি-মা! সে কে?

মানসী -         ক্লাসে এসেছিলেন তো! সবচেয়ে বড় ম্যাডাম। যাঁর ছবি টাঙান আছে হেডদিদির মাথার ওপর!

মা -              কী? পাগল হয়ে গেলি নাকি? কী বলছিস?

মানসী -         পরে বোঝাব। (একটা চাদর জড়াতে জড়াতে জবাব দেয়) তুমি জানো, সব সায়েন্স! হ্যান্ডেল সোজা করা, প্যাডেলের এক্সেল ব্যালেন্স করা, চাকার টিউনিং, ফ্রিহুইলের বেয়ারিং বসান, পাংকচার টিউবে তাপ্পি লাগান, তার ওই আঠা সলিউশন

মা -              বুঝি না, কী বলিস (বলে মেয়ের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে মাথা নেড়ে নিজের কাজে মন দেন। একটু পরে সামনের দিকে তাকিয়ে হেসে বলেন) মেয়ের জন্য ভেবে ভেবে মরছি এমন নয়। ওরাই বা কী করবে? স্কুলে যাওয়ার আসল মজাটাই যে নেই আজকাল। এমনিতেও হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে। দিদিমণি বলল নাকি ইঞ্জিনিয়ার হবে। কী করে হবে? টাকা কোত্থেকে আসবে?

[মা ভিতরে চলে যান। কিছুটা সময় যায়। একবার আলোগুলো স্তিমিত করে আবার বাড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে। মানসী বাবার দোকান থেকে ফিরে ওদিকে দিদিমণির বাড়িতে পৌঁছোয়। দিদিমণি দরজা খোলেন। দুজনে দূরে দূরে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে বসে।]

মানসী -         দিদিমণি, ওই ছবি-মা কে ছিলেন?

দিদিমণি -      উনিই আমাদের এই স্কুলটা তৈরি করেছিলেন।

                   [হঠাৎ আবার সেই মহিলা ঢুকে পড়েন তাদের পিছন দিক থেকে]

মহিলা -         উহুঁ। ভালো করে পড়নি স্মরণিকাটা। (বলে দিদিমণি যে বইটা পড়ছিলেন সেটা উঠিয়ে পাতা ওল্টান। তারপর অন্যমনস্ক হয়ে পড়েন।) অবশ্য সে তথ্যটা খুব জরুরি নয়। তোমাদের জন্য জানা জরুরি যে আমি একা ছিলাম না। উনিশ শতকে, বা বিশ শতকের শুরুতে আমার মত অনেকে ছিল যারা নিজে বিশেষ লেখাপড়া না শিখতে পেরেও শিক্ষার আলো নিয়ে গেছে মেয়েদের মাঝে। তাদের কথা তোমাদের জানা জরুরি।

মানসী -         (ভয়ে ভয়ে) আপনি কি ভুত?

মহিলা -         তুমি না লেখাপড়া শিখছ? ভুত হয়?

মানসী -         তাহলে?

মহিলা -         আমি তোমাদেরই মনের ভিতরটা। সেখানে যে স্কুলের অফিসঘরে টাঙানো একটা পুরোনো ছবি আঁকা হয়ে আছে! সেই। তোমাদের কৌতুহলে বেঁচে উঠেছি, বলতে পারো।

মানসী -         ছুঁয়ে দেখব?

মহিলা -         (মুচকি হেসে) তোমাদের এখন সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং চলছে না? তবে যে কথাটা বলছি শোনো। আগেকার যুগের আমরা অনেক লড়াই করে লেখাপড়া শিখেছি, তোমাদের লেখাপড়ার ব্যবস্থা করেছি। সেটাকে কখনো অশ্রদ্ধা কোরো না।

মানসী -         আপনার বিষয়েই একটু বলুন না ছবি-মা?   

দিদিমণি -      (মানসীর দিকে চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে) এ্যাই, কী হচ্ছে? অঘোর কামিনী ওনার নাম

মহিলা -         থাক না এখন! ছবি-মা-ই ভালো। আমি কিন্তু একদমই লেখাপড়া শিখিনি ছোটোবেলায়। অ-আ-ক-খ-ও লিখতে জানতাম না। বিয়ে হয়ে গেল। দশ বছর বয়সে। ভাগ্যিস বরটা খুউব ভালো পেয়েছিলাম। বাইরে বাইরেই থাকত, রোজগারের তালাশে। বড় শ্বশুরবাড়িতে বেকার ভাইয়ের বৌয়ের কাজের বহরটা সে জানতেও পারতো না। কিন্তু যখনি আসতো, রাতে যতই ঘুম পাক আমার, জোর করে বসিয়ে আমায় অ-আ-ক-খ লেখা শেখাতো। পাগলের মত ভালোবাসত আমাকে। কী, না বৌ হলে চলবে না, সাধনসঙ্গিনী হতে হবে।

দিদিমণি -      সাধনসঙ্গিনী বলতে?

মহিলা -         ও তো ব্রাহ্ম ছিল, তাও নববিধান মতে। পরমেশ্বরে ভক্তি আর মানুষের সেবায় লীন হওয়াই সে মতে প্রকৃত ভালোবাসার পথ। যত লীন হবে, তত দেখবে যে একে অন্যকে নিজের ভিতরে পাচ্ছ। তুমি তো আর ছোটো মেয়ে নও মানসী। আজকাল তো ভাবভালোবাসার মানুষ তোমরা নিজেরাই জুটিয়ে নাও। তোমার দিদিমণিও নেবে (দিদিমণি লজ্জা পায়), তারপর তুমিও নেবে (মানসীও লজ্জা পায়)। খেয়াল রেখ যে সে তোমায় তার মত করে যেমন ভালোবাসে, তোমার মত করেও যেন ততটাই ভালোবাসে এবং মর্যাদা দেয়। আমার তো সৌভাগ্য ছিল যে তেমন মানুষ পেয়েছিলাম, সবাই কি আর পেত? এখনো পায়?

দিদিমণি -      তবে এটা কিন্তু ঠিক ছবি-মা যে মর্যাদা পাওয়াটা খুব জরুরি। এই যে কাদম্বিনী গাঙ্গুলির কথা আমরা পড়ি, তাঁর বর, দ্বারকানাথ গাঙ্গুলি তিনি তো মাস্টারমশাই ছিলেন, আগের একটা বিয়ে ছিল, তার সন্তান, বয়সের ফারাক ৩৯ আর ২২, সতেরো বছর আগের বৌয়ের দুটো আর কাদম্বিনীকে দিয়ে আটটা দশটা সন্তানকে মানুষ করলেন কাদম্বিনী, শুনলে কিরকম বীভৎস লাগে। মনে হয় বরটাই অমানুষ। অথচ দেখুন, দ্বারকানাথ না এগিয়ে এলে কাদম্বিনীকে বেশ্যা বলা বন্ধ হত না, বদমাইশ গোঁড়া মানুষগুলোর উচিৎ শিক্ষা হত না, কাদম্বিনীরও মেডিক্যাল পড়া হত না। আমরা যে গর্ব করে বলি ভারতে প্রথম মহিলা ডাক্তার!

মহিলা -         একদম ঠিক। আসলে তখন জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যাপারটাই লোকের অজানা ছিল। কাজেই শুধু ওই দিকটা দিয়ে বিচার করতে গেলে ধোঁকাও খেতে পারো। আমারই তো দশে বিয়ে আর ছাব্বিশে পৌঁছোতে পৌঁছোতে পাঁচটা সন্তান, তাও কত কম আমরা এক সঙ্গে থাকতে পেরেছি। নিজের ঘর কোনো আশ্রিতকে দিয়ে বারান্দায় শুয়েছি। কিন্তু ওই যে গোঁ-টা ওর ছিল, যে আমায় উপযুক্ত সাধনসঙ্গিনী বানাবে, সেটাই আমার গোঁ হয়ে গেল। উপযুক্ত সাধনসঙ্গিনী হবই। ভক্তি আর সেবায় পুরোপুরি ডুবে যাবো। বিধান যখন পেটে ছিল তখনই প্রশ্নটা আসতে শুরু করল। প্রার্থনার সময় পেটে নড়াচড়া করত, মন উচাটন হত আমার। তখনই বিধানের বাবাকে বললাম, আর নয়। আমাদের ক্ষণিক শারীরিক মিলনের সুখ বা সাধ যেন আমাদের সাধনপথকে বিঘ্নিত না করে। সাধনপথেই হোক আমাদের মিলনের পথ। আত্মিক মিলন চিরসাথী হব আমরা। সে যদি না মানতো, হত? কত কষ্ট হয়েছে মানুষটার, আমারও হয়েছে, কিন্তু অবিচল থেকেছি দুজনেই। সঙ্কল্পে সফল হয়ে আধ্যাত্মিক বিবাহ সেরেছি।

মানসী -         আধ্যাত্মিক বিবাহ?

দিদিমণি -      আমিও বুঝলাম না।

মহিলা -         এমন কিছু কঠিন ব্যাপার নয়। আমরা ব্রাহ্মমতে সেরেছিলাম। কিন্তু তোমরা সাধারণভাবে চিন্তা করতে পারো। জীবনে যদি বড় কিছু করতে চাও, আর এমন জীবনসঙ্গী পেয়েছ যে সেও চায়, তাহলে দুজনে মিলে একটা দিন ধার্য্য করে, নিজেদের পছন্দসই কোনো জায়গায় দাঁড়াও নদীর ধারে, মন্দিরে, কোথাও। বন্ধুবান্ধবেরাও থাকবে। দুজনে একে অন্যের হাত ধরে সঙ্কল্প নাও যে আজ থেকে মানুষের যে সেবায় নেমেছি সে সেবাই আমাদের প্রেম, সে সেবায় সাফল্যই আমাদের মিলন। ব্যস, এটাই আধ্যাত্মিক বিবাহ বলতে পারো।

মানসী -         আপনারা কোথায় গিয়ে করেছিলেন?

মহিলা -         রাজগীরে গিয়ে। তারিখটাও মনে আছে (হাসেন) ২৭শে জানুয়ারি, ১৮৯১।  তারপর তো স্কুলের বিষয়ে ভালোভাবে চিন্তা করতে পেরেছি। দুই মেয়েকে নিয়ে আমি গেছি লখনৌ, মিস থোবার্নের স্কুলে আর সে থেকেছে তিন ছেলেকে নিয়ে পাটনায়।

দিদিমণি -      বড় মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন না?

মহিলা -         টিঁকলো কই। যাকে ভালোবাসত তার সঙ্গেই বিয়ে দিলাম, বেজাতে বিয়ে দিয়েছি বলে একঘরেও হলাম কিন্তু সে ছেলেই ছেড়ে চলে গেল।

মানসী -         একঘরে?

দিদিমণি -      একঘরে মানে, সমাজ থেকে বার করে দেওয়া, কেউ কথা বলবে না, কেউ বাড়িতে আসবে না, ডাকবেও না কেউ, পারলে দুধওয়ালা, খবরের কাগজওয়ালা বন্ধ করিয়ে দেবে আগে বলত ধোপানাপিত বন্ধ করিয়ে দেওয়া

মহিলা -         এমনিতেও। পাটনায় আসার পর একঘরেই ছিলাম। পর্দা মানি না, ব্রাহ্ম, একা একা রাস্তায় হেঁটে যাই, পথে কাউকে অসুস্থ দেখলে বাড়িতে নিয়ে আসি, মেয়েদের রাখি আর পড়াই দোষ কম নাকি? কারোর বাড়িতে নেমন্তন্নে গেলাম, এ্যাই এ্যাই এ্যাই ওখানে বোসো না, আপনি তো দেখছি সব পণ্ড করে দেবেন এ্যাই কে আছিস? ওদিকে কোনায় একটা আসন পেতে দে এনার জন্য, আলাদা করে আর এই জায়গাটা একবার গঙ্গাজল দিয়ে মুছে দে এই ছিল আমার অবস্থা!

দিদিমণি -      রোকেয়া বেগমকেও তো ভাগলপুর থেকে উৎখাত করেছিল তার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা। স্কুল বন্ধ করে দিয়েছিল। কী কী সব বলত তার তাঁর বিষয়ে। বিবাহিত জীবনেও কথা শুনতে হত। নিঃসন্তান ছিলেন। অথচ তাঁর বর, সখাওয়ত সাহেব যদি স্ত্রীকে তার সম্ভাবনায় না ভালোবাসতেন, মর্যাদা না দিতেন যে এই নারী একদিন দিশারি হবেন, টাকা জমিয়ে তার হাতে না দিয়ে যেতেন তাহলে কীভাবে এগোতেন রোকেয়া? কীভাবে আলোর পথে নিয়ে যেতেন মুসলমান ঘরের অন্ধকারে থাকা অবরোধবাসিনীদের?

মানসী -         আমার বইয়ে সাবিত্রীবাই ফুলের বিষয়ে আছে। তাঁকেও নিশ্চয়ই ভালোবাসতেন জ্যোতিবা ফুলে?

দিদিমণি -      ভালোবাসতেন শুধু নয়, নিজের স্ত্রীয়ের এক স্বাধীন নারী হিসেবে এগিয়ে চলার ইচ্ছেটাকে ভালোবাসতেন, যথাযোগ্য মর্যাদা দিতেন। ভালোবাসায় এই দিকটা জরুরি। নইলে

মানসী -         নইলে?

দিদিমণি -      সন্দেহজনক (দুষ্টুমি ভরা চোখে ছাত্রীর দিকে তাকিয়ে হাসেন)।

মহিলা -         এটা তোমাদের সময়কার ভাষা। আমি তো বেশিদিন আর রইলামও না। আমার যাওয়ার পর বিধানের এটাও আমাদের সময়কার চিহ্ন, তাই না? বার বার বিধানের বাবা বলছি, সুসারের বাবাও বলতে পারতাম, এখনকার সময়ের মানুষ হলে। তা তিনিই তো উদ্যোগ নিলেন আর এই প্রদেশে মেয়েদের প্রথম সরকারি স্কুল হিসেবে রয়ে গেল আমার স্কুলটা।

                   [বাইরে মানসীর মা ডাকছেন। আওয়াজটা শুনেই মহিলা পিছনে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।]

মা -              এ্যাই মানসী, এখানে বসে আছিস? বাড়ি যাবি না? কত কাজ পড়ে আছে।

[মানসী বেরিয়ে এসে মায়ের সঙ্গে বাড়ির দিকে রওনা দেয়। দিদিমণি ভিতরে চলে যান।]

                                                ------------------

[বিকল্পে]

দিদিমণি -      (নিজের চেয়ার ছেড়ে এগিয়ে এসে গুনগুনিয়ে ওঠেন)

জানার লড়াই

    বড় লড়াই

             লড়তে হবে

                                                    দিন-রাতও

    যাচ্ছে চুরি,

    ধরতে হবে

               মানসী -                         যেমন করে

             পারো শুরু

              করতে হবে

              তিনজনে (মাকে নিয়ে) -      আকাশের

              লিখনগুলো

    পড়তে হবে

 

১৭.১.২৩  / ২.৯.২৩

No comments:

Post a Comment