বড় বড় নাম ধরে এগোনোটাই প্রথা (তাতে কাজটা সহজও হয়)।
প্রথম নাম নেব বলদেব পালিত (১৮৩৫ – ১৯০০)। বলদেব পালিত একজন যশস্বী কবি। পাটনার দানাপুর সৈন্য-ছাউনিতে চাকরি
করতেন এবং দানাপুর শহরেই থাকতেন। ‘সাহিত্যসাধক চরিতমালা’র দ্বিতীয় খন্ড বলে, “বলদেব পালিত শুধু যে কবিত্বশক্তির অধিকারী
ছিলেন তাহা নহে, তিনি ছিলেন সংস্কৃত কাব্য সাহিত্য দর্শন নাটকাদির একজন অক্লান্ত পাঠক।
তাঁহার মধ্যে প্রতিভা ও পাণ্ডিত্যের দুর্লভ সংমিশ্রণ হইয়াছিল। বাংলা কবিতায় বিবিধ সংস্কৃত
ছন্দের প্রবর্ত্তন সাহিত্যক্ষেত্রে তাঁহার সর্ব্বপ্রধান কৃতিত্ব। মালিনী, উপজাতি, বসন্ততিলক
প্রভৃতি দুরূহ সংস্কৃত ছন্দে বাংলা কবিতা রচনা করিয়া তিনি বাংলা-কাব্যের রূপের বহুধা
বিচিত্র বিকাশের পথ সুগম করিয়া দেন। তাঁহার পূর্ব্বে আর কোনও বাঙালী কবি, এমনকি ভারতচন্দ্র
পর্য্যন্ত এত বিভিন্ন ও বিচিত্র ছন্দে কবিতা রচনা করেন নাই। কাজেই এক্ষেত্রে তাঁহাকে
অগ্রণী বলিলে অতিশয়োক্তি হইবার সম্ভাবনা নাই। সংস্কৃত ছন্দকে বাংলা কবিতায় স্বচ্ছন্দভাবে
ব্যবহার করিয়া বলদেব যে শক্তির পরিচয় প্রদান করেন তাহাতে স্বয়ং বকিমচন্দ্র পর্য্যন্ত
মুগ্ধ হইয়া তাঁহার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা না করিয়া থাকিতে পারেন নাই।” যদিও, ন্যায্যভাবেই বঙ্কিমচন্দ্র তাঁকে
‘অনাধুনিক’ বলেছিলেন, কেননা সাহিত্যের, বিশেষকরে কাব্যের
মননকেন্দ্র কলকাতায় সে সময় যে আলোড়ন চলছিল, বলদেব পালিত সে সম্পর্কে অনবহিত ছিলেন মনে
হয়।
দ্বিতীয় নাম কেদারনাথ বন্দোপাধ্যায় (১৮৬৩
– ১৯৪৯)। তাঁর জন্ম ও শিক্ষা বাংলায়। কর্মজীবন
পুরোটাই বিহারের বাইরে। সাহিত্যজীবন ও খ্যাতিও প্রায় পুরোটাই বিহারের বাইরের। তবুও
তিনি বিহারের বাংলা সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ নাম কেননা শেষ জীবনে বিহারের পুর্ণিয়ায় এসে
থাকতে শুরু করার পর তাঁর বৈঠকখানায় যে সাহিত্যবাসর গড়ে ওঠে সেখানেই তরুণ সতীনাথ ভাদুড়ীর
সাহিত্যবোধের মনে-খড়ি (হাতেখড়ির মত) হয়। সেছাড়াও, ‘প্রবাসী বঙ্গসাহিত্য সম্মেলন’এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তিনি। বিহার
বাংলা আকাডেমি উনিশশো আশির দশকে তিন খণ্ডে কেদার রচনাবলী প্রকাশ করে। চতুর্থ খন্ড অপ্রকাশিত
থেকে যায়।
তৃতীয় নাম হিসেবে আমরা অবশ্যই শরৎচন্দ্র
চট্টোপাধ্যায়ের (১৮৭৬ – ১৯৩৮) নাম উল্লেখ করব। এ কারণে নয় যে তাঁর কৈশোর ও যৌবনের প্রথমাংশ
ভাগলপুর অঞ্চলে কেটেছিল। এ জন্যও নয় যে তাঁর রচনায় সেখানকার মানুষজন ও প্রকৃতি এসেছে।
সেসব ‘বাংলাসাহিত্যে বিহার’ বিষয়ের অন্তর্গত। তাঁর নাম একারণে নেব
যে তিনি, এবং একমাত্র তিনিই, দৃষ্টান্তস্বরূপ, ‘বিহারে বাংলাসাহিত্য’ নিয়ে ক্রমাগত কাজ করেছেন – শুধু ভাগলপুরে নয়, মুজফফরপুরে গিয়েও সাহিত্যসভা,
সাহিত্যপাঠের আসর গড়েছেন, নতুন ও অপ্রধান কবিলেখকদের উৎসাহ দিয়েছেন লিখতে, সাহিত্যবাসরে
এসে পড়তে। প্রথমদিকের কিছু রচনাও সেই সাহিত্যবাসরেরই ফলশ্রুতি এবং ভাগলপুরে বসে লেখা।
চতুর্থ নাম অনুরূপা দেবী (১৮৮২ – ১৯৯৮)। যদিও বাংলা সাহিত্যে, কোনো না কোনোভাবে
‘মোড়-ঘোরানো’ ভূমিকায় বিহারের যে সাহিত্যিক ত্রয়ীকে
(বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়, বনফুল ও সতীনাথ ভাদুড়ী) আমরা দেখতে পাই, অনুরূপা দেবীর তেমন
কোনো ভূমিকা নেই, কিন্তু বিহারবাসী প্রথম নারী-সাহিত্যিক তো তিনি বটেই। তাঁর বেশ কয়েকটি
উপন্যাস পাঠকদের মাঝে সেসময় জনপ্রিয় হয়েছিল; সব মুজফফরপুর শহরে বসে লেখা। শরৎচন্দ্র
যে সময় মুজফফরপুরে গিয়ে সাহিত্যবাসর বসাতে যাদেরকে অনুপ্রাণিত করতেন তাদের মধ্যেই ছিলেন
অনুরূপা দেবী। রবীন্দ্রনাথের বড় মেয়ে মাধুরীলতা ও তিনি পরম বন্ধু ছিলেন। দুজনে মিলে
প্রতিষ্ঠা করেন চ্যাপম্যান গার্লস স্কুল। পরবর্তী কালে অনুরূপা দেবী কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে
‘লীলা’ বক্তৃতা দিতে আমন্ত্রিত হন। সে বক্তৃতায়
নারীশক্তির মুক্তির সুর ফুটে ওঠে।
পঞ্চম নাম হিসেবে থাকবেন বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়
(১৮৯৪ – ১৯৮৭)। তিনি পুরোপুরি বিহারের মানুষ। বিহারের
হিন্দি, মৈথিলী ও অন্যান্য সাহিত্যসমাজে তিনি ‘দ্বারভাঙ্গা কে বিভূতিবাবু’ নামে পরিচিত। তাঁর ‘কুশিপ্রাঙ্গণের চিঠি’ বহুকাল আগে থেকে হিন্দি অনুবাদে বিহারে
পরিচিত। আরো বহু গল্পে বিহারের মানুষজন, বিহারের নিসর্গ খুব সহজভাবে এসেছে। ‘কুশিপ্রাঙ্গণের চিঠি’, ‘জীবনতীর্থ’ ইত্যাদি বইগুলো যেহেতু উত্তমপুরুষে বিবৃত,
এ প্রদেশে, বাংলাভাষী ও অন্যভাষীদের মধ্যে চলমান ভাষা ও সংস্কৃতিগত মিথষ্ক্রিয়ার প্রথম
রূপটি সেখানে ফুটে ওঠে। বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় বিহার বাঙালি সমিতির সম্মানীয় সক্রিয়
সদস্য, এবং বিহার বাংলা আকাডেমির প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ ছিলেন। প্রসঙ্গবহির্ভূত হলেও
বলতে ইচ্ছে করে যে এহেন বিভূতিভূষণকে নিয়ে লেখা বইয়েরও নাম হয় ‘অপ্রবাসী বিভূতিভূষণ’, অর্থাৎ, প্রবাসী হলেও তিনি বাংলার মূলভূমির
সঙ্গে যুক্ত (কিন্তু বিহারি নন কিছুতেই!)।
আরেক বিভূতিভূষণও (বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়)
বিহারে বেশ কিছুদিন সময় কাটিয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যুও হয় ঘাটশিলায় যা তখন বিহারের অন্তর্গত
ছিল। তাঁর জগদ্বিখ্যাত উপন্যাস ‘পথের পাঁচালী’ তিনি ভাগলপুরেই লিখতে শুরু করেন, এবং ‘আরণ্যক’ উপন্যাসের প্রধান উপজীব্য ভাগলপুর জেলান্তর্গত
জঙ্গল, পাহাড়, আদিবাসী ও অন্যান্য মানুষজন। সেখানেও সেই আন্তর্ভাষিক ও আন্তর্সাংস্কৃতিক
মিথস্ক্রিয়া আছে কিন্তু বহিরাগত বাঙালি হিসেবে। আর বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়কে সেভাবে
বিহারের বাংলা সাহিত্যে গণ্য করা যায় না।
ষষ্ঠ নাম বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় ‘বনফুল’ (১৮৯৯ – ১৯৭৯)। তাঁর জন্ম পুর্ণিয়া জেলার মণিহারি গ্রামে। লেখাপড়া বিহারে। এবং
১৯৬৮ অব্দি তাঁর কর্মস্থলও বিহার। শরতচন্দ্রের স্মৃতিধন্য শহর ভাগলপুরের আরেক বিখ্যাত লেখক, যাঁর
বেশির ভাগ সাহিত্যজীবন বিহারে কেটেছে। বহুপ্রসু লেখক তিনি। তাঁর বেশ কয়েকটি উপন্যাস
নিয়ে ফিল্ম হয়েছে, যেগুলো ফিল্ম হিসেবেও বিখ্যাত। তবে ওই যে ‘মোড় ঘোরানো’ ত্রয়ীর কথা বললাম, বনফুলের অসাধারণ মর্মস্পর্শী
অণুগল্পের বিরাট সম্ভার বাংলায় অণুগল্প লেখার একটা চল এনে দিয়েছে। তাঁর রচনাতেও বিহারবাসী
বাঙালি এবং অন্যভাষী মানুষের মধ্যেকার সম্পর্কের একটা ছবি এসেছে। বলা যেতে পারে বিভূতিবাবুর
ক্ষেত্রে সেটা প্রধানত মৈথিলি ও বাংলার, বনফুলের ক্ষেত্রে অঙ্গিকা ও বাংলার।
জন্মতিথির হিসেবে সপ্তম নাম শরদিন্দু বন্দোপাধ্যায় (১৮৯৯ – ১৯৭০)। তাঁর জন্ম বহির্বঙ্গে কিন্তু বিহারে নয়, জৌনপুরে। তাঁর পারিবারিক
বাসস্থান পুর্ণিয়া। এবং তিনি ম্যাট্রিক পাশ করেছেন মুঙ্গের থেকে। আইন পাশ করেছেন পাটনা
থেকে। পাটনায় প্র্যাক্টিস করা ছেড়ে সেই যে তিনি ১৯৩০ সালে মুম্বাইয়ে চলে যান, তারপর
আর বিহারে আসেন নি। সুবিখ্যাত ‘ব্যোমকেশ বক্সী’র জন্মদাতা এই অসাধারণ লেখকের রচনাজগতের ওপর বিহারের খুব একটা দাবি
থাকতে পারে না। ‘ব্যোমকেশ’ সিরিজ শুরুই হয়েছে ১৯৩২এ। তবু, মুঙ্গেরে থাকতে, এবং পাটনায় থাকতে
তিনি বেশ কিছু ছোটোগল্প লিখে ফেলেছিলেন। কাজেই বলা যেতে পারে যে তাঁর গোয়েন্দা বা ঐতিহাসিক
কাহিনীর ধারার দিকে এগিয়ে যাওয়ার সংকল্পের বীজ বিহারেই উপ্ত হয়েছিল।
অষ্টম ও এক অসাধারণ গুরুত্বপূর্ণ বিহারি
বাঙালি লেখকের নাম সতীনাথ ভাদুড়ী (১৯০৬ – ১৯৬৫)। তাঁর জন্ম, কর্ম, সাহিত্যজীবন,
রাজনৈতিক জীবন সব বিহারে, পুর্ণিয়ায়। তাঁর নামে অনেকগুলো প্রথম আছে। ‘জাগরী’র মত উপন্যাস বাংলায় তিনিই প্রথম লিখলেন।
একটি আদ্যোপান্ত রাজনৈতিক উপন্যাস, জবানবন্দীমূলক বা যাকে ইংরেজিতে স্ট্রিম অফ কনসাসনেস্
চেতনার স্রোত বলে অনেকটা সেই রীতি অনুসারী এবং পুরোপুরি বিহারের প্রেক্ষিতে লেখা। কেননা
কংগ্রেস সোশ্যালিস্ট পার্টি, কম্যুনিস্ট পার্টির সঙ্গে তাদের মতানৈক্য এবং পরে সাময়িক
ঐক্য সবই বিহার ফেনোমেনন। আবার ‘ঢোঁড়াইচরিত মানস’এর মত উপন্যাসও বাংলায় তিনিই প্রথম লিখলেন। পৌরাণিক ফর্ম ব্যবহারের
দিক থেকে বলুন, বিহারের একটি পশ্চাৎপদ জাত-সমুদায়ের জীবনকাহিনী হিসেবে বলুন এবং স্বাধীনতা
সংগ্রামের প্রতি সাবালটার্ণ দৃষ্টিভঙ্গিটিকে তুলে ধরার দিক থেকে বলুন, ‘ঢোঁড়াইচরিত’ তুলনাহীন। আরো অনেক লেখা নিয়ে বলা যায়।
কিন্তু বাংলা সাহিত্যে ‘মোড়-ঘোরানো’ বিহারি ত্রয়ীর, তিনি নিঃসন্দেহে অন্যতম। এটাও উল্লেখ্য যে রাজনৈতিক
কর্মী হিসেবে জেল খাটার ইতিহাস বিহারের আর কোনো লেখকের জীবনে নেই।
এরপরে আশালতা সিংহের (১৯১১ – ১৯৮৩) নাম
নেব। এই যশস্বী লেখিকা ভাগলপুরে জন্মেছিলেন। কিন্তু তের বছর বয়সে বিয়ে হয় এবং তিনি
বীরভূমে (বাংলা) চলে যান। লেখকজীবন সেখানেই শুরু হয়েছিল। কিন্তু জন্মসূত্রে বিহারের
সঙ্গে সম্পর্কটা থেকে যায়। এক সময় বিস্মৃত হয়ে পড়া এই লেখিকার সম্পূর্ণ রচনাবলী প্রকাশ
করে বিহার বাংলা আকাডেমি।
পরবর্তী প্রজন্মে বিহারের দুজন খ্যাতনামা লেখককে আমরা পাই, চন্দ্রগুপ্ত
মৌর্য (সুভাষচন্দ্র ঘোষ) এবং কৃশাণু বন্দোপাধ্যায়। কৃশানু মুঙ্গেরবাসী ছিলেন। তাঁর
গোয়েন্দা বাসব সিরিজ একসময় জনপ্রিয় ছিল। এখনও আমাজন অনলাইন শপে তাঁর বইয়ের বিজ্ঞাপন
পাওয়া যায়। গোয়েন্দাগল্প বাদে কৃশানু সামাজিক বিষয়েও উপন্যাসাদি রচনা করেছেন।
চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য বা সুভাষচন্দ্র ঘোষ সামাজিক বিষয়ের ওপরই উপন্যাস
ও গল্প রচনা করেছেন। তিনি ছিলেন ভাগলপুর বাসিন্দা। তাঁর গল্প-উপন্যাসে বিহারবাসী বাঙালি
ও অন্যভাষীদের মধ্যেকার সাংস্কৃতিক মিথস্ক্রিয়া প্রভূত পরিমাণে এবং বিভিন্ন মাত্রায়
পাওয়া যায়। জীবৎকালে তিনি যথেষ্ট পরিচিত নাম ছিলেন। তাঁর উপন্যাসের ওপর দূরদর্শনে সিরিয়াল
হয়। তিনি যুগান্তর পুরষ্কার পেয়েছিলেন এবং ভারতীয় জ্ঞানপীঠের সদস্য ছিলেন। বিহারের
খবরের কাগজগুলোয় তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ে যখন তিনি বিহার বাংলা আকাডেমির সদস্যতা নিতে অস্বীকার
করেন। মৃত্যুর পর বিস্মৃতপ্রায় হয়ে যাওয়া এই মানুষটিকে নিয়ে বীরেন্দ্রভূষণ মুখোপাধ্যায়
লিখিত একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ ধারাবাহিক ছাপে বিহার বাঙালি সমিতির মুখপত্র ‘সঞ্চিতা’। দু’বছর আগে তাঁকে নিয়ে একটি বই প্রকাশিত হয়। লেখেন প্র. তন্ময় বীর ও
বীরেন্দ্রভূষণ মুখোপাধ্যায়। বহির্বঙ্গের লেখক সিরিজের এই বইটি প্রকাশের ভার নেন ত্রিপুরার
প্রকাশন সংস্থা, মুখাবয়ব প্রকাশন। কৃশানু বন্দোপাধ্যায়কে নিয়েও প্র. তন্ময় বীর কাজ
করছেন।
●
ধীরে ধীরে ধারাটি শুকিয়ে আসছিল। লেখকই যদি
হতে চাই তাহলে কলকাতায় থাকতে হবে, বিহারে বাঙালিদের সাংস্কৃতিক পরিবেশ ক্রমাগত ছোট
হয়ে আসছে … এই চিন্তাটা
মাথায় গেঁথে যেতে শুরু করে। দিব্যেন্দু পালিত ভাগলপুরের মানুষ কিন্তু কলকাতায় পড়াশোনা
করতে গিয়ে সেখানেই স্থায়ী হয়ে যান।
ষাট-সত্তরের দশকে তেমন খ্যাতিমান বাঙালি
সাহিত্যিক আর কেউ রইলেন না বিহারে। গোপাল হালদার মাঝেমধ্যে এসে থাকতেন পাটনায়, কিছুদিনের
জন্য বিহার বাংলা আকাডেমির উপাধ্যক্ষও হয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর সাহিত্যকর্মে কোথাও বিহার
নেই। জীবনজীবিকাও বাংলার।
তা’বলে সাহিত্য প্রয়াস বন্ধ থাকে নি। সেসময়
লঘু সাহিত্যিক পত্রিকা যথেষ্ট বেরুতো পাটনা, ভাগলপুর, পুর্ণিয়া ও অন্যান্য শহর থেকে।
মোটামুটি তার একটা খতিয়ান দিচ্ছি।
পাটনা
থেকে – সঞ্চিতা (১৯৬০এর দশক থেকে চলছে), সপ্তদ্বীপা
(ষাট সত্তরের দশকের পত্রিকা), অভিযান (সত্তরের দশকে), কিশলয় (সত্তরের দশকে), বীজপত্র
(৯০এর দশকে), সময় (৮০র দশকে), ঈক্ষণ (৯০এর দশকে), প্রতর্ক (নতুন সহস্রাব্দিতে) , সংক্রমণ
(৯০এর দশক থেকে অনিয়মিত চলছে)
পূর্ণিয়া
থেকে – অর্ঘ্য, বনসাই (সত্তরের দশক)
ভাগলপুর থেকে – নক্ষত্র, যীশু, সপ্তবহ্নি, পূর্ণিমা, লেখা,
ব্রাত্য, মঞ্জরী, অঙ্কুর, সহস্রাব্দিক (বন্ধ হয়ে গেছে); এছাড়া হাতেলেখা পত্রিকা বেরুতো
অনেক – ছায়া, আশা, বাঙালি, সাড়া, জঞ্জাল।
৪৮ জন
কবির একটা সূচী পাই তৎকালীন এক কাব্যসঙ্কলন থেকে। বোধহয় বিহার বাংলা আকাডেমিরই প্রয়াসে
বাংলার প্রকাশন থেকে বেরিয়েছিল। এর মধ্যে অনেকে হবেন যাঁরা আজ আর বিহারের নন, ঝাড়খন্ডের
–
প্রবাসজীবন
চৌধুরি, সুধীর করণ, বাসন্তীকুমার মুখোপাধ্যায়, গুরুদাস মুখোপাধ্যায়, সত্যেন্দ্র দে,
সত্য কুন্ডু, যশোদাজীবন ভট্টাচার্য, গোপালহরি বন্দোপাধ্যায়, রোহিণীকুমার দাশ, সমীর
রায়চৌধুরি, শুভেন্দু পালিত, মঞ্জুলি ঘোষ, দেবব্রত গঙ্গোপাধ্যায়, গৌরাঙ্গ শিকদার, সুবিমল
বসাক, জীবনময় দত্ত, মলয় রায়চৌধুরি, জ্যোতির্ময় দাশ, অমল সেনগুপ্ত, দাশরথি সেনগুপ্ত,
বারীন ঘোষাল, পূর্ণেন্দু মুখোপাধ্যায়, দীপক গোস্বামী, কালী মোহান্ত, জয়ন্ত ঘোষ মৌলিক,
বিশ্বজিত সেন, শান্তিরঞ্জন চক্রবর্তী, বিদ্যুৎ পাল, নির্ঝর চট্টোপাধ্যায়, দীপন মিত্র,
উজ্জ্বল সিংহ, আনন্দ দাশগুপ্ত, অনাথবন্ধু চট্টোপাধ্যায়, রজতকিশোর দত্ত, সুমন্ত রায়,
অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়, অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়, সঞ্জীব নিয়োগী, পার্থসারথি উপাধ্যায়, ঋতুপর্ণ
গোস্বামী, অবনীশ বসু, দীপক সেনগুপ্ত, তপন সেন, বিভাস ভট্টাচার্য, রসময় সেনাপতি, সুজাতা
সিংহ, স্বামী সোমেশ্বরানন্দ, সুরজিৎ বিশ্বাস (বিহারের সাম্প্রতিক বাংলা কবিতা, দে’জ পাব্লিশিং)
এঁদের
মধ্যে থেকে এক মলয় রায় চৌধুরি, হাংরি জেনারেশন আন্দোলন, তার ঘোষণাপত্র রচনা এবং সেকালীন
সুবিখ্যাত কবিতা ‘প্রচন্ড বৈদ্যুতিক
ছুতার’ (স্টার্ক ইলেক্ট্রিক জেসাস) রচয়িতা হিসেবে
সর্বভারতীয় নাম। সমালোচনা ও বিতর্ক নিজের জায়গায়; পাটনার এই কবি বিহারের মানুষ হয়ে
বাংলা সাহিত্যে ‘মোড়-ঘোরানো’ কাজ করেছিলেন।
সূচীতে আশ্চর্যজনক ভাবে পূর্ণিয়ার আলো রায়ের
নাম নেই, যখন নাকি বিহারের বাংলা সাহিত্য জগতে তাঁর পরিচিতি আছে।
এখন আপাততঃ
বিহারের কোনো শহর থেকে কোনো পত্রিকা বেরুচ্ছে বলে আমার জানা নেই। স্থানীয় সাহিত্যরচনা
সম্বলিত শারদীয় স্মরণিকা বেরোয় পাটনায় শূরোদ্যান ও কালিবাড়ি থেকে, মুজফফরপুরে হরিসভা
থেকে, ভাগলপুরে দুর্গাবাড়ি থেকে, পুর্ণিয়ায় ভাট্টা দুর্গাবাড়ি থেকে। দ্বারভাঙা, গয়া,
ছাপরা, কাটিহার বা মোতিহারি থেকে বেরোয় কিনা আমি জানিনা।
লেখালিখি
করছেন (যদ্দূর জানি) পূর্ণিয়া থেকে আলো রায়, অঙ্কন রায়, অজয় সান্যাল, প্রদীপ কুমার
দে, তমাল রুদ্র; পাটনা থেকে দিলীপ কুমার সিংহ, বিদ্যুৎ পাল, দেবদত্ত লাহিড়ী, মমতা দাশশর্মা,
তৃষা পাল; ভাগলপুর থেকে নির্ঝর চট্টোপাধ্যায় (কলকাতাবাসী), ডঃ বিনয় কুমার মাহাতা, বীরেন্দ্রভূষণ
মুখোপাধ্যায়, শম্পা দেবনাথ, অঞ্জন ভট্টাচার্য,
বৈশাখী বসুরায় ইত্যাদি।
বিহার বাঙালি সমিতি ২০১৭ সাল থেকে প্রতি
বছর, নতুনদের উৎসাহ দিতে ‘বিহার বাংলা সাহিত্য সম্মেলন’ করা শুরু করেছিল, বিশেষ এগোতে পারে নি।
●
‘বিহারে বাংলা সাহিত্য’, ভারতীয় বাংলা সাহিত্যের একটা অংশকে আলাদা করে দেখানোর প্রচেষ্টা।
কিন্তু ব্যাপারটা শুধু ভৌগোলিক নয়। দ্বিবিধ চ্যালেঞ্জের মোকাবিলায় নিহিত বিহারবাসী
বাঙালিদের সাংস্কৃতিক আত্মানুসন্ধান। প্রথমটি হল সাহিত্যের মনন-ভুগোলে কার্য্যরত মেট্রোপলিস-অভিমুখী
কেন্দ্রাভিগ বল। ভারতীয় বাঙালিদের জন্য সেটা কলকাতা অভিমুখী। এবং সেই বোধ তাঁদের সাহিত্যেও
ছায়া ফেলে। যার কারণে প্রজন্মের পর প্রজন্ম বহির্বঙ্গে কাটিয়েও অনেকে আজও নিজেদের প্রবাসী
বাঙালি বলেন। এবং কবিসাহিত্যিকেরা কলকাতার কোনো না কোনো বন্ধু-আড্ডায়, পত্রিকা-গ্রুপে
নিজেকে শামিল পেয়ে, মাঝেমধ্যে কলকাতায় গিয়ে, কফিহাউজে সময় কাটিয়ে পরিতৃপ্ত থাকেন। দ্বিতীয়টি
হল পশ্চিমবঙ্গ বাদে অন্যান্য প্রদেশে, সংক্ষেপে বহির্বঙ্গে, ভিন্নভাষিক সাহিত্যিক ও
সামাজিক পরিবেশে, সাধারণতঃ ভাষাগত সংখ্যালঘু হিসেবে নিজেদের ভাষিক, সাংস্কৃতিক শক্তির
আপেক্ষিক ন্যূনতা ও ক্রমাগত ক্ষয়। সেটা আরো বাড়িয়ে তোলে, আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর সমাজে
ক্রমবর্দ্ধমান ইংরেজির ব্যবহার, রাজভাষার নামে হিন্দির আগ্রাসন এবং খোদ বাঙালিদের
(যাঁরা বেশির ভাগই মধ্যবিত্ত) রাজনৈতিক পলায়নবাদ।
তাই আমাদের প্রয়োজন হয় বলবার, দেখ, এত বড় বড় সাহিত্যিকেরা একসময়
এখানে ছিলেন। এখানে বসেই লেখালিখি করেছেন। এখানকার মানুষজন, এখানকার নিসর্গ, সব তাঁদের
সাহিত্যের উপজীব্য হয়ে উঠেছিল। এত এত পত্রপত্রিকা এখানকার বিভিন্ন শহর থেকে বেরুতো
ইত্যাদি ইত্যাদি। বস্তুতঃ এসব ইতিহাস-রচনার সামগ্রী। সাহিত্য বর্তমানে বিচরণশীল, ভালোবাসার
মত। আমি কাউকে ভালোবাসি, এটাই আসল। আগে কে কবে কাকে ভালোবেসেছিল জানলে ভালো লাগবে তবে
না জানলেও আমার ভালোবাসা মিথ্যে হয়ে যাবে না। আমার সময়কে আঁকতে ইচ্ছে হয়, শব্দে বা
রঙে বা সুরে, ব্যস, এটাই আসল। আগে কে কবে কী কীভাবে এঁকেছিল জানলে ভালো লাগবে তবে না
জানলেও আমার আঁকাটা মিথ্যে হয়ে যাবে না।
No comments:
Post a Comment