[বিরানব্বই সালের ডাইরি খুলে দেখলাম পড়ে আছে। ২৩.৫.১৯৯২ তারিখে আলোকজী মানে আলোকধন্বাকে ঘরে বসে শুনিয়েছিলাম। ]
Labels
- Ajker dintar janya (10)
- Alokji's poems in English translation (6)
- Articles (116)
- Behar Herald (2)
- Bhinshohore (55)
- Biography (1)
- Engels (11)
- Hindi (48)
- Housing Question (10)
- Kedarnath Bandopadhyay (1)
- Krishak Sabhar Smriti (2)
- Lok Janwad (4)
- Magadher Sahitya (6)
- Meghsumari (155)
- Phire ese (170)
- Plays (10)
- Poems (462)
- Poems by Robin Datta (5)
- Priyo Pochis (8)
- Sanchita (1)
- Sirir mukhe ghor (20)
- sketches (6)
- Smritiprasanga (2)
- Somudro Dubhabe Dake (29)
- Song (1)
- Songs (7)
- Stories (51)
- Translations (88)
- Video (5)
- कौन थे इश्वरचन्द्र विद्यासागर (200वीं जन्मजयंती पर एक कर्मवीर की कीर्तिगाथा) (19)
Tuesday, September 19, 2023
স্বর্গের দরজায় – ম্বুঈসেনি ওসওয়াল্ড ম্শালি (দক্ষিণ আফ্রিকা)
Monday, September 18, 2023
বিহারে বাংলা সাহিত্য – অতীত ও বর্তমান
উদ্বেগ
শুধু তাহাই নয় আনুসঙ্গিক যে আনন্দ, তাহার হ্রাসও তো দেশেরই ক্ষতি! বিশ্ব হ্যাপিনেস ইন্ডেক্সে দেশের গড়পড়তা আনন্দ বাড়াইতে হইলে আনন্দের এই উচ্চ শিখরগুলিকে উচ্চতর করিতে হইবে, তাহার নিমিত্তে যদি তলদেশের নিরানন্দ প্রসারিত হয়, তাহার হ্রাসেও তথা উদ্বেগের বৃদ্ধিই একমাত্র পথ। আপনারা কি অবহিত নহেন যে ধনত্রয়োদশী অথবা ধনতেরসে হিন্দিভাষী অঞ্চলে কোটি কোট দরিদ্র মানুষ, গৃহে সম্মার্জনী থাকিলেও আরো একটি সম্মার্জনী এবং/অথবা ঘরে কিছু কাটিয়া খাইবার না থাকিলেও চামচ কিনিয়া থাকে?
আজিকালকার সময় আধুনিক সময়। আন্তর্জাল গৃহীর শক্তি, গৃহিণীরও শক্তি; সন্তানাদির শক্তি তো অবশ্যই। সন্তানেরা যখন দূরদেশে কর্মক্ষেত্রে দূদিন-তিনদিনব্যাপী যাত্রায় ট্রেনে চাপিয়া যায়, প্রহরে প্রহরে উদ্বিগ্ন ফোন আসে, “খোকা, কদ্দুর পৌঁছোলি? খুকি, কোথায় তুই এখন? সকালের জলখাবার খেয়েছিস?” ইত্যাদি। ইতিবাচক প্রত্যুত্তরের সমর্থনে টাওয়ার দৃশ্যমান হইলেই হোয়াটস্যাপে ভিডিও খুলিয়া যায়, “এই দ্যাখো, আমার জলখাবার, এই দ্যাখো, চিলকা পেরুচ্ছি, এই দ্যাখো, আমাদের ক্যাম্পাস, এই দ্যাখো আমার ফ্ল্যাট, আমার পিজি, আমার ছাত, সামনের মন্দির …” উদ্বেগনিরসনের সুবিধা বৃদ্ধির সহিত উদ্বেগের অভিব্যক্তিবৃদ্ধি ও নিরসনশিল্পের উন্নতিতে আন্তর্জাল কম্পানিগুলির যে লাভ, তাহাও তো দেশেরই লাভ! বস্তুতঃ, বিমানযাত্রায় যে আন্তর্জাল বন্ধ রাখিবার ব্যবস্থা থাকে তাহা খুলিয়া দেওয়া উচিৎ। তাহা হইলে ভিডিও কলে উদ্বিগ্ন গুরুজনদিগকে বিমানসেবিকার স্মিতমুখ, গবাক্ষের বাহিরে মেঘপুঞ্জে সূর্যাস্ত, সমুদ্র ও পর্বতরাজি দেখাইবারও সুযোগ থাকিবে।
তাই বলি, উদ্বেগ লইয়া অযথা ঘাঁটাঘাঁটি করিবেন না। উদ্বেগ থাকিলে, তবে তো উদ্বেগ প্রশমিত করিবার ঔষধাদিও বিক্রয় হইবে? অমঙ্গলবিনাশী সত্যনারায়ণের পূজা অথবা যজ্ঞ-হোমাদি হইবে? পূজাসামগ্রী বিক্রয় হইবে, মহাদরিদ্র পুরোহিতসমাজের উপার্জন বাড়িবে; বিদেশের কথা ছাড়িলেও, মুম্বই, পুণে, ব্যাঙ্গালোর ইত্যাদি শহরে সে উপার্জন আইফোন ও রোলেক্স ঘড়িরও বিক্রয় বৃদ্ধি করে।
যদি আমি অমঙ্গলের আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন হইতে না পারি, খাওয়াদাওয়ায় কোনো ব্যাঘাত যদি না ঘটে, বার বার গৃহের বাহিরে-ভিতরে আসাযাওয়া না করি, প্রয়োজনীয় ঔষধাদি গ্রহণ বিস্মৃত না হই, তাহা হইলে কেমন আমার ভালোবাসা, কেমন আমার অপত্য স্নেহ, কেমন আমার শ্রদ্ধা? আমরা তো গর্ব করিয়া বলিতে পারি যে, যে ভগবান আমাদিগের চিত্তের বিকার নাশ করেন, বিশ্বের ও জীবের মঙ্গলে ও কল্যাণে আশ্বস্ত করেন, সব উদ্বেগ প্রশমিত করেন, আমরা আজিকার দিনে তাঁহাকেই লইয়া সর্বাধিক উদ্বিগ্ন! ভগবান আজি একটি জাতীয় উদ্বেগ!
যদিচ শেষ সত্য ইহাই যে উদ্বেগ, মানবসম্পর্কেরই পরিচায়ক ও অভিব্যক্তি। এবং তাহা আদিম। মানুষ মানুষের সহিত সম্পর্ক স্থাপিত করিয়াছে, উদ্বেগের জন্ম হইয়াছে। মানবী মানবকে ভালোবাসিয়াছে, উদ্বেগের জন্ম হইয়াছে। শিশুর জন্ম – মাতা ও পিতার হৃদয়ে উদ্বেগের জন্ম। বংশ, গণ, পরিবার ও বৃহত্তর সমাজনির্মাণের সহিত উদ্বেগের প্রসার ঘটিয়াছে। সেদিক দিয়া আধুনিক কালে আমরা আজ কম উদ্বিগ্ন হই। পাড়ার ছেলেটি বা মেয়েটি রাতে বাড়ি ফিরিল না কেন, তাহা শুধু মাতা, পিতা, ভ্রাতা, ভগ্নী বাদে কাহাকেও উদ্বিগ্ন করে না। গ্রামের সন্তানটি দূর দেশে গিয়াছে কর্মসংস্থানের সন্ধানে, পূজায় বাড়ি ফিরিবে না, সে শুধু তাহার পরিবারের উদ্বেগ। কোনো এক সময় গ্রামে বরযাত্রী আসিলে তাহাদের যত্ন ও গ্রামের কন্যাটির নির্বিঘ্নে বিবাহ পুরো গ্রামটির উদ্বেগের কারণ হইত, আজ? দেশের মানুষেরা তাহাদের ইতিহাসযাত্রায় বিগত শতাব্দীর প্রাক্কালে আসমুদ্রহিমাচল এই ভুখন্ডের শৃংখলমুক্তির উদ্বেগে এক হইতে পারিয়াছিল। আজি সে উদ্বেগ কোথা?
দেশের অর্থনৈতিক
ও অগ্রগতি ও বিকাশক্রমে আজি উদ্বেগও একটি শিল্প। বস্তুতঃ তাহা বিনোদন শিল্পের অংশ।
উদ্বেগ নির্মিত হইতেছে। কোটি কোটি টাকায় প্রস্তুত, অত্যাধুনিক যন্ত্রসমন্বিত তাহার
বৃহৎ কর্মশালায় সময়ানুসারে, বাজারের নেতৃবৃন্দের যেমত চাহিদা, বিজ্ঞাপনের বিনিময়ে সেমত
উদ্বেগ স্থান অথবা গণসমূহ বিশেষে উৎপন্ন করা হইতেছে, দেশের নেতৃবৃন্দের যেমত চাহিদা, বিজ্ঞাপন ও দাক্ষিণ্যের বিনিময়ে সেমত
উদ্বেগ স্থান অথবা গণসমূহ বিশেষে উৎপন্ন করা হইতেছে। দেশের অনুন্নতি গ্রাস করিতে করিতে
বিকাশ ক্রমশঃ সর্বগ্রাসী হইয়া উঠিতেছে।
বহুদিন পর - নাগার্জুন
সঙ্গতকার - মঙ্গলেশ ডবরাল
১০.১.১৯৯৭
Monday, September 4, 2023
শিঙাফুলে বিকেল
কলেজের ক্লাসে একদিন কেউ ‘কিশলয়’ নামে একটা পত্রিকা বিক্রি করছিল। তার আগে কেউ একটা মিনিপত্রিকাও বিক্রি করেছিল। মিনিপত্রিকাটার নাম মনে নেই। দেবল দাশগুপ্ত সম্পাদিত কিশলয়ের শেষ পৃষ্ঠায় দীপন মিত্রের কবিতা ছিল। কবিতাটা পড়ে তৎক্ষণাৎ মাথায় গেঁথে গেল। আর পত্রিকাদুটো বলে দিল যে এধরণের পত্রিকা স্থানীয়, অর্থাৎ পাড়া-ভিত্তিক প্রয়াসেও বার করা যায়।
কাজেই দীপন মিত্রকে আমি নামে চিনতাম। কিন্তু সে যে সাইকেল ঠেঙিয়ে
নিজেই প্রফেসর্স লেন, নালা রোড থেকে জক্কনপুরে আসবে আমার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে, এটা
অভাবনীয় ছিল আমার জন্য। সত্যি বলতে কি, লেখালিখি শুরু করে পাড়ায় চুল বাড়িয়ে ঘুরলেও
বাংলা সাহিত্যের যে জগত বলে, তার সঙ্গে একেবারেই পরিচিত ছিলাম না। দীপনকে দেখে মনে
হয়েছিল সে সেই জগতের সঙ্গে পরিচিত। তাই তাকে বলেছিলাম আমার জন্য জীবনানন্দ দাশের কাব্যসংগ্রহ
নিয়ে আসতে। মনে হয় তখনই বেরিয়েছিল বেঙ্গল পাব্লিশার্স থেকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সম্পাদনায়,
‘দেশ’এ বিজ্ঞাপন
দেখেছিলাম।
কিছুদিন পর, অজিতকাকুর সব্জির দোকানটার সামনেই বোধহয়, দীপন আমায়
জীবনানন্দের কাব্যসংগ্রহ দিয়ে গেল। সে তার ঢ্যাঙা সাইকেলটায় এসেছিল। অনেক বছর পর, যে
সাইকেলে সামনে রডে বসে (শেখর চালাচ্ছিল) আলোকজির বাড়ি আসতে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটল। সামনের
ফর্কটা ভেঙে দাঁতে আর কপালে ঢুকে যায়। আমিও তখন আলোকজির বাড়িতে।
অনেকদিন পর শুরুটা ধরতে সত্যিই খুব অসুবিধা হয়। তাই শুরুটা ধরার
চেষ্টা না করে সেই মুহূর্তটা মনে করলাম। জীবনানন্দ দাশের কাব্যগ্রন্থের সঙ্গে প্রথম
সাক্ষাৎ। সময়টা বিকেল। আকাশ মেঘলা। প্রথম খন্ড, কমলাভ হলুদের ওপর লাল অক্ষর, দ্বিতীয়
খন্ড, ঈষৎ পাতলা, লালের ওপর সাদা অক্ষর। দীপন অবশ্য তারপরেও বেশ কয়েকবার আমার জন্য
বিস্ময় নিয়ে এসেছে। সে অনেক পরে একবার। শ্রীকৃষ্ণনগর, সাতচল্লিশ নম্বরে। দীপনরাও প্রফেসর্স
লেন, নালা রোড থেকে চলে এসেছে ওই পাড়ায়। আমার এক জন্মদিনে সক্কালবেলায়, বৃষ্টির মধ্যে
এসে কড়া নাড়লো। এক হাতে ছাতা আর এক হাতে পাঁচটা মোটা বইয়ের বান্ডিল, সুকুমার সেনের
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস।
তালচের থেকেই কবি-কবি হাওয়া নিয়ে ফিরেছিলাম। কাজেই বাচ্চু (নির্ভেজাল
জিগরি দোস্ত) বা বিশুর (গিটারাড্ডা) বদলে পার্থর সঙ্গে আড্ডাটা বাড়তে শুরু করল। কিছুদিনে
সবার পরিস্থিতি পাল্টালো। তাপস বোধহয় তখন একটু সংসার-সমস্যায়। খোকন ততদিনে ঝাড়্গ্রামে
চলে গেছে। খোকনের নেতৃত্বে চ্যাংড়ামির দিনগুলোও পেরিয়ে এসেছি।
কলেজের শেষ বছর থেকেই বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ মাথার কোথাও না
কোথাও একটা নৈতিক নিষেধবার্তা দিচ্ছে যে আর নয়, একটু জড়িত হও চলমান ইতিহাসের সঙ্গে
(যদিও সেটা কিরকমভাবে হতে হয় জানা ছিল না)।
পার্থ আমায় অন্য এক পার্থর সঙ্গে পরিচয় করালো। সে নিজে ব্যাংকের
চাকরি জয়েন করছে বলে ধরিয়ে দিল হাতে লেখা পত্রিকাটার দায়িত্ব। নিতুদা, অশোকদা, ভারতীদি,
অঞ্জলিমাসি …! মাসি বলতাম না পিসি? না জ্যেঠিমা? যদিও সে
হিসেবে জ্যাঠামশাই বা মেসোমশাই পিসেমশাই মানুষটি যে ভারতের ইতিহাসের এক মহান (বটুকেশ্বর
দত্ত), সেটা বোধগম্যিতে আনি নি। আমিও না, অন্য কেউও না। নইলে প্রথম ছাপাই পত্রিকায়
অঞ্জলি দত্তের লেখা ছাপলাম ভূপেন্দ্র কিশোর রক্ষিত রায়কে নিয়ে, যাঁর নামও তার আগে জানতাম
না, আর রোজ চোখের সামনে দেখা বটুকেশ্বর দত্তের একটা সাক্ষাৎকার না হোক, রুগ্ন দিনের
একটা চর্চা পর্য্যন্ত করতে পারলাম না? আসলে তখন তো ভগৎ সিংও শুধু একটি ছবি! ওই যারা
‘ফাঁসির মঞ্চে জীবন করিলো দান’! ব্যস, আর কিছু নয়।
যা হোক, … অঞ্জলিমাসি এবং আরো অনেকের সাহায্যে হাতে লেখা পত্রিকাটিকে ছাপানো পত্রিকা (পত্রিকাপ্রসঙ্গ আছে ‘গ্যালিপ্রুফ’ লেখাটায়) করে তুললাম আর সে পত্রিকার জন্যই লেখা চাইবার সূত্রে বোধহয় পার্থর স্কুটারে চেপে ফণীশ্বরনাথ রেণুর বাড়িতেও গেলাম আর কঙ্কড়বাগে জীবনময় দত্তের বাড়িতেও গেলাম (এ-২৪ ছিল কি কোয়ার্টারটার নম্বর?)। ততদিনে বোধহয় আমার কলেজের পড়া শেষ। কিছুদিন টিউশনি চালিয়ে যাওয়ার পর প্রথম চাকরি শুরু করবো কুর্জি হাসপাতালে।
কফিহাউজের আড্ডাটা এগোলো না। কেননা বাঙালি পরিচিতদের মধ্যে কেউ কফিহাউজে যেত না। তারা বরং গাঁটে পয়সা থাকলে পিন্টুতে বসত। কদমকুঁয়ার দিকে আবার ভোল্গা ছিল বোধহয়। নিতাই কাফেও ছিল। তখনকার বুদ্ধিজীবিতার ক্রেজ, কফি হাউজের (পরে বন্ধ হয়ে যায়) একটি সন্ধ্যা হয়ে থেমে গেল। কিন্তু জীবনদার সঙ্গে আড্ডাটা জমে উঠল এলআইসি ব্রাঞ্চ ২এর পুরোনো বাড়িটায়, জীবনদার টেবিল ঘিরে। সেই টেবিলেই এক এক করে অনেকের সঙ্গে দেখা হল। ফল্গুদাকে (ফল্গু ঘটক) চিনলাম। আনন্দর (আনন্দ দাশগুপ্ত) সঙ্গে হৃদ্যতা হল। ফল্গুদার সূত্রে আবার চতুরঙ্গের অনেককে চিনলাম (চতুরঙ্গের একটি কবিগোষ্ঠিতে আমি বামপন্থী বিশ্বকবিতা জানার জাঁক দেখিয়ে পড়েছিলাম মায়াকভস্কির অনুবাদ (নিজেরই করা) আর ফল্গুদা আমার গোলাপি ডাইরিটা টেনে নিয়ে পড়লেন আমার কবিতা।
জীবনদার এলআইসির আড্ডায় আমি বেশ কিছুদিন শরিক ছিলাম। সেই আড্ডায়
থাকতে থাকতেই তো পিরান্দেলোর (বইটা জিপিওর গেটের সামনে রাস্তা থেকে দু’তিন টাকায় কিনেছিলাম) ‘দ্য জার’ গল্পটার ছায়ায় প্রথম নাটক লিখলাম ‘জালা’। আজ হলে কোথাও ছাপতে
দিতাম না। কিন্তু তখন নতুন নতুন। পিন্টু হোটেলে ফল্গুদা, জীবনদা আর আমি – ‘অনীক’এ ছাপাবেন বলে জীবনদাকে কথা দিয়ে পান্ডুলিপিটা আমার হাত থেকে নিয়ে
নিলেন। ছেপেও গেল। ‘সপ্তদ্বীপা’তেও দু’একটা কবিতা ছেপেছে।
‘সপ্তদ্বীপা’র তরফ থেকে প্রকাশিত হল বিহারের কবিদের কাব্যসংকলন ‘ফেরিঘাটে সম্মিলিত প্রার্থনা’, তাতে আমি, আনন্দ, পার্থ সবাই ছিলাম।
তবে জীবনদার একটা কথা আমায় বড় সমস্যায় ফেলে দিত। হয়তো আমিই কখনো
বলেছিলাম, কিছু পড়ে বিস্মিত হয়ে, “কত কিছু লেখা
হয়ে আছে জীবনদা!” আর তিনি জবাব দিলেন, “পড়িসনা, বেশি পড়িসনা, মনে হবে সব লেখা হয়ে গেছে, তখন আর লিখতেই ইচ্ছে
হবে না।” এটা আবার কীরকম কথা হল? আর আমি পড়ার পোকা!
ইয়ারপুরে আনন্দ (দাশগুপ্ত)র লাল রঙের বাড়ির ঘরটাও একটা ঠেক ছিল।
ও কবিতায় পুরোপুরি জীবনানন্দের একটা ধাঁচ রেখে লিখত। কবিতা নিয়ে অনেক বকবকানি চলত ওর
সঙ্গে। একবার ওর সঙ্গে যুক্তভাবে কাব্যসঙ্কলন করারও প্ল্যান করে ফেললাম। তখন বোধহয়
কুর্জিতে কাজ করছি আর আমার গোলাপি রঙের ডাইরিটা ভরে গেছে। বইয়ের নাম ঠিক করা হল ‘এইসব উজ্জ্বল অনুভূতিমালা’। তবে পার্থর
ঠেকটা আমার সবচেয়ে প্রিয় ছিল। বৌদিও ছিল, পান্নাদার স্ত্রী, যখন তখন চা পাওয়ার জন্য।
যখন নাকি পার্থ ছিল নাটকের লোক, ‘বিদ্রোহী’র সদস্য।
ওদিকে দীপনের কাছ থেকে রবীন দত্তর নাম আর বর্তমান ঠিকানা পেলাম।
এসব খবরও পেলাম যে রবীনদার কবিতার অনুবাদ নাকি হাংরি জেনারেশনের মলয় রায়চৌধুরির সঙ্গে
এমেরিকার পত্রিকায় বেরিয়েছে। রবীনদা যদিও জীবনময় দত্তের ‘সপ্তদ্বীপা’ পত্রিকার সহ বা
যুগ্মসম্পাদক, জীবনদাকে জিজ্ঞেস করলে একটু শ্লেষাত্মক জবাব পেতাম – ‘ওনারা সব মহাজ্ঞানী’ টাইপের যে জবাব হয় সেরকম। ঠিকানা পাওয়ায় সুবিধা হল। আমরা তখন হাতে
লেখা পত্রিকাটাকে ছাপা পত্রিকা করার তোড়জোড় করছি। সবাই এদিক ওদিক যাচ্ছে লেখা যোগাড়
করতে। আমি রবীন দত্তর কাছে লেখা চেয়ে চিঠি লিখলাম। জবাবে লেখা তো পেলামই না, উল্টে
ঐতিহাসিক বিকাশের চক্রাকার গতি, হেগেলের উক্তি, এইসব পত্রিকা-ফত্রিকা করার অর্থহীনতা
ইত্যাকার বিষয়ে ভরা একটা জবাব পেলাম। আমিও ঠুকলাম চিঠি, চক্র অর্থাৎ বৃত্ত থেকে ট্যাঞ্জেন্ট
বার করে বৃহত্তর ও উচ্চতর বৃত্ত তৈরি করার প্রয়াসের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে। জবাবে পেলাম
কবিতা “নীল আলো চলে যাচ্ছে কলকাতা থেকে কুড্ডালোরে”। ছাপা ‘অভিযান’এর প্রথম সংখ্যায় প্রথম কবিতা শেষমেশ লিখলেন রবীন দত্ত।
তার কিছুদিন পর রবীন দত্ত, তত দিনে রবীনদা নিজেই এলেন জক্কনপুরে
এক সন্ধ্যেয়। পার্থর বাবা সাতকড়ি মিত্রর হোমিওপ্যাথি ক্লিনিকে, চেম্বারের বাইরে বেঞ্চটায়
বসে অনেকক্ষণ গল্প। গল্প আর কী? শুধু মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনে যাওয়া অজয়ের জল, তারাভরা
আকাশ, সারাঠ আর পালোজোরি গ্রামের কথা, মানুষের কথা। আমি ছাড়া পার্থ ছিল।
আর কেউ কেন ছিল না? মনে নেই। তবে আমাদের যে প্রধান আড্ডাটা আগে ছিল,
মিঠুর (মানে ছোট নন্দীজ্যাঠার বড় ছেলে) সাইকেলের দোকান, তার অংশীদারেরা একে একে চাকরিসুত্রে
পাটনার বাইরে যেতে শুরু করেছিল, বাচ্চুও বোধহয় তখনই সিপলা জয়েন করল ছাপরায়, তাপসও কোথাও
ধরেছিল আর মিঠুরও কিছু নতুন বন্ধু হয়েছিল। আমি নিজেও কুর্জি – সকাল সাতটায় বেরোই আর বিকেল পাঁচটায় ফিরি। আড্ডার ঠেক বলতে রয়ে
গিয়েছিল পার্থদের বাড়ির গ্যারাজের ওপর তার ছোট্ট এক চিলতে ঘরটা। কবিতা চুটিয়ে লিখছি।
পত্রিকার দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ সংখ্যা বার করছি।
চতুর্থ সংখ্যা বার করার আগেই তো ‘সপ্তদ্বীপা’র সঙ্গে ডীল হল
(সে ডীলের কথাও ‘গ্যালিপ্রুফ’এ বলেছি)। চতুর্থ সংখ্যার প্রচ্ছদপৃষ্ঠায় দেওয়া কবিতাটা, কুর্জির
ক্যাম্পাসে ছোট দেবদারুগুলোর নিচে দাঁড়িয়ে অনুভূত, কাজেই তখনও চাকরিতে আছি। তারপরে
যখন সেটা ‘নেই’ হল, তখন
থেকে দানাপুরে বাল্টির কারখানায় চাকরি খুঁজতে যাওয়া পর্য্যন্ত সময়ে দু’একবার প্রফেসর্স লেনে দীপনের বাড়িতে গেছি এবং আলোকধন্বার কথা শুনেছি।
তখনই কি এক সন্ধ্যেয় প্রফেসর্স লেনের মোড়ে আলোকজির অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে
ছিলাম দীপন, শেখর, সুব্রত আর আমি? পদাবলীর চাঁদ উঠেছিল পদাবলীচর্চায় পণ্ডিত মানুষটির
(ডঃ বিমানবিহারি মুখোপাধ্যায়) বাড়ির পিছন দিয়ে, আর আলোকজি পৌঁছোলেন! পাঞ্জাবে পুলিস
হাজতে থেকে আসা হিরো! গল্পে গল্পে বলে উঠলেন, “তাশা বাজছে!
বন্য হাতি বাজছে! … দেউড়ি থেকে বাইরে আয় জমিদার! প্রেমচন্দ তোদের
ওপর ভরসা করেছিল, আমরা দেব বল্লমের ঘা!” … পরে অবশ্য বাতিল করেছিলেন পংক্তিগুলো!
মনে হয় তাই হবে। কেননা তখনও আলোকধন্বা কবিনামটা আমার সড়গড় হয় নি,
আমি বাড়ির নাম নিত্যানন্দটা ধরেছিলাম বেশ চৈতন্যদেবসুলভ চেহারার সঙ্গে মিলিয়ে। আর দানাপুরে,
যে কোয়ার্টারটায় ‘রম্যাণি বীক্ষ্য’এর লেখক সুবোধকুমার চক্রবর্তীর সঙ্গে পরে দেখা করেছিলাম, তার পাশ
দিয়ে পিছনের খোলা মাঠে বেরিয়ে বাল্টির কারখানাটার দিকে যাওয়ার সময় আমার পকেটে একটা
কবিতা ছিল। কবি নিত্যানন্দের প্রশংসায় লেখা। পরে ছিঁড়ে ফেলেছিলাম, কবিতা হিসেবে ফালতু
মনে হয়েছিল। অর্থাৎ আলোকজির সঙ্গে শুধু বাহ্যিক নয়, কিছুটা আভ্যন্তরীণ সাক্ষাতও হয়ে
গিয়েছিল।
মনে যখন এই রকম বহুমুখী টান, একদিকে কবিতার বিশ্বালোকে রবীনদা দেওঘরে,
অন্যদিকে আলোকজি, দীপন পাটনায় আর নিজের পুরোনো সাহিত্যিক আড্ডাবাজিতে জীবনদার অফিস,
পার্থর ঘর আর জক্কনপুরের রাস্তাঘাট, কিসুনজির চায়ের দোকান, মিঠুর দোকান … তখন আমি পাটনা ছাড়লাম। দিনের বাসের ছাতে বসে গেলাম ধানবাদ, রামচরিত্তরজির
কৃপায় ব্যাঙ্কমোড়ে ব্যাঙ্কের মেঝেতেই রাতে ঘুমোলাম আর পরের দিন ভোরবেলায় খুঁজতে খুঁজতে
গেলাম মনাইটাঁড়ে পূর্ণেন্দু নারায়ণ মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি।
আরেকটা নতুন টান আঁকড়া গাঁথলো বুকে – ধানবাদের সাহিত্যজগত আর পূর্ণেন্দুদা। সালটাও যে সে নয়। ১৬ই ফেব্রুয়ারি
১৯৭৪ থেকে ১৯৭৫এর, সম্ভবতঃ মে মাসের শেষ বা জুনের প্রথম সপ্তাহ অব্দি। ‘সম্পূর্ণ ক্রান্তি’ থেকে ভিয়েৎনামের
মুক্তি।
সোয়া বছরে অনেক কিছু হল। ধানবাদ সাহিত্যকার সংঘের সক্রিয় সদস্য হলাম।
বিভিন্ন ভাষার লেখকদের মধ্যে মনে রাখার মত নাম, খোরঠা ভাষার কবি শ্রীনিবাস পানুরির
সঙ্গে আলাপ হল পুরানা বাজারের শেষে ইন্ডিয়ান অয়েলের ডিপোর কাছে তাঁর পানের দোকানে।
দৈনিক আড্ডা হল স্টেশন পার করে হীরাপুরে ঢুকতেই ডানদিকের রেলকোয়ার্টারে, কবি রোহিণী
কুমার দাশের বাড়ি। পূর্ণেন্দুদার সঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে ‘স্বাক্ষর’ পত্রিকার ছক কষা
হল। সে পত্রিকার জন্য লেখা সংগ্রহে বোধহয় দুবরাজপুরেও গেলাম।
স্বাক্ষর প্রকাশিত হল। একুশে ফেব্রুয়ারির ফোল্ডার ছাপা হল এবং অনুষ্ঠান
হল লিন্ডসে ক্লাবে। তখনও ইউনিয়ন সেভাবে ধরিনি তাই ট্রেড ইউনিয়নের জগত থেকে বিচ্ছিন্ন
ছিলাম। আর তাই কোলিয়ারি কামগার ইউনিয়নের অফিসে রায়বাবুর সঙ্গে, বা অন্য কোথাও দুই বক্সিদার
সঙ্গে পরিচয় হওয়া সত্ত্বেও সেগুলো জিইয়ে রাখতে পারি নি।
মাঝে মধ্যে গয়ায় ট্রেন বদলে পাটনায় আসতাম। ইতিমধ্যে আমার বাবা, মা আর দুই বোন নিজেদেরই খাটাখাটনিতে জক্কনপুরের বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছে রেললাইনের অন্য পারে, গঙ্গার দিকে, শ্রীকৃষ্ণ নগরে। এমনকি আমার সাইকেলটাও নিয়ে এসেছে। বোনেরা বড় হয়ে উঠছে। সে বাড়িতে একপাশে আমার পিস্তুতো জ্যাঠামশাই, জ্যেঠিমা আর ছোট্টো ভাই সঞ্জু থাকে। তাদেরকে প্রথম দেখলাম। চিনলাম।
চুয়াত্তরের বর্ষায় দু’চার দিনের
ছুটি পেয়েই চলে গেলাম দেওঘর। অঝোর বৃষ্টির মধ্যে সকালে ক্যাস্টর টাউনে একটা পুরোনো
ধাঁচের লালরঙা বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। ভেজা কাপড় ছেড়ে, হাতমুখ ধুয়ে, লুচি-তরকারি
জলখাবার খেয়ে বাঁদিকের গোল ঘরটায় গিয়ে বসলাম। রবীনদা জিজ্ঞেস করলেন “কী শুনবে?” আর উইলস নেভিকাটের
টিনটা এগিয়ে দিলেন। আমি একেবারেই বলতে অপারগ ছিলাম যে কী শুনব। শুনেছি কী, আজ অব্দি?
…
রবীনদা নিজেই রেকর্ড প্লেয়ারে লাগালেন রবিশঙ্কর-আলিআকবরের সিন্ধু
ভৈরবী। তবে (এখন জানি বলে বলতে পারি) নিউইয়র্ক ফিলহার্মোনিকেরটা নয়। তার আগের, যাতে
আলাপ একটু বেশিক্ষণ, ঝালা কম, আর রেকর্ডের অন্য পিঠে রাগ শ্রী। তারপর আরো কিছু শোনালেন।
বোধহয় গান, ওঙ্কারনাথ ঠাকুর কী? রাগ দেশ? হয়তো আমার মুখ দেখে বুঝলেন যে এত ক্লাসিকাল
একবারে সহ্য হচ্ছে না। তখন প্লেয়ারে বসালেন একটা অন্য রেকর্ড, বললেন, “এটা শোনো!”
যে মুহূর্তে বঙ্গোর আওয়াজের মধ্যে শুরু হল ভারী, ঘষা আওয়াজের কোনো
ফুঁয়ে বাজা যন্ত্রে উদাত্ত বিদেশি সুর, আমি বিজ্ঞের মত বললাম, “স্যাক্সোফোন?” উনি বললেন, “না, ক্ল্যারিওনেট।” “ক্ল্যারিওনেট?” অবাক হয়ে আমি রেকর্ডএর
খাপটা হাতে তুলে নিলাম – এ্যাকার বিল্ক,
ক্ল্যারিওনেট, স্ট্রিং কোরাল, লিয়ন ইয়ং, এ টাচ অফ ল্যাটিন, মারি এলেনা, লা পালোমা,
এদিওস মা চাপারিতা, হাবানেরা … ফ্রেঞ্চকাট দাড়িওয়ালা
এক সাহেবের প্রোফাইল, কালো হাফ জ্যাকেট … সব মাথায়
গেঁথে গেল।
কখনো ভাবিই নি বিয়ের অর্কেস্ট্রায় শোনা পাতলা কিনকিনে আওয়াজের ক্লারিওনেট
এত ভারি, গ্র্যানিউলার আর রোমান্টিক হয়ে উঠতে পারে। মেঘলা আকাশ, সবুজ পাতার সম্ভার
আর লা পালোমার সুর মিলেমিশে এক হয়ে গেল। পঞ্চাশ বছর পর আজও এ্যাকার বিল্ক সাহেবের ‘টাচ অফ ল্যাটিন’ আমার রোজকার
মগজ-ফ্রেশনার। তাঁরই গানে গলা মিলিয়ে পুরো এ্যাটিচুডে গেয়ে উঠি, “অন দ্য সানি সাইড
অফ দ্য সানি স্ট্রিট বয়!”
রবীনদার বাড়িতে দুটো
দিন আমায় কত কী যে দিল! বৃষ্টিভেজা ভোরে নন্দনপাহাড়, গোরস্তানে একটা বাচ্চা মেয়ের একজোড়া
শ্বেতপাথরের পা … কবে চিল্ড্রেন্স
পার্কে বিসমিল্লা খাঁয়ের সানাইয়ে শোনা বুক ছেঁড়া সুরটার শব্দগুলো সুনন্দা পটনায়েকের
গলায় শোনা – “অগুরু চন্দনকা, চিতা সজাউঁ, অপনে হাথ জলাউঁ” … আর সারা দিন রাত
আরো আরো বেশি জীবনসংপৃক্ত কবিতার জন্য আর্তি! বোধহয় পরের দিন শিউবচ্চনজী এসেছিলেন।
তাঁর সঙ্গে পাটনা থাকতেই দীপনের বাড়িতে আলাপ হয়েছিল। খুব দিলদার মানুষ। রবীনদার অফিস
আছে বলে আমরা দুজনে শিমুলতলা ঘুরে এলাম।
সে বছরই জয় প্রকাশ নারায়নের সভা হল ধানবাদে। এখন যেখানে বাসস্ট্যান্ড
সেই মাঠে। ব্যাঙ্ক থেকে সবাই গেল, আমিও গেলাম। নানান কথার মধ্যে একটা কথা বললেন, “একটা সময় ছিল যখন শ্রমিক শ্রেণীই সমাজবিপ্লবকে নেতৃত্ব দিত। এখন
আর সেই সময় নেই। ধানবাদ তো শ্রমিকদেরই শহর। দেখুন তো, কতজন শ্রমিক এসেছে কয়লা খনি থেকে?
আজকের সমাজবিপ্লবকে নেতৃত্ব দিচ্ছে ছাত্রসমাজ। তারাই সম্পূর্ণ ক্রান্তিকে পথ দেখিয়ে
এগিয়ে নিয়ে যাবে।”
মোটেই স্বীকার করতে পারলাম না কথাটা। পড়াশোনা থাক আর না থাক, এটুকু
বামপন্থী তো কবিতা লিখতে লিখতে হয়ে গেছিলাম! মাথায় এলো লেনিন পড়তে হবে। সে সপ্তাহেই,
বা কাছাকাছি কোনো সময়ে, মাইনে পেয়ে কলকাতায় গিয়ে ন্যাশনাল বুক এজেন্সি থেকে লেনিনের নির্বাচিত রচনা সংকলন নিলাম, তবে হিন্দিতে। ব্যাঙ্কে
কথা হলে হিন্দিতে কোটেশন ঝাড়তে হবে তো!
ওদিকে রবীনদার শোনানো সঙ্গীত ছিল মাথায়। একবারের মাইনে থেকে রেকর্ডপ্লেয়ার
কিনে, রেকর্ড কিনলাম কলকাতায় ফ্রিস্কুল স্ট্রিটে গিয়ে। এ্যাকার বিল্কও পেলাম একটা,
তবে ‘স্ট্রেঞ্জার অন দ্য শোর’। আর বিথোফেন, ‘লা এম্পেরিওর’। এভাবেই এক এক করে আরো কিছু রেকর্ড।
আরেকবার কলকাতা গিয়ে দেখা করলাম ‘গল্পকবিতা’র সম্পাদক কৃষ্ণগোপাল
মল্লিকের সঙ্গে। বললেন, পত্রিকা তো বন্ধ হয়ে গেছে। পুরোনো সংখ্যাগুলো টাল করে রাখা
ছিল। কয়েকটি কিনলাম। একটি পত্রিকা বেরুতো, ‘প্রতিশ্রুতি’। দু’একবার আমার লেখা
ছেপেছিল। তাদের চিঠি পেলাম আসানসোলে নাকি কবিসম্মেলন হবে। গেলাম। জুটে গেলাম ‘কৌরব’এর কমল চক্রবর্তির
নেতৃত্বে স্থানীয় কবি বিধু বাউরি, আমি ও আরো একজন। স্টেশনের কাছে কোনো দোকানে গিয়ে
দেশি মদ খাওয়া হল। সেই নেশা নিয়েই ফিরে গেটে ঢোকার মুখে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে দেখলাম।
কথা কমলই বললেন। হলের ভিতরে নামজানা অনেক বয়োজ্যেষ্ঠ কবি। তখনই বোধহয় ঋত্বিক ঘটকের
‘যুক্তি তক্কো গপ্পো’ তৈরি হয়েছে বা হচ্ছে এবং তাতে অভিনয় করেছেন অনন্য রায়। আমি জানতাম
না। সম্মেলনে দেখলাম তাঁকে ঘিরে বেশ ভিড়। শক্তি চট্টোপাধ্যায় আসেন নি মনে আছে। বিকেলের
দিকে আমিও কবিতা পড়লাম। এবং সব শেষে কি জানি কেন অবসন্ন এবং বিরক্ত হয়ে সন্ধ্যের একটা
প্যাসেঞ্জারের শূন্য কামরায় ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ধানবাদে ফিরে এলাম।
‘স্বাক্ষর’এর জন্য লেখা নিয়ে আসতে পূর্ণেন্দুদা পাঠালেন বোধহয় দুবরাজপুরেই
অনুপম দত্তের কাছে। জয়ন্ত চক্তবর্তীর সঙ্গেও দেখা হল। বোকারোয় যেতাম এক বোন আর ভগ্নীপতির
সঙ্গে দেখা করতে। তখনও নয়ামোড়ে বিরসা মুন্ডার প্রতিমাটা বসানো হয় নি। ‘স্বাক্ষর’এর জন্য লেখা চাইতে সেই ভাস্করের বাড়িতেও গেলাম একদিন, সেক্টর
১২য়। ব্যাঙ্কের পুরোনো পাসবুকে শুরু হওয়া আমার কবিতার খাতাটাও ভরে উঠেছে … পঁচাত্তরের নয়ই মে, রাত্রে ধানবাদ স্টেশনের
ওভারব্রিজে রাত দশটায় খবর পেলাম ভিয়েতনাম মুক্ত!
আর তার এক মাস পর,
পাঁচ বা ছয়ই জুন আমি ধানবাদ থেকে পাটনায় ফিরে এলাম। কিন্তু জক্কনপুরে নয়, শ্রীকৃষ্ণনগরে।
এখান থেকে অফিসে যাওয়ার, বা ফেরার পথে জক্কনপুরে, ইয়ারপুরে যাওয়া কষ্টকর। কাজেই বলা
যায় ভৌগোলিক কারণে পার্থ, বাচ্চু, মিঠু, তাপস, আনন্দ, নিতুদা … এদের কারোর সঙ্গেই নিয়মিত যোগাযোগ আর থাকল
না। তারাও ব্যস্ত নিজেদের চাকরিতে। কয়েক বছর পর এক পার্থ আর নিতুদা ছাড়া ও তল্লাটে
আর কেউ রইল না। ‘অভিযান’ যে আবার শুরু করা যেতে পারে, সেটা আর ভাবাই
হল না।
ব্যাঙ্কে জয়েন করে
দীপনের বাড়ি গেলাম বিকেলে এবং এটাই হল আমার নতুন রুটিন। আলোকধন্বাও সেখানে এলেন এবং
প্রোগ্রাম হল যে আলোকজির ভাইয়ের বিয়েতে ২৩শে জুন আমরা বরযাত্রী যাবো মুঙ্গেরের গ্রামে।
২৫শে জুন সেই বিয়ে থেকে ফেরার সময় রাস্তায় ট্রাকের মাথায় বসে খবর পেলাম যে দেশে এমার্জেন্সি
জারি হয়েছে।
এমার্জেন্সি কী বস্তু
এবং তাতে আমাদের মানে কবিলেখকদের কী করণীয় সেসব ভালো করে বুঝতে বুঝতেই ২২শে আগস্টে
সোন নদীর বাঁধ ভাঙল (ভাষ্যান্তরে, সেনাছাউনি বাঁচাতে উড়িয়ে দেওয়া হল)।
ভাগ্যিস তার কিছুদিন
আগে বাঁসঘাট থেকে পঁচিশ টাকায় একটা মই কিনে এনেছিলাম (প্রসঙ্গটা আগে একটা গল্পে এনেছি)।
রাত্রে সেই মই বেয়ে ছাতে গিয়ে শুয়ে টেবিল ল্যাম্পের আলোয় এঙ্গেলসের ডায়ালেক্টিক্স অফ
নেচার পড়ছি। মইটার জন্য দৌড়ে অন্য কোনো বাড়ির দোতলায় আশ্রয় ভিক্ষে করতে হল না। অভুক্তও
থাকতে হল না। পরিবার, অন্নের সংস্থান মানে উনুন, কয়লা, চাল, ডাল তো বাঁচলই (বন্যার
জল পরিষ্কার করে খাওয়ার জন্য ছানা-ফাড়ার-ফিটকিরিটাও বেঁচে গেল), আমার বইও সব বেঁচে
গেল। একটু বৃষ্টিতে ভিজে ধেবড়ে গেল কিছু কিছু। রেকর্ডপ্লেয়ার আর রেকর্ডগুলো বেঁচে গেল।
বন্যার শেষের দিকে
নৌকোয় করে এসেছিল আলোকজি। আমিও বন্যাশেষে বাড়ির সবাইকে জামশেদপুর পাঠিয়ে জোঁকে আর জ্বরে
একা মরার ভয় থেকে বাঁচতে চলে গেলাম আলোকজির বাড়ি। শুরু হল আমাদের দুজনের যৌথ জীবনের
প্রারম্ভিক পর্ব।
৭, হিন্দুস্তানি
প্রেসের বাড়িতে সেই প্রথম সন্ধ্যাগুলোয় আমি লাগাতার আলোকজিকে মায়াকভস্কির ‘ক্লাউড ইন টাউজার্স’ পড়ে আর হিন্দি করে করে শোনাতাম। এবং সেভাবে
আমারও কবিতাটা আরো ভালো ভাবে পড়া হয়ে যাচ্ছিল। এক সপ্তাহ পরে জামশেদপুর গেলাম। বাড়ির
সবাই ফিরে এল।
এর পরের ঘটনাগুলো
কালানুক্রমে ধরা খুব মুশকিল। কেননা বেশ কয়েকটা ঠেক তৈরি হল আমার, নতুন বন্ধুদের সঙ্গে
আড্ডার। একটা তো নিজেরই বাড়ি, ২৪/৮, শ্রীকৃষ্ণনগর। আরেকটা দীপনের বাড়ি, প্রফেসর্স লেন।
তৃতীয়, আলোকজীর বাড়ি, ৭, হিন্দুস্তানী প্রেস। চতুর্থ কিছুদিন পর, রবীনদাও লক্ষীসরাই
থেকে পাটনা এসে গেলে, তাঁর বাড়ি, মন্দিরির মুখে। আর পঞ্চম, পপুলার নার্সিং হোমের গলি,
আমাদের রাজনৈতিক আড্ডা (পরে বিশদে যাবো)। বস্তুতঃ দীপনের বাড়িটা ছিল ‘পাঠঘর’, আমার বাড়িটা ছিল ‘সঙ্গীতঘর’, আলোকজীর বাড়িটা ‘সৃজনশালা’ আর পরবর্তীতে রবীনদার বাড়িটা ‘স্টুডিও’।
হ্যাঁ, এটা সত্যিই যে এই পর্বে, মোটামুটি পাঁচ বছরের, পুরোনো বন্ধুদের
সঙ্গে সম্পর্ক শিথিল হয়ে এসেছিল। পার্থর বিয়ে তো আমাদের মধ্যে সবার আগে হয়েছিল। ওর
বিয়েতে গিয়েছিলাম দুবরাজপুর। বাচ্চুর বিয়েতে হাফ-এ্যাটেন্ড করেছিলাম, কেননা সে রাত্তিরেই
দীপনের ছোড়দির বিয়ে ছিল। ব্যাস, ওইটুকুই। আনন্দ বোধহয় তখনই চলে গেল শিলং। তাপস, বিশুর
সঙ্গে ও পাড়ায় না গেলে দেখা হত না (তাও খুব কম)। জীবনদা, ফল্গুদা, নিতুদা … সবার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেল। তার প্রধান কারণ পরে, পপুলার
নার্সিং হোমের গলির প্রসঙ্গে আসবে।
(২)
প্রফেসর্স লেন, দীপনের বাড়ি
ধানবাদ যাওয়ার আগেই এখানে আমি কয়েকবার এসেছিলাম। ফিরে এসে যেহেতু
ইউনিভার্সিটি ব্রাঞ্চ জয়েন করলাম, অশোক রাজপথ ধরে সোজা বাড়ি যাওয়ার বদলে সাইকেলের মুখটা
একটু ঘুরিয়ে নিলেই এখানে পৌঁছে যেতাম। তখনও দীপন কলেজে, মানে পিজিতে পড়ছে। ফিজিক্স।
গলিতে ঢুকতেই দেখা যেত বাঁদিকে তৃতীয় বাড়িটার দোতলার বারান্দায় কমলা রঙের শিঙে ফুলের
গুচ্ছ ফুটে আছে। ঘরে ঢোকার মুখে একটা টবে ছিল স্পাইডারলিলি। আমি গিয়ে বাইরের ঘরে ওর
বিছানায় শুয়ে পড়তাম। ঘুমিয়েও পড়েছি অনেকবার। টের পাইনি কখন ওর দিদিদের কেউ একটা চাদর
দিয়ে গেছে গায়ের ওপর। হঠাত ঘুম ভেঙে দেখেছি দীপন ভাত খাচ্ছে অথবা খেয়ে একটা সিগরেট
ধরিয়েছে। তারপর এক এক করে এসে ভিতরে গেছেন দাদা, ছোড়দা। দিদিরাও সবাই কাজ করতেন। কখনো
দেরি হলে তাঁদের মধ্যেও কেউ না কেউ আমার ঘুম ভাঙার পরে ঢুকতেন। মা থাকতেন ভিতরের ঘরে।
একটু সন্ধ্যা হলে একে একে সবাই আসত। আলোকজী তো আসবেনই, তবে সবচেয়ে
দেরি করে। আলোকজী এলে পর আমরা হাঁটতে বেরুতাম। মোটামুটি পথটা যেদিক দিয়েই হোক না কেন,
শেষ প্রান্তে থাকতো দশ নম্বর রোড। তখন তো রাজেন্দ্রনগর উড়ালপুলও তৈরি হয় নি আর মোড়ের
ওপর রামাবতার শাস্ত্রীর নামে পার্কও তৈরি হয় নি। পার্কের জায়গায় এক হাত ওঠা একটা খোলা
গোল মাটির চত্বর যাতে ঘাসও নেই। মনে আছে কেননা ওতেই বসে এক সন্ধ্যায় দীপন, আমি, শেখর,
সুব্রত (আরো কেউ কি ছিল?) কিছুক্ষণ আড্ডা মেরেছিলাম, গেয়ে গেয়েছিলাম – তখন একটু আধটু রবীন্দ্রসঙ্গীত তুলছি ক্যাসেট থেকে।
চত্বরের পর লেভেল ক্রসিং, তবে ওদিক দিয়ে নয়, দশ নম্বর রোড আমরা পূবে,
বাহাদুরপুর হয়েই ধরতাম আর এক পাক ঘুরে আবার ওদিক থেকেই ফিরতাম। দশ নম্বর রোডের বিশেষত্ব
ছিল রাস্তার পরেই রেলের জমিতে দীর্ঘ অগোছালো একটি বাগান আর তারপর রেললাইন। তখনো রাজেন্দ্রনগর
স্টেশন তৈরি হয় নি তাই যে ট্রেন যেত, পুরো বেগে যেত এবং আমাদের হেঁটে চলার সময় অন্ততঃ
একটা ট্রেন তো যেতই। পাঁচিলের ওপর দিয়ে বাগানে উঁকি দিলে অন্ধকারে দেখা যেত সঞ্চরণশীল
জোনাকির দল। আমাদের রোজকার কবিতার ক্লাসে চুড়ান্ত পর্বগুলোয় প্রবেশ করতাম আমরা এখানেই।
আগের বর্ণনা থেকেই স্পষ্ট যে আমি ছিলাম সবচেয়ে আনকোরা। বাংলা কবিতা,
হিন্দি কবিতা, বিশ্বকবিতা, সাহিত্য ও শিল্পের পরম্পরা, মার্ক্সবাদ … কোনো কিছুর সঙ্গেই আমি সেভাবে পরিচিত ছিলাম না। খুব ছোটোবেলায় পূর্ণিয়ায়
থাকার সময়, মনে আছে, রান্নাঘরের চৌকাঠের কাছে বসিয়ে এবং দুপুরে বা রাত্রে শোবার সময়
মা রবীন্দ্রনাথের ‘শিশু’ থেকে পড়ে
বা মুখস্থ শোনাত। লেখক যে রবীন্দ্রনাথ এবং সঙ্কলনটি যে ‘শিশু’ তা জানতাম না। তবে
তার অনুরণন রয়ে গিয়েছিল ভিতরে। সেটুকুই ছিল সম্পদ। তার পর একটু বড় হয়ে, দেব সাহিত্য
কুটিরের বইগুলো কিছু পড়েছি। স্কুলে উঁচু ক্লাসে পড়ার সময় বাসে আসা যাওয়া করতে হত। ফেরার
সময় বাসে না এসে ঝালনুন চাটতে চাটতে হেঁটে ফিরতাম। সে পয়সায় দেব সাহিত্য কুটিরের শারদীয়
সঙ্কলন ছাড়া বাকি সমস্ত হিন্দি বই কিনেছি। তাও দু’একটি ছাড়া সব বাজে। পুরো দস্তুর ‘কবি কবি’ হাবভাব দেওয়ার পর,
ঐ যে বললাম, দীপনকে দিয়ে জীবনানন্দ কেনালাম, নিজেও কিছু কিনলাম কিছু যোগাড় করে পড়লাম
… ব্যাস।
কাজেই শিঙেফুলওয়ালা বাড়িটা এক স্বর্গ হয়ে উঠেছিল। কখনো দীপন কিনে
নিয়ে ফিরছে ইউজেনিও মোন্তালে, সেজার ভায়খো, আন্তোনিও মাচাদো, কখনো আমি কিনে নিয়ে যাচ্ছি
আয়মে সেজারে, ভাস্কো পোপা, মিরোস্লাভ হোলুব … । কখনো পিপলস
বুক হাউজ (পাটনা কলেজের সামনেই ছিল তখন, আর আমার দুপুরের আড্ডা হত টিফিনের সময়) থেকে
কিনে নিয়ে যেতাম রসুল গমজাতভ বা অন্য কারো সদ্য আসা সঙ্কলন। নেরুদা, হিকমত। মায়াকভস্কি,
ভাপ্সারভ তো আছেনই। পড়া শেষে সেই দশ নম্বর রোড। পথে আলোচনা। আলোকজী আর দীপনই আলোচনা
চালাতো বেশিক্ষণ। পরে যখন রবীনদা পাটনায় এসে গেলেন, তিনিও আসতেন কখনো কখনো সন্ধ্যায়
এবং আলোচনায় শামিল হতেন। আমি শ্রোতা। কোনোদিন শিউবচ্চনজি গোপালগঞ্জ থেকে এলে তিনিও
শ্রোতা হতেন। পরের দিকে কমে গিয়েছিল কিন্তু মাঝে মধ্যে দীপনের ছোটবেলার বা কলেজের বন্ধুরাও
আসত। আর আসতেন হরেকৃষ্ণ ঝা। তবে কম। সন্ধ্যার দিকে ওনার টিউশনিগুলো থাকত।
আমাদের আরো একটা চর্চার বিষয় ছিল সেসময়। পাটনার সিনে সোসাইটি রমরমিয়ে
চলছিল। ওরা তো মেম্বার ছিলই। আমিও মেম্বার হলাম, এবং নিয়মিত, প্রায় প্রতি শনিবার, আইএমএ
হলে সিনেমা দেখতে যেতাম। সিনেমার দৃশ্যের পর দৃশ্য নিয়ে আলোচনা হত। রবীনদা আবার কিনে
আনলেন, ফিল্ম সেন্স, ফিল্ম ফর্ম। আইজেনস্টাইনের। যদিও আমার পড়া হয়ে ওঠেনি। সে সময় আলোকজীর একটা কথা মনে খুব দাগ কেটেছিল। “ভার্বস, ভার্বস বেশি থাকা উচিৎ আমাদের কবিতায় …” । ভার্বস অর্থাৎ ক্রিয়াপদ, অর্থাৎ স্থির, বর্ণনা ও অলঙ্কারনির্ভর
চিত্রকল্পের জায়গায় গতির চিত্রকল্প বেশি বেশি করে আনার চেষ্টা করা উচিৎ; ক্রিয়াতেই
কবিতা আবিষ্কার করা উচিৎ।
এরই মধ্যে একদিন ধনঞ্জয়জীও শামিল হলেন সান্ধ্য আড্ডায় (বোধহয় তখন
এমার্জেন্সি উঠে গেছে, কেন্দ্রে জনতা পার্টির সরকার, এবং বোধহয় রবীনদাও এসে গেছেন পাটনায়)।
কথা উঠল ক্যাপিটাল পাঠ নিয়ে। সত্যি বলতে কি, ক্যাপিটাল আমিও ততদিনে কিনে ফেলেছি কিন্তু
হাজার চেষ্টা করেও দাঁত বসাতে পারি নি। প্রস্তাবটা সবার মনে ধরল। শুরু হল ক্যাপিটাল
পাঠ। এক সঙ্গে পড়া যে কত লাভজনক, তখন বুঝলাম। যে বইটায় দাঁত বসাতে পারছিলাম না, সবার
সাহায্যে তরতর করে এগিয়ে যেতে শুরু করলাম।
বাড়িতে রেকর্ড প্লেয়ারে ক্লাসিকাল বা ইওরোপীয় ক্লাসিকাল আর নয়তো
আমার পেটেন্ট এ্যাকার বিল্ক শুনলেও বাংলা গানের কোনো রেকর্ড ছিল না। দীপনের বাড়িতে
ছিল, চেয়ে আনতেও পারতাম কিন্তু সেখান থেকেও ইওরোপিয়ান ক্লাসিকালই আনতাম। আসলে বাংলা
গান আর তার মধ্যেও বিশেষ করে রবীন্দ্র সঙ্গীতের প্রতি আমার বিতৃষ্ণা ছিল। যখন নাকি,
এক সময় রোববারে নিয়ম করে বেলা দশটার সময় রেডিওতে আকাশবাণী কলকাতা খুলে ‘খর বায়ু বয় বেগে’ শুনেছি।
কিন্তু পঙ্কজ মল্লিকের মত গলা তো পেতামই না, দুপুরে বিভিন্ন বাড়ির জানলা দিয়ে যে আওয়াজগুলো
শুনতে পেতাম রবীন্দ্রসঙ্গীতের নামে, আরো জ্বালা ধরিয়ে দিত। এছাড়া গান বলতে মাইকে পুজোর
সময় বাজত আধুনিক গান, হিন্দি সিনেমার গান তার চেয়ে বেশি ভালো লাগত। কীর্তন বা শ্যামাসঙ্গীত
বা লোকগীতি … কিছুই সেভাবে শুনিনি।
একদিন কিছু একটা নিয়ে চর্চার সুবাদে মনে হল শ্যামাসঙ্গীত শোনা উচিৎ।
দীপনের কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে এলাম পান্নালাল ভট্টাচার্য। পরের সকালে স্নান করে খেয়ে ভাবলাম
সিগরেট খেতে খেতে একটা গান শুনে নিই তারপর অফিসে বেরুবো। কী যে হল! গান শুরু হতেই সবচেয়ে
আগে উঠে গিয়ে আমি ভিতরের দরজাটা বন্ধ করে দিলাম। ভিতর থেকে এত জোরে কাঁপিয়ে কান্না
উঠে আসছিল যে বোনেরা বা মা “কী হয়েছে” ভেবে ছুটে আসতে পারত। অফিসে যাওয়া মাথায় উঠল। বিশেষ করে “আসার আশা” গানটার সঙ্গে এক
ঝোঁক যদ্দূর সম্ভব নিঃশব্দে কাঁদার পর সারা দুপুর সেই গান শুনে চললাম। কান্নার পিছনে
কোনো ভক্তিভাবটাব নয়, ছোটবেলা থেকেই আমি অবিশ্বাসী, ছিল একটা বিরাট অপরাধবোধ, যে এ
গান আমি আগে কেন শুনি নি।
এরকমই আরেকদিন হঠাৎ এক সন্ধ্যায় দীপনদের ভিতরের ঘরে রেকর্ড প্লেয়ারে
বেজে উঠল “আমি চঞ্চল হে”! নিজের অবস্থাটাকে মুগ্ধ বিস্ময় বলি না ভিরমি খাওয়া বলি? জিজ্ঞেস
করে জানলাম, রবীন্দ্রসঙ্গীত, গাইছেন দেবব্রত বিশ্বাস। আমার মনের অবস্থা একটা কবিতায়
ধরতে চেষ্টা করেছিলাম। তখন রেকর্ড প্লেয়ারের যুগ প্রায় শেষ, ক্যাসেট প্লেয়ার এসে গেছে।
কয়েক দিনের মধ্যেই দাস রেডিওতে গিয়ে একটা ক্যাসেট প্লেয়ার কিনলাম আর একটাই ক্যাসেট
কিনলাম, দেবব্রত বিশ্বাসের। আগামী সাত দিনে সব কটা গান, সুর, বাজনা সুদ্ধু প্রায় মুখস্থ
করে ফেললাম।
শ্রীকৃষ্ণ নগর, আমার বাড়ি
যেমন আগেই বলেছি, আমার বাড়িটা হল সঙ্গীতঘর। দীপনের বাড়ির তুলনায়
অনেক কম বসা হত, আর বসলে প্রধানতঃ সঙ্গীত শোনা হত। সে সময় পুরো পাটনা শহরটাই দুর্গাপুজোয়
হয়ে উঠত সঙ্গীত সম্মেলন। এবং অনেক আগেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল পরম্পরা। কেননা আমি দেখিনি
কিন্তু এমন মানুষেরা ছিলেন যাঁরা বেগম আখতারকে গাইতে শুনেছিলেন পুরোনো জেলের দেয়াল-লাগোয়া
অনুষ্ঠানটায়। পুজোর সময় কী হয়ে উঠত পাটনা! এদিকে চিল্ড্রেন্স পার্ক, তারপর পুরোনো জেলের
দেয়াল ঘেঁষে, তারপর বীণা সিনেমা ওদিকে পাটনা কলেজিয়েট, গোবিন্দ মিত্র রোড, সব্জিবাগের
মোড় … আবার ওদিকে গিয়ে বোরিং রোড চৌরাস্তা, দেওয়ালির
সময় আবার স্টেট ব্যাঙ্ক এলএচও … ঘুরে ঘুরে শুনতে
শুনতে রাত কাবার হয়ে যেত।
আলোকজী আমার ঘরে এসে সবচেয়ে বেশি শুনতেন কিশোরী আমোনকর। আমারও ভীষণ
প্রিয় ছিল রাগ ভূপে তাঁর “সহেলা রে”। তখন আমার কাছে এক এক করে বেশ কিছু রেকর্ড জমে উঠেছে। কিছু রেকর্ড
যেমন মোৎসার্টের ফ্লুট কনসার্টো, হেন্ডেলের ‘কাক্কু এন্ড
নাইটিঙ্গেল’ দীপনের কাছ থেকে চেয়ে এনেছিলাম। রবিশঙ্কর,
আলি আকবরের নিউইয়র্ক ফিলহার্মোনিকের রেকর্ডটায় বিশেষ করে রাগ মাঞ্জ খামাজ আমাদের ভালো
লাগত। সিন্ধি ভৈরবী তো কথাই নেই। আর একটা রেকর্ড আমার প্রিয় ছিল, রবিশঙ্কর, ইহুদি মেনুহিন।
বিশেষ করে মেনুহিনের ‘এনেস্কোর সোনাটা’।
সঙ্গীতের কথায় একটা প্রসঙ্গ এখানেই সেরে নিই। একটা সময় ছিল যখন বন্ধুদের
সঙ্গে গলা মিলিয়ে আমিও বলতাম “ধুর! ওসব আবার কে
শোনে।” সে সময় বাজারে নানা রকমের নেশা। মদ, ভাঙ,
গাঁজা তো আছেই, সিগরেটের তামাকে চরস মিশিয়ে খাওয়া বা দুটো ম্যান্ড্র্যাক্স খেয়ে জেগে
থাকা … সেগুলোও ছিল। যাহোক, কিছু একটায় মেজাজ তৈরি
করে রাতের প্রথম দিকে অনুষ্ঠানে গিয়ে অর্কেস্ট্রা শুনে ফিরে আসতাম। দু’একবার সিতারা দেবীর নাচও দেখেছি কিন্তু তা বোঝার এলেম ছিল না।
এক অষ্টমীর রাতে ফিরে এসে আবার ভোরে উঠে গিয়ে দুধ নিয়ে ফিরছি। সামনের
বাড়ির কাকুর সঙ্গে দেখা হল। ওই ভোর বেলায় তৈরি হয়ে বেরিয়েছেন। জিজ্ঞেস করায় বললেন “এখনই তো আসল প্রোগ্রাম শুরু হয়!” কী একটা কৌতুহল জাগল, বাড়িতে দুধ রেখে ওনার পিছু নিলাম। রেললাইন
পেরিয়ে ওদিককার রাস্তাটায় উঠতেই দূর থেকে সানাইয়ের আওয়াজ ভেসে এল। বিয়ের নহবতের সানাইও
আমার অসহ্য লাগতো, খ্যানখ্যানে মনে হত। কিন্তু সেই সকালের সানাইয়ে কী যে ছিল, আমি প্রায়
দৌড়ে পৌঁছে গেলাম চিল্ড্রেন্স পার্কে। তখন তো বুঝিনি, পরে জেনেছিলাম উনি ভৈরবীতে “যোগী মত জা” ধরেছিলেন। সেই প্রথম
শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের টানে আর মায়ায় আমি বশীভূত হয়েছিলাম। তার পর থেকে ধীরে ধীরে প্রতি
বছর পুজোয় সকালের দিকে গিয়ে অনুষ্ঠানে ঢুঁ মারা নিয়মিত হয়ে উঠেছিল।
আমার ঘর নিয়ে একটা বিচ্ছিন্ন প্রসঙ্গ আছে যাতে দীপন আলোকজী বা রবীনদা
কেউ নেই। সেটা হল হরেকৃষ্ণ ঝার সঙ্গে রাত কাটানো। হরেকৃষ্ণ ঝা তখনো কবি হিসেবে আত্মপ্রকাশ
করেন নি। ডাইরিতে মকশো করলেও কাউকে কিছু শোনান নি। বিজ্ঞানের মেধাবী ছাত্র ছিলেন। তবে
সে সময় রুজি চলত টিউশনি করে। সারা সন্ধ্যা ছাত্র পড়িয়ে, পার্লসিনেমার পাশে জয়বমবম নামে
একটা খাবার ঝুপড়িতে রাতের কয়েকটি রুটি খেয়ে দশটার পর উনি আমার ঘরের কড়া নাড়তেন। বাড়িতে
সেসব আর অস্বাভাবিক ছিল না। তারপর চলত সারারাত আমাদের আলোচনা। রোগা পাতলা, ঈষৎ কুঁজোভাবে
হাঁটা, মাথাভরা কোঁকড়াচুল মানুষটা শ্রোতা ছিলেন খুব ভালো। আলোকজী আর দীপনের সঙ্গে কথাবার্তায়
যেমন আমি অপেক্ষাকৃত চুপ থাকতাম, হরেকৃষ্ণ ঝার সঙ্গে কথাবার্তায় ঝাজীই চুপ থাকতেন।
আমি বিছানায় বসে পান্ডিত্য ঝাড়তাম আর উনি সামনের চেয়ারে বসে, টেবিলে কনুই রেখে শুনে
যেতেন। হাল্কা একটা হাসি থাকত ঠোঁটে।
রাত তিনটে নাগাদ আমরা উঠে পড়তাম। যাতে কারুর ঘুম না ভাঙাতে হয় তাই
আমার সাইকেলের তালাটা বাইরের দরজায় লাগিয়ে আমরা বেড়িয়ে পড়তাম। পাটনা জাংশনের বাইরে
তখনো হট্টগোল। বন্ধ দোকানপাটের সুযোগ নিয়ে ফুটপাথ ভর্তি চায়ের দোকান। বসে চা খেতাম,
সিগরেট খেতাম। রাতের স্টেশনে গিয়ে চা খাওয়ার নেশা তিনিই ধরিয়েছিলেন। পরে একা একাও গেছি।
অঁরি বারবুসের ‘ইনফার্নো’ বইটা পড়তে পড়তে অস্থির হয়ে স্টেশনে প্ল্যাটফর্মে চলেগিয়েছিলাম।
বেঞ্চে বসে শেষ করছি বইটা তখন পূবের আকাশ ফর্সা হয়ে উঠছে।
ঝাজীর সঙ্গে গিয়ে তখনি ফিরে আসতাম। চারটের সময় চাঁদ থাকতো উইমেন্স
কলেজের বাড়িটার ওপর। রাতের দলছুট কয়েকটা পাখি উড়ে যেত। ফিরে এসে আমরা ঘুমিয়ে পড়তাম।
সকালে উঠে ঝাজী নিজের বাড়ি যেতেন (বাড়ি মানে একা এক পরিচিতের সঙ্গে থাকা) আর আমিও স্নান
করে খেয়ে অফিস।
ঝাজী প্রথম কবিতা লেখা শুরু করে আমায় শুনিয়েছিলেন ইউনিভার্সিটি লাইব্রেরির
সামনের ঘাসে মাঠটায় বসে। ও জায়গাটাও আমাদের খুব প্রিয় ছিল। দীপনকে দিয়ে আনানোর পর ‘নেরুদার অটোবায়োগ্রাফি’ আমার হাত
থেকে ঝাজী নিয়ে নিয়েছিলেন। ওখানেই বসে পড়ে শেষ করেছিলেন কয়েক দিনে। আমি বসে শেষ করেছিলাম
চ্যাপলিনের অটোবায়োগ্রাফি। ঝাজীর একটা গুণের প্রশংসা আমি প্রথম থেকেই করেছি। উনি স্থির
করেছিলেন যে যখনই লিখবেন মৈথিলিতেই লিখবেন।
এই সঙ্কল্পের একটা প্রেক্ষিত আছে। বিহারি ভাষার অনেক কবি (বিহারি
ভাষা গ্রিয়ারসন অনুসারে বলছি – মগহি, মৈথিলি, ভোজপুরি,
অঙ্গিকা, বজ্জিকা) কবিমহলে একটু পরিচিত হলেই দ্বিভাষী হয়ে ওঠেন। তাঁরা নিজের মাতৃভাষাতেও
লেখেন এবং হিন্দিতেও লেখেন, যাতে সর্বভারতীয় হিন্দি-জগতে পরিচিত হয়ে উঠতে পারেন। মজা
হল, হিন্দি লেখার সময় তাঁরা আধুনিক হিন্দি কবিতার মেজাজটা গ্রহণ করেন অথচ মাতৃভাষায়
লেখার সময় সে ভাষার পারম্পরিকতায় থাকার চেষ্টা করেন। এমনকি নাগার্জুন, যিনি হিন্দিরই
প্রসিদ্ধ গণকবি, তিনিও মৈথিলি কবিতা লেখার সময় বদলে যান – তাঁর হিন্দি কবিতার তীক্ষ্ণ রাজনৈতিক মেজাজ মৈথিলিতে আর থাকে না।
অবশ্য এই ছক ভেঙেওছেন কয়েকজন, যেমন মথুরা প্রসাদ নবীন, আদ্যন্ত মগহি কবি থেকেও তীক্ষ্ণ
রাজনৈতিক এবং আধুনিক।
হরেকৃষ্ণ ঝাও পরবর্তী জীবনে আদ্যন্ত মৈথিলি কবি রইলেন। সেই ভাষাতেই
কাব্যনির্মিতির আধুনিকতা নিয়ে প্রয়োগ করলেন, সময়ের কথা বললেন। পরে তাঁর সঙ্গে আমার
সম্পর্ক ছিল না অনেক বছর (যেমন অনেকের সঙ্গেই ছিল না, সেটা আমার ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ)।
পাটনার জীবন ছেড়ে তিনি গ্রামে চলে গিয়েছিলেন নকশালপন্থী কোনো একটা গ্রুপে কাজ করতে।
তারপর কবে আবার পাটনায় ফিরে এসেছিলেন জানি না। অনেক খুঁজে তাঁর ফোন নম্বর পেয়ে একবার
ফোন করেছিলাম, কিন্তু দেখা আর হল না। খবর পেলাম তাঁকে মৈথিলি সাহিত্যে “প্রবোধ স্মৃতি সম্মান”এ সম্মানিত
করা হয়েছে। তার কিছুদিন পরে তিনি মারা গেলেন। মারা যাওয়ার পর ফেসবুকে ছবি পেলাম তাঁর।
কী চেহারা হয়েছিল বয়সে আর অসুস্থতায়! …
হিন্দুস্তানী প্রেস, আলোকজীর বাড়ি
আলোকধন্বা তখন হিন্দির স্বনামধন্য কবি। তাঁর ‘জনতা কা আদমি’, ‘গোলি দাগো পোস্টর’ এবং ‘শঙ্খ’ হিন্দি জগতে বিরাট
সাড়া ফেলেছে। কলেজে ইন্টারমিডিয়েটেই লেখাপড়া ছেড়ে রাজনীতিতে চলে এসেছেন, সাহিত্য ও রাজনীতিরই পুরো
সময়ের কর্মী থাকবেন এরকম একটা ভাব, পাঞ্জাবে গ্রেপ্তার হয়েছেন কবিতা পড়ার জন্য … সব মিলিয়ে এমন একটা আভা যে তাঁর কাছে পৌঁছোতে আমার সময় লাগে নি।
তিনিই বন্যার শেষ দিনগুলোয় নৌকো করে আমাদের হালহকিকৎ জানতে এসেছিলেন,
বন্যার পর সাত দিন তাঁরই বাড়িতে ছিলাম, ভাবীর হাতের রান্না খেয়েছি, তাঁর দাদাবৌদির
তিনটে সন্তানকে কোলেপিঠে করেছি (দাদা, ডঃ এস কে সিং তখন ইংল্যান্ডে; নকশাল রাজনীতির
সঙ্গে সম্পর্কের অভিযোগে তাঁর ওপর নজর ছিল সিআইডির)। আর সবচেয়ে বড় কথা, তাঁর কবিতার
ওই তীক্ষ্ণ, সতেজ স্টেটমেন্টধর্মী গঠন আর দশ নম্বর রোডে বলা সেই “ভার্বস, ভার্বস …” আমায় মোহিত
করেছিল।
কিছুদিন পর ভাবী আর বাচ্চারাও ইংল্যান্ডে পাড়ি দিল। দিল্লিতে তাদের
ছাড়তে গেলাম আমি আর আলোকজী। তারপর, একা হয়ে যাওয়ায়, বেশ কিছুদিন সন্ধ্যায় আমাদের বাড়িতে
আসার পর রাতের খাবারটাও আমাদের বাড়িতে খেয়ে যেতেন। কাজেই, ধীরে ধীরে আমিই বরং ওই বাড়িতে
রাত কাটাতে শুরু করলাম আর বাড়িটা বস্তুতঃ আগামী ছয়-সাত বছরের জন্য আমার দ্বিতীয় বাড়ি
হয়ে গেল।
কখনো এমনও হয়েছে, দীপনের বাড়িতে সন্ধ্যা কেটেছে, সেখান থেকে সাইকেলে
বাড়ি গেছি, আবার রাত সাড়ে নটা নাগাদ আলোকজীর বাড়িতে এসেছি, সকালে হোটেলে খেয়ে অফিস
করেছি, তারপর আবার এক রুটিন। ধীরে ধীরে রাতের খাবারটাও আলোকজীর সঙ্গে খেতে শুরু করলাম।
রান্না করতাম আমিই। সে মজার রান্না। আলোকজীর বাবা, মাও আমাকে তাঁর ভালো বন্ধু বলে জানতেন।
গ্রাম থেকে পাটনায় এলে ওই বাড়িতেই থাকতেন। মা বিড়ি খেতেন। ফুরিয়ে গেলে ছেলেকে বলতেন
আমার সিগরেট থেকে একটা এনে দিতে। কথা বিশেষ হত না।
পরের দিকে একবার তো এমন হয়েছিল যে একদিকে তাঁর বাবার অপারেশন হয়েছে,
গোবিন্দ মিত্র রোডে একটা নার্সিং হোমে আছেন। ওদিকে আমার বাবা সকালে দুধ আনতে যাওয়ার
সময় পড়ে গেছেন, বাড়িতেই বিশ্রামে আছেন। আলোকজী বলে বসলেন, তাঁর শরীর অসুস্থ (অসুস্থতা
চিরকাল তাঁর বাতিক), বাবার কাছে থাকতে পারবেন না। অগত্যা আমিই অফিসের পর দীপনের বাড়ি
বা আলোকজীর বাড়ি হয়ে বাড়ি গেছি, খাবার খেয়ে এসেছি নার্সিং হোমে, সারারাত জেগে-ঘুমিয়ে
ভোর রাতে বাড়ি গেছি, দুধ এনেছি, তারপর ঘুমিয়েছি দুঘন্টা।
সেসব যা হোক, আমার জীবনে সেসব বছরগুলো অবিস্মরণীয়। ‘জনতা কা আদমি’, ‘গোলি দাগো পোস্টর’ এবং ‘শঙ্খ’ এর পর একটা স্তিমিত
সময় এসেছিল তাঁর লেখালিখিতে। এমনিতেও লেখালিখির ব্যাপারে তিনি ভীষণ আলসে। অসাধারণ স্মৃতিশক্তি,
মুখে মুখে কবিতা, সাহিত্য বা ইতিহাস নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করে যাবেন, মাঝে মধ্যে পদ বলবেন
কখনো তুলসি, কখনো কবীর, কখনো সুরদাস, কখনো মীরা …। নিজেরও মনে ঘুরঘুর করতে থাকা কবিতার পংক্তিগুলো আওড়াবেন কিন্তু
কাগজকলম নিয়ে বসবেন না কিছুতেই।
তার ওপর ছিল রাজনীতির বদল। প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত একমাত্র
তিনিই ছিলেন। দীপনও ছিল না, আমি তো না-ই। এরই মধ্যে ধনঞ্জয়জী এলেন, ক্যাপিটাল পড়া শুরু
হল এবং একটা রাজনৈতিক গোষ্ঠি প্রতিষ্ঠা করা নিয়ে কথাবার্তা শুরু হল। অবস্থানটা অতিবামপন্থীই
(সিপিআই, সিপিআইএমকে সংশোধনবাদী ইত্যাদি বলা) ছিল, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য ছিল
যে উপর্যুপরি রাজনৈতিক পরাজয়, ভাঙন ও মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার ঘটনাবলি আমাদের
ভাবতে বাধ্য করেছে যে দেশ ও দেশের মানুষকে আমরা এখনো ভালোভাবে চিনি না, বুঝি না। কাজেই
অন্যান্য সমস্ত গোষ্ঠিগুলো থেকে স্বতন্ত্র, আমাদের কাজ হবে অধ্যয়ন, শুধুই অধ্যয়ন। সবরকম
রাজনৈতিক সক্রিয়তা আমরা পরিহার করে চলব।
স্বাভাবিকভাবেই এ অবস্থান আলোকজীকেও প্রভাবিত করেছিল। অবশ্য তার
আগেও, বস্তুতঃ চারু মজুমদারের লাইন আসার পর আলোকজীর দাদা এবং আলোকজী দুজনেই সেই লাইনের
নিন্দা করেছিলেন এবং রাজনৈতিক সক্রিয়তা থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে নিয়েছিলেন। ধীরে ধীরে
আলোকজীর মধ্যে একটি কবিতা জন্ম নিচ্ছিল। তখন এমনটাই হত, যে দুলাইন কবিতা ভাবলেন। পাটনায়
বিভিন্ন ঘরোয়া কথাবার্তায় এবং ফোনে একে, ওকে শুনিয়ে দিলেন। ব্যস, সারা দুনিয়া বলাবলি
করছে যে আলোক নতুন কবিতা লিখছে – জবলপুরে হিন্দি
নতুন গদ্যের এক রূপকার, ‘পহল’ পত্রিকার সম্পাদক জ্ঞানরঞ্জন, দিল্লিতে মঙ্গলেশ ডবরাল সবাই আশান্বিত
যে ‘জনতা কা আদমি’র কবি নতুন পথে এগোচ্ছে, অথচ কাগজে কলমে কিচ্ছু নেই।
দীপন, আমি আরো সবাই মিলে ঘ্যাঁতাতে ঘ্যাঁতাতে কোনো রকমে কাগজে লেখালাম।
আরো কিছু দিন লাগলো স্বাভাবিকভাবেই, কিছুটা এগোতে। যেমন ‘জনতা কা আদমি’, ‘গোলি দাগো পোস্টর’ এবং ‘শঙ্খ’এর পর প্রায় পাঁচ
বছর পর প্রথম কবিতা ‘পতঙ্গ’। তত দিনে লাইনগুলো আমারও মুখস্থ হয়ে গেছে, কিন্তু এগুচ্ছে না আর
কিছুতেই। হঠাৎ একদিন মুজফফরপুর থেকে ‘পুরুষ’ পত্রিকার সম্পাদক বিজয়কান্ত পৌঁছে গেলেন, “এবার তুই কবিতাটা পুরো করবি, আমায় দিবি, তবেই এখান থেকে যাবো”। রাতে হুইপ জারি করলেন, “পালদা, আপনি
নিজের জায়গায় শুয়ে পড়ুন, আমিও পড়ছি কিন্তু আলোক ঘুমোবে না। বাইরে ব্যালকনিতে বসে কবিতা
পুরো করবে আগে, তবে শুতে পাবে।” বেতের সোফাটায় শুয়ে
(ওটাই পছন্দসই শোয়ার জায়গা ছিল আমার) অনেক রাত অব্দি দেখেছিলাম বাইরে আলো জ্বালিয়ে
আলোকজী বসে লিখছেন। সকালে ঘুম ভাঙতে দেখলাম কবিতা পুরো, বিজয়কান্ত যাওয়ার জন্য তৈরি।
ঠিক তেমনটাই হল ‘কপড়ে কে জুতে’র বেলায়। ঠিক মনে নেই, ‘পহল’এ বোধহয় জ্ঞানরঞ্জন বিজ্ঞাপনও দিয়ে দিয়েছিলেন যে পরবর্তী সংখ্যায়
আসছে আলোকধন্বার নতুন কবিতা …। কবিতা পুরো আর
হয় না। একদিন এসে পৌঁছোলেন জ্ঞানরঞ্জন আর বীরেন ডংগোয়াল। এসেছিলেন অন্য একটা সভায়,
সেখান থেকে আর ফিরলেন না। আলোকজীর বাড়িতে ঘাঁটি গাড়লেন। রাতে জ্ঞানরঞ্জন, বয়স্ক মানুষ,
ভিতরের ঘরে আলোকজীর বিছানায় শুলেন। বীরেন রইলেন বাইরের খাটে। আমি সোফায়। আলোকজী বাইরে
ব্যালকনিতে, চেয়ার, টুল নিয়ে বসে কবিতা পুরো করছেন। পুরো হলও সে রাত্তিরেই। পরের দিন
কবিতার সঙ্গে জ্ঞানভাই আর বীরেন ডংগোয়ালকে আলোকজী আর আমি গিয়ে ট্রেনে চড়ালাম।
বীরেন খুব আলাপী আর হাসিমুখ মানুষ ছিলেন। তখনো অব্দি আমি তাঁর কবিতা
পড়িনি। পরে দীপনের ও আমাদের বন্ধু রঞ্জনকে নিউয়র্কের জন্য রওনা করে আমরা এলাহাবাদে
গিয়েছিলাম, বীরেনের তৎকালীন বাড়িতে। তখন মঙ্গলেশও সেখানে থাকতেন। বীরেনের সঙ্গে পরেও
দেখা হয়েছে দিল্লিতে। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের বাড়িতে আমি আসলে মঙ্গলেশজীর সঙ্গেই দেখা
করতে গিয়েছিলাম। উনি তখন ‘জনসত্তা’র সাহিত্য পাতার সম্পাদক। হঠাৎ বীরেনজী হাজির, “চলো সমোসা খাতে হ্যঁয়, ক্যয়সা হ্যয় আলোক?”। পাটনা জংশনে ট্রেনে বসে আছি। ট্রেন ছাড়লে নামব। আলোকজীর কথাতেই
বোধহয়, আমরা দুজনে গাওয়া শুরু করলাম, “দেখো, উয়ো
চাঁদ ছুপকর করতা হ্যয় ক্যা ইশারা”। ট্রেনে লাইট জ্বলেনি
তখনও। পরে একদিন বীরেন ডংগোয়ালের মৃত্যুসংবাদ খুব কষ্ট দিয়েছিল।
মঙ্গলেশের সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের সুযোগটা অপরিচয় থেকে গিয়েছিল। সেই
পঁচাত্তরে দিল্লী গেছি ভাবীদের ছাড়তে। একদিন রাতে পৌঁছোলাম, পাড়ার (বা এলাকার) নাম
মনে নেই, চার-পাঁচ তলা বাড়ির প্রশস্ত ছাত, মাঝখানে চিলেকোঠার নামে একটা বেশ বড়ই ঘর।
বহুক্ষণ দাঁড়িয়ে গল্প করলাম আমি আর আলোকজী। মঙ্গলেশ এলেনই না। পরে জেনেছিলাম কোনো অনুষ্ঠানে
গিয়েছিলেন। একবার হাতে কিছু পয়সা এসেছে। একা ঘুরতে বেরোলাম। আলোকজী বললেন ভুপাল গেলে
ভারত ভবনে মঙ্গলেশের সঙ্গে দেখা করতে, আর নিশ্চয়ই করে জীবনানন্দের কবিতা শোনাতে।
সেরেছে! আলোকজীর যেমন সব মুখস্থ থাকে, আমার তেমনি কিছুই মুখস্থ থাকে
না। ছোটোবেলাতেও মুখস্থ করতে আমি পারতামই না। তবুও মুখস্থ করলাম। সারা রাস্তা প্রতি
ঘন্টায় আওড়াতে আওড়াতে গেছি। এলাহাবাদে সঙ্গম, ট্রেন বদলে জবলপুর, সেখান থেকে ধুঁয়াধার,
ভেড়াঘাট, তারপর অমরকন্টক, তারপর ভুপাল। সালটা বোধহয় ৮২ ছিল, গ্যাস দুর্ঘটনার কয়েক মাস
পর। সারাক্ষণ আউড়ে গেছি “আবার আকাশে অন্ধকার
নিবিড় হয়ে উঠেছে/ আলোর রহস্যময়ী সহোদরারা মত যেই অন্ধকার …” । ভারত ভবন থেকে বেরিয়ে ঝিলের ধারে হাঁটতে হাঁটতে মঙ্গলেশজীকে কবিতাটা
শুনিয়ে তবে খালাস। তারপর নিশ্চিন্তে ঘুরেছি সাঁচী, বিদিশা, মুম্বই, ভাস্কো, মডগাঁও
…। খুব প্রিয় কবি ছিলেন আমাদের সবাইকার। সহজ,
নিবিড়, গহন চিত্রকল্পের মাধ্যমে ঢুকে যেতেন মানুষের অন্তর্মনে এবং অন্তর্সম্পর্কে,
তার মুক্তির ইচ্ছেয়। অথচ প্রয়োজনে কিছুটা ফ্ল্যাট হওয়ার বিপদ সত্ত্বেও রাজনৈতিক বক্তব্যে
যেতে পেছপা হননি কখনো। তাঁর মারা যাওয়াটাও কোভিডের সময় এক বড় অসমাপ্তি তৈরি করল। তার
একটা ব্যক্তিগত কারণও ছিল।
আলোকজীর তৃতীয় কবিতা শুরু হল “ভাগী হুই লড়কিয়াঁ”। এটা অবশ্য
আমার সামনে শেষ হয় নি। তখন আলোকজী রীতিমত সক্রিয়। হায়দ্রাবাদ যাচ্ছেন, দিল্লী যাচ্ছেন,
কলকাতা যাচ্ছেন। তাঁর ওই বাইরে যাওয়ার সময়গুলোতেই, বোধহয় তিরাশির পুজোর সময় চারদিন
তাঁর বাড়িতে আমি একা স্বেচ্ছাবন্দী হয়ে ছিলাম। খাবার বলতে করতাম ভাত আর ডাল। সঙ্গে
ছোট এক প্যাকেট ডালমুট। বাকি ঘন্টার পর ঘন্টা বসে-শুয়ে তৈরি করলাম আমার প্রথম কবিতার
বইয়ের পান্ডুলিপি। যদিও সেটা কোনো কাব্যিক উত্তরণের পরিতৃপ্তিজনিত ঘটনা ছিল না, রাজনৈতিক
সঙ্কটপ্রসূত ছিল। পরে বলব।
“ভাগী হুই
লড়কিয়াঁ” শুরু হয়েছিল কিছু ঘটনার মধ্যে দিয়ে। মেয়েরা
পালিয়েও কেন পালিয়ে যেতে পারে না, কেন আবার বশ্যতা স্বীকার করে … এধরণের কিছু প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়ার পর। দীপন, আমি সবার সামনেই
ঘটছিল কবিতাটার অগ্রগতি। তারপর উনি গেলেন দিল্লী। পরে খবর পেলাম যে ‘হংস’ পত্রিকায় ছেপেছে।
আমিও পত্রিকা কিনে পুরো কবিতাটা পড়লাম।
ততদিনে নীলুদিও আমাদের বন্ধু মহলে পুরোটা বন্ধু এবং তার পরেও কিছুটা
অভিভাবক হয়ে শামিল হয়ে গেছেন। আমার ওপর চাপ কিছুটা কমেছে। শাহিদ এবং আরো কয়েকজন আসতে
শুরু করেছে। আর ওপরে যে রাজনৈতিক সঙ্কটের কথা বললাম সেটা আমায় বিয়ে অব্দি টেনে নিয়ে
গিয়েছিল। কাজেই আলোকজীর পরবর্তী কবিতাগুলোর লেখন চোখের সামনে ঘটিত হলেও আমার রাত-জাগায়
সম্পূর্ণ হয় নি। ‘জিলাধীশ’ও একটা টার্নিং পয়েন্ট ছিল – সেই একই
রাজনৈতিক সঙ্কটসম্ভূত। তারপর ‘ব্রুনো কী বেটিয়াঁ’, ‘প্যার’ আরো অনেক ছোট ও মাঝারী কবিতা সে সময় নিয়মিত লিখে গেছেন তিনি। সবগুলো
মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে শহরে।
একটা প্রসঙ্গ বলে এ ঠেকটার কথা শেষ করব। ফণীশ্বরনাথ রেণু যখন মারা
গেলেন। হঠাৎ খবর পেলাম অপারেশনের সময় এনেস্থেসিয়ার ওভারডোজে রেণুজি কোমায় চলে গেছেন।
রাতে আমি আর আলোকজী হাসপাতালে পৌঁছোলাম। মাঝরাতে ডঃ আব্দুল অহমদ হাই (তখন জুনিয়র) একটা
রবারের হাতুড়ি নিয়ে হাতে পায়ের গাঁটে ব্যথার অনুভূতি পরীক্ষা করতে পৌঁছোলেন। পেলেন
না। আমি একটু পরে বেরিয়ে গলিতে চা-বিস্কুট খেয়ে বাড়ি চলে গিয়েছিলাম। আলোকজী বসেছিলেন
সারারাত। রেণুজী আর ফেরেন নি।
মন্দিরির মুখে, রবীনদার বাড়ি
রবীনদার সঙ্গে সেই যে দেওঘরে বৃষ্টির দুদিন কেটেছিল, আমি ধানবাদ
থেকে গিয়েছিলাম, তারপর দেখা হয়েছিল ছিয়াত্তরে আমাদের নেতারহাট সফরে। যদিও তাতে আলোকজী
ছিলেন না। ছিলেন রবীনদা, দীপন, সুব্রত আর আমি। শিউবচ্চনজী ছিলেন কী? মনে পড়ছে না। তবে
সফরের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ছিল রবীনদা-সঙ্গ। ছিয়াত্তরের অক্টোবরে রবীনদা পাটনায় এসে গিয়েছিলেন
কী? মনে নেই।
এখন ভাবি ছিয়াত্তরে, এমার্জেন্সির বছরে আমরা ভালোই ঘুরে বেড়িয়ে ছিলাম।
ছিয়াত্তরেরই জানুয়ারিতে বোধহয় আমি আর দীপন গেলাম কেঁদুলির মেলায়। আশ্রমে থাকা, সকলে
মিলে দুপুরের রান্না করা, লোকজনকে খাওয়ানো, রাতভর আখড়ায় আখড়ায় গিয়ে বাউল গান বা পল্লীগান
শোনা, সে এক অনন্য অভিজ্ঞতা। তারপর মার্চে গেলাম অমরকন্টক, ভুপাল … একটু আগে যে বলেছি, মঙ্গলেশ প্রসঙ্গে। তারপর অক্টোবরে এই আমরা চারপাঁচ
জনে নেতারহাট। আর ছিয়াত্তরেই আমি, দীপন আর ধনঞ্জয়জী গিয়েছিলাম কাঠমান্ডু। সে ছাড়া ছিল
আমার বেশ কয়েকবার ব্যক্তিগত ও অন্তর্গত সফর; প্রতি সপ্তাহান্তে বেনারস যাওয়া।
প্রত্যেকটি সফরের নিজস্ব গল্প আছে দীপ্যমান, কিন্তু সেসব তো আর এইলেখার
অন্তর্গত বিষয় নয়। এখানে আমি শুধু বিভিন্ন বন্ধুসংসর্গে পাওয়া অনুভূতি, বিবেক আর চেতনার
আলোগুলোকে একজায়গায় করছি। যদি নেতারহাট সফরের সময় রবীনদা পাটনা এসে গিয়ে থাকেন তাহলে
তার আগে আমি লক্ষীসরাইয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেছি, বেশ কয়েকটি বিদেশি কবিতার বই হাতে
নিয়ে। নেতারহাট সফর আমাদের কাছে সুইজারল্যান্ড সফরের মত ছিল। আদিগন্ত পাইনের বন, সরবুজ্জার
হলুদ ক্ষেত, সূর্যাস্ত দেখে ফেরার সময় জঙ্গলের চাঁদনিতে নেতারহাট স্কুলের ছাত্রদের
সমবেত গলায় গান, মহুয়ার টলমলানি আর রবীনদার কথা। কবিতা নিয়ে, শিল্প নিয়ে, সঙ্গীত নিয়ে
… তারই সঙ্গে তাঁর বলিষ্ঠ টেনিস খেলোয়াড়সুলভ
শরীরী ভাষা আর আমুদে মনোভাব।
রবীনদাও আরেক। না লিখতে চাইতেন, না ছবি আঁকতে চাইতেন। সমস্যাটা সেই
পুরোনো – ‘এত কিছু করা
হয়ে গেছে!’ আর নয়তো ‘হবে কী? সেই তো এক পাঠক বা দর্শককুল! যেটা সত্যিই সবচেয়ে বেশি জরুরি
সেই সমাজ বদলের কোন কাজে লাগবে এই লেখালিখি বা আঁকাআঁকি?’ অথচ রবীনদাকে নিয়ে মনের ভিতরে মিথ তো ‘সপ্তদ্বীপা’র পৃষ্ঠায় তাঁর কবিতাগুলো
পড়েই জন্মেছিল। “এখানে তো মধ্যরাতে সত্ত্বার গভীরে শুধু পদধ্বনি
শুনি / ভ্লাদিমির আপনি কি আমাকে আজ ক্রুশে বিদ্ধ করে যাবেন / কারণ নিজের কাছে সমর্পিত
রক্তের লেগুনে / সূর্যোদয় হল না এখনো …”
কবিতাগুলো পড়েই স্থির করেছিলাম যেমন করেই হোক, ছাপতেই হবে রবীমদার
কবিতার বই, ‘মানুষের নামভূমিকায়’। তাই জীবনদা আর আমি বোঝাপড়া করে একসঙ্গে ‘সপ্তদ্বীপা’ আর ‘অভিযান’এ ১ থেকে ১৬ আর ১৭
থেকে ৩২ পৃষ্ঠাসংখ্যায় রবীনদার কবিতা ছেপে ৫০০-৫০০ অফপ্রিন্ট করিয়েছিলাম। তাও শেষ অব্দি
হয় নি। রবীনদা রাজিই হলেন না। শুধু আমি নয়, দীপন, এবং সবাই রবীনদার কবিতার এক নতুন
মেজাজে অভিভূত ছিলাম, আমি তো এখনও আছি। যদি কারো ভক্ত হয়ে থাকি, সে রবীনদার ভক্ত।
রোজ ভোর চারটের সময় আমার জানলায় এসে আস্তে ডাকতেন। আমি ভিতরে কিছুতেই
ঘুম তাড়াতে পারছি না আর উনি তখনও বাইরে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ক্রমাগত জগিং করে যাচ্ছেন।
বেরিয়ে জোর হাঁটায় সোজা চিড়িয়াখানা। আমিও খুব কম হাঁটি না, কিন্তু অত জোরে পেরে উঠতাম
না। তারপর চিড়িয়াখানায় ঢুকেও আবার এক চক্কর! ব্যাঙ্কের ম্যানেজার হয়েও সাইকেলে আসাযাওয়া
করতেন। সবুজ রবিনহুড, বড় একটা চেন দিয়ে, আমরা বলতাম হাতি বাঁধার চেন দিয়ে, বাঁধতেন।
ফেরার সময় আমি আগে, উনি পরে দীপনের বাড়ি। এসবেরই মধ্যে একদিন একটা
ছবি দেখালেন, “দেখ তো কেমন?” ছবি দেখা উনিই শিখিয়েছিলেন। তাঁর কাছে শিখে শিখে ছবির এলবামগুলো
কিনেছিলাম একে একে। হয়তো এদুয়া মানে-র (ধুর! এই ফরাসি উচ্চারণগুলো কেমন যেন) সেই বিখ্যাত
ছবিটা নিয়ে ধন্ধে আছি – একজন বারকন্যা দাঁড়িয়ে
আছেন সোজা দর্শকের দিকে মুখ করে কিন্তু অন্যমনস্ক, আত্মমগ্ন, আর পিছনে বিরাট আয়নায়
তার পিঠ ও বারে বসে থাকা মানুষজনের প্রতিচ্ছবি … । কী দেখব এতে? বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়? রবীনদা পাশ থেকে এসে দুম করে
বললেন, “কমলালেবুগুলোর ভলিউম দেখেছ?” …
তাঁর দেখানোতেই হাওয়া, আলো আর তুলির পোঁচের ছন্দগুলো দেখলাম। ‘লাস্ট ফর লাইফ’ পড়লাম। ‘এগোনি এন্ড এক্সট্যাসি’ তিনি নিজেই
পড়ে পড়ে শোনাতেন। উনবিংশ শতকের সমাজপ্রেক্ষিতে ভ্যান গগ ও লোত্রেকের বাইনারি, আর ষোড়শ
শতকের সমাজপ্রেক্ষিতে মিকেলাঞ্জেলো আর ব্রুগেল-এর (দ্য এল্ডার) বাইনারি এসব নিয়ে কথা
ফুটলো মুখে। গাদাগুচ্ছের
ছবি পত্রিকা কেটে কেটে এখনো জমানো আছে … গণেশ পাইন,
নীরদ মজুমদার …। সোভিয়েত ল্যান্ড থেকে পিকাসো, রেনাতো গুত্তুসো,
শাগাল, ওসিপ জারদার্যান …। তারপর উডকাটের
জগত! এক রহস্যময় শিল্পউদ্ভাস!
বোর্ডমাউন্ট ক্যানভাসে ছবিটা দেখে অবাক হয়ে গেলাম। শক্তিশালী ড্রয়িং
দেখেছিলাম। বলতেনও বার বার, ড্রয়িং পোক্ত না হলে পেন্টিং কখনো দাঁড়াবে না। পিকাসোর
ড্রয়িং দেখ। … কিন্তু পেন্টিং কখনো দেখি নি। ব্যস, ধরে পড়লাম,
পেন্টিং করিয়েই ছাড়ব। সে এক অদ্ভুত সময় শুরু হল। মন্দিরি কাঠপুলের কাছে এক ছুতোর মিস্ত্রিকে
মাপ দিয়ে ইজেল তৈরি করানো হল। কাঠের ফ্রেম তৈরি করানো হল বিভিন্ন মাপের। মহেন্দ্রু
ঘাটের রাস্তাটার সামনে ক্যানভাসের দোকানটা এখনো আছে, যদিও সে মহেন্দ্রু ঘাটটা নেই।
সেখান থেকে হাতে কোয়ালিটি বুঝে, টেক্সচার বুঝে ক্যানভাস কেনা হত। তারপর রবীনদার বাড়িতে
এসে, ছুটির সারাটা দুপুর ক্ল্যাম্প দিয়ে টেনে, টান টান ক্যানভাস মাউন্ট করে, হাতুড়ি
দিয়ে কোকই কাঁটি পোঁতা।
ব্যস, ওই কাজটুকু আমার ছিল। ক্যানভাসটা ঢাকের চামড়ার মত টান টান
করার ব্যাপারে রবীনদা আমার কাঁধের জোরে ভরসা করতেন। টেনে ধরে বলতেন, নাও পেরেক বসাও।
কোকই কাঁটি জানেন? জুতোয় ঠোকে মুচি, কাঁচালোহার আধইঞ্চির পেরেক। বেঁকে আঁকড়ে ধরে সহজে।
তারপর আঠার প্রলেপ লাগানো। না না এই আঠা নয়, শিরিষের আঠা লাগাবো। সাইন্স কলেজের মাঠের
শিরিষ গাছ থেকে দলা দলা শিরিষের আঠা নিয়ে এসেছি। আঠা শুকোলে পর প্রাইমার।
এবার শুরু হত অভিযান। ইজেলটা অবশ্য নিতেন না। ভারি, বড় ইজেল। ছোট
ক্যানভাস, রঙ, তুলি, প্যালেট, লিনসিড, টার্পেন্টাইনের (তিসি আর তারপিন) তেল ইত্যাদি
আমি আর রবীনদা ভাগাভাগি করে ধরতাম। আমার নিজের থাকতো কবিতা লেখার ডাইরি আর কলম। দুটো
সাইকেলে দুজনে বেরিয়ে যেতাম। বেশির ভাগ সময় এয়ারপোর্টের দিকে। তখন পুরো এলাকাটা এত
কাঁটাতার ঘেরা ছিল না। খোলামেলা, জনশূন্য, পরিত্যক্ত বাংলোর বাগান, অঢ়রের ক্ষেত, নালা
…। সারা দুপুর উনি ছবি আঁকতেন, আমি কবিতা বা
ডাইরি লিখতাম।
তবে ক্যানভাস নিয়ে যাওয়াটা কমে গেল। বোর্ড, বোর্ডপিন আর কাগজ নিয়ে
যাওয়াটা সহজ। ড্রয়িং করে এসে পরে ক্যানভাসে করা। কিন্তু সেটা মনঃপুত হওয়ার নয়। তাই
কিছু দিনে ক্যানভাস আর কাগজ আলাদা রাস্তা ধরল। ক্যানভাসে ফুটে উঠতে শুরু করল স্বপ্নছবি
– রাতের ছুটন্ত ট্রেন, সামনে প্ল্যাটফর্মে তামার
কলসিতে মুচুকুন্দ ফুল। ট্রেনের ইঞ্জিন, ধুঁয়ো, ড্রাইভার বা খালাসিদের ইতস্ততঃ অবয়বের
মাঝে বাঁকানো বেরে ক্যাপ, কলার ওঠা শার্ট আর প্যান্টে একজন অপরিচিত, নিজে, সিগরেট খাচ্ছে।
রাতে আমি রবীনদার ঘরেই থাকতাম আকচার। আমাকেই শীতের রাতে বসিয়ে একটা পোর্ট্রেট করলেন।
নিজের ঘরটাও আঁকলেন – ইজেল, ইজেলে চড়ানো
ক্যানভাস, রঙের ইজেল, খুঁটিতে ঝোলানো একটা রঙমাখা কাপড়, নিচে বইপত্র …।
আর ড্রয়িং হতে শুরু করল শ্রমজীবী মানুষের ভীড়ে। সেই ধারাতেই এল হার্ডিঞ্জ
পার্কের উল্টোদিকে বস্তী ভাঙার দৃশ্য, এ্যাংলোবার্মিজ কার্টার ও তার পরিবার, তাদের
তারের খাঁচা তৈরি করার কাজ, তাদের সহযোগী রাজস্থানী মুন্নাজী। স্টেশনের কাছের রিকশাওয়ালারা,
তাদের দিনযাপন …। মাঝে মধ্যে আলোকজী, দীপন সবাই রবীনদার বাড়িতে
পৌঁছোতো। তাঁর বাবা ছিলেন বিপ্লবী বটুকেশ্বর দত্তর ছোট ভাই। অসুস্থ ছিলেন সে সময়। আর
বাড়িতে ছিলেন মা, স্ত্রী আর দুই ছেলে মেয়ে – অমিত আর
সোমা। একবার রবীনদার সঙ্গে তাঁর গ্রামেও গিয়েছিলাম, বর্দ্ধমানে। সে আরেক প্রসঙ্গ।
পপুলার নার্সিং হোমের গলি, আমাদের রাজনৈতিক
আড্ডা
আড্ডা বলতে, সেখানেই আমাদের সে সময়কার রাজনীতির পথপ্রদর্শক, ধনঞ্জয়জী
সপরিবারে থাকতেন। আর দুই ঘরের ওই একতলা ঘরটায় ভারতবর্ষ আর পৃথিবী নিয়ে জবরদস্ত আলোচনা
হত। আমরা, ‘কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী’রা ছাড়া আরো অনেকে থাকত সেই আলোচনায়। রান্না হত ইকমিক কুকারে, রোজ
না খেলেও মাঝে মধ্যে খেতাম। ভারতের মধ্যবিত্ত যুবক তো, কাজেই ‘শুধু অধ্যয়ন করব’ গোছের একটা
শপথ নিলেও দেশের ভবিষ্যৎ পন্থা নিয়ে স্পষ্ট একটা অভিমত না তৈরি করে বাঁচা সম্ভব ছিল
না। সেটা ছিল, তবে তার কোনো প্রকাশ ছিল না, শুধু আলোচনা চলত – ওই ঘরটায় বা উপরোক্ত যে কোনো ঠেকে। যেমন আমরা বিশ্বাস করতাম যে
গণতান্ত্রিক বিপ্লব, জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব আর নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব তিনটেই লক্ষ্য
হিসেবে ঠিক নয়, সঠিক লক্ষ্য সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব, তবে এসইউসির কৃষিতে সামন্তবাদ নেই,
শুধুই পূঁজিবাদ … থিসিসটা ভুল।
আমাদের ওই দল বা বলা যায় রাজনৈতিক কেন্দ্রটার একটিই সম্মেলন ভভুয়ার
দিকে কোনো গ্রামে হয়েছিল। দুদিনের সে অভিজ্ঞতা ভুলবার নয়। যদিও একটি গল্পে পরে ওই সম্মেলনের
একটা প্রসঙ্গ নিয়ে লিখেছি, কিন্তু এখনও, আমার জীবনের সেই প্রথম রাজনৈতিক সম্মেলনের
প্রতিটি মুহূর্ত আমার ভিতরে বেঁচে রয়েছে। রাজনৈতিক অবস্থান পাল্টেছে, আমরা আর কোথাও
মিলিত হই না, সারা বিশ্বে সোভিয়েত বিপর্যয়ের প্রভাব, কিন্তু সাচ্চা সেই মানুষজনের চোখের
আর্তিই তো দেশ! সেদিনও এবং আজও।
কোনোরকম রাজনৈতিক সক্রিয়তা আমাদের ছিল না। তবে একটা ব্যাপারে মাঝেমধ্যে
দ্বিমত হত। কয়েকজন বলতাম, যেটুকু পড়েছি, জেনেছি তা নিয়েই, অন্ততঃ কিছু জ্বলন্ত বিষয়ে
আমাদের পলেমিক্সে যাওয়া উচিৎ। একমাত্র পলেমিক্সে গেলেই আমরা বুঝতে পারবো আমাদের যুক্তিগুলো
কতটা মজবুত। অন্য দল বলতো না, আমাদের এখনো আরো তৈরি হওয়া উচিৎ। জয় হত দ্বিতীয় পক্ষেরই।
তখনই কথা উঠল নিজেদের মধ্যে আলোচনার জন্য একটা আভ্যন্তরীণ পত্রিকা থাকা উচিৎ। এমার্জেন্সিতে
কোথাও গোপনভাবে সেকেন্ড হ্যান্ড সাইক্লোস্টাইল মেশিন পাওয়া গেল না। তখনই আমি নেমে পড়লাম
স্টেনসিল, কাগজ, কালি আর বেলন চাকি নিয়ে সাইক্লোস্টাইলের বিকল্প তৈরি করতে। সে মজার
গল্প অন্যত্র বলেছি।
সেসময় গানবাজনা শুনতে শুনতে ইচ্ছে হত নিজেও কিছু বাজাতে। হাওয়াইয়ান
গিটার একটু আধটু তালচেরের সময় থেকে জানতাম। একটা ছিলও। বোধহয়, সঞ্জু, আমার ভাইয়ের।
বা দীপনের বাড়ির। মনে নেই। কিন্তু না, ক্লাসিকাল ইন্সট্রুমেন্ট চাই। একটা বেহালা কিনে
নিয়ে এলাম। সারা রাত পাড়ার ঘুমের বারোটা বাজাতাম। তখনই আবার একটা সোভিয়েট ফিল্ম দেখলাম
পার্ল সিনেমায়। নাম মনে নেই। একটা বাচ্চা ছেলে ভায়োলিনে খুব সুন্দর একটা সুর বাজাচ্ছে।
বাড়ি এসে সুরটা তুলতে চেষ্টা করলাম। শব্দ ছাড়া সুরের স্মৃতি থাকে নাকি? ফস্কে ফস্কে
যায়। তখন একটা গান বাঁধলাম ওই সুরটার ওপর। তাও হিন্দিতে।
একদিন গিটার নিয়ে গিয়ে স্ট্রামিং করে শোনালাম সবাইকে গানটা। ওদের
কারোর বিশেষ পছন্দ হল না কেননা সুরটা পুরোপুরি ইউরোপীয়, আর ওদের মতে বিপ্লবের সঙ্গীত
দেশের মাটির কাছাকাছি হওয়া উচিৎ। কথাটা ভুলও নয়। তবে দীপনের পছন্দ হল, কেননা ওর কান
সেধরণের সুর শুনতে অভ্যস্ত। একটা নতুন শখ জুটল। মাঝে মধ্যে গান লেখা, বা কোনো কবিতায়
সুর দেওয়া। ভাবটা যেন এক্ষুনি একটা ব্যান্ড তৈরি করে রাস্তায় নেমে পড়ব বলে। যাহোক,
সেসব হল না।
শখের শেষ আছে নাকি? গভীর রাজনৈতিক সময়। অথচ রাজনৈতিক কোনো কাজ, পোস্টার,
ওয়ালরাইটিং অব্দি করছি না। পলেমিক্সে যাচ্ছি না। শুধু পড়া আর নোট করা, কতক্ষণ সম্ভব?
আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। ফটোগ্রাফিতে হাত মকশো করতে শুরু করলাম। আর ফটোগ্রাফি তো শুধু
ছবি তোলা নয়, তার ডেভেলাপিং, প্রিন্টিং। বাবা একসময়কার প্রফেশনাল। নিজের স্টুডিও ছিল।
তবু তাঁর কাছ থেকে ক্লু না নিয়ে আমার এক বন্ধু ফটোগ্রাফার আদিল, তার কাছ থেকে ক্লু
নিয়ে, একটা সেকেন্ড হ্যান্ড এনলার্জার কিনে, নিজের পুরো ঘরটারই ঘুলঘুলি, জানলা সিল
করার উপায় করে নিলাম। চলল সারারাত খেলা। মেটল, হাইড্রোকুইনলের মিশেলটা পাল্টে পাল্টে
দেখছি কেমন এফেক্ট আসছে, এক্সপোজার পাল্টাচ্ছি, কাগজ পাল্টাছি, কখনো গ্লসি, কখনো ম্যাট
… বড় বড় কোলাজ তৈরি করছি আর ফিক্সার থেকে বার
করে স্নানঘরের চৌবাচ্চায় ধুচ্ছি। হাতে, ঘাড়ে হাইপো সলিউশনের গন্ধ থাকত সব সময়।
তবে বেঁচে গেলাম ৮১তে কালার এসে গেল বলে। কালারের কিট, এসি, এসব
কেনার মুরোদ ছিল না। ডার্করুমের ঘুলঘুলগুলো খুলে গেল আবার। … ভিতরে ভিতরে একটা মতভিন্নতার আভাস পাক খাচ্ছিল। একবার বেড়াতে গেলাম
নর্থ-ইস্টে। পাঁচজন, সবাই রাজনৈতিক বন্ধু, দীপন, আলোকজী, রবীনদা কেউ ছিল না। (এই সফরের
কয়েকটি দিক নিয়ে একটা গল্প লিখেছি পরে)। ধর্মনগর বা করিমগঞ্জে, কোথাও বাসে ধনঞ্জয়জী
হিন্দিভাষার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে চিরাচরিত রাষ্ট্রভাষা-টাইপের মন্তব্য করে বসলেন। মেজাজ
খিঁচড়ে গেল। বিপ্লবী মানুষ ভাষার প্রশ্নে এত হ্যাকনেইড কী করে হতে পারে?
তবে ঝঞ্ঝাটটা লাগল অন্য দিক থেকে। একটা ছোট্ট, বস্তুতঃ তুচ্ছ বিষয়
নিয়ে বিবাদ এক রাতের মিটিংএ আমাদের দুভাগ করে দিল। কষ্ট হল আরো যে আমি, দীপন আর আলোকজী
একদিকে বেরিয়ে এলাম, আর রবীনদা অন্যদিকে রয়ে গেল। আপাত বিষয়টা তুচ্ছ হলেও সঙ্ঘাতের
অন্তর্নিহিত কারণগুলো তো গভীর ছিল। সেসব দিকে আমরা নজরও দিই নি। বেরিয়ে আসার পর এক
এক করে সঙ্ঘাতের বিন্দুগুলো ফুটে উঠতে শুরু করল। সত্যিকারের অধ্যয়ন এবার শুরু হল।
(৩)
হঠাৎ যেন গৃহহীন হয়ে পড়লাম। জানি না, দীপন এই কথার সঙ্গে একমত হবে
কিনা, তবে আমার মনের অবস্থা তো সেরকমই ছিল। চারটে ঠেক একবারে গেল। মানে, সৃজনী আড্ডার
ঠেক হিসেবে হারিয়ে গেল। রাজনৈতিক কেন্দ্র আর রবীনদার বাড়ি তো এমনিতেই গেল। যদিও দীপনেরা
কিছুদিন পর চলে এল আমারই পাড়ায়, দেখা হওয়া বেড়ে গেল কিন্তু আগের দিনগুলোর মেজাজ আর
রইল না। উল্টে চেপে ধরল পড়া। এখন তো আর কেন্দ্র নেই, তার আশ্বস্ততা নেই যে কোনো প্রশ্ন
জাগলে গিয়ে আলোচনা করে নেব। এখন নিজেই সব পড়তে হবে, বিশেষ করে দীপন আর আমি চেষ্টা করলাম
কম্যুনিস্ট পার্টিগুলোর ভাঙনের বৈশ্বিক ছবিটা স্পষ্ট করতে। ইন্টারন্যাশনালগুলোর ইতিহাস,
ষাট পার্টির দলিল, আশি পার্টির দলিল। ক্যাপিটাল বাকি অংশটুকু পড়া।
দীপনও ততদিনে চাকরিতে ঢুকে গেছে। আমরা আগের সেই ‘কোনোরকম রাজনৈতিক সক্রিয়তায় যাবো না’র লাইন ছেড়ে একটু একটু করে নিজেদের ট্রেড ইউনিয়নে কাজ করতে শুরু
করলাম। একটা অদ্ভুত বদ্ধ অবস্থায় ছিলাম কিছুদিন আগে পর্য্যন্ত। আমার দুর্বলতা যে সময়মত
প্রশ্নগুলো তুলি নি। যেন মেনে নিয়েছিলাম, কেউ কিছু না বললেও – এখন কবিতার প্রকাশন করা যাবে না, কেননা এখনও আমরা তৈরি হইনি, কবিতাও
তো পলেমিক্সের অঙ্গ! … বিয়ে করা যাবে না,
কেননা বুর্জোয়া বিবাহ বেশ্যাবৃত্তির শামিল, আর বিপ্লবের পথে তেমন সঙ্গিনী তো জোটে নি!
… ট্রেড ইউনিয়নে আমরা কোনো দায়িত্ব নেব না,
কেননা আমরা এখনো তৈরি হই নি …। এখন হাস্যকর মনে
হলেও এটাই ছিল অন্ততঃ আমার অবস্থান।
আগের পর্বটা মোটামুটি ছিল পঁচাত্তরের মাঝ থেকে বিরাশি অব্দি। এই
পর্বটা চলল তিরাশি থেকে নব্বই অব্দি। সবচেয়ে আগে কিছুটা লেখাপড়া সেরে, কিছুটা ডাইরিতে
চিন্তা করে নিজের অবস্থানগুলো স্পষ্ট করলাম। দীপন বলে আমি গোঁয়ার। তা সত্যিই। অনেক
সময় করবই বা পারবই জানান দিতে গিয়ে এমন উদ্ভট কিছু করেছি যা পরে নিজের কাছেও হাস্যকর
লেগেছে। যাহোক, সবচেয়ে আগে আমায় আগের রাজনৈতিক অবস্থানের ধারাবাহিকতায় একটা জায়গা খোঁজার
ছিল যা আমায় রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় হতে সাহায্য করে।
ডক্ট্রিনেয়ারিজম না ইম্পিরিসজম, কোনটা শ্রেয়, এই নিয়ে বহুবার আলোচনা
হত আমাদের পুরোনো গোষ্ঠিতে। হয়তো লেনিন কোথাও এই বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করেছেন, মনে নেই।
ইম্পিরিসিজমকে আমরা শ্রেয় মনে করতাম, এবং তখনও এবিষয়ে সিপিআই(এম)এর প্রশংসা করতাম।
নিজেদেরই অনুশীলনহীন তাত্ত্বিকতায় এভাবে বলতাম, ‘লেনিন তো বলেইছেন কনক্রিট এনালিসিস অফ কনক্রিট সিচুএশন। এখন কনক্রিট
এনালিসিস করে একটা মোনিস্ট থিওরি অব্দি যদি না-ও পৌঁছোতে পেরে থাকি, কনক্রিট সিচুয়েশনটা
তো নিয়ে চলছি! সিলেক্টিভ তো হচ্ছি না!’
সেই জায়গাটাই ধরলাম এবং স্থির করলাম যা কিছু ভাবধারাগত অসহমতি থাক,
সিপিআই(এম)এর সঙ্গেই কাজ করব। তাই সবচেয়ে আগে, ১৯৮২ সালে নিজেদের ব্যাঙ্কে যখন ইউনিয়নে
ভাঙন ধরল, আমি সেই ভাঙনের সঙ্গে গেলাম আর পুরো সক্রিয়তায় গেলাম। মুজফফপুর যাওয়ার পথে
সারারাত মহেন্দ্রু ঘাটে বসে, সকালে স্টিমারের ডেকে, ভেন্যুতে পৌঁছে চা খেতে খেতে চুটিয়ে
মার্ক্সবাদ চর্চা করলাম আর নতুন সংগঠননির্মাণের বিভিন্ন দিক নিয়ে আমার কী অবস্থান,
সবাইকে জানিয়ে দিলাম বার বার। কথাতেই আছে, নতুন মোল্লা পেঁয়াজ বেশি খায়।
এ তো গেল একটা কাজ। দ্বিতীয় হল, কবিতার বইয়ের পান্ডুলিপি তৈরি করা।
পাঁচ-ছ’বছরে বেশ কিছু কবিতা জমেছিল। তখন আবার, হয়তো
আলোকজীর দেখাদেখি কিম্বা মহাকাব্যিক ব্যাপ্তিতে জীবনকে দেখার তাগিদে দীর্ঘ কবিতা লেখার
ঝোঁক ছিল। আলোকজী আমাদের সঙ্গে থাকলেও ওইসব ‘আমরা এখনো
তৈরি নই’এর তাত্ত্বিক কচকচিতে থাকেন নি। প্রতিষ্ঠিত
কবি, কবিতা লিখেও গেছেন, ছেপেওছে একের পর এক। যশ আরো ছড়িয়ে পড়েছে। কিছুটা আমাদের সঙ্গে
কথাবার্তায় আর অনেকটা নিজের অভিজ্ঞতায় ‘গোলি দাগো
পোস্টার’এর সময়কার রাজনৈতিক আবিষ্টতা থেকে মুক্ত করেছেন
নিজেকে। ‘পতঙ্গ’, ‘কপড়ে কে জুতে’, ‘ভাগী হুই লড়কিয়াঁ’ সোৎসাহে
গ্রহণ করেছে পাঠক। এবং সে সময়টায় দেশের বিভিন্ন অনুষ্ঠান থেকে তাঁর ডাকও আসছে। আগেই
লিখেছি যে আলোকজী বাইরে গেছেন, এমন একটা সময়ে তাঁর ফ্ল্যাটে চার দিন নিজেকে গৃহবন্দী
করে নিজের পান্ডুলিপি বা যাকে বলে প্রেস কপি, তৈরি করলাম।
পরের বছর ফেব্রুয়ারি বা মার্চে বোধহয় গেলাম কলকাতা। অনুষ্টুপ পত্রিকার
কিছু সংখ্যা আগে কখনো কলকাতায় এসে সংগ্রহ করেছিলাম। পড়ে ভালো লেগেছিল। তাই খুঁজে গেলাম
অনুষ্টুপের অফিসে। সেখানে সে সময় ভাগ্যক্রমে কবি সৃজন সেন ছিলেন, তাও একা। আমি তাঁকে
চিনতাম না। পরিচয় হল। আমার উদ্দেশ্য বললাম। পান্ডুলিপি তাঁর হাতে দিলাম। তাঁর পছন্দ
হল। বললেন অনুষ্টুপ থেকেই প্রকাশিত হবে। টাকা অবশ্যই আমায় দিতে হবে, আর প্রেস? আমি
ধানবাদের সময় থেকে জানতাম বিষ্ণুদার প্রেস, রেনেশাঁ প্রিন্টার্স। সেখানেই ছাপা হল।
প্রুফ দেখাদেখি সারলাম পরের বার গিয়ে, কখনো প্রেসে বসে কখনো যাদবপুরে, মামার বাড়িতে।
আমার প্রিয় মাস, মে-তে ছেপে বেরিয়ে গেল বইটা, ‘আজকের দিনটার
জন্য’।
প্রচ্ছদ যিনি করেছিলেন তাঁর নামও মনে নেই, অফিসটাও মনে নেই। তবে
বড় অফিস, তিন বা চার তলায়। আমি আইডিয়াটা দিলাম। মিছিল আসছে, কিন্তু একটি মুখ, মিছিলের
সামনে কিন্তু মিছিল থেকে স্বতন্ত্র, একটু আত্মমগ্ন, চিন্তান্বিত। অনেক করেও মুখটা বোঝাতে
পারছিলাম না। তখনই সামনে পড়ে থাকা একটা স্মরণিকায় মনে হয় জীবন বীমার বিজ্ঞাপন দেখলাম।
একটা মুখ ছিল, চিন্তান্বিত। সেটা দেখালাম। প্রচ্ছদ তৈরি হল। … একশোটা বই নিয়ে পাটনায় ফিরেছিলাম। বেচেবুচে, বিলিয়ে-টিলিয়ে শেষ
করে দিলাম। এই গেল দ্বিতীয় কাজ। এবার তৃতীয় কাজ।
বিয়ে। কিছু ডাইরিতে লেখালিখি আছে, যেগুলো একটা গল্পে ব্যবহার করেছি।
ধীরে ধীরে নিজের ভিতরের জটগুলো ছাড়ালাম। তারপর একদিন আমার প্রিয় মানুষ মীনাক্ষীবৌদিকে
সোজাসুজি গিয়ে বললাম, বৌদি, মেয়ে খুঁজে দিন, বিয়ে করব। বৌদি খুব খুশি। দাদাও খুব খুশি।
ঈষৎ এদিক ওদিক হাতড়ানোর পর বৌদি কাজলের সঙ্গে দেখা করিয়ে দিলেন। পাটনার মেয়ে। কলেজে
চাকরী করে। সামনাসামনি কথা হল শিগগিরই। শর্ত
রাখলাম, বিয়েতে ব্রাহ্মণ পুরুত থাকবে না, কোনো রকম ধর্মীয় অনুষ্ঠান হবে না, যেগুলো
লোকাচার বা স্ত্রীআচারের মধ্যে পড়ে, হতে পারে আর সবচেয়ে বড় কথা, আমি অফিসে প্রমোশন
নেব না। ইউনিয়নবাজি করব, সাহিত্যচর্চা করব। ও জিজ্ঞেস করল, আমি যদি প্রমোশন পাই? যদি
লেকচারারে চান্স পেয়ে যাই? আমি বললাম নো প্রব্লেম। বিয়ে হয়ে গেল। সারা জীবনের সঙ্গী
একজন বন্ধু পেয়ে গেলাম।
এর পরের কিছু বছর স্বাভাবিকভাবেই ঘরসংসার অনেকটা সময় নিতে শুরু করল।
এক বছর পর আমি নিজেই কাজল আর ছেলের সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণনগর ছেড়ে চলে গেলাম ভিখনাপাহাড়ির
দিকে। সেখান থেকে আমার অফিসও কাছে। ওর কলেজ যাওয়াও সহজ। ভিখনাপাহাড়িতে চলে আসায় আলোকজীর
সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ বেড়ে গেল, সামনেই বাড়ি। বিয়েতে এসেছিল রাণা, তার সঙ্গে বন্ধুত্ব
বাড়ল। ইউনিয়নের কাজকর্ম আগেই নিয়ে এসেছিল সহকর্মী ও বিভিন্ন ব্যাঙ্ককর্মী নতুন বন্ধু
ও অভিভাবক। সেদিকেই ঢলে গেল জগতটা। নতুন প্রাণের অরুণ বেশ কিছুদিন ধরে কানের কাছে আওড়াচ্ছিল
পার্টি, মানে সিপিআই(এম)এ যোগ দেওয়ার কথা। পঁচাশির শেষে তখন নতুন শিল্পনীতি গ্রহণ করা
নিয়ে আলোচনা চলছে। আমি ওই নীতি গ্রহণ করার পক্ষে ছিলাম। অরুণকে বললাম, যদি গৃহীত হয়
আমি যোগ দেব। গৃহীত হল। ছিয়াশির পয়লা জানুয়ারি আমি ফর্ম ভরলাম।
আমার স্বভাব যে কাজটা ধরি, চুটিয়ে করি। আমার ধ্যান, জ্ঞান হয়ে গেল
পার্টি। তখনও প্রত্যেকটা নীতিগত দলিল খুঁত খোঁজার মন নিয়েই পড়তাম, বড় বড় সব নোট লিখতাম
ডাইরিতে, মোটা মোটা দাগ দিয়ে রাখতাম, কংগ্রেসের রাজনৈতিক প্রস্তাব অবশ্যই পড়তাম আর
সংশোধন রাখতাম বৈঠকে (এ কাজটা এখনও করি) … কিন্তু কাজ আঁকড়ে ধরলাম। পার্টির বহিখাতা, বইয়ের দোকান, সাংস্কৃতিক
সংগঠন, বিভিন্ন গণসংগঠনের প্রোগ্রাম, নিজেদের প্রত্যেকটি বৈঠক সিরিয়াসলি নেওয়া …। কবি-সাহিত্যিক থেকে সাধারণ সম্পাদকের প্রতিবেদন রচনাকারী হয়ে গেলাম।
ঠাট্টা করে বলতাম একটা বোর্ড টাঙিয়ে নিচ্ছি, ‘এখানে সাধারণ
সম্পাদকের প্রতিবেদন লেখা হয়’। যাহোক, এমার্জেন্সি
ও তার পরবর্তী বছরগুলোয় প্রায় চুপচাপ বসে থাকার শোধ তুলে অনেকখানি ছড়িয়ে দিলাম নিজেকে
বিভিন্ন কাজে।
এল ১৯৯০-৯১। ইংরেজিতে কথা আছে না ওয়াটারশেড? বিশ্বের জন্য ওয়াটারশেড
তো ছিলই। যখন বিভিন্ন পূর্ব ইওরোপীয় দেশগুলোয় সমাজবাদী রাষ্ট্র তাশের ঘরের মত ভেঙে
পড়ছে, একটা পার্টি জিবিতে খোদ সর্বোচ্চ নেতা বললেন, না, সোভিয়েত ইউনিয়ন সে জিনিষ নয়,
ওখানে ভেঙে পড়বে না সমাজবাদী রাষ্ট্র! অর্থাৎ তাঁরও বুকে বিশ্বাস ছিল যে সোভিয়েত সহ্য করে নিতে পারবে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির চুড়ান্ত
আঘাত। অথবা হয়তো তিনি জানতেন রাশিয়ায় পার্টির দুর্বলতা, জনবিচ্ছিন্নতা কিন্তু সব কথা
জিবিতে বলতে চান নি। কিন্তু সোভিয়েত ভাঙলো। আর আয়রনি (বিদ্রুপ ঠিক হবে কি?) এটাই যে
ভাঙার পর যে দুটি ঘটনা বস্তুতঃ মিডিয়া প্রচারের প্রধান উপজীব্য হয়ে মনকে বেদনায় ভরিয়ে
দিচ্ছিল, সে দুটি ঘটনাই আশ্বাস দিল যে সোভিয়েত হারে নি। এক, বরফের রাতে মস্কো নিউজের
দপ্তরের সামনে ট্যাঙ্কে চড়ে বরিস ইয়েল্ত্সিনের বিয়ারের বোতল হাতে হম্বিতম্বি … আর দুই, মস্কোয় রাস্তায় এক তরুণীর সদম্ভ ঘোষণা, “হ্যাঁ, আমি ডলার-বেশ্যা হতে চাই” …।
আমি তখন ১৯তম কংগ্রেসের সময়কার দলিলে, বুখারিনের নেতৃত্বাধীন ‘রেশম-গোষ্ঠি’ আর স্টালিনের নেতৃত্বাধীন
‘ইস্পাত-গোষ্ঠি’র বিতর্কটা আবার থেকে পড়ছিলাম। তবে ভীষণ বিরক্ত করছিল কংগ্রেসের
মাঝে মাঝে বার বার ‘জয় স্টালিন’, জয় স্টালিন’ স্লোগানগুলো। কিন্তু
সে সময়টা আমার জীবনেরও একটা ওয়াটারশেড। রবীনদা তো কয়েক বছর আগেই কলকাতায় চলে গিয়েছিলেন।
যাওয়ার আগে দুবার দেখা করেছিলাম। একবার তাঁর অপারেশনের খবর পেয়ে হাসপাতালে। আরেকবার
রাস্তায়। ধরে নিয়েও এসেছিলাম কাজলের সঙ্গে দেখা করাতে। কিন্তু সেই যে সুরটা কেটেছিল,
রাগে-ক্ষোভে পরের দিন সকালে, ওনার কাছে থাকা আমার সবকটা বই আমায় ফেরত দিয়ে গিয়েছিলেন,
সে সুর আর জোড়া লাগল না।
একানব্বইয়ে (১৬ই ফেব্রুয়ারি), আমার ইউনিয়ন ও পার্টিজীবনের সবচেয়ে
প্রিয় বন্ধু অনুপম, সে-ও সপরিবারে চলে গেল কলকাতায়। কলকাতারই মানুষ। একদিন ফিরে যাওয়ারই
ছিল। সপরিবারে বলার নিহিতার্থ যে সেটা আমারও পরিবারের মত ছিল। তারপর দীপন। আগেও বলত,
যথার্থই বলত, যে ভালো কাপড় বুনতে গেলে তাঁতিদের পাড়ায় থাকতে হবে’। অর্থাৎ কবিতা লিখতে হলে কলকাতায় যেতে হবে। ট্রান্সফার নিয়ে চলে
গেল। যাওয়ার সময় আবার আমাকে দায়ীও করে গেল যে আমার জন্যই সে পাটনা ছাড়ছে। কেননা, একসাথে
পড়াশুনো করব বলে যে চুক্তি ছিল আমাদের বন্ধুত্বের সেটা আমিই ভেঙেছি। অভিযোগটা সত্যিই,
কিন্তু আমারও উপায় ছিলন না। ও গেল ১৪ই এপ্রিল। বাকি রইলেন আলোকজী। নীলুদি। মানে যারা
সবচেয়ে কাছের ছিলেন তাদের মধ্যে। পূর্ণেন্দুদাও বিগত বারো বছর ধরে পাটনায়, কিন্তু তখনও
তাঁর বলয়ে, অর্থাৎ বাঙালি সমিতি, একাডেমি ইত্যাদির বলয়ে আমি একেবারেই ছিলাম না। কাজেই,
এক আলোকজী যত ঘনিষ্ঠই হোক, বাংলায় তো আর কথা বলতে পারব না।
প্র্যাক্টিক্যালি বাড়ি ছাড়া বাংলায় কথা বলাই বন্ধ হয়ে গেল। তার ওপর,
ওদিকে আমার মেয়েটি জন্ম নিল, অরুণকে বলে অফিসে সবাইকে মিষ্টি খাওয়ালাম, আর্মড গার্ড
সাহেব ভুরুও কোঁচকালেন, মেয়ের জন্মে মিষ্টি? আর এদিকে আমার কাজের একটা কেরাণিসুলভ ত্রুটি
(ক্লারিক্যাল এরর) নিয়ে জল ঘোলা হওয়া শুরু করল। ম্যানেজার ছিল রাইভাল ইউনিয়নের পেটোয়া।
কাজেই জল ঘোলা হতে হতে বেনামি আবেদনের ভিত্তিতে সিবিআই মামলা অব্দি হল। ইউনিয়ন, ফেডারেশন,
পার্টি সবাই আমার সঙ্গে দাঁড়ালো। কিন্তু অরুণটাই, আমার সবচেয়ে কাছের, এমনকি পারিবারিক
বন্ধু হয়েও, বাধালো বিপত্তি। সেই তখন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক। নিজের ট্রান্সফার আগে
করিয়ে নেওয়ার জন্য একটা ওপরচালাকি দেখাতে গিয়ে নীতিগত ভাবে ফাঁসলো।
আমিই ওর সবচেয়ে বড় বন্ধু। সবাই তাকালো আমার দিকে। শেষে সিদ্ধান্ত
মেনে ধানবাদ সম্মেলনে আমিই দাঁড়ালাম ওর বিরুদ্ধে। কখনো ভাবিই নি আমি সামনের সারিতে
আসব। পিছনের সারিতে থেকে সাহিত্যে, গানে বেশ আনন্দে কাটছিল। কিন্তু তা হওয়ার ছিল না।
অরুণ ভুল করেছে তো ভুলটাকে ঠিক করার দায় আমার। পুরো সম্মেলন খালি। কেউ আমার আর অরুণের
প্রতিদ্বন্দিতা দেখতে রাজি নয়। তবু ১৭-১৩য় ফয়সালা হল। আমি জিতলাম।
দু বছরের মধ্যে, আমার এবং আমাদের বিশ্বভাবনা ও সৃজনভাবনার পুরো নির্মাণটা
ভেঙে গুঁড়িয়ে গিয়েছিল সমাজবাদের বিপর্যয়ে। যদিও সেটা হৃদয়ঙ্গম হতে কয়েকটি বছর লেগেছিল।
নতুন করে বিশ্বভাবনা ও সৃজনভাবনা তো এখনও চলতে থাকা প্রতর্ক। তারও দু’বছর আগেই সফদর হাশমির হত্যা হয়েছিল। তবে সে ঘটনা এবং সে সংক্রান্ত
প্রসঙ্গ ভিন্ন পর্বের বিষয়। আমার চোদ্দ-পনেরো
বছরের বন্ধুমজলিশ উঠে গেল, একদিকে সিবিআই মামলার মুখোমুখি হলাম আর অন্যদিকে সংগঠনে
এক বন্ধুকে নিজেই হারিয়ে ইউনিয়নের সামনের সারিতে চলে আসতে বাধ্য হলাম।