Monday, April 7, 2025

সেমিনারের দরজা খুলে

ভাষা ও সংস্কৃতির প্রাচীনতা, অবশ্যই গর্বের। কিন্তু নবীনতা তার থেকেও বেশি গর্বের।

কথাটা কি ধোঁয়াটে শোনাচ্ছে? তাহলে আরেকটু খোলসা করে বলি।

ভাষা ও সংস্কৃতির ধারাবাহিকতা সম্পর্কিত সমাজটির বিকাশের বিভিন্ন পর্বের মধ্যে দিয়ে গড়ে ওঠে। একটি পর্বে, একটি যুগসন্ধিকালে, কোনো ভাষা এবং সংস্কৃতির বিগত হাজার বছর, বিগত সবকটি পর্বের বিকাশচিহ্ন, গ্রহণ, বর্জন, পুনঃপরিভাষণ, বিশ্লেষণ ও সংশ্লেষণের মধ্যে দিয়ে নবীকৃত হয়। একটি বিশেষ দেশকালে যে নবীকরণ প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে তার পুরোটা হওয়ার মধ্যেই থাকে তার প্রাচীনত্বের (অথবা অর্বাচীনত্বের) সার্থকতা। নবীকরণটা না হলে প্রাচীনতা অর্থহীন।

দেশে স্বাধীনতা সংগ্রাম চলছে। বা সমাজটাকে বদলাবারই না হয়, একটা আন্দোলন চলছে। ধর্মকে সংস্কার করার জন্য চলছে একটা অভিযান। একটি প্রাচীন ভাষা ও সংস্কৃতি, কিন্তু সে হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারল না সেই অভিযানের। অথচ একটি অর্বাচীন ভাষা ও সংস্কৃতি হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারল। তাহলে কোনটা বেশি গর্বের হবে? প্রাচীনতা, না নবীনতা? প্রাচীনতা সেখানে গর্বের কী বলতে গেলে প্রাচীন সে ভাষাটি মরেই যাবে। অবধারিত তার মৃত্যু।

আমাদের এই দেশটা সেদিক থেকে সত্যিই গর্বের যে এদেশের সবকটি ভাষা, প্রাচীন হোক বা অপেক্ষাকৃত নবীন, এমনকি অনেকগুলি লিপিহীন (সেসময়ে) উপজাতীয় ভাষা মায় প্রধান ভাষাগুলোর উপভাষাসুদ্ধু ব্রিটিশ শাসনবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে এবং তার পরিপূরক সমাজসংস্কারের সংগ্রামে নিজেদের নবীকরণ ঘটিয়ে নিতে পেরেছে। তাই (প্রত্যন্ত দু-একটি ভাষা হয়তো বা বিলুপ্ত হয়ে থাকতে পারে, কিন্তু সাধারণভাবে) কোনো ভাষা মরে নি। বরং জেগে উঠেছে আত্মবোধনের এক প্লাবক বিস্ময়ে। এই প্রেক্ষিতটাই আমাদের ভাষাসমস্যার প্রেক্ষিত। এবং এটাই তার সমাধানেরও প্রেক্ষিত।

ব্রিটিশ শাসন তাদের শাসনাধীন দেশটাকে ভাগ করেছিল প্রশাসনিক সুবিধায়। স্বাধীনতা আন্দোলন এগোতে গিয়ে টের পেল এটা ভুল, এটা ভারতবর্ষের জনতার ঐক্যের পরিপন্থী। আন্দোলন এগোবার পথে চিনল ভারতবর্ষের বহুজাতিক সত্ত্বা এবং এই সত্ত্বার প্রধান পরিচয়, ভাষা। ১৯২০ সালে নাগপুর অধিবেশনে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস ভাষার ভিত্তিতে রাজ্যগুলির পুনর্গঠনের নীতি স্বীকার করলও। ১৯২৮ সালে মতিলাল নেহরু রিপোর্ট নামে পরিচিত সর্বদলীয় কমিটির রিপোর্ট ভাষার ভিত্তিতে রাজ্যগুলির প্রশাসনিক পুনর্গঠনের দাবি জানালো। ধারণাগত কিছু অপূর্ণতা তাতে ছিল। কিন্তু স্বাধীনতা-প্রকল্পের আবশ্যক অঙ্গ হয়ে দাঁড়ালো রাজ্যগুলির ভাষাভিত্তিক পুনর্গঠন যাতে নিহিত রইল দেশের বহুজাতিক সত্ত্বার স্বীকৃতি। এই দাবি লাগাতার বজায় রইল কংগ্রেসের সনদে, স্বাধীনতা অব্দি। স্বাধীনতার পর কী হল?

ঠিক তাই হল যা অন্য অনেক দাবির ক্ষেত্রে হল। বিশেষ করে যে দাবিগুলিতে নিহিত ছিল দেশ ও সমাজের অধিকতর গণতন্ত্রীকরণ ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রত্যাশা।

ঠিক তাই হল বলে আমি কিছুই হল না বলতে চাইছি না। বলছি, দ্বন্দ্বের যে নতুন রূপটা অন্য ক্ষেত্রে দেখা গেল, ভাষার ক্ষেত্রেও সেটা দেখা গেল। স্বাধীনতার আগে যেখানে ছিল ইংরেজ সরকার বনাম ভারতবর্ষের জনতার দ্বন্দ্ব, স্বাধীনতার পরে সেখানে দেখা গেল বড়ো বড়ো পূঁজিপতি ও তাদের তাঁবেদার সরকার বনাম দেশের জনতার দ্বন্দ্ব।

কথাটা রাজনীতি শোনাচ্ছে?

তাহলে বলুন, স্বাধীনতার ঠিক পরে পরেই যখন অন্ধ্র, কর্ণাটক, কেরল ও মহারাষ্ট্রে পুনর্গঠনের আন্দোলন তুঙ্গে, ভাষাভিত্তিক রাজ্য কমিশন কিম্বা দার কমিটি কেন বলল, প্রশাসনিক সুবিধাই পুনর্গঠনের প্রধান ভিত্তি হওয়া উচিৎ? এবং দেশের সুরক্ষা ও স্থিতিশীলতার খাতিরে পুনর্গঠন এখন (মানে তখন) বাঞ্ছনীয় নয়? ১৯২৮ সালের সাইমন কমিশনও তো ঠিক এই কথাই বলেছিল!

এমনকি ১৯৫৪ সালের ২৩শে জুন ইস্টার্ন ইকোনমিস্টএর পাতায় বড়ো শিল্পপতিরা রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনকে তাদের মত জানালো যে, কোনো রকম পুনর্গঠন স্থগিত রাখা উচিৎ কেননা তা জাতীয় অর্থনীতির বিকাশের পরিপন্থী!

রাজ্য পুনর্গঠন তবুও হল। নানা বিতর্কের মধ্যে দিয়ে। পুরোটা হল না। হতে থাকল, এখনো হচ্ছে। জনতার আন্দোলনের চাপে। তাতে ফলটা দাঁড়ালো এই যে আন্দোলনের উত্তেজনা অনেক সময়েই জাতীয় ঐক্যের ন্যূনতম মাত্রাটা ছাড়িয়ে যেতে থাকল। কিন্তু দোষটা কার? কে বিভেদ সৃষ্টি করছে ভারতের ঐক্যে? ভাষা আন্দোলন? না ভাষার ন্যায়সঙ্গত দাবিগুলির প্রতি উদাসীনতা?

আসলে একচেটিয়া পূঁজির কাছে সারা ভারতবর্ষ একটি বাজার। সেখানে নানা রকম ভাষা হলে তাদের ক্ষতি। একটিই ভাষা থাকলে তাদের লাভ। তাই, হিন্দিকে তারা বার বার সম্পর্ক-ভাষা থেকে রাষ্ট্রভাষায় উন্নীত করতে চাইছিল। বিরোধ হলে বরং ইংরিজিই চলুক, এই মনোভাবে ইংরিজিরও বয়স দশ দশ বছর করে বাড়ছিল। ওদিকে বহুজাতিক পূঁজির কাছে সারা পৃথিবীই একটা বাজার। ইংরেজি তাদের জন্য এমনিতেও বেশি লাভজনক। তবু ভাষা যখন জাতির আত্মপরিচয় ও প্রতিরোধী ঐক্যের হাতিয়ার হয়ে থাকছে তখন তারা আরম্ভ করেছে অধোজাতীয় (সাবন্যাশনাল) সত্ত্বাগুলিকে জাতীয় সত্ত্বার বিপক্ষে দাঁড় করানোর খেলা। যাতে ঐক্যে ভাঙন ধরানো যায় আর পরিণামে একভাষা (ইংরেজি) ভিত্তিক বিশ্বায়নের পথ সুগম হয়। কিন্তু সে কথা আপাততঃ থাক।

সুনীতিবাবু বলেছিলেন, বাঙ্গা্লী জাতির বা বাঙ্গলা দেশের সম্বন্ধে কিছু কথা বলিতে হইলে ভারতবর্ষকে বাদ দেওয়া যায় না। ভারত হইতেছে সাধারণ। বাঙ্গলা হইতেছে বিশেষ। যাহা লইয়া বাঙ্গালীর বাঙ্গালীত্ব, বাঙ্গালীর অস্তিত্ব তাহার মধ্যে বেশীর ভাগই ভারতবর্ষের অন্য জাতির মধ্যেও মিলে। ভারতের অন্যান্য প্রদেশের লোকেদের সঙ্গে সেই সব বিষয়ে বাঙ্গালীদের সমতা আছে।

বিশেষের উপর ঝোঁক দিয়া সাধারণকে ভুলিলে চলিবে না সাধারণই যখন প্রধান।

এই উদ্ধৃতিটা পেলাম সঞ্চিতার, বিহার বাঙালি সমিতির হীরক জয়ন্তী ও সঞ্চিতার রজত জয়ন্তী সংকলন থেকে। যে লেখার নিচে এই উদ্ধৃতিটা বক্স করা আছে সে লেখাটি শ্রী বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের ১৯৭৭এ লেখা। লেখাটিতে হাল্কা চালে বিভূতিবাবু একটি বিপদের দিকে ইংগিত করেছেন যা আজ আরো বেশি করে, বহুমাত্রিক প্রাসঙ্গিকতা রাখে।

বিভূতিবাবু দেখিয়েছিলেন যে যখন বাংলাওয়ালা আর হিন্দিওয়ালা নিজেদের মধ্যে বিতর্কে ডুবে আছে, বাংলাওয়ালা অভিযোগ করছে হিন্দির আধিপত্য-বিস্তারী চক্রান্তের, বাংলার প্রতি সরকারি ঔদাসীন্যের আর হিন্দিওয়ালারা নিজেদের ডিফেন্ড করছে, ঠিক তখনই তাদের পুরো বিতর্কটাকে মার্জিনে ঠেলে দিয়ে এগিয়ে আসছে দুদলেরই বাড়িতে প্রতিপালিত ইংরেজিওয়ালা নতুন প্রজন্ম। উনিশশো সাতাত্তরে ব্যাপারটা বাড়ির সাংস্কৃতিক পরিবেশ, কেরিয়ার আর ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলের ত্রিকৌণিক অন্তর্ক্রিয়ায় সীমাবদ্ধ ছিল। আজ, ২০০১ সালে, বিশ্বায়নের সর্বগ্রাসী হামলার মুখে দাঁড়িয়ে ব্যাপারটা কি ওইটুকুতেই সীমাবদ্ধ আছে? নাকি ছড়িয়ে পড়েছে অনেক দূর ও অনেক গভীর অব্দি?

একটু তাকান তো টিভির বিভিন্ন ন্যাশনাল ও রিজিওনাল, সরকারি ও বেসরকারি চ্যানেলের বিজ্ঞাপনগুলোর দিকে! ভাষা আছে, সব ভাষা আছে; বাংলা, হিন্দি, তামিল, পাঞ্জাবি, প্রভৃতি সব, কিন্তু ফর্মের স্তরে। কন্টেন্ট? সব ক্ষেত্রে ইংরেজি আমেরিকান। সংলাপ বলার স্টাইল আমেরিকান। চরিত্রগুলির বৈশিষ্ট্য ও তাদের অন্তর্ক্রিয়ার ধরণ আমেরিকান। স্মৃতিসংকেত ও অর্থবিস্তার আমেরিকান। সিরিয়ালগুলোও তাই। অভিনয়ের বুনট, যাকে আধুনিক অভিনয় বলা হচ্ছে আমেরিকান। এমনকি উত্তেজিত নৈঃশব্দটুকুও হলিউড থেকে ধার করা। নাচ, গান, কমিক স্ট্রিপ ছেড়েই দিলাম। আগামি প্রজন্মের স্বপ্নময় ভবিষ্যৎ? আমেরিকায়, ইয়োরোপে, অস্ট্রেলিয়ায়। যদিও এটা কোনো ভাষারই সাধারণ শ্রমজীবী জনতার কথা নয়। কিন্তু মধ্যবিত্ত জনতার কথা এবং তারাই নতুন দুনিয়ার ভাবধারাগত প্রকল্পের সুত্রধার।

চমস্কি সাহেব যখন ভারতে এসেছিলেন তখন বলেছিলেন (একটু দীর্ঘ উদ্ধৃতি দিচ্ছি)ঃ-

If we believe that we are in an ideology-less world it is only because the efforts to impose rigid ideologies have been so successful that they seem invisible, like the air we breathe.

We live in the grip of fanatic ideologies and enormous efforts to implement them are a constant pre-occupation of the powerful and their doctrinal institutions; the huge public relations industries, media, schools and universities etc. We can observe it in practice, we can read it in the pronouncements and publications of leading figures in the business and intellectual worlds. We should take quite seriously their concern to wage the everlasting battle for the minds of men, who must be indoctrinated with the capitalist story to regiment the minds of men as an army regiments their bodies to control opinions and attitudes etc.

The strongest ideology by far, in my opinion is the mostly fraudulent doctrine of free-market capitalism …”

এই হল পরিস্থিতি। এই পরিস্থিতি শুধু বাংলার বা বাঙালির জন্য নয়, ভারতবর্ষের সবকটি ভাষাভাষী মানুষের জন্য, গোটা অনুন্নত তৃতীয় বিশ্বের জন্য।

একসময় মনে করতাম ভাষা বাঁচলেই সংস্কৃতি বাঁচবে। আজ মনে হচ্ছে সংস্কৃতি বাঁচলে তবে তো ভাষা বাঁচবে!

তাহলে ভাষা ও সংস্কৃতির ভবিষ্যৎ?

খুবই উজ্জ্বল এবং সে উজ্জ্বল উদ্ধারের ভার আমাদেরই হাতে। যে স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক আমাদের জাতিসত্ত্বা প্রতিষ্ঠা, আমাদের গণতন্ত্রপ্রতিষ্ঠা, আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতিপ্রতিষ্ঠা, সে স্বাধীনতাকে কি আমরা বাঁচিয়ে রাখতে পারবো না? উন্নীত করতে পারবো না সাম্রাজ্যবাদ-ও-একচেটিয়া-পূঁজি-প্রযোজিত-বিশ্বায়ন বিরোধী সর্বভাষিক ঐক্যের স্তরে?

এটাই এই পর্বের নবীকরণের চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জের প্রকল্পটি চোখের সামনে দাঁড় করাবার চেষ্টা করলেই দেখব অন্যান্য সব সমস্যা শিক্ষার সমস্যা, মার্জিনালাইজেশনের সমস্যা, হিন্দির আধিপত্যের সমস্যা, সরকারি ঔদাসীন্যের সমস্যা সেমিনার হলের দরজা খুলে বাইরে পথে গিয়ে প্রতিরোধী আত্মনির্ণয়ের স্লোগান হয়ে দাঁড়াচ্ছে, অন্য আরো অনেক স্লোগানের সঙ্গে। তার পিছনে গিয়ে আমাদের দাঁড়াতে হবে, পায়ে পা মিলিয়ে চলতে হবে।

আমাদের বার বার মনে রাখতে হবে নবীকরণের শেষ যে পর্বের আমরা সন্তান তা হল ইংরেজজাতির গোলামির বিরুদ্ধে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রকল্পে আমাদের জাতিসত্ত্বার, ভারতভূমির সবকটি জাতিসত্ত্বার সামুহিক আত্মনির্ণয়ের পর্ব। এই প্রকল্পেই নবীকৃত আমাদের দুতিন হাজার বছরের সংস্কৃতি ও সাতশো বছরের ভাষা। এই নবীকৃত দুতিন হাজার বছরে, মোয়নজোদড়ো এবং কবীর যেমন একাধারে ইতিহাসবোধ ও প্রতিরোধ, বর্ণমালা ও সুর, সম্বোধন ও সম্পর্ক, শিল্পায়ন ও বনসৃজন, কৃষি ও কৃষ্টি সবকিছুই একাধারে ইতিহাসবোধ ও প্রতিরোধ। ভবিষ্যৎ নিহিত এই প্রতিরোধী ইতিহাসবোধের বর্তমানে, বাস্তবতায়।

 

২৭.৩.২০০১

[ভারতীয় বঙ্গভাষী সমিতির প্রতিষ্ঠা-সম্মেলনের স্মরণিকায় প্রকাশিত]  


No comments:

Post a Comment