Sunday, April 20, 2025

মে-দিন পাখি

মে-দিন তুমি অনেকটা জুড়ে সাজো
লুটেরাতন্ত্রে স্রষ্টা গোলাম;
তার অন্তরে ওঠা অবিরাম  
প্রশ্নগুলোর বিশ্বরূপে বাজো
 
এতোও সহজ নয় হওয়া উচ্ছল!
উৎপীড়নের অনেক স্মৃতি,
গভীর করতে থামায় গীতি,
ঐক্যে ব্যাপক চায় প্রাণের ঢল 
 
ভিড়ের মেলা, নিঃসঙ্গতার হাট
রাষ্ট্রভজানিঃসাড় গৎ;
সমস্ত ন্যায়বিচারের পথ
রাষ্ট্রধ্বংসী গণ-ঐক্যের পাঠ
 
অনেকটাই পিছিয়ে ফিরছি রণে
মরীয়া পূঁজির রাজ-স্যাঙাৎ
লেলিয়ে দিচ্ছে ভ্রাতৃঘাত,
তরুণেরাও রুখছে জীবনপণে
 
মে-দিন হোক ধুলোট রোদের পাখি!
লালঝান্ডার দীপ্র ছায়ার,
কাম্য বদলটাকে বোঝার,
সংহতি। বহু জুলুম-শোধ বাকি।  

২০.৪.২৫

 


দাদরমন্ডির রাস্তাটা

ইতিহাস ইঁটপাথরে যা থাকে
তার চে' অনেক বেশি থাকে সব্জিবাজারের
শাপলাবেচা নারীটির চোখে
নবাবী শহরের পশ্চিম দরজা দিয়ে সকালে
যে যুবকটি বেরিয়েছিল,
ভেজা মেঠো রাস্তা ধরে, হাঁটতে হাঁটতে
গিয়ে বসেছিল টিলার ওপরে,
\জানত না টিলার নিচটা লুপ্ত রাজবাড়ি
রাস্তাটা জানত
আর তাই আমার শূদ্রাণী সাথিনটির সঙ্গে বেঞ্চে
বসে যখন চা খাই, রোদটায়
তিতলির মত ওড়ে বিভিন্ন লিপির বর্ণগুলো
জেমস প্রিন্সেপের তালিকা থেকে -
ব্রাহ্মী বাংলা দেবনাগরী ...
ভাবীজির রান্নাঘরে মশলার গন্ধে মাখা ইতিহাস
তাঁর পুরুষ্টু স্তন দুটো থেকে বয়ে পৌঁছোয়
পাঁচটি কন্যার মাতৃত্ব সময়ে
উপরকি-তে বেনারসিবাবুকে অটোয় এগিয়ে আমি
নিচলকি ধরতে,
বর্ষার রাতে পেরোই হাঁটুজল নিস্তব্ধ বন্ধবাজার
বেসামাল ডুবি ভরা নর্দমায়, উঠি,
রাস্তার কলের নিচে বসে গা থেকে পাঁক ছাড়াই
অন্ধকারে মনে হয় এগিয়ে আসছে শ্রমণেরা;
নাকি জৈনমুনিদল? নাকি পীর সমুদায়?
আমাকে এই সময়জটের জারকে নিজ
নশ্বরতা রসিয়ে নিতে দাও মুক্তিদাতারা!
দোহাই তোমাদের!
দেহের মন আছে যেমন,
মনেরও তো দেহ আছে নেই?

১৭.৪.২৫

 

Saturday, April 19, 2025

বিহার বাঙালি সমিতির ‘কেন’, ‘কবে’ এবং ‘কিভাবে’

 ·      বিহার-বাংলা বিচ্ছিন্নকরণ

কথাটা সবাই জানে যে বাংলা প্রথমবার বিভাজিত হয়েছিল ১৯০৫ সালে। তখনও বাংলাকে হিন্দু ও মুসলমান ধর্মাবলম্বী সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলা ও অঞ্চল হিসেবে দুভাগে ভাগ করা হয়েছিল। বিভাজনের কথিত কারণ ছিল প্রশাসনিক সুবিধা কিন্তু আসল কারণ, সবাই জানেন, ছিল ক্রমবর্দ্ধমান বিপ্লবী আন্দোলন। কিন্তু বিভাজনের আঘাতে বিপ্লবী আন্দোলন তো দমানো গেলই না, উল্টে বিভাজন-বিরোধী গণআন্দোলন তীব্র রূপ ধারণ করল। গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কলকাতার রাজপথে বেরিয়ে আসা, রাখীবন্ধনের দিন হিন্দু-মুসলমান পথচারীদের রাখী বাঁধার গল্পও আপনারা জানেন। অবশেষে ১৯১১ সালের ১২ই ডিসেম্বর বাংলা-ভাগ রদ করা হল। কিন্তু ঘোষণাটা কলকাতায় হল না। আন্দোলনের চাপে পিছিয়ে যাওয়ার বিব্রত মুখটা ঢাকতে, সেদিনই দিল্লিতে স্থানান্তরিত হওয়া রাজধানী থেকে ঘোষণা করল। আর তার তিন মাস পর, ২২শে মার্চ ১৯১২য়, ইংরেজ সরকার আবার ভাগ করল বাংলাকে এবার ধর্মের তাসের জায়গা নিল প্রাদেশিকতার তাস। দেখানো হল যে শিক্ষিত বিহারিদের আন্দোলনের দাবি মেনে বিহার এবং ওড়িশাকে স্বতন্ত্র প্রদেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হল (যদিও বিহার আর ওড়িশা বিযুক্ত হল তার ২৪ বছর পর, ১৯৩৬এ)।

·      বিপ্লবী কার্যকলাপ দমন

মূল উদ্দেশ্য কিন্তু তখনও সেই এক ছিল বিপ্লবী আন্দোলনের অগ্রগতি রোধ। কিন্তু হল কি? কয়েক বছর আগে ব্রজকিশোর স্মারক প্রতিষ্ঠান থেকে বিহারের স্বাধীনতা আন্দোলন নিয়ে একটি সংগ্রহ বেরিয়েছিল। তাতে বিহারবাসী বাঙালিদের যোগদান নিয়ে পূর্ণেন্দু মুখোপাধ্যায়ের একটি প্রবন্ধে পাচ্ছি, অনুশীলন সমিতির একটি শাখা ১৯০৯ সালে গঠিত হল বেনারসে। গঠন করলেন শচীন্দ্রনাথ সান্যাল। ১৯১৩ সালে তিনিই পাটনার বাঁকিপুরেও একটি শাখা খুললেন। বাঁকিপুর শাখার নাম ছিল পাটনা রিভলিউশনারি সোসাইটি এবং তার নেতা ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র মিত্র। অর্থাৎ, বিহারকে আলাদা করেও বিপ্লবী আন্দোলনের অগ্রগতি রোধ করা গেল না। বরং সেটা অন্যান্যদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়তে লাগল। (তার একটিই চরম উদাহরণঃ শহীদ বৈকুন্ঠ শুক্লা কর্তৃক লাহোর ষড়যন্ত্র মামলায় রাজসাক্ষী হওয়া বেতিয়ার ফণী ঘোষের হত্যা; এবং পরিণামে ফাঁসি দড়ি গলায় নেওয়া)।

বিহার এবং ওড়িশা বাংলা থেকে ছিন্ন হওয়ার পর থেকেই সরকারি মহলে এবং সংবাদ মাধ্যমে হাওয়া তোলা হচ্ছিল যে এবার বিহারে শুধু বিহারিরাই চাকরি পাবে। অস্পষ্ট ইংগিত ছিল, বিহারি-বাঙালিরা বিহারি নয়। কিন্তু তাতেও যখন যুবসমাজকে বিপ্লবী স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে দূরে সরানো গেল না তখন, ১৯১৮ সালের ২রা সেপ্টেম্বর, বিহার সরকারের প্রধান সচিব মিস্টার ম্যাকফার্সন একটি সার্কুলার জারি করলেন। সে সার্কুলারে ছিল ডোমিসাইল (স্থায়ী বসবাস) সংক্রান্ত নিয়মাবলী।

·      ডোমিসাইল (স্থায়ী বসবাস) নিয়ম ও তার প্রভাব

সেই নিয়মাবলী অনুসারে, কোনো ব্যক্তিকে এই প্রদেশের স্থায়ী বসবাসকারী স্বীকার করা হবে না, যদি না সে এ বিষয়ে, যে জেলার সে বাসিন্দা বলে দাবি করছে সে জেলার পদকর্তা কর্তৃক জারি প্রমাণপত্র না পেশ করতে পারে। কাউকে স্থায়ী বসবাসকারীর প্রমাণপত্র দেওয়ার আগে জেলার পদকর্তা নিজে সন্তুষ্ট হবেন যে আবেদকের পরিবার প্রদেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করছে, সে এই প্রদেশকে নিজের নিবাস (হোম) হিসেবে গ্রহণ করেছে এবং নিজের জন্মভূমিতে স্থায়ীভাবে ফিরে যাওয়ার তার কোনো অভিপ্রায় নেই। অভিপ্রায় না থাকার প্রমাণ হিসেবে জেলা-পদকর্তা দেখতে পারে যে জেলায়, সংশ্লিষ্ট আবেদকের পরিবার ন্যূনপক্ষে তিন বছর ধরে বসবাস করেছে সে জেলায় তাদের নিজেদের কোনো বাড়ি আছে কিনা, এবং তারা প্রদেশেরই স্কুলে এবং কলেজে নিজেদের বাচ্চাদের পড়িয়ে আসছে কিনা। কিন্তু স্থায়ী বসবাসের দাবি প্রতিষ্ঠা করতে সেসব বিবেচনাকে পর্যাপ্ত বা একান্ত প্রয়োজনীয় মনে করা যাবে না। জেলার পদকর্তা ইচ্ছে করলে, সে প্রয়োজন মনে করে এমন অন্য যে কোনো প্রমাণ চাইতে পারবে, যাতে মান্য হয় যে আবেদকের পরিবার নিজেদের জন্মভূমি পরিত্যাগ করেছে এবং জেলায় স্থায়ীভাবে বসবাস করার অভিপ্রায় রাখে। ব্যবসাবাণিজ্য করার জন্য বা সরকারি কার্যালয়ের দায়িত্ব নিষ্পাদন করার জন্য বসবাস, স্থায়ী বসবাসের প্রমাণ হিসেবে গণ্য হবে না।

এতেও, দেখ, বাঙালিদের কেমন অধিকার-বঞ্চিত করছি, কেমন কুঁকড়ে যাচ্ছে তারা বলে ঠিক তেমন ঘৃণার আনন্দ ছড়ানো গেল না। ডিভাইড এন্ড রুলএর রুলবুক অনুযায়ী আরো নিষ্পেষণ চাই। তবে অপর পক্ষ গল্পটা খাবে। ওদিকে স্বাধীনতা সংগ্রাম পুরো দেশে তীব্র হয়ে উঠছে! ১৭ই ফেব্রুয়ারি ১৯২৮, অর্থাৎ প্রথম সার্কুলারের দশ বছর পর, বিহার এবং ওড়িশার তৎকালীন প্রধান সচিব এইচ. কে. ব্রিস্কো আরেকটি সার্কুলার জারি করলেন। তাতে নির্দেশ দেওয়া হল যে প্রত্যক্ষ প্রয়োজন ছাড়া স্থায়ী বসবাস প্রমাণপত্র(ডোমিসাইল সার্টিফিকেট) দেওয়া হবে না। সরকারের অভিপ্রায় এটাই ছিল যে স্থায়ী-বসবাস সংক্রান্ত অনুসন্ধান তখনই করা হবে যখন কোনো ব্যক্তি, (১) হয় সরকারি চাকরির প্রার্থী, অথবা (২) বৃত্তি প্রার্থী, অথবা (৩) শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শূন্যপদের প্রার্থী। এমন নির্দেশনামার উদ্দেশ্য ছিলঃ প্রার্থী না হলে আবেদন করতে পারবে না আর প্রমাণপত্র পেতে পেতে তারিখ পেরিয়ে যাবে! বিহার বাঙালি সমিতি কর্তৃক পুনঃপ্রকাশিত দ্য বেঙ্গলি বিহারি কোশ্চেন পড়লে বুঝবেন কী অবস্থা হয়েছিল বিহারের বাঙালিদের!

·      অন্তর্বর্তী প্রাদেশিক সরকার

এমনই দমবন্ধ অবস্থার মধ্যে ১৯৩৫ সালে গভর্নমেন্ট অফ ইন্ডিয়া এ্যাক্ট জারি হলে পর, ১৯৩৬ সালের এপ্রিল মাসে বিহার আর ওড়িশাকে আলাদা করে, ১৯৩৭এ প্রাদেশিক বিধানসভার জন্য নির্বাচন হল। বিহারে অন্তর্বর্তী প্রাদেশিক সরকার গঠিত হল। বিহারের বাঙালিরা ভেবেছিল যে এই প্রথম নির্বাচিত সরকার, দেশের আশা ও উদ্দীপনার মাঝে গঠিত সরকার, দেশের ঐক্যের খাতিরে উগ্র প্রাদেশিকতাকে এড়িয়ে চলবে। শিক্ষিত শহুরে সমাজ ও সংবাদমাধ্যমের একাংশের মিথ্যে-তথ্যভিত্তিক বাঙালি-বিদ্বেষের চাপে সরকার বিধানসভায় বাঙালি-বিহারির অস্তিত্বের সংকটটাকেই কথার মারপ্যাঁচে এড়িয়ে চলতে লাগল। সেসময়কার বিধানসভার অধিবেশনগুলোয় চলা প্রশ্নোত্তরের রেকর্ড ইত্যাদি দেখলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যাবে। আবারও বলব, ১৯৩৮ সালের, ব্যারিস্টার পি. আর. দাস রচিত দ্য বেঙ্গলি বিহারি কোশ্চেন পড়ুন। বিহার বাঙালি সমিতি প্রকাশিত করেছে; তাদের কার্যালয়ে পেয়ে যাবেন। শুধু ঐ দুটো সার্কুলারেই থামে নি। ১৯৩৮ সালেই এসেছিল ওডেন সার্কুলার এবং ব্রেট সার্কুলার। সোজাসুজি মিথ্যে ইঙ্গিত ছিল যে বাঙালি কর্মচারিতে সচিবালয় ইত্যাদি ভরে আছে। যখন নাকি ১৯১২য় যখন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সচিবালয় ভাগ হল, ইংরেজ সরকারের নির্দেশেই সেই কর্মচারিদের বিহারের সরকারি দপ্তরগুলোতে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল!   

·      ডোমিসাইল রুলের বিরুদ্ধে লড়াই - সংগঠন প্রতিষ্ঠা

এহেন পরিস্থিতিতে বিহারের বাঙালিরা সংগঠিত হলেন। ব্যারিস্টার প্রফুল্ল রঞ্জন দাস, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের ছোটোভাই, পাটনা হাইকোর্টের স্বনামধন্য ব্যারিস্টার। মানবাধিকার এবং নাগরিক অধিকারের লড়াইয়ে তাঁর দেশজোড়া সুনাম। দেশবন্ধুর শিষ্য নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু পাটনায় এলে তাঁর বাড়িতেই উঠতেন এবং ভাইয়ের আবদারে বিভিন্ন স্বদেশী কাজে দান চেয়ে নিয়ে যেতেন। তিনিই এই মহৎ কাজে নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে এলেন। তাঁর স্বাক্ষরে একটি সভার বিজ্ঞপ্তি গেল সারা বিহারে। ১২ই ফেব্রুয়ারি ১৯৩৮ সালে পাটনার এ্যাংলো-স্যান্সকৃট স্কুলে (এখন আমরা স্কুলটিকে সংস্থাপক, শ্রী পূর্ণেন্দু নারায়ণ সিংহের নামে নামাঙ্কিত পি. এন. এ্যাংলো-স্যান্সকৃট স্কুল নামে চিনি) প্রদেশের ৭২ জন বাঙালি সমবেত হলেন। উল্লেখ্য, যে এক ডাকে পাটনা বাদে রাঁচি, গয়া, ছাপরা, ডালটেনগঞ্জ, পুরুলিয়া (তখন বিহারে ছিল), ভাগলপুর, জামশেদপুর, ঝরিয়া, পুর্ণিয়া, মুজফফরপুর, দ্বারভাঙ্গা, মোতিহারি, আরা, সাঁওতাল পরগণা, হাজারিবাগ অর্থাৎ ষোলোটি জেলার মানুষ তো এসেছিলেনই, কেননা সেদিন নির্বাচিত কার্যনির্বাহী সমিতিতে এই ষোলোটি জেলার প্রতিনিধি ছিলেন। সভায় সভাপতিত্ব করলেন ছাপরার শ্রী হেমচন্দ্র মিত্র। সভায় নবপ্রতিষ্ঠিত বেঙ্গলি এসোসিয়েশন, বিহারএর সভাপতি নির্বাচিত হন শ্রীপ্রফুল্ল রঞ্জন দাস (অন্যান্য সদস্যদের নাম এবং সমিতির গঠন-সংক্রান্ত বিষয়ে বিশদে জানতে পড়ুন বিহার বাঙালি সমিতিঃ সংহতি ও সমন্বয় এবং অধিকার আদায়ের সংগ্রামে ৮২ বছর)। পরের দিন সেই কার্যনির্বাহী সমিতি নবনির্বাচিত সভাপতির বাড়িতে বসে নিয়মাবলী তৈরি করার কাজ শুরু করেন। নিয়মাবলী লিপিবদ্ধ হলে ৭ই এপ্রিল ১৯৩৮, সোসাইটিজ রেজিস্ট্রশন এ্যাক্ট ১৮৬০এর অন্তর্গত রেজিস্ট্রিকৃত হয়।

অনেকে বলেন, হ্যাঁ হ্যাঁ, ওই তো, আগে বেঙ্গলি সেটলার্স এসোসিয়েশন ছিল পরে বেঙ্গলি এসোসিয়েশন হল। বা, আসলে ৩৭এ প্রবাসী বঙ্গসাহিত্য সম্মেলন হল পাটনায়! তারই অনুপ্রেরণায় প্রেরণা, অনুপ্রেরণা তো পূর্বে সম্পন্ন সব কাজ থেকেই মানুষে নেয়, নিতে পারে। কিন্তু দুটো সংগঠনের কোনোটার সঙ্গেই এই নতুন সংগঠন প্রতিষ্ঠার কোনো যোগ পাওয়া যায় নি। প্রতিষ্ঠার এক বছর পর, ৮ই এপ্রিল ১৯৩৯এ জামশেদপুরে প্রথম বার্ষিক অধিবেশন উপলক্ষে সমিতির প্রথম সম্পাদক শ্রী শৈলেন্দ্রনাথ দত্ত বলেন যে, ১৯৩৭ সালে ডোমিসাইল সার্টিফিকেট অধিনিয়মের প্রয়োগের ব্যপকতা বৃদ্ধির প্রতিবাদে বাঙালি সমিতির জন্ম। [সূত্রঃ পূর্বোক্ত বিবাসঃ ৮২ বছর]

·      বিহার হেরাল্ড ও বেঙ্গলি এসোসিয়েশন, বিহার

বিহার হেরাল্ড বিহারের সম্ভবতঃ প্রথম ও ভারতের সপ্তম সংবাদপত্র (Behar Herald, 30.9.2015, Letter to the editor Somnath Roy]। এই সংবাদপত্রের প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক ছিলেন শ্রী গুরুপ্রসাদ সেন, পণ্ডিত, মানবদরদী সাংবাদিক এবং পেশায় উকিল। ১৮৭৫ সালের মার্চ মাসে এর প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়। যখন বেঙ্গলি এসোসিয়েশন, বিহার তৈরি হয় তখন তৎকালীন স্বত্বাধিকারী শ্রী মিহিরনাথ রায়, এসোসিয়েশনেরও সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। বিহারের বাঙালিদের সংগ্রামে সাহায্য হোক, এই উদ্দেশ্যে তিনি পত্রটির স্বত্ব বেঙ্গলি এসোসিয়েশনকে দান করেন। বস্তুতঃ আগামী নয় বছর, যখন বিহারের কোনো সংবাদপত্র বাঙালিদের বক্তব্যগুলো তুলে ধরেনি, মিথ্যে-তথ্যভিত্তিক অপপ্রচারক কিছু বাঙালি-বিদ্বেষীদের কথা ফলাও করে ছেপে প্রদেশে ভাষাভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতার বিষ ঢেলেছে, তখন একমাত্র বিহার হেরাল্ডই, বাস্তব সত্যকথাগুলো বলেছে, বিহারের বাঙালিদের সমস্যাগুলো তুলে ধরেছে বার বার। আজও বিহারের পুরোনো বাঙালি বাড়িতে বুড়ো মানুষেরা স্মৃতিচারণ করেন যে তাঁদের শৈশবে বাবা-কাকারা সকালে ধমকাতেন, আজকের বিহার হেরাল্ডটা পড়েছিস? পড়, অন্ততঃ ইংরেজি শেখার জন্য পড়!

ডোমিসাইল রুলের বিরুদ্ধে লড়াই আদালতে, সংবাদপত্রে, কংগ্রেস হাইকমান্ডের সঙ্গে আলোচনায়

লড়াই এগিয়ে চলল। এই লড়াইয়ের বিস্তারিত বর্ণনা এখানে দেব না কেননা আগেই বলেছি, প্রফুল্ল রঞ্জন দাস রচিত দ্য বেঙ্গলি বিহারি কোশ্চেন বইটায় সে ইতিহাস সবিস্তারে আছে। আরেকটি বই ঘাঁটতে পারেন স্টাডিজ ইন গান্ধীজম, নির্মল কুমার বোস, অষ্টম অধ্যায়। সংক্ষেপে এটুকু বলিঃ ৬ই মে ১৯৩৮এ বেঙ্গলি এসোসিয়েশন, বিহারের সভাপতির দায়িত্বে শ্রী প্রফুল্ল রঞ্জন দাস বিহারের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী (অন্তর্বর্তী সরকারের সময়কালে মুখ্যমন্ত্রীদের প্রধানমন্ত্রী বলা হত) ডঃ শ্রীকৃষ্ণ সিংকে একটি দীর্ঘ চিঠি লিখে চলমান অবস্থা এবং প্রাদেশিক সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিবাদ করেন। ৯ই মে, পণ্ডিত জহরলাল নেহরুকে চিঠি লেখেন, যার সঙ্গে সংলগ্ন ছিল একটি নোট এবং আরো সমস্ত কাগজপত্র। ২৬শে মে পণ্ডিত নেহরু চিঠি লিখে জানান যে নোটটি নিয়ে কংগ্রেস ওয়র্কিং কমিটিতে কথা হয়েছে। উপরুল্লিখিত স্টাডিজ ইন গান্ধিজম বইটায় আছে যে ওয়র্কিং কমিটি বেঙ্গলি বিহারি কোশ্চেন খতিয়ে দেখতে বাবু রাজেন্দ্র প্রসাদের অধ্যক্ষতায় একটি কমিটি গঠন করে। পণ্ডিত নেহরুর চিঠিতেও পরামর্শ দেখতে পাই যে রাজেন্দ্রবাবুর সঙ্গে খোলাখুলি কথাবার্তা হলে আপনাদের অভিযোগ ও অসুবিধাগুলো দূর হবে। দাসসাহেব রাজেন্দ্রবাবুকে স্মারকলিপি দেন। তার ভিত্তিতে রাজেন্দ্রবাবুর কমিটি কিছু সুপারিশ করে। সেই সুপারিশের ভিত্তিতে ১১-১৪ই জানুয়ারি ১৯৩৯এ কংগ্রেস ওয়র্কিং কমিটি বারদোলি অধিবেশনে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে।

কংগ্রেসের বারদোলি অধিবেশনের প্রস্তাব

বারদোলি অধিবেশনের প্রস্তাবে ডোমিসাইল সার্টিফিকেটের ব্যবস্থাটাকে রদ করতে বলা হয়। বলা হয় যে প্রার্থী নিজেই তার আবেদনের সঙ্গে তার স্থায়ী বসবাস সম্পর্কে ঘোষণা করবে, সে ঘোষণার সত্যতা যাচাই করবে। আরো অনেক সুপরামর্শ ছিল তাতে। আর বিহারের নাম নিয়ে স্পষ্টভাবে বলা হল, In regard to Bihar no distinction should be made between Biharis properly so-called and the Bengali-speaking residents of the province born or domiciled there. The term Bihari should in fact include both these classes and in the matter of services, as well as other matters, an identical treatment should be given to both.

এর পর সোজাসুজি শ্রী গুরুচরণ সামন্ত এবং ভগবান প্রসাদ মজুমদার রচিত বিহার বাঙালি সমিতির ইতিবৃত্ত থেকে উদ্ধৃত করি। লেখাটি ১৯৯৮তে প্রকাশিত সমিতির হীরকজয়ন্তী স্মরণিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। একটি পুস্তিকাও হয়েছিল, এবং চার বছর আগে প্রকাশিত উপরুল্লিখিত বই বিবাসঃ ৮২ বছরএও সঙ্কলিত আছে।

সমিতি আশা করেছিল যে জাতীয় কংগ্রেসের ফর্মুলা বিহারের কংগ্রেস সরকারও মেনে নেবেন। বারদোলীতে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের অধিবেশনে গৃহীত প্রস্তাব বিহার সরকার অক্ষরতঃ কার্যকরী করেনি। শুধু উক্ত সার্টিফিকেট দেবার নিয়মের কিছু রদবদল করে দেয়। দাশ মহাশয়ের ৩.১.৩৯এর চিঠি থেকে জানা যায় যে রাজেন্দ্রবাবু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন যে সার্টিফিকেট পাবার জন্য বিহারে ১০ বছর একনাগাড়ে বসবাসের প্রমাণ দাখিল করতে হবে। শিক্ষার ক্ষেত্রে যে সংস্থাগুলিতে কম সংখ্যায় ছাত্র ভর্তি করা হয় সেখানে বিহারের প্রত্যেক কমিউনিটির জনসংখ্যার অনুপাতে আসন সংরক্ষিত হবে, ব্যবসার ক্ষেত্রে যদিও কোনো সার্টিফিকেটের প্রয়োজন নেই, তবুও বিহার সরকার বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে বিহার বাসীদের অগ্রাধিকার দেবার নির্দেশ দিতে পারবেন; এবং বিহারের যে এলাকায় বাঙলা কথ্যভাষা সেখানে বাঙলা ভাষাতেই প্রাথমিক শিক্ষা হওয়া বাঞ্ছনীয় (দ্রঃ Central Privileges File)।

ডোমিসাইল রুল রদ হল না; দেশের পরিস্থিতি বদলে গেল 

২৯.৫.৪৬ তারিখে বিহার সরকারের ডেপুটি সেক্রেটারি সমিতিকে জানান যে সরকার পরিচালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে ভর্তির সময় জলপানি (Scholarship) পাবার অধিকারের জন্য এবং অন্যান্য বিষয়ে বাঙালীদের পূর্ববৎ ডোমিসাইল সার্টিফিকেট দাখিল করতে হবে। অর্থাৎ ডোমিসাইল রুলের কোনো পরিবর্তন হবে না (দ্রঃ No. 1572, বিহার সরকার, শিক্ষা বিভাগ ২৩.৫.৪৬এর নির্দেশ)। ১৩.৩.৪৬ তারিখে বিহার সরকার নতুন ধরণের ডোমিসাইল সার্টিফিকেট প্রবর্তন করেন (দ্রঃ Behar Herald, 12.6.47)। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে দীর্ঘ নয় বছরের চেষ্টাতেও সমিতি ডোমিসাইলের নিয়মটি সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করাতে পারেনি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ায়, চাকুরী ও ব্যবসার যে স্ফীতি দেখা যায় তার ফলে ডোমিসাইল প্রশ্নটি নিজে থেকেই চাপা পড়ে যায়। বাংলার মন্বন্তর, যুদ্ধ, ৪২এর আন্দোলন, যুদ্ধোত্তর রাজনৈতিক উত্থান ও আন্দোলন এবং স্বাধীনতার ও নুতন সংবিধানের সুখ-স্বপ্ন শিক্ষা-চাকুরী-ব্যবসার সমস্যাকে ধামাচাপা দিয়ে দেয়। সমিতিও নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। ভারতের সংবিধান গৃহীত হবার পর, সমিতির দাবীর অনুকূল কেন্দ্রীয় সরকারের Public Employment Act গৃহীত হওয়ায় ডোমিসাইল ব্যবস্থাটি রদ হয়ে যায়।

এটাই ছিল বিহার বাঙালি সমিতির কার্যকলাপের প্রথম পর্যায়। এই পর্যায়ে মোট নয়টি বার্ষিক সাধারণ সভা হয় সংগঠনের। আরো বিস্তৃত বর্ণনা উপরুল্লিখিত বিবাসঃ ৮২ বছর বইটিতে পাবেন। তবে উপরুল্লিখিত ইতিবৃত্ত থেকে একথাটাও উদ্ধৃত করা প্রাসঙ্গিক হবে, সমিতির প্রথম পর্যায়েও বাঙলা শিক্ষা ও বাঙলা মাধ্যমে শিক্ষার জন্য সমিতির কিছু প্রচেষ্টার নিদর্শন পাওয়া যায় যদিও তা প্রস্তাব গ্রহণ, আবেদন-নিবেদন বা অনুনয়েই সীমিত। ১৯৪৬ সালের বার্ষিক অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে প্রস্তাব গৃহীত হয় যে বিহার সরকার বাঙলা ভাষাকে অনিবার্য ও ঐচ্ছিক বিষয়রূপে শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করুক (দ্রঃ সম্পাদকের ২.১১.৪৬এর সার্কুলার)। ঐচ্ছিক বিষয় হিসাবে বাঙলা পড়াবার ব্যবস্থা সরকার করেনি।

 

 

(২)

স্বাধীনতার পর বিহার বাঙালি সমিতি

দেশের স্বাধীনতাপ্রাপ্তির এক বছর আগে (১৯৪৬এর পর) থেকে ১৯৬৬ অব্দি সংগঠন নিষ্ক্রিয় ছিল। ১৯৬৬তে পুনর্জীবিত হয়। মধ্যবর্তী সময়ে, বাংলাভাষা সম্পর্কিত একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। মানভুম জেলায় বাঙালিদের ওপর হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার প্রতিবাদে ভাষা আন্দোলন শুরু হয় এবং ১৯৫৬ সালে মানভুমের একটি অংশকে নতুন জেলা, পুরুলিয়া জেলায় রূপান্তরিত করে বিহার থেকে পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এর কী প্রভাব পড়ে বিহারের অন্যত্র বসবাসকারী বাংলাভাষীদের মনে, জানা যায় না। তবে, স্বাধীনতা-পরবর্তী পটভূমিতে, দেশের নিজস্ব নতুন সংবিধানের কাঠামোয়, ১৯৫৬র রাজ্য পুনর্গঠন-পরবর্তী বিহারের ভৌগোলিক পরিসরে বিহার বাঙালি সমিতি কাজ শুরু করে।

দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রারম্ভ ১৯৬৬তে হলেও, পুরোদমে কাজ শুরু হয় ১৯৬৮ থেকে। প্রথম কয়েক বছরেই (১৯৭২ অব্দি সময়কালে) গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি নীতিসূত্র-সূচক পদক্ষেপ গৃহীত হয়

১) বাংলাভাষী বিহারি শব্দবন্ধটি প্রথম ব্যবহৃত হয় (সভাপতির ভাষণে ব্যবহার করেন ডঃ বিষ্টু মুখোপাধ্যায়)।

২) সংহতি ও সমন্বয় নীতিবাক্য হিসেবে গৃহীত হয় (শ্রী বিভুতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের প্রস্তাবে)।

৩) ঐ নীতিবাক্য সম্বলিত একটি প্রতীকচিহ্ন (Emblem) গৃহীত হয় (ডঃ গুরুচরণ সামন্ত পরিকল্পিত)।

৪) জনগণনায় ভাষাগত সংখ্যালঘু হিসেবে গণনার দাবি জানায় সমিতি (১৯৬৯ সালে, ভাগলপুর সম্মেলনে; আগে সংখ্যালঘুর মধ্যে ভাষাগোষ্ঠিগুলো অন্তর্ভুক্ত ছিল না)।

স্বাধীনতার পর থেকে বিহারের বাঙালীরা সংখ্যালঘুরূপে শুধু কাগজে কলমেই স্বীকৃত ছিল। এর কার্যকর সরকারী স্বীকৃতি শুরু হয় ১৯৭০ সাল থেকে। সমিতির একক চেষ্টার ফলেই স্কুল কলেজের বিধিবৎ সংখ্যালঘু স্বীকৃতি সংক্রান্ত সরকারী নির্দেশ জারি করানো হয়। সমিতির দাবীতেই সরকার ১৯৭০এ রাজ্যস্তরীয় ধর্মীয় ও ভাষাগত সংখ্যালঘু কমিশন গঠন করে এবং ১৯৭১এ সমিতির সম্পাদক দীপেন্দ্রনাথ সরকারকে কমিশনের সদস্য মনোনীত করে। [বিবাস-র ইতিবৃত্ত, সামন্ত ও মজুমদার]

৫) শ্রী অতুলপ্রসাদ সেন রচিত ও সুরারোপিত মোদের গরব মোদের আশা গানটি সমিতি গীত হিসেবে স্বীকৃত হয়।

৬) সমিতির একটি পতাকা স্বীকৃত হয় (পরিকল্পনা করেন জামালপুরের নৃপেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী)। 

৭) বিহার হেরাল্ড, এসোসিয়েশনের আর্থিক সংকটের ফলে যার স্বত্ব অন্য একটি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে দিতে হয়েছিল, আবার এসোসিয়েশনের স্বত্বে ফিরে আসে। বরং তার মুদ্রণ ও প্রকাশনের জন্য সারা বিহার থেকে অনুদান সংগ্রহ করে মুদ্রণযন্ত্র খরিদ করা হয়।

৮) সঞ্চিতা পত্রিকাটি কয়েকজন সাহিত্যপ্রেমিক ব্যক্তির স্বত্বাধিকার থেকে, তাঁদেরই অনুরোধে ও প্রস্তাবে, বিহার বাঙালি সমিতির মুখপত্র ও সাহিত্যপত্র হয় এবং ত্রৈমাসিক হিসেবে তার প্রকাশন শুরু হয়।

৯) ইংরেজি নাম বেঙ্গলি এসোসিয়েশন, বিহারএর সঙ্গে সঙ্গে বাংলা নাম বিহার বাঙালি সমিতিও যুক্ত হয় (১৯৭২)।

১৫টি স্মারকলিপির বিষয়

বিবাসঃ ইতিবৃত্তপ্রবন্ধটিতে ১৫টি স্মারকলিপির উল্লেখ আছে। লেখকদ্বয় ১৯৭২এর বার্ষিক বিবরণী থেকে সেই স্মারকলিপিগুলোর বিষয়গুলো জেনেছেন। ঐ পর্যায়ের কাজকর্ম সম্পর্কে ধারণা করতে হলে আমরাও, রাজ্য সংখ্যালঘু আয়োগকে দেওয়া ঐ ১৫টি স্মারকলিপির বিষয়গুলো তালিকাভুক্ত করতে পারি।

১) প্রাথমিক স্তরে বাংলা শিক্ষা, পরীক্ষা ও মূল্যায়ন।

২) মাধ্যমিক স্তরে বাংলা শিক্ষা, পরীক্ষা ও মূল্যায়ন।

৩) বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে বাংলা শিক্ষা, পরীক্ষা ও মূল্যায়ন।

৪) বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার মাধ্যমে ত্রিভাষাসূত্র।

৫) পাঠ্যপুস্তক।

৬) রেডিওয় বাংলা অনুষ্ঠান।

৭) জনগণনা।

৮) চাকরি।

৯) অফিসের কাজে বাংলাভাষার ব্যবহার।

১০) শিশুসাহিত্য সাহায্যকোষের জন্য অনুদান।

১১) বাংলা লাইব্রেরীর জন্য অনুদান।

১২) রাজ্যস্তরে স্থায়ী সংখ্যালঘু কমিশন গঠন।

১৩) সংখ্যালঘুদের অধিকার পুনর্বিচার।

১৪) কেন্দ্রীয় সংখ্যালঘু কমিশনের রিপোর্ট রাজ্য বিধানসভায় পেশ করা।

১৫) সংখ্যালঘু অধিকার সমন্বিত বাংলা পুস্তিকা প্রকাশ করা।

অর্থাৎ, কাজের মোটামুটি চারটে ক্ষেত্র টের পাওয়া যায় প্রথমতঃ, ভাষার ও ভাষামাধ্যমে শিক্ষা; দ্বিতীয়তঃ, ভাষাগত সংখ্যালঘুর অধিকার, সে অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা এবং জনগণনায় সেই পরিচয়ের স্বীকৃতি; তৃতীয়তঃ, বিগত পর্যায়ের অবশেষ হিসেবে থেকে যাওয়া চাকরির ক্ষেত্রে ভেদাভেদ; চতুর্থতঃ, সংস্কৃতি সংরক্ষণ।

বাঙালী সমিতির কাজের দুটো দিক আছে। একটি ধারা জনগণের চোখের সামনে থাকে তাতে আছে সংগঠন, সম্মেলন, প্রচার, শিক্ষাবিস্তার, সাহায্যকোষ ও অন্যান্য কাজ। কাজের অন্য যে ধারা সেটা থাকে চোখের আড়ালে তাতে আছে ভাষাগত সংখ্যালঘু গোষ্ঠী হিসাবে আমাদের প্রাপ্য আদায় করার চেষ্টা।” [১৯৭৫ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারী পাটনায় অনুষ্ঠিত ১৭তম বিহার রাজ্য বঙ্গভাষী সম্মেলনের অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতির ডাঃ শরদিন্দু মোহন ঘোষালের ভাষণ, দ্রঃ বিবাসঃ ইতিবৃত্ত]

এই পর্যায়ে শিক্ষা সংক্রান্ত কাজই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। প্রত্যন্ত গ্রামে গ্রামে ঘুরে বাংলা ভাষাশিক্ষা বা বাংলামাধ্যমে শিক্ষার প্রকৃত অবস্থা, বাংলাভাষী গ্রামীণ জনগণের সমস্যাবলীর সরেজমিন তদন্ত হয়েছে।

·      সমিতির সাহায্যে সরকার রাজ্যে নিজস্ব বাংলা পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করিয়েছে এবং পাঠ্যপুস্তক নিগম কর্তৃক তার প্রকাশন হয়েছে।

·      প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে কয়েক হাজার বাংলা শিক্ষক নিয়োগ হয়েছে।

·      বিশেষ করে দক্ষিণ বিহারের (এখন ঝাড়খন্ড) অনেক স্কুলে বাংলা মাধ্যম প্রবর্তিত  হয়েছে।

·      সমিতির দেওয়া প্যানেল থেকে বাংলা অনুবাদক নিযুক্ত হয়েছে।

·      বাংলাভাষী পরীক্ষকই বাংলা খাতা দেখবে সে ব্যবস্থা হয়েছে।

·      অনেক বাংলা স্কুল সংখ্যালঘুর স্বীকৃতি পেয়েছে।

·      কেন্দ্রীয় সাক্ষরতা প্রকল্পে বিহারে বাংলাভাষাকে যোগ করা হয়েছে।

এই সব কাজ করাতে সমিতি বহুবার স্বয়ং অথবা কোনো ব্যক্তির মাধ্যমে আদালতেরও দ্বারস্থ হয়েছে। বহু জায়গায় জমির ও কর্তৃত্বের লোভে বাংলা সংখ্যালঘু স্কুলগুলোর ওপর স্থানীয় মাফিয়ারা হামলা করেছে, চক্রান্ত করে কমিটিগুলোকে অপসারিত করার চেষ্টা করেছে; প্রতিহত করেছে বাঙালি সমিতি।  

জনগণনার কাজে হস্তক্ষেপ করে, বাংলাভাষী জনগণকে সচেতন করে বাঙালি জনসংখ্যার পরিসংখ্যানে কৃত্রিম হ্রাস রোধ করতে পেরেছে সমিতি।

বিহার হেরাল্ড, সঞ্চিতা ও প্রকাশনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা

এই পুরো সময়টায় বিহার হেরাল্ড একটি প্রতিষ্ঠিত সংবাদ-সাপ্তাহিক হিসেবে বিহারের বাঙালিদের সমস্যাগুলোর আর সমিতির লড়াইয়ের খবর, যত দূর সম্ভব বাঙালি-অবাঙালি ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছে। সঞ্চিতা সাহিত্যপত্র থেকে সমিতির মুখপত্র এবং সংবাদ-বুলেটিন হয়ে উঠেছে এবং বিশেষভাবে ফোকাস করেছে, সারা বিহারে সমিতির বিভিন্ন শাখাগুলোর কাজকর্মের ওপর। মাঝে মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ পুস্তিকাও প্রকাশিত হয়েছে যাতে বাংলাভাষী জনগণ সচেতন হয়ে ওঠে।

নন্দন কানন

গত শতকের সত্তর, আশি এবং নব্বই এই তিন দশকের সময়কালে আরো অনেক কাজ করেছে বিহার বাঙালি সমিতি। তবে সম্পূর্ণ নতুন ধরণের একটি প্রকল্প সমিতির সামনে এসে অকস্মাৎ হাজির হয়েছে ১৯৭২ সালে। কিভাবে হাজির হল, কিভাবে হাতে নিল সে প্রকল্প সমিতি, সেসব কাহিনী অন্যত্র সবিস্তারে বলা আছে। ইংরেজিতে বই আছে, বাঙালি সমিতির প্রকাশনায় Bhashatirtha: 50 yearsনন্দন কানন ও বিহার বাঙালি সমিতি নামে প্রবন্ধও বহুবার ঘুরেছে সোশ্যাল মিডিয়ায়, Nandan Kanan, Karmatar এর ফেসবুক পেজে গেলে প্রচুর সামগ্রী পেয়ে যাবেন। এখানে এটুকুই বলতে পারা যায়, ১৯৭০ সাল আসতে আসতে দুই বাংলার বুদ্ধিজীবী জগতে পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সার্ধশততম জন্মবার্ষিকী উদযাপনের উৎসাহে, জীবনী রচনা, গ্রন্থাবলী প্রকাশন, আলোচনাসভা ইত্যাদি ছাড়াও অনেক নতুন গবেষণা শুরু হয়। সেই জ্ঞানপিপাসু সময়ে তাঁরা বুঝতে পারেন যে বাংলার উনিশ-শতকীয় নবজাগরণের শিখর-স্বরূপ এই প্রবাদপ্রতিম মহামানবের অনেক কিছুই অজানা থেকে গেছে। সেই সূত্রেই বিহার বাঙালি সমিতির কাছে, (তৎকালীন) দক্ষিণ বিহারের দুমকা জেলার কর্মাটাঁড় গ্রামে বিদ্যাসাগরের একটি বাড়ি খুঁজে বার করার প্রস্তাব আসে। কেননা, আগের রচিত জীবনীগুলোতেও বার বার এসেছে যে বিদ্যাসাগর, কলকাতা শহরের শিক্ষিত মানুষজনের সংবেদনশূন্যতা, সামাজিক অনীহা ও দুর্ব্যবহারে বিরক্ত হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর জন্মস্থান বীরসিংহ গ্রামের প্রতিও খুব বেশি টান ছিল না কেননা বাবা-মা বেনারসে চলে গিয়েছিলেন এবং পুত্র নারায়ণচন্দ্রের আচরণ তিনি অত্যন্ত ক্ষুব্ধ ছিলেন। আত্মীয়স্বজনদের প্রতি এমনিতেও তাঁর খুব বেশি টান ছিল না। যাদেরকে সাহায্যে মাসোহারা পাঠাবার বন্দোবস্ত করেছিলেন তারা পেয়েই যেত। তাই তিনি কর্মাটাঁড় নামে কোনো এক অখ্যাত আদিবাসী অধ্যুষিত গ্রামে বাড়ি কিনে থাকতে শুরু করেন।

বিহার বাঙালি সমিতি সেই বাড়ি খুঁজে বের করে, বাড়িটিকে উদ্ধার করার জন্য কমিটি ইত্যাদি তৈরি করে তৎকালীন মালিকের কাছ থেকে কেনার উদ্যোগ নেয়। জনে জনে দানরাশি সংগ্রহ করে বাড়িটি কেনে, এবং তার রক্ষণাবেক্ষণ শুরু করে। এ কাজে বিহার সরকার এবং তার প্রতিনিধিরা প্রভূতভাবে সাহায্য করেন। আমাদের ভাষাগুরু, বিশ্বের এক অনন্যসাধারণ বিজ্ঞানসম্মত প্রাইমার বর্ণপরিচয়এর স্রষ্টা বিদ্যাসাগরের এই বাড়িটির নাম আগে থেকেই নন্দন কানন ছিল। সমিতি এই পরিসরটিকে ভাষাতীর্থ নামে অভিষিক্ত করে।

ঝাড়খন্ড আলাদা রাজ্য হওয়ার পর থেকে বিহার বাঙালি সমিতি এবং ঝাড়খন্ড বাঙালি সমিতি, বিদ্যাসাগর স্মৃতিরক্ষা সমিতি নামে একটি রেজিস্ট্রিকৃত সংগঠনে যুক্ত হয়ে এই পরিসরটির রক্ষণাবেক্ষণ, বাৎসরিক উৎসবাদি এবং আরো নানারকম কাজ করে চলেছে।      

বিহার বাংলা আকাডেমি

গত শতকের আশির দশকে বিহারে, ভোজপুরী, মৈথিলী, মগহী প্রভৃতি বিহারি ভাষাগুলোর আকাডেমি তৈরি করার উদ্যোগ নেয় সরকার। বিহার বাঙালি সমিতিও সরকারের কাছে বিহারে একটি বাংলা আকাডেমি খোলার প্রস্তাব রাখে। ১৯৮২ সালে পূর্ণিয়ায় বিহার বঙ্গভাষী সম্মেলনের (বিহার বাঙালি সমিতির নিয়মাবলী অনুসারে সাধারণ সভার খোলা অধিবেশনটিকে আলাদা গুরুত্ব দিতে বিহার বঙ্গভাষী সম্মেলন অভিহিত করা হয়) রজত জয়ন্তী উৎসবে, প্রধান অতিথি হয়ে এসেছিলেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি সেদিন শীঘ্র বিহার বাংলা আকাডেমি প্রতিষ্ঠা করার ঘোষণা করেন। ১৯৮৩-৮৪র বাজেটে তার জন্য অর্থ বরাদ্দ করা হয় এবং ১২ই মে ১৯৮৩তে, পাটনার রামমোহন রায় সেমিনারিতে সম্পন্ন আয়োজনে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীই বিহার বাংলা আকাডেমির উদ্বোধন করেন।

নিজের অস্তিত্বের প্রথম পর্বটিকে স্বর্ণযুগ প্রমাণিত করে বাংলা আকাডেমি, বিহারের বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চাকে এক নতুন স্তরে উন্নীত করেছিল। চমকপ্রদ সব প্রকাশন, বিহারের বাংলা সাহিত্যের অজানা অধ্যায়গুলোতে আলোকপাত, আন্তর্জাতিক আলোচনাসভা, আমন্ত্রিত জ্ঞানীগুণীজনের বক্তৃতা, সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার, গবেষণার কাজ । তারপর কাজে কর্মে একটু স্তিমিত ভাব আসে। তা সত্ত্বেও কাজ চলতে থাকে। ২০১২, ২০১৩ সালের আন্তর্জাতিক আলোচনাসভা আজও বহু মানুষের স্মৃতিতে অমলিন হয়ে আছে। কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনও হয়েছে সে সময়। যখন বিহারের স্কুলে স্কুলে বাংলা বই মুদ্রিত রূপে পাওয়া যাচ্ছিল না, আকাডেমি পিডিএফ বই, টেক্সট বুক কমিটির ওয়েবসাইট থেকে ডাউনলোড করে ছাপিয়ে সরবরাহ করেছে।

(আপাততঃ নির্জীব হয়ে আছে আকাডেমি। তবে আশা করা যায় সরকার স্থায়ী অধ্যক্ষ ও নির্দেশক নিযুক্ত করলে আকাডেমি আবার ক্রিয়াশীল হবে।)

 

 

 

 

 

 

 

(৩)

ঝাড়খন্ড রাজ্য আলাদা হওয়ার পর বিহার বাঙালি সমিতি

নতুন সহস্রাব্দ শুরু হতে না হতেই ঝাড়খন্ড রাজ্য বিহার থেকে আলাদা হয়ে গেল। তার একটা বিরাট প্রভাব পড়ল জনসংখ্যায় বাংলাভাষীদের আনুপাতিক শক্তির ওপর। বাঙালি অধ্যুষিত তৎকালীন দক্ষিণ বিহার ঝাড়খন্ডে চলে যাওয়ায় অবশিষ্ট বিহারে বাঙালি জনসংখ্যা আনুপাতিক ভাবে অনেক কম হয়ে গেল। গত দশকগুলোর লড়াইয়ে যা কিছু পেয়েছিলাম, সব হারিয়ে গেল। বাংলা পাঠ্যপুস্তক ছাপা বন্ধ হয়ে গেল, বাংলা শিক্ষক নিয়োগ বন্ধ হয়ে গেল। সরকারী বিভাগে গিয়ে এসব বিষয়ে প্রশ্ন করলে শুনতে হত, বিহারে আর বাঙালি কোথায়?

এই পর্যায়ের বিরাট লড়াইয়ের বর্ণনা উপরুল্লিখিত বিবাসঃ ৮৩ বছর এবং অন্যান্য লেখায় আছে। সময়টা বর্তমান, কাজেই মুখে মুখেও অনেকে অনেককিছু জানেন।

সমস্যাগুলোর কয়েকটি পুরোনো, কয়েকটি নতুন। সেসবে পরে আসা যাবে। বরং কাজের ধরণধারণগুলিকে যদি লক্ষ্য করি, কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ নতুন দিকের উল্লেখ করা যুক্তিযুক্ত হবে।

·      নতুন ধরণের সামুদায়িক ঐক্য প্রয়াস

শহুরে বাঙালি এবং গ্রামীণ বাঙালি এক মঞ্চে আগেও ছিল। বর্তমান ঝাড়খন্ড যখন বিহারে ছিল, জামশেদপুরের বাঙালি আর সিংভুমের গ্রামের বাঙালিকে, ধানবাদের বাঙালি আর মানভুমের গ্রামের বাঙালিকে, এবং সেভাবেই অন্যত্রও শহর আর গ্রামের বাঙালিকে এক সংগঠনে বিহার বাঙালি সমিতিই বেঁধেছিল। বর্তমান বিহারের দিকে, শহুরে বাঙালিদের মধ্যে আবার কয়েক প্রজন্ম ধরে অধিবাসী বাঙালি আর ১৯৪৭ বা ১৯৭১এ উদ্বাস্তু হয়ে আসা বাঙালিও ছিল যারা বিহার বাঙালি সমিতিতে একজোট হয়েছিল।

কিন্তু, বিহারের উদ্বাস্তু কলোনিগুলোতে যে কয়েক লক্ষ বাঙালি পুনর্বাসিত হয়ে, কৃষিজীবী জীবন অতিবাহিত করছিল, তারা প্রধানতঃ একটি ভিন্ন, বিশেষভাবে উদ্বাস্তুদের মঞ্চ বলে গঠিত সংগঠনে ছিল। কিন্তু, বিচ্ছিন্ন ভাবে তারা সরকারের কাছ থেকে কোনো দাবিই আদায় করতে পারছিল না। বাঙালি স্বার্থরক্ষায় বিহার বাঙালি সমিতির সংগ্রাম এবং সাফল্য তাদের মনে নতুন ভরসা জাগালো। ২০০৮ সালের এপ্রিল মাসে, পাটনার রামমোহন রায় সেমিনারী প্রাঙ্গণে যখন বিহার বাঙালি সমিতির সাধারণ সভা চলছিল, সেই উদ্বাস্তু সংগঠন এসে বিহার বাঙালি সমিতিতে নিজেকে বিলীন করল। এই নতুন সামুদায়িক ঐক্য গঠনের পথটায় কিছু জটিলতা আছে। দুই সমুদায়ের মধ্যেকার দূরত্বটা অনেক ক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক এবং অনেক ক্ষেত্রে শ্রেণীগত। বিহার বাঙালি সমিতির সক্ষম নেতৃত্ব, শুধু শীর্ষস্তরে নয়, নিম্নস্তরেও এই ঐক্য প্রসারিত করতে বদ্ধপরিকর। এবং এই পথে এখনো অব্দি বিহার বাঙালি সমিতি সারা দেশের একমাত্র বাঙালি সংগঠন।  

·      গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পথে প্রথমবার

জেলায় জেলায় ধর্না, পাটনার গান্ধী ময়দানে দিনের পর দিন রিলে ধর্না, কালেক্টারিয়েট অফিসের সামনে রাস্তায় ব্যানার, প্ল্যাকার্ড নিয়ে অবস্থান, পাটনায় গর্দানিবাগ থানার সামনে (সরকার নির্দেশিত ধর্নাস্থল) অবস্থান রাজপথে মিছিল এবং শেষে এমনকি নির্বাচন বহিষ্কারএর (ভোট বয়কট) ডাক! এধরণের গণআন্দোলন বিহার বাঙালি সমিতি আগে কখনও করে নি। সরকারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সমিতির প্রতিনিধিরা কথা বলেছে, মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছে, রাজ্যপালের সঙ্গে দেখা করেছে কিন্তু এসব আগে হয় নি। বাঙালি সাংস্কৃতিক যাপনে প্রভাতফেরির পরম্পরা প্রথম থেকেই আছে। সম্মেলন, নেতাজী জয়ন্তী যে কোনো পার্বণে হতে পারে। কিন্তু প্রতিবাদী সক্রিয়তার এক নতুন পর্ব শুরু হল। এই সব আন্দোলনের বছর/মাস/তারিখ উপরুল্লিখিত বিবাসঃ ৮৩ বছরএ তো আছেই, অন্যান্য লেখাতেও আছে। যেহেতু এটা চলতি সময়ের পর্ব, তাই সালতারিখ, ছবি ইত্যাদি সম্বলিত বর্ণনা সঞ্চিতায়, বিহার হেরাল্ডে এবং সোশ্যাল মিডিয়াতেও পাওয়া যাবে।

প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য, ২০০৫ সালের মে মাসে অবশ্য পাটনার রাস্তায় বাঙালিদের স্বতঃস্ফূর্ত একটি বড় প্রতিবাদ মিছিল হয়েছিল। পাটনা কালীবাড়ি এলাকায় বসবাসকারী এক বাঙালি পরিবারে হওয়া বীভৎস হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে। বিহার বাঙালি সমিতি তার উদ্যোগে শামিল থাকলেও ব্যানারটা বিষয়ভিত্তিক ছিল, কোনো সংগঠনের নয়।   

·      নির্বাচন বহিষ্কারএর ডাকে বিপুল ঐক্য ও মহিলাদের সাড়া

নির্বাচন বহিষ্কারএর ডাক দেওয়ার পর সমিতির সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক পূর্ব ও পশ্চিম চম্পারণের গ্রামে গ্রামে ঘুরেছিলেন। সে এক বিরাট অভিজ্ঞতা। তখনো ওসব এলাকায় ডাকাতের দৌরাত্ম পুরোপুরি শেষ হয় নি। অথচ পৌঁছোতে পৌঁছোতে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। তাঁরা গিয়ে দেখেছেন, প্রচুর সংখ্যায় মানুষেরা অপেক্ষা করছেন। কোথাও হয়তো গতরাতে কীর্তনের আয়োজন হয়েছিল। সে-প্যান্ডাল খোলানো হয় নি। তারই নিচে, পুরুষেরা তো বটেই, নারীরাও বিপুল সংখ্যায় তাঁদের নেতাদের প্রতীক্ষায় বসে আছেন। সেটা খুব স্বাভাবিকও ছিল। মায়েরাই তো ভাষা ও কৃষ্টির বাহক ও সূত্রধার। গ্রামীণ, প্রধানতঃ কৃষিজীবী, পশ্চাৎপদ বা তপশীলী জাতের পরিবারের নারীসমাজের এই সমর্থন, বিহার বাঙালি সমিতির অমূল্য সম্পদ হয়ে উঠল।

এই গ্রামীণ মহিলাদের জঙ্গিপনাও দেখার মত। একবার অন্য জেলায় একটি শহুরে উদ্বাস্তু কলোনিতে জমিমাফিয়াদের আক্রমণ হয়েছিল। জিপে অস্ত্রশস্ত্র ভর্তি করে নিয়ে গিয়েছিল। দুপুরবেলা, কলোনিতে পুরুষেরা কেউ নেই, সবাই কাজে গেছে। মহিলারাই বেরিয়ে এল যুদ্ধহুঙ্কার তুলে। যা পাওয়া যায় হাতের কাছে - দা, বঁটি, শাবল সব নিয়ে। কলোনিছাড়া করল দুষ্কৃতীদের। প্রশাসন তার অনেক পরে এসেছিল।    

·      মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠক

বিহার বাঙালি সমিতি প্রথম থেকেই যে কোনো সমস্যার সমাধানের জন্য রাজ্যের সরকারের সঙ্গে টেবিলে বসে আলোচনার সুসম্পর্ক বজায় রেখেছে। প্রথম পর্বে, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানমন্ত্রী ডাঃ শ্রীকৃষ্ণ সিংএর সঙ্গে সমিতির সভাপতি ব্যারিস্টার পি আর দাস মহাশয়, ডোমিসাইল নীতি নিয়ে বিরোধ সত্ত্বেও পত্রালাপ এবং কথাবার্তা চালিয়ে গেছেন। দ্বিতীয় পর্বেও, সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদকগণ নিয়মিত পত্রালাপ এবং কথাবার্তার মাধ্যমেই সমস্যার সমাধান করেছেন। তৃতীয় পর্বে, (হয়তো ঝাড়খন্ড হওয়ার পর বাঙালির সংখ্যা কমে গেছে বলে এবং ভারতীয় প্রশাসনিক সেবার কিছু অতি-পণ্ডিত সচিবের বোঝানোয়) মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বার্তালাপ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বারবার তাঁর জনতা দরবারএ গিয়ে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখা করেও বোঝানো যায় নি যে গণতন্ত্রে ছোটো-বড়ো সব সমুদায়ের সঙ্গেই কথাবার্তা বলতে হয়, সমস্যাগুলোর প্রতি সহানুভূতিশীল হতে হয়। রাজার মতো দরবারে লাইন লাগালে গরীব বৃদ্ধাকে বৃদ্ধাবস্থা পেনশনের কাগজ দেওয়ার ছবি হয়তো তোলানো যায়, কিন্তু সমুদায়কে উপেক্ষা করার দায়টা কাটে না।

কিন্তু সেই মুখ্যমন্ত্রীই, আন্দোলন ও নির্বাচন বহিষ্কারএর সম্ভাব্য সাফল্যের চাপে যখন বুঝে গেলেন যে ভোটের রাজনীতিতে অঙ্ক ভুল হয়ে যাওয়া নিশ্চিত, তখন নিজে বিহার বাঙালি সমিতিকে ডেকে পাঠালেন। আশ্বাস দিলেন এবং নির্বাচনের পর এমন আনুষ্ঠানিক বৈঠক করলেন যা আগে কখনও হয় নি। একদিকে সমিতির সাতজন প্রতিনিধি এবং অন্যদিকে মুখ্যমন্ত্রী, উপমুখ্যমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রীর সচিব, বিকাস আয়ুক্ত, আয়ুক্ত, কার্মিক বিভাগ, পাটনা, পুর্ণিয়া, মোতিহারি ও বেতিয়ার জেলাশাসক, এসডিও এবং অন্যান্য আধিকারিকেরা।

একটা ইতিহাস রচিত হল সেই দিন।

·      সংখ্যালঘু কমিশনের মাধ্যমে সমস্যার নিদান

বিহার রাজ্য সংখ্যালঘু আয়োগে উপাধ্যক্ষ হিসেবে নিযুক্ত হওয়ার পর বিহার বাঙালি সমিতির সভাপতি, বাঙালি জনসাধারণের নানান সমস্যা সমাধান করার কিছু নতুন সুযোগ পেলেন। সংখ্যালঘু আয়োগের উপাধ্যক্ষের পদমর্যাদা রাজ্যমন্ত্রীর। গাড়ি, সিকিউরিটি, পুলিস আর প্রশাসনকে এক হুকুমে সক্রিয় করে তোলা এসব বিহারের গ্রামীণ অঞ্চলের অনেকটা সামন্ততান্ত্রিক পরিবেশে খুব দরকার হয়ে পড়ে। বিশেষ করে, কলোনিতে জমিমাফিয়ার হামলাবাজি, জবরদখল রুখতে, কোনো বাঙালি ব্যক্তি বা পরিবারের সম্পত্তিকে বেআইনি কব্জা থেকে মুক্ত করাতে, পুলিসকে সষ্ক্রিয় করতে, অসামাজিক শক্তির সঙ্গে তাদের যোগসাজস বন্ধ করতে, বাঙালিদের পাব্লিক প্রপার্টিগুলো, যেমন মন্দির, ক্লাব, স্কুল, ইত্যাদিকে দখলমুক্ত করাতে পদমর্যাদা কাজে লাগে। বিশেষ করে এখনকার সময়ে যখন বিগত কয়েক দশক ধরে বিধানসভায় বা বিধান পরিষদে একজনও বাঙালি বিধায়ক নেই, মন্ত্রী তো দূরের কথা।   

·      এডিআরআই কৃত সার্ভে

মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে হওয়া বৈঠকের ফলশ্রুতি হিসাবে সরকার এশিয়ান ডেভেলাপমেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউটকে বিহারের বাঙালিদের আর্থিক এবং শিক্ষাগত অবস্থা খতিয়ে দেখতে একটি ক্ষেত্র সমীক্ষা করার কাজ দিল। বিহারে, ভাষাগত সংখ্যালঘু হিসেবে বাঙালিদের এটা প্রথম সমীক্ষা ছিল। সেই সমীক্ষায় দেখা গেল যে শহুরে এবং গ্রামীণ মিলিয়ে বাঙালির আর্থিক ও শিক্ষাগত স্তর অন্য অনেক সমুদায়ের নিচে।

তারই সঙ্গে জড়িয়েছিল পুনর্বাসিত বাঙালিদের মধ্যেকার দলিত জাতগুলোকে বিহারের তপশীলের অন্তর্ভুক্ত করা। তার জন্য জরুরি ছিল সেই সব জাতের জাতিতাত্ত্বিক সমীক্ষা (এথনোলজিকাল সার্ভে)। সেটাও করল এডিআরআই।

এ লড়াই এখনো চলছে।

·      ভাষাগত সংখ্যালঘু বিদ্যালয়কে প্রদত্ত সংরক্ষণ

এ কাজটা নতুন নয়। গত সাতাশি বছরে বার বার করতে হয়েছে। আপাততঃ পাটনার রামমোহন রায় সেমিনারি, ভাষাগত সংখ্যালঘু পরিচালিত বিদ্যালয় হিসেবে বিহার বাঙালি সমিতির সঙ্গে অধিভুক্ত। অঘোর প্রকাশ শিশু সদনের পরিচালন সমিতি বিহার বাঙালি সমিতির সদস্যরাই চালাচ্ছে। মুজফফরপুরের হরিসভা স্কুলটির কার্য্যত সংরক্ষণে সমিতির মুজফফরপুর শাখার ভূমিকা আছে। তেমনই, ভাগলপুরের দুর্গাচরণ হাই স্কুলটি যদিও একটি স্বতন্ত্র বাঙালি শিক্ষা-সম্পর্কিত কমিটি পরিচালিত, সমিতির ভাগলপুর শাখা তাদেরকে সাহায্য করে থাকে। লাহেরিয়াসরাইয়ের তিনটে বাঙালি স্কুলের প্রতি প্রশাসনের উপেক্ষার কথাও দ্বারভাঙ্গা কালেক্টারিয়েট হলে, সংখ্যালঘু আয়োগের সামনে, ডিএমসাহেবের উপস্থিতিতে বিহার বাঙালি সমিতি উঠিয়েছিল। জামালপুরের একটি ভাষাগত সংখ্যালঘু স্কুল আপাততঃ সংকটের মধ্যে আছে।

 

আজকের লড়াই

·      পুনর্বাসিত উদ্বাস্তু বাঙালিদের দাবিসমূহ

১। দলিত জাতিগুলোর বিহারের তপশীলে অন্তর্ভুক্তিঃ যেমন একটু আগেই বলা হল, লড়াইটা এখনো চলছে। কিছুদিন আগেই সভাপতির নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিমন্ডল দিল্লি গিয়েছিলেন।

২। জমির স্বত্বঃ এ লড়াইটাও বহুদিন ধরে চলছে। কেন্দ্রীয় সরকারের ঋণ মকুব হয়ে গেছে সেই কবে, কিন্তু স্বত্বের কাগজ হাতে না পাওয়ায় জমির বাঁটোয়ারা বা বিক্রি কিছুই হতে পারছে না, চার-পাঁচজনের পরিবারকে দেওয়া সেই জমি এখন পাঁচ প্রজন্ম পরে, পঞ্চাশজনের নামে দেখানো থাকছে না তারা বিপিএল কার্ড পাচ্ছে, না ফ্রি রেশন, না অন্য কোনো সুবিধা।

৩। জাতি শংসাপত্রঃ বিহার তপশীলের অন্তর্ভুক্ত না হলে তারা তপশীলী জাতের শংসাপত্র পাবে না। তবে আপাততঃ সরকারের নির্দেশ রয়েছে তাদেরকে ই.বি.সি. শংসাপত্র (অর্থনৈতিকভাবে অনগ্রসর) দেওয়ার। যার বাসস্থান যেখানে, সেখানকার সি.ও. এই শংসাপত্র দেবে। কিন্তু বহু জায়গায় সি.ও.রা এড়িয়ে যেতে চায়। স্থানীয়ভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়ে বাঙালিরা সেখানে বিহার বাঙালি সমিতির ব্যানারে লড়াই করে।

৪। বিকাশ প্রাধিকরণঃ এই সব অবস্থা দেখে পুনর্বাসিতরা দশ বছর আগে দাবি তুলেছিল, যখন ঐ একই অঞ্চলে (পশ্চিম চম্পারণ) পঞ্চাশ হাজার থারু উপজাতির জন্য বিকাশ প্রাধিকরণ হতে পারে, তাহলে সাড়ে তিন লক্ষ পুনর্বাসিত বাঙালি উদ্বাস্তুদের জন্য কেন নয়। তৎকালীন উপমুখ্যমন্ত্রী জনসভায় আশ্বাসও দিয়েছিলেন যে বিকাশ প্রাধিকরণ তৈরি হবে। আজও হয় নি। সে লড়াইও চলছে।

·      সাধারণভাবে বাঙালিদের দাবিসমূহ

১। বাংলাভাষা শিক্ষার ব্যবস্থা

এ লড়াইয়ে আংশিক সাফল্য এসেছে। বিহারের বিভিন্ন স্কুলে বাংলাভাষার শিক্ষক নিযুক্ত হয়েছে। যদিও শেষ মুহূর্তের তাড়াহুড়োয় খুব উপেক্ষিতভাবে বাংলা বইয়ের ছাপার কাজ শুরু হয়েছে, আশা আছে এই পুস্তিকা পাঠকের কাছে পৌঁছোনোর আগে বইগুলো বিদ্যালয়ে পৌঁছে যাবে। পাটনা হাই কোর্টে সমিতির করা পিআইএল-এ, সরকারের হলফনামা দেওয়ার অনেক বছর পর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়েও বাংলার অধ্যাপকেরা নিযুক্ত হয়েছেন। আমাদের দাবি, নির্বাচনের বছর বলে নয়, প্রতিবছর নিয়মিত ভাবে যেন প্রয়োজনানুসারে পাঠ্যবই মুদ্রণ এবং শিক্ষক নিযুক্তি সম্পর্কিত পদক্ষেপ নেওয়া হয়।

২। সংখ্যালঘু কল্যাণ বিভাগে ভাষাগত সংখ্যালঘু সেল

এ দাবিও উঠেছিল নবছর আগে। খোদ মুখ্যমন্ত্রী বিহার বাঙালি সমিতির সভায় প্রধান অতিথি হয়ে এসে এই আশ্বাস দিয়েছিলেন। এখনো সে আশ্বাস তিনি পুরো করেন নি। আমাদের দাবিঃ অবিলম্বে ভাষাগত সংখ্যালঘু সেল খোলা হোক।

৩। বিহার বাংলা আকাডেমির পুনরুজ্জীবন

বিহার বাংলা আকাডেমিকে পুনর্জীবন দান পুরোপুরি সরকারের হাতে। নবছর ধরে উচ্চশিক্ষা বিভাগ, আকাডেমিটাকে মুন্ডহীন করে রেখেছে। আমাদের দাবিঃ অবিলম্বে স্থায়ী অধ্যক্ষ এবং স্থায়ী নির্দেশক নিযুক্ত করে আকাডেমিটাকে পুনরুজ্জীবিত করা হোক।

৪। সংখ্যালঘু আয়োগে স্থায়ী বাঙালি উপাধ্যক্ষ

পুরোনো সংখ্যালঘু আয়োগ ভেঙে দেওয়ার পর নতুন আয়োগ এখনো তৈরি হয় নি। সে সম্পর্কে সুপারিশ করার জন্য গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটিতে, প্রাক্তন উপাধ্যক্ষ হিসেবে বিহার বাঙালি সমিতির সভাপতিও শামিল ছিলেন। সুপারিশের অন্তর্ভুক্ত রয়েছে এই দাবি, যে নবগঠিত আয়োগে স্থায়ী বাঙালি উপাধ্যক্ষের পদ সৃজন করা হোক।

 

এমন নয় যে বিহার বাঙালি সমিতি এসব ছাড়া অন্য কিছু করে না। বিভিন্ন শাখায় এবং কেন্দ্রীয় সাধারণ সভা উপলক্ষেও বিচিত্রানুষ্ঠান হয়, সাহিত্যবাসর হয়। মাঝেমধ্যে মেলা হয়, তাতে কচিকাঁচা ও যুবদের আকৃষ্ট করার মত উপভোগ্য আয়োজন থাকে; সমিতির ভাগলপুর শাখার নাম তো রক্তদানের কাজে দেশের সংসদে পর্য্যন্ত উচ্চারিত হয়েছে! তাছাড়া থাকে সমিতি সদস্যদের বিভিন্ন সামাজিক কাজে ভূমিকা দুর্গাপুজো, কালীপুজোর আয়োজন থেকে বাঙালিদের প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে স্বেচ্ছাসেবা

তবে যে কাজ আর কেউ করে না, শুধু বাঙালি সমিতি করে অবশ্যই সবার সহযোগিতায় তার সংক্ষিপ্ত ফিরিস্তি উপরে দেওয়া হলে। এই প্রেক্ষিতেই বাঙালিদের ভাষা ও কৃষ্টিগত স্বার্থরক্ষার পথে, দেশের সংবিধান প্রদত্ত অধিকারগুলো আদায় করার পথে বিহার বাঙালি সমিতি, সাতাশি বছর পেরিয়ে এগিয়ে চলেছে।

বিহার বাঙালি সমিতির অনন্যতা

এতক্ষণ যা কিছু পড়লেন তা থেকে কি স্পষ্ট হয়না যে বিহার বাঙালি সমিতি একটি অনন্য সংগঠন?

তবুও, একটা প্রবৃত্তি থাকে মানুষের। সদস্যতা ফর্মটা ভরার পর যখন বন্ধুকে বলব, তুইও ভর না! আর সে বলবে, কেন? কী হবে বাঙালি সমিতির সদস্য হয়ে? কী এমন করেছে সমিতি? তখন যেন বলতে পারি, শোন তাহলে! সারা দেশে এমন সংগঠন আর অন্যটি নেই।

-       কেন?

বাঙালির সংহতি অধিবাসী বাঙালি ও পুনর্বাসিত বাঙালির ঐক্য

-       আচ্ছা, বাঙালিদের পুজো, নববর্ষ, রবীন্দ্রজয়ন্তী, নাটক, বিচিত্রানুষ্ঠান ইত্যাদি তো প্রায় সব রাজ্যেই হয়?

-       হ্যাঁ, হ্যাঁ! আরে এদিকে হিন্দি বেল্টে বেনারস, এলাহাবাদ, কানপুর, লক্ষ্ণৌ, ওদিকে দেহরাদুন, নৈনিতাল, সিমলা, জয়পুর দিল্লি তো কথাই নেই!

-       মধ্যভারতে রায়পুর, জব্বলপুর, বিলাসপুর, ভুপাল, ভিলাই, আবার পাশের ঝাড়খণ্ডে রাঁচি, জামশেদপুর, ধানবাদ, দুমকা, পালামৌ

-       নিচের দিকে নাগপুর, পুণে, চেন্নাই মুম্বই আর বেঙ্গালুরু তো ছেড়েই দিলাম বাঙালিরা রাজ করে !

-       নিশ্চয়ই বাঙালি পুজো কমিটি, সাংস্কৃতিক সংগঠন, সাহিত্য পরিষদ ইত্যাদিও আছে?

-       অবশ্যই আছে।

-       এবার বল, কখনো রায়পুরের বাঙালি আর ১৫ কিলোমিটার দূরের মানা রিফিউজি কলোনির বাঙালিকে একসঙ্গে, এক মঞ্চে কোনো বিষয়ে আন্দোলন করতে দেখেছিস? দেহরাদুন আর পিলিভিতের বাঙালিকে, মুম্বই বা পুনে বা নাগপুরের বাঙালিকে গঢ়চিরোলির বাঙালিকে নিয়ে কথা বলতে শুনেছিস? বেঙ্গালুরুর বাঙালিকে শুনেছিস সিন্ধানুরের বাঙালিদের ডাকতে, আপনারাও আসুন আমাদের পুজোয়?

-       না, ওরা আলাদা আলাদা থাকে, তাতে কী হল?

-       বিহার বাঙালি সমিতি কিন্তু একটাই সমন্বিত ঐক্য, যার মঞ্চ থেকে বেতিয়া শহরের বাঙালি আর পশ্চিম চম্পারণের পুনর্বাসিত বাঙালি, মোতিহারির বাঙালি এবং পূর্বী চম্পারণের পুনর্বাসিত বাঙালি, মুজফফরপুরের, দ্বারভাঙ্গার, ভাগলপুরের সব জায়গার দুধরণের এক সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলে, সরকারকে নিজেদের দাবিদাওয়া জানায়।

-       তাতে লাভ কী হয়?

আইনস্বীকৃত ভাষিক সংখ্যালঘু পরিচয়

-       লাভ হয় যে সরকার কথা শোনে। কোথাও শুনেছিস ভাষিক সংখ্যালঘু সংগঠনের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী, উপমুখ্যমন্ত্রী, মুখ্যসচিব এবং সংশ্লিষ্ট জেলার উচ্চ আধিকারিকদের নিয়ে কথা বলছেন, আশ্বাস দিচ্ছেন, সেই আশ্বাস কার্যকর করতে যথাযথ নীতিনির্দেশ জারি হচ্ছে এবং কাজ হচ্ছে শুনেছিস? সরকারি স্কুলে বাংলা পড়া, বা বাঙালি সমুদায় পরিচালিত বেসরকারি স্কুলে সরকারি সাহায্য হয়তো বেশ কয়েকটি হিন্দি বা বি রাজ্যে আছে। কিন্তু সেখানে পাঠ্যক্রম স্থানীয় হলেও পাঠ্যপুস্তক সাধারণভাবে পশ্চিমবঙ্গ থেকে আনানো হয়। বিহারে ১৯৬০এর দশক থেকে বিহার সরকার লিখিত ভাবে বিহার বাঙালি সমিতির সহযোগিতায় বাংলা পাঠ্যপুস্তক তৈরি করাচ্ছে এবং ছেপে বিতরণের ব্যবস্থা করছে।

-       ১৯৬০এর দশক থেকে?

-       হ্যাঁ, ঝাড়খন্ড হওয়ার পর কিছু বছরের জন্য বন্ধ হয়েছিল। ২০০৭-০৯এর আন্দোলনের পর আবার পাঠ্যক্রম কমিটি বসিয়ে পাঠ্যক্রম তৈরি হল, সেই পাঠ্যক্রম অনুযায়ী পাঠ্যপুস্তক কমিটি তৈরি করে পাঠ্যপুস্তক লেখানো হল, কম্পোজ হল সেই বই! যা হোক, জেলা শিক্ষা দপ্তর আর স্কুলগুলোর গাফিলতিতে সে বই ছাপা হল না।

-       তখন?

-       তখন আর কি? পিডিএফ করে আপলোড করে দেওয়া হল বিভিন্ন ওয়েবসাইটে, কম্পিউটার এবং আরো কয়েকটি বিষয়ের মত। ছাত্রদেরকে বলা হল, সাইবার কাফেতে গিয়ে প্রিন্ট করিয়ে তার ক্যাশমেমো হেডমাস্টারকে জমা দিলে পয়সা পেয়ে যাবে। রাইট টু এজুকেশনএর বই তো! ফ্রি রাখতে হবে!

-       অতো সব পারে না কি ছোটো ছোটো ছাত্ররা?

-       সমিতিও সেই ব্যাপারটা নিয়ে ক্ষুব্ধ ছিল। যাই হোক এ বছর, নতুন শিক্ষা নীতি অনুসারে মডিউল তৈরি হওয়ার পর সেই বইই একটু ফের বদল করে ছাপতে গেছে। দেখা যাক কী হয়?

-       হুম

-       শুধু কি তাই? বাংলা শিক্ষক নিয়োগ কিভাবে শুরু হল? ২০১১এ আলাদা করে স্পেশ্যাল উর্দু টিইটি পরীক্ষা শুরু হল। সমিতি চেপে ধরল সরকারকে। তড়িঘড়ি সরকার ঘোষণা করল, না, শুধু উর্দু না, উর্দু এবং বাংলা টিইটি পরীক্ষা হবে। তুই ভাবতে পারিস, সে সময়কার পাটনার দেয়ালে দেয়ালে রাতারাতি পোস্টার পড়ল, বঙ্গলা টিইটি পরীক্ষাকে লিয়ে ক্র্যাশ-কোর্স, সম্পর্ক করেঁ, মোবাইল নম্বর …” । হাঃ হাঃ, সবাই থাকে নিজের নিজের ধান্ধাতে!

-       নিয়োগ হল?

-       হল না মানে? হল। হচ্ছে। এখন তো বিপিএসসির মাধ্যমেও হচ্ছে। হ্যাঁ পোস্টিংএ কিছু উল্টোপাল্টা আছে। গার্জেনরাও ঐরকমই। কিন্তু নিয়োগ তো হচ্ছে!

-       আর কলেজে?

-       হুঁঃ! জানিস, ঐ ২০১১তেই পাটনা হাইকোর্টে এ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসরের ভ্যাকেন্সি জানতে আর তাতে রিক্রুটমেন্টের জন্য পিআইএল করিয়েছিল বিহার বাঙালি সমিতি। রাজ্য সরকারকে হলফনামা জমা দিয়ে বলতে হয়েছিল যে সারা বিহারে ৫৭টা পোস্ট আছে বাংলা বিষয়ে এ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসরের, আর তাতে শিগগিরই নিয়োগ শুরু হবে।

-       হয়েছিল।

-       তখন হয় নি, কিন্তু এই এবার, অবশেষে ২০২৪এ বিপিএসসির তত্ত্বাবধানে বাংলায় এ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসরের নিয়োগ হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয়। আরো কয়েকটি ভ্যাকেন্সি রয়ে গেছে। সরকারকে চিঠি লিখেছে সমিতি।

স্থানীয় জনতার বিভিন্ন গোষ্ঠী ও সংগঠনের সঙ্গে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সমন্বয় বহুভাষিক কর্মসূচি রূপায়ণ

-       আচ্ছা, এত যে বাঙালি বাঙালি করিস, স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে ঝঞ্ঝাট হয় না?

-       আজ অব্দি কক্ষনো হয় নি। ইংরেজরাই চেষ্টা করে পারেনি পড় না এই চটিবইটার শুরুর পৃষ্ঠাগুলো! নানান ধরণের মানুষ থাকে। কেউ কেউ করতেই পারে ঝঞ্ঝাট। কিন্তু বিহারের মানুষজন তো আমাদের আপনার। আপনা হ্যায় বস্‌! আমরা যে বিহারিই! আর সেভাবে দেখলে খচ্চর লোক বাঙালিদের মধ্যে কম আছে নাকি? খোট্টাকথাটা তো তারাই পয়দা করেছে। আর আমরা তো লোগোতেই লিখে রেখেছি সমন্বয়। রাজ্যের উন্নয়নের প্রশ্নে সবভাষীদের সঙ্গে বাঙালিরাও আছে! আছে মানে পিছলগ্‌গু নয়, সামনের সারিতে আছে। আমরা এখানে আলোচনাসভা করি, কবিসম্মেলন করি সব বহুভাষী। বাংলা, মৈথিলি, ভোজপুরী, অঙ্গিকা, বজ্জিকা, মগহী, উর্দু, হিন্দি সব একসঙ্গে চলি। কবিসম্মেলনে আর সাহিত্যসভায় তো ইংরেজি কবি-সাহিত্যিকেরাও থাকেন।

-       বিহারে ইংরেজি সাহিত্যিক আছেন?

-       হ্যাঁ, সবাই অরুন্ধতী রায় বা অমিতাভ ঘোষ হবেন এমন তো কথা নেই? সব বাঙালি কবিই কি আর শঙ্খ ঘোষ হবেন? সেসব ছাড়। তুই এই বিহার বাঙালি সমিতির ৮৭ বছরে কে কে সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন তাদের নাম জানিস?

-       না।

-       তাহলে কথাবার্তা ছেড়ে একজিট নিই। একটা পোস্টার ঝুলিয়ে দিয়ে যাই। শুধু আমাদের দশজন সভাপতি। কিরিরিরিং

৮৭ বছরের ইতিহাসে আমাদের পথপ্রদর্শকগণ

প্রফুল্ল রঞ্জন দাশ

প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। ভারতখ্যাত ব্যারিস্টার। নাগরিক অধিকারের প্রশ্নে আজীবন যোদ্ধা। সাহিত্যপ্রেমী। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের ছোটো ভাই এবং নেতাজি সুভাষ ছন্দ বসুর নিকটতম শুভানুধ্যায়ী। রবীন্দ্রনাথ পাটনায় এসে তাঁর বাড়িতেই উঠেছিলেন।

ডঃ শরদিন্দু মোহন ঘোষাল

পাটনার বিখ্যাত জনদরদী পাগলা ডাক্টর। গরীব মানুষেরা আজও তাঁকে গল্পকথায় খুঁজে বেড়ায়। রবীন্দ্রভবন এবং রবীন্দ্র বালিকা বিদ্যালয়ের রূপকার। তাঁরই উদার সাহায্যে বিদ্যাসাগরের বাড়ি নন্দনকানন খুঁজে বার করার কাজ হাতে নেওয়া গিয়েছিল। দক্ষ নাট্যপ্রযোজক, পরিচালক ও অভিনেতা।

বিমানবিহারি মজুমদার

বৈষ্ণবসাহিত্যে দিকপাল পণ্ডিত, অথচ আবার রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অধ্যাপক। নানান বিষয়ে পাঠ্যপুস্তক রচয়িতা যা এখনো বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে। তিনি পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্য দিয়ে দেখিয়েছিলেন যে জনসংখ্যার অনুপাতে বিহারে বেশির ভাগ সরকারী চাকরি বাঙালিদের হাতে, এই প্রচারটা কতবড়ো মিথ্যে এবং দুরভিসন্ধিমূলক।

বিভূতিভূষণ মুখোপাখ্যায়

বাংলা সাহিত্যের সবার পরিচিত রবীন্দ্রপুরস্কারপ্রাপ্ত জনপ্রিয় সাহিত্যিক। রাণুর প্রথম ভাগ ও দ্বিতীয় ভাগ অদ্বিতীয় শিশুসাহিত্য। অসংখ্য উপন্যাস ও ছোটো গল্পের লেখক। তাঁর কুশী প্রাঙ্গণের চিঠিহিন্দিতেও একই রকম জনপ্রিয়। নিবাস, দ্বারভাঙ্গা। বিহার বাংলা আকাডেমির প্রথম অধ্যক্ষ।

পদ্মভূষণ ডঃ বিষ্টু মুখোপাধ্যায়

সারা ভারতে স্বনামধন্য অর্থোপেডিক সার্জন। উত্তরপূর্ব ভারতে এতোটাই তাঁর নামডাক ছিল যে তাঁর ক্লিনিক এবং নার্সিং হোমের (তাঁর মারা যাওয়ার এত বছর পরেও) কাছের ওষুধের দোকান, হোটেলগুলোর সাইনবোর্ডে এখনো অসমীয়া ভাষায় নাম লেখা থাকে।

ডঃ লম্বোদর মুখোপাধ্যায়

সুবিখ্যাত স্বাধীনতা সংগ্রামী, নেতাজি সুভাষচন্দ্রের অনুযায়ী, ইংরেজ সরকারের অত্যাচারের বিরুদ্ধে আদিবাসী পাহাড়িয়াদের সচেতন করে তোলার কাজে লীন। বিধায়ক ছিলেন। হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক হিসেবেও তাঁর খ্যাতি ছিল। সমিতির সভাপতি পদে একমাত্র রাজনৈতিক নেতা।

প্রভু মুখোপাধ্যায়

ষাটের দশক হোক বা আশির দশক। সমিতির সংকটমুহূর্তে এসে নির্দ্বিধায় হাল ধরার মানুষ। বিহার চেম্বার অফ কমার্সের একমাত্র বাঙালি অধ্যক্ষ। খুব কম কথার, পাটনার এই ব্যবসায়ী মানুষটি জীবৎকালে সবসময় সমিতির অভিভাবক থেকেছেন।

ডঃ বীরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত

জন্মসূত্রে মাধেপুরার মানুষ হলেও তিনি দ্বারভাঙ্গায় স্বনামধন্য শিশু চিকিৎসক ছিলেন। তাঁরই সভাপতিত্বের কালে বিহার বাংলা আকাডেমি প্রতিষ্ঠিত হয়। 

ডঃ দিলীপ সেন

বিহারের সবচেয়ে নামকরা প্যাথোলজি ল্যাব সেন ডায়াগ্নস্টিক্সএর প্রতিষ্ঠাতা। সহস্রাব্দ বদল এবং বিহার-ঝাড়খন্ড বিভাজনের সময় তিনিই সমিতির সভাপতি ছিলেন। খুব কষ্টের সময়ে তিনি হাল ধরে থেকেছেন।  

ডঃ দিলীপ কুমার সিংহ

বর্তমান সভাপতি। ২০০৫-০৬এর সমস্যাদীর্ণ অবস্থায় সমিতির হাল ধরে আজ কুড়ি বছরের এক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন, যা অবিশ্বাস্য মনে হয়, কখনো কখনো।

----------------------

শুধু দশ জন সভাপতির নাম পোস্টারে তুলে সাজালাম বলে এই নয় যে এঁরাই সব। মুখ বুজে, ঘাড় গুঁজে কাজ করে যাওয়া সাধারণ সম্পাদক, কোষাধ্যক্ষ এবং আরো বিভিন্ন নেতাদের কথাও তো মনে রাখতে হবে। আমাদের মনে থাকার সময়কালের মধ্যে সবার প্রিয়, সবার কাছের মন্টুদা (দীপেন্দ্রনাথ সরকার), গুরুচরণদা (গুরুচরণ সামন্ত) এঁদের কথা বিশেষ করে মনে রাখি।

আর মনে রাখি সারা বিহারের গ্রামে শহরে ছড়িয়ে থাকা মা, বোন, ভাই, কাকা, জ্যাঠা, দাদুদের কথা যাঁরা বিহার বাঙালি সমিতিকে বুকের কাছে আগলে রেখেছেন। সব সংগ্রামের সাফল্যের তাঁরাই সূত্রধার।

 

●●●●●●●●