Friday, August 11, 2023

বহুভাষী কবিসম্মেলন

মেমেন্টোর দোকান থেকেই স্যারকে ফোন লাগালো শুভাশিস, আইটেম একটা পছন্দ হয়েছে, হ্যাঁ, মিলনেরও, একবার আপনি দেখে নেবেন?
  • কোনো দরকার নেই। সময় কম। যথেষ্ট সংখ্যায় আছে তো? আমাদের চল্লিশটা মত চাই।

  • হ্যাঁ, তাই তো পছন্দ করলাম, চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশটা রেডি আছে, দাম বাজেটের মধ্যে, দেখতেও ছিমছাম, শুধু

  • কী?

  • নিচের জায়গাটায় দুই ভাষায় লেখানো যাবে না, এক ভাষায় হবে। 

  • কোন ভাষায়?

  • যা চাইবেন! ও তো স্টিকার তৈরি করে সাঁটিয়ে দেওয়া। বাংলায় হলে আমাদের করিয়ে দিতে হবে মাপ মত। ইংরেজি, হিন্দি হলে ওরা করে নেবে। 

  • ঠিক আছে, অর্ডার দিয়ে দাও।

ফোন রাখার আগে থেকেই মিলন শুভাশিসের কাঁধ ঝাঁকাচ্ছিল।

  • কী বলছিস?

  • ফোনটাই তো রেখে দিলি। যাহোক, বলছিলাম, স্টিকারে তো বিশেষ খর্চা নেই। পিছনে দেখ, এতটা জায়গা আছে। সামনেটার জন্য ওরা ইংরেজিতে করিয়ে নিক। পিছনে লাগানোর জন্য বাংলা স্টিকার আমরা তৈরি করিয়ে নিই। এদেরকেই দিয়ে দেব। সাঁটিয়ে দেবে।

সর্দারজি কথা বুঝতে পারছিল। বলল, সো হো জায়গা, নো এক্সট্রা কস্ট। ব্যস, কল শাম তক মিল জানা চাহিয়ে। 


মানা করা সত্ত্বেও স্যার নিজে বাজারে গিয়ে সিঙাড়া নিয়ে এসেছেন। বৌদি মুড়ি দিয়ে গেছেন। 

  • এটা আমাদের মাথাতেই ছিল না। অথচ দেখ সময় মত সীতাদা আবির্ভূত হলেন, নিজেই প্রস্তাবটাও দিলেন, তার জন্য টাকাটাও দিলেন সব কবিদের জন্য একটা করে মেমেন্টোর ব্যবস্থা হয়ে গেল। আচ্ছা, আমি কী কী করেছি তোমাদের বলে দিই। আমি ইন্দরের সাহায্য নিয়ে এখন অব্দি ভোজপুরির তিনজন, মৈথিলীর তিনজন, মগহীর দুজন, অঙ্গিকা একজন, বজ্জিকা একজন, হিন্দির সাতজন, উর্দুর দুইজন, প্লাস বাংলার আমরা ছাড়া আরো তিনজন অর্থাৎ সব মিলিয়ে বাইশজনের সঙ্গে ফোনে কন্ট্যাক্ট করে কনফার্মেশন নিয়েছি, এঁরা আসবেনই। এছাড়া প্রধান অতিথি হিসেবে নির্মলবাবুকে অনুরোধ করেছি। বয়স হয়েছে, অসুস্থ থাকেন, তবু কথা দিয়েছেন আসবেন।

  • কুঁওয়রজীকে বলেন নি? সদ্য বড় পুরস্কার পেলেন, দিল্লিতে!

  • অত্যন্ত খারাপ রেসপন্স পেলাম। হ্যাঁ, সবচেয়ে আগে ওর কাছেই গিয়েছিলাম। এক সাথে আমরা কাজও করেছি এক সময়। ভেবেছিলাম সোৎসাহে রাজি হবে। হুঁঃ!

  • কেন? কী বললেন?

  • মুড়িটা শেষ করো আগে। চা ঠাণ্ডা হয়ে যাবে যে! বলবখন, কী বলল। আগে বলো, হলের কী খবর?

  • হলের খবর মানে? হল তো হয়েই আছে। এক দিন আগে থেকে তাতে প্রোগ্রাম চলবে। দ্বিতীয় দিন দুপুরের খাওয়ার পর এই কবি সম্মেলন। হলে কী করার আছে?

  • মানে, সেমিনারের মেন ব্যানারটার পাশ দিয়ে বা ডায়াসের টেবিলের সামনে কোথাও কবি সম্মেলনের একটা ব্যানার থাকবে তো? একটা ব্যানার বাইরে গেটের কাছেও থাকতে হবে। ব্যানারটা হিন্দিতে হতে হবে। কেননা কবিরা তো সেমিনারে অংশ নিচ্ছে না। অনেকে জানেও না কী হচ্ছে। তো, তারা যে একটা বিশেষ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত সেটা তো তারা গেটে লেখা এক্সপেক্ট করবে। আশ্বস্ত হবে।

  • এটা তো আগে মাথায় দেন নি। দিন দিন, শিগগির লিখে দিন ব্যানারের ম্যাটারটা। গিয়ে দিয়ে আসছি।

  • লিখে নাও না, বলে দিচ্ছি। আমার আবার হিন্দিতে লিখতে গিয়ে বানান ভুলটুল হয়ে যাবে।

মিলন লিখে নিল। মুড়ি চা খেয়ে দুজনে বেরিয়ে গেল। 


কুঁওয়র অমনের ফ্ল্যাটটা ছিমছাম। মিলনদের স্যার মানে কমলেশ চ্যাটার্জি আগে কখনো আসেন নি। প্রয়োজনও হয় নি। কলেজে হোক বা সভাসমিতিতে, দেখা হয়েই যায়। দরকারি কথা থাকলে ফোনেও সেরে নেওয়া যায়। সেদিন দেখা করতে গিয়ে যেটা হল, কুঁওয়রের সঙ্গে তেমনটা যে কখনো হবে, ভাবেনও নি। কবিসম্মেলনের নকশাটা শুনেই ভোঁতাভাবে প্রতিক্রিয়া দিল কুঁওয়র, আপনারা হিন্দির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন!

  • মানে?

  • এই যে মাতৃভাষার প্রশ্ন। আমি জানি আমার মাতৃভাষা হিন্দি নয়, ভোজপুরি। কিন্তু আমার বাড়িতে আমার ছেলেমেয়েদের মাতৃভাষা হিন্দি। আমি হিন্দিতে লিখি। আমি মনেও রাখি না আমার মাতৃভাষা কী ছিল। আমার ভাষা হিন্দি, এটুকুই যথেষ্ট। হিন্দির যে সম্মিলিত শক্তি, সেটা মাতৃভাষার প্রশ্ন তুলে ভাঙব কেন? আপনারা এইসব মাতৃভাষা, বহুভাষী, জিগিরগুলো তুলে তুলে হিন্দির একতাকে ভাঙছেন। মানে, আমি বলছি না, জেনেশুনে করছেন। মাতৃভাষার প্রশ্ন তোলা আপনাদের জন্য স্বাভাবিক। বিহারে বাংলা, বাঙালির সঙ্কট, শিক্ষা-সংস্কৃতির সমস্যা বুঝি না তা নয়। একটা অল ইন্ডিয়া পার্সপেক্টিভও আছে, কিন্তু বিকশিত ভারতীয় ভাষাগুলোর জন্য। আপনি পূর্ববঙ্গের ভাষার বা বীরভূমের ভাষার আলাদা স্বীকৃতি চাইবেন? ভোজপুরি, মৈথিলী হোক বা ব্রজভাষা, অওয়ধি হোক, এসব ভাষাগুলো মিলেমিশেই তো হিন্দি তৈরি হয়েছে। তারপরও মিডিওকার কবিরা লোকভাষা, জনভাষা এসব ক্যাচি জার্গন তৈরি করে লবিইং করছে আর হিন্দি ভুগছে।

কমলেশবাবু আর হিন্দি-প্রভুত্ববাদের কথা তুললেন না। এটা জানতেন যে বেসিক্যালি কুঁওয়র ওই রাষ্ট্রভাষাবাদীদের ক্যাম্পের বিরুদ্ধে।   

  • তাহলে নাগার্জুন ফিরে ফিরে মৈথিলীর কাছে যেতেন কেন? শুধু নাগার্জুন কেন, মৈথিলী কবিদের তো একটা দুনিয়া আছে, নেই? আর মগহীর ওই যে, খুব ভালো রাজনৈতিক কবি, আমাদের সভা-টভাতেও তো কতবার বক্তারা তাঁর লাইন আওড়ায়

  • মথুরা প্রসাদ নবীন

  • হ্যাঁ, আর ভোজপুরি যে কত গুরুত্বপূর্ণ আজ মার্কেটের কাছে, তা তো অশ্লীল গান আর ফিল্মের বন্যাই বলে দেয়। ভাই কূঁওয়র, আপনি তো ভাষাশাস্ত্র জানেন। ভাষা তো স্ট্যাটিক নয়। ডায়নামিক। জনতা যদি চায়, তার ভাষাটা এগোক, স্বতন্ত্র স্বীকৃতি পাক, কেউ তাৎক্ষণিকভাবে দমন করতে পারে, কিন্তু চিরকালের মত? আর আপনি কী সেটা চাইবেন? আপনিই যে বীরভূমের ভাষার কথা তুললেন, এই তো কামতাপুরি ভাষার কথা উঠছে, আপনি যে রাজনৈতিক শক্তিই হোন, একটা সমাধান-সূত্রে আসতে হচ্ছে, নেই বলে কি উড়িয়ে দিতে পারা যায় মানুষের রোজকার যাপন?

  • তা আপনি যাই বলুন, কিন্তু বিহারে ওই হিন্দির উপভাষাগুলোকে হিন্দির সঙ্গে সমানে সমানে বসানো একটা নেতিবাচক রাজনীতি, অন্ততঃ আমি মনে করি আমি যাব না আপনাদের কবিসম্মেলনে। আপনি আমার গুরুজন, জানেন যে কোনো অহংকার-টহঙ্কারের ব্যাপার নয়, পলিটিক্যালি আমি যাব না। 


জানুয়ারির কুড়ি তারিখ। পাটনায় যত জমাট কুয়াশা, দিনের পর দিন রোদের জন্য আকুতি, ঘর ভর্তি ভেজা কাপড়, সব ওই জানুয়ারির প্রথম দুই সপ্তাহ। সংক্রান্তির দিন রোদ উঠবেই আর তারপর শীত কমতে শুরু করবে। ভোররাতের কামড়টা থাকবে, তবে রোদ যতক্ষণ, আবহাওয়ারও মেজাজ ভালো থাকবে। ইন্সটিটিউটের ক্যাম্পাসে কাল থেকেই বাঙালি নরনারীর কলস্বর। পিছনে গঙ্গার দিকের খোলা মাঠটায় সামিয়ানার নিচে বাঙালি খাবারের গন্ধ। ওপরে হস্টেলের ঘরগুলোও ভাড়া নেওয়া হয়েছে, সেখানে কলঘরে বাংলা গান, ঘরে বাংলায় কচকচি, এমনকি গেটের বাঁদিকে আবর্জনার ঝুড়িতে বাংলা লেখা ছেঁড়া কাগজ।

  • এটাই প্রাপ্তি। তাই না? দুর্গোপুজো-কালিপুজোতেও হয়, কিন্তু সেটা ভিন্ন ধরণের কলতান। এখানে সাহিত্য-সংস্কৃতির মৌতাত, বাঙালিয়ানা চর্চার মৌতাত। সারা বছর, বছর কেন, বছরের পর বছর কেটে যায় হ্যাঁ, খুব হলে কোনো বাড়িতে কয়েক বন্ধু মিলে চর্চা করলাম নইলে নির্ভেজাল বাংলা চর্চার সুযোগ কোথায় পাই। 

  • তা আপনিই তো নির্ভেজালে ভেজাল ঢোকালেন, কালকের কবিসম্মেলন!

  • সেটারও দরকার আছে। এই যাঁরা বাইরে থেকে এসেছেন, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ থেকে, তারপর বাংলাদেশের দুজন অতিথি, তাঁরা তো দেখবেন এখানকার বহুভাষিক আবহ। একে অন্যের মধ্যে আলাপচারিতাও হবে

সোজা পিছনে চলে যান। জলখাবারটা সেরে নিন আগে, ওরা তাড়া দিচ্ছে …” বলতে বলতে সনত বাইরের দিকে চলে গেল।

  • তুমি কোথায় চললে?

  • আরে, স্টেপলার, আলপিন, সেলোটেপ পুরো থলেটাই অফিসে রয়ে গেছে।

শুভাশিস হেঁকে দাঁড় করালো, হেঁটে যাচ্ছেন কোথায়? রিকশায় সময় লাগবে। আমার স্কুটারটা নিয়ে যান। সনত শুভাশিসের স্কুটার নিয়ে বেরিয়ে গেল। 

পিছনের মাঠটায় সামিয়ানার বাইরে সীতাদা বাংলাদেশের দুজন অতিথি আর শিলচরের এক ভদ্রলোকের সঙ্গে বসে আছেন। কমলেশ আর শুভাশিসকে জলখাবারের প্লেট নিয়ে আসতে দেখে বললেন, ওই যে, ওরাই থিংক ট্যাঙ্ক। ওরাই বোঝাবে সমিতিতে আমরা কী করি।

মিলন বাঁ হাতে দুটো খালি চেয়ার টেনে আনল। কমলেশ একটায় বসে বললেন, বলুন, কী জানতে চান। 

  • বিহারে প্রবাসী বাঙালির সংখ্যা কত? 

কমলেশ মুচকি হেসে বললেন, প্রবাসী এই হবেন দশ পনেরো হাজার …”

  • কী? এই যে শুনলাম সাড়ে সাত লক্ষ!

  • তারা তো প্রবাসী নয়। অধিবাসী। বিহারি বাঙালি। তাদের সবাইকার কর্ম এখানে, আদ্ধেকের বেশির জন্মও এখানে, মরবেও বেশির ভাগ এখানেই। ভোটের সময় বিহারের সরকারের কথা ভাবতে হয়, পশ্চিমবঙ্গের সরকারের কথা ভাবা শখ হতে পারে কারোর, তবে প্রয়োজন নেই। আমরা বিহারি বাঙালিকে নিয়ে কাজ করি। 

  • মানে বিহার যখন বেঙ্গল থেকে আলাদা হল তখন যারা চাকরিসূত্র এদিকেই রয়ে গেল

  • শুধু তারা নয়। যারা আকবরের সময় থেকে ছিল, দ্বারভাঙা রাজের মহালে ছিল, যারা তারও আগে থেকে চর্যাপদের সময় থেকে এখানে ছিল তারাও রইল। সাতচল্লিশে দেশভাগে যে উদ্বাস্তুদেরকে এখানে পূনর্বাস দেওয়া হল তারা রইল। তাদের মধ্যে চাষবাস করা, ব্যবসা করা, গায়েগতরে খাটা মানুষেরাও আছে।

  • বাপরে! এ তো পুরো সমাজ! তারা নিজেদের ভাষাসংস্কৃতি ধরে রেখেছে। অনেকে পারে নি। না পেরে হারিয়ে যাওয়াটাকেই তারা ভবিতব্য মেনে নিয়েছিল। এখন সমিতির কাজে জোয়ার আশায় তারাও মাঝে মধ্যে ভাঙা ভাষায় বলছে আমরাও বাঙালি।

  • দাঁড়ান, দাঁড়ান। এ দীর্ঘ ব্যাপার। আমার নোটবই লাগবে। পরে, সন্ধ্যেবেলায় কথা বলব এ নিয়ে। থাকবেন তো? সভার পর? হ্যাঁ, থাকবেন। এখন বলুন বহুভাষী কবিসম্মেলনটা কী? বহুভাষী তো আমরাও করি। আসামেও, সে একবার গিয়েছিলাম ধুবড়িতে বোধহয় বাংলা, অসমীয়া, গোয়ালপাড়িয়া, টোটো, বোড়ো কিন্তু বহুভাষী বলে যদ্দূর মনে পড়ে, মানে যদি কথাটা এসেও থাকে, সেভাবে হাইলাইটেড হয় নি। আমাদের এখানেও কেউ চাটগাঁইয়া ভাষায় লেখে, ময়মনসিংহের ভাষায় লেখে কিন্তু আপনারা তো অভিমন্যুর বাড়া, নিজেরাই চক্রব্যূহ সৃষ্টি করে তার মধ্যে নিজেদেরকে ফেলছেন! হিন্দি নিজে, তার পাঁচ-ছয়টি উপভাষা সঙ্গে, তার ওপর উর্দু, আর এদের মাঝখানে একা বাংলা …” 

তাও কজন?, সীতাদা ফোড়ন কাটলেন, সাকুল্যে পাঁচজন!

  • সেটাও পরেই শুনবেন নাহয়। ওদিকে সভা শুরু করতে দেরি হচ্ছে। দুবার ভিতর থেকে স্বাতীবৌদি এসে মনে করিয়ে দিয়ে গেছেন। চলুন আপনারা, প্লীজ, সবাই! হলের ভিতরে চলুন। অতিথি ছাড়া বাকি সবাই নাম রেজিস্ট্রি করিয়ে ভিতরে ঢুকবেন। আমি এই হাতটা ধুয়ে আসছি।

  • আপনার তো খাওয়াই হয় নি। বসে খেয়ে নিন আগে। আমরা এগোচ্ছি।


কবিসম্মেলন জমজমাট হবে বোঝাই যাচ্ছে। পরের দিন দুপুরে গাড়ি, রিকশা, স্কুটারে ভোজপুরি, মগহি, মৈথিলী, অঙ্গিকা, বজ্জিকা, হিন্দি, উর্দুর কবিরা সবাই পৌঁছে গেলেন। কয়েকজন মহিলাও এসেছেন। আরো দুএকজন যুবক-যুবতীকে ইন্দর সঙ্গে করে নিয়ে এল। স্যারকে বলে কবিতা পড়ার অনুমতি করিয়ে নিল। বাংলার তরফ থেকে দুজন মহিলাকে কমলেশ নিজে বলেছিলেন, তারা দুজনেই এসেছে। দুটো একাডেমির অধ্যক্ষও এসেছেন। প্রধান অতিথি নির্মল চন্দ্র মিশ্র অনেক আগেই এসে বসে আছেন। হাঁটতে একটু অসুবিধে হয় তাই একটি ছেলে সঙ্গে আছে। 

প্রধান অতিথি এবং উর্দু আর ভোজপুরি একাডেমির অধ্যক্ষকে মঞ্চে ডেকে, উত্তরীয়, পুষ্পগুচ্ছ আর মেমেন্টো দেওয়ার পর বাংলাদেশের দুজন অতিথিকেও মঞ্চে ডেকে নিলেন কমলেশ। একটা বেশ আন্তর্জাতিক আন্তর্জাতিক ব্যাপারও হয়ে গেল তাতে। প্রধান অতিথির অনুমতিক্রমে একটা নাতিদীর্ঘ সম্ভাষণে এই বহুভাষী কবিসম্মেলনের তাতপর্য ব্যাখ্যা করলেন। বিহারের বহুভাষিক জনজীবনের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক মাত্রা আর বাঙালিদের ভাষাশিক্ষা সংক্রান্ত সমস্যার কথাও হাল্কাভাবে ছুঁয়ে গেলেন। আশা ব্যক্ত করলেন যে বিহারের বাঙালির মাতৃভাষার লড়াইএ বিভিন্ন মাতৃভাষাভাষীরা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবে। একবার কুঁওয়রের কথাটা মনে পড়ে যাওয়ায় নিজের অজান্তেই হাল্কা মাথা নাড়লেন।

হাতের সূচী অনুযায়ী এক এক করে কবিদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি দিয়ে ডাকতে শুরু করলেন। সবাইকে আগে একটা গোলাপ ফুল, মেমেন্টো আর উত্তরীয় দিয়ে সম্মান জানানো হচ্ছিল। জিনিষগুলো এগিয়ে দিচ্ছিল স্বাতীবৌদির নেতৃত্বে মহিলা ভলান্টিয়াররা আর সম্মান জানাচ্ছিলেন খোদ সীতাদা, মানে সমিতির সভাপতি, সবার পরিচিত মুখ, জনপ্রিয় উকিল। পুরোটাই হিন্দিতে সঞ্চালিত হচ্ছিল। দুঘন্টার অনুষ্ঠানে কেউ হল ছেড়ে বেরুলো না। মিলন কিনারে একটা থাম ঘেঁষে দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করল, সবচেয়ে বেশি আলোড়িত হচ্ছে তো বাঙালিরাই, বিশেষ করে যারা বিহার, ঝাড়খন্ডের বাঙালি। হিন্দি-উর্দুভাষীর বাংলা বুঝতে অসুবিধা হয়, কিন্তু স্থানীয় বাংলাভাষী তো সবকটা ভাষাই মোটামুটি বোঝে। অনেকে তো বাংলায় তোতলায় কিন্তু মগহী বা ভোজপুরিতে মাস্টার। যেমন ছিলেন বিভূতিবাবু মৈথিলীতে। একটা কথা মনে হওয়ায় হেসে উঠল মিলন। ভীষ্ম সাহনির সেই সেমিনার গল্পটির সুরে ভবিষ্যতে বাঙালি ওই ভাষার কবিকুলকে বলতেও পারে, তোমাদেরকে দেড়শো অডিয়েন্স দেব, পাঁচ হাজার টাকা লাগবে। তালি, বাহ বাহ, ফ্রি। আরেকটা বলানোর জন্য একশো টাকা করে এক্সট্রা। শুভাশিসকে কথাটা বলবে বলে খুঁজতে লাগল, কোথায় গেল সালা! 


পোডিয়ামের পিছনে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসেছিলেন কমলেশ, যাতে অযথা সময় নষ্ট না হয়। ওই একটা পোডিয়ামের মাইক, একটা হ্যান্ডহেল্ড পাশাপাশি ভুল করে অন থেকে গেলেই ক্যাঁ কোঁ শুরু হয়। মঞ্চটাও এখানে ছোটো। তাই পোডিয়াম মাইকেই কাজ চালাচ্ছিলেন।

কিচ্ছুক্ষণ ধরে দেখছেন যে নির্মলবাবু মেমেন্টোটা হাতে নিয়ে পিছনের স্টিকারটা হাত দিয়ে খুঁটে খুঁটে তুলতে চেষ্টা করছেন। কবিদের সূচী শেষ হতেই প্রধান অতিথিকে ভাষণের জন্য ডেকে কমলেশ এগিয়ে আস্তে করে জিজ্ঞেস করলেন, কি হল, নির্মলবাবু? 

  • আরে এটা তুলতে চেষ্টা করছি।

  • আসলে বাঙালিদের অনুষ্ঠান তো, তাই সামনের ইংরেজির সঙ্গে পিছনে বাংলাতেও একটা  

  • পিছনে কেন? ওটাই তো সামনে থাকবে। এরকম আছে আরো স্টিকার?

বলতে বলতে পোডিয়ামে চলে গেলেন ভাষণ দিতে। বাংলা জানেন না বলে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে রবিঠাকুরেরই প্রসঙ্গ টেনে শুরু করলেন। কমলেশ নেমে গেলেন মিলনকে খুঁজতে। 

  • তোমার কাছে বাংলা স্টিকার এক্সট্রা ছিল না কতগুলো?

  • স্টিকার কেন, মেমেন্টোও তো আছে। বার করো তো!

মিলন বার করল। 

  • ছেঁড়াছিঁড়ি করতে হবে না। এটার সামনের দিকেও ইংরেজির ওপর দিয়েই বাংলা স্টিকার লাগিয়ে দাও। মাঝে মাঝে আমরা নিজেদেরই বুঝতে ভুল করে ফেলি।

মেমেন্টোটা হাতে নিয়ে মঞ্চে নিজের জায়গায় গিয়ে বসলেন। নির্মলজির ভাষণ শেষ হওয়ার পর সীতাদাকে ধন্যবাদজ্ঞাপন করতে ডেকে, প্রধান অতিথির কাছে গেলেন, এই নিন। ওটা দিয়ে দিন। 

  • এই তো সুন্দর। বাঃ, এবার না র‍্যাকে রেখে দেখাতে পারবো যে বাংলাভাষীদের হাতে পেয়েছি। নইলে বার বার পিছনে ঘুরিয়ে দেখাতে হত। লোকে জানতেও চাইতো না। (পাশে বসে থাকা বাংলাদেশের অতিথিদের জিজ্ঞেস করলেন) কী? ঠিক কিনা?

কমলেশ আপসোসে ঠোট কামড়াচ্ছিলেন, এখন তো বত্রিশ-তেত্রিশটা মেমেন্টোয় নতুন করে স্টিকার লাগানো যাবে না। কেন নিজেরাই নিজেদেরকে এত ছোট করে দেখি আমাদের পারস্পরিক সম্পর্কগুলো যাচাই করার সময়?


●●●●●●●●●●






No comments:

Post a Comment