Labels
- Ajker dintar janya (10)
- Alokji's poems in English translation (6)
- Articles (116)
- Behar Herald (2)
- Bhinshohore (55)
- Biography (1)
- Engels (11)
- Hindi (48)
- Housing Question (10)
- Kedarnath Bandopadhyay (1)
- Krishak Sabhar Smriti (2)
- Lok Janwad (4)
- Magadher Sahitya (6)
- Meghsumari (155)
- Phire ese (170)
- Plays (10)
- Poems (462)
- Poems by Robin Datta (5)
- Priyo Pochis (8)
- Sanchita (1)
- Sirir mukhe ghor (20)
- sketches (6)
- Smritiprasanga (2)
- Somudro Dubhabe Dake (29)
- Song (1)
- Songs (7)
- Stories (51)
- Translations (88)
- Video (5)
- कौन थे इश्वरचन्द्र विद्यासागर (200वीं जन्मजयंती पर एक कर्मवीर की कीर्तिगाथा) (19)
Wednesday, August 30, 2023
নবজাগরণী
Thursday, August 24, 2023
গ্যালি প্রুফ
ভারতী প্রিন্টিং প্রেস
‘ল’ এক পোয়া
অভিযান
বড় বটগাছটা
থ্যাঁতলানো দাঁতন আর আলতা
সদাহাস্যমুখ
ঘোষদা
ইউনিকোড
মাডগার্ড-খোলা সাইকেল
প্রথম সাইকেলটা ছিল মাসভাড়ায়। হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করার পর ইয়ারপুর গুমটির সামনে ‘ছোটো’ নন্দী জ্যাঠার দোকান থেকে বাবা আনিয়েছিল। ঠিক মনে পড়ছে না, তার আগেই কি অন্য কোনো একটা সাইকেলে চালানোটা শিখে নিয়েছি? বোধহয় বাবার অফিসের সাইকেল, তাঁর কোনো সহকর্মী এনে রেখেছিলেন! হাম্বার, ব্রিটিশ ব্র্যান্ড, কালো রঙের আর ছোট চামড়ার সিট! ছোটোবেলা থেকে নজর ছিল। সত্যিই কি পেয়েছিলাম চড়তে? নাকি স্বপ্নকে বাস্তব ভাবছি? হয়তো তাই, ভাড়ায় আনা সাইকেলটাতেই বোধহয় শিখেছিলাম!
বাবার শেখানোর ধরণটা
ভালো ছিল। অন্য সবাই উৎসাহ দিত সোজা দুদিকে পা রেখে বসে প্যাডেল করে ব্যালেন্স সামলাবার
চেষ্টা করতে। বাবা দেখাতেন বাঁ প্যাডেলে একবার চাপ দিয়ে তার ওপর এক পায়ে দাঁড়ানো। কতক্ষণ
দাঁড়াতে পারি দেখতে আর সেটা স্টেডি করতে বলতেন। আস্তে আস্তে সময়টা বাড়াতে বলতেন। পরে
বুঝেছিলাম ব্যালেন্স পা দিয়ে হয় না, মেরুদন্ড দিয়ে হয়।
সামনে একজনকে বসিয়ে
চালানো মানে ডাবল-রাইডিং, বা সামনে আর পিছনে দুজনকে বসিয়ে চালানো, ত্রিপল-রাইডিং শিখলাম
তারপর।
ভাড়ার সাইকেলটা পাওয়ার
পর টিউশনিতে, ম্যাটিনি শোয়ে আর কলেজে যাওয়া শুরু করলাম। কিছুদিনে বোধহয় নিজের সাইকেল
পেলাম, সেকেন্ড হ্যান্ড এ্যাটলাস (মনে হয় পেয়েছিলাম, কেননা ভাড়ার সাইকেল নিয়ে তো যা
ইচ্ছে তাই করা যায় না)। নন্দী জ্যাঠার দোকানেই কেনা। আর কলেজে ভর্তি হওয়ার পরের বছর
মার্চে ক্লাসের চারজন সঙ্গীকে জুটিয়ে মিহির সেনের অনুপ্রেরণায় প্রাণিত করলাম, “চল না, ভারত-ভ্রমণে বেরোই! সবাই তো করছে কিছু
না কিছু!” সাড়া পেলাম না,
“ওসব বেঙ্গলে হয়।
এখানে কে কী করছে দেখা তো!” তখন কলকাতা-ভ্রমণে
নামতে হল। মোটামুটি প্রসন্ন মনে রাজি হল তারা। প্রিন্সিপাল পিএন শর্মা স্যারও খুশি
যে তাঁর কলেজ থেকে সাইকেল ট্যুরের একটি দল বেরুচ্ছে। বাড়িতেও সবার দুশ্চিন্তা কমল যে
অন্ততঃ একা যাচ্ছে না ছেলে।
সেক্রেটারিয়েটে ক্রিকেটের
মাঠে কেউ বলেছিল রিভলবার সঙ্গে রাখতে। আরেকজন বলল এসব কাজে স্পন্সর লাগে, টাকা কোথায়
পাবি? কলেজে কেউ বলল চম্বলের উপত্যকায় ডাকাতরা বন্ধক করে রাখতে পারে। আমি করার মধ্যে
নিজের সাইকেলটার মাডগার্ড খুলিয়ে নিলাম, কেননা সামান্য ঘষা লাগলেও চলন ভারি করে দেয়,
আর মায়ের কাছ থেকে চেয়ে নিলাম পঁচিশটা টাকা। একটা টুলকিট রাখবো ভেবে টিউবের টুকরো,
রাবার সলিউশন, শিরিষ কাগজ, তের ফুটোওয়ালা রেঞ্চ, টায়ারের টুকরো (দরকারে গিট্টিসের জন্য),
কাঁচি আর এ ধরণেরই আরো কিছু জিনিষ যোগাড় করেছিলাম। কিন্তু নিলাম না, কেননা একটা হ্যান্ডপাম্প
কিনতে হত, তার পয়সা ছিল না।
আবছা হলেও আমার মাথায়
মূল প্ল্যানটাই ছিল যে কলকাতায় পৌঁছে আরো এগোবার জন্য নিজেকেও এবং সবাইকে উৎসাহিত করব।
ভারত বলব না, হয়তো বলব ম্যাড্রাস। তাও না হলে ভুবনেশ্বর। বা সোজা বোম্বাই। রাস্তায়
যতদূর সম্ভব বিনা পয়সায় রাত্রিবাসের ব্যবস্থা করব আর সেভাবেই দিনের খাবারটাও জুটে গেলে
আরো ভালো। একান্তই না হলে, বড় শহরে কলেজ ক্যাম্পাসে ঢুকে সাহায্য চাইব। যা হবে দেখা
যাবে। এ ছাড়া উপায়ও ছিল না। স্পন্সরও পাবো না, রিভলবারও পাবো না আর চম্বল তো ফিরতি
পথের ব্যাপার! আগে ততটা পৌঁছোই!
তার আগে সাইকেলে
দুবার রাজগীর গিয়ে আইডিয়া হয়ে গিয়েছিল যে একদিনে কতটা চালাতে পারব। ধার্য দিনে (সম্ভবত
৯ই মার্চ, ১৯৭০, কেননা গুগল বলছে দিনটা সোমবার আর আমাদের কলকাতা ছাড়বার দিনটার সঙ্গে
পিছু-হিসেব করলে মিলছে) সকাল সাতটা নাগাদ আমি, চপল, বিষ্টু, আশীষ আর অসিত কলেজে পৌঁছে
গেলাম। আজকালকার মত ঝান্ডা দিয়ে সংকেত-টঙ্কেত কেউ না করলেও প্রিন্সিপ্যালস্যার, শিক্ষক
আর সহপাঠীদের শুভকামনা নিয়েই কলেজ থেকে রওনা হলাম।
১
তখন তো গঙ্গাপুলও
নেই আর বখতিয়ারপুর সুপারওয়েও নেই। মহেন্দ্রু, আলমগঞ্জ, সিটিকোর্ট, সিটি চৌক, মারুফগঞ্জ,
দিদারগঞ্জ, কচ্চি দরগাহ, টেঢ়াপুল, ফতুয়া, খুসরুপুর হয়েই বখতিয়ারপুর হয়ে বিহারশরীফ পৌঁছোলাম।
বোধহয় আশীষ বা অসিতেরই পরিচিত কোনো বাড়ি ছিল সেখানে। তাঁরা খুব আপ্যায়ন করেছিলেন মনে
আছে। প্রথম দিন, ওইটুকু চালিয়েই সবার পায়ে ব্যথা। মার্চ মাস, তাই ভাবা মত টাটকা খেজুর
রসও পাইনি রাস্তায়। যদিও এই স্মৃতিকথা হিন্দিতে লেখার সময় লিখেছিলাম যে রাতে আমরা বিহারশরীফে
রয়ে গেলাম, সেটা বোধহয় ঠিক নয়। যেমন করে হোক, সবাইকে ঠেলেঠুলে রাজগীর নিশ্চয়ই পৌঁছে
গিয়েছিলাম। সাধারণ বুদ্ধি বলে, একটা ছোট বাড়িতে পাঁচজনের থাকা সম্ভব নয় আর বিহারশরীফে
ধর্মশালা বলতে নেই। রাজগীর ধর্মশালায় ভরা। দ্বিতীয়তঃ বিহারশরীফ থেকে বরহি, রাজগীর,
গয়া হলে গেলে একটু বেশি লম্বা রাস্তা, আমাদের দলের পক্ষে এক দিনে পেরুনো সম্ভব নয়।
তৃতীয়তঃ দ্বিতীয় দিনেই আমাদের বরহি পৌঁছোনো যুক্তিযুক্ত কেননা কলকাতা যেতে সময় লেগেছিল
পাক্কা পাঁচ দিন।
বিহারশরীফের ভদ্রলোকের
একটা উপদেশ বিরাট কাজে লেগেছিল। তখন রাজনৈতিক আবহাওয়া গরম। বিহারেও দারোগা প্রসাদ রায়ের
নেতৃত্বে অ-কংগ্রেস সংযুক্ত বিধায়ক দলের সরকার। তিনি বললেন, একটা খাতা রাখুন সঙ্গে।
যেখানে পৌঁছোবেন, সবচেয়ে আগে পুলিস থানায় রিপোর্ট করে লিখিয়ে নেবেন যে এই সময়ে শহরে
ঢুকলাম। সম্ভব হলে পরদিন বেরোবার সময়েও লিখিয়ে নিতে পারেন। বস্তুতঃ ভদ্রলোক নিজেই একটা
খাতা কিনে আমাদেরকে সঙ্গে করে বিহারশরীফ থানায় নিয়ে গেলেন আর দারোগাসাহেবকে দিয়ে লিখিয়ে
নিলেন – এই সময়ে এই পাঁচজন
(সবার নাম) বিহারশরীফে পৌঁছোলো। নিচে দস্তখৎ আর শিলমোহর।
খাতাটা যে কত কাজ
দিয়েছিল কী বলব! বলতে গেলে ওই খাতার রেকর্ডের জন্যই প্রত্যেক জায়গায়, এমনকি সেন্সিটিভ
জায়গাতেও পুলিসের শুধু সাহায্য নয়, রীতিমত বন্ধুত্ব পেয়েছি; নিজেদের টিফিন থেকে তারা
খাইয়েছে। কিন্তু দুঃখের কথা, পরে চপলদের হোস্টেলে (ইউনিভার্সিটি পিজি হোস্টেল) পুলিস
রেডের সময় খাতাটা যে গেল, আর পেলাম না। ওর কাছে রাখাই ভুল হয়েছিল।
পরের দিন ভোরবেলায়
রাজগীর হয়ে গয়া, বোধগয়া, ডোভি হয়ে বরহি। হিন্দিতে লেখার সময় লিখেছিলাম যে আমরা রাতে
গয়ায় ছিলাম, কিন্তু সেটা হিসেবে মেলে না। রাজগীর থেকে গয়া খুব কাছে। যাই হোক, রাজগীরের
প্রধান রাস্তাটা ধরে পেছন দিক দিয়ে বেরিয়ে কিছু দূর গিয়েই অবাক! তখন তো জানতাম না,
ঝিলটার নাম ঘোড়াকটোরা। ছোটোবেলা থেকে রাজগীর গেছি দশবার, গয়া গেছি পাঁচবার, কিন্তু
রাজগীর থেকে গয়া কখনো যাই নি। আর তখন এই ঝিলটা সাধারণতঃ রাজগীরের দ্রষ্টব্য স্থানগুলোর
মধ্যে পড়ত না তাই যখন রাজগীর থেকে এগিয়ে ভোরের আলোয় পাহাড়ে ঘেরা বিরাট ঝিলটা চোখে পড়ল
অবাক হয়ে গেলাম। একবার যে ছবিটা মাথায় ঢুকলো, পরে অনেক, বিশেষ করে রুশী উপন্যাসের দৃশ্য
বুঝতে সহায়ক হয়ে থাকল। ওই যে, চেঙ্গিজ আইতমাতভের ‘জামিলা’ বা আরো সেরকমই সব সিকোয়েন্স। তাও তো তখন পরিযায়ী পাখিদের চলন বুঝতামও
না, চিনতামও না।
বরহি পৌঁছে যখন থানায়
লেখাতে গেলাম, তাদেরই কথায় সরকারি বাংলোয় গিয়ে কেয়ারটেকারকে বলে জায়গা পেয়ে গেলাম।
একটাই ঘর পাঁচজনের জন্য। ডাকবাংলো না ফরেস্ট বাংলো মনে নেই। কিন্তু রাত হতেই দুশ্চিন্তার
বিষয় জুড়ে বসল একটা। ঘরে ঢুকে গল্প করছি, রাতের খাবার খেতে বেরোবো, এমন সময় কেয়ারটেকার
এসে খবর দিল ওদিকের বড় একটা ঘরে সি.আর.পি.র এক দুঁদে অফিসার দিল্লী থেকে এসে পৌঁছেছেন,
আমাদের দেখা করতে বলেছেন। হয়ে গেল। খিদে-ফিদে মাথায় উঠল। যদিও কেউই কোনো রাজনীতি করি
না, কিন্তু কী হতে কী হয়ে যাবে বলা যায়? গেলাম। গিয়ে দেখি এক বাঙালি অফিসার, কলকাতা
যাচ্ছেন, আমরা নাকি সাইকেল ট্যুরে বেরিয়েছি শুনে দেখা করতে চেয়েছেন। ভয় অনেকটা কাটল।
একেবারে রাজকীয় সমাদরে সুন্দর পেয়ালাপিরিচে চা এল সবার জন্য। তাঁর অফার করা ৫৫৫এর প্যাকেট
থেকে আমি আর বোধহয় অসিতও এক একটা সিগরেট ফুঁকলাম। পাঁচজনের রাতের খাবারটাও তাঁর তরফ
থেকে ঘরে এসে গেল, অর্থাৎ ফ্রি।
পরের দিন বিকেলে
পৌঁছোলাম ধানবাদ। আশীষের পিসীর বাড়ি ছিল বোধহয়। পৌঁছোতেই খবর পেলাম যে আশীষকে শিগগির
পাটনায় ফেরত যেতে হবে। কেননা তার বাবার জায়গায় তার চাকরি মঞ্জুর হয়ে গেছে। ঠিক হয়ে
গেল যে আশীষ কলকাতায় পৌঁছেই ফিরে যাবে। অসিত বলল, সেও ফিরে যাবে, “পোষাচ্ছে না রে, রোজ রোজ সত্তর-আশি মাইল সাইকেল
চালানো!”
কেমন একটা দৃশ্য
মনে আছে। বিকেলের আলোয় ধানবাদে একটি বাড়ির দরজার সামনে বাড়ির মানুষেরা আর আমরা পাঁচজন।
অর্থাৎ, ধানবাদে সে বাড়িতে আমরা রাত্রিবাস করি নি। তার মানে আবার গোবিন্দপুর হয়ে ডান
দিকে নিরসা, বরাকর পেরিয়ে নিশ্চিত আসানসোল অব্দি গিয়েছিলাম। ফ্রিতে থাকার জন্য ধর্মশালা
ইত্যাদি আর কোথায় পেতাম। দ্বিতীয়তঃ আশীষের চাকরির খবর নিশ্চয়ই এনার্জাইজারের কাজ করেছিল।
পরের ভোরে আসানসোল থেকে বেরিয়ে বেশ দেরিতেই ঢুকেছিলাম বর্দ্ধমান জেলার ইসলামপুরে। থানায়
রিপোর্ট করার সময় কোনো ধর্মশালা আছে কিনা নিশ্চয়ই জিজ্ঞেস করে থাকব। তাঁরা বা পথচারী
কেউ কাছেপিঠে কোথাও একটি অনাথাশ্রম থাকার কথা বলে ছিলেন হয়তো। সেটা খুঁজে বার করলাম।
গৃহকর্ত্রী এক বয়স্ক মহিলা। তিনি অনুমতি দিলেন থাকতে। কিন্তু খাবার তো শেষ। অনাথাশ্রমের
ছেলেরাও ব্যাপারটা নিয়ে আপশোষ করল। আমরা সাইকেল রেখে, হাতমুখ ধুয়ে বাইরে বেরুলাম খাবারের
খোঁজ করতে। রাত প্রায় বারোটা। সব দোকান বন্ধ। হঠাৎ দেখলাম একটা তেলেভাজার ঝুপড়ি। কিন্তু
পরিষ্কার, আলোয় ভরা আর প্রচুর ভিড়। সামনে দুএকটা ট্রাক, ভ্যান দাঁড়িয়ে। দুটো উনুনে
লাগাতার সিঙাড়া ভাজা হচ্ছে আর নামানোর ওর ঝুড়ি সুদ্ধু উঠে যাচ্ছে ট্রাকে আর ভ্যানে।
আমরা অনুরোধ করলাম আমাদেরও দুটো করে দিতে। অভুক্ত, আর পাটনা থেকে সাইকেল ট্যুরে বেরিয়েছি।
কাজ হল। চাঙারিতে দুটো করে পেয়ে গেলাম খেতে। মানে, কিনেই। বসে বসে জানলাম যে পরের দিন
কলকাতায় সমাবেশ, তাতেই লোক যাচ্ছে। তাদের জলখাবারের জন্য সিঙাড়া চাপছে ট্রাকে।
ইসলামপুর থেকে সোজা
কলকাতা। কিন্তু পৌঁছোতে পৌঁছোতে রাত ন’টা। দিনের সমাবেশ কেমন হয়েছিল জানি না, কিন্তু বিকেল থেকে নাকি বৃষ্টি।
রাত নটায় হাওড়া ব্রিজে উঠে নামতে গিয়েই চোখে পড়ল সামনে জল। কিন্তু ততক্ষণে সাইকেল এত
বেশি মোমেন্টামে যে ব্রেক নিতে গেলেই রাবারদুটো ছিটকে বেরিয়ে যাবে। একেবারে মোড়ের ওপর
যখন থামল তখন সাইকেলও ভাসছে, আমরাও ভাসছি। গলাজলে কোনো রকমে পায়ের নিচে রাস্তার পাথরের
স্ল্যাবগুলোর হদিশ নিতে নিতে ডানদিকে এগোলাম। যাবো খিদিরপুর, চপলের দাদার বাড়ি। আশীষ
আর অসিত মনে নেই কোথায় আলাদা হয়েছিল – হাওড়ায়, স্ট্র্যান্ড রোডে না খিদিরপুরে পৌঁছে। পাটনায় ফিরে জেনেছিলাম
ওরা সুরক্ষিত, সময় মত পৌঁছে গিয়েছিল। আশীষ চাকরিতে জয়েনও করে নিয়েছিল।
২
চপলের দাদা পোর্ট
ট্রাস্টেই কাজ করতেন। যেখানে তাঁর বাসা, তার পিছনেই মহমেডান স্পোর্টিংএর ক্লাবঘর। দাদার
বাড়িতে পাঁচ দিন রয়ে গেলাম। আর সেখানেই সিদ্ধান্ত সার্বজনীন করে আমার, চপলের আর বিষ্টুর
সাইকেলের সামনে প্লেট ফিট করালাম – ‘সাইকেল ট্যুর, পাটনা
টু কন্যাকুমারী, ভায়া ক্যালকাটা, ভুবনেশ্বর, বিশাখাপত্তনম, ম্যাড্রাস …’
এক দিন রাইটার্সে
গিয়ে তখনকার যুক্তফ্রন্ট সরকারের ক্রীড়ামন্ত্রী শ্রী রাম চ্যাটার্জির সঙ্গে দেখা করলাম।
সবাই বলেছিল, সেটা নাকি করতে হয়। ছবিও তোলাতে হয়। সে ছবি খবরের কাগজে ছাপে। দেখা করতে
গিয়ে প্রথমে তো আমিই এক গাদা বকুনি খেলাম। চপল আর বিষ্টু বেঁচে গেল। দোষটা আমারই। হাফপ্যান্ট
আর গেঞ্জি একদম মাটি-মাটি হয়ে গেছে বলে ভাবলাম মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে যাব, সঙ্গে
রাখা একটা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে যাই। সেভাবেই তৈরি হয়ে রাইটার্সে পৌঁছে নিচে কোথাও
একটা হেল্পডেস্কে বললাম যে আমরা পাটনা থেকে আসছি।
তিনি খবর পেয়ে নিজেই
বাইরে বেরিয়ে এলেন। কেননা বাইরেই তো ছবি হতে পারবে সাইকেলের সঙ্গে। আমায় দেখেই রেগে
উঠলেন – “পায়জামা পাঞ্জাবি? একটু বুদ্ধিসুদ্ধি নেই,
স্পোর্টস মিনিস্টারের সঙ্গে দেখা করবে স্পোর্টসম্যান হিসেবে, সাইকেল ট্যুরে বেরিয়েছ!
… গেঞ্জি, প্যান্ট
নোংরা হয়ে গেছে বলে পায়জামা পাঞ্জাবি পরে ছবি তোলাবে? … কই, তোমাদের ফটোগ্রাফার কই?” … যাঃ, এটাও তো ব্লান্ডার। কাউকে নিয়েই যাই নি। যা হোক, উনি হাত মিলিয়ে
টিলিয়ে ওপরে চলে গেলেন। আমরাও বোকার মত ফিরে এলাম।
আরেকদিন গেলাম জ্যেঠিমার
বাড়ি। সেখানেও বকুনি খেলাম মাকে একটাও চিঠি লিখিনি বলে। সোজা বাড়ি ফিরতে বললেন। হাতে
ফেরার ভাড়া হিসেবে পঁচিশটা টাকা দিলেন। আমি পেট ভরে জ্যেঠিমার হাতের রান্না খেতে খেতে
ভাবলাম, যাক, ভুবনেশ্বর, ওয়ালটেয়ার তো এতেই হয়ে যাবে।
সামনে বোধহয় শীল্ডের
খেলা ছিল। রাত ভর মহমেডানের ক্লাবঘরে বিজয় মিছিলের মহড়া চলত। কান ফাটানো আওয়াজে বিরাট
বিরাট ড্রামগুলো বাজত সারা রাত। পঞ্চম দিন ভোরবেলায় বেরোলাম। কেননা মাঝে খবর পেয়েছি
সেদিন বন্ধ। শহর ছেড়ে দিতে হবে আলো ফোটার আগেই। সেই প্রায়ান্ধকারেও দেখলাম বাচ্চাদেরকে
রাস্তায় পেরেক পোঁতার জন্য লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। গাড়ি গেলেই যেন চাকা বার্স্ট করে। আমরা
পাশ দিয়ে বেরিয়ে বেরিয়ে কলকাতা ছাড়লাম। হতে পারে সে তারিখটা ১৮ অথবা ২০ মার্চ। অজয়
মুখার্জির নেতৃত্বে যুক্ত ফ্রন্ট সরকার পড়েছিল ১৯শে মার্চ, বন্ধটা সেই সরকার ফেলার
চক্রান্তের বিরুদ্ধে আগেও হতে পারে, পরেও হতে পারে। ইতিহাসবিদেরা বলতে পারতেন।
তখন এনএইচ ফাইভ,
এনএইচ সিক্স নামগুলো অত মুখে মুখে ঘুরত না। (তখনকার এনএইচ ফাইভ এখন এনএইচ সিক্সটিন
হয়ে গেছে)। একটা ম্যাড্রাস রোড, একটা বম্বে রোড। আমরা ম্যাড্রাস রোড ধরলাম। দুপুরে
ভাত খেলাম দাঁতনের একটা পাইস হোটেলে। পিছনেই পুকুর। স্নান করতে পারতাম কিন্তু করলাম
না। জামাকাপড় ছাড়ো, পরো, দিনের বেলা, ওদিকে বসত …। মাথায় মুখে জল দিয়ে এসে মাছ ভাত খেলাম। আমরা হাইওয়ে ছেড়ে কোনো
অন্য রাস্তা ধরেছিলাম কিনা মনে নেই। তবে মনে আছে যে বিকেলে কাঁথি বা কন্টাই পৌঁছেছিলাম।
সেখানকার থানার পাশ দিয়ে যেতে যেতে ঢুকবো ভাবিও নি, কেননা হাতে যথেষ্ট সময়, অন্ততঃ
পঁচিশ-তিরিশ মাইল আরো সাইকেল চালিয়ে কোথাও পৌঁছোবো তবে বিশ্রাম নেব, কিন্তু থানার ইনচার্জ
নিজে লোক পাঠিয়ে ডেকে নিলেন। জানলা দিয়ে সাইকেলের সামনের প্লেট আর আমাদের সাদা গেঞ্জি,
হাফপ্যান্ট বোধহয় দেখতে পেয়েছিলেন। কী এলাহি আপ্যায়ন! আগেও এবং পরে আরো বহু জায়গায়
পুলিশ থানায় খেয়েছি, সিপাহিজিরা নিজেদের টিফিন থেকেও খাইয়েছেন, কিন্তু ওভাবে, প্লেট
ভরে মিষ্টি সাজিয়ে কোথাও কেউ খাওয়ায় নি। আর কেন? না আমরা সাইকেল ট্যুরে বেরিয়েছি!
সে রাতে যেখানে ছিলাম,
যদ্দুর মনে পড়ছে, রাত হয়ে গেছে, সামনে কোনো শহরের নাম দেখছি না মাইল-ফলকগুলোতে, আর
অন্ধকারে হঠাৎ ডানদিকে একটা দোতলা বাড়ি দেখলাম, বোর্ডে হাই স্কুল আর সঙ্গে হস্টেল লেখা।
ঢুকে পড়লাম। ক্যাম্পাসে কোনো দেয়াল নেই, গেটও নেই। ওয়ার্ডেন বা যেই ছিলেন তাঁর অনুমতি
নিয়ে ছেলেরা অত রাতেও আমাদের জন্য আলাদা করে ভাত চাপালো, একটা ঘরে বিছানা করে মশারি
টাঙিয়ে দিল, আমরা সামনে অন্ধকার পুকুরে স্নান করে, খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। হয়ত ডেবরা
বা বেলদা বা অন্য কোনো জায়গায় ছিল স্কুলটা। পরের দিন ভোর বেলায় যখন বেরুলাম, সব ছেলেরা
রাস্তায় এসে বিদায় জানালো, উৎসাহ দিল এবং অনেকে বলল যে তারাও বেরোবে মাধ্যমিকের পর।
সাহায্য, আতিথেয়তা
সব জায়গায় পেয়েছি কিন্তু এ জিনিষটা, এই খেলাসুলভ মনোভাব, স্পোর্টিভ স্পিরিট পশ্চিমবঙ্গ
ছাড়া কোথাও পাইনি। বাকি সব জায়গায় এমনকি কিশোর, যুবকেরাও রীতিমত চিন্তা করতে শুরু করেছে
আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে, কোথায় শোবো, কোথায় খাবো, কোনো দুর্ঘটনা না হয় … এসব নিয়ে। তারপর সাহায্য করেছে। কিন্তু এই
যে, “এগোন! আমরাও আসছি!” এই উল্লাসধ্বনিটা শুধু বাংলাতেই পেয়েছিলাম;
এই স্কুলে বা তার আগে ইসলামপুরে, এমনকি চলতি রাস্তাতেও, যেখানেই সকালে বা বিকেলে বাচ্চাদের
স্কুলে যাওয়া বা খেলতে যাওয়া দলের পাশ দিয়ে গেছি।
৩
পরের দিন জলখাবারটা,
মানে পুড়ি-সব্জি, উড়িষ্যার কোনো গ্রাম-সংলগ্ন গঞ্জের খড়-ছাওয়া খাবার দোকানে সেরেছিলাম।
জানলা দিয়ে দেখছিলাম ক্ষেতের আলপথে গ্রামীণেরা কোঁচড়ে মুড়ি বেঁধে আসছে, দোকানে ঢুকে
এক প্লেট তরকারি কিনে মুড়ি-তরকারি খাচ্ছে। সে সময় না খেলেও পরে এই কম্বিনেশনটা আমার
ফেভারিট হয়ে উঠেছিল, এখনও আছে। দুপুরের খাবার বোধহয় খেয়েছিলাম জলেশ্বরে। রাতে ছিলাম
বালেশ্বর বা বালাসোরের পুলিস থানায়। খাবারও দিয়েছিল পুলিস।
উড়িষ্যায় ঢুকেই পেতে
শুরু করলাম একের পর এক নদী। আর সে নদী আমাদের পাটনার গঙ্গার মত নয়। স্বচ্ছ জল, নিচে
কাদা নয় বালি, আর অনেকটা দূর অব্দি গভীরতা আস্তে আস্তে বেড়েছে। চপল না হয় কলেজে সাঁতারে
চ্যাম্পিয়ন, আমি তো ডুবতে চ্যাম্পিয়ন! একটুও সাঁতার জানি না। সুবর্ণরেখা জানতাম জামশেদপুরে।
এখানে রাস্তায় পেয়ে অবাক হলাম। সঙ্গে সঙ্গে ব্রিজ পেরিয়ে রাস্তা থেকে নেমে জলের ধারে।
জামাকাপড় ভিজলে মুস্কিল, তাই গামছা পরে জলে নামলাম। চপল সাঁতরাচ্ছিল, আমি শরীরের সব
নিঃশাস বার করে, চিৎ হয়ে আস্তে আস্তে তলায় শুয়ে পড়লাম। বেশি নয়, আড়াই-তিন ফুট। চোখ
খুলে জলের ভিতর থেকে আকাশ দেখলাম যতক্ষণ পারি। এ কাজটা গঙ্গায় বা কোনো পুকুরে কখনো
পারি নি। চেষ্টাও করি নি। বেরিয়ে এসে দেখলাম সব ক্লান্তি ধুয়ে গেছে। নিয়ম করে নিলাম,
নদী বা বড় নালা বা বাঁধের জল এলেই স্নান করব। সে যদি সারাদিনে পাঁচ বার হয় তো পাঁচ
বার। এই নিয়ম পালন করেছিলাম শেষ অব্দি। তবে বড় নদীগুলো – মহানদী, গোদাবরী – সন্ধ্যেয় অথবা ভোরে পেরিয়েছি। আর ঈষৎ ভয়-ধরানো
ছিল তাদের বিশালতা। অচেনা যে! গঙ্গা তো নয়। কাবেরী নদীতে প্রথম স্নান তো রাত্রে করলাম।
একটা পাথুরে বাঁধ পেয়েছিলাম সন্ধ্যের দিকে, কোথায় মনে নেই। মনের আনন্দে স্নান করেছিলাম।
বালাসোর থেকে বেরিয়ে
কোথাও জলখাবার খেলাম। ভদ্রকে? নাকি আগেই? মনে নেই। কিন্তু একটা বাজে ব্যাপার ঘটল। তিনজনে
জলখাবার খাওয়ার পর হঠাৎ বিষ্টু বেরিয়ে গেল। কোথায় গেল দেখতে চপল উঠল। দেখল পাশের মিষ্টির
দোকানে একা একা মিষ্টি খাচ্ছে। চেপে ধরলাম। বলল, নিজের পয়সায়। “নিজের পয়সা আবার কী রে?” সবার নিজের নিজের পয়সা নিয়েই তো এখানে কালেক্টিভ
ফান্ড। মিষ্টি খেতে ইচ্ছে হলে বলতিস, তিনজনেই খেতাম! তুই আলাদা করে, লুকিয়ে, চুরি করে
খেলি কেন?” খরচে সমতা আনতে
আমরা দুজনেও মিষ্টি খেলাম। কিন্তু রাগটা গেল না। এমনিতেই পয়সার অভাব। বাড়িতে পোস্টকার্ড
লিখতে গেলেও কার্ডের দাম নিয়ে ভাবতে হয়। মিষ্টি খেতে গিয়ে মিছিমিছি পয়সা বেরিয়ে গেল।
যাহোক, তারপর ভদ্রকে বা পেরিয়ে কোথাও দুপুরের খাবার খেয়ে রাত আটটায় সোজা ভুবনেশ্বর।
ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে। মেজদি আর জামাইবাবু অনন্তদা আছেন জানতাম। গরম গরম পরোটা তরকারি
খেলাম পেট ভরে। তাঁরা বকাবকি করলেন না একটুও। রাত ন’টায় তিনটে ছেলেকে রান্না করে খাওয়ালেন। এমনকি যখন বললাম এই রাতেই
পুরী বেরিয়ে যাবো যাতে সূর্যোদয়টা ধরতে পারি, তখনো বকাবকি করলেন না। খুব ভালো লাগল
এই মনোভাবটা। বোধহয় তাঁদের ছেলেও সেসময় সেখানে ছিল।
কিন্তু পুরী পৌঁছোনো
হল না সময় মত। মাঝরাতে অন্ধকার পিপলি পার হয়েই ভরা পেটে এত ঘুম পেতে লাগল! একটা নালা
পার হচ্ছিলাম। দেখলাম বড় কালভার্ট। দিব্যি ঘুমিয়ে পড়া যায়। গড়িয়ে পড়লেও খুব নিচে নয়
নালাটা। গভীরও নয়। আর পিছনেই পিপলি। এখন ঘুমন্ত হলেও রাত শেষ হতে হতে তো জাগবেই। এসব
ভেবেচিন্তে সাইকেলে তালা লাগিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম – দুজন একদিকে, একজন অপরদিকে।
ভোরবেলায় ঘুম ভাঙলো
বৃষ্টির ফোঁটায়। খুব হালকা, ঝিরঝিরে। ভিজতে ভিজতে শুয়ে থাকা থেকে সাইকেল চালানো ভালো,
হয়তো অদূরে কোনো চায়ের ঠেকও খুলে যাবে ততক্ষণে্ ভেবে এগোলাম। আর এক ঘন্টার মধ্যে একটা
দুর্ঘটনা ঘটল। বৃষ্টি পড়ছে, চোখে পড়লে চোখ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, রাস্তা পিছল, আর মাডগার্ড-খোলা
সাইকেলে সবচে’ বড় বিপদ শুকনো ধুলোর
রাস্তায় আর কাদাটে রাস্তায় – পিছনের চাকার ছিটে শিরদাঁড়া দেগে দেয় আর সামনের চাকার ছিটে পেট।
তারই মধ্যে দু’একটা যদি বেশি ওপরে
ওঠে, লোকে রিফ্লেক্সে চোখ বন্ধ করবে। এরই মধ্যে মাথায় কলসি নিয়ে এক বৃদ্ধা রাস্তা পেরোতে
গিয়ে সামনে চলে এলেন। তিনিও পড়লেন ধাক্কায় আর আমি সাইকেল থেকে ছিটকে অন্যদিকে পড়লাম।
মুখ মাথা কনুই ঘষটে গেল। তখনও উঠতেও পারি নি, বৃদ্ধা দেখলাম উঠে চ্যাঁচামেচি শুরু করেছেন,
তাঁর কলসি ভেঙে গেছে, দাম দিতে হবে। গ্রামের লোকও জুটে গেল। আমরাও তিনজন তুমুল তর্ক
করলাম। হয়তো, তারাও বুঝল যে বৃদ্ধার শুধু কলসি ভেঙেছে আর এদিকে আমার চোখের পাশ, গাল,
কনুই ছেঁচড়ে গেছে, রক্ত পড়ছে। পয়সা দিতে হল না। আমরা এগিয়ে গেলাম। ছেঁচড়ানো জায়গায়
কিছু লাগিয়েছিলাম কিনা মনে নেই।
সাক্ষীগোপালের একটু
আগে থাকেই মন্দিরের দালাল পিছু ধরল। চলুন দর্শন করিয়ে দেব, পূণ্য হবে, পাব্লিক পাঁচ
টাকা, ভিআইপি দশ টাকা। যাওয়ার তো ছিলই না। অনেকক্ষণ পাপপূণ্য, পাব্লিক-ভিআইপি, আসল
ভগবান, নকল ভগবান নিয়ে তর্ক করে ওর মাথা খেলাম। শেষে ও সাক্ষীগোপালের দিকে বাঁক নিল,
আমরা এগিয়ে গেলাম।
পুরীর অনেকটা আগে
থেকে কামানের চাপা আওয়াজের মত গুম গুম ভেসে আসতে শুরু করল। মন বলল এ পুরীর ঢেউ ভাঙার
শব্দ। মা বলেছিল ছোট বেলায়।
পুরীর ঢেউয়ের ধাক্কায়
আছাড়ও খেলাম, আর পায়ে ফিরতি জলের টান গামছাটাও খুলে নিয়ে যাচ্ছিল। দোষটা আমারই। জাঙিয়া
ভিজে গেলে সাইকেল চালাতে অসুবিধে হবে বলে খুলে সরিয়ে রেখেছিলাম। জীবনে প্রথম সমুদ্র
দেখে তার হাতে খেলার বস্তু হলাম শিশুর মত। জগন্নাথ মন্দিরে একবার ঢুঁ না মারলে লোককে
বলতেও কেমন লাগবে তাই ঘুরে এলাম। মন্দিরের শিল্প বোঝার মত বুদ্ধিও ছিল না আর অসময়ে
মন্দিরের পাটও বন্ধ ছিল।
ভুবনেশ্বরে ফিরে
এসে মেজদির ওখানে রাত কাটিয়ে সকালে বেরিয়ে পড়লাম ঠিকই কিন্তু মাথায় অন্য একটা বুদ্ধি
ছিল। মা বলত ভুবনেশ্বরে নাকি আমার বড় মামা থাকে, এজি অফিসে বড় পোস্টে কাজ করে, বোধহয়
এজি (এএজি বা পিএজিও হতে পারে)। একে ওকে জিজ্ঞেস করে এজি অফিস পৌঁছোলাম। জ্ঞান হওয়ার
পর কখনো দেখি নি। নামও ভালো করে জানি না। পদবীটা জানি। অফিসে ঢুকে সেটুকুই বললাম। বললাম
আমি ভাগ্নে, পাটনা থেকে আসছি। মোক্ষম! পাঁচ মিনিটে বড় মামার সামনে হাজির। চেম্বারের
বাইরে নামটা তো ছিলই, চেহারাও ছোট মামার সঙ্গে মিলছিল।
মামার সঙ্গে দেখা
করার উদ্দেশ্য ছিল পরে বলে মাকে খুশি করা। মামা যে এত খুশি হবেন বুঝিও নি। একজনকে ডেকে
সোজা বাড়িতে পাঠালেন তিনজনকে, মামীমার কাছে। দুই মামাতো বোনের সঙ্গেও পরে দেখা হল।
ছোটজন তো আমায় দেখেই নি, বড় জন, মানে বয়সে দিদি খুব ছোটো বয়সে একবার দেখেছিল। দাদা
কলকাতায় ছিল তাই দেখা হল না। তিনদিন আরামে কাটালাম মামার বাড়ি।
এখানেই বিষ্টুর অপকর্ম
ধরা পড়ল। সন্দেহ তো ছিলই। চপল একদিন ওর ব্যাগ হাঁটকে বার করল দুটো ৩৬ এমএম ক্যামেরা
ফিল্মের রোল। বোধহয় অর্ওয়ো। তখন তো এসবের দামও জানতাম না, তবে রোলদুটো খিদিরপুরে চপলের
দাদার ড্রয়ারে আমিও দেখেছিলাম। এ সোজাসুজি চুরি। তার মানে হয়তো পয়সাও চুরি করেছে। মামার
বাড়ি বলে ঝঞ্ঝাট করলাম না। স্পষ্ট শাসিয়ে দিলাম, এখান থেকে বেরিয়ে আমি আর চপল হাইওয়ে
ধরব আর ও রেলস্টেশনে যাবে। পাটনা ফিরবে। না ফিরতে চায়, যেখানে ইচ্ছে যাক, আমাদের সঙ্গে
থাকবে না।
মামার বাড়ি মানে
বিরাট সরকারি বাংলো। সামনে গাছে ভরা রাস্তা। সে রাস্তায় একদিন ভোরবেলা বেরিয়ে দেখলাম
এক সাধু ছুরি দিয়ে একটা গাছের গুঁড়ি খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে কী করছে। ফিরে আসার সময় দেখলাম
খোঁচানো জায়গাটায় সিঁদুর লেপে পাশে ছোট লাল ঝান্ডি গেড়ে ধ্যান করতে শুরু করেছে। ওমা!
দুপুর হতে হতে পুরো ভিড়! গাছে নাকি শিউজি প্রকট হয়েছেন। সামনে বেছানো চাদরে দেখলাম
পয়সার ছড়াছড়ি।
পয়সা প্রায় ফুরিয়েই
গিয়েছিল আমাদের। আরো এগোবার ইচ্ছে আছে বলে চাঁদা চাওয়া যেতে পারে কিন্তু মামার কাছে
পয়সা চাওয়া যায় না। আর মামা-মামীমাও কলকাতার জ্যেঠিমার মত মিষ্টি ধমক দিয়েই নিশ্চিন্ত
ছিলেন যে এবার ঘরের ছেলেরা ঘরে ফিরে যাবে। আমরা কখনো বলি নি যে আমাদের কাছে টাকা নেই।
জ্যেঠিমা তো কলকাতায় শুধু আমায় দেখে পঁচিশ টাকা দিয়েছিলেন। কলকাতা থেকে পাটনার ভাড়া
তখন চোদ্দ টাকার বেশি নয়। মামার বাড়িতে তো আমরা তিনজন। ভুবনেশ্বর থেকে ভাড়াও বেশি।
তাই আমাদের পকেটে টাকা নেই জানলে ভাড়া আর রাহাখরচ বাবদ একশো টাকার কম দিতেন না। কিন্তু
যেহেতু বুক ফুলিয়ে বলেছিলাম, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, যথেষ্ট আছে”, তাই বেরোবার সময় আমার হাতে পঁচিশ বা তিরিশ টাকা দিলেন। তাঁদেরকে
দেখানোর জন্য স্টেশনের রাস্তা ধরলাম। মেজদিরা জানতও না যে আমরা ভুবনেশ্বরেই থেকে গেছি
আরো তিন দিন, তাই জানালামও না। বিষ্টুকে স্টেশনের দিকে এগিয়ে আমি আর চপল আবার হাইওয়ে
ধরলাম।
৪
দু’চার ঘন্টা বাদেই চিলকার দেখা পেলাম। ভাবলাম
চিলকার জলেই হাতমুখ ধুয়ে জলখাবার সারবো। দেখতে যতই বিশাল হোক, দূরে মাঝবরাবর একটা দ্বীপ
আর তার পাহাড় নিয়ে যতই বিস্মিত করুক, সুবর্ণরেখা নদী তো আর নয়। পাড়ে নামতেই কাদা। জল
ঘোলাটে। মুখ ধুতেই ইচ্ছে করল না। চিলকার জল বলে একটু ওপর ওপর ছুঁইয়ে হোটেলের বেসিনের
জলে মুখ ধুলাম। দুটো ইডলি খেলাম, আর তখনই মনে হল এই একই দামে একটা পোস্ট কার্ড পাওয়া
যায়। অনেকদিন মাকে চিঠি লেখা হয় নি। এর পর রাস্তায় পোস্ট অফিস পেলেই লিখে ফেলব।
সারা দিন বাঁপাশে
চিলকা দেখতে দেখতে সন্ধ্যে নাগাদ পৌঁছোলাম রম্ভা। রাস্তার ওপর শুধু একটা বাড়িতেই আলো
জ্বলছিল। গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকে আশেপাশে থাকার জায়গা পাওয়া যাবে কিনা জানতে চাইলাম। তারা,
কী উদ্দেশ্যে বেরিয়েছি আর কোত্থেকে আসছি শুনে সাদরে আমন্ত্রণ জানালো যেন তাদের আতিথ্য
গ্রহণ করি। চোখে পড়েছিল যে বাড়িটা শহুরে নয়, পাকা দালানের চার দিকে বাগান, ফসলের গোলা,
গুদাম আর গবাদি পশুর খাটাল। মালিক জানলাম রাজস্থানি। অনেক গল্প করলেন। মনে হল অনেক
দিন পর চুটিয়ে হিন্দিতে কথা বলতে পেরে খুব খুশি হলেন। রাতে রুটি, তরকারির পর বড় এক
গেলাস দুধ খেতে হল। বারান্দাতেই শোয়ার জায়গা হল। সামনে নীলচে কালো আকাশের তারার আলোয়
মাঝ-চিলকার পাহাড়টা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। তারই মধ্যে মাঝে মাঝে তারা খসে পড়ার স্তিমিত
ঝিলিক। দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরের দিন ভোরে বেরিয়ে সকাল আটটা-সাড়ে আটটা
নাগাদ পৌঁছোলাম বেরহামপুর বা ব্রহ্মপুর। সামনেই দেখলাম ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস। একটা
বুদ্ধি দিল চপল, “চল ভিসির সঙ্গে দেখা
করি গিয়ে। পাটনায় ফিরে বললে আমাদের প্রিন্সিপ্যালসাহেব খুশি হবেন, মানে গুড স্টুডেন্ট
টাইপ ব্যাপার হবে।”
- চল, কিন্তু খবরদার, ইংরেজি বলবি না।
চপলের ওই এক দোষ। দরকার নেই তবু ইংরেজি বলবেই
আর নির্ঘাত ভুল বলবে।
তাই হল। ভাইস চ্যান্সেলর
স্যার হিন্দিতে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার বাবা?” চপল ইংরেজিতে জবাব দিল, “মাই ফাদার ওয়াজ ডেড, স্যার!” ঠোঁটে একটু হাসি এনে স্যার প্রশ্নের সুরে পুনরুক্তি করলেন “ওয়াজ ডেড?” আর কিছু বললেন না। কলেজ লাইব্রেরির জন্য বই দিলেন দুটো।
ওড়িশা সীমান্ত পেরিয়ে
অন্ধ্রে ঢুকেছি। গরম দুপুর। রাস্তায় কোথাও কোথাও গাছের ছায়া আছে কিন্তু না থাকলেই ঠা
ঠা রোদ্দুর। ঠিক কোন জায়গা মনে নেই। তবে অন্ধ্রে ঢুকেই, এটুকু মনে আছে, কেননা ভাষা
বদলে যাওয়ায় সমস্যায় পড়েছিলাম। তাই আমাদের দেখে মোপেড থামিয়ে দাঁড়ানো প্যান্ট-শার্ট
পরা মানুষটি যখন ইংরেজি-হিন্দি মিলিয়ে কথা বলা শুরু করলেন, ধড়ে প্রাণ এল। জানলাম যে
তিনি শিক্ষক এবং (যা বুঝলাম) বামপন্থী রাজনীতির কর্মী, নিজের কাজে যাচ্ছেন এবং সরি,
ধারে কাছে কোথাও খাবার বা এমনকি জল পাওয়ারও আশা নেই। বাঁদিকে খানিকটা নেমে একটা গ্রাম
আছে বটে, কিন্তু কী পাবেন বলা মুশকিল। অনেকখানি যেতে হবে আরো।
সেই একটি দুপুরে
বেশ কিছুটা দেশ দেখেছিলাম। একটা অন্য লেখায় গ্রামের ঘটনাদুটোর বর্ণনা করেছি। ছোট্ট
গ্রামের রাস্তাটায় বাড়িগুলোর যা অবস্থা, দরজায় কড়া নাড়তে সাহস হল না। ভাষার বাধাও তার
একটা কারণ। ভেবেই নিয়েছিলাম যে গ্রামের গরীব নিরক্ষর মানুষ, কাজেই তেলেগু ছাড়া আর কিছু
বলতে পারবে না, আর আমরাও কিছু বোঝাতে পারবো না। কিন্তু শেষ প্রান্তে মাটি, বাঁশ আর
খড়েরই যে পরিচ্ছন্ন বাড়িটার ওপর ভরসা করলাম, যে সম্পন্ন গৃহস্থ, পাশে বিরাট পেয়ারা
বাগান, নিশ্চয়ই একটু হিন্দি-ইংরেজি বুঝবে, একটু জল, দুটো পেয়ারা অন্ততঃ নিশ্চয়ই খেতে
দেবে, সে বেরুলো একা থাকা এক কুজন্মা-পুঙ্গব। শালার পুরো পরিবার শহরে, এখানে একা থেকে
বাগানের দেখাশুনো আর লেখাপড়া করছে, কিন্তু এটুকু হৃদয় নেই যে দুগ্লাস জল খাওয়ায়, পেয়ারা
তো দূরের কথা। দরজা বন্ধ হওয়ার পর দশটা গালাগাল দিয়ে গ্রামের বাইরে উঠে এলাম। সাদাটে
জমি অনেকখানি ছড়িয়ে উঠে গেছে, রোদ ঠিকরে উঠছে মাটি থেকে, একটাও গাছ নেই। বুনো ঝোপ বা
ঘাসও নেই। উঠে গিয়ে বাঁদিকে একটা আটচালা। আগে একবার গিয়ে চা, জলের কথা বলতে চেয়েছিলাম,
কিন্তু লোকটা অঘোরে ঘুমোচ্ছিল, উনুনের আঁচ নামানো। দোকান ছেড়ে সোজা আরেকটু উঠলেই হাইওয়ে,
সেখানে গাছের ছায়া। প্রায় সেখানেই নারীদের দলটির সঙ্গে দেখা হল। পিছনের গ্রামটারই বাসিন্দা
সব। জল আনতে গিয়েছিল। আশ্চর্য, যাদের নিরক্ষর ভেবে দরজায় কড়া নাড়িনি (অবশ্য সে সময়
তারা ছিলও না, জল আনতে গিয়েছিল) তারাই ঘিরে ধরল আমাদের। নিরক্ষর হওয়া সত্ত্বেও মায়ের
মন দিয়ে আমাদের খিদে, তেষ্টা বুঝলো। দূর থেকে সংগ্রহ করে আনা জল তো খাওয়ালোই, চায়ের
দোকানটায় নিয়ে গিয়ে জোর করে দোকানদারকে ওঠালো, তাকে দিয়ে উনুনের আঁচ বাড়িয়ে চা করালো,
সেই চা আমরা খেলাম আর নিজেদের কোঁচড় থেকে একটু একটু পয়সা বার করে তারা সে চায়ের দাম
মেটালো।
সেই গাছে ঘেরা হাইওয়েতে
একটু এগোবার পরই দেখলাম একটা দৃশ্য। রাস্তার পাশ দিয়ে এক বৃদ্ধা নারী মাথায় কাঠকুটো
নিয়ে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ দাঁড়িয়ে দুহাত দিয়ে জঙ্ঘার কাছ থেকে টেনে টেনে শাড়িটা ওপরে ওঠালেন,
তারপর দাঁড়িয়েই পেচ্ছাপ করা শুরু করলেন। আমরা
অবাক হলাম কেননা আগে কখনও দেখিনি। এমন কিছু স্বাস্থ্যকর ব্যাপার নয়। পায়ে পেচ্ছাপের
ছিটে লাগছে, ঘাসে পুঁছে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। আমরা নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করলাম। অনেক
পরে পাটনায় যখন সাহিত্যচর্চা শুরু করেছি, আফ্রিকার কবি আয়মে সেজারএর ‘রিটার্ন টু মাই নেটিভ ল্যান্ড’ পড়তে পড়তে এই দৃশ্যটাই পেয়েছিলাম।
সেদিনকার আর বিশেষ
কিছু মনে নেই। বোধহয় কোনো নদী বা বাঁধে স্নান করে খিদে কমিয়েছিলাম। বা হয়তো এগিয়ে কোথাও
বেলা দুপুরে কোনো ঝুপড়ি হোটেলে ভাত খেয়েছিলাম। বলছি এজন্য যে প্রথম রসম-ভাত এরকমই একটা
হোটেলে খেয়েছিলাম, সেদিন বা পরের দিন আর যেহেতু অভ্যাস ছিল না, পুরো রসমটা ভাতের নিচ
দিয়ে কলাপাতায় গড়িয়ে প্যান্টে পড়েছিল, মনে আছে। রাতে, বোধহয় পলাসা থানায় (এখন গুগল
দেখে দূরত্ব আন্দাজ করে বলছি) রিপোর্ট করার পর ওরা নিজেদের থেকে কিছু খাবার দিয়েছিল
আর থানার বাড়িটায় ডানপাশের খোলা মেঝেতে শোয়ারও জায়গা দিয়েছিল।
৫
পলাসা বা নিকটস্থ
যে জায়গাই হোক, সেখান থেকে বেরিয়ে সারাদিনে বিশেষ কিছু ঘটেনি। ঘটেনি? না ঘটেছিল? আবার
দুপুরের খাওয়ার একটা সুন্দর দৃশ্য, কিন্তু দিন নিয়ে ধন্ধ। এক মেঘলা দিনে ভাত খেয়েছিলাম,
জায়গাটা এমন যে বাঁদিকে একটা অন্য রাস্তা, কোথাও যাওয়ার স্টেট হাইওয়ে বেরিয়ে গেছে।
ডানদিকে ছোটো একটা পাহাড়। পাহাড়ের মাথায় মন্দির (অবধারিত)। তবে সিঁড়িটা তিন-চার স্তরে
উঠেছে। একটু ওঠার পরই বাঁদিকে ডানদিকে দোকান। আবার আরেকটু উঠে তেমনই। আমরা নিচে সাইকেল
রেখে অনেকটা ওপরে উঠে বাঁদিকের একটা হোটেলে খাবার খেয়েছিলাম, মানে দক্ষিণ ভারতীয় থালি
যেমন হয় (সাম্ভরটা পাটনাতেও ভারত কফি হাউজে খেয়েছি, তাই ভাত দিয়ে রপ্ত হতে শুরু করেছিল)।
জানলা দিয়ে নিচের রাস্তা, আমাদের সাইকেল আর ওদিকের মোড় দেখা যাচ্ছিল। সেদিনই কী? না
অন্য কোনো দিন?
বিকেলের একটু আগে
বোধহয় শ্রীকাকুলাম থানায় ঢুকতে গেলাম। সে সময় আকাশে খটখটে রোদ। থানায় হাজিরা দেওয়ার
কোনো প্রয়োজন ছিল না। থাকবো তো অন্য কোথাও, রাতে। কিন্তু পাটনা থেকেই খবরের কাগজের
মাধ্যমে জানতাম, শ্রীকাকুলাম নকশাল-প্রভাবিত জায়গা। তাই যেচে একটা এ্যালিবাই তৈরি করতে
গিয়েছিলাম আর কি। ঢুকতে ঢুকতেই শুনলাম বীভৎস চিৎকার। ব্যারাকের মত থানা। হাজতটা সামনে
থেকেই দেখা যায়। দেখলাম কালো মত একজনকে বেদম পেটাচ্ছে দুজন পুলিস। রীতিমত শিউরে ওঠার
মত দৃশ্য। আগে কখনো এরকম সামনা সামনি দেখিনি। যদিও ঘুরিয়ে ফিরিয়ে জানা গেল যে লোকটি
নাকি এমন কিছু নয়, সাধারণ চোর, আর চোরেরা এরকমই চ্যাঁচায় ইত্যাদি … কিন্তু বড়বাবুকে দিয়ে খাতায় আসছি-যাচ্ছি লিখিয়ে
সাইন করিয়ে মানে মানে কেটে পড়লাম।
একটু পরে মাইলফলকে
বা দিকচিহ্নে বিশাখাপতনমের নাম আসা শুরু করল। নামটা জানতাম। হয়তো উল্টোরথ, নবকল্লোল
বা প্রসাদে কোনো উপন্যাসে পড়েছি। নামটাও যে সুন্দর। বিশাখা কোনো মেয়ের নাম হলে আজও
সুন্দরী আর বুদ্ধিমতী মনে হয়। মাইল যা লেখা ছিল, পড়ে আমি আর চপল মনস্থির করলাম, আজই
পৌঁছোতে হবে। ব্যস, ক্লান্তি ভুলে সাইকেল ছোটাবার চেষ্টা করলাম। রাস্তা ভালো। তাই দু’একবার ট্রাকের ডালার চেন খপ করে ধরে কয়েক মাইল
ঝড়ের বেগে এগোলাম। এ খেলাটা মাঝে মধ্যেই করতাম। তখন অত ভয়-টয় করত না। মাথায় বোধও ছিল
না যে ছাড়ার পর বাঁ দিকে হঠাৎ বাধা পেলে কী হবে।
সন্ধ্যের পর রাস্তা
ওপরে উঠতে শুরু করল। চড়াইয়ে প্যাডেল করা কষ্টকর হয় ঠিকই, কিন্তু বিপজ্জনক হয় না। এমনিতেই
আস্তে চলে সাইকেল, সামনে থেকে বড় কিছু আসতে দেখলে দিব্যি বাঁদিকে সরে থেমে যাওয়া যায়।
কিন্তু বিপদ আনছিল অন্ধকার। ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। বাঁকের মুখে হঠাৎ ওদিক থেকে ট্রাকের
হেডলাইট দেখলে বাঁদিকে একটু চেপে যাবো, সেটাই নিয়ম। কিন্তু চাপবো কোথায়? একটু চাপতে
গেলেই পাতায় পা পিছলে নিচের দিকে সরছি। ওই আলোতেই ঠাহর করে দেখছি ভালো রকম গভীর খাদ।
এভাবেই চলল এক ঘন্টা। রাস্তা সমতল হচ্ছে দেখে বুঝলাম চুড়োয় উঠে এসেছি। এবার নামতে হবে।
নামাটাই বিপজ্জনক। বেগ আটকে রাখা মুস্কিল হয়ে যায়। অনেকক্ষণ অন্ধকারেই ঠাহর করে করে,
আসতে, যেতে থাকা ট্রাকগুলোর আলোয় কিছুটা দূর রাস্তা বুঝে বুঝে নামতে থাকলাম। হঠাৎ একটা
বাঁক পেরোতেই নিচে ঝলমল করে উঠল বিশাখাপতনম। আর কী চাই! পাতার ফাঁক দিয়ে আসা বিশাখাপতনমের
আলোতেই বিশাখাপতনমে পৌঁছে গেলাম রাত সাড়ে ন’টা নাগাদ।
প্রথম পাওয়া পুলিস
থানায় (বিশাখাপতনম বড় শহর, অনেক থানা; মনেও নেই অনকাপল্লি ছিল না বিশাখাপতনম ইস্ট বা
অন্য কিছু) রিপোর্ট করে থাকার জায়গার কথা জানতে চাইলাম। আমাদের কথায় ওরা বোধহয় বুঝলো
বাঙালি। একটা দিক নির্দেশ দিল। গিয়ে দেখি সাধারণ একটা ভাতের দোকান বা পাইস হোটেল, ওপরে
ইংরেজি এবং বাংলায় লেখা ‘মিত্রবাবুর হোটেল’!
এখানেই যখন এলাম, তাহলে তো গাঁটের পয়সা খরচ
করে আগে ভাত খেতে হবে; তাও জানি না বাঙালি-খানার দর কত। রসম-সম্বর-ভাত অনেক সস্তা পড়ে।
আমতা আমতা করে বললাম, “আসলে আমরা থাকার
জায়গা খুঁজছিলাম, ধর্মশালা টাইপের, থানা এখানে পাঠিয়ে দিল …”। হোটেলে বলতে গেলে শেষ ব্যাচ খাচ্ছিল। মাছ
ভাতের গন্ধ। তিন ধাপ সিঁড়ির নিচে দাঁড়িয়ে একজন যুবক, ওপরে কাউন্টারে বসা হোটেল-মালিকের
সঙ্গে গল্প করছিল। সে-ই সাহায্য করল আমাদের। মিত্রবাবুকে বলল, “অত ভাবছেন কী? বাঙালি ছেলে, দেখছেন সাইকেল
ট্যুরে বেরিয়েছে, কোথায় যাবে ওরা? ভিতরে জায়গা করে দিন!”
- আরে, শোয়াবো কোথায়? ভাঁড়ার ঘরের ম্মেঝেতে? খাটও তো নেই।
- মেঝেতেই শোয়ান! (আমাদের দিকে তাকিয়ে) কী, আপনারা শুতে পারবেন না?
চাদর-টাদর আছে তো?
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, সে
আছে”, আমরা বললাম। মিত্রবাবু
ব্যাজার মুখ করে বললেন, “ঠিক আছে, দেখছেন
তো! (পিছনের ঘরটা দেখিয়ে) ওপাশ দিয়ে খাবারের বাল্টি, ডেকচিগুলো রাখা থাকে, তাই মেঝেয়
তেল টেল থাকলে বলবেন, ওরা মুছে দেবে। আপনারা এদিকের দেয়াল ঘেঁষে শুয়ে পড়বেন। কদিন থাকবেন?”
- এই দু-তিন দিন’
- ঠিক আছে, আগে খাবারটা খেয়ে নিন।
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, খাবারটা
আগে খেয়ে নিন”, সিঁড়ির নিচের যুবকটি
বললেন।
- আচ্ছা, কত দিতে হবে, দু-তিন দিন থাকার?
“সে কিছু দিতে হবে
না। মনোময় বলল, আমারও মনে হল এটুকু করাই যায়। নিন, খেয়ে নিন আগে। ওরা বাসনপত্র ধোবে।”
খাওয়া হল। মনোময়
দাঁড়িয়েই ছিল। একটা সিগরেট খেতে খেতে গল্প করলাম। জানলাম, ও সিআরপিএফের জওয়ান। খড়গপুরে
বাড়ি। এখানে ক্যাম্পে থাকে। বলল, কাল এসে ভালো করে গল্প করবে।
ক্লান্ত থাকলে ডাল,
মাছ আর তরকারির গন্ধ কী করবে? ভাঁড়ার ঘরের মেঝেতে চাদর বিছিয়ে আরামে ঘুমোলাম। তিনদিন
ছিলাম। একটু জিরিয়ে নিলাম। শহরে, বন্দর এলাকায় আর সমুদ্রের ধারে ঘুরে বেড়ালাম। একটাই
দৃশ্য মনে আছে। বন্দরের কাছে উজ্জ্বল সোনালি-হলুদ গন্ধকের পাহাড়। সারাদিনের খাবার খরচটাও
দিতে হল না। মিত্রবাবু সেটাও ফ্রি করে দিলেন। একদিন রাতে মনোময় নিজের ক্যাম্পে ইয়ে
গেল। ক্যাম্পে ওর খাটে বসে এক এক দিস্তা ঘি-লাগানো রুটি খেলাম তরকারি দিয়ে।
৬
অনেক আগেই আমরা ম্যাড্রাস
রোড বা এনএইচ ৫ ছেড়ে সমুদ্রের ধারে ধারে ছোট রাস্তা ধরে এগোচ্ছিলাম। তাই মাঝে মধ্যে
ছোট ছোট জায়গায় রাত্রিবাস হত যার নাম মনে নেই। যেমন বিশাখাপত্তনম থেকে বেরিয়ে সেদিনই
আমরা কোথাও পৌঁছে রাত্রিবাস করেছিলাম। দূরত্ব হিসেবে বড় জায়গা দুটো, কাকিনাড়া আর রাজামুন্দ্রি।
বা হয়তো, তৃতীয় কোনো ছোটো জায়গায় ছিলাম! রাজনগরমএ ছিলাম! কে জানে! একটাই যোগসূত্র আছে
মাথায় যে পরের দিন সকাল ন’টা-দশটার মধ্যে টাডেপল্লিগুডেম
পৌঁছে গিয়েছিলাম। জলখাবার কোনো একটা দোকানে খেয়েছি যার সামনেই খাল। খালের জলেই সবার
স্নান, কাপড় কাচা আর সেই জলই খাওয়া। তাই দোকানেও খাওয়ার জন্য সেই খালেরই জল দিয়েছিল।
তাতে ব্যাঙাচি ভাসছে দেখে ঝগড়া টগড়া করে মনটা ঘিনিয়ে ছিল। টাডেপল্লিগুডেমেও একই রকম
খাল। তাই এটাও মনে নেই যে জলখাবারের ঝগড়াটা টাডেপল্লিগুডেমেই হয়েছিল না এক ঘন্টা আগের
অন্য কোনো গ্রামে।
আরো মনে নেই যে গোদাবরী
নদীর ব্রিজ সেদিনই সকালে পেরিয়েছিলাম। যখন নাকি সেটাই হওয়ার কথা। অন্যথা হওয়ার উপায়
নেই। কিন্তু মনেও নেই। শুধু মনে আছে দীর্ঘ একটা সেতু এমন সময়ে অবাক বিস্ময়ে পেরিয়েছিলাম
যখন সেতুর আলোগুলো জ্বলছে। মহানদী সন্ধ্যা রাতে পেরোনোর কথা, কেননা রাত করে ভুবনেশ্বরে
পৌঁছেছিলাম। আর রাজামুন্দ্রিতে রাত্রিবাস করলে আলো ফোটার আগে গোদাবরী ব্রিজ পেরোবার
কথা। হয়তো দুটো ব্রিজই আলোজ্বলা অবস্থায় পেরিয়েছি। আর যেমন আগে বলেছি, সে কারণেই গোদাবরীতে
স্নান করিনি। মহানদীতেও করিনি। শুধু অবাক বিস্ময়টা রয়ে গেছে পঞ্চাশ বছর ধরে, “এত বড় নদী? এত জল?” বিস্ময়ের আরো একটা কারণ ছিল যে পাটনার গঙ্গাসেতু
তখনও ভবিষ্যতের গর্ভে। নইলে গর্ব করে বলতে পারতাম, “হেঁঃ, এর থেকে বড় ব্রিজ তো আমাদের গঙ্গার ওপর!”
যাহোক, টাডেপল্লিগুডেমের
খালের ব্রিজটা পেরুচ্ছি, ইংরেজিতে একজনের ডাক শুনতে পেলাম, “ফ্রেন্ড, ফ্রেন্ড!” পিছন ফিরে দেখি এক বয়স্ক ভদ্রলোক, আকাশী নীল
রঙের পায়জামা আর শার্ট পরে, ওই যাকে স্লিপিং স্যুট বলে কিন্তু আমরা পরে বাজারে যাই।
খুবই সৌম্য, শিক্ষিত চেহারা। বললেন, “আপনাদের সাইকেলে লাগানো প্লেট দেখেই থামালাম। আসুন, কাছেই আমার বাড়ি,
এক এক কাপ কফি খেয়ে যাবেন।” খালের পাশ দিয়ে
কিছুটা গিয়েই তাঁর ছোট্ট, ছিমছাম বাগানওয়ালা একতলা বাড়ি। গেটের নেমপ্লেটে দেখলাম লেখা
আছে ডাক্তার! বারান্দায় বসলাম। তিনি নিজেই ভিতর থেকে কফি নিয়ে এলেন। কফি খাওয়া হলে
একটা ছোট্ট নোটবই বার করলেন। “আপনারা বড় কাজ করছেন, পাটনা টু কন্যাকুমারি অন বাইসাইক্ল, আপনাদের
অটোগ্রাফ নেব।” রীতিমত ভ্যাবাচ্যাকা
খেয়ে গেলাম। যাহোক, নিজেদের নাম লিখলাম। উনি পিছনের পাতাগুলো উল্টে উল্টে দেখালেন কত
মানুষের স্বাক্ষর। দক্ষিণের কাউকেই চিনি না। চেনা নাম শুধু পেলাম অশোক কুমার আর মীনাকুমারী।
আমাদের ভিরমি খাওয়ার অবস্থা। কোনোরকমে মুখের অমায়িক হাসি হাসি ভাবটা বজায় রেখে বিদায়
নিয়ে সোজা আবার খালের ব্রিজে। চপল পাশ থেকে বলল, “গধা জনম ছেড়ে গেল রে আমাদের! অশোক কুমারের সঙ্গে একই খাতায় সাইন
করলাম, বল!”
সেদিন রাতে কোথায়
ছিলাম ভুলে গেছি। মছিলিপতনম? না বিজয়ওয়াড়া? চপলের কাছে রাখা ডাইরিটা পুলিশের গুদামে
ঢুকে যাওয়ায় যে কী ক্ষতি হয়েছে! মনে হয় বিজয়ওয়াড়ারই বাইরের দিকে কোথাও কেননা সকালে
কৃষ্ণা নদী পেরোতে গিয়ে বলেছিলাম মনে আছে, “ওমা, জল কোথায়?” গোদাবরী দেখার পর মার্চ-এপ্রিলে কৃষ্ণা দেখে সেরকমই মনে হওয়ার কথা।
বিজয়ওয়াড়া থেকে ওঙ্গোল
বা ওঙ্গোল থেকে নেল্লোর এই দু দিনের কথা বিশেষ মনে নেই। দিনও মনে নেই। দুদিনের জায়গায়
তিন দিনও হতে পারে। দু’তিনটে ঘটনা শুধু
মনে আছে। প্রথম – চম্পারণ থেকে বেরুনো
হিন্দীভাষী তরুণ এক হিচ-হাইকারের সঙ্গে দেখা। বোধহয় সারা ভারত ঘোরার প্রোগ্রামে। রাস্তায়
হেঁটেই যাচ্ছিল। দেখা হল, গল্পসল্প হল। তাকে ছেড়ে এগিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর পাশ দিয়ে
একটা ট্রাক বেরুলো। দেখলাম জানলা দিয়ে হাত নাড়ছে। দ্বিতীয় – চারজন পদযাত্রীর সঙ্গে দেখা। ভরদুপুরে তাদের
সঙ্গে দেখা হয়েছিল। চারজনই বাঙালি। কুলটি আয়রণ ওয়র্ক্সের কর্মী। ছুটি নিয়ে কন্যাকুমারী
পদযাত্রায় বেরিয়েছে। তারা নেমন্তন্ন করল তাদের সঙ্গে দুপুরের খাবারটা খেতে। একটা বন্ধ
পোড়ো বাড়ির খোলা হাতায় ঢুকে ইঁট, কাঠকুটো জড়ো করে উনুন জ্বাললো। একজন কাছাকাছি কোনো
পুকুরে গিয়ে জল নিয়ে এল গ্যালনে। হয়তো আগেই দেখে নিয়েছিল পাশে পুকুর আছে, আমরা লক্ষ
করি নি। তাই এখানে রান্নার যোগাড় বসিয়েছিল! সব কিছু ছিল তাদের পিঠের বোঝায়। হাঁড়ি,
হাতা, থালা, চাল, নুন, একটু তেঁতুল …। চাল ধুয়ে চাপিয়ে দিল। ততক্ষণ বসে যাদের বিড়ি ফোঁকার, ফুঁকলো। ভাত
হয়ে গেলে থালায় থালায় ভাত বাড়া হল। গরম ভাত, নুন আর তেঁতুল। কখনো খাইনি আগে, কিন্তু
গরম ভাতের গন্ধই আলাদা। পেট ভরে খেলাম। তার পর একসঙ্গে বিড়ি খেয়ে, ওদেরকে বিদায় জানিয়ে
এগিয়ে গেলাম। পরে তাদের সঙ্গে হঠাৎ আবার দেখা হয়েছিল। সেটা যথাস্থানে বলব।
তৃতীয় ঘটনা, নেল্লোর
বা গুডুর বা কাছাকাছি তৃতীয় কোনো শহরে সন্ধ্যায় ঢোকার মুখে। যেখানে রাতে আমরা ছিলাম।
যে রাস্তায় আমরা চলছিলাম সেটা তৈরি হচ্ছিল। ছোট পাথরকুচি নয়, বড় বড় ইঁটের টুকরো ফেলা,
আগামীকাল দুরমুষ বা রোলার চালানো হবে বা হয়তো একবার চালানো হয়েছে, অন্ধকারে কিছুই দেখতে
পাচ্ছিলাম না। মাঝেমধ্যে যে সাইকেলগুলো সামনে থেকে বা পিছন থেকে আসছিল, দেখলাম তাদের
সবকটার সামনে লম্ফ লাগানো। সাইকেলের জন্য কেরোসিনের লম্ফ, সে সময় পাওয়া যেত। হ্যান্ডেলের
সামনে বাস্কেট ফাঁসাবার জন্য একটা ফ্ল্যাট হুক থাকত, তাতেই বসানো হত। চৌকো লন্ঠনের
মত, কিন্তু খুব ছোট। সাইকেল আরোহী নিজের সামনে দুফুট জমি ছাড়া প্রায় কিছুই দেখতে পেত
না, কিন্তু সে যে আসছে সেটা রাস্তায় বিপরীত দিক থেকে আসা মানুষেরা দেখতে পেত। হঠাৎ
আমাদের সামনেই দেখলাম, ইঁটের টুকরোর ঝাঁকুনিতে একজনের লম্ফতে আগুন ধরে গেল। অর্থাৎ,
ভিতরের কেরোসিন ছলকে বেরিয়ে পলতের আগুনে জ্বলে লম্ফর সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ল। আর ঠিক
তখনই বাঁদিকের অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এসে দুজন পুলিস আমাদের থামালো। কী, না, লম্ফ ছাড়া
এগোনো যাবে না। অনেকক্ষণ তর্ক করলাম, আমরা হিন্দিতে তারা তেলেগুতে, সামনে আগুন ধরে
যাওয়া সাইকেলটার উদাহরণ দিলাম কিন্তু ছাড়ান পেলাম না। এমন কিছু দামী নয় এবং সব দোকানে
রাখে, কিন্তু আমাদের সেটুকু খরচ করতেও গায়ে লাগছিল। পয়সা ফুরিয়ে এসেছিল। বোধহয় দুটাকা
বা তেমনি কিছু দাম। একটু পিছিয়ে একটা গুমটি-দোকান ত্থেকে কিনে তারপর আবার এগোলাম।
তবে ঘটনা এটা নয়।
যদিও নেল্লোর বা গুডুর এখন দেখাচ্ছে অন্ধ্র প্রদেশে কিন্তু তামিলনাডুর একেবারে লাগোয়া।
সে সন্ধ্যায় আমাদের ধারণা ছিল যে আমরা তামিলনাডুতে ঢুকছি। যে রাস্তা দিয়ে ঢুকলাম সেটায়
ঢুকতেই বাজার ছিল আর সন্ধ্যায় ফুলের দোকানে ভরা ছিল। মেয়েরা দল বেঁধে ফুল দিয়ে সাজাচ্ছিল
নিজেদের বেণী। আমি আর চপল নিজেদের মধ্যে কোনো মস্করা করেছিলাম কিনা মনে নেই। তবে তীব্র
এক আকর্ষণ অনুভব করেছিলাম আর সেটা শুধু দৈহিক ছিল না। এত দূর ভেবেছিলাম যদি ভাগ্যচক্রে
বাড়ি না ফিরতে পারি তাহলে এই তো সেই দেশ, সেই ভাষা, সেই মুখ যা নিয়ে সারাজীবন কাটিয়ে
দেওয়া যেতে পারে! কোত্থেকে তামিলের প্রতি এত আকর্ষণ এসেছিল জানি না। অনেক বছর পরে যখন
তামিলের প্রাচীন সাহিত্য, ‘শিলপ্পদিকরম’, ‘মণিমেখলই’ বা সঙ্গম সাহিত্যের প্রেম ও যুদ্ধের কবিতাগুলো ইংরেজি অনুবাদে পড়ছি,
দু’একটা অনুবাদ করছি
আর পাগল হচ্ছি কেন তামিল শিখলাম না, তখনও বার বার সেই সন্ধ্যের বাজার, ফুলের দোকান
আর মেয়েদের বেণী, কাঁধ, মুখ আর উচ্ছলতা মনে পড়ত; এখনো মনে পড়ে।
৭
চেন্নাই বা তখনকার
ম্যাড্রাস বিকেল বিকেল পৌঁছে গিয়েছিলাম। সারা দিন একটা কিচ্ছু খাবার জোটেনি, কেননা
পয়সা শেষ, কোনো থানায় বা অন্য কোথাও কেউ এক কাপ কফিও খাওয়ায় নি। তার কারণ অবশ্য ভাষা।
অন্ধ্রে হিন্দি তবু চলে, তামিলনাডুতে একেবারেই চলে না। আর গ্রামে তো আরো সমস্যা। ভাঙা
ইংরেজিও কেউ বুঝবে না। নইলে, ঠিক মত বোঝাতে পারলে এমনটা হওয়া সম্ভবই ছিল না যে কেউ
কফি বা নাস্তা করাতো না। মানুষ তো এক, সারা ভারতে! সে যা হোক, পকেটে থাকার মধ্যে ছিল
দুটো ফিল্মের রোল, যেটা বিষ্টুর কাছ থেকে বাজেয়াপ্ত করেছিল চপল। রাস্তার ধারে একটা
ফোটো স্টুডিও খুঁজে ঢুকলাম। অনেক কষ্টে বুঝিয়ে-বাঝিয়ে, নিজেদের পেটে হাত বুলিয়ে, সাইকেলের
সামনের প্লেটটা দেখিয়ে স্টুডিওর মালিককে রোলদুটো কিনতে রাজি করানো গেল। বোধহয় দশ বা
কুড়ি টাকা পেয়েছিলাম। তাই নিয়ে গেলাম পাশে একটা খাবারের দোকানে।
বুভুক্ষুর মত দোসা
খাচ্ছি, এমন সময় একটা ছেলে ঢুকে জিজ্ঞেস করতে করতে আমাদের টেবিলের কাছে চলে এল। পরিষ্কার
হিন্দিতে জিজ্ঞেস করল, “আপনারাই আসছেন সাইকেলে?” পরিচয়ে জানলাম সে মোতিহারির ছেলে, এখানে টেক্সটাইল
টেকনোলজি পড়ছে, সাইকেলের প্লেটদুটো পড়ে দেখা করতে চলে এল।
আ হা হা, হঠাৎ ম্যাজিকের
মত বদলে গেল সমস্ত কিছু। এই আমরা ভাবছিলাম এর পর কোথায় যাবো, কী খাবো, এগোবো, না সাইকেল
বেচে বাড়ি ফেরার ট্রেন ধরবো, কী ভাষায় কাউকে বোঝাবো আমাদের সমস্যা … আর আধ ঘন্টার মধ্যে আমরা পেয়ে গেলাম আশ্রয়,
অভিভাবক, আহার এবং আরো অনেক কিছু। কোথায় গেল দুঃসহ গরম আর ক্লান্তি! উপসাগরের হাওয়ায় গা মেলে দিলাম।
ছেলেটি পড়তো বোধহয়
ইন্সটিট্যুট অফ টেক্সটাইল টেকনোলজিতে কিন্তু হস্টেলে বা মেসে থাকত না। ইলিয়ট বিচের
দিকেই কোথাও একটা সরকারি শ্রমিক ব্যারাক ছিল। গলিতে ঢুকে দুদিকে দুটো ব্যারাক, প্রত্যেকটি
ব্যারাকে কমন বারান্দার পর আটটা করে ঘর। এক একটি ঘরে এক একটি পরিবার। স্বাভাবিক ভাবেই
উদ্ভিন্নযৌবনা কুমারী বা বধু না হলে বন্ধ ঘরে ঘুমোবার দুর্ভোগ কাউকে সইতে হয় না। ঘরে
ডাঁই করা থাকে জিনিষপত্র, খাট, বিছানা কিন্তু রান্না হয় বারান্দায় আর শোয়া হয় রান্নার
জায়গা পরিষ্কার করে বারান্দায় অথবা খোলা আকাশের নিচে গলি ভরে, খাটিয়ায় অথবা মাটিতে
বিছানা পেতে। মোতিহারির ওই ছেলেটির এক দাদা আর বৌদি তাদের সন্তান নিয়ে ডানদিকের ব্যারাকের
একটা ঘরে থাকত, তাই সে নিজেও তাদের সঙ্গে থাকতে শুরু করল। আমরাও গিয়ে তাদেরই অতিথি
হলাম। যা সামর্থ্য তারই মধ্যে তারা যেন, আমাদেরই দাদা-বৌদি এভাবে আদরযত্নে রাখল পাঁচ
দিন।
আর ও ছেলেটি! পরের
দিন নিজের কলেজ কামাই করে আমাদেরকে নিয়ে গেল ম্যাড্রাস আইআইটি। প্রথম ঢুকলাম কোনো আইআইটি
ক্যাম্পাসে। পাটনার বাণিজ্য মহাবিদ্যালয়ে পড়া ছেলে, ক্যাম্পাসে ঢুকে ভিরমি খেয়ে যাওয়ার
যোগাড়! বিশাল সাজানো বন, তাতে হরিণ ঘুরছে। মাঝে মধ্যে বিভিন্ন খেলার কোর্ট। সেসব কিছু
পেরিয়ে, মেন বিল্ডিং ছাড়িয়ে তবে হোস্টেল। তার পরিচিত একটি ছেলের কাছে নিয়ে গেল। আমাদের
কথা শুনে সে ছেলেটি আমাদেরকে নিয়ে গেল ক্যান্টিনে। দুপুরের খাওয়ার সময়। সবাই খাচ্ছে,
আমরাও খেলাম তার অতিথি হিসেবে। সেখানেই সে তার সহপাঠিদের মধ্যে আমাদের সমস্যার কথা
রাখল। সবাই আশ্বাস দিল সাহায্য করবে। বোধহয় পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ টাকা উঠেছিল। আমরা দুদিন
পরে গিয়ে নিয়ে এসেছিলাম।
একদিন ভোরবেলায় গেলাম
ইলিয়ট বিচ। বিচটা মাছ ধরার কেন্দ্র। সেই কাকভোরে একের পর এক নৌকো সমুদ্রের ভিতর থেকে
দৃশ্যমান হয়ে তীরে আসছিল আর নামাচ্ছিল জালভরা মাছ। এক জায়গায় ল্যাজওয়ালা ঘুড়ির মত দেখতে
নীলচে-ধূসর একটা বিরাট মাছ দেখলাম বার করে সেখানেই খুচরো খরিদ্দারদের বিক্রির ব্যবস্থা
করা হচ্ছে। ছোটবেলায় বাবা যেমন বর্ণনা করেছিলেন সে হিসেবে এটাই শঙ্কর মাছ হওয়ার কথা।
আমরাও মাছ কিনলাম কিছুটা। দুপুরে বৌদি তার ঝোল খাওয়ালেন ভাত দিয়ে।
ম্যাড্রাস থেকে রওনা
হওয়ার দিন বৌদি রাত তিনটেয় উঠে আমাদের জন্য একবারের খাবার পরিমাণ লেমনরাইস আর একবারের
খাবার মত কার্ডরাইস তৈরি করে, কলাপাতায় মুড়ে কাপড়ে বেঁধে দিয়ে দিলেন। তখন তো এ নামগুলোও
জানতাম না। বৌদি তাই বলেছিলেন, “দু’রকমের টক ভাত দিয়ে
দিয়েছি, খেয়ে নিও।” আমরা এমন গাড়োল, জানতাম না যে টকভাত অনেকক্ষণ থাকে। ম্যাড্রাস ছাড়ার
পর দুঘন্টা পেরোতেই বলতে শুরু করলাম খেয়ে নিই বরং, নইলে নষ্ট হয়ে যাবে। ওই সকালে, একবারে
দুবারের ভাত খেয়ে এমন পেট আইঢাই করতে শুরু করল যে গামছা পেতে গাছের নিচে শুয়ে পড়লাম।
৮
পন্ডিচেরি যাওয়ার
রাস্তাটা স্বপ্নের মত। দুপাশে একমানুষ উচ্চতার নারকোল গাছের সারি। রোদ্দুরে পাতাগুলো
ঝিকঝিক করছে। কখনো ডানহাত কখনো বাঁহাত বাড়িয়ে কচি ডাব ছুঁতে ছুঁতে আমরা এগিয়ে চলেছি
মাইলের পর মাইল।
পৌঁছোলাম দুপুরে,
একটু দেরি করে। জিজ্ঞেস করে করে পৌঁছোলাম আশ্রমে। ভেবেছিলাম দুপুরের খাবারটা পেয়ে যাবো
প্রসাদ হিসেবে, পয়সা লাগবে না। পুরোনো বাড়ি। সাধারণ একটা লোহার গেট। কিন্তু বন্ধ। কাউকে
খুঁজছি জিজ্ঞেস করব বলে, এমন সময় এক ভদ্রলোক ভিতর থেকে বেরিয়ে এলেন। আমাদের উদ্দেশ্য
শুনে পরিষ্কার বাংলায় বললেন, “এখন তো দেরি হয়ে গেছে, আর পাওয়া যাবে না। তাছাড়া আগে থেকে নাম লেখাতে
হয়। … ঠিক আছে, চলুন আমার
সঙ্গে।” সাইকেল নিয়ে তাঁর
সঙ্গে হাঁটা দিলাম। কথাবার্তায় জানলাম তিনি পশ্চিমবঙ্গেই কোথাও কোনো কলেজে (নামধাম
ভুলে গেছি) কমার্স পড়াতেন, অবসরগ্রহণের পর এখানে চলে এসেছেন, এখানেই থাকেন। তাঁর বাড়িতে
নিয়ে গেলেন। সেখানে দুটো করে কালো বানরুটি আর কফি খাওয়ালেন। শুনলাম যে ওই অদ্ভুতদর্শন
শক্ত কালো বানরুটি নাকি আশ্রমেই তৈরি হয়। যদিও খেতে মন্দ ছিল না। অনেক পরে জেনেছিলাম
যে কালোবান নাকি এক বিশেষ পুষ্টিকর রুটি, বিলেতে খোসাসুদ্ধু গম আর আরো কিছুর আটা মিলিয়ে
তৈরি হয়।
বিকেল অব্দি তাঁর
বাড়িতেই রইলাম। গল্প করলাম। তিনিও কমার্সের দুটো বই দিলেন। বোধহয় তাঁর নিজের লেখা ছিল।
তারপর আমাদেরকে নিয়ে বেরিয়ে সমুদের ধারের একটা রাস্তায় নেমে ডানদিকে এগোলেন। আমরা বাঁদিকে
পাঁচিলের ওপারে সমুদ্র থেকে থেকে চোখ ফেরাতে পারছিলাম না। কিছুদুর যাওয়ার পর একটা সরকারি
রেস্টহাউজের মত কোনো কিছুর ক্যাম্পাস এল। সেখানে কথা বলে আমাদের শোয়ার ব্যবস্থা করে
দিলেন। ঘরে জায়গা হল না। বাইরে লনে খাট পেতে শুতে হবে। আমরা খুশিই হলাম বরং। আমাদের
শোয়ার ব্যবস্থা করে তিনি চলে গেলেন।
সেদিন রাতে বেরিয়ে
কোথায় খেয়েছিলাম মনে নেই। সেই ঘিঞ্জি একটা মুসলিম দোকানে মিটপরাঠা কি? খেয়েছিলাম মনে
আছে, সন্ধ্যে হচ্ছিল মনে আছে, পন্ডিচেরিরই বাইরের দিকে মনে আছে, কিন্তু কবে মনে নেই।
হয়তো সেই সন্ধ্যেতেই হবে। মনে থাকার কারণ মিটপরাঠার বিদঘুটে ধরণ। অর্ডার দিয়ে ভেবেছিলাম,
পয়সা খর্চা করে যখন খাচ্ছি জম্পেশ করে খাবো। মিটপরাঠা মানে ছোটো একটা বাটিতে মাংস থাকবে
ঝোলসুদ্ধু আর থালায় পরোটা থাকবে। তিনকোনা, বা চারকোনা বা গোল। ওমা, এল একটা ঘ্যাঁট।
লচ্ছা পরাঠা তৈরি করে, সেটাকে কুচি কুচি করে ছিঁড়ে, মাংস আর ঝোলে ভালো করে মেখে হাজির
করল। একেই নাকি এদিকে মিটপরাঠা বলে। তাতেও আবার নারকোল তেলের গন্ধ। মেজাজ খিঁচড়ে গিয়েছিল।
এর থেকে ইডলি অনেক ভালো হত। তাও গলাধঃকরণ করলাম।
যদি সেদিনই সন্ধ্যায়
খেয়েছিলাম কথাটা সত্যি হয় তাহলে বলতে পারি ফিরে এসে রাত্রে ঘাসের লনে খাট বিছিয়ে আকাশের
নিচে ঘুমোলাম, দেয়ালের ওপারে সমুদ্র তার ঢেউয়ের শব্দে ডাক দিয়ে যাচ্ছিল।
ভোরবেলায় বেরিয়ে
পড়া সাধারণ নিয়ম ছিল বলে বলছি, তবে মনে নেই। মনে নেই মানে দু’পা ঘাসের পর দেয়ালের ওপারে বঙ্গোপসাগরের জলের
অসীম ছুঁয়ে সূর্যোদয় নিশ্চয়ই সাধারণ দৃশ্য ছিল না। কিন্তু হয় উঠতে দেরি হয়েছিল। অথবা
রাত থাকতে বেরিয়ে পড়েছিলাম! কোনো স্মৃতি নেই। সে রাতে কোথায় পৌঁছেছিলাম তাও মনে নেই।
থাঞ্জাভুর? নাগেপতনম? ময়ুরম? না কুম্ভকোণম? কে জানে। মনে হচ্ছে কুম্ভকোণম।
তবে দুপুরটা মনে
আছে। দুদিকে আখের ক্ষেত। ক্ষেতের পাশেই এক কোনে পেষাইকলে আখের রস করে বড় উনুন ধরিয়ে
গুড় তৈরি করা হচ্ছে। সেখানে গিয়ে একটু গুড় বা আখের রস চাইতে গিয়ে ধ্যাঁতানি খেলাম।
পাশ থেকে একজন ইশারা করল দূরে একদিকে। সেখানে যেতেই চাষীরা এগিয়ে এসে আখের কাটা টুকরো
বান্ডিল করে সাইকেলের রডে বেঁধে দিল। ইশারায় বলল খেতে খেতে চলে যাও। সত্যিই সে দুপুরটা
আখের রস চুষে চুষে কাটালাম। আর কী মোটা লাল লাল আখ!
তার পরের রাতে বিরলিমলইয়ে
ছিলাম এটা স্পষ্ট মনে আছে। মনে থাকার কারণ তিনটে। প্রথমতঃ দুপুরের একটু পর একটা কফির
দোকান থেকে বেরিয়ে, আমরা দুজন আর একজন তামিল তরুণ দুধওয়ালা একসঙ্গে সাইকেলে চলা শুরু
করেছিলাম। “মাখন” নামে একটা গল্প বা শব্দচিত্রে সেই বিকেল আর
সন্ধ্যেটা অন্যত্র ধরার চেষ্টা করেছি। সারা বিকেল তার ইশারার ভাষায় জেনেছিলাম যে সে
কোনো বড় জমিদার বা জোতদারের ঘরের মুনিষ, বাঁধা মজুর বা চাকর। মালিকের খাটাল থেকে দুধ
ক্যানে ভরে, সাইকেলে চাপিয়ে পঁচিশ-তিরিশ মাইল অব্দি দোকানে দোকানে যোগান দিয়ে আসা তার
দৈনন্দিন কাজ, এবং ক্যান খালি হয়ে যাওয়ার পর ভিতরের দেয়ালে লেগে থাকা মাখনটুকুও সে
নিজের নয়, মালিকের সম্পত্তি মনে করে। এবং সেই মাখনটুকু চেঁছে আমাদের খাইয়ে, চিনি ছড়িয়ে
যে দিতে পারছে না সেটাকে নিজের আতিথেয়তার ত্রুটি মনে করে সে বুঝিয়ে দিয়েছিলে সে কে!
আমরা গর্বে চোখের জল ফেলেছিলাম যে আমাদেরও স্বদেশ বলতে কিছু একটা আছে যা আমরা জানতাম
না।
দ্বিতীয় কারণ এই
যে বিরলিমলইয়ে রাতের জায়গা থেকে বেরিয়ে (সস্তার হোটেল বা ধর্মশালা কিছু একটা) আমরা
বাজারে এক উৎসবের সম্মুখীন হয়েছিলাম। ভাষা বুঝিনি, তবু নাচে, গানে, মুখোশে ঐতিহ্যবাহী
মনে হয়েছিল সেই উৎসব। আর তৃতীয় কারণ, ওই উৎসবে দর্শকদের ভিড়ে কুলটির সেই পদযাত্রীদের
সঙ্গে আবার দেখা হয়েছিল। আমরা যে ম্যাড্রাসে ছিলাম পাঁচ দিন, ততদিনে তারা এতটা এগিয়ে
এসেছিল।
বিরলিমলইয়ের পথেই
বিকেলে তিরুচিরাপল্লীতে ঢুকেছিলাম তখন বৃষ্টি পড়ছিল। খুব পরিচ্ছন্ন মনে হয়েছিল শহরটা।
৯
আবার স্মৃতিভ্রংশ।
বিরলিমলইয়ের পরের রাতে কোথায় ছিলাম? কন্যাকুমারী আমরা বিকেল তিনটে নাগাদ পৌঁছেছিলাম।
এবং পৌঁছোবার পর হাতে এতটা সময় ও পায়ে শক্তি ছিল যে সে রাতেই ত্রিভেন্দ্রম বা তিরুঅনন্তপুরম
গিয়ে থেকেছিলাম। তা যদি হয় তাহলে সকালে আমাদের তিরুনেলভেলি থেকে বেরুতে হয়। আর তাহলে
তার আগের রাতে আমাদের থাকার জায়গা হতে হয় মাদুরাই থেকে একটু এগিয়ে, বিরুধুনগর বা শিবকাসী।
আসলে হাইওয়েগুলোর শুধু নাম বা সংখ্যাই পাল্টায় নি, রুটও পাল্টেছে বহু জায়গায়। শুধু
ন্যাশনাল কেন স্টেট হাইওয়ে এবং অন্যান্য রাস্তাও। ডবল-লেন, ফোর-লেন, সিক্স-লেন করার
জন্য জমি না পাওয়া গেলে নতুন জমি কিনেছে সরকার, অন্য দিক দিয়ে ঘুরে গেছে রাস্তা। কাজেই
নিশ্চিত হয়ে বলা খুব মুশকিল। মাদুরাই গেলে রামেশ্বরম ঘুরে যাওয়ার একটা ইচ্ছে হত। যদি
নাও যেতাম সে ইচ্ছেটার একটা দাগ থেকে যেত স্মৃতিতে। তা যখন নেই তখন মাদুরাইতে থাকি
নি।
মনে রাখার মত কোনো
ঘটনা যে ঘটেনি সে রাতে সেটাও স্পষ্ট। নইলে তার সূত্র ধরেই জায়গাটার নাম মনে চিহ্ন রাখত।
কন্যাকুমারী পৌঁছোতেই গ্রাস করে নিয়েছিল তিন সমুদ্রের হাওয়া। সাইকেল চালিয়েই সোজা পৌঁছেছিলাম
জলের কাছে, তিন সমুদ্রের রঙ দেখেছিলাম। কিন্তু আমাদের ভিতর থেকে অস্থির করে রেখেছিল
পয়সার অভাব। আর ম্যাড্রাসের ছাত্রদের কথাবার্তা, ছাত্রদের প্রতি বিশ্বাস ইত্যাদি একদম
নিশ্চিন্ত করে রেখেছিল যে ত্রিভেন্দ্রমের ইউনিভার্সিটি হস্টেলে গেলে থাকা, খাওয়া, আরো
এগিয়ে যাওয়ার জন্য কিছু টাকা, সব যোগাড় হয়ে যাবে। তাই কন্যাকুমারীর সূর্যাস্তের বদলে
পথে আরবসাগরের সূর্যাস্ত দেখে নেব ভেবে পাঁচটা নাগাদ ত্রিভেন্দ্রমের পথে পাড়ি দিলাম।
রাত নটার পর ঢুকলাম
ত্রিভেন্দ্রম শহরে। রাস্তায় রাস্তায় ভিড় আর পুলিসের ছয়লাপ। তক্ষুনি একটা বড় পথসভা ভেঙেছে।
কেন জিজ্ঞেস করতে জানলাম সরকার নাকি পড়ে গেছে। পঞ্চাশ বছরে আজ অব্দি মিলিয়ে দেখিনি।
আজকাল ইন্টারনেট হয়েছে। গুগলে ব্রাউজ করতে করতে দেখলাম ২রা এপ্রিল ১৯৭০এ সি অচ্যুত
মেনন মন্ত্রীসভা থেকে তাঁর অর্থমন্ত্রী এন কে শেষন পদত্যাগ করেছিলেন। কিন্তু আমরা তো
বারো-তেরো এপ্রিলে পৌঁছে হবো। তাহলে? ফেব্রুয়ারি ১৯৭০এ ভারতের সে সময়কার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ
মামলা উঠেছিল কেরল থেকে সুপ্রিম কোর্টে – কেশবানন্দ ভারতী বনাম …। তাহলে সেই সম্পর্কিত কিছু?
জানিনা। কিন্তু জানতে
পেলাম যে সব স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ, হস্টেল খালি করিয়ে দেওয়া হয়েছে। এবার?
মুখ শুকিয়ে গেল। খুঁজে খুঁজে গেলাম থানায়। তাদের মাথা আগে থেকেই গরম। সারাদিন নানান
পথসভার ভিড় সামলানোর ধকল। আমাদের কথা কিছু শুনলই না। দূর দূর করে তাড়িয়ে দেওয়া বাকি
রাখলো। বাইরে পুলিসেরই এক কনস্টেবল বললো ক্যান্টনমেন্ট থানায় চলে যেতে, ওরা শান্তিতে
আছে সারা দিন, ওরা কিছু করবে নিশ্চয়ই। তাই গেলাম। আর সত্যিই, নোটবুকে রেকর্ডও করলেন
দারোগাসাহেব, থানার ক্যাম্পাসেই একটা খোলা জায়গায় শোয়ার জায়গাও হয়ে গেল আর দু’তিনজন কনস্টেবল নিজেদের রাতের খাবার আমাদের সঙ্গে ভাগও করলো।
রাত তো কাটলো। সকাল? সকালে উঠেই তো আবার খিদে?
একটা কিচ্ছু নেই পকেটে। বিক্রি করার মতও কিচ্ছু নেই, উপহারে পাওয়া বইগুলো আর নিজেদের
জামাকাপড় ছাড়া। যদি বিক্রি করিও, যা পাবো তাতে কতদূর পৌঁছোবো। এর পরের রাজ্যের বড় শহর
তো আর এক দিনের রাস্তা নয়! সেই চার-পাঁচ বা ছয় দিনের রাস্তা হবে। তবে গিয়ে কোনো কলেজ
বা হাই স্কুলের ছাত্র পাবো। চপলও মুষড়ে পড়লো, বললো, “শোন। আর ভেবে লাভ নেই। এই শেষ। ফিরে চল।”
- ফিরবো কী করে? সাইকেল চালিয়ে?
- বেচে দেবো সাইকেলদুটো।
- বেচে দেবো?
- হ্যাঁ। অতো আঁতকে ওঠার কী আছে?
- ঠিক আছে, চল কোনো সাইকেলের দোকানে।
সারা শহর না হোক,
রেল স্টেশন অব্দি যতগুলো সাইকেলের দোকানে সম্ভব হল, একভাবে জিজ্ঞেস করে গেলাম। সবকটা
মুণ্ডু নেড়ে দিল। সাড়ে দশটা বাজছে। স্টেশনের পোর্টিকোর বাইরে সাইকেলদুটো দাঁড় করিয়ে
দেয়ালে বসেছিলাম। একজন প্রৌঢ়, মনে হল রেলেরই কর্মচারী জিজ্ঞেস করলো কী ব্যাপার। আমরা
বললাম। জিজ্ঞেস করলো, “দুটোই?” “হ্যাঁ, নিশ্চয়ই, একটা বেচে এখন তিন হাজার মাইল ডবল-রাইডিং করে ফিরবো
নাকি?” মনে নেই কীভাবে
দরদাম করেছিলাম। হয়তো আড়াই-তিনশো চেয়ে থাকবো। আমার তো লজঝড়ে মাডগার্ড-খোলা এ্যাটলাস।
কিন্তু চপলেরটা তো সেমি রেসিং। আমারটা যদি একশোও হয়, ওরটা তো দেড়শো হবেই। কিন্তু ফোরম্যানসাহেব
(নিজেই পরিচয় দিয়েছিলেন যে ওয়ার্কশপে ফোরম্যান) ভুলবার নয়। ধূর্ত লোক। বুঝে গেছে আমাদের
অবস্থা। না খেয়ে বসে আছি। শেষে হাতজোড় করে পাটনা অব্দি যা ভাড়া হয় গুনে দিতে বললাম।
রাজি হল না। কলকাতা? রাজি হল না। শেষে বাধ্য হয়ে ওর বলা দাম আশি টাকায় দুটো সাইকেল
বেচে দিলাম। দু’তিন টাকা বোধহয় বেশি
দিয়েছিল খাবার নামে। তাই দিয়ে মসাল দোসা খেয়ে ভুবনেশ্বরের টিকিট কেটে ওয়েটিং রুমে ঢুকে
বসলাম। ট্রেন বিকেলে।
চুপচাপ বসেছিলাম
ওয়েটিং রুমে, মাঝখানের টেবিলটায় হাতে মাথা রেখে। পিছন থেকে এক বৃদ্ধা সৌম্যদর্শন পাঞ্জাবী
মহিলা উঠে এসে পাশে বসলেন। তাঁর স্বামীই মনে হল, এক বৃদ্ধ সর্দারজি পিছনে বসেছিলেন।
খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন কী ব্যাপার, মুখ এত শুকনো কেন? বলতেই হল। তিনি উঠে গিয়ে
নিজেদের ব্যাগ থেকে দুটো কৌটো (ওই আগে যেরকম গ্ল্যাক্সো বা নেস্টোমল্টের টিন পাওয়া
যেত) বার করে টেবিলে এনে রাখলেন, “ঘরের ছেলে, অনেকদিন বাইরে বাইরে থাকলে। এত দূরে এসে পড়েছ। এভাবে
কেউ আসে? এই নাও, একটা কৌটোয় চিড়ে আছে ভরা, আর অন্যটায় চিনি আছে, জলে ভিজিয়ে বা শুকনো
খেলে মনে হয় দু’চার দিন টেনে নিতে
পারবে। আর কিছু তো এখন তোমাদের দিতে পারবো না। প্রার্থনা করি ভালো ভাবে বাড়ি পৌঁছে
যাবে।”
তারপর আর কী! ট্রেনে
একটা ছেলে আমাদের বন্ধু হয়ে গিয়েছিল। নেল্লোরে সিট নিয়ে ঝঞ্ঝাট হওয়ায় সেই সামাল দিয়েছিল,
আলুর বড়া, ডালের বড়া খাইয়েছিল। ভুবনেশ্বর, আবার মামার বাড়ি, কলকাতার টিকিট, কলকাতা,
আবার জ্যেঠিমার (আর চপল তার দাদার) বাড়ি, পাটনার টিকিট, পাটনা। কলেজে প্রিন্সিপ্যাল
সাহেবের চেম্বারে ঢুকে তাঁকে উপহার পাওয়া বইগুলো দিলাম। বিষ্টু ফিরে এসে তাঁকে উল্টোপাল্টা
কিছু বলেছিল। আমরা সত্যিটা বলায় সে বকুনি খেল।