Wednesday, August 5, 2020

ঘুড়ি

ঘুড়ির মালিকানার একটা নিয়ম আছে।

ঘুড়ি যতক্ষণ তোমার লাটাইয়ের সাথে সুতোর টানে বাঁধা, ততক্ষণ, ওই যে নীল আকাশে ফরফর করে উড়ছে ওটা তোমার ঘুড়ি। আকাশের বুকে লড়াই চলবে হয় নিজের ঘুড়িটাকে বাঁক দিয়ে তুমি ছোঁ মারো অন্য ঘুড়ির ওপর অথবা অন্য ঘুড়ি বাঁক নিয়ে ছোঁ মারুক তোমার ঘুড়ির ওপর, লড়াই চলবে, কখনো টান, কখনো ঢিল্লি... কী ধরণের মাঞ্ঝা তোমার সুতোয় সেটাও মাথায় রাখতে হবে ... যাঃ, ভোঁ-কাট্টা, ঘুড়িটা কেটে গেল।

ব্যাস, ওটা আর তোমার ঘুড়ি নয়। কিছুক্ষণ আকাশের ঘুড়ি। বেসামাল উড়তে উড়তে ঘুড়িটা কখনো গাছে ফেঁসে, কখনো ইলেক্ট্রিক বা টেলিগ্রাফ তারে ফেঁসে যেই পৌঁছোল মাটির কাছাকাছি ... নতুন মালিকের দল, শুকনো গাছের ডাল, ছোটো লগি ইত্যাদি নিয়ে তৈরি। ওরা সেই কখনো থেকে আকাশের গায়ে পিছলে নামতে থাকা ঘুড়িটাকে অনুসরণ করে দৌড়োচ্ছে! ওরাও সবাই মালিক হবেনা। যে ঘুড়িটা সবচেয়ে আগে হাতে নিতে পারবে, ঘুড়ি তার। সে দুর্বল হোক, বয়সে ছোটো হোক, কেউ তার কাছ থেকে ঘুড়িটা কেড়ে নিতে পারবে না। যদি মনে হয় যে না, ওটা এখনও তোমারই ঘুড়ি থাকবে, তো মানা করেছে কে লাটাই ফেলে দৌড়োও। ছাত থেকে বালুর ঢিপির ওপর লাফিয়ে, মাঠঘাট পেরিয়ে সবচেয়ে আগে গিয়ে লোটো ঘুড়িটা! হ্যাঁ, লুটতে হবে। কাটা ঘুড়ি যে লুটবে, তার।  

ঘুড়িটা বুকের সাথে লাগিয়ে, দুটো কান্নি দুহাতে ধরে সে দৌড়োবে। আনন্দে দুহাত মেলেও দিতে পারে, ঘুড়ি পড়বে না। হাওয়ার ধাক্কায় ঘুড়িটা ফরফর শব্দ করতে করতে পাঁজরের সাথে সেঁটে থাকবে যেন ঘুড়িটা পাওয়ার আনন্দে, ঘুড়ি নিয়ে রাস্তাময় দৌড়োবার আনন্দে পাঁজরগুলো পাতলা আর হাল্কা হয়ে গেছে, এবার কাঁধের হাড়দুটোই কান্নি। আর সে নিজেই ঘুড়ি, দৌড়োচ্ছে না, আকাশে উড়ছে ...।

শঙ্কর এক গা জ্বর নিয়ে শুয়ে শুয়ে ভাবছিল। যেন সে একা নয়, মোতি, অর্জুন, সকলে একসাথে উড়ছিল কাল। এই ওড়ার আনন্দেই তো বিকেল হতে না হতেই শুকনো কাঁটাঝোপ, গাছের ডাল ভেঙে হাতে নিয়ে ওরা তৈরি হয়ে যায়। জায়গা মত দাঁড়িয়ে লক্ষ্য রাখে আকাশে, ঘুড়িগুলোর কাটাকাটি খেলায়।

 

শঙ্করের হাতের ডালেই ঘুড়িটা প্রথম ফেঁসেছিল। একেবারে তরতাজা ঘুড়ি, একটাও তাপ্পি নেই। সোনালি লাল রঙ। সঙ্গে অনেকখানি ভালো মাঞ্ঝার সুতোও ছিল। ঘুড়িটা বুকের কাছে ধরে বিজয়গর্বে ও সকলের দিকে তাকাল। সকলে ওর দিকে তারিফের নজরে চেয়ে আছে। মোতি, অর্জুন, কালুয়া ও বাকি সবাই। চোখে চোখে একটু একটু লোভ।...

মা পুড়িয়া করে একটু বার্লি নিয়ে এসে ঘরে ঢুকলেন। ঢুকতে বেরুতে কড়কড় করে ড্রাম কেটে তৈরি করা টিনের দরজাটা। শঙ্করের চোখে কী পড়ল! পুরোনো খড়ের চিলতে বোধহয়! ছাত থেকে ঝরছে। তাই পাশ ফিরে শুল। মা উনুনে চাপান ডালটা, ঢাকনা সরিয়ে একবার দেখে নামিয়ে রেখে জলের বাটি চাপালেন বার্লির জন্য।      

 

শঙ্কর আর মোতি বাকি বন্ধুদের থেকে আলাদা হয়ে, ঘুড়ি নিয়ে গলিতে দুপা এগোতেই পাশের পাকা বাড়ি থেকে হাঁক শুনে থমকে দাঁড়াল, এ্যাই, শোন! একজন বয়স্কা মহিলার কর্কশ আওয়াজ। শঙ্কর দেখল ওর থেকে বড় একটা ফর্সা ছেলে ছাতের ওপর থেকে নুয়ে ওকে দেখছে। নিচে বারান্দা থেকে হাঁক দেওয়া মহিলাটি ওর মা বা পিসি কিছু একটা হবে।

ওর ঘুড়ি নিয়েছিস কেন? মহিলা প্রশ্ন করলেন। ওর ঘুড়ি! শঙ্কর ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। ঘুড়ির মালিকানার সাধারণ নিয়ম না জেনে যে কেউ ঘুড়ি ওড়াতে পারে এটা শঙ্করের ধারণাতেই ছিল না। এখন এই পাকা দালানের মহিলাকে সে নিজের ভাষায় কী করে নিয়মটা বোঝাবে ভাবতে ভাবতে ঠোঁটে দুএকবার বুদবুদ কেটে চুপ করে গেল।

কী রে উতু, ওটা তোর ঘুড়ি না? এবার কর্কশ আওয়াজের প্রশ্নটা ওপর দিকে ছোঁড়া। ছাতের কার্নিশ ধরে দুলতে দুলতে উতু নামের ছেলেটি জবাব দিল, হ্যাঁ। ছেলেটির জবাব দেওয়ার ঢঙ দেখে শঙ্করের মনে হল মালিকানার নিয়মটা ও জানে। কিন্তু এখন গলির ভিতরকার বস্তির ছেলেকে ঘুড়িটা নিয়ে ঢুকতে দেখে আর ঘুড়িটা আনকোরা আছে দেখে মাথায় ঢুকেছে যে মাকে বা পিসীকে বললে ফেরত পাওয়া যেতে পারে।

তাই মহিলা চোখ পাকিয়ে শঙ্করের দিকে তাকাতেই এবার শঙ্করের মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, ঘুড়িটা তো কেটে গিয়েছিল!

-       ও, কেটে গিয়েছিল! তাহলে ঘুড়িটা আর ওর থাকে না নাকি?

-       হ্যাঁ, (ওপর দিকে আঙুল তুলে) ও তো জানে!

মা ওপর দিকে আঙুল দেখানটাকে আমল না দিয়ে সোজা প্রশ্ন করল, তুই ঘুড়িটা ফেরত দিবি কি দিবি না!

-       আর ঘুড়িটা যদি অন্য রাস্তায় পড়ত?

-       তার মানে?

-       অন্য কেউ লুটে নিয়ে চলে যেত যদি?

-       ও, তক্কো হচ্ছে! দাঁড়া, আসুক ওর দাদারা। বলছি। এই বস্তির ছেলেগুলোর সাথে ভালো ভাবে কথা বলা বেকার।

মোতিটা এতক্ষণ কোনো কথা বলেনি। হঠাৎ উসকে দিল আগুনটা, তা মুখ লাগান কেন? ... আর সবাই জানে, (ওপর দিকে দেখিয়ে)ও...ও জানে কাটা ঘুড়ি যে লোটে তার। চল শঙ্কর! বলে শঙ্করের হাতটা টেনে গলির ভিতর দিকে হাঁটা দিল। ওরা শুনতে পেল, বটে বলে রাগে কাঁপতে কাঁপতে মহিলা ঘরে ঢুকে দরজাটা দড়াম করে বন্দ করে দিলেন।

 

মা ঘরে অনেকক্ষণ আগে আগে ঢুকেছিলেন। বার্লি নামিয়ে আবার ডালটা চড়িয়ে দিয়েছিলেন। তারপর পাখার হাওয়ায় বার্লির ঘোলটা ঠান্ডা করছিলেন এতক্ষণ। এবার নিয়ে এলেন শঙ্করের কাছে, নে ওঠ, খেয়ে নে! উনুনের কাছে ফিরে গিয়ে কাগজের মোড়ক খুলে দেখলেন কটা রুটি আছে। কাজের বাড়ি থেকে জলখাবারে পাওয়া। গামলায় বার করা আটা থেকে আদ্ধেকটা তুলে আবার টিনে রেখে দিলেনও। আটা মাখতে মাখতে শুরু করলেন, কী দরকার ছিল মুখে মুখে তর্ক করার? বড় বাড়ির মানুষজন, তাও আবার মেয়েমানুষ। ঘরে আগুন লাগান ছেলে সব! শঙ্কর পাশ ফিরে বার্লির বাটিতে চুমুক দিল।

... সন্ধ্যায় শঙ্কর, মোতি, কালুয়া ও আরো সবাই রাস্তার কিনারে বসে গল্প করছিল। পাশে বিড়ি-সিগরেটের দোকানে মৌলবী সাহেব গুনগুন করে সুর ভাঁজছিলেন আর দুলতে দুলতে বিড়ি বাঁধছিলেন।

মৌলবী সাহেবই ডাকলেন ওদের, এ বচ্চো, এই বাবু তোদের ডাকছেন। ওরা উঠে এগিয়ে গেল। বাবু মানে আঠেরো-উনিশ বছরের রঙচঙে ছেলে, পাশে তারই মত তার বন্ধু। সিগরেট ধরিয়ে ঘুরে দেখল ওদের সকলকে। তারপর হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করল, তোদের মধ্যে কে একটা সোনালি-লাল ঘুড়ি লুটেছিল রে, আজ বিকেলে? মানে, (অদূরে আঙুল দেখাল) ওই গলির মোড়ের যে বাড়িটা, ওই বাড়িরই ছেলে ওড়াচ্ছিল। বিকেলে ওর পিসির সাথে তক্কাতক্কিও হয়েছে। তোদের মধ্যে কে সে?

মোতি হাত টিপতে যাচ্ছিল তার আগেই শঙ্কর বলে উঠল, আমি! কেন? কী হয়েছে? যুবকটি এগিয়ে এসে বলে শঙ্করের কান ধরে হ্যাঁচকা টান দিল। কানের কাছে প্রচন্ড যন্ত্রণা কানের লতির নিচটা ছিঁড়ে গেছে। শঙ্কর ককিয়ে উঠতে কান ছেড়ে ঠাস করে একটা চড় মারল যুবকটা, শালা, বড় ঘরের মহিলাদের সাথে কথা বলতে জান না, না? চাবকে ছাল তুলে নেব। ততক্ষণে মোতি ঝাঁপিয়ে পড়েছিল যুবকটার হাতের ওপর। বন্ধু যুবকটা মোতির চুল ধরে সজোরে টান দিতে ও মৌলবী সাহেবের দোকানের পায়ায় ঠোক্কর খেল।

তখনই শঙ্করের মা ফিরছিলেন কাজের বাড়ি থেকে। হাতের থলেতে কাগজের মোড়কে সে বাড়িতে পাওয়া জলখাবার ছিল। ঝগড়া দেখে দৌড়ে এসে মোতিকে আর শঙ্করকে টেনে নিলেন নিজের দিকে। বাকি ছেলেগুলো মারমুখী হয়ে উঠেছিল। ওদেরকে চিৎকার করে ধমক দিয়ে থামালেন। শঙ্করের কানের নিচটা শাড়ির খুঁট দিয়ে মুছতে মুছতে ক্রুদ্ধ চোখে যুবক দুটোর দিকে তাকালেন, লড়াই করতে এসেছে দেখ ... বীরপুরুষ ... কেন মারছিলে বাচ্চাদের?

বন্ধু যুবকটা একদৃষ্টে শঙ্করের মার শরীরের দিকে তাকিয়েছিল। গলাটাকে চেষ্টায় গম্ভীর করে দুজনে বলল, ছেলেটাকে ঠিক করে কথা বলতে শেখাও ... মুখে মুখে তর্ক করে। মা যুবক দুজনের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে শঙ্কর আর মোতিকে দেখল, তারপর হিড়হিড় করে দুজনকে টানতে টানতে ঘরের দিকে নিয়ে চলল।

প্রথম যুবক, মহিলাটি দূরে চলে গেছে দেখে একটা কুৎসিত গালি দিল। কালুয়া তখনও দাঁড়িয়েছিল। গালি শুনে ওর মুখ কুঁচকে উঠল। মৌলবী সাহেব অনেক আগে থেকেই ঝগড়াটা থামানোর জন্য অনুরোধ করতে করতে শেষে দোকান ছেড়ে নেমে এসেছিলেন। উনি প্রশ্ন করলেন, কী হয়েছে বলুন তো? কী করেছে বাচ্চাদুটো?

-       আরে সব হারামির বাচ্চাদের কারবার। এক তো পরের জিনিষ চুরি করবে। তার ওপর ইজ্জতদার ঘরের মহিলাদের সাথে কথা বলতে জানে না।

-       (মৌলবী সাহেব কালুয়া আর অন্যদের দিকে তাকান) তোরা জানিস নাকি, কী হয়েছিল!

-       কালুয়া বলতে যাচ্ছিল, প্রথম যুবক বাধা দিল, ওরা আবার কী বলবে।

-       বলুক না, শুনি!

এই করে ওদের মাথায় চড়ান আপনি। বলে দুজনে চলে গেল অন্য দিকে। মৌলবী সাহেব, অস্বীকৃতিসূচক মাথা নাড়তে নাড়তে কালুয়ার দিকে ফিরে তাকালেন।

কালুয়া ঘুড়ি লোটার ঘটনাটা শুনিয়ে দিল। পরেরটুকু নিয়ে তো ওরা গল্পই করছিল তাই সেটুকুও শুনিয়ে দিল।

মৌলবী সাহেব আগের মতই মাথা নাড়তে নাড়তে স্বগতোক্তি করলেন, ওরা তো ভূল করে নি। এটাই তো ঘুড়ির দস্তুর! ঘুড়ি কাটা পড়লে তো সেটা আকাশের! এখন যে সেটা পেল সেটা তার! ... এই নিয়ে ঝগড়া? আর এরা তো কথাটাকেই ঘুরিয়ে দিল। ইজ্জত, লিহাজ, ঔরত, কথা বলার ভদ্রতা ... কী কী সব কথা উঠিয়ে এভাবে মারল ছেলে দুটোকে? ছি ছি ...!

 

শঙ্কর ঘরের কোনের দিকে তাকিয়ে দেখল। কোনো বড় পাখির পালকের মত ঘুড়ির ছেঁড়া অংশগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। সন্ধ্যায় মা ঘুড়িটা ফেরত দিতে গিয়েছিল। ওরা সেটা অপমান করা হচ্ছে দেখিয়ে, লোকজনকে শুনিয়ে আরো দুএকটা কথা শুনিয়েছে মাকে। মা ঘরে এসে ঘুড়িটা কুটি কুটি করে শঙ্করের চোখের সামনে ছিঁড়ে ঘা লাগা শরীরে আরো কয়েক ঘা কষিয়েছেন। রাত্রের দিকে হু হু করে জ্বর এসেছে শঙ্করের।

মোতি একটু আগে এসেছিল। ওর মাথাটা এক জায়গায় ফুলে আছে। মুখে রাগ। বলল, শালার মেরে আমি মাথা ফাটিয়ে দেব। বড়লোকের ছা, হাজারটা ঘুড়ি কিনবে অথচ একটা ঘুড়ির জন্য, তাও কাটা ঘুড়ির জন্য ...। মোতি শঙ্করের চেয়ে দু বছরের বড়। ও অনেক কিছু বোঝে। ওর বাবা রিক্সা চালান। মাঝে মাঝে রক্ত বিক্রি করে আসেন পাদ্রীদের হাসপাতালে। ও জানে বেশিদিন চলবেনা এই ঘুড়ির পিছনে ছোটা। শঙ্করেরও না। কাজ ধরতে হবে কোথাও। বড় বাড়ির তো ধেড়েগুলোও ঘুড়ি নিয়ে হই হই করে। ওদের আর মাত্র কিছু দিন। তা থেকেও দুতিনটে দিন চলে গেল এই ঝঞ্ঝাটে।

 

শঙ্কর ঘরের খোলা দরজা দিয়ে তাকাল। সামনের চালার ওপর সজনে গাছের পিছনে চাঁদ হাল্কা হাল্কা দোল খেয়ে মেঘের ফাঁকে ফাঁকে এগিয়ে চলেছে। ওর হাত অদৃশ্য সুতোয় টান দিতে শুরু করল। এই ... এই ... এই বেরিয়ে এল চাঁদটা। ... কানটা টন টন করছে, গরম, আর ফুলে আছে একটু। রাগ, ক্ষিদে আর জ্বর নিয়ে সে উঠল। ঘরের কোনায় গিয়ে ঘুড়ির মাঞ্ঝা দেওয়া সুতোটা লপটাতে শুরু করল আঙুলে। তারপর খুলে ছুঁড়ে ফেলল, যাঃ, কাঁচা মাঞ্ঝা, তাই তো কেটেছিল রে তোর ঘুড়িটা। এবার দ্যাখ, আমি কেমন মাঞ্ঝা দিই। অপেক্ষা কর কিছুদিন। শালা, টিপ করে তোর ঘুড়ির ওপরেই ছোঁ মেরে নেমে আসব। তখন দেখব তোর পিসি আর দাদা কী করে।

মোতিকেও বুঝিয়ে বলতে হবে ঝঞ্ঝাট বাড়ানোর কোনো দরকার নেই। একটু মেহনত করব, রোজগার করে সুতো, লাটাই, ঘুড়ি কিনব। মাঞ্ঝা দেব জবরদস্ত, পিছনে আবর্জনার ডাঁইটার পাশে, দুজনে মিলে। তারপর প্রত্যেক রোববার শালা ওরই ঘুড়ি তাক করে কাটব। ঘুড়ি ওড়ানোই বন্ধ করে দেব।

শঙ্করের খেয়ালই ছিল না, কখন ও ঘুমিয়ে পড়েছে মেঝেতেই।

 

কয়েকদিন পর। মোতি হইহই করতে করতে ঢুকল। ওর বাবা ওকে একটা নতুন লাটাই, সুতো আর ঘুড়ি কিনে দিয়েছে। কিন্তু শঙ্কর অন্যকিছু ভাবছে।

-       একবার যাবি? মৌলবী সাহেবের দোকানে?

-       কেন?

-       চলই না।

মৌলবী সাহেব দোকানেই ছিলেন। বিক্রির জন্য নতুন আনা কয়েকটি ঘুড়ি তখনও ভিতরে যত্নে রাখা ছিল।   

-       মৌলবী সাহেব, আপনি তো মাঞ্ঝা দেওয়া সুতোও রাখেন।

-       সবসময় থাকে না, তবে এখন আনিয়েছি। চাই?

-       না, বলছিলাম, আমরা যদি সুতোয় মাঞ্ঝা দেওয়ার কাজ নিই, আপনি আমাদের লাটাই আর সুতোর যোগাড় দেবেন?

-       ধারে?

-       হ্যাঁ। একবারই দিয়ে দেখুন না! আমরা সস্তায় দেব।

মৌলবীসাহেব স্থির দৃষ্টিতে শঙ্করের দিকে তাকান। তাঁর মনে পড়ে যায়, এ ছেলেটাই সেদিন মিছিমিছি মার খেয়েছিল দুটো বেয়াদব চ্যাংড়ার হাতে। ওর মাকেও উনি চেনেন। বললেন, তোমার মাকে ডেকে আনো, উনি রাজি হলে তবে দেব।

শঙ্কর পড়ল ফ্যাসাদে। তবু হাল ছাড়ল না। দুপুরে ধরল মাকে। বুঝিয়ে সুঝিয়ে রাজি করিয়ে মৌলবী সাহেবের কাছে নিয়ে এল। মৌলবী সাহেব কথা দিলেন, বিকেলে দিয়ে দেবেন জিনিষ। ততক্ষণে মোতিরও রং লেগেছে। পিছনে আবর্জনার ডাঁইয়ে ভাঙা বাল্ব, শিশি, ডিমের খোলা এন্তার পাওয়া যাবে। অন্য আবর্জনার ডাঁই থেকেও আনা যাবে। শিরিষের গঁদ দুজনে মিলে পার্ক থেকে আনবে। বাকি জিনিষ দুজনে মিলে যোগাড় করবে। আঠা জ্বাল হবে শঙ্করের ঘরে। কাঁচ পেষাও হবে তার ঘরে শিলনোড়ায়। মাকে কথা দিল ভালো করে ধুয়ে রাখবে শিলনোড়া, নইলে মায়ের কথা মত কাঁচের গুঁড়োই খাবে।

কয়েক সপ্তাহ পর। ওই আবর্জনার ডাঁইয়ের একপাশে পাত্রভরা মাঞ্ঝার মশলা রাখা আছে। কালুয়া একদিকে লাটাই ধরে দাঁড়িয়ে। সেই সুতো শঙ্করের হাতের মশলার দলার ভিতর দিয়ে আস্তে আস্তে টানছে মোতি। তারপর, এধারের দেয়াল থেকে ওধারের দেয়াল অব্দি সুতো ফাঁসাচ্ছে রোদে শুকোতে। মশলায় রংও দেওয়া হয়েছে। তাই নিচের রাস্তা থেকে দেখলে আকাশের গায়ে গোলাপি সুতোর তারগুলো দেখা যাচ্ছে।  

মোতি, শঙ্কর আর কালুয়ার কাজকর্ম দেখে উৎসাহিত আরো দুএকটি বাচ্চা ছেলে দাঁড়িয়ে দেখছিল। তখনই মৌলবীসাহেব এলেন। খুশি-খুশি ভাব।

-       ভালো খবর আছে শঙ্কর! তোমাদের তৈরি সুতো বিক্রি হয়েছে। খুব ভালো মাঞ্ঝা দিচ্ছ তোমরা।

কাছে এসে, সুতোর শুকিয়ে আসা অংশে আলতো করে আঙুল ছুঁইয়ে ফিরে তাকালেন। হাল্কা হাসিতে রহস্য এনে বললেন, ধারের পরখ আছে তোমাদের, মানতে হবে।   


No comments:

Post a Comment