আঠেরোশো সাতান্নর ভারতীয়
বিদ্রোহের সত্যকাহিনীটি, সমসাময়িক ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ ও কালপঞ্জীলেখক রচিত
ইতিবৃত্তসমূহ এবং খোদ ব্রিটিশ শাসককূল কর্তৃক বিভিন্ন মহাফেজখানায় রক্ষিত যাবতীয় সামগ্রী থেকে আহরণ
করেই পুনর্গঠন করা সম্ভব । ভারতীয় দিক থেকে যথার্থ ঐতিহাসিক সামগ্রীর দুঃখজনক অভাব
রয়েছে । কারণ দুটো । প্রথমতঃ ঐতিহাসিক নথীপত্র রেখে চলার পরম্পরা ভারতে ছিলনা ।
দ্বিতীয়তঃ, ১৮৫৭র সংগ্রামের অসফলতার পর যে সন্ত্রাসের পরিবেশ গড়ে উঠেছিল, তাতে
কোনো ভারতবাসীর পক্ষে তার নিজস্ব বয়ানে কাহিনীটি লেখার চেষ্টা করা ছিল বিপজ্জনক ।
মুষ্টিমেয় যে ক’জন সমসাময়িক ভারতবাসী এ বিষয়ে লিখেছিলেন তাঁরা কাজটা ব্রিটিশদের
জন্য করেছিলেন ।
এমত পরিস্থিতিতে ১৮৫৭
সম্পর্কিত লোকগীতিগুলি অত্যন্ত মূল্যবান আকরসামগ্রী । ঐতিহাসিক বিবরণীর
পূঙ্খানুপূঙ্খতার দিক থেকে লোকগীতিগুলি খুব বেশী বিশ্বাসযোগ্য না হতে পারে কিন্তু
অন্য অনেক ভাবে তারা উপযোগী । তাদের প্রধান ও পরম মূল্য এই তথ্যে যে তারা যে জনতার
প্রতিচ্ছবি সে জনতার দৃষ্টিভঙ্গির খুব প্রামাণ্য দলিল । আজকের ভারতীয় ইতিহাসবিদদের
জন্য ১৮৫৭ নিয়ে রচিত এ লোকগীতিগুলি, ১৮৫৭র বিদ্রোহ ও তৎপরবর্ত্তী সময়ের আমাদের
সাধারণ মানুষজনের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা, দৃষ্টিভঙ্গি ও আকাঙ্খাগুলি অনুধাবন করার
পথনির্দেশক । তাদের সাহায্য নিয়ে আমরা ব্রিটিশ আকরসামগ্রীগুলো আরো সমর্থ ও
নিশ্চিতভাবে ব্যবহার করতে পারি ।
এই সংকলনে [যে সংকলনের ভূমিকা
পূরণ চন্দ যোশীর এই প্রবন্ধ - অনু∙] প্রকাশিত গান ও গীতিকবিতাগুলি পুরো একটি বছরের প্রয়াসে
আমি সংগ্রহ করতে পেরেছি । যদি একজন মানুষ এতগুলো সংগ্রহ করতে পারে তাহলে ভাবুন যে
আমাদের জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের একটি মহান ঘটনার ইতিহাস লেখার জন্য জনমানসে জীবিত
লোকশ্রুতি থেকে খাঁটি ও ভালো সামগ্রী সংগ্রহ করার কী বিরাট স্বর্ণখনি আমাদের
গবেষণাকর্মীদের সামনে অনাবিষ্কৃত পড়ে রয়েছে ।
এই লোকগীতিগুলির সঠিক
মূল্যায়ণের জন্য ১৮৫৭র জাতীয় বিদ্রোহের পটভূমিটা স্মরণ করা জরুরী ।
অভ্যুত্থানটির জাতীয় রাজনৈতিক
চরিত্র এই তথ্যের মাধ্যমে স্পষ্ট হয় যে তদানীন্তন ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেল লর্ড
ক্যানিং, প্রথমে একে ‘সিপাহি মিউটিনি’ নামে পরিভাষিত
করেছিল । কিন্তু খুব শীগ্গিরই সে ‘রেবিলিয়ন’ এবং ‘রিভোল্ট’ শব্দগুলি ব্যবহার করতে বাধ্য হয় । ডিজরায়েলি সে সময় ব্রিটিশ
সংসদে বিরোধী দলনেতা ছিলেন এবং অভ্যুত্থান বিষয়ে তাঁর বক্তৃতায় তিনি বললেন যে ইস্ট
ইন্ডিয়া কম্পানির নীতিই - “জাতীয়তা ধ্বংস করার নীতি” – এর কারণ ।
লন্ডন টাইমসের খ্যাতনামা সংবাদদাতা রাসেল্স, যিনি এই অভ্যুত্থান সম্পর্কে
প্রতিবেদন লিখতে ভারতে এসেছিলেন, দেখেশুনে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন যে এই
অভ্যুত্থান “বিজাতীয়দের চাপিয়ে দেওয়া জোয়াল ছুঁড়ে ফেলার, দেশীয়
অধিপতিদের পূর্ণশক্তিতে পুনর্স্থাপিত করার এবং দেশীয় ধর্মমতগুলির পূর্ণ প্রভাব
ফিরিয়ে আনার জাতীয় সংকল্প ।”
আঠারোশো সাতান্ন খ্রীষ্টাব্দে
ব্রিটিশেরা তাদের ‘বিভেদী-শাসন’ নীতির অনুসরণে ভারতের এক অংশের
সাহায্য নিয়ে আরেক অংশকে জয় করতে করতে দেশটির স্থানিক সীমান্তে পৌঁছে গিয়েছিল এবং
ভারতের স্বাধীনতাপ্রাপ্তির আগে যে ভূভাগটিকে ‘ব্রিটিশ ভারত’ বলা হত তার সবক’টি এলাকা তাদের
দখলে চলে এসেছিল । সমসাময়িক একটি অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান পত্রিকায় তৎকালীন পরিস্থিতি সম্পর্কে
ভারতবাসীদের দৃষ্টিভঙ্গী এভাবে বিবৃত হয়, “দেশীয়রা ইংরেজদের
তুলনা করে সাদা-পিঁপড়ের সাথে । মোক্ষম তুলনা বটে ।”
১৮৫৭র বিদ্রোহের প্রাথমিক
উদ্দেশ্য ছিল তাহলে বিদেশীদের বিতাড়িত করা, বিজাতীয় ফিরিঙ্গি শাসন শেষ করা এবং
জাতীয় সার্বভৌমতা ফিরে পাওয়া ।
শুধু বিজাতীয় শাসন চাপিয়ে
দেওয়া নয়, ব্রিটিশ আধিপত্যের অর্থ ছিল ভারতের পারম্পরিক সমাজব্যবস্থার ধ্বংস । তারা
ভারতের ভূমি-ব্যবস্থা ওলটপালট করে দিল । তারা ভারতের বাণিজ্য, শিল্প এবং কারিগরী
উৎপাদন প্রণালী ধ্বংস করে দিল । তারা সার্বিক বিধ্বংস ছড়িয়ে দিল চারদিকে ।
থমাস লো রচিত ‘বিদ্রোহকালীন
মধ্যভারত’ শীর্ষক একটি সমসাময়িক ইতিবৃত্তে পরিস্থিতির বর্ণনা করা
হয়েছে (পৃ ৩৫৭-৩৫৮) এভাবে, “...ধ্বংস, ধ্বংস, দারিদ্র... যেন এক কুষ্ঠরোগী স্পর্শ
করেছে এই ভূমি, সবকিছু তীব্র ভাবে ক্ষয়ের দিকে চলেছে... যার ব্যবহারযোগ্য চোখ ও
কান রয়েছে সে এক মুহূর্তের জন্যও সন্দেহের বশীভূত না হয়ে বোঝে যে এত শক্তিশালী
একটি দেশের সমস্ত সম্পদ আমরা প্রায় সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেছি, আর আমাদের কারিগরী
উৎপাদনশীল শহরগুলোর আবর্জনা এই ভূমির প্রতিটি খাঁজে ঢুকিয়ে দিয়েছি... প্রতীত হয়
যেন আমরা পশ্চিমের বাণিজ্য সামগ্রী দিয়ে এই দেশের সমস্ত সহজাত প্রয়োজনীয়
উৎপাদনগুলি ধ্বংস করার উদ্যম চালিয়েছি এতদিন ।” লো সাহেব এক
বৃদ্ধ গ্রামীণের কথা উদ্ধৃত করেন, “জঙ্গলগুলোও, সাহেব ! গাছ, নদী, কুঁয়ো, সমস্ত গ্রাম আর সবক’টি পবিত্র শহর
সরকারের দখলে ! তারা সব নিয়ে নিয়েছে, সমস্ত কিছু ! ভালো, ভালো ! কিইবা করতে পারি আমরা
?”
এই হতাশাব্যঞ্জক পরিশিতি থেকে
বিদ্রোহে কৃষকদের গণঅংশীদারী সম্ভব হয়েছিল । অবশ্যই ব্রিটিশ নীতির দ্বারা সমভাবে
আক্রান্ত হয়েছিল জমিদার ও চাষী, বণিক ও কারিগর ইত্যাদি সবক’টি ভারতীয় শ্রেণীর
স্বার্থ । তারা সবাই নিজেদের জীবিকা বাঁচাতে রুখে দাঁড়িয়েছিল আর এতেই বিদ্রোহটি গণ-অভ্যুত্থানের
চরিত্র পায় ।
ঠিক এই সময়টাতেই রূপ গ্রহণের
প্রক্রিয়াতে ছিল আধুনিক হিন্দী । হিন্দী ও তার বিভিন্ন উপভাষাগুলি উত্তর ও
মধ্যভারতের সেই বিশাল অঞ্চলের জনতার মাতৃভাষা ছিল যে অঞ্চল এই জাতীয় অভ্যুত্থানের
প্রধান আধারভূমি ।
সমসাময়িক হিন্দী কবিরা, যাঁরা
আজ হিন্দী সাহিত্যের সাহিত্যিক পরম্পরায় বিশেষ স্থান গ্রহণ করে থাকেন – যে ঘটনাবলীর
মধ্যে তাঁদের জীবন অতিবাহিত হল এবং যে সমস্যাগুলো তাঁদের দেশ ও জনতার সামনে ছিল সেগুলোর
প্রতি কী ধরণের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন ? এ প্রসঙ্গে তাঁদের রচিত পংক্তিগুলি স্মরণ
করা উপযোগী ।
পন্ডিত যজ্ঞদত্ত তেওয়ারী
লিখলেন –
ভারতের দুর্দশার প্রতি তাদের কোনো দৃষ্টি নেই, বিলাসে
মত্ত ।
কোথাও সেই শৌর্য্য বিক্রমের;
রাজা ভোজের অবশিষ্ট নেই কিছু;
রাজধানী ডুবে আছে উচ্ছৃংখলতায়;
কোথায় কনৌজের সেই দীপ্তি ?
‘ভারত’ শব্দটি ব্যবহার করা হচ্ছে এসময়, তার দুঃখদুর্দশা কষ্ট
দিচ্ছে, আমাদের মহান ঐতিহাসিক অতীতের প্রতিতুলনায় দেখানো হচ্ছে সেই ভারতীয়
সামন্তদের নিষ্কর্মাপনা যারা ভারতীয় সমাজের শীর্ষে আসীন ছিল ।
ভারতেন্দু তাঁর বিখ্যাত নাটক ‘ভারত দুর্দশা’য় লিখলেন –
হায়, হায় ! ভারত দুর্দশা আর দেখা যায় না কো !
হল অন্ধ, পঙ্গু সবে, দীন হীন, কাঁদে অবিরত ।।
সুখী সাজসজ্জা বেশ ধরে এই ইংরেজ শাসন ।
অথচ বিদেশে সব চলে যায় এ দেশের ধন ।।
তার ওপর দুর্মূল্য, কালরোগ ক্রমশঃ ছড়ায় ।
দিনে দিনে দুঃখ আরো আরো বেড়ে চলে হায় ।।
সবার ওপরে এই ট্যাক্সোর বিপদ শিয়রে ।
হায় হায় ! ভারত দুর্দশা আর
দেখা যায় না রে ।।
আবার ব্রিটিশ অর্থনৈতিক শোষণের
বিষয়ে তিনি লিখলেন –
লুন্ঠন চালায় ওরা এদেশের বুকে, যন্ত্রবলে
সম্পদ কমতে থাকে প্রতিদিন, দুঃখ বেড়ে চলে
আমাদের হাত বাঁধে ওদের মসলিন, কাপাস
আমরা আজ বিদেশী তাঁতীদের দাস
সামান্য জিনিষটাও বিলেতের আমদানী করে
প্রতিদিন আনা হয় জাহাজের খোলে
ভরে ভরে ।
আকাল এবং ভারতের উৎপাদিকা
শক্তির সংহার ইত্যাদিও সমসাময়িক হিন্দী কবিতায় প্রতিফলিত হয় । নজীর হিসেবে বদ্রী
নারায়ণ চৌধুরী ‘প্রেমঘন’এর পংক্তি –
পালাও ! পালাও ! ভয়াবহ এক এসেছে আকাল !
ভারত ঢাকছে ধ্বংসের কালো মেঘের তাল !
ধুলোয় মিশেছে বাণিজ্য আর সদাগরীটাও !
শিল্প ও উদ্যমগুলিও, সব উধাও !
বরবাদ হয়ে রয়েছে ক্ষেতে যত কৃষিকাজ !
দুর্মূল্যের আগুন লেগেছে
চারদিকে আজ ।
১৮৫৭র বিদ্রোহের প্রসঙ্গ
একবারই এসেছে ভারতেন্দুর রচনায় । বিদ্রোহ পরবর্ত্তী ব্রিটিশ আতঙ্কের দিকে আঙুল তুলে
তিনি বলেন –
সিপাহী বিদ্রোহের আগুন প্রশমিত
করা হল নৃশংসতায়,
আতঙ্কে ভারতবাসীরা তাদের মাথা নাড়তে সাহস করেনি ।
অন্যান্য প্রধান হিন্দী কবিরা
অবশ্য, ১৮৫৭র প্রসঙ্গে সরাসরি আসতে হলে এধরণের জাতীয় অনুভুতির বহির্প্রকাশ ঘটান নি
। প্রতাপ নারায়ণ মিশ্র লিখলেন যে যখন ১৮৫৭য় সেনাবাহিনী বিদ্রোহ করল তখন “জনতা দৃঢ়ভাবে সরকারের পক্ষে ছিল” । নিশ্চিত যে এটা সত্য নয় । এটা নিছক ব্রিটিশ শাসকের সুনজরে
আসতে কবির চেষ্টার প্রতিফলন । ‘প্রেমঘন’ মশাই এটাও বলে ফেললেন যে অভ্যুত্থানের পিছনে ছিল ভ্রান্ত ধারণা
এবং যারা বিদ্রোহ করেছিল তারা “নিজেদেরই ধ্বংসের বীজ বুনে ব্যাপক ক্ষতির কারণ হয়েছিল” । ব্রিটিশ শাসনের বিষয়ে এদের আগের কবিতাগুলির সাথে উপরোক্ত
উদাহরণসমূহের চমকপ্রদ বৈপরীত্য, এই কবিদের জাতীয় ও সামাজিক চেতনার স্বরূপ উদ্ঘাটিত
করে ।
ঐতিহাসিক দিক থেকে কারণগুলো বোঝা
যায়। আগের পংক্তিগুলো বিদ্রোহের আগে লেখা এবং বিদ্রোহ নিয়ে লেখাগুলো বিদ্রোহের
অসফলতার পর সন্ত্রাসের ছায়ায় লেখা । পরাজয়ের পর দেশভক্তিতে ভরসা জিইয়ে রাখা সহজ
নয়। তার ওপর আবার এই সব কবিরা তখন পর্য্যন্ত সামন্ততান্ত্রিক ভাবধারার প্রভাবে
ছিলেন ।
যদি পারম্পরিক হিন্দী কবিরা ১৮৫৭র
বিদ্রোহের পক্ষে দৃঢ়ভাবে দাঁড়াতে না পেরে থাকেন তাঁদের সেই বিচ্যুতি এক রাজস্থানী
কবি আড়াল করে দিয়েছিলেন । সুরজমল ছিলেন বুন্দির দরবারের সভাকবি । তিনি গোটা
রাজস্থানের সবক’জন রাজকুমার এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সাথে অবিরাম চিঠিপত্র
লিখে তাঁদের, জাতীয় অভ্যুত্থানের সফলতার জন্য সর্বস্ব দান করতে রাজি করার প্রয়াস করেছিলেন
। তাঁর সেই দেশাত্মক ভবিষ্যৎ-দৃষ্টি ছিল যার ফলে তিনি ১৮৫৭র অভ্যুত্থানে ভারতের
মুক্তির সুবর্ণ-সুযোগ দেখতে পাচ্ছিলেন । ঠাকুর ফুলচন্দ সিংকে একটি চিঠিতে তিনি
লিখেছেনঃ-
“এই রাজারা, যারা দেশের সমস্ত ভূসম্পত্তির মালিক ...... এরা
নিজেরাই চল্লিশ, ষাট বা সত্তর বছর পিছনে নিক্ষিপ্ত হয়েছে আর তবুও [ব্রিটিশদের]
গোলামী করছে । কিন্তু আমার এ ভবিষ্যৎবাণী মনে রাখুন, যে যদি বৃটিশেরা এবারের মত
বেঁচে বেরিয়ে যেতে পারে তাহলে ওরা [ব্রিটিশেরা] ওদের [রাজাদের] পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন
করে দেবে। কেউ আর নিজের
রাজত্বে প্রভু থাকবেনা । সবাইকে খ্রীস্তান করে দেওয়া হবে । যদি আমরা একটু দূরদৃষ্টি
রাখি আমরা সহজে দেখতে পাবো যে [ব্রিটিশ শাসনে] কারো কোনো লাভ হবার নয় । যদি
[ভারতবর্ষের] দিন ভালো হয়ে ওঠে তাহলে আমি আবার তার বিষয়ে চিন্তা করব এবং তার
প্রশস্তি গাইবার ছক কষব এবং [আমার কবিতায়] তাকে মহিমান্বিত করব । আমি বেশি লিখছিনা
কিন্তু আমার অর্থ প্রশস্ত ।” এই
বিচক্ষণ পংক্তিগুলো এমন এক পারম্পরিক সামন্ততান্ত্রিক কবির লেখা যিনি নিতান্ত প্রাথমিক
স্তরের তবু উগ্র দেশপ্রেমের ভাবনায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন । তিনি কিছু ‘গদর সম্পর্কিত দোহা’ লিখে রেখে গেছেন। অনুবাদ করা কঠিন তবু নিচে চেষ্টা করা
হয়েছে ।
বিক্রম সম্বৎ বর্ষ উনিশশো চোদ্দ হল শেষ ,
পাঁচই জৈষ্ঠ, বিষ্যুৎ, ছোবলের পাল্টি খেল ফণী ।
যে অরণ্যে ভুলেও কখনো বুনো ভালুক, গন্ডার
কিম্বা হাতিও যায় না; নাচে আজ ঢ্যাঙা শেয়ালেরা ।
চুমরিও না গোঁফান্ত; তোমাকেই চুমরে দেবে কাল –
কালের ঘরে ইঁদুর, গুঁফো মুখ, চিবিয়ে বেড়ায় ।
শুওর খায় সবুজ, ঝিলজল কাদা করে হাতি ,
সিংহিনির প্রেমে বুঁদ, সিংহ ভোলে জীবনের দাঁও ।
বেজাতের দয়া শোঁকো হে ঠাকুর! রেখো না নামে সিং –
ও নাম থাবায় হাতি ফেলে ধন্য; হয়না কো ভেড়া ।
বংশগুণ-দায় ভুলে বিজাতীয় দোরে নাড়ো ল্যাজ ,
আলস্যে, সুখবাসরে দামি আয়ু যায় তোমাদের ।
কেল্লা থেকে বার হওয়া তোমাদের জীবন বেরোনো ,
কেল্লা বিনে মৃত বই কিছু নও, থাকে শুধু নাম ।
‘কী কাজ লোভের ধনে?’ প্রশ্ন করে ভীরুর পত্নিটি
‘একে একে খোঁটে পোকা, লহমায় ওড়ায়
তিত্তির’ ।
জীর্ণ কুঁড়ে, মাটির দেয়ালে ঘাস, সব রক্তদাগ ;
ধিক্ অধিপতিগণ, তোমাদের উচ্চ রাজবাড়ি ।
প্রাসাদ-লুটেরা ওরা, কুঁড়েগুলো, ভাবে অভিশাপ ;
শূন্য ঘরে মৃত্যু পাবে নিশ্চিত,
লুটতে এলে কুঁড়ে ।
আমি অন্য কোনো সমসাময়িক কবির
বিষয়ে জানিনা যিনি এতদূর অব্দি ভেবেছিলেন এবং এত তীব্র অনুভূতি দিয়ে লিখেছিলেন ।
প্রথমে তিনি রাজকুমারদের নেতৃত্ব দিতে ডাকলেন কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই তাদের আসল
ভূমিকা তাঁর কাছে প্রকট হয়ে পড়ল আর কী তীব্র ভাবে তিনি তাদের ভর্ৎসনা করলেন ! এই
ব্যাপারটা কবিকে অত্যন্ত আধুনিক করে তোলে । পারম্পরিক সামন্ততান্ত্রিক কবি হিসেবে
তিনি আগেই খ্যাতি অর্জন করেছিলেন । কিন্তু ত্বরিতে পরিপূর্ণ হতে থাকা দেশপ্রেমের
কর্ত্তব্যবোধ তাঁকে, কুলীন লোকশ্রুতি এবং সামন্ততান্ত্রিক বীরধর্মের নিপূণ
চিত্রকল্পগুলোকে ব্রিটিশদের ক্রীড়নক সামন্তদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে বাধ্য করল ।
যখন নাকি ওই সামন্তরাই তাঁর রাজকীয় পৃষ্ঠপোষক ছিল এবং পরম্পরাগত ভাবে রাজস্থানের
নেতৃত্ব তাদেরই হাতে ছিল । এভাবে সুরজমল আমাদের সেই প্রবর্তক জাতীয় কবি হওয়ার
মর্যাদা পান, যিনি সামন্ততান্ত্রিক ভাবনাচিন্তার কাঠামোয় আবদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও
সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী, এবং জীবন্ত অভিজ্ঞতার মাধ্যমে সামন্তবাদ-বিরোধী হয়ে ওঠেন ।
নিজের চারদিকে রাজস্থানী দরবারগুলোয় দেখতে থাকা সামন্ততান্ত্রিক ক্ষয়িষ্ণুতার
বিরুদ্ধে, বীরধর্মের সামন্ততান্ত্রিক মূল্যগুলো ব্যবহার করে তিনি নিজের চিন্তায় এই
বৈপ্লবিক ভাঙন আনতে সফল হন ।
বিদ্রোহীদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং
আশাআকাঙ্খাগুলি সহজ ও মর্মস্পর্শী শব্দে তাদের পতাকা-গান ‘কৌমী তরানা’য় বিধৃত হয়ে আছে । এটি প্রথম প্রকাশ পায় সমসাময়িক ‘পয়ামে আজাদী’তে, আর মূল প্রতিলিপি, শোনা যায় ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রক্ষিত আছে । নিচের বয়ানটি পন্ডিত
সুন্দরলাল সম্পাদিত ‘নয়া হিন্দ’ থেকে নেওয়া ।
১৮৫৭ পতাকা-গান
আমাদের হিন্দুস্তান আমাদের – আর কারো নয় ।
পবিত্র মাতৃভূমি প্রিয়তর
স্বর্গ হতে ,
এ বিশ্ব আলোকিত তার অন্তর্জ্যোতির ছটায় ।
পুরাতন তবুও নবীন এক
ও অদ্বিতীয়
আমাদের হিন্দুস্তান আমাদের
– আর কারো নয় ।
গঙ্গা ও যমুনার জলে আমাদের
ভূমি উর্বর
এবং হিমাদ্রি শিরে আমাদের প্রহরী বিরাট ।
নিম্নে তটের তালে তালে বেজে চলে সাগরের শিঙা ।
উপচিয়ে ওঠে আমাদের সোনা ও হীরের যত খনি ।
আমাদের ঐশ্বর্য ইর্ষ্যা জাগায় দুনিয়ার ।
এরি মাঝে ফিরিঙ্গি এসে কেমন যাদুতে করে বশ
মাতৃভূমিতে হয় লুট- ধ্বংসের
শাসন কায়েম ।
দেশবাসী! শুনছ কি ডাকে – শহীদেরা ডাকে
তোমাদের ?
দাসত্ব-শৃঙ্খল ভাঙো বুকের
আগুন ওগরাও ।
হিন্দু, মুসলমান, শিখ – সবাই আমরা
ভাই ভাই ।
মুক্তি-পতাকা
আমাদের ধরো উঁচু ! সেলাম জানাও !
কিছু
স্বনামধন্য ভারতীয় ইতিহাসবিদ একটি তত্ত্বের প্রচার করেন যে ১৮৫৭র ভারতে জাতীয়
অনুভূতি বলে কিছু ছিল না । বিদ্রোহীরা দেশপ্রেমের ভাবনায় উদ্বুদ্ধ হননি । ১৮৫৭র
পতাকা-গান এসব তত্ত্বের সবচেয়ে ভালো জবাব । যে জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম ভারতকে
স্বাধীনতা এনে দিল তার ভিত্তিমূলক ধারণা ও ভাবনাচিন্তাগুলো বেশির ভাগই এই গানটিতে
রয়েছে ।
লোকগীতিগুলিকে
আকরসামগ্রী হিসেবে দাঁড় করান এবং ব্যবহার করার আগে ওই সময়টির ঐতিহাসিক সামাজিক
ব্যবস্থার সঠিক মূল্যায়ণ করা জরুরি। ১৮৫৭কালীন সময়ে সামন্তরা ভারতীয় সমাজের প্রধান
শ্রেণী তো ছিলই এমনকি আপামর জনসাধারণও সামন্ততান্ত্রিক ভাবধারার প্রভাবে ছিল । এই
লোকগীতিগুলির পিছনে যে দৃষ্টিভঙ্গি কাজ করতে দেখা যায় তাতে এটা স্পষ্ট । শুধু তাই
নয় । ভালো করে পড়লে দেখা যায় কীভাবে দেশপ্রেম জন্ম নেয়, কীভাবে সামন্ততান্ত্রিক
সমাজে ও চিন্তাপ্রণালীর ভিতরে তা বিকশিত হয় এবং কীভাবে তা শেষ অব্দি ওই সামাজিক ও
ভাবধারাগত বন্ধন ভেঙে ফেলে এগোয় ।
এই
লোকগীতিগুলির সবক’টির ভিতরে যোগসুত্রের
মত রয়েছে ফিরিঙ্গির, বিদেশি জবরদখলকারীর প্রতি জ্বলন্ত ঘৃণা । ঘৃণা তার বিজাতীয় শাসনের
বিরুদ্ধে, ভারতের পারম্পরিক জীবনপ্রণালীতে ভাঙন ধরানোর বিরুদ্ধে, সাধারণ মানুষের
দৈনন্দিন জীবনে দুর্দশা হানার বিরুদ্ধে । ফিরিঙ্গির বিরুদ্ধে ঘৃণায় রয়েছে তীব্র
আবেগ এবং এ ঘৃণা অমর ।
ফিরিঙ্গির
বিরুদ্ধে লড়াই সবচেয়ে মহৎ কাজ হিসেবে দেখানো হয়েছে এই গীতিসমূহে । সর্বাধিক
প্রশংসিত গুণ হিসেবে ধরা হয়েছে বীরত্ব, সাহস এবং আত্মত্যাগ । নিষ্ক্রিয়তা এবং
বশ্যতাকে দেখানো হয়েছে সবচেয়ে বেশি লজ্জাজনক কলঙ্ক হিসেবে ।
সংগ্রামের
মধ্যে দিয়ে বিভিন্ন জাতি ও সম্প্রদায়ের যে ঐক্য দেখা দিয়েছে তার ওপর গড়ে তোলা
হয়েছে নিজেদের উদ্দেশ্যের প্রতি মহান আস্থার দৃঢ়তা । সংগ্রামের সফলতার জন্যেও এই
জনপ্রিয় ঐক্যকে প্রয়োজনীয় মনে করা হয়েছে । সংগ্রামের আগুনে জাতীয় ঐক্যের এই
অভিজ্ঞতা ভারতকে সামন্ততান্ত্রিক অনৈক্য থেকে জনপ্রিয় ঐক্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছে
এবং একটি আধুনিক জাতীয় আন্দোলনের নির্মাণ সম্ভব হয়েছে ।
সেইসব ভারতীয়
ইতিহাসবিদগণ যারা এই অভ্যুত্থানের জাতীয় জনপ্রিয় চরিত্রটি অস্বীকার করেন তাঁরা
বলেন যে এটি একটি প্রতিক্রিয়াশীল বিস্ফোরণ ছিল । এটি সফল হলে নাকি সামন্ততন্ত্রের
পুনরুজ্জীবন ঘটত । তাঁরা এই তথ্যটির ওপর খুব জোর দেন যে বিদ্রোহীরা মোগল বাদশাহ
বাহাদুর শাহকে দিল্লীর এবং নবাব ওয়াজেদ আলি শাহকে লখনউএর সিংহাসনে বসান আর এধরণেরই
সব কাজ করতে চাইছিল ।
উপরুল্লিখিত
তথ্যটি ইতিহাসের দিক থেকে সত্য । কিন্তু এই কাজটির ভিত্তি ছিল এক গভীর ও সুস্থ
জাতীয় আবেগ যে নিজেদের শাসক যে কোনো বিদেশি শাসক থেকে ভালো । লন্ডন টাইমসের
সংবাদদাতা হিসেবে রাসেল্স ভারতের বহু স্থানে ঘুরেছিলেন । তিনি তাঁর ডাইরিতে
লিখেছেন, “ভারতের জনতার, আমাদের
শাসন-প্রণালীর প্রতি কোনো আস্থা নেই” । লর্ড ডালহাউসির রোলার-চালানো
রাজত্বের সময় তাঁর কাউন্সিলের এক সদস্য কর্ণেল লো কার্যবিবরণীতে লিখছেন, “সব দিক থেকে এতদ্দেশীয়রা, পরিচিত ভূভাগের অধিবাসীদেরই
অনুরূপ । তারা বিদেশিদের থেকে নিজেদের রীতিরেওয়াজগুলো বেশি পছন্দ করে ।” অভ্যুত্থানকালে ব্রিটিশ পক্ষের এক ভারতীয় সাংবাদিক মুন্শী
মোহনলাল লিখছেন, “এইসব [বিদ্রোহী] এলাকার
জনতা, ব্রিটিশদের স্থানে ভারতীয়দের শাসক হিসেবে বেশি পছন্দ করত ।”
উনবিংশ শতাব্দীর
সেই ঐতিহাসিক পরিস্থিতিতে যখন ইংরেজের জয়যাত্রা একের পর এক দেশীয় রাজ্যগুলোকে
পদানত করে এগিয়ে চলেছে, তখন কি এটাই স্বাভাবিক নয় যে ভারতের জনগণ নিজেদের জাতীয়
সার্বভৌম ক্ষমতা রক্ষা করতে এবং ফিরে পেতে পারম্পরিক শাসকদের পিছনে গিয়ে দাঁড়াবেন ?
তৎকালীন পরিস্থিতিতে এইসব ক্ষমতাচ্যুত শাসকেরাই সার্বভৌম ভারতের একমাত্র প্রতীক
হতে পারত । সমসাময়িক ব্রিটিশ দিনপঞ্জীলেখক এবং কর্তৃপক্ষেরা ঘটনাটিকে এভাবেই
দেখেছিল এবং তাই ১৮৫৭র অভ্যুত্থানকে ‘জাতীয়
বিদ্রোহ’ হিসেবে চিহ্নিত
করেছিল ।
আবার
এটাও সত্য যে যদিও বিদ্রোহীরা মোগল রাজবংশের প্রতিনিধিকে দিল্লীর সিংহাসনে এবং আউধ
রাজবংশের প্রতিনিধিকে লখনউএর সিংহাসনে বসিয়েছিলেন, তাঁরা কোনোভাবেই ভারতীয়
সামন্ততন্ত্র কিম্বা মধ্যযুগীন স্বৈরতন্ত্রের পুনরুজ্জীবন ঘটাতে চান নি । এই সব
পারম্পরিক শাসকেরা নিছক প্রতীক হিসেবে গণ্য হত, আসল ক্ষমতা ছিল সশস্ত্র বিদ্রোহী
সেপাইদের হাতে । এই সব সেপাইরা ভারতের পরিশ্রমী বলিষ্ঠ চাষীকূল থেকে এসেছিলেন ।
জাতীয় মহাফেজখানায় বিদ্রোহীদের আদালতের যে কাগজপত্র সুরক্ষিত রয়েছে তা থেকে প্রমাণ
হয় যে অভ্যুত্থানে বিদ্রোহী সেপাইদের সামূহিক নেতৃত্ব ছিল । বলতে গেলে এই নেতৃত্ব,
১৮৫৭র অভ্যুত্থানে জন্ম নেওয়া নতুন সংগঠিত বিপ্লবী শক্তি ছিল । এই নেতৃত্বের ওপর
ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সামরিক গতিবিধি পরিচালনার সর্ব্বোচ্চ দায়িত্ব তো ন্যস্ত ছিলই,
দেশের নাগরিক প্রশাসনের ভারও এই নেতৃত্বের হাতে ছিল । বাহাদুর শাহ শুধু ফর্মান আর
ঘোষণায় স্বাক্ষর করত এবং এক ধরণের সাংবিধানিক রাজা হিসেবে কাজ করত । গরীবদের বাদ
দিয়ে শুধু ধনীদের সিন্দুক থেকে যুদ্ধের জন্য অর্থ জোটানোর নির্দেশ এই নেতৃত্বই দিত
। ইংরেজদের চালানো ভূমিরাজস্ব-প্রণালীর বিরুদ্ধে ঘোষণা করেছিল এই নেতৃত্ব এবং
লাঙল-যার-জমি-তারএর ডাক দিয়েছিল । লালকেল্লার ভিতরে এই নেতৃত্ব এক নতুন ও গণমুখীন
আবহাওয়া সৃষ্টি করেছিল – মোগল-বংশজ সম্রাট
যখন সিদ্ধান্ত নিতে ইতঃস্তত করত বা ভয়ে পশ্চাৎপদ হত তখন ফৌজিরা সামরিক বুট পরে
কুচকাওয়াজ করে দেওয়ান-ই-খাসএ ঢুকে পড়তেন এবং “আরে বুড়ো! আরে বাদ্শাহ!” বলে বাহাদুর শাহকে নাড়িয়ে দিতেন ।
এমনই ছিল
ভারতীয় জনতার অগ্রবাহিনী বিদ্রোহী সেপাইদের নতুন রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা এবং
বৈপ্লবিক কর্মকান্ড । এমনই ছিলেন ভারতের সাধারণ জনগণ যাঁদের হৃদয় থেকে এই
লোকগীতিগুলি উৎসারিত হয়েছিল । যখন এই বিদ্রোহী সেপাইদের রাজদ্রোহের অপরাধে
প্রকাশ্যে অভিযুক্ত করা হয়েছিল তখন রাজনৈতিক শক্তিগুলি সম্পর্কে তাদের নির্ণয়
বিচক্ষণ ও নির্ভূল ছিল । বিদ্রোহের আগে অব্দি জনগণ ভারতের সামন্ত শ্রেণীকে নিজেদের
পারম্পরিক নেতা হিসেবে গণ্য করতেন । ১৮৫৭র অভ্যুত্থানের সময় এবং তার পর ভারতের
জনগণ সামন্ত শ্রেণীর বিভিন্ন অংশের মধ্যে তফাৎ করতে শুরু করলেন ।
নেতাদের
বিশ্বস্ত ভাবে অনুসরণ করলেও গাইলেন তাঁরা শুধু ঝাঁসির রাণী, ভোজপুরের কুঁঅর সিং,
আউধের রাজা গুলাব সিং ও রাজা বেণীমাধব এবং সেই সমস্ত অধিপতিদের সম্মানে যারা
ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন এবং দেশপ্রেমিকের ভূমিকা পালন করেছিলেন ।
বরং
তাঁরা তীব্র কটুক্তি করলেন সেই সব অধিপতিদের যারা জাতীয় অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধাচরণ
করেছিল এবং ইংরেজদের পক্ষ নিয়েছিল । যেমন কুঁঅর সিংকে নিয়ে রচিত গানগুলোয় ডুমরাঁও,
টেকারি আর রামগড়ের রাজাদের, কিম্বা আউওয়ার বিদ্রোহী ঠাকুরকে নিয়ে রচিত গানে
যোধপুরের মহারাজার উল্লেখ পাওয়া যায় ।
এতে বেশ
ভালো ভাবে বোঝা যায় ভারতের জনগণের রাজনৈতিক বিচারবুদ্ধি । ১৮৫৭র সংঘর্ষের সময়েও
এবং তার পরেও, নিজেদের পারম্পরিক শাসকশ্রেণীর মধ্যে যারা দেশপ্রেমিকের ভূমিকা পালন
করেছিল এবং যারা বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল তাদের স্পষ্ট ভাবে চিহ্নিত করে ফারাক করতে
তাঁরা সক্ষম ছিলেন ।
১৮৫৭র
সংগ্রামের অসফলতার প্রাথমিক কারণ ছিল সামগ্রিক ভাবে ভারতের সামন্ত-শাসক শ্রেণীর
আধমনা চেষ্টা অথবা বিশ্বাসঘাতক ভূমিকা । ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতীয়
সামন্তদের মূল্য সম্পর্কে এই জীবন্ত জাতীয় অভিজ্ঞতা, ভারতীয় দেশপ্রেমিকদের পরবর্তী
প্রজন্মের জন্য ভারতীয় বিপ্লবের সফলতার সঠিক রণনীতি তৈরি করার ভিত্তিপ্রস্তর
প্রমাণিত হল । তা এই যে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম শুধু ব্রিটিশ বিরোধী হলে চলবে
না, [ভারতীয়] সামন্ত বিরোধীও হতে হবে । ১৮৫৭র লোকগীতিগুলি এই সংক্রমণকে ব্যাখ্যা
করার মূল্যবান ঐতিহাসিক দলিল ।
ভারতে লোকশিল্প
জনতার কাছে পৌঁছোনোর পরম্পরাগত মাধ্যম । প্রমাণ রয়েছে যে ১৮৫৭র অভ্যুত্থানের
সংগঠকেরা পরিকল্পিত ভাবে এবং কার্যকরী ভাবে গণপ্রচারের এই পদ্ধতি, জনতাকে বিদ্রোহে
উদ্বুদ্ধ করতে, গ্রহণ করেছিলেন । ১৮৫৭র ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ কে (Kaye) লিখছেন, “দুটো বিষয় কাঠপুতলিওয়ালারা অত্যন্ত আনন্দের সাথে দেখায়
– মোগলদের পতন আর ইংরেজদের বিরুদ্ধে ফরাসিদের জয়;
একটির উদ্দেশ্য ঘৃণা জাগিয়ে তোলা আর দ্বিতীয়টির উদ্দেশ্য দর্শকদের মনে অবজ্ঞা
জাগিয়ে তোলা” । ট্রেভেল্যান তাঁর ‘কানপুর’ প্রসঙ্গে
লেখেন যে উৎসব আর তামাশাগুলো বিপ্লবী প্রচারে ব্যবহার করা হত । “থিয়েটারে কাজে লাগানো পুতুলগুলো বিচিত্র ভাষায় কথা
বলতে লাগল এবং এক বিচিত্র নৃত্য শুরু করে দিল । পুলিশ থানার কাছে গাওয়া হতে লাগল
পানওয়াড়া [গীতিকবিতা] এবং লাওয়নিয়া [কোমল আবেগ জাগান সাঙ্গীতিক শিল্প মাধ্যম]। আল্হা-উদলের
গীতিকাব্যও [রক্ত আন্দোলিত করা বীরগাথা] কাজে লাগান হল । কলকাতা থেকে পাঞ্জাব
অব্দি, রাতে বিপজ্জনক সব তামাশা [লোকনাটিকা] দেখান হত । জিপসী মেয়েদেরও ব্যবহার
করা হত । ভিশ্তিরা জল দিতে অস্বীকার করতে লাগল, আয়ারা কাজ ছেড়ে চলে গেল ।” এসব হয়েছিল একশো বছর আগে এবং তখন থেকে ১৮৫৭র এই লোকগীতিগুলি
ভারতের সাধারণ জনগণের হৃদয়ে দেশপ্রেমের সঞ্চার করতে সাহায্য করেছে ।
ওই মহান
জাতীয় অভ্যুত্থানে যাঁরা অংশগ্রহণ করেছিলেন, তাঁদেরই মধ্যেকার প্রতিভাবান
লোককবিদের রচিত ১৮৫৭র এই লোকগীতিগুলি অনেকভাবে আমাদের সমৃদ্ধ জাতীয় ঐতিহ্যের অংশ ।
এই গীতিগুলি ঐতিহাসিক সামগ্রীর গুরুত্বপূর্ণ আকর যা থেকে আমরা ওই অভ্যুত্থানের সময়
ভারতীয় জনতার দৃষ্টিভঙ্গি ও আশা আকাঙ্খা সম্পর্কে জানতে পারি । কীভাবে বিদ্রোহের
এই পরম্পরা আমাদের জনতার মধ্যে জীবিত রয়েছে এবং বিকশিত হয়েছে তার অধ্যয়নের জন্যও
ওই গীতিগুলি আকরসামগ্রী । দ্বিতীয়তঃ, দুর্ভাগ্যবশতঃ এই গীতিগুলি আমাদের
দেশাত্মবোধক কাব্য-ঐতিহ্যের স্বল্প-পরিচিত ক্ষেত্র । তাই এগুলি আজ প্রচারে জনপ্রিয়
করে তুলতে পারলে আমাদের জাতীয় সাহিত্য আরো সম্পদশালী হবে । শেষ কথা এই যে গীতিগুলি
রচিত হয়েছে নানা ধরণের বহুবিচিত্র লোকসাঙ্গিতিক শিল্প মাধ্যমে । অন্য যে কোনো
কিছুর থেকে বেশি ভাবে এই গীতিগুলির হৃদয় গরম করা সঙ্গীত দেশ প্রেমের রক্তকে
আন্দোলিত করে । এগুলি প্রচার করতে পারলে আমাদের জাতীয় সঙ্গীতও লাভবান হবে । এই
লোকগীতিগুলি এখনও খুব বেশি পরিচিত নয় । তবুও এ আমাদের জাতীয় ঐতিহ্যের অংশ এবং এ
ব্যাপারে আমরা গর্বিত বোধ করতে পারি । এগুলো রত্নের মত সংগ্রহ করা, পড়া এবং গাওয়া,
আমাদের বিদ্রোহী পিতৃপুরুষদের ঋণ শোধ করার এক সহজ উপায় ।
১৮৫৭র
সংগ্রাম, তার নাটকীয় ঘটনাবলী এবং বিষয়বস্তু খুব ভালো সামগ্রীর যোগান দেয় যা থেকে
নিয়ে, আমাদের জাতীয় সাহিত্যে ও শিল্পে নতুন প্রেরণাদায়ক সৃজনকর্ম সম্ভব হতে পারে ।
স্বাধীন ভারতে আমাদের কর্তব্যপালনে এ কাজ আমাদের সাহায্য করবে । আমাদের, অর্থাৎ
ভারতের জনগণের জন্য, ১৮৫৭র শহীদ, যোদ্ধা এবং অসাধারণ প্রতিভাসম্পন্ন যদিচ
স্বল্পপরিচিত লোককবিদের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের এবং তাদের ঐতিহ্যকে এগিয়ে নিয়ে চলার
এটাই সবচেয়ে ভালো উপায় । তাঁরাই তো এই মহৎ লোকগীতিগুলি আমাদের জন্য রেখে গেছেন ।
[লেখক - পূরণ চন্দ যোশী । পূরণ চন্দ যোশী কর্তৃক সংগৃহীত এবং সম্পাদিত লোকগীতি সঙ্কলন ‘লোকগীতিতে ১৮৫৭’ য় সম্পাদকের ভূমিকার বাংলা অনুবাদ । মহাবিদ্রোহের সার্ধশতাব্দী
উপলক্ষে ‘প্রতর্ক’ পত্রিকার জন্য অনুবাদ করা হয়েছিল, কিন্তু ‘প্রতর্ক’এর
সে সংখ্যাটি আর প্রকাশিত হয়নি। ]
অনুঃ
বিদ্যুৎ পাল
No comments:
Post a Comment