Tuesday, September 4, 2018

খিলানে মৌচাক


পাঁচ বছর আগে এই নতুন আটতলা বাড়িটায় উঠে এসেছে শেয়ার বাজার। দোতলা থেকে সাততলা অব্দি কয়েকটি সওদাগরি সংস্থার দপ্তর আর বেশির ভাগ ব্রোকার। আটতলায় রিং। কিছু চার্টার্ড ও ট্যাক্স একাউন্ট্যান্টেরও অফিস রয়েছে।
প্রধান প্রবেশপথ আর দুপাশের দোকানের ছাত থেকে সাততলার ছাত অব্দি একটা বিশাল খিলান। প্রত্যেক তলার, খিলানের দিকের খোলা অংশটায় একটা জানালা, জানালার নিচে কংক্রিটের চৌবাচ্চা যাতে ছোটো ছোটো বাগান বাড়ছে পাঁচ বছর ধরে ঝাউ, মরশুমি ফুল, ফার্ন, বড় ঘাস, লতা।
খিলানের জোড়ে, ওই সাততলায় একটা বিরাট মৌচাক। যে দেখে তার মনে প্রশ্ন উঠতে পারে ওই মৌচাকের কাছে কেউ কীভাবে পৌঁছোবে! ছাত থেকে দড়ি ঝুলিয়ে? সাততলার বরগা কিম্বা জানালা থেকে? এক যদি উপর থেকে দড়ির সিঁড়ি ঝুলিয়ে নেমে, সাততলার বরাবর অব্দি পৌঁছোলে আঁকশি দিয়ে টানা যায় খুব ধীরে ধীরে ভাবতে গা শির শির করে। বা যদি দমকলের হাইড্রলিক সিঁড়ি ওঠানো যায় নিচ থেকে জানিনা এত উঁচু যায় কিনা।
অবশ্য এটুকু উচ্চতা নিয়ে চিন্তার এই ভার্টিগোগুলো এই শহরের নিজস্ব। কেননা পূর্বে কলকাতা, পশ্চিমে দিল্লী, দক্ষিণ-পশ্চিমে মুম্বই। ধূর দক্ষিণে চেন্নাই। কাছাকাছি ব্যাঙ্গালোর, হায়দ্রাবাদ। তাছাড়া ছবিতে ম্যানহাটান আইল্যান্ড তো রয়েছেই। দেয়ালে আটফুট বাই চারফুট পোস্টারে, ধংসের আগের রক্তপিঙ্গল আলোয়, ওপরে দৈত্যাকৃতি মহাকাশযানের তলপেট, নিচে ম্যানহাটান যেন ততটাই মহাজাগতিক বরাবরি কা টক্কর নিচে জ্বলজ্বল করছে ইন্ডিপেন্ডেন্স ডে, আখরী জঙ্গ

গঙ্গা-কাবেরী সংযুক্তিকরণ পরিকল্পনা এখনো হাতে নেওয়া হয়নি। কিন্তু এই শহর অব্দি, গত তের বছর ধরে, ওপারের কৃষিপ্রধান অঞ্চল থেকে ছুটে আসছে একটি দীর্ঘ পথ-সেতু প্রদেশের গর্ব। তারই সাথে আসছে কৃষিপূঁজি। চাষে লাভ কম, ঝক্কি নাহক বেশি, তাই শেয়ারবাজারের মাধ্যমে চলে যাচ্ছে দেশের নগরকেন্দ্রগুলোয় শিল্পসমৃদ্ধির ডিমে তা দিতে।
ডিমে তা দিতে ... বাঃ, কথাটা বেশ ভালো। চতুর্বেদীজী ভাবেন। আটতলায় রিং, মাথায় ছাতের গরম তাও বোধহয় ওই, ডিমে তা দিতে। যদিও ভিতরের শীতাতপনিয়ন্ত্রণ চতুর্বেদীজীকে ভাগলপুরের গঙ্গার ধারে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। এপারের শাহী জর্দালু আম, ওপারের শাহী লিচু, নওগাছিয়ার কলা। কতরনি চাল আর চিঁড়ের কোনো জবাব আছে? আর রেশম!

বুড়ো পাটোয়ারীর ব্যবসা যখন রেশম, চাল, ফল, জমির মরশুম থেকে মরশুমে পারার মত গড়াচ্ছে আর দিনে দ্বিগুণ রাতে চৌগুণ হয়ে শ্বেতপাথর বসাচ্ছে নাথনগর জৈনমন্দিরে, অনন্তপ্রসাদ চতুর্বেদী তখনকার যুবক। বাপ-মা নেই, কাকার কাছে মানুষ হওয়া ছেলে অনন্ত আরো কিছুদিন পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারত এর ওর বাড়িতে রান্না করে বা ছেলে পড়িয়ে। বন্ধু কামেশ্বর রাজনীতিতে যাওয়ার তালিম নিত। চলেও গেল।
কিন্তু অনন্তর একটু ভেবে দেখার সময়ের প্রয়োজন ছিল। ভেবে দেখার সময় পেতে চাইলে স্বাধীনতা চাই। কাকার খয়রাত থেকে, রান্নার আঁচ থেকে, ছেলেপড়ানোর ঝক্কি থেকে আর বয়সের খুচরো পাপের লোভ থেকে স্বাধীনতা। ... দেশ স্বাধীন হয়েছে চোখের সামনে আট বছর আগে; রেডিওতে, খবরের কাগজের পাতায় নেহরুজীর শিল্পসমৃদ্ধ ভারতের প্রতিশ্রুতি। প্রদেশের নীলরক্ত, মুখ্যমন্ত্রী শ্রীবাবুর চোখের প্রশাসনিক ভারসাম্যে বলছে, গেরস্তের খোক্কা হোক কিন্তু আগে মিথিলাঞ্চলে না আগে মগধে? ভোজপুরে না বৈশালীতে? সিংভূমে, ছোটানাগপুরে? মোকামায়? না কি স্নেহধন্য বেগুসরাইয়ে? ... ওদিকে গরীবগুর্বোদের স্বাধীনতার নতুন অর্থ চেনাচ্ছে কম্যুনিস্ট পার্টি ক্লকটাওয়ারের পাশ দিয়ে কালেক্টরের অফিসের দিকে চলেছে মিছিল যে শোষণ চলছে ব্রাহ্মণ্যসমাজের প্রতিষ্ঠাকাল থেকে, আজ আজাদ হিন্দুস্তানে তার তিলাঞ্জলি হোক ইংরেজ জমানার মতই; জমিদার, পূঁজিপতি, ব্যাপারী, সেঠ, কালাবাজারী, ভ্রষ্ট প্রশাসন নিপাত যাক, মুর্দাবাদ! ... অনন্তর একটু ভেবে দেখার সময়ের প্রয়োজন ছিল। অভাবগ্রস্ত ছেলে সে!

তাই, স্বাধীনতার প্রয়োজনে অনন্ত গোলামী লিখে দিল পাটোয়ারীর ব্যবসায়। ভেবে দেখতে দেখতে অনন্ত, অনন্ত প্রসাদ হল, কাকার অকালকুষ্মান্ড ছেলেদুটোকে মানুষ করল, খুড়তুতো বোনের বিয়ে দিল, নিজে বিয়ে করল, বাচ্চা হল না, দত্তক নিল, একটা বলতে গেলে কুড়িয়ে পাওয়া মেয়েকে, চতুর্বেদীজী হল।
ছ-সাত হাজার বছরের মানবসভ্যতা; ভাবতে ভাবতে একটা জীবন, ভাবনার প্রভাবে একটা বিন্দু হয়ে হাপিশ হয়ে যায়।

                         
বাজার বড্ড তেতে রয়েছে, তাও এতদিন ধরে লাগাতার লক্ষণ ভালো নয় মন বলছে দীপককে বোলো যে খেলুক, কিন্তু একটু সামলে খেলুক ...
বুড়ো পাটোয়ারী ভাগলপুর থেকে ফোন করে চতুর্বেদীজীকেই কথাগুলো বলেন ছেলে দীপকের লোকাল গার্জেন বলতে ওই ম্যানেজার চতুর্বেদীই, এটা আর কেউ না মানুক, বুড়ো পাটোয়ারী মানেন
চতুর্বেদীজী ফোনটা রেখে মালিকের ছেলের ঘরের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকেন কিছুক্ষণ নিচে নিউমার্কেটের পিছন-উঠোন বা খিড়কি-উঠোন গাড়ী মেরামত, লেদ, স্পেয়ার পার্টস, ভাঙা টেম্পো, ট্রাক, ভাতের হোটেল, মদের দোকান ডান দিকে নিউমার্কেট, বাঁদিকে জেল সামনে দূরে রেলস্টেশন-চত্বর একটি উঁচু মন্দিরের চুড়ো ততোধিক উঁচু একটি মসজিদের চুড়ো ওদিকে একটা গুরুদ্বারাও আছে চাঁদানি মার্কেটের পাশে তবে চুড়ো নেই প্রয়োজনও নেই এ শহরের আসল পরিচয় তো দশম গুরুজীর জন্মস্থান, তীর্থ হ্যাঁ, গির্জা নেই কাছাকাছি যা আছে সব উত্তর দিকে
মে মাসের রোদ্দুরে ঝিম ঝিম করছে নিচের অবসন্ন ভীড়টা বাজল? উপরে রিংএ দুপুরের অবসর হবে এবার মসজিদের চুড়োর কাছে লাগান মাইকটার দিকে তাকিয়ে কেয়া বহরা ভয়ো খুদায় গুনগুন করতে বেরিয়ে আসেন চতুর্বেদীজী পাশের টেবিল থেকে অনিল সিং প্রশ্ন করে, কী চতুর্বেদীজী, পন্ডিতাইনের তবিয়ত নাসাজ নাকি? বড় উদাস মনে হচ্ছে আপনাকে? এই বয়সেও যদি রাতে এত অত্যাচার করেন তাহলে কি ওনার সইবে?
বাকি সকলে হেসে ওঠে চতুর্বেদীজী কম যান না বা যেতে চান না এই মুহুর্তে কেননা ওনার ভাবনার সুত্রটা ছিঁড়ে দিয়েছে অনিল, তো, আর কে আছে যার ওপর অত্যাচার করতে পারি, তুইই বল! ভাবীজী আমার কথা বলছিল নাকি? বল, বল, লজ্জা পাস না!
হাঃ হাঃ,... কী রে অনিল? তোর জোয়ান ঠাকুরাইনকে ম্যানেজারসাহেব নিজের ভাবীজী বানিয়ে নিলেন?... শ্রীনিবাস আরো কিছু বলতে যায় তখনই ছোটো মালিক দীপক পাটোয়ারী ঘরে ঢোকে সঙ্গে ঘুমন্ত অংশীদার মঞ্জু পাটোয়ারী নিজের কামরায় ঢুকে চতুর্বেদীজীকে ডেকে পাঠায় মালিক
দীপকের ব্যস্ত উৎসাহ দেখে বুড়ো পাটোয়ারীর সাবধানবাণীটা আর দীপককে বলা হয় না অবশ্য এ বিষয়ে তাঁর নিজেরও কিছু পূর্বানুমান ছিল তাই বাজার পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা না জানালেও দীপককে আগে বেশ কয়েকবার বলেছেন অন্যদিকে টাকা খাটাতে বাজার বদলাচ্ছে ভাগলপুরে তো জমি আছে আপনার নামে বাবার সাথে কথা বলে একটা এগ্রো-বেস্‌ড প্রজেক্টে হাত লাগান না সিডবির সাথে, বিএসএফসির সাথে কথা বলুনশেয়ারের বাজারে ষাঁড়-ভালুক লেগেই আছে কাল কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসবে তাও আবার পূর্বাঞ্চলের আবহাওয়া জ্বর হলে শরীর খারাপ বোঝা যায় না, বেশ লিসা লিসা লাগে
-       চাচাজী, আপনি পুরোনো দিনের মানুষ আপনার হিসেবে আপনি ঠিকই বলেছেন খেলার ওই ছকটাই বুদ্ধিমানী ছিল আগে কিন্তু গত কয়েক বছরে ভীষণভাবে বদলে গেছে দুনিয়াটা চাচাজী এখানে বসে সেটা অত টের পাওয়া যায় না আর এই অফিসের ব্যবসা তো খেলা নয়, খেলানো! মানুষ খেলতে চাইছে আমরা খেলাচ্ছি মানুষ আরো আরো খেলতে চাইবে আগামী দিনগুলোয় আর কোনো খেলা তো থাকবে না ... সরকারও চাইছে লোকে আরো বেশি করে খেলুক!
-       সে মানছি তবু, ভাগলপুর আপনার জন্মস্থান একটা কিছু বড় আপনার সেখানে গড়ে তোলা উচিৎ
-       সেটা অন্য ব্যাপার একটা কিছু করতে পারলে আমারও ভালো লাগবে কিন্তু এ মুহুর্তে ওদিকে মন দিতে পারছি না আপনি ভার নেবেন? বলুন! আমি জানি আপনি গা ঝেড়ে লেগে গেলে সোনা ফলিয়ে ছাড়বেন কিন্তু আপনি তো কবীরপন্থী আজ অব্দি একটা শেয়ার নিজের পয়সায় কেনা বেচা করলেন না অথচ শেয়ার বাজারে, ব্রোকারের অফিসে কাজ করছেন এরকম ইউনিক লোক দেখেছ মঞ্জু?
-       বৌমাকেই বলুন ভার নিতে লেখাপড়া জানা মেয়ে
-       কে? মঞ্জু? আপনিই জিজ্ঞেস করুন!
-       কী (বেটি বলতে গিয়ে সামলে নেন কেননা লক্ষ্য করেছেন যে মেয়েটি বেটি সম্বোধনটা জাস্ট গায়ে মাখে না, শ্বশুরমশায়ের লোক বলে) আপনি পারবেন না? আমরা তো থাকব সাথে
-       আই নীড মাচ মোর এক্সপিরিয়েন্স
কাঁচের ওপারে দেখা যায় রিং থেকে এসে গেছে সবাই কথা আর এগোয় না ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে চতুর্বেদীজী ভাবেন, অবশ্যই, অবশ্যই, মাচ মোর এক্সপিরিয়েন্স! ট্রু! কিসের জন্য? ... ঘুমন্ত অংশীদার/ ঘুমের ভাণে বংশী শোনে/ মুঠোয় ছেঁড়ে গলার হার!/ সখা আমার, কবে শুনবি? / বংশী বাজে চমৎকার! ...

এইসব স্বগত রসিকতাগুলো চতুর্বেদীজীকে নিজের পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখতে, আবার বিচ্ছিন্ন মনটাকেও, পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে সাহায্য করে সন্ধ্যায় অফিস বন্ধ করে কিশোর তাঁর হাতেই চাবি দেয় তিনি তালাটা চেক করে মালিকের হাতে চাবি সোপর্দ করেন
আগে করতেন না কিন্তু দীপকের বিয়ের পর থেকে জোর করে চালু করিয়েছেন কোনোদিন মালিক বা মালিকদম্পতি আগে বেরিয়ে গেলে চাবিটা বাড়িতে গিয়ে দিয়ে আসতে হয় সকালে অবশ্য প্রতিদিনই কিশোর গিয়ে চাবি নিয়ে আসে চতুর্বেদীজী তার জন্য অপেক্ষা করেন নিচে, রেডিমেড কাপড়ের দোকানটায় বসে তার মালিকও ভাগলপুরের মানুষ
সাতটা নাগাদ তিনি ফেরেন নিজ রাজপ্রাসাদে লোহানিপুর, সুখদেও প্রসাদের বাড়ির পিছন দিক, দোতলা

                                                                   
কুড়িয়ে পাওয়া মেয়ে বোধহয় নিজের মেয়ে থেকেও বেশি ভালো হয় তাও এক্কেবারে কুড়িয়ে পাওয়া নয়, যাকে বলে মাঝপথে ক্যাচ করা, কী বলিস?... অনেকদিন হল পূর্ণবয়স্ক হয়ে ওঠা মেয়ে রশ্‌মির মনের নানান মেঘগুলো এভাবেই খুঁচিয়ে ছিঁড়তে চান চতুর্বেদীজী
পুলিস রেকর্ডে রশ্‌মির পিতৃপক্ষের জাত কায়স্থ ফতুহার বাসিন্দা দুজনেই চাকরী করতেন সকাল দশটার ট্রেনে পাটনা আসার পথে কম্পার্টমেন্টে আগুন লাগে দুজনেই পুড়ে মারা যান আরো অনেকজনের সাথে দুজনেরই নতুন চাকরী ছিল তাই তাদের কাজের জায়গাদুটো থেকেও বিশেষ কিছু ক্ষতিপূরণ বাবদ তাদের মেয়েটি পায় নি মেয়েকে ওঁরা রেখে যেতেন মেয়ের দিদিমার কাছে সেখানেই ছিল সে খবরের কাগজে তার মর্মান্তিক পরিস্থিতি ছোট্টো করে বেরোয় সেই খবরটা পড়েই চতুর্বেদীজী, স্ত্রী পরমেশ্বরীর সাথে গিয়ে মেয়েটির দিদিমার সাথে দেখা করেন কথা দেন যে ও দিদিমার নাতনীই থাকবে পুজোপার্বণে দেখা করিয়ে যাবেন দিদিমার সাথে
তারপর তো দিদিমাও মারা গেলেন হঠাৎ গজিয়ে ওঠা উত্তরাধিকারীরা হড়পে নিল দিদিমার বাড়িটা ছেলে পক্ষের লোকেরা তো প্রথম থেকে এই বিয়েরই বিরুদ্ধে ছিল, কেননা অসবর্ণ, প্রেমঘটিত বিবাহ যৌতুকের কোনো ব্যাপার ছিল না কাজেই ছেলের বাড়ির বা মেয়ের বাড়ির কেউই আর খোঁজও করল না সেই দুবছরের মেয়েটির যে এখন চতুর্বেদীজীর সামনে দাঁড়িয়ে তেইশ বছরের রশ্‌মি
চতুর্বেদীজীও চিনতে যাননি সেই উত্তরাধিকারীদের। বেশ তো আছে তাঁর আদরের মেয়েটি। একটাই খোঁচ যে এখনও বিয়ের ব্যবস্থা করতে পারলেন না। রশ্‌মিই যে রাজি হয়না, তিনি কী করবেন। বলে কিনা পণ দিয়ে বিয়ে করবে না। একটি পয়সা না, পয়সা ছাড়া কোনো অন্যভাবেও না। এক কানাকড়িও পণ বা আর্থিক সাহায্যের প্রশ্ন না তুলে কেউ আসুক, তবে সে ভেবে দেখবে।
অথচ অভাব ছিল না। বুড়ো পাটোয়ারীও বলে রেখেছেন, যা লাগবে, যত টাকা ঘাটতি পড়ছে বলে মনে হবে, সব দেবেন। কিন্তু মেয়ে রাজি হলে তবে তো!
হয়তো তাও যোগাড় হয়ে যেত। কেননা উত্তরাধিকারে রশ্‌মির কোনো অংশীদার নেই, এ কথাটা হিসেবের মধ্যে রাখত ছেলেপক্ষের লোকেরা। কিন্তু রশ্‌মির দ্বিতীয় শর্তটা আরো মারাত্মক। কাউকে লুকোনো চলবে না যে সে দত্তকপুত্রী, কুড়িয়ে পাওয়া মেয়ে। এখন, কে সাক্ষ্য দেবে যে যে পরিবার থেকে তাকে দত্তক নেওয়া হয়েছে সেটা কায়স্থ পরিবার? আর আজকাল বিয়েশাদির বাজারে যত রকমের ফেরেববাজি চলে। হয়ত পরে জানা যাবে যে বাড়ির কাজের লোকের মেয়ে! বা হাসপাতালে পড়ে পাওয়া! কোন জাতের কে বলবে? ...
আর, সবই তো পালকপিতার কৃতিত্ব!
কবীর বেচারা বুঝিয়ে মরল কত ভাবে তার মত।
দুনিয়া পাগল রইল রে দাদু, ধরল না তার পথ।।
...............
পরমকে বুঝে যদি ধ্যান করো তাঁর
বাদ্য না থাক, তবু হবে ঝংকার।
চাঁদ বিনে চাঁদনিতে ভরবে আকাশ,
যেদিকে চাইবে পাবে অমলিন হাঁস।।
সেই ছোটোবেলা থেকে এসবই পড়ে, গেয়ে শুনিয়েছেন মেয়েকে। পরমেশ্বরী এসে বই বন্ধ করে দিতেন, মেয়ে কি সন্ন্যাসিনী হবে? ... চল, ওঠ, রশমি! আমার কাজে একটু হাত লাগা এসে!

আজ দুপুরে অফিসের জানালা দিয়ে স্টেশন চত্বরটা দেখার সময় থেকেই লাহোর শহরের কথা চতুর্বেদীজীর মাথায় ঘুরছে। ভাবা যায়? পঞ্চাশের আদ্ধেক বোম্বাই লাহোর থেকে এসেছিল! চাঁদনি রাতে নায়ক জানালায় দাঁড়িয়ে গান গাইছে নায়ক লাহোরের, গায়ক লাহোরের, গীতিকার লাহোরের, সুরকার লাহোরের! খুঁজলে জানা যাবে চাঁদটাও লাহোর থেকে এসেছিল! অথচ লাহোর আর তাঁদের দেশ নয়! এলাহাবাদ আছে, বেনারস আছে অথচ লাহোর নেই! ব্যাপারটা দুপুর থেকে তোলপাড় করছে তাঁকে।
-       কী রে রশ্‌মি, লাহোরে যাবি?
-       দূর! বাবা, রোজ অফিস থেকে ফেরার সময় তুমি একটা নতুন দুষ্টুমি মাথায় নিয়ে আসো। ... আমার নোটস খুঁজে পাচ্ছি না। কাল ক্লাস নিতে হবে। মনে হচ্ছে সুনীতা নিয়ে গিয়েছিল, ফটোকপি করিয়ে দিয়ে যাবে বলে, আর দেয়নি। এখন তো ও ... বিয়ে করে চলে গেছে আহমেদাবাদ! ওর বিয়ের সময় গেলামও, কিন্তু নোটসের কথাটা মনেই ছিল না।
-       তোর এই টিউটোরিয়াল আর কোচিং চালিয়েই দিন কাটবে?
-       তা আমাকে এখন লেকচারারের চাকরি দেবেটা কে?
-       ওঃ, চাকরি, ক্লাস ... এর বাইরে কিছু নেই? বিয়ে করবি না?
-       না তো কখনই বলিনি!
-       কিন্তু তোর শর্তগুলো তো ...
-       খারাপ?
-       কে বলেছে খারাপ? কিন্তু ...
-       আর, শর্ত তো আমি রাখিনি! শর্ত তো ছেলেপক্ষ রাখে যে এই দিতে হবে। আমি শুধু তোমায় বলেছি যে ওদের ওই শর্তটা তোমাকে মানতে দেব না। আমি মানব না।
-       আর দ্বিতীয়টা? সেটা তো আরো মারাত্মক!
-       সম্পর্কের বনিয়াদটা সত্যের ওপর দাঁড় করান মারাত্মক? তুমি বলছ?
এরপর আর কোনো কথা যোগায় না বাপের মুখে। বাপের অবস্থাটা বুঝতে পেরে মেয়ে এসে হাত বুলিয়ে দেয় মাথায়।
-       লোকের কথা শুনে নিজেকে বিচলিত কোরো না বাবা। আমি তো আর ঘরের কোণে মনমরা হয়ে বসে নেই। কাজ করছি। যে সময়টা পাচ্ছি কাজেই লাগছে। ভালো করে দাঁড়াতে চেষ্টা করছি নিজের পথে।

রাতে আবার স্ত্রী, পরমেশ্বরী প্রশ্ন করেন, কিছু ভাবছ মেয়েটার বিষয়ে?
-       ভাবছি লাহোর যদি ভারতে থাকত রশ্‌মি নিশ্চয়ই নিজের পছন্দ মত একটা ছেলে পেত। বিয়ে হয়ে যেত দুজনের।
-       ফের সেই বাজে রসিকতা! তুমি কি একরকম থেকে যাবে সারাজীবন? বয়স বাড়ছে না কমছে?
-       কমছে! আমাকে একরকম দেখছ পঁয়ত্রিশ বছর ধরে?... আগে কত বুড়ো ছিলাম! বোনের বিয়ে দিয়েছি ধারকর্জ করে। ভাইদুটোকে মানুষ করা যাকে বলে, তাই করেছি ... ভাগলপুরে একটা বাড়ি করেছি শেষ জীবনে থাকার মত! এখন ধীরে ধীরে বয়স কমছে। আরো কমিয়ে ফেলতে চাই। ... কবে মরে যাব! ছিঃ, অলক্ষুণে কথা, তোমার হয়ে বলে নিলাম। ... কিন্তু, ওই যে বললাম! লাহোর, করাচি, পেশাওয়র, সিয়ালকোট... এই সব নিয়ে যদি আজ ভারত হত, তাহলে বোধহয় যৌবনে বুড়োও হতাম না, আর হলেও এখন বয়স কমাতে এত অসুবিধে হত না। ... রাগ করে চুপ করে গেলে? ওপাশ ফিরে আমায় যাচ্ছেতাই করছ মনে মনে? কামেশ্বরটাও এদিকে বহুদিনযাবৎ পাটনায় আসেনি। এলে এসব নতুন জ্ঞানের কথা শোনাতাম শালাকে। ...
পরমেশ্বরী কিছু বলেন না। বয়স হলেও সুস্থ সমর্থ শরীর। তবু একটা সন্তান হল না। মনঃকষ্ট থেকেই যায়। রশ্‌মিকে পরের মেয়ে ভাবতে হয়নি কখনো। তা হয়তো কিছুটা এই বাচাল স্বামীর ছেলেমানুষী হাবভাবের জোরেই। কখনো ঘরের কোণে কোনো মেঘ দানা বাঁধতে দেন না। তবু, না হয় রশ্‌মির একটা ছোট্টো ভাই কিম্বা বোনই হত। কিন্তু সে যদি আবার বড় হয়ে রশ্‌মিকে অশ্রদ্ধা করত? বোধহয় ভালোই হয়েছে হয়নি। রশ্‌মি তাঁদের সবচেয়ে বড় অহঙ্কার।
-       পরমেশ্বরী, ঘুমোলে?
-       না।
-       একটা বিজ্ঞাপন দিয়েছিলাম খবরের কাগজে, আজ বেরিয়েছে।
-       বিজ্ঞাপন!
-       হ্যাঁ, আরে ওই পাত্র-পাত্রী কলামে, রশ্‌মির ...
-       ওতে আবার আমাদের ঘরে ছেলেমেয়ের বিয়ে হয় নাকি?
-       হয় নিশ্চয়ই! অনেকেই তো দেয়।
-       কী দিয়েছ তাতে?
-       ওই, বয়স, উচ্চতা, গায়ের রঙ, দেখতে শুনতে ভালো, শিক্ষাদীক্ষা, কাস্ট নো বার আর ...
-       কী? কাস্ট নো বার, মানে অসবর্ণে বাধা নেই ... আর লিখেছি, কোনোরকম পণের দাবী না থাকলে ভালো হয়!
-       এটাও লিখে দিলে? আর মেয়ের জাত?
-       দিইনি, কোনো রেসপন্স এলে তখন খোলাখুলি কথা বলব।
-       একটাও আসবে না।
-       দেখা যাক!
পরমেশ্বরীর ঘুম আসছিল না। স্বামীর দিকে ঘুরে শুলেন। একটু ঘেষটে গেলেন কাছে। দেখলেন, চতুর্বেদীজীর চোখেও ঘুম নেই। চেয়ে আছেন তার দিকে।

                                                     
সাত আটটা চিঠি খামে ভরে পাঠিয়ে দিয়েছে খবরের কাগজের অফিস থেকে। একটা চিঠি কোনো পাগলের অশ্লীল প্রলাপ। তিনটে চিঠিতে পণের যৌক্তিকতা সম্পর্কে কিছু উপদেশ দেওয়া আছে, যেমন, সামর্থ্য না থাকলে আলাদা ব্যাপার, কিন্তু সামর্থ্য থাকলে পিতার সম্পত্তিতে কন্যার অংশের কিছুটা ওই পণ বা যৌতুকেও না দিলে বেচারিকে বঞ্চিত করা হয়, আর শাস্ত্রের বিধানও লঙ্ঘিত হয় ইত্যাদি দুটো চিঠিতে চতুর্বেদীজীর ভিটেমাটি, বাড়িঘর নিয়ে প্রশ্ন আর দুটো চিঠি একেবারে আলাদা অর্থাৎ, ঠিক যেমন মর্যাদাসম্পন্ন কথাবার্তা চতুর্বেদীজী, কেউ না কেউ নিশ্চয়ই বলবে ভেবেছিলেন, ঠিক সে রকম
একজন বয়স্ক, বিবাহবিচ্ছেদ প্রাপ্ত ইঞ্জিনিয়ার বিল্ডার-প্রমোটারএর ব্যবসা করেন পার্টনারশিপে যথেষ্ট সম্পত্তিবান নিজের নিঃসঙ্গতা জাহির করেছেন আর, মেয়েকে সুখে রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন
আরেকজন সামাজিক কর্মী বয়স লিখেছেন চল্লিশের ওপর বিয়ে করার সুযোগ হয়নি নারীর সম্মান সম্পর্কে সচেতন বলে জানিয়েছেন আরো কিছু কথা আছে সমাজ, প্রগতি ইত্যাদি বিষয়ে
একটি চিঠিও পাত্রের বাবা বা কোনো অভিভাবকের লেখা নয় পাত্রদের নিজেদের হাতে লেখা

অফিসে শ্রীনিবাস পাশে বসে; মোটা খাম দেখে কিছু আন্দাজ করেছিল হয়ত কিন্তু চতুর্ব্রদীজীর গম্ভীর মুখ দেখে কিছু জিজ্ঞেস করেনি ছুটির পর বাইরে বেরিয়ে অনিলকে বলেছিল
-       কিসের খাম?
-       মনে হল কোনো খবরের কাগজের দপ্তর থেকে এসেছে বিতর থেকে বেরুলো ছসাতটা খাম আর ইনল্যান্ড
-       তার মানে রশ্‌মির বিয়ের ব্যাপারে হবে
-       চিঠিগুলো পড়তে পড়তে কেমন গম্ভীর হয়ে গেলেন
-       হতেই পারে ভালো পাত্র পাওয়া তো আর চাট্টিখানি কথা নয়! ... ছাড় আজ বিরক্ত করিস না বুড়োকে কাল জিজ্ঞেস করা যাবে

-       চিঠিগুলো দেখবি নাকি রশমি? বেশ মজার!
-       চিঠি! কিসের চিঠি?
-       না, মানে, তোর জন্য একটা বিজ্ঞাপন দিয়ে...
মেয়ের মুখ দেখে কথা আর শেষ করতে পারেন না চতুর্বেদীজী। মেয়ে এগিয়ে এসে বাপের সাথে ঝগড়া করতে গিয়েও করতে পারে না। দুজনে চুপচাপ বসে থাকেন কিছুক্ষণ।
-       তোকে আগে বলিনি। ভুল করেছি, স্বীকার করছি। কিন্তু অবস্থাটা দেখ, আমাদের সমাজের!
মেয়ে তবুও কিছু বলে না। হঠাৎ চিঠিগুলো হাত থেকে টেনে নিয়ে বাইরে চলে যায়। যাক বাঁচা গেল চতুর্বেদীজী ভাবেন, রাগ করে ছিঁড়ে ফেলুক, ল্যাঠা চুকে যাবে।
কিন্তু ল্যাঠা চোকে না। রাতে, খাওয়ার পর শুয়ে একটা বইয়ের পাতা ওল্টাচ্ছেন কামেশ্বর দিয়ে গিয়েছিল অনেকদিন আগে (দিয়ে গিয়েছিল নাকি ছেড়ে গিয়েছিল ভুল করে) রাহুল সাংকৃত্যায়নের লেখা দিমাগী গুলামী রশমি নিঃশব্দে এসে চিঠিগুলো পাশে রেখে দিয়ে চলে গেল।
বই পড়া মাথায় উঠল। চিঠির তোড়াটা হাতে নিয়ে বোকার মত বসে রইলেন চতুর্বেদীজী।

সকালে যতবার রশমির সাথে একা হলেন, কথা সরাতে পারলেন না মুখ থেকে। শেষে রশমির কোচিংএ যাওয়ার সময়টা তাক করলেন। বেচারী মায়ের কাছে এসে বসতেই অদূরে এসে বসলেন।
-       আরেক কাপ চা দাও পরমেশ্বরী, শরীরে ঠিক যুৎ পাচ্ছি না।
-       এখন চা খাবে? তাহলে খাবার খাবে কখনো?
-       খাব একটু পরে। আগে চা দাও এক কাপ। ... কী রে রশমি, তুই কিছু বলছিস না কেন বল তো? আমি তো চিঠিগুলো তোকে দেখাতে চেয়েছিলাম যে তুই মজা পাবি! কী ফালতু চিঠি সব! অথচ কাল রাত থেকে তুই গম্ভীর হয়ে আছিস!
পরমেশ্বরী কিছুই জানতেন না।
-       কিসের চিঠি?
-       আরে, তোমায় বলেছিলাম না কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়ার ব্যাপারটা! তারই চিঠি এসেছে ছসাতখানা।
-       ও মা, আমায় তো বল নি!
-       আরে দুর! ওগুলো আবার বিয়ের সম্বন্ধ নাকি? ... কাল হাতে পেয়ে ভাবলাম রশমিকেই দেখাই। ও মজা পাবে। কিন্তু দেখে মুখটা এমন গম্ভীর করে নিল ...
-       কই সে চিঠি?
-       ওই তো, আমার ব্যাগে। এ্যাই রশমি, কথা বলছিস না কেন মা?
চতুর্বেদীজী স্পষ্ট দেখতে পেলেন মেয়ের চোখদুটো জলের অভাবে, শুকনো আগুনে পুড়ে কালো হয়ে যাচ্ছে।
চা খাওয়া আর হল না।

অফিসের জন্য তৈরি হয়ে খাবারটা খেতে খেতে পরমেশ্বরীর হাতে চিঠিগুলো এনে দিলেন।
-       এই নাও। পড়ে দেখ, কী এমন আছে চিঠিগুলোয়? বিজ্ঞাপন তো ও দেয় নি। দিতে চায়ও নি। তাহলে চিঠিতে সাপ, ব্যাং যাই আসুক ওর তো মনে আঘাত পাওয়ার কথা নয়। ও ভালো করেই জানে যে এর মধ্যে একটিও ওর যোগ্য পাত্র নয় আর আমিও এদের কারোর সাথেই ওর বিয়ে দিতে যাচ্ছি না, তাহলে এত রাগ, কষ্ট কেন? কথাই বলছে না কাল থেকে!
-       মেয়ে তো তোমারই। তুমিই বোঝো কিসের রাগ, কিসের কষ্ট। ওকে না বলে ওর বিয়ের জন্য বিজ্ঞাপন দিয়েছ, বিয়ের জন্য কাতরতা দেখিয়েছ দশটা লোকের মধ্যে, তাই হয়ত কষ্ট পেয়েছে! (চিঠিগুলো খুলে খুলে চোখ বোলাতে থাকেন) একটাও যোগ্য পাত্র নেই?
-       না। (চতুর্বেদীজী অন্যমনস্ক ভাবে জবাব দেন; পরমেশ্বরীর কথাটা ওনাকে ভাবায়। সত্যিই তো, এতে মেয়ের কষ্ট হওয়া তো স্বাভাবিক। ...)
-       তাহলে আর আমাকে দেখিয়ে কী হবে। ও মেয়ে তো এমনিতেও রাজকুমারী!

সারাদিন অফিসে আনমনা কেটে যায়। অনিল, শ্রীনিবাস ঠাট্টাতামাশা করে, খোঁচা মেরে, এমনকি সোজাসুজি প্রশ্ন করেও কোনো থই পায় না। চিঠির কথা তুলতেই, পরে শুনিস, শরীরটা ভালো নেই বলে এড়িয়ে যান।
সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার মুখেই চমক! গেটের কাছে হাসিমুখে রশমি অপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে আছে।
-       ফিরলেন? কন্যাদায়গ্রস্ত অনন্ত প্রসাদ চতুর্বেদীজী?
পিতা বুঝে পান না কন্যার নতুন চালটা কী। তবু, হাসিমুখ দেখে ধড়ে প্রাণ আসে।
-       চুপ কর্‌! কাল রাত থেকে আমায় গাড্ডায় পচিয়ে এখন ঠাট্টা হচ্ছে। সারাদিন কেমন করে কেটেছে জানিস?
-       আর আমার? কাল রাত থেকে?
-       বিজ্ঞাপন দেওয়াতে তোর মত ছিল না তবু, তাও আবার তোকে না জানিয়ে বিজ্ঞাপন দিলাম বলেই তো তোর কষ্ট, অভিমান, আমার ওপর রাগ... কেন জানাইনি জানিস?
-       জানি।
-       ছাই জানিস। তুই ভাবছিস, তুই আপত্তি করলে আর দিতেই পারতাম না, তাই জানাইনি, তাই তো?
-       না, সেটা কারণ নয়। ভিতরে চল। হাত, পা ধুয়ে বস তবে বলছি।
পরমেশ্বরী মঙ্গলবারের পুজো দিতে গেছেন মন্দিরে। রশমিই চা করে নিয়ে আসে। পোকার উৎপাত কমাতে ব্যালকনির আলোটা জ্বালিয়ে ঘরেরটা নিবিয়ে দেয়।
-       এবার বল্‌! কী কারণ!
-       তোমার আশঙ্কা ছিল যে একটাও চিঠি আসবে না।
কথাটার সত্যতায় ভিতরে ভিতরে নাড়া খেয়ে যান পিতা, এটাই সত্য ছিল ভাবেন, কিন্তু এতটা আমল না দিয়ে হাল্কাভাবে দেখার ভাণ করছিলেন; মেয়ে বটে। তবু ওই কথাটাকেই অস্ত্র করেন।
-       সে তো এখনও তাই। যাকে বলে চিঠি, কোনো যোগ্য পাত্রের তরফ থেকে, তা কই এসেছে?
-       এসেছে তো। তোমার মতে যোগ্য না হতে পারে, তারা নিজেরা তো যোগ্য মনে করছে নিজেদের। আমাকেও তাদের যোগ্য মনে করছে।
-       ছাড় চিঠির কথা। অনেক হয়েছে। ঘাট হয়েছে বিজ্ঞাপন দিয়েছি। এই শেষ। কিন্তু তুই ওরকম গম্ভীর হয়ে গিয়েছিলি কেন? তোর কি মনে হয়েছিল আমি ...
-       আচ্ছা বাবা, আমার বর কেমন হওয়া উচিৎ তুমি মনে কর?
চতুর্বেদীজী একটু সময় নেন ভাবতে।
-       কেমন আবার! তোর সাথে মানানসই, বয়সে তোর থেকে একটু বড় হলেও বন্ধুর মত, চিন্তায় উদার, ভালোবাসবে তোকে, পরস্পরের জন্য সমান মর্যাদাবোধ থাকবে, জাতপাত মানবে না, যৌতুক ইত্যাদিকে ঘৃণা করবে ...
-       পাবে?
-       কেন পাব না?
-       এঁড়ে তর্ক কোরো না।
-       তর্ক কিসের? পাওয়ার আশাই তো মানুষ করে!
-       ব্যাস্‌ আশা কর। আমিও আশা করি। স্বপ্ন দেখি। আর খুশি মনে নিজের রোজকার জীবনটা কাটাই। কী দরকার রূঢ় বাস্তবের আঘাত হেনে স্বপ্নটা ভেঙে দেওয়ার? রোজকার জীবনটা কাটানোই তো মুশকিল হয়ে যাবে!
-       এটা কোনো কথা হল? চেষ্টা থাকবে না?
কথার জবাব না পেয়ে পিছন ফিরে চতুর্বেদীজী দেখেন মেয়ে চলে গেছে নিজের ঘরে।



চিঠিগুলোর হাত থেকে কিছুতেই মুক্তি পান না চতুর্বেদীজী। যতবার ছিঁড়ে ফেলতে যান, মনে হয়, আচ্ছা থাক, আমাদের সমাজের বহুমূল্য দস্তাবেজ! দলিল! ... খবরের কাগজের বড় খামটায় ভরে অফিসে, নিচের ড্রয়ারটায় তালা লাগিয়ে রেখে দেন।

গত তিন দিন ধরে বাজার খুব নড়ছে। শেষমেশ পড়েনি অবশ্য এক দিনও, উঠেইছে প্রতিদিন, কিন্তু নড়া বন্ধ হচ্ছে না। আর নাড়াচ্ছে আট-দশটা ব্লু-চিপ। তার মধ্যে তিনটে জাতীয় স্তরের দৈত্য। ব্যাপারটা কী? অন্য কেউ নাড়াচ্ছে না তো এই দৈত্যগুলোকে?
সকাল থেকে ফোন তিনটে ব্যস্ত। দীপকও সকাল থেকে নিজের চেম্বারে, কম্পিউটারে চোখ।
দুপুরে টিফিনটা নিয়ে চতুর্বেদীজীর টেবিলে খুলে বসল অনিল শ্রীনিবাস এল ওদিক থেকে চতুর্বেদীজী নিজের ছাতুর বোয়াম, গেলাস আর জলের বোতল বার করলেন বাকি তিনজন রিং থেকে এখনো ফেরেনি
-       ব্যাপারটা কিন্তু ভালো করছ না চচ্চু! এবার ঝগড়া হয়ে যাবে একদম ভালো করছ না
-       কী করলাম?
-       মেয়ের বিয়ে নিয়ে সমস্যা হয়, সবারই হয় পেটে পুরে রাখলে কি সমস্যা কমবে? যদি মনে হয় আমরা কোনো সাহায্য করতে পারব না, তবু তো বলে বুক হাল্কা কর ... কই দেখি! কী চিঠি এসেছে খবরের কাগজ থেকে দেখি! দেখি চিঠিগুলো! না দিলে কিন্তু জোর করে নিয়ে নেব দেরাজ ভেঙে
-       দেখাব না তুই শালা ব্রাহ্মণবাদী! তুই কী বুঝবি আমার সমস্যা? নিজে তো পণ নিয়ে বিয়ে করেছিস ...
কিন্তু চিঠিগুলো দেখাতেই হয় অনিলকে জাতপাতের ঘেরায় দুধরণের মানুষ থাকে এক, যারা জানে ব্যাপারটা মন্দ কিন্তু দুনিয়াদারীর সুতোগুলো ধরে রাখার জন্য সচেতনভাবে থাকে দুই যারা ওই সংস্কারেই প্রতিপালিত, অচেতনভাবে থাকে দ্বিতীয়দলের লোকেদের মধ্যে অনেকেই বেশ সহজ মানুষ নতুন ভাবনার স্বাদ একবার পেয়ে গেলে নিজের অতীত নিয়ে লজ্জিত হয় আর তা থেকে বেরিয়ে আসতে চায় অনিল সেই ধরণের ছেলে বিয়ে হয়েছিল গ্রামে, ম্যাট্রিক পড়ার সময় এখন সেসব কথা তুললে লজ্জিত হয় বরং পুরোনোপন্থী বৌয়ের সাথে ঝগড়া বাধায় মাঝে মধ্যে, এই সব নিয়েই
চিঠিগুলো দেখে, পড়ে সেও উদাস হয়ে যায়

অনিলকে বলেন না, তবে মনে মনে চতুর্বেদীজী একটা দুষ্টুবুদ্ধি নিয়ে খেলতে থাকেন একটা চিঠি বজ্জাতি। পাঁচটা চিঠি তাদের পরিবারের সাথে বিজ্ঞাপনদাতাকে একটা সমঝোতায় আনার চেষ্টা। কিন্তু শেষ দুটো চিঠি পড়ে মনে হয় পাত্র নিজেই নিজের অভিভাবক। বাকিদের সাথে কথা বলতে গেলে পাত্র থাকবে আড়ালে। এ দুজন নিজেরাই কথা বলবে।
চতুর্বেদীজীর এমন মনে হল। কেননা লাহোর হিন্দুস্তানে নেই আর খিলানের ওই মৌচাকটা সরাবার মত উঁচু সিঁড়িও কে জানে আছে কিনা এ শহরে। ওই দুজনের সাথে কথা বলা ছাড়া কোনো উপায় নেই গত কুড়ি বছরের বদলটাকে বোঝার। কামেশ্বর থাকলে ভালো হত। কিন্তু কামেশ্বরও যে নেই। একটিবার কথা বলবেন ওই দুজনের সাথে। বিয়ে? না না, বিয়ের পথে এগোনোর প্রশ্নই নেই। রশমিকে জানতেও দেবেন না। তবু, বছর চল্লিশের দুজন লোক একজন ইঞ্জিনিয়ার, একজন সামাজিক কর্মী যারা বছর তেইশের একটি মেয়েকে বিয়ে করার জন্য পাত্র হিসেবে এগিয়ে আসে, মেয়েকে সুখে সম্মানে স্ত্রী করে রাখার প্রতিশ্রুতি দেয়, পণ, যৌতুক চায় না, জাত জানতে চায় না; তারা কেমন লোক? কই, কোনো সমবয়সী তরূণ, বলিষ্ঠচেতা যুবক তো এগিয়ে এল না! সেরকম কেউ নেই এ প্রদেশে? আর এরাই বা কেমন লোক? বৌ-হ্যাংলা? মিথ্যুক, ষড়যন্ত্রী? নিপাট ভদ্রলোক? নাকি মনোরোগী? কী ভাবে তারা মেয়েটিকে? মেয়ের পরিবারকে কী চোখে দেখে তারা?
এত নির্মেঘ পরিবার তাঁর! সকালে রশমি চুলে বিলি কেটে দিচ্ছিল। চোখটা ছলছল করে এল চতুর্বেদীজীর। কী করে দূরে সরাবেন মেয়েটিকে? মাথা থেকে তার হাতটি নিয়ে নিজের বুকের ওপর রাখলেন। একবার ভাবলেন টেনে পাশে বসিয়ে পিঠে হাত বুলিয়ে দেবেন। তারপরেই মনে হল, না, এত টান ভালো না। বিদায় দিতে তো হবেই। আজ নয়তো কাল। ... উঠে পড়লেন।
-       কী হল?
-       কটা বাজে বল তো? কাজে যেতে হবে না? তোর তো ছুটি মনে হচ্ছে আজ!
-       না, দেরি করে যাব।
-       যা, দ্যাখ, মায়ের রান্না হল কিনা।
কবীর, খিদেটা কুকুর
বিঘ্নিত করে জ্ঞান।
দু এক টুকরো ফেলে
নিঃশঙ্কে কর ধ্যান।।

পবন টাওয়ারের পাঁচ তলায় সিনহা অ্যান্ড ওয়াধেরা কন্সট্রাকশন্সের অফিস। এ.পি.সিনহার চেম্বারটা দেখিয়ে দেয় দারোয়ান। একটি ছেলে কী কাজ জিজ্ঞেস করে স্লিপ এগিয়ে দেওয়ায় নিজের নামের দুই তৃতীয়াংশ লেখেন, অনন্ত প্রসাদ। ছেলেটিকে বলেন বল, ব্যক্তিগত। ছেলেটি ভিতরে গিয়ে বেরিয়ে এসে একটু অপেক্ষা করতে বলে। পাঁচ মিনিট পরে এক দম্পতি চেম্বার থেকে বেরিয়ে আসে। ছেলেটি চতুর্বেদীজীকে ভিতরে যেতে ইশারা করে।
-       নমস্কার। টাইমস অফ ইন্ডিয়ায় গত তিন তারিখে ম্যাট্রিমোনিয়াল কলামে একটা বিজ্ঞাপন বেরিয়েছিল, আপনি তাতে রেসপন্ড করেছিলেন ...
-       হ্যাঁ হ্যাঁ, নমস্কার! বসুন।
-       আমার নাম অনন্ত প্রসাদ। মেয়ের বাবা আমার কাজের জগতের বন্ধু। তবে একসাথে কুড়ি বছর ধরে কাজ করছি তো, পরিবারের মতই সুখ দুঃখ দায়িত্ব ভাগ করে নিই।
-       (কিছুক্ষণ নীরবতার পর) আপনি আমার চিঠিটা পড়েছেন তো?  
-       পড়েছি। (একটু ইতস্তত ভাব দেখিয়ে) আচ্ছা, আপনি এই বিয়েটা কীভাবে দেখেন?
-       ?
-       মানে, আপনার বয়স মেয়ের বয়সের দ্বিগুণ। বিয়ে হলে এটা আপনার দ্বিতীয় বিয়ে হবে। আপনি যৌতুক চাননা। মেয়ের জাত ইত্যাদি সম্পর্কেও, বলতে গেলে, উদাসীন। আপনার প্রথম পক্ষের ...
-       (কিছুক্ষণ বুঝতে চেষ্টা করে) বুঝেছি। আমার প্রথম পক্ষের স্ত্রীর সাথে আমার ডিভোর্স হয়ে গেছে। আমার বা আমার পরিবারের অত্যাচারে ডিভোর্স নিয়েছিলেন কিনা সেটা আপনারা তাঁর কাছ থেকেও জেনে নিতে পারেন। ঠিকানা, ফোন নম্বর আমি দিয়ে দেব। আপাততঃ আমার বলার ...
-       বলতে ইচ্ছে না হলে না বলতে পারেন।
-       না, শুনে নিন। বিশ্বাস করা না করা আপনাদের ব্যাপার। ... আসলে যখন বিয়ে হয়েছিল, বলতে গেলে বেকার ছিলাম। অভাব ছিল না, বাপের চাকরি, উপরি দুটোই ছিল, বড় সংসার ছিল। শুধুমাত্র লোভ ... না লোভও ঠিক নয়, লোকদেখানির জন্য বাবা পণ নিয়ে লেখাপড়াজানা মেয়ে ঘরে আনলেন আর তাকে জুতে দিলেন বড় সংসারের জোয়ালে। সারাবাড়ির খাটাখাটনি, ফরমায়েস ... আমিও বয়স আন্দাজে ভীরু ছিলাম। আবার আমাদের বাড়িটাও কোনো ক্রিমিনাল বাড়ি তো ছিল না, যে বৌ অবাধ্য হলে অত্যাচার করবে! বাপের বাড়ি চলে গেল সে। সেপারেশনের জন্য আবেদন করল কোর্টে। বলতে পারেন, ওই এক জায়গায় আমি দৃঢ় হয়ে নিজের বাড়ির ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে এক কথায় সেপারেশন মেনে নিলাম।
-       - কোনো ইস্যু ...
-       গর্ভবতী ছিল। আমি জানিনা ওর গর্ভপাতের ইচ্ছে ছিল কিনা। কিন্তু ওর বাড়ির চাপে ...
-       তিনি এখন কোথায়?
-       তিলাইয়ায়। চাকরি করে। স্কুলে।
-       আপনি খোঁজখবর নেন নি তারপর?
-       জিদ ধরে গেল। নিজের পায়ের নিচের মাটিটাকে শক্ত করার। ছোটো ঠিকেদারী থেকে শুরু করে আজ এখানে। তারই মধ্যে পড়াশুনো করে ল পাশ করলাম।
-       তাহলে এখন থিতু হয়ে বসে আরেকবার সংসার ...
-       হ্যাঁ, এখন একটু লোনলি ফীল করি।
-       কিন্তু (ইতঃস্তত ভাব দেখিয়ে) ... নিজের বয়সের রেঞ্জে কাউকে ...
-       তাও খুঁজেছি। তবে ...
-       কী?
-       মানে আমার বয়স একটু হলেও এখনও সুস্থ, শক্তসমর্থ আছি; সেরকম অবিবাহিত, বা ডিভোর্সি ইস্যুলেস কেউ ...
-       ইস্যুলেস কেন?
-       আমার সংসারটা আমারই সংসার হোক। আরেকটা সংসারের অবশিষ্ট ...
-       (থামিয়ে দিয়ে) বুঝেছি, বুঝেছি। ... সেই ভদ্রমহিলার নাম কী ছিল?
-       (ড্রয়ার খুঁজে কাগজ নিয়ে একটা ঠিকানা লিখে) সুষমা সহায়। এই যে ঠিকানা।
-       অযাচিত উপদেশ মনে হলে ক্ষমা করবেন। তবে, আমার মনে হয় আপনার একবার যাওয়া উচিৎ (হাতের কাগজটার দিকে তাকিয়ে) এই ভদ্রমহিলার কাছে।
-       নাঃ, ওই পুরোনো জীবনের কোনো কিছুতে ফিরে যেতে চাই না। হলে নতুন সম্পর্ক কিছু তৈরি হোক। ইট মাস্ট বি মাই ফ্যামিলি; আই মীন ...
-       কিন্তু, কিছু তো তাঁকে বলার ছিল আপনার। আজ এতদিন পর ... যখন বুঝছেন যে আপনিও সময় মত আপনার বাড়ির অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারেন নি।
-       হতে পারে। তবে এত দিন পর আবার ...
-       তো, এই বিয়েতে আপনি ডাউরি চান না, কাস্টও জানতে চান না পাত্রীর ...
-       না। তবে পাত্রীর সাথে কথা বলতে চাই সামনাসামনি। ছবি এনেছেন?
-       না। পরে এসে দিয়ে যাব; মানে আমি বা অন্য কেউ এসে দিয়ে যাবে। আচ্ছা, আসি তাহলে এবার?


রাস্তার বাঁদিকে সবকটি গলিই গঙ্গার দিকে নেমেছে। তাও আবার ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে, একে অন্যের সাথে মিলে মিশে। পৌঁছোবার পথটা জানা না থাকলে শুধু লিখিত ঠিকানার ওপর ভরসা করে পৌঁছোনো খুব মুশকিল।
তবু, লোকটি বোধহয় এলাকায় পরিচিত। কৈলাশনাথ ভারতী নামটা বলতে পানের দোকানওয়ালা একটা বাচ্চা ছেলেকে ডেকে সঙ্গে পাঠিয়ে দিল।
গঙ্গায় নামার সিঁড়ি শুরু হওয়ার একটু আগে, গলিটার ডান দিকে জীর্ণ সাইনবোর্ড
বার্হস্পত্য সমাজ
সহৃদয় প্রকাশন সংস্থান
ভারতী আবাসীয় বিদ্যালয় (মান্যতা প্রাপ্ত)
(নর্সরী সে সাতোয়াঁ তক)
বাচ্চা ছেলেটি ভিতরে ঢুকতে ইশারা করে চলে গেল। খোলা দরজা। বেলা চারটে বাজে। স্কুল ছুটি হয়ে গেছে নিশ্চয়ই অনেকক্ষণ। ভিতরে ঢুকতেই একটা ক্লাসঘর। লম্বা, পুরোনো ডেস্ক পাতা। ভিতরের দরজা পেরিয়ে বারান্দা সামনে ও বাঁদিকে। ডানদিকের বারান্দাটা ক্লাসঘরে পরিণত। সামনের বারান্দার পর উঠোন, কলতলা তারপর দেয়াল। বারান্দা ধরে বাঁদিকে যেতে এই ক্লাসঘরের পর আরো দুটো ক্লাসঘর। তারপর সরু সিঁড়ি। সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে ঠিক নিচের মতই দুটো ঘর। একটা অফিস। একটা হেডমাস্টারের ঘর। তারপর, অর্থাৎ নিচের বাইরের ঘরটার ওপর একটা আধতৈরি ঘর। বাইরের দিকটা টাট দিয়ে ঢাকা। কিছু লেখা নেই। ভিতরে সতরঞ্চি পাতা। বইয়ের আলমারি। একটা সাইকেল। একটা সিন্দুক। দেয়ালে কিছু ছবি। অফিসঘর থেকে একজন খোঁড়া লোক বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, কাকে চাই?
-       কৈলাশনাথ ভারতী।
-       আসুন।
সতরঞ্চি পাতা ঘরটার ডানদিকে পার্টিশন দেওয়া, চতুর্বেদীজী খেয়াল করেন নি। পার্টিশনের ভিতরে একজন লোককে জাগাল খোঁড়া লোকটি।
চশমা হাতে চোখ মুছতে মুছতে তিনি বেরিয়ে এলেন। খাদির আধময়লা পাঞ্জাবি, ধুতি। একটু মোটা। রঙ রোদজ্বলা। চুলে হাল্কা পাক ধরেছে।
-       কোথা হতে আসা হচ্ছে মহাশয়ের?
-       টাইমস অফ ইন্ডিয়ার একটা বিজ্ঞাপন দেখে কৈলাশনাথ ভারতী নামে একজন ...
-       বক্স নম্বর?
-       ৩৫৭২
-       তা, আপনি?
-       আমি পাত্রীপক্ষ থেকে ... মানে, পাত্রী আমার সহকর্মীর মেয়ে।
-       ওনারা চিঠি লিখলেই তো পারতেন। ঠিকানা দেওয়া ছিল। যেখানে বলতেন পৌঁছে যেতাম!
-       চিঠি আজকাল সময় মত কি আর পৌঁছোয়?
-       তা, আপনি পাত্রীপক্ষ থেকে এসেছেন, ভালোই করেছেন, চাক্ষুষ দেখে যাবেন বাড়িঘর। (কথা বলতে বলতে লোকটি হেডমাস্টারের ঘরে ঢুকে ভিতরের জানলাটা খুললেন, পাখার সুইচটা অন করলেন) আসুন। বসুন। বলুন কী জিজ্ঞাস্য।
-       ভারতীজী ...
-       অধমই কৈলাশনাথ ভারতী।  
-       নমস্কার! আমি অনন্ত প্রসাদ। তা এটা কি আপনার বাড়ি না শুধু স্কুল?
-       স্কুল, বাড়ি, অফিস যা বলুন সব এখানেই। বাইরে সাইনবোর্ড দেখেছেন নিশ্চয়ই।
-       বাড়িতে আপনি একা?
-       একা কোথায়? ওই যে দেখলেন, খোঁড়া লোকটি! ও আমার ভাইপো।
-       ভাইপো!
-       হ্যাঁ, ওই রকম দড়িপাকানো চেহারা তাই বয়স বেশি মনে হয়।
-       আর ভাই?
-       ভাই বলতে বড় ভাই, দাদা। ঘাটের মন্দিরে থাকেন, সন্ন্যাসী মানুষ। এখন আছেন, ফের কবে চলে যাবেন কোথাও!
-       আর আপনার বা আপনাদের বাবা? মা?
-       দুজনেই গত।
-       তা ... বিয়ে করেন নি কেন এতদিন?
-       আগে ভেবেছিলাম করব না। এখন মনে হয় করে নিলে ভালো হয়।
-       আচ্ছা, মেয়ের বয়স তো বিজ্ঞাপনে দেওয়া ছিল!
-       হ্যাঁ, তেইশ বছর। আমার প্রায় চল্লিশ। বয়সের বড় ফারাক। ... আসলে কী জানেন? একটা পরীক্ষা করতে চিঠিটা পাঠালাম।
-       পরীক্ষা?
-       হ্যাঁ। মুখে তো অনেকেই বলে, জাত মানি না। অনেক পাত্রপক্ষও থাকে আজকাল যারা বলে পণ নেব না, যৌতুক চাইনা দহেজ-বিরোধ! কিন্তু তলে তলে সব চলে। ... ভাবলাম, দেখি কতটা সাচ্চা বিজ্ঞাপন দেওয়া পরিবারটি। এই তো আমি, জাতে পাসি, হরিজন। যৌতুক নেব না তো নেব না, ব্যাস। ঘটাও করতে দেব না। মন্দিরে বিয়ে করব। পাত্রীপক্ষ ভরসা না করলে কোর্টে রেজিস্ট্রি করব। কিন্তু ওই প্যান্ডাল, ভোজ, সানাই, গয়না, উপহার ... সব ভড়ং। ... আমি বড়লোকও নেই যে এসব তিয়াগ করছি। হাঃ হাঃ। চাকরি করি না। ব্যবসা বলুন, সেবাব্রত বলুন, এই স্কুল, সমাজসেবা আর লেখালিখি নিয়ে আছি। দেখি বিজ্ঞাপনদাতারা কে কেমন!
-       লেখালিখি? মানে সাহিত্য?
-       হ্যাঁ, সমাজসংস্কারের সাহিত্য। (র‍্যাক থেকে হাতড়ে পেড়ে, ধুলো ঝেড়ে এগিয়ে দেন) এই দেখুন, নিন। নারীদের অনেক উঁচু আসনে আমি দেখি। আমার লড়াইটা তো মনুসংহিতার বিরুদ্ধে। ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কৃতির বিরুদ্ধে! ... গরীব হরিজন ছেলেমেয়েদের নিয়ে স্কুল চালাই।
চতুর্বেদীজীর হাতে তিনটে বই। সস্তা কাগজে ছাপা চটি বই চার্বাকের হত্যা, মহাভারত এবং আমাদের পরিবারতন্ত্র (একটি তূলনামূলক নীতিশাস্ত্রীয় আলোচনা) ... আর ইংরেজরা ব্রাহ্মণ্যবাদী ব্যবস্থাকে কীভাবে কায়েম রাখল
-       নিয়ে যান। পড়ে দেখবেন।
-       এ তো মহৎ কাজ! ...এই পথটা বেছে নেওয়ার কথা কীভাবে আপনার মনে এসেছিল?
-       আমার বাবা মা ছোটোবেলা থেকেই নেই। প্রকৃতপক্ষে আমার দাদাই আমাকে বড় করে তুলেছেন।
-       দাদা যে ... বললেন সন্ন্যাসী!
-       সে তো এই পনেরো বছর ধরে।
-       আগে কী করতেন?
-       সরকারী অফিসে কাজ করতেন।
-       উনিও বিয়ে করেন নি... ওঃ সরি, এই লোকটিই তো, বললেন ভাইপো ... তা, ওনার মানে আপনার দাদার স্ত্রী?
-       মারা গেছেন। তাতেই তো সন্ন্যাসী হলেন।
-       কী করে মারা গেলেন উনি?
-       খুব অসুস্থ থাকতেন। কী হয়েছিল কে জানে!
-       আর তাঁর মৃত্যুতে দাদা সন্ন্যাসী হয়ে গেলেন! ছেলের কথাও ভাবলেন না?
-       কখন কার মনে যে কী কাজ করে কিছু বলা যায়!
-       ঠিকই। আপনিও কি সেই তখন থেকেই নিজেকে সামাজিক কাজে ব্রতী করলেন?
-       না, এ কাজে তার আগে থেকেই ...
-       কিন্তু ব্রাহ্মণ্যসমাজের বিরুদ্ধে আপনার এই জেহাদ। এর পিছনে কোনো ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ? না বলতে চাইলে বলবেন না।
-       ওই সমাজব্যবস্থা, চিন্তাধারা তো আমাদের পঙ্গু করে রেখেছে! আমাদের মূর্খ, পাষন্ড করে রেখেছে! পুরূষতান্ত্রিক করে রেখেছে।
-       সে তো আপনার বৌদির মৃত্যুর আগে থেকেই ছিল!
-       (লোকটি কপাল ঘষেন) বলতে পারেন।
-       এই বাড়িটি কি আপনাদের পৈত্রিক?
-       (চমকে উঠে) হ্যাঁ, না, ... মানে আমাদেরই। (হঠাৎ জোরে হাঁক দেন) বাবলু!
বাবলু, মানে খোঁড়া ছেলেটি দরজার কাছে এসে দাঁড়ায়।
-       এনার চায়ের ব্যবস্থা করেছিস? ... করিস নি? ... বাঃ, এটাও তোকে বলতে হবে? এই নে, মহাবীরকে তিনটে চায়ের জন্য বল আর কিছু মিষ্টি কিনে নিয়ে আয় (কুড়ি টাকা বার করে এগিয়ে দেন)।
-       না না, আর মিষ্টির ঝামেলা করবেন না। এমনিতেও আমার বয়স হয়েছে ...
-       ঝামেলা আর কী? কেউ তো আর নেই বাড়িতে। নইলে কি আর দোকান থেকে চা আনিয়ে ...। আর মেয়ের বাড়ি থেকে আসছেন ... একটু মিষ্টিমুখ না হলে ...
-       আপনাদের খাওয়াদাওয়াও কি...
-       ওই বাবলুই করে। রুটি, তরকারি, ভাত, ডাল যেমন তেমন হোক, করেই নেয়।
-       দাদাকে বলেন না, সংসারে ফিরে আসতে?
-       কোনো লাভ নেই। উনি এখন পুরোটাই সন্ন্যাসী হয়ে গেছেন।



গত দুদিনের অভিজ্ঞতার কথা স্ত্রী পরমেশ্বরী আর মেয়ে রশমিকে শোনানোর জন্য ছটফট করছিলেন চতুর্বেদীজী
এ তো মাত্র দুটো এরকম ভূরি ভূরি আছে এই ধরিত্রীতে এমনই মহিলারাও আছেন নিশ্চয়ই! ... বড় জটিল ব্যাপার কবীর সাহেব কি এসবে সাহায্য করতে এগিয়ে আসবেন না? আর কামেশ্বরের রাহুলজী? এই জরদ্গব সমাজে কি উদারপন্থা হামেশাই উদরপন্থার পাঁকাল পথ ধরেই সম্ভূত হবে? এই জটিলতায় কীভাবে কেউ সহজ মানুষ হয়ে চলার কথা ভাববে? প্রতিপদে কুম্ভীপাক!
কিন্তু আসল কুম্ভীপাক যে ডেকে আনলেন চতুর্বেদীজী নিজেই! আগুনে তো পুড়লেনই, তাঁর মস্করা শুনতে রইল কেবল যমদূত

সন্ধ্যেবেলা বৌ ও মেয়েকে রসিয়ে রসিয়ে শোনাচ্ছিলেন ইন্টারভিউদুটোর গল্প লক্ষ্য করলেন রশমির মুখ থমথমে হয়ে উঠেছে উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপছে ওর শরীর গল্প শেষ না হতেই উঠে চলে গেল
চতুর্বেদীজী থতমত খেয়ে বাইরে গিয়ে দেখেন রশমি কার্ণিশে মুখ রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে
-       কী হল রে? তুই কাঁদছিস কেন?
-       কিচ্ছু না
-       আরে এ তো মজার কথা! গল্পের খোরাক! আমি কি তোর বিয়ে দেওয়ার কথা ভেবে ওদের কাছে গিয়েছিলাম নাকি? ... এ্যাই! কী হয়েছে কী? এভাবে কাঁদছিস কেন?
রশমি হঠাৎ সোজা হয়ে চোখটা মুছতে মুছতে বলে উঠল, আর কাঁদছি না, চলো!
-       কোথায় যাচ্ছিস?
-       ঘরে, কাল ক্লাস আছে সকাল সকাল; নোট তৈরি করতে হবে

রাতে পড়া ছেড়ে উঠে এসে খাবারটা খেয়ে গেল সকালে উঠে স্নান করে ব্যাগ নিয়ে কোচিংএ বেরিয়ে গেল রাতে বলেছিল, মা, খেতে দাও, সকালে, বাবা, মা, বেরোচ্ছি তৃতীয় কোনো কথা শোনার জন্য চতুর্বেদীজী ও পরমেশ্বরী দেবী হাপিত্যেশ করে রইলেন কিন্তু শুনতে পেলেন না
হতভম্ব ভাব নিয়েই চতুর্বেদীজী অফিসে গেলেন

একমাস হতে চলল সবকিছু স্বাভাবিকভাবেই চলছে বুড়ো পাটোয়ারির চাপে এবার ছোটো পাটোয়ারি সিরিয়াসলি ধরতে শুরু করেছে চতুর্বেদীজীকে, ভাগলপুরে যান চাচাজী, ফুড প্রসেসিংএর প্রজেক্টটা নিয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু করুন, আমাকে এডভাইস করুন কী করতে হবে ... কিছু একটা নতুন আইডিয়া খেলান মাথায় রেডিমেড গার্মেন্টস, হোটেল ... বাবা আমায় টিঁকতে দিচ্ছে না মঞ্জু পাটোয়ারী আগের মতই এক্সপিরিয়েন্স গ্যাদার করছেন
চতুর্বেদীজীর মন ভালো নেই রশমি বড্ড বেশি স্বাভাবিক আচরণ করছে হঠাৎ যেন বড় হয়ে গেছে একটু বেশি উনি দেখতে পাচ্ছেন পাথরটা রশমির শিরাউপশিরার জালে ফেঁসে থাকা পাথরটা হাজার চেষ্টা করছেন খুঁচিয়ে তুলে ফেলে দেওয়ার তুলতে গিয়েই টান পড়ছে শিরায় এবার রশমির যন্ত্রণাবিদ্ধ হয়ে কাঁদা উচিৎ কিন্তু রশমি হেসে চতুর্বেদীজীকেই শুনিয়ে দিচ্ছে
চৈতন্যের গলিপথে আমি খেলি যে দোল
প্রেমের পাঁক উড়ছে আজ হাওয়ায়
শব্দাতীতের কলরবে লোভ মোহ দুজন
পাশ কাটিয়ে, পালিয়ে প্রাণ বাঁচায়
এটা কিরকম হল? গুগলি? কী বলতে চায় মেয়েটা? খোলসা হয় না কিছুতেই চতুর্বেদীজী যে তিমিরে, সে তিমিরেই থেকে যান পরমেশ্বরীও বোঝেন কিছু একটা হয়েছে মেয়েটার কিন্তু তিনিও হদিশ করতে পারেন না মেয়েটা এত নিয়ম করে ক্লাস নেওয়া, পড়াশুনোয় মেতে আছে কেন? ও কি বিয়ে আর করবেই না, স্থির করে নিয়েছে? একটা ভালো পাত্রের সন্ধানও তো তাঁরা করে উঠতে পারছেন না!

আজ বিকেলে একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি যাবেন বলে মনিবের চেম্বারে অনুমতি নিতে ঢুকেছিলেন শ্রীনিবাস ভিতরে ঢুকে চতুর্বেদীজীকে কানে কানে ডাকল চতুর্বেদীজী বেরিয়ে ভুত দেখলেন
সামনে রশমি সিঁথিতে সিঁদুর পিছনে কৈলাশনাথ ভারতী দুজনে সামনে এসে ঢিপ ঢিপ প্রণাম করল
চতুর্বেদীজীর মুখে কথা সরল না এক লহমায় বুঝতে পেরে রশমি এগিয়ে এসে ধরে ফেলল অজ্ঞান হয়ে গেছেন

জ্ঞান ফিরল হাসপাতালে তখন চারদিকে সবাই দাঁড়িয়ে কিন্তু কেউ জানে না তাঁর জ্ঞান ফিরে এসেছে রশমির দিকে চোখ পড়তে মুচড়ে উঠল বুকটা চোখের ভিতরটা ছলছল করে উঠল আর কে জানে কেন প্রথম মনে পড়ল কৈলাশনাথ ভারতীর সন্ন্যাসী দাদার কথা তাঁকে দেখা হয় নি
কী হল এটা? কেন করল রশমি এমন? আমি কী কিছু ভুল করে ফেলেছিলাম, কিছু অন্যায় করে ফেলেছিলাম ওর প্রতি? ভাবতে ভাবতে অজানা একটা ভয়ের ঘড়ঘড়ে গলায় ডাকলেন, রশমি! হাত তুলতে চেষ্টা করলেন মেয়ে দৌড়ে কাছে গেল দেখল বাবা চোখে জল নিয়ে হাসার চেষ্টা করছেন
-       লাহোর হিন্দুস্তানে থাকলে এমন হত? না, হত না রে?
-       তুমি ভালো আছ তো বাবা? কেমন লাগছে শরীরটা?
-       কী জানি, হয়ত এমনই হত! নাকি, হত না? সেরে উঠব তো?
-       একশোবার! তোমার সমস্ত কিছু নর্মাল ডাক্তার বলছেন জাস্ট শক! (বলেই অধোমুখ হল রশমি) সরি, বাবা একটা লড়াই চালাচ্ছিলাম নিজের ভিতরে তাই কিছু বলিনি তোমাদের
-       পরমেশ্বরী, মেয়ে জামাইকে আশীর্বাদ কর ভারতীজী, নমস্কার
-       ছি ছি, এ কী বলছেন, আমি তো সম্পর্কে আপনার ছেলে হলাম!
-       সেবাব্রতে ব্রতী থাকবেন তো? নাকি
-       নিশ্চয়ই এবার তো আরো বেশি করে থাকব
-       লেগে থাকুন এখন আমার মেয়েও আপনার পাশে গিয়ে দাঁড়াল দেখবেন যেন আপনার বৌদির মত অজানা রোগে না মারা যায়
-       (কৈলাহনাথের মুখে একটা ছায়া; এসে পায়ে হাত দিল) অনেক কথা আছে বাবুজি আপনি সুস্থ হয়ে উঠুন আগে এই নতুন সংসারজীবন আমারও এক অগ্নিপরীক্ষা আর সে পরীক্ষায় আপনার মেয়েই আমার বিচারক আপনি আমার ওপর বিশ্বাস রাখুন তা আমি বলছি না কিন্তু নিজের মেয়ের প্রতি কিছুতেই বিশ্বাস হারাবেন না

সুস্থ হয়ে চতুর্বেদীজী অফিসে গেলেন সাত দিন পর এর মধ্যে তিন দিন মেয়ে জামাই তাঁদের কাছে এসে থেকে গেছে মেয়ে কোচিংএর কাজ ছেড়ে এবার ভারতীর স্কুলটা নিয়ে উঠে পড়ে লেগেছে একদিন সকালে জামাই বাইরে একটু হাঁটতে গেছে পরমেশ্বরী জিজ্ঞেস করলেন, কেন এই বিয়েটা করলি মা? তুই সুখী হবি? চতুর্বেদীজী অদূরেই ছিলেন তাঁর দিকে চোখ তুলে মেয়ে বলল, তুমি তো ওর বাড়িতে যাওনি মা! গেলে প্রথম প্রশ্ন করতে, তোর ভয় করল না? ... কী, বাবা, তাই তো? আমি তো বাবার ওই ব্যবসার জগৎ দেখেই শিখেছি যে বড় কিছু ভাবতে গেলে বড় রিস্ক নিতে হবে তবে, বাবা, বৌদির ব্যাপারে কৈলাশনাথ শুধু তার নীরবতায় ভাগীদার বৌদির বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর জন্য ও তাই নিজেকে দায়ী করে আর মা, তুমি দেখ স্কুলটা আমি কেমন করে সাজাই এর থেকে বড় সুখ কি চাকরী বা ঘরকন্না করে পেতাম? নাহয় একটু বুড়ো বরই হল আমার!
-       তুই সত্যি বলছিস না মা আমার ওপর রাগ করে, বা একটা মিথ্যে হতাশা থেকে এই সিদ্ধান্ত তুই নিয়েছিস
-       (রশমি সোজাসুজি বাবার দিকে তাকায়) না বাবা প্রথম প্রথম আমিও সেটাই ভাবতাম আর ভিতরে দ্বন্দ চলত হয়ত, এখনও ভাবি ... তবে, তার থেকে বড় সত্য, নিজের জীবনটাকে বড় প্রজেক্ট হিসেবে ভেবে রিস্ক নিয়েছি
-       (রেগে)কিসের বড় প্রজেক্ট? তুই বড় বিজনেস-ওম্যান হবি?
-       না গরীব ছেলেমেয়েদের জন্য একটা এত ভালো স্কুল করব, এত ভালো লেখাপড়ার সুযোগ দেব যে সম্পন্ন গৃহস্থরাও নিজের ছেলেমেয়েদের সেখানে পাঠাতে চাইবে
-       আর, তাতে ওই ... তোকে সাহায্য করবে?
-       সেটাই তো ও কথা দিয়েছে

আটতলা বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে উপরে তাকিয়ে দেখলেন, যেমন ছিল, তেমনই আছে মৌচাকটা বাঃ, বেশ! ধরাছোঁওয়ার বাইরে থাকতেই পার তোমরা থাক তবে আমি আর পরমেশ্বরী চললাম ভাগলপুর গুডবাই ...

________
 

  

No comments:

Post a Comment