Tuesday, July 31, 2018

লোহার কড়াই


লোহার কড়াই মানে লোহার কড়াই
কিসে কী হয় জানিনা বাপু!
রান্না খেলে শরীরে লোহা যায় কিনা, লোহা গেলে শিরদাঁড়া সোজা থাকে কিনা, আর শিরদাঁড়া সোজা রেখেই বা আজকাল কী লাভ ...
ব্যাস, আবার তুমি উল্টা বাউল গাইতে শুরু করলে!
ওসব ছাড়ো, হাতে গুনছি
এক, যে ভারী বলে পিছলে টাল খেয়ে উল্টে যাওয়ার সম্ভাবনা কম ডান হাতের আটা মাখাটায় হাত ডুবিয়ে বাঁ হাতে খুন্তি নাড়া চলে
দুই, যে দিব্যি ঝামা ঘষে মাজা যায়, ঝিয়ের হাতে পড়লে সতর্ক থাকতে হয় না
তিন?
আর দরকার?
চোর বা বাওয়ারিশ কেউ ঘরে ঢোকার চেষ্টা করলে মাথায় ঠুকে দেওয়া যায়, হুলো বেড়ালের মাজা ভেঙে দেওয়া যায় হল?

আগে না হয় ভাবা যেত পাড়াটা শেষ হত রেললাইনে তারপর সরকারী কৃষিফার্ম, সবুজ, জনমানবহীন বাঁদিকে দূরে পাওয়ার হাউজ দিনেদুপুরে ডাকাতি সারার ভালো এলাকা ছিল তা বলে এখন?
ফার্মের আদ্ধেকে ভাগ বসিয়েছে বাসস্ট্যান্ড, তারপর ব্যস্ত নতুন বাজার আর কলোনী আমাদের পাড়াটার তো কথাই নেই এখন এই রাস্তা চলে গেছে পুনপুন অব্দি সারা দিন চলে বাজাজ, বিক্রম, পিয়াজ্জিও, টাটা চারশো সাত এসবের হৈহাল্লায় বেলা আটটায় ডাকাতি? তাও আবার কোনো বড়লোকের বাড়িতে নয়, গরীব বাঙালি বামুন পরিবারের আড়াইখানা ঘরে?
-      কী বলব দিদি, কখনো ভেবেছিলাম নাকি? ঘরে মা; বাবা সদ্য খেতে বসেছে ডিউটিতে যাবে বলে তারপর আমার বড় মেয়ে, জামাই ছোটো মেয়ে ... হ্যাঁ, বড় মেয়ে-জামাইয়ের বাড়িতেই তো উঠে এসেছিলাম গত বছর! ... না, ওখানে আর কুলোচ্ছিল না, তারপর জামাই বলল ... খরচটা, ওই বাবা কিছুটা দিত, আমার তো জানো এখন কাজ নেই হাতে, ছোটো মেয়েটা কিছু সেলাই-ফোঁড়াই করে পায় ... বলতে গেলে জামাইই চালায় পুরো সংসারটা ... চমকে সবার চিৎকারগুলো গলায় আটকে গেল বলে প্রাণে বেঁচে গেলাম কারোর কোনো রকম আঘাত লাগল না ... মেয়েটার জন্যই তো ভয় ছিল কী আবার নেবে সোনাদানা তো আর ছিল না সংসারের জিনিষপত্র সব নিয়ে গেল বাসনকোসন কাপড় টিভিটা তিনটে হাতঘড়ি ... হতে পারে! ... আঃ, এত তেষ্টা পেয়েছিল! সেই কখন বেরিয়েছি ... বাঙালি বলে! হতে পারে গরীব বলেই! ডাকাতরাও এই আমাদেরই মত ছিল বোধহয় নইলে ঘরের জামাকাপড়, রান্নার হাঁড়ি-খুন্তি-কড়াই এসব আবার কেউ নিয়ে যায়?
হ্যাঁ, বাবাকে তো সবাই চেনে শ্রদ্ধাও করে চল্লিশ বছর ধরে কম্পাউন্ডার মল্লিক হোমিও ফার্মেসিতে ... কালিয়া কালিয়া ছিল বাবার ... না না, মা তো আরো আগের থেকে এদিককার ... মা, ঘুমিয়ে পড়লে? এ্যাই নীরু, মাসির ঘরটা একটু গুছিয়ে দে ততক্ষণ! ... তুমি বস দিদি, আমি চাপিয়ে দিচ্ছি ভাতটা
হ্যাঁ, বড় জামাই তো ফ্ল্যাট নিয়েছে একটা, ভাড়ায়, ইয়ারপুরে আমরা মন্দিরীতে আছি
ওই তো অশ্বত্থগাছের নিচের মন্দিরের পাশ দিয়ে যে গলিটা ভিতরে গিয়ে ডান দিকে... হ্যাঁ, সরু হওয়ার পর আরো পাঁচটা বাড়ি পেরিয়ে ডানদিকে তোমার আছে কোনো জানাশুনো দিদি? সারাদিনের জন্য ঘরের কাজের লোক চাইলে ... নীরুর যা বয়স, ওকে পাঠাতে চাই না আমিই করব তুমি তো তোমার ভাইয়ের বাড়িতে দেখেছ আমার কাজ ...
জামাইবাবু রাগ করবেন না তো দিদি? এ তো লোহার কড়াই! পুরোনো, ভারী লোহা! বরং এলুমিনিয়ামের হাল্কা একটা কড়াই হলেও আমার চলত না দিদি, ডেকচি আর দিও না, একটা কিনেছি কোনো রকমে বরং পুরোনো শাড়ি একটা আর বিছানার চাদর বেশি থাকলে একটা দিও ... কী বলব দিদি কাউকে বলতেও তো লজ্জা করে কতজনের কাছে হাত পাতব! ...

-      তা ওই দিদি বাঙালিন বলে আর পুরোনো পরিচিত বলে আমার কোনো দাবী নেই না কী? অত ভালো লোহার কড়াইটা বাগিয়ে নিয়ে যাবে মায়ে, বেটিতে আর নাতনিতে মিলে? আর আমি যে এ বাড়িতে কাজ করছি দেড় বছর ধরে? কতবার যে তোমার গা হাত পা টিপে দিলাম দিদি? বকাবকি কর, রাগ হয়, বাসন আছড়াই, আবার ফিরে আসি ... বরটা দিব্যি অটো চালাত মদ গিললে মারধর করত, তবু তো ছিল! কেটেই ফেলল ওকে কারা কাটল? জানি, কিন্তু কিচ্ছু করতে পারব না আমি এখন দুই মেয়ে আর এক ছেলে নিয়ে ঘানি টানছি সংসারের ... মাথার ওপর বলতে আছেন শ্বশুর, শাশুড়ি মাথার ওপর বলতে একেবারেই মাথার ওপর আমি বিধবা মেয়েমানুষ ওই এক ঘরে মেঝেতে শুয়ে থাকি বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে আর ওনাদের বুড়ো বয়সের রসকেলি চলে মাঝরাতে খাটের ওপর ... দেওরটা তার নিজের বৌকে ছেড়ে এখন আমার পিছনে পড়েছে আবার বিয়ে করব? ছেলেমেয়েগুলোর কী হবে? ... যদি বড় মেয়েটাকে উঠিয়ে নিয়ে যায় কেউ? বলতে নেই, দেখতে তো সুন্দর হয়ে উঠছে দিন কে দিন! ... আমাকেও তো দিতে পারতে দিদি কড়াইটা! তোমার আছে দিদি, তাই প্রয়োজনে একটু মশলা, তেল, একটু চিনি চুরি করি এমন কী অপরাধ? ... কী করে বুঝলে ওই মেয়েমানুষ সত্যি বলছে? আর রাস্তায় নেমেছিস তো এত বাছবিচার কিসের, কাজে? বামুন বলে? আমিও তো বানিয়াইন! করছি তো দশ ঘরের কাজ! লড়ে যাচ্ছি দুদশ টাকার চিনি তেল অপরাধ হল? আমাকে লুকিয়ে দিয়ে দিলে কড়াইটা?

সত্যিই তো, কী এমন অপরাধ? আর যদি ভালো মনে ভাবো, দেখবে একটু আধটু বেইমানিতেই আস্ত থাকে ইমান একটু আধটু চুরিতে অটুট থাকে সততা বেঁচে বর্তে থাকে বেইমানি না মাখিয়ে কাঁচা ইমানটাকে মেলে ধর, চুরি বাদ দিয়ে শুকনো সততাটা তুলে ধর, ফস্‌ করে জ্বলে শেষ হয়ে যাবে সোডিয়ামের মত
মিথ্যে ছাড়া সত্য থাকে নাকি? মিথ্যেই তো সত্যের বস্ত্র, খাদ্য, আচ্ছাদন এবং বয়সকালে শিক্ষা ও রোজগার মিথ্যে তো সত্যেরই শিল্প এবং সেই শিল্পেই তো মূর্ত্ত হয় সত্য মিথ্যে বিনা যে বিমূর্ত্ত সত্য তা কি দেখা যায়? না ছোঁওয়া যায়? না অন্তরে নেওয়া যায়?
এই যে রাজমণি কোথায় ওর সত্য আর কোথায় ওর মিথ্যে? বলে খেয়ে পরে মানুষ কিন্তু সকাল সকাল যেদিনই দেখা করতে আসে কিছু খেয়ে যায়, কিছু মায়ের জন্য নিয়ে যায় না না করেও নিয়ে যায় আলু, পেঁয়াজ, সব্জী বিলাস প্রসাদ ওর বর কিন্তু অন্য কারোরও বর সেই সাথে থাকে জিতেন্দ্র সিং ওর বর নয় কিন্তু খোঁজখবর রাখে, দেখাশুনো করে, বিপদে আপদে সাহায্যও করে যে ছেলেটি ওর বুকের দুধ খেয়ে মানুষ সে ওরই ছেলে কিন্তু একটা গোঁজামিল রয়েছে আর যে মেয়েটির প্রতি ওর স্নেহে কোনো গোঁজামিল নেই সে আবার আজ ওর দিদির মেয়ে জিতেন্দ্র সিংএর সাথে দেখা হলে কত কথা, কত ব্যথা আবার দেখা হোয়ার আগে অব্দি শেষ মরিয়া চেষ্টা যাতে দেখা না হয় বরের সাথে দেখা করতে যায় রায়পুরে, বলে সতীন নাকি বড়বৌএর মর্যাদা দিয়ে রাখে; বরের কাছ থেকে লাখ টাকার প্রতিশ্রুতি নিয়ে আসে ছেলের পড়ার খরচ মেটাতে, কিন্তু সে টাকা আর আসে না
এ বাড়িতে আসত, বিশেষ বন্ধুর মত সারা দিন থাকত যখন কিছুদিন একা ছিলাম, দিনের পর দিন আমার খাবার নিচে রেখে দিয়ে গেছে ওর টাকা চাই আমি যদি অন্ধকারে টেনে নিয়ে গিয়ে ওকে জোর দেখিয়ে বলতাম, শরীর দে তবে টাকা পাবি, ও দিত না তোমার বরকে ও পথে টানার ভাগীদার ও হত না
অথচ রাজমণিকে আজ যারা টাকা দিচ্ছে তারা ওর শরীরের পুরোনো স্বাদ মনে করে কিছু ভিক্ষে দিচ্ছে হয় ওদের কাছে যাবে রাজমণি যারা ওর সত্য দেখে টাকা দেবে অথবা আমাদের কাছে আসবে যারা ওর মিথ্যে দেখে টাকা দেবে যে এসব কিছুই নয়, ওর বর ভালো কাজ করে, ওকে রানীর মত রাখতে চায় সারা জীবন, সে এলেই আমাদের টাকাটা মিটিয়ে দেবে
কিন্তু এটা মিথ্যে আর ওটাই সত্যি তাই বা বলি কী করে? সত্যের মধ্যেও যে মিথ্যে রয়েছে আর মিথ্যের মধ্যে সত্য
যতদিন সত্যি-মিথ্যের মিশেলটা ছিল, ও আসত দাপটের সাথে আসত ভালোও লাগত ধীরে ধীরে যখন বুঝল যে মিথ্যের মিশেলটা উবে গিয়ে কাঁচা সত্য দাঁত দেখাচ্ছে, ও আসা বন্ধ করে দিল
-      না না, বাজে বলছ, টাকাটা তো নিয়েই গেল ধানাই পানাই করে তাই আসা বন্ধ করে দিল
-      কিন্তু আদ্ধেক টাকা তো ফিরিয়েও দিয়েছিল, মানে যোগাড় করে এনে দিয়েছিল তোমার প্রয়োজনে
-      সে তো আমারই বালাটা চুরি করে বিক্রি করে
-      তারপরেও তো আমরা কিছু বলিনি নিছক সন্দেহের ওপর তো কিছু বলা যায় না
-      কিন্তু সন্দেহ তো করা যায় আর যাকে করছি তাকে বোঝানো যায় তাতেই তো উবে যায় মিথ্যের মিশেলটা অথবা হয়তো ওর মিথ্যেটাকেই সত্যি বলে দাঁড় করিয়ে দিই ওর সামনে আর সত্যিটা কুন্ঠিত, শ্বাসরুদ্ধ হয় নির্মমভাবে এতটাই নির্মম যে ও বুঝে যায় আমরা জেনেশুনে করছি ওর কঠোর সত্যটাকে ঠাট্টায় অপমানিত করছি
-      যাই বল, ও যেমন ঘোড়েল মেয়েছেলে থানা পুলিস বল, গুন্ডা বল, সবার সাথে বন্ধুত্ব মনে হয় না খুব বেশি লজ্জা টজ্জা ও পেয়েছে এ ভাবেই চলছিল ওর জীবন, এখনও চলছে নেহাৎ চক্ষুলজ্জায় আসা বন্ধ করেছে হয়তো অন্য কোথাও যাচ্ছে আজকাল অথচ খারাপ লাগে ভাবতে

চক্ষুলজ্জা হ্যাঁ, সেটাই তো বলছিলাম ওই যে বললাম বয়সকালে মিথ্যা হয় সত্যের শিক্ষা ও রোজগার! লজ্জাটা হল শিক্ষা আর চক্ষুলজ্জাটা হল রোজগার যেমন জীবনের ফাঁকি একটা কাঁচা, বেরিয়ে থাকা সত্য সব সময় লজ্জা সবাই দেখে ফেলছে, এর থেকে মরে যাওয়া ভালো মনে হয় অথচ বিবেকের এই শিক্ষাটুকু নিয়ে বেঁচে থাকা যায় না আবার, ওই ফাঁকি নিয়েই বেঁচেও থাকতে হবে তাহলে বরং ফাঁকিটাকেই বেঁচে থাকার রসদ করে তুলি চক্ষুলজ্জার আধঢাকা আবরণে নিজেকে করে তুলি বৈচিত্রময়, রহস্যময়! কিছুটা বেহায়া, কিছুটা লাজুক!
সত্যের যা কিছু খাবার মিথ্যেই জোটায় সত্যের তো ক্ষমতাই নেই নিজের জন্য খাবার জোটানোর বড় বড় সত্যগুলো পেটভরা ক্ষিদে নিয়ে একে অন্যের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে আর মিথ্যেরা দিনরাত তাদের জন্য খাবার জুটিয়ে চলেছে

যাবার সময় প্রীতি বলেছিল, আর কখনো দেখা হবে কিনা জানি না কাকি কাঁদছিল এবং খুব আদর করে গিয়েছিল আমায়
পাঁচ বছরে এ বাড়িতে কবার এসেছিল? খুব বেশি বার নয় দুএকবার নিজের আগের বর আর দুই মেয়েকে সঙ্গে করে বাকি প্রত্যেকবার একা এবং ঝড়ের মত কখনো শাড়ি, কখনো জিন্স খুব সাজগোজ আর চোখের নিচে কালি শুনলাম বরের নাকি বড় অসুখ শুনলাম শ্বশুরবাড়ির লোকজন ওকে পছন্দ করে না শুনলাম বর সঙ্গে থাকে না আবার একবার বরকে সঙ্গে নিয়ে এল তারপর শুনলাম ওরা আলাদা ঘর নিয়ে থাকে তারপর আবার ও একা ঘর নিয়ে থাকে একবার নাকি ঘর ছাড়তে হল মিথ্যা অভিযোগে যে ও মাঝে মধ্যেই ঘরে নতুন নতুন পুরুষ নিয়ে আসে
এখানে এসে বুভুক্ষুর মত দুটো ভাত খেয়ে যেত ... তারপর এই শেষবার এল নতুন বর সঙ্গে নিয়ে ওর সাথে নাকি হাসপাতালে দেখা এত শরীর খারাপ হয়েছিল প্রীতির যে হাসপাতালে ভর্ত্তি হতে হয়েছিল সে হাসপাতালে এই ছেলেটিও ছিল পা ভেঙে গিয়েছিল কোনো দুর্ঘটনায় ছেলেটি ওর প্রতি করুণায় ওকে বিয়ে করেছে
কিন্তু ওর মুখে আগের পক্ষের বরের অসুখের জন্য চিন্তার ছায়া দেখলে বিরক্ত হয়ে ওঠে আগের পক্ষের মেয়েদুটোর কথা শুনলে আরো বিরক্ত হয়ে রেগে ওঠে কেন না ছেলেটি নাকি বড়লোক বনেদি বাড়ির ছেলে সেখানে এটুকু খবরেই বাড়ি তোলপাড় যে ছেলে পাটনায় গিয়ে চালচুলোহীন একটা মেয়েকে বিয়ে করেছে এর পর যদি শোনে মেয়েটির জাতের ঠিক নেই, আগেও বিয়ে হয়েছিল, বর এখনও বেঁচে আছে আর দুটো মেয়েও রয়েছে ...!
কিন্তু ছেলেটি করে কী? ব্যবসা করে কিসের ব্যবসা? বোঝা যায় না নানা রকম ছায়া ছায়া মানুষের সাথে ফোনাফুনি, দেখাসাক্ষাৎ!
কোথায় নিয়ে যাচ্ছে প্রীতিকে ওর ভবিতব্য? এটাই বড় প্রশ্ন ছিল ও শেষ বার যাওয়ার বেলায়
প্রথম সম্ভাবনা, ও শ্বশুরবাড়ি যাবে বরের সঙ্গে তারা স্বীকার করে নেবে এবং অন্দরমহলে গোপন ঘরে ঢুকিয়ে তিলে তিলে মেরে ফেলবে এক বছরের মধ্যে যাতে ছেলের আবার বিয়ে দেওয়া যায়
দ্বিতীয় সম্ভাবনা যে ছেলেটি তাকে আলাদা ঘরে রাখবে ব্যবসার কাজে ব্যবহার করবে প্রীতির শরীরটা? তাহলে অন্ততঃ প্রীতি ততদিন বাঁচবে যতদিন শরীরটা কাজে লাগে
তৃতীয় সম্ভাবনা, জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণায় ও নিজেই শেষ করবে নিজেকে পারবে? আগের পক্ষের শ্বশুরবাড়িতে ফুলের মত মেয়েদুটো কীভাবে আছে একবার ভাববে না?
চতুর্থ সম্ভাবনাঃ ও আবার পালাবে এবং মৃত্যুর ছোবল শরীরে লাগিয়ে যত দিন পারবে বাঁচবে তাহলে হয়তো মেয়েদুটোকে দেখতে পাবে কয়েকবার, বা অসুস্থ বরটাকেও দেখতে পাবে, পরিবারের নজর এড়িয়ে তাহলে হয়তো আবার আসবে আমাদের সাথে দেখা করতে নীল, কালশিটে পড়া গাল ঘষবে আমার দাড়িতে
কিন্তু লোহার কড়াইয়ের মত কোনো জিনিষ কি কোনোদিন ওর কাজে লাগবে?
ওর বাবা নাকি পাঞ্জাবী আর দাদু নাকি দেশভাগের সময় এদিকে এসেছিলেন শিয়ালকোটের মন্ডি ছেড়ে এসে পাটনায় আবার ব্যবসা গড়ে তোলা দাদু কি দেখতে পাচ্ছেন তাঁর এক নাতনি কিরকম জাহান্নামের আগুনে পুড়ছে? লোহার কড়াই দূরে থাক, এ্যালুমিনিয়ামের পাতলা কড়াইও কতবার উল্টে দিয়ে ছুটলো কখনো বুকের দুধের তাগিদে, কখনো পেটের খিদেয়, কখনো যৌবনের তাড়নায় আর সবচেয়ে বেশি, একটু শান্তির আশ্রয়ের খোঁজে

সুমির কথা বিশেষ বলব না ওর জীবনে লোহার কড়াই পাওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও থাকতে পারে
ও নাকি কাজ করবে বাড়ির কাজ তাই ওকে নিয়ে এসেছিল মল্লিকবাড়ির ঝি ওদের পাড়ায় নাকি সন্ধ্যেবেলায় এক কোণে হাতে মাথা গুঁজে বসেছিল মেয়েটি দাদার বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে মামার বাড়ি যাওয়ার রাস্তা জানা নেই
সে যাই হোক, উঁচু জাতের ফুটফুটে কিশোরী, সে হবে ঝি? বাড়ি এসে দেখি আমারই বিছানায় আমারই চাদরটা গায়ে টেনে ঘুমিয়ে আছে তোমারও ওঠাতে মায়া লাগছে
যদ্দিন ছিল, সামনে আসতেই যেন কন্যাদায় দিয়ে যাচ্ছিল আমায় তারপর একদিন বন্ধুদের ডেকে মিটিং করলাম একে রাখা যেতে পারে না, যেমন করে হোক ওকে বাড়িই ফেরাতে হবে এদিক ওদিক খোঁজখবর ... একদিন এসে শুনলাম চলে গেছে ওর মামা খুঁজতে খুঁজতে পৌঁছে গিয়েছিল কী জানি মামা কেমন? ... দেখলে, নিজের সোয়েটারটা রেখে তোমার শালটা গায়ে দিয়ে গেছে! এখনো ভাবি, যদি থেকে যেত? যদি শেষ অব্দি আমাকে কন্যাদানই করতে হত? কার হাতে দিতাম ওকে?...

সেই লোহার কড়াই তাতে রান্নার স্বাদই আলাদা, তুমি আমাকে বোঝাও ধীরে ধীরে তোমার রান্নার স্বাদে তোমার ছেলের জিভ গড়ে উঠছে, যেমন আমার জিভ আমার মায়ের রান্নার স্বাদে গড়ে উঠেছে মেয়ের জিভ ত কলকাতায়, দিদাদের হাতের রান্নায় গড়ছে তোমার ওই সাততাড়াতাড়ির ঘন্টটা সত্যিই দারূণ হয়

কিন্তু আমার এখনো মনে পড়ে সেই বিয়ের পরের এক রাত্তিরের ঘটনা দুজনে ভালোবাসছি দুজনকে আর হঠাৎ আমার মনে হল তুমি অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছ কী হল, জিজ্ঞেস করায় তোমার চোখে জল চলে এল তুমি বলতে লাগলে তোমার সেই আদিবাসী বান্ধবীর কথা যাকে তার বর আর তার ছোটো বোন পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করছিল আর সত্যিই এক ট্রাকের ধাক্কায় সে পৃথিবী থেকে সরে গেল কিছুদিন পর তার প্রভিডেন্ট ফান্ড আর গ্রাচুইটির টাকা নিয়ে সুখের সংসার পাতল তার বর আর ছোটো বোন দূরে কোথায় রয়ে গেল সেই নারীর ছোটোবেলার তালপুকুরে রোদ আর তার নিঃসঙ্গ বাপের, একা রান্না করে জীবন ঠেলার জন্য, মেয়েরই কিনে দেওয়া লোহার কড়াই

আমি সেদিন হেসে উঠেছিলাম এখনো হাসি কত নারীর কত ব্যথায় ভরা তোমার শরীরে একটু সতর্ক হয়ে ভাসি আর নিজের সেই সতর্কতায় হাসি হাসি নিজের অক্ষমতায়, যে মহান মানুষ নই কাজের বেঘোরে মিশিয়ে এক করে নিতে পারি না ভালোবাসার যন্ত্রণা আর সুখ                        



No comments:

Post a Comment