Thursday, August 2, 2018

টুসু


সকাল সাড়ে ছটা সরোজিনী আজ তাড়াতাড়ি ফিরছেন এপার্টমেন্টের দারোয়ান অবাক হয়ে এগিয়ে এসে গেটটা খুলে দিল
-       দুবে সাহেব ফিরেছেন?
-       উনি তো আজ যান নি মর্নিং ওয়াকে ম্যাডাম!
-       ওঃ, তাই দেখলাম না রাস্তায় আমি হাবলাম কী জানি! ... আর তাই ফিরেও এলাম যাই, একবার দেখা করে তারপর বাসায় ফিরব

সরোজিনীর ফ্ল্যাট সি ব্লকে, তিন তলায় লেখিকা, একা থাকেন বিধবা এবং ছেলে, মেয়েরা সবাই বাইরে ব্রজনারায়ণ দুবে অবসরপ্রাপ্ত সরকারী আধিকারিক তাঁরও সুখ্যাতি আছে বিদ্বৎসমাজে, নৃতত্ববিদ হিসেবে তিনিও একা থাকেন কেননা পরিস্থিতি এক তাঁর ফ্ল্যাটটা কমপ্লেক্সে ঢোকার মুখেই ব্লকে, দোতলায় নোয়ডা, সেক্টর ওয়ানে এই কমপ্লেক্সটা সবচেয়ে পুরোনো
সরোজিনী ধাক্কা দিতেই দরজাটা খুলে গেল কাজেই সোজা ঢুকে গেলেন খাবার জায়গাটায় নাঃ সকালে শেষ করা কফির কাপটা নেই; টেবিল খালি বুকটা অল্প ছ্যাঁৎ করে উঠল একটু ইতস্ততঃ করে ঢুকে পড়লেন শোবার ঘরে
-       ঠিক সময়ে এসেছেন একটু সাহায্য করুন উঠতে
-       মাটিতে শুয়ে কেন? কী হয়েছে আপনার? আরে! নাকটা পুরো রক্ত-রক্ত হয়ে আছে! ... ইস্‌স্‌, পড়ে গেছিলেন?
-       হাতটা ধরবেন?
-       ওঃ, সরি!
পাশে বসে হাতটা কাঁধের ওপর ফেলে আগে বসালেন তারপর টেনে তুলে বিছানায় বসাতে গিয়ে নিজেও ধপ করে বসে পড়লেন
-       হবে না বসে থাকুন গার্ডকে ডাকছি ডাক্তারকেও খবর দিতে হবে আসছি আমি

ডাক্তার ওষুধপত্র দিয়ে চলে গেছে প্রেশারটা বেড়ে গিয়েছিল খুব বেশি একটু সাবধানে থাকতে হবে সরোজিনী দুবেজীর রান্নাঘরে দুকাপ কালো চা তৈরি করতে করতে বললেন, ভাগ্যিস, অর্জুন রাওয়াতের কবিতায় টুসুর গান ঢুকতে চাইছিল, তাই সময় মত আসতে পারলাম
-       অর্জুন রাওয়াতটি কে?
-       মল্লিকা রায়চৌধুরী যাকে ভালোবাসে
-       নাউ, হু ইজ দিস মল্লিকা রায়চৌধুরী?
সরোজিনী এক কাপ চা দুবেজীর হাতে দিয়ে নিজের চাটা নিয়ে চেয়ারে বসলেন পড়ার টেবিলেই কাঁচের বয়ামে বিস্কুট রাখা থাকে খুলে দুটো দুবেজীকে দিলেন
-       আমি তো মুখই ধুইনি এখনো!
-       আমাকেই বা ধুতে দিলেন কই? খেয়ে চাটা খান নইলে আবার আরেক ঝামেলা হবে ... মল্লিকা রায়চৌধুরী হল টুসু গানের এলাকার মেয়ে আর আমি টুসু সম্পর্কে কিচ্ছু জানি না কাল রাত থেকে ভাবছি আপনার সাথে দেখা হলে জিজ্ঞেস করব
-       ফোন করলেন না কেন?
-       ও মা! আমি কী করে জানব মর্নিং ওয়াকে আপনার দেখা পাব না আজকে!

সরোজিনী নিজের ফ্ল্যাটে গিয়ে চান করলেন ডালটা প্রেশার কুকারে বসিয়ে, ভিন্ডির ভুজিয়া কড়াইয়ে সিম আঁচে চাপা দিয়ে নিজের টেবিলে এলেন চলতে থাকা লেখাটার মাথায় টুসু লিখে দুবেজীর কাছ থেকে পাওয়া তথ্যগুলো টুকে রাখলেন রুটি করলেন গার্ডকে ডাকলেন নিজের এবং দুবেজীর খাবার হটকেসে সাজিয়ে বললেন ব্লকে ১০২য়ে পৌঁছে দিতে তারপর ঘড়ির দিকে তাকালেন বারোটা এখনো বাজে নি দুবেজী একটার আগে খান না সময়টার সদ্ব্যবহার করা যাক
চলতে থাকা লেখাটা নিয়ে বসলেন

এজাজ নার্সিং হোম বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ডাক্তার মোঘনির হাতও খুব ভালো তাই রুগীর ভীড় তবে অর্জুন রাওয়াতকে খাতির করেন ডাক্তার হার্নিয়ার অপারেশন দোতলার এক কোণে জানলার ধারের ঘরটা পছন্দ হয়েছিল অর্জুনের সেটাই পেয়েছে
জানালার অদূরে একটা মুচুকুন্দ গাছ চওড়া, ভারী পাতাগুলো হাওয়ায় ওলটপালট হতে থাকে গাছের পাশ দিয়ে কলোনির পুরো রাস্তাটা, বড় রাস্তা অব্দি দেখা যায় বড় রাস্তা পেরিয়ে ওপারে একটা সরু গলি ঢুকে গেছে দেড়শো বছর পুরোনো, সরু সরু ইঁটের পাঁজরওয়ালা এক পরিত্যক্ত বাড়ির খিলানের নিচ দিয়ে চলে গেছে গলিটা বাড়ির একটা ঘর ঠিক গলিটার মাথার ওপর, নহবৎখানার মত
অর্জুন জানালার কাছে দাঁড়িয়ে ভাবে নিজের গ্রামের রাতটার কথা বাবা ফিরতেন ফিরে আসার আওয়াজে দিদি ঘুমচোখে উঠত রুটি সেঁকতে মা বলতেন, তাড়াহুড়ো কিসের? রাত আরো বাড়ুক! ওনার হিসেবের কাজ শেষ হোক! তবে তো খাবেন! ... দিদি আকাশে সপ্তর্ষির অবস্থান দেখে বোঝার চেষ্টা করত কত রাত হল
... কবিতায় ছবিই তো রাজনীতি! একটা ব্যাপ্ত রাজনৈতিক প্রতর্ক সব সময় কবির মাথায় চলছে
কখন মল্লিকা এসে ঘরে ঢুকেছে, খাটের পাশ থেকে চার্টটা উঠিয়ে দেখেছে কোন ওষুধ দেওয়ার সময় এখন, খেয়াল করেনি অর্জুন জলের এম্পুলের ভাঙা টুকরোটা নিচের গামলায় ঠকাস করে পড়তে পিছন ফিরে তাকাল
-       সুপ্রভাত!
-       সুপ্রভাত, কবিমশায়! কিছু এল?
-       কী?
-       কবিতার লাইন? জানলার বাইরে একদৃষ্টে তাকিয়েছিলেন!
-       আসছিল না কিছুতেই হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম হঠাৎ কখন যে এল, ঢুকে পড়ল আমার ঘরে, ঝড়ে আমার দুয়ারগুলি ভেঙে বুঝতেই পারিনি
-       সত্যি? ধন্যবাদ! এবার এসে একটু শুয়ে পড়ুন তো একটা ইঞ্জেকশন নিতে হবে আপনাকে

                         
দরজায় শব্দ, দুবে! দরওয়াজা খোল্‌! ...
আরে, এতো সতীশ প্রসাদ! আরো কিছু কন্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে ব্রজনারায়ণ দুবে টিভিটা মিউট করে উঠে এসে দরজা খুলে দেন হুড়মুড় করে ঢুকে পড়েন সতীশ প্রসাদ, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, তাঁর স্ত্রী বীণা, শালী (ভদ্রমহিলা আজমেরে থাকেন, নামটা দুবের মনে নেই), বি ব্লকের দীপু ও তার স্ত্রী অঞ্জনা
-       হঠাৎ, দল বেঁধে?
-       শালা, ডুবে ডুবে জল খাওয়া হচ্ছে? এই নাকি ব্রাহ্মণ বংশের কুলদীপক!
-       মানে?
দীপু হাত তুলে থামায় আঙ্কলজী, প্লীজ! মস্করা পরে করবেন আর তাছাড়া আপনি, দুবে আঙ্কল সব এক বয়সী আমাদের সামনে ওই ভাষায় মস্করা করলে ... অঞ্জনা, তুমি রাখ কথাটা
সতীশ প্রসাদের শালী এগিয়ে আসেন আপনাদের সবার বুদ্ধিশুদ্ধি কি লোপ পেল? পরে বলবেন কথা আগে একটু চা করে নিয়ে আসি
চা হতে হতে সরোজিনী এসে পড়েন সবাই সসম্ভ্রমে উঠে দাঁড়িয়ে তাঁকে অভ্যর্থনা করেন সরোজিনী বিব্রত হয়ে অনুযোগ করেন, সতীশবাবু, বীণাভাবী, আপনারা যদি এমন করেন তাহলে তো মুশকিল আপনারা আমার থেকে বয়সে যথেষ্ট বড়!
-       তুমি আমাদের এই কমপ্লেক্সের গর্ব সরোজিনী সুসাহিত্যিক, জনপ্রিয়... জনপ্রিয় কী বলছি, ওয়ান অফ দ্য বেস্টসেলার নভেলিস্টস ...
-       বুঝলাম, বুঝলাম, এবার বসুন আমি চা করে আনি
-       কল্যাণী করতে গেছে
-       ও কি খুঁজে পাবে কিছু? দুবেজীর রান্নাঘরের যা ছিরি!
সতীশ, বীণা আর দীপুর মধ্যে চোখাচোখি হয়
রান্নাঘরে কল্যাণী চা করেই নিয়েছিল সরোজিনীকে দেখে চায়ের ট্রেটা নামিয়ে রেখে প্রণাম করতে যায় সরোজিনী বাধা দিয়ে জড়িয়ে ধরে
-       কবে এসেছ আজমের থেকে?
-       আজই তো এলাম, সকালে
-       তোমার ছেলেরা?
-       একজন কলকাতায়, একজন দামনে
-       স্বামী?
-       আজমেরে এই তো রিটায়ার করল
-       কিছু করছে?
-       হ্যাঁ, বিশুদ্ধ অবসরযাপন আর বিশ্বজগতের খুঁত ধরা
-       হাঃ হাঃ !
-       আমরা এসেছি কেন জান?
-       না, জানিনা তো আর, আসার আবার কারণ থাকে নাকি সব সময়? এসেছ, ভালো হয়েছে বরং আমার একটা কথা আলোচনা করার ছিল আর আশ্চর্য যে দুপুরে আলোচনার কথাটা ভাবতেই তোমার মুখটা ভেসে উঠেছিল
-       কী কথা দিদি?
-       তুমি ওদের চাটা দিয়ে এস আমি আর তুমি এখানে বসে চা খেতে খেতে কথা বলব

কল্যাণী ফিরে এল
-       বোন, তুমি তো জান যবে থেকে এই কমপ্লেক্সে বিভিন্ন ফ্ল্যাটে বুড়োবুড়িরা একা হতে শুরু করেছে মানে, ছেলেমেয়েরা সবাই বাইরে বাইরে, তারপর কারোর স্ত্রীবিয়োগ ঘটল, কারো স্বামীবিয়োগ; অবশ্য আমি নিজে তো বিশ বছর ধরে একা (একটু চুপ করে গেলেন সরোজিনী)
-       ?
-       দুবেজীরও স্ত্রীবিয়োগ হয়েছে ছবছর আগে তবে তখন উনি সম্পূর্ণ সুস্থ ছিলেন ইদানিং অসুস্থ হয়ে পড়ছেন
-       তুমিই তো ওনার দেখাশোনা কর দিদি একমাত্র গার্জেন এবং বন্ধু
-       হুঁ ... তাই ভাবছিলাম ... (কল্যাণীর চোখে চোখ রেখে সোজা ছোঁড়েন কথাটা) আমরা যদি বিয়ে করে নিই, কেমন হয়?
কল্যাণীর চোখ দুটো বিস্ফারিত হতে শুরু করে ঠোঁট দুটো আধখোলা, একটা চিৎকারের সম্ভাবনা সরোজিনী ভীষণভাবে অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন
-       সরি ... হয়তো এভাবে ... সোজাসুজি কথাটা ... বলা সমিচীন হয় নি কিন্তু ... তোমার খারাপ লাগল ...
কল্যাণীর চোখে মুখে এবার উল্লাসটা ফুটে বেরুতে শুরু করেছে সরোজিনী থতমত খেয়ে যান চেঁচিয়ে ওঘর থেকে সবাইকে ডাকার তুমুল ইচ্ছেটা কোনো রকমে নিরস্ত করে কল্যাণী জাপটে ধরে সরোজিনীকে
-       সত্যি দিদি, তুমি গ্রেট কোনো ধানাই পানাই না করে এত সহজে তুমি বলে দিলে সেই কথাটা যেটা বলতে ওঘরে চারজন হিমশিম খাচ্ছে এখনও তুমি বললে ... তুমি, নারী হয়ে! এখন বুঝছি, তুমি কেন এত বড় লেখিকা ... কিন্তু ...
-       কী?
-       দুবেজীর মতামত?
-       আমি কি ওনার সাথে কথাটা না বলেই তোমাকে বলছি? তবে লজ্জা পাচ্ছেন একবার বললেন পাশের ফ্ল্যাটটা আমার ব্লকে খালি আছে কিনা জানতে; শিফ্‌ট করে যাবেন পাশাপাশি থাকলে দেখাশোনাও হবে আর এই সব বিয়েটিয়ের প্রস্তাব নিয়ে অপ্রস্তুতও হতে হবে না
-       তাহলে?
-       ওসব সঙ্কোচ ওভাবে তো আর হয় না আমিই বা দুটো ফ্ল্যাট সামলাব কী করে? লোকটা যে সত্যিই অসুস্থ আর একা, একজন কারোর সব সময় কাছে থাকার প্রয়োজন তাতে তো কোনো সন্দেহ নেই!
-       একটা কথা বলব দিদি? এই যে আমাকে বললে, এরপর এখন আপাততঃ কাউকে তুমি এই কথাটা বলবে না মানুষটাকে নিজে স্পষ্ট করে জানাতে হবে তার কী মত তোমার মত একজন নারীকে বন্ধু ও সহচর হিসেবে পেতে চায় না ভাড়ায় খাটা দেখাশোনার লোক চায় এবং সেটা আমি জানব সঙ্কোচের, লজ্জা পাওয়ার ঢং করা সত্তর বছর বয়সে মানায় না
কল্যাণী বসার ঘরে চলে আসে পিছু পিছু সরোজিনীও আসেন সতীশ প্রসাদ হেঁকে ওঠেন, বাঃ, এ দেখছি দুটো দল বানিয়ে দিলে তোমরা আমরা কখন থেকে বসে আছি
-       আমি আর দিদি গল্প করছিলাম আর, আপনারা বসে আছেন মানে? আপনাদের তো করণীয় ছিল কিছু!
-       সে ভার তো অঞ্জনাকে দিয়েছিলাম আমরা বেচারী তখন থেকে চেষ্টা করে যাচ্ছে
-       আর চেষ্টা করতে হবে না এবার নিজের নিজের বাড়ি যাই আমরা
-       কেন? রাত তো বেশি হয়নি!
-       অঞ্জনা কী বলেছে এতক্ষণে?
-       বলেছে দুবে আঙ্কলের বিয়ে করার কথা ভাবা উচিৎ
-       আর দুবে আঙ্কল কী বলেছেন?
-       কোথায় কিছু বলছেন!
-       তাই তো বললাম বাড়ি চলুন মাস মাইনেতে দেখাশোনা করার লোক অনেক পাওয়া যায় দুবেজীর পয়সাও আছে যোগাড় করে নেবেন! বিয়ের মর্যাদা বোঝার ক্ষমতাই ওঁর নেই
দুবেজী কল্যাণীর দিকে চোখ তুলে তাকালেন কল্যাণী না দেখার ভাণ করে সরোজিনীকে ডাকল তারপর হাত ধরে বলল, চল দিদি, তোমাকে পৌঁছে দিয়ে তারপর বাড়ী যাব বাকি সবাই কল্যাণীর এই হঠাৎ ক্রোধে অপ্রস্তুত হয়ে পড়াতে আড্ডাটা ভেঙে গেল

                                                                                             
... বাইরে গলিতে মে মাসের বেলা সাড়ে এগারোটায় ঝাঁ ঝাঁ রোদ্দুর মোড়ের কাছে মাটির কলসীর দোকান সাজিয়ে দরজার দুধাপ সিঁড়িতে বসে ঝিমোচ্ছে এক বুড়ো ঝিমোতে ঝিমোতে ধপ করে নিচে পড়ে গেল আরে আরে বলে পাশের হাতপাখার দোকানওয়ালী প্রৌঢ়া দৌড়ে গিয়ে তাকে তুলে আবার বসিয়ে দিল
অর্জুনের মনে পড়ল দুবছর আগে এক এপ্রিলে দেখা দৃশ্য। রাজেন্দ্রনগরের ছয় নম্বর রাস্তায়। বুড়ো মুসলমান সুর্মা আর আতরের ফেরিওয়ালা। সামনে বসে এক প্রৌঢ়া, পৌরসভার কর্মচারী ঝাড়ুদারনী। হয়ত প্রতি বছর এই সময়েই দেখা হয়। ফলসা গছের ছায়ায় বসে বুড়োর হাতে সুর্মা লাগিয়ে নিতে নিতে কত জমা কথার দেওয়া নেওয়া।
কিন্তু অর্জুন কী করবে এবার? বাড়ি গিয়ে চিঠি লিখবে? খামে ভরে রেজিস্ট্রী করে পাঠাবে? মল্লিকা রায়চৌধুরী, কে/অ এজাজ নার্সিং হোম ... ? নাকি, এই বারো-ঘর-এক-উঠোনের ঠিকানায় রামপুর লেন, মুসল্লহপুর হাট ...? কত নম্বর কে জানে! কী লিখবে চিঠিতে? বলতে চাওয়া অথচ না বলতে পারা কথা? ক্ষমা চাইবে? গত সন্ধ্যার ব্যবহারের জন্য?

লিখতে লিখতে রাত দুটো নাগাদ ঘুমিয়ে পড়েছিলেন সরোজিনী। এত রাত সাধারণতঃ করেন না। কিন্তু একটা গুমোট, কিছুতেই কাটছিল না। দমবন্ধ লাগছিল। তাই লিখে চলেছিলেন।
ঘুম থেকে উঠতে বেলা হয়ে গেল। আজ আর সকালের চাটা দুবেজীর ফ্ল্যাটে গিয়ে খাওয়া হল না। মর্নিং ওয়াকেও যাওয়া হল না। দুবেজী অবশ্য সেরেও ঊঠেছেন। হয়ত নিজেই চা করে খেয়ে নিয়ে থাকবেন। সরোজিনী চোখে মুখে জল দিয়ে, চা হাতে নিয়ে আবার লেখার টেবিলে এসে বসলেন।
... গত সন্ধ্যার ব্যবহার ...
... গত সন্ধ্যার ব্যবহার ...
সরোজিনী পিছনের পৃষ্ঠাগুলোয় ফিরে যান। দুদিন আগের লেখা। গোধুলিবেলায় অর্জুনের ঘরে এসেছে মল্লিকা। সাথে মল্লিকার ছোটো মেয়েটি। পাঁচ ছ দিন আগে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে নিজের ঘরে ফিরে এসেছে অর্জুন।

 ঠিক তখনই লোডশেডিং। একা মানুষ। চায়ের সরঞ্জাম জোটাতে জোটাতেই মোমবাতি জ্বালতে হল ঘরে। ... মোমের আলোয় কী দেখলে তার হাসিতে অর্জুন? কী দেখলে ঈষৎ বয়স-লাঞ্ছিত ভ্রূকুঞ্চনে? মেয়ের হাতটা বার বার ধরে রাখায়? কী যেন গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের লাইনদুটো, সেদিন চৈত্রমাস, তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ, তোমার এক বাঙালি কবিবন্ধু শুনিয়েছিল শম্ভু মিত্রের অভিনয় প্রসঙ্গে তুমিও কি দেখলে নিজের সর্বনাশ?
নাকি স্মৃতিতে ভেসে এসেছিল দিসিকার সানফ্লাওয়ারএর সেই বিখ্যাত দৃশ্য? যুদ্ধের পর নায়ক অনেক খুঁজতে খুঁজতে এসেছে নায়িকার ঘরে! নায়িকা তো ছেড়েই দিয়েছিল হাল। যুদ্ধফিরতি ট্রেনের কামরার পর কামরায় শখানেক তারই মত নারীদের সাথে নিজের মনের মানুষটির ছবি দেখিয়ে দৌড়োতে দৌড়োতে! ... মোমের আলোয় তারা দেখল একে অন্যকে। স্পর্শ করল। যুদ্ধের অভিজ্ঞতা যুগচেতনার উত্তরণ ঘটিয়েছে তাদের দুজনেরই মনে। তাদের দেখায় এক মানবজন্মের রহস্য সঞ্চারিত হল হাওয়ার মর্মরে পরিচয় বদলে গেল অপরিচয়ে আর অপরিচয় বহুজন্মের পরিচয় হয়ে উঠল!

টেলিফোন। সরোজিনী ঘোর কাটে। বেলা এগারোটা। ভ্যাঙ্কুভার থেকে মেয়ে নন্দিতার ফোন করার সময়। পরিচিত প্রশ্নের উত্তরটা মুখে যুগিয়ে রিসিভারটা কানে দিতেই শোনেন দুবেজীর ক্ষীণ কন্ঠস্বর, ভালো আছেন তো? সকালে এলেন না যে?
-       দেরী হয়ে গেল আজ। রাতে একটু বেশি জাগতে হয়েছিল।
-       মল্লিকা টুসু গেয়ে শোনালো অর্জুনকে?
-       হুম্‌! নাঃ, সেরকম কোনো জায়গা এখনো পাইনি। মল্লিকা জানেও না টুসুর গান। ওসব অর্জুনের মনের উড়াল। ... সকালে চা খেয়েছেন?
-       হ্যাঁ, চা আর বিস্কুট খেয়েছি। এক গেলাস ছাতুর শরবতও খেয়েছি। দুপুরেরটা কী করি ভাবছি। আচ্ছা, সেদিন যে কথা হল আমার আপনার মানে বলছিলাম যে আমাদের ছেলেমেয়েদের কী মতামত, তা একটিবার জেনে নেওয়া উচিৎ নয় কি?
ফোনটা কেটে দেন সরোজিনী। ভাবেন শিশুসুলভ আচরণ, তবু করেন। টেবিলের ওপর লেখার জায়গাটা পরিষ্কার করার অছিলায় ফোনটা একটু জোরে ঠেলে দেন কি? দড়াম করে পড়ে যায় সেটটা। সরোজিনী ভ্রূক্ষেপ না করে লেখায় ফিরে আসতে চান। ওঃ, না, নন্দিতার ফোন আসবে তো! ফোনটা উঠিয়ে রাখেন আবার।

কল্যাণী তার একটু পরেই টোকা দেয় দুবেজীর ঘরে। ঘর খোলা। টেবিলে কম্পিউটার চলছে। একটা সিডি মনে হয়। এক বুড়ো আদিবাসী মানুষ ক্যামেরার পিছনে কারোর প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে। কীবোর্ডের ডান দিকে একটা নোট বই। কলম গুঁজে বন্ধ করা।
দুবেজী কই? দুবেজী রান্নাঘরে। পিছন থেকে দেখে মনে হল খিচুড়ি টাইপের কিছু একটা প্রেশার কুকারে চাপাবার চেষ্টা করছেন। কল্যাণী কোনো জানান না দিয়ে ফিরে আসে। সোফায় বসে অপেক্ষা করে। দুবেজী একটু পরে ঘরে ঢুকে চমকে যান। কল্যাণী দুবেজীর চোখে চোখ রাখে।
-       কাজের লোকের খোঁজ নিয়ে এসেছি। টাকা যা বলছে তাতে আপনার পুষিয়ে যাবে।
দুবেজী অধোবদন হয়ে বসে থাকেন।
-       কী হল, আসতে বলব, বিকেলে?
-       রান্নাটা দেখে আসি। দুটো প্রেশার দিল না?
-       একটাও দেয় নি। আর চারটে প্রেশার দিলেই বা কী? ছেইপোড়া খাবেন! তাই তো রয়েছে ভাগ্যে! (দুবেজী কিছু একটা বলতে চান, জল থেকে মাথা বার করে নিঃশ্বাস নেওয়ার মত কিন্তু কল্যাণী বলতে দেয় না) আপনার লজ্জা করে না? (উঠে গিয়ে বাইরের দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে আসে) এক নারী, সেও কচি খুকি নয় ষাটের ওপর বয়স, প্রতিষ্ঠিত লেখিকা, নিজের মনটা খুলে আপনাকে দিয়ে দিতে সাহস করল আর আপনি তা গ্রহণ করবেন কি করবেন না ভাবতেই হিমশিম খাচ্ছেন? ...
-       কী করা উচিৎ আমার? তুমিই বল!
-       যান, দিদিকে ডেকে নিয়ে আসুন নিজের ঘরে। বরণ করে আনুন। বিয়ের সব ব্যবস্থা আমরা করে দেব।
-       এই বয়সে বিয়ে? কী বলবে লোকে? ছেলেমেয়েরাই বা কী বলবে?
-       তাহলে কি বিয়ে না করেই থাকতে চান? ওই লিভ টুগেদার টাইপের? অবশ্য তাতেও সমস্যা নেই। এই বয়সে আর ... (দুবেজীর কান দুটো লাল)। তবে আমার মনে হয়না দিদি মানবে।
-       তোমার কোনো রাখঢাক নেই।
-       কিসের রাখঢাক? আপনার বয়স সত্তর ছুঁই ছুঁই, দিদির বাষট্টি, আমার বাহান্ন। ওসব ছাড়ুন। স্পষ্ট কথা বলুন। আপনি দিদির সাথে থাকতে চান না চান না। মনের মধ্যে টান অনুভব করেন না করেন না। দিদি সাথে থাকলে ভরসা পান না পান না। আজ সকালে দিদি এসেছিলেন?
-       না, ওঁর দেরী হয়ে গিয়েছিল উঠতে।
-       কী করে জানলেন?
-       ফোন করেছিলাম।
কল্যাণীর একটা কান রান্নাঘরে ছিল। প্রেশারের তিনটে আওয়াজ শুনে বন্ধ করে দিয়ে এল।
-       কিন্তু তোমার কী মনে হয়? ছেলেমেয়েদের মতামত নেওয়া উচিৎ নয়?
-       নেবেন! পক্ষে হলে ভালো। বিপক্ষে হলেও নো প্রব্লেম। আগে নিজের মতটা স্থির করুন।
রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে বলে যায়, স্থির করুন, স্থির করুন, নইলে খিচুড়িটা আবার আগুনে চাপিয়ে পুড়িয়ে দিয়ে যাব আমি।
রান্নাঘরে সব্জির ঝুড়ি হাতড়ায় কল্যাণী। কিছু ভাজাভুজি চাই তো! খিচুড়িটা খাবে কী দিয়ে বুড়ো? ভাবে।

                                                     
কাল সকাল থেকে এই তিন ব্লকের হাউজিং কমপ্লেক্সে একটা ছোটো উৎসবের সাড়া জাগবে। আটাত্তরটা ফ্ল্যাটের মধ্যে কয়েকটা দারুণ উৎসাহিত এবং সব রকম আয়োজনে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। কিছু ফ্ল্যাট মুখে অভিনন্দন জানিয়েছে কিন্তু দূরত্ব বাঁচিয়ে চলছে। কিছু ফ্ল্যাট চাপা ক্রোধে দরজায় কুলুপ এঁটে নিয়েছে। বিরোধ স্পষ্ট ভাবে কেউ করেনি কেননা সামাজিক অবস্থানে উদারমনস্ক হয়ে থাকাটা তাদের জন্য রোমে রোমান হয়ে থাকার মত।
তাছাড়া আর্থিক স্বচ্ছলতা সমাজের বাঁধনগুলো আলগা করে দেয় বলে আত্মীয়তা আর শত্রুতা দুইই সীমার মধ্যে থাকে। আবার সেই কারণেই এপার্ট্মেন্টের গার্ড, কেয়ারটেকার, চাকর-বাকর সবাই রাত্রে বেসমেন্টে বসে নির্লিপ্ত ভাব দেখিয়ে মুখের তেতোটা সরায়, সব বড়লোকদের ব্যাপার স্যাপার ভায়া! দুচারজন বয়স্ক তারই মধ্যে দুটো নিঃসঙ্গ বৃদ্ধ পুরুষ ও নারীর মনোবেদনা উপলব্ধি করে, বলে শাস্ত্রে তো বাধা নেই। আর শরীরের খিদেরও কোনো প্রশ্ন নেই এখানে। ইশ্বরের ইচ্ছাতেই হচ্ছে এই মিলন।
সরোজিনীর মেয়ে এসে গেছে। ভ্যাঙ্কুভার থেকে এসে হোটেলেই উঠেছে সোজা, কেননা মায়ের একাকী লেখিকা-জীবনের নানান উপসর্গের কথা সে জানে। একটু অবাকও, তাই। মা লিখবে কী করে? ... তবে ভীষণ খুশী। বলেছে, মা তো আমার মেয়ে। আমি কোলে বসিয়ে কন্যাদান করব।
দুবেজীর ছেলেমেয়েরা অবশ্য ততটা খুশী নয়। নীতিগত ভাবে মানলেও ভিতর থেকে খটকাচ্ছে। সম্পত্তির উত্তরাধিকারের ব্যাপার নিয়ে কোনো ভবিষ্যৎ সমস্যা তাদের মনে উঁকি দিয়েছে কিনা জানতে চাইলে তারা তেড়ে মারতে আসবে কেননা তারা নিজেদের যথেষ্ট প্রতিষ্ঠিত, আত্মনির্মিত এবং এসব ফিউডাল হ্যাংলামো থেকে মুক্ত মনে করে। সরোজিনীর জাতের ব্যাপারটাও তাদের কাছে কোনো ব্যাপার নয় ননব্রাহ্মিণ, ব্যাকওয়ার্ড, সো হোয়াট! ... রিডিকুলাস! ... তবুও কেন জানি একটু খটকাচ্ছে। আটষট্টি নাকি উনসত্তর বছর বয়সে বিয়ে? বাবা পেনশনের নিয়ম কানুন সব দেখে নিয়েছে তো, রিম্যারেজের ক্ষেত্রে?
কল্যাণীর বলতে ইচ্ছে করে, তাহলে কিছুদিন তো দুবেজীর সৌভাগ্য হবে দিদির বইয়ের টাকায় খাওয়ার!
সরোজিনী আজ সারা দিনে কিছুই করেন নি। অথচ সারা দিন চিন্তা করেছেন কত কাজ করার রয়েছে। কোত্থেকে শুরু করবেন তাই ভেবে পান নি। আর তাই জরুরি কাজটুকুও হয় নি।
টবের গাছগুলোয় জল দেন নি। পরিচর্যা করেন নি। চান করেছেন কিন্তু নিজের, ছাড়া কাপড়টুকুও কাচেন নি। মেয়ে এসে কেচে দিয়ে গেছে। রান্না করেছে। মাকে খাইয়ে দিয়ে গেছে। সরোজিনী সত্যিই নন্দিতার মেয়ে হয়ে গেলন নাকি?
ওদিকে কল্যাণী জানে দুবেজীর ছেলেমেয়েরা এসে গেলেও তারা কোনো কম্মের নয়। তাই নিজে সারা দিন দাঁড়িয়ে থেকে মেয়ে আর বৌদের দিয়ে কাজ করিয়েছে।
ব্লকের ফ্ল্যাট সংখ্যা ১০২ এখন কাল সকালে বরযাত্রার জন্য প্রস্তুত। সিব্লকের ২০৪ও এখন কাল সকালে বিবাহের মন্ডপ হওয়ার জন্য প্রস্তুত।
রাত।
গল্পটা এই ফ্ল্যাটে থাকতে থাকতেই শেষ করে যেতে চান সরোজিনী।

কেন বুঝল না অর্জুন মল্লিকার মনের কথাটা? নাকি বুঝেছিল? বুঝেছিল বলেই ভয় পেয়ে গিয়েছিল?
একা থাকতে থাকতে একা থাকার কিছু অভ্যাস কিছু দেয়াল ভিতরে ভিতরে গড়ে ওঠে। একটা বয়সের পর আড়ষ্টতা এসে যায় নানা রকমের। নতুন পরিস্থিতির চ্যালেঞ্জ সামনে এলেই একাকীত্বের খোলসে ঢুকে পড়তে ইচ্ছে হয়।
মল্লিকারও কি নেই সে খোলস? তবু সেই খোলস ভেঙে আজ সে এসেছিল একটা প্রাণের বন্ধুর হদিশ পেতে। হয়ত এ মানুষটায় পেতে পারি জীবন-সহচর!
নার্সিং হোমে অর্জুনের সাথে হৃদ্যতা হওয়ার পর থেকে মল্লিকার নিজের অতীতে আসা যাওয়া বেড়ে গিয়েছিল। ... অর্জুনবাবু, জানেন? মানস থাকলে এরকম ভাবত। মানস, দেখছ? অর্জুনবাবু কেমন করছেন? ... কথাগুলো তোমার মত নয়। বা তুমিও এই বয়সে পৌঁছোলে হয়ত এরকমই বলতে! ... দুদিকে দুই পুরুষের হাতে হাত রেখে তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে দিতে দিতে মল্লিকা আরো বেশি মা হয়ে উঠতে পারছিল নিজের মেয়েটির জন্য।  

সরোজিনী অনির্দিষ্ট স্থির চোখে বসে রইলেন কিছুক্ষণ। নাঃ, কোনো ভয়, কোনো সঙ্কোচ নয়। নিছক পুরুষটির নারী সম্বন্ধে প্রথাগত ধারণা। সন্ধ্যেবেলায় মেয়ের হাত ধরে তোমার ঘরে তোমার একাকী জীবনে সাহস করে ঢুকেছে মানে একটু বসতে চায়, একটু গল্প করতে চায়, মানে নারীটি তোমার গলায় ঝুলবার সুলুকসন্ধান খুঁজছে। গরীব নার্স, বিধবা, বারো-ঘর-এক-ঊঠোনে থাকে ... তুমি তাকে কাছে ডেকে থাকার ঘর দেবে, তোমার নাম দেবে, সান্নিধ্য দেবে, সে বর্ত্তে যাবে!
নাঃ, অর্জুনের অবুঝের ভাণ করে ভদ্রতা দেখানো, চা খাইয়ে, বাচ্চাটার হাতে বিস্কুট ধরিয়ে মল্লিকাকে বিদেয় করাটা ওর নারীত্বের চুড়ান্ত অপমান। ওকে অনুতপ্ত হয়ে পরের দিন সকালেই যেতে হবে মল্লিকার ঘরে ... । বারো-ঘর-এক-ঊঠোনের সেই দরজা। সকালবেলায় কাচা কাপড়ের সারি আর সাবানের গন্ধ। সরোজিনী কলমটা উঠিয়ে নেন।   

... শালা, দয়া দেখাতে এসেছ! মেয়েছেলে দেখলে করুণা উথলে পড়ে তাই না? করুণার রাজা, কবি! সব খেল দেখা আছে আমার। আপনি যাবেন না লোক জড়ো করব? ... বললাম তো কোনো কথা শুনতে চাই না। আমি নষ্টা মেয়েলোক। বিধবা হয়ে মরদ চরে বেড়াচ্ছি সাত বছর ধরে। আর কিছু?
কখনো অর্জুনের দিকে তাকিয়ে কখনো ভেজা কাপড়গুলো মেলতে মেলতে এতগুলো কথা বলে ফেলল মল্লিকা। তার পর খালি বাল্টি নিয়ে সটান ভিতরে চলে গেল।
অর্জুন দাঁড়িয়ে রইল ওই উঠোনেই বহুক্ষণ। এগিয়ে মল্লিকার ঘর অব্দি যেতে বাধছিল কেননা আশেপাশের অনেকগুলো চোখ তাকে দেখছে। ফিরেও তো যাওয়া যায় না। মল্লিকার এই ক্রুদ্ধ রূপ এবার সত্যিই পাগল করতে শুরু করেছে ওকে।
হঠাৎ দরজাটা খুলে গেল। হাতে বাল্টি। চুল খোলা। কাঁধে গামছা। দৃষ্টিতে আগুন নিয়ে যেন অন্য কাউকে বলল, একি, এখনো যায় নি? হতভাগা ভেবেছে কী? দোরগোড়ায় ধৈর্য্য ধরে দাঁড়িয়ে থাকলেই গলে যাবে মেয়েমানুষের মন? থাক্‌ দাঁড়িয়ে তাহলে। ... বলে অর্জুনকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে স্নানঘরের দিকে চলে গেল।
অর্জুন একটু ইতস্ততঃ করে ধীর পায়ে ফিরে গেল।

                                                     
বিয়েটা পরের দিন দুপুরবেলায় সুষ্ঠুভাবে হয়ে গেল। কিছু শাস্ত্র মেনে, কিছু না মেনে। সরোজিনী বধুবেশে পরেছিলেন কটকি কাজ তোলা ফিকে সবুজ শাড়ি। ব্রজনারায়ণ দুবে বরসাজে নিজের পেটেন্ট, খাদির ধুতি পাঞ্জাবি। পুরো অনুষ্ঠানে ঝলমল করছিল কল্যাণী, নন্দিতা আর অঞ্জনা। বরকর্তা সতীশ প্রসাদ। শুভদৃষ্টি, মালাবদল, অগ্নিসাক্ষ্য, সাতপাক ... নন্দিতার কমান্ড-লিস্ট আর শেষ হচ্ছিল না। ... শেষে খাওয়া দাওয়া, ফ্ল্যাটে এবং কর্মচারীদের মধ্যে মিস্টির প্যাকেট বিলি।
এই ফ্ল্যাটটা সরোজিনীর থাকবে। বইপত্র, আরো সব জিনিষ। মাঝে মধ্যে একান্তে কিছু কাজ করার প্রয়োজন হলে ... । বাকি সময় তালাবন্ধ থাকবে। নন্দিতা এলে আর হোটেলে থাকতে হবে না এই যা।
আজ রাত থেকে কাল সকালের মধ্যে ছেলেমেয়েরা সবাই চলে যাবে। আবার একা একা অনেকগুলি ফ্ল্যাটে অনেকজন বুড়োবুড়ি। শুধু তারা দুজন আর একা একা নয়।
এ্যাই, একটা গ্রুপ ফটো হলে হয় না? সরোজিনী বলে ওঠেন, সবাই তো চলে যাবে!
নিশ্চয়ই হয়। দীপু তার ক্যামেরায় জুমটা ফিট করে। বিকেলের আলোটা সুন্দর। তিন ব্লকের মাঝখানে চেয়ার সাজানো হয়। মাঝের, চেয়ার-সারিতে দুবেজী আর সরোজিনীর দুদিকে বীণাভাবী আর সতীশ প্রসাদ আর তাদের দুপাশে বসে এপার্টমেন্টের আরো দুজন বয়স্য যাঁরা বিয়েতে ছিলেন। নিচে বসে কল্যাণী, নন্দিতা, অঞ্জনা, দুবেজীর মেয়ে রাণী আর তিন বৌ। নাঃ, মানাচ্ছে না। কল্যাণী, তুমি এইখানে দাঁড়াও, দুবে আর সরোজিনীজীর ঠিক পিছনে। আর দাঁড়াবে পিছনে অন্যান্য পুরুষেরা। দীপু, নিজের জায়গাটা রেখ। টাইমার আছে তো?
সতীশজীর কথা শেষ হতেই হঠাৎ যেন চমক ভাঙার মত বলে ওঠেন সরোজিনী, আর নন্দিতার বাবা! হরিনাথজী? রাণীর মা? ভগবতীজী?
সবাই বাকরূদ্ধ। এ কী হল সরোজিনীজীর? এমন সময়ে হঠাৎ দুই মৃত ব্যক্তির নাম!
কিন্তু সরোজিনী তখন নিজেরই গল্পের পংক্তিতে, দুদিকে দুই পুরুষের হাতে হাত রেখে তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে দিতে দিতে ...
নন্দিতা, যাও। নিজের বাবার ছবিটা নিয়ে এস ঘর থেকে। আর রাণী, তুমিও নিজের মায়ের ছবিটা নিয়ে এস। একটা করে চেয়ার রাখ আমার আর দুবেজীর দুপাশে। ছবি দুটো থাকবে।
নন্দিতা আর রাণী উঠে যায় তাদের মায়ের আদেশ পালনে। দীপু তাড়া দেয়, জলদি, বিকেলের আলোটা নইলে আর পাবো না।
সরোজিনীর মাথায় খুব তাড়াতাড়ি এগোতে থাকে গল্পের শেষটা। আজ রাতে তো হবে না, কাল দুপুরে নিজের ঘরে বসেই লিখতে হবে।

অর্জুন চলে যাওয়ার একটু পরেই স্নান সেরে বেরিয়ে পড়ে মল্লিকা। নার্সিং হোম দশ মিনিটের পথ। প্রতিদিন রিক্‌শায় যায় কিন্তু আজ রিক্‌শা নিল না। এ পাড়ায় বাসা নেওয়ার পর আজ অব্দি কেউ তার তীক্ষ্ণ কন্ঠস্বরটুকু শোনে নি। কটুক্তি দূরের কথা। আজ হঠাৎ অতক্ষণ ওভাবে চেঁচিয়ে তার মনে হল আগলগুলো ভেঙে গেছে। এবার আর বাধ নেই তার এই বারো ঘর মানুষজনের মধ্যে। তার ভরসা, তার দ্বিধা, তার অভিসার, অভিমান, ক্ষোভ ও নিজের কন্ঠরোধ সব খোলামেলা হয়ে গেল এক দমকা হাওয়ায়। এমনই তো ছিল সে! আসানসোলের রেলকলোনিতে। ফ্রক পরা দাপুটে মেয়েটি।
ডিউটিতে কোনো অসতর্কতা কোনো ব্যাঘাত ঘটতে দিলনা মল্লিকা। সে যে চুড়ান্ত পেশাদার এই সুনামটা কখনো ক্ষুন্ন হতে দেয় না সে। মেট্রন সিস্টার ডিসুজা তাই ওকে একটু সমীহ করে চলেন। অনেক সময় নার্সিং হোমের ম্যানেজমেন্ট নিয়ে আলোচনায় ডাক্তার মোঘনিও তার মতামত নেন।
কিন্তু ডিউটি শেষ হতেই সে বাইরে বেরিয়ে ফোনে কথা বলল ছাপরায় ডঃ প্রসাদের সাথে। হ্যাঁ, সে এ সপ্তাহেই তাঁর নার্সিং হোম জয়েন করতে চায় মেট্রন হিসেবে। মাইনে মঞ্জুর। সব শর্ত মঞ্জুর। শুধু মেয়েকে একটা ভালো স্কুলে ভর্তি করার ব্যবস্থা করে দিতে হবে।
পরের দিন ডঃ মোঘনি ছিলেন না। সিস্টার ডিসুজার মাধ্যমে ইস্তফার চিঠিটা জমা দিয়ে নিজের ঘরে ফিরে এল।
সে আর ভাববে না। অর্জুন যদি আসে আরেকবার তো ভালো। নইলে মনে থাকবে এই উঠোন, স্নানঘর, নার্সিং হোমের জানালার বাইরে মুচুকুন্দ গাছ আর ... তার আগলগুলো খুলে যাওয়া, গতকাল।   

[সাত আট বছর আগে সঞ্চিতা, বইমেলা সংখ্যায় প্রকাশিত]





No comments:

Post a Comment