১
মেয়েদের শেষ দলটি চলে যাওয়ার পরেও অপরিচ্ছন্ন বাস্কেটবল
কোর্টটায় কলেজ বাড়িটার ছায়া পড়তে দেরী থাকে। ছায়া শুধু আরেকটু গাঢ় হয় পোর্টিকোর
কাছে – প্রিন্সিপ্যাল আর দু’চারজন টিচার, বিদায় নেবার আগে কাজের দিনের শেষ
বাক্যালাপটুকু সারতে থাকেন।
এতক্ষণে ডিপার্টমেন্টে তালা ঝুলিয়ে তারও বাড়ির পথে রোনা
দেওয়ার কথা কিন্তু আজ ...!
সাত বছরে প্রথমবার এ ব্যাপারে এত নিশ্চিত হয়েছে সে, যে
লোকটা আসবেই।
সে তো বলতে গেলে ওই একবারই দেখা, প্রথম আলাপ, শিপ্রা বৌদির
বাড়িতে সন্ধ্যেবেলায়। তাও কোনো অঘটনে নয়, রীতিমত ব্যবস্থা করে। মনে হয়েছিল, লোকটি
কথার দাম রাখা নিয়ে একটু বেশিই সচেতন।
তবু, যদি না আসে?...
হতে পারে না। হলে সে নিজের কাছে ছোটো হয়ে যাবে।
কে ছোটো হয়ে যাবে? সে? নিজের কাছে?
প্রিয় গোলাপী শাড়িটার আঁচল সে গাছকোমর করে নেয়, পনেরো বছর
আগেকার দস্যিপনায়।
অসম্ভব!
বলেছিল না প্রতিমাবৌদি! “ছেড়ে দিবি কিসের জন্য? তুই কি কোনো অন্যায় করেছিস? ভালোবাসা
সবাই খুঁজি আমরা। পছন্দ মত একটা মানুষ চাই জীবনসঙ্গী হিসেবে। ঘর বাঁধার অংশীদার
খুঁজি। তা বলে পিছন দরজা দিয়ে চোরের মত কেউ আসতে চাইলে তার নাক ভেঙে দেব না
জুতিয়ে? ঠিক তেমনি, ঘরের লোকেই যদি ইশারায় বলতে চায় যে তুই সেই চোরের জুড়িদার,
মানে তুই নিজেই তলে তলে চোরকে আস্কারা দিচ্ছিস, তোর নিজেরও বন্ধ ঘরে শরীরখেলাটা
পছন্দ আর তুই আসলে তাই করছিস এতদিন ধরে ... তখন কী করবি? চুপ করে থাকবি? কানে হাত
চাপা দিবি? না না না না করবি আর সবাই মুখ টিপে হাসবে? ... চোরও ভাববে যে তোর
বদনামে ওর প্রবৃত্তিগুলো পাখা মেলার জায়গা পাচ্ছে? ... ভালো কথা বলি শোন্। ওকে
ডেকে আন বাড়িতে সবার সামনে। আর সবাইকে শুনিয়ে ওকে জিজ্ঞেস কর, ‘তুমি নাকি আমাকে ভালোবাসো? তাহলে এইখানে এই মুহুর্ত্তে কবুল
কর আর বল কবে বিয়ে করবে আমায়?’
-
!!!
-
কী ভাবছিস? ওই এক অস্ত্রে দু’দিকই ঘায়েল হবে। কথাটা বলার সাথ সাথে বাড়ির ওই
গুজগুজফুসফুস-তন্ত্রটা হেঁচকি তুলবে। আর চোরের কতটা চুরি আর কতটা কী, সব বেরিয়ে
যাবে। বল, করবি?
-
!!!
-
সে স্বীকার করে নিলে আর রাজি হয়ে
গেলেও ক্ষতি নেই। যে বুকের পাটা দেখিয়ে বলবে ‘ভালোবাসি’, সে যে জাত যে ধর্মের লোক হোক, ধনী হোক, গরীব হোক, যে বয়সের হোক, তার হাত ধরে
বেরুলে জীবনটা খুব খারাপ কাটবে না। আর স্বীকার না করলে যেমন আছিস, থাকবি। গায়ে
ফোস্কা পড়বে না। বাড়িতে তোর ওপর রোজকার ওই উপদেশবাক্যের জুলুম বন্ধ হয়ে যাবে।
কম ভুগতে হয়নি ওই পন্থায়। মেয়েদের এভাবে দেখতে মায়েরাও তো
পারে না। ভয় করে। তবে, প্রতিমাবৌদির কথাটার দাম সে টের পেয়েছে। তারপর আর কোনো দিন
তাকে নিজের কাছে ছোটো হতে হয়নি। ভালোবাসার আকাঙ্খাও নিজের কাছে কখনো লুকোতে হয়নি।
আর তার আগে? চিরাচরিত নাটকের মত, সকলকে সারাদিন অনেক অনেক
ভালোবেসে, নির্জন ক্ষণে, সবচেয়ে ভালো শাড়িটা পরে জীবনকে বিদায় জানিয়েছিল। দরজায়
আগল তুলে মুখে পুরে দিয়েছিল শিশির সব কটা ঘুমের ওষুধ। কিন্তু, তখনও তো ক্ষীণ
বিশ্বাস ছিল যে মা, ভাইয়েরা হয়ত বুঝবে খুব বেশি দেরী হওয়ার আগেই। আগলটা কি ঈষৎ
ঢিলে করে বন্ধ করেছিল? জ্ঞান ফিরে আসার পর যখন ডাক্তারবাবু কপালে হাত রেখে সস্নেহে
সেই বিশ্বাসটাই ফেরাতে চেয়েছিলেন তার অন্তরে ... কুঁকড়ে ছোটো হয়ে গিয়েছিল সে নিজের
কাছে।
-
কী রে, বাড়ি গেলি না?
-
নাঃ, একটা কাজ আছে। তুইও বোস না।
একসাথে বেরোবো। প্রিন্সিপাল চলে গেছেন?
-
কখনো! একটা লোক নেই কলেজে!
-
তুই বোস না।
-
বসে যাচ্ছি। আমার আর কাজ কী এমন!
কিন্তু তোর ব্যাপারটা বুঝছি না।
-
খুব বুঝছিস।
-
আমি?
-
হ্যাঁ, না বুঝলে ‘ব্যাপার’ বলতিস না।
-
হাঃ হাঃ, কে রে? ওই সেই?
-
হ্যাঁ।
-
সেই বিড়িখোর, মোটু! তুই তো শালা ভুঁড়িতে আটকে যাবি!
-
চুপ!
লোকটা মজার। জঙ্গুলে
দাড়ি গোঁফ গজিয়ে একটা কপট গাম্ভীর্য গড়ে রাখে। সাদার ওপর খয়েরি ডোরাকাটা শার্ট, জলপাই সবুজ
প্যান্ট আর পায়ে? বুঝে দ্যাখ, হাওয়াই
চপ্পল। নধর গোপাল। রঙেও কেষ্ট ঠাকুর।
কথার কী মারপ্যাঁচ! … আমরা একে অন্যকে চিনি না, ভালোবাসিনা, তবু একসাথে জীবন গড়ার জন্য কিছু বেসিক আন্ডারস্ট্যান্ডিং
থাকা দরকার। ‘বেসিক আন্ডারস্ট্যান্ডিং’! ও,
না, ‘জীবন গড়া’ও না আবার, ‘জীবন গড়ার একটা চেষ্টা’!
চাকরীতে প্রমোশন নিতে চান না। সাহিত্যে আর ট্রেড ইউনিয়নে, রাজনীতিতে
থাকতে চান। … খেতে পরতে দিবি তো? আর প্রমোশন চাস না নাকি পাস না? নাঃ, এবার একটু প্রশ্ন করা যাক। মিনুটা কী যে করছে! এতক্ষণে চা পাঠাতে
পারল না। লোকটা ভাববে কী?
-
আচ্ছা, আপনি নাহয় প্রমোশন নেবেন না। কিন্তু ধরুন, আমি তো এমএ পরীক্ষাটা আবার দিচ্ছি। পাশটাশ করলে যদি টিচিংএ যেতে পারি?
-
আপনার যদি কোনো উচ্চমন্যতায় পেয়ে বসার
ভয় থাকে, আপনি ভেবে নিন। আমার কোনো হীনমন্যতায় পেয়ে বসার ভয় নেই, আপনি লেকচারার হলে। আমি কেরানী। যদ্দিন চাকরী করছি, কেরানীই থাকব।
-
কিন্তু আপনি নেবেন না কেন প্রমোশন? প্রমোশনের সাথে (এটা একটা গোলমেলে ব্যাপার, বাড়িতে সবাইকে বোঝাতে বেগ পেতে হবে) আপনার রাজনীতি, সাহিত্য আর ট্রেড ইউনিয়নের শত্রুতা কোথায়?
লোকটা আবার একটা লম্বা ভাষণ দেয়। চোখদুটো ঈষৎ লালচে। মনে হয় রাত্রে ঘুমোয়নি। … এতক্ষণে চা এল। আর যমুনাদির আলুর চপ। বিচ্ছিরি। রোজই খায় তবু আজ বিচ্ছিরি লাগছে।
বাইরে ভাদ্রের দুপুর। ভিতরে উঁচু সিলিং থেকে ইংরেজ আমলের ফ্যানের আওয়াজ। ঘষা, চুন লাগা জানলার কাঁচটায় কয়েকটা পোকা উড়ে এসে
বসছে বার বার। হয় বসুক, নয় উড়ে যাক! এ কী বিরক্তিকর!
চায়ে চুমুক দিয়ে আবার একটা সিগারেট ধরিয়েছে নধর গোপাল। কী ভীষণ সিগারেট খায়! মেয়েদের সামনে এদের নিজেকে একটু বেশি স্মার্ট না দেখালে চলে না। বন্ধ করতে হবে ধীরে ধীরে …। কে বন্ধ করবে? ছিঃ। কী সব ভাবতে শুরু করে দিয়েছে! … মিনুকে বললে হি হি করে হাসতে শুরু করে দেবে এর সামনেই।
প্রশ্ন কর্ না হতচ্ছাড়ি!
কথা বল্! লোকটা দুনিয়াজাহানের ফিলসফি ঝেড়ে যাচ্ছে
আর তুই শুধু চোখ আর হাসি দেখে আর বক্তিমে শুনে হৃদয় যাচাই করছিস?
চাবুক খাওয়ার মত করে সোজা হয়ে ওঠে সে
-
আপনার বাড়ির লোকেরা এই বিয়ে মানবে
তো? মানে শুধু জাতের ব্যাপার নয়, সে তো অনেকেই
মেনে নেয় আজকাল কিন্তু আমার এ্যাপিয়ারেন্স, আমার ফ্যামিলি সম্পর্কে
যা বললাম … ।
-
আশা করি মানবে। একবারে না হোক, দুবারে, তিনবারে। সেটা বড় কথা নয়। বিয়ে তো আর বাড়ির সঙ্গে বাড়ির হচ্ছে না ...
-
যদি একান্তই না মানে?
-
সেটা তাদের ব্যাপার। না মানার মত তো কিছু নেই।
-
কিন্তু যদি না মানে?
একগুঁয়ে হয়ে উঠেছে সে। কী হবে? হবে না! গরম মসালদোসা খাব মিনুর সাথে
বেরিয়ে।
-
বললাম তো, এটা তাদের ব্যাপার।
-
দোষটা আমার ঘাড়ে এসে পড়বে তো! (গা
ঝেড়ে ওঠার ভঙ্গী করে) আমি চাই না তা। আপনি
বরং আপনার বাড়ির লোকেদের কথা বলতে পাঠান আমার বাড়ির লোকেদের সাথে।
... তাহলে আর শিপ্রাবৌদিকে বলা কেন, “না বৌদি, আমি নিজে আগে
দেখা করব – সে যে কেউ হোক। বাড়িতে এসে ছেলের বাপ আমায় মা মা করবে তার পর চিঠি পাঠাবে আমার মায়ের কাছে – ওঁ হরি ... আমরা যারপরনাই দুঃখিত যে আপনার মেয়েকে ... আই
এ্যাম ফেড আপ। ছেলে হোক বা ছেলের বাবা হোক, আমি নিজে আগে দেখা করব”...
-
আপনি কেন বাড়ির ব্যাপারটায়
মিছিমিছি জোর দিচ্ছেন? আমিই তো এসেছি আপনার কাছে, শিপ্রাবৌদির কাছে খোঁজ নিয়ে। আপনি বলেছিলেন আসতে, কথা বলতে চেয়েছিলেন!
-
আমার বাড়ির লোকের সাথেও কথা বলতে
হবে।
-
নিশ্চয়ই বলব। আগে নিজেরা তো কথা বলে নিই।
চোখে চোখ রাখার চেষ্টা করে চলেছে সমানে; লোকটার সাহস তো কম নয়!
-
চলুন, এবার ওঠা যাক। দেরী হয়ে গেছে। ... এ্যাই মীনু! তালাগুলো লাগা। ... দাঁড়ান, আমার ব্যাগটা
নিয়ে আসি ডিপার্টমেন্ট থেকে।
সহকর্মী বন্ধুকে ডাকার অছিলায় ঘর থেকে ভিতরবারান্দায় ঢুকে
যায়। এত তাড়াতাড়ি হাঁটছে কেন? সঙ্কোচ আর অস্বস্তিটা কাটাতে? আর? আর? লোকটাকে বুঝতে না দিতে;
কী বুঝতে না দিতে? ... ডিপার্টমেন্টের দুটো দরজার দুটো তালা
ঘটাং ঘটাং শব্দে বন্ধ করে – মনে হয় লোকটা সাচ্চা! কিন্তু যদি ধোঁকা হয় তো? ...
নিশ্চিত যাবে এবার – এ শহর ছেড়ে চলে যাবে। কোথায়?
২
এলবিডিদের গ্রুপটা থেকে আলাদা হওয়ার কিছুদিনের মধ্যে সে
বুঝতে পেরেছিল, মতবিরোধটা ছোটো খাটো সাংগঠনিক নিয়ম নীতির
ব্যাপারে আর একটু ব্যক্তিগত স্তরে শুরু হওয়া সত্ত্বেও ধীরে ধীরে রাজনৈতিক রূপ
নিচ্ছে। ভাবধারাগত জমি চাইছে দিনরাত।
যেমন, ২০শে এপ্রিল, অর্থাৎ মতবিরোধ শুরু হওয়ার চার সপ্তাহ পরে সে ডাইরিতে লিখলঃ
“... ভুল, সংগ্রামহীন
বন্ধুত্বের যত বিষ, ভাববাদী আশা ও ভালোবাসার যত ধোঁয়া, সব বেরিয়ে এসেছে। দিন
গুনছি বোঝাপড়ার। বোঝাপড়া না করতে পারলে। শেষ নিষ্পত্তি অব্দি না পৌঁছোতে পারলে এত দিনকার সব প্রচেষ্টার ইতি হবে এখানে।
“পড়ছি ...”
কিন্তু এটাও তার মনে হচ্ছিল যে একটু খোলা হাওয়ায় নিঃশ্বাস
নেওয়া দরকার। তাই চারদিন পরেই লিখলঃ
“... অনেক রকম কাজে নিজেকে ঢিলে ছেড়ে দিয়েছি। যেহেতু সংগঠিত পড়াশোনা আপাততঃ বন্ধ হয়ে আছে, এই ঢিলে ছাড়ায় লাভই হচ্ছে। যতটা
একলা পড়ার সামর্থ্য আছে পড়ছিও। আবার না
পড়তে পারার অবসেশন মাথায় কোনো চাপও সৃষ্টি করছে না। কিন্তু কথা হল, এরকম কতদিন চলবে?”
বস্তুতঃ সে এমন একটা মানুষ, রাজনৈতিক
ভাবনাচিন্তার জগতে নিষ্ঠাভরে ঢোকা সত্ত্বেও কোনো দিন কোনো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত
একান্ত ব্যক্তিগত ক্ষমতায় নিতে হয় নি। তার মূলশক্তি ছিল কর্মী হিসেবে নিজেকে জোয়ালে জুতে রাখার ক্ষমতা। যাদের সাথে একমত হতে সে ‘বিপ্লব’ শব্দটাকে ‘দেশ’, ‘মানুষজন’, ‘প্রেম’, ‘প্রকৃতি’, ‘মিথুন’ ও ‘পরিশ্রম’ ইত্যাদি ধারণাগুলোর কষ্টিপাথর এবং প্রায়
শালগ্রামশিলা করে ফেলেছিল তাদেরকে নিজের কর্মক্ষমতার সবটুকু দিতে পারাই ছিল তার
কাছে দিনযাপনের সার্থকতার নিরিখ। তাই
মতবিরোধ যখন হল, তার বুভুক্ষু ভালোবাসা একটা প্রতিশোধস্পৃহা
নিয়ে জেগে উঠল।
৯ই মে
“চৈত্ররাতের মোড়ে হাওয়ায়
হৃদয় জাহাজ হয়ে ভেড়ে –
মৃত নাবিকদের স্বপ্ন যত
শুভ্র শিমূল হয়ে ওড়ে।
ডাকলো শোনো কোনো রাতের পাখি, ফুটল
কোথাও কোনো ফুল
তারার মাঝে পাতার
নীড়ে সত্তার প্রাচীন শিলায়!
গভীর রাতের স্তব্ধতায়
তেমনি জাগে প্রশ্ন –
কালের সমুদ্রের অস্থিরতার, রক্ত কখন
সাড়া পায়?”
১২ই জুন
“শরীরের খিদে ... প্রেমের কাল্পনিক বার্তালাপ
বড় বেশি গজগজ করতে শুরু করেছে মাথায়। একেবারে সেই ‘ফেয়ারওয়েল টু আর্মস’এর যুদ্ধকালো দিগন্তের পটভূমিতে হোটেলের শান্ত কামরায় ফ্রেড
আর ক্যাথির ডেলিরিয়ামের মত।
মনোনিবেশ সহকারে কিছু পড়তে পারছি না। ...
দিমিত্রভের বিখ্যাত রিপোর্টটা পড়ছিলাম। আরো
বেশি করে আজ ফীল করছি ইন্টারন্যাশনালের ইতিহাস পুঙ্খানুপুঙ্খ জানার।”
১১ই জুলাই
“তিন তারিখে লেখা গানটার দ্বিতীয় প্যারা আবার
লিখছি।
ঘোলা জলের এক জীবন ছেড়ে ব্যাপ্তির তৃষ্ণায়
কৈশোরের যে সাথীদের ছেড়ে এসেছি এক দিন –
আজ কোনো এক মিছিলে হঠাৎ তাদের কাউকে পেয়ে
স্মৃতির প্রতি ক্ষোভ, প্রেমের শপথে
বদলে যায়!...
ধুৎ! দাঁড়াচ্ছে না কিছুতেই। ভারী হয়ে থাকছে। একে গান বলে না।”
আসলে দুদিন আগে একজিবিশন রোডে একটা মিছিলে তার কৈশোরের
পরিচিত একটি ছেলের সাথে দেখা হয়ে গিয়েছিল। রবিদা
বললেন, “ছেলেটি ভালো। ইয়ং, এনার্জেটিক। ও আসার পর ওদের ইউনিয়নটা দাঁড়িয়ে গেছে। দেখ, প্রতিটি মিছিলে সবাইকে
মোবিলাইজ করে নিয়ে আসে।”
(সেই হিমু।
সাইকেলের চেন হাতে জড়িয়ে মারপিট করে বেড়াতো। সুরজ
বলেছিল, মিশিস্ না, এখনই লন্ঠ হয়ে গেছে
পুরোদস্তুর! ...)
নিজেও তো বদলে যাচ্ছিল সে! কোথায় দূরে সরে যাচ্ছিল
লাইব্রেরির সামনের মাঠ, নেরুদার মেময়ের্স,
রিলকের নয় নম্বর এলেজি, ১৮৪৪এর ইকনমিক এন্ড ফিলসফিকাল
ম্যানাস্ক্রিপ্টস, কালপুরুষের সাথে রাত!
হল সাজাতে হবে পোস্টারে – আমি আছি। রাত
জাগতে হবে স্টেশনে – আমি আছি। রিপোর্ট লিখতে হবে – আমি আছি। মাছের ব্যবস্থা করতে হবে – আমি আছি। স্লোগান
দিতে হবে – আমি আছি। ছড়িয়ে দাও, ছড়িয়ে দাও নিজেকে। ...
৯ই সেপ্টেম্বর
“... শ্রমিকদের নিজস্ব ইনিশিয়েটিভ, জনতার নিজস্ব ইনিশিয়েটিভ। বিপ্লবী
গণতান্ত্রিক আর প্রতিক্রিয়াশীল আমলাতান্ত্রিক সংস্কারের মধ্যে তফাৎ। একই কাজের দুটো ধরণে বিপরীত শ্রেণীর উদ্দেশ্য সাধিত হয়।”
১১ই সেপ্টেম্বর
“... কিন্তু এক্ষেত্রেও (শস্যের কারবারের একচেটিয়া
স্বত্ত্ব, রুটির র্যাশনিং,
সর্বজনীন শ্রমবাধ্যতা ইত্যাদি) অন্যান্য সমস্ত ইতিহাসনির্মাণকারী ক্রিয়াশীলতার
ন্যায়। সর্বহারা তার অস্ত্রগুলি পূঁজিবাদের হাত
থেকেই নিয়ে নেয়, শূন্যের মধ্যে থেকে সৃজন বা আবিষ্কার করে
না। - লেনিন (বলশেভিকরা কি রাষ্ট্রক্ষমতা হাতে রাখতে
পারবে?) ...”
এবং, এতদিন পর –
২৩শে সেপ্টেম্বর
“...বই থেকে রাস্তায় আবার রাস্তা থেকে বইয়ে
যাওয়ার পথ খুঁজে পাচ্ছি আজ এত বছর ... অনেক জটিলতার মধ্যে দিয়ে পোড় খেয়ে...”
১১ই অক্টোবর
“এক সময় জারিস্ট রাশিয়া ছিল শত্রু, শুধু রাশিয়ার নয়, ইয়োরোপের সমস্ত বিপ্লবী আন্দোলনের। আর তার ভিতর থেকে বেরিয়ে এসেছেন হের্জেন, প্লেখানভ, লেনিন! বিপ্লবী কাজ চালিয়ে যেতে, শুধু রাশিয়ার জন্য নয়, সমগ্র বিশ্বের জন্য। আজ সোভিয়েত রাশিয়াকে বলা হচ্ছে ‘সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী’। কিন্তু যারা বলছে, রোমানভ পরিবারের
ভাঁড় ছাড়া আর কোনো চেহারা কি তাদের মধ্যে আছে?”
২৭শে ডিসেম্বর
“অনেককিছু সম্পর্কে মত খুব দ্রুত পাল্টাচ্ছে...”
৩০শে ডিসেম্বর
“গত তিন চার দিন ধরে সমানে কাজ করে চলেছি। কথাবার্ত্তা, সার্কুলারের
স্টেনসিল কাটানো, সাইক্লো করা, এরেঞ্জ
করে স্টেপ্ল করা, ভুল কারেকশন করা,
ডেসপ্যাচ করা, আবার সার্কুলার লেখা,
আবার ...। এক্ষুণি একটা লিখে উঠলাম। সকাল থেকে দুপুর, একটা লিখে রিভাইজ
করতে দিয়ে এসেছি। কাল সকালে দুটো লিখতে হবে।
“... এ নয় যে শুধু প্রেমহীন ছিল জীবন,
নিষ্কলুষ, শুধু ইচ্ছার দীপ্তিতে ভরা।
অপ্রেমের বিকৃতিতে আমার
বসন্ত ভয়ার্ত হয়ে ছিল। মৃত্যু-ভয়ে
দ্বিধাদীর্ণ হত কাজ।
“... ওঃ, এর থেকে ভালো ছিল, প্রত্যেক রাতের এই যন্ত্রণা থেকে। কেন সাড়া দিইনি সেই রাতে – ভাস্কো বীচে মেয়েটির মধুর ইশারায়? না, না, বেশ্যাবৃত্তি না। ... ওই ‘ইয়ামা দ্য পিট’ পড়ার পর যে আমাদের কথাবার্তা হয়েছিলঃ বুর্জোয়া ম্যারেজ > এ্যান্টিথেসিস বেশ্যাবৃত্তি আর সোশ্যালিস্ট ম্যারেজএ সিন্থেসিস! একটা
হাস্যকর সরলীকরণ!
“... এখন, কোনো আন্দোলনের
পথেই সঙ্গিনী খুঁজে নেব ভাবলে তো কাজেকর্মে এই একাকীত্বের বিকৃতি ছাপ ফেলতে শুরু
করবে!
“একটা রাস্তা খুঁজে বার করতে হবে।”
৩১শে ডিসেম্বর
“... একটা ছোট্টো ঘটনা। দুর্বিষহ কয়েকটি রাত ও দিন।
জ্যোৎস্নাকে কালো করে দেওয়া অনির্ণয়ের ক্ষতে ভরা সময়। ... একেবারে শেষমুহুর্তে, এক ঝটকায়, অর্থাৎ ব্যাপক তাৎপর্য না বুঝে নেওয়া একটা বড় সিদ্ধান্ত। তারপর, উল্টোপথে, ইতিহাসে তন্নতন্ন করে আগেই নেওয়া সিদ্ধান্তের তাৎপর্য খোঁজা, নতুন ভাবে নিজেকে গড়ে তোলার, সংগঠিত করার রাস্তা। ... আর শেষ অব্দি যখন পৌঁছোলাম বলে মনে হল, দেখলাম –
সর্বাত্মক সন্দেহ। সেই প্রথম বিতর্কের আগে অব্দির ধারণাগুলোর
(সত্যের ও সত্য অব্দি পৌঁছোবার পদ্ধতির) বুনিয়াদী সমালোচনা।
“আর আজ খোলা আকাশের নিচে আবার সহজভাবে, বস্তুতঃ সহজভাবে দাঁড়িয়ে আছি। মরছি, বাঁচছি, খারাপ কাজ
করছি, ভালো কাজ করছি, এই যে এখানে
নোংরা ঘাঁটছি, ওই যে ওখানে নোংরা সরাবার চেষ্টা করছি। বহু কোটি লোক করছে সারা পৃথিবীতে। বিপ্লবের মুখ ও তার দূরত্ব আজ অনেক বেশি পরিষ্কার। কাজ, কাজ, প্রতিনিয়ত কাজে
ডুবে থাকার চেষ্টা করে যাচ্ছি। ...
একটা মৃতদেহ পাশে পড়ে আছে। বেদনা ও
ক্ষোভের মেয়াদ ফুরিয়ে যাওয়ার পরেও পড়ে আছে। আমার
ভাত খেয়ে ওঠার পরেও পড়ে আছে। আমি গান
গাইছি – মৃতদেহ পড়ে আছে। বেদনা ও ক্ষোভের মেয়াদ কম বলে চিন্তা করে লাভ নেই। শত্রুকে আঘাত করার ক্ষমতা বাড়ুক – বেদনা ও ক্ষোভের মেয়াদও বাড়বে।”
পরের বছর/ ১৩ই মার্চ
“নিজেকে নগ্ন করা কঠিন নয়। সেই মানুষ খোঁজা কঠিন, যার কাছে নিজেকে নগ্ন করলে
স্ট্যালাক্টাইটের প্রথম হিমবিন্দুর মত একটা ভয় হাড়ের ভিতর জাগে না। বেশি রাতের নির্জন ছুরিটা নিয়ে কোনো সম্মোহন আবিষ্ট করে না। ... নগ্নতার বন্ধু গড়ে তোলা, নগ্নতার সময় ও পরিবেশ গড়ে তোলা একটা সম্যক শিল্প,
বাঁচবার। যে পারে না তার নির্জন মন ও শরীর, তার মন ও শরীরের নির্জনতায় জ্বলে শেষ হয়ে যায়। ...
“কিন্তু পরশু হুইলার সিনেট হলে তাঁর বক্তৃতায়
এই বিষয়টার ওপর আরেকটু আলোকপাত করতে পারতেন – অর্গানাইজড মাস ইনিশিয়েটিভ। এমনকি ছোটো ছোটো সংস্কারের প্রশ্নেও ... গণতান্ত্রিক দাবীগুলোর পক্ষে ...
শান্তি আন্দোলনে ... অধিকাধিক সংখ্যক জনতার অংশীদারী ... রিভল্যুশনাইজিং
প্র্যাক্টিস ... থিসিস অন ফায়ারবাখের প্রথম থিসিস।”
১৬ই আগস্ট
“আজ ... এর সাথে প্রথম আলাপ হল। আলাপ ও তারই সাথে পারস্পরিক ইন্টারভিউ। দু’জনেই জানছিলাম যে একসাথে জীবন কাটাতে পারি
কিনা তা জানার জন্য দেখা করছি।
ইন্টারভিউয়ের পারফর্মেন্সে উনি আমার কাছে পাবেন দশে দশ। আমি ওনার কাছে দশে ছয় পেতে পারি। জ্ঞান
দেওয়া স্বভাবটা তো এখনো যায় নি।
“খুব কাছের কোনো একজনের সব-কিছু-বুঝে-ফেলা মৃদু
হাস্যদীপ্ত চোখের কাছে আমি আনন্দ-লুকোতে-না-পেরে-বিব্রত হয়ে উঠতে চাই।”
৩
সাত দিনের লাগাতার আশ্বিনে ঘাসের আস্তরণটা শুকিয়ে গেছে
কিন্তু নিচের মাটি এখনও ভেজা। আলতো
ভাবে হাত রাখলে ভরসা হয় অথচ হাতে ভর দিলেই চেটো ভিজে নোংরা হয়ে ওঠে। হাঁটুজলে ধানচারার বাড়ের মত যে একটা অন্তর্লীন
সময় – এখনও চলছে। অবসর ভালো লাগে না। কাজ টানে, সকাল হতেই। তবু, এই সময়েই এল প্রেম – প্রেম?
মাঠের একটা দিকে ধোপাদের কাপড় শুকোবার গন্ধ। বাকিটা জুড়ে দুটো ফুটবল-মাঠ আর পাঁচ ছয়টা ক্রিকেট-মাঠ একে
অন্যের মধ্যে ঢুকছে বেরুচ্ছে। ছেলেদের
পিঠ চকচক করছে রোদ্দুরে। কিনার ঘেঁষে দু’চারজন করে বয়স্ক পুরুষের দল – দুনিয়াদারীর হিসেব নিকেশ। অপসৃয়মান একটা বাসের ছায়া তার নীল শাড়িটাকে আরো গাঢ় নীল করে দিয়ে গেল।
-
এমন সময়ে তুমি এলে! কিছু নেই
ভিতরে। সব জ্বলে গেছে। ... ছবিটা দেখেছ? এই আমি ছিলাম। কোমর অব্দি চুল। ... কোথায় ছিলে তুমি? আরো আগে আসতে পারলে না? আসতে ছোটোবেলায়! বা এই যখন
ম্যাট্রিকে পড়ি! তোমার সাইকেলের পিছনে চেপে রোজ পালিয়ে যেতাম স্কুল থেকে!
-
কোথায়?
-
যেখানে সেখানে! আর সব্বাইকে তাক
লাগিয়ে দেখিয়ে দিতাম আমি কী জিনিষ।
-
এখনো তো পারো!
-
নাঃ, বড়ো ক্লান্ত লাগে। কত কিছু যে গেছে এই মনটার ওপর দিয়ে। বলেছি
না তোমায়? একেকটি ঘটনা সব?
-
আমি তোমার কষ্টকে ছোটো করছি না। মনের কষ্টও কষ্ট। শরীরের
কষ্টও কষ্ট। কিন্তু জীবনের বাইরের কিছু তো আর বাঁচো নি!
আর ওই একেকটি ঘটনাকে অতিক্রম করেই তুমি শক্তি জোটাতে পেরেছো আজও সুন্দর হয়ে ওঠার!
-
?
-
আমাদের সবারই দেরী হয়ে যায়। কী করবে বল?
-
কোথায় ছিলে তুমি? একই শহর। একই আসা যাওয়ার পথ। দেখিনি কেন? তুমিও তো দেখনি
আমায়!
-
দেখেছি হয়ত। দেখেও দেখিনি। চোখ দিয়ে কি আর দেখা হয়? মনটাই ছিল উধাও।
-
কোথায়?
-
সে তুমি বুঝবে না।
-
অন্য কাউকে ভালোবাসতে? মিতা?
-
হাঃ হাঃ, না তেমন কোনো ব্যাপার নয়। ... মিতার কথা তো বলেইছি তোমায়। সে কবে
ফুরিয়ে গিয়েছে। ওসব নতুন জওয়ানির একতরফা প্রেম তো হতেই থাকে।
-
তবে?
-
বুঝবে না। বুঝবে না। ইন্টেলেকচুয়াল ব্যাপার। পরে, ধীরে ধীরে, যদি শুনতে
চাও তো বলব।
-
সত্যি, কেন এলে না ছোটোবেলায়। কাঁচা
আম কুড়োতাম জঙ্গলে।
-
ক্লাসিক, ক্লাসিক!
-
ঠাট্টা করছ?
-
কী করব বল? ঠাট্টা না করলে এত আনন্দ ভার হয়ে ওঠে বুকের ভিতর।
-
সত্যি তুমি খুশী?
-
খুশী? খুশী বড় হাল্কা শব্দ। সুখী তো
আরো বাজে। আনন্দ – বেদনাঘন আনন্দ!
-
আমি যে তোমার মত ইন্টেলেকচুয়াল নই?
-
কেন চাটছ মিছিমিছি?
-
না সত্যি, তোমার সন্দেহ হয় না? আমি তোমার সাথে চলতে পারব কিনা? আমার থেকে আরো ভালো কাউকে পেতে পারতে!
প্রেয়সীর কানের পিছনে আলগোছে হাত নিয়ে গিয়ে টেনে আনে একটা
পাকা চুল। হাতটা ফেরার সময় অবাধ্য ভাবে ছুঁইয়ে আসে গলা, চিবুক...।
-
দ্বিতীয় কথাটা আত্মুঅপমান। ওটা ফিরিয়ে নাও। ‘আরো ভালো’র
কোয়েস্ট যদি সঙ্গিনীবদল দিয়ে শুরু করি তাহলে তা দেশবদলেও থামবে না। জীবনবদল অর্থাৎ আত্মহত্যায় শেষ হবে। ... আর সন্দেহ বলবে? তা তো হয়। সেটাও তো তোমার অংশীদারিত্বে। আমার
সন্দেহের আদ্ধেকটা তোমার। তোমার সন্দেহের আদ্ধেকটা আমার। বিশ্বাসের সাথী পাওয়া তো সহজ। সন্দেহের, সংশয়ের সাথী পাওয়াই কঠিন। তবু, তা যে পাওয়া যায়, খুঁজলে, সেই বিশ্বাসটা হওয়ার পরই তো তোমাকে খুঁজে
পেলাম।
-
!
-
বুঝবে। ধীরে ধীরে। মানুষেরই কথা। মানুষকে বলছি। না বোঝার কিছু নেই।
-
আচ্ছা, সেদিন তুমি জানতে যে আমি সত্যি তোমায় ফোন করব?
-
আমি তো টিফিন টাইমে সিগারেট খেতে
খেতে রাস্তা দেখছিলাম জাভেদের দোকানে বসে। একটু
পরেই দেখি হন হন করে হাঁটতে হাঁটতে এসে তুমি উঠে গেলে দোতালার পোস্ট অফিসে! মামলা
বুঝে আমিও দৌড়ে নিজের অফিসে ঢুকে ফোনের পাশে দাঁড়ালাম।
-
আরে! তুমি দেখে ফেললে কোত্থেকে
ফোন করছি?
-
“আপনাকে কলেজ থেকে ফোন করে জানাব”!
-
সত্যি! কেন তুমি আমার ছোটোবেলায়
এলে না!
['কুলায় ফেরা' ওয়েবজিনে প্রকাশিত]
No comments:
Post a Comment