Tuesday, July 31, 2018

সিরাজুলের রক্ত


তাহলে জাপানী মটোরসাইকেলেরও স্টার্ট নিতে দেরী হয়ে যায় কখনো কখনো। ...
সিরাজুলের রক্তের আঁজলাগুলো মুছতে দেরী হলেও মাছি বসতে পায়নি। কালচেও হয়নি বিশেষ। ব্যাঙ্কের প্রধান গ্রিলটার কাছে শ্বেতপাথরের ওপর লাল গাঢ় সংক্রামিত পথ, তিনটে চেয়ারের সারি দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছিল। পুলিস আসবে, দেখবে, ছবি তুলবে হয়তো, তারপর মোছা হবে।
ভিতরে বাইরে তুমুল শোরগোল চলছে তখন। লুটেরা তিনটে ছিল না চারটে; যে দুটো ধরা পড়েছে তাদের হাতে যখন টাকার থলেও নেই এবং মটোরসাইকেলটাও পড়ে আছে তাহলে টাকার থলে নিয়ে বাকি একটা বা দুটো কোনদিক দিয়ে দৌড়ে পালালো নাকি আরেকটা মটোরসাইকেল ছিল; ফায়ারিংটা ভুল সময়ে হয়ে কীভাবে লুটেরাদের ধরা পড়িয়ে দিল; সিরাজুলকে পিস্তলের বাঁট দিয়ে মাথায় কোন ছেলেটা মেরেছিল; ছেলেগুলো বড়লোক না গরীবঘরের আর সবচেয়ে বেশী উত্তেজনা ছিল এই বিতর্কে যে লুটেরা দুটোকে ধরলো কে? জনতা, ব্যাঙ্কের কর্মচারী নাকি ট্র্যাফিক পুলিস?
সিরাজুলের রক্তের আঁজলাগুলোয় মাছি বসতে পায়নি যখন নাকি দুঘন্টা পর এনকাউন্টারে গুলি খেয়ে মরা লুটেরা ছেলেদুটোর মাথায় চোয়ালে ঘাসে ও পরে ঠেলাগাড়িতে লেগে থাকা রক্তে এন্তার মাছি বসেছিল সারাদিন। শুকিয়ে কালচে হয়েছিল। সবচেয়ে বড়কথা সিরাজুল মরেনি তারা মরেছিল।
একেই বলে ইশ্বরের ন্যায়। কেননা সিরাজুল অধর্ম করেনি। যে মালিকের নেমক খেয়েছে আঠাশ বছর তার টাকাটা বুকে আঁকড়ে ধরে লুটেরাদের হাত থেকে বাঁচাবার শেষ অব্দি চেষ্টা করেছিল। শেষ অব্দি মানে জ্ঞান হারানো অব্দি।
যে ছেলে দুজন গুলি খেয়ে মরলো তাদের পকেটে কোনো চিঠি পাওয়া যায়নি। আশ্চর্য! তাহলে সেদিনই সকালে শহরের পূর্ব প্রান্তে গ্রাম-থেকে-আসা ছেলেটি, স্যুটকেসসুদ্ধু, মাথায় রহস্যময় আঘাত পেয়ে মরে পড়েছিল কেন? তার কি এদেরই কারোর কাছে আসার কথা ছিল না? আর যদি কথা নাই থাকে আসার, তাহলে ওই ছেলেটির শরীর অত করূণ অভিমানে কেন শুয়েছিল ট্রান্সফর্মারটার নিচে? এই ছেলেদুটিরই বা মুখে এক জেদী বেপরোয়া ভাব কেন ছিল?
গ্রাম থেকেই শহরে আসে মানুষ। কোনোদিন সিরাজুলও এসেছিল। তার মালিকও এসেছিল। এসেছিল মৃত লুটেরা ছেলেদুটোও। এমনকি পুলিস কর্তারাও। যারা গ্রাম থেকে শহরে আসে না, শহরেই জন্মমৃত্যু তারাও, শহরে হাঁফ ফেলতে ফেলতে একদিন কোনো না কোনো ভাবে বহুকাল আগের বিস্মৃত গ্রামটা পেয়ে যায়। তারপর থেকে তারা রোজ সেখান থেকে আসে।
সেদিন লোকালে মানে ডিয়েমিউতে বাঢ় থেকে পাটনা আসার পথে কথা হচ্ছিল তিনজনের। একজন ভূস্বামী-ব্যাবসাদার, একজন হাকিম-ভূস্বামী, একজন পুলিস-কর্ত্তা, চাকরী সুত্রে ভূস্বামীর জামাই। বুঝলে ভায়া, দেশটা বদলাচ্ছে। আবার থেকে বিদেশী রাজ আসছে। আর এটা অত্যন্ত সুখবর। বুঝলে না? বোঝাচ্ছি। এই যে এত হাল্লা শুনছো ডাঙ্কেল, গ্যাট ... ব্যাপারটা কী জানো? সমাজবাদ খতম। সাম্যবাদের হাউয়াও হাওয়া। কম্যুনিস্টরা গেছে মায়ের ভোগে। বীজ, সার সবকিছুরই দাম বাড়বে। চাষবাস করা হয়ে যাবে দারূণ কঠিন। ছোটো কৃষক তো ছেড়ে দাও, মধ্যম কৃষকও জমি ধরে রাখতে পারবে না। ওদিকে ব্যাঙ্কগুলো হবে প্রাইভেট। ভর্তুকি-রাজও খতম ... । আঃ, এতে আমাদের চিন্তা কী? প্রথম প্রথম হয়তো মনে হবে যে আমাদেরও একটু কষ্ট হচ্ছে। হোক! ... একটু সময় যেতে দাও। সব জমি আসবে আমাদেরই হাতে। শালা, এই সব অজাত কুজাতগুলো বড় বাড় বেড়েছিল। সব আবার হাত জোড় করে দাঁড়াবে বৈঠকখানার দরবারে। জমিদারী হবে আবার থেকে কায়েম্। মহাজনীও শুরু হবে চুটিয়ে। আর শহর হবে বিলায়তী বাবুদের। কী ভাবছো? জমির পয়সা বিলায়তী কারবারে লাগাও। আর বিলায়তী কারবারের পয়সা জমিতে লাগাও। হাঃ ... হাঃ ... ।
হাঃ ... হাঃ ...।
বীরুও হেসেছিল। নিজের দুর্ভাগ্যের জৌলুসে। মে মাসের দুপুরে তার আয়নাটা তাকে বললো ... সব ঠিক আছে গুরু, কিন্তু তোমার ফাইটটাই তোমাকে মেরে দিচ্ছে। পথ নাটিকা থেকে প্রসেনিয়ামে শহরের বামপন্থী নাট্যদলটির বিজয় অভিযানে বীরু দাপটের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়েছে। যেমন অভিনয়, তেমনই গান। ফর্সা দোহারা শরীরটা হেলেদুলে মঞ্চে উঠলেই দর্শকরা আশ্বস্ত হয়, কোঁচকানো ভ্রূগুলি ঢিলে হয় যে এবার গতি আসবে নাটকে, পার্ট ভুলে ধ্যাড়ানো সইতে হবে না চ্যারিটি টিকিটের দশ টাকার দায়ে। কিন্তু তবু কী যেন একটা মেরে দেয় বীরুকে। একটা কেমন যেন আত্মবিশ্বাসের অভাব আর তার ফলে ঈষৎ অতি-অভিনয়। হয়তো আরো অনেকের মত এনএসডি করে এলে ব্যাপারটা কাটতো। এফটিটিআই তো অনেক দূরের ব্যাপার। দিল্লীরটা হাতের নাগালে ছিল। যে কটা মাল যাচ্ছে বীরু তাদের থেকে ভালো। পরীক্ষায় পাশ করবেই। কিন্তু যাওয়াই হবে না। পরিবার রয়েছে মাথার ওপর। ওর রোজগারটাই ভরসা। অন্যদের মত গাঁইয়ের জমিজিরেতও নেই বাপের পয়সাও নেই। তাই ট্রেডিং কোম্পানির মালিক, ম্যানেজার, একাউন্টেন্ট, বাবুর ফাইফরমাস খাটা সকাল থেকে বিকেল অব্দি। বীরু, নালন্দার ভ্যানের চালান রেডি আছে, মাল তোল্‌। বীরু, যা তো বাবা, রাধে কে দেখছি না, ছটা চায়ের জন্য ওকে বল তো! বীরু, এই ফাইলটা যাওয়ার সময় বড় সাহেবের ঘরে দিয়ে যাস। এই যে এ্যাক্টর সাহেব, কুমার বীরু, বস্‌ না সামনে, এই ভাউচারগুলোতে স্ট্যাম্প মার দেখি তাড়াতাড়ি! ... এ কী ছার লড়াই! তাও একা লড়ে যাওয়া। ... তাই সন্ধ্যেবেলা স্টেজের বীরু তো হয়ে যাওয়া যায়, বীরুর স্টেজ হওয়াতে একটা খামতি থেকে যায়। ... বীরু, নালন্দার ভ্যানটা... ! হঠাৎ সিরাজুল ঢুকতে বীরু ভ্যাবাচ্যাকা মেরে স্থির হয়ে গেল। সারা উর্দিতে কালচে রক্তের ছোপ, মাথায় একটা ফেট্টি যেমন তেমন করে বাঁধা, ডান চোখটা ফুলে বীভৎস হয়ে আছে ...
-       ডাকাতি হয়েছে ব্যাঙ্কের সামনে, হাসপাতালে ফাস্ট এড করিয়েছি, পুলিস রিপোর্ট লিখবে তারপর বাড়ি যাবো, কিছু পয়সা চাই।
-       আরে বোসো, বোসো সিরাজুল!
-       বাপ রে, তুমিই তো আজকে খবর! এই তো একটু আগে জানতে পারলাম।
-       ইস্‌। কী ভাবে মেরেছে!
-       তাও ভাগ্য যে গুলি চালায় নি!
-       টাকা! ... সাহেব ফিরলে তবে তো!
-       আচ্ছা দাঁড়াও, আমরাই কিছু ব্যবস্থা করে দিই। এ্যাই শর্মাজী, কুড়ি টাকা করে সব বাবুদের কাছ থেকে নাও তো! আর আমার পঞ্চাশ টাকা। দেবনাথবাবু, আপনিও পঞ্চাশ টাকা দেবেন। এটা ধার হল সিরাজুল, কোম্পানি থেকে এডভান্স পেলে দিয়ে দিও।
-       সত্যি, ভগবানের অশেষ কৃপা যে প্রাণে বেঁচে গেছ!
-       কত রক্ত পড়েছে! চোখটার ভিতরে চোট লাগে নি তো?
বীরু আস্তে আস্তে এসে সিরাজুলের সামনে বসে পড়লো মুখটা ভালো করে দেখতে। এভাবেই স্টেজের বাঁদিকে বিকেলের আলোয়, চোখে ব্যাথা ও বিস্ময় ফুটিয়ে কবীরের সামনে বসেছিল। পরিচালক বলেছিলেন, বীরু, ওভার-এ্যাক্ট করবি না, ধীর ছন্দে এগিয়ে এসে বসবি, ওই দোহাটা উচ্চারণ করার আগে কবীরের একটা কাতর বিভ্রান্ত অথচ প্রতিশ্রুত নৈঃশব্দ চাই, তুই সেই নৈঃশব্দ!
-       সিরাজুল চাচা, বাড়ী পৌঁছে দেব?
বীরু হঠাৎ একটা শান্তি অনুভব করে মনে। এখনো করার যথেষ্ট জিনিষ আছে অভিনয়ে, বীরু দেখাবে।

যথেষ্ট আছে মশাই। এর থেকে বেশী কী চান? এটা জেলা সদরের থানা। আর সাকুল্যে একটা জীপ আছে এখানে যেটাকে ধাক্কা দিয়ে স্টার্ট দিতে হয়। তাও কি সরকার পয়সা দিয়েছে ভাবছেন না কি? চাঁদা তুলেছি, চাঁদা, জনতার কাছ থেকে। ক্রিমিন্যাল আসে হিরো হোন্ডায়। জাপানী ইঞ্জিন; পাঁচ মিনিটে আপনার আওতার বাইরে চলে যায়। ফোর্স নেই। তাও তো আমরা এত কিছু করি। বলে একটা সিগারেট ধরান সদরের এসপি রবীন্দ্র সিং। তরূণ পুলিস অফিসার। পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর রাজনীতি বিজ্ঞানের তাঁর সমসাময়িকেরা কেউ দিল্লীতে কেউ বিলেতে ভালো পজিশনে রয়েছে। ... বাইরে জুন মাসের ধুলো ওড়ে। কৃষিকাজ কমে চলেছে লাগাতার। প্রথম তো রিটার্ন নেই; এর থেকে শেয়ারে টাকা খাটানো ভালো। দ্বিতীয়, রাজনৈতিক লড়াই, উগ্রপন্থা; আজ এদিকে দুটো লাশ পড়ছে, কাল ওদিকে তিনটে লাশ পড়ছে। তৈরি হচ্ছে ক্রিমিন্যাল। জেলে ভরে কী হবে? ক্রিমিন্যাল রঙরূট, দুবছর জেল খেটে হবে হার্ডকোর। ধরা পড়লেই এনকাউন্টার করে মেরে সাফ করে দাও এটাই আমাদের সাধারণ নীতি-নির্দেশ। তবেই সমাজটাকে সাফসুথরো রাখা যাবে।

সাফ! প্যাসেঞ্জার ট্রেনের কামরা সাফ করার কোনো মানে হয় না। আর, এই ট্রেনটার তো কোনোকিছু নিয়েই কারোর কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই, ব্যস পৌঁছোনো নিয়ে কথা। কখন মাঝ ক্ষেতে বসে যাবে ইঞ্জিন! তিন ঘন্টা পর অন্য ইঞ্জিন আসবে তাও যদি পাওয়া যায়। পিছন থেকে ঠেলা মেরে পরবর্ত্তী স্টেশন। তবে গিয়ে পাশের লাইন ধরে সামনে লাগানো যাবে ইঞ্জিন। ভ্যাকুম খুলে গ্রাম থেকে বরযাত্রী-বিদায় হবে প্রতি দশ মাইল অন্তর। তবু ছেলেগুলো কামরার মেঝেতে ঝাঁট দেয়। যাত্রীদের কাছে হাত পেতে মেহনতানা চায়। শিশু মুখ, চোখে বিপজ্জনক উদাসীনতার ঝিলিক নিয়ে দশ পয়সার আশীর্বাদ শোনে, যা বাবু, এ্যায়েশ্‌ কর্‌
চালের বস্তার ওপর বসে জমাদার পান্ডেজী পা উঠিয়ে বাদামের খোসা ঝাঁট দিয়ে নিয়ে যাওয়ার জায়গা করে দেয়। তারপর পাশের জুনিয়র কনস্টেবলটিকে শেখানো জারি রাখে, এটা জেনে রাখো যে মানুষ স্বভাবতই অপরাধী প্রকৃতির। সমাজ যে চলছে সেটা আমরা আছি বলেই। হ্যাঁ, তা সত্ত্বেও যে অপরাধ হয় সেটা ওই, যেখানে যেখানে আমরা নেই সেখানে হয়। ল এন্ড অর্ডার কায়েম থাকছে, রাখছি, এটাই নিয়ম। অপরাধটা ব্যতিক্রম। ব্যতিক্রম তো সব নিয়মেরই থাকে। ...

যেমন এই নিয়মটা যে ডাকাত ধরলে পুরস্কার বা প্রশংসাপত্র পাওয়া যায়। পাওয়া অবশ্যই যেতে পারে কিন্তু তার আগে আইও মিথিলেশ প্রসাদকে ম্যানেজ করতে হবে। ম্যানেজ করা মানে ম্যানেজ করা, তার আবার মানে কী? আর যদি ম্যানেজ না করো তার ফলও ভোগ করতে হবে হাতে হাতে! কেস ডাইরি হবে এমন যে তুমিই হয়ে যাবে ডাকাতের সহযোগী, এ্যাকমপ্লিস! কথাটা খারাপ লাগলো ওনার! ওসির কাছে তদ্বির করতে গেলেন। আরে যদি আইজিকেও তদ্বির করেন তবুও কিচ্ছু হবে না। কেস লড়তে থাকুন দশ বছর!...

দশ বছরে কত কিই না হতে পারে। দূরদর্শন দেখায় হেলিকপ্টারের দরজায় হাত রেখে দাঁড়ানো মহিলা শিল্পপতিটিকে। দশ বছর আগে স্বাধীনচেতা নারীদের একজন হিসেবে নিজের ব্যবসা শুরু করেছিলেন। যমুনার ওপারে নিজের কারখানায় রিকশায় বসে পৌঁছোতেন। এখন তাঁর নিজস্ব একটি এরোপ্লেন এবং একটি হেলিকপ্টার আছে। প্রদেশের রাজধানীতে এসে যে কদিন থাকেন সে কদিন তাঁর থাকার খরচ দৈনিক এক লক্ষ টাকা। দশ বছর মানে অনেক কিছু। দশ বছর আগে দেশ, আইএমএফ প্রভুদের কর্জের তৃতীয় কিস্তি নিতে অস্বীকার করতে পারতো তা সে দেশের শাসকদলনেত্রী, প্রধানমন্ত্রীর জনপ্রিয়তা বাঁচিয়ে রাখার খাতিরেই হোক না কেন। তারপর তো সে প্রধানমন্ত্রীর, নিজেরই বাসভবনে গুলিতে জর্জর হয়ে মৃত্যু, পরবর্ত্তী প্রধানমন্ত্রীর তড়িঘড়ি বিদেশী কর্জ ও বিদেশী মাল আমদানীর পরিবেশ নির্বাধ করার ঘোষণা; ফলস্বরূপ নির্বাচনে পরাজয় যদিও, তবু বোমার আঘাতে মৃত্যু এবং উত্তরসুরী সরকারের, আইএমএফ-বিশ্বব্যাঙ্ক প্রভুদের প্রতি বৈপ্লবিক নিবেদন, আসুন স্যার, কর্জ যত নিতে হুকুম করবেন, মাথা পেতে নেব, বাজেটটাও করে দিন স্যার পেটে গুঁতো মেরে এগিয়ে দিচ্ছি দেশের কোমর স্যার, হাতুড়ি মেরে ভাঙুন! ... সব ওই দশ বছরেই।

হাতুড়িই যেন মারা হয়েছিল ছেলেটির মাথায়। বা হয়তো ট্রাকের ধাক্কা লেগেছিল। রক্তে জবজবে হয়ে ছিল মাথার পেছন আর ঘাড়। পরনে পাজামা আর শার্ট। হাতে ছোটো সস্তা স্যুটকেস। এভাবে আসার মানে তার আগে কেউ এ শহরে এসেছে, তার একান্ত আপন। যদিও তার নির্দিষ্ট ঠিকানা ছেলেটির কাছে নেই। শহরে আসার ডাকটাও হয়তো নির্দিষ্ট ছিল না। আদ্ধেক লেখা চিঠি দেড় মাস পরে পৌঁছোয় সিনেমার মত। তবু মনে ভরসা জাগে শহরে পৌঁছোলেই সব কিছুর হদিশ করে নেওয়া যাবে। হদিশ করেও নেওয়া যায় বস্তুতঃ। রোদ, বৃষ্টি্‌ ভাতের মার আর চোখের শীত পোহাতে পোহাতে একদিন নিজেই হদিশ হয়ে যায় ওস্তাদ দুনিয়াদার! ছেলেটির মৃত্যু নিছক অঘটন বই কিছু নয়। ... গুলিও অঘটন। থানার উঠোনে, ঠেলায় শোয়ানো দুর্বৃত্ত ছেলেদুটির লাশ নিছক অঘটন। অঘটনের ভয়ে থাকলে জীবন চলে না। আইনেরও চলে না, বেআইনেরও  চলে না। ...

খুব কাছ থেকে মারা গুলিতে মাথার বেআইনি ভিতরটা বাইরে বেরিয়ে এসেছে। দেখছে শখানেক জোড়া চোখ। মাথার ভেতরটা সবারই একরকম, সে আইনি হোক আর বেআইনি হোক, ধনী হোক বা গরীব হোক।
-       ধনীরা আর গুলি খেয়ে মরবে কেন মশাই। তারাই তো গুলি করায়, পুলিসকে দিয়ে।
-       সে যাই বলুন, যা দৌরাত্ম বাড়ছে টিভি আর সিনেমার, সব বড় ঘরের ছেলেরাও ক্রিমিন্যাল হয়ে উঠছে।
-       তা, এ দুজনকে কেমন দেখলেন?
-       মরা মানুষ কি কথা বলে? না, তার জাত চেনা যায়? আর আজকাল তো সবাই জীন্স ঝাড়ে, ফিল্মি কায়দায়। তবু দেখে স্বচ্ছল ঘরেরই মনে হল।
-       হতেই হবে। এসব ব্যাঙ্ক ডাকাতি, প্রতারণা, জালিয়াতি তো আর গরীব অশিক্ষিত ছেলেরা করতে পারে না! ... দেশের আশি প্রতিশত অপরাধ বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় করে। ইংলিশ দিস, দ্যাট করে মানুষকে বোকা বানাচ্ছে, শোষণ করছে আর রাজত্ব চালাচ্ছে। শাসনও ওদের, পুলিসও ওদের আর কোর্টও ওদের!
-       সত্যি, কোর্টের যা অবস্থা! শালা সব কিছু ঠিক মত হল! এভিডেন্স ভেঙে গেল, উইটনেস ভেঙে গেল, আর্গুমেন্ট ভেঙে গেল, তারপরও... ! কী হবে ভাই, কে জানে! কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। সব কিছু হাকিমের মুড আর হুইমের ওপর ডিপেন্ড করছে! কী অদ্ভুত!
-       অদ্ভুত আবার কী? এই তো হবে। বড় ঘরের চার ভাইয়ের মধ্যে একটা কুলাঙ্গার ল পাশ করে উকিল হচ্ছে। আর দশজন উকিলের মাঝে একটা নামুরাদ যার পয়সা পেটার এলেম নেই, হচ্ছে হাকিম। মুন্সীকে দিয়ে পুরোনো জাজমেন্ট বার করিয়ে টুকলিফাই করে জাজমেন্ট লিখছে। উকিলদের তর্ক শোনার সময় কান চুলকোচ্ছে আর ঝিমোচ্ছে! আর যা হয় তা বলার দরকার নেই। যতক্ষণ সব কিছু বিলকুল সাফ না করা হচ্ছে...। আর তা কোনোদিনই হবে না...।

এবার সাফ করিয়ে দিন, ব্যাঙ্কের চীফ ম্যানেজার বললেন সিনিয়র ম্যানেজার (অপারেশন) কে। ঝাঁটা হাতে মাতা প্রসাদ এগিয়ে এল। চেয়ার সরিয়ে রক্তের শুকিয়ে আসা আঁজলাগুলোর ওপরে আগে জল ঢালা হল। তারপর ঝাঁটা দিয়ে ঘসে ঘসে ওঠানো...। চেম্বারে তখন তিনজন কর্মচারী সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম ডিটেল দিয়ে বর্ণনা করছে, ডাকাতদের ডাকাতি করে পালাবার ঘটনাটা যাতে তার মধ্যে দিয়ে তাদের ডাকাত ধরার সাহস, প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব আর মনোবল প্রমাণিত হয়। ব্যাঙ্ক ডাকাতি না হলেও ব্যাঙ্কের সামনে তো হয়েছে! ডিটেলে সামান্য হেরফের ঘটছে স্থান আর কালের যাতে হাজিরার সময়টা এড়িয়ে যাওয়া যায়। ব্যাঙ্ক কর্মচারীর জীবনে আর আছেই বা কী ভাই! প্রশংসাপত্র বা পুরস্কার পেয়ে গেলে প্রমোশনে কাজে লাগবে!

প্রমোশন? তোমার হিতাকাঙ্খীদের ইচ্ছেটা অনুচিৎ নয় সিরাজুল। আমিও তোমার পরিস্থিতিতে থাকলে একই আশা করতাম। কিন্তু ..., ট্রেডিং কোম্পানির এখনো-যুবক মালিক হাতের কলমটা নাড়তে নাড়তে বলেন। পরণে গাঢ় তুঁত রঙের সাফারি স্যুট, চোখে দামী চশমা, বুকপকেটে স্যুটের রঙের সাথে মানানসই দামী দুটো কলম। পুরো গেট-আপটা মাদাম তমুক আসার আগের দিন একঝোঁকে তৈরি করা। যে কটা কোম্পানির প্রোডাক্টের এই ট্রেডিং কোম্পানিটি পূর্বাঞ্চলে প্রধান থোক বিতরক, তার একটির আদত আমেরিকান মূলটির তরফ থেকে পরিদর্শক মাদাম তমুক ভারতে এসেছিলেন। ট্রেডিং কোম্পানির যুবক মালিকটিকে আগামী শরৎ কালে আমেরিকায় আসার নিমন্ত্রণ জানিয়ে গেছেন। তবে যুবক মালিক দক্ষিণ ফ্রান্স হয়ে যেতে চান, পারলে ডেনমার্কও। গঙ্গার ওপারে একটা ফুড প্রসেসিং ইউনিট দাঁড় করানো নিয়ে ভাবনাচিন্তা করছেন। এই দাঁওয়ে হয়ে গেলে ভালো কেননা আবহাওয়া অনুকুল আর তাছাড়া টাকা পাওয়ার সম্ভাব্য স্রোতগুলোয় তেল-শোষা ঘুঁটেরা নেই আপাততঃ।

আমিও তোমার পরিস্থিতিতে থাকলে একই আশা করতাম। কিন্তু একটু দূর থেকে ভাবো। সিরাজুলের চোখের সামনে আঙটির ঝিলিকে নড়তে থাকা কলমটা বুকপকেটের নয়, টেবিলের। ডাকাত পাঁচজনের দুজন মরেছে, একজন জেলে। বাকি দুজন বাইরে ঘুরছে। ওদের আরো লোক আছে। আসল  স্কীমার জেলে বসেই কাজ করাচ্ছে দশ বছর ধরে। তুমিই ওদের প্রথম টার্গেট ছিলে। তাই তোমাকে ওরা ভালো করে চিনে রেখেছে। তোমাকে দিয়ে টাকা পাঠানোর কাজ করানো যাবে না। যুবক মালিক চোখ নামিয়ে কাঁধ উচকে হাত ওল্টান, আর কোথায় কাজ করাতে পারি তোমাকে দিয়ে? সব ডিপার্টমেন্টেই যথেষ্ট স্টাফ রয়েছে। কাকে সরাবো? তাছাড়া তোমার বয়সও হল...! যুবক মালিক কলম নাড়ানো থামিয়ে চোখ তোলেন (বাবা বলতেন, যত তেতো সিদ্ধান্তই হোক, চোখ নামিয়ে কক্ষণো বলবি না যাকে বলছিস তার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়াটা যেন পুরোপুরি দাগ কেটে তোর মনে বসে যেতে পারে; তাছাড়া, তুইই মালিক, তোর সিদ্ধান্ত মানে পুরো কোম্পানির আত্মবিশ্বাস!)। সিরাজুল নিজের ভিতরে ভোঁতা ধাক্কার জেরটা সামলাচ্ছিল। ঘা এখন শুকিয়ে গেছে। তবে ডান চোখটা এখনো একটু ফোলা। একটু টনটন করে। বলতে বাধছে সিরাজুল, তুমি বাবার সময়ের লোক, তবে তোমার আর আমার ব্যবসার ভালোর জন্য বলতে হচ্ছে যে তুমি অন্য চাকরী খুঁজে নাও। হ্যাঁ, তুমি যে সাহস দেখিয়েছ তার পুরস্কার দিয়েই কোম্পানি তোমাকে রিটায়ার করাবে। ...

খুঁজে নাও বললেই কি খুঁজে নেওয়া যায়? এত বড় হয়ে গেছে এ অঞ্চলটা! বীরু কিছুতেই পার্ল ভিডিওর দোকানটা খুঁজে পায় না যাতে সিরাজুল কাজ করে ইদানিং। পার্ল ভিডিওর মালিক স্বজাতিপ্রেমী মুসলমান, সেই সুত্রেই কাজটা পাওয়া। ভিডিওর শোরুমের পাশ দিয়ে একটা আঁধার ঘোরানো সিঁড়িপথ। ওপরে ওয়ার্কশপ। ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রপাতি সারাইয়ের দোকান। সেটাও বহিরাবরণ। সেখানে গেলে ক্লায়েন্ট হদিশ পায় এক মুক্ত দুনিয়ার ... জাপানী সেলুলার ফোন, ফটোকপিয়ার, আসল বিদেশী কম্পিউটার, ভিডিও ক্যামেরা... এমনকি গাড়ীও চাইতে পারেন, গ্রাহক ভগবান, আমরা নিশ্চয়ই যোগাড় করে দেওয়ার চেষ্টা করবো ... বীরু পানের দোকানটার সামনে জিরোচ্ছিল। তখনি পিছন থেকে একটা আওয়াজ বীরু ফিরে তাকিয়ে দেখলো শার্ট আর পাজামা পরে হাতে স্যুটকেস নিয়ে একটি ছেলে। পকেট থেকে একটা চিঠি বার করে এগিয়ে দিল। তাতে শান্তি অশান্তির কিছু ভাঙাচোরা কথা আর দুর্বোধ্য একটা ঠিকানা লেখা। স্যার, এটা কোথায় বলতে পারেন? তখনি একটা মটোরসাইকেলে দুটো ছেলে হুস করে এসে পানের দোকানে দাঁড়ালো।

[বিহার বাঙলা আকাডেমি প্রকাশিত আকাডেমি পত্রিকায় ২০১০এ প্রকাশিত]      




No comments:

Post a Comment