Sunday, February 11, 2018

পৃথিবী তৈরি হয় প্রতিদিন (হিন্দী কবি আলোকধন্বার কিছু কবিতার অনুবাদ)

কেউ বলেছিল অনুবাদ করতে । বেশ কিছু বছর আগে । কবিও জানতেন না । কাল বললাম । এও বললাম, পড়ে আছে, বরং ফেসবুকে দিয়ে দিই । অন্ততঃ ভূল ধরারও তো দু’একজন পাওয়া যাবে !

 

আমগাছ

বিশ বছর পুরোনো
সাঁঝরঙা এ আমগাছ

বেশ ক’টি ডাল
ভুঁই অব্দি ঝুঁকে উপরে উঠেছে
কয়েকটি
গুঁড়িটাকে নিজেদের সাথে
ওপরে আকাশে নিয়ে গেছে

রাতে এ গাছটির নিচে
শুকনো ঘাসের মত উষ্ণতা
নীড়, পাখিদের নিঃশ্বাস
তাদের ডানা আর বিষ্ঠার গন্ধ
কালো মাটির মত ছায়া।

নদীরা

ইছামতী ও মেঘনা
মহানন্দা
রাবি ও ঝিলম
গঙ্গা গোদাবরী
নর্মদা ও ঘাঘরা
নাম নিতেও কষ্ট হয়

সেটুকুই দেখা হয় এদের সাথে
যেটুকু চলার পথে এরা এসে পড়ে

আর তখনও মাথা
কত কম এদের কাছে পৌঁছোয়
মাথা তো ভরা থাকে
লুটেরাদের
বাজারের কোলাহলে ।

ছাগলেরা

যদি অসীমে থাকত ঝোপ
ছাগলেরা অসীমেও যেত
পেটভরে পাতা খেয়ে
ফিরে আসতো
পৃথিবীর কোনো পরিচিত বারান্দায়

যখন আমি প্রথম পাহাড়ে গেলাম
পাহাড়ের খাড়া চড়ানেও
দেখা হল ছাগলদের সাথে
অনেক নিচের গ্রাম থেকে
গ্রীষ্মে হারিয়ে যেতে থাকা সবুজের সাথে উঠতে উঠতে
তারা চলে আসতো উপরে
   
কিন্তু রাখালের দেখা পেলাম না কোথাও
হয়ত ঘুমিয়ে ছিল তারা
কোনো অশ্বত্থের ছায়ায়
এ সুখ আছে তাদেরই কপালে।

ঘুম

রাতের বখাটেরা
আমারও চিত্তের কাছে দাঁড়াও
দাও এমন ঘুম
যার ওপর একটি তৃণেরও ভার নেই

এমন ঘুম
যেন চাঁদে জলীয় ঘাস।

শরীর

মানবীরা যুগ যুগ ধরে যে’টির রচনা করল
যুগের পর যুগে, রাতগুলোয় এত আপন হল শরীর
আজ তা’ খুঁজতে বেরোলাম আমি নিজের শরীরে।

তফাৎ    

দেখো
একদিন আমিও ওভাবেই সন্ধেবেলায়
কিছুক্ষণ বেড়াতে বেরোবো আর
ফিরে আসতে পারব না!

সবাই বুঝবে যে আমি
শেষ করেছি নিজেকে।

না, অসম্ভব,
সম্পূর্ণ মিথ্যে হবে সে খবর!
তুমিও বিশ্বাস করে বোসো না আবার
তুমি,
যে জানো আমাকে একটু আধটু!
অসংখ্যবার
আমার জামায় ঠিক হৃৎপিন্ডের কাছে
ব্যাজ লাগিয়েছো লাল ঝান্ডার,
তুমিও বিশ্বাস করে বোসো না ভাই!

নিজের দুর্বল থেকে দুর্বলতর মুহুর্তেও
তুমি ভেবো না
যে আমার মস্তিষ্কের মৃত্যু হয়ে থাকবে!
না, কখনও না!

হত্যা ও আত্মহত্যাগুলি এক করে দেওয়া হয়েছে সময়ের
এই আদ্ধেক অন্ধকারে।
তফাৎ করে নিও কমরেড!

 

জেলাশাসক

তুমি এক পিছিয়ে থাকা বক্তা।

বিরোধের এমন ভাষায় রাখো বক্তব্য
যেন রাজাদের বিরোধ করছ।
এ ভাষা এমন এক সময়ের
যখন লোকসভার জন্ম হয়নি।

তুমি কি ভাবো
লোকসভা
বিরোধের ভাষা এবং বিষয়বস্তু
তেমনই থাকতে দিয়েছে
যেমন ছিল রাজাদের যুগে?

এই যে মানুষটি
টেবিলের অন্যদিকে বসে তোমায় শুনছে
এত কাছ থেকে এবং মন দিয়ে
এ রাজা নয় জেলাশাসক।

                                    রাজাদের চেয়ে
                                    অনেক বেশি শিক্ষিত সাধারণতঃ
রাজাদের চেয়ে বেশি
তৎপর ও তন্নিষ্ঠ এই জেলাশাসক!

দূরে কোনো কেল্লায় – ঐশ্বর্যের নির্জনে নয়
মানুষটি,
আমাদেরই গলিতে জন্ম নেওয়া এক বালক।
আমাদের নানান অসফলতা ও ভূলের মাঝে
এর প্রতিপালন – এ জানে আমাদের  
সাহস আর লোভ;
নিজের ভিতরে
ধৈর্য ও ভাবনা ধরে
অনেক বেশি, রাজাদের চেয়ে!

এ উৎপন্ন করতে পারে বেশি ভ্রান্তি
বেশি ভালো করে স্বাধীনতা থেকে দূরে
সরিয়ে রাখতে পারে আমাদের।
কঠোর
কঠোর সতর্ক দৃষ্টি চাই
সরকারবাহাদুরের
অতি উত্তম এই মাথাটির ওপর!

কখনো কখনো তো
শিখতেও হতে পারে
এর কাছ থেকে!


ছাতে মেয়েরা

ছাতে
এখনও আসে মেয়েরা
আমার জীবনে পড়ে তাদের ছায়াগুলি।

জানা কথা যে মেয়েরা ওই ছেলেগুলোর জন্যই এসেছে
যারা তাশ খেলছে নিচে গলিতে
নর্দমার ওপর তৈরি সিঁড়িগুলোয়  
অথবা খাচ্ছে চা
ফুটপাথের উন্মুক্ত চা’খানার বেঞ্চিগুলোয়
ওই ছেলেটিকে ঘিরে
যে খুব মিষ্টি বাজাচ্ছে মাউথ অর্গানে
আওয়ারা এবং শ্রী ৪২০ এর অমর সুর।

ভুঁইয়ে বেছানো একটি দোকান, পত্রিকার
তার সামনে দাঁড়িয়ে কিছু যুবক 
                        পড়ছে খবরের কাগজও।
সবাই ছাত্র নয় তার মধ্যে
কিছু বেকার কিছু চাকুরে
আবার রয়েছে কিছু নিষ্কর্মাও

কিন্তু ওদের সবার রক্তে আছে প্রতীক্ষা
একটি মেয়ের!
আশা আছে
যে ওই বাড়ি ওই ছাদগুলি থেকে
কোনো সন্ধ্যায়
আসবে ভালোবাসা।


আলো, জীবনের প্রথম সিনেমার

যে রাতে ভাঙল বাঁধ
আর জল ঢুকল শহরে

তুমি খোঁজটাও নিলে না

যেন এত বড় হলে নারী
এই শহরটি ছাড়াই
যেখানে তোমার প্রথম রেলগাড়ি ছিল
আর আলো ছিল
জীবনের প্রথম সিনেমার।


চৌরাস্তা

সে নারীদের ঐশ্বর্য আমার সঙ্গে রইলো
চৌরাস্তা পার করতে যাঁরা শেখালেন আমায়।  

ছিলেন তাঁরা আমাদেরই পাড়ার
কাজে যেতেন রোজ সকালে
তাঁদের পথে পড়ত আমার স্কুল
মা আমায় তাঁদের হাতে ছেড়ে দিতেন
ছুটি হলে তাঁদের অপেক্ষা করতাম
তাঁরা আমায় অপেক্ষা করতে শেখালেন।

জনপদের স্কুলটায়
প্রথম ভর্তি হয়েছিলাম
কিছু দিন পর
একাই যেতে লাগলাম
আর তারও কিছুদিন পর
অনেক ছেলেরা বন্ধু হয়ে গেল আমার
তখন একসাথে আমাদের
আরো অনেক অন্য রাস্তা দিয়েও
স্কুলে যাওয়া আসা শুরু হল

কিন্ত আজও
ওই ক’টা দিনের এত দশক পরেও
যখন কোনো বড় শহরের
এলোমেলো চৌরাস্তা পেরোই
সে নারীদের কথা মনে পড়ে
আর আমি আমার ডান হাত
তাঁদের দিকে বাড়াই
বাঁহাতে ওই স্লেটটা সামলাই
যেটা কুড়ি বছরের
খবর-কাগজের
পিছনে ছেড়ে এসেছিলাম! 


দাম

এখন তো ভুলে যাওয়ারও বেশ ভাল দাম পাওয়া যায়

এখন তো এটাই করে
লোভী নীচ মানুষেরা।

আকাশের মত হাওয়া

সমুদ্র,
তোমার তটগুলি শরতঋতুর

আর তুমি নিজে সমুদ্র
সূর্য আর লবণের

তোমার কন্ঠস্বর
আন্দোলন ও গভীরতার

আর অনেক দেশ পার করে
তোমার ভিতরে পৌঁছনো
হাওয়াগুলি
আকাশের মত

তোমায় পার করার ইচ্ছে
বেশি হয় না
হারিয়ে যাওয়ার
ভয় থাকে সব সময়।


রেলগাড়ি

প্রত্যেক ভালো মানুষের একটি রেলগাড়ি থাকে
যেটি তার মায়ের বাড়ির দিকে যায়

হুইসিল বাজিয়ে
ধোঁয়া উড়িয়ে।

জংশন

আহ, জংশন!
রেলগাড়িগুলো বেশিক্ষণ দাঁড়ায় যেখানে
বাকি পথটুকুর জন্য জল নেয়

আমি খুঁজি সেখানে আমার
পুরোনো সহযাত্রী।

শরতের রাত

শরতের রাতগুলি
এত হাল্কা আর খোলা
যেন কাল সকাল অব্দি পুরোটাই
                        সাঁঝ

যেন এই সাঁঝের পরের
রাতগুলি হবে অন্য মরশুমে। 

পথ

বাড়িগুলির ভিতর দিয়ে যেত পথ আমাদের
এত বড় উঠোন
সবদিকে বারান্দা আর বারান্দা
দরজাগুলো গলিতে খুলত
ওদিক থেকে রোদ আসত দিনের শেষ অব্দি

আর ওই গাছগুলো
এমনভাবে ছিল ছাতে ছাতে ঘেরা
গাছে চড়তাম
আর নামতাম যে কোনো ছাতে

ছিলাম বাঁদরের চেয়ে বেশি বাঁদর
বেড়ালের চেয়ে বেশি বেড়াল

বিজলির খাম্ভাগুলো
পাথর দিয়ে বাজাতে বাজাতে, গলিতে
কাল আমরা ছিলাম।

সুর্যাস্তের আকাশ 

অতগুলো সুর্যাস্ত তার অতগুলো আকাশ
অত তার রঙ
দীর্ঘ রাজপথে সন্ধ্যা
ধীরে, খুব ধীরে ছাওয়া সন্ধ্যা
হোটেলগুলোর আশেপাশে
আলো আলো
মানুষের ভীড়
দূর অব্দি দেখা যাওয়া তাদের চেহারা
তাদের কাঁধ পরিচিত কন্ঠস্বর

এসব কিছুকেও ঘটনার মত কোনোদিন
লিখবে কবি এ দেশে।

বিস্ময়, তরমুজের মত

যখন তার তীর থেকে ফিরে এলাম
বেশি বড় দেখা গেল তাকে

সে নারীদের এখন বেশি দেখতে পাই
যারা চুমো খেয়েছিল আমায় শৈশবে

ওই পশুরা
যারা সুদূর রোদ্দুরে আমার সাথে খেলত
আর পারতো না প্রতীক্ষা করতে

আর ওই প্রথম ছাতাগুলো
যেগুলোর খুব কাছে ছিল মেঘ

সমুদ্র আমায় নিয়ে চলল সেই দুপুরে
যখন ডাকতেও পারতাম না
কান্নাই ছিল ডাক

যেখানে বিস্ময়
তরমুজের মত
যতটা সবুজ ততটাই লাল।

থিয়েটার

পার্কের বেঞ্চির
কোনো শেষ নেই
শুধু ভরটা দিয়ে পার্কে
আছে শহরের বাইরে অব্দি

সেতুর আলোগুলোর
কোনো শেষ নেই
আমার রাতগুলো ভরা ওই আলোয়
মরণের সামনেও
থাকবে স্মৃতিতে

দীঘলচঞ্চু ছোটো পাখি
কাঠঠোকরা
কোনোরকমে দু’তিনবার দেখেছি
গত দশবারো বছরে

আবার দেখা দেবে পাখিটা
এবার থিয়েটারে

থিয়েটারের কোনো শেষ নেই
কোনো একটা ইমারতের নাম নয় থিয়েটার।

পাখি ও তারারা

পাখিরা যাচ্ছে আর তারারা আসছে

কয়েক মিনিট আগে
সূর্যাস্ত ধুয়েছে আমার ঘষা প্যান্ট

আমার সামনে যে মাঠ
সেটি অনেকক্ষণ অব্দি অদৃশ্য হতে থাকলো
আমার চলায় উঠতে থাকলো তার ধুলো

এত আর্দ্র বেগুনি দানা
পড়ছে, ছড়িয়ে যাচ্ছে অবিরাম আমার ছায়ায়
যেন আমার আসাই উচিৎ হয়নি
এদিকে।

সাতশো বছর পুরোনো ছন্দ

পৃথিবী ঘুরতে ঘুরতে গেল কোনদিকে
যে ফুল ফুটলো আপেলে

আলাদা আলাদা করে
ছোটো ছোটো শহরের চাঁদ
বৃষ্টি থেকে উপরে উঠতে থাকা তাদের শান্তি
মনে পড়লো

ঘাসের পাতার ওপর দাঁড়িয়ে গেল ফোঁটা
ছড়িয়ে পড়তে লাগলো সমস্ত ঘুমে  

রোদ্দুর নামলো লেবুতে

প্রথম প্রেম যখন ছাই হয়ে গেল
নিজেকে বাঁচিয়ে নিলো ওই শ্যামলী নৃত্যশিক্ষিকা
দাঙ্গার বিরুদ্ধে প্রভাতফেরিতে তাকে দেখা গেল আবার
শরীরে ও সমুদায়ে এক

লম্বা ছুটি মাঝখানেই শেষ করে
কাজে ফিরলো আবার
অনুশীলন করাতে এল নিজের ছাত্রীদের
ছন্দ, সাতশো বছর পুরোনো ।

সমুদ্র ও চাঁদ

যখন সে চাঁদের দিকে উঠছিল
পশ্চিম ভারতের শেষ প্রান্তে
সেই সন্ধ্যায় আমি সমুদ্রকে দেখলাম

আর চাঁদ
ট্রামের চাকার মত বড়
আর ওই শহর কলকাতা বহুদূর
যেখানে ট্রাম চলে

সমুদ্র উঠছিল চাঁদের দিকে
যেভাবে উঠতে পারে শুধু ঘোড়া
যেমন ঘোড়া দেখাই যায় তখন
যখন দৌড়োয়

সমুদ্র উঠছিল চাঁদের দিকে
আমি এক্কেবারে কাছেই দাঁড়িয়েছিলাম
এমন এক একাকীত্ব এমন এক উত্তেজনা
কাঁদারও ইচ্ছে হয়েছিল
কিন্তু বেরুলো না

আর কিভাবে রাত আসছিল
অত উঁচু ঢেউএ
কোথাও
শুধু আমার পুরোনো জামাটায় ছাড়া
দেখা যাচ্ছিলো না

বেশিক্ষণ দাঁড়ানো ছিল কঠিন
বোম্বাইয়ের ভিতরে ফিরে এলাম।

পায়ে চলা পথ

ওখানে সঘন বৃক্ষরাজি
ভিতরে যায় পায়ে চলা পথ

একটু এগিয়ে উৎরাই শুরু হয়
নামে নদীর তীরে
যেখানে নারীরা রয়েছে
নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে
কাটতে থাকে ঘাস
বৃক্ষরাজির ভিতরেই
তাদের কথাবার্তা শুনতে পাওয়া যায়।

মীর

মীর কে নিয়ে কথা বলো
তো সে কথাগুলোও ততটাই ভালো লাগে
যতটা মীর

আর তোমার ওই কয়ে চলা
প্রেমপাগলামির সারল্যে
হৃদয় হৃদয় করা
হৃদয় নিয়ে কথা বারবার
জোর দিয়ে বলা নিজের হৃদয় বিষয়ে যে
জনাব এ সেই হৃদয়
যে মীরের গলি হয়ে এসেছে।

বাসনা

যেখানে নদীরা সমুদ্রের সাথে দেখা করে
সেখানে কী আছে আমার
আমি জানিনা
কিন্তু যেতে হবে ওদিকে একদিন

ওদিকে কাউকে যেতে দেখলে
কেমন চাগিয়ে ওঠে বাসনা!

কে বাঁচালো আমার প্রাণ

কে আমার প্রাণ বাঁচালো
দু পয়সার মোমবাতির আলো

দুচারটে সেদ্ধ আলু

শুকনো পাতার আগুন
আর মাটির বাসনগুলো
খড়ের বিছানা আর
খড়রঙা চাঁদ

পথনাটিকার বখাটে দেখতে ছোকরাগুলো
ছেঁড়া কাপড় পরে
সত্যের গৌরবের মত কন্ঠস্বরে
মোড়ে মোড়ে কঠিন মোকাবিলায়
যারা দাঙ্গাকারীদের করলো তাড়া
শিখলো রঙ্গমঞ্চ বীর ভারতীয় তরুণদের কাছে
ভেজা বস্ত্রের মত আকূল অভিনয়

ঠাকুমার জন্য রুটি সেঁকার চিমটে নিয়ে
ইদগাহের মেলা থেকে ফিরতে থাকা ছোট্টো হামিদ
আর ছয় ডিসেম্বরের পর
ফেব্রুয়ারি আসতে আসতে
জংলা কুল
এরা সব বাঁচালো আমার প্রাণ।


ক্যারাভান

সমুদ্র আর শহর
একে অন্যের স্মৃতিতে ভরপুর

বন্দর এদের পথ
আর শ্রমিক এদের ক্যারাভান

সন্ধ্যায় গভীর জলে
যখন জাহাজীরা নামায় নোঙর
শহর নিজের আলো জ্বালে
দরজায় দাঁড়ানো নারীরা দেখা দেয়
কী আছে ওদের মনে
কেমন জমি
বালুর ওপরেও জল
আর বালুর নিচেও জল

সমুদ্রে কাজ করা মানুষেরা
যখন শহরে আসে
রাত শুরু হয়
এটা ছুটির হপ্তা
এক হপ্তার রাত শুরু হয়
সাত দিন শুধু রাত আর রাত
দুঃখ থাকবে কিন্তু খোলা থাকবে রেস্তরাঁ
মাঝরাতের পরেও সিনেমা দেখান হবে

গান গাওয়া হবে দলে দলে
নারীদের সঙ্গে সঙ্গে গাইবে পুরুষেরা
গানে বাচ্চারাও শামিল হবে
আর গৃহপালিত পশুগুলোও

জাহাজের নোঙর শুয়ে থাকবে জলে

আবার পরের হপ্তায় সমুদ্র, শুধু সমুদ্র থাকবে
কিন্তু এ হপ্তায় শহর, শুধু শহর।

নিজের কথা

কত দিন ধরে রাত
আসছে যাচ্ছে পৃথিবীতে
তবু তাকে দেখা
তার মধ্যে থাকা
এক অসামান্য কাজ মনে হয়

মানে আমি
নিজের কথা বলছি।


(‘দুনিয়া রোজ বনতি হ্যায়’ বইটির ছোটো কবিতা এখানে শেষ হল। এবার এদিকে পত্রিকায় মুদ্রিত কবিতা থেকে।)


দেখা

হঠাৎ তুমি চলে এস

এত রেলগাড়ি চলে ভারতে
যে কোনো সময়
যে কোনো জায়গা থেকে
তুমি আমার কাছে আসতে পারো

কিছুদিন থেকো এই ঘরে
যেটা ততটাই তোমার
গভীর পিপাসা রয়েছে তোমাকে দেখার
তোমাকে শোনার

কিছুদিন থেকো
যেন তুমি যাওনি কোথাও

আমার হাতে সময়
কম হয়ে চলেছে
আদরের বন্ধু আমার

মানুষজনে সঘন ভরা আমার দেশ
সন্ধ্যে হতেই
কত নারী আপন
ঘরে ফেরে
বহু বার সত্যিই মনে হয়
তুমি ওদেরই মাঝে কোথাও
আসছ
সেই রোগা শরীর
মিহি চেকের সুতি শাড়ি
কাঁধে ঝুলন্ত
ঝালর লাগানো ব্যাগ
পায়ে চটি
আমি বলি জুতো পরো খেলোয়াড়দের
ছুটোছুটিতে ভরসা করা যায়

তোমারও বেশি মন লাগবে নিজের কাজে
আমার সাথে একবার দেখা করে ফিরলে

সুখদুঃখ আসবে যাবে
সবকিছু পার্থিব এখানে
কিন্তু দেখা হওয়া পার্থিব নয়
দেখা হওয়ার সতেজতা
থাকবে এখানেই, হাওয়ায়!
দেখা হলে তৈরি হয় নতুন জায়গা
একবার আবার দেখা হওয়ার পরও
একবার আবার দেখা হওয়ার ইচ্ছে
শেষ হবে না কখনও পৃথিবীতে

চেন্নইয়ে কোকিল

চেন্নইয়ে কোকিল ডাকছে
যখন নাকি
মে মাস এসে গেছে
সমুদ্রের তীরে এই শহরে

কোকিল ডাকছে নিজের ডাক
কী হিন্দী
আর কী তামিল
তেমনই মিষ্টি ডাক
যেমন অওয়ধের আমবাগানে!

কোকিল
বাঁচিয়ে রাখছে সেই ঋতু
যে ঋতুর বিষয়ে আমরা
কম জানি কোকিলের চেয়ে!

বৃষ্টি

বৃষ্টি একটি পথ
নারীর কাছে যাওয়ার

ঝরতে থাকা জল
জীবিত ও মৃত মানুষদের
মাঝখানে বয়ে যায়

এক ধরণের রাত
বৃষ্টি

এত দীর্ঘ সময় পরেও
একটি সুদূর ও বহিরাগত বস্তু

শরীর থেকে বেশি
মাথা ভেজে

বহু বার এক হতে থাকে
ঘর ও বাহির!

বড় পশুরা
আষাঢে
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে
ভেজে অনেকক্ষণ
আকাশের নীচে জাগায়
আদিম দিনের কম্পন

বৃষ্টির শব্দে
মিশে রয়েছে আমারও কন্ঠস্বর!


প্রশ্ন বেশি

পুরোনো শহর
চায় উড়তে
কিন্তু ডানা তাদের 
আকচার ডোবে রক্তের কাদায়!

আমি আজও
ওই শহরগুলোর চৌরাস্তায়
কখনো বক্তৃতা দিই
যা আমার বহু বছর ধরে কাজ
কিন্তু আমার
নিজেরই কন্ঠস্বর এখন
অপরিচিত মনে হয়

নিজের ভিতরে আমি ঘেরাবন্দি হচ্ছি

প্রশ্ন বেশি
আর
কথা বলার লোক
কেউ কেউ
পরাজয়টা বড়, মানুষ হওয়ার
তবু এত স্বাভাবিক কেন জীবন?

রেশমা

রেশমা গান
আমাদের জাতিটাকে
কোনো একটি দেশকে নয়

যখন গান
গঙ্গা থেকে সিন্ধু অব্দি
ঢেউ ওঠে

কোথায় নিয়ে যান
কোন অসমাপ্ত
অসফল প্রেমাখ্যানের
বেদনায়

রেশমা জাগান
বহু শতাব্দী পিছনে ছেড়ে আসা শরীর
ধুলো থেকে
অশ্রু ও কুঁড়ি থেকে উঠিয়ে

এমন বিষাদ
ও দোটানায় ফেলেন
শূন্যতাও ভরে মনে

অনেক বার বুঝতেও পারি না
পিছনে ছেড়ে যেতে থাকে জগৎ
কিছু করে উঠতে পারি না

অনেক বার বাইরে নিয়ে যান
জাতি আর দেশগুলি থেকেও
আবার থেকে ভবঘুরে করতে চান নাকি
মানুষকে?

কার প্রয়োজন
রেশমার গাওয়া ওই
অশান্ত প্রেম!

আমি শুনি ওনাকে
বার বার

শুনি কি, বরং
ফিরি ওনার দিকে
বার বার
যেটা ওই একবারই
কিন্তু বদলে যেতে থাকে
তাঁর কন্ঠস্বর
ইষৎ আর্দ্র
কাছে ডাকেন

দূরে দূরে থাকা আমাদের!



No comments:

Post a Comment