রজত ফোনে এত জোরে কথা
বলে!
-
বুলানটার কী হয়েছে বল তো?
-
কেন?
-
বুলানের বিষয়ে তো আমার নিজের যা ধারণা ছিল… আর শুধু বুলানের
বিষয়ে কেন আমাদের সব বন্ধুদের বিষয়েই আমাদের নিজেদের একটা ধারণা তো ছিল যে যত
অধঃপতন হোক, যাকে বলে ‘চুড়ান্ত প্রতিক্রিয়াশীল’, তা আমরা কখনো হব না?”
-
‘চুড়ান্ত… প্রতিক্রিয়া…শীল’!
-
আরে, ওসব ‘প্রগতিশীল-প্রতিক্রিয়াশীল’ ব্যাপারগুলো কি
বুঝতাম? তবু বুঝতাম যে বয়স বাড়তে হাঃ হাঃ, শুধরাবার জায়গায় স্সালা হয়ত আরো অধঃপতন হবে –
হয়ত আরো চুটিয়ে মাল খাব, হয়ত স্টেশনগোলম্বর থেকে রাঁড় ওঠাব, হয়ত, হয়ত ঘুষফুষও
কামাব চাকরিতে, এ্যাঁ!… তারপর আরো বয়স বাড়তে চৈতন্যোদয় হবে, ধম্মকম্মে মন দেব…
কিন্তু… স্সালা মানুষের মধ্যে কখনো ‘মোছলমান, শুদ্দুর, ডোম, মেথর, খিরিস্তান’ এসব
করব না। তাই তো?”
আমি ফোনে মাথা নাড়লাম।
“তিলক, গেরুয়া, দাড়ি,
এলোকেশী, ব্যাপারীর গুরুদেব! দেখলে আজও (একটা অপশব্দ) জ্বলে যায়!”
এবার ফোনে মাথা না নেড়ে
আমি নিজেই যুগিয়ে দিলাম ওকে মুখের কথাটা, “সত্যি রজত! ভালো ধরিয়ে দিলি! মনে নেই
জাতপাত আর ধর্মের ভড়ং নিয়ে ঘেন্নাটা কেন এবং কী ভাবে তৈরি হয়েছিল। কিন্তু তুই ভালো
ধরিয়েছিস আমাদের বন্ধুদের আসল মিলটা। আর
তা যদি বলিস তো এসবে বোধহয় বুলানের একটা বড় ক্রেডিট ছিল!”
বস্তুতঃ আমাদের মধ্যে ওই
যাকে বলে ছিল মহাত্মা, বুলানকেই ওই টাইপের ছেলে বলে ঠাট্টা করতাম আমরা, নিজে পাঁকে
নেমে আমাদের হৃদয়ের পাঁকে পদ্মফুল ফোটাবে একদিন…! সাথে আছে অথচ সাথে নেই, মাঝে মধ্যে
দার্শনিকের মত বচন, “এ কী সবের মধ্যে দিনগুলো বর্বাদ করছি আমরা, বল্ তো!”
আর আজ এতদিন পর সেই
বুলানের বিষয়ে এমন কিছু খবরাখবর দিল রজত যে ওর বাড়ি যাওয়া স্থির হল। আর কেউ তো
শহরে নেই – শুধু আমি, রজত, অরুণ।
ফোনে রজত আবার যাচ্ছেতাই
করল বুলানকে, “…কেউ সালা ব্রিলিয়ান্ট ছেলে ছিলাম না আমরা। ‘লীক’ ছেড়ে বেরিয়ে
সমাজবদল শুরু করারও হিম্মৎ ছিলো না পোঁদে। ছাপোষা ছিলাম, ছাপোষা আছি। তবু একটা
স্ট্যান্ডার্ড তো ছিল!”
* * * *
বাড়িটা সদ্য রঙ করান তাই
রোদ্দুর খেলছে। বুলানের বাবা এটা কিনেছিলেন। তখন খাপরার চালা ছিল। পরে কড়িবর্গার
ছাত করে দোতলায় দুটো ঘর তোলা হয়।
এসব ওনারই
মুখে শোনা।
পূর্ববঙ্গে
নিজের দেশের সাথে উনিশশো আটত্রিশে সম্পর্ক ছিন্ন করার পর তাঁরা পাঁচ ভাই বিভিন্ন
শহরে ছড়িয়ে পড়েছিলেন। বুলানের বাবা এই শহরে শিক্ষকতার কাজ পেয়ে এসেছিলেন। তারপর
মায়ের কিছু গয়না আর বিয়ের সুত্রে পাওয়া কিছু মালকড়ি কাজে লাগিয়ে একটা পুরোনো
ট্রেড্ল, কয়েক সেট টাইপ ও প্রাথমিকভাবে জরুরি জিনিষপত্র কিনে প্রেসটা খুলেছিলেন।
বিভা প্রিন্টিং ওয়ার্ক্স। খুব ভালো ভাবে কখনো চলেনি প্রেসটা। কেননা ইষৎ নেশাখোর
হয়ে পড়েছিলেন ভদ্রলোক – প্রেসে রাত জাগতে জাগতে।
প্রেসটাকে পুনর্জীবন দিল বুলান। দিল মানে দিতে বাধ্য হল। তার
আগে অনেক চৈত্র-বৈশাখ।
তখন আমরা
এক এক করে চাকরিতে ঢুকছি। সন্ধ্যার ঠেক আগের মতই কাজলের দোকান। বুলানকে দেখতাম
দুপুর থেকেই বসে আছে। আমরা পৌঁছোলে লাগাতার দুটো সিগরেট আমাদের পয়সায় ফুঁকে
সারাদিনেরটা উশুল করত।
বুলানের বাবা, মা
বুলানের সাথেই থাকতেন। তিন দাদা, বাইরে থাকতেন। বুলান বলতো স্বার্থপর। “পয়সা আছে,
খরচ করে তিন বোনের বিয়ে দিয়েছে। মাঝে মধ্যে মুখে কর্ত্তব্য সারে – ফোনে বাবা মাকে
তাদের কাছে গিয়ে থাকার কথা বলে”। বাবা,
মাকে সাথে রাখবে বলে বুলান বাইরে চাকরীর খোঁজও করত না।
কিন্তু ছোটো মোটোও কিছু
না পেয়ে একদিন চলে গেল বিহারশরীফ। কোল্ড স্টোরেজে চাকরি। সপ্তাহান্তে আসা যাওয়া।… তিন
মাসের মাথায়, “কী রে?” … “দূর! পোষালো না!”…
তারপর ধৈর্যের সাথে
হোমিওপ্যাথি শিখল কিছুদিন। শিখে থিতু হয়ে বসল বাড়িতে। “আর চাকরীর খোঁজ নয়,
হোমিওপ্যাথি করব আর প্রেসটাকে দাঁড় করাব!”
এদিকে
আমরাও চাকরিসুত্রে এক এক করে এদিক ওদিক, হয় শহর পাল্টাচ্ছি নয় তো সংসারধর্মে জড়িয়ে
পড়ছি। কয়েক বছর আগে খবর পেয়েছিলাম বুলানও বিয়ে করেছে। মন্দিরে মালাবদল করে,
সাদামাটা বিয়ে। আমাদের নেমন্তন্ন করেছিলো। কিন্তু এমন হল সেদিন, কেউ যেতে পারলাম
না। পরে দু’একবার ওকে বলেছিলাম বাড়িতে একটা পার্টি দিতে। দেয় নি। অবশ্য আমাদের
বন্ধুদের মধ্যে যারা এখন বাইরে থাকে তারা যখন এসেছে একবার গিয়ে কর্তব্য সেরে
এসেছে।
রজতও গেছে
দুএকবার। যাওয়া হয় নি আমার আর অরুণের। শুনেছি গিরিডিতে শ্বশুরবাড়ি। গরীবঘরের মেয়ে।
নিজের পরিবারে জোর খাটিয়ে কোনোরকম অনুষ্ঠানহীন বিয়ে সেরেছে বুলান। আর বন্ধুমহলে
শাসিয়ে দিয়েছে যে আসবে, আসুক কিন্তু যেন উপহার নিয়ে না আসে। রজত বোধহয় একটা শাড়ি
নিয়ে গিয়েছিল, বন্ধুর নতুন বৌকে দিতে, তাও ফিরিয়ে দিয়েছে। চীজ বটে…
-
তুই তো দেখেছিস রজত, বুলানের বৌকে। কেমন? মানে, বুলানের
কনয্যুগাল লাইফে কোনোরকম টেনশন…
-
আরে দূর! খুব ভালো, মিশুকে মেয়েটি। আবার বুলানের থেকে বেশি
শিক্ষিতও। গিরিডিতে ইস্কুলে টিচার ছিল। বুলানটাই পাগ্লে গেছে, বিয়েটা কীভাবে করল
দেখলি না! যত প্রব্লেম ওর নিজেকে নিয়ে।
* * * *
রাস্তায় আসতে দু’জায়গায়
ল্যাম্পপোস্টে বাঁধা বোর্ড দেখেছিলাম – ‘ডা০ বিমান মিত্র’;
ইত্যাদি-ইত্যাদির নিচে তীরচিহ্ন।
সামনে প্রেস। পিছন ও
ওপরটা নিয়ে বাসস্থান। বাড়ির লাগোয়া কাঁচা জমির ওপর একইঁটের মেঝে ও গাঁথনি করে একটা
ঘর তোলা হয়েছে। এসবেস্টসের শেড। শুধু সামনের দেয়ালটুক চুনকাম। তাতে ঘষা কাচের একটা
জানলা আর প্লাইউডের একপাল্লা স্প্রিং লাগানো দরজা। দরজায় টাঙানো থার্মোমিটার
কম্পানির প্রচারে ‘ডক্টর ইজ ইন/আউট’ টায় ‘ইন’ করা আছে।
দরজায় ঠেলা দিয়ে দেখলাম
ঘর ফাঁকা। রজত ডাক ছাড়ল “বুলান!” কেউ সাড়া দিল না। প্রেসের দিকে এসে ভিতরে ঢুকে
দেখি মেশিন চলছে। চারজন কাজে ব্যস্ত। মেশিনম্যান ছাড়া বাকি তিনজনের মধ্যে দুজনকে
কর্মচারী মনে হল না। রঙ শুকোনোর জন্য ছড়িয়ে রাখা পোস্টারগুলো গুছিয়ে তুলছিল। ছোটো
ছোটো দোরঙা পোস্টার – একটা ব্লকছবি আর কাঠের টাইপ – ‘অযোধ্যায় রামমন্দির
নির্মাণার্থে মুক্ত হস্তে দান করুন’। হলুদ কাগজের ওপর মেরুনরঙা হিন্দি অক্ষরগুলো।
নিচে কালো রঙে সংগঠনের নাম।
অবশ্য কোনো সিদ্ধান্তে
পৌঁছোনো এখনও অব্দি অনুচিৎ। ব্যবসার দিকটাও তো আছে। বুলান বলে এভাবে ভাবছি নইলে
প্রতিটি শহরে গ্রামে এখন এধরণেরই পোস্টারের ছয়লাপ। ‘সশস্ত্রবাহিনীর প্রহরায় ‘রামশিলা’
নিয়ে মিছিল যাচ্ছে প্রতিদিন। দেয়ালে দেয়ালে যুদ্ধের ডাক।
একটি বাচ্চা ছেলে এগিয়ে
এল কে জানে কোনদিক থেকে। এতক্ষণ দেখতে পাই নি।
-
ডাক্তার সাহেব আছেন?
-
আজ তো রুগী দেখেন না!
-
আমরা ওনার বন্ধু। কোথায় উনি?
ছেলেটি প্রায় না যেতে
দেওয়ার ভঙ্গিতে “আপনারা অপেক্ষা করুন, আমি জিজ্ঞেস করে আসছি” বলে ভেতরে চলে গেল।
একটু পরেই ফিরে এসে বলল, “আসুন”।
সিঁড়িতে ওঠার মুখে
বাঁদিকে একটা ছোটো ঘর। বুলানের বাবার সময় থেকেই ওটা প্রেসের অফিস। দরজা ভিতর থেকে
আব্জানো। শিক দেওয়া ছোটো জানলা দিয়ে ভেতরে বসে থাকা তিনচারজনের মুখ দেখা গেল।
তিনজন মুখিয়া ধরণের লোক, ধুতি-কুর্তা পরে বসে। একজন বলিষ্ঠ জোয়ান, স্ট্রাইপের
শার্ট আর গলায় ছোটো রুদ্রাক্ষ/কাঁচপুঁতির মালা, কপালে সিঁদুরের টিপ, তাতে দু’তিনটে
চালের দানা লেগে আছে। দেখে খেয়াল হল গেটের বাইরে জীপের মত একটা বড় গাড়ি দাঁড়িয়ে
থাকতে দেখেছি। আমাদের সাথে চোখাচোখি হওয়ার আগে থেকেই লোকটা সানগ্লাস খুলে স্থির
দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকিয়েছিল।
ওপরে উঠতে উঠতে রজত
ইচ্ছে করে বেশ জোরে বললো, “কী বদল, দেখেছিস? শালা নির্ঘাৎ বসে আছে ওখানেই, তবু উঠে
এল না।
এরপর আর চুপ থাকা সম্ভব
ছিল না। বুলান ঘরের ভেতর থেকেই চেঁচিয়ে বললো, “আসছি রে, দশ মিনিটের মধ্যে। তোরা
বস্ না ওপরে গিয়ে। মা আছে। ছোড়দিও এসেছে।
* * * *
মেসোমশাই
চলচ্ছক্তিহীন – ঘরে নিজের বিছানায়। রত্নাদি মানে ছোড়দির বর কোথায় জানতে চাওয়ায়
জানা গেল বুলানের কান্ডকারখানা দেখে আর থাকতে চায়নি। এক সপ্তাহের ছুটি নিয়ে
এসেছিল, দুদিনের মাথায় চলে গেছে। পরে আবার এসে রত্নাদিকে নিয়ে যাবে।
-
কী, হয়েছিল কী?
নানান কথায় সে কথাটা আর
মাসীমার মুখে শোনা হয়ে উঠলো না। তার আগেই বুলান এসে গেল। “তোরা বসে কথা বল, আমি
যাই একটু চায়ের ব্যবস্থা করি” বলে মাসীমা চলে গেলেন।
-
কী রে? হঠাৎ? একেবারে দল বেঁধে?
অরুণ আক্ষেপ করে বললো,
“দলটাই তো রইলো না রে! সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফুল্ সংসারী জীব হয়ে গেলাম। এমন সংসারী যে
তোর সাথে আমার দেখা হচ্ছে সাত বছর পর। আর বোধহয় (আমার দিকে চোখ ঘোরালো) মিলনেরও।
কী রে, তাই তো?… তাই এলাম আজ।”
-
তাই এসেছিস? আমার সাথে দেখা করতে? (মুখে শ্লেষের একটা
স্মিতরেখা হেনে) সাত বছর পর?
রজত চশমাটা খুলে হাতে
নাচাতে লাগলো। উত্তেজিত হচ্ছিলো ভিতরে ভিতরে। গরগর করে উঠলো, “তুই ঠিক সন্দেহ
করেছিস। তোর সাথে দেখা করতে আজ আসিনি। এসেছি তোর পেছনে লাত মারতে। বহুদিন খাসনি
তো। খেলে মস্তিষ্কে এত অর্শ হত না।”
বুলানের মুখে একটা ছায়া।
তবু হাসতে হাসতেই বললো, “তোদের জন্য তো খোলাই ছিলো পেছনটা। এলেই পারতিস!”
“রত্নাদির বর চলে গেলেন
কেন রে?” জিজ্ঞেস করতেই বুলান ঘুরে ঝাম্টা দিলো মুখ, “তোরা কি আমার সাথে অভীদার
মেডিয়েটর?”
অরুণ জোর গলায় সবাইকে
চুপ করালো, “শোন্ শোন্ …কেউ কারো মেডিয়েটর নই। সোজা কথায় সোজা ভাবে আসা ভালো।
আমরা সবাই প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিক। জীবনে ছাপোষা গেরস্ত হয়ে কাটিয়ে দিলাম এতদিন। এখন
যদি আমাদের মধ্যে কারো কিছুটা রাজনীতি, সমাজসেবা ইত্যাদি করতে ইচ্ছে হয় তো সেটা তো
খুব ভালো জিনিষ! সে যদি আমাদের আর সবাইকেও এ ব্যাপারে এনথিউজ করতে পারে, ইনভল্ভ
করতে পারে তো আরো ভালো! কিন্তু, একটা মিনিমাম কালচারাল স্ট্যান্ডার্ড তো ছিল
আমাদের?”
রজত থামালো, “ওসব
কালচার-ফালচার ছাড়। এ্যাই বুলান, শোন! তুই আমাদের বন্ধুত্বের একটা প্যাক্ট তৈরি
করেছিলি মনে আছে?”
-
!!
-
(একবার আমার কাঁধের ওপর দিয়ে দেখে নিল ঘরে কেউ ঢুকছে কি না,
তারপর কন্ঠস্বর নিচু করে) মনে আছে, সে কুড়ি বছর আগে, তাপসের বাড়িতে… স্সালা সাত জনে
মাল খেয়ে নাঙ্গা হয়ে বসে নিজের নিজেরটায় হাত বোলাচ্ছি… আর তুই মহাত্মা ওই পোজেও আকাশবাণী!
ঝেড়ে চলেছিস আমাদের। ‘লাইফটা নিয়ে কিছু কর! কিছু কর!’… মনে আছে? তোর প্রপোজালে আমরা প্যাক্ট
করেছিলাম সেদিন যে আর যা কিছু করি, জাত আর ধর্মের ভেদ মানবো না!
-
(হাসতে হাসতে) মনে থাকবে না কেন, বস্? সে সব দিনের কথা কেউ
ভোলে?
আমি বললাম, “আর তুই তো
কম্যুনিজ্মের কথা বলতিস!”
বুলান মুখ না ঘুরিয়েই উত্তর
দিল, “হ্যাঁ, তাও বলতাম বটে।”
“তাহলে এটা কী করছিস?”
আমরা তিনজনে একসাথে গর্জে উঠলাম।
যেন কিচ্ছু বুঝতে পারছে
না এভাবে মুখটা ওপরে ওঠাল, “কী?”
-
স্সালা শেষ অব্দি দাঙ্গাবাজদের দলে নাম লেখালি? রুচিতে
বাধল না? কপালে তিলক কেটে ধর্মের ভড়ং করবি আর যত রকমের স্কাউন্ড্রেলদের নিয়ে আসবি
বাড়িতে? বসে পাড়ায় পাড়ায় অশান্তি বাধাবার ছক কষবি?
-
তুই বলে জাত মানিস না! ওরা তো মনুবাদী! ছুয়াছুতও মানে ওদের
নেতাগুলো।
-
তুই এতটা অধমে গেলি কী করে বল তো?
মাসীমা ভিতর থেকে ডাকলেন
বুলানকে। বুলান ট্রেতে চা আর বিস্কুট, চানাচুর নিয়ে ফিরে এল। অরুণ একটা সিগারেট
বাড়াল বুলানের দিকে।
-
ছেড়ে দিয়েছি।
রজত ফোড়ন কাটল, “হুম্...!
হিন্দুদের নৈতিক শক্তিতে বলবান হতে হবে তো! তার প্রথম পদক্ষেপ!
-
নাহয় তাই হল। নৈতিক শক্তিতে বলবান হওয়া কি খারাপ? আর সেই
সুবাদে যদি অভ্যেসটা, মানে বদভ্যেসটা ছেড়ে গিয়ে থাকে…
-
আচ্ছা ছাড়! বল এবার, কী করছিস এসব?
-
কী করবো! তোদের মত চাকরিবাকরি তো নেই! হোমিওপ্যাথিক
ডাক্তারি করছি, প্রেসটাকে চালু রাখার চেষ্টা করছি যাতে পরিবারের খাইখরচ মেটাতে
পারি। আ…আর কিছু পূণ্য অর্জন বা সেল্ফ স্যাটিস্ফ্যাকশনের কাজ করছি – দেশ দশের
চিন্তা করা, কল্যাণভাবনা – খারাপ?
রজত চশমাটা পরে
হিসহিসিয়ে ওঠে, “শালা তুমি খুব বড় দাঁওয়ের খেলোয়াড় হয়ে গেছ, তাই না? আমাদের
ধরাছোঁয়ার বাইরে? আমরা সব বোকাচো…” “এ্যাই চুপ!” দাবড়ালো অরুণ, “গালি না দিয়ে কথা
বলতে পারিস না?”
* * * *
বুলান হাসে
আর পা নাচায়।
দ্বিতীয়বারের
চা’টা রত্নাদি দিয়ে যায়। চুপচাপ চা খাওয়া হয়। আমরা বুঝে যাই বুলান কোনো সাফাই
নিজের রাজনীতির বিষয়ে দেবে না। হয়ত দিত। আলাদা করে বসে কথা বললে – আমি বা অরুণ।
আমাদের শুরুটাই ভুল হয়ে গেল। আসাটা বেকার হল বলতে গেলে। বেলা বাড়ছে। উঠে পড়ি।
গেটের কাছে
এসে বুলান ঘুরে দাঁড়ালো। ঠোঁটের কোণে হাসির রেখাটা এতক্ষণে একবারও কিন্তু তাচ্ছিল্যের
মনে হয় নি। যদিও পা নাচানোটা ছিল, উত্তেজনা চাপতে। এবার আরো শান্ত, বেলা একটার চড়া
রোদে মুখে বরং একটা সহৃদয়তার ছোঁয়া লাগলো।
“তোরা তো
এলি আর এলোপাথাড়ি ফায়ারিং করে গেলি। তিনটে জবাব শুনে যা। এক আমার ক্লিনিকে হিন্দু
রুগীও আসে মুসলমান রুগীও আসে। তোরা খবর নিয়ে দেখিস আমি কোনো বিভেদ রাখি কিনা
চিকিৎসায়। যদি আমার প্রেসে ‘বাবরি মসজিদ বাচাও’এর পোস্টার ছাপতে আসে তাও ছেপে দেব।
ব্যাবসাটা ব্যবসার মত করেই করবো। কেন না সংসারের খরচটা এ থেকেই জোগাড় করতে হবে
আমাকে। দুই, ছুয়াছুত, জাতপাত, অস্পৃশ্যতা এসব মানার কথা কী বললি কিছু বুঝলামও না।
খোঁজ নিয়ে দেখতে পারিস, আমার ওই রাজনৈতিক ‘কার্যভার’ বল, সেবার দায়িত্ব বল সব তো
মিউনিসিপ্যালিটির শ্রমিকদের মধ্যে, ওই মেথরদের ঘরে ঘরে গিয়েই কথা বলা, ওদেরই ঘরে
চা, নাস্তা, জল খেয়ে এগোনো! আর তিন, মুসলমান-বিদ্বেষী আমরা নই। এক ঐতিহাসিক জাতি
হিসেবে আমরা হিন্দুদের জাতীয় ঐক্যের জন্য কাজ করি আর তুষ্টিকরণ, তোষণের রাজনীতির
বিরোধ করি। এটা আমাদের দেশ। এতে সবার স্বাগত। কিন্তু এক যৌথ পরিবারের সদস্য হয়ে
থাকতে হবে। …যৌথ পরিবারে কর্ত্তা একজনই হয়! সবাই কর্ত্তা হওয়ার কুফল তো দেখছিস!
বাবা অথর্ব, মা সংসারের জোয়াল টানছে, দাদা-বৌদিরা নিজের নিজের গুছোচ্ছে, আমি
সাপ-লুডো খেলছি!…আমার অন্যায় আবদার যদি পরিবারের যিনি কর্ত্তা তিনি ক্রমাগত মানতে
থাকেন, পরিবার থাকবে? পরিবার যেমন ভাঙবে, দেশও ভাঙবে! …আর ডেমোক্র্যাসির পরিভাষায়
তোরাও তো বলিস, মাইনরিটি মাস্ট সাবমিট টু মেজরিটি!… তোরা পাড়ায় খবর নিয়ে দেখ আমরা
অশান্তি বাধাই, দাঙ্গাবাজি করি, না জলের সমস্যা, বিজলির সমস্যা, রাস্তা মেরামতের
সমস্যা, স্কুলবাড়ির সমস্যা আরো নানা রকম সমস্যার নিদানে দৌড়োদৌড়ি করি। রাস্তা
জামটামও করি! তাতে তোদের অসুবিধে হয়ে থাকলে অবশ্য কিছু করার নেই।… দুপুরের ভাতটা
খেয়ে গেলেই পারতিস!”
সামনের ‘জয়
মাতাদি’ স’মিল থেকে মেশিন-করাতের শব্দ আসছে। বিগত শিখবিরোধী দাঙ্গায় এটিতেও আগুন
ধরানো হয়েছিলো। অন্য অনেকের মত, ত্রিলোচন সিংও ব্যবসা ছেড়ে পালায় নি। চুলদাড়ি
কামিয়ে মোনাও হয় নি। সত্তর বছরের মত বয়স হবে। আজাদির তোহফা এক মারণযজ্ঞে পালিয়ে এই
শহরে এসেছিলো। এখন ফলাও কারবার। আবার পালিয়ে, যেতো কোথায়?
বুলানকে
বুঝবার ও বোঝাবার ব্যাপারে একটা চুড়ান্ত অসফলতার বোধ নিয়ে আমরা তিনজন মোড়ের দিকে
এগোই। বুলান পিছনে গেটের কাছে দাঁড়িয়ে একবার হাত নাড়ে, তারপর ভেতরে চলে যায়।
“চল সালা
আমরাও এবার একটু রাজনীতিটিতি করি” রজত গরগর করে ওঠে, “এদের দাঙ্গাবাজির ওষুধ মগজ- ধোলাই
নয়, আসল ধোলাই। তুই তো কিছু করতিস! না রে, অরুণ! স্টুডেন্ট পলিটিক্স! বল্ তো, কোন
পার্টিতে গেলে এগুলোর সাথে সোজাসুজি লড়াই হবে?”
-
ছ্যাবলামো করিস না তো! এতগুলো জ্ঞান দিল, জবাব দিলি না কেন
তখন?
-
হোঃ, বাবরির পোস্টার ফ্রিতে ছাপবে? যেমন রামমন্দিরের ছাপছে?
-
তুই জানলি কী করে? ফ্রি ছাপছে?
-
ওসব বোঝা যায় মিলন! ছাড় ও কথা, চল! এ্যাই অরুণ, নিজের স্কুটার
স্টার্ট কর! আমি মিলনকে বসিয়ে নিচ্ছি। বড় রাস্তায় গিয়ে আরো এক এক কাপ চা খেয়ে
তারপর আলাদা হওয়া যাবে। মেজাজটা খিঁচড়ে গেছে।…
* * * *
অভীদা আর রত্নাদির সাথে
একদিন দেখা হয়ে যায় স্টেশনে।
-
বুলান কেমন আছে রত্নাদি?
-
তুমি গেছ এদিকে ওর কাছে?
-
নাঃ, কাজেকর্মে ফেঁসে থাকি, প্রতি রোববারে ভাবি আজ যাবো, আর
যাওয়া হয়না।
-
গেলে বুঝবে। ডাক্তারি পড়ে গেছে, প্রেসের কাজও কমে গেছে। তার
ওপর খরচ বাড়ছে সংসারের। বাচ্চা হওয়ার পর সুবির কিছু কমপ্লিকেশন হয়েছিল…
-
সুবি কে?
-
ও মা! বুলানের বৌ, সুবীরা! ওর একটা বড় অপারেশন দাঁড়িয়ে থেকে
করিয়ে এলাম। বুলানের তো দেখাও পাওয়া যেত না। অবশ্য তুমি তো দেখও নি ওকে। তোমরা সেই
যে গিয়েছিলে একসাথে, তারপর তো যাওনি (আমি মাথা নাড়লাম), তখন বাপের বাড়ি গিয়েছিল।
অভীদা আমার কাঁধে হাত
রাখেন। “তোমার তাড়া নেই তো? আমাদের ট্রেন আসতে দেরী আছে। চলো, এক কাপ চা খেয়ে
আসি।”
রিফ্রেশমেন্ট রুমে বসে
নিজের ব্রীফকেসটা কোলের ওপর নিয়ে অভীদা কিছু খুঁজতে থাকেন।
-
তোমরা ওকে বোঝাও না কেন রত্নাদি? যে রাজনীতি করে লোকের গাড়ি
বাড়ি হচ্ছে, সে রাজনীতি করে ও সর্বস্ব খোয়াচ্ছে। তোমরা, দিদিরা স্নেহভরে কাছে টেনে
বকুনি দিলে ও বুঝবে নিশ্চয়ই।
-
দূর! এত মিথ্যে কথা বলে আজকাল। এদিকে তো বৌটাকেও মারধর শুরু
করেছিল!
-
বৌকে মারধর শুরু করেছিল?
অভীদা ব্রীফকেস থেকে মুখ
তোলেন। “হ্যাঁ, সেই ব্যাপারেই তো একটা জিনিষ দিতে চাইছি তোমাকে।” দুটো খাম আমার
দিকে বাড়িয়ে বলেন, “আমার ওপর ওর বিশেষ রাগ। কেননা ওর বৌকে আমি ওর সামনেই বলেছিলাম
যে যদি মারধর করে, মাথা নিচু করে সহ্য করবে না। বাপের বাড়িতে যেতে অসুবিধা বোধ
করলে আমাকে নিজের দাদা মনে করবে আর নির্দ্বিধায় চলে আসবে। গলগ্রহ হয়ে, আশ্রিতা হয়ে
থাকারও প্রয়োজন নেই। লেখাপড়া করা মেয়ে, কাজ খুঁজবে, পাবেও নিশ্চয়ই, নিজের রোজগারে
খাবে।”
-
তোমার ওভাবে বলা কিন্তু উচিৎ হয় নি। ছেড়ে চলে যাওয়াটাই সব
সময় শ্রেয় নয়। নিজের জায়গাটা করে নিতেও কি মেয়েদের কম দুর্ভোগ সহ্য করতে হয়?
খামদুটো খুলে দেখি দুটো
চিঠি আর ডাইরি বা নোটবুকের কিছু ছেঁড়া পাতা। চিঠি অভীদার উদ্দেশে। লেখিকা সুবীরা।
ছেঁড়া পাতার লেখাগুলো বুলানেরই মনে হল এক নজরে।
-
ঘাবড়িও না। প্রেমপত্র নয়। পড়ে নিও। বুলানকে জানতে সুবিধে
হবে। তবে ওকে কিছু বোলোনা যে এসব তুমি পড়েছো। বুঝতেই পারছো। ওগুলো নিজের কাছেই
রেখো।
* * * *
চিঠি – ১
পাটনা, তাং ৪।১২।১৯৮৮
শ্রদ্ধাস্পদেষু,
অভীদা,
আপনি ও ছোড়দি আমার প্রণাম নেবেন। আপনি আমাকে দাদার মত ভরসা দিয়েছিলেন তাই এই চিঠি
আপনাকে লিখছি। জানি, শুধু ও কেন, আরো অনেকের চোখে আপনাকে আমার এই চিঠি লেখা
দৃষ্টিকটু ঠেকবে। তবু না লিখে পারলাম না।
বিয়ের আগে
ও কেমন ছিল তা তো আমি জানি না, কিন্তু বিয়ের পরদিন থেকেই কিছু কিছু ব্যাপার দেখে
আমি বিচলিত হয়েছি। কিছু কথা আপনাকে বলা অশোভন। ছোটো বোনের কথা ভেবে ক্ষমা করে
দেবেন।
বিয়ের
হ্যাঙ্গাম শেষ হওয়ার দু’চারদিন পরেই এক দুপুরে আমায় বলল পালঙ্কটা উঠিয়ে দেবে। বলল
পালঙ্কে ঘুম হয় না। মায়ের বারণও শুনল না। ওই নতুন, বিয়ের পালঙ্ক খুলে সরিয়ে পুরোনো
একটা খাট বাইরে থেকে নিয়ে এসে পাতল। তারপর লক্ষ্য করলাম কিছুতেই জানলা খুলে ঘুমোতে
চায় না। এমনিতেও ওর ঘুম খুব পাতলা। জানলা খোলা থাকলে বা আলো জ্বললে ও চোখ বন্ধই
করতে পারে না।
যদিও মনে
হবে আমি আমার গয়নার লোভে বলছি, কিন্তু খুব খারাপ লাগল যখন গয়নাগুলো নিজের সাথে
জয়েন্ট লকারে না রেখে মায়ের নামে রাখল আর নমিনি করল আমাকে। এমনকি মা নিজেও যথেষ্ট
আপত্তি করলেন। ও জোর খাটিয়ে বলল এমনটাই নাকি হওয়া উচিৎ।
একদিন
রাত্রে নিজের হোমিওপ্যাথির একটা ছোটো বাক্সো ঘাঁটছিল। আমি পিছন থেকে এসে দাঁড়াতে ও
কেমন যেন অদ্ভুতভাবে চোখ তুলে আমার দিকে তাকাল। তারপর একটা শিশি হাতে তুলে ঘোরাতে
ঘোরাতে জিজ্ঞেস করল ‘বল তো ওটা কিসের ওষুধ?’ তারপর নিজেই বলল ওটা নাকি বিষ! আমি
শিউরে উঠে জিজ্ঞেস করলাম কী কাজে লাগে। বলল কিচ্ছু না। যদি কোনোদিন দরকার পড়ে তাই
রেখে দিয়েছে। কিসের দরকার জিজ্ঞেস করাতে কিছু বলল না। প্রশ্ন করলাম ‘ওটা আলাদা
রাখো না কেন?’ তো বলল, এটাই তার সজাগ থাকার পরীক্ষা! সব ওষুধের সঙ্গে মিশে থাকবে তবু
ভূল করেও হাত যাবে না। প্রশ্ন করলাম ‘যদি যায়?’ বলল, তাহলে ভূলের মাশুল গুনতে হবে।
আরেকটা
ব্যাপার। বলতে নোংরা লাগে তবু বলছি। বিয়ের পর বেশ কয়েক বার আমায় প্রশ্ন করেছিল যে
বিয়ের আগে আমার কারোর সাথে সম্পর্ক ছিল কি না। প্রথম প্রথম স্বাভাবিক কৌতুহল ভেবে
আমিও শর্ত দিতাম, ঠিক আছে, এটা করো, সেটা করো, বা নিজেরটা বল তবে বলব। কিন্তু অবাক
লাগত যে প্রশ্নটার উত্তর জানার বিশেষ ইচ্ছে ওর কখনো থাকত না। যেন ধরে বসে আছে যে
বিয়ের আগে আমার…
মাঝে মধ্যে
ও ডাইরি লিখত। যত্ন করে রাখা থাকলে আমি খুলে পড়তামও না। কিন্তু ডাইরিগুলো এমনিই
ফেলা ছিল এক কোণে, আবর্জনায়। তাই, ডাইরিগুলোর লেখা পাতাকয়টি ছিঁড়ে লুকিয়ে রেখে
দিয়েছিলাম নিজের কাছে। এদিকে যা শুরু করেছে ও! পাতাকয়টি আমার কাছে খুঁজে পেলে হয়ত
ক্ষেপে যাবে। এই চিঠির সাথে তাই আপনার কাছে পাঠিয়ে দিলাম।
কাল
সারারাত বাড়ি ফেরেনি। এখন দুপুরে, কিচ্ছু না খেয়ে ঘুমোচ্ছে। আমি রেগেই বলেছিলাম,
“তুমি না খেলে আমারও খাওয়া হয়না। আর তাতে অভুক্ত থাকে পেটের বাচ্চাটা। তুমি ওর
বাপ! ওর কথাটাও ভাববে না?” ব্যাস্ একটা চড় বসিয়ে দিল আমার গালে।
শেষ কথা।
একবার গিরিডি গিয়েছিলাম।
ওকে সঙ্গে নিয়ে আশে পাশে ঘুরতে বেরোলাম। আমার ভাইবোনেরাও সাথে ছিল। উস্রি ফল্সের
ধারে এক ভদ্রলোকের সাথে আলাপ হল।
এখন মনে হয়
সেটা আরো কাল হল। কথাচ্ছলে হাত দেখতে চাইলেন। আমার হাত দেখে বললেন আমার স্বামী খুব
বড় মানুষ হবেন। আমি বিশেষ পাত্তা দিলাম না। ওর হাতটা দেখে বললেন পাটনায় ওনার
যাওয়ার কথা আছে, গেলে ওর সাথে দেখা করবেন। আর সে দেখা যা হল…এখনো চলছে! আপনারা
নিজেরা এসেও অনেক কিছু দেখে গেছেন।
যবে থেকে
গিরিডির ওই ভদ্রলোক এ বাড়িতে ঢুকেছেন! আগে ও রামকৃষ্ণ মিশন টিশন যেত, পাড়ার পুজো
কমিটিতে থাকত। সব ছেড়েছুড়ে দিয়েছে, বড়লোকি কারবার বলে।
মা হয়ত
ভাবেন, আমিই ওকে আটকে রাখার যথেষ্ট চেষ্টা করি না। দম বন্ধ হয়ে আসে।
যা মনে এল
লিখলাম। ক্ষমা করবেন।
আপনার
ছোটো বোন
সুবীরা
চিঠি – ২
পাটনা, তাং ১২।৩।১৯৮৯
শ্রদ্ধাস্পদেষু,
অভীদা,
আমার প্রণাম নেবেন। ছোড়দিকে প্রণাম জানাবেন। আপনি এবার এখানে আসার আগে কয়েকটি ঘটনা
ঘটেছিল। একদিন সকালে উঠে স্নান করে আমাকে নিয়ে বসতে চাইল ঠাকুরঘরে। বলল গীতা পড়বে,
আমাকেও পড়তে হবে সঙ্গে। আমি ঠাকুরদেবতা মানি না তা তো নয়! মাঝে মধ্যেই মায়ের শরীর
খারাপ হলে পুজোটা আমিই দিই। সন্ধ্যে দেওয়াটা মা প্রথম থেকেই আমার ওপর ছেড়ে
দিয়েছেন। কিন্তু সকালে কাজ থাকে অনেক। তবু মা যখন ওকে খুশি করার জন্য আমায় বললেন
বসতে, বসলাম। দুদিন পর ভাইজী (ওই গিরিডির ভদ্রলোক) এলে আমি ওনাকেই খুলে বললাম আমার
অসুবিধার কথা। ওনার বোঝানোতেই বোধহয় পরদিন থেকে আমায় সাথে বসান বন্ধ করে দিল। কিন্তু
রাত্রে ঘরে এসে বলল আমার সাথে শোবে না। আমি কান্নাকাটিও করলাম। কিছুতেই শুনল না।
তারপর থেকে ও আলাদা মাটিতে বিছানা করে শোয়। আমিও তাই খাটে শুতে পারি না। মাটিতেই
অন্যদিকে শুই আর ঠান্ডা লেগে যায়।
তারপর তো
আপনারা এলেন। জানি না, আপনাকে পাঠান চিঠি বা ডাইরির পাতার ব্যপারটা কতটা কী বুঝতে
পেরেছে কিন্তু আপনার এগ্রেসিভ কথাবার্ত্তায় ও ভীষণ রেগে গেল। আপনি চলে যাওয়ার পরের
দিন রাত্তিরবেলায় ওর সাথে আমার বচসা হয়। আমি আপনার উদাহরণ শুধু ছোড়দির সাথে আপনার
বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বোঝাবার জন্য দিয়েছিলাম। তাতেই থাপ্পড় মেরে চুলের মুঠি ধরে
মাটিতে ফেলে দিল আমায়।
আজকাল
ডাক্তারিতেও মন দেয় না। বাড়িতে থাকেই না বলতে গেলে। প্রেসঘরে দিনরাত অদ্ভুত সব
লোকেদের আনাগোনা।
আর কী বলব?
বুঝি মানুষটা অসৎ নয় তাই যেন গোমরাতে থাকে ভিতরে ভিতরে। আমাকে না হোক, কাউকেও যদি
বন্ধু মনে করে মনের সমস্যাগুলো বলে একটু সহজ হয়ে উঠতে পারত!
ইতি,
সুবীরা
* * * *
ডায়েরির ছেঁড়াপাতা
১। কিছু
সুবিধেবাদী দালাল ইংরেজদের হাত থেকে পেল দেশটার শাসন। নিজেদের মধ্যে ভাগবাঁটোয়ারা
করে নিল। ছড়িয়ে দিল নানা ধরণের দুরাচার যাতে মানুষ ক্লীব হয়ে পড়ে।…
২। একটা
সুসমঞ্জস সংস্কৃতি ছিল আমাদের। মন্দিরের চুড়ো থেকে বটতলার গ্রামসভা অব্দি সব এক
সুত্রে বাঁধা। ইসলামী আক্রমণকারীরা প্রথম
এই গাঁথনিটাকে ভাঙল। নিজেরা রাজার জাত হিসেবে রইল। বাকি সবাই প্রজা। তারপর এল
ইংরেজরা। নতুন রাজার জাত। …যারা ধর্মান্তরিত হল, মুসলমান বা খ্রিশ্চান হল, তারাও
তো ওই রাজার জাতে উঠতেই গেল!… ইংরেজ লুটেপুটে চলে গেল। যাওয়ার সময় দেশটাকে ভেঙে
আরেক রাজার জাতকে তাদের হিস্যা দিয়ে দিল। আর আমাদের সুবিধেবাদী নতুন শাসকেরা এখানে
থেকে যাওয়া মুসলমানদের না নিজেদের দেশে যেতে দিল না মিশ খাওয়াল এদেশের সাথে। একটা
বিচ্ছিন্ন জাতিসত্ত্বা হিসেবে, গোষ্ঠিসত্ত্বা হিসেবে টিঁকিয়ে রাখল নানান বিশেষ
সুবিধার কথা বলে। কুড়ি কোটি মানুষের মধ্যে ষাট কোটি মানুষের ভয় আর নিরাপত্তাহীনতার
বোধ জিইয়ে রেখে নিজেদের সিংহাসন সুরক্ষিত করে রাখল।
৩। আর আমরা আরো
জঘন্য। আমরা সব ভুলে গেলাম। নিজেদের জাতিসত্ত্বা, ইতিহাস, সংস্কৃতি!
৪। রুশ! চীন!
নকল করে কী প্রগতিশীল হওয়া যায়? বিপ্লব করা যায়? আমাদের মত ক্লীবেরা কি চীনের
মানুষের মত লং মার্চ করবে? রুশের শ্রমিকের মত গৃহযুদ্ধ লড়বে?
৫। অথচ ওরা আজও
একটি বিচ্ছিন্ন জাতিসত্ত্বা হিসেবে বাস করছে আমাদের চারপাশে। ওরা নিজেদের দেশ পায়
ইরানে, ইরাকে, তুর্কিতে, লিবিয়ায়, প্যালেস্টাইনে, আফগানিস্তানে, লাগাতার একের পর
এক জাতিসত্ত্বার মুক্তিসংগ্রামে! আর আমরা? স্বেচ্ছায় নিজেদের দেশ হারাচ্ছি
প্রতিদিন!…… সেই অপহৃত আর অপচয়িত জাতিসত্ত্বা গড়ে তুলতে হবে আবার। ভারতবর্ষে সবাই
থাকবে। কিন্তু এটা কাদের দেশ বলতে এত দ্বিধা কেন?
৬। যুক্ত
পরিবার। সারা উঠোনভরা আত্মীয়স্বজনের হাসি, কথাবার্তা! কেন হারিয়ে যাচ্ছে? বড় নিজের
দায়িত্বপালনে গাফিলতি করছে। ছোটো ছোটোর মত থাকতে চাইছে না। পিতার যা ভূমিকা হওয়া
দরকার তা তিনি পালন করছেন না।
…হিন্দু একটা টোটেম! হিন্দু একটা ঐক্য! হিন্দু এ দেশের
স্বাতন্ত্রচেতনা!…
আজ কৈলাশ মেস্তরের বাড়ি
গিয়েছিলাম।
৭। কৈলাশ
মিউনিসিপ্যালিটিতে কাজ করেন। জাতে মেথর। তার মেয়েটার জ্বর চলছিল সাতদিন ধরে। আমার
কাছে এসে ওষুধ নিয়ে গিয়েছিল। ওষুধে কাজ হয়েছে। জ্বর নেমে গেছে। তাই আমন্ত্রণ
জানিয়েছিল বাড়িতে। বলতে সাহস পায়নি প্রথমে। ভাইজী বসেছিলেন। উনিই বললেন, “কী হে
কৈলাশ, ডাক্তারবাবুকে বাড়িতে ডেকে মিষ্টি খাওয়াবে না? ডাকো! উনি যাবেন। উনি
ছুয়াছুৎ মানেন না।”
একটা নতুন
অভিজ্ঞতা হল। নতুনভাবে দেখতে শিখলাম অনেককিছু। আজ থেকে দশ বছর আগে এর বিশিষ্ট
পরিচয়টা মাথাতেই ঢুকত না। হয়ত শুরু করে দিতাম লাল বই, চীন, রুশ, ভিয়েৎনাম,
শ্রমিককৃষক, শ্রেণীসংগ্রাম! কিন্তু ওই মানুষটি! ওই যে রেললাইনের ধারে সার সার
দেড়শো খানেক, তালপাতায় ছাওয়া মাটির ঘরের মধ্যে একটিতে নিজের স্ত্রীপুত্রকন্যাসহ
নিজের স্বাতন্ত্র্য নিয়ে রয়েছে! নেম-প্লেট নেই তার আস্তানার দরজায়। তবু আমাদের বাড়িঘরদোর
থেকে অনেক বেশি আত্মপরিচয়সম্পন্ন ওই পাতায় ছাওয়া আস্তানা। অনেক বেশি
‘জৈবসাংস্কৃতিক’! ঐ একচিলতে ঘরেই তার ঠাকুরের ছবি, তার ধ্যান, তার ছন্দপাঠ।
হিন্দুত্বের ওপর হিন্দুদেরই করা হাজার বছরের আঘাত-অপমান সয়েও তার স্বনিষ্ঠ
ছন্দপাঠ, তার আতিথেয়তা, তার শ্রদ্ধা, তার লাউমাচা, তার বৌয়ের, ঘটি থেকে গড়িয়ে
দেওয়া জল, আমাদের হাত ধোওয়ার জন্য। ভারতবর্ষের সত্য অনেক বেশি আবহমান কৈলাশ
মেস্তরের পরিবারে।
৮। ভাইজী বলছেন
সদস্যতা নিয়ে নিতে। কাজ করতে পুরোদমে। আমারও মন বলছে এটা আমার কাজ। দেরি করলে খুব
বেশি দেরি না হয়ে যায়। বিষের শিশি ভূল না করে দেয় হিসেব।
৯। ভাইজীর সাথে
একটা ব্যাপারে আমার মতপার্থক্য হয়। উনি বলেন কম্যুনিজ্ম আমাদের কাজের সবচেয়ে বড়
শত্রু। কেননা ওরা ধর্মবিরোধী। ভগবানকে নিয়ে ঠাট্টা করে। বলে ধর্ম হল আফিং। এসব কথা
আমিও জানি। তবে আমার মনে হয় ওরা মূর্খ, অন্ধ!…
তবে এটাও
ঠিক যে কৈলাশ মেস্তরকে যখন ওরা নিজেদের দলে ভিড়িয়ে নিল, রাগে পা থেকে মাথা অব্দি
জ্বলে উঠেছিল ওই কুকুরের বাচ্চা, ওদের লিডার সহদেওএর ওপর। কৈলাশের ঘরে গিয়েছিলাম।
দেখলাম ইতস্ততঃ করছে বসতে। ওদের মিটিং চলছিল স্ট্রাইক নিয়ে। বোঝালাম আমাদের
ইউনিয়নও স্ট্রাইকে আছে। মাথা নিচু করে শুনে গেল। আপ্যায়ন যদিও আগের মতই ছিল তবু
একটিবার মনে হল যদি পুলিশ ঝাঁপিয়ে পড়ে ভেঙে দিত ওদের মিটিং – খুশি হতাম। হেঁকড়ি
ভুলে যেত ওরা।… হয়ত ভাইজির কথাই ঠিক।
* * * *
পড়া শেষ
হল। কারো মুখে কোনো কথা সরল না। ‘কারো’ মানে অরুণ, রজত আর রজতের বৌ শিপ্রা।
চিঠিদুটো
আর ডাইরির পাতাগুলো আমিই পড়ছিলাম জোরে জোরে, যাতে সবাই শুনতে পায়। শিপ্রা অবশ্য
পুরোটা শোনেনি। মাঝে চা করতে উঠে গিয়েছিল।
রজতরা সদ্য
ভাড়া নিয়েছে এই ফ্ল্যাটটা। ফ্ল্যাট বলতে গ্যারেজের ওপর মেজ্জানাইনে এক ঘরের ইউনিট।
কিন্তু বেশ ছিমছাম। এমনকি এক ফালি ব্যালকনিও করা আছে।
ব্যালকনির
সাদা রেলিঙে প্রতিফলিত হচ্ছিল বাইরে রাস্তায় জ্বলে ওঠা আলো। মার্কারিভেপার। ভেপারটার
সামনে কোনো গাছের ডালপালা আছে নিশ্চয়ই – আলোটা কাঁপছে। রাস্তার ওপারের জানলা থেকে
এক মহিলা নিচের ফুচকা- ওয়ালাকে ডাকছিলেন।
এতদিন এই
চিঠি আর ডাইরি আমার কাছেই পড়েছিল। অরুণ, রজতকে বলেছিলাম বহুবার, ওরা গা করে নি।
মাঝে মধ্যে ফোনে রজত মস্করা করত, “বুলানের রাজনীতি তো দেশ ছেয়ে ফেলল রে! আজকের
পেপার দেখেছিস? অযোধ্যায় চার লক্ষ কারসেবক! কী হবে বল তো? বুলানও আছে নাকি ওদের
মধ্যে?… স্সালা এই ঘোলাজলে নিজের মন্ত্রীটন্ত্রী হওয়ার একটা জায়গা করতে পারল না
আহাম্মকটা। আজ বাদে কাল তো সরকার হবেই এদের। এই দ্যাখ, শিপ্রা আমাকেই ঝাড়ছে। বলছে
আমি নাকি নির্লজ্জ! এত সিরিয়াস একটা ব্যাপার নিয়ে মস্করা করছি?”
আজ সকালে একটা খবর পেয়ে
তিনজনেই দৌড়েছিলাম হাসপাতালে। যখন রজত বলল দুপুরের খাওয়ার ব্যবস্থাটা ও করবে
বাড়িতে, তখন বললাম, “তাহলে আজ ওগুলোও শুনে নে আজ। আর কবে শুনবি?”
শেষে রজতই মুখ খুলল থ’ মারার
মত করে।
-
এ যে বিদ্বান মানুষ রে ভাই! কী বাংলা লিখেছে!
সাহিত্যটাহিত্য করে নাকি? ‘অপচয়িত’! আমি তো মানেও জানি না। শিপ্রা জানতে পারে।
শিপ্রা চা ঢালতে ঢালতে
প্রশ্ন করল, “সুবীরা ভালো আছে এখন?” গলাটা একটু ধরা মনে হল।
“না!” অন্যমনস্ক ভাবে
উত্তর দিল অরুণ, “এখনো জ্ঞান ফেরেনি।”
-
সত্যিই সিঁড়ির মুখে ওকে ধাক্কা দিয়েছিল ওর বর? মানে আপনাদের
বুলান?
-
সত্যিমিথ্যে কে জানবে? যতক্ষণ না…
No comments:
Post a Comment