১৯৭২ সালে ইগনাস মানে ইগনাস কিস্কু শহরের মিশনারি হাসপাতালটায় কাজ করত। একাউন্টস সেকশনে চাপরাশির কাজ। পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি লম্বা মানুষটির বয়স ছিল প্রায় বত্রিশ বছর। পাঁচ বছর ধরে কাজ করছে। কিছুদিন হল তার বৌ মারিয়াও কাজ পেয়েছে, লিনেন ডিপার্টমেন্টে। দুজনে হাসপাতাল থেকে একটু দূরে জুতো কারখানার উল্টো দিকের রাস্তাটায় থাকে। হাসপাতালের আরো অনেক কর্মচারি আছে ওখানে। বস্তিটায় বেশির ভাগ খৃস্টান, সামনে মিশনারি স্কুল এবং একটা চার্চ। শহরের কিনারে এই এলাকাটা।
প্রতিদিন সকাল সাড়ে সাতটায় ইগনাস স্নান আর জলখাবার সেরে
নদীর পাশের রাস্তা ধরে হাঁটা দেয় হাসপাতালের দিকে। একটা সাইকেল কিনেছিল। কিছুদিন
আগে, রোববারে সিনেমা দেখতে গিয়ে চুরি হয়ে গেছে।
“খুব ভালো হয়েছে” বৌ টিটকিরি দেয়, “একা একা গিয়ে সিনেমা দেখে আসার রোগটা ছেড়েছে। কখনো শুনিনি যে কেউ ঘরে বৌকে রেখে,
ঘুরে আসার নাম করে বেরোয় আর সিনেমা দেখে আসে!”
- সে তো অনেকে বৌকে লুকিয়ে বন্ধুর বাড়ি গিয়ে মদ খেয়ে আসে, আমি যাই?
- এবার তাও যাবি।
- হ্যাহ্, মদ খাইনা আমি। ও একটা অভ্যেস রয়ে গেছে সিনেমা দেখার। সেসব সিনেমা
আবার তুই দেখতেও চাস না।
- হ্যাঁ, মার-ধাড়, রোমান্স অওর সেক্স সে ভরপূর ...
- ভ্যাট্, শুধু ওই এ্যাকশন ফিল্মগুলো দেখতে ভালো লাগে, ইংরেজি ...
- ওতেই তো ওই সবও থাকে!
- থাকে, তবে আমি ওসব দেখিনা।
- না, চোখ বুজে বৌকে ওই জায়গায় ভেবে নিই।
- থামবি?
ইগনাসের গলায় রাগের থেকে বেশি উগ্র বাসনা ফুটে ওঠে বৌকে
জাপটে ধরার। সাত সকালে অনেক কাজ এখন। ডিউটিতেও যেতে হবে। মারিয়া চুপ করে যায়।
অশোকে ম্যাটিনি শোয়ে ছিলো শন কনেরির গোল্ডফিঙ্গার; দ্বিতীয়
বার এসেছিল। টিকিট কাউন্টারের অদূরে দেয়ালে ভর দিয়ে রাখা ছিল সাইকেলটা। নজরও রাখছিল
ইগনাস। ভেবেছিল টিকিটটা কেটে তারপর স্ট্যান্ডে ঢোকাবে। অন্য কেউও যে নজর রাখছে,
সেটা ভাবেনি। গেল।
এখন পয়সা জমাচ্ছে আরেকটা কিনবার। চাইলে প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে
ধার পেত, কিন্তু ইচ্ছে নেই। এই ভালো, সে ভাবে। খরচ করার ইচ্ছেটার রাশ টেনে রাখা
যায় আর সেটা বাইরের চাপে নয়, নিজের ইচ্ছের জোরে হয়। বাইরের চাপের ওপর নির্ভরশীল হওয়া
উচিৎ নয়, নিজের ইচ্ছের জোর বাড়ানো উচিৎ, ... । আর তাতে হাঁটাটাও হয়ে যায়, শরীর মন ভালো
থাকে – ইগনাস নিজের অজান্তেই আরো জোরে পা চালিয়ে দেয়
হাসপাতালের দিকে।
মারিয়া আলাদা আসে। আরো কয়েকজন মহিলা কর্মচারির সাথে। ওরাও
হেঁটেই আসে। সারাদিন কাজের সময়ে মারিয়া আর ইগনাসের দেখা হয় তিনবার। দু’বার বেলা দশটার আর বিকেল তিনটের চা খাওয়ার সময়। আর একবার
দুপুরের খাবার খাওয়ার সময়। দুবেলার চা টা ক্যান্টিনে খেলেও, দুপুরের খাবারটা সাধারণতঃ
মারিয়া নিয়ে আসে। ক্যান্টিনের খাবারটাও সস্তাই পড়ে। বা, হয়ত একই পড়ে, সকালে উঠে যে
পরিশ্রমটা করতে হয় সেটা ধরলে। হয়তো একটু কমানোও যায় শাকসব্জিতে। কিন্তু, আসল স্বার্থ
একসাথে বসে খাওয়া। ক্যন্টিনে তো পুরুষ আর নারীদের বসার ঘর আলাদা। নিজের খাবার হলে
বাইরে ঘাসের ওপর বা একটু কিনারে ছায়ায় গিয়ে বসে একসাথে খাওয়া যায়, দুটো কথা বলা যায়।
হোক না ঠান্ডা রুটিসব্জি, এই পাওয়াটা অনেক বেশি।
এক স্বচ্ছ নীল আশ্বিনের সকালে হাসপাতালে আসছিল ইগনাস।
মারিয়ার পেট ফুলে ওঠাটা এখন বাইরে থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় ... ইগনাসের মনচোখে ভাসছিল।
বিয়ের প্রায় চার বছর পর ওদের সন্তান-সম্ভাবনা। তবে তার জন্য মানত টানত বিশেষ কিছু
করেনি। প্রথম প্রথম তো ভালোই লাগতো ইগনাসের – রাতের পর রাত চুটিয়ে পাওয়া সুখ! কি দরকার এখন ঝঞ্ঝাটের! তারপর
একদিন...।
বাবা হওয়ার অধৈর্য, সুখ, ভয়, আশঙ্কা এসবের থেকে, ইগনাস অনুভব
করছে, আশ্চর্য ভাবটাই হয় বেশি। কী ওই জীবটা? ওরই জোয়ান রক্তে তার বীজ লুকিয়ে ছিল? কিছু স্বর্গীয় রাতের
প্রহর! মারিয়ার পুষ্ট, কালো, উথলানো দেহ! সারা শরীর ঝনঝনানো সুখের মাঝে ইগনাসের শরীর
থেকে ওই বীজের মারিয়ার ভিতরে চলে যাওয়া! আর মারিয়ার নিজের রক্তে, রসে, সেই বীজের অঙ্কুরিত
হওয়া! ধীরে ধীরে মানুষের শরীরের রূপ গ্রহণ করা! মাথা, গলা, বুক, পেট, হাত, পা...চোখ,
কান, নাক, ঠোঁট ...! ... কেমন অদ্ভুত লাগে না, ইশ্বরের সৃষ্টি? দুজনেরই ওই
ইন্দ্রিয়ের ভিতরেই আবার দুটো পথ! একটা ত্যাজ্য বেরিয়ে আসার আর একটা একে অন্যকে
গ্রহণের! শরীরের সাথে শরীর, মনের সাথে মন যখন হয়, একে অন্যের ভিতরে কতদূর যায়?
ওইটুকুই? যতটা ইন্দ্রিয় যায়? না সমস্ত রোমকুপ দিয়ে যায়? ঘামের নুনে মাখামাখি হতে হতে
...
এই সাতসকালে ইগনাসের গা গরম হয়ে ওঠে।
মাথা ঝাঁকিয়ে ও চলার গতি বাড়িয়ে দেয়। মনে পড়ে খুব ছোটোবেলায় খারাপ কথা মনে এলে মা
বুকে ক্রুশচিহ্ন এঁকে নিতে বলত। কিন্তু ওর, প্রথমতঃ তো মনেই থাকে না। দ্বিতীয়তঃ,
যদি বা মনে থাকে তবু, এক রাস্তা লোকের মাঝে কথা নেই বার্তা নেই হঠাৎ আঙুল উঠিয়ে ক্রুশচিহ্ন এঁকে নেওয়া – কেমন যেন লজ্জা করে আর তাছাড়া, ক্রুশচিহ্ন আঁকলেই লোকে হয়ত
সন্দেহ করবে ও খারাপ কথা ভাবছিল! আর তৃতীয়তঃ, কোনটা ভালো আর কোনটা খারাপ, সেটাই তো
সে ঠিক করে উঠতে পারে না। সাতসকালে নিজের বৌটাকে পাওয়ার ইচ্ছে কি খারাপ?
সিস্টার থেরেসের মুখে যেন কিছু আটকায় না। লোকে বলে উনি আদ্ধেক
ইংরেজ, আদ্ধেক বার্মীজ। লড়াইয়ে লড়াইয়ে কাটিয়েছেন অনেক দিন। ওই দশাসই ছয়-ফুট্টা চেহারা।
মাথাটা নামিয়ে ইগনাসের মুখের কাছে এনে বলেন, “ইস্স, লিনেনে কাজ পাওয়া গেলে কি ভালো হত, না? একটু আড়াল পেলেই...”।
“ধ্যাৎ”, বলে ইগনাস লাজুক মুখে পাশে সরে যায়। সিস্টার তবুও ছাড়েন না, “মনে রেখো, মারিয়াকেও বলে দিয়েছি, ইফ আ বয় দেন ইটস জয়, ইফ আ
গার্ল দেন ইটস পার্ল!”
ইগনাস বিড়ির শেষটা ফেলে, পা দিয়ে চেপে নিভিয়ে হাসপাতালের
গেটের ভিতরে ঢুকল। বাঁদিকের শেড দেওয়া জায়গাটায় মেয়েপুরুষের দল কে দল বসে আছে।
একটা দল কাঁদছে। কেউ মারা গেছে – ওদের স্বজন। এবার ইগনাস ক্রুশচিহ্ন এঁকে নেয়, ভোলে না। যিশুর মুখটা মনে করতে ভালো
লাগে। খুব ভালো লাগে এরকম অপরিচিত অদেখা কারো আত্মার জন্য শান্তির প্রার্থনা করতে।
যারা বেঁচে রইল তাদের মনে যেন মৃতকের জীবনের স্মৃতি সুখের স্মৃতি হয়, ভালো স্মৃতি
হয় – ইগনাস এমন একটা প্রার্থনা নিজে থেকেই তৈরি
করে নিয়েছে। প্রতিদিন হাসপাতালে ঢুকতেই বা সারাদিনে অনেকবার এরকম দৃশ্যের সম্মুখীন
হতেই হয়। আর প্রতিবার ইগনাস ওই প্রার্থনাটা মনে মনে আওড়ায়।
গেটের ডানদিকে সাইকেলের শেড। রামজীবন সামনে কাগজের টিকিট আর
খুচরো নিয়ে বসে আছে। ভিতরে এডওয়ার্ড ও অনিলকে দেখল ইগনাস। সাইকেল রাখছে। দুজনেই
একাউন্টস সেকশনের কেরানি। না, ভুল হল। একজন একাউন্টস। একজন মেডিক্যাল রেকর্ডস।
গতবার এডমিনিস্ট্রেটরদের মিটিংএ দিল্লি থেকে আসা সিস্টার এগনেসের পোস্ট নিয়ে ঝগড়া
হওয়ার পর মেডিক্যাল রেকর্ডস আলাদা করে দেওয়া হয়েছে। ইনচার্জ সিস্টার এগনেস। আর
একাউন্টস মিস্টার ব্যানার্জির হাতে।
ঝানু লোক মিঃ ব্যানার্জি। রেষারেষি আর ঝগড়ার মাঝে নিজের খাতির
বাঁচিয়ে দিব্যি টিঁকে আছেন। নতুন নতুন যারা আসে তারা মিঃ ব্যানার্জির কথার জালে জড়িয়ে
পড়ে। কথাবার্তা, ঘরের কুশল প্রশ্ন, এখানকার রেষারেষির ব্যাপারেও দু’একটা চুটকি গোপন কিছু বলার মত করে বলে বুঝিয়ে দেন যে তিনি
ওকে নিজের লোক মনে করছেন। ডিসিপ্লিনের আগল খুব বেশি শক্ত করে তারপর মাঝে ঢিল দিয়ে
বোঝানো যে সব তাঁরই হাতে, তিনিই সর্বেসর্বা। সামনের জন নিজের লোক তাই তার জন্য করছেন
সবার জন্য করেন না। চীফ এডমিনিস্ট্রেটর আর সিস্টার এগনেসের সঙ্গে মিস্টার ব্যানার্জির
ঠান্ডা লড়াই। তাই নতুন কেরানি এলেই মিস্টার ব্যানার্জি বোঝার চেষ্টা করেন কী ধরণের
লোক।
অবশ্য এসব
কেরানিদের কথা। ইগনাসের এতে বিশেষ কিছু আসে যায় না।
দেবদারু গাছের নিচে নিচে আরো অনেক রুগির সাথে আসা লোকজনেরা
বসে আছে। তারপর সদর দরজার সামনের চত্বরটা। ডানদিকে রক্তদাতাদের লাইন। বেশির ভাগই মুটে,
মজুর, রিক্সাওয়ালা। এক বোতল রক্ত বেচলে ঘরে চাল আসবে...।
লাইনের আগেই শেষ দেবদারু গাছটার নিচে অনুপমবাবু দাঁড়িয়েছিলেন।
নতুন কেরানি। সিগরেট খাচ্ছিলেন। বললেন, “এ্যালোয়শিয়াস ফিডেলিসের সাথে দেখা হয়েছে?”
-
মানে অনিলবাবু তো?
-
হ্যাঁ, অনিল।
-
এই তো দেখলাম সাইকেলস্ট্যান্ডে।
-
কিছু বলেনি তোমায়?
-
না তো, আর বলবেনই বা কী করে? আমি তো
আর সাইকেলস্ট্যান্ডে ঢুকিনি। বাইরে থেকে দেখলাম সাইকেলে তালা লাগাচ্ছেন। উনি তো দেখেনই
নি আমাকে।
-
ওঃ, আচ্ছা, পরে একবার দেখা করে নিও।
-
কেন?
-
বলছি তো, দেখা করে নিও। কিছু কথা
বলবেন।
এখানে বেশির ভাগ ক্রিশ্চান কর্মচারির দুটো করে নাম আছে।
একটা ক্রিশ্চান নাম আর একটা হিন্দু নাম। তারা বেশির ভাগ আবার বেতিয়ার দিকের লোক।
ইগনাসেরও ছিল নাকি? অন্য কোনো নাম? কে জানে! বাপ-মা বেঁচে থাকলে বলত। অথবা দেবীমামা,
যার হাত ধরে সেই সাত বছর বয়সে গ্রাম ছেড়ে এখানে চলে এসেছিল। সে মামাও আর নেই।
হাসপাতালে কাজ পাওয়ার আগে অব্দি ছুটকো ছাটকা কাজ করে বড় হয়েছে। সাত ক্লাসের পর আর
পড়াও হয়নি।
কথা মানে নিশ্চয়ই জব্বর কথা। ভাবল চা-নাস্তা খাওয়ার সময় ক্যান্টিনে
অনিলবাবুর সঙ্গে দেখা করবে। তার আগে অনিলই ওকে পাকড়াও করল, “চল, ইগনাস, পান খাওয়াও”। বলে নিয়ে গেল মেন গেটের বাইরে পানের দোকানে।
-
কেমন পান খাবে, বলো! জর্দা না মিষ্টি?
-
আমি তো খাই না।
-
ও, না, বেশি বিড়ি সিগরেট খেতে হবে না, লজেন্স খাও একটা।
পকেট থেকে বার করছেন দেখে ইগনাস অবাক হয়ে তাকালো।
-
আরে, ব্রাদার জন দিয়েছিলেন সকালে।
ব্রাদার জনকে সবাই চেনে। দেখতে ইংরেজের মত। অস্ট্রেলিয়ান।
বড় কোনো দুর্ঘটনার পর চিকিৎসা করাতে আনা হয়েছিল এখানে। সেরে উঠলেন, কিন্তু শরীর আদ্ধেক
অকেজো রয়ে গেল। এখানেই রয়ে গেলেন। হুইলচেয়ারে ঘোরেন। নানারকমের কাজে সাহায্য করেন।
আর দেখা হলেই মিষ্টি হেসে ‘হেলো’ বলে পকেট থেকে একটা লজেন্স বার করে এগিয়ে
দেন।
নিজের পানটা মুখে ফেলে অনিলবাবু আড়ালে ডেকে বললেন, “কাল চলো না, একটু ময়দানের দিকে যাব ডিউটির পর। আমার সাইকেলেই
নিয়ে যাব।”
-
ময়দান! অত দূরে! কী ব্যাপার?
-
চলোই না, এক সাথে আমরা একটু চা,
সিঙাড়া খাব! একটু ঘুরব। কিছু কথাও বলব।
মারিয়াকে বলে দিয়েছিল দেরি করে ফিরবে আজকে। অনিলবাবুর
সাইকেলে বসে ময়দানে গিয়ে ইগনাস দেখল, হোলি মাদার! এ তো সবাই বসে আছে! সবাই মানে,
পুরো একাউন্টস সেকশন, মেডিক্যাল রেকর্ডস, ওপিডি আর ফার্মেসির কেরানি, খাজাঞ্চি আর
টাইপিস্টরা। তার সাথে ইগনাসের মত ওই সব ডিপার্টমেন্টের চার পাঁচজন চাপরাশি। শুধু
পি.কে.সিনহা নেই, ও আজকে আসেনি। এ্যাডমিনিস্ট্রেশন সেকশনের টাইপিস্ট এব্রাহাম গান
গাইছিল। কি সুন্দর গলা! “ক্যয়সী হসীন
রাত বহারোঁ কী রাত হ্যয়, ইক চাঁদ আসমাঁ পে হ্যয় অওর ইক মেরে পাস হ্যয়...”
কথা হল, ইউনিয়ন তৈরি করতে হবে। শান্ত ভাবে পুরো কথাটা লুডউইগ
সাহেব রাখলেন। ভিক্টরসাহেব কিছু সন্দেহ প্রকাশ করলেন। তাতে এ্যালোয়শিয়াস উত্তেজিত
হয়ে উঠেছিল। লুডউইগ তাকে শান্ত করলেন। রায়চৌধুরিবাবুও শান্ত করলেন। কমলেশ আর বাকি
টাইপিস্টরা শুধু শুনল। একটা ছোটো কমিটি তৈরি হল তিনজনের। তারা গিয়ে খোঁজখবর নেবে, সরকারি
হাসপাতালের কর্মচারিদের সাথে কথা বলবে আর পাশেই তো একটা বড় কেন্দ্রীয় শ্রমিক সংগঠনের
দপ্তর। তার লোকজনেরা মাঝে মধ্যে হাসপাতালে আসেন। তাদেরও জিজ্ঞেস করবে। এটাই তো শুনে
কেউ বিশ্বাস করবে না যে এত বড় হাসপাতালে এখনও অব্দি কোনো ইউনিয়ন নেই! নার্সদেরও
নেই। এ.এন.এম.দেরও নেই। পুরো হাসপাতালটা এ্যাডমিনিস্ট্রেটর
আর ইনচার্জদের ইচ্ছে মত চলছে। যার কাজ ভালো লাগল না সরিয়ে দিল। এরকম চলতে পারে?
ওরা তৈরি
করতে পারলে তবে হয়ত নার্সদের ভরসা হবে।
পরের দিন অফিসে আসতেই শুনল ইগনাস যে এ্যালোয়শিয়াস ফিডেলিস,
মানে অনিলকে সাসপেন্ড করে দেওয়া হয়েছে। দোষ? সিস্টার এ্যাগনেসের কথার অবাধ্যতা।
যদিও সবাই বুঝছে যে কালকের মিটিংএর খবরটা জানাজানি হয়ে গেছে।
দুপুরে ক্যান্টিনের পাশের জায়গাটায়, ছায়া দেখে ঘাসের ওপর বসে
মারিয়া টিফিন বাক্সো থেকে কাগজে মোড়া রুটিগুলো বার করে খুলছিল। ইগনাস এসে বসল।
রুটি ছিঁড়তে ছিঁড়তে বলল, “অনিলবাবুকে সাসপেন্ড করা হয়েছে জানিস?
-
জানি। ওই হারামজাদিটা করিয়েছে।
-
হ্যাহ্! গালাগাল দিস কেন?
সিস্টার তো!
ক্যান্টিনের ভিতর থেকে লুডউইগ এগিয়ে এল খইনি ডলতে ডলতে, “চিন্তার কিছু নেই, ইগনাস। এ্যালোয়শিয়াস ফিরে আসবে। গাধাটাকে
বলেছিলাম, “দ্যাখ, এখনও কিছুই হয়নি। ইউনিয়ন দূরের কথা,
আমরা ঠিকমত একও হতে পারিনি। একবার কয়েকজন বসেছি মাত্র। মিছিমিছি এখনই তাও খাসনা।
গর্মি দেখাস না। না......, বাবুসাহেব এসেই সকাল সকাল ঝগড়া করে নিলেন। কেউ আমরা এসে
পৌঁছোইওনি তখনও। আর করবি তো কর ব্যানার্জিবাবুর সামনেই। ব্যানার্জিবাবুকেই সাক্ষী খাড়া
করে দিল সিস্টার।
-
ব্যানার্জিবাবু হয়ে গেলেন সাক্ষী?
“হবেন না?” রুটির দলাটা জল দিয়ে গিলতে গিলতে বলল মারিয়া, “খুব বুদ্ধির কাজ করেছেন। উনিই ফিরিয়ে আনবেন অনিলবাবুকে।”
“এই দ্যাখ, ইগনাস, মারিয়ার বুদ্ধি তোর থেকে বেশি”, লুডউইগ আসন করে বসল ঘাসের ওপর, “আজ কি রান্না করেছিলি মারিয়া?” টিফিন বাক্সের তলানিতে উঁকি দিয়ে বলল, “আরে! এ তো শাপলার ডাঁটির চচ্চড়ি মনে হচ্ছে, বাঃ!”
ইগনাস একটু হতপ্রভ হয়েছিল মারিয়ার সমঝদারি আর তার ওপর
লুডউইগের প্রশংসায়। এবার একটু সপ্রতিভতা দেখানোর সুযোগ পেল, “তা, গরীবের টিফিনবাক্সোতে আর কী থাকবে স্যার, শাপলার ডাঁটি ছাড়া?”
সোজাসুজি মারিয়ার ধ্যাঁতানি খেতে হল, “ওভাবে বলছিস কেন? খারাপ খেলি? ... অন্নের কখনো অশ্রদ্ধা
করতে নেই। তা আপনিও একদিন আসুন লুডউইগ স্যার, আমাদের বাড়িতে। নাহয় শাপলার ডাঁটিই খেয়ে
যাবেন!”
“আসব? খাওয়াবি?”, লুডউইগ খইনিটা চিমটি দিয়ে উঠিয়ে দাঁতের ফাঁকে রাখল, “সত্যি, সত্যি, শাপলার ডাঁটির চচ্চড়ি দিয়েই ভাত খাব কিন্তু। খুব
ভালো লাগে খেতে। ... তোর সাইকেলের কি হল ইগনাস? কবে কিনবি?”
-
দেখি। পয়সা জমাই, আর খরচ হয়ে যায়
কিছু কিছু।
-
কর্জ নিবি? বলব ব্যানার্জিবাবুকে?
-
না। কর্জ নেব না। কিছুতেই না। আর
অসুবিধে তো কিছু হচ্ছে না। হেঁটে হেঁটে দিব্যি আসছি রোজ।
সময় হয়ে
গিয়েছিল। সবাই রওনা দিল নিজের নিজের কাজের দিকে।
অনিলবাবুর
সাসপেন্সন ফেরত হয়েছিল। কাজে ফিরে এসেছিলেন কয়েকদিন পরই। তবে ইউনিয়ন তৈরি হয়েছিল
অনেক বছর পর। তত দিনে অনেক কিছু বদলে গিয়েছে হাসপাতালে। অনেক কর্মচারি পালটে গেছে।
সেসবের আগের কথা।
ইগনাস আর মারিয়ার ছেলের বয়স হয়েছে চার বছর। নতুন সাইকেলের
সামনের রডে একটা সিট লাগানো হয়েছে তার জন্য। সেই সিটে ছেলে জয়কে বসিয়ে, পিছনের
ক্যারিয়ারে মারিয়াকে বসিয়ে এক রোববার ইগনাস বেরুলো সিনেমা দেখতে। এবার আর ইংরেজি
এ্যাকশন নয়, হিন্দী সামাজিক। বেশ নিশ্চিন্ত মনে বেরিয়েছে, কেননা তিনটে টিকিট সকালে
গিয়ে আগাম কেটে এনেছিল।
ভীড় বেড়ে গেছে রাস্তায়। এলসিটি ঘাটের কাছে পৌঁছোতে নদীর দিকে
চোখ গেল। একটা ট্রাক আস্তে আস্তে ঢাল বেয়ে নেমে জেটি হয়ে বার্জে চড়ছে। জয় তো জয়,
পিছন থেকে মারিয়াও চিৎকার করে উঠল। থামো, থামো, দেখবো... হড়বড়িয়ে বেসামাল হয়ে গেল
সাইকেল। মারিয়া তো লাফিয়ে নেমে পড়েছিল। কোমরে একটু হ্যাঁচকা টান লেগেছিল শুধু।
ইগনাস সাইকেলসুদ্ধু আছাড় খেল ডানদিকে। ডান হাতটা ভর দিতেও নামায়নি, শক্ত করে
হ্যান্ডেলে রেখেছিল যাতে পড়তে থাকা জয়ের মাথাটা না ঠুকে যায় রাস্তায়।
মারিয়া দৌড়ে গিয়ে, পথচলতি মানুষজনের সাহায্য নিয়ে আগে জয়কে কোলে নিল, তারপর ইগনাসকে ওঠালো। সাইকেলটা
ওরাই দাঁড় করিয়ে দিল রাস্তার পাশে। ভাগ্যিস কিছু হয়নি। তবে ইগনাস বুঝছিল, ভালো রকম
চোট লেগেছে ডান কাঁধে। এই কাঁধ নিয়ে সাইকেল চালিয়ে সিনেমা দেখতে যাওয়া হবে না। মারিয়া
ছলছলে চোখে তাকিয়েছিল ওর দিকে।
-
খুব লেগেছে
না? আমারই অন্যায়। ওভাবে চিৎকার করা উচিৎ হয়নি। ভেঙে টেঙে গেছে কিনা কে জানে। বাড়ি
চল। যেতে পারবি তো? না কি একটু আরাম করে নিবি বসে?
-
নাঃ, ঠিক
আছে চল। সিনেমার টিকিটগুলো নষ্ট হল। আমি সাইকেলটা নিয়ে হেঁটে যাচ্ছি। তুই জয়কে নিয়ে
আয়।
কথাটা বলে ইগনাস স্ট্যান্ড থেকে সাইকেল
নামিয়ে ঘুরতে চেষ্টা করল, কিন্তু ধপ পড়ে গেল সাইকেলটা। ডান হাতে জোর পাচ্ছে না। এবার
উলটো দিক থেকে বাঁ হাতে উঠিয়ে ওই এক হাতেই টানতে চেষ্টা করল সাইকেলটা। এবার মারিয়া
খপ করে ধরল অন্য দিকের হ্যান্ডেল।
-
তুই জয়কে
বাঁ হাতে ধরে হাঁট। আমি সাইকেলটা নিয়ে এগোচ্ছি।
-
পারবি?
-
কেন পারব
না? শাড়ি পরে না থাকলে বা এটা মেয়েদের সাইকেল হলে আমিই তোদের দুজনকে বসিয়ে চালিয়ে
নিয়ে যেতাম। কত চালিয়েছি সাইকেল, ছোটোবেলায়!
বিকেল হয়ে আসছিল। মারিয়া সাইকেল
নিয়ে আর পিছনে ইগনাস জয়কে বাঁহাতে ধরে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির দিকে এগোচ্ছিল।
হাসপাতালটা রাস্তাতেই পড়ে। যদিও আজ রোববার, তাও বিকেল। তাতে কি। হাসপাতাল তো। ডিউটিতে
নার্স, জুনিয়র ডাক্তাররা তো আছেই ওয়ার্ডে। একবার দেখিয়ে নিয়ে গেলেই তো হয়। মারিয়া ভাবল
কথাটা। বলল ইগনাসকে। ইগনাসেরও মনে ধরল।
হাসপাতালে শুধু দেখানোই নয় – এক্সরেও
হয়ে গেল আর কাঁধের হাড়ের ডিসলোকেশনের জন্য পিঠে আটের পট্টিও জুটে গেল তিন সপ্তাহের
জন্য। নার্স আর ডাক্তারদের মধ্যে কে না চেনে ইগনাস আর মারিয়াকে। জয় হাতে পেল কিছু
লজেন্স।
বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যে রাত। তিন
জনে ধীরে ধীরে এগোচ্ছিল রাস্তায়। মারিয়া কিছুটা এগিয়ে গিয়ে ছিল। হঠাৎ ইগনাস
চেঁচিয়ে উঠল। কথাটা বলল জয়কে, কিন্তু উদ্দেশ্য ছিল যে মারিয়াও শুনুক।
-
সামনের ছুটির
প্রোগ্রামটা তাহলে ঠিক করে ফেলি, কি বলিস জয়?
-
প্রোগ্রাম?
কি?
-
ওই বার্জে
করে আমি, তুই আর জয় যাবো গঙ্গার ওপারে। ওপারে গিয়ে মাছ-ভাত খাবো, তারপর ফিরে আসব।
সামনের অন্ধকার থেকে মারিয়া ফুট
কাটলোঃ-
-
হ্যাঁ।
আর বালির চড়ায় আরেকটা আছাড় খাবো। আর আরেকটা কাঁধের হাড় ভাঙবো। আর তারপর বৌয়ের কোলে
ফিরবো।
-
হ্যাহ্ ...
তুই না! ... তবে তোকে এক সেট সালোয়ার কামিজ আমি কিনে দেবো মাসের শেষে। সাইকেল চালানোটা
অভ্যাসে থাকুক, কি বলিস?
-
ওসব ইশারা
করে আমার হমদর্দি পাবি না। আর সাইকেল চালাতে আমার অভ্যেসের দরকার নেই। এই দ্যাখ...
শাড়িটা গুটিয়ে মারিয়া প্যাডেলে বাঁ
পা রেখে চাপ দিল। তার পর সামনে থেকে ডান পা গুটিয়ে ওদিকের প্যাডেলে নিয়ে গেল। অভিজ্ঞ
স্লো সাইক্লিস্টের মত আস্তে আস্তে ব্যালেন্স করে এগুলো, তারপর ঘুরিয়ে নিয়ে এল
ইগনাসের কাছে – পার করে পিছন দিকে চলে গেল। ফিকে ল্যাম্পপোস্টের আলোয় চকচক
করে উঠল মারিয়ার খোলা হাঁটুদুটো।
পিছন থেকে ফিরে এসে সাইকেল থেকে নেমে
আবার হাঁটতে লাগল পাশাপাশি।
জয় আরেকটা লজেন্সের মোড়ক খুলে মুখে ফেলছিল। মা ওর পকেট থেকে
দুটো বার করে একটা ইগনাসকে দিল, একটা নিজের মুখে পুরল, “সবকটা
একাই খাবি নাকি? ক্রিমি হবে পেটে, তখন পাছা চুলকোবি।” জয়ের কিছু করার ছিল না। খাপ্পা হয়ে মুখ ভার করে হাঁটতে
থাকল বাবার বাঁ হাতের আঙুল ধরে।
ইউনিয়ন যখন সত্যি সত্যি তৈরি হল তখন
জয়ের বয়স সাত বছর। রোজ স্কুলে যায়। তিন বছরের বোন পার্ল এখনও স্কুলে যাওয়া শুরু
করেনি।
হাসপাতালের জনসংযোগ অধিকারী হয়ে
এসেছিলেন বি কে প্রসাদ। উনিই কিছু বুঝিয়েছিলেন সিস্টার আর এ্যাডমিনিস্ট্রেটরদের। তখন
শহরে ও দেশে রাজনৈতিক নেতাদের বোলবালা একটু বেড়েছে। বি কে প্রসাদই একদিন সব বিভাগে
ঘুরে ঘুরে কর্মচারীদের বলে এলেন বিকেল চারটেয় পিছনের হলে জমায়েত হতে।
সময় মত সবাই হলে পৌঁছে গেল। একটু
পরে বি কে প্রসাদ একজন সরকারি নেতাকে অভ্যর্থনা জানাতে জানাতে হলে নিয়ে এলেন। পরে
জেনেছিল ইগনাস ওটা ঠিক সরকারি নেতা নয়। ওকে ইন্টাকের নেতা বলে। আগে থেকে মালা এনে
রাখা ছিল। লুডউইগ আর আরো কয়েকজন গিয়ে মালা পরালো। কিছুক্ষণ ইউনিয়নের কার্যকারিতা
নিয়ে ভাষণ হল। তারপর বি কে প্রসাদ এ্যালোয়শিয়াস ফিডেলিসের নাম ধরে ডাকলেন। এ্যালোয়শিয়াস
উঠে গিয়ে মাইকে একটা লিস্ট পড়ল। প্রেসিডেন্ট – ভিক্টরসাহেব,
সেক্রেটারি – লুডউইগ, ট্রেজারার – পি কে সিনহা ... কমিটিতে মেয়েদের
মধ্যে এমনকি মারিয়ারও নাম ছিল।
আর সেই মারিয়াই কিনা ইগনাসের পাশ থেকে
চেঁচিয়ে উঠল, “আর অনিলবাবুর নিজের নাম? উনিই তো সবচেয়ে আগে উদ্যোগ নিয়েছিলেন
ইউনিয়ন গড়ার!”
পাশ থেকে ইগনাস ওর হাত টেনে বসাবার
চেষ্টা করল, পারল না। এ্যালোয়শিয়াস কিছু বোঝাবার চেষ্টা করছিলেন উনি নিজের নাম কেন
রাখেন নি, “আর আমি তো থাকবই সব কাজে!”
মারিয়া নাছোড়বান্দা। অনিলবাবুকে না
রাখা হলে ওও থাকবেনা। আর রইলইনা শেষ পর্যন্ত। তখন কমিটির লিস্টে ফের বদল করে
ইগনাসের নাম রাখা হল। ইগনাস গাঁইগুঁই করছিল। মারিয়া চুপ করিয়ে দিল, “তুই থাক।
কিছু বলতে হবে না এখন।”
তবে ইউনিয়ন তৈরি হওয়ার কিছুদিন পর থেকেই
দেখা গেল বস্তুতঃ বি কে প্রসাদই ইউনিয়নের সর্বেসর্বা হয়ে উঠেছেন। যদিও প্রেসিডেন্ট,
সেক্রেটারি বলতে ভিক্টরসাহেব আর লুডউইগ আছে, ইন্টাকের ঝান্ডাও ওড়ে সাইকেল
স্ট্যান্ডের টিনের চালে আর ক্যান্টিনের পাশে, কিন্তু সব চাবিকাঠি কার্যতঃ বি কে
প্রসাদের হাতে – উনিই এখন আবার হাসপাতালের জনসংযোগ অধিকারী হওয়ার সাথে সাথে
কার্মিক অধিকারী। সবাই একটু সাবধান থাকে ওই লোকটি থেকে।
“শালা চোর!” ইগনাস সকালে পার্লকে কোলে বসিয়ে দুধরুটি খাওয়াতে খাওয়াতে
বলল, “ইউনিয়ন হয়েও কোনো লাভ হল না। শয়তানটা পকেটে পুরে ফেলল
ইউনিয়নটাকে।”
“কি করবে।
সবাই তো আর এ্যালোয়শিয়াস ফিডেলিস নয় যে চাকরির তোয়াক্কা না করে লড়ে যাবে। সেই
ব্যানার্জিবাবুও আর নেই। ভালো সিস্টারদেরও বেশির ভাগ চলে গেছে।” জয়কে স্কুলে পাঠানোর জন্য তৈরি করছিল
মারিয়া, “তাও, ইউনিয়ন হওয়াতে অন্ততঃ কিছু তো লাভ হয়েছে। অন্ততঃ নালিশ
শোনানোর একটা জায়গা ... একটু নিরাপত্তা ...কিছু ভাতাও বেড়েছে। ওই নিয়েই এগোও!”
...............
যেখানে জয়ের পকেট থেকে মা দুটো
লজেন্স বার করেছিল, সেখানেই গজিয়ে ওঠা আলো-ঝলমল দোকানপাটের মাঝে সিগরেটের দোকানটার
সামনে স্কুটার থামালো জয়। ২০১১ সাল। বিরাট চওড়া হয়ে গেছে সামনের তেমাথা আর তিন
দিকের রাস্তা। অদূরে বিরাট মলটার উঠোনে কোনো প্রোগ্রাম চলছে। কাঁচাবয়সী ছেলেমেয়েদের
ভীড়ের চিৎকার, গানবাজনার শব্দ ভেসে আসছে।... গঙ্গার বুকে সেই বার্জ আর স্টিমারও আর
নেই। ওদিকে ব্রীজ তৈরি হয়ে গেছে বিরাট। এদিকেও তৈরি হচ্ছে একটা –
রেলব্রীজ। মাঝখান থেকে গঙ্গাই গেছে শুকিয়ে। চড়ার পর চড়া। সেই কবে বাবা মার সাথে
বার্জে করে ওপারে যাওয়া, বালিয়াড়ি পেরিয়ে ঝুপড়ি দোকানে মাছভাত খাওয়া... মনে আছে
জয়ের।
ওর বয়স এখন উনচল্লিশ। এখন ওই হাসপাতালের
কর্মচারিদের ইউনিয়নের সেক্রেটারি। আই এ পাশ করে কম বয়সেই হাসপাতালে কাজে ঢুকে পড়েছিল
জয়। ইগনাস আর মারিয়ার তদ্বির তো ছিলই। বি কে প্রসাদ ছেলে চিনতেন। জয়ের বুদ্ধিসুদ্ধি
দেখে ওকে নিজের চেলা বানিয়ে নিয়েছিলেন।
সেই শুরু। স্বাভাবিকভাবেই লুডউইগের
অবসর গ্রহণের পর জয়কে সবাই সেক্রেটারি হিসেবে মেনে নিল। কিছুদিনে বি কে প্রসাদও
গেলেন। এক মহিলা এলেন জনসংযোগ অধিকারি হয়ে। কার্মিক দিকটা নতুন এ্যাডমিনিস্ট্রেটর
সিস্টার লুসিল নিজের হাতেই রাখলেন। তবে জয়ের হাতে সেক্রেটারি হিসেবে আগের থেকে
অনেক বেশি জোরের জায়গা হয়ে গিয়েছিল তত দিনে। আশে পাশে সবদিকেই তো এখন কাজকর্মের বিভিন্ন
জায়গায় ইউনিয়ন। রিকশা ইউনিয়ন, টেম্পো ইউনিয়ন, দোকান কর্মচারি সংঘ। তার ওপর আবার
জাত-ভিত্তিক ইউনিয়ন। নাপিত, ধোপা, ছুতোর, কোইরি ... । ব্রাহ্মণ, রাজপুত, ভুমিহার
আর লালাদের সংঘ তো আগে থেকেই ছিল। “লালুজি আসার পর এই পিছড়ি জাতির সংঘগুলো
হল” জয় ভাবে, “আর মজা দেখ, একই টাইমে ভীড় বাড়লো শহরে,
কাজকর্ম বাড়লো, ছোটো ছোটো ইউনিয়নগুলোয় যেমন জাতপাত নিয়ে নেতাগিরির লড়াই শুরু হল, তারা
সামলেও নিল! নিজেদের মজবুত করতে শুরু করল ওই জাতি-বিবাদকেই সামাল দিতে! একেই বলে
লীলা! ... আর তারই মধ্যে এসে গেল নীতীশজির রাজ। এখন আবার সব একটু ঠান্ডা। শান্তি
আর বিকাস দেখছে সবাই! খ্রিস্টান এসোসিয়েশনেরও তো এখন বেশ রমরমা। হিন্দু সংঘ,
মুসলমান সংঘগুলো তো আগে থেকেই আছে।”
সেক্রেটারি জয় কিস্কু এখন হাসপাতাল-ক্যান্টিনের
পাশে ইউনিয়নের দপ্তরেই বেশি বসে। সকালে কিছুক্ষণ বিভাগে হাজিরা দেয়। প্রয়োজনে
ইন্টারকমে অথবা বাইরে গেলে সদ্য-বাজারে-আসা সেলফোনটা পকেট থেকে বার করে কথা বলে
নেয় একাউন্টেন্ট বা এ্যাডমিনিস্ট্রেটরের সাথে।
জয় সিগরেটটা ধরাচ্ছিল ঠিক তখনই
সামনের রাস্তা দিয়ে যাওয়া একটা খালি পুরোনো বাজাজ এফই বোঁ করে সাইড নিয়ে দাঁড়ালো।
মাথায় সিটুর ঝান্ডা উড়ছে। ড্রাইভার ছেলেটা ওখান থেকেই চ্যাঁচাতে চ্যাঁচাতে এগিয়ে
এল, “জয়ভাইয়া, এ জয়ভাইয়া!”
জয় তাকিয়ে গলা তুলল, “আরে,
নিমাই! চ্যাঁচাচ্ছো কেন? আমি তো দাঁড়িয়ে আছি এখানেই।”
-
না, আসলে
মনে হল সিগরেটটা ধরিয়েই আপনি স্কুটার স্টার্ট করবেন।
-
কি, হয়েছে
কি।
-
জরুরি কথা
ছিল।
-
কি?
-
আমার এক
বৌদি আছে। ওকে এএনএমের কোর্সে ভর্তি করাতে চাই। জানেনই, দাদার চাকরিটা যেমন তেমন।
অথচ গুমোর রয়েছে, বৌকে চাকরি করতে দেবে না।
-
সিগরেট খাবে?
-
না, আমি খাই
কোথায়? বলছিলাম, আমি হাল্লাগুল্লা করে এই এএনএমের কোর্সের জন্য রাজি করিয়েছি। বুঝিয়েছি,
চাকরি করতে হবে না। ধাইয়ের কাজ, ইঞ্জেকশন, জল চড়ানো এসব শিখে যাবে তো পাড়াতেই এর
ওর তার ঘরে কাজ করে কিছু পয়সা রোজগার করতে পারবে। অনেক কষ্টে রাজি করাতে পেরেছি।
একবার কোর্সটা করিয়ে নিলে ... ততদিনে ঘরের অবস্থাও কিছুটা পাল্টাবে।
সিগরেটের দোকানওয়ালা দুজনকেই চিনত।
ফুট কাটল, “লাল ঝান্ডা পৈরবি করছে তিরঙার কাছে!” জয়
বিরক্ত হয়ে ঘুরে তাকালো, “নামেই বাবাজি। বুদ্ধিতে মোষ। এখানে
ঝান্ডা কোত্থেকে এলো? ভাই কথা বলছে ভাইয়ের সাথে, দেখতে পাচ্ছোনা?”
-
এসব কথা তো
এখানে দাঁড়িয়ে হবে না। এস বাড়িতে এক দিন। কথা বলে রাখব। কিন্তু পয়সা লাগবে যে।
দিতে পারবে।
-
দেব।
যেমন করে হোক। আর যা বলবেন।
-
যা বলবেন
টলবেন নয়। তিরিশ হাজার লাগবে ওখানে, স্কুলে। দিতে হবে।
-
হ্যাঁ, সে
তো আমিই খবর নিয়েছিলাম। আর ... অন্যকিছু। মানে আপনার...
জয় মুচকি হাসল।
-
দ্যাখো,
আমার বিষয়ে তোমায় কে কি বলেছে জানিনা। জমানা এসে গেছে সব কাজেই এদিক ওদিক করার;
আমিও করি। এই ভর্তির কাজেও করি, করব। ম্যানেজমেন্ট খাতির করে, কিছু সাহেব লোকেরা খাতির
করে; কিছু সুযোগসুবিধে পেয়ে যাই। তবে ইউনয়নের কাজে যেমন আজ অব্দি কর্মচারির পয়সা খাইনি,
এসব কাজেও তোমাদের কাছ থেকে নেব না।
ইগনাস আর মারিয়া এখন এখানে থাকেনা।
অনেক কম বয়সে বাপ-মা হারা ইগনাস এক
মামার হাত ধরে রাজধানি শহরে চলে এসেছিল। তারপর বহূ বছর জামতাড়ায় নিজের গ্রামে সে যায়নি।
জয় বড় হয়ে খোঁজখবর নিয়ে, আত্মীয়-স্বজনদের সাথে কথা বলে গ্রামে নিজেদের একটুকরো
বসত-জমিটা উদ্ধার করে।
মারিয়া আবার জীবনে গ্রামে থাকেনি। রাজধানির
ক্রিশ্চান কোয়ার্টারেই জন্ম। তবু সেই গিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে পুরোনো বাড়ির ভাঙা ঢিপিটা
সাফ করিয়ে নতুন ঘর তোলে। সেখানেই এখন থাকে দুজনে।
জয় থাকে ওদের পুরোনো ভাড়াবাড়িটারই
কাছে একটা ফ্ল্যাটে। বিয়ে করেছে বাঙালি হিন্দু মেয়েকে। ওই নিমাইয়ের জাতের – ঘোষ। মেয়ে
আছে দুটো। জয়ের বোন পার্ল থাকে পলিটেকনিকের পিছনে, তার শ্বশুরবাড়িতে।
পার্লকেই দেখতে যাচ্ছিল জয়। হঠাৎ
মনে পড়ে গেল চল্লিশ বছর আগের ঘটনাটা। মা সাইকেল থেকে নেমে ওর পকেট থেকে দুটো
লজেন্স বার করে নিয়েছিল।
নিমাই নিজের টেম্পোয় উঠে স্টার্টারের
হ্যান্ডেলটায় টান দিচ্ছিল। জয় চেঁচিয়ে ডাকল, “এ্যাই
নিমাই, রাখো ওটা। এদিকে এস।” দোকানওয়ালাকে বলল, “দশটাকার লজেন্স দাও তো বাবাজী, এই
বয়াম থেকে।” মাথায় খেললো
যে পার্লের বাচ্চাটার জন্যও তো কিছু কিনতে হবে।
দোকানদার লজেন্স বার করে সামনের
পাটায় রেখে গুনছিল। জয় একটা উঠিয়ে নিমাইএর হাতে দিল, “যাও, মিষ্টি
খেতে খেতে যাও। আর নিশ্চিন্ত থাকো। হয়ে যাবে কাজ।”
ব্যাঙ্গালোর/ ১৯.৭.২০
[শিল্পে অনন্যা, জানুয়ারী-মার্চ ২০২৪ তে প্রকাশিত]
ভালো লাগলো অনেক দিন পর আপনার লেখা পড়লাম
ReplyDelete