Tuesday, May 31, 2016

প্যানক্রিয়াস


অম্লাশয়ের রোগ শুনলেই মলয়ের কানে হাত থেকে বাসন ফস্কানো থামাবার আওয়াজ বাজে। আশ্চর্য, অন্য অনেক রকম আওয়াজ বা সংকেত ভেসে উঠতে পারত। যেমন সমরবাবুর ডাক, ডিরোজিওর লিনোকাট
অথচ না! এক বয়স্ক নারী শ্রান্ত হাতে বাসনগুলোর ফস্কে যাওয়া আটকান। ধাতু আর দেয়ালের ঘষটানির শব্দ ওঠে বন্দ কাঁসরের মত কিছুটা। শ্রান্ত স্বরে বলেন স্বামীকে, “ফোনটা বাজছে তখন থেকে, ওঠাও না!”
বুড়ো মানুষটার চমক ভাঙে। ফোনটা উঠিয়ে টেপেন, “হ্যাঁ বৌমা, আগামীকাল রওনা দেব আমরা। পরশু সকালে পৌঁছোবো। চিন্তা কোরো না। হাসপাতাল থেকেই বলছ? কেমন আছে আজ ত্রিদিব? (একটা নিঃশ্বাস ছোট্টো করে ছাড়েন) রুমি আছে পাশেই? দাওনা একটু কথা বলি দিদুভাইয়ের সাথে। ও হ্যাঁ, ধরো, মাকে দিচ্ছি ফোনটা।”

“বাংলার নবজাগরণ কি একটা ইস্যু, বিহারে?” কথাটা খুব আস্তে বলতে চেয়েও মলয়ের মুখ ফস্কে বেশ জোরে বেরিয়ে গেল। আর সবাই তো শুনলোই, অল্প দূরে বসে থাকা সমরবাবুও শুনে ফেললেন। কাজেই কথাটার মুখ ঘোরানো ছাড়া আর কোনো উপায় রইল না।
“বাংলার নবজাগরণকে বিষয় করে কোনো আয়োজন করা সত্যিই খুব কঠিন” আগের কথাটা থেকে সুত্র নিয়ে মলয় পুরো হলঘরকে সম্বোধন করল, “তার আগে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দিই। সমরবাবু, একটু উঠে দাঁড়ান। ইনি সমর মিত্র। কলকাতায় থাকেন। এখানে এসেছিলেন ব্যক্তিগত, পারিবারিক কাজে। উনি কিছুই জানতেন না; বিহারে বাঙালি কোথায় থাকে, তারা কী করে। অথচ এই সত্তর বছর বয়সে প্রথম বিহারে এসে উনি আমাদের খুঁজে নিলেন। একসাথে সবাইকে, মানে যাকে বলে অকুস্থলে বামাল পাকড়াও করলেন পুরো গ্যাংটাকে।
“সে যা হোক, বিশুবাবু আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পর উনি সরাসরি প্রশ্ন করলেন যে আমরা ডিরোজিওকে নিয়ে কিছু করছিনা কেন? আপনারা যাঁরা ডিরোজিওর নাম শোনেন নি তাঁদেরকে সংক্ষেপে বলি যে উনবিংশ শতাব্দীর বাংলায় নবজাগরণ বলে যে একটি বিপ্লব চিন্তাচেতনার ক্ষেত্রে ঘটেছিল, যার প্রধান কিছু ব্যক্তিত্ব হিসেবে রামমোহন, বিদ্যাসাগর প্রভৃতি নাম আপনারা শুনে থাকেন, সেই নবজাগরণের একটা পুরো প্রজন্মকে যিনি শিক্ষক হিসেবে নব্যচেতনায় দীক্ষিত করেছিলেন তিনি হলেন, হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও। ক্ষণজন্মা এই মানুষটি মাত্র বাইশ বছর এই পৃথিবীতে ছিলেন। তাঁর জন্মের দ্বিশতবর্ষ এখন চলছে এবং তাঁর জন্ম এই বিহারের ভাগলপুরেই হয়েছিল।”
সামনে বসেছিলেন অধ্যাপক ইন্দুভূষণবাবু। চেঁচিয়ে শুধরে দিলেন, “জন্ম হয়নি, কিছুদিন এসে ছিলেন ভাগলপুরে। তখন তাঁর বাবা থাকতেন সেখানে, কর্মসুত্রে।”
ততক্ষণে ধীর পায়ে সামনে এগিয়ে এসেছেন সমরবাবু। মলয় এগিয়ে গিয়ে তাঁকে হাত ধরে এনে বসায় ইন্দুভূষণবাবুর পাশে, “এখানেই বসুন স্যার!” দুজনকে আলাপ করিয়ে দেয়। কিন্তু সমরবাবু কিছু একটা বলতে উন্মুখ, মলয়ের হাতটা ধরে ইষৎ টানেন, “১৪ বছর বয়সে ভাগলপুরে এসে ডিরোজিও সেখানেই কবিতা লেখা শুরু করেন – ভাগলপুরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তাঁর মধ্যে স্বদেশপ্রীতি ও কাব্যপ্রীতি দুইই জাগিয়ে তোলে। ঠিক বললাম তো, ইন্দুভূষণবাবু?”
মলয় মাইকের কাছে ফিরে যায়।
“নিজেকে শুধরে নিচ্ছি, আক্ষরিক অর্থে জন্ম হয়নি, কবিজন্ম হয়েছিল ভাগলপুরে। কিন্তু, এসবকিছু সত্ত্বেও যা বললাম (মলয় হাত ওল্টালো) বিহারে এখন যা অবস্থা, ভাষাটাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বাঙালিরা লড়ছে, সেই পরিস্থিতিতে রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ করে নিই, যথেষ্ট, তাঁরা সর্বজনপরিচিত নাম, কিন্তু ডিরোজিও তা নন। তাহলে নবজাগরণের কন্টেন্টটাকে নিয়ে আলোচনা করতে হয়। সেসব গুরুগম্ভীর একাডেমিক বিষয়। বাংলা ডিপার্টমেন্টে হলেও হতে পারতো, কী বলেন সুনন্দাদেবী?”

মলয় বসে পড়ে। এই ভাষণটা দেওয়ার আগে যার সাথে কথা বলা সে শুরু করেছিল তিনি সমিতির সভাপতি। সভা শেষ হয়ে চা’পান পর্ব চলছে বলে তিনিও নিশ্চিন্তে মলয়ের বক্তৃতা শুনছিলেন। হঠাৎ মলয় বসে পড়ায় তিনি ধন্ধে পড়লেন। সভা শেষ হলেও তিনি তো সমিতির সভাপতি। একটা শেষ কথা তো বলতেই হয়! একটু আশাও জাগিয়ে রাখতে হয়!
“সমর মিত্রকে স্বাগত জানাই। অনেকে পাটনায় থাকেন অথচ বলেন, ’সমিতি কী যে করে, কোথায় মিটিং-টিটিং হয়, কী প্রোগ্রাম করেন কিচ্ছু খবর পাইনা’। অথচ সমরবাবুকে দেখুন! এই বয়সে, প্রথমবার বিহারে এসে ঠিক আমাদের খুঁজে নিয়েছেন। সমরবাবুকে আমরা আশাহত করতে চাইনা। আমি বরং বলি, সমরবাবু, যদি আপনি পাটনায় আপাততঃ কিছুদিন থাকেন, তাহলে মাঝে মধ্যেই আমাদের এভাবে খুঁজে নিন। আমাদের অফিসের ঠিকানাটা বিশুবাবু আপনাকে দিয়েছেন নিশ্চই। আসুন সেখানে। আমাদের শিক্ষিত করুন। মুখ্যুসুখ্যু মানুষ আমরা। কোনোরকমে, দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে আমরা নিজেদের ভাষা, সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি। কিছু বিদ্বান মানুষও আছেন আমাদের মাঝে, এই মলয়বাবু, ইন্দুভুষণবাবু, সুনন্দাদেবী। আপনারা সবাই মিলে আলোচনা করে যদি মত দেন যেকী যেন নাম বললেন? ডিরোজিও। তা তাঁকে স্মরণ করে কোনো অনুষ্ঠান করার প্রস্তাব যদি আপনারা দেন তা নিশ্চয়ই সানন্দে আমরা গ্রহণ করবো। সত্যি তো, যেমন আপনারা বললেন, নবজাগরণী প্রজন্মের শিক্ষক, তাও আবার বিহারের ভাগলপুরে জন্ম, তাঁকে স্মরণ করা তো আমাদের কর্ত্তব্যের মধ্যে পড়ে!”

বিকেলে কাজ শেষ করে মলয় অফিসে তার কোনার ঘরটায় বসে ড্রয়ার থেকে ইউনিয়নের কাগজপত্রগুলো বার করছিল। রোজ ভাবে অদরকারিগুলো আলাদা করে ছিঁড়ে ফেলবে, ড্রয়ারটা একটু খালি হবে। হঠাৎ একটা মুখ ঘরের দরজা ফাঁক করে উঁকি দিল। “মলয়বাবু! আছেন তো!”
-     হ্যাঁ, হ্যাঁ, আসুন! বাঃ, আপনার দেখছি অচেনা জায়গা খুঁজে বার করার একটা নেশা আছে। আমাকে ফোন করলেই পারতেন। আমার পক্ষে আপনার ওই হোটেলে, কী যেন নাম বলেছিলেন? স্কাইল্যান্ডপৌঁছোনো খুব সহজ ছিল।
-     আপনি ব্যস্ত মানুষ। কবে সময় করে উঠতে পারবেন! আমার আর কি, দিন রাত চুপচাপ বসে বসে কাটানো। তার থেকে ভালো, ঘুরে বেড়াই। ঘোরাও হয়ে যায়, আপনাদের সাথে দেখাসাক্ষাৎও হয়ে যায়।
-     চা খাবেন?
-     খাবো। তার সাথে একটা সিগারেটও খাবো। কাজেই এখানে নয়। বাইরে যেতে আপনার অসুবিধে নেই তো?
-     কোনো অসুবিধে নেই। কাজ তো শেষ। এসব ইউনিয়নের কাগজপত্র ছাঁটাই-বাছাই করছিলাম।
-     খুব ইউনিয়ন করেন, না?
-     তা একটু করি।
-     দুটো একসঙ্গে ম্যানেজ হয়ে যায়? মানে এদিকে ইউনিয়ন, যাতে প্রায় সবাই অবাঙালি আর ওদিকে বাঙালি সমিতি অসুবিধে হয় না?
-     আমি বেসিক্যালি লেখাপত্তর নিয়ে থাকতেই ভালোবাসি। তবে আমার একটা স্ট্যান্ডপয়েন্ট আছে। যে কাজে আমার ভাত জুটছে, সেখানকার ইউনিয়নে থাকা, পুরোদমে থাকা আমি অবশ্যকর্তব্য মনে করি। আবার যেখানে আমার ভাষার জন্য মানুষে লড়ছে, সঙ্ঘবদ্ধ হচ্ছে, সেখানেও যথাসম্ভব থাকা আমি কর্তব্য মনে করি।

কথা বলতে বলতে দুজনে বাইরে বেরিয়ে রাস্তার ওপারে চলে গিয়েছিল। “আপনি খাবেন তো’ জিজ্ঞেস করে সমরবাবু মলয়ের পিছন পিছন ঢুকলেন চায়ের দোকানে।
-     চা অবশ্য ওদিকে বেশি ভালো পাওয়া যায়। কিন্তু দাঁড়িয়ে খেতে হবে। আর যুৎ করে সিগারেটটাও যখন খাব তখন বসে চা খাওয়াটাই বেশি সুখকর।
-     ঠিক। কিন্তু যেটা বলছিলাম, এসবে এত যে ব্যস্ত থাকেন তাতে লেখার কাজে বা নিজের ইচ্ছেমত পড়ার কাজে ক্ষতি হয়না?
-     হয়তো হয়! আমার লেখক বন্ধুরাও তাই বলে। কিন্তু সমরবাবু, এটা বিহার। সমাজের সবরকম কাজেই লোকের অভাব। কাজেই কাঁধ লাগাতে হয়। আচ্ছা, আপনি তো এখন থাকবেন কিছুদিন পাটনায়?
-     আপাততঃ আছি। কিছুদিন পর ফিরবো। আবার আসবো। এভাবেই চলবে মনে হচ্ছে এখন। আসলে হোটেলে খাওয়াদাওয়া করতে করতে আমার ছেলের শরীরটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে বার বার। নিজে রান্না করা, ওর যা কাজ তাতে পোষায়না। তাই তো ওই হোটেলটায় ঘর নিয়েছিলো। অফিসটাও কাছে পড়বে, খাওয়াটাও ওই হোটেলে বলেকয়ে একটু সাদামাটা করিয়ে নেবে। কিন্তু এখন তা সত্ত্বেও শরীর কাবু হয়ে পড়ায় ওর মাকে এসে থাকতে হচ্ছে। হোটেলের ওই ঘরেই ভাতেভাত ফুটিয়ে নেওয়ার একটু ব্যবস্থা করে দিয়েছি। ছেলের স্ত্রীর পক্ষে এখানে এসে থাকা সম্ভব নয়। ওরও চাকরি আছে, তার ওপর মেয়ের পড়াশুনো। কাজেই আমি একবার এখানে, একবার ওখানে সে যা হোক, আপনার কবিতার বইটা পড়লাম। স্পষ্ট সমালোচনা পছন্দ করেন তো?
-     পছন্দ করি কিনা জানিনা। তবে আগ্রহ সহকারে চাই। পেলে, আমি জানি আমার লাভ হবে। আর আমিও আপনার মনোগ্রাফটা পড়েছি। বাংলার রেনেশাঁর যে এমনও একটি পর্ব ছিল উত্তরকালীন, শ্রমজীবী জনতার কাছে পৌঁছোনোর সত্যি বলতে আমার কোনো আইডিয়াই ছিলো না।
…………………………………………………
    
আকাশে ফাল্গুনের বিকেল। কথাটার মানে এই যে এই রাস্তাটায় ঢোকার পর দুসার বহুতলের ফাঁকে লম্বা এক ফালি আকাশ ছাড়া বছরের কোনো ঋতুর কিছুই বোঝা যায় না। হ্যাঁ, বর্ষায় জল জমে রাস্তায়। আকাশ দেখে ঋতুর ভেদ টের পাবে এত বিচক্ষণ চোখও মলয়ের নয়। তবু মাথায় ফাল্গুন ব্যাপারটা ছিল বলে কথাটা ওভাবে মনে এল।

স্কাইল্যান্ড হোটেল। হোটেলটার পাঁচ তলার এই ঘর ঠিক হোটেলের ঘরের মত নয়। আশে পাশে দু’একটা আরো ঘর রয়েছে যাতে হোটেলের কর্মচারীরা থাকে। তার পর খোলা ছাত খানিকটা। মাঝে মধ্যে পাইলিংএর থাম আর শিকের গোছা উঁচিয়ে আছে। মনে হয় এই ঘরটাও কর্মচারীদের জন্য ছিল। কাজের জায়গার কাছাকাছি মাসকাবারি থাকার ব্যবস্থা সস্তায় করতে গিয়ে হোটেলের এইঘরটা বেছে নিয়েছিলেন ত্রিদিব। মালিকও সেই হিসেবেই এই ঘরটা খালি করিয়ে দিয়ে দিয়েছিল।
নিজের অফিসে, অফিসের বাইরে চায়ের দোকানে, বিভিন্ন সভা সমিতিতে সমরবাবুর সাথে এই কয়েক মাস ধরে নিয়মিত আড্ডা দিয়েছে মলয় কিন্তু হোটেলে আসেনি। আসবো আসবো করেও আসেনি। তাই সমরবাবুর স্ত্রীকেও দেখেনি কোনোদিন। এই প্রথম দেখলো। ভেবেছিলো ছেলে ত্রিদিবের সাথেও দেখা হয়ে যাবে! তা তো আর সম্ভবই নয়। অমরবাবুর বৌমা আর সাত বছরের নাতনি রুমির সাথেও কোনোদিন দেখা হবে কী?
-     কী হয়েছিলো? আপনি তো বলেছিলেন হোটেলে খাওয়াদাওয়া করতে করতে
-     তাই তো ভাবছিলাম এতদিন ধরে! কিন্তু এবারে ডাক্তারের সন্দেহ হওয়াতে পরীক্ষাটরীক্ষা করালো। (একটু দম নিলেন) প্যানক্রিয়াসে ক্যান্সার বলছে ডাক্তার। তাই কলকাতাতেই নিয়ে গেলাম। এখন তো হাসপাতালে। অফিস চিকিৎসার খরচ তো দিচ্ছে। দেখুন কী হয়। (একটা বই বার করে আনলেন ব্যাগ থেকে) এই বইটা আপনি রাখুন। পাদরী লঙকে নিয়ে বেশি কাজ হয়নি বাংলায়। আর, আপনি জানেন আমি সেকেন্ডারি সোর্সের ওপর ভরসা করে চলিনা। প্রাইমারি সোর্স ঘাঁটি। আশা করি আপনাদের কাজে লাগবে বইটা। আর হ্যাঁ, আগামী এপ্রিলে ডিরোজিওর দ্বিশতজন্মবার্ষিকী পুরো হচ্ছে। কিছু একটা করুন আপনারা, পাটনায়, ভাগলপুরে বাইশ বছরের ছোট্টো জীবনে মানুষটা ভারতবর্ষের জন্য এত কিছু করলো!

ঘোঁঘোঁ বিছানার ওপর রাখা মোবাইলটা আস্তে আস্তে সরছে ভাইব্রেশনে, একটা কোনো পরিচিত ফিল্মি গানের সুরে রিং টোন। সমরবাবুর স্ত্রী কিছু করছিলেন মাটিতে বসে। উঠে আসতে গিয়ে হাতের বাসনগুলো ফস্কে যেতে লাগলো। ধাতু আর দেয়ালের ঘষটানির শব্দ উঠলো বন্দ কাঁসরের মত কিছুটা।

ফোনে খবর এসেছিলো ত্রিদিবের আয়ু আর এক মাস।  




No comments:

Post a Comment