সাড়ে নটার মধ্যে দলসিংসরায় পৌঁছোতে হলে সাতটার বাস ধরতে হবেই। যদিও সে বাস পৌনে ন’টাতেই পৌঁছে দেয়। কিন্তু তার পরের বাস আটটায়, তাও লোকাল, দশ জায়গায়
দাঁড়িয়ে-টাড়িয়ে পৌঁছোয় সাড়ে দশটা নাগাদ। আর অতক্ষণ যদি অপেক্ষা না করে সোনলের
বাবা? পার্টির কাজে আসছে, হয়ত মিটিং সেরে ওদিক থেকেই ফিরে চলে গেল পাটনা। তখন আর
দেখাও হবে না।
‘আর দেখা হওয়াটা এত জরুরি!’
আটা মাখতে মাখতে পূর্ণিমা ভাবে। আটাটা মাখা থাকলে রুটিটুকু করে নিতে পারবে সোনল।
ছোটো ভাইবোনদুটোর না খেয়ে স্কুলে যেতে হবে না; সোনলও খেয়ে নেবে। আটা মাখা হয়ে যাক,
সে নিজে স্নানটান করে তৈরি হয়ে নিক, তারপর বাচ্চাগুলোকে ওঠাবে ঘুম থেকে ।
এখন পৌনে ছ’টা। সাতটার
বাসটা ধরতে হলে সাড়ে ছটার মধ্যে বেরিয়ে পড়তে হবে।
হাইওয়েতে শিরীষগাছটার তলায়
সওয়ারি জমতে শুরু করে দিয়েছে। আলপথে তাড়াতাড়ি পা চালায় পূর্ণিমা। ক্ষেতে ক্ষেতে বড়
হয়ে ওঠা তামাকের পাতাগুলো মাঝেমধ্যে পায়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে। গ্রাম থেকে রাস্তাও একটা
উঠে এসেছে কিন্তু সেটা ঘুরপথ। সবাই এই আলপথ ধরেই পা চালায়। যেমন ওরা এসে গেছে তার
আগেই। অবশ্য, তার গ্রামের কেউ কি…
হাইওয়েতে উঠে হাতের চটিটা
পায়ে গলিয়ে ওপারে তাকায়, ‘যাঃ, যা ভয় পাচ্ছিল, গ্রামের পরিচিত দুটো বুড়োও আছে
আবার। এবার শুরু হয়ে যাবে। পূর্ণিমা ঘোমটাটা ভালো করে মাথার ওপর টেনে রাস্তা পার
করে। ভীড়ের পাশ কাটিয়ে এক প্রান্তে তিনজন মহিলার সাথে গিয়ে দাঁড়ায়। শুনতে পায়, শুরু
হয়ে গেছে দুই বুড়োর আহা উহু। যেন এ এলাকা থেকে এক পূর্ণিমার বরই লাল ঝান্ডার রাজনীতি
করছে। “ কী করে যে নিজের বৌ ছেলেমেয়েকে গ্রামে ফেলে রাখে একা! আবার ঘরের আনাজপানির
ব্যবস্থাটাও বৌকেই দেখতে হয়। দু বিঘা জমির চাষের ব্যবস্থা করা, সেলাই-ফোঁড়াই, আচার
তৈরি করা, তারই মধ্যে ছেলেমেয়েদের ইস্কুলে পড়ার জন্য…”
ভাগ্যিস বাসটা এসে যায়।
ভিতরে পিছনদিকে জায়গা পেয়ে যায় বসার।
সেভাবে দেখতে গেলে, এই
এলাকাটা লালঝান্ডারই এলাকা। বেশ কয়েকবার বিধায়কও হয়েছেন তাদের পার্টির নেতা। তবে
কাজেকর্মে সেই রমরমা আর নেই। মানে একটা উৎসাহ, প্রতিদিন নতুন কাজের, ছোটো ছোটো
বৈঠকেও কমরেডদের গহমাগহমি, গান, নাটক, প্রভাতফেরী…নেই তা
নয়, কিন্তু যেন গতানুগতিক, বাসি, বাসি। যখন নাকি পার্টি আগের থেকে বেশি ছড়িয়ে
পড়েছে। নতুন পাকা ঘর তৈরি হয়েছে লোকাল কমিটির।
যাঃ, এসব তার মনের কথা,
পূর্ণিমা ভাবে, সে নিজেই তো আসলে নিয়মিতভাবে কোনো কাজেকর্মে নেই। শুধু সংসার ঠেলে
যাচ্ছে দশ বছর যাবৎ। এবার সোনলের বিয়ের চিন্তাও শুরু করে দিতে হবে।
আঠেরো বছর হয়ে গেল তাদের
বিয়ের। বিয়ের আগে যুবসংগঠনে তাদের দেখা। যুবসংগঠনের সাংস্কৃতিক টিম প্রোগ্রাম করবে
কিসানসভার সম্মেলনে। ধর্মবীরই জিম্মা নিয়েছে প্রোগ্রামের। সেক্রেটারিকে বলল, এবারে
নতুন ব্যাপার ঘটাবে। গানের গ্রুপে মেয়েদেরও শামিল করবে। কোথায় আছে গায়িকা মেয়ে? কেন?
পূর্ণিমার গলা ভালো, আমি শুনেছি। কী করে শুনলে? সে ছাড়ো না। ওকে রাজি করাও। তা
নাহয় একজন হল, আর? ওকেই বলো আরো দুতিনজনকে জোটাতে।
পরে বলেছিল ধর্মবীর,
যুবসংগঠনের ক্যাম্পে রাত্তিরে বেরিয়েছিল খৈনির খোঁজে। মেয়েদের ঘরটার পাশ দিয়ে
যাওয়ার সময় শুনতে পায় গুনগুন, তারই বাঁধা গানের সুর। পরে সকালে সুধাজীকে জিজ্ঞেস
করে জানতে পারে গুনগুনকারিণীর নাম – পূর্ণিমা।
পুরো এলাকায় প্রথম কোনো
রাজনৈতিক গানের টিমে মেয়েদের কন্ঠস্বর এল। মাইকে গলা মেলালো চারজন, কিন্তু সবচেয়ে
জোরালো আর সুরেলা আওয়াজ পূর্ণিমার।
বাস পৌঁছে গেছে। মোড়ে নেমে
তাড়াতাড়ি গ্রামের দীপনারায়নের মোটর পার্টসের দোকানে পৌঁছোলো।
- ভাবীজী, প্রণাম!
- আসেননি এখনো?
- কে, ধর্মবীরভৈয়া? আসার কথা ছিল নাকি? (কর্মচারী ছেলেটিকে প্রশ্ন করল) এসেছেন
নাকি রে?
- হুঁ। স্টেশনের দিকে প্রোগ্রাম আছে। বলেছেন বসাতে।
- বসুন ভাবীজী। চা টা খান। এক্ষুণি এসে যাবেন তার মানে।
- না ভাই, চা খাবো না। এক গ্লাস জল খাইয়ে দাও শুধু। আমি একটু বাজার থেকে আসছি
এটা (হাতের থলেটা দেখিয়ে) সীতারামজীর দোকানে পৌঁছিয়ে।
ফিরে আসতে আসতে দশটা হয়ে
যায়। তখনো দেখা নেই। বাইরে চেয়ারটায় বসে থাকতে থাকতে ঢুলুনি আসে। ঘুমিয়েই পড়েছিল
বোধহয়। হঠাৎ ঘুম ভাঙতেই চোখের সামনে দশাসই শরীর।
- কতক্ষণ বসে আছিস?
- (চোখ ফেটে জল আসে, কিন্তু সামলে নেয়) এই আধঘন্টা।
- বাস তো সাড়ে ন’টায় পৌঁছে গেছে।
- বাঃ, কাজ ছিল না! আচারের বয়ামদুটো পৌঁছোনোর ছিল সীতারামজীর দোকানে!…তুমি যাবে গ্রামে?
- না। ফিরতে হবে। ওখানে কাজ আছে। এসেছিলাম কমরেড লখন বলেছিল একটা সাংস্কৃতিক
আয়োজন করেছে আজকে স্টেশন চত্বরে। আমি রাজ্যনেতাকেও নিয়ে এলাম। এসে দেখি ভোঁ ভাঁ।
কী, না হয়ে উঠতে পারল না। সেটা খবর দিবি তো! কোনো জবাব নেই। কী বলব?
- কিছু টাকা এনেছ? আমার হাত এক্কেবারে খালি।
ধর্মবীর মাথা নিচু করে
থাকে। পূর্ণিমার বুঝতে অসুবিধা হয় না।
- ওয়েজ পাওনি এমাসের?
- আমি এসে দিয়ে যাবো তোকে টাকা, এক সপ্তাহের মধ্যে। না আসতে পারলে কারুর হাত
দিয়ে পাঠিয়ে দেব।
- সোনলের বিয়ের চিন্তাও শুরু করতে হবে এবার। ছেলে টেলে দেখছো কোথাও।
- দেখছি। বিয়ের টাকাটারও তো ব্যবস্থা করতে হবে! কম টাকার ব্যাপার তো আর নয়! না
করেও চল্লিশপঞ্চাশ হাজার… ছাড় ওসব। চল কিছু খেয়ে আসি। খিদে পায়নি তোর?
- সে একটু পেয়েছে।
মোড়ের ওদিকটায় চা-মিষ্টির
দোকান। দোকানদার নমষ্কার করে। ধর্মবীরকে চেনে না এমন লোক কম আছে এখানে। দুটো করে
লিট্টি আনায়।
- ওই রাজ্যনেতা কোথায় গেলেন? ওনাকে দেখলাম না তো!
- আরে, আমাকে ফাঁসিয়ে দিল সকলদেব। দেখেই বলল, ভূষণজী বলেছেন, পটৌরিতে জিবি আছে
লোকালের, আমি যেন অ্যাটেন্ড করি, একটু সাহায্য হবে রিপোর্টিঙে। তা সাংস্কৃতিক
ফ্রন্টের নেতাকে আর আটকে রাখি কেন, প্রোগ্রামটাই তো হলনা। ওনাকে বাস ধরিয়ে দিলাম।
আমি বিকেলের বাসে যাব।
- তবু একবার বাড়ি যাবে না! (ধর্মবীর করূণ দৃষ্টিতে তাকায়) থাক, থাক, আর কৈফিয়ত
দিতে হবে না। (ধর্মবীর হাতটা রাখে পূর্ণিমার হাতের ওপর, চাপ দেয়) ব্যস্, হয়েছে!
ধন্য হয়ে গেছি! (দুজনেই হাসে) গানটান লেখ, না শুধু মিটিং?
- কোথায় তেমন সময় পাই। তবু লিখি মাঝে মধ্যে। একটা লিখেছি গতকাল। শুনবি?
- এখানে নয়। খেয়ে নাও। ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।
চা খেয়ে ওঠে ধর্মবীর।
- চল্, দুজনে পান খাই অনেকদিন পর।
পান চিবোতে চিবোতে
হাইওয়েটায় উঠে চারদিকে তাকায় দুজনে। তারপর, যেদিকে বাজারটা তাড়াতাড়ি শেষ হয়েছে,
সেই দিকে হাঁটা শুরু করে। হট্টগোল কমে এলে, ধর্মবীর খুব নিচু গলায় গুনগুন করার মত
গেয়ে পূর্ণিমাকে, নতুন লেখা গানটা শোনাতে থাকে।
No comments:
Post a Comment