- কী হইল? দেরি হইতাসে ক্যান?
-
সালা, হোখতে নৈখে বন্দ্ ই
দরোয়াজা। তলবো জকড়ল্ বা।
-
এই ভাষায় কথা কইয়ো আমার দিদার
সাথে!
-
হুঁহ্। জ্যায়সে বুঢ়ী বিয়ে
ভেঙে দেবে আমাদের।
বলে,
ঘুরে বৌয়ের গালে জোরে চিমটি কাটল বলরাম। বলরাম দাস।
ভোর
চারটে। আলো ফোটা শুরু হয়েছে কেবল। আকাশে ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ কয়েকটি বলে দিচ্ছে বেলা
বাড়তেই চড়চড়ে হবে আশ্বিনের রোদ। কলোনী থেকে বেরিয়ে রাস্তায় ওঠার মুখে পথটা ঈষৎ
চওড়া। ডানদিকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভাঙাচোরা বাড়ি। বাঁদিকে রিফিউজি কলোনী
সাবক্যানালের শুকনো খাত; ফিডার থেকে জল আসেনা কয়েক বছর যাবৎ।
রাস্তায়
দাঁড়িয়ে থাকা টাটা ম্যাক্সিটা আগে থেকেই ভরাট। বাইরে দাঁড়িয়ে মুখিয়া জনার্দন
পান্ডে।
-
হই দেখ হিরো হিরোইনকে! অবলে
টুটল্ বা নীন্দ্।
গাড়ীর
ভিতর থেকে জিজ্ঞেস করলেন প্রবীণ কালীপদ বিশ্বাস, “কৌন হ্যায় মুখিয়াজী?
-
উ হে, নিরঞ্জন কে ভতিজওয়া
বলরাম!
বাকিটুকু
পুরো করলো ড্রাইভার, “আ ওকর মেহরারু, কঞ্চনমালা!”
সদ্য
বিয়ে হয়েছে দুজনের কাজেই এই খোঁটাটুকু ওদের প্রাপ্য।
কালিপদ
বিশ্বাস গাড়ির ভিতরদিকে হাঁক দিলেন, “গোবিন্দ! তুই ব্যানারটা আনতে ভুইলা গেলি কাল।
অখনে থাকলে এইখান থিকাই স্লোগান তুলতাম!”
“পুষ্করদা
ব্যানার লইয়া থাকবো কইসে, শনিচরির নিকট। আর নারা লাগাইতে ব্যানারের কাম কী?
লাগাইলেই হয়! (জোরে আওয়াজ তোলে) বিহার বঙ্গালি সমিতি জিন্দাবাদ!…”
সাড়া
পায়না। সব ঝিমিয়ে আছে। আরেকটু বেলা হোক। চা, তামাক হলে পর তাহুত হবে মেজাজ।
গাড়ী
ছুটেছে সাঁই সাঁই করে। ভয়ও করে বাবা। গুড়গুড় করে আসতে থাকা ভীমকায় ট্রাকগুলোর পাশ
কাটাতে গিয়ে টলমল করে এই ছোট্ট সওয়ারি ভ্যান। মুখিয়াজী একটু পেছিয়ে, নিজের বাইকের
পিছনে বসে। বাইক চালাচ্ছে সন্তোষ, তাঁর বিশেষ শিষ্য। নিজের ক্ষেত্রের বাঙালি
সমাজের প্রতি তাঁর একটু দুর্বলতা আছে। অন্যান্য মুখিয়ারা তাই ঠাট্টা করে বলে ‘আধা
বঙ্গালি’।
কাঞ্চনমালা
ভিতরে একপাছায় ঠেসে বসে বাইরে খেতের দিকে তাকিয়ে ছিল। বলরাম এবং আরো দুজন গাড়ীর
পিছনে, বাইরে ঝুলছে।
লৌরিয়া
চিনি মিল ছাড়িয়ে বাঁকের কাছে বাইকে বসেছিল পুষ্কর, পিছনে রাহুল। ম্যাক্সি এসে
থামতেই ব্যানার এগিয়ে দিল। গোবিন্দ আর রাহুল মিলে বেঁধে দিল গাড়ির সামনে।
ডানদিকে
চায়ের দোকানে ধুঁয়ো উঠতে শুরু করেছে।
-
দেরী বা?
-
দস মিনট!
-
চাহ্ওয়া তব এইজে পী লিহল জাই,
মুখিয়াজী। সবাইকার নীন্দ খুলবে তো নারাও লাগবে ভালো করে।
*
* * *
বেতিয়া
থেকে বগহা, প্রায় উদয়পুর জঙ্গল বা বাল্মিকীনগর ব্যাঘ্র পরিযোজনা অব্দি বিভিন্ন
ব্লকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বাঙালি শরণার্থী কলোনী বা গ্রাম। এছাড়া বেতিয়া শহরে বা
বেতিয়ারাজের নগরীতে আছে পুরোনো বাসিন্দা, শহুরে বাঙালি। তবু, গঙ্গার উত্তর পাড়ে সিওয়ান,
গোপালগঞ্জের পর এই এলাকাটা ভোজপুরী ভাষাক্ষেত্রের পূর্বাঞ্চল। কাজেই পঁয়ষট্টি বছর
ধরে পূর্ববঙ্গের বাংলা পরে নিয়েছে পূর্বী ভোজপুরীর আবরণ – কিছুটা জীবনের স্বাভাবিক
নিয়মে, কিছুটা অস্বাভাবিক।
এই
গ্রামগুলোর সবকটি আবার এক অবস্থায় নেই। যেমন, বলরাম দাসের গ্রামে ভোজপুরীর অনুপ্রবেশ
এতটাই যে ভাঙা ভাঙা বলা ছাড়া বলরামের প্রজন্মের বাংলার সাথে আর কোনো সম্পর্ক নেই।
অথচ তার স্ত্রী, শৈশবে বাপ-মা হারিয়ে দিদার সান্নিধ্যে থাকা কাঞ্চনমালা মনে, এবং
প্রাণেও, বাঙালী। বাংলা, মানে দিদার জেলার উপভাষা যে বাংলা, বলতে তো জানেই, দিদার
কাছে বাংলা লেখা শেখার সুবাদে ‘লেখার’ বাংলাও বলতে পারে। প্রাণে বললাম এই জন্য যে
তার বরের ভোজপুরীতে প্রেমালাপ এক্কেবারে সহ্য করতে পারে না।
বস্তুতঃ
বলরামের বাংলা না জানার আরেকটা কারণ আছে। বলরামের পূর্বপুরুষ যে জমিটুকু পেয়েছিল বেশ
কয়েক বছর আগে তার আদ্ধেক দখল নিয়ে নিয়েছে অন্য গ্রামের দবঙ্গ চাষীরা। বলরামের বাবা
তার বিরুদ্ধে অনেক নালিশ-টালিশ জানিয়ে হার মেনেছেন। শুধু হার মানাই নয়, বছরের পর
বছর নালিশ নিয়ে বিভিন্ন সরকারি আমলা, নেতাদের কাছে রোজকার দৌড় কেড়ে নিয়েছিল তাঁর
জীবনীশক্তি। অন্য কিছু করে নিজের পরিবারটাকে দাঁড় করানোর চেষ্টা আর তিনি করতে
পারছিলেননা। সে সময় সদ্য তরুণ বলরাম নিজেকে টেনে বার করে পরিবারের এই হাহুতাশের
পরিমন্ডল থেকে। হাহুতাশের ওই পরিমন্ডলটাই তার জন্য বাংলার পরিমন্ডল ছিল। কাজেই তার
বিরুদ্ধে বিদ্রোহে সে নিজেকে পুরোপুরি ভোজপুরিভাষী করে নিল। মুখিয়াজীর কাছ থেকে
কিছু টাকা ধার নিয়ে স্টোভ, হাঁড়ি, তাওয়া কিনলো। ঠিক ওই জায়গাটাতেই ইঁট পেতে বসতে
শুরু করলো রোজ বিকেলে, যেখানে এখন মুখিয়াজীর বাইকটা দাঁড় করানো রয়েছে। ডিমের ওমলেট,
ডিমসেদ্ধ ভালোই বিক্রী হতে শুরু করলো। এখন তার নিজের ঠেলা আছে। শুধু কলোনীর লোকেরা
নয়, বড় রাস্তা দিয়ে যাওয়া লোকেরাও দাঁড়িয়ে তার ব্রেড-ওমলেট খেয়ে যায়। বলা যায় যে
পুরোপুরি নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে, বাবা মা বোনদের দুবেলার খিদে মেটাবার মোটামুটি
গ্যারান্টি করে তবে সে বিয়ে করেছে। যে পৈত্রিক কুঁড়েঘরটি ছিল তার লাগোয়া
পেঁপেগাছগুলির গা ঘেঁষে আলাদা একটি ঘর তুলেছে মাটির – সেটাই এখন পাশের গ্রামের
মেয়ে কাঞ্চনমালার সংসার। অক্খর ভোজপুরি বলরাম এখন খাস বঙ্গালিন কাঞ্চনমালার
গোলাম, সবাই বলে। তাই নিজের বিজনেস ছেড়ে বলরাম আজকের মিটিংএ বৌকে নিয়ে চলেছে।
অবশ্য
বলরামের উদ্যমের ছোঁয়াচে বলরামের বাবাও আজ হতাশা কাটিয়ে উঠেছেন। ভাগবাঁটোয়ারা আর জবরদখলের
পর যেটুকু চাষ আছে, করেন। আখের ফসলটা তো ধরেনই। আর অনেক সময় ছেলের শহর থেকে ফিরতে
দেরি হলে ঠেলাটা নিজেই নিয়ে গিয়ে লাগান বড়রাস্তার ধারে। ডিম বেচা না হলেও আংটা
থেকে ঝোলানো পপকর্নের প্যাকেট, চানাচুরের প্যাকেট বিক্রী হতে থাকে। বলরামের মা
প্রস্তাব দিয়েছেন ঠেলায় ব্যবস্থা করতে পারলে তিনি, তাঁর বৌমা আর দুই মেয়ে মিলে
খোলায় ছোলা, মটর, বাদাম ইত্যাদি ভেজে দিতে পারেন। কিন্তু সেটা আবার ডিমের সাথে মিশ
খায় না। আলাদা জায়গা করতে হয় পাশে। একজন এ্যাসিস্ট্যান্ট চাই। বলরাম ভাবছে কিছুদিন
ধরে।
ম্যাক্সিটা
এখন হাঁইহাঁই করে ফাঁকা হাইওয়েতে ছুটছে। অনেকক্ষণ স্লোগান চালিয়ে একটু ঝিমিয়ে
পড়েছে গোবিন্দদাদা আর কালিপদ মামা। ঝিমিয়ে নিচ্ছে বরং বলা যায়। আবার ধরতে হবে শহরে
ঢুকলে পর। বলরাম আস্তে করে বৌয়ের কানে কানে বললো, “দু’বজে নিকলকে হম্নিকে এগো
সিনেমা দেখব্ যাই। ফির লৌট কে আ জাইব্ হল মে।”
কাঞ্চনমালা
হাঁক দেয়, “গোবিন্দদাদা!” বলরাম সজোরে ওর মুখটা চেপে ধরে।
তার
মানে এই নয় যে কাঞ্চন সবসময় এধরণের প্রস্তাব খারিজ করে। মাঝে মধ্যেই সিনেমা দেখতে
বেতিয়া শহরে আসে দুজনে। কিন্তু এখন গোবিন্দদাদাকে ডাকার কারণ আজকের বেতিয়া-যাত্রার
বিশেষত্ব – “বাঙালীদের সমস্যা নিয়ে জনসভা। বাংলা ভুলে যাচ্ছে বাঙালীরা, স্কুলে
বাংলা পড়ানো হচ্ছেনা… এসব নিয়ে কথা তোলার সুযোগ
এসেছে আজ, আজ না গেলে কিন্তু পরে আপশোষ করবো আমরা”, বাড়িতে এসে বলেছিলেন
কালীপদমামা। তাই বললাম যে কাঞ্চন প্রাণেও বাঙালী। আজকের সভার গুরুত্ব তার কাছে
বিশেষ।
যদিও
গোবিন্দদাদাকে ডাকার ফলটা হয়েছিল উল্টো। সে কথায় পরে আসছি।
গোবিন্দ
ছিল ড্রাইভারের পাশে। কাঞ্চনের হাঁক শুনে পিছনে ঘুরে মুখ বাড়ালো। বলরামের হাতটা
নিজের মুখ থেকে সরিয়ে কাঞ্চন কথা ঘোরালো, “আর কত সময় লাগবো পৌঁছাইতে?” গোবিন্দ
বলরামের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে হাসলো, “হ, তোরা ত এই প্রথম আসতাছস্ বেতিয়া
শহরে!”
*
* * *
বিরাট
সভা। কত বড় বড় নেতা মঞ্চে বসে। উদ্বাস্তু নেতা, বাঙালি সমিতির নেতা… আবার সাংসদ, বিধায়ক, জেলা সভাপতি। আরো নাকি আসছে, পরে পৌঁছোবে। আর সবার
মাঝে মধ্যমণি সেই ভারিক্কি চেহারার ডাক্তারবাবু। কাঞ্চন দেখেছে তাঁকে দু’দুবার।
তাদের কলোনীতে এসেছিলেন, সভা করেছিলেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনের মাঠটায়। সভার পর
দুলালের বাবা আর বড়ভাই ধরে নিয়ে এসেছিল দুলালকে। একটা পায়ে প্লাস্টার। প্লাস্টারের
ওপর হাঁটুর কাছটা ফুলে আছে, আর হলদেটে হয়ে আছে। অনেকদিন ভুগলো বেচারা সেই ব্যারাজে
কাজ করতে গিয়ে এ্যাক্সিডেন্টে।
সকাল
সোয়া আটটা নাগাদ হলে পৌঁছেই অবাক হয়ে গিয়েছিল কাঞ্চন। কত কত মেয়েলোক প্রভাত ফেরীর
জন্য লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে! দিদার বয়সী, মা-মাসীদের বয়সী, তার নিজের বয়সী, স্কুলের
মেয়েরা… সে নিজে পিছনে গিয়ে দাঁড়াবার
পর একজন একটা প্লেকাঠ দিলো হাতে। ঘুরিয়ে দেখলো হিন্দীতে ছাপা আছে, “শরণার্থিয়োঁ কী
জমীন পর গৈরকানূনী কব্জা বন্দ্ করো”। বাঃ, এ তো শ্বশুরমশায়ের কথা! পিছনে ফিরে
বলরাম কোথায় খুঁজতে গিয়ে দেখে ওর হাতেও একটা প্লেকাঠ, “বংগ্লা পঢ়নে-পঢ়ানে কী
ব্যবস্থা করনী হোগী”। ব্যাজার মুখ করে দাঁড়িয়ে বলরাম। হেসে ফেলে কাঞ্চন। বেশ
হয়েছে।
……………………………………
অনেকক্ষণ
হয়ে গেছে মিটিং। মহিলাদের জন্য আগে খেয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা ছিলো তাই দুপুরের ভাতটাও
ধাক্কাধাক্কি করে খেয়ে এসেছে। বিরাট টাউন হলে বাঁদিকে মহিলাদের মধ্যে, পাখার হাওয়া
দেখে জায়গা লুটে বসে ছিলো কাঞ্চন। হঠাৎ দেখলো বাঁদিকের দরজার বাইরে গোবিন্দদাদার
সাথে কথা বলছে বলরাম। বলরাম হাসি হাসি লাজুক লাজুক মুখে মাথা চুলকোচ্ছে আর
গোবিন্দদাদা কপট রাগ দেখিয়ে থাপ্পড় মারছে ওর পিঠে। দ্যাখো কান্ড! নিশ্চই সিনেমা
যেতে চাওয়ার কথা বলছে। “ঠারাও, আমিও দেখাইতাসি!”
চুপটি
করে নিজের সিট থেকে উঠে পড়লো কাঞ্চন। পাশ থেকে চুমকি জিজ্ঞেস করলো, “কহাঁ দিদি?” “তু
চুপচাপ বৈঠ্ অইজা, চাপাকল সে পানি ভরব্” বলে হাতে বোতলটা উঠিয়ে ডানদিকে এগিয়ে
গেল কাঞ্চন। চেয়ারের সারি, জনমানুষ ঠেলে দরজা দিয়ে বেরিয়ে মিশে গেল ভীড়ের মধ্যে।
পিছন ফিরে একবার লক্ষ্য করল চুমকির সাথে কথা বলে বলরাম এদিকেই আসছে। জলের চাপাকলের
কাছে জল নিয়ে খাওয়ার জায়গার দিকে যাচ্ছিলো লীলাপিসি। দৌড়ে গিয়ে তাকে ধরলো, “একবার
চলো না বাইরে, পেটটা ভার ভার লাগছে!”
-
বাইরে কোথায়?
-
ওই যে এনাউন্স করলো না, সুলভ
শৌচালয় আছে বাইরে, আজকে মিটিংএ যারা এসেছে তাদের জন্য ফ্রি!
হাতে
ঘড়ি নেই। সুলভ শৌচালয়ের সিঁড়ি দিয়ে উঠে ভেবেছিল পয়সা নেওয়া লোকটার কাছে সময় জানবে।
কিন্তু উঠেই দেখলো দেয়ালঘড়ি – দুটো বাজছে। মোটামুটি আধ ঘন্টা সময় কাটাতে হবে।
লীলাপিসিকে সিঁড়িতে বসিয়ে ধীরেসুস্থে ‘মহিলা’ লেখা দরজাটার দিকে এগোলো।
বলরাম
চাপাকলের দিকে গিয়ে দেখলো কাঞ্চন নেই। খাওয়ার জায়গার দিকে দেখলো শেষের ব্যাচগুলো
চলছে। ওখানেও নেই। সুলভ শৌচালয়ের দিকে গেছে বুঝলো না। তবে এটা বুঝলো যে ওর
গোবিন্দদা’র কাছে সিনেমা যাওয়ার অনুমতি নেওয়াটা কাঞ্চন টের পেয়েছে, আর ও কিছুতেই যাবে
না। কেন যাবে না?
বলরাম
ক্ষুব্ধ মনে চাপাকলের পাশে দাঁড় করানো বাস, ম্যাক্সি, জিপগুলোর ছায়ায় ঘাসে বসে
বিড়ি ফুঁকলো অনেকক্ষণ ধরে। মাইকে আওয়াজ ভেসে আসছে, এলাকার একজন মহিলা বিধায়ক
বাঙালি সমাজকে খুশি করার জন্য ভাঙা ভাঙা বাংলায় ভাষণ দিচ্ছেন। বলরাম চেনে
বিধায়কজীকে, অক্খড় ভোজপুরিভাষী। ওর মাথায় একটা বুদ্ধি খেললো।
*
* * *
জগদীশ
মন্ডল অনেকক্ষণ বুঝতেই পারলো না বলরামের সমস্যাটা কী। বলরামকে ও চেনেও না।
-
আপনি কোন কলোনী থেকে এসেছেন?
(বলরাম কলোনীর নাম বললো)
-
ওখানকার নেতারা তো আছেন,
কালীপদদা, গোবিন্দ…
-
উরা সোব বেস্ত আছেন। রউয়া শিক্ছক
বানি। হামার ই কামটা করে দেন, প্লীজ।
-
তা তুমি বলতে চাইছিলে তো
এতক্ষণ নাম লেখাওনি কেন? এখন তো সময় শেষ।
-
সে আমি করিয়ে লেব, ব্যাস
দু’লাইন লিখে দিন বাংলা, হিন্দি অক্ছরে।
জগদীশ
এক প্যারা লিখে দিল দেবনাগরীতে বাংলা। বলরাম ছুটে গেল মঞ্চে। ও জানে কাকে বললে কাজ
হবে। মঞ্চের সিঁড়ি দিয়ে উঠছিলেন প্রেসিডেন-ডাকদরবাবু। সোজা পা ধরলো। “ঠিক আছে। এই
বিধায়কদের ভাষণটাষণ শেষ হোক। তারপর তোমাকে ডাকা হবে। কই তোমার স্লিপটা কোথায়?”
সাড়ে
চারটে বাজে। সাংসদ, বিধায়ক যাঁরা এসেছিলেন ভাষণ দিয়ে, সম্মান গ্রহণ করে চলে গেছেন।
আরো তিনজন আসার কথা আছে, এখনও আসেননি। প্রেসিডেন্ট পকেট থেকে একটা স্লিপ বার করে
মঞ্চ-সঞ্চালকের দিকে এগিয়ে দিলেন, “এই ছেলেটাকে ডেকে নিন, একেবারে পায়ে হাত দিয়ে
অনুরোধ করে গেছে।”
ওদিকে
বলরাম দুঘন্টা ধরে হলের বাইরেই ঘুরছে। দেখেছে কাঞ্চন ফিরে এসেছে নিজের সিটে,
কিন্তু কাছে যায়নি। অধিকন্তু, চুমকিকে যেহেতু ইচ্ছে করে রাগ দেখিয়ে বলে দিয়েছিল যে
ও একাই সিনেমা দেখতে যাচ্ছে, কাঞ্চন সেই শুনে আর খোঁজও করেনি, গোঁজ হয়ে বসে আছে।
নামটা
মাইকে শুনে কাঞ্চন চমকে তাকালো মঞ্চের দিকে। বলরাম মাইকের কাছে গিয়ে একবার ভীড়ের
মধ্যে ডানদিকে তাকালো। কাঞ্চন বুঝলো ওকেই দেখতে চাইলো বলরাম।
“মাননীয়
সভাপতি, মঞ্চে আসীন অতিথিগণ এবং পশ্ছিম আর পূরবী চম্পারণের সরনারথি কলোনি থেকে আসা
হজার হজার বাঙালি মা, বোন, পিতরিপর্তিম গুরুজন এবং বন্ধুরা! আমি বাংলা জানি না।
কখনো সিখতে পারিনি। (কাগজ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সোজা মাইকের দিকে তাকালো) আর হমার বৌ
রাগ করে আমি বংলা বলি না। ভোজপুরি বলি। সত্যি সরম কি বাত। আমি ওয়াদা করছি বংলা
সিখবো। বৌয়ের কাছেই সিখবো। (ওদিকে কাঞ্চনের মুখটা লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো, মাথা নিচু
করে জলের বোতলটা খোঁজার ভান করলো) জরুর সিখবো। (বলরাম কাগজের দিকে দৃষ্টি ফেরালো
আবার) আজ যে মহতী উদ্দেস্সে আমরা সবাই সমিতির ডাকে এখানে এসেছি, আমাদের সোক্তি
দেখছে এলাকার নেতারা। আমরা আমাদের দাবীগুলো সরকারের কাছ থেকে নিতে সফল হবোই। বলুন
সবাই একসাথে, “সরনার্থি একতা জিন্দাবাদ! বাঙ্গালি একতা জিন্দাবাদ! বাংলা ভাসা
জিন্দাবাদ!”
কাঞ্চন
চেঁচিয়ে ‘জিন্দাবাদ’ বলে চকিতে তাকালো বাঁদিকে-ডানদিকে। সবাই বলছে তো? না ও একাই? …যাঃ। সবাই বলছে। “লোকটা যেন কী! সবার সামনে এভাবে বলতে আছে আমার রাগ করার কথা?”
তিনমাসের অন্তঃসত্ত্বা কাঞ্চনের ইচ্ছে হল এক্ষুনি ঝাঁপিয়ে পড়ে বলরামের বুকে। মনের
সুখে কিলোয়।
No comments:
Post a Comment