Sunday, August 12, 2018

অয়ন


নদীর ওপারে স্কুল এপারে বাড়ি আসাযাওয়ার পথে অয়নের স্কুলবাসটা সুবর্ণরেখা পেরোয় ব্রীজ শুরু হতেই বাচ্চাদের গুনতি শুরু হয় এক, দুই, তিন, চার ... তার সাথে জানলার ধারে বসা বাচ্চারা বাস পেটায় তালে তালে নদী ও ব্রীজের ওপর বাস চলার শব্দ ছাপিয়ে, নদীতীরে কাজ করতে থাকা মানুষজনের কানে আসে সমবেত শিশুস্বরে গুনতি আর বাস পেটানোর দুম, দুম খোদ তেওয়ারিজী ড্রাইভার থাকলে বত্রিশে শেষ হয় তাঁর চেলা বিনোদ থাকলে পঁচিশ ছাব্বিশে গুনতি যাই হোক না কেন আওয়াজে নদী ও ব্রীজ দুটোই হেরে যায় বাচ্চাদের কাছে
স্কুলের উত্তর-পূর্ব দিকে রাস্তাটা অনেক দূর অব্দি গিয়ে কয়েকটি পাহাড়ের ভিতরে ঢুকে গেছে স্কুলের ঠিক উল্টোদিকে নতুন কলোনী এখনো বাসিন্দা আসেনি বেশির ভাগ ফ্ল্যাটে কেননা এ্যালটমেন্ট আটকে আছে কম্পানির ঝামেলায়
স্কুলের পিছন দিকে দুপ্রস্থ চাষজমি আর কিছুটা নাবাল (হয়ত কোনো কালে শাখা নদী ছিল) পেরিয়ে বড়সড় একটা টিলা চুড়োয় একটা মাজার দেখা যায়
সারা বছর বিশেষ কেউ যত্ন নেয় না মাজারটার প্রত্যেক জুলাইয়ে একটা সপ্তাহে হঠাৎ সেজে ওঠে ছোটো খাটো মেলা বসে যায় মানুষজন আসে অনেক তবে স্কুলের সামনে দিয়ে নয় নদীর পর যে মাটির রাস্তাটা বাঁদিকে ঢুকে গেছে, সেই রাস্তা ধরে গিয়ে পাহাড়তলীতে জিরোয় তারপর উঠতে শুরু করে তা শুধু জুলাইয়ের গরম আর পথের শ্রান্তির জন্য নয়, মেলাটা শুরুই হয় ওই চড়াই থেকে
অয়নের আব্দার সত্ত্বেও ওর বাবা মা ওকে এই মেলায় নিয়ে যান নি কোনো দিন অয়ন বড় হচ্ছে ধীরে ধীরে এ বছর আর ও নিজেকে আটকে রাখতে পারল না বন্ধুদের কাউকে সঙ্গে নিয়ে গেলে বাড়িতে জানবে নিশ্চয়ই নিজে ভালো সেজে বন্ধুর দোষ দেখাতে কে ছাড়ে! তার ওপর যখন নাকি এ ধরণের চুগ্‌লিতে বন্ধুর মায়ের হাতে মুখরোচক খাবার পাওয়া যায় পরের দিন স্কুলে কলা দেখিয়ে রাগাবার মজাটাও বরাদ্দ হয়ে যায়
টিফিনে গার্ডের চোখে ধুলো দিয়ে অয়ন, স্কুলকম্পাউন্ডের পিছনের গেট টপকে বেরিয়ে গেল ক্ষেত ধরে ছুটতে ছুটতে পাহাড়তলী তারপর চড়াই

অয়ন যেদিক দিয়ে চড়ছে সেদিকটা নিচের দোকানপাটগুলোর পিছন দিক, একটু ফাঁকা ফাঁকা মাঝরাস্তায় একটা পাথরের ওপর বসে এক বৃদ্ধ, এক তরুণী সম্ভবতঃ বৃদ্ধের মেয়ে তরুণীর কোলে একটি শিশু
দুজনেই বসার আরাম ছেড়ে উঠবার চেষ্টা করছে পাথরটার ওপর একটা আমলকী গাছের ঝিরঝিরে ছায়া সামনে চড়া রোদে আরো বেশ খানিকটা চড়াই আকাশের খন্ড খন্ড মেঘ যেন আয়নার মত আরো বাড়িয়ে তুলছে রোদের তেজ কাছে দূরে কোথাও বৃষ্টি নেই তাই হাওয়াও নেই বরং রয়েছে দুচার দিন আগে হওয়া বৃষ্টির বাষ্প মাটি থেকে, সুবর্ণরেখা থেকে উঠে আসছে
অয়নও হাঁপাচ্ছিল হাঁপাচ্ছিল বলেই বোধহয় ওর কচি হাত পায়ের জোরও জেগে উঠেছিল ক্লাস সেভেনের ছাত্র বলে কথা তাই এগিয়ে গেল পরিবারটির দিকে
-       আমি নিয়ে নি বাচ্চাটাকে, কোলে?
অয়ন হিন্দীতে জিজ্ঞেস করেছিল কিন্তু জবাব পেল ঈষৎ হিন্দী টানে কিন্তু পরিষ্কার বাংলায়
-       না না, সে কী! আহা এত ছোটো ছেলে, তোমার নিজেরই মুখ তো ঘেমে লাল হয়ে গেছে!
-       ও কিছু না দিন না!
-       না না, ঠিক আছে, তুমি বরং তোমার কাঁধে আমার বাবাকে একটু ভর দিতে দাও পারবে তো?
বৃদ্ধ অয়নের কাঁধে ভর দিয়ে এগোলেন অয়ন দেখল খুব বৃদ্ধ নন, কিন্তু অসুস্থ বলে বেশি মনে হয়
মাজারটার কাছে ভীড় তরুণী তার বাবার দিকে তাকাল
-       বাবা, পারবে যেতে? নাহলে এখানেই বসে জিরোও আমি এই ছেলেটির সাথে গিয়ে ফিরে আসছি এক্ষুণি
-       না, পারব এত কাছে এসেও একবারটি মাথা না ঠেকিয়ে ফিরে যাব? চল্‌
-       তাহলে ভাই, তুমি আমার বাচ্চাটাকেই কোলে নাও সাবধানে নাও আমি বাবার হাত ধরছি আমার সঙ্গে সঙ্গে থাক তোমার নাম কী?
-       অয়ন
-       স্কুল পালিয়ে এসেছ?
-       ...
-       ভালো কর নি যাক, এসেছ যখন, সাথে সাথে থাকবে আমাদের ... আমার নাম মালতী তোমার বাবা কী করেন?


অয়নের ফিরে আসতে আসতে বিকেল হয়ে গিয়েছিল পিছনে পাহাড়ে তখনো মেলার ভীড় গেটটা টপকে, ক্যান্টিনের পাশের ছোট্টো দরজাটা দিয়ে ভিতরে ঢুকে, গ্যালারী পার করে নিজের ক্লাসরুমে ঢুকে দেখল সব খালি কেউ নেই ছুটি হয়ে গেছে
নিজের সীটে গিয়ে সন্তর্পণে নিজের ব্যাগটা বার করল ডেস্কের ভিতর থেকে জলের বোতল নিল মেলায় কিছু খায়নি মালতীদি খাওয়াতে চেয়েছিল যা পয়সা ছিল পকেটে তা দিয়ে ঘুড়ির সুতোয় মাঞ্জা দেওয়ার জন্য এক পুড়িয়া কাঁচের গুঁড়ো আর রঙ কিনেছিল তাই বোতলের বাকি জলটুকু ঢকঢক করে গলায় ঢেলে দিল
বাইরে ছুটতে গিয়েই দেখল পোর্টিকোর কাছে অন্য টিচারদের সাথে ক্লাসটিচারও দাঁড়িয়ে আছেন মিথ্যেটা মুখে তৈরিই ছিল তাই সোজাসুজি ক্লাসটিচারের মুখোমুখি হল
-       টা বাজছে স্যার? আমার বাস চলে গেছে, না?
-       তুমি! কোথায় ছিলে? ম্যাথ্‌সের ম্যাডাম বললেন তুমি ক্লাসে ছিলে না!
-       ভীষণ পেটে ব্যাথা করছিল স্যার! ওপরের খালি স্টোররুমটায় একটা বেঞ্চে শুয়েছিলাম কখন ঘুমিয়ে পড়েছি খেয়াল নেই
-       মিথ্যে কথা শোবার জন্য স্টোররুমে যেতে হল? টিচারকে বললে না কেন?
-       সরি স্যার! ... কিন্তু সত্যি বলছি
অয়নের মুখ দেখে হয়ত ক্লাসটিচার আদ্ধেক বিশ্বাস করলেন কথাটা কিন্তু আর বিশেষ কিছু প্রশ্ন করলেন না
-       দ্বিতীয়বার যেন এরকম না হয় তাহলে তোমার পেরেন্টসদের রিপোর্ট করব ... তুমি পরের বাসটা ধরে চলে যাও রহমত সাহেব, ড্রাইভারকে বলে দিন এফ-সেক্টরের মোড় ঘুরে ওকে নামিয়ে দিয়ে আসবে

মা অয়নের বাসে অয়নকে না পেয়ে বাড়ি গিয়ে স্কুলে ফোন করছিলেন তখনই অয়ন ঘরে ঢুকল মাকেও অয়ন একই কথা বলল যা ক্লাসটিচারকে বলেছিল, কিন্তু মা বিশ্বাস করলেন না কেননা অয়ন হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল বই গোছাতে যা ও কখনো এই সময় করে না
মায়ের বকুনিতে অয়নকে আরেকটা মিথ্যে কথা বলতে হল, যে ও ক্লাস ফাঁকি দিয়ে গল্পের বই পড়ছিল; পড়তে পড়তে ঘুম পেয়ে গিয়েছিল। মা এটাও বিশ্বাস করলেন না। কিন্তু আর কিছু প্রশ্নও করলেন না। ছোটো ছেলের মন। তিনি জানেন, একটু পরে বা কাল, পরশু অয়ন সত্যি কথাটা মাকে না বলে থাকতে পারবে না। ওর পেট ফুলতে থাকবে।
পরের দিন শনিবার। স্কুল ছুটি। অয়ন বেলা দশটার সময় ঘুড়ির কান্নি ঠিক করছিল। মা অয়নকে একটা পাঁউরুটি কিনে আনতে বললেন। মনে ভেবেছেন বিকেলে ব্রেড রোল তৈরি করবেন।
অয়ন পয়সা নিয়ে বেরিয়ে গেল। পাঁউরুটির সাথে, মা দুটো দেশলাই আর একটা গায়ে মাখার সাবানও আনতে বলেছেন।
সেক্টর-এফএর মার্কেটে মনোহারি দোকান দুটো। আর আছে একটা আটাচাক্কি, শাকসব্জির দোকান, মাছ, মাংসের দোকান, একটা মিষ্টির ঠেলা। অবশ্য এছাড়া একটা পান সিগারেটের দোকানও আছে। দুটো মনোহারি দোকানেই পাঁউরুটি উঁকি মারছিল তবু অয়ন মোড় ঘুরে লাইব্রেরি আর কম্যুনিটি হলের পাশ দিয়ে বাজারের দিকে চলল। এই বাজারটা কলোনির লাগোয়া কিন্তু কলোনির বাইরে পড়ে। বাজারের সাথে প্রজেক্ট-বহির্ভূত বিভিন্ন কাজের কর্মচারী, ব্যবসায়ী, নানান কাজের মজুর, রিকশা-ঠেলা চালক ও আরো বিভিন্ন প্রকারের মানুষের বাড়িঘর, বসত। বেশ কিছু পুরোনো বাসিন্দাদের বড় বড় বাড়িও আছে। একটা সিনেমা হল আছে। বলতে গেলে এই জায়গাটা গঞ্জ থেকে শহর এই বাজারকে কেন্দ্র করেই হচ্ছিল। হঠাৎ তামার কারখানা গড়ে উঠল তিরিশ বছর আগে। তৈরি হতে শুরু করল প্রজেক্টের নতুন নতুন কলোনি, সুদৃশ্য রাস্তাঘাট ... আসল শহরটাই আধপথে পিছিয়ে রয়ে গেল।
মেলার পথে যে পরিচয় হয়েছিল মালতীদিদির সাথে, বলেছিল সানরাইজ স্টোরের পাশের গলি দিয়ে ডান দিকের পঞ্চম বাড়িটা।
সানরাইজ স্টোরে পাঁউরুটি, দেশলাই আর সাবান কিনে অয়ন এগোলো। দরজায় কড়া নাড়তে হল না। খোলা। অয়ন, জেগে ওঠা ঈষৎ ভয়টা গিলে ঢুকে দেখল উঠোন। ডানদিকে, বাঁদিকে বেশ কয়েকটি ঘর। কোন ঘরে যাবে?
বাঁদিকে প্রথম ঘরটার সামনে এক মোটা মত মহিলা। অয়ন জিজ্ঞেস করল, মালতীদি?
মহিলা চোখ পাকিয়ে খুব ভালো করে অয়নের আপাদমস্তক খুঁটিয়ে দেখলেন। তারপর ডান দিকের শেষপ্রান্তে ভিতরে যাওয়ার একটা গলি দেখিয়ে দিলেন।
অয়ন সেই গলি দিয়ে ভিতরে গিয়ে দেখল, যাঃ এ তো আরেকটা বারান্দা, অন্যদিকে বাইরে যাওয়ার গ্রিল, কোনো ঘর তো নেই! গ্রিলটা খোলা। অয়ন বাইরে বেরিয়ে নিচের ঘাসজমিতে নেমে এল। সামনে একটা বড় বন্দ গেট সবসময় বন্দ থাকে হয়ত, গেটের বাইরে দোকানের গুমটি, ভাঙা গাড়ি। তখনই চোখে পড়ল বাঁদিকে গ্যারেজের মত ঘরটার দিকে। দরজাটা ঘরের মত, পর্দা টাঙানো, গ্যারেজের মত তো নয়! হোক না হোক এই ঘরটাই হবে। অয়ন দরজার কাছে গিয়ে ডাক দিল, মালতীদি!
মেলায় পরিচয় হওয়া মুখটা বেরিয়ে এল, অয়ন! তুমি, এখন? কোত্থেকে আসছ? সঙ্গে কে? তুমি একা? এস, এস, ঘরে এস।
একটাই ঘরে সব কিছু। একটা খাট। একটা তোরঙ্গ। তার ওপর কিছু পুঁটলি। তারে টাঙানো জামা কাপড়। ডান দিকে সেলাই মেশিন। নতুন কাপড়ের টুকরো পাশে ভাঁজ করে রাখা। ঘরে ঢোকার মুখে ডান দিকে রান্নার উনুন, বাসন, একটা বড় বাটিতে ধোয়া চাল, আরেকটাতে কিছু তরিতরকারি কেটে ধুয়ে রাখা। মালতীদির বাবা খাটে শুয়ে হাওয়া করছেন পাশে শুয়ে থাকা নাতিকে।
মালতীদি একটা আসন বিছিয়ে অয়নকে বসতে বললেন।
-       তোমাকে কী খাওয়াই বল তো? এই নাও, দুটো বিস্কুট খেয়ে জল খাও। কোত্থেকে আসছ এখন? আজ স্কুলে যাওনি?
-       স্কুল আজকে বন্ধ। মা বলল, পাঁউরুটি আনতে। ভাবলাম এই সুযোগে তোমার বাড়িটা খুঁজে দেখে যাই।
-       এই সুযোগে? এ ধরণের সুযোগ আর কক্ষনো নিও না (মালতীর কন্ঠস্বরটা গম্ভীর হয়ে গেল)। যদি আসতে হয়, মা বাবাকে বলে আসবে।
-       যদি না আসতে দেয়?
-       তাহলে আসবে না।
অয়ন অধোমুখে বসে রইল দেখে মালতী ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিল।
-       দেখ, এটা শুধু মা বাবার বাধ্য হয়ে থাকারই প্রশ্ন নয়। এই যে তুমি বললে, যদি না আসতে দেয়! তার মানে তোমার মনে এই সন্দেহটা আছে। কেন আছে? তুমি তোমার ছোট্টো জীবনের অভিজ্ঞতাতেও এটা বুঝে নিয়েছ যে তোমাদের জীবন থেকে আমাদের জীবনের দুস্তর ফারাক। আমাদের মত মানুষদের সাথে মিশতে তোমাদের বাড়িতে মানা করা হয়। তুমি সে মানাটা মানতে চাওনা। হয়ত আমিও চাইনা। কিন্তু লুকিয়ে, না বলে নয়। ... আচ্ছা, আমিই তোমাদের বাড়ি যাব একদিন।
অয়ন আঁতকে উঠে মালতীর মুখের দিকে তাকাল।
-       এতেই ভয় পেয়ে গেলে? তাহলে আর আমায় দিদি কী করে বলবে?
-       না, তা নয়, কিন্তু মা ... মানে স্কুল পালিয়ে মেলায় যাওয়ার কথাটা ...
-       মাকে বল নি, এই তো? কিন্তু বলতে তো হবে। আজকেই বলবে। এখনি। যাও, বাড়ি যাও। উঁহুঁ, না করবে না। বকুনি খাওয়ার হয় খাবে, কিন্তু বলবে। নইলে এই দিদিটাকে ভুলে যাবে। ঠিক?

এমনিতেও পাঁউরুটি আনতে গিয়ে এত দেরী করার জন্য অয়নের বকুনি প্রাপ্য ছিল। ভেবেছিল আরেকটা মিথ্যা বলবে যে এখানের পাঁউরুটিগুলো টাটকা মনে হল না বলে বাজারে গিয়েছিল। কিন্তু বাড়ি ছুটতে ছুটতে মালতীদির কথাগুলো মনে পড়ল। মায়ের মুখটাও মনে পড়ল। বাবা তো পরে জানবে যা কিছু জানার। মিথ্যের পর মিথ্যে! এত বলা যায় নাকি? এর থেকে দমবন্ধ করে এক নিঃশ্বাসে সত্যিটা বলে ফেলা ভালো। মা রাগ করবে। বাবা রাগ করবে। বকুনি খাবে। মার? কে জানে, কখনো সেভাবে মার খায় নি অয়ন। কিন্তু দেখে তো অনেককে মার খেতে। জানলার বাইরে থেকে শোনে। স্কুলে ক্লাসটিচার মারেন না। কিন্তু উঁচু ক্লাসের অঙ্ক টিচার! শুনেছে, নাকি ভীষণ মারেন। ... নাঃ, সত্যিটা বলেই ফেলবে ও। মার টার কিচ্ছু না, মায়ের মুখটার কষ্ট আর ও দেখতে পারছে না মনে মনে। মালতীদিও এত ভালো!
মা ব্যালকনিতে চিন্তিত ও উত্তেজিত হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। অয়নকে আসতে দেখে ভিতরে গিয়ে দরজা খুলে দাঁড়ালেন।
-       এত দেরি হল কিসে?
অয়ন মাথা নিচু করে কিছু না বলে ঘরে ঢুকে গেল। দরজা বন্ধ করে মা রাগত ভাবে জিজ্ঞেস করলেন, বলছিস না কেন, এত দেরি হল কিসে। ঘরের সামনে তো দোকান! কোথায় গিয়েছিলি? অয়ন তবুও মাথা হেঁট করে রইল।
-       তোর কাল থেকে কী হয়েছে বল তো? স্কুলের বাস মিস করলি, কেন মিস করলি, একটা মিথ্যে বানিয়ে বললি। আমি বুঝতে পারিনি ভেবেছিস? আজ কটা জিনিষ আনতে দিলাম সামনের দোকান থেকে, বাবুসাহেব এক ঘন্টা পরে এলেন। এবার যদি বাবাকে বলে দিই এসব কথা? ... আর, তুই আমাকে, নিজের মা কে মিথ্যে বলতে শুরু করেছিস?
অয়ন একবার মাথা হেঁট অবস্থাতেই চোরের মত চোখ তুলে মাকে দেখল। তারপর ছুটে এসে মাকে জড়িয়ে ধরল। মা বুঝতে পারলেন ওর মনের অবস্থাটা। তাই আর না বকে, ওকে জড়িয়ে নিয়ে গিয়ে বসালেন। নিজেও বসলেন।
-       মা, একটা কথা বলব? তুমি রাগ করবে জানি। কিন্তু ...
-       বল না বেটা, কী কথা? কী হয়েছে কী?
-       কাল আমি তোমায় মিথ্যে বলেছিলাম।
-       সেটা তো আমি বুঝতেই পারছি ...
-       আমি গিয়েছিলাম স্কুলের পিছনের পাহাড়টায়, যেখানে মেলা বসে এসময়।
-       তুই একা গিয়েছিলি?
-       হ্যাঁ।
-       আর গার্ড?
-       দেখতে পায়নি আমায়।
মা অয়নের মুখের দিকে চেয়ে চুপ করে থাকেন। ওনার মনে পড়ে যায় অয়ন বেশ কয়েকবার আব্দার করেছিল ওই মেলায় নিয়ে যাওয়ার জন্য।
-       কাজটা কিন্তু ভালো কর নি অয়ন। একদমই ভালো কর নি। তুমি জান কতধরণের লোক থাকে মেলায়? যদি কিছু একটা হয়ে যেত? এটা খুব খারাপ একটা ব্যপার হল।স্কুলে কমপ্লেন করতে হবে আমাদের। ছি ছি, এত অবাধ্য হয়ে যাচ্ছ তুমি ভিতরে ভিতরে?
স্কুলে কমপ্লেনের নামে অয়ন রীতিমত ভয় পেয়ে গেল।
-       আর আজ এখন দেরি হল কেন?
কী বলবে অয়ন? তার আগে তো মেলায় কী হয়েছিল সেটা বলতে হয়! মালতীদির মুখটা মনে এল। আর মালতীদির বাবার, তার কাঁধে হাত রেখে পাহাড়ে ওঠা। তারপর মাজারের কাছে ভীড়ের মধ্যে বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে এগোনো আর মালতীদির হাতটা ওর কাঁধে শক্ত করে চেপে থাকা। ... যদি খুলে না বলে সমস্ত কথা তাহলে মালতীদির সাথে দেখা করা বন্ধ হয়ে যাবে। আবার বললেও মা বারণ করবেই, দেখা করতে। বাবা শুনলে তো আরো ...। তারপর স্কুলে কমপ্লেন ...। নাঃ, সাহস যুগিয়ে বলতেই হবে কথাটা। মা বারণ করলেও কখনো সখনো পালিয়ে দেখা করতে পারবে। মালতীদি বারণ করে দিলে তো দেখাই হবে না আর!
-       তোমার স্কুলে বলতে হয় বলে দাও। কিন্তু তোমায় শুনতে হবে পুরো কথাটা।
-       কিসের পুরোটা? এখন কোথায় গিয়েছিলি?
অয়ন উত্তেজনায় প্রায় মুখস্ত বলার মত করে ওই পরিবারটির সাথে দেখা হওয়া, একসাথে পাহাড়ে চড়া, বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে মাজারের কাছে পৌঁছোনো, মালতীদির সাথে দিদি-ভাই পাতানো, আজ ওদের বাড়ি খোঁজা, মাকে যাতে অয়ন সব কথা সত্যি বলে তার জন্য মালতীদির দিব্যি দেওয়া ... সব শুনিয়ে দিল।
মা রীতিমত ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। ভিতরে ভয়ে কাঠ মেরে তবু বাইরে শান্ত থেকে তিনি রান্নার যোগাড় করতে লাগলেন। রান্নায় মন বসছিল না।
-       মালতী, ওই মেয়েটির বর কই?
-       জানিনা।
-       বিধবা? বিধবা মানে জানিস তো?
-       জানি। না।
-       তুই জিজ্ঞেস করিস নি?
-       ধ্যাৎ!
-       তুই ভাবিয়ে তুললি। তোর বেরুনো বন্ধ করতে হবে।
অয়ন রেগে থম্‌ মেরে নিজের পড়ার টেবিলের দিকে চলে গেল। তারপর মেঝেতে বসে ঘুড়ির কান্নি ঠিক করতে লাগল এক মনে।
দুপুরে অয়নের বাবা ফিরে এলেন। মা প্রথমে ভাবলেন এখন বলবেন না, কিন্তু না বলে থাকতেও পারলেন না। অয়নের বাবা কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে এখানে চাকরি পেয়েছিলেন। চাকরির চার বছরের মাথায় বিয়ে করেন। তাঁর স্ত্রী, মানে অয়নের মাও এমএ পাশ। এখানে আসার পর কিছু দিন স্থানীয় কিন্ডারগার্টেন স্কুলে পড়ান। অয়ন হওয়ার পরও কিছুদিন শিক্ষকতার কাজটা চালিয়ে যান, তারপর ছেড়ে দেন। ঠিক মত মাইনে নেই অথচ হ্যাপা অনেক। অয়নের বাবা মা দুজনেরই পুজোপার্বণ, থিয়েটার, বিচিত্রানুষ্ঠান ইত্যাদি যে কোনো সামাজিক সাংস্কৃতিক কাজেকর্মে, ডাক আসলেই ঝাঁপিয়ে পড়ার সুনাম আছে।
বাবা অয়নের বিরুদ্ধে দায়ের করা নালিশগুলোকে মনে মনে গুরুত্ব দিলেও মুখে কিছু বললেন না, বরং বাঃ, ভালোই তো, অয়ন তো বড় হয়ে গেছে দেখছি, পরোপকারীও হয়েছে, তা একদিন ওই দিদিকে আর ওর বাবাকে আমাদের বাড়িতে ডেকে আনলেই হয় ... ইত্যাদি বলে অয়নের মন জানবার চেষ্টা করলেন।
অয়ন খেতে খেতে অস্ফুট স্বরে বলে উঠল, দিদি তো বলেইছে আমাদের বাড়িতে আসবে এক দিন। চল না, কাল যাবে ওদের বাড়ি? ডেকে আনতে?
অয়নের এরকম খোলা জবাবে বাবা একটু সতর্ক হলেন। তাই এড়িয়ে গিয়ে বললেন, ভালোই তো, যাওয়া যাবে। কিন্তু কথা হল, পড়াশোনার কী খবর? তোমার থার্ড টার্মিনাল তো এসে গেল!
অয়ন বুঝল না হঠাৎ পড়াশোনার কথা কোত্থেকে এসে পড়ল। তবুও আশ্বস্ত তো করল, পড়াশোনা তো করছিই।
মা এতক্ষণ শুনছিলেন। ঠান্ডা হুমকির স্বরে বললেন, বাবাকে বলে দিলাম, এবার যা ভালো বোঝো তোমরা কর। ক্লাস ফাঁকি দিয়ে এদিক ওদিক বেরিয়ে যাওয়া, অবাধ্যতা, মিথ্যে বলা এসব তো নাহয় বুঝে নেওয়া যায়। প্রশ্ন হল কোনো খারাপ চক্করে না পড়ে যাও। দিন কাল ভালো নয়।

পরের দিন অয়নকে বাবাকে নিয়ে মালতীদির বাড়ি যেতে হল না। মালতীদি নিজেই এসে গেল সকাল বেলায়। বাচ্চাটাকে বাড়িতে রেখে এসেছে।
অয়নের মায়ের সাথেই কথা হল বেশিক্ষণ। কিছু কথা নিচুস্বরেও হল। অয়ন একবার সাথে নিয়ে গিয়ে নিজের পড়ার ও খেলার জিনিষ রাখার জায়গা দেখিয়ে দিল।
অয়ন লক্ষ্য করল মালতীদি সারাক্ষণ নিজে থেকেই মাটিতে বসল। চা খেয়ে চায়ের কাপটা নিজে ধুয়ে রাখল। মা কিছু বললেন না।
দুপুরে অয়ন শুনল বাবা জিজ্ঞেস করছে মাকে, কেমন দেখলে মেয়েটাকে? মা চুপ করে রইলেন।
-       কী হল? কিছু বলছনা যে!
-       পরে বলব। এখন ঘুমোও।
বিকেলের একটু আগে মা আর বাবা উঠে পড়ল। বাইরের ঘরে গেল চা খেতে। অয়ন ঘুমের ভাণ করে উৎকর্ণ হয়ে পড়ে রইল। শেষে থাকতে না পেরে উঠে, মা, আমিও চা খাব বলে পড়ার ঘরে ঢুকে দরজাটা ভেজিয়ে দিল। এখান থেকে বেশি শোনা যায় বাইরের ঘরের কথাগুলো।
-       যা শুনলাম তা বলার মত না। ... আজকাল তো অবশ্য কোনো কিছুতেই আর আশ্চর্য হয় না। সবই হতে পারে। সিনেমার গল্প মনে হয়।
-       কী বলছ কিছু বুঝতে পারছি না। আর মেয়েটির হাঁড়ির খবর, যদি কিছু থাকেও, তা নিয়ে দরকার কী? আমি বলছি, তুমি যে ভয় পাচ্ছিলে ছেলে কোনো খারাপ চক্করে না পড়ে, সে আশঙ্কা মিটেছে তো?
-       খারাপ চক্করের কথা নয়। মেয়েটির ব্যাপারে (মায়ের গলা খাটো হতে অয়নও ভেজানো দরজার কাছে চলে এল শুনতে) সব কিছু যদি অয়ন জানতে পারে! ... মেয়েটির বিয়ে হয়নি, সিঁদুরও পরে না, অর্থাৎ লুকোতেও চায় না যে ওর বাচ্চাটা ...
-       প্রেম করে পিছিয়ে যাওয়ার গল্প?
-       না, অনেক বেশি জটিল ... ওকে কিছু বদমাইস তিন বছর আগে কিডন্যাপ করে ... তখন ওরা আরেকটু মফস্বলে থাকত... ছোটো জায়গা, থাকা সম্ভব ছিল না বলে এখানে উঠে এসেছিল ... হ্যাঁ, পুলিসে নালিশ করেছিল, মামলাও চলছে ... কিন্তু ওর পক্ষে রায় বেরোবে কিনা সন্দেহ ... ওই বদমাইসদের জন্য মামলায় পয়সা ঢালার লোক আছে ... তবে এখন যিনি জেলাশাসক, তিনি নাকি সৎ লোক ... মালতী তাঁর সাথে দেখা করেছিল ... তিনি যেভাবে সম্ভব সাহায্য করবেন বলেছেন ... কথা হচ্ছে, অয়নের তো এসব বোঝার বয়স হয় নি! ওর মনের ওপর কেমন প্রভাব পড়বে ...
-       একটু শক্ত হাতে বন্ধ করে দাও এই মেলামেশাটা। মেয়েটিকেও সাবধান করে দেওয়া যাবে যেন ও অয়নের সাথে না মেশে!
-       সেটাই খারাপ লাগছে। ... মেয়েটি এত সৎ ও নির্ভীক ... ও তো অন্য কিছু বানিয়েও বলতে পারত! ... আর এত আত্মসম্মানবোধ! ভালো ঘরেরই মেয়ে, মা নেই, আর জ্ঞাতিগুষ্ঠিরা ওর এই বাচ্চাটাকে জন্ম দেওয়ার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তাই এখন যেমন তেমন করে থাকছে, সেলাই ফোঁড়াই করে দিনগুজরান করছে। বিজ্ঞানে উচ্চমাধ্যমিক করেছে ... অথচ যেহেতু ও জানে যে আমাদের বাড়িতে সাধারণভাবে ওকে সম্মানের সেই জায়গাটা কেউ দেবে না তাই ও কিন্তু কোনো চেয়ারে বা সোফায় বসেনি ... এইখানে মাটিতে বসেছে, চা খেয়ে নিজের কাপটা নিজে ধুয়ে রেখেছে ...
-       মানা কর নি?
-       না, আমি একটু যাচাই করছিলাম ওর ব্যবহার।
-       বাব্বা, তুমি এত বেশি চিন্তাভাবনা করছ যেন কাল ওদের এবাড়িতে এনে তুলবে!
-       তা নয়। আর এটা কম্পানির কোয়ার্টার। নিজের বাড়ি হলে আমি সত্যিই ওই ধরণের চিন্তাকে প্রশ্রয় দিতাম। ... আসলে, মেয়েটির সাথে দেখা হওয়ার পর আমি সত্যি চাইনা এমন কিছু করতে যাতে মেয়েটি মনে আঘাত পায়। যদি অয়নকে ওর সাথে দেখা করতে বাধা দিই, ও এত বোকা নয় যে বুঝতে পারবে না। আর অয়নও তো এক ক্লাস পালিয়ে যাওয়া ছাড়া সত্যি কোনো খারাপ কাজ করেনি। কিন্তু ... কলোনির পরিবেশ ... কাল কানাঘুষোয় এ নিয়ে কথা উঠবেই ...
-       আচ্ছা, ও থাকার ঘরটা পেল কী করে?
-       সে আরেক গল্প ওই বাড়ির মালিক ওই বাজারের পুরোনো মহাজন এবং স্থানীয় ও আগে থেকেই ওই বদমাইস তিনটেকে চিনত এবং কোনো জমিবাড়ি সংক্রান্ত ব্যাপারে শত্রুতা ছিল তাও অন্যান্য ভাড়াটেদের বিরোধিতায় বাড়ির ভিতরে ঘর দিতে পারেনি, পিছনের জমিতে পুরোনো গ্যারেজএ থাকতে দিয়েছে
অয়ন আর পারছিল না। মায়ের প্রতি ভালোবাসায় কাঁদতে কাঁদতে নিজের পড়ার টেবিলে চলে গেল। চোখের জলটা সদ্য শুকিয়েছে, তখনই মা চা নিয়ে ঢুকল, চা দিলাম। কিন্তু দুধটা না খেয়ে কিন্তু খেলতে বেরোবি না।

                                                     
দুমাস কেটে গেছে। পুজো এসে গেছে। এফ-সেক্টরের কলোনিতে পুজো বেশ ঘটা করেই হয়।
দুমাসে মাত্র একবারই মালতীদির সাথে অয়নের দেখা হয়েছে। মা ওকে সঙ্গে করে মালতীদির বাড়ি নিয়ে গিয়েছিল এক শনিবার। এমনিতেও ও আভাস পেয়েছে যে স্কুলে এবং বাড়িতে ওকে একটু চোখে চোখে রাখা হচ্ছে।
পুজোর ঠিক আগেই একসঙ্গে দুটো ঘটনা ঘটল।
অয়নদের স্কুলে একজন টিচার আছেন কে কে চৌধুরি। এডহক ভিত্তিতে অস্থায়ী চাকরি। এডহক টিচার বেশ কয়েকজন আছেন কিন্তু কে কে চৌধুরিকে সবাই চেনে। বাকি সকলে, তাদের চাকরিটা অস্থায়ী হওয়ার দরুন প্রিন্সিপ্যাল বা অন্যান্য সিনিয়র টিচারদের সমীহ করে চলে। চৌধুরি স্যার এমনিতে হাসিখুশি, কথা কম বলেন। কিন্তু কারোর প্রতি কোনো অন্যায়, অবিচার হওয়ার প্রশ্নে সে যদি চৌধুরিস্যারকে বিষয়টা বুঝিয়ে কনভিন্স করতে পারে তাহলে তাকে আর পায় কে! চৌধুরিস্যার তুলকালাম করে দেবেন তার জন্য। ... স্কুলের ছেলেমেয়েদের কথাবার্তায় অয়ন শুনল যে চৌধুরিস্যার বিয়ে করবেন। আর বিয়ে হওয়া এবং বিয়ে করার মধ্যে কিছু রহস্যময় তফাৎ আছে যা উঁচু ক্লাসের ছাত্ররা জানে। তাছাড়া এই বিয়ে করার ব্যাপারটা নিয়ে প্রিন্সিপ্যালস্যার এবং অন্যান্য টিচারেরা খুবই অসন্তুষ্ট। যাকে বিয়ে করবেন তার নাম নাকি মালতী দেবী।
রাত্রে নিজের ঘরে বসে অয়ন পড়ছিল। হঠাৎ শুনল বাবা ফিরে এসে মাকে বলছে, শুনেছ? তোমার মালতী তো এখন খবর! ও মামলায় জিতে গেছে। দোষী তিনজনের সাজা হয়েছে। বর্তমান ডিএম নিজে উদ্যোগ নিয়েছিলেন মালতীর বিয়ের। একটি ছেলে এগিয়েও এসেছে। অয়নদের স্কুলে টিচার!
অয়ন আর থাকতে পারল না। পড়ার টেবিল ছেড়ে লাফিয়ে উঠে এসে বলল, আমি জানি। তাঁর নাম চৌধুরিস্যার, কে কে চৌধুরি। বিয়েটা করলে বোধহয় ওনার চাকরি থাকবে না।

স্কুল সরগরম। চৌধুরিস্যারকে রিজাইন করতে বলেছে প্রিন্সিপ্যাল। রিজাইন না করলেও, এ্যাডহক তো, সরিয়ে দিতে সমস্যা হবেনা, নালিশকারী অভিভাবকদের আশ্বস্ত করেছেন প্রিন্সিপ্যাল। টিফিনে অয়ন হঠাৎ ক্ষেপে উঠল বন্ধুদের মাঝে কথাটা শুনে।
-       রিজাইন করতে বলা হয়েছে? বললেই হল? কী দোষ করেছেন উনি?
-       তুই জানিস না? উনি যাকে বিয়ে করছেন সেই মহিলা ...
-       কী, বল?
বাকিরা চুপ করে থাকে। অয়ন এত উত্তেজিত হল কেন তাও তারা বুঝতে পারে না।
-       আমার সাথে যাবি?
-       কোথায়?
-       টিচার্সরুমে, চৌধুরিস্যারের কাছে।
-       পাগল নাকি? ওখানে সব টিচারেরা আছে!
-       তাই তো যাব। যাবি?
-       কিন্তু যাবি কেন?
-       জিজ্ঞেস করব, ওনাকে প্রিন্সিপ্যালস্যার কেন রিজাইন করতে বলেছেন!
-       দ্যাখ, সত্যি যদি যেতে হয় তাহলে চল উঁচু ক্লাসের দাদাদিদিদের কাছে আগে যাই। ওরা সঙ্গে থাকলে একটু জোর থাকবে।
-       ঠিক আছে। তাই চল।
ওরা পাঁচ ছজন গেল মাঠের ওধারে যেখানে ক্লাস নাইনের কয়েকজন ছেলে জটলা করে বসেছিল অয়নের প্রস্তাবটা শুনে ভুরূ কুঁচকে উঠল ওদের
-       রিজাইন করতে প্রিন্সিপ্যালস্যার বলেছে, করলে করবে চৌধুরিস্যার, তোর তাতে কী? তুই জানিস পুরো ব্যাপারটা?
-       আমি মালতীদিকে চিনি খুব ভালো করে চিনি খুব ভালো দিদি কিন্তু সেটা প্রশ্ন নয়, প্রশ্ন হল কে কোথায় বিয়ে করবে না করবে তা নিয়ে চাকরী ছেড়ে দেওয়ার কথা উঠবে?
-       ক্লাস সিক্সে পড়িস পেকে গেছিস পুরো এবার তোকে স্কুল ছাড়তে বলবে প্রিন্সিপ্যালস্যার চল্‌ ফুট্‌
যে কজন সহপাঠী ছিল তাদেরকে নিয়ে অয়ন গেল টিচার্সরুমে, চৌধুরিস্যারের কাছে
-       আপনার সাথে কথা বলতে চাই স্যার!
-       কী হল? তুমি কোন ক্লাসে পড়? নাম কী?
-       ক্লাস সিক্স, সেকশন ডি আমার নাম অয়ন দাস
-       কী কথা বলতে চাও
-       আপনাকে প্রিন্সিপ্যালস্যার রিজাইন করতে বলেছেন এটা অন্যায় আমরা প্রিন্সিপ্যালস্যারকে বলতে চাই
চৌধুরিস্যার ভালো করে অয়নের আপাদমস্তক দেখলেন
-       তুমি ...
-       আমি মালতীদিকে চিনি স্যার আমি ওনাকে দিদি বলি
চৌধুরিস্যারের মুখ দিয়ে কথা সরছিল না অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, তুমি বললে, আমরা! আমরা কই? তুমি তো একা! অয়ন পিছনে তাকিয়ে দেখল বন্ধুরা দরজার আরো পিছনে সিঁটিয়ে যাচ্ছে চৌধুরিস্যার হেসে ফেললেন, দেখ, তুমি ছোটো ছেলে তোমার এসবে পড়ার কোনো প্রয়োজন নেই তুমি মালতীকে যখন চেন বলছ ... জানিনা অবশ্য কীভাবে চেন ... সে যাই হোক, তাহলে তুমি আমার বন্ধুও বটে নাও, হাত মেলাও (হাত বাড়িয়ে ওর হাতটা ধরে নাড়িয়ে দেন) আর তোমার ফিলিংসের জন্য ধন্যবাদ ... কিন্তু তুমি ওকে চিনলে কী করে? মানে ...

                                                         
অয়ন দারুণ ব্যস্ত ইদানিং
নিজের বাবা মার জন্য এত গর্ব অয়ন আগে কখনো আলাদা করে অনুভব করেনি মা সিদ্ধান্ত করেছেন যে মালতীর বিয়ে উনি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে দেবেন বাবাও তাতে একমত বাবার, প্রথমে একটু দোনামনা ছিল কিন্তু একবার মনস্থির করে নেওয়ায় যেন ফিরে গেছে নিজের আগের দিনগুলোয় বরং অফিসের দুচারজন সহকর্মীকেও জুটিয়ে নিয়েছে এই সৎকাজে

মালতীদের আশ্রয় বাজারের সেই বাড়িটা থেকেই দুপুর নাগাদ মালতী বেরুলো অয়নের মা তাকে সাজিয়ে দিয়েছেন, একটা বেনারসী শাড়ি উপহার হিসেবে তাকে দিয়ে সেটাই পরিয়ে দিয়েছেন গয়না বলতে পুরোটাই রুপোর সেট, সোনার জলে কাজ করা এই সেটটা অয়নের বাবার বন্ধুরা মিলে দিয়েছে মালতীর সাথে অয়নের মা, মায়ের কোলে মালতীর বাচ্চাটা, মালতীর বাবা, অয়ন ... ঘাসজমি পেরিয়ে, দুধাপ সিঁড়ি বেয়ে উঠে, গলিপথটা পেরুতেই দেখা গেল উঠোনের চার দিকের ঘরগুলো থেকে উঁকি মারছে মুখ, কিন্তু কেউ এগিয়ে আসছে না
শুধু বাঁদিকের প্রথম দরজার সেই মোটা মহিলা, যাকে অয়ন মালতীদি কোথায় থাকে জিজ্ঞেস করেছিল, এগিয়ে এলেন তাঁর চোখে জল অয়নের মায়ের কাছে এসে হাতজোড় করে বললেন, আপনারা ছিলেন বলে দিদি, এই অভাগীর একটা গতি হল আমরা তো ওকে খরচের খাতাতেই ধরে রেখেছিলাম ...মানুষ চাইলে কী না হয়!
অয়নের বাবা একটা গাড়ি যোগাড় করে এনেছেন আরেকটি গাড়িতে বাবার বন্ধুরা যেতে হবে দূরে এখানে বাড়িতে রেজিস্ট্রার ডেকে রেজিস্ট্রি করান ঝামেলাও যেমন, তার ওপর এটাও প্রশ্ন ছিল কোন বাড়িতে হবে! অয়নের বাবা প্রস্তাব দিয়েছিলেন তাঁদের ফ্ল্যাটের, কিন্তু মালতী রাজি হয়নি তাই রেজিস্ট্রারের অফিস চৌধুরিস্যারও সোজা রেজিস্ট্রি অফিস পৌঁছোবেন সঙ্গে থাকবেন তাঁর দুতিন জন বন্ধু তাঁর বাবা মা বা বাড়ির কেউ এ বিয়েতে আসছে না, তাঁরা এই বিয়েটা মানবেন না বলে দিয়েছেন

রেজিস্ট্রারের অফিসে জেলাশাসকও এসেছিলেন বয়স চল্লিশের রোগা পাতলা লম্বা এক মানুষ দুজনকে ফুলের তোড়া দিয়ে অভিনন্দন জানালেন দুতিনজন সাংবাদিক এসেছিলেন তাঁরা জেলাশাসককে প্রশ্ন করলেন, আপনি স্যার এই উপলক্ষে যুবসমাজের উদ্দেশে কিছু বলতে চাইবেন না? মানে, এই ধরণের সংস্কারমূলক ভাবনাচিন্তা যাতে... মাঝখানে চৌধুরিস্যার বলে উঠলেন, যদি ডিএম সাহেব কিছু মনে না করেন, আমি এই প্রশ্নে আমার আপত্তি জানাচ্ছি সংস্কার ইত্যাদির প্রশ্ন এখানে অন্ততঃ আমার দিক থেকে নেই আমি কাউকে উদ্ধার করিনি মালতীর জীবনের ঘটনাটা অন্য এক সুত্রে আমি জানতাম তাই কোর্টে মামলার তারিখে আমিও উপস্থিত থাকতাম দেখতাম জল কোন দিকে গড়াচ্ছে সেখানেই মালতীকে দেখে আমি তার স্বাভিমান আর দর্পকে ভালোবেসেছিলাম তার সংগ্রামটাকে সম্মানের চোখে দেখেছিলাম আর এমন এক নারীকে জীবনসাথী হিসেবে পেতে চেয়েছিলাম তখনই এই আমাদের ডিএম সাহেব এখানে বদলি হয়ে এলেন আর এই মামলায় নিজে ইন্টারেস্ট নিলেন উনি ইন্টারেস্ট না নিলে মালতী ন্যায় পেত না, দোষীদের সাজাও হত না আমি ডিএম সাহেবের কাছে গিয়েই আমার মনের কথা বললাম জেলাশাসক মুচকি হেসে বললেন, হ্যাঁ, ঠিক তাই বলতে গেলে আমি শুধু ঘটকের কাজ করেছি যুবসমাজের কথা বলছিলেন না? এই চৌধুরিবাবুর মত যুবক থাকতে হবে তো! আমি, আমরা, সবাই কি চাইব না এ ধরণের যুবক অনেক অনেক হোক আমাদের সমাজে?
-       মালতীদেবী আপনি কিছু বলবেন?
-       আমি একাই লড়ছিলাম যারা আমাকে নষ্ট করেছিল তাদের শাস্তি দেওয়ানোর সাথে সাথে একটা বড় প্রশ্ন ছিল আমার পথে নিজের লজ্জা, দ্বিধা ও সঙ্কোচ কাটিয়ে নিজেকে ফিরে পাওয়া সেই ফিরে পাওয়ার লড়াইয়ে ডিএম সাহেব যেমন অভিভাবকের মত এগিয়ে এলেন তেমনই বন্ধুর মত পেলাম অয়নকে কোথায়, অয়ন?
অয়নের খোঁজ পড়াতে ওর মা ওকে ঠেলে এগিয়ে দিল মালতীর দিকে
-       এই যে, অয়ন তারপরই এক সাথে এই কয়েক মাসে অনেক কিছু ঘটে গেল কাকতালীয় হতে পারে কিন্তু আমার এই ছোট্টো ভাইটিকে পাওয়া আমার বিরাট বড় পাওয়া
চৌধুরিস্যার হাসতে হাসতে পাশে এসে অয়নের কাঁধে হাত রাখলেন, আরে আমাকেও নিন শালাসাহেব, আপনাদের ভাইবোনের ছবির ফ্রেমে!
দুতিনটে ক্যামেরার ফ্ল্যাশ একসাথে অয়নের সলজ্জ মুখের ওপর ঝলসে উঠল

---------