Monday, June 27, 2016

মাখন

দুপাশের ক্ষেত থেকে উপসাগরীয় সন্ধ্যার ধূসর অন্ধকার উঠে আসছে রাস্তায়।
সারাদিন সাইকেল চালিয়েছি নোনা গরম হাওয়ার বিপরীতে। চট্‌চট্‌ করছে চোখমুখ। অবশ্য এখন আর সে তাত নেই। আরাম দিচ্ছে একটা ভেজা ঠান্ডা ভাব। গায়ের জামাটা খুলে জড়িয়ে রেখেছি হ্যান্ডেলে।  
          পকেটের অবস্থা বুঝে দুপুরে কিছু খাই নি, আখ চুষেছি। মানে, সকালের জলখাবারটা ভালোই হয়েছিল। দুপুর নাগাদ পৌঁছই একটা মেঠো গুড়ের ভাটিতে। গিয়ে আখ চাইতে একজন ইশারায় জানালো, ‘এখানে নয়, মহাজন টের পেয়ে যাবে, ওই গরুর গাড়ীটার কাছে যাও’। সেই গরুর গাড়ীর চালকই আখ দিয়েছিল এক আঁটি। তাও ভালো করে কেটে, পাতার দড়ি দিয়ে বেঁধে।

          এই মহাজন-মালিক-ধনিক বা বলা যায় তাদের ‘পুঙ্গব’ নামক বস্তুটিকে কয়েকদিন আগেই অন্ধ্রের, বোধহয় রাজামুন্দ্রির পরেই কোনো একটা গ্রামে দেখেছিলাম। গরম দুপুর। হাইওয়ে থেকে একটু নেমে একটা বন্ধ চায়ের দোকানের পাশ দিয়ে এগিয়ে একটা মাটির রাস্তা চলে গেছে। দুপাশে বিহারেরই মত বেহায়ার বেড়া, দুস্থ কুঁড়েঘর। শেষপ্রান্তে বাঁদিকে হঠাৎ দেখি একটা বড় পেয়ারা বাগান। থোকা থোকা পেয়ারা ফলে আছে, পাকা, ফিকেসবুজ, হলুদ। একটা ছিমছাম ঘর ঢোকার মুখে। কুঁড়েই বলা যেতে পারে কিন্তু পরিচ্ছন্ন সুদৃশ্যতা আর উচ্চতায় তফাৎটা স্পষ্ট। আমরা দরজায় ধাক্কা দিতে একটি সুন্দর যুবক হাতে বই নিয়ে বেরিয়ে এল। দেখতে আমাদেরই মত শহুরে। ভরসা হল। পাটনা-বিহার থেকে আসছি, কলেজের ছাত্র, কন্যাকুমারী যাচ্ছি, সাইকেল ট্যুর, গুড স্পোর্ট ইত্যাদি বলে ক’টা পেয়ারা চাইলাম।… দূর দূর করে ভাগিয়ে দিল বলতে গেলে! গালাগাল দিতে দিতে গ্রাম থেকে বেরিয়ে আসছি। কয়েকজন বয়ষ্কা, অল্পবয়ষ্কা মেয়েলোক কাঁখে ভরা কলসি নিয়ে হাইওয়ে থেকে নামছে – খাওয়ার জল নিয়ে আসছে কোথাও থেকে - আমাদের পথ আটকাল। জানি না কী বুঝল আমাদের কথা। চায়ের দোকানটায় গিয়ে ভিতরে ঢুকে দোকানির ঘুম ভাঙাল, উনুনে আঁচ জাগাতে বলল, চা খাওয়াল আমাদের, নিজেদের মধ্যে চাঁদা করে দাম মেটাল, তারপর ছাড়ল। ‘পুঙ্গব’ শব্দটার অর্থ বুঝলাম সেদিন।

          সত্তর মাইল আজ সাইকেল চালানো হয়ে গেছে। দশ মাইল দূরে বিরালিমালাই। সেখানেই রাতে বিশ্রাম নেব।
          আকাশে তারা ফুটছে দুটো একটা করে। দিগন্তের দিকে এক চাপ ভেজা ভেজা মেঘ। “কত তারিখ রে আজ?” বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলাম।
          “থার্ড মার্চ নাইন্টিন সিক্সটিনাইন”, দাঁত চেপে বলা উত্তর পেলাম।
-      খিদের চোটে ক্ষেপে গেছিস? ওই দিনে তো আমরা পাটনা থেকে রওনা দিয়েছিলাম!
-      ক্যালেন্ডার গলায় ঝুলিয়ে তো আর রওনা দিই নি!
-      ডাইরিটা কোথায়?
-      তোর ব্যাগেই তো আছে! খুলে দেখ! পেট জ্বলছে, উনি এখন বার তিথির হিসেব করবেন পাঁজি খুলে।
-      আরে দূর! মোটামুটি কতদিনে পৌঁছব কন্যাকুমারী তার হিসেব কষছি।
-      বেঁচে থাকলে ঠিকই পৌঁছে যাব।
-      বাঁচবি, বাঁচবি!
-      তোর ওপাশের মালটিকে জিজ্ঞেস কর না, কিছু আছে কিনা ওর দুধের ড্রামে, বেঁধেছেঁধে রাখা। শহর থেকে ফিরছে, কিছু না নিয়ে কি আর ফিরবে? এই…চানাচুর-মানাচুর, কী যেন বলে – বোন্ডা…

ছেলেটি আমাদের সাথে কুড়ি মাইল ধরে আসছে। রোগা ছিপ্‌ছিপে চেহারা। মুখটা লম্বাটে, কচি। আমাদের থেকে দু’তিন বছর ছোটো হবে বয়সে। চুল কোঁকড়া, দ্রাবিড় ধাঁচের একটু চাপা থুতনি। গায়ের রঙ কফি। চোখ কালো। আমাদের সাথে দেখা হওয়ার পর থেকে তাতে বিষ্ময়ের রঙ লেগে আছে। গায়ে আধময়লা গেঞ্জি আর স্থানীয় ধরণে দুপাট করে পরা লুঙ্গি। সাইকেলের পিছনে ক্যারিয়ারে বাঁধা একটা বড় দুধের ড্রাম – খালি বলে রাস্তার এবড়ো খেবড়ো জায়গাগুলোয় ঢুমঢুম আওয়াজ করছে।
এতক্ষণ হয়ে গেল, তবু খুব কম কথা হয়েছে আমাদের মাঝে। অথবা বলা যায়, অনেক হয়েছে, হয়েই চলেছে, কিন্তু বুঝেছি খুব কম। ছেলেটি হিন্দি জানে না। ইংরেজী জানার প্রশ্নও ওঠে না। আর আমাদের এক বর্ণ তামিল বোঝার কোনো প্রয়োজন হয় নি কখনো। আমার বন্ধুটি আবার বদমায়েসি করে মাঝে মধ্যে বাংলাও ঝাড়ছে।
          যে কটি কথা বুঝতে পেরেছি তা এইঃ ছেলেটি সামনের এক গ্রামের বাসিন্দা। এক ধনিকের বাড়িতে কাজ করে। নানান কাজের মধ্যে এটাও তার একটা কাজ যে সকালে যা দুধ হয় ধনিকের বাথানে, তার এক অংশ বাইশ মাইল দুরের শহরটির কিছু হোটেলে সে যোগান দিয়ে আসে। যাওয়া আসাটা সাইকেলেই করে। সন্ধ্যায় ফিরে এসে মালিককে বিক্রি বুঝিয়ে দেয়। সে কি বন্ডেড লেবার ছিল? – তখন শব্দটা জানতাম না, তাই জিজ্ঞেস করি নি।
         
          এবার সে থামল। বাঁ দিকে দেখাল আঙ্গুল দিয়ে। ক্ষেতের পর ক্ষেত – অন্ধকারে আভাস পাওয়া যায় – কোথাও খাড়া ফসল, কোথাও কাটা হয়ে গেছে আর দূরে টিমটিম করছে কয়েকটি আলো।
          দুমাস পর আমরা যখন বাড়ি ফিরেছিলাম, মা আমায় প্রশ্ন করেছিল, “এত দূরে দূরে ঘুরে এলি, মাঝে মধ্যে একেকটা চিঠি লিখলে কী হত? কত দুশ্চিন্তায় থাকতাম আমরা সবাই”। আমি নিজের আলস্য ঢাকতে আর মাকে একটু রাগাতে জবাব দিয়েছিলাম, “কী করব! পয়সাই ছিল না। একটা পোস্টকার্ডের যা দাম, তা দিয়ে দুটো ইডলি হয়ে যেত সকালের জলখাবারে”। কথাটা সত্যি হলেও বলার কোনো প্রয়োজন ছিল না। মা কিছু বলে নি, শুধু ছোট্টো একটা নিঃশ্বাস ফেলেছিল।…
          ছেলেটি বোঝাল ওটাই তার গাঁ। তারপর আমাদের দিকে ফিরে তাকিয়ে সসঙ্কোচে কিছু বলল। অন্ধকারে তার মুখটাও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল না। তাই কিছুই বুঝলাম না তার কথা।
          আরো দু’একবার বলতে আকারে ইঙ্গিতে বুঝতে পারলাম। বলতে চাইছে যে সে আমাদের কিছু দিতে চায়। এত দূরের যাত্রায় বেরিয়েছি ঘর-পরিবার ছেড়ে! সে তো কোনোদিন এভাবে দেশটাকে ঘুরে দেখার কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারবে না। নাহয় আমাদের কিছু দিতে পারার সুখটা তার থাকবে! কিন্তু!…
          আমরা দুজনেই সমস্বরে না না করে উঠলাম। আমার বন্ধুটি মুখে বদ। না’এর মাঝেই আস্তে করে বাংলায় ফুট কাটলো, “সব পয়সা দিতে হবে না, আদ্ধেক দিলেই চলবে।”
-      কী বললি?
বলে, তাকিয়ে দেখি বন্ধুটি দূরে আকাশে তাকিয়ে বলছে, “কী ন্যাচারাল সিনারি মাইরি!
আমি ছেলেটিকে জোরগলায় বললাম, “তোমায় কিচ্ছু দিতে হবে না। বরং খুব ইচ্ছে হয় তো বিড়ি খাইয়ে দাও।“ কোঁচড়ের দিকে দেখিয়ে ফের ঠোঁটে দুআঙুল ছুঁইয়ে ইশারা করলাম, “আছে বিড়ি?”
ছেলেটি কিছুই শুনতে পেল বলে মনে হল না। তখনো আমাদের ইশারায় বুঝিয়ে বুঝিয়ে, বলে বলে চিন্তা করছে – ‘পয়সা তার নয়। দুধের মাপে হিসেব করা আছে মালিককে দিতে হবে।… সাইকেলের পাংকচার ঠিক করার নামে… হবে না।…’। একটা ছোটো নিঃশ্বাস ফেলে মাথাটা নুয়ে পড়ল তার।

দূরের ওই টিমটিম আলো কয়েকটি আরো স্পষ্ট হচ্ছিল সামনের ক্ষেতগুলোয় অন্ধকার ছড়িয়ে পড়াতে।
হঠাৎ অন্ধকারে হেসে উঠল সে। কিছু একটা খুঁজে পাওয়ার আনন্দে। দুধের ড্রামটা খুলে ভিতরে হাত ঢোকাল। কাচিয়ে কাচিয়ে কিছু তুলতে লাগল ঢাকনাটায়। প্রথমে বুঝতে পারিনি। কাছে গিয়ে দেখি মাখন। অতটা দুধ নিয়ে গিয়েছিল শহরে, বাইশ মাইল নাড়াচাড়াতেই বেশ খানিকটা মাখন বেরিয়ে লেগে রয়ে গিয়েছিল ড্রামের গায়ে।
-      দেখে নে! দেখে নে! মালিক এ জিনিষটার হিসেব নেয় না। শালা নিজে খায় রোজ।
-      নিজে খায়, না মালিকের ছোটো নাতিটাকে খাওয়ায়, তুই জানলি কিভাবে?
-      তাহলে কী বলবে আজ মালিককে?
-      তা আমি কী জানি! হয়ত বকুনি খাবে! মার খাবে! আরো অনেক মার-বকুনির সাথে এটাও শামিল হবে!
-      বাব্বা! ফিলসফি!…

আধঢাকনি মত হল। আমাদের দিকে এগিয়ে দিয়ে ইশারা করল খেয়ে নিতে। আবার ইশারাতেই, চিনি ছড়িয়ে দিতে না পারার আক্ষেপটাও বোঝাল।
-      এঃ, চিনি ছাড়া কাঁচা মাখন! খেয়েছিস কখনো?
-      আমি কোত্থেকে খাব! তোর তো তবু, বলেছিস গ্রামে আসাযাওয়া আছে।
-      হ্যাঁ, হ্যাঁ! গ্রামে আমাদের ভরা গোয়াল, দশটা দুধেল গাই…
-      চুপচাপ খা!

মাখনটুকু খাওয়া হতে, ঢাকনিটা নিয়ে যথাস্থানে লাগিয়ে ছেলেটি এবার কোঁচড় থেকে তিনটে বিড়ি বার করল। বিড়ি ধরিয়ে, কয়েক ফুঁক একসাথে টেনে, শেষে আমরা বিদায় নিলাম।
চুপচাপ এগিয়ে যাচ্ছিলাম। একবার পিছন ফিরে তাকাতে দেখলাম ছেলেটি আলের পথে কিছুটা এগিয়ে, আমাদের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বিড়ির লাল বিন্দুটা তার ঠোঁটের কাছে একবার দীপ্ত হয়ে উঠল।



Tuesday, May 31, 2016

প্যানক্রিয়াস


অম্লাশয়ের রোগ শুনলেই মলয়ের কানে হাত থেকে বাসন ফস্কানো থামাবার আওয়াজ বাজে। আশ্চর্য, অন্য অনেক রকম আওয়াজ বা সংকেত ভেসে উঠতে পারত। যেমন সমরবাবুর ডাক, ডিরোজিওর লিনোকাট
অথচ না! এক বয়স্ক নারী শ্রান্ত হাতে বাসনগুলোর ফস্কে যাওয়া আটকান। ধাতু আর দেয়ালের ঘষটানির শব্দ ওঠে বন্দ কাঁসরের মত কিছুটা। শ্রান্ত স্বরে বলেন স্বামীকে, “ফোনটা বাজছে তখন থেকে, ওঠাও না!”
বুড়ো মানুষটার চমক ভাঙে। ফোনটা উঠিয়ে টেপেন, “হ্যাঁ বৌমা, আগামীকাল রওনা দেব আমরা। পরশু সকালে পৌঁছোবো। চিন্তা কোরো না। হাসপাতাল থেকেই বলছ? কেমন আছে আজ ত্রিদিব? (একটা নিঃশ্বাস ছোট্টো করে ছাড়েন) রুমি আছে পাশেই? দাওনা একটু কথা বলি দিদুভাইয়ের সাথে। ও হ্যাঁ, ধরো, মাকে দিচ্ছি ফোনটা।”

“বাংলার নবজাগরণ কি একটা ইস্যু, বিহারে?” কথাটা খুব আস্তে বলতে চেয়েও মলয়ের মুখ ফস্কে বেশ জোরে বেরিয়ে গেল। আর সবাই তো শুনলোই, অল্প দূরে বসে থাকা সমরবাবুও শুনে ফেললেন। কাজেই কথাটার মুখ ঘোরানো ছাড়া আর কোনো উপায় রইল না।
“বাংলার নবজাগরণকে বিষয় করে কোনো আয়োজন করা সত্যিই খুব কঠিন” আগের কথাটা থেকে সুত্র নিয়ে মলয় পুরো হলঘরকে সম্বোধন করল, “তার আগে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দিই। সমরবাবু, একটু উঠে দাঁড়ান। ইনি সমর মিত্র। কলকাতায় থাকেন। এখানে এসেছিলেন ব্যক্তিগত, পারিবারিক কাজে। উনি কিছুই জানতেন না; বিহারে বাঙালি কোথায় থাকে, তারা কী করে। অথচ এই সত্তর বছর বয়সে প্রথম বিহারে এসে উনি আমাদের খুঁজে নিলেন। একসাথে সবাইকে, মানে যাকে বলে অকুস্থলে বামাল পাকড়াও করলেন পুরো গ্যাংটাকে।
“সে যা হোক, বিশুবাবু আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পর উনি সরাসরি প্রশ্ন করলেন যে আমরা ডিরোজিওকে নিয়ে কিছু করছিনা কেন? আপনারা যাঁরা ডিরোজিওর নাম শোনেন নি তাঁদেরকে সংক্ষেপে বলি যে উনবিংশ শতাব্দীর বাংলায় নবজাগরণ বলে যে একটি বিপ্লব চিন্তাচেতনার ক্ষেত্রে ঘটেছিল, যার প্রধান কিছু ব্যক্তিত্ব হিসেবে রামমোহন, বিদ্যাসাগর প্রভৃতি নাম আপনারা শুনে থাকেন, সেই নবজাগরণের একটা পুরো প্রজন্মকে যিনি শিক্ষক হিসেবে নব্যচেতনায় দীক্ষিত করেছিলেন তিনি হলেন, হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও। ক্ষণজন্মা এই মানুষটি মাত্র বাইশ বছর এই পৃথিবীতে ছিলেন। তাঁর জন্মের দ্বিশতবর্ষ এখন চলছে এবং তাঁর জন্ম এই বিহারের ভাগলপুরেই হয়েছিল।”
সামনে বসেছিলেন অধ্যাপক ইন্দুভূষণবাবু। চেঁচিয়ে শুধরে দিলেন, “জন্ম হয়নি, কিছুদিন এসে ছিলেন ভাগলপুরে। তখন তাঁর বাবা থাকতেন সেখানে, কর্মসুত্রে।”
ততক্ষণে ধীর পায়ে সামনে এগিয়ে এসেছেন সমরবাবু। মলয় এগিয়ে গিয়ে তাঁকে হাত ধরে এনে বসায় ইন্দুভূষণবাবুর পাশে, “এখানেই বসুন স্যার!” দুজনকে আলাপ করিয়ে দেয়। কিন্তু সমরবাবু কিছু একটা বলতে উন্মুখ, মলয়ের হাতটা ধরে ইষৎ টানেন, “১৪ বছর বয়সে ভাগলপুরে এসে ডিরোজিও সেখানেই কবিতা লেখা শুরু করেন – ভাগলপুরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তাঁর মধ্যে স্বদেশপ্রীতি ও কাব্যপ্রীতি দুইই জাগিয়ে তোলে। ঠিক বললাম তো, ইন্দুভূষণবাবু?”
মলয় মাইকের কাছে ফিরে যায়।
“নিজেকে শুধরে নিচ্ছি, আক্ষরিক অর্থে জন্ম হয়নি, কবিজন্ম হয়েছিল ভাগলপুরে। কিন্তু, এসবকিছু সত্ত্বেও যা বললাম (মলয় হাত ওল্টালো) বিহারে এখন যা অবস্থা, ভাষাটাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বাঙালিরা লড়ছে, সেই পরিস্থিতিতে রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ করে নিই, যথেষ্ট, তাঁরা সর্বজনপরিচিত নাম, কিন্তু ডিরোজিও তা নন। তাহলে নবজাগরণের কন্টেন্টটাকে নিয়ে আলোচনা করতে হয়। সেসব গুরুগম্ভীর একাডেমিক বিষয়। বাংলা ডিপার্টমেন্টে হলেও হতে পারতো, কী বলেন সুনন্দাদেবী?”

মলয় বসে পড়ে। এই ভাষণটা দেওয়ার আগে যার সাথে কথা বলা সে শুরু করেছিল তিনি সমিতির সভাপতি। সভা শেষ হয়ে চা’পান পর্ব চলছে বলে তিনিও নিশ্চিন্তে মলয়ের বক্তৃতা শুনছিলেন। হঠাৎ মলয় বসে পড়ায় তিনি ধন্ধে পড়লেন। সভা শেষ হলেও তিনি তো সমিতির সভাপতি। একটা শেষ কথা তো বলতেই হয়! একটু আশাও জাগিয়ে রাখতে হয়!
“সমর মিত্রকে স্বাগত জানাই। অনেকে পাটনায় থাকেন অথচ বলেন, ’সমিতি কী যে করে, কোথায় মিটিং-টিটিং হয়, কী প্রোগ্রাম করেন কিচ্ছু খবর পাইনা’। অথচ সমরবাবুকে দেখুন! এই বয়সে, প্রথমবার বিহারে এসে ঠিক আমাদের খুঁজে নিয়েছেন। সমরবাবুকে আমরা আশাহত করতে চাইনা। আমি বরং বলি, সমরবাবু, যদি আপনি পাটনায় আপাততঃ কিছুদিন থাকেন, তাহলে মাঝে মধ্যেই আমাদের এভাবে খুঁজে নিন। আমাদের অফিসের ঠিকানাটা বিশুবাবু আপনাকে দিয়েছেন নিশ্চই। আসুন সেখানে। আমাদের শিক্ষিত করুন। মুখ্যুসুখ্যু মানুষ আমরা। কোনোরকমে, দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে আমরা নিজেদের ভাষা, সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি। কিছু বিদ্বান মানুষও আছেন আমাদের মাঝে, এই মলয়বাবু, ইন্দুভুষণবাবু, সুনন্দাদেবী। আপনারা সবাই মিলে আলোচনা করে যদি মত দেন যেকী যেন নাম বললেন? ডিরোজিও। তা তাঁকে স্মরণ করে কোনো অনুষ্ঠান করার প্রস্তাব যদি আপনারা দেন তা নিশ্চয়ই সানন্দে আমরা গ্রহণ করবো। সত্যি তো, যেমন আপনারা বললেন, নবজাগরণী প্রজন্মের শিক্ষক, তাও আবার বিহারের ভাগলপুরে জন্ম, তাঁকে স্মরণ করা তো আমাদের কর্ত্তব্যের মধ্যে পড়ে!”

বিকেলে কাজ শেষ করে মলয় অফিসে তার কোনার ঘরটায় বসে ড্রয়ার থেকে ইউনিয়নের কাগজপত্রগুলো বার করছিল। রোজ ভাবে অদরকারিগুলো আলাদা করে ছিঁড়ে ফেলবে, ড্রয়ারটা একটু খালি হবে। হঠাৎ একটা মুখ ঘরের দরজা ফাঁক করে উঁকি দিল। “মলয়বাবু! আছেন তো!”
-     হ্যাঁ, হ্যাঁ, আসুন! বাঃ, আপনার দেখছি অচেনা জায়গা খুঁজে বার করার একটা নেশা আছে। আমাকে ফোন করলেই পারতেন। আমার পক্ষে আপনার ওই হোটেলে, কী যেন নাম বলেছিলেন? স্কাইল্যান্ডপৌঁছোনো খুব সহজ ছিল।
-     আপনি ব্যস্ত মানুষ। কবে সময় করে উঠতে পারবেন! আমার আর কি, দিন রাত চুপচাপ বসে বসে কাটানো। তার থেকে ভালো, ঘুরে বেড়াই। ঘোরাও হয়ে যায়, আপনাদের সাথে দেখাসাক্ষাৎও হয়ে যায়।
-     চা খাবেন?
-     খাবো। তার সাথে একটা সিগারেটও খাবো। কাজেই এখানে নয়। বাইরে যেতে আপনার অসুবিধে নেই তো?
-     কোনো অসুবিধে নেই। কাজ তো শেষ। এসব ইউনিয়নের কাগজপত্র ছাঁটাই-বাছাই করছিলাম।
-     খুব ইউনিয়ন করেন, না?
-     তা একটু করি।
-     দুটো একসঙ্গে ম্যানেজ হয়ে যায়? মানে এদিকে ইউনিয়ন, যাতে প্রায় সবাই অবাঙালি আর ওদিকে বাঙালি সমিতি অসুবিধে হয় না?
-     আমি বেসিক্যালি লেখাপত্তর নিয়ে থাকতেই ভালোবাসি। তবে আমার একটা স্ট্যান্ডপয়েন্ট আছে। যে কাজে আমার ভাত জুটছে, সেখানকার ইউনিয়নে থাকা, পুরোদমে থাকা আমি অবশ্যকর্তব্য মনে করি। আবার যেখানে আমার ভাষার জন্য মানুষে লড়ছে, সঙ্ঘবদ্ধ হচ্ছে, সেখানেও যথাসম্ভব থাকা আমি কর্তব্য মনে করি।

কথা বলতে বলতে দুজনে বাইরে বেরিয়ে রাস্তার ওপারে চলে গিয়েছিল। “আপনি খাবেন তো’ জিজ্ঞেস করে সমরবাবু মলয়ের পিছন পিছন ঢুকলেন চায়ের দোকানে।
-     চা অবশ্য ওদিকে বেশি ভালো পাওয়া যায়। কিন্তু দাঁড়িয়ে খেতে হবে। আর যুৎ করে সিগারেটটাও যখন খাব তখন বসে চা খাওয়াটাই বেশি সুখকর।
-     ঠিক। কিন্তু যেটা বলছিলাম, এসবে এত যে ব্যস্ত থাকেন তাতে লেখার কাজে বা নিজের ইচ্ছেমত পড়ার কাজে ক্ষতি হয়না?
-     হয়তো হয়! আমার লেখক বন্ধুরাও তাই বলে। কিন্তু সমরবাবু, এটা বিহার। সমাজের সবরকম কাজেই লোকের অভাব। কাজেই কাঁধ লাগাতে হয়। আচ্ছা, আপনি তো এখন থাকবেন কিছুদিন পাটনায়?
-     আপাততঃ আছি। কিছুদিন পর ফিরবো। আবার আসবো। এভাবেই চলবে মনে হচ্ছে এখন। আসলে হোটেলে খাওয়াদাওয়া করতে করতে আমার ছেলের শরীরটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে বার বার। নিজে রান্না করা, ওর যা কাজ তাতে পোষায়না। তাই তো ওই হোটেলটায় ঘর নিয়েছিলো। অফিসটাও কাছে পড়বে, খাওয়াটাও ওই হোটেলে বলেকয়ে একটু সাদামাটা করিয়ে নেবে। কিন্তু এখন তা সত্ত্বেও শরীর কাবু হয়ে পড়ায় ওর মাকে এসে থাকতে হচ্ছে। হোটেলের ওই ঘরেই ভাতেভাত ফুটিয়ে নেওয়ার একটু ব্যবস্থা করে দিয়েছি। ছেলের স্ত্রীর পক্ষে এখানে এসে থাকা সম্ভব নয়। ওরও চাকরি আছে, তার ওপর মেয়ের পড়াশুনো। কাজেই আমি একবার এখানে, একবার ওখানে সে যা হোক, আপনার কবিতার বইটা পড়লাম। স্পষ্ট সমালোচনা পছন্দ করেন তো?
-     পছন্দ করি কিনা জানিনা। তবে আগ্রহ সহকারে চাই। পেলে, আমি জানি আমার লাভ হবে। আর আমিও আপনার মনোগ্রাফটা পড়েছি। বাংলার রেনেশাঁর যে এমনও একটি পর্ব ছিল উত্তরকালীন, শ্রমজীবী জনতার কাছে পৌঁছোনোর সত্যি বলতে আমার কোনো আইডিয়াই ছিলো না।
…………………………………………………
    
আকাশে ফাল্গুনের বিকেল। কথাটার মানে এই যে এই রাস্তাটায় ঢোকার পর দুসার বহুতলের ফাঁকে লম্বা এক ফালি আকাশ ছাড়া বছরের কোনো ঋতুর কিছুই বোঝা যায় না। হ্যাঁ, বর্ষায় জল জমে রাস্তায়। আকাশ দেখে ঋতুর ভেদ টের পাবে এত বিচক্ষণ চোখও মলয়ের নয়। তবু মাথায় ফাল্গুন ব্যাপারটা ছিল বলে কথাটা ওভাবে মনে এল।

স্কাইল্যান্ড হোটেল। হোটেলটার পাঁচ তলার এই ঘর ঠিক হোটেলের ঘরের মত নয়। আশে পাশে দু’একটা আরো ঘর রয়েছে যাতে হোটেলের কর্মচারীরা থাকে। তার পর খোলা ছাত খানিকটা। মাঝে মধ্যে পাইলিংএর থাম আর শিকের গোছা উঁচিয়ে আছে। মনে হয় এই ঘরটাও কর্মচারীদের জন্য ছিল। কাজের জায়গার কাছাকাছি মাসকাবারি থাকার ব্যবস্থা সস্তায় করতে গিয়ে হোটেলের এইঘরটা বেছে নিয়েছিলেন ত্রিদিব। মালিকও সেই হিসেবেই এই ঘরটা খালি করিয়ে দিয়ে দিয়েছিল।
নিজের অফিসে, অফিসের বাইরে চায়ের দোকানে, বিভিন্ন সভা সমিতিতে সমরবাবুর সাথে এই কয়েক মাস ধরে নিয়মিত আড্ডা দিয়েছে মলয় কিন্তু হোটেলে আসেনি। আসবো আসবো করেও আসেনি। তাই সমরবাবুর স্ত্রীকেও দেখেনি কোনোদিন। এই প্রথম দেখলো। ভেবেছিলো ছেলে ত্রিদিবের সাথেও দেখা হয়ে যাবে! তা তো আর সম্ভবই নয়। অমরবাবুর বৌমা আর সাত বছরের নাতনি রুমির সাথেও কোনোদিন দেখা হবে কী?
-     কী হয়েছিলো? আপনি তো বলেছিলেন হোটেলে খাওয়াদাওয়া করতে করতে
-     তাই তো ভাবছিলাম এতদিন ধরে! কিন্তু এবারে ডাক্তারের সন্দেহ হওয়াতে পরীক্ষাটরীক্ষা করালো। (একটু দম নিলেন) প্যানক্রিয়াসে ক্যান্সার বলছে ডাক্তার। তাই কলকাতাতেই নিয়ে গেলাম। এখন তো হাসপাতালে। অফিস চিকিৎসার খরচ তো দিচ্ছে। দেখুন কী হয়। (একটা বই বার করে আনলেন ব্যাগ থেকে) এই বইটা আপনি রাখুন। পাদরী লঙকে নিয়ে বেশি কাজ হয়নি বাংলায়। আর, আপনি জানেন আমি সেকেন্ডারি সোর্সের ওপর ভরসা করে চলিনা। প্রাইমারি সোর্স ঘাঁটি। আশা করি আপনাদের কাজে লাগবে বইটা। আর হ্যাঁ, আগামী এপ্রিলে ডিরোজিওর দ্বিশতজন্মবার্ষিকী পুরো হচ্ছে। কিছু একটা করুন আপনারা, পাটনায়, ভাগলপুরে বাইশ বছরের ছোট্টো জীবনে মানুষটা ভারতবর্ষের জন্য এত কিছু করলো!

ঘোঁঘোঁ বিছানার ওপর রাখা মোবাইলটা আস্তে আস্তে সরছে ভাইব্রেশনে, একটা কোনো পরিচিত ফিল্মি গানের সুরে রিং টোন। সমরবাবুর স্ত্রী কিছু করছিলেন মাটিতে বসে। উঠে আসতে গিয়ে হাতের বাসনগুলো ফস্কে যেতে লাগলো। ধাতু আর দেয়ালের ঘষটানির শব্দ উঠলো বন্দ কাঁসরের মত কিছুটা।

ফোনে খবর এসেছিলো ত্রিদিবের আয়ু আর এক মাস।  




Monday, May 30, 2016

বগহা – ২


- কী হইল? দেরি হইতাসে ক্যান?
-     সালা, হোখতে নৈখে বন্দ্‌ ই দরোয়াজা। তলবো জকড়ল্‌ বা।
-     এই ভাষায় কথা কইয়ো আমার দিদার সাথে!
-     হুঁহ্‌। জ্যায়সে বুঢ়ী বিয়ে ভেঙে দেবে আমাদের।
বলে, ঘুরে বৌয়ের গালে জোরে চিমটি কাটল বলরাম। বলরাম দাস।

ভোর চারটে। আলো ফোটা শুরু হয়েছে কেবল। আকাশে ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ কয়েকটি বলে দিচ্ছে বেলা বাড়তেই চড়চড়ে হবে আশ্বিনের রোদ। কলোনী থেকে বেরিয়ে রাস্তায় ওঠার মুখে পথটা ঈষৎ চওড়া। ডানদিকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভাঙাচোরা বাড়ি। বাঁদিকে রিফিউজি কলোনী সাবক্যানালের শুকনো খাত; ফিডার থেকে জল আসেনা কয়েক বছর যাবৎ।
রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা টাটা ম্যাক্সিটা আগে থেকেই ভরাট। বাইরে দাঁড়িয়ে মুখিয়া জনার্দন পান্ডে।
-     হই দেখ হিরো হিরোইনকে! অবলে টুটল্‌ বা নীন্দ্‌।
গাড়ীর ভিতর থেকে জিজ্ঞেস করলেন প্রবীণ কালীপদ বিশ্বাস, “কৌন হ্যায় মুখিয়াজী?
-     উ হে, নিরঞ্জন কে ভতিজওয়া বলরাম!
বাকিটুকু পুরো করলো ড্রাইভার, “আ ওকর মেহরারু, কঞ্চনমালা!”
সদ্য বিয়ে হয়েছে দুজনের কাজেই এই খোঁটাটুকু ওদের প্রাপ্য।

কালিপদ বিশ্বাস গাড়ির ভিতরদিকে হাঁক দিলেন, “গোবিন্দ! তুই ব্যানারটা আনতে ভুইলা গেলি কাল। অখনে থাকলে এইখান থিকাই স্লোগান তুলতাম!”
“পুষ্করদা ব্যানার লইয়া থাকবো কইসে, শনিচরির নিকট। আর নারা লাগাইতে ব্যানারের কাম কী? লাগাইলেই হয়! (জোরে আওয়াজ তোলে) বিহার বঙ্গালি সমিতি জিন্দাবাদ!
সাড়া পায়না। সব ঝিমিয়ে আছে। আরেকটু বেলা হোক। চা, তামাক হলে পর তাহুত হবে মেজাজ।

গাড়ী ছুটেছে সাঁই সাঁই করে। ভয়ও করে বাবা। গুড়গুড় করে আসতে থাকা ভীমকায় ট্রাকগুলোর পাশ কাটাতে গিয়ে টলমল করে এই ছোট্ট সওয়ারি ভ্যান। মুখিয়াজী একটু পেছিয়ে, নিজের বাইকের পিছনে বসে। বাইক চালাচ্ছে সন্তোষ, তাঁর বিশেষ শিষ্য। নিজের ক্ষেত্রের বাঙালি সমাজের প্রতি তাঁর একটু দুর্বলতা আছে। অন্যান্য মুখিয়ারা তাই ঠাট্টা করে বলে ‘আধা বঙ্গালি’।
কাঞ্চনমালা ভিতরে একপাছায় ঠেসে বসে বাইরে খেতের দিকে তাকিয়ে ছিল। বলরাম এবং আরো দুজন গাড়ীর পিছনে, বাইরে ঝুলছে।
লৌরিয়া চিনি মিল ছাড়িয়ে বাঁকের কাছে বাইকে বসেছিল পুষ্কর, পিছনে রাহুল। ম্যাক্সি এসে থামতেই ব্যানার এগিয়ে দিল। গোবিন্দ আর রাহুল মিলে বেঁধে দিল গাড়ির সামনে।
ডানদিকে চায়ের দোকানে ধুঁয়ো উঠতে শুরু করেছে।
-     দেরী বা?
-     দস মিনট!
-     চাহ্‌ওয়া তব এইজে পী লিহল জাই, মুখিয়াজী। সবাইকার নীন্দ খুলবে তো নারাও লাগবে ভালো করে।

      *                             *                         *                      *
বেতিয়া থেকে বগহা, প্রায় উদয়পুর জঙ্গল বা বাল্মিকীনগর ব্যাঘ্র পরিযোজনা অব্দি বিভিন্ন ব্লকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বাঙালি শরণার্থী কলোনী বা গ্রাম। এছাড়া বেতিয়া শহরে বা বেতিয়ারাজের নগরীতে আছে পুরোনো বাসিন্দা, শহুরে বাঙালি। তবু, গঙ্গার উত্তর পাড়ে সিওয়ান, গোপালগঞ্জের পর এই এলাকাটা ভোজপুরী ভাষাক্ষেত্রের পূর্বাঞ্চল। কাজেই পঁয়ষট্টি বছর ধরে পূর্ববঙ্গের বাংলা পরে নিয়েছে পূর্বী ভোজপুরীর আবরণ – কিছুটা জীবনের স্বাভাবিক নিয়মে, কিছুটা অস্বাভাবিক।
এই গ্রামগুলোর সবকটি আবার এক অবস্থায় নেই। যেমন, বলরাম দাসের গ্রামে ভোজপুরীর অনুপ্রবেশ এতটাই যে ভাঙা ভাঙা বলা ছাড়া বলরামের প্রজন্মের বাংলার সাথে আর কোনো সম্পর্ক নেই। অথচ তার স্ত্রী, শৈশবে বাপ-মা হারিয়ে দিদার সান্নিধ্যে থাকা কাঞ্চনমালা মনে, এবং প্রাণেও, বাঙালী। বাংলা, মানে দিদার জেলার উপভাষা যে বাংলা, বলতে তো জানেই, দিদার কাছে বাংলা লেখা শেখার সুবাদে ‘লেখার’ বাংলাও বলতে পারে। প্রাণে বললাম এই জন্য যে তার বরের ভোজপুরীতে প্রেমালাপ এক্কেবারে সহ্য করতে পারে না।

বস্তুতঃ বলরামের বাংলা না জানার আরেকটা কারণ আছে। বলরামের পূর্বপুরুষ যে জমিটুকু পেয়েছিল বেশ কয়েক বছর আগে তার আদ্ধেক দখল নিয়ে নিয়েছে অন্য গ্রামের দবঙ্গ চাষীরা। বলরামের বাবা তার বিরুদ্ধে অনেক নালিশ-টালিশ জানিয়ে হার মেনেছেন। শুধু হার মানাই নয়, বছরের পর বছর নালিশ নিয়ে বিভিন্ন সরকারি আমলা, নেতাদের কাছে রোজকার দৌড় কেড়ে নিয়েছিল তাঁর জীবনীশক্তি। অন্য কিছু করে নিজের পরিবারটাকে দাঁড় করানোর চেষ্টা আর তিনি করতে পারছিলেননা। সে সময় সদ্য তরুণ বলরাম নিজেকে টেনে বার করে পরিবারের এই হাহুতাশের পরিমন্ডল থেকে। হাহুতাশের ওই পরিমন্ডলটাই তার জন্য বাংলার পরিমন্ডল ছিল। কাজেই তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহে সে নিজেকে পুরোপুরি ভোজপুরিভাষী করে নিল। মুখিয়াজীর কাছ থেকে কিছু টাকা ধার নিয়ে স্টোভ, হাঁড়ি, তাওয়া কিনলো। ঠিক ওই জায়গাটাতেই ইঁট পেতে বসতে শুরু করলো রোজ বিকেলে, যেখানে এখন মুখিয়াজীর বাইকটা দাঁড় করানো রয়েছে। ডিমের ওমলেট, ডিমসেদ্ধ ভালোই বিক্রী হতে শুরু করলো। এখন তার নিজের ঠেলা আছে। শুধু কলোনীর লোকেরা নয়, বড় রাস্তা দিয়ে যাওয়া লোকেরাও দাঁড়িয়ে তার ব্রেড-ওমলেট খেয়ে যায়। বলা যায় যে পুরোপুরি নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে, বাবা মা বোনদের দুবেলার খিদে মেটাবার মোটামুটি গ্যারান্টি করে তবে সে বিয়ে করেছে। যে পৈত্রিক কুঁড়েঘরটি ছিল তার লাগোয়া পেঁপেগাছগুলির গা ঘেঁষে আলাদা একটি ঘর তুলেছে মাটির – সেটাই এখন পাশের গ্রামের মেয়ে কাঞ্চনমালার সংসার। অক্‌খর ভোজপুরি বলরাম এখন খাস বঙ্গালিন কাঞ্চনমালার গোলাম, সবাই বলে। তাই নিজের বিজনেস ছেড়ে বলরাম আজকের মিটিংএ বৌকে নিয়ে চলেছে।
অবশ্য বলরামের উদ্যমের ছোঁয়াচে বলরামের বাবাও আজ হতাশা কাটিয়ে উঠেছেন। ভাগবাঁটোয়ারা আর জবরদখলের পর যেটুকু চাষ আছে, করেন। আখের ফসলটা তো ধরেনই। আর অনেক সময় ছেলের শহর থেকে ফিরতে দেরি হলে ঠেলাটা নিজেই নিয়ে গিয়ে লাগান বড়রাস্তার ধারে। ডিম বেচা না হলেও আংটা থেকে ঝোলানো পপকর্নের প্যাকেট, চানাচুরের প্যাকেট বিক্রী হতে থাকে। বলরামের মা প্রস্তাব দিয়েছেন ঠেলায় ব্যবস্থা করতে পারলে তিনি, তাঁর বৌমা আর দুই মেয়ে মিলে খোলায় ছোলা, মটর, বাদাম ইত্যাদি ভেজে দিতে পারেন। কিন্তু সেটা আবার ডিমের সাথে মিশ খায় না। আলাদা জায়গা করতে হয় পাশে। একজন এ্যাসিস্ট্যান্ট চাই। বলরাম ভাবছে কিছুদিন ধরে।  

ম্যাক্সিটা এখন হাঁইহাঁই করে ফাঁকা হাইওয়েতে ছুটছে। অনেকক্ষণ স্লোগান চালিয়ে একটু ঝিমিয়ে পড়েছে গোবিন্দদাদা আর কালিপদ মামা। ঝিমিয়ে নিচ্ছে বরং বলা যায়। আবার ধরতে হবে শহরে ঢুকলে পর। বলরাম আস্তে করে বৌয়ের কানে কানে বললো, “দু’বজে নিকলকে হম্‌নিকে এগো সিনেমা দেখব্‌ যাই। ফির লৌট কে আ জাইব্‌ হল মে।”
কাঞ্চনমালা হাঁক দেয়, “গোবিন্দদাদা!” বলরাম সজোরে ওর মুখটা চেপে ধরে।
তার মানে এই নয় যে কাঞ্চন সবসময় এধরণের প্রস্তাব খারিজ করে। মাঝে মধ্যেই সিনেমা দেখতে বেতিয়া শহরে আসে দুজনে। কিন্তু এখন গোবিন্দদাদাকে ডাকার কারণ আজকের বেতিয়া-যাত্রার বিশেষত্ব – “বাঙালীদের সমস্যা নিয়ে জনসভা। বাংলা ভুলে যাচ্ছে বাঙালীরা, স্কুলে বাংলা পড়ানো হচ্ছেনা এসব নিয়ে কথা তোলার সুযোগ এসেছে আজ, আজ না গেলে কিন্তু পরে আপশোষ করবো আমরা”, বাড়িতে এসে বলেছিলেন কালীপদমামা। তাই বললাম যে কাঞ্চন প্রাণেও বাঙালী। আজকের সভার গুরুত্ব তার কাছে বিশেষ।
যদিও গোবিন্দদাদাকে ডাকার ফলটা হয়েছিল উল্টো। সে কথায় পরে আসছি।

গোবিন্দ ছিল ড্রাইভারের পাশে। কাঞ্চনের হাঁক শুনে পিছনে ঘুরে মুখ বাড়ালো। বলরামের হাতটা নিজের মুখ থেকে সরিয়ে কাঞ্চন কথা ঘোরালো, “আর কত সময় লাগবো পৌঁছাইতে?” গোবিন্দ বলরামের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে হাসলো, “হ, তোরা ত এই প্রথম আসতাছস্‌ বেতিয়া শহরে!”

      *                             *                         *                      *
বিরাট সভা। কত বড় বড় নেতা মঞ্চে বসে। উদ্বাস্তু নেতা, বাঙালি সমিতির নেতা আবার সাংসদ, বিধায়ক, জেলা সভাপতি। আরো নাকি আসছে, পরে পৌঁছোবে। আর সবার মাঝে মধ্যমণি সেই ভারিক্কি চেহারার ডাক্তারবাবু। কাঞ্চন দেখেছে তাঁকে দু’দুবার। তাদের কলোনীতে এসেছিলেন, সভা করেছিলেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনের মাঠটায়। সভার পর দুলালের বাবা আর বড়ভাই ধরে নিয়ে এসেছিল দুলালকে। একটা পায়ে প্লাস্টার। প্লাস্টারের ওপর হাঁটুর কাছটা ফুলে আছে, আর হলদেটে হয়ে আছে। অনেকদিন ভুগলো বেচারা সেই ব্যারাজে কাজ করতে গিয়ে এ্যাক্সিডেন্টে।
সকাল সোয়া আটটা নাগাদ হলে পৌঁছেই অবাক হয়ে গিয়েছিল কাঞ্চন। কত কত মেয়েলোক প্রভাত ফেরীর জন্য লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে! দিদার বয়সী, মা-মাসীদের বয়সী, তার নিজের বয়সী, স্কুলের মেয়েরা সে নিজে পিছনে গিয়ে দাঁড়াবার পর একজন একটা প্লেকাঠ দিলো হাতে। ঘুরিয়ে দেখলো হিন্দীতে ছাপা আছে, “শরণার্থিয়োঁ কী জমীন পর গৈরকানূনী কব্জা বন্দ্‌ করো”। বাঃ, এ তো শ্বশুরমশায়ের কথা! পিছনে ফিরে বলরাম কোথায় খুঁজতে গিয়ে দেখে ওর হাতেও একটা প্লেকাঠ, “বংগ্‌লা পঢ়নে-পঢ়ানে কী ব্যবস্থা করনী হোগী”। ব্যাজার মুখ করে দাঁড়িয়ে বলরাম। হেসে ফেলে কাঞ্চন। বেশ হয়েছে।
 ……………………………………
অনেকক্ষণ হয়ে গেছে মিটিং। মহিলাদের জন্য আগে খেয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা ছিলো তাই দুপুরের ভাতটাও ধাক্কাধাক্কি করে খেয়ে এসেছে। বিরাট টাউন হলে বাঁদিকে মহিলাদের মধ্যে, পাখার হাওয়া দেখে জায়গা লুটে বসে ছিলো কাঞ্চন। হঠাৎ দেখলো বাঁদিকের দরজার বাইরে গোবিন্দদাদার সাথে কথা বলছে বলরাম। বলরাম হাসি হাসি লাজুক লাজুক মুখে মাথা চুলকোচ্ছে আর গোবিন্দদাদা কপট রাগ দেখিয়ে থাপ্পড় মারছে ওর পিঠে। দ্যাখো কান্ড! নিশ্চই সিনেমা যেতে চাওয়ার কথা বলছে। “ঠারাও, আমিও দেখাইতাসি!”
চুপটি করে নিজের সিট থেকে উঠে পড়লো কাঞ্চন। পাশ থেকে চুমকি জিজ্ঞেস করলো, “কহাঁ দিদি?” “তু চুপচাপ বৈঠ্‌ অইজা, চাপাকল সে পানি ভরব্‌” বলে হাতে বোতলটা উঠিয়ে ডানদিকে এগিয়ে গেল কাঞ্চন। চেয়ারের সারি, জনমানুষ ঠেলে দরজা দিয়ে বেরিয়ে মিশে গেল ভীড়ের মধ্যে। পিছন ফিরে একবার লক্ষ্য করল চুমকির সাথে কথা বলে বলরাম এদিকেই আসছে। জলের চাপাকলের কাছে জল নিয়ে খাওয়ার জায়গার দিকে যাচ্ছিলো লীলাপিসি। দৌড়ে গিয়ে তাকে ধরলো, “একবার চলো না বাইরে, পেটটা ভার ভার লাগছে!”
-     বাইরে কোথায়?
-     ওই যে এনাউন্স করলো না, সুলভ শৌচালয় আছে বাইরে, আজকে মিটিংএ যারা এসেছে তাদের জন্য ফ্রি!

হাতে ঘড়ি নেই। সুলভ শৌচালয়ের সিঁড়ি দিয়ে উঠে ভেবেছিল পয়সা নেওয়া লোকটার কাছে সময় জানবে। কিন্তু উঠেই দেখলো দেয়ালঘড়ি – দুটো বাজছে। মোটামুটি আধ ঘন্টা সময় কাটাতে হবে। লীলাপিসিকে সিঁড়িতে বসিয়ে ধীরেসুস্থে ‘মহিলা’ লেখা দরজাটার দিকে এগোলো।

বলরাম চাপাকলের দিকে গিয়ে দেখলো কাঞ্চন নেই। খাওয়ার জায়গার দিকে দেখলো শেষের ব্যাচগুলো চলছে। ওখানেও নেই। সুলভ শৌচালয়ের দিকে গেছে বুঝলো না। তবে এটা বুঝলো যে ওর গোবিন্দদা’র কাছে সিনেমা যাওয়ার অনুমতি নেওয়াটা কাঞ্চন টের পেয়েছে, আর ও কিছুতেই যাবে না। কেন যাবে না?

বলরাম ক্ষুব্ধ মনে চাপাকলের পাশে দাঁড় করানো বাস, ম্যাক্সি, জিপগুলোর ছায়ায় ঘাসে বসে বিড়ি ফুঁকলো অনেকক্ষণ ধরে। মাইকে আওয়াজ ভেসে আসছে, এলাকার একজন মহিলা বিধায়ক বাঙালি সমাজকে খুশি করার জন্য ভাঙা ভাঙা বাংলায় ভাষণ দিচ্ছেন। বলরাম চেনে বিধায়কজীকে, অক্‌খড় ভোজপুরিভাষী। ওর মাথায় একটা বুদ্ধি খেললো।

      *                             *                         *                      *
জগদীশ মন্ডল অনেকক্ষণ বুঝতেই পারলো না বলরামের সমস্যাটা কী। বলরামকে ও চেনেও না।
-     আপনি কোন কলোনী থেকে এসেছেন? (বলরাম কলোনীর নাম বললো)
-     ওখানকার নেতারা তো আছেন, কালীপদদা, গোবিন্দ
-     উরা সোব বেস্ত আছেন। রউয়া শিক্‌ছক বানি। হামার ই কামটা করে দেন, প্লীজ।
-     তা তুমি বলতে চাইছিলে তো এতক্ষণ নাম লেখাওনি কেন? এখন তো সময় শেষ।
-     সে আমি করিয়ে লেব, ব্যাস দু’লাইন লিখে দিন বাংলা, হিন্দি অক্‌ছরে।
জগদীশ এক প্যারা লিখে দিল দেবনাগরীতে বাংলা। বলরাম ছুটে গেল মঞ্চে। ও জানে কাকে বললে কাজ হবে। মঞ্চের সিঁড়ি দিয়ে উঠছিলেন প্রেসিডেন-ডাকদরবাবু। সোজা পা ধরলো। “ঠিক আছে। এই বিধায়কদের ভাষণটাষণ শেষ হোক। তারপর তোমাকে ডাকা হবে। কই তোমার স্লিপটা কোথায়?”

সাড়ে চারটে বাজে। সাংসদ, বিধায়ক যাঁরা এসেছিলেন ভাষণ দিয়ে, সম্মান গ্রহণ করে চলে গেছেন। আরো তিনজন আসার কথা আছে, এখনও আসেননি। প্রেসিডেন্ট পকেট থেকে একটা স্লিপ বার করে মঞ্চ-সঞ্চালকের দিকে এগিয়ে দিলেন, “এই ছেলেটাকে ডেকে নিন, একেবারে পায়ে হাত দিয়ে অনুরোধ করে গেছে।”
ওদিকে বলরাম দুঘন্টা ধরে হলের বাইরেই ঘুরছে। দেখেছে কাঞ্চন ফিরে এসেছে নিজের সিটে, কিন্তু কাছে যায়নি। অধিকন্তু, চুমকিকে যেহেতু ইচ্ছে করে রাগ দেখিয়ে বলে দিয়েছিল যে ও একাই সিনেমা দেখতে যাচ্ছে, কাঞ্চন সেই শুনে আর খোঁজও করেনি, গোঁজ হয়ে বসে আছে।

নামটা মাইকে শুনে কাঞ্চন চমকে তাকালো মঞ্চের দিকে। বলরাম মাইকের কাছে গিয়ে একবার ভীড়ের মধ্যে ডানদিকে তাকালো। কাঞ্চন বুঝলো ওকেই দেখতে চাইলো বলরাম।
“মাননীয় সভাপতি, মঞ্চে আসীন অতিথিগণ এবং পশ্ছিম আর পূরবী চম্পারণের সরনারথি কলোনি থেকে আসা হজার হজার বাঙালি মা, বোন, পিতরিপর্‌তিম গুরুজন এবং বন্ধুরা! আমি বাংলা জানি না। কখনো সিখতে পারিনি। (কাগজ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সোজা মাইকের দিকে তাকালো) আর হমার বৌ রাগ করে আমি বংলা বলি না। ভোজপুরি বলি। সত্যি সরম কি বাত। আমি ওয়াদা করছি বংলা সিখবো। বৌয়ের কাছেই সিখবো। (ওদিকে কাঞ্চনের মুখটা লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো, মাথা নিচু করে জলের বোতলটা খোঁজার ভান করলো) জরুর সিখবো। (বলরাম কাগজের দিকে দৃষ্টি ফেরালো আবার) আজ যে মহতী উদ্দেস্‌সে আমরা সবাই সমিতির ডাকে এখানে এসেছি, আমাদের সোক্তি দেখছে এলাকার নেতারা। আমরা আমাদের দাবীগুলো সরকারের কাছ থেকে নিতে সফল হবোই। বলুন সবাই একসাথে, “সরনার্থি একতা জিন্দাবাদ! বাঙ্গালি একতা জিন্দাবাদ! বাংলা ভাসা জিন্দাবাদ!”


কাঞ্চন চেঁচিয়ে ‘জিন্দাবাদ’ বলে চকিতে তাকালো বাঁদিকে-ডানদিকে। সবাই বলছে তো? না ও একাই? যাঃ। সবাই বলছে। “লোকটা যেন কী! সবার সামনে এভাবে বলতে আছে আমার রাগ করার কথা?” তিনমাসের অন্তঃসত্ত্বা কাঞ্চনের ইচ্ছে হল এক্ষুনি ঝাঁপিয়ে পড়ে বলরামের বুকে। মনের সুখে কিলোয়।   



সকালের বাস


সাড়ে নটার মধ্যে দলসিংসরায় পৌঁছোতে হলে সাতটার বাস ধরতে হবেই। যদিও সে বাস পৌনে নটাতেই পৌঁছে দেয়। কিন্তু তার পরের বাস আটটায়, তাও লোকাল, দশ জায়গায় দাঁড়িয়ে-টাড়িয়ে পৌঁছোয় সাড়ে দশটা নাগাদ। আর অতক্ষণ যদি অপেক্ষা না করে সোনলের বাবা? পার্টির কাজে আসছে, হয়ত মিটিং সেরে ওদিক থেকেই ফিরে চলে গেল পাটনা। তখন আর দেখাও হবে না।
‘আর দেখা হওয়াটা এত জরুরি!’ আটা মাখতে মাখতে পূর্ণিমা ভাবে। আটাটা মাখা থাকলে রুটিটুকু করে নিতে পারবে সোনল। ছোটো ভাইবোনদুটোর না খেয়ে স্কুলে যেতে হবে না; সোনলও খেয়ে নেবে। আটা মাখা হয়ে যাক, সে নিজে স্নানটান করে তৈরি হয়ে নিক, তারপর বাচ্চাগুলোকে ওঠাবে ঘুম থেকে ।
এখন পৌনে ছ’টা। সাতটার বাসটা ধরতে হলে সাড়ে ছটার মধ্যে বেরিয়ে পড়তে হবে।

হাইওয়েতে শিরীষগাছটার তলায় সওয়ারি জমতে শুরু করে দিয়েছে। আলপথে তাড়াতাড়ি পা চালায় পূর্ণিমা। ক্ষেতে ক্ষেতে বড় হয়ে ওঠা তামাকের পাতাগুলো মাঝেমধ্যে পায়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে। গ্রাম থেকে রাস্তাও একটা উঠে এসেছে কিন্তু সেটা ঘুরপথ। সবাই এই আলপথ ধরেই পা চালায়। যেমন ওরা এসে গেছে তার আগেই। অবশ্য, তার গ্রামের কেউ কি
হাইওয়েতে উঠে হাতের চটিটা পায়ে গলিয়ে ওপারে তাকায়, ‘যাঃ, যা ভয় পাচ্ছিল, গ্রামের পরিচিত দুটো বুড়োও আছে আবার। এবার শুরু হয়ে যাবে। পূর্ণিমা ঘোমটাটা ভালো করে মাথার ওপর টেনে রাস্তা পার করে। ভীড়ের পাশ কাটিয়ে এক প্রান্তে তিনজন মহিলার সাথে গিয়ে দাঁড়ায়। শুনতে পায়, শুরু হয়ে গেছে দুই বুড়োর আহা উহু। যেন এ এলাকা থেকে এক পূর্ণিমার বরই লাল ঝান্ডার রাজনীতি করছে। “ কী করে যে নিজের বৌ ছেলেমেয়েকে গ্রামে ফেলে রাখে একা! আবার ঘরের আনাজপানির ব্যবস্থাটাও বৌকেই দেখতে হয়। দু বিঘা জমির চাষের ব্যবস্থা করা, সেলাই-ফোঁড়াই, আচার তৈরি করা, তারই মধ্যে ছেলেমেয়েদের ইস্কুলে পড়ার জন্য
ভাগ্যিস বাসটা এসে যায়। ভিতরে পিছনদিকে জায়গা পেয়ে যায় বসার।

সেভাবে দেখতে গেলে, এই এলাকাটা লালঝান্ডারই এলাকা। বেশ কয়েকবার বিধায়কও হয়েছেন তাদের পার্টির নেতা। তবে কাজেকর্মে সেই রমরমা আর নেই। মানে একটা উৎসাহ, প্রতিদিন নতুন কাজের, ছোটো ছোটো বৈঠকেও কমরেডদের গহমাগহমি, গান, নাটক, প্রভাতফেরীনেই তা নয়, কিন্তু যেন গতানুগতিক, বাসি, বাসি। যখন নাকি পার্টি আগের থেকে বেশি ছড়িয়ে পড়েছে। নতুন পাকা ঘর তৈরি হয়েছে লোকাল কমিটির।
যাঃ, এসব তার মনের কথা, পূর্ণিমা ভাবে, সে নিজেই তো আসলে নিয়মিতভাবে কোনো কাজেকর্মে নেই। শুধু সংসার ঠেলে যাচ্ছে দশ বছর যাবৎ। এবার সোনলের বিয়ের চিন্তাও শুরু করে দিতে হবে।
আঠেরো বছর হয়ে গেল তাদের বিয়ের। বিয়ের আগে যুবসংগঠনে তাদের দেখা। যুবসংগঠনের সাংস্কৃতিক টিম প্রোগ্রাম করবে কিসানসভার সম্মেলনে। ধর্মবীরই জিম্মা নিয়েছে প্রোগ্রামের। সেক্রেটারিকে বলল, এবারে নতুন ব্যাপার ঘটাবে। গানের গ্রুপে মেয়েদেরও শামিল করবে। কোথায় আছে গায়িকা মেয়ে? কেন? পূর্ণিমার গলা ভালো, আমি শুনেছি। কী করে শুনলে? সে ছাড়ো না। ওকে রাজি করাও। তা নাহয় একজন হল, আর? ওকেই বলো আরো দুতিনজনকে জোটাতে।
পরে বলেছিল ধর্মবীর, যুবসংগঠনের ক্যাম্পে রাত্তিরে বেরিয়েছিল খৈনির খোঁজে। মেয়েদের ঘরটার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় শুনতে পায় গুনগুন, তারই বাঁধা গানের সুর। পরে সকালে সুধাজীকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারে গুনগুনকারিণীর নাম – পূর্ণিমা।
পুরো এলাকায় প্রথম কোনো রাজনৈতিক গানের টিমে মেয়েদের কন্ঠস্বর এল। মাইকে গলা মেলালো চারজন, কিন্তু সবচেয়ে জোরালো আর সুরেলা আওয়াজ পূর্ণিমার।


বাস পৌঁছে গেছে। মোড়ে নেমে তাড়াতাড়ি গ্রামের দীপনারায়নের মোটর পার্টসের দোকানে পৌঁছোলো।
-     ভাবীজী, প্রণাম!
-     আসেননি এখনো?
-     কে, ধর্মবীরভৈয়া? আসার কথা ছিল নাকি? (কর্মচারী ছেলেটিকে প্রশ্ন করল) এসেছেন নাকি রে?
-     হুঁ। স্টেশনের দিকে প্রোগ্রাম আছে। বলেছেন বসাতে।
-     বসুন ভাবীজী। চা টা খান। এক্ষুণি এসে যাবেন তার মানে।
-     না ভাই, চা খাবো না। এক গ্লাস জল খাইয়ে দাও শুধু। আমি একটু বাজার থেকে আসছি এটা (হাতের থলেটা দেখিয়ে) সীতারামজীর দোকানে পৌঁছিয়ে।

ফিরে আসতে আসতে দশটা হয়ে যায়। তখনো দেখা নেই। বাইরে চেয়ারটায় বসে থাকতে থাকতে ঢুলুনি আসে। ঘুমিয়েই পড়েছিল বোধহয়। হঠাৎ ঘুম ভাঙতেই চোখের সামনে দশাসই শরীর।
-     কতক্ষণ বসে আছিস?
-     (চোখ ফেটে জল আসে, কিন্তু সামলে নেয়) এই আধঘন্টা।
-     বাস তো সাড়ে ন’টায় পৌঁছে গেছে।
-     বাঃ, কাজ ছিল না! আচারের বয়ামদুটো পৌঁছোনোর ছিল সীতারামজীর দোকানে!তুমি যাবে গ্রামে?
-     না। ফিরতে হবে। ওখানে কাজ আছে। এসেছিলাম কমরেড লখন বলেছিল একটা সাংস্কৃতিক আয়োজন করেছে আজকে স্টেশন চত্বরে। আমি রাজ্যনেতাকেও নিয়ে এলাম। এসে দেখি ভোঁ ভাঁ। কী, না হয়ে উঠতে পারল না। সেটা খবর দিবি তো! কোনো জবাব নেই। কী বলব?
-     কিছু টাকা এনেছ? আমার হাত এক্কেবারে খালি।

ধর্মবীর মাথা নিচু করে থাকে। পূর্ণিমার বুঝতে অসুবিধা হয় না।
-     ওয়েজ পাওনি এমাসের?
-     আমি এসে দিয়ে যাবো তোকে টাকা, এক সপ্তাহের মধ্যে। না আসতে পারলে কারুর হাত দিয়ে পাঠিয়ে দেব।
-     সোনলের বিয়ের চিন্তাও শুরু করতে হবে এবার। ছেলে টেলে দেখছো কোথাও।
-     দেখছি। বিয়ের টাকাটারও তো ব্যবস্থা করতে হবে! কম টাকার ব্যাপার তো আর নয়! না করেও চল্লিশপঞ্চাশ হাজার ছাড় ওসব। চল কিছু খেয়ে আসি। খিদে পায়নি তোর?
-     সে একটু পেয়েছে।

মোড়ের ওদিকটায় চা-মিষ্টির দোকান। দোকানদার নমষ্কার করে। ধর্মবীরকে চেনে না এমন লোক কম আছে এখানে। দুটো করে লিট্টি আনায়।
-     ওই রাজ্যনেতা কোথায় গেলেন? ওনাকে দেখলাম না তো!
-     আরে, আমাকে ফাঁসিয়ে দিল সকলদেব। দেখেই বলল, ভূষণজী বলেছেন, পটৌরিতে জিবি আছে লোকালের, আমি যেন অ্যাটেন্ড করি, একটু সাহায্য হবে রিপোর্টিঙে। তা সাংস্কৃতিক ফ্রন্টের নেতাকে আর আটকে রাখি কেন, প্রোগ্রামটাই তো হলনা। ওনাকে বাস ধরিয়ে দিলাম। আমি বিকেলের বাসে যাব।
-     তবু একবার বাড়ি যাবে না! (ধর্মবীর করূণ দৃষ্টিতে তাকায়) থাক, থাক, আর কৈফিয়ত দিতে হবে না। (ধর্মবীর হাতটা রাখে পূর্ণিমার হাতের ওপর, চাপ দেয়) ব্যস্‌, হয়েছে! ধন্য হয়ে গেছি! (দুজনেই হাসে) গানটান লেখ, না শুধু মিটিং?
-     কোথায় তেমন সময় পাই। তবু লিখি মাঝে মধ্যে। একটা লিখেছি গতকাল। শুনবি?
-     এখানে নয়। খেয়ে নাও। ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।

চা খেয়ে ওঠে ধর্মবীর।
-     চল্‌, দুজনে পান খাই অনেকদিন পর।

পান চিবোতে চিবোতে হাইওয়েটায় উঠে চারদিকে তাকায় দুজনে। তারপর, যেদিকে বাজারটা তাড়াতাড়ি শেষ হয়েছে, সেই দিকে হাঁটা শুরু করে। হট্টগোল কমে এলে, ধর্মবীর খুব নিচু গলায় গুনগুন করার মত গেয়ে পূর্ণিমাকে, নতুন লেখা গানটা শোনাতে থাকে।