Monday, April 7, 2025

গুরুচরণদা

ভাবতাম গুজরাটের আনন্দ শহরে তাঁর মেয়ের বাড়িতে কিম্বা কর্ণাটকের ব্যাঙ্গালোরে তাঁর ছেলের বাড়িতে যাব কোনো না কোনো একদিন। কিন্তু কখনো ভাবিনি তাঁর সাথে সেখানে পৌঁছোলেই দেখা হবে। বরং ভেবেছি, এই হয়ত পরের মোড়টা ঘুরলেই পৌঁছোব; কাউকে জিজ্ঞেস করছি বাড়িটার হদিশ উনি পিছন থেকে এসে আলতো করে আমার পিঠে হাত রাখবেন, এসেছ? খুব ক্লান্ত নয়তো? তাহলে চল হাতের একটা কাজ সেরে নি, তুমি থাকলে সুবিধেই হবে তার পর বাড়ি যাব

আনন্দে যাওয়া হলনা। ব্যাঙ্গালোরে নিজের কাজে তিন বার গিয়েও দেখা হলনা। যেমন স্বভাব হয় এধরণের মানুষদের একবার জানানও দিলেননা যে যাচ্ছেন।

ডাক্তারগিরি

ডাক্তারদের একটা বিশেষত্ব থাকে। তাঁরা তো আপনার থেকে অনেক বেশি ভালোরকম বোঝেন আপনার শরীরটাকে! যখন কোনো ডাক্তার দেখেন আপনাকে তখন আপনার শরীরের ভিতরের প্রত্যেকটা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, তার হাড়-পেশী-শিরাউপশিরার বুনট তাঁর নিজের পড়া পাঠ্যপুস্তক, ছেঁড়াকাটা মড়া, ঘাঁটা কঙ্কাল আর ডাক্তারির অভিজ্ঞতার সাথে মিলিয়ে নিতে থাকেন। আপনি হয়ত অনেকক্ষণ ধরে বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করছেন আপনার ব্যথাটা ঠিক কোথায় এবং কী ধরণের কিন্তু বারবার মনে হচ্ছে ঠিক বুঝিয়ে উঠতে পারছেন না। হঠাৎ ডাক্তার তাঁর চেয়ারটা থেকে ঝুঁকে একটা বিশেষ জায়গায় জোর টিপুনি দিলেন আপনি বীভৎস রকমের একটা চীৎকার করে উঠলেন আর এক লহমায় নিজেও বুঝে গেলেন ব্যথাটা ঠিক কোন জায়গায় আর কী ধরণের!

চাকরিতে থাকাকালীন এক সময় একটা প্রতারণার মামলায় জড়িয়ে পড়েছিলাম। নানারকম কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখা সত্ত্বেও স্বাভাবিক ভাবেই মনটা ভীষণ খারাপ থাকত। শুভাকাঙ্খীরা খুব সন্তর্পনে জানতে চাইছে কী হয়েছে ব্যপারটা, যাতে আমার আঘাত না লাগে। যারা একটু দূরের, তারা সামনে না বললেও পিছনে, আরে আমরাও দুনিয়া দেখেছি বস্‌! সুদ্ধা সুদ্ধা মানুষেরা ভিতরে ভিতরে কে কোথায় কোন গুল খিলিয়ে বসে আছে আপনি বুঝতেও পারবেন না। খোঁজ নিয়ে দেখুন, নিশ্চই মাল কামিয়েছে বা কামাবার ধান্ধায় ছিল, এমনি এমনি সিবিআই ধরেনা।”… সত্যি যদি এই অভিযোগে চাকরি চলে যায় বা জেল খাটতে হয় তাহলে ছেলে মেয়ের জীবনে তার কী প্রভাব পড়বে, এই সব আকাশপাতাল ভাবতে থাকতাম ভিতরে ভিতরে।

এমনই মানসিক অবস্থা যখন, তখন কয়েকজন ডাক্তার আমায় ওষুধ দিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে ছিলেন আমার ট্রেড ইউনিয়নের শিক্ষক ও গুরুজনেরা । যেমন নিসার সাহেব, ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট; চায়ের দোকানে বেঞ্চিতে বসে ছোলা চিবোতে চিবোতে মুচকি হেসে শুরু করলেন, কা হো, সুনাতানি বহুতে মাল কমইলে বাড়!”… আর দ্বিতীয়জন গুরুচরণদা। দেখা হতেই, এই যে ক্রিমিন্যাল! এসেছ? বস।

চীৎকার করিনি অবশ্য, কিন্তু টিপুনি দুটোই ছিল মোক্ষম! হাতের তালুর এ্যাকুপ্রেশার পয়েন্টে টিপে মাথার ব্যথা সারানোর মত। তৎক্ষনাৎ লাঘব হল ব্যথা।

রওশন-খয়াল  

উর্দুর এই শব্দটা খুব ভালো লাগে। যাঁদের ভাবনাচিন্তা আলোকোজ্জল, তাঁরাই রওশন-খয়াল।

যখন কঙ্কড়বাগে তাঁর বাড়িতে পৌঁছোতাম, সময়টা সচরাচর হত অপরাহ্ন, সাড়ে তিনটে বাজছে হয়ত দরজা খোলা থাকত, ভিতর থেকে আওয়াজ দিতেন আসছি!

ভিতরে ঢুকে বসতে দেখলাম লুঙ্গি পরে খালি গায়ে একটা গাজর চিবোতে চিবোতে আসছেন। খাবে? গাজর চিবোতে আমারও ভালো লাগে; আমার হাতে একটা গাজর ধরিয়ে সামনের সোফাটায় বসলেন। সামনের ছোট টেবিলের স্তুপের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে হয় আগেকার প্রুফ ছাপার কাগজের মত ময়লা নয়ত একপিট্‌ঠা দুটো কাগজ তুলে নিলেন। দ্যাখো, একটা খসড়া করেছি প্রোগ্রামের! পড়ে যাও একবার। তারপর বলো আর কী কী করা যেতে পারে।

পড়ে গেলাম। কোনো বড় অনুষ্ঠান বা সম্মেলন গোছের কিছু একটার সাফল্যের জন্য কী কী অবশ্যকরণীয় তার একটা বিশদ ছক। আজকের সরকারি ভাষায় যাকে বলে ডিপিআর ডিটেল্ড প্রোজেক্ট রিপোর্ট। দেখে আমি যতটা উৎসাহিত ঠিক ততটাই হতোদ্যম হয়ে পড়ছি। এত কাজ! করবে কারা? লোক তো গোনাগুনতি! আলোচনাচক্র, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, শিশু ও যুবদের মাঝে বিভিন্ন গ্রুপে গান, আবৃত্তি, প্রশ্নোত্তরী প্রতিযোগিতা, স্মরণিকা ছাপানো, পরিচয়মালা/সংক্ষিপ্ত ইতিহাস গোছের দশটা চটি বই ছাপানো, সারা ভারত থেকে বাছা বাছা মানুষদের ডেকে আনা, তাদের থাকাখাওয়ার ব্যবস্থা, ব্যাগ তৈরি করানো, রাজ্যপালের প্রোগ্রাম নেওয়া, হ্যানত্যান তার ওপর প্রত্যেকটি আইটেমের খুঁটিনাটি, ডেট শিডিউল।

আমি হয়ত হেসে বললাম, কে কোন কাজটা করবে তাদের নামগুলোও পাশে পাশে লিখে দিন! দেখুন কজন আসে।

তাও লিখে দিতেন। এবং কাজগুলো ঠিক অতটা না হলেও কিছুটা তো হতই। ঠিক যেভাবে হওয়ার কথা ছিল সেভাবে না হলেও হত। তাঁর খুঁতখুঁতেমিতে ব্যতিব্যস্ত হতাম সবাই। এতে এত খরচ হল কেন? তোমাদের দুজনকে দায়িত্ব দিচ্ছি, খোঁজ নাও এই বিলটা আসল না নকল? প্রত্যেকটা দরের জন্য আলাদা করে বাজার থেকে কোটেশন নিয়ে মেলাও।’… এটা এত বাজে হল কেন? কোত্থেকে করানো হয়েছে কাজ? আমাকে দাও ঠিকানা, আমি নিজে গিয়ে চেক করব। নিশ্চই বখরার ব্যাপার আছে।’… তারপর ক্ষোভের হতশ্বাস, মনের তাগিদটাই কমে যাচ্ছে মানুষের! শুধু মুখের ফেরেববাজি!”… তবু, আবার তৈরি করতে বসতেন ভবিষ্যতের নতুন কাজের নতুন কর্মসূচী!

পরে যখন এখানকার বাড়ি বিক্রি করে চলে গেলেন, মাঝেমধ্যে আসতেন, শেষের দিকে থাকতেন মিঠাপুর বি এরিয়ায়, ডঃ (ক্যাপ্টেন) দিলীপ কুমার সিনহার অতিথি হয়ে হোপ হস্পিট্যালের পিছনের ঘরটায়। তখনও ওই রকম ব্যাপক কর্মসূচী, এই তো সার্ধশতবার্ষিক রবীন্দ্রজয়ন্তীর আগেও। শুধু, কে কোন কাজটা করবে, সেটা আর বুঝে উঠতে পারতেন না।

কিন্তু করতে তো হবে! তোমরা বুঝতে চাইছ না।…” স্পষ্ট বলতেন না, কিন্তু তাঁর উদ্দীপনা আর ব্যাকুলতা  দেখে মনে হত বলতে চাইতেন যে প্রত্যেকটি সামাজিক/সাংস্কৃতিক উদযাপনে, মানুষের চেতনাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাগুলোর যে একটি নির্দিষ্ট ন্যূনসীমা থাকে, তার নিচে যেন কখনই না থামে আর তাকে যেন এড়িয়েও না যায় সে উদযাপন।

ওঘরে কফি আছে হোপ হাসপাতালের ঘরটায় বসে বলতেন, খেতে চাও তো তৈরি করে নাও গিয়ে। ব্ল্যাক কিন্তু। এক মগ আমাকেও দিও। জল ফোটাতে ফোটাতে আমি অনুভব করতাম, অসুস্থ শরীর নিয়ে ঘরে বন্দী একটা মানুষ ওঘরে বিহার ও বহির্বঙ্গে বাঙালিদের কিংকর্তব্য আর তাতে বাঙালি সমিতির ভূমিকা নিয়ে যে এত চিন্তাশীল, সেই চিন্তাটা নিছক বাঙালিয়ানার নয়, সেই সুস্থ সচেতন গণতান্ত্রিক চেতনার, যা ভারতের সবচেয়ে বড় রক্ষাকবচ।  আর তাঁর ভাবনাচিন্তায় যে এত আকূলতা আর অস্থিরতার দোলা, তার ঠেলাটা আসছে সেই মহামানবের সাগরতীরের আকাশের আলোর প্রবাহ থেকে, যে সাগরতীরে পৌঁছে আলোর প্রবাহ অব্দি মাথাটা ওঠাতে পারে বলেই কোনো কোনো মানুষ রওশন-খয়াল হয়ে ওঠে। 

শিষ-বাজিয়ে

আজকাল খুব চলেছে শব্দটা, হুইস্‌ল্‌-ব্লোয়ার, বাংলায় আক্ষরিক অর্থে শিষ-বাজিয়ে, যদিও সদর্থে হবে দৃষ্টি-আকর্ষক, বা সাবধানকর্ত্তা, বা হাঁক-দার। জানিনা কলকাতায় এর কোনো সরকারি বাংলা হয়েছে কিনা।

ভারত স্বাধীন হওয়ার পর প্রতিটি জনগণনার সময় এই বহির্বঙ্গে, বাংলা মাতৃভাষার ক্ষেত্রে যে কারচুপিটা সরকার বা সরকারি বিভাগ বা সরকারি আধিকারিকেরা করে চলেছে সেটা তিনিই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছিলেন।

এই কারচুপিতে সংশ্লিষ্ট আধিকারিকদের প্রত্যক্ষ আর্থিক কোনো প্রাপ্তি নেই। আনন্দপ্রাপ্তি অবশ্যই আছে চিত্তের বাঙালি-বিদ্বেষ পরিতৃপ্ত হয়। এক ধরণের ভাবের ঘরে চুরি। যেখান থেকে শুরু হয় সেখান থেকে যদি ধরি, তাহলে প্রথমতঃ, জনগণনার ফিল্ডকর্মীরা ফর্ম নিয়ে ঘরে ঘরে পৌঁছোয় না। তাদের ট্রেনিংএর সময় দেওয়া হয় উপদেশটা। ফর্ম উল্টো পাল্টা ভরে দিলে পরে তোমাদেরই জবাবদিহি করতে হবে; তাই একটা খাতায় প্রধান তথ্যগুলো নোট করে নিও কিছু মাইনর ইনফর্মেশন তো কমন রাতে ঘরে বসে ওই খাতা দেখে দেখে ফর্মগুলো ভরে তারপর কমন ইনফর্মেশন গুলো বসিয়ে নিও! এই হিসেবে মাতৃভাষার ইনফর্মেশনটাও মাইনর ও কমন। কাজেই রাত্রে ঘরে বসে সব হিন্দি ভরে দেওয়া যায়! আবার সব কাজের মত এই কাজেরও সুপারভিজন হয়, এবং সেই কাজটি করেন যে আধিকারিক, তার সাথে খুব স্বাভাবিক ভাবে জড়িয়ে যায় স্থানীয় রাজনীতির কুস্বার্থ। ভূল তথ্যকে ঠিক দেখাতে অনেক ঠিক তথ্যকে ভূল প্রতিপন্ন করতে হয়। তৃতীয়তঃ, তথ্য-বর্গীকরণ। একটি লোকভাষা বা উপভাষা মাতৃভাষা হলে তাকে কোন প্রধান ভাষার সাথে জুড়তে হবে, এই সিদ্ধান্তটা কারো ব্যক্তিগত মূর্খতা বা চালাকির এক্তিয়ারে না থাকলেও বেশ কয়েকজন সরকারি ভাষাবিদ/ব্যুরোক্র্যাটদের সামূহিক মূর্খতা বা চালাকির এক্তিয়ারে থাকতেই পারে।   

বিগত কয়েক বছরে, জনগণনায় তথ্যপ্রযুক্তির প্রয়োগ, ঘরের মানুষের সামনে আধারকার্ডের ফর্ম ভরানোর বাধ্যবাধকতা, তথ্যের অধিকার সম্পর্কিত আইনটির বলবৎ হওয়া ইত্যাদি ঘটনাগুলো অন্যান্য অনেক সরকারি কাজের মত জনগণনার কাজেরও জনবিরোধী গোপনীয়তা অনেকাংশে কম করতে পেরেছে। ২০১১র জনগণনার পরিসংখ্যানে আপনি কোথায়, তা অনলাইনে জানতে পারছেন। লিঙ্গুইস্টিক সার্ভে বা ভাষার জরিপ, যা ভারতে প্রথম ও শেষবার সেই উনবিংশ শতাব্দীর মাঝে গ্রিয়ারসন সাহেব করেছিলেন, আজ আবার হচ্ছে, আর তাতে আপনার জায়গা আপনি অনলাইনে জেনে নিতে পারবেন।

তাছাড়া, আমি এটাও মনে করি যে ১৯৯১এর পর বিভিন্ন কারণে আত্মপরিচয়ের রাজনীতির (identity politics) যে একটা পর্ব শুরু হয়েছে, তাতে বহির্বঙ্গে বাংলাভাষীদের প্রতি হতে থাকা অন্যায় ও জুলুমগুলো রাজনীতিগত দিক থেকে ওঠানো একটু সহজ হয়েছে, অন্ততঃ শিক্ষিত এবং রোজগারে প্রতিদ্বন্দ্বী ভিন্নভাষীদের সামাজিক বিদ্বেষদৃষ্টি কিছুটা নরম পর্যায়ে চলছে আপাততঃ।

কিন্তু আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে? অথচ সেই বিষম পরিস্থিতিতে গুরুচরণ সামন্তের মত মানুষেরা কিভাবে এগিয়ে চলেছিলেন? একটি গুরুত্বপূর্ণ লেখা আছে ওনার, বাঙালির অন্তর্ধান ও বিহার। বহুবার ছাপা হয়েছে, পুস্তিকা হয়েও বেরিয়েছে। তথ্য/পরিসংখ্যানে সমৃদ্ধ লেখাটি থেকে কয়েকটি পংক্তি উদ্ধৃত করার লোভ সামলাতে পারছিনা।

…“এর আগে আমি ১৯৭১ সালের জনগণনার সময়, ঘাটশীলার বি.ডি..র অফিসে গণনাকারীদের কিভাবে ১৪ নং কলমে লিখে দেবার নির্দেশ দেওয়া হচ্ছিল, তা উল্লেখ করেছি। উক্ত ঘটনার পর, বিহার বাঙালি সমিতির পক্ষ থেকে এ নিয়ে পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি ও ১০ হাজার লিফলেট বিলি করা হয়। ১৯৮০ সালেই জামশেদপুরে নি.ভা.বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনে, বহির্বঙ্গ শাখায়, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রণব মুখার্জির উপস্থিতিতে, বাংলাভাষী জনসংখ্যার হেরফের করার প্রসঙ্গটা উত্থাপন করে মিডিয়ার কাছে আমার পরিসংখ্যানগুলো বিলি করে দিই।”…

যিনি লিখছেন, মনে রাখতে হবে নিজের পেশাগত জীবনে তিনি একজন কলেজ শিক্ষক (আগামী দিনে সেই কলেজের প্রাচার্য), পাঠ্যপুস্তক প্রণেতা অর্থাৎ ইংরেজীতে যাকে বলে একডেমিশিয়ান। অন্ততঃ বাইরের মানুষজনের চোখে। অথচ কাজগুলোর কথা একজন পোড়খাওয়া রাজনৈতিক/সামাজিক কর্মীর ভাষায় বলছেন।

কয়েক বছর আগে। আনন্দ কিম্বা ব্যাঙ্গালোর থেকে গুরুচরণদা পাটনায় এলেন। আমাকে অফিসে ফোন করে ডাকলেন। যাওয়ার ছিল অশোক সিনেমার পাশে একটা গলিতে, সেন্সাসের অফিসে। ২০০১র জনগণনার ভাষাভাষী-অধ্যায় তখনও প্রকাশিত হয়নি। সন্দেহের যথেষ্ট কারণ ছিল যে পরিসংখ্যান এধার ওধার করার কিছু একটা খেলা চলছে ভিতরে ভিতরে। অফিসারের কাছে বসে, ভাষাভাষী-অধ্যায়ের প্রকাশনের শুধু একটা সম্ভাবিত দিনক্ষণ পাওয়া গেল। অফিসারের কার্ডটা নিয়ে আমাকে দিয়ে দিলেন মাঝে মধ্যে খোঁজখবর নিতে।

আমার কিন্তু নেওয়া হলনা। এই এক্ষুণি, এই লেখাটা লেখার সুবাদে মনে পড়ায় ইন্টারনেটে সেন্সাসের সাইট খুলে ২০০১ সালের জনগণনার ভাষাগত পরিসংখ্যানগুলো ডাউনলোড করলাম।

গুরুচরণদা গুরুচরণদা, আমি আমি! অথচ কাজগুলো করার জন্য তেমন সচেতন, নিরলস ও অভিজ্ঞ হুইস্‌ল্‌ব্লোয়ারের আজও ততটাই প্রয়োজন!  

 

পুরোনো রাজদূত

বোতাম ছেঁড়া গেরুয়া রঙের জামা পরে একটা পুরোনো রাজদূত মোটরবাইক ভটভটিয়ে পৌঁছে যেতেন আমার অফিসে। পরে অবশ্য একটা মোপেড ধরেছিলেন অপেক্ষাকৃত হাল্কা বলে। কিন্তু রাজদূত শব্দটার সাথে একটা যেন সম্পর্ক ছিল তাঁর। একদিন নিজের বাড়িতে দেখালেন একটা যত্ন করে মোড়া কাপড়ের টুকরো, চিনতে পারছো? সত্যি বলতে আমি পুরো প্রসঙ্গটা জানতামই না। তাই পতাকা মনে হলেও সেই মুহুর্তে জেনারাল নলেজে ফেল করেছিলাম। কোন দেশের, গুলিয়ে ফেলেছিলাম।

পরে পূর্ণেন্দুদা পুরো প্রসঙ্গটা বলেছিলেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার উপলক্ষে বিহার বিধানসভায় বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলিত হয়েছিল। পতাকাটা সাপ্লাই করেছিলেন গুরুচরণদা, তাও রাত জেগে নিজের ঘরের সেলাই মেশিনে সেলাই করে! সে পতাকা আর বিধানসভার আর্কাইভে থাকেনি, ফিরে এসেছিল আসল দর্জির হাতে। পরে আরেকটা প্রসঙ্গ জানলাম। বিহারের তরফ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রশস্ত্র যোগান দেওয়া হয়েছিল আর সেই অস্ত্রবোঝাই ট্রাকটা দেশের সীমান্তে নিয়ে পৌঁছেছিলেন গুরুচরণদা। তাহলে হলেন কিনা তিনি রাজদূত? বাংলাদেশের জন্য ভারতের, আর ভারতের জন্য বাংলাদেশের? সে তাঁর জামার বোতাম যতই ছেঁড়া থাকুক, বাইকটা যতই লজ্ঝড় হোক!

         যখনই ভাবি, মনে হয় তাঁদের একটা দিন ছিল। ষাট-সত্তরের দশকে কদমকুঁয়ায় সুলেখা প্রিন্টিং ওয়ার্ক্সে মন্টু সরকার, ওদিকে নালা রোড পেরিয়ে ডঃ এ কে সেন, দলদলির মুখটায় ভাগলপুর মেসের সামনে গুরুচরণ সামন্ত, তারপর রঙীন হালদার, আরো একটু আগে ডঃ ঘোষাল কী সব মানুষ ছিলেন! সবাই রাজদূত! স্বপ্নের পৃথিবীর রাজদূত!

এখন অনেকে বলবেন, হাঃ, কী হল সেই স্বপ্নের পৃথিবীর? এটা ঠিক যুদ্ধে আহত বীরকে যেন বলা, হাঃ, কী হল অস্ত্র নাচিয়ে? বড় যে বলতে জিতবে? তার তো কোনো লক্ষণ দেখতে পাচ্ছিনা। আর জিতলেও তদ্দিন তুমি বাঁচবে কী? মিছিমিছি জীবনটা

নষ্ট করলে!

স্বপ্নের যোগানদার

শুধু অস্ত্রের আর পতাকার, দুষ্প্রাপ্য বই, দলিল আর পরিসংখ্যানের আর হ্যান্ডবিলের নয়, প্রয়োজনে বস্তুতঃ স্বপ্নেরও যোগানদার হয়ে যেতেন গুরুচরণদা। ঘটনাটা আমার সাথেই ঘটেছিল।

রবিঠাকুরের কিছু রচনার সংকলন নাকি হিন্দিতে বেরুবে আর প্রকাশক বিশ্বভারতীর যে প্রাক্তন শিক্ষককে এই সংকলন সম্পাদনার দায়িত্ব দিয়েছে তিনি গুরুচরণদার বিশেষ পরিচিত, বলা যায় পুরোনো বন্ধু। গুরুচরণদার সাথে বসে তিনি সম্ভাব্য অনুবাদকদের নামের একটা সূচী তৈরি করেছেন। তাতে আমার নামও আছে, পুনশ্চ ও আরো কয়েকটি শেষের দিকের বইয়ের কবিতার অনুবাদকর্তা হিসেবে। আমি শুনে প্রথমে তো ঘাবড়ে গেলাম। কিন্তু সে যাই হোক, গুরুচরণদা সেই প্রফেসরসাহেবের সাথে আমার অফিসে এলেন, এমনকি আগাম-মজুরি (৫০%) পেলে তবেই চুক্তিতে সই এসব কথাও হল, সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে গুরুচরণদা বললেন, কাজটা শুরু করে দাও, এগিয়ে থাকো, পরে সময় পাবে না।

তখন বাড়িতে আমার শ্বাশুড়ি অসুস্থ, শয্যাশায়ী। তিনি নিজেও, নাইট কলেজে গুরুচরণদার কাছে পড়ে গ্র্যাজুয়েশন করেছেন এক সময়, গুণমুগ্ধ ছাত্রী। ওঘরে সবাই তাঁকে ঘিরে, আর বাইরের ঘরে আমি বসে বসে পুনশ্চর কবিতাগুলোর অনুবাদে রত। মাথায় স্বপ্ন, আমারও নাম থাকবে রবিঠাকুরের কবিতার হিন্দি অনুবাদে!

শ্বাশুড়ি মারা গেলেন কিছুদিন পর। ওদিকে সেই সংকলনও আর প্রকাশিত হলনা। বা হয়ে থাকলেও আমাকে বাদ দিয়েই হয়ে থাকবে।

দুরুখি মাই

আমাদের বাড়িতে খেতে বারম্বার অনুরোধ করতেন আমার স্ত্রী। শেষে একবার দুপুরে এসেছিলেন। কিন্তু খান নি। তখন তাঁর স্মৃতিপথে ঘোরার পর্ব। রামগড়, হাজারিবাগ ঘুরে আসছেন। নিজের তোলা নানান ফটো দেখালেন। রামগড়ে তাঁদের আদি বাসস্থান, রাজপুরোহিত হিসেবে, নেতাজী যে গাড়িতে করে গোমো গিয়ে দেশ থেকে পালাবার জন্য ট্রেন ধরেছিলেন (সে গাড়ির ছবিই কী? নাঃ, আমারও স্মৃতিভ্রংশ হচ্ছে), একটা প্রাচীন মন্দিরে কোমরউঁচু থামের ওপর গর্ত্তে জল, সে জল নাকি ফুরোয় না, ভিতর থেকে কী রহস্যে ভরে ওঠে কেউ জানেনা(!) । লোকশ্রুতির ভিতরে প্রবেশ করার এই শখটা তাঁর ছিল জানতামনা। বললাম, তাহলে চলুন, দুরুখি মাইকে দেখে নেবেন। আমাদের বাড়ির সামনের গলিতে একটা ছোট্টো চুড়োহীন মন্দির বা বলতে গেলে পুজোর ঘর। মন্দির পেরোতে গলিটা বাঁক নিয়েছে মন্দিরের দেয়ালের সাথে। তারপর ওদিকে বেরিয়ে গেছে। দুদিক দিয়েই বড় রাস্তায় পড়া যায় তাই নাম দুরুখি। মন্দিরের বাইরে পুরাতত্ত্ব বিভাগের একটা বোর্ড, তাতে লেখা আছে যে মন্দিরের ভিতরে মুর্ত্তিটা বৌদ্ধ শিল্পের শালভঞ্জিকা মোটিফ, স্থানীয় মানুষেরা দেবী হিসেবে পুজো করে থাকে।

মন্দির খোলা ছিল। এক মহিলা পুজো দিচ্ছিলেন। আমি চটি খুলে ভিতরে ঢুকে তাঁকে আশ্বস্ত করলাম ব্যাঙ্গালোর থেকে এসেছেন প্রফেসর সাহেব। পুরোনো মুর্ত্তি-টুর্ত্তি এসব নিয়ে রিসার্চ করেন দেশদুনিয়া ঘুরে।

তাও তো আছে, গুরুচরণদা। তিরিশ বছর আগে রেললাইনের ওপারে তালবনের ভিতরে একটা প্রায় আস্ত অশোকস্তম্ভ দেখেছিলাম, আর্কিওলজিকাল সার্ভের বোর্ডও ছিল। আজ সব বেমালুম হাপিশ। খাম্বাসুদ্ধু গিলে খেয়ে বাড়ি উঠে গেছে তিন তলা!

(যে মহিলা পুজো দিচ্ছিলেন তাঁর দিকে ইশারা করে) ওনাকে বলো না মুর্ত্তির গায়ের কাপড়টা একটু সরাতে। কিছু তো বোঝাই যাচ্ছে না ক্যামেরায়!

(বললাম, মহিলা শিউরে উঠে কান চাপা দিলেন) ছি, ছি, মাতার গায়ের কাপড় সরাতে বলছেন? পুরুষদের সামনে মায়ের কাপড় সরানো যায়না। পাপ হবে!

আর কিছু বলার থাকে না।

সেবারে হাজারিবাগ ঘুরে যে ছবি তুলেছিলেন সেগুলোই কাজে লাগিয়েছিলেন কয়েক সপ্তাহ পরে লেখা রবীন্দ্রনাথ ও হাজারিবাগ প্রবন্ধটাতে।

[বিহার বাংলা আকাডেমির প্রকাশনা 'গুরুচরণ সামন্ত স্মারকগ্রন্থ'এ প্রকাশিত] 



সেমিনারের দরজা খুলে

ভাষা ও সংস্কৃতির প্রাচীনতা, অবশ্যই গর্বের। কিন্তু নবীনতা তার থেকেও বেশি গর্বের।

কথাটা কি ধোঁয়াটে শোনাচ্ছে? তাহলে আরেকটু খোলসা করে বলি।

ভাষা ও সংস্কৃতির ধারাবাহিকতা সম্পর্কিত সমাজটির বিকাশের বিভিন্ন পর্বের মধ্যে দিয়ে গড়ে ওঠে। একটি পর্বে, একটি যুগসন্ধিকালে, কোনো ভাষা এবং সংস্কৃতির বিগত হাজার বছর, বিগত সবকটি পর্বের বিকাশচিহ্ন, গ্রহণ, বর্জন, পুনঃপরিভাষণ, বিশ্লেষণ ও সংশ্লেষণের মধ্যে দিয়ে নবীকৃত হয়। একটি বিশেষ দেশকালে যে নবীকরণ প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে তার পুরোটা হওয়ার মধ্যেই থাকে তার প্রাচীনত্বের (অথবা অর্বাচীনত্বের) সার্থকতা। নবীকরণটা না হলে প্রাচীনতা অর্থহীন।

দেশে স্বাধীনতা সংগ্রাম চলছে। বা সমাজটাকে বদলাবারই না হয়, একটা আন্দোলন চলছে। ধর্মকে সংস্কার করার জন্য চলছে একটা অভিযান। একটি প্রাচীন ভাষা ও সংস্কৃতি, কিন্তু সে হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারল না সেই অভিযানের। অথচ একটি অর্বাচীন ভাষা ও সংস্কৃতি হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারল। তাহলে কোনটা বেশি গর্বের হবে? প্রাচীনতা, না নবীনতা? প্রাচীনতা সেখানে গর্বের কী বলতে গেলে প্রাচীন সে ভাষাটি মরেই যাবে। অবধারিত তার মৃত্যু।

আমাদের এই দেশটা সেদিক থেকে সত্যিই গর্বের যে এদেশের সবকটি ভাষা, প্রাচীন হোক বা অপেক্ষাকৃত নবীন, এমনকি অনেকগুলি লিপিহীন (সেসময়ে) উপজাতীয় ভাষা মায় প্রধান ভাষাগুলোর উপভাষাসুদ্ধু ব্রিটিশ শাসনবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে এবং তার পরিপূরক সমাজসংস্কারের সংগ্রামে নিজেদের নবীকরণ ঘটিয়ে নিতে পেরেছে। তাই (প্রত্যন্ত দু-একটি ভাষা হয়তো বা বিলুপ্ত হয়ে থাকতে পারে, কিন্তু সাধারণভাবে) কোনো ভাষা মরে নি। বরং জেগে উঠেছে আত্মবোধনের এক প্লাবক বিস্ময়ে। এই প্রেক্ষিতটাই আমাদের ভাষাসমস্যার প্রেক্ষিত। এবং এটাই তার সমাধানেরও প্রেক্ষিত।

ব্রিটিশ শাসন তাদের শাসনাধীন দেশটাকে ভাগ করেছিল প্রশাসনিক সুবিধায়। স্বাধীনতা আন্দোলন এগোতে গিয়ে টের পেল এটা ভুল, এটা ভারতবর্ষের জনতার ঐক্যের পরিপন্থী। আন্দোলন এগোবার পথে চিনল ভারতবর্ষের বহুজাতিক সত্ত্বা এবং এই সত্ত্বার প্রধান পরিচয়, ভাষা। ১৯২০ সালে নাগপুর অধিবেশনে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস ভাষার ভিত্তিতে রাজ্যগুলির পুনর্গঠনের নীতি স্বীকার করলও। ১৯২৮ সালে মতিলাল নেহরু রিপোর্ট নামে পরিচিত সর্বদলীয় কমিটির রিপোর্ট ভাষার ভিত্তিতে রাজ্যগুলির প্রশাসনিক পুনর্গঠনের দাবি জানালো। ধারণাগত কিছু অপূর্ণতা তাতে ছিল। কিন্তু স্বাধীনতা-প্রকল্পের আবশ্যক অঙ্গ হয়ে দাঁড়ালো রাজ্যগুলির ভাষাভিত্তিক পুনর্গঠন যাতে নিহিত রইল দেশের বহুজাতিক সত্ত্বার স্বীকৃতি। এই দাবি লাগাতার বজায় রইল কংগ্রেসের সনদে, স্বাধীনতা অব্দি। স্বাধীনতার পর কী হল?

ঠিক তাই হল যা অন্য অনেক দাবির ক্ষেত্রে হল। বিশেষ করে যে দাবিগুলিতে নিহিত ছিল দেশ ও সমাজের অধিকতর গণতন্ত্রীকরণ ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রত্যাশা।

ঠিক তাই হল বলে আমি কিছুই হল না বলতে চাইছি না। বলছি, দ্বন্দ্বের যে নতুন রূপটা অন্য ক্ষেত্রে দেখা গেল, ভাষার ক্ষেত্রেও সেটা দেখা গেল। স্বাধীনতার আগে যেখানে ছিল ইংরেজ সরকার বনাম ভারতবর্ষের জনতার দ্বন্দ্ব, স্বাধীনতার পরে সেখানে দেখা গেল বড়ো বড়ো পূঁজিপতি ও তাদের তাঁবেদার সরকার বনাম দেশের জনতার দ্বন্দ্ব।

কথাটা রাজনীতি শোনাচ্ছে?

তাহলে বলুন, স্বাধীনতার ঠিক পরে পরেই যখন অন্ধ্র, কর্ণাটক, কেরল ও মহারাষ্ট্রে পুনর্গঠনের আন্দোলন তুঙ্গে, ভাষাভিত্তিক রাজ্য কমিশন কিম্বা দার কমিটি কেন বলল, প্রশাসনিক সুবিধাই পুনর্গঠনের প্রধান ভিত্তি হওয়া উচিৎ? এবং দেশের সুরক্ষা ও স্থিতিশীলতার খাতিরে পুনর্গঠন এখন (মানে তখন) বাঞ্ছনীয় নয়? ১৯২৮ সালের সাইমন কমিশনও তো ঠিক এই কথাই বলেছিল!

এমনকি ১৯৫৪ সালের ২৩শে জুন ইস্টার্ন ইকোনমিস্টএর পাতায় বড়ো শিল্পপতিরা রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনকে তাদের মত জানালো যে, কোনো রকম পুনর্গঠন স্থগিত রাখা উচিৎ কেননা তা জাতীয় অর্থনীতির বিকাশের পরিপন্থী!

রাজ্য পুনর্গঠন তবুও হল। নানা বিতর্কের মধ্যে দিয়ে। পুরোটা হল না। হতে থাকল, এখনো হচ্ছে। জনতার আন্দোলনের চাপে। তাতে ফলটা দাঁড়ালো এই যে আন্দোলনের উত্তেজনা অনেক সময়েই জাতীয় ঐক্যের ন্যূনতম মাত্রাটা ছাড়িয়ে যেতে থাকল। কিন্তু দোষটা কার? কে বিভেদ সৃষ্টি করছে ভারতের ঐক্যে? ভাষা আন্দোলন? না ভাষার ন্যায়সঙ্গত দাবিগুলির প্রতি উদাসীনতা?

আসলে একচেটিয়া পূঁজির কাছে সারা ভারতবর্ষ একটি বাজার। সেখানে নানা রকম ভাষা হলে তাদের ক্ষতি। একটিই ভাষা থাকলে তাদের লাভ। তাই, হিন্দিকে তারা বার বার সম্পর্ক-ভাষা থেকে রাষ্ট্রভাষায় উন্নীত করতে চাইছিল। বিরোধ হলে বরং ইংরিজিই চলুক, এই মনোভাবে ইংরিজিরও বয়স দশ দশ বছর করে বাড়ছিল। ওদিকে বহুজাতিক পূঁজির কাছে সারা পৃথিবীই একটা বাজার। ইংরেজি তাদের জন্য এমনিতেও বেশি লাভজনক। তবু ভাষা যখন জাতির আত্মপরিচয় ও প্রতিরোধী ঐক্যের হাতিয়ার হয়ে থাকছে তখন তারা আরম্ভ করেছে অধোজাতীয় (সাবন্যাশনাল) সত্ত্বাগুলিকে জাতীয় সত্ত্বার বিপক্ষে দাঁড় করানোর খেলা। যাতে ঐক্যে ভাঙন ধরানো যায় আর পরিণামে একভাষা (ইংরেজি) ভিত্তিক বিশ্বায়নের পথ সুগম হয়। কিন্তু সে কথা আপাততঃ থাক।

সুনীতিবাবু বলেছিলেন, বাঙ্গা্লী জাতির বা বাঙ্গলা দেশের সম্বন্ধে কিছু কথা বলিতে হইলে ভারতবর্ষকে বাদ দেওয়া যায় না। ভারত হইতেছে সাধারণ। বাঙ্গলা হইতেছে বিশেষ। যাহা লইয়া বাঙ্গালীর বাঙ্গালীত্ব, বাঙ্গালীর অস্তিত্ব তাহার মধ্যে বেশীর ভাগই ভারতবর্ষের অন্য জাতির মধ্যেও মিলে। ভারতের অন্যান্য প্রদেশের লোকেদের সঙ্গে সেই সব বিষয়ে বাঙ্গালীদের সমতা আছে।

বিশেষের উপর ঝোঁক দিয়া সাধারণকে ভুলিলে চলিবে না সাধারণই যখন প্রধান।

এই উদ্ধৃতিটা পেলাম সঞ্চিতার, বিহার বাঙালি সমিতির হীরক জয়ন্তী ও সঞ্চিতার রজত জয়ন্তী সংকলন থেকে। যে লেখার নিচে এই উদ্ধৃতিটা বক্স করা আছে সে লেখাটি শ্রী বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের ১৯৭৭এ লেখা। লেখাটিতে হাল্কা চালে বিভূতিবাবু একটি বিপদের দিকে ইংগিত করেছেন যা আজ আরো বেশি করে, বহুমাত্রিক প্রাসঙ্গিকতা রাখে।

বিভূতিবাবু দেখিয়েছিলেন যে যখন বাংলাওয়ালা আর হিন্দিওয়ালা নিজেদের মধ্যে বিতর্কে ডুবে আছে, বাংলাওয়ালা অভিযোগ করছে হিন্দির আধিপত্য-বিস্তারী চক্রান্তের, বাংলার প্রতি সরকারি ঔদাসীন্যের আর হিন্দিওয়ালারা নিজেদের ডিফেন্ড করছে, ঠিক তখনই তাদের পুরো বিতর্কটাকে মার্জিনে ঠেলে দিয়ে এগিয়ে আসছে দুদলেরই বাড়িতে প্রতিপালিত ইংরেজিওয়ালা নতুন প্রজন্ম। উনিশশো সাতাত্তরে ব্যাপারটা বাড়ির সাংস্কৃতিক পরিবেশ, কেরিয়ার আর ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলের ত্রিকৌণিক অন্তর্ক্রিয়ায় সীমাবদ্ধ ছিল। আজ, ২০০১ সালে, বিশ্বায়নের সর্বগ্রাসী হামলার মুখে দাঁড়িয়ে ব্যাপারটা কি ওইটুকুতেই সীমাবদ্ধ আছে? নাকি ছড়িয়ে পড়েছে অনেক দূর ও অনেক গভীর অব্দি?

একটু তাকান তো টিভির বিভিন্ন ন্যাশনাল ও রিজিওনাল, সরকারি ও বেসরকারি চ্যানেলের বিজ্ঞাপনগুলোর দিকে! ভাষা আছে, সব ভাষা আছে; বাংলা, হিন্দি, তামিল, পাঞ্জাবি, প্রভৃতি সব, কিন্তু ফর্মের স্তরে। কন্টেন্ট? সব ক্ষেত্রে ইংরেজি আমেরিকান। সংলাপ বলার স্টাইল আমেরিকান। চরিত্রগুলির বৈশিষ্ট্য ও তাদের অন্তর্ক্রিয়ার ধরণ আমেরিকান। স্মৃতিসংকেত ও অর্থবিস্তার আমেরিকান। সিরিয়ালগুলোও তাই। অভিনয়ের বুনট, যাকে আধুনিক অভিনয় বলা হচ্ছে আমেরিকান। এমনকি উত্তেজিত নৈঃশব্দটুকুও হলিউড থেকে ধার করা। নাচ, গান, কমিক স্ট্রিপ ছেড়েই দিলাম। আগামি প্রজন্মের স্বপ্নময় ভবিষ্যৎ? আমেরিকায়, ইয়োরোপে, অস্ট্রেলিয়ায়। যদিও এটা কোনো ভাষারই সাধারণ শ্রমজীবী জনতার কথা নয়। কিন্তু মধ্যবিত্ত জনতার কথা এবং তারাই নতুন দুনিয়ার ভাবধারাগত প্রকল্পের সুত্রধার।

চমস্কি সাহেব যখন ভারতে এসেছিলেন তখন বলেছিলেন (একটু দীর্ঘ উদ্ধৃতি দিচ্ছি)ঃ-

If we believe that we are in an ideology-less world it is only because the efforts to impose rigid ideologies have been so successful that they seem invisible, like the air we breathe.

We live in the grip of fanatic ideologies and enormous efforts to implement them are a constant pre-occupation of the powerful and their doctrinal institutions; the huge public relations industries, media, schools and universities etc. We can observe it in practice, we can read it in the pronouncements and publications of leading figures in the business and intellectual worlds. We should take quite seriously their concern to wage the everlasting battle for the minds of men, who must be indoctrinated with the capitalist story to regiment the minds of men as an army regiments their bodies to control opinions and attitudes etc.

The strongest ideology by far, in my opinion is the mostly fraudulent doctrine of free-market capitalism …”

এই হল পরিস্থিতি। এই পরিস্থিতি শুধু বাংলার বা বাঙালির জন্য নয়, ভারতবর্ষের সবকটি ভাষাভাষী মানুষের জন্য, গোটা অনুন্নত তৃতীয় বিশ্বের জন্য।

একসময় মনে করতাম ভাষা বাঁচলেই সংস্কৃতি বাঁচবে। আজ মনে হচ্ছে সংস্কৃতি বাঁচলে তবে তো ভাষা বাঁচবে!

তাহলে ভাষা ও সংস্কৃতির ভবিষ্যৎ?

খুবই উজ্জ্বল এবং সে উজ্জ্বল উদ্ধারের ভার আমাদেরই হাতে। যে স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক আমাদের জাতিসত্ত্বা প্রতিষ্ঠা, আমাদের গণতন্ত্রপ্রতিষ্ঠা, আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতিপ্রতিষ্ঠা, সে স্বাধীনতাকে কি আমরা বাঁচিয়ে রাখতে পারবো না? উন্নীত করতে পারবো না সাম্রাজ্যবাদ-ও-একচেটিয়া-পূঁজি-প্রযোজিত-বিশ্বায়ন বিরোধী সর্বভাষিক ঐক্যের স্তরে?

এটাই এই পর্বের নবীকরণের চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জের প্রকল্পটি চোখের সামনে দাঁড় করাবার চেষ্টা করলেই দেখব অন্যান্য সব সমস্যা শিক্ষার সমস্যা, মার্জিনালাইজেশনের সমস্যা, হিন্দির আধিপত্যের সমস্যা, সরকারি ঔদাসীন্যের সমস্যা সেমিনার হলের দরজা খুলে বাইরে পথে গিয়ে প্রতিরোধী আত্মনির্ণয়ের স্লোগান হয়ে দাঁড়াচ্ছে, অন্য আরো অনেক স্লোগানের সঙ্গে। তার পিছনে গিয়ে আমাদের দাঁড়াতে হবে, পায়ে পা মিলিয়ে চলতে হবে।

আমাদের বার বার মনে রাখতে হবে নবীকরণের শেষ যে পর্বের আমরা সন্তান তা হল ইংরেজজাতির গোলামির বিরুদ্ধে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রকল্পে আমাদের জাতিসত্ত্বার, ভারতভূমির সবকটি জাতিসত্ত্বার সামুহিক আত্মনির্ণয়ের পর্ব। এই প্রকল্পেই নবীকৃত আমাদের দুতিন হাজার বছরের সংস্কৃতি ও সাতশো বছরের ভাষা। এই নবীকৃত দুতিন হাজার বছরে, মোয়নজোদড়ো এবং কবীর যেমন একাধারে ইতিহাসবোধ ও প্রতিরোধ, বর্ণমালা ও সুর, সম্বোধন ও সম্পর্ক, শিল্পায়ন ও বনসৃজন, কৃষি ও কৃষ্টি সবকিছুই একাধারে ইতিহাসবোধ ও প্রতিরোধ। ভবিষ্যৎ নিহিত এই প্রতিরোধী ইতিহাসবোধের বর্তমানে, বাস্তবতায়।

 

২৭.৩.২০০১

[ভারতীয় বঙ্গভাষী সমিতির প্রতিষ্ঠা-সম্মেলনের স্মরণিকায় প্রকাশিত]  


Wednesday, April 2, 2025

কন্নড়

হয়তো ওই দ্বিতীয় গলিটায় তুমি থাকতে।
বেশ জমজমাট ছিল, ভিড়, দোকানপাট
দুএকবার ফিরেছিলাম সন্ধ্যায়!
তবে মারিয়াম্মা মন্দির ধরে চেনা রাস্তার অভ্যেস
তাড়াতাড়ি ফেরার তাগিদ
অভ্যস্ত দোকান থেকেই রোজকার
                টুকিটাকি কেনার লোভ
এড়াতে পারি নি।
হয়তো ওই গলি ধরেই রোজ ফেরার
অভ্যেস করতে হতো।
দেশোয়ালি দোকান কয়েকটা ধরতে হত রোজকার।
সময়টাও প্রশস্ত ছিল লকডাউনে বন্দি;
নইলে ওই শহরে গিয়ে থাকা আর হয় কোথায়?
 
হয়তো ওই গলি ধরেই অভ্যেস করতে হতো
রোজ বিকেলে বেরিয়ে হেঁটে ফেরার।
কোনো একটি বাঁক ঘুরতেই আধোঅন্ধকার দোতলায়,
তোমাকে দেখতে পেয়ে যেতাম
যেমন তামিলে জুঁই ফোটার জানালা,
তেমনই তোমার বসন্ত রানীর আকাশ!
কবে থেকে সন্ধানে ছিলে,
সমুদ্রের তীরে ঝোড়ো বৃষ্টি থেকে আমগাছে ভরা পাহাড়ের
গরম অব্দি তোমায় চকিত অনুভব করেছি কান্নাডিগা
                                                   কাহিনীগুলোতে

১.৪.২৫ 

সকালে সিঁড়িতে বসেছিলে

সকালে সিঁড়িতে বসেছিলে, মুখে আলো।
বন্ধুত্বও হয়েছিল একটু, সেদিনই।
অনেক পরে, তখন এন্তার দুর্নাম
বাসস্ট্যান্ডে দেখলাম;
                                মায়ায় পড়েছি।
আজ ভাবি অন্নচিন্তা আপনজনের,
শেখালো বাজানো, বাদ্য করে, মন্দভাগ্য!
দেহে মনে ক্লেদস্পর্শ নিয়ে ক্ষোভটাকে,
হর্ষোল্লাস দেখানোর দাপট গেয়েছ।
 
প্রণয় পেয়েছ মিথ্যা, বন্ধুত্ব ভেজাল!
সবাইকে সুখে রেখে, টেনেছ জোয়াল।
ভাবি আরেকটু কাছে বন্ধুত্বে দাঁড়ালে,
ক্ষতিবৃদ্ধি কিছু হোক বা না হোক, রোজ
তুমুল কিছু ঝগড়া হলে, প্রতিবার
গাল খেতাম তোমার, নিঃস্বতা কমত।
 
২৯.৩.২৫
 

Friday, March 28, 2025

ইয়াসিন

মৃত্যুর কিছুদিন আগে থেকে মানুষটির মনে, সারা জীবনের ন্যায়-অন্যায়ের প্রশ্নগুলো প্রবলভাবে নাড়া দিতে শুরু করল। আর তার ফলে বিশেষ ভাবে জেগে উঠল তিন-চারটে পরিবারের মুখ যেগুলো তার জীবনের বিভিন্ন সময়ের সাহেবদের পরিবার।

আমাদের সমাজে চতুর্থ শ্রেণীর বা মুখের কথায় ফোর্থ গ্রেডএর, অন্যান্য শ্রেণীদের পরিবারে একটা বিশেষ গুরুত্ব আছে। ফোর্থ গ্রেড, সরকারি চাকরি করলে তো বটেই, বেসরকারি চাকরি করলেও ফোর্থ গ্রেড। এবং কোনো চাকরি না করে ছোটোখাটো ব্যবসা করলেও ফোর্থ গ্রেড, বিশেষ করে থার্ড, সেকেন্ড আর ফার্স্ট গ্রেডের পরিবারগুলোর দৈনিক কথাবার্তায়। আর এই ফোর্থ গ্রেডের মানুষেরা সারা জীবন, চাকরি বা ব্যবসার কাজ ছাড়াও প্রতিদিন, কোনো না কোনো সাহেব/হাকিম/হুজুর/মালিক পরিবারের ফাইফরমাশ খাটে। সরকারি এবং বেসরকারি চাকুরেদের ক্ষেত্রে ফার্স্ট বা সেকেন্ড গ্রেডের সাহেবদের পরিবারে খাটাটা বাধ্যতামূলক হয়। ব্যবসাদার হলে সামাজিক আনুগত্যের অভিব্যক্তি হয়, যেমন উঁচু বাড়ির লাগোয়া নিচু কুঁড়েতে থাকা গোয়ালা, ধোপা, এমনকি ছুতোর বা দর্জিও। (সেক্ষেত্রে বরং ডোমেরা মুক্ত কেননা পরম্পরাগতভাবে অচ্ছুৎ হওয়ার জেরে একমাত্র সাফাইয়ের কাজ ছাড়া অন্য কোনো কাজে তাদেরকে ডাকাই হয় না)। তবে বাধ্যতাটাও ধীরে ধীরে স্বভাবে পরিণত হয় কেননা দুপয়সা বখশিশের সঙ্গে সঙ্গে প্রচ্ছন্ন আশ্রয় এবং প্রশ্রয় জোটে যেটাকে সময় মতো কাজে লাগাতে পারলে ছেলের চাকরি, মেয়ের বিয়ে, বাড়ি তোলা ইত্যাদিতে ভাঙিয়ে মদত পাওয়া যায়।

থার্ড গ্রেডের সাহেবদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটায় সংশ্লেষ বেড়ে যায়। সেখানে বাধ্যতা বলতে কম থাকে। একটা সূক্ষ্ম পর্দার এধার-ওধার থেকে সাহেব এবং সেবক দুজনেই একে অন্যের প্রায় বাড়ির লোক হয়ে ওঠে, এবং সেধরণেরই প্রত্যাশা গড়ে ওঠে দুতরফে। আবার সেখানেই কখনো কখনো পর্দায় ফুটো হয়; পরিণামে কলহ আর কেলেঙ্কারিরও জন্ম হয়।

যাহোক, সেসব ফিল্মী ব্যাপার। তবে দপ্তরের চাপরাশি আর গৃহভৃত্যের মধ্যেকার অন্যোন্যতা অনেকদিন ধরেই বর্তমান। দপ্তরের চাপরাশি যেমন গৃহভৃত্যের কাজ করে, যে গৃহভৃত্য হয়ে মনিবের ঘরে ঢোকে সেও স্বপ্ন দেখে যে হুজুর তাকে দপ্তরে চাপরাশির কাজটা পাইয়ে দেবেন ( সে জানে শুরুটা আজকাল ডেলি ওয়েজ বা লিভ ভ্যাকেন্সি দিয়েই হয়)।

ইয়াসিন এই কক্ষপথেই চল্লিশ বছর কাটিয়েছেন। হঠাৎ তাঁকে গলার ক্যান্সার আক্রমণ করেছে এবং তিনি এখন মৃত্যুপথযাত্রী। অন্যান্য ভালো গৃহভৃত্যের বা গৃহভৃত্যের কাজ করা চাপরাশিদের মতো ইয়াসিনেরও সেসব বাড়িতে বিশিষ্ট স্থান থাকত যেখানে যেখানে তিনি কাজ করেছেন। প্রায় পরিবারের অঙ্গ হয়ে থাকতেন।

উচ্চবিত্ত পরিবারের (অর্থাৎ থার্ড গ্রেড নয়, সেকেন্ড বা ফার্স্ট গ্রেড) সদস্যদের বিবিধ প্রকার নিঃসঙ্গতা, অহঙ্কারের ঠোকাঠুকি এবং নানান মানসিক সমস্যার মাঝে গৃহভৃত্যদের নীরব, অনুশাসিত, কর্মঠ, অন্তরঙ্গ তবু বিজাতীয় উপস্থিতি মাঝে মাঝে জটিল মানবিক বিভ্রম তৈরি করে।

কর্মক্ষম দিনগুলোয় ইয়াসিনও বহুবার এই বিভ্রমে পৌঁছেছেন আর কিছুদিনের জন্য সেই অলীক জগতে ঘোরাফেরা করেছেন যেখানে ধনী আর গরীবে কোনো ভেদ নেই, মনিব বা মনিবানি বা পুরো মনিব পরিবার এবং গৃহভৃত্য পারস্পরিক সুহৃদ। ইয়াসিন কখনো বন্ধু কখনো অভিভাবক কখনো সন্তান হয়েছেন। তারপর একদিন অনিবার্যভাবে হঠাৎ সেই জগতটা ছোট্টো কিন্তু রূঢ়তম আঘাতে ভেঙে গেছে। ইয়াসিনও সেই সময়গুলোতে নিজেকে স্থির রাখতে পারেন নি নিজেকে প্রতারিত মনে করার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার জ্বালায় অসভ্যতাও করেছেন কখনো কখনো।

মৃত্যুপথযাত্রী ইয়াসিনের মনে সেই মুহূর্তগুলো ভীড় করে জেগে উঠল। এবং তিনি সিদ্ধান্ত করলেন যে মারা যাওয়ার আগে ঐ পরিবারগুলোতে যাবেন এবং নিজের তখনকার ব্যবহারের জন্য ক্ষমা চাইবেন।

ধীরে ধীরে এই ইচ্ছাটা তাঁকে আবিষ্ট করে তুলল। যেন কৃত-অন্যায়এর পাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার যথার্থ সম্ভব প্রায়শ্চিত্তপথ তিনি খুঁজে পেয়েছেন আর, দারিদ্র্য নয়, সংসারের জ্বালাযন্ত্রণা নয়, নিজের অসফলতা বা অক্ষমতাগুলো নয়, অন্যায়এর এই পাপবোধটাই তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড়ো মানসিক ভার।

দুই ছেলেকে বলাতে তারা মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল। স্ত্রীও বুঝলেন না। অসুস্থ শরীর নিয়েও ইয়াসিনকে বার বার উত্তেজিত হতে হল, তোরা বুঝছিস না! যাঁদের নেমক খেয়েছি আমি, যাঁদের বদান্যতা ছিল বলে তোরা মানুষ হলি, সংসারটা চলল, ফরিদার বিয়ে হল, তাঁরাই তো আমার জন্য আল্লার দূত ছিলেন! তাঁদের আমি অপমান করেছি …”

অপমান করেছ? আর তোমাকে যে যখন ইচ্ছে হল তারা দূর দূর করে তাড়িয়ে দিল, সেটা মনে পড়ছে না?

প্রবল ভাবে মাথা নাড়লেন ইয়াসিন, কিচ্ছু না, কিচ্ছু না! তাঁরা সব বড়ো বড়ো লোক। আমাকে বাড়ির একজনের মতো রেখেছিলেনি। আল্লা তো আমার পরীক্ষা নিচ্ছিলেন যে আমি নিজের হোশ, নিজের ইমান ঠিক রাখতে পারি, নাকি নিজেকে ওঁদের সমান ভাবতে শুরু করি। আর আমি, পাপী মানুষ, নিজেকে ওঁদের সমান ভাবতে শুরু করে দিতাম। তাই তো গন্ডগোলটা লাগত প্রতিবার!

মৃত্যুপথযাত্রীর অনেক অবুঝ ইচ্ছাও স্বজনেরা মেনে নেয়। বিবেকের তাড়নায় মেনে নিতে বাধ্য হয়। ইয়াসিনের পরিবারও মেনে নিল।

ইয়াসিনের বাড়িটা শহরের প্রান্ত ছাড়িয়ে এক গ্রামে। ইদানিং শহর ঐ গ্রামটাকে গ্রাস করে নিজের একটা অঞ্চল করে নিচ্ছে। নিজের চাকরী জীবন, ছেলেদের স্কুলে নিয়ে বা কাজেকর্মে যাওয়া আসা সাইকেলেই চলেছে এতকাল। কালেভদ্রে রিকশা বা অটো লেগেছে বিয়েশাদি বা অন্য কোনো অনুষ্ঠানে যেতে। কিন্তু গুরুতর অসুস্থ মানুষ সাইকেল চালায় কী করে! তাই ক্ষুদ্র সম্বল থেকে কিছুটা বার করে পকেটে রেখে ইয়াসিন দুই ছেলের কাঁধে ভর দিয়ে বাড়ি থেকে বেরোন।

খোলা ইঁটের দুধাপ নেমেই রাস্তা। আঠাশ বছর আগে বিহারশরীফ থেকে এসে যখন এই প্রত্যন্ত এলাকায় বাড়ি নেন তখন, মুসলমান বস্তিতে হলেও ইয়াসিন নিজেই রাস্তায় একজন বিজাতীয় মানুষ হতেন। ধীরে ধীরে পরিবেশ ঘরোয়া হয়ে ওঠে। দুপুরবেলা শান্ত রাস্তায় নিমফুল ঝরত। থ্রেশিং মেশিনের আওয়াজ আসত সামনে থেকে আর মোড়ের কাছে কুকুরগুলো ঝিমোতো। আটা পেষাইয়ের কলটাও বসতিতে ছিল না, বড়ো রাস্তার ওপর ছিল।

গত তিন বছরে হুলিয়া বদলে গেছে। নিচে নেমেই বাঁদিকে চায়ের দোকান। সেখানে সাতসকাল থেকে জমির দালাল, খরিদ্দার আর সদ্যজাগ্রত ব্যবসাবুদ্ধির গরমে দারুণ প্যাঁচালো মুখ করে নিবিষ্ট মনে চা খেতে থাকা জমিবিক্রেতা চাষিদের ভীড়। ক্রমাগত স্কুটার, মটোর সাইকেল, ট্রাক আর ট্র্যাক্টর-ট্রেলারের আসাযাওয়া।

চা-ওয়ালা জিজ্ঞেস করল ছেলেদের, কোথায় বেরুলে বাপকে নিয়ে এই বেলায়? ডাক্তারের কাছে?

কোথায় বেরুচ্ছে বলতে হলে অনেক কিছু বলতে হয়। তাই ছোট্ট একটা হুঁ বলে দায় সেরে তারা এগিয়ে যায়। ক্যানালের পাশ দিয়ে বড়ো রাস্তায় উঠে, অটো ধরে পৌঁছোয় স্টেশন। সেখান থেকে আবার অটো ধরে পুলের ওপর। নেমে রিকশা ধরে রিয়াজ কলোনি, ডঃ ইকবাল রশিদের বাড়ি।

ইকবাল রশিদ হাড়ের ডাক্তার তবে সাধারণ শল্যচিকিৎসক হিসেবেও সুনাম আছে। আজ তাঁর বিরাট চারতলা নার্সিং হোম। ইয়াসিন যখন এবাড়িতে প্রথম এসেছিলেন তখন নার্সিং হোমের জায়গায় পুরোনো ব্রিটিশ জমানার ভিলায় ছিল রশিদ ক্লিনিক, ইকবালের বাবার নামে। ভিলার চারদিকের বাগানের জমিতে একটু একটু করে ভিত বাড়িয়ে গড়ে উঠেছিল রিয়াজ কলোনির প্রথম দিককার বাড়িঘরগুলো।

নার্সিং হোমের পিছনেই আবাস। দারোয়ান ইয়াসিনকে চিনে পথ ছেড়ে দিল। হঠাৎ এতদিন পর দেখা রোগজীর্ণ মানুষটার হালচাল জানার পর খবর দিল, কিন্তু, সাহেব তো বাড়িতে নেই!

-       কোথায় গেছেন? এসময় তো বাড়িতেই থাকেন!

-       হ্যাঁ, গেছেন রাজপুরায়। এনার দাদুর একটা এস্টেট ছিল না? আমবাগান, পুকুর ! সেটারই জরীপ চলছে।

-       কেন?

-       রশিদ গার্ডেন্স নামে কলোনি তৈরি হবে। বড়ো মানুষদের বাড়িঘর।

-       বড়ো সাহেব তো কোনোদিন যানও নি ওদিকে!

-       তিনি আগের দিনের মানুষ ছিলেন তাঁর জমানা আজাদির জমানা ছিল। মানুষজনও অন্যরকম ছিল।

-       তা ইকবাল সাহেবও কিন্তু বাপের গুণ পেয়েছেন। এত নামডাকওয়ালা ডাক্তার, তবু গরীবদের তো মুফতেই দেখেন!

-       আরে, মানুষের কথা তো হচ্ছে না! হচ্ছে জমানার কথা। দৌলত, জমীন এসব তো আর পড়ে থাকে না। যেমন জমানা চায়, তেমন চেহারা দিতে হয়। না দিলে হাতছাড়া হয়ে যায়। পয়সার জুবান আছে সে যা বলে, তার মালিককে তা শুনতে হয়।

দর্শনতত্ত্বের কথাটা বলার গর্বে দারোয়ানসাহেব দাড়ি চোমরালেন।

-       আর মেমসাহেব?

-       তিনিও সঙ্গে গেছেন। তিনিই তো দেখাশোনা করছেন পুরো ব্যাপারটা।

-       ফিরবেন কখন?

-       ফিরবেন। দুপুরের খানা খাবেন। আপনি বসুন না ভিতরে। অসুস্থ মানুষ, কোথায় যাবেন এখন? চলুন, আমার ঘরেই বসুন।

দারোয়ানসাহেব গেটের শিকলটা লাগিয়ে ওদের তিনজনকে বাগানের ধারে নিজের ঘরটায় নিয়ে গেলেন।

ডঃ ইকবাল রশিদ এলেন একটা নাগাদ। ইয়াসিন খবর পাঠিয়ে দেখা করলেন বসার ঘরের পার্শ্ববর্তী বারান্দায়।

-       আদাব ইয়াসিন সাহেব। একি চেহারা হয়েছে আপনার? কী হয়েছে? আপনি বসুন। (একটা বেতের চেয়ারের দিকে ইঙ্গিত করেন)

উত্তেজনায় শরীর হঠাৎ নিজে থেকে কাঁপতে শুরু করেছিল ইয়াসিনের। এ বাড়িতে এসব জায়গায় বসার অভ্যাস নেই। তাই দাঁড়িয়ে থাকেন।

-       আদাব, আদাব ছোটো সাহেব। কী হয়েছে! কী হয় নি? এরা তো আমায় বলে না, কিন্তু আমি জানি আমি বেশি দিন গলায়

বাকরুদ্ধ ইয়াসিনের মুখ থেকে ডঃ ইকবাল রশিদের দৃষ্টি গলার দিকে নামল। গলার ফোলা, ইয়াসিনের কথা আর দুপাশে দুই ছেলের চোখ দেখে তিনি আন্দাজ পেয়ে গেলেন কী হয়েছে। ধাক্কা লাগল তাঁরও, অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুর কাছে গিয়ে দাঁড়ানো মানুষটার দিকে তাকিয়ে। তাঁকে বাড়ি থেকে স্কুলে আর স্কুল থেকে বাড়িতে পৌঁছে দিত এই মানুষটা।

হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়ে গেল ডঃ রশিদের। ইয়াসিনদের অপেক্ষা করতে বলে, বারান্দা দিয়ে নেমে সদর দরজার পোর্টিকোর দিকে গেলেন। গাড়িটা দাঁড় করানো আছে। ঠিক যা ভেবেছিলেন তাই। জানালার কাঁচগুলো ওঠানো নেই। আর পোর্টফোলিও ব্যাগটা পিছনের সিটে পড়ে আছে। এত অন্যমনস্ক পরভীন। যেন হাওয়ায় উড়ে চলে। পয়সা কিভাবে আসে তার বোধ নেই। গাড়ির ভিতরে ঢুকে কাঁচগুলো ওঠালেন। ব্যাগটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে গাড়ি লক করলেন। তারপর ভিতরে গেলেন ডাইনিং হলের দিকে। স্ত্রী বিস্ময়ে লজ্জিত হলেন।

-       ওঃ, আই এ্যাম সো সরি।

-       নট ফর দ্য ফার্স্ট টাইম।

-       সব ঠিকঠাক আছে তো? দেখে নিয়েছ?

-       দেখিনি। কিছু হওয়ার কথা নয়। কিন্তু কেন ? কথায় বলে পরিস্থিতি চোর তৈরি করে।

-       কে এসেছে কে? কার সাথে কথা বলছ? এখানে খাবার ঠাণ্ডা হচ্ছে।

-       বাবার সময়ের একজন কাজের লোক। তুমি চেন না। নাউ হি ইজ ডাইং। আমি আসছি এক্ষুনি।

ডঃ রশিদ আবার পিছনের বারান্দার দিকে গেলেন যেখানে ইয়াসিন মাটিতে বসেছিলেন। বড়ো সাহেবের ছেলেকে ঢুকতে দেখে দুই ছেলের হাতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াতে যান।

-       বসে থাকুন। বসে থাকুন, উঠতে হবে না।

ডঃ ইকবালের এক দিদি তখন কলেজের ছাত্রী। ইকবালও আন্দাজ পেতেন যে বাড়িতে অস্বস্তিকর কিছু একটা চলছে। তাঁর দিদির কলেজের এক বন্ধু গিরিজাশঙ্কর তার সাথেই দিদির বিয়ে হল পরে মাঝে মাঝেই বাড়িতে আসত। বাবা ধর্মনিরপেক্ষ মূল্যবোধের মানুষ, ভালো বা মন্দ লাগার ঊর্ধ্বে তিনি নিজের মূল্যবোধের মান রাখতে ব্যাপারটায় আপত্তি জানান নি কখনো। মায়ের আপত্তি ছিল কিন্তু সুর ছিল নরম। কঠোর ছিল দাদুর আপত্তি। আর ইয়াসিন, বোধহয় নিমকের খাতিরেই বা নিজের ব্যক্তিগত বিশ্বাস থেকে দাদুর তরফে থাকতেন। এটুকু হলে কিছু বলার ছিল না। কিন্তু দাদু শেষে মরীয়া হয়ে একটা বিচ্ছিরি কান্ড ঘটালেন ছেলেটাকে ঠাণ্ডা করতে আর তাতে বোকার মত আগ বাড়িয়ে গেলেন ইয়াসিন। বেশ গর্ব করে এসে বললেন যে ছেলেটাকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে, যত বড়ো পাখা ততটাই ওড়া উচিৎ। দেখুন ওর বাড়ির লোকদের! রুকসানা দিদির এইসব কান্ডকারখানার জন্যই না ওরা এখানে এসে আমাদের বেইজ্জত করতে সাহস পায়!

বেচারা ইয়াসিন। ঐ আমাদের কথাটার তাৎপর্য কয়েকদিন পর বিকেলেই তিনি টের পেয়ে গেলেন। রুকসানা বাড়ি ফিরল গিরিজাকে নিয়ে, রেজিস্ট্রি অফিস থেকে সোজা। দাদু ওদের আশীর্বাদ করবেন না, তবু দুজনে তাঁর আশীর্বাদ চাইল।

তারপরেই রুকসানা গম্ভীর মুখে সবাইকে শুনিয়ে বলল, ইয়াসিনচাচাকে যদি তোমরা রাখতে চাও রাখো। কিন্তু বাইরের কোনো কাজে। বাড়ির কাজে নয়। বাকি সবাইও এই ব্যবস্থায় সায় দিল। কিন্তু ইয়াসিনও তখন মোটামুটি যুবক। রক্ত গরম। গিরিজাশঙ্করের সামনে বলা কথাটায় নিহিত অপমান তাঁর সহ্য হল না। সাহেবকে বলে কাজ ছেড়ে দিলেন। ভেবেছিলেন, সাহেব নিজের মুখে কিছু বলবেন। অন্ততঃ একবারও বলবেন না, থেকে যাও, আমি দেখছি ব্যাপারটা। কদিন নাহয় ছুটি নিয়ে নাও। কিন্তু কিছু বললেন না।

তাঁর বৌয়ের তখন দ্বিতীয় বাচ্চা হবে। সাহেবের আচরণে সেদিন কাঠ মেরে গেলেও বাধ্য হয়ে ফিরে গেলেন ছ-সাত দিন পর। কিন্তু গেটের মুখেই যখন দারোয়ান শোনালো তাঁর ঢোকা মানা তখন আর নিজেকে স্থির রাখতে পারলেন না। বয়সটাও তখন জোয়ান। শালা পয়সার সাথে পয়সা, বাপের সাথে বেটি মিলে গেল আর আমাকে ফেলে দিল দুধের মাছির মতো ছুঁড়ে! শালা সব দেখা কেচ্ছা আমি ভাঙব বাইরে …” শেষ হুমকিটা হাওয়াবাজি ছিল কেননা বস্তুতঃ কোনো কেচ্ছা সে দেখে নি। শুধু যা হয়, চাকরদের খোশগল্পে শুনেছিল জোয়ান ছেলেমেয়েদের ব্যাপারস্যাপার।

ডঃ ইকবাল রশিদের ভুরুটা ঈষৎ কুঁচকে গেল ঘটনাটা মনে পড়ায়। দারোয়ান এসে জানিয়েছিল। খেয়াল হল ডাইনিং টেবিলে স্ত্রী অপেক্ষা করছেন, খাবার ঠাণ্ডা হচ্ছে। তবু মানবিকতা বলে কথা।

-       চিকিৎসা চলছে?

বড়ো ছেলে নীরবতা ভাঙল, অনেক খরচ ডাক্তারসাহেব, চিকিৎসা কিকরে করাবো? ইয়াসিন উত্তেজনায় কাঁপল, চুপ কর! চুপ কর! না ছোটো সাহেব, চিকিৎসা এ রোগের হবে না, আপনিই ভালো জানেন। আর আজ এসব কথা বলে পাপের বোঝা বাড়াবো না। আজ শুধু ক্ষমা চাইতে এসেছি হুজুর! ইয়াসিনের চোখ দিয়ে ময়লা জল গড়িয়ে পড়ে, মরার আগে শুধু ক্ষমা চেয়ে যেতে চাই অনেক কথা বলেছিলাম সেদিন, অনেক খেলাপ করেছি নেমকের; দোজখের আগুন দেখতে পাচ্ছি আমি

ইয়াসিনের কথায় বিব্রত বোধ করেন ডঃ ইকবাল রশিদ। কিছু বলতে যান। তার আগেই ইয়াসিন চোখের জল মুছে প্রশ্ন করেন, দিদি কোথায়?

-       কে? ও, রুকসানা? এ শহরেই আছে।

তার ঠিকানা বলে ডঃ ইকবাল বড়ো ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বলেন, এঁর তো মনের অবস্থা ভালো নয়। এখন কিছু বলাও যাবে না। আজ বিকেলে বা কাল দশটা থেকে এগারোটার মধ্যে ক্লিনিকে একবার এস। ওনার প্রেসক্রিপশন, রিপোর্ট ইত্যাদি নিয়ে এস। তারপর ইয়াসিনের দিকে তাকিয়ে বলেন, আপনি আমার কাছে ক্ষমার কথা বলে আমাকে বিব্রত করছেন। তখন যা হয়েছিল, তখনই হয়েছিল। আর আমি তো ছোটো ছিলাম। আমাকে আপনি স্কুল থেকে আনতেন, আমার সঙ্গে খেলতেন সেভাবেই আমি আপনাকে জানি। আমার কাছে আপনার ক্ষমা চাওয়ার কিচ্ছু নেই। আল্লার কাছে দুয়া চাইব যাতে আপনি ভালো হয়ে ওঠেন। এখন বাড়ি যান। বলে পকেট থেকে দুশো টাকা বার করে বড়ো ছেলেকে দিতে যাবেন তখনই ইয়াসিন আবার হাঁ হাঁ করে উঠলেন, না না হুজুর! ওটা দিয়ে আমাকে আবার এহসানমন্দ করবেন না। এবার অনুমতি দিন। আদাব ডঃ ইকবাল ধমক দিয়ে টাকাটা ছেলের পকেটে গুঁজে দিতে পারতেন কিন্তু ইয়াসিনের উত্তেজনা দেখে সাহস করলেন না। শুধু মনে করিয়ে দিলেন, রিপোর্টগুলো নিয়ে এস কিন্তু। বাবাকে নিয়ে দুই ছেলে বেরিয়ে গেল।

পরের দিন ইয়াসিন গেলেন রুকসানার বাড়ি। রুকসানা নিজে কলেজে শিক্ষকতা করেন এবং স্বামী গিরিজাশঙ্কর মূলতঃ সাংবাদিকতা এবং ঈষৎ রাজনীতি করেন। বাড়িতে প্রথম গিরিজাশঙ্করের সঙ্গেই দেখা হল। তিনি চিনতে পারলেন না। ইয়াসিনকেই মনে করাতে হল প্রায় তিন দশক আগেকার দিনগুলো। গিরিজাশঙ্কর নিজের ভিতরকার একটা ছোট্টো অমানবিক উল্লাসের ভাবটাকে সজোরে চাপতে গিয়ে মাত্রাধিক তেতো হয়ে গেলেন। ভাগ্যিস, পাশে বসে থাকা বন্ধুটি তাঁর খুবই অন্তরঙ্গ তাঁর এই ছোট্টো মনোবিকলন কাল কফিহাউজের খবর হয়ে যাবে না। মাত্রাধিক তেতোভাবেই প্রশ্ন করলেন, ও আচ্ছা! তা, এতদিন পর কী মনে করে? আজ আবার কী চান? কিন্তু তারপরেই সামলে নিজের স্বাভাবিক সমাহিত ভাবে ফিরে আসেন, বসুন, বসুন আগে। এত রোদ্দুরে এসেছেন। আপনাকে তো খুবই অসুস্থ মনে হচ্ছে। একটু জিরিয়ে নিন। আমি একটু কাজগুলো সেরে নিই।

বন্ধুকে ইংরেজিতে সংক্ষেপে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিয়ে, হেসে একটা সিগরেট ধরান। তারপর টেবিলে ছড়িয়ে রাখা কাজটা শেষ করতে মনোনিবেশ করেন। বস্তুতঃ লোকটির আসার উদ্দেশ্য আন্দাজ করার চেষ্টা করতে থাকেন।

কাজ শেষ হয়। কাগজ গুছিয়ে রাখতে রাখতে মুখ তুলে তাকান গিরিজাশঙ্কর, এবার বলুন ক্যয়সে ক্যয়সে আনা হুয়া।

ইয়াসিনের বাস্তবিক অবস্থা এবং আসার উদ্দেশ্যটা জেনে তিনি পাণ্ডিত্যসুলভ সারল্যে বললেন, আপনি কেন ক্ষমা চাইছেন ইয়াসিন সাহেব? আপনি কারো হয়ে কাজ করেছিলেন। যা করতে বলা হয়েছিল তাই করেছিলেন। আর সেটাও এতদিন আগেকার কথা। তবে আপনি রুকসানার সঙ্গে দেখা করে নিন। হয়তো আপনার মনটা হাল্কা হবে। আপনার আল্লা আপনার সঙ্গেই আছেন। আপনি কোনো পাপের ভাগী নন। বলে নিজের ভিতরে হাল্কা অনুভব করলেন যে মৃত্যুপথযাত্রী একটা মানুষের মনকে শান্তি দেওয়ার চেষ্টা করতে পেরেছেন।

রুকসানা খবর পেয়ে নেমে এলেন দোতলা থেকে। সবসময় তিনি সবাইকার প্রিয়পাত্র এবং দ্রুত হস্তক্ষেপে যে কোনো সমস্যার সমাধান করতে জানেন।

-       ইয়াসিনচাচা, আপনি! এত বছর পর? ইস, কী চেহারা হয়েছে! আসুন, আসুন, ভিতরে আসুন!

হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলেন ভিতরে। কার্পেটে বসালেন। নিজেও বসে পড়লেন সামনে।

-       কী ইয়াসিনকাকা? এত দিন কোনো কথা মনে রাখতে হয়? একবারও আর দেখা করতে এলেন না? সেদিন রাগের মাথায় কী বলেছিলাম; বাড়ির সবাইও আমাকে ভালোবেসে আমার কথা মেনে নিল। কত ভালো লাগছে আপনাকে দেখে! এ দুজন আপনার ছেলে?

ইয়াসিন এতক্ষণ হতভম্ব হয়ে ছিলেন। এবার হু হু করে কেঁদে ফেললেন। বহুক্ষণ লাগল তাঁর কান্না সামলাতে। দিদি, দিদি, তুমি আমাকে আর পাপের ভারে নুইয়ে দিও না দিদি! আমাকে ক্ষমা চাইতে দাও!

-       আরে দূর! নিকুচি করেছে ক্ষমার। দেখুন তো বাইরে বসে আছে মানুষটা, কেমন দশাসই। সেদিনের মার খাওয়ার পর থেকেই ওর গায়ের জোর বাড়তে শুরু করে দিয়েছিল। তবেই তো বিয়েটা হল। আপনাদের দুয়ায় এখন ছেলেপুলে নিয়ে সংসার করছি।

রুকসানা এখনও সুন্দরী এবং বয়সে মোটা হয়েছে। ওর হাসিঠাট্টার জৌলুষে ধন্ধ লেগে গেল ইয়াসিনের। আর সেই ধন্ধের ঘোরে কখন শরবত এল, সে এবং ছেলেরা খেল, আর কখন রুকসানা তিনশো টাকা বড়ো ছেলে হানিফের পকেটে গুঁজে দিল সে টের পেল না।

-       কিচ্ছু হবে না ইয়াসিনকাকা! আপনি ভালো হয়ে যাবেন। ভালো করে চিকিৎসা করান।

একটা বিষম ধাক্কা খেয়ে দুই ছেলের সাথে বেরিয়ে এল ইয়াসিন।

বাড়িতে রাগে চিৎকার করছিল হানিফ, আর যাবো না, কিছুতেই যাবো না। চিকিৎসার পয়সা নেই। আর ওনাকে নিয়ে এখন এই তীর্থযাত্রা চালিয়ে যেতে হবে। না না, পয়সা আমি নেব না, পাপের ভাগী হব না তা নিও না! হয়ো না! কে বলেছে বাড়ি বাড়ি ঘুরে এই ক্ষমা চাওয়ার নাটক করতে?

-       চুপ কর! আপা তিনশো টাকা দিল আর তুই নিয়ে নিলি। মুখে যোগালো না, যে না, নেব না। আমাকে আরো পাপের ভাগী করলি। আমি বেচলাম আমার ইমান। উঃ !

ইয়াসিন হাঁপাতে থাকেন। তারপর শুয়ে পড়েন। সাতদিন পেরিয়ে গেছে। শরীরটা দুদিনের ধকলেই জবাব দিয়ে দিয়েছিল। আবার উঠেছেন আজ। কিন্তু গলার কষ্ট আর সারা শরীরের দপদপানি বেড়ে চলেছে হু হু করে। কিচ্ছু খেতে ইচ্ছে করে না। খেতে পারেনও না। তবু আজ সকাল থেকে জিদ ধরেছেন, বেরোবেন। বেরোলেনও। ছোটো ছেলে মজিদ বিশেষ কথা টথা বলে না। তবে বাপকে ভালোবাসে। তার কাঁধেই ভর দিলেন ইয়াসিন। বাধ্য হয়ে বড়ো ছেলেও অন্য হাতটা কাঁধের ওপর নিল। মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলা মানুষটাকে আর কতো আঘাত করা যায়! এমনিতেও, কোনো চিকিৎসা তো কিছু করতে পারছে না, অন্ততঃ মনটা শান্তি পাক! আর শেষ যুক্তিটা বাপের দিকে তাকিয়ে নিজের মনের ভিতরে চাপা দিল হানিফ যদি অনুগ্রহ না নেওয়ার এই বর্তমান পাগলামিটা কমে তাহলে বড়ো বড়ো মালদার পার্টিগুলোর সঙ্গে পরিচয় চিকিৎসার খরচ, ভবিষ্যতে একটা কোনো রোজগারের ব্যবস্থা আর ভাবতে চায় না হানিফ। দর্জির কাজ শিখে আজকাল একটা ছোটো দোকান দিয়েছে ক্যানালের বাঁকটায়; ছোটোখাটো কাজ আসে। মজিদের পড়াশোনাও চালানো যায় নি। যেমন করে হোক সংসারটা দুর্লক্ষ্য আশায় আশায় চলছে।

ইয়াসিন আজ শিকদার সাহেবের বাড়ি গেলেন। নরেন্দ্রনাথ শিকদার। এখনও অব্দি কাগজে কলমে ইয়াসিন যে ডিস্ট্রিবিউটার কম্পানির চাপরাশি তার প্রাক্তন এরিয়া ম্যানেজার। তিন বছর আগে অবসর গ্রহণ করেছেন। শিকদার সাহেব শিল্পী মানুষ। এস্রাজ বাজান। চিত্রকর্ম, নাট্যকর্ম প্রভৃতিকে উৎসাহ দেন। বস্তুতঃ তাঁর বাড়ির একদিকের গ্যারাজটা বহুকাল ধরে একটি নাট্যদলের রিহার্সাল রুম হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তাঁর বাড়িটা অফিসপাড়ার ঠিক পিছনে একটা শান্ত পরিচ্ছন্ন গলিতে। এক সময় এই এলাকায় গণ্যমান্য ব্যক্তিরা থাকতেন। এখন এখানকার প্রতি ইঞ্চি জমির গুরুত্ব ব্যবসার দৌরাত্ম্যে বেড়ে গেছে। একের পর এক বাড়ি ভেঙে তৈরি হচ্ছে দপ্তর, বাণিজ্য এবং আবাস প্রকল্প।

শিকদার সাহেবের বড়ো ভাই বীরেন শিকদার বহুকাল যাবৎ প্রবাসী। এই বাড়িতে আদ্ধেক ভাগ তাঁরও তবে তাঁর কোনো প্রয়োজন নেই। তাই পুরো বাড়িটার মালিক বা ভোগস্বত্বাধিকারী কার্যতঃ ছোটো ভাই নরেন্দ্র বা পরিচিতদের নীরুদা।

গোল বেধেছিল একবারই। ছবছর আগে। একজন প্রমোটার পুরো জমিটা নেওয়ার তালে ছিল। ছোটোভাইয়ের অনমনীয় ভাব দেখে সে গিয়ে ধরল বড়ো ভাই বীরেন শিকদারকে, দিল্লিতে। দাদা ছোটো ভাইকে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে না পারার দায়ে অভিযুক্ত করলেও, প্রথমে এ ব্যাপারে ছোটো ভাইয়ের ওপর কোনো চাপ সৃষ্টি করতে রাজি হন নি। কিন্তু প্রমোটার নিজের কাজ করতে জানে। সে চারদিক থেকে প্রভাবের পরিবেশ গড়ে তুলল। প্রথমে বীরেন শিকদারের বৌ আর ছেলেকে ভাঙালো। তারপর বীরেন শিকদারকে। পুজোর ছুটিতে বীরেন শিকদার সপরিবার এলেন। কথাবার্তা প্রমোটারের আশানুরূপ বচসায় রূপান্তরিত হল। এবং বীরেন শিকদার ছেলে আর বৌয়ের রাগারাগিতে সম্পত্তি ভাগাভাগির কথা বলে ফেললেন। ছোটোভাই হতভম্ব হয়েও রাজি হয়ে গেলেন। কিন্তু সেটা তো প্রমোটার চায় নি। তার পুরোটা দরকার। কাজেই ভবিষ্যতের অনুকূলতর পরিস্থিতির আশায় সে দৃশ্যের নেপথ্য থেকে সরে গেল। আর, দুই ভাইয়ের মধ্যে গড়ে উঠল একটা কালো দেয়াল যার একদিকে গ্লানি এবং অন্যদিকে অভিমান।

এই রকম মুহূর্তেই ছোটোভাইয়ের শিল্পীবন্ধুরা এবং নাট্যদলের ছেলেরা বীরেন শিকদারকে ধরল। ভাইকে বলে ফেলা কথাটার দায় থেকে অব্যাহতি দিতে তাঁকে তোয়াজ করতে শুরু করল যে ছোটো ভাই তো এ শহরেই আছেন, কিন্তু বড়ো ভাইই তো এ শহরের প্রবাসী নান্দনিক পৃষ্ঠপোষকদের অন্যতম। তিনি যদি রাগ করে দিল্লি ফিরে যান তাহলে তাঁদের জমিতে গ্যারেজে রিহার্সাল চালানো দলটির পক্ষে কঠিন হয়ে যাবে। বীরেন শিকদার একই সঙ্গে হাঁফ ছেড়ে বাঁচার দীর্ঘশ্বাস নিলেন এবং তাতে আত্মশ্লাঘারও সুবাস পেলেন। বললেন, না না, সে কি? রিহার্সাল বন্ধ করবেন কেন? …”

ইয়াসিন তখন সাহেবের কম্পানিতে চাকরির সুবাদে এ বাড়ির ঘরের লোকের মতো। অফিসের কাজ সেরে এবং ছুটির দিনে তিনি নরেন্দ্রনাথ শিকদারের এবং তাঁর স্ত্রীয়ের যাবতীয় কাজের দায়িত্ব নেন। শিকদার সাহেব সরকারি সাহেবদের মতো নন। ইয়াসিনকে দিয়ে বাড়িতে যা কাজ করান তার জন্য একটা মূল্য ধরে হাতে দেন। তাঁর স্ত্রীও ইয়াসিনকে কখনো খাবার না খাইয়ে ছাড়েন না। বাড়ির বাগানটার দেখাশোনাও ইয়াসিন করেন।

একদিন, রিহার্সাল শুরুর একটু আগে। প্রবীণ হীরেন ভট্টাচার্য (তিনি দলটির অন্যতম নাট্যপরিচালক) এবং একটি স্বনামধন্য হিন্দি নাট্যদলের প্রধান বিজয় চৌধুরি গ্যারাজে অর্থাৎ রিহার্সাল রুমটায় এসে ঢুকলেন। ছেলেদের কয়েকজন ওদিকে একজনের হাতে ধরা তালিকার সঙ্গে প্রপ্‌সগুলো মিলিয়ে সাজিয়ে রাখছিল। কিছুদিন পরেই শো। ইয়াসিন গ্যারাজের সামনে পোঁতা নতুন রাবার প্ল্যান্টটার মাটি তৈরি করতে করতে ফুট কাটলেন

-       আপনারাও তাজ্জব লোক!

কেন? কী হল? বলে ছেলেদের দল থেকে জয়দীপ এগিয়ে এল, তার আগে একটা বিড়ি ছাড় দেখি! ইয়াসিন বিড়ির বান্ডিল, লাইটার এগিয়ে দিতে দিতে বলল, বাড়িতে ভাইয়ে ভাইয়ে কথা বন্ধ, পরিবারে পরিবারে লড়াই লেগে গেল, আর আপনারা এরই মধ্যে নিজেদের গান, বাজনা, ড্রামা চালিয়ে যাচ্ছেন?

-       তো? শোকসভা করব?

-       আপনাদের মুখ চেয়েই সাহেব, ভালো মানুষ, বড়ো ভাইয়ের কথাও মানলেন না। বড়ো ভাই তো গুরুজন!

-       সেসবে আর আমরা কী বলব? পরিবারের ভিতরকার ব্যাপার। আমরা তো বীরেনদার কাছ থেকেও অনুমতি নিয়েছি, তবে রিহার্সাল করছি। আর এসব তো আজকাল সবজায়গাতেই হচ্ছে। প্রমোটার হারামজাদাগুলো বাড়িতে বাড়িতে ভালো মানুষ সেজে ঢুকে টাকার লোভ দেখাচ্ছে। বৌ, ছেলেমেয়ে পটে গেলেই কাজ হাসিল! তবে ইয়াসিন ভাই, সবার কাছেই তো আর পয়সার ফিকিরটাই বড়ো ফিকির নয়! আর দুভাইএর কারোরই তো আর অভাব নেই!

-       অভাব? সম্পত্তি তার নিজের স্বভাবে চলে হুজুর! বলুন তো কতো লাখ টাকার লোকসান?

-       তোকেও ঐ প্রমোটার পয়সা দিয়েছে না কি রে?

-       ইয়াসিন পয়সার ভুখা নয়। যা বলার, নিজের ইমান থেকে, মুখের ওপর বলে। আপনাদের এখন কিছুদিন এখানে আসা উচিৎ ছিল না। আর কী করেন এসব? গান, বাজনা, ড্রামায় সময় কাটিয়ে?

হীরেনবাবু  আর বিজয়বাবুও কথোপকথনটা শুনছিলেন। এ ধরণের অযাচিত আর ধৃষ্ট উপদেশ কারোরই হজম হল না। স্বাভাবিকভাবেই তাঁরা নরেন্দ্রনাথ শিকদারের কানে ওঠালেন। একজন অতিথির সামনে বলে, হিন্দি নাট্যদলের বিজয় চৌধুরির উপস্থিতিটাকে গুরুত্ব দেওয়া হল। নরেন্দ্রনাথ ইয়াসিনকে ডেকে পাঠালেন। যা স্বভাব ছিল ইয়াসিনের। সাহেবের গম্ভীর ধমক শুনেও চুপ থাকলেন না, ভুলও স্বীকার করলেন না। উল্টে সাহেবকেও উপদেশ দিয়ে দিলেন। বড়ো ভাই পিতৃতুল্য, নাটক-গানবাজনা করা প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের পরিচয় নয় ইত্যাদি নীতিবাক্যও শোনালেন।

নরেন্দ্রনাথ বেশি কিছু না বলে বাড়িতে তার আসা বন্ধ করে দিলেন। তারপর অফিসে তাকে খুব কঠোর কিন্তু সংযত ভাষায় বুঝিয়ে দিলেন যে ইয়াসিন অধস্তনেরও অধস্তন কর্মচারি। অফিসে তাঁর আসাযাওয়ার সময়, মাঝেমধ্যে পরবে মদ খাওয়ার অভ্যাস এবং না বলে ছুটি নেওয়ার ওপর কড়া নজরদারি চলতে লাগল। চাকরি থেকে বার করে দেওয়ারও হুমকি দেওয়া হল তাকে। এমনভাবেই চলছিল ইয়াসিনের অসুখ ধরা পড়া অব্দি।

শুধু একদিন তাঁর ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল। এক শীতের দিনে দুপুরেই মদ খেয়ে আউট হয়ে ঢুকে পড়েছিলেন অফিসে, শিকদার সাহেবের কামরায়। বাছা বাছা ইংরেজি বাক্যাংশ দিয়ে তাঁকে ভূষিত করেছিলেন। তখন বাকি সবাই তাঁকে ধরাধরি করে নিয়ে গিয়ে লাঞ্চরুমে মাথায় জল ঢালে। তাঁর হয়ে শিকদার সাহেবের কাছে ক্ষমা চায়।

ইয়াসিন আজ দুই ছেলের কাঁধে ভর দিয়ে শিকদার সাহেবের বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতে নিজের হাতে পোঁতা রাবার প্ল্যান্টটার দিকে তাকালেন। তার পিছনেই গ্যারাজ, বা রিহার্সালের ঘর। এখন বন্ধ। কলিং বেলের শব্দে শিকদার সাহেবের মেয়ে দরজা খুললেন।

ইয়াসিনকে শিকদার সাহেবের মেয়ের না চেনার কথা নয়। এবং সেটা তার না চেনার ভঙ্গিতে বোঝা গেল। ইয়াসিনের আদাবের কোনো জবাব না দিয়ে সে ভিতএ দিকে হাঁক দিল, বাবা, তোমার সাথে কেউ দেখা করতে এসেছে। বলে ভিতরে চলে গেল। এতে এটাও বোঝা গেল যে উপেক্ষা বা তাচ্ছিল্যটা ব্যক্তিবিশেষের প্রতি নয়, সহজাত।

ইয়াসিনকে তার দুই ছেলে বারান্দার ধারে থামে ভর দিয়ে বসালো। ইয়াসিন তাঁর নিজের হাতে একসময় পরিচর্যা করা বাগানটার দিকে চেয়ে রইলেন। এখনও হয় নি, তবে আরো কিছুক্ষণ পর বাগানটা তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠবে। পছিয়ার ধুলো হাওয়ায় ধুসর রঙ ধরবে সবুজে।

শিকদার সাহেব বেরিয়ে এলেন, কী খবর ইয়াসিন? কেমন আছো? তোমার কাগজপত্র তো হেড অফিসে মুভ করে দিয়েছি। আর এই হানিফকে তোমার জায়গায় রাখার জন্য রিকমেন্ড করেও দিয়েছি। এখন ওখান থেকে কী আসে তা দেখার অপেক্ষা। তোমার চিকিৎসাপত্র ঠিক মতো চলছে তো? আমি যদি আরো কিছু সাহায্য করতে পারি তো বল!

ইয়াসিনের কন্ঠস্বর এমনিতেও ফ্যাঁসফ্যাঁসে হয়ে গিয়েছিল। আরো বুঁজে এল, না হুজুর, আর কোনো এহসান নিতে আসি নি। আর এরা আশ্বস্ত করলেও আমি জানি যে আমার মৃত্যু আগতপ্রায়। আর কয়েকটা দিন বাঁচব। আমি আমি আপনাদের সবাইকার কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছি। জীবনে ভুলচুক হয়েই যায়। আপনারা যে ভালোবাসা দিতেন তাতে আমি নিজের অওকাত ভুলে মনে করতাম আই আপনাদের সমান সমান। আর সেই ভুলের সুযোগ নিয়েই শয়তান বসে পড়ত আমার জিভে! সেসবেরই মাফি চাইতে এসেছি।

শিকদার সাহেব সৌম্যভাবে হাসলেন, আহা হা, এভাবে নিজেকে কষ্ট দিও না। আমরা সবাই সমান। মানুষই তো আমরা। তবে হ্যাঁ, সমাজ, পরিবার, কিছু আদবকায়দা তো থাকেই। সবসময় থাকবে। আর সেসব তো যখনকার কথা তখনই শেষ হয়ে গেছে। আমি বা কেউই, ক্ষমা করার কে? কে বস্তুতঃ ক্ষমা করে, ঈশ্বর না সময়, তা ঠিক করতে না পেরে শিকদার সাহেব চুপ করে গেলেন।

দাদার সাথে সেদিন মনোমালিন্য হলেও এখন শিকদার সাহেব প্রায় তৈরি হয়ে গেছেন বাড়ি, জমি বিল্ডারকে দিয়ে দিতে। যেমন দিনকাল, তেমনই চলতে হবে। ইয়াসিনের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ভাবলেন মানুষ কতরকম ভাবে নিজের স্বার্থে আপোষ করতে জানে। এই ছুতোয় লোকটা নিজের ছেলের চাকরির জন্য তদ্বির করে গেল ঘুরিয়ে। যাতে সাহেব মনে কোনো রাগ না পোষেন। যাক! হয়ে গেলে ভালোই। হেড অফিসে তো ভালোভাবেই রেকমেন্ড করেছেন।

নিজের প্রথম মনিব, বিহারশরিফের আলুর আড়তের মালিকের কাছে যেতে গিয়ে ইয়াসিন ট্রেনে মারা গেলেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স ছিল আটান্ন বছর আর তার মধ্যে চল্লিশ বছর তাঁর সঙ্গী বলতে ছিল সাইকেল, আকাশী নীল কিম্বা ছোটো-চেকের শার্ট (আগেকার ডিজাইনেঃ হাফ হাতা, গলা থেকে বুক অব্দি বোতাম, নিচে দুপাশটা দুদিক থেকে গোল কেটে জোড়া), সাদা পাজামা, চটি, কাঁধে গামছা, সততা এবং তেমনই কিছু নৈতিক মূল্যে দৃঢ় থাকার গর্ব আর ছোটো ছোটো পাপের অনুতাপ। বলার অর্থ, তিনি বিশ্বাস করতেন মানুষ একলা এসেছে এই দুনিয়ায়, একলাই যাবে। সকাল পাঁচটা থেকে আটটা অব্দি বাড়িতে এবং তারপর রাত আটটা অব্দি মনিবদের দপ্তরে কিম্বা বাড়িতে পরিশ্রম করা এই ছিল তাঁর দৈনন্দিন।

বিহারশরিফেরই একটু আগে তাঁর শেষনিঃশ্বাস পড়ল তাই তাঁর শরীর বিহারশরিফেই নামানো হল। রেলপুলিস ইত্যাদির হুজ্জত থেকে বেরিয়ে বিভ্রান্ত হানিফ আর মজিদ শোকের মধ্যেও বুদ্ধি খাটালো। যেটুকু পয়সাকড়ি ছিল, লাগিয়ে অটো ভাড়া করে বাপের শরীর নিয়ে গেল আলুর আড়তের মালিকের কাছে। বললও যে আব্বু তাঁর কাছে মাফি চাইতে আসছিলেন।

-       কিসের মাফি?

-       তা তো জানি না। গত এক মাস ধরে এভাবেই ঘুরছিলেন নিজের সব মনিবদের বাড়িতে বাড়িতে।

আড়তদার এইরকম পরিস্থিতিতে স্বভাবতই একটু অস্বস্তি, একটু দুঃখ এবং একটু স্মৃতিসুখ অনুভব করলেন। তবে সবচেয়ে বেশি যেটা অনুভব করলেন সেটা ছিল ভয়। না, ইয়াসিনের মৃত শরীরটাকে নয়, অতীতকে। বস্তুতঃ অতীত মনে পড়লে মানুষের মনে ঝড় উঠতে থাকে। হিসেব গোলমাল করে দিতে চায়। একটা বৈরাগ্যের ভাব ঘিরে ধরে। অতীতের বোঝা বওয়া চাট্টিখানি কথা নাকি!

আর এই ইয়াসিন, তাঁর বাপের আমলের লোক কেন যে সেসময় মা একে শুধু কাজছাড়া নয়, শহরছাড়া করার জন্য জিদ ধরেছিলেন তা তাঁর নিজেরও ভালো করে জানা নেই। তিনি তখন বেশ ছোটো। আজও মা যখন জানতে পেয়ে অন্দরমহল থেকে বাইরে এলেন মৃত ইয়াসিনের শরীরটা দেখতে, হঠাৎ ছেলেকে একটা বেমক্কা হুকুম দিলেন, বৌয়ের মাদুলিটা আজ বিকেলেই করিয়ে নিয়ে আসবি, বলে দিলাম! আড়তদার কথাটা এই মুহূর্তে বলার কোনো মানে খুঁজে পেলেন না।

যাই হোক, ইয়াসিনের শরীরটা একটা গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা তিনি করে দিলেন। গাড়িটা প্রথমে গেল শহরের সেই পাড়ায় যেখানে এক সময় ইয়াসিনের ছোটোবেলা কেটেছিল এবং এখনও তাঁর দূর সম্পর্কের জ্ঞাতিরা থাকেন। তারপর পাটনার দিকে রওনা দিল।

                           x               x                x                x

হানিফ আজকাল মজিদকে নিয়েই দোকান খুলে বসে। গত দেড় মাসে মাঝে মাঝেই দোকান বন্ধ থাকায় প্রচুর লোকসান হয়ে গেছে। গ্রাহকের ভরসাটাই চলে গেছে যে দোকান কখন খোলা থাকবে আর কখন বন্ধ থাকবে। এরপর আবার যদি সত্যিই শিকদার সাহেব ডেকে পাঠান! বাপের কম্পানিতে একটা চাকরি যদি সত্যিই হয়ে যায়! তার আগে মজিদটাকে পাকাপোক্ত করে দিলে সে-ই চালাতে পারবে। আর, একান্তই না পারলে কাউকে দিয়ে দিতে হবে, কেননা মজিদ অন্যরকম ছেলে।

মজিদ সত্যিই অন্যরকম। দর্জির দোকানে ছোটোখাটো কাজ ভালোমতই আসে। মজিদ টাকাপয়সার হিসেব রাখে। দাদা কাটিং করে দাগ দিয়ে দিলে মেশিনও চালায় কখনো কখনো।

কিন্তু মাঝেমধ্যেই সে চলে যায় এদিক ওদিক। খালের ধারে গিয়ে বসে থাকে। চায়ের দোকানে বসে শহরের হালচাল কান পেতে শোনে। তারপর চলে যায় বাড়ি। মায়ের কাছে গিয়ে বসে পড়ে।

একদিন বলল, আচ্ছা আম্মি! আব্বু তোমার প্রতি কোনো অন্যায় করে নি? অন্যায় কথা বলে নি? আমিই তো দেখেছি! তার জন্য কখনো ক্ষমা চেয়েছিল?

-       কী বলিস তুই? উনি তো আমার শওহর ছিলেন! আমার কাছে আবার ক্ষমা চাইবেন কেন?

-       ঠিকই বলেছ। আসলে, যারা আপন নয়, তাদেরকে আপন মনে করাটাই ভুল। আর তাদের কাছে ক্ষমা চাইতে যাওয়া মানে আবার তাদের সেই আপনই মনে করা! বাবা কি সত্যিই বুঝত না এই সহজ কথাটা?

-       মরা মানুষের বিষয়ে কটু কথা বলতে নেই, তবু বলছি তোর বাপ ছিল অহঙ্কারী আর ভীতু। অন্যায় করেও থাকি তো তার বোঝা মাথায় নিয়ে মরব! যে কষ্ট সহ্য করল মানুষটা এক বছর ধরে, নরকের আগুন কি তার চেয়ে বেশি কিছু? কী এমন কারোর মনে রাখার মতো জীবন বাঁচি আমরা যে মনের ভিতর খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে এসব দৈনন্দিন ব্যাপারে ন্যায়-অন্যায়, ভুল-ঠিকের প্রশ্ন তুলব? আর তুললামও তো এই? অন্যায় কী, তা বোঝা এত সহজ? বুঝলে পর, উদয়াস্ত পরিশ্রম আর অপমানের একটা জীবন কেউ হাসিমুখে বেঁচে যেতে পারে?