ভাবতাম গুজরাটের আনন্দ শহরে তাঁর মেয়ের বাড়িতে কিম্বা কর্ণাটকের ব্যাঙ্গালোরে তাঁর ছেলের বাড়িতে যাব কোনো না কোনো একদিন। কিন্তু কখনো ভাবিনি তাঁর সাথে সেখানে পৌঁছোলেই দেখা হবে। বরং ভেবেছি, এই হয়ত পরের মোড়টা ঘুরলেই পৌঁছোব; কাউকে জিজ্ঞেস করছি বাড়িটার হদিশ – উনি পিছন থেকে এসে আলতো করে আমার পিঠে হাত রাখবেন, “এসেছ? খুব ক্লান্ত নয়তো? তাহলে চল হাতের একটা কাজ সেরে নি, তুমি থাকলে সুবিধেই হবে… তার পর বাড়ি যাব”।
আনন্দে যাওয়া হলনা। ব্যাঙ্গালোরে নিজের কাজে তিন বার গিয়েও দেখা হলনা। যেমন স্বভাব হয় এধরণের মানুষদের – একবার জানানও দিলেননা যে যাচ্ছেন।
ডাক্তারগিরি
ডাক্তারদের একটা বিশেষত্ব থাকে। তাঁরা তো
আপনার থেকে অনেক বেশি ভালোরকম বোঝেন আপনার শরীরটাকে! যখন কোনো ডাক্তার দেখেন
আপনাকে তখন আপনার শরীরের ভিতরের প্রত্যেকটা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, তার
হাড়-পেশী-শিরাউপশিরার বুনট তাঁর নিজের পড়া পাঠ্যপুস্তক, ছেঁড়াকাটা মড়া, ঘাঁটা
কঙ্কাল আর ডাক্তারির অভিজ্ঞতার সাথে মিলিয়ে নিতে থাকেন। আপনি হয়ত অনেকক্ষণ ধরে
বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করছেন আপনার ব্যথাটা ঠিক কোথায় এবং কী ধরণের কিন্তু বারবার মনে
হচ্ছে ঠিক বুঝিয়ে উঠতে পারছেন না। হঠাৎ ডাক্তার তাঁর চেয়ারটা থেকে ঝুঁকে একটা
বিশেষ জায়গায় জোর টিপুনি দিলেন… আপনি বীভৎস রকমের একটা চীৎকার করে উঠলেন আর এক লহমায় নিজেও বুঝে গেলেন ব্যথাটা
ঠিক কোন জায়গায় আর কী ধরণের!
চাকরিতে থাকাকালীন এক সময় একটা প্রতারণার
মামলায় জড়িয়ে পড়েছিলাম। নানারকম কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখা সত্ত্বেও স্বাভাবিক ভাবেই
মনটা ভীষণ খারাপ থাকত। শুভাকাঙ্খীরা খুব সন্তর্পনে জানতে চাইছে কী হয়েছে ব্যপারটা,
যাতে আমার আঘাত না লাগে। যারা একটু দূরের, তারা সামনে না বললেও পিছনে, “আরে আমরাও দুনিয়া দেখেছি বস্!
সুদ্ধা সুদ্ধা মানুষেরা ভিতরে ভিতরে কে কোথায় কোন গুল খিলিয়ে বসে আছে আপনি বুঝতেও
পারবেন না। খোঁজ নিয়ে দেখুন, নিশ্চই মাল কামিয়েছে বা কামাবার ধান্ধায় ছিল, এমনি
এমনি সিবিআই ধরেনা।”… সত্যি
যদি এই অভিযোগে চাকরি চলে যায় বা জেল খাটতে হয় তাহলে ছেলে মেয়ের জীবনে তার কী প্রভাব
পড়বে, এই সব আকাশপাতাল ভাবতে থাকতাম ভিতরে ভিতরে।
এমনই মানসিক অবস্থা যখন, তখন কয়েকজন
ডাক্তার আমায় ওষুধ দিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে ছিলেন আমার ট্রেড ইউনিয়নের শিক্ষক ও
গুরুজনেরা । যেমন নিসার সাহেব, ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট; চায়ের দোকানে বেঞ্চিতে বসে
ছোলা চিবোতে চিবোতে মুচকি হেসে শুরু করলেন, “কা হো, সুনাতানি বহুতে মাল কমইলে বাড়!”… আর দ্বিতীয়জন গুরুচরণদা। দেখা
হতেই, “এই যে ক্রিমিন্যাল! এসেছ? বস।”
চীৎকার করিনি অবশ্য, কিন্তু টিপুনি দুটোই ছিল মোক্ষম! হাতের তালুর এ্যাকুপ্রেশার পয়েন্টে টিপে মাথার ব্যথা সারানোর মত। তৎক্ষনাৎ লাঘব হল ব্যথা।
রওশন-খয়াল
উর্দুর এই শব্দটা খুব ভালো লাগে। যাঁদের
ভাবনাচিন্তা আলোকোজ্জল, তাঁরাই রওশন-খয়াল।
যখন কঙ্কড়বাগে তাঁর বাড়িতে পৌঁছোতাম, সময়টা
সচরাচর হত অপরাহ্ন, সাড়ে তিনটে বাজছে হয়ত… দরজা খোলা থাকত, ভিতর থেকে আওয়াজ দিতেন “আসছি!”
ভিতরে ঢুকে বসতে দেখলাম লুঙ্গি পরে খালি
গায়ে একটা গাজর চিবোতে চিবোতে আসছেন। “খাবে?” গাজর চিবোতে আমারও ভালো লাগে;
আমার হাতে একটা গাজর ধরিয়ে সামনের সোফাটায় বসলেন। সামনের ছোট টেবিলের স্তুপের
মধ্যে হাত ঢুকিয়ে হয় আগেকার প্রুফ ছাপার কাগজের মত ময়লা নয়ত একপিট্ঠা দুটো কাগজ
তুলে নিলেন। “দ্যাখো, একটা খসড়া করেছি প্রোগ্রামের!
পড়ে যাও একবার। তারপর বলো আর কী কী করা যেতে পারে।”
পড়ে গেলাম। কোনো বড় অনুষ্ঠান বা সম্মেলন
গোছের কিছু একটার সাফল্যের জন্য কী কী অবশ্যকরণীয় তার একটা বিশদ ছক। আজকের সরকারি
ভাষায় যাকে বলে ডিপিআর – ডিটেল্ড প্রোজেক্ট রিপোর্ট। দেখে আমি যতটা উৎসাহিত ঠিক ততটাই হতোদ্যম হয়ে
পড়ছি। এত কাজ! করবে কারা? লোক তো গোনাগুনতি! আলোচনাচক্র, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান,
শিশু ও যুবদের মাঝে বিভিন্ন গ্রুপে গান, আবৃত্তি, প্রশ্নোত্তরী প্রতিযোগিতা,
স্মরণিকা ছাপানো, পরিচয়মালা/সংক্ষিপ্ত ইতিহাস গোছের দশটা চটি বই ছাপানো, সারা ভারত
থেকে বাছা বাছা মানুষদের ডেকে আনা, তাদের থাকাখাওয়ার ব্যবস্থা, ব্যাগ তৈরি করানো,
রাজ্যপালের প্রোগ্রাম নেওয়া, হ্যানত্যান… তার ওপর প্রত্যেকটি আইটেমের খুঁটিনাটি, ডেট শিডিউল।
আমি হয়ত হেসে বললাম, “কে কোন কাজটা করবে তাদের নামগুলোও
পাশে পাশে লিখে দিন! দেখুন ক’জন আসে।”
তাও লিখে দিতেন। এবং কাজগুলো ঠিক অতটা না
হলেও কিছুটা তো হতই। ঠিক যেভাবে হওয়ার কথা ছিল সেভাবে না হলেও হত। তাঁর
খুঁতখুঁতেমিতে ব্যতিব্যস্ত হতাম সবাই। ‘এতে এত খরচ হল কেন? তোমাদের দুজনকে দায়িত্ব দিচ্ছি, খোঁজ নাও এই বিলটা আসল
না নকল? প্রত্যেকটা দরের জন্য আলাদা করে বাজার থেকে কোটেশন নিয়ে মেলাও।’… ‘এটা এত বাজে হল কেন? কোত্থেকে করানো হয়েছে কাজ? আমাকে
দাও ঠিকানা, আমি নিজে গিয়ে চেক করব। নিশ্চই বখরার ব্যাপার আছে।’… তারপর ক্ষোভের হতশ্বাস, “মনের তাগিদটাই কমে যাচ্ছে মানুষের!
শুধু মুখের ফেরেববাজি!”… তবু, আবার তৈরি করতে বসতেন ভবিষ্যতের নতুন কাজের নতুন কর্মসূচী!…
পরে যখন এখানকার বাড়ি বিক্রি করে চলে
গেলেন, মাঝেমধ্যে আসতেন, শেষের দিকে থাকতেন মিঠাপুর ‘বি’ এরিয়ায়, ডঃ (ক্যাপ্টেন) দিলীপ কুমার সিনহার অতিথি হয়ে হোপ হস্পিট্যালের পিছনের
ঘরটায়। তখনও ওই রকম ব্যাপক কর্মসূচী, এই তো সার্ধশতবার্ষিক রবীন্দ্রজয়ন্তীর আগেও।
শুধু, কে কোন কাজটা করবে, সেটা আর বুঝে উঠতে পারতেন না।
“কিন্তু
করতে তো হবে! তোমরা বুঝতে চাইছ না।…” স্পষ্ট বলতেন না, কিন্তু তাঁর উদ্দীপনা আর ব্যাকুলতা দেখে মনে হত বলতে চাইতেন যে প্রত্যেকটি সামাজিক/সাংস্কৃতিক
উদযাপনে, মানুষের চেতনাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাগুলোর যে একটি নির্দিষ্ট
ন্যূনসীমা থাকে, তার নিচে যেন কখনই না থামে আর তাকে যেন এড়িয়েও না যায় সে উদযাপন।
“ওঘরে কফি আছে” হোপ হাসপাতালের ঘরটায় বসে বলতেন, “খেতে চাও তো তৈরি করে নাও গিয়ে। ব্ল্যাক কিন্তু। এক মগ আমাকেও দিও।” জল ফোটাতে ফোটাতে আমি অনুভব করতাম, অসুস্থ শরীর নিয়ে ঘরে বন্দী একটা মানুষ ওঘরে বিহার ও বহির্বঙ্গে বাঙালিদের কিংকর্তব্য আর তাতে বাঙালি সমিতির ভূমিকা নিয়ে যে এত চিন্তাশীল, সেই চিন্তাটা নিছক বাঙালিয়ানার নয়, সেই সুস্থ সচেতন গণতান্ত্রিক চেতনার, যা ভারতের সবচেয়ে বড় রক্ষাকবচ। আর তাঁর ভাবনাচিন্তায় যে এত আকূলতা আর অস্থিরতার দোলা, তার ঠেলাটা আসছে সেই মহামানবের সাগরতীরের আকাশের আলোর প্রবাহ থেকে, যে সাগরতীরে পৌঁছে আলোর প্রবাহ অব্দি মাথাটা ওঠাতে পারে বলেই কোনো কোনো মানুষ ‘রওশন-খয়াল’ হয়ে ওঠে।
শিষ-বাজিয়ে
আজকাল খুব চলেছে শব্দটা, হুইস্ল্-ব্লোয়ার,
বাংলায় আক্ষরিক অর্থে ‘শিষ-বাজিয়ে’, যদিও
সদর্থে হবে ‘দৃষ্টি-আকর্ষক’, বা ‘সাবধানকর্ত্তা’, বা ‘হাঁক-দার’। জানিনা কলকাতায় এর কোনো
সরকারি বাংলা হয়েছে কিনা।
ভারত স্বাধীন হওয়ার পর প্রতিটি জনগণনার সময়
এই বহির্বঙ্গে, বাংলা মাতৃভাষার ক্ষেত্রে যে কারচুপিটা সরকার বা সরকারি বিভাগ বা
সরকারি আধিকারিকেরা করে চলেছে সেটা তিনিই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছিলেন।
এই কারচুপিতে সংশ্লিষ্ট আধিকারিকদের প্রত্যক্ষ
আর্থিক কোনো প্রাপ্তি নেই। আনন্দপ্রাপ্তি অবশ্যই আছে – চিত্তের বাঙালি-বিদ্বেষ পরিতৃপ্ত হয়। এক ধরণের ভাবের
ঘরে চুরি। যেখান থেকে শুরু হয় সেখান থেকে যদি ধরি, তাহলে প্রথমতঃ, জনগণনার
ফিল্ডকর্মীরা ফর্ম নিয়ে ঘরে ঘরে পৌঁছোয় না। তাদের ট্রেনিংএর সময় দেওয়া হয় উপদেশটা।
“ফর্ম উল্টো পাল্টা ভরে দিলে পরে
তোমাদেরই জবাবদিহি করতে হবে; তাই একটা খাতায় প্রধান তথ্যগুলো নোট করে নিও – কিছু মাইনর ইনফর্মেশন তো কমন – রাতে ঘরে বসে ওই খাতা দেখে
দেখে ফর্মগুলো ভরে তারপর কমন ইনফর্মেশন গুলো বসিয়ে নিও!” এই হিসেবে মাতৃভাষার ইনফর্মেশনটাও মাইনর ও কমন। কাজেই
রাত্রে ঘরে বসে সব হিন্দি ভরে দেওয়া যায়! আবার সব কাজের মত এই কাজেরও সুপারভিজন
হয়, এবং সেই কাজটি করেন যে আধিকারিক, তার সাথে খুব স্বাভাবিক ভাবে জড়িয়ে যায়
স্থানীয় রাজনীতির কুস্বার্থ। ভূল তথ্যকে ঠিক দেখাতে অনেক ঠিক তথ্যকে ভূল প্রতিপন্ন
করতে হয়। তৃতীয়তঃ, তথ্য-বর্গীকরণ। একটি লোকভাষা বা উপভাষা মাতৃভাষা হলে তাকে কোন
প্রধান ভাষার সাথে জুড়তে হবে, এই সিদ্ধান্তটা কারো ব্যক্তিগত মূর্খতা বা চালাকির
এক্তিয়ারে না থাকলেও বেশ কয়েকজন সরকারি ভাষাবিদ/ব্যুরোক্র্যাটদের সামূহিক মূর্খতা
বা চালাকির এক্তিয়ারে থাকতেই পারে।
বিগত কয়েক বছরে, জনগণনায় তথ্যপ্রযুক্তির
প্রয়োগ, ঘরের মানুষের সামনে আধারকার্ডের ফর্ম ভরানোর বাধ্যবাধকতা, তথ্যের অধিকার
সম্পর্কিত আইনটির বলবৎ হওয়া ইত্যাদি ঘটনাগুলো অন্যান্য অনেক সরকারি কাজের মত জনগণনার
কাজেরও জনবিরোধী গোপনীয়তা অনেকাংশে কম করতে পেরেছে। ২০১১র জনগণনার পরিসংখ্যানে
আপনি কোথায়, তা অনলাইনে জানতে পারছেন। লিঙ্গুইস্টিক সার্ভে বা ভাষার জরিপ, যা
ভারতে প্রথম ও শেষবার সেই উনবিংশ শতাব্দীর মাঝে গ্রিয়ারসন সাহেব করেছিলেন, আজ আবার
হচ্ছে, আর তাতে আপনার জায়গা আপনি অনলাইনে জেনে নিতে পারবেন।
তাছাড়া, আমি এটাও মনে করি যে ১৯৯১এর পর
বিভিন্ন কারণে ‘আত্মপরিচয়ের রাজনীতি’র (identity
politics) যে একটা পর্ব শুরু হয়েছে, তাতে বহির্বঙ্গে
বাংলাভাষীদের প্রতি হতে থাকা অন্যায় ও জুলুমগুলো রাজনীতিগত দিক থেকে ওঠানো একটু
সহজ হয়েছে, অন্ততঃ শিক্ষিত এবং রোজগারে প্রতিদ্বন্দ্বী ভিন্নভাষীদের সামাজিক
বিদ্বেষদৃষ্টি কিছুটা নরম পর্যায়ে চলছে আপাততঃ।
কিন্তু আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে? অথচ সেই
বিষম পরিস্থিতিতে গুরুচরণ সামন্তের মত মানুষেরা কিভাবে এগিয়ে চলেছিলেন? একটি
গুরুত্বপূর্ণ লেখা আছে ওনার, ‘বাঙালির অন্তর্ধান ও বিহার’। বহুবার ছাপা হয়েছে, পুস্তিকা হয়েও বেরিয়েছে। তথ্য/পরিসংখ্যানে সমৃদ্ধ লেখাটি
থেকে কয়েকটি পংক্তি উদ্ধৃত করার লোভ সামলাতে পারছিনা।
…“এর আগে আমি ১৯৭১ সালের জনগণনার সময়, ঘাটশীলার বি.ডি.ও.র
অফিসে গণনাকারীদের কিভাবে ১৪ নং কলমে ‘হ’ লিখে দেবার নির্দেশ দেওয়া হচ্ছিল, তা উল্লেখ
করেছি। উক্ত ঘটনার পর, বিহার বাঙালি সমিতির পক্ষ থেকে এ নিয়ে পত্র-পত্রিকায়
লেখালেখি ও ১০ হাজার লিফলেট বিলি করা হয়। … ১৯৮০ সালেই জামশেদপুরে নি.ভা.বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনে, বহির্বঙ্গ শাখায়, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রণব
মুখার্জির উপস্থিতিতে, বাংলাভাষী জনসংখ্যার হেরফের করার প্রসঙ্গটা উত্থাপন করে
মিডিয়ার কাছে আমার পরিসংখ্যানগুলো বিলি করে দিই।”…
যিনি লিখছেন, মনে রাখতে হবে নিজের পেশাগত
জীবনে তিনি একজন কলেজ শিক্ষক (আগামী দিনে সেই কলেজের প্রাচার্য), পাঠ্যপুস্তক
প্রণেতা… অর্থাৎ ইংরেজীতে যাকে বলে একডেমিশিয়ান।
অন্ততঃ বাইরের মানুষজনের চোখে। অথচ কাজগুলোর কথা একজন পোড়খাওয়া রাজনৈতিক/সামাজিক কর্মীর
ভাষায় বলছেন।
কয়েক বছর আগে। আনন্দ কিম্বা ব্যাঙ্গালোর
থেকে গুরুচরণদা পাটনায় এলেন। আমাকে অফিসে ফোন করে ডাকলেন। যাওয়ার ছিল অশোক সিনেমার
পাশে একটা গলিতে, সেন্সাসের অফিসে। ২০০১র জনগণনার ভাষাভাষী-অধ্যায় তখনও প্রকাশিত
হয়নি। সন্দেহের যথেষ্ট কারণ ছিল যে পরিসংখ্যান এধার ওধার করার কিছু একটা খেলা চলছে
ভিতরে ভিতরে। অফিসারের কাছে বসে, ভাষাভাষী-অধ্যায়ের প্রকাশনের শুধু একটা সম্ভাবিত
দিনক্ষণ পাওয়া গেল। অফিসারের কার্ডটা নিয়ে আমাকে দিয়ে দিলেন মাঝে মধ্যে খোঁজখবর
নিতে।
আমার কিন্তু নেওয়া হলনা। এই এক্ষুণি, এই
লেখাটা লেখার সুবাদে মনে পড়ায় ইন্টারনেটে সেন্সাসের সাইট খুলে ২০০১ সালের জনগণনার
ভাষাগত পরিসংখ্যানগুলো ডাউনলোড করলাম।
গুরুচরণদা গুরুচরণদা, আমি আমি! অথচ কাজগুলো
করার জন্য তেমন সচেতন, নিরলস ও অভিজ্ঞ হুইস্ল্ব্লোয়ারের আজও ততটাই প্রয়োজন!
পুরোনো রাজদূত
বোতাম ছেঁড়া গেরুয়া রঙের জামা পরে একটা
পুরোনো রাজদূত মোটরবাইক ভটভটিয়ে পৌঁছে যেতেন আমার অফিসে। পরে অবশ্য একটা মোপেড
ধরেছিলেন অপেক্ষাকৃত হাল্কা বলে। কিন্তু রাজদূত শব্দটার সাথে একটা যেন সম্পর্ক ছিল
তাঁর। একদিন নিজের বাড়িতে দেখালেন একটা যত্ন করে মোড়া কাপড়ের টুকরো, “চিনতে পারছো?” সত্যি বলতে আমি পুরো
প্রসঙ্গটা জানতামই না। তাই পতাকা মনে হলেও সেই মুহুর্তে জেনারাল নলেজে ফেল
করেছিলাম। কোন দেশের, গুলিয়ে ফেলেছিলাম।
পরে পূর্ণেন্দুদা পুরো প্রসঙ্গটা বলেছিলেন।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার উপলক্ষে বিহার বিধানসভায় বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলিত
হয়েছিল। পতাকাটা সাপ্লাই করেছিলেন গুরুচরণদা, তাও রাত জেগে নিজের ঘরের সেলাই
মেশিনে সেলাই করে!… সে
পতাকা আর বিধানসভার আর্কাইভে থাকেনি, ফিরে এসেছিল আসল ‘দর্জি’র হাতে। পরে আরেকটা প্রসঙ্গ জানলাম। বিহারের তরফ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের
অস্ত্রশস্ত্র যোগান দেওয়া হয়েছিল আর সেই অস্ত্রবোঝাই ট্রাকটা দেশের সীমান্তে নিয়ে
পৌঁছেছিলেন গুরুচরণদা। তাহলে হলেন কিনা তিনি ‘রাজদূত’? বাংলাদেশের জন্য ভারতের, আর ভারতের জন্য বাংলাদেশের? সে তাঁর জামার বোতাম
যতই ছেঁড়া থাকুক, বাইকটা যতই লজ্ঝড় হোক!
যখনই
ভাবি, মনে হয় তাঁদের একটা দিন ছিল। ষাট-সত্তরের দশকে কদমকুঁয়ায় সুলেখা প্রিন্টিং
ওয়ার্ক্সে মন্টু সরকার, ওদিকে নালা রোড পেরিয়ে ডঃ এ কে সেন, দলদলির মুখটায় ভাগলপুর
মেসের সামনে গুরুচরণ সামন্ত, তারপর রঙীন হালদার, আরো একটু আগে ডঃ ঘোষাল… কী সব মানুষ ছিলেন! সবাই রাজদূত!
স্বপ্নের পৃথিবীর রাজদূত!
এখন অনেকে বলবেন, “হাঃ, কী হল সেই স্বপ্নের পৃথিবীর?” এটা ঠিক যুদ্ধে আহত বীরকে যেন
বলা, “হাঃ, কী হল অস্ত্র নাচিয়ে? বড় যে
বলতে জিতবে? তার তো কোনো লক্ষণ দেখতে পাচ্ছিনা। আর জিতলেও তদ্দিন তুমি বাঁচবে কী? মিছিমিছি
জীবনটা
নষ্ট করলে!”
স্বপ্নের যোগানদার
শুধু অস্ত্রের আর পতাকার, দুষ্প্রাপ্য বই,
দলিল আর পরিসংখ্যানের আর হ্যান্ডবিলের নয়, প্রয়োজনে বস্তুতঃ স্বপ্নেরও যোগানদার
হয়ে যেতেন গুরুচরণদা। ঘটনাটা আমার সাথেই ঘটেছিল।
রবিঠাকুরের কিছু রচনার সংকলন নাকি হিন্দিতে
বেরুবে আর প্রকাশক বিশ্বভারতীর যে প্রাক্তন শিক্ষককে এই সংকলন সম্পাদনার দায়িত্ব
দিয়েছে তিনি গুরুচরণদার বিশেষ পরিচিত, বলা যায় পুরোনো বন্ধু। গুরুচরণদার সাথে বসে
তিনি সম্ভাব্য অনুবাদকদের নামের একটা সূচী তৈরি করেছেন। তাতে আমার নামও আছে, ‘পুনশ্চ’ ও আরো কয়েকটি শেষের দিকের বইয়ের
কবিতার অনুবাদকর্তা হিসেবে। আমি শুনে প্রথমে তো ঘাবড়ে গেলাম। কিন্তু সে যাই হোক,
গুরুচরণদা সেই প্রফেসরসাহেবের সাথে আমার অফিসে এলেন, এমনকি আগাম-মজুরি (৫০%) পেলে
তবেই চুক্তিতে সই… এসব কথাও
হল, সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে গুরুচরণদা বললেন, “কাজটা শুরু করে দাও, এগিয়ে থাকো, পরে সময় পাবে না।”
তখন বাড়িতে আমার শ্বাশুড়ি অসুস্থ,
শয্যাশায়ী। তিনি নিজেও, নাইট কলেজে গুরুচরণদার কাছে পড়ে গ্র্যাজুয়েশন করেছেন এক
সময়, গুণমুগ্ধ ছাত্রী। ওঘরে সবাই তাঁকে ঘিরে, আর বাইরের ঘরে আমি বসে বসে ‘পুনশ্চ’র কবিতাগুলোর অনুবাদে রত। মাথায়
স্বপ্ন, আমারও নাম থাকবে রবিঠাকুরের কবিতার হিন্দি অনুবাদে!
শ্বাশুড়ি মারা গেলেন কিছুদিন পর। ওদিকে সেই সংকলনও আর প্রকাশিত হলনা। বা হয়ে থাকলেও আমাকে বাদ দিয়েই হয়ে থাকবে।
দু’রুখি মাই
আমাদের বাড়িতে খেতে বারম্বার অনুরোধ করতেন
আমার স্ত্রী। শেষে একবার দুপুরে এসেছিলেন। কিন্তু খান নি। তখন তাঁর স্মৃতিপথে
ঘোরার পর্ব। রামগড়, হাজারিবাগ ঘুরে আসছেন। নিজের তোলা নানান ফটো দেখালেন। রামগড়ে
তাঁদের আদি বাসস্থান, রাজপুরোহিত হিসেবে, নেতাজী যে গাড়িতে করে গোমো গিয়ে দেশ থেকে
পালাবার জন্য ট্রেন ধরেছিলেন (সে গাড়ির ছবিই কী? নাঃ, আমারও স্মৃতিভ্রংশ হচ্ছে),
একটা প্রাচীন মন্দিরে কোমরউঁচু থামের ওপর গর্ত্তে জল, সে জল নাকি ফুরোয় না, ভিতর
থেকে কী রহস্যে ভরে ওঠে কেউ জানেনা(!)… । লোকশ্রুতির ভিতরে প্রবেশ করার এই শখটা তাঁর ছিল জানতামনা। বললাম, “তাহলে চলুন, দুরুখি মাইকে দেখে
নেবেন। আমাদের বাড়ির সামনের গলিতে একটা ছোট্টো চুড়োহীন মন্দির বা বলতে গেলে পুজোর
ঘর। মন্দির পেরোতে গলিটা বাঁক নিয়েছে মন্দিরের দেয়ালের সাথে। তারপর ওদিকে বেরিয়ে
গেছে। দুদিক দিয়েই বড় রাস্তায় পড়া যায় তাই নাম দু’রুখি। মন্দিরের বাইরে পুরাতত্ত্ব বিভাগের একটা বোর্ড, তাতে
লেখা আছে যে মন্দিরের ভিতরে মুর্ত্তিটা বৌদ্ধ শিল্পের শালভঞ্জিকা মোটিফ, স্থানীয় মানুষেরা
দেবী হিসেবে পুজো করে থাকে।
মন্দির খোলা ছিল। এক মহিলা পুজো দিচ্ছিলেন।
আমি চটি খুলে ভিতরে ঢুকে তাঁকে আশ্বস্ত করলাম – ব্যাঙ্গালোর থেকে এসেছেন প্রফেসর সাহেব। পুরোনো
মুর্ত্তি-টুর্ত্তি এসব নিয়ে রিসার্চ করেন দেশদুনিয়া ঘুরে।
তাও তো আছে, গুরুচরণদা। তিরিশ বছর আগে
রেললাইনের ওপারে তালবনের ভিতরে একটা প্রায় আস্ত অশোকস্তম্ভ দেখেছিলাম,
আর্কিওলজিকাল সার্ভের বোর্ডও ছিল। আজ সব বেমালুম হাপিশ। খাম্বাসুদ্ধু গিলে খেয়ে
বাড়ি উঠে গেছে তিন তলা!
(যে মহিলা পুজো দিচ্ছিলেন তাঁর দিকে ইশারা
করে) ওনাকে বলো না মুর্ত্তির গায়ের কাপড়টা একটু সরাতে। কিছু তো বোঝাই যাচ্ছে না
ক্যামেরায়!
(বললাম, মহিলা শিউরে উঠে কান চাপা দিলেন)
ছি, ছি, মাতার গায়ের কাপড় সরাতে বলছেন? পুরুষদের সামনে মায়ের কাপড় সরানো যায়না।
পাপ হবে!
আর কিছু বলার থাকে না।…
সেবারে হাজারিবাগ ঘুরে যে ছবি তুলেছিলেন
সেগুলোই কাজে লাগিয়েছিলেন কয়েক সপ্তাহ পরে লেখা ‘রবীন্দ্রনাথ ও হাজারিবাগ’ প্রবন্ধটাতে।
[বিহার বাংলা আকাডেমির প্রকাশনা 'গুরুচরণ সামন্ত স্মারকগ্রন্থ'এ প্রকাশিত]