সব সফরের প্রস্তুতি থাকে। আমার ক্ষেত্রে, হাতে হাজার-বারোশো খানেক
টাকা (১৯৭৬এ কম ছিল না, আমার তখনকার তিন মাসের মাইনে মোটামুটি) জমা হওয়ার পর, সাতশো
হাতে রেখে আর পাঁচশো ড্রাফট করিয়ে নিয়ে, একমাত্র প্রস্তুতি বাকি রইল একটি কবিতা মুখস্থ
করা। সবচেয়ে কঠিন কাজ। জীবনে কখনো কোনো পরীক্ষায় কোনো প্রশ্নের উত্তর আমি মুখস্থ করে
লিখতে পারি নি। হয় বুঝে নিজের ভাষায় লিখেছি নয় ছেড়ে বেরিয়ে গেছি। তাকেই কিনা জীবনানন্দ
দাশের কবিতা মুখস্থ করতে হবে।
আসলে আমার বন্ধু ও অগ্রজসম হিন্দি কবি আলোক ধন্বা যখন জানলেন আমার
জবলপুর যাওয়ার ইচ্ছে আছে কেননা সেখান থেকেই অমরকন্টকের বাস যায়, আর অমরকন্টক নামটা,
যেদিন থেকে রবীনদার কাছে জায়গাটার বর্ণনা শুনেছি, কাঁটার মত ফুটছে – বললেন, “তাহলে নিশ্চয়ই করে
ভূপাল যাবেন। ভারত ভবনে মঙ্গলেশ আছে, ওরা সাথে দেখা করবেন আর জীবনানন্দ দাশের কবিতা
শোনাবেন।” মঙ্গলেশ মানে মঙ্গলেশ ডবরাল, আলোক ধন্বার
সমসাময়িক হিন্দি কবি, উত্তরাখন্ডের (তখন উত্তর প্রদেশ) মানুষ, এবং জবলপুরবাসী গল্পকার
এবং সম্পাদক জ্ঞানরঞ্জন সম্পাদিত ‘পহল’ পত্রিকায় তাঁর ‘ভুখ’ এবং অন্যান্য কবিতা পড়ে আমিও প্রশংসক হয়ে উঠেছি। তখনও তাঁর প্রথম
বই ‘পহাড় পর লালটেন’ প্রকাশিত হয় নি।
জীবনানন্দের ‘নগ্ন নির্জন হাত’ মুখস্থ করতে বেশ কয়েকদিন লাগল। আমারও জিদ ছিল যে মুখস্থ করবই, কাগজে
লিখে পকেটে রেখে নিজের সঙ্গে প্রতারণা করব না। জেদটা চেপেছিল আলোক ধন্বাকে দেখে। কী
অবলীলায় দিব্যি মুখস্থ আউড়ে যান কবীর, সুর, তুলসি, নিরালা, দিনকর, নাগার্জুন, গালিব,
মীর, ফৈজ, মখদুম …! মানে একটা অবিশ্বাস্য ব্যাপার। আমি অবাক
হয়ে তাঁর মুখের দিকে চেয়ে থাকি। তাই চিরকুট রাখলাম না। তবে হ্যাঁ সফরে বেরোবার পর,
ভূপাল পৌঁছোনো অব্দি প্রতিটি দিন ট্রেনে, বাসে, রিক্সায়, ঘরে, বাথরুমে কবিতাটা আউড়ে
গেছি যাতে ভুলে না যাই।
তারিখটা মনে নেই। তবে সেদিন রাজেন্দ্রনগর স্টেডিয়ামে সন্তোষ ট্রফির,
সিজন ১৯৭৬-৭৭এর ফাইনাল হয়েছিল, বাংলা মহারাষ্ট্রকে হারিয়েছিল। ম্যাচটা দেখেছিলাম। ইন্টারনেট
ঘেঁটেও তারিখটা পেলাম না। তবে কম্বল নিয়েছিলাম মোটা। তাই হয়তো জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারি
হবে। সন্ধ্যায় ফিরে মাকে বললাম, একটু ঘুরে আসব জব্বলপুর-টব্বলপুর। মা আমায় চিনত। এভাবেই
বেরিয়েছি আগেও। সন্ধ্যেরাতে স্টেশনে গিয়ে দেখলাম কিছুক্ষণের মধ্যে কোথায় যাওয়ার ট্রেন
পাওয়া যাবে। দেখলাম এলাহাবাদ হয়ে দিল্লি। জব্বলপুরের জেনেরাল টিকিট কেটে ট্রেনটায় চড়ে
গেলাম। হ্যাঁ, জেনেরাল টিকিট কেটে স্লিপারে আমি তখনও যেতাম না, পরেও কখনো যাই নি। আর
জেনেরালে বসে, দাঁড়িয়ে, মেঝেতে শুয়ে সফরপথের বন্ধুত্ব হয়েই যায়। এক রাত কেটে গেলে সবাই
আপন লাগে।
শুধু সকালে পায়খানা যাওয়া এক সমস্যা। খুব বেশি হলে নেমে যাও কোনো
স্টেশনে। পরের ট্রেনটা ধরে নাও। জিনিষপত্র বলতে ছিল একটা ব্রিফকেস সদৃশ স্যুটকেস। তিন
বছর আগে, ধানবাদে থাকার সময় কিনেছিলাম চল্লিশ টাকা দিয়ে। তখনো সিন্থেটিক ফাইবারের ব্রিফকেস
বা স্যুটকেস অন্ততঃ এদিককার বাজারে আসে নি। বা হয়তো বড়োলোকি দোকানগুলোয় এসেছিল। টিনের
তোরঙ্গ থেকে হাল্কা কিছু চাইলে যেমন ছিল চামড়ার স্যুটকেস তেমনই ছিল প্লাইউডের তৈরি
ছোটো স্যুটকেস বা ব্রিফকেস। হ্যাঁ, বাজারে রেক্সিন এসে গিয়েছিল, তাই ব্রিফকেসটাকে সুদৃশ্য
করতে রেক্সিন নিয়ে মুড়ে, টিনের পাত দিয়ে এজিং করে দেওয়া হত। পাটনায় ফিরে সেই ব্রিফকেসেই
রাখতাম কলকাতার ফ্রিস্কুল স্ট্রিট থেকে কেনা পুরোনো এবং অন্যান্য দোকান থেকে কেনা নতুন
লংপ্লেয়িং রেকর্ডগুলো।
সেসব বার করে, বইয়ের তাকে রেখে দিয়েছিলাম। নিয়েছিলাম দু’একটি জামাকাপড়, গামছা আর কম্বল। স্যুটকেস ছাড়া হাতে ঝোলালাম একটা
ওভারকোট।তখনকার দিনে হিন্দির কবি, শিল্পী, বুদ্ধিজীবীদের দেখতাম শীতে ওভারকোট পরে।
কলকাতায় কোনো চল ছিল কিনা জানি না। দিল্লীতে ওভারকোটের শীত পড়ে। কলকাতায় পড়ে না। যাই
হোক, বেশ স্টাইলিশ একটা এ্যাটিচুড লাগত। তাই এক বছর আগে বা হয়তো সেই বছরই শীতে পাটনা
জাংশনের সামনে মাটিতে ঢেলে বেচা সেকেন্ড হ্যান্ড শীতের কাপড়ের মধ্যে থেকে বেছে কিনেছিলাম।
গাঢ় সর্ষে রঙের। আর কলারে ফার। পুট ছিল না। অর্থাৎ, আদতে ওটা ইয়োরোপীয় কোনো নারীর ছিল।
নগদ একশো টাকায় কেনা ওভারকোটটা হয়ে দাঁড়িয়েছিল আমার, যাকে হিন্দিতে
বলে ‘টশন্’। অনেক বছর
ছিল আমার সঙ্গে। রবীনদার আঁকা পেন্টিং এবং স্কেচে, তাঁর ছেলে-মেয়ে, অমিত আর সোমাকে
কোলে নিয়ে কিছু ছবিতে। শেষে পাটনার মঞ্চে ‘গ্যালিলিও’ করা আমার বন্ধুতুতো ভাইপোটি চেয়ে নিয়ে গেল। গ্যালিলিওর কস্টিউমে
আগের ওভারকোটটা পাওয়া যাচ্ছে না বলে। দু’বছর পর জানালো
ইঁদুরে খেয়ে গেছে। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি ব্রেখটের মূল নাটক ‘গ্যালিলিও’ পাটনায় কখনো মঞ্চস্থ
হয় নি।বাংলায় প্রবীর দত্তের করা সংক্ষিপ্ত রূপান্তরের হিন্দি অনুবাদ করেছিলেন নিলুদি,
কমরেড নলিনী তিওয়ারি। সেটাই বহুবার মঞ্চস্থ করেছিল ‘প্রেরণা’ নামে একটি সংস্থা।
যাহোক, এই সফরের বিভিন্ন অংশের অভিজ্ঞতা আগে লেখা বেশ কিছু কবিতায়
এবং গল্পে বা শব্দে আঁকা রেখাচিত্রে ব্যবহার করেছি। তার মধ্যে কবিতা ‘কলিমেরা’ এবং রেখাচিত্র ‘টিট্টিভ’ প্রকাশিত। আদৌ সেসব
কেউ পড়েছেন কিনা জানি না। পড়ে থাকলে পুনরুক্তি মনে হবে – ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। ভোরবেলায় এলাহাবাদ পৌঁছোলাম। আগে কখনো যাই নি।
হিন্দি সাহিত্য কিছুটা জানতাম বলে এলাহাবাদের একটা গুরুত্ব ছিল মনে। তবে এমন কিছু দাগ
কাটল না দেখে। পরিচিত কেউ আছেন বলে জানতামও না তখন। একটা রিক্সাকে বললাম সঙ্গমে নিয়ে
যেতে। জানতাম না তখন কুম্ভমেলা চলছে। বা সদ্য শেষ হয়েছে। রিক্সাওয়ালা বলেছিল কিনা মনে
নেই। সঙ্গমে গিয়ে অন্ততঃ কিছুই বুঝি নি।
দিব্যি বালি পেরিয়ে জল অব্দি গেলাম আর গঙ্গা-যমুনার দুই রঙের জলের
মিলনরেখা দেখে অভিভূত হলাম। নামটা ত্রিবেণী, কিন্তু তৃতীয় নদী সরস্বতী বিলুপ্ত বলেই
তখন স্বীকৃত ছিল। রিক্সাকে বলাই ছিল দাঁড়াবে। ফেরার পথে বাজারে একটা দোকানে জলখাবার
খেয়ে স্টেশনে ফিরে এলাম। একটা ট্রেন আসছিল জব্বলপুরের দিকে যাওয়ার। সে ট্রেনটা ঢুকতেই
প্রথম টের পেলাম কুম্ভের ভিড়। এত মানুষ প্ল্যাটফর্মে কোথায় ছিল কে জানে। ইঞ্জিনের বাঁশি
বাজার আগে কোনো রকমে দরজার হাতলটা ধরে দাঁড়াতে পেরেছি আর শরীরটা ভিতর দিকে চাপছি ক্রমাগত।
ছেঁউকির পর কোথাও, কোনো স্টেশনের আগে ট্রেনটা থেমে গেল। শুরু হল
নামার জন্য ধাক্কাধাক্কি। দু’একজন বেরুতেই ভিতরে
চাপার জায়গা পেলাম। তাই স্যুটকেস আর ওভারকোটটা পায়ের কাছে নামিয়ে রেখে ডানহাতটাকে একটু
আরাম দিচ্ছিলাম। বাঁহাতে দরজার হাতল ধরা ছিল। খেয়াল হল, মাথার ওপর দিয়ে বাইরের দিকে
এগোচ্ছে একটা বড় বস্তা। এখানেই ভুল করে ফেললাম। যার বস্তা, তার যখন ছুঁড়ে রেললাইনের
পাথরে ফেলতে অসুবিধে নেই, আমার তাকে সাহায্য করার কোনো প্রয়োজন ছিল না। তার নামার সময়
শুধু একটু সিঁটিয়ে যেতাম। কিন্তু আমি বস্তার এক প্রান্ত ধরে নিলাম। ব্যস, সে নিজের
হাত সরিয়ে পুরো বস্তাটা আমার হাতে ছেড়ে দিল। আমার কব্জি মচকে দিয়ে ভারি বস্তাটা ধপ
করে নিচে গিয়ে পড়ল। তারপর লোকটিও নেমে গেল।
আমি তখন মচকানো কব্জিটা বুকে চেপে সেঁক দেওয়ার চেষ্টা করছি। পরবর্তী
দশ বছর ছিল সেই ব্যাথা। কব্জির ভিতরের একটা হাড় মাঝেমধ্যেই ফুলে উঠে, ঠেলে বেরিয়ে আসতে
চাইত। বাবা বলত, পূর্ণিমা এলেই জ্বালাবে। পূর্ণিমার চাঁদ নদীতে জোয়ার আনতে পারে, অর্থাৎ
তার মাধ্যাকর্ষণ নদীর জলকে টানতে পারে জানতাম। তাবলে শরীরের ভিতরের হাড়টাকেও টানবে?
বিশ্বাস করি নি। তবে আকাশের দিকে তাকিয়ে টের পেয়েছি হাড়টা ফুলে উঠত সেই দিনগুলোতে।
পিরমোহানিতে বসতেন ডাঃ এইচ. এন. মিত্র। এমবিবিএস ফিজিশিয়ান, পাটনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে
ছিলেন। কিন্তু অবসর গ্রহণের পর হোমিওপ্যাথি শুরু করেন। তিনি বলেছিলেন, দশ বছর থাকবে।
ওষুধ দিতেন।
যাহোক, ট্রেনটা চলতে শুরু করল। জায়গা হওয়ায় আমিও দরজা ছেড়ে জলের
বেসিনটার দিকে সরে গেছি। স্যুটকেসটা খাড়া রেখে, তার ওপর হাতে কম্বল নিয়ে বসার জোগাড়
করছি। সামনে বসে থাকা এক বৃদ্ধ তাঁর থলে থেকে একটা পুঁটলি বার করলেন। খোলা হলে দেখলাম
পোড়ানো আলু। তাঁর সঙ্গে ছিল এক বিবাহিতা যুবতী এবং একটি ছোট ছেলে। হয়তো পুত্রবধু আর
পৌত্র। আলু ছাড়িয়ে খাওয়া শুরু করতেই পোড়ানো আলুর সুগন্ধে জায়গাটা ম ম করে উঠল। হোলির
আগজার নিভন্ত আগুনে আলু ছুঁড়ে ফেলা হয় পোড়ানোর জন্য, দেখেছি। ছাই থেকে সেই আলু ছড়ি
দিয়ে টেনে বার করতে, ঝেড়েঝুড়ে ছাড়িয়ে খেতেও দেখেছি বাচ্চাদের। কিন্তু কখনো চাই নি।
এখন এমন চনমন করে উঠল খিদে যে ভাবলাম চেয়েই নিই। যাহোক, স্টেশন এসে গিয়েছিল। চাইলাম
না।
ফেরিওয়ালার কাছ থেকেই কিছু কিনে খেলাম। জব্বলপুরে নামলাম বিকেল নাগাদ।
রিক্সাকে বললাম বাসস্ট্যান্ডের কাছে কোনো হোটেলে নিয়ে যেতে। দেখেশুনে একটা সস্তা কামরা
নিলাম, দোতলায়। জানলা দিয়ে সামনেই দেখা যায় বাস স্ট্যন্ড। তখন তো আর ইন্টারনেট নেই।
কাউন্টারের ভদ্রলোক পাটনা থেকে আসছি জেনে বললেন, কাল তো সন্তোষ ট্রফির ফাইন্যাল ছিল
ওখানে। আমিও সন্তোষ ট্রফির ফাইন্যালের রেজাল্ট, শ্যাম থাপার ড্রিবল, বিকাশ পাঁজির মিডফিল্ড
থেকে বল নিয়ে লম্বা দৌড় ইত্যাদি নিয়ে বোদ্ধার মত দুটো কথা বলার সুযোগ পেয়ে গেলাম।
রাজেন্দ্রনগর স্টেডিয়ামের (এখন মইনুল হক স্টেডিয়াম) সঙ্গে আমার একটা
সম্পর্ক ছিল। বাবা যে কন্সট্রাকশন কম্পানিতে একাউন্টেন্টের কাজ করতেন সেই কম্পানিই
স্টেডিয়ামের মেইন প্যাভেলিয়নটা তৈরি করার বরাত পায়। তখন আমি কলেজে পড়ি। কিন্তু বাবার
মনে কোনো ভাবে একটা ধারণা তৈরি হয়েছে যে ব্যবসায় আমার সৌভাগ্য আছে। তার জন্য পরে আমায়
ছোড়দার কাছে তালচেরেও যেতে হয়েছিল আবার (আগে গরমের ছুটি কাটাতে গিয়েছিলাম একবার; তখন
পিসি থাকতেন, তাঁরই কোয়ার্টারে ছিলাম)। ভুগর্ভস্থ খনির পরিত্যক্ত সুড়ঙ্গগুলোতে জল আর
বালি ভরার স্টোইং পাইপলাইনগুলো মেরামত করার সাবকন্ট্র্যাক্ট নিয়েছিলাম, মানে ছোড়দাই
পাইয়ে দিয়েছিল।
কিন্তু তার আগে, আমাকে তৈরি করার জন্য বাবা পাঠিয়েছিলেন নির্মীয়মান
রাজেন্দ্রনগর স্টেডিয়ামে। কম্পানির হয়ে, দাঁড়াতে হবে মাচার সিঁড়ির দোতলায়। ওপরে ছাত
ঢালাই হচ্ছে। নিচে থেকে কংক্রিটের ঝুড়ি মাথায় নিয়ে চড়া মহিলাদের হাতে ফি-ঝুড়ি টিকিট
দিতে হবে। সেই টিকিট যোগ করেই তাদের মজুরির হিসেব হবে সেদিনকার। সেই মজুরির টাকার চেকে
জেনারেল ম্যানেজারের সাইন করাতে একা একা উড়োজাহাজে কাঠমান্ডুও গিয়েছিলাম একদিনের জন্য।
কিন্তু সে কাজ আমার পোষালো না। মজুর নারীরা সবাই তো একরকম নয়। আর আমি দাঁড়িয়েও থাকতাম
একটা উঁচু জায়গাটায়। ওপরে আসার সময় কয়েকজন দুষ্টুমি করে উদলো হয়ে আসা বুক দেখিয়ে ইশারা
করত আর লজ্জা পেলে হিহি করে হাসত। মেজাজ খারাপ হতে শুরু করল আমার। মাকে বলে দিলাম,
যাবো না, বাবাকে বলে দাও।
জব্বলপুরে পরের দিন ভোরে উঠে ভেড়া ঘাটের বাস ধরলাম। ধুঁয়াধারে তখন
জল কম। কাজেই জলের ধোঁয়াও নেই। আমরা এপারে দাঁড়িয়ে আছি। জলপ্রপাতের ওপারে লাইন দিয়ে
বাচ্চা বাচ্চা ছেলেগুলো দাঁড়িয়ে রয়েছে। বলছে চারানি, আটানি জলপ্রপাত যেখানে নামছে সেখানে
ফেলার জন্য। এপারে লোকেরা ফেলছে। সঙ্গে সঙ্গে ওপার থেকে ছেলেগুলো অত উঁচু থেকে ঝাঁপ
দিচ্ছে জলে। এমন তাক তাদের, জলে ডুব দিয়ে কেউ না কেউ ঠিক হাত পেতে দিচ্ছে, সিকেটা জলের
তল ছোঁয়ার আগে। মুঠোয় ভরে, জলের ওপরে এসে দেখাচ্ছে। যে পেল, সিকেটা তার হল। আমিও এপারে,
পাথরের গায়ে গায়ে নামার রাস্তা ধরে নিচে গেলাম। কিন্তু শেষ দাঁড়াবার জায়গাটাও এত উঁচু
যে জল ছুঁতে পারলাম না।
কিনার ধরে হাঁটতে হাঁটতে একটু নির্জনে চলে গেছি। দুপাশে গোলাপি শ্বেতপাথরের
পাহাড়, মাঝখান দিয়ে খরস্রোতা তরল ইস্পাত-রঙা জল বয়ে চলেছে। সেখানটায় আবার নিচে নামার
জায়গা খুঁজতে লাগলাম। হঠাৎ পিছন থেকে হাঁক এল সজোরে, “ওখান থেকে সরে যান।” পিছন ফিরে
দেখি দুজন পুলিস। নিচে দেখতে মানা করার কারণ জিজ্ঞেস করাতে বলল, ওখানটা সুইসাইড পয়েন্ট
নামে পরিচিত। অনেক আত্মহত্যা হয়েছে, ওখান থেকে জলে লাফিয়ে। অদ্ভুত! না? বিপজ্জনক জায়গাগুলোর
সৌন্দর্য্যই সবচেয়ে বেশি সম্মোহিত করে আর টানে। কেউ কেউ মনের অবস্থা ভালো করতেই সেই
সৌন্দর্য্যের সামনে দাঁড়ায় অথচ টানটা মৃত্যুটান হয়ে ওঠে।
কোথাও কোনো একটা দোকানে চা-জলখাবার খেলাম। ভেড়াঘাট থেকে মার্বেল
রক্সে যাওয়ার নৌকো তখনো ছাড়ত। কিন্তু ভালো লাগল না একা একা যেতে। বলতে কি, কোনো আকর্ষণই
অনুভব করলাম না। এসব যাওয়া, হয় সম্পূর্ণ একা হতে পারে, নৌকো রিজার্ভ করে (তার পয়সা
ছিল না) আর নয়তো বন্ধুবান্ধব, খুব কাছের কোনো নারীর সঙ্গে হতে পারে (সেটা সম্ভব ছিল
না)। অনেক পরে গিয়েছিলাম। তখন আমি স্ত্রী-পুত্র-কন্যা পরিবৃত। একবার ঘাটটা ঘুরে আমি
উঠে গেলাম চৌঁসঠ যোগিনী মন্দিরটা দেখতে। সবচেয়ে ভালো লাগল গর্ভগৃহে নন্দীর পিঠে হরগৌরীর
যুগলমুর্তি। … দুপুরের দিকে বাস ধরে ফিরে গেলাম জব্বলপুর।
ফিরে শহরটা একটু ‘পরিক্রমা’ করলাম হেঁটে হেঁটে। এক জায়গায় ‘লেনিন চৌরাস্তা’ দেখে থমকে
দাঁড়ালাম। নিশ্চয়ই এখন আর নেই। উন্নয়নের বুলডোজারে সেখানকার মানুষের স্মৃতিতেও ক্ষীণ।
সেই চৌরাস্তা ছেড়ে রেললাইন ধরে এগোলাম যাতে স্টেশনে কাছে যেতে পারি, সন্ধ্যে হয়ে আসছে।
এক জায়গায় একটা পুরো বস্তি দেখলাম গরীব মানুষদের, কোথাও রাস্তা চওড়া করার জন্য বা নতুন
নির্মাণের জন্য ভেঙে উজাড় করে দিয়েছে। মজার ব্যাপার, দুটো লাইনে কোন ট্রেন কখন আসে
তার হিসেব রাখছে বাচ্চারাও। যেহেতু রেললাইনে পাশের জমিটা ঢালু, জলের দিকে নেমে গেছে,
তাই মাঝ রেললাইনে তোলা উনুনে ভাত চাপিয়েছে। তার চারদিকে বাচ্চারা হাল্লা করে হিসেব
রাখছে – আগে আপ বম্বে মেল আসবে, উনুন সরাতে হবে ভাতের
হাঁড়ি সুদ্ধু? নাকি আগে ভাত ফুটবে, তারা খেতে পাবে গরম গরম? এই প্রসঙ্গটাও একটি কবিতায়
আছে, তবে প্রকাশিত নয়।
পরের সকালে উঠে জানলা দিয়েই দেখতে পেলাম অমরকন্টকের বাস ডিপোর বাইরে
বেরিয়েছে। ক্লিনার ছেলেটি চ্যাঁচাচ্ছে অমরকন্টক এবং আরো সমস্ত মধ্যবর্তী স্টেশনের নাম
বলে। তৈরি হয়ে নেমে, হোটেলের পয়সা মিটিয়ে বাসটার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। লজ্ঝড় বাস, স্টার্ট
নিয়েই দম ফুরিয়ে যাচ্ছে। আবার স্টার্ট …। ক্লিনার
ছেলেটিরই বকবকানিতে জানতে পারলাম, বাসটা বিখ্যাত, নাম ‘বুঢ়ি মাই’। বুঢ়ি মাই স্টার্ট
নিতে দেরি করে, কিন্তু একবার স্টার্ট নিয়ে নিলে দিব্যি পৌঁছে যায় অমরকন্টক।
সত্যি সত্যি একবার স্টার্ট ধরে নেওয়ার পর বুঢ়ি মাই অমরকন্টক অব্দি
আর বেগড়বাঁই করল না। কিন্তু ধীর গতি এবং জায়গায় জায়গায় থামার কারণে আড়াইশো কিলোমিটার
পথ পৌঁছোতে প্রায় সন্ধ্যে করে দিল। এবার কোথায় যাই? কোনোদিকে কোনো হোটেলের সাইনবোর্ড
চোখে পড়ল না। একটা বাজার মত ছিল। ঢুকতেই বাঁদিকে একটা রুটি তরকারির দোকান। ভাবলাম আগে
খেয়েই নিই। খেতে খেতে এই দোকানেই হয়তো জিজ্ঞাসাবাদ করে কোনো থাকার জায়গার হদিশ পাবো।
যেমন হয়, টিনের চালার নিচে বাঁদিকে কোমর সমান উঁচু একটা মাটিলেপা
চাতাল। চাতালের একদিকে দুটো উনুনের আঁচ। সে আঁচ বাড়ানো কমানোর জন্য চাতালের ওদিকে,
ঠিক উনুনের নিচে দুটো গহ্বর আছে যেখানে শিক ঢুকিয়ে ছাই হওয়া কয়লা নামানো যায়, ওপরে
নতুন কয়লা দিলে, পাখা দিয়ে হাওয়া করা যায়। এক উনুনে রুটির তাওয়া এবং আরেক উনুনে তরকারির
ডেকচি ছাড়াও আরো কয়েকটি পাত্র পাশে সার দিয়ে সাজানো রয়েছে। একটায় হয়তো ডাল, একটায় ভাত,
একটায় ভুজিয়া … তার পিছনে বেদিরই ওপর বসে মহিলা রুটি বেলছেন।
ফর্সা মোটা মত বেশ জাঁদরেল কিন্তু মিষ্টি চেহারা। এক পুরুষ, তাঁরই ফাইফরমাশ মত দোকানের
অন্যান্য কাজ করছে – পিছন থেকে বাসন ধুয়ে নিয়ে আসা, কয়লা নিয়ে
আসা …। চাকর মনে হল না, মহিলার স্বামীই হবেন। পিছনে
একটা খাটে বসে তের চোদ্দো বছরের এক মেয়ে লেখাপড়া করছে।
সেই মেয়েটিকেই নাম ধরে হাঁক দিলেন মহিলা। অপেক্ষারত গ্রাহকের সংখ্যা
বাড়ছে। মেয়েটি উঠে এসে টেবিলে সবার সামনে গেলাসে জল, শালপাতায় গরম গরম রুটি, পেঁয়াজ,
লঙ্কা আর শালপাতারই দোনায় গরম আলুর তরকারি দিয়ে গেল। পেট ভরে খেলাম। অমরকন্টকের পশ্চাদপটে
‘টিট্টিভ’ নামে যে একটি রেখাচিত্র আছে ‘সিঁড়ির মুখে ঘর’ বইটিতে,
তাতে এই সন্ধ্যে এবং পরবর্তী এক দিনের ঘটনাবলী অনেকটাই বিধৃত আছে। ঐ মহিলাকেই জিজ্ঞেস
করলাম কোথাও থাকার জায়গা পাওয়া যাবে কিনা। মহিলা হাত দিয়ে পিছনে ইংগিত করে একটি মন্দিরের
কথা বললেন, “যাও, মিল জায়েগি সোনে কী জগহ।”
এখন আর অন্ধকার রাতে দেখা সেই মন্দিরের বহিরঙ্গ কিছুই মনে নেই। কোন
দেবতা বা দেবীর মন্দির তাও মনে নেই। তবে পুরোনো এবং বিশাল। বড় খোলা দরজা দিয়ে ঢুকেই
সামনে বড় বাঁধানো উঠোন। মাঝখানে মন্দিরের প্রধান পুরোহিত এবং অন্যান্য কয়েকজন কথা বলছেন।
ডানদিকে মন্দিরের মূল গর্ভগৃহ। আমি রাতে থাকার কথা জিজ্ঞেস করায় প্রধান পুজারী একজনকে
কিছু বললেন। সে উঠে আমাকে সঙ্গে করে বাঁপ্রান্তের শেষে একটা ঘরে নিয়ে গেল। দরজা খুলে
আলো জ্বালাতে দেখলাম আট বাই দশ ফুটের ছোট্টো ঘর। ওপাশে একটা বন্ধ জানলা। মেঝে ফাটল
ধরে ভেঙে ভেঙে গেছে। সেই মেখেতেই কম্বলটা পাতলাম আর কম্বলটা গায়ে দেওয়ার জন্য রাখলাম।
এখন আপশোস হয়। সে-সময় উন্মুক্ত নিসর্গ বাদে আর কিছুই আকর্ষণ করত
না। অমরকন্টকে এত বড় বড় পুরোনো মন্দির, গুগলে দেখি, তখন কিছুই দেখি নি। ঘুরেও তাকাই
নি। যেটায় রাত কাটালাম তার গর্ভগৃহের কাছেও গেলাম না। জানলাম না সেখানে কে অধিষ্ঠিত।
পরের সকালে ছাড়ার সময় ঘুরেও দেখলাম না চুড়োটা কোন ধাঁচের। তবু সেই মন্দিরের আর পুজারির
কাছে আমি ঋণী, অমন অসাধারণ একটা রাত উপহার দেওয়ার জন্য। অসাধারণ কেন? বলছি। আমি তো
আলো নিভিয়ে, স্যুটকেসটাকে মাথার বালিশ করে, পাতা কম্বলে শুয়ে পড়লাম। ওভারকোটটা গায়ে
চড়িয়ে নিলাম আর পায়ের জুতোটা পরেই থাকলাম, যাতে ঠাণ্ডা না লাগে।
হঠাৎ, মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেল। হাতে ঘড়ি থাকত না। কটা বাজে বুঝতে পারছি
না। একটা সিগরেট খেতে ইচ্ছে হল। বন্ধ ঘরে খেলে গন্ধটা মন্দিরে ছড়াবে তাই আলো জ্বালিয়ে
জানলাটা খুলতে গেলাম। কিছুতেই খোলে না। শেষে একটু বেশি জোর খাটাতে গিয়ে দেখি পুরোনো
কাঠের ফ্রেমটাই দেয়াল থেকে খুলে বেরিয়ে আসছে। আমার গায়ে নিশ্চয়ই এত জোর নেই যে কাল
কেউ বলবে আমিই এই জানলার ফ্রেমটা উপড়েছি। ওপড়ানো অবস্থাতেই আছে। তাই টেনে বার করে নিচে
নামিয়ে রাখলাম। বাইরে অন্ধকার। ভালো করে দেখার জন্য ঘরের আলোটা নিভিয়ে দিলাম। ঠাহর
করে দেখলাম, মন্দির সংলগ্ন জমি, জঙ্গলের মত গাছগাছালি।
লাফিয়ে নামতেই চোখে পড়ল রাতের আকাশ। এত তারা? যেন গিজগিজ করে বেড়ে
চলেছে তারাগুলোর অসংখ্যতা, আর গরম দুধে মুড়ি ঢাললে যেমন মুড়ির দানায় দুধ ঢোকার একটা
মিহি চুরমুর শব্দ ওঠে, তেমনই শব্দ উঠছে আকাশে। না, নীহারিকার মেঘ নয়, স্পষ্ট তারাই,
ছোটো-বড়ো, কিন্তু এত এত! সম্মোহিত ভাবে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ, তারপর, যে জন্য লাফিয়ে
বাইরে নেমেছিলাম, সিগরেটটা ধরালাম। চিরকাল শহরের মানুষ, জানতামই না চারদিক পুরোপুরি
অন্ধকার হলে আর আকাশ পরিষ্কার থাকলে রাতের আকাশ কেমন হয়। ঠাণ্ডায় কাঁপছিলাম। তবু ঘরে
যেতে ইচ্ছে করছিল না।
ঘুম ভাঙল দেরি করে। আপশোস হল, ভোরে উঠে সূর্যোদয় দেখতে যাওয়া হল
না। মন্দিরের উঠোনে যাকে পেলাম তাকেই সংক্ষিপ্ত একটা ধন্যবাদ জানিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেলাম।
কোনদিকে যাই? মন্দিরের আশ্রয় রাতে তারা দেখালো বটে কিন্তু পরিণামে ভোরে ওঠা আর হল না।
ডানদিকে কিছুটা হাঁটতেই হঠাৎ চোখে পড়ল একটা সরকারি রেস্টহাউজের বোর্ড। এখন আর মনে নেই
সেটা পি-ডব্ল্যু-ডি-র ছিল, না বনবিভাগ বা অন্য কিছু ছিল। রাতে
খাবারের দোকানের মহিলা হয়তো আমার চেহারা দেখে এই জায়গাটার কথা বলেন নি।
একতলা বাড়ি, মাঝখানে উঠোন রেখে চারদিকে ঘর, সবকটাই খালি। দরজা খোলা
ছিল। ভিতরে ঢুকে কেয়ারটেকারকে খুঁজে বার করলাম। বিশেষ তদ্বির করতে হল না। আট টাকায়
এক দিনের জন্য ঘর দিয়ে দিল। শর্ত একটাই, সরকারি আধিকারিক যদি আসে, সঙ্গে সঙ্গে বার
করে দেবে। বললাম, অবশ্যই। তারপর ঘরে স্যুটকেসটা রেখে একটু আরাম করলাম। হাতমুখ ধুয়ে,
দরজায় তালা লাগিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। আবার গেলাম রাতের খাবারের দোকানটায়। লেখাপড়া ছেড়ে
এসে রুটি তরকারি জল সাজিয়ে দেওয়া ছোটো মেয়েটির মুখ ভুলতে পারছিলাম না। একই সঙ্গে তার
মায়েরও, দোকান সামলানোর কর্তৃত্ব। আবার সেই রুটি তরকারি খেয়ে জিজ্ঞেস করলাম সোন আর
নর্মদার উদ্গমস্থলটা কোথায়। সকালে মন্দির থেকে বেরিয়ে যেদিকে গিয়েছিলাম, ওরা তার বিপরীত
দিকে হাত দেখিয়ে নর্মদামন্দিরের কথা বলল।
এখন জানি না কেমন হয়েছে, তখন খুবই সাধারণ একটি মন্দির ছিল নর্মদামন্দির।
এতদিন আগেকার কথা, সবকিছু মনেও নেই। যদ্দূর মনে পড়ে, মূল উৎসস্থলটা ঘিরেই গড়ে উঠেছে
মন্দির – সামনের দিকে নর্মদারই জল, সরোবরের মত, তারপর
উত্তর-পশ্চিমে ছোটো স্রোত হয়ে বেরিয়েছে। পরে কোথাও দক্ষিণ-পশ্চিম মুখো হয়েছে নিশ্চয়ই।
কিন্তু উৎস থেকে বেরিয়ে অনেক দূর অব্দি তার গতি উত্তর-পশ্চিম ছিল। আর সেই একই উৎস থেকে
একটি অত্যন্ত ক্ষীণ ধারা মন্দিরের পিছন দিকে বেরিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব কোণে কিছুদূর গেছে,
তারপর হঠাৎ পেয়েছে পাহাড়ের খাড়া উতরাই। একদম খাড়া।
ন্যাড়া পাথরের চাতাল। কোনো উদ্ভিদ নেই। মাঝখান দিয়ে বয়ে যাওয়া জলধারা
এত ক্ষীণ যে আশপাশের পাথরে কোনো পিচ্ছিলতাও নেই। তবু খাড়া উতরাইয়ের কিনারে গিয়ে নিচে
দেখার সাহস হল না। আরেকটা উদ্দেশ্যও ছিল। আমি উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লাম। ঘষটে ঘষটে এগিয়ে
কিনারে মাথাটা এগিয়ে নিচে তাকালাম। অন্ধকারে বিশেষ চোখ যায় না তবে অনেক নিচ অব্দি গেছে
ক্ষীণ কিন্তু খাড়া জলপ্রপাত। তারপর সোঁতা হয়ে জঙ্গলে এগিয়েছে। পথে বিভিন্ন জায়গায় অন্যান্য
উপনদীর জল নিয়ে বলীয়ান হয়ে শেষে বিহারের কোইলোয়ারে বিশাল বক্ষ নিয়ে মিশেছে গঙ্গায়।
বাঁদিকে ঘষটে গিয়ে ঠিক সেখানে ঠোঁট লাগালাম যেখানে জলটা নামছে। ঢোঁকে
ঢোঁকে জল খেলাম – আমাদের সোন নদীর উৎসের জল। এই নদীরই ক্যানালের
জল দেড় বছর আগে পাটনায় আমাদের ঘরদোর ডুবিয়েছিল। এমন নয় যে জলে দারুণ কিছু স্বাদ পেলাম,
কিন্তু মনটা ভরে গেল ওভাবে জল খেয়ে। একটা দৈহিক বোধ ছিল যেন। নিজের নদীকে বিভুঁয়ে নিজের
আশ্লেষে পাওয়ার। সেভাবেই ঘষটে ঘষটে পিছিয়ে এসে উঠে দাঁড়ালাম। গায়ের ধুলো ঝেড়ে মন্দিরের
সামনে রাস্তায় চলে এলাম।
এবার নর্মদার পথ ধরে এগোনো রাস্তায়। কোথাও তো স্রোতটাকে নিজের মত
করে পাবো। যে রেস্টহাউজে উঠেছিলাম তার পাশ দিয়েই এগোতে থাকলাম। ডানদিকে ঢালু ঘাসে ভরা
চড়াই, দীর্ঘ গাছের সারিতে ভরা। বাঁদিকে উতরাই তবে ভাঙাচোরা, কেননা মাঝেমধ্যে বসতি আছে।
আর তারই পিছন দিয়ে নর্মদা এগিয়েছে। অনেকটা দূর যাওয়ার পর পেলাম – একটা ছোট্ট খাড়া উতরাইয়ে জল নিচে নেমে পুকুরের মত ছড়িয়েছে, তারপর
আবার এগিয়েছে। লাফিয়ে লাফিয়ে কাছে গিয়ে পৌঁছোলাম। জলের গভীরতা জানি না, আর সাঁতারও
জানি না। তাই স্নান করতে সাহস হল না।
দেখলাম জল যে খাড়া পাথরের ওপর থেকে নামছে, সে পাথরের মাঝামাঝি একটা
গুহা আছে, জলের দেয়ালের ভিতর দিয়ে দেখা যাচ্ছে সেটা কোনো সাধুর বাসস্থান। সাধু নেই,
তবে একটা শিবলিঙ্গ বোধহয়, কিছু ফুল, পাশে কাপড়ের টুকরো ইত্যাদির অস্তিত্ব বোঝা যাচ্ছে।
এর বেশি আর মনে নেই। ঐ গুহায় নিশ্চয়ই যাই নি। কিন্তু ঐ ধরণের গুহা, লোকস্মৃতির এত পরিচিত
একটি দৃশ্য যে মনে হয় গিয়েছিলাম, জলের দেয়ালে চোখ রেখে এদিকের পৃথিবীটাকে দেখেছিলাম।
নিচের নেমে আসা জলে হাত মুখ ঘাড় ধুয়ে চলে এলাম।
বিপরীত দিকের চড়াইয়ে উঠে ওভারকোটটা ঘাসে নামিয়ে রাখলাম। স্নান করার
ইচ্ছেটা পুষিয়ে নিতে জামাকাপড় খুলে ঘাসে শুয়ে পড়লাম, পিঠ, বুক ঘসলাম। ঠাণ্ডা হাওয়ায়
শিরশির করছিল গা। জুতো খুলে পায়েও ঠাণ্ডা হাওয়া লাগালাম। ছায়া ছায়া পুরোটা জায়গা, রোদ্দুর
পেতে আরো ওপরে যেতে হবে। আধঘন্টা পর জামাকাপড় গায়ে চড়িয়ে রোদ্দুরের দিকে এগোলাম। ওই
পথেই ফিরলাম রেস্টহাউজে।
সন্ধ্যায় আবার সেই একই দোকানে রুটি তরকারি খেয়ে ফিরে এসে দেখি একটা
ঘরে আলো জ্বলছে, কেউ এসেছে। কেয়ারটেকারকে জিজ্ঞেস করলাম, কী, বার করে দেবে নাকি? সে
মুচকি হেসে আশ্বস্ত করল। কিছুক্ষণ ডাইরিতে আঁকিবুকি করে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লাম। যদি
মাঝরাতে বেরিয়েও যেতে হয় এই শীতে, যতক্ষণ পারা যায় ঘুমিয়ে নেওয়া ভালো। এমনিতেও ভোর
চারটেয় ঘুম ভাঙা টার্গেট।
ঠিক সময়ে ঘুম ভেঙে গেল। ওভারকোট, বেরে টুপি, মাফলার, জুতো ইত্যাদিতে
সজ্জিত হয়ে ওপরের চড়াইয়ে শালবনের দিকে ছুটলাম। ঠিক মত আলো ফোটে নি তখনো, তবে একটা আভা
ছড়িয়ে পড়ছে। এটাই রবীনদার বলা ট্র্যাক। তাই আভায় যখন ঘাসের ওপর একটা পাখির দেখা পেলাম,
সেটা কি আর টিট্টিভ না হয়ে আর কিছু হতে পারে? টিট্টিভ দেখার প্রসন্নতা বুকে নিয়েই এবার
দৌড়োনো শুরু করলাম। শালবনের ভিতরে এক চড়াই ঢালু হয়ে নেমে আবার চড়াই শুরু হল। আবার ঢালু
হয়ে নেমে আবার চড়াই শুরু হল। এভাবেই শেষ প্রান্তে পৌঁছে থমকে দাঁড়ালাম।
সামনে প্রসারিত আদিগন্ত স্থির কালো ঢেউ। তারপর দেদীপ্যমান পীত স্বর্ণাভ
আকাশ। কিছুক্ষণ সময় লাগল বুঝতে, আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেটা সাতপুরা পাহাড়শ্রেণীর
পূর্বপ্রান্তের শেষ উঁচু চুড়ো, এবং সেটাই অমরকন্টক অধিত্যকা। এর পর শুরু বিন্ধ্য পাহাড়শ্রেণী
যেটি বিহারের দক্ষিণ প্রান্ত (এখন ঝাড়খণ্ড) অব্দি চলে গেছে। আমার দৃষ্টিক্ষেত্রে, নিচে
সমুদ্রের কালো ঢেউয়ের প্রসার আসলে বিন্ধ্য শ্রেণী। ভাবতে ভাবতেই, রঙবদলে কোনো জানান
না দিয়ে লাফিয়ে উঁকি দিল চোখধাঁধানো সাদা সূর্য্য।
প্রথম প্রথম আশাহত করে। কত রকম রঙের খেলা দেখব ভাবি। সূর্য্য প্রায়
ঔজ্জল্যহীন লাল থালার মত উঠবে! সবই তো দৃষ্টিপথে ধুলো আর মেঘের খেলা। এখানে এখন মেঘ
নেই। অরণ্য-আবরিত পাহাড়শ্রেণীর ওপর ধুলোর আস্তরণ থাকার প্রশ্ন নেই। তাই এমন সূর্যোদয়!
… আশেপাশে একটু বসার মত পাথর ছিল না। তাই দাঁড়িয়েই
রইলাম। সিগরেট খেলাম একটা। গাছে পাখির আওয়াজ পাচ্ছিলাম কিন্তু বন্য কোনো পশুর আভাস
পাইনি। একটু আগে দৌড়ে আসার পথেও পাই নি। হয়তো এই শালবনে মানুষের বসতিও আছে। দেখতে পাই
নি। ওই নির্জনতায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ফিরে গেলাম। চিৎকার করে কোনো গান গেয়েছিলাম কি?
যা ছোটোবেলা থেকে আমার অভ্যাস? মনে নেই।
ফিরে, স্নান করে, কেয়ারটেকারকে পয়সা দিয়ে ওই একই দোকানে শেষ বার
খাবার খেলাম। তারপর চলে গেলাম বাসস্ট্যান্ডে। ভূপাল কিভাবে যাবো জিজ্ঞেস করে, যদ্দূর
মনে পড়ে, শাহডোলের বাস ধরলাম। নাকি অনুপপুরের বাস ধরলাম? ট্রেনটা কোন স্টেশন থেকে ধরলাম?
মনে নেই। আজ গুগল বলছে, অনুপপুর কাছে, অনুপপুর থেকে ভূপাল হয়ে ইন্দোর যাওয়ার ট্রেন
আমি ধরেওছি পরে, কিন্তু সেই সফরে আমার মাথায় শাহডোল নামটা গেঁথে আছে। হয়তো শাহডোলের
বাস ধরে মাঝপথে অনুপপুরে নেমে গিয়েছিলাম। কে জানে!
তবে, কোনো সুপারফাস্ট ট্রেন তখন ছিল কিনা জানি না, একটা ধীরগতি ট্রেন
ধরেছিলাম। কেননা দুপুরে ধরলেও, ট্রেনটা ভূপাল পৌঁছেছিল পরের দিন সকালে। বেশি রাতে গাডরওয়ারা
স্টেশনে আমাদের অন্ধকার কম্পার্টমেন্টে একটি সরলমতি, মিশুকে অন্ধ মেয়ে চড়েছিল এবং আমার
সামনের সিটে জানলার ধারে তাকে বসার জায়গা করে দিয়েছিল সহযাত্রীরা – এ-প্রসঙ্গটা ব্যবহার করে একটা স্কেচ লিখেছিলাম পরে। সেটা আর ছাপতে
দিই নি।
ভূপাল (হ্যাঁ ভূপাল, হবিবগঞ্জ বা কমলাপতি নয়) জাংশনে নেমে একটু এগোতেই
একটা হোটেলে থাকার জায়গা পেয়ে গেলাম; দোতলায় ঘর। সাড়ে সাত বছর পর ভূপাল গ্যাস দুর্ঘটনার
পর থেকে বার বার ওই ঘরটার কথা মনে পড়ে। সেসময় কে ছিল ঐ ঘরটায়? জাংশন স্টেশনটাই যখন
বিষাক্ত গ্যাসে কবলে চলে গিয়েছিল, ঐ হোটেলে কারোর বেঁচে থাকার কথা নয়। … চোখমুখ ধুয়ে, নিচে গিয়ে চা খেয়ে, দুটো সিগরেট ফুঁকে বেগ এল। আজ
স্মার্টলি যাওয়া জরুরি। কবি মঙ্গলেশ ডবরালের সঙ্গে দেখা হবে। কবিতা শোনাতে জবে! পায়খানা,
স্নান সেরে, জামাকাপড় বদলে নেমে রাস্তায় হাঁটা দিলাম।
যদিও মধ্যপ্রদেশে জনপ্রিয় স্ট্রিটফুড পোহা, তবে তখনও অব্দি পোহা
খাই নি। মায়ের ‘চিঁড়ের পোলাও’ বা ‘চিলাও’এরই স্বাদ জিভে ছিল। সেদিনও যদ্দূর মনে হয় পোহা খাই নি। পোহার স্বাদ
প্রথম নিয়েছিলাম ইন্দোরে, চুরাশির ডিসেম্বরে। সে আরেক সফর। কোথাও কোনো রেস্টুরেন্টে
পরিচিত পুড়ি-সব্জি খেয়ে একে ওকে জিজ্ঞেস করে হ্রদ বা ঝিলের দিকে হাঁটা দিলাম। ঝিল বা
তাল। লোকোক্তি আছে, ‘তাল মে তাল, ভূপাল
কা তাল’। আলোকজি বলেছিলেন, ভারতভবন ঝিলেরই ধারে। একবার
ঝিলে পৌঁছে গেলে, ঠিক নজর ঘুরিয়ে চিনে নেব। বা দরকার পড়লে আরেকবার জিজ্ঞেস করব। আগে
ঝিলে তো পৌঁছোই।
যে চওড়া পিচঢালা রাস্তাটা ধরে যাচ্ছিলাম তার বাঁদিকে পর পর বাগানে
ঘেরা বড় সব হাতা। ভিতরে কী আছে বুঝতে পারছিলাম না। হঠাৎ একটা পাঁচিলহীন বাগানের ওপারে
বিশাল জলরাশি চিকচিক করে উঠল। ওই তো ঝিল! কিন্তু গেটে তালা লাগানো। এরকম দু’একটার পর একটা খোলা গেট পেয়ে ঢুকে পড়লাম। এক বৃদ্ধ, নিরস্ত্র রক্ষক
বা কেয়ারটেকার এগিয়ে এলেন। “কোথায় যেতে চান?” “ভাইজি, ঝিলটা দেখতে
যাবো। যদি কোনো অনুমতি নেওয়ার ব্যাপার থাকে তো বলুন!” “না, যান!”
‘যান’, বলেও মানুষটি আমার সঙ্গে সঙ্গে চলতে থাকলেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম,
“এত সব বাগান কার?” বললেন, “বড় বড় রইস লোকেরা
ঝিলের চারদিকে জমি কিনে রেখে দিয়েছে। কখনো কিছু করবে। আগেও গাছই ছিল। সেগুলো এখন যার
যার বাগানের সম্পত্তি। কিছু নতুন গাছও লাগানো হয়েছে।” জিজ্ঞেস করলাম, “তা, এই বাগানটা
কার? তিনি বললেন, “ক্রিকেট খেলেন পটৌদির এক নবাব, জানেন?” “হ্যাঁ, হ্যাঁ, জানব
না কেন?” আমি বললাম, “মনসুর আলি খান পটৌদি।” রক্ষক বললেন,
“তাঁরই বেগম সাহিবার এই বাগান।” ভিরমি খাওয়ার জোগাড়। “শর্মিলা টেগোর?” “হ্যাঁ বোধহয়, উনি
তো ফিল্মে কাজ করেন?” “হ্যাঁ” বলে পাশের নতুন
বড় হওয়া ঝোপের মত গাছটার পাতা ছুঁলাম। সত্যি হোক বা না হোক, শর্মিলার নাম শুনে রোমাঞ্চিত
কে না হত?
কিছুটা দূর যাওয়ার পর রক্ষক বিদায় নিলেন। আমি ঝিলের ধারে পৌঁছোলাম।
ওই তো, ওপর দিকে সুন্দর, নতুন, অভিনব ছাঁদের বাড়িটা। ওটাই হবে ভারতভবন। আগেই রাস্তা
ছেড়ে ওদিকে চলে যেতে পারতাম। কিন্তু তাহলে আর শর্মিলার বাগানে হাঁটার রোমাঞ্চটা পেতাম
না। হেঁটে হেঁটে উঠলাম। সত্যিই ভারতভবন কমপ্লেক্স ছিল সেটা। ভিতরে গিয়ে মঙ্গলেশজির
চেম্বার খুঁজে বার করলাম। নিজের পরিচয় দিলাম। খুব আপনভাবে বসালেন। সামনে বসা যাঁর সঙ্গে
কথা বলছিলেন, তাঁর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন। গিরিধর রাঠি, হিন্দির আরেকজন সমসাময়িক কবি।
নাম শুনেছিলাম আলোকজির মুখে বা কোনো পত্রিকায় পড়েছিলাম। কিছুক্ষণ পর এক কমবয়সি সুদর্শনা
এসে মঙ্গলেশজিকে কোনো চিঠির খসড়া পড়িয়ে মঞ্জুর করিয়ে নিয়ে গেল।
গিরিধর রাঠিকে বিদায় জানিয়ে মঙ্গলেশজি বাইরে বেরিয়ে এলেন। ঝিলের
ধারে আমার আসার পথটি ধরেই চলতে চলতে পাটনার খবর, আলোক ধন্বার খবর, তাঁর অন্য বাঙালি
কবিবন্ধু দীপন মিত্রর খবর, বিহারবাসী অন্যান্য হিন্দি কবিদের খবর জিজ্ঞেস করতে লাগলেন।
আমি কী লিখি তাও জিজ্ঞেস করতে লাগলেন। অথচ একবারও জীবনানন্দ দাশের কথা জিজ্ঞেস করছেন
না। যাঃ, আমার মুখস্থ করার পরিশ্রমটা বৃথা যাবে। এই এখনও, ঝিলের জল দেখতে দেখতে কবিতাটা
মনে মনে আউড়েছি। শেষে আমিই কথার মাঝখানে দুম করে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি বাংলা কবিতায়
জীবনানন্দ দাশকে পড়েছেন? “হ্যাঁ, কিছু কিছু
পড়ে শুনিয়েছে কেউ না কেউ। আলোকও খুব নাম নেয় ওনার। খুব বেশি পড়ি নি।”
এই তো লাইনে এনে ফেললাম। বাংলা কবিতায় জীবনানন্দের স্থান, নতুন যুগবোধ,
কাব্যভাষা, মেজাজ ইত্যাদি নিয়ে ভূমিকা ফেঁদে, বনলতা সেন, আট বছর আগের এক দিন, কুড়ি
বছর পর, অবসরের গান, চিল ইত্যাদি মনে থাকা কয়েকটি কবিতার নাম আউড়ে শুরু করলাম, “এই যেমন …”। গড় গড় করে মুখস্থ
বলে গেলাম “আবার আকাশে অন্ধকার নিবিড় হয়ে উঠেছে/ আলোর
রহস্যময়ী সহোদরার মত এই অন্ধকার …।” “অনেক কমলা রঙের রোদ
ছিল” বলার সময় বুকটা ঢিপ ঢিপ করছিল। তার পরেরটুকুই
বার বার ভুলে যাচ্ছিলাম ট্রেনে, বাসে, হোটেলে, অমরকন্টকের রাস্তায়। যাহোক, উৎরে গেলাম।
শেষ করলাম “তোমার নগ্ননির্জন হাত” বলে।
মঙ্গলেশ কী ভাবলেন জানি না। কবিতা নিয়ে নয়, আমার শোনাবার ব্যগ্রতা
নিয়ে, সেটাই ভাবছিলাম। আরো কিছুক্ষণ কথা হল। খাওয়াদাওয়ার কথা জিজ্ঞেস করায় না বলে দিলাম।
ফিরে গিয়ে ওনার চেম্বারে বসে চা খেয়ে বিদায় নিলাম। ভূপালে আর থাকার কোনো মানে হয় না।
কোথাও যাওয়া যাক। ফিরে হোটেলে জিজ্ঞেস করলাম। বলল, সাঁচি ঘুরে আসুন। নামটা তো জানতামই।
সাঁচিতেই রাত কাটাবো ভেবে, হোটেল ছেড়ে বাসস্ট্যান্ডে সাঁচির বাস ধরলাম। এক ঘন্টার রাস্তা।
ছুটির দিন নয়, তাই লোকজন বলতে নেই। অনেকক্ষণ ঘুরে ঘুরে দেখলাম সাঁচি স্তূপ, সেই পরিসরে
অন্যান্য নির্মাণের অবশিষ্টগুলো।
দেখতে দেখতে অত্যন্ত মূর্খ ও অহংকারী মনে হচ্ছিল নিজেকে। এসব জায়গায়
একজন গাইড থাকা একান্ত দরকার। সে হয়তো ভুলই কিছু বলবে, কিন্তু কিছু দেখার, ভাবার একটা
ভাবনা-পরিসর সৃজন করবে। আর নয়তো নিজেই ইতিহাস এবং পুরাতত্ত্ববিদ হও। দুটোর কোনোটাই
আমি নই। স্তম্ভের অলংকরণে ফুলপাতা, নারীমূর্তির ভঙ্গিমা বা বোধিসত্ত্বের প্রতিমা দেখে
ইতিহাসবোধহীন মনে বাঃ বাঃ করা কি যে আহাম্মকী। আর সত্যিই, মূল স্তূপ, প্রবেশদ্বার ইত্যাদির
চেয়ে আমায় বেশি আকর্ষণ করল স্তূপের বাঁদিকে একটি নির্মাণ, পুরাতত্ত্ব বিভাগের লাগানো
ফলকে কী লেখা ছিল মনে নেই। স্তম্ভগুলো চৌকো, অলঙ্করণহীন এবং একটু ভিন্ন। বেশি এলেগ্যান্ট
মনে হল আমার। মূল স্তূপটার একবার পরিক্রমা করার পর সেখানে গিয়েই বসে রইলাম কিছুক্ষণ।
তবে যা দেখছিলাম, আশেপাশে থাকার জায়গা বলে কিছু চোখে পড়ছিল না। দূরে
কোথাও সরকারি অতিথি আবাস-টাবাস বলে যদি কিছু থাকেও সেখানে প্রবেশ পাবো না। সন্ধ্যে
নামার আগেই বেরিয়ে যেতে হবে। বাসস্ট্যান্ডে যেতে যেতেই শুনলাম কোনো বাস চ্যাঁচাচ্ছে
‘বিদিশা’ ‘বিদিশা’। বাঃ ‘চুল তার কবেকার অন্ধকার
বিদিশার নিশা’র সেই বিদিশা! যেতেই হবে। ওখানেই যাবো। বাসে
চেপে গেলাম। আরে! একদম কাছে। লোকিছকাল বাস। থামতে থামতেও আধঘন্টা-চল্লিশ মিনিটে পৌঁছে
দিল। একটা হোটেলে ঢুকলাম। বাজে ঘিঞ্জি হোটেল। ঘরে ঘরে জুয়াড়িদের আড্ডা। ছোট্টো, অপরিষ্কার
শহর। … কী খেলাম, কোথায় খেলাম মনে নেই। হোটেলের কামরা
বন্ধ করে তাড়াতাড়িই ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরের দিন ভোরে নিচে নেমে হোটেলের কাউন্টারে জিজ্ঞেস করে জানলাম চার-পাঁচ
মাইলের মধ্যে একটা কোনো পুরাতাত্ত্বিক স্থান আছে, উদয়গিরি গুহা। সেদিকে হাঁটা দিলাম।
গিয়ে দেখতে দেখতে সেই একই লজ্জার ভাব মনে এল। সাঁচি স্তূপ পরিসরের তো একটা দৃষ্টিনন্দন
মহনীয়তা আছে। কিছু বুঝি না বুঝি রীতিমত সমীহ জাগে। বিদিশার উদয়গিরি গুহা পুরোপুরি পুরাতত্ত্বের
ছাত্রদের জন্য। কিছুক্ষণ ঘুরে দেখে ফেরার পথ ধরলাম। দুদিকে প্রান্তর। হঠাৎ রাস্তার
ডানদিকে দেখি মেলা বসেছে। চারটে বা ছ’টা ব্যাডমিন্টন
কোর্টের মত জায়গা কানাত দিয়ে ঘিরে দোকানপাট সাজানো হয়েছে।
দৃশ্যত অপূর্ব যে বৈশিষ্ট্য, তা হল, সবকয়টি দোকান একই জিনিষের – চাকা। ছোটো চাকা, বড় চাকা, রঙিন চাকা, কাঁচা-কাঠরঙা চাকা, লোহার
পাত বসানো চাকা, টায়ারওয়ালা চাকা, ঠেলার চাকা, টাঙার চাকা, গরুর গাড়ির চাকা …। মাঝে মধ্যে দু’একটা চাকা
মেরামতের দোকান। অর্থাৎ, সব মিলিয়ে চাকার বাজার বা চাকার মেলা। প্রাচীন সমাজের জন্য
খুবই প্রয়োজনীয় কিন্তু কখনো চিন্তা করি নি এ বিষয়ে। আর দেখলাম তো এই প্রথম। দেখেই মনে
হল অবিস্মরণীয়! … আমার কোনো চাকা কেনার ছিল না। তাই চেরা কাঠ
আর রঙ আর লোহার গন্ধ বুকে নিয়ে এগিয়ে গেলাম।
দু’পা এগোতেই ছিপছিপে
চেহারার এক বয়স্ক মানুষ আমার পথ আটকালো। কোত্থেকে আসছেন, কোথায় উঠেছেন ইত্যাকার দ্রুত
প্রশ্নবাণের সম্মুখীন হতেই সতর্ক হলাম। লোকটা নিশ্চয়ই ইন্টেলিজেন্সের লোক। কী সন্দেহ
করল জানি না, রীতিমত হুমকি দিল একদিনের মধ্যে বিদিশা ছেড়ে যাওয়ার জন্য। রাগ হয়েছিল।
বলতেও পারতাম যাবো না। ফের ভাবলাম থেকেই বা করব কী? বিদিশা তো এই। রাতে হোটেলের কামরায়
ঘুম না আসা অব্দি বিদিশার নিশা বলতে জুয়াড়িদের হাল্লা শুনতে হবে। হোটেলে গিয়ে, পয়সা
মিটিয়ে তখনি স্টেশনে গেলাম। কী আশ্চর্য! কিছুক্ষণের মধ্যে আসছে বম্বের ট্রেন। কখনো
যাই নি। ঘুরে আসা যাক।
পরের দিন সকালে ট্রেন পৌঁছে দিল ঐতিহাসিক ভিক্টোরিয়া টার্মিনাসে।
বাইরে বেরিয়ে, যেদিকে হোটেলের সন্ধান নিয়ে যায় ভেবে এগোলাম। পৌঁছে গেলাম ফোর্ট এলাকায়।
বম্বে বা এখনকার মুম্বাই কখনো যাই নি, কিন্তু সিনেমায় এত দেখেছি এসব এলাকা যে একেবারেই
অপরিচিত লাগছিল না। একটা হোটেলে জায়গা পেলাম। টিপিক্যালি বম্বেরই মত জায়গা। তিনতলা
হোটেলবাড়ির চারতলার চিলেকোঠায়, অর্থাৎ সিঁড়ির পাশে একটা বিছানা এবং একটা কাবার্ড। কামরা
নয়, তাই দরজা নেই, তালাচাবির কোনো ব্যাপার নেই। কাবার্ডের তালাচাবি পাবে, তাতেই জিনিষপত্র
রেখে যেখানে যেতে হয় যাও। ভাড়া চোদ্দ টাকা। বাথরুম পায়খানা একতলা নিচে নেমে, তিন তলায়।
নিয়ে নিলাম। সিঁড়ির দরজাটাই আমার দরজা, বিছানার সামনে। খোলা ছিল।
বেরিয়ে, চোখেমুখে লাগতে থাকা ভেজা কাপড় সরিয়ে ছাতের প্রান্তে পৌঁছোলাম। রেলিংএ হাত
দিয়ে নিচে তাকাতেই চমকে উঠলাম। অভাবনীয়! ডকইয়ার্ড। ভিক্টোরিয়া গোদি। সামনে আরব সাগরে
জাহাজ দাঁড়িয়ে আর নিচে কন্টেনারের পর কন্টেনারের সারি। গোদি মজুরেরা কাজ করছে। ক্রেন
নামছে কন্টেনার ওঠাতে …। পুরো চোদ্দ টাকা
ওই এক লহমায় উশুল হয়ে গেল। সিগরেটের ধোঁয়া ওড়ালাম, ফাউ! বিছানায় ফিরে পরিতৃপ্তিতে চোখ
বন্ধ করলাম।
একটু বেলায় নিচে নেমে খুঁজে বার করলাম নিজের ব্যাঙ্ক, ফোর্ট ব্রাঞ্চ।
ড্রাফটটা ভাঙাতে গিয়ে আমারই বয়সী একটি মারাঠি ছেলের সঙ্গে আলাপ হল। একসঙ্গে বাইরে একটা
রেস্টুরেন্টে গেলাম। জিজ্ঞেস করল কী খাবো। বললাম, ভাই শ্রীখন্ডের বহুত নাম শুনেছি,
খাওয়াও। শ্রীখন্ড খাওয়ালো। তারপর তাকে বিদায় জানিয়ে মেরিন ড্রাইভের দিকে হাঁটা দিলাম।
সারা দিন কেটে গেল ওদিকেই, সমুদ্রের আর সীগালের শব্দ শুনতে শুনতে। সমুদ্র তো আগেও দেখেছি
সাইকেল ট্যুরের সময়, পুরী, বিশাখাপতনম, ম্যাড্রাসে, পন্ডিচেরিতে। বঙ্গোপসাগর। আর কন্যাকুমারিতে
তিন সমুদ্রের সঙ্গম। কিন্তু বম্বের মেরিন ড্রাইভ, শুধু আরব সাগর বলে নয়, সাদা-কালো
সিনেমার যুগে হিন্দি প্রদেশে বড় হওয়া আমাদের জাতিস্মৃতি।
কত গান, কত রাত, কত উৎসব, কত একাকীত্ব, নিঃস্বতা, কত ঘুরে দাঁড়ানো
কোনো না কোনো নায়কের ভূমিকায়! এমনকি জলের ঢেউ ভাঙার জন্য বিছিয়ে রাখা ওই কংক্রিটের
বিচিত্র ত্রিমুখী টেট্রাপডগুলো (টেট্রাপড শব্দটা এদিকে জেনেছি)! যদিও হদ্দ নোংরা, তবু
চওড়া পায়েচলা পথের পর সেই বিখ্যাত পাঁচিল-সহ-বসার জায়গা টপকে ওগুলোর ওপর গিয়ে বসা যায়।
আরো নেমে জলও ছুঁয়ে আসা যায়। অনেকক্ষণ বসে, একবার নরিম্যান পয়েন্ট অব্দি গিয়ে, ফের
উল্টো দিকে চৌপাটি ছুঁয়ে, কিছু খেয়ে ব্যান্ডস্ট্যান্ড অব্দি গেলাম। সন্ধ্যে হয়ে গিয়েছিল।
রাস্তা পার করে ঢুকলাম মালাবার হিলসে ওঠার রাস্তায়।
শুধু জায়গাগুলো দেখছিলাম। তাই বড় বড় বাংলোগুলোর গেটে লাগানো নেমপ্লেট
পড়ার কোনো ইচ্ছে ছিল না। কিছুটা গিয়ে একটা পার্ক দেখলাম। ঢুকে শেষ প্রান্তে গিয়ে দেখি
চোখের সামনে আলোয় আলোয় ঝলসে উঠল সারা দুপুর, বিকেল ধরে হেঁটে চলে বেড়ানো রাস্তাটা,
এই রূপটার জন্যই নাম, কুইন্স নেকলেস! … কিছুক্ষণ
বসলাম একটা বেঞ্চে। নামার সময় মাঝপথে একটা ভাতের হোটেল পেলাম। না, দোকানঘর বোঝা যায়
না। বোধহয় কোনো সরকারি অফিসের পরিসর। তার কর্মচারিদের জন্য খাবারের দোকান, পরিসরের
দেয়াল ঘেঁষে। আর রাতের জন্য সেই দোকানের একটা অতিরিক্ত দরজা পাঁচিল কেটে তৈরি করা।
যুক্তিও আছে। দোকানের মালিক, অফিসের বড়বাবুকে বলতেই পারে, রোজকার আনাজপাতি আনতে অতটা
ঘুরে যাবো? পোষাবে?
একেবারে বিহারি জুগাড়। আর সত্যিই, ভিতরে ঢুকে দেখলাম বিহারি দোকান।
দুটাকায় ডাল, ভাত, সব্জি। একবারে রাতের খাওয়া সেরে আবার হেঁটে হেঁটে ফোর্ট। চিলেকোঠা।
রাতের ডকইয়ার্ড! … হোটেলের রাস্তাটায় ঢুকবার আগে ভিক্টোরিয়া
টার্মিনাসের সামনের বড়রাস্তাটার ফুটপাথ ধরে হাঁটছিলাম। ফুটপাথ মানে ঢাকা ফুটপাথ। দিল্লির
কনট সার্কাসের মত। দুটো দৃশ্য মনে আছে। বম্বে মহানগরেই দৃশ্যদুটো সম্ভব। ওপারে চোখ
পড়ল। বন্ধ সেন্ট্রাল লাইব্রেরির বিশাল রাজসিক সিঁড়ি ওপরে উঠে গেছে। অথচ কেউ বসে নেই।
কত পড়ুয়া ও প্রেমিকের বসে থাকার কথা ছিল! আলোআঁধারি থাকার কথা ছিল। দ্বিতীয় দৃশ্য ফুটপাথেই
দেখলাম, পায়ের কাছে। দামি কোট, প্যান্ট এবং পার্সি টুপি পরা একজন, হাতের নতুন দামি
স্যুটকেস মাথায় দিয়ে চাদর পেতে শুয়ে পড়ছেন। ফুটপাথেই রাত কাটাবেন।
পরের দিন কোথায় কোথায় গেলাম মনে নেই। তবে একজায়গায় বীভৎস নোংরা,
পায়খানায় ভরা একটা সিঁড়ি ধরে সমুদ্রের তীর থেকে ওপরে উঠে আসতে হল।… বস্তুতঃ বম্বের ওই দিকটা দেখার জন্যই বেরিয়েছিলাম, কিন্তু কোথায়
গিয়েছিলাম, মনে নেই। বিকেলে ভাবলাম গোয়া যাওয়া যাক। স্টেশনে এসে ধরলাম সহ্যাদ্রি এক্সপ্রেস।
মিরজ অব্দি। ভাগ্যিস তখন জানতাম না যে গোয়া যাওয়ার বাসও আছে, জাহাজও আছে। না জানার
জন্য যে কিছু অসাধারণ অভিজ্ঞতা হল, সেসব তো যথাস্থানে আসবে। তাৎক্ষণিক অভিজ্ঞতা হলঃ
ট্রেনও যে ডবলডেকার হয়, প্রথম দেখলাম। বম্বে-পুনা বা মুম্বই-পূণে। এখন আবার চল হয়েছে,
পূর্বাঞ্চলেও শুনছি আনবে সরকার; যদিও সে ট্রেন নিশ্চয়ই উচ্চতায় খাটো হবে। এখন তো সব
লাইনই ইলেক্ট্রিক। মুম্বই-পূণে লাইনেও ডবলডেকার আছে কিনা জানি না। যে ট্রেনে চড়লাম,
সহ্যাদ্রি এক্সপ্রেস, সেটাও কোভিডের পর বন্ধ হয়ে গেছে।
দুপুরে পৌঁছোলাম মিরজ। স্টেশনেই রইলাম। আর বিকেলে ধরলাম ভাস্কো-ডি-গামা
বা সংক্ষেপে ভাস্কোর ট্রেন। জানলার ধারে বসার জায়গা পেয়ে গেলাম। আমার সামনের জানলার
ধারে বসেছিলেন এক সর্দারজি। তখনকার দিনে ট্রেনে সিগরেট খাওয়া বন্ধ হয় নি। অনেকক্ষণ
ধরে উসখুস করছি। সর্দারজির নাকের ডগায় সিগরেট ধরাবো? … শেষে জানলার দিকে মুখ করে ধরালাম। হাতে আড়াল করে ধুঁয়ো ছাড়ছি যাতে
জানলা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে যায়। হঠাৎ দেখি সর্দারজি বলছেন, “দিন তো আপনার সিগরেটের প্যাকেটটা!” হয়ে গেল। নির্ঘাত ছুঁড়ে ফেলে দেবেন বাইরে। আঙুলের সিগরেটটা তক্ষুনি
ফেলে, নিভিয়ে, পকেট থেকে প্যাকেটটা বার করে এগিয়ে দেলাম। ও মা! উনি দিব্যি একটা সিগরেট
বার করে ঠোঁটে নিলেন আর দেশলাই চাইলেন। আশেপাশের বাকি সবাইও সন্ত্রস্ত ও হতবাক। আমাকে
শাস্তি দেওয়ার কোনো ইমোশনাল চাল নয়তো?
দেশলাই এগিয়ে দিতে উনি দিব্যি সিগরেট ধরিয়ে জোরে জোরে সুখটান দিতে
লাগলেন। দু’বার দেওয়ার পর বললেন, “নাঃ, জুত হচ্ছে না। আরেকটা দেখি!” সবাইকে হতভম্ব করে আমার প্যাকেট থেকে আরেকটা সিগরেট নিয়ে ধরালেন।
দু-দুখানা চারমিনার, একসঙ্গে ঠোঁটে দিয়ে জোরালো
সুখটান দিচ্ছেন সর্দারজি। পুরোটা খাওয়া হলে, মেঝেতে ফেলে জুতো দিয়ে পিষে নিভিয়ে বললেন,
“আর্মিতে থাকার সময়েই বদভ্যাসটা হয়ে গিয়েছিল।
বাড়ি ফিরলে পর সমস্যা হত। পকেটে গুড় নিয়ে বেরিয়ে যেতাম। দোকান থেকে কিনে, ক্ষেতের ভিতরে
বসে খেয়ে, কুলকুচো করে, গুড় মুখে দিয়ে বাড়ি ফিরতাম। … অনেক দিন পরে খেলাম!” বললাম, “কিন্তু সর্দারজি আপনাদের তো মানা!” সংক্ষিপ্ত উত্তর, “হ্যাঁ, কিন্তু
অনেকেই খায়।”
ভোরবেলায় কেউ যেন চেঁচিয়ে বলল, “দুধসাগর আসছে। জলের ছিটে পড়বে!” কথাটার তাৎপর্য না বুঝে বসে রয়ে গেলাম। দৌড়ে ডান দিকের গেটের কাছে
গেলে দেখতে পেতাম পাহাড়ের চুড়ো থেকে গা বেয়ে দুধের মত নেমে আসা জলপ্রপাতের ধারা। চৈতন্য
হল যখন পেরোচ্ছি। ভালোরকম জলের ছিটে জানলা দিয়ে ঢুকে ভিজিয়ে দিতে লাগল সবাইকে। তখন
দৌড়ে গিয়ে ডানদিকে ওপরে তাকালাম। দুধসাগর ততক্ষণে পিছনে চলে গেছে। তবুও দেখতে পেলাম।
একটু পরে এল ছোট্টো এক প্ল্যাটফর্মের স্টেশন সাংকওয়াল। আহা! স্টেশন থেকে নামতেই সমুদ্র।
কিন্তু এখানে তো আমার নামবার নয়।
একটু বেলা করে পৌঁছোলাম শেষ স্টেশন, মার্মুগাঁও বা ভাস্কো-ডি-গামা,
সংক্ষেপে ভাস্কো। ট্রেনের সহযাত্রী সেই সর্দারজি বলে দিয়েছিলেন সোজা গুরুদ্বারায় যেতে।
স্টেশনের বাইরে এসে প্রথম দেখলাম বাইকট্যাক্সি। তখন আর কোনো শহরে এর প্রচলন দেখি নি।
এক যুবক বাইকট্যাক্সিওয়ালার পিছনে বসে কয়েক মিনিটে পৌঁছে গেলাম গুরুদ্বারা। জনশূন্য।
একপ্রান্তে কলতলায় এক মহিলাকে দেখলাম কাপড় কাচছেন। তাঁকেই বললাম, থাকার জায়গা চাই।
বললেন, জানো তো, এখানে মদ, তামাক চলবে না? বললাম, জানি। ঠিক আছে, যাও, ওই ঘরটায় গিয়ে
জিনিষপত্র রাখো, আরাম করো। যে দরজা দিয়ে ঢুকেছিলাম, তার ডানদিকে একটা ছোটো দোতলা। দোতলায়
একটাই ঘর এবং পাঁচিল ঘেঁষে উঠোন থেকে সিঁড়ি উঠে গেছে।
গিয়ে দেখলাম একেবারেই শূন্যঘর। খাটফাট কিছু নেই। স্যুটকেস আর ওভারকোট
রেখে আবার মহিলার কাছে গেলাম। বললাম, বাইরে যাবো খেতে। ঘরের তালাচাবি? তিনি বললেন, নিশ্চিন্তে যাও। কিচ্ছু হবে না। মহিলার কন্ঠস্বরে এমন
ভরসা ছিল যে কোনো উদ্বেগই আর রইল না। দিব্যি বেরিয়ে গেলাম। ভাস্কোর কোন পথ ধরে কিভাবে
সমুদ্রের কাছে গিয়েছিলাম মনে নেই। তবে দুপুরের রোদে যে জায়গাটায় গিয়ে বসেছিলাম সে জায়গাটা
নিচু পাহাড়ের ঘাসে ভরা ঢাল, সোজা সমুদ্রে নেমে গেছে। ভাস্কো বন্দরটা ডানদিকে দূরে কিছুটা
দেখা যাচ্ছে আর জাহাজগুলো আমার সামনে অব্দি ছড়িয়ে আছে। তখন অব্দি নেরুদা একটু আধটু
পড়েছি। জানি না, ভালপারাইজোতে আদৌ এমন কোনো জায়গা আছে কিনা। কিন্তু পাহাড়ের ঢালে বসে
বসে প্রশান্ত মহাসাগরের তীরে ভালপারাইজোর কথা মাথায় আসছিল।
অনেকক্ষণ পরে, ঢাল থেকে পিছিয়ে নেমে যে রাস্তা দিয়ে গিয়েছিলাম সে
রাস্তার মোড়ে ফিরে এলাম। পাটনারই মত একটা গুমটিঘর দোকান থেকে কিছু কিনে খেলাম। তারপর
মোড় থেকে অন্য দিকে যাওয়া রাস্তাটা ধরলাম। হঠাৎ একটা চাপা কিন্তু অসংখ্য অবিরত চিটপিট
চিটপিট চিটপিট শব্দ কানে এল। শব্দের উৎস ধরে বাঁদিকে রাস্তা থেকে নেমে এগিয়ে গেলাম।
দেখি সমুদ্রের সঙ্গে যুক্ত একটি অগভীর জলাভূমি যা তীরের কাছে এসে অনেকটা প্রসারিত পাঁক
হয়ে আছে। আর সেই পাঁক জুড়ে একেক ইঞ্চি থেকে কোনো ক্ষুদ্র প্রাণীর নিঃশ্বাসের বুদবুদ
উঠছে চিটপিট চিটপিট শব্দ করে। কোন প্রাণী? শামুক? ঝিনুক? শঙ্খ? নাকি জীবিত প্রবাল?
সেখানকার ভাষা জানি না। লোকজনও বিশেষ নেই। তাই মনের প্রশ্নটা প্রশ্নই থেকে গেল।
কিভাবে দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যে হল মনে নেই। সন্ধ্যেয় শিশুদের কলরবমুখর
এক সমুদ্রতীরে ছিলাম। তীরে অনেক মানুষ। পরিবার। দোকানপাট। আলো। একটা দোকান থেকে পান
কিনছিলাম। দোকানের সামনে অনেকগুলো মেয়ে। দৃষ্টিকটুভাবে উগ্র তাদের সাজগোজ। একটি মেয়ে
আমাকে ইশারা করল। পাটনা থেকে বেরোবার পর প্রায় দশ-এগারো দিন ধরে লাগাতার সফর … প্রতিদিন নতুন নতুন বিস্ময়ের সামনে দাঁড়ানো … বাড়িয়ে তুলেছিল একাকীত্ব। ওই রকম একটা ইশারার দরকার তৈরি হচ্ছিল
মনে। অপ্রতিরোধ্য মনে হল ওর ডাক। কিন্তু তারপর ওর দিকে ভালো করে তাকালাম। কী ছোট্টো
একটা মেয়ে! মেকআপের জন্য মুখটা বয়স্ক দেখাচ্ছে। ধ্যাৎ। এর সঙ্গে? নাঃ। কিছুতেই না।
…
যদি মোটামুটি সমবয়সী কোনো নারী হত, সে সন্ধ্যেয় নিশ্চিত ডাকে সাড়া
দিতাম। … আরেকটু নিঃসঙ্গতার মধ্যে রাতে গুরুদ্বারায়
ফিরে এলাম। ঘুম আসছিল না। গুরুদ্বারায় করে হয়তো ঠিক করলাম না কিন্তু বেশি রাতে একবার
হস্তমৈথুন করলাম। সকালে ঘুম থেকে উঠে বাসস্ট্যান্ড থেকে মাডগাঁওয়ের বাস ধরে নিলাম।
ঘন্টাখানেকের সফরে পৌঁছে, কাঠের পার্টিশন দিয়ে কামরা ভাগ করা একটা হোটেলে উঠলাম। খেয়ে
দেয়ে আরাম করলাম কিছুক্ষণ। মাডগাঁওএ আসার উদ্দেশ্য ছিল বেনালিম বিচে যাওয়া। কেউ বলেছিল।
বলেছিল, পাশের বিচটায় যেতে পারবে না, হিপ্পিদের বিচ, সব ন্যাংটো হয়ে ঘুরে বেড়ায়, পাশের
বিচটায় যেও। দারুণ সুন্দর। … বিকেলে একটা বাস
ধরে চলে গেলাম বেনালিম বিচ।
রেশমি নীল জলের এই সমুদ্র তীরে বিচিত্র এক সন্ধ্যা আর রাত আমার জন্য
অপেক্ষা করেছিল। বালিতে নেমেই ডান দিকে নজর কাড়ল ‘পেড্রোজ বার’। বারের সঙ্গে আমার
কারবার নেই, তবে দেখলাম কিছু কিছু খাবার জিনিষও আছে, কাজে লাগবে। তীরের বালিতে একটু
একটু দূরে পাতার ছাউনি করা আছে। তাতে বিদেশি পর্যটকদের দেখতে পেলাম। কে হিপ্পি, কে
নয় তা আর কিকরে বুঝব। অনেক বছর আগে ইয়ারপুরে মিঠুর সাইকেলের দোকানে জিন্স পরা লম্বাচুলো
একটি ছেলে এসে বসেছিল। আমরা জিজ্ঞেস করায় বলেছিল বাড়ি সুইজারল্যান্ড। জানি না মারিজুয়ানা
বা কোকেনের তালাশ ছিল কিনা। ‘হরে রাম হরে কৃষ্ণ’ সিনেমা বাদে ওই ছিল আমার দেখা একমাত্র বিদেশি পর্যটক অথবা লম্বাচুলো
হিপ্পি।
তীরের বালিতে হাঁটছি, সন্ধ্যা নামছে, হঠাৎ দেখি বিদেশি স্নানার্থীদের
একটা দল, জলে ভেজা, এগিয়ে আসছে। পাঁচজনের দলে চারজন পুরুষ এবং নারী স্নানের পোষাকে।
ঠিক আমার সামনে পঞ্চমজন, দলের সবচেয়ে তরুণী সদস্য, কটা, কোঁকড়া চুল, একটু দোহারা শরীর
আর সম্পূর্ণ উলঙ্গ। ভরা স্তন বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে, এমনকি যোনিমুখের চুলে শঙ্খের টুকরো
লেগে আছে তাও দেখছি। ওরা নিজেদের পাতার ছাউনিতে চলে গেল আর আমি পড়লাম ফাঁপরে। সৈয়দ
মুজতবা আলির চাচাকাহিনীতে নাকি অন্য কোনো বইয়ে, জার্মানির ন্যুডিজম নিয়ে রসিকতা পড়েছি,
কিন্তু কখনও ভাবি নি। সত্যিই কি এতে মুক্তির কোনো অনুভূতি, নাহয় ভ্রান্তিই হল, আদৌ
নিহিত আছে?
একটু নির্জনে গিয়ে নিজের জুতো, জামা, প্যান্ট, গেঞ্জি, জাঙ্ঘিয়া
সব খুলে একটা ঝোপে লুকিয়ে রাখলাম। নজর রাখতে হবে কেননা পয়সাও আছে। কোনো দিকে কেউ নেই
তো? দেখে নিয়ে নেমে গেলাম জলে। সন্ধ্যের আলোয় স্নান করলাম প্রাণ ভরে। মাঝে মধ্যে ঝোপটার
দিকে নজর রাখছিলাম। মুক্তির স্বাদ-টাদ বড় কথা, তবে সমস্ত শরীরে নির্বাধ নোনা জল, ঝিনুকের
টুকরো আর বালির স্পর্শের একটা নেশা তো আছেই। নিজের দিকে তাকালাম। মেয়েটার গা ভরে ঝিনুকের
টুকরো লেগেছিল। এখন আমারও গা ভরে লেগে আছে। উঠে এসে সমস্যা হল, গামছা তো নেই। গা মুছব
কী করে? অগত্যা যে ঝোপে জামাকাপড় রেখেছি, তারই সামনে বালিতে বসে পড়লাম। আর ঠিক তখনি
এক সাধারণ ভারতীয় দম্পতি (কোঙ্কনি না মারাঠি জানি না) আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসতে
হাসতে সামনে দিয়ে চলে গেল।
একটা কথা কিন্তু আমার মাথায় গেঁথে গেল। নগ্নতার সঙ্গে যৌনতার কোনো
সম্পর্ক নেই। একটু আগে যখন তরুণীটি আমার পাশ দিয়ে হেঁটে গেল এবং আমি চোখ বুজে থাকি
নি, ওর পুরো শরীরটা দেখেছি, তখনও মনে কোনো যৌনভাব জাগে নি। একটি অলঙ্ঘ্য শুদ্ধতার আভা
যেন ওকে ঘিরে ছিল। কিন্তু সেটাকে আমি গুরুত্ব দিই নি। ভেবেছিলাম তার কারণ ইওরোপীয় শরীর
আর আমার ইওরোপীয় পেন্টিংএ ন্যুড দেখার অভ্যাস। কিন্তু যখন নিজে নগ্ন হলাম একটু পরে,
সমুদ্রে স্নান করলাম, জলের ভারি স্পর্শ, ক্ষুদ্র প্রাণীদের ছোঁয়া যথেষ্ট সেন্সুয়াস
ছিল, তখনও কিন্তু কোনো যৌনভাব জাগে নি। যখন ওই দম্পতি আমাকে দেখে হাসতে হাসতে চলে গেলেন,
অস্বস্তিকর লজ্জা জেগেছিল ঠিকই, কিন্তু শরীর ঢাকার ব্যগ্রতা তাড়া করে নি। আমরা বলি
যে শরীরে মন আছে। কিন্তু সে মুহুর্তে আমার নগ্ন, আর্দ্র্য শরীরটাই মনের শরীর হয়ে ছিল।
সে মনে ভালোবাসা আছে, গান আছে, স্বপ্ন আছে কিন্তু তাৎক্ষণিক যৌনতা নেই। অথচ, আগের রাতে
ভাস্কোতে নিছক মনের বিচলনের কাছে হেরে গিয়েছিলাম।
পেড্রোজ বারের সামনেই সমুদ্রের দিকে মুখ করে একটা বসার জায়গা। ফিরে
সেখানেই বসলাম। আজ আর ফিরব না। রাত কাটাবো সমুদ্রের ধারেই। ঈষৎ দূরে একটা গুমটিঘর থেকে
কয়েকটা সিগরেট কিনে ফিরে এলাম। রাত গাঢ় হচ্ছে ধীরে ধীরে। সাড়ে আটটা নাগাদ দেখলাম দু’একজন ইওরোপীয় এসে পেড্রোজ বারে বসে কিছু খেয়ে গেল। আমিও উঠে গিয়ে
বারের বেঁটে খাটো কোঁকড়াচুলো মাঝবয়সী লোকটাকে জিজ্ঞেস করলাম, খাওয়ার কিছু পাওয়া যাবে
কিনা। সোজাসুজি মিষ্টি হেসে না বলে দিল। আরে? এক্ষুনি যে ওরা এসে খেয়ে গেল? ওসব হিপিদের
খানা, আপনি খেতে পারবেন না। দিব্যি পারব, দিন তো আপনি! আনলে পর দেখলাম ফ্যানসুদ্ধু
ভাত; পাশে একটুখানি ফরাসবিন আর কুচোচিংড়ি সেদ্ধ। ফার্স্ট ক্লাস। বেশ তারিয়ে তারিয়ে
খেলাম। তারপর জল খেয়ে, পয়সা দিয়ে আবার চলে গেলাম বসার জায়গাটায়।
একটু পরে পেড্রোজ বার বন্ধ হওয়ায় পুরোপুরি অন্ধকার হয়ে উঠল চার দিক।
তখন দেখলাম সমুদ্রের যে ঢেউগুলো তীরে এসে আছড়ে বা ছড়িয়ে পড়ছে তার ভাঁজের আগাগুলো থেকে
দূর থেকেই সবুজাভ আলো বেরোতে দেখছি। ওটাই ফসফোরাস! … ঢেউয়ের ফসফোরাস দেখতে দেখতে আর নানান কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে কেটে
গেল ছ’ঘন্টা বুঝতেই পারলাম না। হয়তো মাঝে তন্দ্রাচ্ছন্নও
হয়েছিলাম। ঘড়ি নেই, তবুও মনে হল রাত এবার শেষ হবে। উঠে গ্রামের ভিতর দিয়ে মাডগাঁওয়ের
রাস্তার দিকে এগোতে শুরু করলাম। একটু পরেই বুঝলাম ফেঁসে গেছি। অপরিচিত মানুষের গন্ধে
গ্রামের সবকয়টি কুকুর সচকিত হয়ে উঠেছে আর একে অপরকে সংকেতধ্বনি পাঠাতে পাঠাতে মানুষটিকে
ঘিরে ধরছে। আর সেই শব্দে কয়েকটি বাড়ির ভিতর থেকেও আওয়াজ উঠতে শুরু করেছে। কী করা যায়?
তখনই দেখলাম সামনে বাঁদিকে একটা একতলা বাড়ির বারান্দায় আলো জ্বলছে।
কাছে গিয়ে দেখলাম স্কুলবাড়ি, আর গেটটা খোলা। খোলা মানে জাম, বন্ধই হয় না। চুপচাপ বারান্দায়
উঠে এমনভাবে বসে পড়লাম যাতে বাল্বের আলোটা মুখে পড়ে। কেউ যদি বন্দুক টন্দুক নিয়ে বেরিয়েও
পড়ে, অপরিচিত ব্যক্তিটির মুখ যেন দেখতে পায়। বোঝে যে সে কোথাও পালাচ্ছে না। … কাজ হল। একটু পরে মানুষ তো মানুষ, কুকুরগুলোও শান্ত হয়ে গেল। আধ
ঘন্টা চল্লিশ মিনিট পর বেরিয়ে ধীর পায়ে গ্রামটা পার করে গেলাম। তারপর মাডগাঁওয়ে যাওয়ার
মোড়ে এসে বাঁদিক ধরলাম। রাস্তায় দু’একবার সাদা
কাপড়ের দোলায় ভুতের ভয় কাঁপালো বটে, কিন্তু আর কিছু ঘটল না। পাঁচ মাইল হেঁটে মাডগাঁওয়ে
যখন ঢুকছি তখন দুপাশের কুঁড়েঘরগুলোর বাইরে কয়লার তোলা উনুন ধরানো হয়েছে; ঘুঁটের ধোঁয়ায়
ভরে গেছে রাস্তাটা।
হোটেলের কামরায় ঢুকে ঘুমোলাম কিছুক্ষণ। বেলা দশটা নাগাদ উঠে পায়খানা,
স্নান সেরে হোটেলের খাবার জায়গায় গিয়ে ভাত আর মাছের ঝোল খেলাম। কী মাছ জানি না, তবে
নোনা, সামুদ্রিক আর আমাদের দিকের মত গুনে দুই বা তিন টুকরো নয়। ভাত, মাছের ঝোল মানে
আগে ভাত দিয়ে গেল। তারপর বাল্টি বা ডেকচি থেকে তুলে এক মগ মাছের, ডালনা বলা যায়, ভাতের
ওপর ঢেলে দিল। ছোটো হলেও গোটা বারো টুকরো তো ছিলই। খেয়ে, হোটেলে থাকা খাওয়ার পয়সা মিটিয়ে
রাস্তায় বেরিয়ে এলাম। বা হয়তো ঘরে আরেকটু জিরিয়ে বিকেলে বেরিয়েছিলাম; মনে নেই। গোয়ায়
আরো ঘুরতে হলে পণজি যেতে হত। কিন্তু আর ইচ্ছে করল না। সব সফরেই কিছুদিন পর বাড়ি ফেরার
টান শুরু হয়। মাডগাঁও স্টেশনে গিয়ে বম্বের টিকিট কাটলাম। ট্রেন কখন এসেছিল, কী নাম
ছিল ট্রেনটার, ফেরার সময়ও মিরজে ট্রেন বদলেছিলাম কিনা, কিচ্ছু আর মনে নেই।
মনে আছে সন্ধ্যায় গোয়ারই কোনো স্টেশন থেকে এক দল ছাত্র-ছাত্রী চড়েছিল।
কথাবার্তা, হৈহুল্লোড়ের মধ্যে একটি মোটা মত, কোঁকড়াচুলো মেয়ে প্যাসেজে বেরিয়ে এসে নাচতে
নাচতে গাইতে শুরু করল, “সুরাঙ্গনী, সুরাঙ্গনী,
সুরাঙ্গনীকা মালু গানভা …, ইয়ে মালু মালু
মালু, সুরাঙ্গনী কা মালু, সুরাঙ্গনীকা মালু গানভা …!” সবাই তাতে গলা মেলালো।
… গানের সুর এবং এই চারলাইনের শব্দধ্বনি আজ
এই লেখা নিয়ে বসা অব্দি এভাবেই মনে ছিল। এখন ইন্টারনেটে দেখলাম তৃতীয় লাইন হয় মেয়েটি
ভুল গাইছিল অথবা আমার ভুল মনে ছিল। সঠিক হবে, ‘মি দেন গেনাপু
মালু’। ইন্টারনেটে এটাও জানলাম যে মূলতঃ গানটি সিংহলি,
অর্থাৎ শ্রীলঙ্কার গান, তবে ভারতের বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। জানি না, বাংলায় হয়েছে
কিনা।
ভাবতে গিয়ে এখন মনে হচ্ছে, ফেরার সময়েও ট্রেন বদলেছিলাম। কেননা এই
গানটা শোনার সময় আমার সিট ছিল লম্বা বাঙ্কের মাঝখানে। অথচ এর পরের মনে থাকা ঘটনাটার
সময় আমি অপর দিকে জানলার ধারে সিঙ্গল সিটে ছিলাম। পরের ঘটনাটা মজার। এক মোটা ভদ্রলোক
এবং তাঁর মোটা স্ত্রী দুদিকের দুই জানলা অধিকার করে, মাঝখানে বাক্সপ্যাঁটরা ঢুকিয়ে
বেশ বিছানা মত করে নিয়েছিলেন। ট্রেনটা রাতে কোল্হাপুর পেরিয়ে ছুটছিল। দম্পতি এক অন্যের
মুখের দিকে পা ছড়িয়ে শুয়েছিলেন, যেমন আমরা সবাই জায়গা কম থাকলে শুই। ভদ্রলোক এক পা
একটু ওপরে, জানালার চৌকাঠে মেলে দিয়েছেন। ঘুমের মধ্যে হঠাৎ পা’টা ধপ করে তাঁর বৌয়ের বুকের ওপর এসে পড়ল। ব্যাস, কোল্হাপুরে চড়া
ছেলেগুলো শুরু করল চ্যাংড়ামি। ভদ্রলোককে ধমকাতে শুরু করল।
ভদ্রলোক যত বলেন, ইনি আমারই স্ত্রী, স্ত্রীও যতই সায় দেন, ছেলেগুলো
তেড়ে যেতে থাকে, “তাবলে পাব্লিক প্লেসে, সবার সামনে বৌয়ের গায়ে
পা ফেলবেন?” একটা অর্থহীন প্রসঙ্গে চ্যাঁচামেচি করে দম্পতির
ঘুম এমনভাবে ছুটিয়ে দিল তারা যে দুজনেই সারারাত মুখ হাঁড়ি করে বসে রয়ে গেলেন, আর শুলেন
না। এই দলটা ততক্ষণে নিজেদের মধ্যে, ব্রিফকেস বাজিয়ে গান শুরু করে দিয়েছে। … সকালে নামলাম ভিক্টোরিয়া টার্মিনাসে। কিন্তু এবার আর ফোর্টে নয়,
একটু হেঁটে গিয়ে হোটেল নিলাম ফ্লোরা ফাউন্টেনের পাশে একটি গলিতে। বারো টাকায় একটা বিছানা,
আর কমপ্লিমেন্টারি দিনের খাবার। আর ঘোরাঘুরি নয়, পাটনা ফিরব, তাই নিয়ে নিলাম। বিনাপয়সার
খাবারটা খেয়ে সারা দুপুর ঐ ফ্লোরা ফাউন্টেন এবং মেরিন ড্রাইভেরই চার্চগেট-লাগোয়া দিকটা
ঘুরলাম। বিকেলে পাটনার ট্রেন ধরে নিলাম। সিটও পেয়ে গেলাম জানলার ধারে, সিঙ্গল।
এর পর আর কিছু থাকত না এই সফরে যদি সামনের সিটে বসা গোদি-মজুর মানুষটির
সঙ্গে আলাপ না হত। তিনিও পাটনার বাসিন্দা, কিন্তু অনেক, অনেক বছর পর বাড়ি ফিরছেন। ছোটোবেলায়
বাড়ি থেকে পালিয়ে পৌঁছেছিলেন বম্বে। স্বপ্ন ওই একটাই, সিনেমায় যাওয়ার। কিন্তু হলেন,
গোদি-শ্রমিক, এখন ক্রেন চালান। ইতিমধ্যে বম্বেতেই বিয়ে করেছেন, সন্তান আছে। সিটে রাখা
আছে মেয়েলি রুমালে বাঁধা একটা আপেল – বেগম হাতে
দিয়ে, মাথার দিব্যি করে খেয়ে নিতে বলেছেন। … ব্যাস, আর
না। বাকিটুকু, এবং ওপরের বেশ কিছু ঘ্টনা নিয়ে ফিরে এসে লিখেছিলাম দীর্ঘ, একটু বেশিই
দীর্ঘ আর অতি-উৎসাহে ভরা কবিতা – ‘কলিমেরা’। ‘আজকের দিনটার জন্য’ নামের সঙ্কলনে,
কবি সৃজন সেনের সৌজন্যে অনুষ্টুপ প্রকাশনী থেকে ছেপেছিল এবং বন্ধুদের ভালো লেগেছিল।
১৭.১০.২৫