১৯৭৪এর ১৫ইফেব্রুয়ারি চাকরিতে যোগ দিতে পাটনা থেকে ধানবাদ রওনা দিলাম। তখন পাটনা-ধানবাদ সোজা ট্রেন ছিল না। গয়ায় ট্রেন বদল করতে হত। তাই সেসব ঝামেলা বাদ দিতে সকালের বাসে রওনা দিলাম ধানবাদ। রাতে পৌঁছে সোজা ব্যাঙ্কে। সেরকমই বলা হয়েছিল আমায়। সোজা ব্যাঙ্কে পৌঁছোবে। ওখানে একজন আছে যে ব্যাঙ্কেই থাকে। সেই রাতে তোমার শোয়ার ব্যবস্থা করে দেবে। পরের দিন ঘরও খুঁজে দেবে।
সেরকমই হল। আমি পরের দিন সকালে ব্যাঙ্কে চান করে, মনাইটাঁড়ের
রাস্তা জিজ্ঞেস করতে করতে পূর্ণেন্দুদার বাড়ি পৌঁছে গেলাম। যদ্দূর দৃশ্যটা মনে আছে,
পূর্ণেন্দুদার বিছানার নিচে মেঝেয় বসে ভাত খেলাম – পূর্ণেন্দুদার
মা বেড়ে দিয়েছিলেন। বিছানার পিছনে বইয়ের র্যাকে হাত দিয়ে গোপাল হালদার রচিত ‘সংস্কৃতির রূপান্তর’ বইটা
হাতে নিয়ে ওল্টালাম। পড়ব বলে জিজ্ঞেস করে ঝোলায় রেখে নিলাম। তারপর ব্যাঙ্কে ফিরে গিয়ে
ফর্মাল জয়েনিং দিলাম ১৬ই ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪। এই তারিখটাই বাকি সব স্মৃতি সাজাবার যোগসূত্র।
সে সময় আমার পরিচিত সাহিত্যকর্মী লোকজনের মধ্যে, পূর্ণেন্দুদার
সাথে ভালো আলাপ ছিল জীবনময় দত্ত, রবীন দত্ত এবং ‘সপ্তদ্বীপা’য় লেখেন এমন আরো অনেকের। এক আমিই চিনতাম না। তবে মনে
হয় পূর্ণেন্দুদার সাথে আমার দু’একটি চিঠি চালাচালি
হয়েছিল। জক্কনপুর থেকে আমরা যে ‘অভিযান’ বার করতাম, তার জন্য লেখাও চেয়ে থাকব হয়ত। (মনে হওয়া
ছাড়া কিছু করার নেই কেননা পাটনা শহরটা ১৯৭৫এর বিধ্বংসী বন্যায় ডুবে আবার যখন উঠেছিল,
অনেক কিছুর সাথে আমার চিঠিপত্রও রয়ে গিয়েছিল জলের নিচে – নইলে,
চিঠি যত্ন করে রেখে দেওয়ার একটা অভ্যাস আমার তখন থেকে ছিল)।
যাই হোক, সেদিন থেকেই আমার পূর্ণেন্দুদার পিছনে পিছনে
ঘুরে অনেককিছু জানার, চেনার এবং করার শুরুআত হল। তাই, পূর্ণেন্দুদার বিষয়ে লেখার অনেকটাই
সেই পর্বে আমার নিজের কথা হয়ে পড়বে।
বরং তার আগে তাঁর আগেকার জীবনের প্রাথমিক তথ্যগুলো
জানিয়ে দিই। পূর্ণেন্দুদার পরিবার মূলতঃ ধানবাদবাসী বা মানভুইয়াঁ ছিল না। তাঁর বাবা
স্টেটব্যাঙ্কে চাকরির সূত্রে তাঁদের আদিনিবাস, হুগলি জেলার রঘুনাথপুর থেকে ধানবাদে
আসেন। আর ফিরে যান না। ধানবাদেই বাড়ি করেন এবং থেকে যান।
কিন্তু পূর্ণেন্দুদার মায়ের বাড়ি এবং মামার বাড়ি পাটনায়।
আর এই মামার বাড়িতেই তাঁর জন্ম হয়। জন্মতারিখ ১৫ই জুন ১৯৪৫। পড়াশুনো শুরু হয় প্রাণজীবন
একাডেমি স্কুল, ধানবাদে এবং এই স্কুল থেকেই ম্যাট্রিক পাশ করেন। কলেজে ভর্তি হতে আবার
যান পাটনা। তবে মামার বাড়িতে আর না। রামকৃষ্ণ মিশনএর হস্টেলে থেকে কলেজ জীবন শুরু করেন
পাটনা কলেজে। পাটনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই বাংলায় পোস্টগ্রাজুয়েট করেন। একাডেমিক জীবনের
প্রথম ধাক্কাটাও এখানেই খান। সে সময় যা বেশ চলতি রেওয়াজ ছিল, পোস্টগ্র্যাজুয়েট স্তরে
হেডের এবং তারপর ডক্টরেট পাওয়ার জন্য গাইডের মন যুগিয়ে চলা এবং লেখাপড়ার বাইরের অনেক
কাজে খাটাখাটনি করা, তা তিনি করলেন না। এমনকি, ‘কর
নি, ঠিক আছে কর নি, একটু নত হয়ে চললেও তো পারো, এসব তো একটু খেয়াল রাখতেই হয় …’ সে সদুপদেশও উপেক্ষা করলেন। ফলে জুটল সেকেন্ড ক্লাস।
পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ে সে সময়কার নীতি অনুযায়ী ফ্রেশার হয়ে কাজ পাওয়ার ওই একটাই শর্ত
ছিল, ফার্স্ট ক্লাস, সেটা হারালেন। কাজেই ফিরে গেলেন ধানবাদ। কাত্রাসগড়ের কাত্রাস কলেজে
অধ্যাপনার কাজ জুটে গেল।
তবে ধানবাদে ফিরে যাওয়ার আগে পাটনার ওই হস্টেলে আবাসিক
থাকা কালীন এবং অবশ্যই পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্র হওয়ার সুবাদে বিহার
বাঙালি সমিতির এবং তার মুখপত্র ‘সঞ্চিতা’র নেতৃবৃন্দের সাথে, বিশেষকরে গুরুচরণ সামন্ত, মন্টু
সরকার, প্রভু মুখার্জি, ডঃ ঘোষাল, রঙিন হালদার ও অন্যান্যদের সাথে তাঁর গাঢ় সম্পর্ক
গড়ে উঠেছিল। সাংগঠনিক কাজেও অংশিদারী গড়ে উঠেছিল। সত্যি বলতে, আজকের ঝারখন্ডএর বড় শহরগুলো
– ধানবাদ, রাঁচি, জামশেদপুর – এত বেশি বাঙালি অধ্যুষিত, যে ভাষাগত সংখ্যালঘুর সংকটটা
তাঁরা আজও সেভাবে অনুভব করে উঠতে পারেন না যেভাবে পাটনা, ভাগলপুর, দ্বারভাঙ্গা, পুর্ণিয়া,
কাটিহারের বাঙালিরা অনুভব করে। কাজেই পূর্ণেন্দুদার জন্যও পাটনায় বিহার বাঙালি সমিতির
নেতা ও কর্মীবৃন্দের সাথে পরিচিত হওয়ার ব্যাপারটার গুরুত্ব ছিল। বাংলা সাহিত্যের দুজন
দিকপালেরও পাটনা আসাযাওয়া ছিল সে সময়। বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় কলকাতায় থাকুন বা দ্বারভাঙ্গায়,
পাটনায় খুব বেশি আসাযাওয়া না করলেও সম্পর্ক রাখতেন। গোপাল হালদার তো এসে থেকেই যেতেন
মাঝে মধ্যে স্ত্রীয়ের কাছে। ১৯৭৩ সাল নাগাদ যখন নতুন কর্মযজ্ঞ শুরু হল – কর্মাটাঁড়ে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বাড়ি ‘নন্দনকানন’ খুঁজে
পাওয়া, তার মালিকানা নেওয়া ইত্যাদি, তখন পূর্ণেন্দুদা ধানবাদেই ছিলেন। ধানবাদ থেকে
সামান্যই দূরত্বে জামতাড়া এবং কর্মাটাঁড়।
পরেও দেখেছি, পূর্ণেন্দুদা নিজের সাহিত্যিক লেখালিখি
থেকে বেশি গুরুত্ব দিতেন সাংবাদিক লেখালিখিকে, এবং দুটোর থেকেই বেশি গুরুত্ব দিতেন
সাংগঠনিক কাজকর্মকে, তা সে কর্মজীবনের সংগঠন হোক, সাহিত্য সংগঠন হোক বা পত্রিকাপ্রকাশ
সম্পর্কিত গোষ্ঠি হোক। এসবেরই মাঝে, বার বার ঢুকতে চেয়েও টিকিট ক্যান্সেল করত ব্যক্তিগত
মাইনে, পিএফ, ইঙ্ক্রিমেন্ট, প্রমোশন সংক্রান্ত সমস্যার প্রতি নজর, স্বাস্থ্য সংক্রান্ত
সমস্যার প্রতি নজর আর দুপুর বা রাতের খাওয়াটা হল কি হল না তার প্রতি নজর।
ধানবাদে প্রথম চাকরিজীবনেও তাই হয়ে থাকবে। একদিকে ‘প্রবাহ’ সাহিত্য
পত্রিকার জন্য কাজ – অন্যের লেখাপত্র
যোগাড় করার চেষ্টার মাঝেই নিজেরও মনে গোমরাতে থাকা কবিতাটা ছেঁড়া কাগজের টুকরোয় লিখে
ফেলা, অন্যদিকে কোলিয়ারি কামগার ইউনিয়নে রায়বাবুর (এ কে রায়) সাথে দেখা করে মাফিয়া
রাজনীতির হালহকিকৎ জেনে, প্রয়োজনে বিনোদবিহারি মাহাতোর সাথেও দেখা করে নিজের সংবাদ
প্রতিবেদনের মালমশলা যোগাড় করা, আরো অন্যদিকে ধানবাদ সাহিত্যকার সঙ্ঘের আয়োজন সফল করতে
উর্দু, হিন্দি, ভোজপুরি, খোরঠা ইত্যাদি বিভিন্ন ভাষার কবিদের সাথে দেখা করে আমন্ত্রণ
জানানো – দুপুরের খাবারটা বিকেলে এবং রাতের খাবারটা মাঝরাতে
হয়ত খাওয়া বা আরো ভালো, যেমন ঢাকা আছে তেমনভাবেই রান্নাঘরে রেখে আসা। সে সময়কার ধানবাদও
তো অন্যরকম। দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত পূর্ণেন্দুদার নিজের ‘স্টোরি’তেই তার ছবিটা পাওয়া যায়ঃ
“একটা গল্পের উল্লেখ
করা যাক। তখন ধানবাদে ডিস্ট্রিক্ট কমিশনার হয়ে এসেছেন কে বি সাক্সেনা। এসেই কয়েকদিনের
মধ্যে হয়ে উঠেছেন কিম্বদন্তির নায়ক। যেখানে মাফিয়ারা গোলমাল করছে সেখানেই কড়া হাতে
দমন করছেন। পুলিশ দল সঙ্গে নিয়ে নিজেই ‘রেড’ করে চলছেন একটার পর একটা মাফিয়াদের শক্ত ঘাঁটি। মাফিয়াদের
দলে তখন ত্রাহি ত্রাহি রব উঠেছে। তাঁর মনে হল কোটিপতি রাজনৈতিক নেতা সুরজদেও সিংয়ের
অপরাধমূলক কাজের বহর ক্রমশঃ বেড়েই চলেছে। অনেকগুলি খুনের মামলা ঝুলছে তার নামে অথচ
জামিন নেবার কোন আগ্রহ নেই। দেখা হলে পুলিশ তাকে সেলাম ঠুকছে। অতএব সাক্সেনা তার দিকে
নজর দিলেন। তাকে বলা হল কোর্টে আত্মসমর্পণ করতে। কাকস্য পরিবেদনা। সাক্সেনার উদ্যোগে
কোর্ট থেকে আদেশ জারি করা হল ধরা না দিলে সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার। বড় বড় পুলিশ অফিসার
বেড়াতে গেলেন তার বাড়িতে। ফিরে এলেন দুটি ছেঁড়া দড়ির খাটিয়া, গোটা কয়েক টিনের সুটকেশ
নিয়ে। শোনা গেল কোটিপতি সুরজদেও সিংএর এটাই বর্তমান অবস্থার নমুনা। সুতরাং সাক্সেনা
পুলিশের ওপর নির্ভর না করে নিজেই ঝাঁপিয়ে পড়লেন। জীবিত বা মৃত ধরতেই হবে। সিংজির হিতাকাঙ্ক্ষী
পুলিশ অফিসাররা ততদিনে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন ডি সি সাক্সেনা অন্য ধাতুতে গড়া। তাঁর
শরীরে দুটো জিনিষের বালাই নেই – একটা ভয়। দ্বিতীয়টা
ব্যক্তিগত লোভ। এহেন মুক্ত পুরুষকে কাবু করবে কোন মন্ত্রে? তাঁরা সিংজিকে পরামর্শ দিলেন
আত্মসমর্পণ করে জামিন নিয়ে বেরিয়ে আসতে। পাটনায় ‘পৈরবি’ চলল সাক্সেনাকে সরিয়ে আনার জন্য। প্রচেষ্টা সফল হল
না। শেষ পর্যন্ত সিংজি বন্দোবস্ত করে কোর্টে আত্মসমর্পণ করলেন। মার্ডার কেস, প্রত্যক্ষ
সাক্ষী আছে, জামিনের অযোগ্য ওয়ারেন্ট। তবু সবাই জানে ‘বেল’ হবে। আগে ভাগে খবর পেয়ে গেলেন সাক্সেনা। সশস্ত্র পুলিশ
দল নিয়ে কোর্টের বাইরে অপেক্ষা করে রইলেন। বেল নিয়ে বের হলেই আবার ধরবেন আটক আইনে।
সেদিন ছিল ‘মর্নিং কোর্ট’।
যথারীতি বেল পেয়েও সিংজি কোর্ট থেকে বেরুতে পারছেন না। কোর্টের মধ্যে গ্রেপ্তার করা
যায় না। অন্যদিন বেলা এগারোটার মধ্যে কোর্টের কাজ শেষ হয়ে যায়। সেদিন কোর্টের ওয়ার্কিং
আওয়র শাস্ত্র-বিরোধী গল্পের পদাঙ্ক অনুসরণ করে এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করল। আপামর
জনসাধারণ ন্যায় কর্মীদের কর্মনিষ্ঠার এই পরিচয় পেয়ে পুলকিত হয়েছিলেন কিনা জানা যায়
নি, কিন্তু কোর্ট প্রাঙ্গণের বাইরে আম আর জামগাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকা সাক্সেনার মনে
কোন ভাবান্তর নেই। তিনি যেন মৎস্য শিকারীর অবিচল নিষ্ঠায় ফাৎনার ওপর নজর রেখে বসে আছেন
সেই মুহুর্তটির জন্য, যখন ফাৎনা নড়ে উঠবে। পুলিশকেও হুকুম দেওয়া হল প্রয়োজনে গুলি চালাতেও
দ্বিধা করবে না। …”
এহেন ধানবাদেই অন্যদিকে এ কে রায় স্বপ্নকে সম্ভব করছেন।
দেখার মত ঐক্য গড়ে তুলেছেন কয়লা শ্রমিকদের সাথে সাঁওতাল চাষীদের। মাফিয়া পহলওয়ানদের
বন্দুক থেমে গেছে সাঁওতাল ধনুকের নিশানায়। মিছিল এগোবেই। হিম্মত থাকলে কেউ থামাবার
চেষ্টা করে দেখুক। পূর্ণেন্দু নারায়ণ মুখার্জি সেই ঐক্যপ্রয়াসেও হাজির।
ওদিকে আবার ‘প্রবাহ’ সাহিত্য প্রয়াসে লেখক হিসেবে যোগদান করছেন ওই অঞ্চলের
নামচিন লেখকেরা, যেমন যশোদাজীবন ভট্টাচার্য্য। কয়লাঞ্চলের বাংলা সাহিত্য পত্রিকা ‘প্রবাহ’র
সুনাম ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে।
সাহিত্যকার সঙ্ঘের মাধ্যমে বিভিন্ন ভাষার লেখকদের মাঝে
নতুন প্রগতিশীল চিন্তাভাবনা ছড়াবে কে? দুনিয়ার বৈপ্লবিক কর্মকান্ডের তাপ কে ছড়াবে উর্দু
গজলে, হিন্দি মুক্তকে, খোরঠা ছন্দে আর স্থানীয় নতুন বাঙালি সাহিত্যিকদের প্রয়াসে? অবশ্যই
পূর্ণেন্দু নারায়ণ মুখার্জি।
ঠিক এই সময়টার পর আমি ধানবাদে পৌঁছোলাম। আমাকে সঙ্গে
পেয়ে পূর্ণেন্দুদা শুরু করলেন ‘স্বাক্ষর’ সাহিত্য পত্রিকা। সঙ্গে রোহিনীকুমার দাশ ও আরো অনেকে
ছিলেন। পত্রিকা তো একটাই বেরুলো, কিন্তু স্বাক্ষরের ব্যানারে দুটো গুরুত্বপূর্ণ কাজ
হল। ২১শে ফেব্রুয়ারি ১৯৭৫ তারিখে লিন্ডসে ক্লাবে আনুষ্ঠানিক ভাবে একটা ফোল্ডার প্রকাশ
করা হল, “একুশের রক্তাক্ত দর্পণে”।
দ্বিতীয় কাজ হল, প্যাম্ফলেট ছাপিয়ে বিতরণ। ‘সেই
লিন্ডসে ক্লাবেই ‘বারবধু’ নাট্যাভিনয় উপলক্ষে অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে।
পূর্ণেন্দুদার মাধ্যমেই আমি ধানবাদের সাহিত্যসমাজের
সাথে পরিচিত হয়েছিলাম আর স্টেশনের কাছে রেলকলোনিতে রোহিণিকুমার দাশ মহাশয়ের বাড়িটা
আমার সন্ধ্যেবেলার আড্ডা হয়ে উঠেছিল। কেননা রাতে হিরাপুর থেকে ফেরার সময় আমাকে ওখান
থেকেই পিকআপ করতেন পূর্ণেন্দুদা। তারপর হাঁটতে স্টেশন ওভারব্রীজ, পুরানা বাজার পেরিয়ে
উনি বাঁদিকে ঢুকে যেতেন মনাইটাঁড়ে আর আমি আরো কিছুটা এগিয়ে রেলকলোনির মাঠটার পাশ দিয়ে
ঢুকতাম গান্ধীনগরে।
আমাদের স্বাক্ষর পত্রিকার জন্য লেখা সংগ্রহ করতে উনি
আমায় পাঠিয়েছিলেন দুবরাজপুর। কলকাতায় রেনেশাঁ প্রিন্টার্সে পত্রিকা এবং ঝরিয়ার প্রেসে
ফোল্ডার, প্যাম্ফলেট ছাপার ব্যাপার আমার ঘাড়েই দিয়েছিলেন।
তবে এটা বুঝি যে যেহেতু সে সময় পূর্ণেন্দুদা পাটনা
যাওয়ার কথা ভাবতেন না এবং আমিও যে শিগগির চলে যাব জানতেন না, তাই বিহার বাঙালি সমিতির
কাজে অংশগ্রহণ করার কোন প্রস্তাব আমায় দেন নি। এবং উনি নিজেও সে সংগঠনের কাজে সে সময়
অংশগ্রহণ করতেন কিনা, গুরুচরণদার সাথে কখনো সিংভুম ইত্যাদির গ্রামে যেতেন কিনা আমি
জানিনা।
১৯৭৪এই তো জয়প্রকাশ নারায়ণ এসেছিলেন এখনকার বাসস্ট্যান্ডের
মাঠটায়। তখন সদ্য সদ্য লেনিন পড়ছি। দেশের ভবিষ্যৎ শ্রমিকশ্রেণী নয় ছাত্রসমাজ – এধরণের প্রস্তাবটা খুব খারাপ লেগেছিল এবং পূর্ণেন্দুদার
সাথে সে নিয়ে যথেষ্ট আলোচনা হত। রায়বাবুর সাথেও ওনার সাথে গিয়েই আলাপ করেছিলাম কোলিয়ারি
কামগার ইউনিয়নের ওফিসে। ১৯৭৫এর মে মাসে ভিয়েতনাম মুক্ত হল। সে রাতে হোটেলে খাবার খেয়ে
স্টেশন ওভারব্রিজ দিয়ে হেঁটে ওপারে যাচ্ছিলাম। দেখি পূর্ণেন্দুদা ওদিক থেকে সাইকেল
নিয়ে ফিরছেন। আমায় দেখেই চিৎকার করলেন, “ভিয়েতনাম
মুক্ত!”
তার কিছুদিন পরেই আমার পাটনায় ট্রান্সফার হয়ে গেল।
আমি পাটনায় আসার পর কিছুদিনের মধ্যেই পূর্ণেন্দুদা
কাত্রাস কলেজ ছেড়ে রাজা শিবপ্রসাদ কলেজ, বেলাগোরিয়া, ঝরিয়ায় জয়েন করেছিলেন। একদিন হঠাৎ
পাটনা বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরি ক্যাম্পাসে চলা ব্যাঙ্কটায় আমার সাথে দেখা করতে এলেন।
আমি তো অবাক। “হ্যাঁ, পাটনা ইউনিভার্সিটি জয়েন করছি। বি এন কলেজ।”
তারপর অনেকটা সময় ঈষৎ দূরে দূরেই কেটেছে। ওনার চাকরিটা
ভিন্ন, তার বন্ধুবর্গ ভিন্ন, সংগঠন ভিন্ন। আমার আবার সে সময়টায়, এমার্জেন্সির মধ্যে
নতুন ধরণের কিছু রাজনৈতিক ঝোঁকে জড়িয়ে পড়া। নতুন সাংগঠনিক লড়াইও শুরু হয়ে যায় ব্যাঙ্কে।
কাজেই, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের ঐতিহাসিক হড়তালে তাঁর
সক্রিয় অংশগ্রহণ, ভাগলপুর জেলে কারাবাস, জেলেই জন্ডিস হয়ে যাওয়া, অন্যদিকে প্রগতিশীল
লেখক সঙ্ঘের পাটনা শাখার সভাপতি হওয়া … এসব
সময় আমরা দূরে দূরেই ছিলাম। একটি পত্রিকা প্রকাশ
করারও উদ্যোগ নেন; আমি শুধু পত্রিকাটা হাতে পাই। বিয়ে করেন। বৌদির সাথে আমার প্রথম
দেখা হয় পূর্ণেন্দুদার মামার বাড়িতে – তখন
সেটা বাঙালি আখড়ায়।
মাঝে মধ্যেই বিভিন্ন পাড়ায় – কখনো কাজিপুরে, কখনো রাজেন্দ্রনগর মেন রোডে, কখনো
ছয় নম্বরে – তাঁর বাড়িতে যাই, বিরাট বড় বড় বৈপ্লবিক কথাবার্তা
বলি, ব্যক্তিগত হৃদ্যতা বজায় থাকে কিন্তু সাংগঠনিক কোনো কাজে আমরা একে অন্যের কাছাকাছি
আসতে পারি না। সত্যি বলতে কাছাকাছি আসার জায়গা দুটোই হতে পারত, সাহিত্য এবং বাঙালি
সংগঠন। আমি সে সময় বাঙালি সংগঠন থেকে দূরে দূরে থাকাই পছন্দ করতাম। সাহিত্যের ক্ষেত্রটা
এত বেশি জড়িয়ে ফেলেছিলাম রাজনীতির সাথে যে কাউকে কিছু শোনাতেও বিশেষ ইচ্ছে হত না। আরেকটাও
কারণ ছিল। কিছুদিন আগে পরে আমরা দুজনেই বিয়ে করেছিলাম। সন্তান হয়েছিল। স্বাভাবিক ভাবেই
নতুন সাংসারিক ব্যস্ততা অনেকটা সময় নিয়ে নেয়। এসবেরই মাঝে তাঁর চোখের সমস্যাও শুরু
হল। রেটিনা ডিট্যাচমেন্টের কেস। তক্ষুনি বৌদি ওনাকে নিয়ে গেলেন চেন্নাই, শঙ্কর নেত্রালয়।
সে সময় এটাই একমাত্র সম্ভব রাস্তা ছিল সেরে ওঠার।
বস্তুতঃ আশির দশক এভাবেই কেটে যায়। সাংগঠনিক কাজে একজায়গায়
কিছুটা আসা আবার শুরু হয় নব্বইয়ের দশকে। আমার দিক থেকে ১৯৯০-৯১-৯২এর ঘটনাবলী নিঃসন্দেহে
তার সবচেয়ে বড় কারণ ছিল। আর কখনো ফিরে আসব না ভেবে ছেড়ে আসা অনেক জায়গায় শুধু আমি কেন,
অনেকেই আবার ফিরে আসছিলেন।
তবে এরই মধ্যে পূর্ণেন্দুদার প্রথম কবিতা সঙ্কলন প্রকাশিত
হল, “আলোকিত দ্রাঘিমার অন্বেষণে”। খবরটা পেয়ে ওনার বাড়িতে গিয়ে নিলাম। তখনো, এবং তার
পরেও, যতবার গেছি, সাহিত্যিক কোনো লেখা নিয়ে আলোচনার চাইতে উনি বেশি প্রয়োজন মনে করেছেন
রাজনৈতিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা। “এই দেখ, তোমার
জন্য জেরক্স কপি করিয়ে রেখেছি”, সদ্য আজকালে
বা অন্য কোনো খবরের কাগজে প্রকাশিত, গোর্খাল্যান্ড নিয়ে লেখাটা, আজকের বিহার ও বাঙালি
নিয়ে লেখাটা, কামতাপুরি নিয়ে লেখাটা … এগিয়ে
দিয়েছেন। এবং নিয়মিত ওনার লেখা প্রতিবেদন বা সম্পাদকের নামে দীর্ঘ চিঠি সে সময় প্রকাশিত
হয়েছে খবরের কাগজে।
সেটা ১৯৯৫ সাল। সরকারের তরফ থেকে বিহার বাঙলা একাডেমির
চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন পূর্ণেন্দুদা (নির্দেশক ইন্দিবর মুখার্জি)। উপনির্দেশক নিযুক্ত
হন বীথিকা সরকার। তিনি পদত্যাগ করলে আমাকে উপনির্দেশক করা হয়। হঠাৎ কিছু হয় নি। গুরুচরণদা
এবং বাঙালি সমিতির নেতৃত্বেই সিদ্ধান্ত হয়েছিল।
এখানেই একটা কথা বলার জায়গা পাচ্ছি। বিহার বাংলা আকাডেমি
গঠিত হয়েছিল আশির দশকের শুরুতে। বাঙালি সমিতির নেতৃস্থানীয় সবাই সেই উদ্যোগে ছিলেন।
নিশ্চয়ই পূর্ণেন্দুদা, গুরুচরণদা আমায় বলে থাকবেন যাতে আমিও শামিল থাকি। কিন্তু সে
সময়, নিজের কার্যক্ষেত্রের সংগঠনের প্রতিদিনকার লড়াই নিয়ে আমি এত ব্যস্ত ছিলাম যে এখন
আর মনেও নেই কবে কে কী বলেছিলেন। কী অজুহাতে আমি আকাডেমির প্রতিষ্ঠা-অনুষ্ঠানে আমি
শামিল হইনি। পরেও, বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক আয়োজনে আমি শামিল হইনি। পূর্ণেন্দুদা
কিন্তু পুরোপুরি ইনভল্ভড ছিলেন। সেটা আকাডেমির স্বর্ণযুগ। প্রথম দু’টার্মে বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় চেয়ারম্যান, তৃতীয় টার্মে
গোপাল হালদার চেয়ারম্যান। প্রথম টার্মে প্রণবশঙ্কর মুখোপাধ্যায় নির্দেশক, পরের দু’টার্মে আভাস চ্যাটার্জি নির্দেশক। একের পর এক প্রকাশন
হয়ে চলেছে। কেদার রচনাবলী তিন খন্ড, আশালতা সিংহ রচনাবলী এক খন্ড … । রামবহাল তেওয়ারি, সুধীর করণ, শৈলেশ বন্দোপাধ্যায়,
ডঃ নন্দদুলাল রায়, ডঃ কল্যাণী মন্ডল প্রভৃতি লেখকের টাটকা পান্ডুলিপিগুলো যোগাড় করে
আনা হচ্ছে। … প্রত্যেকটি
প্রকাশনের সাথে গুরুচরণদা এবং পূর্ণেন্দুদার অক্লান্ত পরিশ্রম প্রধানভাবে জড়িয়েছিল।
বড় বড় আলোচনাচক্র আয়োজন করা হত। সবেতেই গুরুচরণদার সাথে সাথে লেগে থাকতেন পূর্ণেন্দুদা।
আরেকজন থাকতেন কিছুটা নেপথ্যে – ব্রিটিশ লাইব্রেরির
লাইব্রেরিয়ান দীপক গোস্বামী এবং তাঁর স্ত্রী কৃষ্ণা গোস্বামী। (গুরুচরণদার পিছু পিছু
লেগে থাকার লাভটা আমি পেতে শুরু করেছিলাম অনেক পরে; আগে করলে আরো অনেক কিছু জানতে পারতাম।)
যাই হোক, পূর্ণেন্দুদা যখন চেয়ারম্যান হলেন, যদিও সে
সময় সরকারি অনুদান অপর্যাপ্ত হওয়ার কারণে, এবং কিছুটা নির্দেশক মহাশয়ের রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্খার
তাড়নায় প্রকাশনার কাজগুলো একটুও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়নি, কিন্তু দু’একটি বড় কাজ, চেয়ারম্যানের উদ্যোগেই হতে পেরেছিল। তার
মধ্যে একটি হল বহুভাষী কবি সম্মেলন। পাটনার মঞ্চে ভাষার ব্যবধান মিটিয়ে সদর্থে বহুভাষী
কবি সম্মেলন এই প্রথম হয়েছিল যাতে বাংলা, হিন্দি, উর্দুর সাথে সাথে মগহি, মৈথিলি, ভোজপুরি,
অঙ্গিকা, বজ্জিকার মত লোকভাষার কবিরাও সমান অংশিদারিত্বে শামিল হয়েছিলেন। এবং এই কৃতিত্বটা
পুরোপুরি পূর্ণেন্দুদার প্রাপ্য। পরেও, আগামি কুড়ি-পঁচিশ বছর অব্দি যখনি বহুভাষী কবি
সম্মেলনের আয়োজন হয়েছে, কেন্দ্রে থেকেছেন পূর্ণেন্দুদা।
বস্তুতঃ, পূর্ণেন্দুদার লেজুড় হয়েই আমি বাংলা সাহিত্যের
কিছু কিম্বদন্তি অথবা সুখ্যাত ব্যক্তিত্বের সাথে দেখা করেছি। এমার্জেন্সির সময় শক্তি
চট্টোপাধ্যায় একটি সরকারি অনুষ্ঠানে এসেছিলেন। প্যালেস হোটেলে এবং পরের দিন সার্কিট
হাউজে পূর্ণেন্দুদার সাথে গিয়েই দেখা করি। তার আগে বা পরে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় এবং
অমিতাভ দাশগুপ্ত এসেছিলেন। বি এন কলেজেই তাঁদের নিয়ে কাব্যপাঠের সংক্ষিপ্ত অনুষ্ঠান আয়োজিত হল, পূর্ণেন্দুদারই উদ্যোগে।
পেরেছিলেন কেননা সে সময় বি এন কলেজের প্রিন্সিপ্যাল ছিলেন এস কে বোস। তাঁকে পরে চিনেছিলাম
যখন এক নকশালপন্থী বলে কথিত মহিলার ফাঁসির সাজার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপতিকে আবেদন করার
জন্য গণস্বাক্ষর অভিযান শুরু হয়। বেশ একটু রাতে আমি হিন্দির স্বনামধন্য কবি আলোকধন্বার
সাথে তাঁর বাড়িতে গিয়েছিলাম। আমার গায়ে একটা চকরাবকরা হাওয়াই শার্ট ছিল। ধমক দিয়ে বললেন,
“এত গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজে বেরিয়েছেন, মানুষের কাছে
যাবেন, একটা সোবার ধরণের জামা পেলেন না?” সত্যি,
একটুও খারাপ লাগে নি। লজ্জা পেয়েছিলাম।
সে যা হোক, পূর্ণেন্দুদার দৌলতে এবং তাঁর আদেশে একটা
পুরো দুপুর আমি কাটাই পাটনার রাজ হোটেলে। বাঙালিদের প্রিয় হোটেল, কেননা মাছটা ভালো
পাওয়া যেত। সেখানেই এসে উঠেছিলেন খ্যাতনামা সাহিত্য-সমালোচক সরোজ বন্দোপাধ্যায় এবং
সাহিত্যিক-সম্পাদক দেবকুমার বসু। সারা দুপুর তাঁদের সাথে থাকা, গল্প করা, ঘুমিয়ে পড়লে
ঠিক চারটেয় উঠিয়ে পাঁচটার মধ্যে, বোধহয় আইএমএ হলের অনুষ্ঠানে নিয়ে যাওয়া আমার কাজ ছিল।
পরের দিন বোধহয় পূর্ণেন্দুদা নিজেই ছিলেন।
অঘোর প্রকাশ শিশু সদনে, মাণিক বন্দোপাধ্যায়কে নিয়ে আলোচনাসভা ছিল।
পূর্ণেন্দুদার পিছু পিছুই পুরোনো ডাকবাংলোর একটা ঘরে
রাত্তিরে গিয়ে কবি শুদ্ধসত্ত্ব বসুর সাথে দেখা করেছিলাম। পরে ২০১২ সালে যখন বিহার বাংলা
আকাডেমির অধ্যক্ষ ডাঃ দিলীপ কুমার সিংহ, সরকার আন্তর্জাতিক সেমিনারের জন্য টাকা দিয়েছে,
বাংলাদেশ থেকে এলেন ঢাকা বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক জনাব শামসুজ্জামান খান এবং সহপরিচালক
জনান আমিনুর রহমান সুলতান, পূর্ণেন্দুদাই তাঁদের সাথে আমার আলাপ করিয়ে দিয়েছেন।
আশির দশকে সত্যি বলতে, আকাডেমির কাজ বাদে বিহার বাঙালি
সমিতিরও সাংগঠনিক কাজগুলো ঝিমিয়ে পড়েছিল। নব্বইয়ের দশকে নতুন উদ্দীপনা আসে গুরুচরণদার
নেতৃত্বে। কর্মাটাঁড় স্টেশনের নামবদল সেই ১৯৭৮এই, বিহার বাঙালি সমিতির চার বছরের লাগাতার
উদ্যোগে ফলপ্রসূ হয়। কংগ্রেস সরকার না করলেও, জনতা পার্টি সরকারের রেলমন্ত্রী মধু দন্ডবতে
স্টেশনটির নতুন নাম ঘোষণা করেন, “বিদ্যাসাগর”। আবার নন্দনকানন থেকেই বিহারে, কেন্দ্রীয় সরকারের
বয়স্ক শিক্ষা অভিযান শুরু হয় – একশোর ওপর কেন্দ্রের
পরিচালনা কেন্দ্র হয় নন্দনকানন। সেসবও ঝিমিয়ে পড়ে আশির দশকে। নব্বইয়ের দশকে সেখানেও
উদ্দীপনা ফিরে আসে। সমিতির নতুন উদ্যোগগুলো, সর্বভারতীয় সংগঠন গড়ে তোলার চেষ্টা, নন্দনকাননে
নতুন ভবন-নির্মাণ, বালিকা-বিদ্যালয়ের পরিচালন, বিদ্যাসাগরের প্রতিমা-স্থাপন … এবং বিশেষ করে সাংগঠনিক বুলেটিন হিসেবে সমিতির মুখপত্র
‘সঞ্চিতা’র
নবকলেবরে প্রকাশন, আনুসঙ্গিক আরো কিছু প্রকাশন, সব কাজে পূর্ণেন্দুদা গুরুত্বপূর্ণ
ভূমিকায় কাজ করেছেন।
নতুন শতক শুরু হতেই বিহার আর ঝাড়খন্ডে বিভাজন সম্পন্ন
হয়। সে সময় সমিতির কাজ আবার ঝিমিয়ে পড়েছিল, যদিও ডঃ দিলীপ সেন, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়
প্রভৃতি তদানিন্তন নেতৃবৃন্দের কর্মশীলতায় প্রদীপটা নিভে যায়নি। কিন্তু বিভাজনের ধাক্কায়
একেবারেই মুহ্যমান হয়ে পড়ে। ২০০৬ সালে হাল ধরেন ডাঃ দিলীপ কুমার সিংহ। ভিন্ন সময়ের
ভিন্ন ধরণে, কাজের গতি ফিরিয়ে আনেন তিনি। চমকপ্রদ ছিল সেই গতি ফেরানো। অনেকগুলো মাত্রা
ছিল তার। এ সময়টায় গুরুচরণদা স্ত্রীর মৃত্যুর পর বার বার চলে যেতে থাকেন ছেলের কাছে
ব্যাঙ্গালোরে এবং মেয়ের কাছে, আনন্দ, গুজরাটে। অন্যদিকে পূর্ণেন্দুদার সাথে আমি অনেকটা
ইনভল্ভড হই বাঙালি সমিতির কাজে। অনেক লড়াই করে বাংলা পাঠ্যপুস্তক প্রকাশন আবার শুরু
করা হয়। গাইডেন্স দেওয়ার জন্য গুরুচরণদাকে পাওয়া যায় না। গাইড হন পূর্ণেন্দু নারায়ণ
মুখোপাধ্যায় এবং পুরোনো অভিজ্ঞতা নিয়ে সঙ্গ দেন বীথিকা সরকার। পূর্ণেন্দুদার সাহিত্যিক
প্রবন্ধ লেখার গতিও বাড়ে। সমিতির মুখপত্র ‘সঞ্চিতা’র প্রকাশন শুরু হয়। নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকেই নতুন
সাহিত্য পত্রিকা বার করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। প্রস্তাব আমিই দিয়েছিলাম, কিন্তু ভরসা
থাকেন পূর্ণেন্দুদা। প্রথমে
“বীজপত্র” প্রকাশিত হয় কয়েকটি সংখ্যা। সে সময়কার সাহিত্যগোষ্ঠিতে
মধ্যমণি হয়ে ওঠেন কবি বিশ্বজিত সেন, সঙ্গে থাকেন কুমার রাণা (তখন পাটনায় ছিলেন) এবং
রাণা ব্যানার্জি (কিছুদিন পর অপঘাতে মৃত্যু হয়)। ঠিক যে কারণে লিটল ম্যাগাজিন বন্ধ
হয়, “বীজপত্র”ও
সে কারণেই বন্ধ হয়। শুরু হয় “ঈক্ষণ”। তাও বন্দ হয়। অবশেষে শুরু হয় “প্রতর্ক”।
স্রেফ পূর্ণেন্দুদা এবং আমার উদ্যোগে। তাও প্রকাশ হয় মাত্র দুটি সংখ্যা। তৃতীয় সংখ্যার
কাজ মাঝপথে বন্ধ হয়ে যায়।
মোটামুটি এ সময়েই পূর্ণেন্দুদার দ্বিতীয় কবিতার বইটা
প্রকাশিত হয়। তার নামটাও মনে নেই আর কপিটাও আপাততঃ হাতের কাছে নেই।
নতুন শতকের দ্বিতীয় দশক শুরু হওয়ার কয়েক বছরের মধ্যেই
দেখলাম পূর্ণেন্দুদা আর পাটনায় থাকতে পারছেন না নিয়মিত। প্রধানতঃ চিকিৎসাজনিত এবং পারিবারিক
নানা কারণে উনি কলকাতা, পুনা, আসানসোল বা ধানবাদে গিয়ে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। তা সত্ত্বেও,
যখনি পাটনায় এসেছেন, দৃষ্টির অক্ষমতা সত্ত্বেও সমিতি ও আকাডেমির বিভিন্ন ধরণের আয়োজনে
থেকেছেন, কাজে লেগেছেন এবং সদুপদেশ দিয়েছেন। শেষের কয়েক বছর আর পাটনায় আসেননি বলতে
গেলে, একমাত্র নভেম্বরে, ব্যাঙ্কে লাইফ সার্টিফিকেট দেওয়ার সময়টুকু বাদে। এখানে আরেকটা
কথা বলে দিই যে ওনার ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে অনেকে ডক্টরেট করে থাকলেও উনি নিজে কিন্তু
আর ডক্টরেট করেননি। কারণটা আগেই বলেছি; যে কারণে এমএ তে সেকেন্ড ক্লাস পেয়েছিলেন। খবর পেতাম যে কলকাতায় বা আসানসোলে বা পুনায় বসে
লেখালিখির কাজ করে যাচ্ছেন। আমার সাথে যোগসূত্রটা প্রধানতঃ হিন্দি অনুবাদে রইল। সে
ধারায় শেষ কাজ ছিল ব্রজকিশোর স্মারক প্রতিষ্ঠানের দু’খন্ডে
বিহারের গৌরবগাথা। প্রথম খন্ডে ব্রিটিশ যুগে বিহারের বাঙালিদের বৈপ্লবিক কর্মকান্ড
নিয়ে লেখা এবং দ্বিতীয় খন্ডে বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় এবং অনুরূপা দেবীকে নিয়ে লেখা
প্রবন্ধগুলো হিন্দিতে অনুবাদ করে দিয়েছিলাম। তার আগে করেছিলাম ‘রবীন্দ্রনৃত্য’ নিয়ে
ওনার লেখা প্রবন্ধটা। আর এসবেরই মাঝখানে যখন ধানবাদে রায়বাবু মারা গেলেন, ওনাকে দিয়ে
একটা অবিচুয়ারি জোর করে লিখিয়ে, ইংরেজি করে বিহার হেরাল্ডে ছাপলাম। তার জন্য হিন্দি
খবরের কাগজ ‘প্রভাত খবর’এর
সেদিনকার ধানবাদ এডিশন পুরোটা পিডিএফে ওনাকে মেল করলাম।
২০১৯র সেপ্টেম্বর মাসে ওনার সাথে দেখা হয়েছিল এশিয়াটিক
সোসাইটির হলে। ‘অজানা বিদ্যাসাগর’এর
আবরণ উন্মোচনে। তখনই বলে রেখেছিলাম পাটনা এলে নিজের প্রকাশিত, অপ্রকাশিত প্রবন্ধগুলোর
কপি এক জায়গায় করে রাখবেন। নিয়ে নেব। বই করে ছাপব। প্রকাশিত যে কটা হাতের কাছে ছিল,
দিয়েছিলেন। অপ্রকাশিতগুলো দেন নি। কেননা উনিও ভাবেন নি আর আমিও ভাবিনি যে সেটাই আমাদের
শেষ দেখার সপ্তাহ। পত্রিকাগুলো স্ক্যান করে ওনাকে ফেরত দিয়ে এসেছিলাম। চার হাজার টাকাও
দিয়েছিলেন। ‘প্রতর্কে’রও
চার হাজার বাকি ছিল। সব মিলিয়ে আট হাজার টাকা আমার কাছেই রয়ে গেল। আমি ব্যাঙ্গালোরে
গিয়ে পড়ে রইলাম। কোরোনায় আর লকডাউনে আশীষের প্রেসও বন্ধ রইল।
আশায় আশায় ছিলাম যে লকডাউন শেষ হতেই কলকাতায় গিয়ে ওনার ফ্ল্যাটে একদিন থাকব। কোনোভাবেই মাথায় আসেনি যে বয়স হচ্ছে, উনি চলে যেতে পারেন।