সংস্কৃত ও হিন্দু শাস্ত্রের
প্রখরতম বিদ্রোহী পন্ডিত, প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের মিলনে নতুন বিদ্যালয়ী পাঠ্যক্রম উদ্ভাবক,
স্নেহময় শিক্ষক, আধুনিক শিক্ষাবিজ্ঞান অনুসারে পাঠ্যপুস্তকের রচয়িতা, সরকারী
কাজ হিসেবে একশোর বেশি বালক-বিদ্যালয় এবং চল্লিশের বেশি বালিকা-বিদ্যালয়ের সংস্থাপক,
ব্যক্তিগত উদ্যোগে নিজ পৈত্রিক গ্রামে ও পরে কর্মাটাঁড়ে গণশিক্ষা ও প্রৌঢ়শিক্ষার
ব্যবস্থায় অগ্রণী, ভারতীয় ব্যবস্থাপনায় প্রথম কলেজের নির্মাতা, বাংলা বর্ণমালার সংস্কারসাধক
ও বাংলা গদ্যকে সাহিত্যের গঠন-সৌকর্য প্রদায়ক...
আর কী বলা যায়?
বর্ণহিন্দু সমুদায়ে বিধবাবিবাহ
প্রচলন, বহুবিবাহ ও বাল্যবিবাহের বিরোধ ধরে কাজ গোনালে উনিশ শতকে নারী ক্ষমতায়নে
এবং নারীমুক্তির প্রশ্নকে পুরো সমাজের মুক্তি হিসেবে দেখা শেখানোয় এই মানুষটির
অবদান কম করা হয়।
জনকল্যাণে করূণাময় ও দয়াময় ব্যক্তিত্বটা
তো কিম্বদন্তি।
তার ওপর আবার ব্যবসায় উদ্যমী?
মানে ওই সংস্কৃত প্রেসের ব্যাপারটা? ওটায় আলাদা করে বলার আবার কী আছে?
হয়তো আছে! কিছুটা!
দেখা যাক! বাঙালির অপবাদ আছে যে তারা ব্যবসায় বিমুখ। যদিও শুধু ব্যবসাদার বা
বাণিজ্যে সফল বাঙালি নয়, প্রকৃত অর্থে উদ্যমী, অন্ত্রেপ্রেনিওর এবং বিশেষ করে
নবজাগরণী-ইয়োরোপের অর্থে উদ্ভাবক-আবিষ্কারক-ব্যবসায়ী বাঙালিও আছেন। দিব্যি বলতে
পারি, তোমাদের মুক্ত দেশে টমাস আলভা এডিসন আছেন তো আমাদের পরাধীন দেশেও আচার্য প্রফুল্ল
চন্দ্র রায় আছেন!
তবুও
অপবাদটা আছে কেননা ঔপনবেশিক শিক্ষাদীক্ষা এবং ভীতু মধ্যবিত্ত আবহাওয়ায় আমাদের মধ্যের
একটা বড় অংশ ঝুঁকির কাজে বাঁচার আনন্দ পেতে ভুলে গিয়েছিলাম। বস্তুতঃ, এখনও
দোনামনায় থাকি। আর সরকারী, বেসরকারী, সওদাগরী দপ্তরে কলম চালানোর চাকরীতে বাঙালিদেরই
বোলবালা ছিল, প্রতিস্পর্ধী ছিল কম।
আরেকটাও
কথা আছে। ব্যবসা করে সংসার চালানো বাঙালি তখনও নগণ্য ছিল না, এখন তো নয়ই। কিন্তু
আমাদের মানসে আদর্শ, ‘নায়কীয়’, বা ‘ভালোমানুষ’ জীবন-যাপনের যে ছবি এক কালে সাহিত্য এঁকে
দিয়েছে ও পরবর্তী কালে থিয়েটার ও সিনেমা যে ছবিকে পোক্ত করেছে সেটা ব্যবসায়ীর নয়,
উদ্যমীর তো নয়ই।
১৮৪৭ সালের
এপ্রিলে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজে তাঁর প্রথম বারের চাকরী থেকে ইস্তফা
দিলেন। কারণ, কর্তৃপক্ষের সাথে মতের অমিল। সেই সময়, বোধহয় যখন মতের অমিলটা মাথাচাড়া
দিচ্ছে আর বিদ্যাসাগর বুঝতে পারছেন যে চাকরীটা ছাড়তে হতে পারে, তিনি অগ্রজপ্রতিম
বন্ধু (বয়সে তিন বছর বড়) মদনমোহন তর্কালঙ্কারের সাথে অংশিদারীতে একটা ছাপাখানা
বসালেন। নাম রাখা হল সংস্কৃত প্রেস। প্রেসের জন্য ৬০০ টাকা ধার করতে হয়েছিল। সে ধার
কেমন করে শোধ হল সে গল্প ইন্দ্র মিত্র রচিত ‘করূণাসাগর বিদ্যাসাগর’ বইটিতে আছে। আশা করি সবাই অল্পবিস্তর জানেন। কাজটার মধ্যে আমরা সাধারণ বাঙালি মানসিকতায় হয়ত একটি
কাব্য-ঐতিহ্যবাহী দুষ্প্রাপ্য পূঁথির পান্ডুলিপি খুঁজে ছাপানোর কাজের ‘আবিষ্কারক’ বা বুদ্ধিগত
দিকটাই বেশি দেখি, কিন্তু এটা যে কারবারী উদ্ভাবক-উদ্যমীরও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য,
সেটা হয়ত নোট করিনা। আবার, অনেক বিদ্যাসাগর-বিরোধীর লেখায় দেখেছি যে তাঁরা
বিদ্যাসাগরের, বিভিন্ন সময়ে ইংরেজ সরকারের কাছে তদ্বির করে, আপস-মীমাংসার মাধ্যমে কাজ
করানোর প্রচেষ্টাকে যেমন হেয় দৃষ্টিতে দেখেন (যুক্তি-অসংগত ভাবে), তেমনই
বিদ্যাসাগরের এই ব্যবসায়িক চাতুর্যকেও হেয় দৃষ্টিতে দেখেন। তাঁদের কাছে এই চাতুর্য
আর বিদ্যাসাগরের সেই বিখ্যাত কথন ‘ঠকানোর চাইতে ঠকা ভালো’, অসংগতি
বা অসামঞ্জস্য মনে হয়।
এটা ঠিক যে ব্যবসার উচ্চাকাঙ্খা বাড়তে শুরু করলে শেষে ওই অসংগতিটা
এসে পড়তে পারে কেননা বাজারের নিয়ম ঘাড়ে চেপে বসে। এমন মানুষও আছেন যাঁরা ব্যবসার জগতে
টিঁকে থাকার দায়ে, ‘ঠকানো’ বা বিভিন্ন ধরণের দুর্নীতি, যদি
নিজে নাও শুরু করে থাকেন, অন্ততঃ কাজেকারবারে, লেন-দেনে, সরকারি বিভাগে কাজ করানোর
ক্ষেত্রে মেনে নিয়েছেন; আবার এমন মানুষও আছেন যাঁরা ব্যবসা করাই ছেড়ে দিয়েছেন।
কিন্তু লক্ষ লক্ষ সাধারণ কারবারী আছেন (বাঙালিও) যাঁরা ঐ উচ্চাকাঙ্খার দুর্নীত হাতছানিটা
এড়িয়ে থাকাটাকে নিজের নৈতিক সফলতা মনে করছেন, এবং হয়ত বেশ টানাটানির মধ্যেই ঘরসংসার
চালাচ্ছেন। বিদ্যাসাগরের ব্যবসায় (এবং অপ্রতিযোগী সময়ে) সেটা বরং সহজতর ছিল, তাই
টানাটানির বৃত্তে না থেকে তিনি বেশ সচ্ছল ব্যবসায়ী হয়ে উঠেছিলেন। নিজের ওপর তো তাঁর
এক পয়সাও খরচ ছিল না। সম্বল তো ওই খাটো ধুতি, চটি আর উড়ুনি। তাই দানবীরের হৃদয়টা
দরকার পড়লেই ব্যবসা থেকে হওয়া আয়ে হাত ঢুকিয়ে দিতে পারত।
তবে এ কথাটাও মনে গেঁথে নেওয়া দরকার যে বিদ্যাসাগর ব্যবসা
এবং ভালোরকম ভাবে লাভের ব্যবসা করতে চেয়ে থাকলেও তাঁর উচ্চাকাংখা কিন্তু ব্যবসায়ীর
উচ্চাকাঙ্খা ছিল না। বিলাসিতা তাঁর ছিল না, খুব বেশি বিলাসিতা উচ্চাকাঙ্খী উদ্যমী ব্যবসায়ীরও
থাকে না। কিন্তু উদ্যমী ব্যবসায়ী ব্যবসাটাকে বাড়ায়। আরেকটা ইউনিট খোলে, অন্য কারবারে
টাকা লগ্নী করে। বিদ্যাসাগরও চাইলে পারতেন। করেন নি কারণ তাঁর ব্যবসায়িক উদ্যমের
একটাই উদ্দেশ্য ছিল – যে নতুন বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষা পদ্ধতি তাঁর পরিকল্পনা, যে পদ্ধতিকে কার্যকরী
করতে নতুন পাঠ্যক্রম নির্মাণ করেছেন এবং সেই পাঠ্যক্রমের উপযোগী পাঠ্যপুস্তক রচনা
করে ও করিয়ে চলার কথা ভাবছেন তা যেন কোনোভাবেই ব্যহত না হয়; কারো দাক্ষিণ্যের বা
কারো শংসাপত্রের অভাব যেন বাধা না হয়ে দাঁড়ায়।
পাঠ্যপুস্তক তো ছিলই। বললেই তৈরি হয়ে
যেত আরো। ছাপার জায়গাও ছিল। কিন্তু তাতে বিদ্যাসাগরের বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতির প্রভাব
ছিল না এবং বললে তারা মানতও না সে পদ্ধতি। সেভাবে বলতে গেলে তো শিক্ষা, স্ত্রীশিক্ষা
সবই তো চলছিল নবজাগরণের দিগন্তে তাঁর উদয়ের আগে থেকে! ক্যাথলিক পদ্ধতিও ছিল,
হিন্দু পদ্ধতিও ছিল!
কিন্তু বিদ্যাসাগরের সংস্কৃত প্রেস হল তাঁর নতুন শিক্ষা পদ্ধতি
কার্যকরী করার উপযোগী নতুন ধরণের পাঠ্যপুস্তক প্রকাশন-যুদ্ধের প্রধান অস্ত্র। এবং তার
তিন প্রধান সৈনিক হলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মদনমোহন তর্কালঙ্কার এবং অক্ষয়
কুমার দত্ত।
১৯৮১ সালে প্রকাশিত ‘বাংলা মুদ্রণ ও প্রকাশন’ (চিত্তরঞ্জন
বন্দোপাধ্যায় সম্পাদিত) নামে একটি সঙ্কলনে নিখিল সরকার রচিত একটি প্রবন্ধ আছে, ‘আদিযুগের
পাঠ্যপুস্তক’। নিখিল সরকারের ভাষায় এই তিনজন ছিলেন পাঠ্যপুস্তক রচনার
ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং মহেশ্বর!
যাই হোক, ধীরে ধীরে সেই সংস্কৃত প্রেসের – যেহেতু
প্রকাশনার কাজটাও ছিল, তাই মেশিনের পাশের ঘরে একটি পুস্তক-ভাঁড়ার বা ডিপজিটরি খোলার
পর – নামকরণ হল সংস্কৃত প্রেস এন্ড ডিপজিটরি। পরবর্ত্তি কালে এটি
বিপণিও হয়ে দাঁড়িয়েছিল কেননা অন্য স্থানে মুদ্রিত ও প্রকাশিত বইও, বিশেষ করে পাঠ্যপুস্তক,
এই ডিপজিটরিতে রাখা হত।
আশ্চর্যের কথা, এই প্রেসটার, সে সময়কার ঠিকানা কিন্তু
সচরাচর কোথাও পাওয়া যায় না। হয়ত কোনো জীবনীতে আছে, আমি পাইনি। এমন কি, উইকিপিডিয়াতেও,
সংস্কৃত প্রেস এন্ড ডিপজিটরির জন্য একটা পুরো পৃষ্ঠা থাকলেও তাতে ঠিকানার উল্লেখ
নেই। হালে, খুঁজতে খুঁজতে ফেসবুকে গৌতম বসুমল্লিক নামে একজনের পৃষ্ঠায় ৯ই জুন,
২০১১ তারিখের পোস্টে পেলাম। পরে দেখলাম ‘এই সময়’ বাংলা দৈনিকের
পোর্টালে এই সংক্রান্ত একটা খবর গৌতম বসুমল্লিকেরই নাম তথ্যসুত্র হিসেবে উল্লেখ
করেছে। গৌতমবাবুর দেওয়া ঠিকানা – ৬৩, আমহার্স্ট স্ট্রীট। তিনি বলছেন
যে এই বাড়িটিতে বিদ্যাসাগর নিজেও বেশ কিছুদিন ছিলেন।
এই সংস্কৃত প্রেস এন্ড ডিপজিটরিতে দ্বিতীয় বই ছাপা হয়
বিদ্যাসাগরেরই নিজের লেখা ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’। এটা
নিয়ে তাঁকে অনেক যুদ্ধ করতে হয়েছে। কেননা ফোর্ট উইলিয়ামের মার্শাল সাহেব তাঁকে
একটি ভালো বাংলা পাঠ্যবই রচনা করতে বললেও তাঁর এই পান্ডুলিপি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের
কর্তৃপক্ষ মনোনীত করেনি। বিদ্যাসাগর তখন গিয়েছিলেন শ্রীরামপুরে কেরী সাহেবের কাছে।
বাংলা বইয়ের ব্যাপারে কেরী সাহেবের প্রশংসা আর শংসাপত্র কে অস্বীকার করবে! ফোর্টের
কর্তৃপক্ষ অগত্যা পান্ডুলিপি মনোনীত করে। তখন বিদ্যাসাগর একশো কপি ছেপে আনার বরাত
পান তিনশো টাকার করাড়ে। বাকি কপিগুলো বিদ্যাসাগর ও তর্কালঙ্কার মহাশয় বন্ধুবান্ধবদের
মধ্যে উপহার হিসেবে বিতরণ করেন। এতে তাঁদের প্রেসের প্রচারও হয়।
এবার বরং উইকিপিডিয়া থেকেই উদ্ধৃত করি – “১৮৪৯
সালে মদনমোহন তর্কালঙ্কার শিশুদের জন্য ‘শিশুশিক্ষা’ নামে
একটি সচিত্র পুস্তকমালা লিখতে শুরু করেন। [যদিও উল্লেখ নেই কিন্তু বোঝা স্বাভাবিক
যে সে বই সংস্কৃত প্রেসেই ছাপা হতে থাকে – বর্তমান লেখক] এই পুস্তকমালার তৃতীয়
বই ছিল বিদ্যাসাগর রচিত ‘বোধোদয়’ (১৮৫০)।”
১৮৫০ সালে মদনমোহন তর্কালঙ্কার জজ-পন্ডিতের চাকরি পান। সংস্কৃত
কলেজের সাহিত্য-অধ্যাপকের কাজ ছেড়ে মুর্শিদাবাদ চলে যান। বিদ্যাসাগরের জীবনীলেখকেরা
জানাচ্ছেন যে সংস্কৃত প্রেস কিছুদিন একসাথে চালানোর পর মদনমোহন তর্কালঙ্কারের সাথে
বিদ্যাসাগর মহাশয়ের মতান্তর হয়। কী বিষয়ে মতান্তর, তা স্পষ্ট বোঝা যায় না। তবে
জীবনী পড়ে, ভ্রমনিরাস পড়ে এবং নিষ্কৃতিলাভপ্রয়াস পড়ে মনে হয় যে দুজনের চরিত্রগত বৈশিষ্টের
পার্থক্যই ছিল মতান্তরের প্রধান কারণ। বিদ্যাসাগরের মধ্যে উদ্যম ব্যাপারটা এত বেশি
ছিল যে তাঁর প্রধান লক্ষ্য থাকত উদ্দেশ্যসাধনের উৎপাদনী একক (প্রোডাকশন ইউনিট)
হিসেবে প্রেসটার সর্বাঙ্গীন উন্নতি, উৎপাদন-দক্ষতা। পূর্বে উল্লিখিত নিখিল সরকার
নিজের প্রবন্ধে লিখছেন, “শোনা যায় পাঠ্য বইয়ের হরফে এবং যুক্তাক্ষরের লিপিচিত্রে
সমতা আনার জন্য তিনি শ্রীরামপুরের অধর টাইপ ফাউন্ড্রি পর্যন্ত ধাওয়া করেছিলেন!” অন্য
দিকে মদনমোহন তর্কালঙ্কারের দৃষ্টিতে উদ্দেশ্যগত এই দিকটা একেবারেই ছিল বলে মনে হয়না।
তাঁর প্রধান চিন্তা ছিল হিসেবের নিখুঁত সততাটুকু এবং ব্যস, সেইটুকুই। দুইয়ের ঘরে
দুই থাকবে তিনের ঘরে তিন... ; মোট ‘পাঁচ’টা ছয় বা
সাত কী করে হবে এবং কী উদ্দেশ্যে হবে সেসব বিদ্যাসাগরের ভাবনা। বিদ্যাসাগরের মত
একবগগা মানুষের তাই তাঁর সাথে ঠোকাঠুকি লাগতেই পারে এবং তাই লেগেছিল। সামনাসামনি থাকলে
হয়ত মিটে যেত। কলকাতা ও মুর্শিদাবাদের দূরত্ব সেটা হতে দিল না। তর্কালঙ্কার মহাশয়ের
অকালমৃত্যুতে, স্বজনের অর্থলোভ এবং ওকালতি প্যাঁচ ব্যাপারটাকে তেতো করে দিল।
যাই হোক, বন্ধুদের সালিশীতে বিবাদের নিষ্পত্তি হয় এবং তাতে
সংস্কৃত প্রেসের মালিকানা স্বত্ব বিদ্যাসাগরের হয়। বিদ্যাসাগরের মালিকানায় এরপর
উত্তরোত্তর প্রেসের শ্রীবৃদ্ধি হতে থাকে। আবার নিখিল সরকারের ‘আদিযুগের
পাঠ্যপুস্তক’ থেকেই উদ্ধৃতি দিচ্ছি। উনিশ শতকের প্রথমার্ধে পাঠ্যপুস্তক
প্রকাশনে ‘স্কুল বুক সোসাইটির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা জানিয়ে তিনি বলছেন,
“উনিশ শতকের পাঁচের দশকে স্কুল বুক সোসাইটির চেয়ে বেশি
নামডাক সংস্কৃত প্রেসের। একটি বিবরণে দেখছিলাম ১৮৫৭ খ্রীষ্টাব্দে, অর্থাৎ
মহাবিদ্রোহের বছরে সংস্কৃত প্রেস বই প্রকাশ করে ৮৪২০০ খন্ড, অথচ সরকারি অনুদান সত্ত্বেও
স্কুল বুক সোসাইটি সেবছর বই ছাপতে পেরেছিলেন মাত্র ৩২০০০ খন্ড!”
একের পর এক বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষার উপযোগী পাঠ্যপুস্তক ছেপে
চলে সংস্কৃত প্রেস এন্ড ডিপজিটরি এবং তার লাভও বেড়ে চলে। বেশির ভাগ বইয়েরই একাধিক
সংস্করণ এবং একাধিক মুদ্রণের কাহিনী গড়ে ওঠে। কিছু ইতিহাস হয়ে ওঠে। নিখিল সরকার লিখছেনঃ
“বিদ্যাসাগরের
‘বর্ণপরিচয়’এর প্রথম ভাগের প্রকাশ ১৮৫৫ খ্রীষ্টাব্দে।
দ্বিতীয় ভাগও একই বছরে। ১৮৯০ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে ‘শিশুশিক্ষা’র প্রথম ভাগের
১৪৯টি সংস্করণ হয়। (প্রথমে বইটির দাম ছিল ৴৬ পাই, পরে কমিয়ে ৴৹ আনা করা হয়।) ১৮৮৯
পর্যন্ত দ্বিতীয় ভাগের সংস্করণ হয় ৮৪টি। (এরও দাম ছিল প্রথমে ৴৬ পাই, পরে ৴৹ আনা।)
১৮৯০ পর্যন্ত ‘শিশুশিক্ষা’র তৃতীয় ভাগের সংস্করণ হয় ১০১টি।
দাম ৴৬ পাই। অন্যদিকে প্রথম প্রকাশের পর ১৮৯০ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত ‘বর্ণপরিচয়’ প্রথম ভাগের
সংস্করণ হয় ১৫২টি। (১৮৫৫-৫৭ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে ৯টি সংস্করণে ৫৩ হাজার কপি বই
প্রচারিত হয়েছিল।) প্রকাশের সময় প্রথম ভাগের দাম ছিল ৯ পাই, পরে বাড়িয়ে ৴৹ আনা করা
হয়। ১৮৯০ পর্যন্ত ‘বর্ণপরিচয়’এর দ্বিতীয় ভাগের সংস্করণ হয়
১৪০টি। দ্বিতীয় ভাগের দাম ছিল প্রথমে ৯ পাই, পরে বাড়িয়ে ৴৩ পাই করা হয়। ‘শিশুশিক্ষা’ তৃতীয় ভাগ
বা ‘বোধোদয়’এর জনপ্রিয়তাও দেখবার মত। বইটির
প্রথম প্রকাশ ১৮৫১ খ্রীষ্টাব্দে। ১৮৯০এর মধ্যে ছাপা হয় ১০৬টি সংস্করণ। ‘বোধোদয়’এর দাম ছিল
৵৹। বিদ্যাসাগরের আর একটি বই ‘কথামালা’র প্রথম
প্রকাশ ১৮৫৬ খ্রীষ্টাব্দে। ১৮৯০এ তার সংস্করণ হয় ৫১টি।”
এই ইতিহাসটাই বলে দিচ্ছে যে ব্যবসায়িক উদ্যমের ঝুঁকি নিয়ে
বিদ্যাসাগর কিভাবে সফলতার পথে এগিয়েছিলেন এবং তারই সাথে, নিজের প্রধান লক্ষ্য – নতুন বিজ্ঞানসম্মত
প্রাথমিক শিক্ষার জোয়ার সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন।
সুবল চন্দ্র মিত্র রচিত ইংরেজি ভাষায় বিদ্যাসাগরের জীবনী ‘ঈশ্বরচন্দ্র
বিদ্যাসাগর, এ স্টোরি অফ হিজ লাইফ অ্যান্ড ওয়র্ক’। তাতে তিনি
বলছেন যে সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর তাঁর আয়ের প্রধান স্রোত হয়ে ওঠে এই
প্রেস আর ডিপজিটরি। বেশ কয়েকজন লোক এই সংস্থাটিতে কর্মরত ছিল, কাজ্জেই তাদেরও
রুজিরুটির যোগান দিত এই প্রেসের চাকরি। কিন্তু প্রেসের ব্যাপারে মন দেওয়ার সময়
পেয়ে যখন তিনি প্রেসের কাজকর্মের ধরণ দেখলেন, তিনি অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হলেন, বিশেষ
করে মুখ্য আধিকারিকের দায়িত্বে যিনি ছিলেন তাঁর চলনে। হিসাব ঠিক মত রাখা হচ্ছিল
না। সব কিছু অগোছালো হয়ে ছিল। তাই প্রেসের কাজটা দেখাশোনা করার জন্য বন্ধু রাজকৃষ্ণ
বন্দোপাধ্যায়কে অনুরোধ করলেন। রাজকৃষ্ণবাবু সে সময় ৮০ টাকা মাইনেতে ফোর্ট উইলিয়াম
কলেজে হেড অ্যাসিস্ট্যান্ট ছিলেন। ছয় মাসের ছুটি নিয়ে তিনি সংস্কৃত প্রেসের কাজকর্ম
দেখতে শুরু করলেন। রাজকৃষ্ণের দক্ষ প্রশাসনে ছয় মাসে প্রেসের ভোল পাল্টে গেল। বিদ্যাসাগরের
পিতৃদেব এত খুশী হলেন যে তিনি রাজকৃষ্ণকে ফোর্ট উইলিয়ামের চাকরি ছেড়ে স্থায়ী ভাবে
সংস্কৃত প্রেস ও ডিপজিটরির দায়িত্ব নিতে বললেন। বিদ্যাসাগরও তাঁর কথায় সায় দিলেন। ফলে,
১৫০ টাকা মাইনেতে রাজকৃষ্ণ বন্দোপাধ্যায় সংস্কৃত প্রেস অ্যান্ড ডিপজিটরির ম্যানেজার
নিযুক্ত হলেন। সুবলবাবুর শব্দে খুব শীগগিরই সংস্থাটি ‘প্রস্পেরাস’ এবং ‘প্রফিটেবল’ ব্যবসা
হয়ে দাঁড়াল।
যদিও শেষ অব্দি এই ব্যবসা আর বিদ্যাসাগরের বা তাঁর পরিবারের
হাতে থাকেনি, তবে সেটা এ কারণে নয় যে উদ্যমী উৎসাহের বা ব্যবসায়িক চাতুর্যের অভাবে
সংস্থাটি লোকসানের ব্যবসায় পরিণত হয়ে পড়েছিল। কারণটা বিদ্যাসাগরী – কিম্বদন্তি
দানশীলতা।
________________________________