Monday, June 27, 2016

মাখন

দুপাশের ক্ষেত থেকে উপসাগরীয় সন্ধ্যার ধূসর অন্ধকার উঠে আসছে রাস্তায়।
সারাদিন সাইকেল চালিয়েছি নোনা গরম হাওয়ার বিপরীতে। চট্‌চট্‌ করছে চোখমুখ। অবশ্য এখন আর সে তাত নেই। আরাম দিচ্ছে একটা ভেজা ঠান্ডা ভাব। গায়ের জামাটা খুলে জড়িয়ে রেখেছি হ্যান্ডেলে।  
          পকেটের অবস্থা বুঝে দুপুরে কিছু খাই নি, আখ চুষেছি। মানে, সকালের জলখাবারটা ভালোই হয়েছিল। দুপুর নাগাদ পৌঁছই একটা মেঠো গুড়ের ভাটিতে। গিয়ে আখ চাইতে একজন ইশারায় জানালো, ‘এখানে নয়, মহাজন টের পেয়ে যাবে, ওই গরুর গাড়ীটার কাছে যাও’। সেই গরুর গাড়ীর চালকই আখ দিয়েছিল এক আঁটি। তাও ভালো করে কেটে, পাতার দড়ি দিয়ে বেঁধে।

          এই মহাজন-মালিক-ধনিক বা বলা যায় তাদের ‘পুঙ্গব’ নামক বস্তুটিকে কয়েকদিন আগেই অন্ধ্রের, বোধহয় রাজামুন্দ্রির পরেই কোনো একটা গ্রামে দেখেছিলাম। গরম দুপুর। হাইওয়ে থেকে একটু নেমে একটা বন্ধ চায়ের দোকানের পাশ দিয়ে এগিয়ে একটা মাটির রাস্তা চলে গেছে। দুপাশে বিহারেরই মত বেহায়ার বেড়া, দুস্থ কুঁড়েঘর। শেষপ্রান্তে বাঁদিকে হঠাৎ দেখি একটা বড় পেয়ারা বাগান। থোকা থোকা পেয়ারা ফলে আছে, পাকা, ফিকেসবুজ, হলুদ। একটা ছিমছাম ঘর ঢোকার মুখে। কুঁড়েই বলা যেতে পারে কিন্তু পরিচ্ছন্ন সুদৃশ্যতা আর উচ্চতায় তফাৎটা স্পষ্ট। আমরা দরজায় ধাক্কা দিতে একটি সুন্দর যুবক হাতে বই নিয়ে বেরিয়ে এল। দেখতে আমাদেরই মত শহুরে। ভরসা হল। পাটনা-বিহার থেকে আসছি, কলেজের ছাত্র, কন্যাকুমারী যাচ্ছি, সাইকেল ট্যুর, গুড স্পোর্ট ইত্যাদি বলে ক’টা পেয়ারা চাইলাম।… দূর দূর করে ভাগিয়ে দিল বলতে গেলে! গালাগাল দিতে দিতে গ্রাম থেকে বেরিয়ে আসছি। কয়েকজন বয়ষ্কা, অল্পবয়ষ্কা মেয়েলোক কাঁখে ভরা কলসি নিয়ে হাইওয়ে থেকে নামছে – খাওয়ার জল নিয়ে আসছে কোথাও থেকে - আমাদের পথ আটকাল। জানি না কী বুঝল আমাদের কথা। চায়ের দোকানটায় গিয়ে ভিতরে ঢুকে দোকানির ঘুম ভাঙাল, উনুনে আঁচ জাগাতে বলল, চা খাওয়াল আমাদের, নিজেদের মধ্যে চাঁদা করে দাম মেটাল, তারপর ছাড়ল। ‘পুঙ্গব’ শব্দটার অর্থ বুঝলাম সেদিন।

          সত্তর মাইল আজ সাইকেল চালানো হয়ে গেছে। দশ মাইল দূরে বিরালিমালাই। সেখানেই রাতে বিশ্রাম নেব।
          আকাশে তারা ফুটছে দুটো একটা করে। দিগন্তের দিকে এক চাপ ভেজা ভেজা মেঘ। “কত তারিখ রে আজ?” বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলাম।
          “থার্ড মার্চ নাইন্টিন সিক্সটিনাইন”, দাঁত চেপে বলা উত্তর পেলাম।
-      খিদের চোটে ক্ষেপে গেছিস? ওই দিনে তো আমরা পাটনা থেকে রওনা দিয়েছিলাম!
-      ক্যালেন্ডার গলায় ঝুলিয়ে তো আর রওনা দিই নি!
-      ডাইরিটা কোথায়?
-      তোর ব্যাগেই তো আছে! খুলে দেখ! পেট জ্বলছে, উনি এখন বার তিথির হিসেব করবেন পাঁজি খুলে।
-      আরে দূর! মোটামুটি কতদিনে পৌঁছব কন্যাকুমারী তার হিসেব কষছি।
-      বেঁচে থাকলে ঠিকই পৌঁছে যাব।
-      বাঁচবি, বাঁচবি!
-      তোর ওপাশের মালটিকে জিজ্ঞেস কর না, কিছু আছে কিনা ওর দুধের ড্রামে, বেঁধেছেঁধে রাখা। শহর থেকে ফিরছে, কিছু না নিয়ে কি আর ফিরবে? এই…চানাচুর-মানাচুর, কী যেন বলে – বোন্ডা…

ছেলেটি আমাদের সাথে কুড়ি মাইল ধরে আসছে। রোগা ছিপ্‌ছিপে চেহারা। মুখটা লম্বাটে, কচি। আমাদের থেকে দু’তিন বছর ছোটো হবে বয়সে। চুল কোঁকড়া, দ্রাবিড় ধাঁচের একটু চাপা থুতনি। গায়ের রঙ কফি। চোখ কালো। আমাদের সাথে দেখা হওয়ার পর থেকে তাতে বিষ্ময়ের রঙ লেগে আছে। গায়ে আধময়লা গেঞ্জি আর স্থানীয় ধরণে দুপাট করে পরা লুঙ্গি। সাইকেলের পিছনে ক্যারিয়ারে বাঁধা একটা বড় দুধের ড্রাম – খালি বলে রাস্তার এবড়ো খেবড়ো জায়গাগুলোয় ঢুমঢুম আওয়াজ করছে।
এতক্ষণ হয়ে গেল, তবু খুব কম কথা হয়েছে আমাদের মাঝে। অথবা বলা যায়, অনেক হয়েছে, হয়েই চলেছে, কিন্তু বুঝেছি খুব কম। ছেলেটি হিন্দি জানে না। ইংরেজী জানার প্রশ্নও ওঠে না। আর আমাদের এক বর্ণ তামিল বোঝার কোনো প্রয়োজন হয় নি কখনো। আমার বন্ধুটি আবার বদমায়েসি করে মাঝে মধ্যে বাংলাও ঝাড়ছে।
          যে কটি কথা বুঝতে পেরেছি তা এইঃ ছেলেটি সামনের এক গ্রামের বাসিন্দা। এক ধনিকের বাড়িতে কাজ করে। নানান কাজের মধ্যে এটাও তার একটা কাজ যে সকালে যা দুধ হয় ধনিকের বাথানে, তার এক অংশ বাইশ মাইল দুরের শহরটির কিছু হোটেলে সে যোগান দিয়ে আসে। যাওয়া আসাটা সাইকেলেই করে। সন্ধ্যায় ফিরে এসে মালিককে বিক্রি বুঝিয়ে দেয়। সে কি বন্ডেড লেবার ছিল? – তখন শব্দটা জানতাম না, তাই জিজ্ঞেস করি নি।
         
          এবার সে থামল। বাঁ দিকে দেখাল আঙ্গুল দিয়ে। ক্ষেতের পর ক্ষেত – অন্ধকারে আভাস পাওয়া যায় – কোথাও খাড়া ফসল, কোথাও কাটা হয়ে গেছে আর দূরে টিমটিম করছে কয়েকটি আলো।
          দুমাস পর আমরা যখন বাড়ি ফিরেছিলাম, মা আমায় প্রশ্ন করেছিল, “এত দূরে দূরে ঘুরে এলি, মাঝে মধ্যে একেকটা চিঠি লিখলে কী হত? কত দুশ্চিন্তায় থাকতাম আমরা সবাই”। আমি নিজের আলস্য ঢাকতে আর মাকে একটু রাগাতে জবাব দিয়েছিলাম, “কী করব! পয়সাই ছিল না। একটা পোস্টকার্ডের যা দাম, তা দিয়ে দুটো ইডলি হয়ে যেত সকালের জলখাবারে”। কথাটা সত্যি হলেও বলার কোনো প্রয়োজন ছিল না। মা কিছু বলে নি, শুধু ছোট্টো একটা নিঃশ্বাস ফেলেছিল।…
          ছেলেটি বোঝাল ওটাই তার গাঁ। তারপর আমাদের দিকে ফিরে তাকিয়ে সসঙ্কোচে কিছু বলল। অন্ধকারে তার মুখটাও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল না। তাই কিছুই বুঝলাম না তার কথা।
          আরো দু’একবার বলতে আকারে ইঙ্গিতে বুঝতে পারলাম। বলতে চাইছে যে সে আমাদের কিছু দিতে চায়। এত দূরের যাত্রায় বেরিয়েছি ঘর-পরিবার ছেড়ে! সে তো কোনোদিন এভাবে দেশটাকে ঘুরে দেখার কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারবে না। নাহয় আমাদের কিছু দিতে পারার সুখটা তার থাকবে! কিন্তু!…
          আমরা দুজনেই সমস্বরে না না করে উঠলাম। আমার বন্ধুটি মুখে বদ। না’এর মাঝেই আস্তে করে বাংলায় ফুট কাটলো, “সব পয়সা দিতে হবে না, আদ্ধেক দিলেই চলবে।”
-      কী বললি?
বলে, তাকিয়ে দেখি বন্ধুটি দূরে আকাশে তাকিয়ে বলছে, “কী ন্যাচারাল সিনারি মাইরি!
আমি ছেলেটিকে জোরগলায় বললাম, “তোমায় কিচ্ছু দিতে হবে না। বরং খুব ইচ্ছে হয় তো বিড়ি খাইয়ে দাও।“ কোঁচড়ের দিকে দেখিয়ে ফের ঠোঁটে দুআঙুল ছুঁইয়ে ইশারা করলাম, “আছে বিড়ি?”
ছেলেটি কিছুই শুনতে পেল বলে মনে হল না। তখনো আমাদের ইশারায় বুঝিয়ে বুঝিয়ে, বলে বলে চিন্তা করছে – ‘পয়সা তার নয়। দুধের মাপে হিসেব করা আছে মালিককে দিতে হবে।… সাইকেলের পাংকচার ঠিক করার নামে… হবে না।…’। একটা ছোটো নিঃশ্বাস ফেলে মাথাটা নুয়ে পড়ল তার।

দূরের ওই টিমটিম আলো কয়েকটি আরো স্পষ্ট হচ্ছিল সামনের ক্ষেতগুলোয় অন্ধকার ছড়িয়ে পড়াতে।
হঠাৎ অন্ধকারে হেসে উঠল সে। কিছু একটা খুঁজে পাওয়ার আনন্দে। দুধের ড্রামটা খুলে ভিতরে হাত ঢোকাল। কাচিয়ে কাচিয়ে কিছু তুলতে লাগল ঢাকনাটায়। প্রথমে বুঝতে পারিনি। কাছে গিয়ে দেখি মাখন। অতটা দুধ নিয়ে গিয়েছিল শহরে, বাইশ মাইল নাড়াচাড়াতেই বেশ খানিকটা মাখন বেরিয়ে লেগে রয়ে গিয়েছিল ড্রামের গায়ে।
-      দেখে নে! দেখে নে! মালিক এ জিনিষটার হিসেব নেয় না। শালা নিজে খায় রোজ।
-      নিজে খায়, না মালিকের ছোটো নাতিটাকে খাওয়ায়, তুই জানলি কিভাবে?
-      তাহলে কী বলবে আজ মালিককে?
-      তা আমি কী জানি! হয়ত বকুনি খাবে! মার খাবে! আরো অনেক মার-বকুনির সাথে এটাও শামিল হবে!
-      বাব্বা! ফিলসফি!…

আধঢাকনি মত হল। আমাদের দিকে এগিয়ে দিয়ে ইশারা করল খেয়ে নিতে। আবার ইশারাতেই, চিনি ছড়িয়ে দিতে না পারার আক্ষেপটাও বোঝাল।
-      এঃ, চিনি ছাড়া কাঁচা মাখন! খেয়েছিস কখনো?
-      আমি কোত্থেকে খাব! তোর তো তবু, বলেছিস গ্রামে আসাযাওয়া আছে।
-      হ্যাঁ, হ্যাঁ! গ্রামে আমাদের ভরা গোয়াল, দশটা দুধেল গাই…
-      চুপচাপ খা!

মাখনটুকু খাওয়া হতে, ঢাকনিটা নিয়ে যথাস্থানে লাগিয়ে ছেলেটি এবার কোঁচড় থেকে তিনটে বিড়ি বার করল। বিড়ি ধরিয়ে, কয়েক ফুঁক একসাথে টেনে, শেষে আমরা বিদায় নিলাম।
চুপচাপ এগিয়ে যাচ্ছিলাম। একবার পিছন ফিরে তাকাতে দেখলাম ছেলেটি আলের পথে কিছুটা এগিয়ে, আমাদের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বিড়ির লাল বিন্দুটা তার ঠোঁটের কাছে একবার দীপ্ত হয়ে উঠল।